একালের শবে বরাত
আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়–আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।
সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হত–মোট কটা পটকা আছে। তারাবাতির। প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।
পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে। গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে ব্রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কজি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।
রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর। ছোটাছুটি করার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। ১ নামাজ শুরু হলো একটু রাত করে। মেঝেতে পরিষ্কার একটা চাদর বিছানো হতো। আমরা ছোটরা বাবার পেছনে নামাজে দাঁড়াতাম। ছোটদের নামাজ দরকার নেই।–বাবা যেমন করছেন তেমন করলেই সোয়াব। আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা মজার খেলার মত। সেজদায় গেলে মাথা থেকে টুপি পড়ে যেত। সেই টুপি চট করে মাথায় দেয়া এবং হাত বাড়িয়ে ছোট ভাইয়ের মাথা থেকে টুপি ফেলে দেয়াতেই সময় কাটত।
সারারাত নামাজ পড়তে হবে এই জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। যে কোন কারণেই হোক শবে বরাতের রাতে আমাদের খাটে নিয়ে শোয়ানো হতো না। নামাজের চাদরেই আমরা শুয়ে থাকতাম। শুধু চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত। আধোঘুম, আধো-জাগরণে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতাম–বাবা নামাজ পড়ছেন। মা তার পাশেই রেহেলে কোরান শরীফ রেখে পাঠ করছেন। ইলেকট্রিক বাতি নিভিয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। আগরদানে আগরবাতি পুড়ছে। যেন অলৌকিক এক দৃশ্য। বাবা নামাজের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসে তার পুত্র-কন্যাদের গায়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। দীর্ঘ ফু–মাথা থেকে পা পর্যন্ত। আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। শবে বরাত এলেই মনে পড়ে এই মঙ্গলময় ফুঁ দেয়ার জন্যে বাবা বেঁচে নেই। মন বিষণ্ণ হয়।
প্রতি শবে বরাতের রাতেই বাবার স্মৃতি মনে করেই হয়তো গভীর রাতে আমার। বাসাতেও মেঝেতে একটা ঢালাও বিছানা করা হয়। বাবার মত নামাজ পড়ে প্রার্থনা করি। কিন্তু কিছুতেই সেই আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারি না।
এবারে শবে বরাতে ভেবেছিলাম বাচ্চাদের কিছু তারাবাতি কিনে দেব। কোথাও তারাবাতি পেলাম না। শুনলাম সরকারী নির্দেশে পটকার দোকান নিষিদ্ধ। খোলা বাজারে পাওয়া যাবে না। তবে বন্ধ বাজারে পাওয়া যাবে।
বন্ধ বাজার খোঁজার ইচ্ছা হলো না। তবে যাদের খোঁজার তারা ঠিকই খুঁজে বের। করল। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল তাণ্ডব। পটকা তো নয়, যেন এটম বোমা ফাটছে। একেকটা পটকা ফুটে ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা কেঁপে উঠে। সেই সঙ্গে চলল মাইক। প্রার্থনা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়, নীরব বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে সেই ব্যক্তিগত নীরব প্রার্থনা সরব আকার ধারণ করল। যা শুরু হল তার নাম প্রার্থনা নয়, কোরান পাঠ নয়–তার নাম হট্টগোল।
আমি আমার এলিফেন্ট রোডের এ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে আছি, নতুন দিনের শবে বরাত উৎসব পালন দেখছি। এ কি ভয়াবহ উৎসব! হচ্ছেটা কি?
অনেকগুলি খণ্ড দৃশ্য দেখলাম। একটা বর্ণনা করি। রাত এগারটা কিংবা সাড়ে এগারটা। এলিফেন্ট রোড ধরে এক ভদ্রলোক তার কন্যা কিংবা কন্যা-স্থানীয় কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মাটি খুঁড়ে কোত্থেকে একটা ছেলে এসে রিকশাওয়ালার সামনে বিকট শব্দে একটা বোমা ফাটাল। রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। তখন শুরু হল বৃষ্টির মত বোমা বৃষ্টি। রিকশার চারদিকে ফাটছে। মেয়েটি কাঁদছে। মেয়ের সঙ্গী হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ছেলেগুলির দিকে তাকাচ্ছেন। ছেলেরা ক্ষমা করবে কেন? তারা ক্ষমা করতে আসেনি, তারা এসেছে মজা করতে। কাজেই তারা মজা করেই যেতে লাগল।
আমেরিকায় হেলোইন উৎসব বলে একটা উৎসব হয়। ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চারা ভূতের মুখোশ পরে বাড়ি বাড়ি যায়। কলিংবেল টিপে বলে–ট্রিট অর ট্রিক (কিছু দাও নয়ত ভয় দেখাব)। ঘরের লোকজন ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে তাড়াতাড়ি মুঠো ভর্তি চকোলেট এনে দেয়। সেই মজার উৎসবের ভয়াবহ বিবর্তন হয়েছে। আজ হেলোইন উৎসবের কথায় আমেরিকাবাসী আঁতকে উঠে। প্রতি স্টেটে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স নামানো হয়। কারণ বর্তমানের হেলোইন উৎসবে মজা করার জন্যে বাড়িতে লোককে বাইরে থেকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। উৎসবটা এখন আর মজার ভয় দেখানো পর্যায়ে নেই। এখন ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলার পর্যায়ে। হেলোইন উৎসবের পর পর আমেরিকার খবরের কাগজগুলি উৎসবে হত্যার সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যা পড়ে যে কোন মানুষ আঁতকে উঠবেন।
আমেরিকা যে পথে যাবে–আমারও তো সেই পথেই যাব। নয়তো সভ্য বলে নিজেদের পরিচয় দেব কি করে? শবে বরাতের বলি শিরোনামে কাগজ এখন খবর ছাপা শুরু করেছে। ভোরের লাগজ লিখেছে–গ্রেপ্তার ৬০০, আহত ৩৬৫। সবে শুরু।
ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে!–ভবিষ্যতের শবে বরাত উৎসবে স্পেশাল পুলিশ বা রায়ট পুলিশ চলবে না–আর্মি নামাতে হবে, ট্যাঙ্ক নামাতে হবে। ধর্মীয় উৎসব কি ভাবে পালন করতে হয় আমরা তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ছাড়ব।