একালের রাজা শিবি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
ছেলেবেলায় স্কুলপাঠ্য সংস্কৃত বইয়ে হরেন কৌশিক রাজা শিবির কাহিনি পড়েছিলেন। পরিণত বয়েসে তাঁকে চাক্ষুষ করলেন।
চাকরিসূত্রে হরেনবাবুকে কলকাতায় এসে বাসা বাঁধতে হয়েছিল। সাউথ এন্ড পার্কের প্রায়-অন্ধকার একটা একতলার ফ্ল্যাট। দু-দিনেই স্ত্রী সবিতা আর ছেলেমেয়ে দুটো অস্থির হয়ে উঠল ‘হ্যাঁগো! এমন বুক-চাপা খাঁচায় মানুষ থাকতে পারে!’
অতঃপর হরেনবাবুর এক নতুন ডিউটি জুটল। ভাগ্যিস মিসা বা এমার্জেন্সি নেই, তাই রোজ সকাল-সকাল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়তেন। বাড়িতে যা-হয় কিছু জলপান সেরেই সবিতা আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে হাওয়া খাওয়াতে চলে আসতেন লেকের ধারে। তিনি আর সবিতা ফাঁকা জায়গায় বসতেন, আর ছেলেমেয়ে দুটো ছুটোছুটি করে খেলত।
ক’দিন পরেই তাঁদের নজর পড়ল চাকাওলা চেয়ারে-বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর তাঁর চাকরের ওপর। এত গরমেও বৃদ্ধের গলা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। চোখে কালো গগলস, হাতে অদ্ভুত ধরনের একজোড়া দস্তানা পরা—আমাদের দেশে যেটা অস্বাভাবিক।
হরেনবাবুরা ভাবলেন, ভদ্রলোকের হয়তো কোনও চর্মরোগ আছে, আলো-হাওয়ার স্পর্শে যা বাড়তে পারে।
ঘড়ি ধরে ঠিক একই সময়ে পাথরে খোদা চাকরটা চেয়ার ঠেলতে-ঠেলতে ঢাকুরের রাস্তা দিয়ে আসত, একই জায়গায় থামত, বৃদ্ধ তাঁর হাতের থলি থেকে কাঁপতে-কাঁপতে কীসের টুকরো যেন বের করতেন, হয়তো পাঁউরুটিরই হবে, তারপর ফোকলা মুখ দিয়ে অবোধ্য স্বরে কী যেন বলতেন, আর কোথা থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে কাক এসে তাঁর চেয়ার ঘিরে ফেলত। কর্কশ আওয়াজ তুলত, ঠুকরে-ঠুকরে গিলতে থাকত সেই টুকরোগুলো।
বৃদ্ধ একদিন লক্ষ করলেন হরেনবাবুদের। তিনি হাসলেন ছেলেমেয়েদের লক্ষ করে। কথা বলবার বিস্তর চেষ্টা করলেন, কিন্তু বেরিয়ে এল সেই দুর্বোধ্য আওয়াজ। সবিতা মমতা-মাখা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আহা! বেচারা।’
এর বেশ কিছুদিন পরে সস্ত্রীক হরেনবাবু এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধের দিকে, আলাপ করতে। তিনি বুঝলেন, কোথায় কী যেন একটা গণ্ডগোল আছে। স্ত্রীকে তিনি বৃদ্ধের কাছে যেতে বাধা দিলেন, কিন্তু সবিতা হেসেই উড়িয়ে দিল স্বামীর নিষেধ। তারপর এগিয়ে গেল।
চাকরটা অভ্যর্থনা জানাতে কোনওরকম ঔৎসুক্য দেখাল না। বৃদ্ধ শুধু মৃদু হাসলেন, কাগজের থলিটা তুলে দিলেন সবিতার হাতে, তারপর ইশারায় জানালেন, ছুটে আসা কাকগুলোকে খাওয়াতে। একমুঠো খাবারের টুকরো বের করে নিয়ে, সবিতা ছুড়ে দিল কাকগুলোর দিকে। টুকরোগুলো সবুজ থকথকে চর্বির মতন। হাত দিয়ে ছুঁতেই সবিতার গা-টা কেমন ঘিনঘিন করে উঠেছিল। বৃদ্ধের দিকে সে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই, তিনি দস্তানা আঁটা হাতদুটো নাড়তে-নাড়তে আনন্দে খলখল করে হেসে উঠলেন। চাকরটা অকস্মাৎ চেয়ারখানা ঘুরিয়ে নিয়ে ঢাকুরের পথে অদৃশ্য হল।
এর পরেও দিনকয়েক হরেনবাবুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবিতা কাকেদের ভোজনপর্বে বৃদ্ধকে সাহায্য করল। সে লক্ষ করল কি না কে জানে, কিন্তু হরেনবাবুর মনে হতে লাগল বৃদ্ধ যেন দিন-দিন কুঁকড়ে ছোট হয়ে যাচ্ছেন। নিছক জরা, না কোনও বিচিত্র রোগ?
একদিন বৃদ্ধের গা থেকে কম্বলটা খসে পড়তেই তিনি লক্ষ করলেন, বৃদ্ধের একখানা পা নেই। দরদী কণ্ঠে চুকচুক করে উঠল সবিতা, ‘আহা! হয়তো কেটে বাদ দিতে হয়েছে।’ কোনও মন্তব্য করলেন না হরেনবাবু, তবে ক’দিন পরে দেখা গেল বৃদ্ধের দ্বিতীয় পা-খানাও অদৃশ্য হয়েছে।
এর পর থেকে তাঁরা আর বৃদ্ধের কাছাকাছি যাননি। দূর থেকেই লক্ষ করতেন, কী এক অজানা পচন রোগে বেচারা যেন গলে-গলে যাচ্ছেন। অজগর সাপের মতন মৃত্যুও কি এমনিভাবেই তিলে-তিলে গ্রাস করে? চেয়ার ঠেলে চাকরটা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরও একটা তীব্র দুর্গন্ধ বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে রাখত।
পরদিন রাত্রে ঘুমোতে-ঘুমোতে সবিতা হঠাৎ গোঙাতে শুরু করল। বিছানার চাদর হাতড়াতে-হাতড়াতে এদিক-ওদিক ওলটপালট খেতে লাগল। হরেনবাবু স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। জড়িত কণ্ঠে সবিতা বারকয়েক ‘হাত, পা’ উচ্চারণ করল, যেন একটা জটিল প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজছে।
হঠাৎই ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে সে কাঁদতে-কাঁদতে উঠে বসল। হরেনবাবু তাকে বুকে টেনে নিলেন, জানতে চাইলেন, কী হয়েছে তার।
কোনও জবাব দিল না সবিতা। একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন বৃদ্ধ যথাসময়েই এলেন। সবিতা ভূতে পাওয়ার মতনই এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। হরেনবাবুর কোনও বাধাই মানল না। কাছ থেকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল বৃদ্ধকে। আগের চেয়ে আরও অনেক ছোট হয়ে গেছেন তিনি—প্রায় অর্ধেক। দু-হাতে ব্যান্ডেজ। কম্বলের বদলে দেহটা আজ শালে ঢাকা। চোখ দুটো কোটরের ভেতরে প্রায় অদৃশ্য। হঠাৎ ফাটা বাঁশের মতো চেরা গলায় তিনি বলে উঠলেন, ‘ওদের খেতে দিয়ো, খেতে দিয়ো।’
সেই প্রথম সবিতা বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনল। চাকরটা প্রায় ধমকে উঠল সবিতাকে, ‘যান, যান, সরে যান এখান থেকে। ওঁকে বিরক্ত করবেন না। খুব অসুখ ওঁর।’
সবিতা ছুটে পালিয়ে এল হরেনবাবুর কাছে। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, চাকরটাই আজ কাগজের ব্যাগ থেকে সেই সবুজ রঙের টুকরোগুলো বের করে ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর রুদ্ধশ্বাসে ছুটে-আসা কাকের দল কা-কা করতে-করতে টপাটপ গিলছে সেগুলো।
এর পর থেকে সবিতার যেন মাথার গোলমাল শুরু হল।
হরেনবাবু স্ত্রীকে ডাক্তার-বাড়ি নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা করে ডাক্তার কতকগুলো বড়ি দিয়ে বললেন, ‘ওঁর বিশ্রামের একান্ত দরকার।’
একফালি বারান্দার কোণে সবিতা একখানা চেয়ারে বসে থাকে দিন-রাত, নখ দিয়ে কী যেন খোঁটে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, ছেলেমেয়ের দিকে নজর দেয় না। দেখেশুনে হরেনবাবু ঠিক করলেন, স্ত্রীকে কোনও নামকরা মনস্তত্ত্ববিদের কাছে নিয়ে যাবেন।
রবিবার ছেলেমেয়েকে নিয়ে হরেনবাবু লেকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল না যে সবিতা যায়, কিন্তু জেদ করে সে স্বামীর সঙ্গে চলল।
ঘাসে-ভরা মাঠটায় ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করে খেলতে লাগল। সবিতা হরেনবাবুর পাশে বেঞ্চে বসল, দৃষ্টি কিন্তু তার ঠায় আটকে রইল ঢাকুরে থেকে আসার সেই পথটার দিকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে হরেনবাবু হাতের বইখানা খুলে পড়তে লাগলেন। হঠাৎ একসময় মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, সবিতা কোনসময় নিঃশব্দে উঠে গিয়ে ঢাকুরের পথটার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের মনে বিড়বিড় করে কী যেন বকছে।
হাতঘড়িটা দেখলেন হরেনবাবু। বৃদ্ধের আসার সময় হয়ে গেছে।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দেখা গেল, চাকরটা একলা আসছে। আজ আর বৃদ্ধ নেই, চাকাওলা চেয়ারও নেই। চাকরটার হাতে শুধু একটা ছাতা আর আগেকার চেয়ে অনেক বড় একটা থলি।
কী যে ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে, হরেনবাবু সেটা অনুধাবন করতে পারলেন। কিন্তু তিনি কোনও কথা বলার আগেই সবিতা তাঁর দিকে ফিরে ভয়ে, আতঙ্কে বিকট চিৎকার করে উঠল।
চাকরটা হাতের থলিটা ফেলে দিয়ে ছুটে পালাল। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে পড়ল নরম, সবুজ, মাংসের টুকরো-টুকরো পিণ্ড। কোথায় ছিল কাকগুলো, কা-কা করতে-করতে ছুটে এল সঙ্গে-সঙ্গে।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৯