একা একা – ১২

১২.

ট্যাক্সিটা এসে থামল নীচে। রিনি কান পেতে ছিল। দুপুরটা অনেক আগুন ঢেলে এখন ঝিমোতে শুরু করেছে। ঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল রিনি।

সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ আসছে। শেষে রিনি তিন জনকেই দেখতে পেল; মামা, মা, তনু।

মামার সমস্ত মুখ কালো, থমথমে। মার চুল আলুথালু, একেবারে শুকনো কালি হয়ে যাওয়া মুখ। তনুর মুখ যেন রোদে পুড়ে কেমন হয়ে গেছে, শুকনো পাতার মতন, চোখ প্রায় বুজে আছেই, কপালটা লালচে, রুক্ষ একমাথা চুল পুড়ে যেন ছাই ছাই রং ধরেছে।

শরদিন্দু বারান্দায় দাঁড়ালেন একটু। নীহার তনুর হাত ধরে শরদিন্দুকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এলেন।

শরদিন্দু বললেন, কলকাতায় আমি আর থাকব না নীহার। আমার ছেলে যদি অন্ধ হয়ে যায় যাক, তবু আর কলকাতায় নয়। জীবনটা বাঁচুক আগে, চোখ পরে।

নীহার তনুকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, আঃ, ওসব কথা এখন থাক। তুমি ওপরে যাও তো!

শরদিন্দু তেতলার সিঁড়ি ধরে চলে গেলেন।

রিনি নিজের ঘরের দরজা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, শেষ পর্যন্ত তনু ফিরে এসেছে। এইমাত্র থানা থেকে খবর পেয়ে মা আর মামা গিয়ে তাকে নিয়ে এল। রিনি কিছু বলল না। ঘরের মধ্যে চলে এল আবার।

.

দুপুর কাটল, বিকেল হল। বিকেলও ফুরিয়ে গেল। বাড়িটা একেবারে চুপ। আজ এ বাড়িতে সারাদিন যা হয়ে গেছে তারপর এই স্তব্ধতাই স্বাভাবিক। মামা নিজের ঘরে। মা ঠাণ্ডা-গরম জল করে তনুকে স্নান করিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছে। চোখে ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। মার নিজের আজ উপোস গেল। মামা কিছু স্পর্শ করেননি। মা এখন নিজের ঘরে। শুয়ে আছে হয়তো।

বিকেলটা ফুরিয়ে গিয়ে বারান্দায় আলোটুকু মরে গেল। কাকচড়ুই যেন খুব ক্লান্ত হয়ে আর ডাকছে না। বাড়িটা নিঃসাড় মতন হয়ে আছে। রিনি নিজের ঘরে শুয়ে বসে নিশ্বাস ফেলে ফেলে শেষ পর্যন্ত বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলে দেখল আর বিকেল বলে কিছু নেই। ঝাপসা অন্ধকার হয়ে এসেছে।

রিনি উঠে বাথরুমে গেল। চোখমুখে জল দিয়ে বাইরে এল। বারান্দায় গাঢ় ছায়া। মানিপ্ল্যান্টের পাতাগুলো কালো হয়ে গেছে। চায়ের টেবিল অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। বাড়িতে রিনি ছাড়া যেন আর কেউ নেই।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল রিনি। তার যেন হুঁশ ছিল না। তারপর মার ঘরে গেল। মা ঘরে নেই। বোধহয় মামার কাছে গিয়েছে। নিজের ঘরেই আবার ফিরে এল। ফিরে এসে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। সন্ধেবেলার ধুলো জমে গেছে চারপাশে। পাখিদের গলা বুজে এসেছে, মানুষজনের কথাবার্তা কেমন এক গুঞ্জনের মতন বাতাসে ছড়ানো। রিনির চুল বাঁধতে ইচ্ছে হল না। শাড়ি জামা বদলাবার গা হল না। তারপর কখন বড় অন্ধকার হয়ে এল।

অন্ধকারে হুশ হল রিনির। বাইরে বারান্দায় এল। বাতিটা এখনও জ্বালা হয়নি। বাতি জ্বালতে গিয়ে রিনি একেবারে তনুর ঘরের পাশে গেল। সুইচটা নুর ঘরের দরজার কাছাকাছি।

রিনি কী মনে করে তনুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তনু যেন সবে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসেছে।

তুমি বড় আশ্চর্য ছেলে। রিনি ঝাপসা অন্ধকারে তনুর আবছা চেহারা দেখতে দেখতে মনে মনে বলল: তুমি বড় আশ্চর্য ছেলে! এত বোকা তুমি? তোমার কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই? আমি বাড়ি ফিরে দেখি তুমি নেই। বেলা বাড়তেই সারা বাড়ি জুড়ে কী হুলুস্থূল। সবাইকে তুমি আজ যে কী করেছ! ছি ছি।

রিনি তনুর ঘরের আলোটা জ্বালাবার জন্যে সুইচে হাত দিয়েছিল। তনু যেন পায়ের শব্দ পেয়ে তাকাল। বাতিটা জ্বালানো হল না রিনির। সে তনুর বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর কীসের যেন অভিমানে, আক্রোশে, দুঃখে, জ্বালায় ব্যাকুল হয়ে বলল, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কেন বাড়ি থেকে একলা বেরিয়েছিলে? কে তোমায় যেতে বলেছিল? কলকাতার তুমি কী জান? তুমি ট্রামবাসে চাপা পড়তে পারতে। পারতে না? অন্ধ কোথাকার! কেন তুমি গিয়েছিলে? কী হত তোমার যদি আজ ওরা তোমায় মেরে ফেলত?

রিনি কাঁদছিল। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা বসে গিয়েছিল। তনুর বুকের জামা ধরে রিনি যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল, তুমি কেন গিয়েছিলে। কোথায় গিয়েছিলে?

তনু রিনির হাতের মুঠো ধরবার জন্যে হাত ওঠাতে গিয়েও পারল না। হাত ভীষণ কাঁপছে।

তনু বলল, রিনি, আমি তোমায় খুঁজতে গিয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *