১০.
নীহার নিজেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। শরদিন্দু ততক্ষণে সিঁড়ির দিকে চলে গেছেন, কিছু বলা গেল না। কীইবা নীহার বলতেন, ছেলেমেয়েরা তখনও সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়ের ওপরই রাগ হল নীহারের; বললেন, তুই বড় বেহায়া।
রিনির ভিজে শাড়ি দিয়ে তখনও টস টস করে জল গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। তার সর্বাঙ্গ ভিজে; মাথা, মুখ, শরীর। নীচের দিকের শাড়ি সায়া ভিজে লেপটে আছে পায়ে। তবুও কোথাও শুকনো নেই। তার কপালের কাছে লাল সিঁদুরের দাগটা মুছে গিয়েও যায়নি।
রিনি বলল, বৃষ্টি কি আমার কেনা? হঠাৎ চলে এল।
সবই হঠাৎ আসে। কে তোকে মাতব্বরি করে কালীঘাট যেতে বলেছিল?
কালীঘাট ঠাকুরের জায়গা। ও বলল, যাব। আমি নিয়ে গেলাম।
আমি নিয়ে গেলাম! নীহার মেয়ের গলা নকল করে বললেন। কত তোমার ঠাকুর-দেবতায় ভক্তি।
রিনি ঠোঁট উলটে জবাব দিল, আমার ভক্তির জন্যে গিয়েছি নাকি? তোমার ওকে বলো, ওর যদি ভক্তি হয় আমি কী করব!
তনু অপরাধীর মতন বলল, আমি বলেছিলাম, পিসিমা।
নীহার তনুর দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলেন না। কী বলবেন! বরং এই ভেজা, সিঁদুর-লেপা দুটি মুখ দেখে তাঁর হাসি পাচ্ছিল। তনুর দিকে তাকিয়ে ধমকের গলা করে বললেন, আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। শীঘ্রি গিয়ে মাথা মুছে জামা কাপড় ছাড় গে। বলে মেয়ের দিকে তাকালেন, এই সন্ধেবেলায় কাকভেজা ভিজে যদি জ্বর হয়, গলাব্যথা হয়–তখন তোকে আমি দেখাব। যা, কাপড় ছাড় গে যা। মাথা মুছবি ভাল করে।
রিনি চলে গেল। তনুও।
নীহার একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে গেলেন। পুজো-টুজো বাকি আছে এখনও।
পুজোয় মন বসাতে পারলেন না নীহার। সব দিন যে মন বসে তাও নয়, আজ যেন একেবারেই বসছিল না। তাঁর সামনে উপকরণ কম, কয়েকটি ধূপ জ্বলছে ধূপদানিতে, নিজের বাগানের দু-চারটি ফুল; সামনে রামকৃষ্ণের একটি ছবি, তার মাথার ওপর শঙ্খচক্রধারী শ্রীকৃষ্ণের পট। পিলসুজের ওপর ছোট প্রদীপ জ্বলছে।
নীহার চোখ বুজে বসে থাকলেও তাঁর মুখে যেন কেমন এক অসহায় ভাব, হয়তো কেমন এক ক্ষোভ ও বিরক্তিও রয়েছে। নীহার মনঃকষ্ট পাচ্ছিলেন যে, বোঝাই যায়। মুখে না বললেও মনে মনে তিনি ভাঙা ভাঙা করে শরদিন্দুকে বলেছেন। অথচ দুঃখবশে দু-একটি কথা যদি মনে মনে বলেই থাকেন সেটুকু কিছুই নয়। বলার কথা আরও হয়তো আছে।
মন শান্ত এবং স্থির করার জন্যে নীহার তাঁর দেবতায় মন বসাতে চেয়ে পারলেন না। কানামাছির মতন কী-যেন তাঁর মনের চারপাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অস্বস্তি এবং বিরক্তিতে বাধ্য হয়েই নীহার উঠে পড়লেন।
শরদিন্দু আজ ইশবগুলের শরবত খাবেন কি না নীহার বুঝতে পারলেন না। বাইরে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। নিজের হাতে শরবতটুকু তৈরি করে নিয়ে তিনি সরলাকে ডাকলেন। রিনির আজ খুব রাগ হয়েছে। মার চা-পান সে করে দেবে কি দেবে না কে জানে! নীহারও মেয়ের ওপর রাগ দেখাতে পারেন। সরলাকে চা করে ওপরে দিয়ে আসতে বলে তিনি শরবত নিয়ে তেতলায় চলে গেলেন। মাথার কাপড়ে বৃষ্টি আড়াল করে নীহার ঘরে ঢুকে দেখলেন শরদিন্দু চেয়ারে বসে আছেন। অন্যমনস্ক, গম্ভীর মুখ।
ঘরে এসে নীহার মাথার কাপড় সরিয়ে দিলেন। তোমার শরবত।
শরবতটা নামিয়ে রেখে নীহার ঘরের চারপাশ দেখলেন। নারান জলের ছাঁট বাঁচাতে জানলা বন্ধ করে দিয়েছে, এক পাশের একটি জানলা শুধু খোলা।
বৃষ্টিটা এলও বড় আচমকা,নীহার বললেন, যেন এই কথাটার সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক আছে যা তিনি স্পষ্ট করে বলতে ভরসা পেলেন না।
শরদিন্দু কিছু বললেন না, নীহারকে দেখলেন শুধু।
নীহার বেতের চেয়ারটা টেনে নেবার আগে খোলা জানলার ধারে গিয়ে একবার জলের ছাঁট দেখলেন। মেঘ ডাকছে গুড়গুড় করে। বর্ষার মতন করে বৃষ্টি এসেছে।
শরদিন্দুর কাছাকাছি এসে নীহার বললেন, জষ্ঠি মাসে এমন বৃষ্টি! মেঘের ডাক শুনেছ?
বোসো, শরদিন্দু বললেন।
বসবার জন্যে চেয়ারটা টেনে নিতে নীহার বললেন, তুমি খুব রাগ করেছ?
শরদিন্দু নিরুত্তর থাকলেন।
নীহার বললেন, ওরা ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষের স্বভাব বলে একটা কথা আছে। যতই বকোঝকো কোন ফাঁকে তারা কী করে বসবে আমরা কী জানতে পারব? তুমি ওদের ওপর মিছিমিছি অত রাগ করলে।
শরদিন্দুনীহারের কথার কোনও জবাব দিলেন না। তাঁর চোখ মুখ এখন অপ্রসন্ন দেখাচ্ছিল না, অথচ তিনি গম্ভীর, অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। নীহারকে আর লক্ষ করলেন না শরদিন্দু, শরবতের গ্লাসটা তুলে নিলেন।
নীহার ততক্ষণে বসে পড়েছেন চেয়ারে। শরদিন্দুর চুপচাপ ভাবটা তাঁর ভাল লাগছিল না। নীহারেরও কিছু কিছু পছন্দ-অপছন্দ আছে। শরদিন্দুর কোনও কোনও ব্যবহার যে তাঁরও পছন্দ নয় এটা শরদিন্দুর জানা উচিত। নীহার অবশ্য অতবড় মানুষটাকে কাণ্ডজ্ঞান শেখাতে চান না, কিন্তু তাঁর যে আজ বেশ খারাপ লেগেছে, তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, এটা জানাতে পারেন বইকী।
বলি-বলব মন নিয়ে নীহার বসে থাকলেন; শরদিন্দু শরবতটা শেষ করে গ্লাসটা রেখে দিলেন। বাইরে ঝাঁপটা দিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল, খোলা ছাদে শব্দ হচ্ছে, এক আধবার যেন বিদ্যুতের আলো দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত মুখ বাড়িয়ে চলে গেল।
সরলা ওই বৃষ্টির মধ্যে চা এনে দিয়ে গেল। পানও।
রিনি কী করছে? নীহার শুধোলেন।
ঘরে।
শ্যাম?
দাদাও তার ঘরে রয়েছে।
ওদের গরম কিছু খেতে দাও দিকিন।
চা দিয়েছি।
সরলা চলে গেল। নীহার চা খেতে খেতে বললেন, ছেলেমেয়েগুলোর সামনে তুমি আজ এমন করলে, আমার খুব খারাপ লাগল। অত রাগ তোমার করা উচিত হয়নি। এরা কী ভাবল বলো তো?
শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকালেন। অন্যায় করলে বলব না?
বলো; আমি বলতে বারণ করছি না। কিন্তু তুমি আজ এমন করলে–যেন…
বাধা দিয়ে শরদিন্দু বললেন, নীহার আমি কী করেছি আমি জানি। তুমি আজকের ব্যাপারটা শুধু দেখছ, আমি কিছুদিন ধরেই এটা দেখছি।
নীহার শরদিন্দুকে দেখতে দেখতে বললেন, তোমায় একটা কথা বলি। আমিও আজকাল তোমায় দেখে দেখে অবাক হচ্ছি। তুমি ওদের এই মেলা-মেশা পছন্দ করছ না।
শরদিন্দু নীহারের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আস্তে করে বললেন, আমি পছন্দ করছি না।
স্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত জবাব। শরদিন্দুর কথা বলার ভঙ্গিতে বিরূপতা নেই, কর্কশতাও নেই। নীহার আহত হতে পারলেন না, ক্ষুণ্ণ হলেন। চা-টুকু খেতে খেতে সামনের প্রবীণ মানুষটিকে দেখলেন, কখনও অন্যমনস্কভাবে, কখনও কেমন এক অভিযোগের দৃষ্টিতে।
নীহার বললেন, তোমার এতটা বয়েস হল, সাধারণ বুদ্ধিটাও কি হল না? আমার মেয়ের কথা বাদ দিলাম, গাছের একটি ফল হয়ে তার সব তাতেই আপন-মরজি, যেমন হুড়ে, তেমনি ছটফটে। কিন্তু ওই ছেলেটার দোষ কোথায়? সে বেচারি একা একা থাকে, কত দুরে, না আছে তার আত্মীয়স্বজন, না মেলামেশার সঙ্গী। ছেলেটা কলকাতায় এসেছে, ঘুরবে, বেড়াবে, গল্পগাছা করবে, একটু তো বাঁধা গোরু ছাড়া পাবার মতন অবস্থা হবেই। তাতে তোমার অপছন্দ হবে কেন? আমার তো বেশ লাগে। থেমে গেলেন নীহার, চা-টুকু জুড়িয়ে গেছে, শেষ করে পাত্রটা নীচে নামিয়ে রাখলেন। শ্যাম তার সঙ্গী পেয়েছে। আর দু-জনের বয়সটারই বা কী এমন তফাত। দুজনে মিশেছে ভাল, মিলেছে ভাল।
শরদিন্দু শান্তভাবে নীহারের কথা শুনছিলেন। দেখছিলেন নীহারকে, আজকের এখনকার নীহার, আর তাঁর পুরনো নীহারের মধ্যে যেন একটা আলোছায়ার খেলা চলছিল। অন্যমনস্কভাবে শরদিন্দু হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিলেন।
মুখে পান পুরে নীহার বললেন, এ বাড়িতে এসে ছেলেটা যদি কদিনের জন্যে আত্মীয়, সঙ্গী পায়, মেলামেশার লোক পায়–তোমার অপছন্দর কী আছে?
শরদিন্দু সিগারেটটা ধরিয়ে নিলেন। নীহারের দিকে না তাকিয়েও তিনি অনুভব করছিলেন, নীহার তাঁর দিকে অপলকে চেয়ে আছেন।
তুমি–শরদিন্দু বললেন, তুমি বলছ, আমার সাধারণ বুদ্ধি হল না। আমি তো দেখছি, তোমারই বুদ্ধিসুদ্ধি হচ্ছে না।
আমার হচ্ছে না। কেন? কী দেখলে তুমি?
আমি ওদের যতটা দেখি নীহার, তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি দেখ। আমি তেতলায় নিরিবিলিতে আছি। তুমি ওদের সঙ্গে পাশাপাশি রয়েছ। সারাটা দিন ওদের মেলামেশা দেখছ, দুজনের হাসি-হল্লা শুনছ। তোমার তো চোখ থাকা উচিত। তুমি মেয়ে।
নীহার বুঝতে পারলেন। না বোঝার কিছু নেই। নীহার যেন কয়েক মুহূর্ত কেমন চঞ্চল হয়ে পড়লেন। পরে বললেন, তোমার কথার মানে আমি ধরতে পেরেছি। তা বেশ তো! তাতেই বা দোষ কী?
দোষ কী! শরদিন্দু যেন অবাক হয়েই নীহারের দিকে তাকালেন।
নীহার সরাসরি শরদিন্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নিজে একদিন ছেলেমানুষ ছিলে না? তোমার ওই বয়েস ছিল না? নীহার খুব আচমকা কথাটা বলে ফেললেন, কেমন এক ঝোঁকের বশেই।
শরদিন্দু যেন এত স্পষ্ট করে কথাটা এই বয়সে নীহারের মুখে শুনতে পাবেন বলে মনে করেননি। কিংবা করে থাকলেও তেমন নিশ্চয় করে ধরে নিতে পারেননি। বললেন, আমার ছিল, তোমার ছিল। আমাদের ছিল বলেই তো আমি বলছি।
নীহার মুখের পান জিব দিয়ে একপাশে সরালেন। কী বলছ তুমি?
এই বয়েসটা ভাল না।
শরদিন্দুর চোখের দিকে না তাকিয়ে নীহার বললেন, আমার তো খারাপ লাগে না। …আমার মেয়েতে আমাতে অনেক তফাত। তবু ওকে দেখলে আমার নিজের কথা মনে পড়ে।
শরদিন্দু ম্লান করে হাসলেন। আমারও পড়ে। আমারও নিজের কথা মনে পড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে।
তোমার ভাল লাগে না?
ভাল লাগার কথাটা এখানে বড় নয়, নীহার। ভাল লাগে বলেই আমরা সব কিছু করতে পারি না। পরেরটাও ভেবে দেখতে হয়।
নীহার কিছুক্ষণ আর কথা বললেন না। বড় করে নিশ্বাস ফেলে একসময় বললেন, তুমি বেশি বেশি ভাব।
শরদিন্দু বললেন, যে বয়সে ভাবনাটা থাকে না, সেই বয়েস আর যে আমাদের নেই, নীহার। আমার মাথার চুল পেকে গেছে, কাজ থেকে ছাড়া পাবার বয়েস হয়েছে, সংসারে আমার ওই একটি মাত্র ছেলে। কেমন ছেলে তুমি তো দেখছ। একেবারে সরল, বোকা, অসহায়। সো ইনোসেন্ট, অ্যান্ড অ্যালোন। ওর জন্যে আমার সারাদিন চিন্তা। শ্যাম-শ্যাম করে আমার জীবনটা কেটে গেল। তুমি তো সব জানো, তোমায় আমি সবই বলেছি।
নীহারের মুখটি বেশ বিষণ্ণ হয়ে এল। তিনি সবই শুনেছেন। কিন্তু শরদিন্দু কি অকারণ বেশি ভয় পাচ্ছেন না? নীহার মৃদু গলায় বললেন, তুমি–তোমার খুব ভয় হয়েছে।
আস্তে মাথা নাড়লেন শরদিন্দু। সত্যি আমি ভয় পাই।
হাতের চুড়িটা নিজের মনেই ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের কোলের ওপর চোখ রেখে নীহার বললেন, তোমার যে কেন ভয় আমি জানি না।
শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে ছাইদানে ফেলে দিলেন। নীহার যেন সব বুঝেশুনেও বুঝতে চাইছে না। শরদিন্দু কেন ভয় পান সেটা কি নীহারকে তিনি গলা ফাটিয়ে জানাতে পারেন? এই বয়সে সেটা অসম্ভব।
নীহার চোখ উঠিয়ে বললেন, আমি তো ভয় পাই না। আমার ভাল লাগে। তুমি বিশ্বাস করো আমার এই বাড়িতে আমরা মায়ে-মেয়ে মিলে কেমন যেন হয়ে ছিলুম। আমাদের সবই ছিল, তবু যেন বাড়িটায় কীসের ফাঁকা ফাঁকা ভাব ছিল। তোমরা এসে কদিন আমাদের কত সুখ দিয়েছ—
নীহার, শরদিন্দু সামান্য অধৈর্য হয়ে বললেন, তুমি বড় ছেলেমানুষি করছ। তোমার কাছে এসে আমরাও কি কম খুশি হয়েছি? …আমার কথাটা তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার মেয়েটি বড় ভাল। কলকাতা শহরে থেকেও এত সরল, জীবন্ত স্বভাব। দেখে আমারই বেশ অবাক লাগে। তোমার গুণে, তোমাদের পরিবারের গুণে এমনটা হয়েছে। মাঝে মাঝে ওর কাণ্ডকারখানা, কথা বলার ভঙ্গি দেখলে আমার মনে হয়, তোমাকেই দেখছি, ওই বয়সে তুমিও প্রায় ওই রকম ছিলে। শরদিন্দু একটু হাসলেন। তা বলে তোমার-আমার ভাল লাগছে বলেই কি চুপ করে থাকা যায়?
কে জানে! নীহার উদাস সুরে বললেন। বলে দরজার দিকে তাকিয়ে কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগলেন। শেষে আচমকা বললেন, তোমার কাছে ভয়টাই বড়।
ভয়, ভাবনা– শরদিন্দু থেমে থেমে বললেন, তুমি মেয়ে; তোমারই উচিত চোখ চেয়ে আরও খানিকটা দূরের জিনিস দেখা।
না হয় দেখলামই আমি। তাতে কী?
তাতে কী? তুমি কেমন করে জিজ্ঞেস করছ, নীহার? তাতে যে সবচেয়ে বড় দুঃখ।
নীহারের মুখ খুব নরম, থমথমে, বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল। চোখ দুটি যেন সামান্য ছলছল করে উঠল, দুঃখ সবার কপালে নাও থাকতে পারে। তোমার-আমার কপাল তো ওদের নয়।
শরদিন্দুও চঞ্চল হচ্ছিলেন। নিজেকে শান্ত, সংযত করে বললেন, সংসারে জোর করে কিছু বলা উচিত নয়, নীহার। আমাদের সময়েও আমরা কি ভেবেছি আমাদের কপালটা খারাপ হবে। তুমি একদিন কোজাগরী পূর্ণিমার দিন দুর্গাবাড়ির সেই মস্ত শিউলিফুলের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমায় বলেছিলে আমার চেয়ে বড় তোমার কাছে কেউ নেই। আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইছি না নীহার, কিন্তু সেটা তো সত্যি হল না। …সংসারে জোর করে কিছু ভাবতে আমি ভুলে গেছি। আমি সাবধানী হয়েছি।
নীহার নীরব হয়ে বসে থাকলেন। তাঁর চোখ দুটি যেন আরও সজল হয়ে এল। মুখটি পরম দুঃখীর মতো। বৃষ্টির শব্দ কমে এসেছে। বসে থাকতে থাকতে নীহার আচমকা বললেন, যা হয়েছে তার দোষ কি আমার?
আমি দোষের কথা বলছি না। কার দোষ, তোমার আমার, তোমার বাবা কাকার না অন্য কার, সেকথা আমি তুলছি না। যা আমরা হবেই ভেবেছিলাম তা হয়নি। পৃথিবীতে এটা হামেশাই হয়, যা এক রকম স্থির বলেই আমরা মনে করি সেটা ভেঙে যায়, শেষ পর্যন্ত হয় না।
নীহার অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। নিজের শরীরের পুরনো দাগ মানুষ যেমন করে লক্ষ করে যেন সেই রকম ভাবে মনের কোথাও কিছু লক্ষ করছিলেন। বড় মায়া লাগছিল। দরজার চৌকাঠ ছুঁয়ে আলোর ঝলকানি আবার পালিয়ে গেল, বৃষ্টির শব্দ বাড়ল আচমকা, মাথার ওপরে মেঘের ডাক গুমগুম করে উঠল।
নীহার হঠাৎ বললেন, তোমার সঙ্গে আজ আমার ঝগড়া করবার মুখ নেই। তুমি আমায় চোর করে নিজে সাধু হচ্ছ! নিজে তুমি কী করেছ তা একবার ভাবো৷
শরদিন্দু বিষণ্ণ চোখে নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি বাস্তবিকই নীহারের সঙ্গে ঝগড়া করছেন না। নীহার তাঁকে ভুল বুঝছে। মোটা, নরম, চাপা গলায় শরদিন্দু বললেন, ছি ছি নীহার, তোমায় আমি চোর করব কেন! যদি তোমায় চোর বলে ধরতাম তাহলে এতকাল পরে ছেলের হাত ধরে তোমার বাড়িতে এসে উঠতাম না। এই এত বড় কলকাতায় তুমিই আমার একমাত্র নিজের। শুধু কলকাতায় কেন, সংসারে আজ তোমরাই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমি অনেক দূরে থাকি, তবু তোমাদের ভালটুকু চাই।
নীহার কোনও কথা বললেন না। এই মানুষটার এখনও সেই জেদ আছে, অহঙ্কার আছে। তার না কোনওদিন হ্যাঁ করা গেল না। যৌবনেও নীহার পারেননি; আজও পারবেন না। তবু শেষবারের মতন বললেন, আমিও তোমাদের খারাপ চাইনি। ভগবান জানেন, আমার মনে কী নিয়ে বেঁচে আছি!
শরদিন্দু শান্ত ভাবে বললেন, তুমি কী নিয়ে বেঁচে আছ, আমি কী নিয়ে বেঁচে আছি, এসব কথা আর এখন তোলা উচিত নয়, নীহার। আমাদের বাঁচা তো শেষ হয়ে আসার সময় হল। আমার ছেলেটার জন্যেই আমার ভাবনা, আমাকে তুমি স্বার্থপর ভাবতে পারো। আমি চাই না, সে এই বয়েসে কোনও দুঃখ পাক। তার কপাল এমনিতেই তো দেখছ। এই বয়েসটা বড় অবুঝ, বড় খারাপ। দুঃখ পেলে সেটা ভোলা সহজ হয় না। আমি তাকে দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে চাই।
নীহার অনুভব করলেন তাঁর চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোনও রকমে ভাঙা গলায় বললেন, তুমি বড় নিষ্ঠুর।
শরদিন্দু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গাঢ় গলায় বললেন, আমি খুব সাবধানী। আমার ছেলের ভাগ্য আমি জানি না নীহার। তার যে কী হবে কেউ বলতে পারে না। আমি তাকে আগলে রাখতে চাই।
নীহার কোনও রকম সাড়া দিলেন না। বাইরে বৃষ্টি নরম হয়ে এল। বাদলা বাতাস ঘরে ঢুকছিল, সমস্ত ঘর ঠাণ্ডা হয়ে। পাখাটা আস্তে আস্তে চলছে। শরদিন্দু ইজিচেয়ারে পিঠ মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছেন। নীহারের চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে কখন শুকিয়ে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত নীহার উঠে পড়লেন। শরদিন্দু চুপ করে চেয়ারে শুয়ে আছেন। বাতাসে একটা কাগজ উড়ে মেঝেতে পড়েছিল। কুড়িয়ে রেখে দিলেন নীহার। শরদিন্দুর মাথার দিক দিয়ে বাতাস আসছে, জানলাটা বন্ধ করে দিলেন।
শরবতের গ্লাসটা তুলে নেবার সময় তাঁর কেমন ইচ্ছে হল, পাকা চুলের ওই মাথাটায় একটু হাত বুলিয়ে বলেন, নীহার তোমার কোনও ক্ষতি করতে চায়নি, কখনও নয়। তার কপাল, আর তোমার কপাল।
শরবতের গ্লাস নেওয়া হয়ে গেলে নিজের চায়ের পাত্রটাও তিনি তুলে দিলেন। আমি নীচে যাচ্ছি, নীহার বললেন।
শরদিন্দু অস্পষ্ট করে সাড়া দিলেন।
দরজার কাছে গিয়ে কী মনে করে মুখ ফেরাতে গিয়ে নীহার দেখলেন, শরদিন্দু একই ভাবে শুয়ে আছেন, তাঁর মুখের সামনে বেতের ফাঁকা চেয়ারটা পড়ে আছে।
নীচে নেমে নারানকে দেখতে পেলেন, তার হাতে গ্লাস-টাস ধরিয়ে দিয়ে নীচের তলার খোঁজ নিলেন। দরজা-জানলা সব বন্ধ আছে কি না, জল-ফল কোথাও ঢুকেছে কিনা। নারান নীচের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বিনি মাইনের সরকার। কত রকম কী তদারকি করে। আজকাল থাকেও নীচে। স্কুলটা খুলে গেছে আজ থেকে।
তনুর ঘরে গেলেন নীহার। তনু বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে।
শ্যাম, আস্তে করে তনুকে ডাকলেন নীহার।
তনু ঘাড়ের তলায় দু-হাত ঢুকিয়ে শুয়ে ছিল চোখ বুজে।
চোখের পাতা খুলল।
নীহার তনুর বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মাথার চুল, মুখ, গলা পরখ করলেন। তোর চুল এখনও ভিজে ভিজে রয়েছে। শরীর খারাপ লাগছে না তো?
না।
ঠিক বলছিস? বলে আদর করে তনুর কপালের কাছে মুখ নিয়ে ছোট করে চুমু খেলেন। তারপর কী যে খেয়াল হল, তনুর পাশে আধখানা শরীর ঝুঁকিয়ে পড়ার মতন করে একটু শুয়ে থেকে বললেন, তোর বাবাকে আজ আমিও খুব বকেঝকে এসেছি। নিজে ছেলেবেলায় মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে কত ভিজেছে, কত কাণ্ডই করেছে; আজ বুড়ো হয়েছে বলে সব ভুলে গেছে। …এই রকমই হয় বুঝলি শ্যাম; আমরা নিজেরটা ভুলে যাই।
আরও খানিকটা শুয়ে থেকে নীহার উঠলেন। মেয়েটাকে একবার দেখে আসবেন।
.