একসঙ্গে থাকা

একসঙ্গে থাকা

কানপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে যখন সময় কাটছে না তখন ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। মধ্যবয়সি, হাতে সুটকেস, পিছনে কাছাকাছি বয়সের সুন্দরী মহিলা, যার চোখ রঙিন চশমায় ঢাকা। ভিতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে আমার কাছাকাছি চেয়ারে বসলেন। কিছু সুন্দরী আছেন যাঁদের উগ্রতা একটা সীমার মধ্যে থাকে, একটু ঘরোয়া বলে মনে হয়। এই মহিলা তেমনি। ভদ্রলোকের মাথায় দ্রুত টাক পড়ছে। বোঝা যায় বছর দেড়েকের মধ্যে সবটাই টাক হয়ে যাবে। শরীর বলছে নিয়মিত ব্যায়াম করেন। আমার দিকে তাকিয়ে যেভাবে হাসলেন তাতে বুঝলাম ওঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়নি। আমি মাথা নাড়লাম।

ওয়েটিং রুমে একটু আগে ভিড় ছিল। দিল্লির ট্রেনটা এসে সেই ভিড় হালকা করে দিয়েছে। কলকাতার ট্রেন আসবে ঘণ্টা দুয়েক পরে। এখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে। এই সময়টা চেয়ারে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে ইচ্ছে করছিল না।

হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, ‘এক্সকিউজ মি, আর ইউ বেঙ্গলি?’

‘হ্যাঁ’, বললাম।

‘বাঃ। ভালো হল। আপনার কাছে দেশলাই আছে?’

এটা সেই সময়ের কথা যখন আমি ধূমপান করতাম। অতএব পকেট থেকে দেশলাই বের করে ওঁকে দিলাম। দিয়ে অবাক হলাম। কারণ তিনি দেশলাইটা সুন্দরীর হাতে দিয়ে দিলেন। সুন্দরী আমার দিকে তাকিয়ে যেভাবে মাথা নাড়লেন তাতে মনে হল ধন্যবাদ বললেন। তারপর গলা তুলে বললেন, ‘আমি যদি এখানে স্মোক করি তাহলে কেউ যদি আপত্তি করেন তো বলতে পারেন।’ আশপাশে বসা যাত্রীদের কেউ কেউ তাকালেন, কিছু বললেন না। দেখলাম একটা দামি প্যাকেট ব্যাগ থেকে বের করে তা থেকে সিগারেট তুলে ঠোঁটে রাখলেন সুন্দরী। দেশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে সিগারেট জ্বালালেন কিন্তু দেশলাইটা ফেরত দিলেন না। একটা উদ্ধত ভঙ্গি এখন ওঁর মধ্যে যা আমার খারাপ লাগল না।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি নিখিল মিত্র, ইনি আমার স্ত্রী সুদর্শনা। কলকাতায় ফিরছি। আপনি?’

আমার নাম ভদ্রলোক বোধহয় প্রথম শুনলেন। কলকাতায় যাচ্ছি জেনে বললেন, ‘সমস্যা একটাই। আমরা টু টায়ারের দুটো আপার বার্থ পেয়েছি। যারা নীচের বার্থ পেয়েছে তাদের একজন কি উপরে উঠে ওকে জায়গা ছেড়ে দেবে?’

‘অনুরোধে লোকে তো ঢেঁকিও গেলে। অনুরোধ করবেন’ জবাব দিলাম।

‘আপনার বার্থ—?’

‘লোয়ার।’

‘বাঃ, লাকি লোক।’ ভদ্রলোক বলামাত্র সুন্দরী চাপা গলায় বললেন, ‘নিখিল?’

‘অ্যাঁ, হ্যাঁ’ ট্রেনে উঠে শুরু করলে বোধহয় ভালো হত। ভদ্রলোক বললেন।

‘আপার বার্থে বসে? তাছাড়া কোনটা ভালো তা তোমার থেকে আমি ভালো জানি।’

সুন্দরী গম্ভীর মুখে সিগারেটে টান দিলেন।

এবার নিখিলবাবু ভদ্রমহিলার সাইড ব্যাগ থেকে একটা সাদা বোতল বের করে এগিয়ে দিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল বোতলে পরিসুদ্ধ জল রয়েছে।

সুন্দরী বোতলের ছিপি খুলে একঢোক গলায় ঢেলে সিগারেট নেভালেন। নিখিলবাবু বললেন, ‘আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আপনি?’

‘খবরের কাগজে আছি। অর্ধসত্য বললাম।’

‘সময় পেলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। সুদর্শনার খুব বেড়ানোর শখ। পুরো ইউরোপ ঘোরা হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় থাকেন কোথায়?’ নিখিলবাবু গল্প করছিলেন।

‘ভবানীপুরে।’

‘আমরা নিউ আলিপুরে। সুদর্শনা ভিড়ের মধ্যে থাকতে পারে না।’

‘ও।’

দেখলাম ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সুন্দরী খালি বোতলটা নিখিলবাবুর হাতে ধরিয়ে দিলেন। নিখিলবাবু সেটাকে নিয়ে চলে গেলেন টয়লেটে। ফিরে এলেন খালি হাতে। সুন্দরী এবার দ্বিতীয় সিগারেট যখন ধরলেন তখন লক্ষ করলাম তাঁর হাত কাঁপছে। কাঠির আগুন নেভাতে সময় নিলেন।

ট্রেন আসছে ঘোষণা হতেই সবাই দরজার দিকে ছুটল। নিখিলবাবু আর তাঁর স্ত্রীকে পিছনে রেখে আমি প্ল্যাটফর্মে এসে কুলিকে জিজ্ঞাসা করে কামরার হদিশ পেয়ে গেলাম। তখনই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেল। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম কিন্তু নিখিলবাবুর গলা শুনতে পেলাম, ‘একটু হেল্প করবেন।’

ট্রেনে উঠে ওঁদের সুটকেস উপরে তুলে নিলাম। নিখিলবাবু খুব যত্ন করে ভদ্রমহিলাকে উপরে তুললেন। আমার লোয়ার বার্থ ফাঁকা। দখল নিলাম। কিন্তু তখনই ওঁরা পৌঁছে গেলেন। নিখিলবাবু বললেন, ‘সুদর্শনা ডিনার করে উপরের বার্থে উঠবে। ততক্ষণ আপনার এই লোয়ার বার্থে বসতে পারে?’

‘নিশ্চয়ই।’ বলে জানালার কাছে সরে গেলাম। ওঁরা বসলেন।

সুদর্শনার যে নেশা ভালোমতো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বোতলে হয় জিন নয় ভদকা ছিল। কিন্তু তিনি কথা বলছেন না। শান্ত হয়ে বসে আছেন। ট্রেন ছাড়ল। খানিকবাদে সুদর্শনা বললেন, ‘আমি এই বার্থে শোব।’

চমকে উঠলাম। আমার পায়ে ব্যথা, উপরে ওঠা সম্ভব নয়। নিখিলবাবু বললেন, ‘এটা ওঁর বার্থ। তুমি কষ্ট করে উপরে উঠে ঘুমিয়ে পড়লেই হাওড়া এসে যাবে।’

‘ইম্পসিবল। আমি কেন কষ্ট করব? নো। আর নয়।’ সুদর্শনা দুলছিলেন।

‘টিকিটের ক্রাইসিস, বুঝতে চেষ্টা করো—!’

‘ভাঁড়মে যাক তোমার ক্রাইসিস।’ সুদর্শনা সোজা হলেন, ‘ওকে! আমি দেখছি কোথাও লোয়ার বার্থ খালি আছে কিনা!’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

নিখিলবাবু বললেন, ‘তুমি বসো, আমি দেখে আসছি।’

‘খবরদার। তুমি যাবে না। আমাকে আমার জায়গা খুঁজতে দাও।’ প্রায় টলতে টলতে সুদর্শনা কামরার প্যাসেজ দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

নিখিলবাবু বললেন, ‘কী হবে!’

বললাম, ‘আপনি সঙ্গে যান। পাবলিক প্রতিবাদ করতে পারে।’

‘আমাকে দেখলে আরও খেপে যেতে পারে। বাড়িতে ও এই অবস্থায় গেলে আমি চোখের আড়ালে থাকি। প্লিজ, আপনি যান, এই হেল্পটুকু করুন।’

ভদ্রলোককেই আমার অসহায় বলে মনে হল। অগত্যা উঠলাম।

দু—পাশের যাত্রীরা তখন রাতের খাওয়া শেষ করছেন। আমি দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত এসে কোথাও সুদর্শনাকে পেলাম না। ভাবলাম টয়লেটে গিয়েছেন। কিন্তু টয়লেট খালি। করিডর দিয়ে পাশের কামরায় যেতেই চমকে উঠলেন। হু হু গতিতে ট্রেন ছুটছে আর দরজা খুলে হ্যান্ডেল ধরে টলছেন সুদর্শনা। তাঁর পিছনটা আমি দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন না তো! কথা বললেই যদি চমকে ওঠেন আর ব্যালান্স হারান তাহলে তাঁর শরীর আর চেনা যাবে না। কী করব? পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে আসব?

এইসময় তিনি পিছনে তাকালেন। বললেন, ‘ও, আপনি!

‘ওখান থেকে সরে আসুন। প্লিজ!’

‘কেন? সরে আসব কেন?’

‘অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে!’

‘আমার জীবনে কতবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তার খবর জানেন?’

‘না। এবার হলে আমার খুব খারাপ লাগবে।’

‘তাই! আচ্ছা, নিখিল আপনাকে পাঠিয়েছে তো! বলুন?’

সত্যি বললে যদি বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাই মিথ্যে বললাম, ‘না।’

‘কার সঙ্গে আছি, দেখুন। মেরুদণ্ডহীন, ভোঁদা মানুষ। বউকে সিগারেট, মদ এনে দেয়। কোনো পার্সোনালিটি নেই। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন।’ সুদর্শনা ঠোঁট বেঁকাল। ‘ইভন, এই যে আপনি, আপনার নাম বললেন, শুনে ওর কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। ওর কাছে আপনার আর একটা কালোয়ারের নামের কোনো পার্থক্য নেই। এইরকম লোকের সঙ্গে থাকা যায়? আপনি বলুন? আঃ, বলছেন না কেন? কত গল্প কত উপন্যাস লিখেছেন, আপনি সব জানেন। তা সত্ত্বেও আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’ সুদর্শনা দরজা ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এল টলতে টলতে।

আমি হতভম্ব। তাহলে এই ভদ্রমহিলা আমাকে অনেকক্ষণ আগেই চিনতে পেরেছিলেন? কিন্তু বোঝাননি। তার মানে, ইনি বাংল গল্প উপন্যাস পড়েন?

হাত নাড়লেন মহিলা, ‘ওর মা, ওর মায়ের জন্য, যখন সময় ছিল তখন ডিভোর্স নিতে পারিনি। হাত ধরে কান্নাকাটি করে আমার জীবনটাকে নষ্ট করে গেছেন মহিলা। এখন আর সময় নেই।’ সুদর্শনা একটু থামলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি এখানে কেন এলেন বলুন তো! না এলে, না এলে—!’

বললাম, ‘চলুন। আপনি আমার বার্থে ঘুমোবেন। আমি আপার বার্থে যাব।’ সুদর্শনাকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে গেলাম আমার বার্থে। নিখিলবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘থ্যাংক ইউ।’

হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে ওঁদের হেঁটে যেতে দেখলাম। পাশাপাশি। গত রাতের ছায়া বিন্দুমাত্র নেই। রঙিন চশমা পরে সুদর্শনা হাঁটছেন নিখিলবাবুর পাশে। চমৎকার সুখী দম্পতির মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *