একাদশ অধ্যায় – কৌশলগত নীতি প্রণয়ন
সীমিত সম্পদের মধ্যে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে মাকাসিদ অর্জন করা সম্ভব হবে না, যদি না তারা চাহিদা ও সম্পদের তালিকা মিলিয়ে দেখে এবং তাদের অনুধাবন করতে হবে যে, তারা কোথায় আছে এবং তারা কোথায় যেতে চায়। এটা অধিকতর কার্যকরভাবে করা সম্ভব, যদি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত নীতি প্রণয়ন করা হয়। এরূপ পরিকল্পনা প্রণীত হলে রাষ্ট্রের পক্ষে লভ্য ভৌত ও মানবসম্পদ বিবেচনায় আনা সম্ভব হবে এবং এ আলোকে সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকার প্রস্তুত করাও সম্ভব হবে। এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের পূর্ণ অবদানকে কাজে লাগানোর স্বার্থে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত ও প্রতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে সরকারকে নীতি নির্ধারণ, ব্যয় কর্মসূচি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।
এরূপ কৌশলে পরিকল্পনা ব্যাপকভিত্তিক হবে না এবং রেখাচিত্রের গোলকধাঁধায় আবদ্ধ, বিধিগত নিয়ন্ত্রণ, সকল ইনপুট ও আউটপুটের মধ্যের ভারসাম্য বিধানের এবং অর্থনীতির ব্যষ্টিক পর্যায়ে তার বরাদ্দ নিয়েও সাফল্য লাভের চেষ্টা হবে না। পরিকল্পনায় একমাত্র সরকারকেই বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনায় আনা হবে না। এটা সম্ভবও নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। এরূপ পথে অগ্রসর হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি অর্থনীতিতে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও শিল্পোদ্যোগকে রুদ্ধ করে দেবে এবং এরকম পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে সমাজতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে সংঘাত ও সংকট দেখা দিয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। মুসলিম দেশগুলোর জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ছাঁকনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদের উপর দাবি প্রতিষ্ঠা এবং মাকাসিদ হাসিলের লক্ষ্যে সীমিত সম্পদের সর্বাধিক দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহারের জন্য নৈতিক ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার তথা অর্থনৈতিক উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ ও সক্রিয় করা।
ইসলামের ছাঁকনি প্রক্রিয়ার বাস্তব রূপদানের বিষয়টি একান্তই অপরিহার্য। এর ফলে অর্থনীতির অগ্রাধিকারভিত্তিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা অর্জনের উপায় নিরূপণে সহায়ক হবে। শরীয়াহর কাঠামোর আওতায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হলে তা বিদ্যমান সম্পদ বরাদ্দের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ এবং পরিবর্তনের খুঁটিনাটি দিকগুলো চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে। এছাড়াও প্রয়োজন হবে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ এবং কর্মের নৈতিকতার রূপায়ণ এবং এসবের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা কর্মসূচি তৈরি করা। এ পরিকল্পনায় পণ্য ও সেবাকে তিনটি শ্রেণী-প্রয়োজন, বিলাস ও মধ্যম পর্যায় হিসেবে বিভক্ত করতে হবে যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।
জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদেরকে ইসলামি মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন হবে। যেখানে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন, সেখানে তাদেরকে এজন্য উদ্বুদ্ধ করা ও অধিকতর দক্ষ হতে বলাটাই যথেষ্ঠ নয়। এজন্য আর্থ-সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারী, শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও সঞ্চয়কারী যিনি যেখানে আউটপুটের ক্ষেত্রে অবদান রাখবেন, তাকে তার প্রাপ্য পুরস্কার দিতে হবে। যদিও মূল্য ও মজুরি স্বাভাবিক অবস্থায় বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেখানে সম্পদ ও ক্ষমতা কতিপয় হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে এবং তারা একচেটিয়া বা একচেটিয়াধর্মী বাজারের বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটায়, সেখানে এ ব্যবস্থাটি সঠিক নয়। সুতরাং তারা জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে তাদের চালনা শক্তি, উদ্যোগ, সৃজনশীলতা ও শিল্পোদ্যোগকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখছে। পরিকল্পনায় বিদ্যমান এ সকল অবিচারমূলক ব্যবস্থা দূর করার জন্য নীতি ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের নির্দেশনা থাকতে হবে।
পরিকল্পনায় সামষ্টিক অর্থনীতি ও বহিঃভারসাম্যহীনতা না ঘটিয়ে অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব হ্রাস ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এ ধরণের পরিকল্পনায় আরো থাকতে হবে বিদ্যমান আয় ও সম্পদের মধ্যকার বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার জন্য প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা সংস্কার কর্মসূচি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপকভিত্তিক মালিকানা পদ্ধতি ও আয়বর্ধক সম্পদ। ইসলামী আদর্শের আলোকে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের জন্য পরিকল্পনাবিদদের বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন হবে, কারণ সম্পদের সুদক্ষ ও সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ছাত্রদেরকে ভালো মুসলমান ও অধিকতর উৎপাদনমুথী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার আনার প্রয়োজন হবে। মোটকথা, পরিকল্পনা বিশেষ কোনো একটি পদক্ষেপের প্রতি কেন্দ্রীভূত হবে না এবং যা অবৈধ নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করবে না। বরং মাকাসিদ অর্জনের জন্য সুবিস্তৃত নীতি ও উদ্যোগ কাজে লাগাতে হবে। এতে উন্নয়ন দর্শন ও কৌশলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। সকল নীতি অর্থ, মুদ্রা, আয়, আমদানি ও উৎপাদন এই কৌশলগত নীতির কাঠামোর আওতায় তৈরি করতে হবে। উৎপাদন, আমদানি, বণ্টন ও ভোগ সংক্রান্ত বিষয়াদি যা কিছুই কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে খাপ খায়, তাকেই আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত মূল্যব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালনার অনুমতি দিতে হবে। চলতি হিসাব পরিচালনায় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারসহ নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র ততটুকু ও ততক্ষণে হবে যতক্ষণ তা অপরিহার্য। সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরোপের নীতি বস্তুগত পারিতোষিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করবে, উন্নয়নের জন্য জনগণের নিজস্ব চালিকাশক্তিকে উজ্জীবিত করবে এবং তা শুধু দুর্নীতি হ্রাস ও অধিকতর দক্ষতাই বৃদ্ধি করবে না, বরং উদ্ভাবন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতেও সহায়ক হবে। অবশ্য ব্যক্তি ধনী বা সম্পদশালী হোক বা নাহোক যা পরিকল্পনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় তার অনুমতি দেয়া যাবে না। কোনো নীতিগত পদক্ষেপ দরিদ্রের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেললে বিশেষ বিবেচনায় এনে উক্ত নীতি সংশোধন করতে হবে এবং তার সাথে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কোনো দেশের সম্পদের পরিপ্রেক্ষিত, চাহিদা ও লক্ষ্য ঘন ঘন পরিবর্তিত হয় না বিধায় নীতির ক্ষেত্রেও ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে তা পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। বারবার নীতির পরিবর্তন করা হলে কেবল অনিশ্চয়তাই বাড়ে এবং এর ফলে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদেরকেই তা সুবিধা এনে দেয়। তবে পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি দখো গেলে তা অবিলম্বে মুক্ত মন নিয়ে সংশোধন করা উচিত। যেহেতু মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ বিভিন্ন ধরনের বলে তাদের মাকাসিদ হাসিলের লক্ষ্য এক হলেও কৌশলগত নীতি পরিকল্পনাও একই রকম হবে এমন কোনো কথা নেই।
যদি সরকার শরীয়াহ থেকে প্রেরণা লাভ না করে এবং বিশেষ কোনো শ্রেণীর পরিবর্তে জনগণের কল্যাণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়, তাহলে এটা প্রত্যাশা করা অবাস্তব হবে যে, সরকার নিজেই এরূপ কৌশলগত নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আগ্রহী হবে। সরকার নিজেই যদি বৈধ না হয় তাহলে তার পক্ষে এটা সম্ভব নয় অর্থাৎ সরকারকে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে এবং সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং মুসলিম দেশগুলোর সকল সংস্কারের মূল কথা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কার। এরূপ সংস্কার ছাড়া ইসলামের আদর্শ ও মুসলিম বিশ্বের বিরাজমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যদি তারা অনুসরণ করে, তাহলে অন্তত একধাপ অগ্রসর হতে পারবে যা সম্পদ ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে করে থাকে।