একাদশ অধ্যায়—দেবীর বরদান

একাদশ অধ্যায়—দেবীর বরদান

ঋষি কহিলেন, দেবী সে‌ই মহাসুরেন্দ্র শুম্ভকে বিনাশ করিলে, ইন্দ্র ও বহ্নিপুরঃসর দেবগণ ইষ্টলাভে সফলমনোরথ হ‌ইয়া প্রফুল্ল বদনে সে‌ই কাত্যায়নী দেবীকে স্তব করিতে লাগিলেন। তখন দেবগণ বলিলেন, ১

হে শরণাগত-দুঃখহরে দেবি! প্রসন্না হও; হে অখিল-জগজ্জননি! প্রসন্না হও; হে বিশ্বেশ্বরি! প্রসন্না হও; তুমি বিশ্বকে রক্ষা কর। হে দেবি! তুমি‌ই চরাচর বিশ্বের ঈশ্বরী। ২

হে দেবি! তুমি জগতের অদ্বিতীয় আধারস্বরূপা; যেহেতু মহীস্বরূপে অবস্থিতি করিতেছ। হে দেবি! তুমি জলস্বরূপে অবস্থান করত এ‌ই সকল বিশ্বের তৃপ্তি সম্পাদন করিতেছ। দেবি! তোমার বীর্য্য অলঙ্ঘনীয়। ৩

হে দেবি! তুমি অনন্তবীর্য্যা বৈষ্ণবী-শক্তি, তুমি সংসারের হেতুভূতা পরমা মায়া; তুমি সমস্ত বিশ্বকে‌ই সম্মোহিত করিয়া রাখিয়াছ। হে দেবি! পৃথিবীতে তুমি‌ই প্রসন্না হ‌ইয়া মুক্তির হেতু হও। ৪

হে দেবি! সমস্ত বিদ্যা‌ই তোমার মূর্ত্তিবিশেষ; হে জননী! তুমি একা‌ই এ‌ই বিশ্ব ব্যাপিয়া রহিয়াছ। হে দেবি! অধিক আর কি বলিব, তুমি‌ই স্তব্যগণের শ্রেষ্ঠা। ৫

তুমি সর্ব্বভূতস্বরূপে বিদ্যমানা, তুমি স্বর্গ ও মুক্তিপ্রদান করিয়া থাক বলিয়া তোমার স্তব করি; কিন্তু দেবি! তোমার নির্গুণ ব্রহ্মস্বরূপের স্তব করিতে গেলে কোন্‌ উক্তি শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীর্ত্তিত হ‌ইবে? কিছু‌ই না। কারণ তোমার গুণ না‌ই, নির্গুণের গুণকীর্ত্তনরূপ স্তব কি প্রকারে সম্ভবে? ৬

তুমি বুদ্ধিরূপে সকলের হৃদয়ে অবস্থিতি করিতেছ! হে স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী! হে দেবি! হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৭

হে বিশ্ববিনাশসমর্থে! তুমি কলা ও কাষ্ঠাদিরূপে জগতের পরিণাম বিধান করিয়া থাক। হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৮

হে সর্ব্বমঙ্গল মাঙ্গল্যে (সমুদায় মঙ্গলস্বরূপা)! হে শিবে (পরমকল্যাণরূপিণী)! হে সর্ব্বার্থসাধিকে (সর্ব্বার্থসাধিনী)! হে শরণ্যে (সকলের রক্ষাকারিণী)! হে ত্র্যম্বিকে (ত্রিলোচনী)! হে গৌরি! হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৯

হে সনাতনি! হে গুণাশ্রয়ে! হে গুণময়ে! হে নারায়ণি! তুমি সৃষ্টি স্থিতি ও বিনাশের শক্তিস্বরূপা; তোমাকে নমস্কার। ১০

হে দেবি! হে নারায়ণি! তুমি শরণাগত দীন ও আর্ত্তজনগণের পরিত্রাণকারিণী এবং সকলের দুঃখহারিণী; তোমাকে নমস্কার। ১১

হে দেবি! নারায়ণি! তুমি ব্রহ্মাণীরূপে হংসযুক্ত বিমানে আরূঢ় হ‌ইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে কুশাভিমন্ত্রিত জল সেচন করিয়াছ; তোমাকে নমস্কার। ১২

হে নারায়ণি! তুমি মহেশ্বরীরূপে মহাবৃষভে আরোহণপূর্ব্বক অর্দ্ধচন্দ্র ও নাগভূষণে ভূষিত হ‌ইয়া ত্রিশূল ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৩

হে অনঘে (নিষ্পাপ)! হে নারায়ণি! তুমি কৌমারী রূপ ধারণপূর্ব্বক ময়ূর ও কুক্কুট (মোরগ বা মুরগি) গণে পরিবৃত হ‌ইয়া মহাশক্তি ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৪

হে নারায়ণি! তুমি বৈষ্ণবী শক্তিরূপে রণস্থলে শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গধনু (বিষ্ণুর ধনুক) রূপ মহাস্ত্রনিচয় ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। তুমি প্রসন্না হও। ১৫

হে শিবে! হে নারায়ণি! তুমি‌ই মহাবরাহরূপে জলমগ্না বসুন্ধরাকে পাতালতল হ‌ইতে উদ্ধৃত করিয়া প্রচণ্ড মহাচক্র ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৬

হে নারায়ণি! তুমি ভয়ঙ্কর নৃসিংহরূপে দৈত্যগণের বধে উদ্যত হ‌ইয়া ত্রৈলোক্য ত্রাণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৭

হে নারায়ণি! তুমি ঐন্দ্রীয় শক্তিরূপে কিরীটোদ্ভাসিত মৌলী (মুকুটধারী) ও সহস্রনয়ন-শোভিতা হ‌ইয়া মহাবজ্র ধারণপূর্ব্বক বৃত্রাসুরের প্রাণ সংহার করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৮

হে নারায়ণি! তুমি শিবদূতী স্বরূপে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করিয়া উৎকট নিনাদ (গর্জন) দ্বারা‌ই দৈত্যগণের মহতী সেনা বিনাশ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৯

হে নারায়ণি! তুমি দংষ্ট্রাকরালবদনা (বড় ও ভয়ঙ্কর দাঁত ও ভীতিজনক মুখবিশিষ্টা) চামুণ্ডারূপে শিরোমালা দ্বারা বিভূষিতা হ‌ইয়াছিলে এবং চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয়কে বিনাশ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ২০

হে নারায়ণি! তুমি লক্ষ্মী, লজ্জা, মহাবিদ্যা, শ্রদ্ধা, পুষ্টি, স্বধা, মহারাত্রি ও মোহরাত্রি-স্বরূপা; তুমি ধ্রুবা (নিত্যা); তোমাকে নমস্কার। ২১

হে নারায়ণি! তুমি‌ই মেধা, সরস্বতী, শ্রেষ্ঠা, বাভ্রবী (দুর্গা), ভূতি (বিভূতি, আটটি ঐশ্বর্য যথা অণিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিতা, বশিতা ও কামাবশায়িতা) ও তামসী; তোমাকে নমস্কার। ২২

হে নিয়তে! হে ঈশে! তুমি প্রসন্না হও। হে দেবি! তুমি সর্ব্বস্বরূপা, সকলের ঈশ্বরী এবং সর্ব্বশক্তিসমন্বিতা; অতএব আমাদিগকে ভয়সমূহ হ‌ইতে রক্ষা কর। হে দুর্গে! হে দেবি! তোমাকে নমস্কার। ২৩

হে কাত্যায়নী! তোমার এ‌ই লোচনত্রয়-ভূষিত সৌম্য বদন, সকল ভূত হ‌ইতে আমাদিগকে রক্ষা করুক; হে দেবি! তোমাকে নমস্কার। ২৪

হে ভদ্রকালী! তোমার এ‌ই যে ত্রিশূল স্বভাবত‌ই নিতান্ত প্রচণ্ড; তাহার উপর আবার শিখাসমূহ সমুদ্গত হওয়াতে, আরও ভয়ঙ্কর হ‌ইয়াছে; তুমি ইহা দ্বারা অশেষ অসুর সংহার করিয়াছ। এ‌ই ত্রিশূল আমাদিগকে ভয় হ‌ইতে রক্ষা করুক; তোমাকে নমস্কার। ২৫

শব্দ দ্বারা সমুদয় জগৎ আপূরণপূর্ব্বক যে ঘন্টা দৈত্যতেজঃসমূহের বিনাশ করে, তোমার সে‌ই ঘন্টা পুত্রের ন্যায় আমাদিগকে প্রতিকূল জন হ‌ইতে রক্ষা করুক; হে চণ্ডিকে! আমরা তোমাকে নমস্কার করি। ২৬

অসুরসমূহের রক্ত ও বসারূপ (মেদরূপ) পঙ্ক দ্বারা চর্চ্চিত ত্বদীয় হস্তশোভন খড়্গ আমাদিগের মঙ্গল করুক! ২৭

হে দেবি! তুমি তুষ্টা হ‌ইয়া অশেষ রোগ সকল বিনাশ কর এবং রুষ্টা হ‌ইলে সকল অভিলষিত প্রিয় অপহরণ কর। হে দেবি! তোমার আশ্রিত মনুষ্যগণের বিপদ্‌ থাকে না এবং তোমাকে যাহারা আশ্রয় করে, তাহারা সকলের আশ্রয়স্বরূপ হয়। ২৮

হে দেবি অম্বিকে! তুমি নানারূপে বহুপ্রকার মূর্ত্তি ধারণ করিয়া ধর্ম্মদ্বেষ্টা মহাসুরগণকে এ‌ই প্রকার যে বিনাশ করিলে, ইহা আর কে করিতে পারে? ২৯

হে দেবি! তোমা ব্যতিরেকে আর কোন্‌ ব্যক্তি এ‌ই বিশ্বকে বিদ্যাসমূহে, শাস্ত্রসমূহে, বিবেকপ্রদীপে, আদ্যবাক্যসমূহে (বেদাদিগ্রন্থে) অথবা অতি মহান্ধকারে মমত্ব-গর্ত্তে ভ্রমণ করা‌ইতে পারে? ৩০

হে দেবি! যেখানে রাক্ষসগণ, যেখানে সর্পগণ, যেখানে শত্রুবর্গ, যেখানে দস্যুবল সমূহ ও যেখানে দাবানল, তুমি সে‌ইখানে সে‌ইখানে‌ই এবং সমুদ্র মধ্যে অবস্থিতি করিয়া বিশ্বকে রক্ষা করিতেছ। ৩১

হে দেবি! তুমি বিশ্বেশ্বরী; যেহেতু এ‌ই বিশ্বকে রক্ষা করিতেছ। তুমি বিশ্বাত্মিকা; যেহেতু এ‌ই বিশ্বকে ধারণ করিয়া রহিয়াছ। হে দেবি! তুমি বিশ্বেশ্বরগণেরও বন্দনীয়া; কারণ যে ব্রহ্মাদি দেবগণ বিশ্বের আশ্রয়, তাঁহারাও তোমার প্রতি ভক্তি-নম্র হ‌ইতেছেন এবং যে সকল জন তোমার প্রতি ভক্তি-নম্র হন, তাঁহারও বিশ্বের আশ্রয় হন। ৩২

হে দেবি! প্রসন্না হও; যেমন অসুর বধ দ্বারা এক্ষণে রক্ষা করিলে, সে‌ইরূপ আমাদিগকে অরিভয় (শত্রুভয়) হ‌ইতে সর্ব্বদা রক্ষা কর! হে দেবি! এ‌ই রূপে সদ্যঃ সকল জগতের পাপগণ ও উৎপাতপরিণাম-জনিত মহোপসর্গ (উল্কাপাত প্রভৃতি) সকলকে প্রশান্ত কর। ৩৩

হে বিশ্বার্ত্তিহারিণী (বিশ্বের যাবতীয় দুঃখ সন্তাপ যিনি হরণ করিয়া থাকেন) দেবি! প্রণত ব্যক্তিগণের প্রতি প্রসন্ন হও। হে ত্রৈলোক্যবাসিনী -পূজনীয়ে! লোকসমূহের বরদা হও (লোকেদের বরদান কর)। ৩৪

দেবী কহিলেন, হে সুরগণ (দেবগণ)! আমি বরদা (সকলকে বরদান করা‌ই আমার স্বভাব); তোমরা ত্রিজগতের উপকারক যে বর মনে মনে ইচ্ছা কর, তাহা আমার নিকট যাচ্ঞা (প্রার্থনা) কর; আমি তাহা প্রদান করিব। দেবগণ কহিলেন, হে অখিলেশ্বরী (বিশ্বের ঈশ্বরী)! ত্রৈলোক্যের সর্ব্বপ্রকার বিঘ্নের প্রশান্তি কর এবং এ‌ইরূপে আমাদিগের শত্রুসমূহকে বিনাশ করিও—এ‌ই আমাদের বর। ৩৫–৩৬

দেবী কহিলেন, সপ্তম মন্বন্তরে অষ্টাবিংশতিসংখ্যক যুগে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে অন্য মহাসুরদ্বয় জন্মগ্রহণ করিবে; তখন আমি নন্দগোপগৃহে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণপূর্ব্বক বিন্ধ্যাচলবাসিনী হ‌ইয়া তাহাদিগকেও বিনাশ করিব। পুনর্ব্বার পৃথিবীতলে অতি ভয়ঙ্কররূপে অবতীর্ণ হ‌ইয়া আমি বিপ্রচিত্তি দানবের বংশসম্ভূত বৈপ্রচিত্ত নামক দানবগণকে বিনাশ করিব। সে‌ই বৈপ্রচিত্ত নামে উগ্র অসুরগণের ভক্ষণকালে আমার দন্ত-সমূহ দাড়িমী-কুসুম (ডালিম গাছের ফুল) সদৃশ রক্তবর্ণ হ‌ইবে। অনন্তর স্বর্গে দেবতাগণ ও মর্ত্ত্যে মানবগণ স্তবকালে সতত আমাকে “রক্তদন্তিকা” বলিয়া কীর্ত্তন করিবে। পুনর্ব্বার শতবার্ষিকী অনাবৃষ্টি দ্বারা জগৎ জলশূন্য হ‌ইলে মুনিগণ কর্ত্তৃক সংস্তুতা (যার স্তব বা মহিমাকীর্ত্তন করা হয়েছে এমন) হ‌ইয়া আমি অযোনিজারূপে উৎপন্ন হ‌ইব। তখন আমি শতনেত্র দ্বারা মুনিগণকে নিরীক্ষণ করিব; সে‌ইজন্য মানবগণ আমাকে “শতাক্ষী” বলিয়া কীর্ত্তন করিবে। ৩৭–৪৩

তৎপরে যতদিন বৃষ্টি না হ‌ইবে, ততদিন হে সুরগণ! স্বকীয় দেহ হ‌ইতে সমুৎপন্ন প্রাণধারক শাক দ্বারা অখিল লোককে পোষণ করিব। এ‌ইজন্য পৃথিবীতে আমি “শাকম্ভরী” নামে বিখ্যাতি লাভ করিব এবং সে‌ই অনাবৃষ্টিকালে দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করিব। তখন আমার “দুর্গাদেবী” এ‌ই বিখ্যাত নাম হ‌ইবে। পুনর্ব্বার যখন আমি মুনিদিগকে রক্ষার জন্য হিমালয়ে ভীমরূপ (ভয়াবহ রূপ) ধারণ করিয়া রাক্ষসগণকে বিনাশ করিব, তৎকালে সকল মুনিগণ নম্রমূর্ত্তি হ‌ইয়া আমাকে স্তব করিবেন এবং আমার “ভীমাদেবী” এ‌ই নাম বিখ্যাত হ‌ইবে। যৎকালে অরুণ নামে মহাসুর ত্রৈলোক্যে মহা বাধা করিবে, তৎকালে আমি অসংখ্যেয় ষট্‌পদসমন্বিত ভ্রামররূপ (অসংখ্য ছয় পা বিশিষ্ট ভ্রমরমূর্ত্তি) ধারণ করিয়া ত্রৈলোক্যের মঙ্গলের জন্য সে‌ই অসুরকে বধ করিব; এ‌ইজন্য লোকসমূহ চতুর্দ্দিক্‌ হ‌ইতে আমাকে “ভ্রামরী” বলিয়া স্তব করিতে থাকিবে। এ‌ই প্রকার যখন যখন দানব-সমুত্থিত বাধা উপস্থিত হ‌ইবে, তখন তখন‌ই অবতীর্ণ হ‌ইয়া শত্রু বিনাশ করিব। ৪৪–৫০

একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত॥১১॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *