একাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে, নিৰ্ম্মল আকাশে ষষ্ঠীর চন্দ্রকলা হাসিতেছে। দক্ষিণেশ্বরের মালাপাড়া এক্ষণে জনশূন্য, ছেলে-বুড়া-আদি ছোটলোকমাত্রেই গ্রামাভ্যন্তরে বড় বড় বাবুদিগের বাড়ীতে ঠাকুর দেখিতে গিয়াছে; কেবল কজ্জলা যায় নাই। কজ্জলার শয্যা প্রস্তুত হইয়াছে, প্রদীপ জ্বালা হইয়াছে। প্রদীপের কাছে পা ছড়াইয়া বসিয়া সে মাটির কুঁড়ী হইতে একটি পান লইয়া চুণ, খয়ের, সুপারী ও কিঞ্চিৎ দোক্তার গুঁড়া দিয়া সাজাইয়া কসে টিপিয়া রাখিল। এই সময়ে গ্রামের ভিতর চৌধুরী মহাশয়দিগের বাড়ীতে জোড়খাই ও কাড়ানাগ্রা, মোড়লদের বাড়ীতে ঢোল ও সানাই এবং বড় বাড়ীতে ঢাক ও জগত্মম্প বাজিয়া উঠিল—গ্রাম তোলপাড় হইতে লাগিল। কজ্জলা মনে মনে বলিল, “বিধাতা যাদের আমোদ করিতে দিয়াছে, তাহারাই আমোদ করুক—আমি অভাগিনী কেবল দুঃখই ভোগ করিব। সুখ আমার কপালে নাই—আমোদ আমার কিসে হইবে? কিন্তু আমার মনের দোষেই আমি দুঃখ পাই, নৈলে আমার অভাব কি? লোকে আমার সঙ্গে কথা কয় না, নাই কইলে, সেজন্য আমি দুঃখ করি না। আমি তার তরে মরি কেন? সে আমার কে? সে ডাকাত, সে খুনে—তার জন্য আমি ভাবি কেন? না তাকে আর ভাবব না—তার নাম আর করব না—এইবার তাকে ভুল।” সহসা কজ্জলা প্রকাশ্যে বলিয়া উঠিল, “সখি, প্রাণ থাকিতে সে নাম আমি ভুলিতে পারিব না,” বলিয়াই উন্মাদিনীর ন্যায় হাসিয়া একটা গান ধরিল,
“কেমনে সে নাম সখি, ভুলিব এখন গো,
আজন্ম জপিনু যে নাম করিয়ে যতন গো?
পড়া পাখী ছেড়ে দিলে,
বনমাঝে প্রবেশিলে,
পারে কি সে কৃষ্ণনাম ছাড়িতে কখন গো?
শরীরে শোণিত চলে,
প্রতিক্ষেপে কৃষ্ণ বলে,
প্রত্যেক নিশ্বাস যে নাম করে উচ্চারণ গো।”
কজ্জলা যখন ঈষদবনত বদনে অনন্যমনে গান করিতেছিল, সেই সময় নির্ম্মম দস্যু রত্নাপাখী ভীষণ শাণিত অসিহস্তে, ভীমগম্ভীর-বদনে সেই কুটীর হইতে কিঞ্চিদ্দূরে ভাগীরথী-তীরে বিচরণ করিতে করিতে ভাবিতেছিল, “কজ্জলা কে? তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? সে একটু দেখতে ভাল, তাই তাকে একটু ভালবাসি। ভালবাসি বলে কি তার গোলাম হব? সে যা বলবে, তাই আমাকে করতে হ’বে? কি—সে আমায় পৈতা ফেলাবে, আমায় ডাকাতী ছাড়াবে, তবে আমায় গ্রহণ করবে? এত বড় স্পদ্ধা! আমি রতন শর্ম্মা—বাপের কুপুত্র, আমি ডাকাতী ছাড়ব? আমি ডাকাত, ডাকাতীই আমার ধর্ম্ম—আমি আমার ধর্ম্ম পরিত্যাগ করব কেন?”
এই সময়ে “ঠাকুর মহাশয়, ঠাকুর মহাশয়” বলিয়া, কে ডাকিল।
রত্না উত্তর করিল, “কি রে এসেছিস?”
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ একজন দৃঢ়কায় পুরুষ তাহার সম্মুখে আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। এই ব্যক্তির নাম ধর্ম্মা যুগী—তখনকার একজন বিখ্যাত বোম্বেটিয়া। সে লঘুস্বরে জিজ্ঞাসিল, “কি ঠাকুর, সাবাড় হয়েছে?”
রত্না। না।
ধৰ্ম্মা। সে কি? এ কাজ আপনি ভাল করছেন না।
রত্না। এ বিষয়ে তুই কথা কবার কে?
ধ। যখন সে সব জানতে পেরেছে, আমাদের পাতালপুরী দেখেছে, তখন তাকে আর কখনই রাখা হ’তে পারে না।
রত্না। সে বিবেচনা আমি করব।
ধ। ঠাকুর, তোমার মোহ জন্মেছে, কাজটা ভাল হচ্ছে না, তলোয়ারখানা আমায় দিন দেখি রত্না। (সরোষে) খবরদার।
ধ। সে কি ঠাকুর? তোমার একটা মেয়েমানুষের তরে আমরা সবাই মারা যাব না কি? রত্না। মারা যেতে হবে না, এখন যা বলি শোন, এক কর্ম্ম কর।
ধ। কি?
রত্না। শ্রীরামপুর থেকে একখানা নৌকা আসছে, তাতে একটি স্ত্রীলোক আছে, স্ত্রীলোকটি কলিকাতার বোসেদের বাড়ীর বৌ, গায়ে বিস্তর টাকার গহনা, সঙ্গে একজন দ্বারবান্, একজন চাকর আর একটি বাবু আছে, বুঝলি, ঝাঁ ক’রে গিয়ে ধগে যা দেখি।
ধ। আপনিও আসুন না।
রত্না। না, আমার তবিয়ৎ বড় আচ্ছা নাই।
“তবে আমি ধনা আর হরি ঠাকুরকে ডেকে নিয়ে যাই,” বলিয়া ধর্ম্মাযুগী প্রস্থান করিল। পরক্ষণে রত্নাপাখী বরাবর কজ্জলার কুটীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখনও সে কোকিলা আপন মনে গান করিতেছিল, আপনার গানে আপনি মোহিত হইতেছিল। রত্নাকে দেখিবামাত্র, সে গান বন্ধ করিয়া খিল খিল শব্দে হাসিয়া উঠিল। বলিল, “রতন তুই অনেক দিন বাঁচবি, এইমাত্র তোর নাম করছিলেম।”
রত্না। তুই কিন্তু এখনই মরবি, আমিও এইমাত্র তোর নাম করছিলেম।
কজ্জলা। তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, তাই যেন হয়।
রত্না। কেন, এত মরবার সাধ কেন?
কজ্জলা। যার সুখ নাই, তার আবার বাঁচবার সাধ কি?
রত্না। তোর যদি সুখ নাই, তবে সুখ আছে কার? এমন গালভরা হাসি, গানভরা প্রাণ, তোর আবার সুখ নাই রে ছুঁড়ি!
কজ্জলা কহিল, “রতন, আমার মনের দুঃখ কেউ বুঝে না বলেই আমি গান করি, আমার গান, কান্না বই আর কিছুই নয়—বড় দুঃখেই আমি গান করি। রতন, পাড়াপ্রতিবাসী আমায় দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, আমার সঙ্গে কেউ একটা কথা কয় না, একি কম দুঃখ! আবার আড়ালে সবাই আমায় গালি দেয়, আমায় ডাইনী বলে, প্রেতিনী বলে। কেন রতন, আমি কার কি করেছি? রতন! আমি কুকুর-বিড়ালেরও অধম হয়ে রয়েছি—আমার আবার বাঁচবার সাধ কি?”
এই কথা বলিয়া কজ্জলা কাঁদিয়া ফেলিল, তাহার পূর্ণ মসৃণ কপোলযুগল অশ্রুধারায় প্লাবিত হইতে লাগিল।
রত্না। আ মোলো যা ছুঁড়ি, কাঁদিস কেন? তোর সঙ্গে কেউ না কথা কয়, বয়ে গেল, তুই কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবি, আমায় ভালবাসবি, আমি তোকে ভালবাসব।
কজ্জলা। তুই কেন আমায় ভালবাসবি, রতন? তোর কি ভালবাসার কেউ নাই?
র। আমার আবার কে আছে?
ক। তোর স্ত্রী নাই? স্ত্রীকে ভালবাসতে হয়, তা কি তুই জানিসনি?
র। আমার স্ত্রী আছে, তোকে কে বললে?
ক। নাই?
র। না।
ক। দেখ, মিছা কথা কসনি; তুই এতবড় মিন্ষে, তোর বে হয়নি, এ কথা কে বিশ্বাস করবে?
র। যদি হয়ে থাকে, তা তোর কি?
ক। যদি তোর স্ত্রী থাকে, তাকে নিয়ে ঘর করগে যা, আমার কাছে আসিস কেন?
র। আমি তাকে ত্যাগ করেছি।
ক। আপনার স্ত্রীকে কে কোথা ত্যাগ করে থাকে—কেন তুই তাকে ত্যাগ করলি?
র। সে কালো বলে আমার মনে ধরে নি, তাই আমি তাকে ত্যাগ করেছি।
ক। আর আমি খুব ফরসা, না?
র। তুই কালো হলেও আমি তোকে ভালবাসব।
ক। তুই যে আমায় ভালবাসবি, এ কথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।
র। কেন, বিশ্বাস হয় না কেন?
ক। তুই যে ডাকাত।
র। আমি ডাকাত, তা তোর কি?
ক। ডাকাতকে কে বিশ্বাস করে? তুই আমায় ভালবাসবি, এ বিশ্বাস আমার হবে কেন?
র। না হবার কারণ?
ক। যার দয়া নাই, মায়া নাই, পুঁটিমাছের মতন মানুষ মারে, সে কি কখন কাকেও ভালবাসতে পারে?
রত্না হাঃ হাঃ করিয়া হাসিয়া বলিল, “মানুষ মারি, তা তোর কি? তোকে ভালবাসব না কেন?”
কজ্জলা। আহা রতন! তুই ও কাজ ছাড়, কি করে তুই মানুষ ঠেঙ্গাইয়া মারিস বল দেখি, আহা! যাদের মারিস, তারা কত যন্ত্রণা পেয়েই মরে, তোর কি একটু দয়া হয় না?
রত্না। আমি না মারলে তারা যদি কখন না মরত, মৃত্যুযন্ত্রণা না পেত, তা হ’লে আমি তাদের মারতেম না। মানুষ মাত্রকে যখন মরতেই হ’বে, মৃত্যু যন্ত্রণা পেতেই হবে, তখন আমি তাদের মারব না কেন? যাকে মারি, সে সকল যন্ত্রণা হতে মুক্ত হয়, আর আমারও কিছু লাভ হয়। আমি বরং মানুষের উপকার করি—তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা পেতে দিই না। ক’সে এমন একটি ঘা লাঠী মাথায় মারলেম, অমনি অচৈতন্য হয়ে পড়লো, আর মলো— কোন যন্ত্রণাই আর পেতে হ’ল না। কিন্তু রোগে ম’লে কত যন্ত্রণা পেত, বল্ দেখি। প্রথমে ত রোগের নানা যন্ত্রণা, তারপরে আবার শ্বাসের যন্ত্রণা; বাপরে বাপরে—শ্বাসের সে ভয়ানক যন্ত্রণা কি চক্ষে দেখা যায়! আমি মানুষকে সেই নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে নিস্তার করি—শুধু মৃত্যুযন্ত্রণা কেন, সকল যন্ত্রণা থেকে চিরদিনের তরে নিস্তার করি। কজ্জলা, আমি কি মন্দ কৰ্ম্ম করি?
কজ্জলা। না—বড় সৎকর্ম্ম করিস! ছেলে রোজগার কোরে বুড়া বাপ, অন্ধ মাকে খাওয়ায়, এমন ছেলেকে তুই মেরে ফেলিস; ছোট ছোট নেড়ি-গেঁড়ি ছেলে-পিলে কষ্টে-সৃষ্টে মানুষ করছে, এমন স্ত্রী লোকের স্বামীকেও তুই ঠেঙ্গিয়ে মারিস—বড় সৎকর্ম্ম করিস।
রত্না। আর তারা যদি রোগেই মরত: তা হ’লে কার দোষ দিতিস? মনুষ্য জীবন যন্ত্রণাময়, আমার মতে মানব-বংশ যাতে শীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তাই করা উচিত।
কজ্জলা। সব মানুষ মরবে, আর তুই বেঁচে থাকবি? পোড়ারমুখো, তুই কেন মর না, দেশের আপদ-বালাই একেবারে ঘুচে যাক।
রত্না। পোড়ারমুখী, তোকে রেখে যে আমি কিছুতেই মরতে পারব না।
কজ্জলা। না হয়, আগে আমায় মার, তারপর আপনি মর।
রত্না। দাঁড়া, আগে দিনকতক তোকে নিয়ে ঘরকন্না করি, তারপর মনের সুখে মরব, নিশ্চয় মরব।
কজ্জলা। আমায় নিয়ে ঘর করবি, ডাকাতী ছাড়তে পারবি? পৈতে ফেলতে পারবি?
কজ্জলার এই কথায় রত্নার মুখমণ্ডল রাহুগ্রস্ত সূর্য্যের ন্যায় ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ধারণ করিল। তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল,—বলিল, “কি ডাকাতী ছাড়ব? আমি বাপের কুপুত্র, তা তুই জানিস?”
কজ্জলা। সে পরিচয় আর দিচ্ছিস কেন? আমি ত আগেই বলেছি, তোকে বিশ্বাস কি? তুই যদি ডাকাতী না ছাড়বি, পৈতে না ফেলবি, আমায় নিকা না করবি, তবে তুই আমার কে? প্ৰাণ থাকতে আমি ধৰ্ম্ম নষ্ট করব না।
রত্না। তোর ধৰ্ম্মটাই বড়, আর আমার ধৰ্ম্ম, ধৰ্ম্ম নয়, না? কি, একটা বাগদীর মেয়ের তরে আমি পৈতা ফেলব, ধর্ম্ম নষ্ট করব?
ক। ডাকাতের আবার ধর্ম্ম কিরে কালামুখো? তুই এইজন্য আমার কাছে মরতে আসিস – ফাঁকী দিয়ে আমার ধর্ম্ম নষ্ট করবি বলে, আমার কাছে আসিস?
রত্না। নে নে, রাখ, ছোট লোকের আবার ধর্ম্ম! বাগদীর মেয়ের আবার সতীত্বের ফড়ফড়ানী! ক। দেখ্ রতন, আমি বড় দুঃখিনী, আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিনি, তোর পায়ে পড়ি, তুই আমার ঘর থেকে যা।
রত্না। তবে একান্তই তোর বাঁচবার ইচ্ছা নাই?
ক। না, একটুও নাই, তুই আমার ঘর থেকে যা।
রত্নাপাখী কোন উত্তর না করিয়া ভীষণ গম্ভীর বদনে তথা হইতে প্রস্থান করিল। কজ্জলা কুটীরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া শয্যায় আসিয়া বসিল। বসিয়া মনে মনে বলিল, “মা, যখন এতদূর আসিয়াছি, আর ফিরিব না—যাহার জন্য সৰ্ব্বত্যাগিনী হইয়াছি, না হয়, তাহারই হাতে মরিব।”