একলা এবং একা
অনন্যার ফ্ল্যাটে শুধু টিভি কথা বলে। কাজের লোক লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা হয় ছুটির দিন। লক্ষ্মীদির কাছে চাবি দেওয়া আছে। রোজ বিকেলে এসে কাজ সেরে যায়। খুবই বিশ্বাসী, ভরসা করা যায় চোখ বুজে।
স্বপ্নে অনেক লোকজন আসে, ঘুম থেকে ওঠার পর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে অনন্যার। তাই সকাল থেকেই টিভি চালিয়ে দিয়ে চা খাওয়া, নিউজপেপারে চোখ বোলানো, অফিসের জন্যে তৈরি হতে থাকে। আজ রেডি হয়ে গিয়েছিল। অভ্যেসমতো শেষবার আয়নার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে ভাঁজ পড়ল অনন্যার কপালে। সালোয়ার কামিজ না পরে গেলেই ভাল হয় আজ। ছুটির পর যেখানে যাবে, ড্রেসটা উপযুক্ত হবে না। বরং কাজটা পণ্ড হতে পারে। এমনিতেই অনন্যার চেহারায় কেজো, কঠিন ভাব আছে। যেটাকে সন্দীপন ভাল ভাষায় চোখা বলত। বিয়ের প্রথম বছর দুয়েক সন্দীপনের অনুযোগ ছিল, একেই তুমি শার্প লুকিং, তার ওপর সালোয়ার কামিজ, জিন্স ফিস পরলে, মাইরি আমি ভেবলে যাই। ইনফিউরিটি কমপ্লেক্সে ভুগি। বস, বিয়ের আগে যা পরেছ, প্রেমিকা হিসেবে সেটা আমার পাশে মানিয়ে যায়। এখন শাড়িটাড়ি পরে তোমাকে বউ হিসেবে ভাবতে দাও। এতে যদি তুমি আমাকে পিউরিটান বলে গালাগালি করো, মাথা পেতে নিতে রাজি।
সন্দীপনের আবদার রাখতে অনন্যা তখন বেশিরভাগ দিনই শাড়ি পরত। অফিস যাতায়াতের জন্যে যা যথেষ্ট আনকমফর্টেবল। তারপর সন্দীপনও চলে গেল ফ্ল্যাট ছেড়ে। অনন্যা আবার সালোয়ার কামিজে ফিরে এসেছে। জিন্সের পক্ষে ফিগারটা এখন ভারী, বয়েসও বাড়ছে, তাই পরে না। কিন্তু আজ বোধহয় শাড়ি পরে যাওয়াই ঠিক হবে। খুব গর্জাস কিছু নয়। এমনি, চলনসই গোছের।
সাড়ে নটার মেট্রোটা ধরতে পারবে না জেনেও, ড্রেস বদলানোর সিদ্ধান্ত নিল অনন্যা।
একটা সাপ্তাহিক বাংলা ম্যাগাজিনের সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব অনন্যার। প্রচুর ওয়র্কলোড নিতে পারে। ফলশ্রুতিতে ওর টেবিলে সবসময় কাজ। ড্রেস বদলানোর কারণে আজ অফিসে ঢুকতে পাক্কা কুড়ি মিনিট লেট। এসেই ডুবে গেছে কাজে। শাড়ি পরিহিতা অনন্যাকে দেখে সহকর্মীদের দৃষ্টি হোঁচট খেয়েছে। পুরনোরা তাকে বহুদিন পর এই ড্রেসে দেখল। নতুনরা তো দেখেইনি। তাই তো আঁখি বলে উঠেছিল, হাউ সুইট! অনন্যাদি, শাড়ি পরে কী দারুণ লাগছে তোমাকে! অফিসের পর কোনও পার্টিতে যাবে নাকি গো?— কথা
শেষ করে একটু থমকে রইল আঁখি। ফের বলল, কিন্তু শাড়িটা ঠিক পার্টিটাইপ নয়। কী ব্যাপার বলো তো, কোনও সভাটভা আছে নাকি?
ঠিক ধরেছিস। শোকসভা। বলেছিল অনন্যা। নতুন মেয়ে আঁখির মুখটা খানিক অপ্রস্তুত হয়ে নিভে গেল। পরক্ষণেই খারাপ লেগেছিল অনন্যার, শোকসভা না বলে সাহিত্যসভা বলা যেতে পারত। একসময় অফিস থেকে বেরিয়ে সাহিত্যের আসরে যেত অনন্যা। সন্দীপনও থাকত কোনও কোনও দিন। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার কারণেই এই চাকরি। পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কাজের চাপও বেড়েছে। পত্রিকার সাহিত্যের পাতা অনন্যাকেই দেখতে হয়। কিন্তু ওইসব পরিবেশে আর যাওয়া হয় না। অন্য একটা বিপদও আছে, যেহেতু নামী পত্রিকায় চাকরি করে, লেখক যশঃপ্রার্থীরা বোকা বোকা পদ্ধতিতে তেল মারে তাকে। যা একেবারে অসহ্য।
কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে টাইপ করতে গিয়ে, ওড়নাটা পিঠের দিকে ঠেলে দেওয়া অনন্যার মুদ্রাদোষ। শাড়ি পরেও সেটা করে ফেলল। হাসি চলে এল ঠোঁটের কোণে, সবই অভ্যেস।
অফিসের একজন অনন্যাকে শাড়ি পরে আসতে দেখে অবাক হয়নি। চোখের ইঙ্গিতে বিবেচনাটাকে সমর্থন করেছে। দীপা, অফিসে অনন্যার থেকে জুনিয়র, বয়েসেও। ওর সঙ্গেই ছুটির পর একটা জায়গায় যাওয়ার কথা। সেখানে শাড়ি পরে যাওয়ার নির্দিষ্ট যুক্তি আছে। দীপা সেটা ঠিকঠাক না বুঝেই ইশারায় সমর্থন জানাল। খুবই সাধারণ বুদ্ধির মেয়ে। সেই কারণেই দীপার সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি অনন্যার। অথচ এই দীপাই কত সহজে অনন্যাকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলল। ভবিষ্যৎ, ভাগ্য, হাত দেখা, কপাল দেখা… এসব অনন্যার আশৈশব পরিবেশের মধ্যে ছিল না। ঠাকুরদার ঠিকুজি কুষ্ঠির বাতিক ছিল। বাবার একেবারেই নয়। সন্দীপনকে বিয়ে করার সময় মা একবার ওইসব প্রসঙ্গ তুলতে গিয়েছিল। বাবা ধমকে থামিয়ে দিয়েছে। মা তখন মিনমিন করে বলেছিল, বিশ্বাস না করো, দেখিয়ে নিতে ক্ষতি কী? সবাই তো দেখায়।
কথাটার আদৌ কোনও মানে দাঁড়াচ্ছে না দেখে খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল অনন্যা। অসহায় অভিমান ফুটে উঠেছিল মায়ের মুখে, ঠিক আছে। তোমরা যা ভাল বোঝো করো।— বলে সরে গিয়েছিল সামনে থেকে।
বিয়েটা সুখের হল না অনন্যার। চার বছর একসঙ্গে কাটানোর পর আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিল সন্দীপন। সেও প্রায় দুবছর হতে চলল। তার মানে এই নয় যে, অনন্যা মনে করে, বিয়ের আগে ঠিকুজি কুষ্ঠি না মিলিয়ে ভুল হয়েছে। ওতেই লেখা ছিল ভবিতব্য। মা-ও ভুলে গেছে ওইসব প্রসঙ্গ। এখন মায়ের ভূমিকা বরং অনেক বোল্ড অ্যান্ড ডেসপারেট। বলে, খবরদার সন্দীপনকে ডিভোর্স দিবি না। ও যেমন একটা মেয়েকে নিয়ে আছে, তুইও কোনও ছেলেকে নিয়ে থাক। তখন বুঝবে ঠ্যালা!
এইসব শুনে বাবা আহত গলায় বলে, কী যা তা বলছ মনীষা! আমি মেয়েকে সেই শিক্ষায় মানুষ করিনি।
অনন্যা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মেয়ের বিয়ের এই পরিণতির ফলে বাবার বয়েসটা
যেন হঠাৎ করে পাঁচ বছর বেড়ে গেল। ব্যক্তিত্বটাই কেমন পালটে গেছে! মাথা উঁচু করে চলা, ন্যায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, এ সব বাবার থেকেই শেখা। অথচ বাবা এখন ও বাড়ি, মানে অনন্যার কুমারীবেলার বাড়ি গেলে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, সন্দীপন যখন সেপারেশন চাইছে, দিয়ে দে না। তুইও বিয়ে-থা করে থিতু হ। সেরকম বিশেষ কারুর সঙ্গে আলাপ হয়নি তোর?
বাবার দিকে একবার শুধু তাকায় অনন্যা। চোখ দিয়ে যা বলার বলে। কথাগুলো সম্ভবত ধরে নেয় বাবা। নইলে তক্ষুনি মাথা নিচু করে নেয় কেন? চোখের ভাষায় অনন্যা বলে, বিয়ের উদ্দেশ্যে একজনের সঙ্গে বিশেষ করে আলাপ করতে হবে! এতটাই চিপ আমি! তা ছাড়া কেন আমি সন্দীপনকে ডিভোর্স দেব? আমার কোন দোষটার জন্যে আলাদা হয়ে গেল সে। সেভাবে তো কোনও এক্সপ্লানেশন খাড়া করতে পারছে না।
তবে একটা ব্যাপারে সন্দীপনের প্রশংসা করতে হবে, এখনও অবধি অনন্যার প্রতি সে কোনও মিথ্যে বা বানিয়ে দোষারোপ করেনি। বলেছে, সাম হাউ আই ফিল, আমাদের আর একসঙ্গে থাকার কোনও মানে হচ্ছে না। হয়তো আমারই ল্যাক, এই দাম্পত্য থেকে আমি কিছু পাচ্ছি না।
অনন্যা তখন বলেছে, তুমি আমার থেকে ঠিক কী পাচ্ছ না বলো? কোথায় খামতি থেকে যাচ্ছে আমার? নাকি আমাদের কোনও সন্তান না আসার জন্যেই তোমার এমনটা মনে হচ্ছে?
সেটাও ঠিক নয়। সন্তানের অভাবটা তো তুমিও ফেস করছ। মানিয়েও নিয়েছ, আমিও তাই। একটা বাচ্চা থাকলে যে জীবনটা অন্যরকম হত, আমার মনে হয় না। দেয়ার ইজ নো ওয়েভ ইন আওয়ার কনজুগাল লাইফ। উই ড্রাগ ইট মিনিংলেসলি। এ যেন টিফিন আওয়ার না থাকা কোনও স্কুল রুটিন।
সন্দীপন কলেজে কালচারাল সেক্রেটারি ছিল। অনন্যার চেয়ে দুবছরের সিনিয়র। ওর বাগ্মিতায় অনন্যা মোহগ্রস্ত হয়ে থাকত সেই কলেজবেলা থেকে। সন্দীপনের যুক্তিজালকে প্রতিরোধ করার পদ্ধতি আয়ত্ত করার চেষ্টা করেনি কখনও। সন্দীপনের সেই ক্ষমতা যখন অনন্যার ওপরই প্রয়োগ হওয়া শুরু হল, অসহায়ের মতো মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বেচারির। ভেবেছিল, এটা হয়তো সন্দীপনের বিশেষ কোনও ফিলজফিক্যাল ক্রাইসিস। ফ্ল্যাট ছেড়ে সন্দীপন চলে গেল পৈতৃক বাড়ি সোনারপুরে। অনন্যার নামে ফ্ল্যাট। এখনও ইনস্টলমেন্ট শোধ করে চলেছে। যাওয়ার দিন সন্দীপন ঘরে পরার পাজামা, পাঞ্জাবি, তোয়ালে, আরও টুকটাক কিছু রেখে গেল। বলেছিল, এগুলো থাক। আমার তো কোনও ঠিক নেই, দুদিন পরেই হয়তো ফিরে আসব। আবার না-ও আসতে পারি বছর খানেক। অতটা সময়ে নিশ্চয়ই বুঝে যাব, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।
আর এল না সন্দীপন। ওর রেখে যাওয়া পোশাকগুলো অনেকদিন পর্যন্ত কেচে পাট করে রাখেনি অনন্যা, পাছে সন্দীপনের গন্ধটা চলে যায়। পরে একসময় কেচে তুলে রাখল আলমারিতে। কেননা ততদিনে অনন্যার কানে খবর এসে পৌঁছেছে সন্দীপন ওর অফিস কলিগ রিঙ্কার কাছে গিয়ে উঠেছে। রিঙ্কা ফ্ল্যাটে একাই থাকত। নাগপুরের মেয়ে। ওর
বাবা মা ওখানেই থাকে। সন্দীপনের মুখে রিঙ্কার কথা বেশ কয়েকবার শুনেছে। রিঙ্কা তখন হয়তো সবে জয়েন করেছে অফিসে। সন্দীপন বাড়ি এসে একদিন বলল, সত্যি, ডায়নামিক একটা মেয়ে এসেছে ডিপার্টমেন্টে! ভীষণ স্মার্ট। দারুণ মার্কেটিং করছে। খুবই অল্পবয়েস।…
অফিসের টুকটাক খবরের মতো এটাকেও ডিনার টেবিলের নিরীহ বাক্যালাপ বলে ধরে নিয়েছিল অনন্যা। পরে একদিন সন্দীপন বলল, রিঙ্কা নাকি একা থাকছে, ফ্ল্যাট নিয়ে। হেভি সাহস!
অনন্যার মনের কোণে সিঁদুরে মেঘের ছিটেমাত্র আভাসও ফুটে ওঠেনি। সন্দীপনের কণ্ঠস্বরের বাড়তি উচ্ছ্বাসটুকু কান এড়িয়ে গেছে। কারণ একটাই, ওদের দাম্পত্যে কোনও অপূর্ণতা ছিল না। সন্তানের ব্যাপারে ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যে-কোনও দিনই সে আসতে পারে। অনন্যা, সন্দীপন দুজনেই সম্পূর্ণ সুস্থ। তাই সন্তানের জন্যে অপেক্ষা ছিল মোটামুটি উদ্বেগহীন।
তবু কেন সরে গেল সন্দীপন? রিঙ্কা অফিসে আসার পর থেকেই কি সন্দীপন ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল? ছদ্ম দার্শনিকতা দেখিয়ে দূরত্ব রচনা করল অনন্যার থেকে। সন্দীপনকে এতটা ভণ্ড ভাবতে কষ্ট হয় অনন্যার। বিয়ের আগে ছবছর খেলার সাথির মতো ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। আক্ষেপ করেছে, কেন দেখা হয়নি কিশোর বয়েসে। কতরকম উদ্যোগ, অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে, রাত কাটিয়েছে খোলা মাঠে বাউলমেলায়। সন্দীপন তো এত বড় অভিনেতা নয় যে, বিরামহীন এত কটা বছর অভিনয় করে যাবে!
রিঙ্কার খবরটা কানে আসার পর অনন্যার প্রথম রিঅ্যাকশন হয়েছিল, বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পাওয়া। যেন তাদের হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে বেরোলেই দেখতে পাবে, উলটো ফুটপাতে শাড়ি পরা মিষ্টি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটাই রিঙ্কা। একবার ওকে চর্মচক্ষে দেখে নিলেই, মনের চোখে ঝলকে উঠবে, সন্দীপন-রিঙ্কার শারীরিক মিলনদৃশ্য। যা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না অনন্যা। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগছিল, অফিস থেকে ফোন এসে এসে ওকে বার করল বাড়ি থেকে। বাসে, রাস্তায় হাঁটার সময় ঘাড় নিচু করে থাকত। চিলতে সিঁদুর ঠেকানোর সংস্কার ছিল সিঁথিতে, ছেড়ে দিল সেটা। সন্দীপনকে ফোন করে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয়নি। ছোট থেকে একা বড় হয়েছে অনন্যা। ভাইবোন থাকলে কেড়ে নেওয়া অথবা ঝগড়াঝাঁটি করার একটা অভ্যেস তৈরি হত। খুব বেশি যেটুকু করতে পারবে বলে মনে হল, সন্দীপনে রেখে যাওয়া পোশাকআশাক, জয়েন্ট ফোটোগ্রাফ, আরও কিছু স্মৃতিচিহ্ন বস্তায় বেঁধে কর্পোরেশনের গাড়িতে ফেলে দিতে। সেসব কিছুই হয়নি। ময়লা নিয়ে যাওয়ার লোকটা রোজ বাঁশি বাজিয়ে চলে যায়। মেকআপ রেডি না হওয়া অভিনেত্রীর মতো অনন্যা অস্থিরবোধ করে। ওই বাঁশিটা যেন নাটক মঞ্চের পরদা সরে যাওয়ার সংকেত।
একদিন সন্দীপনই ফোন করল। মামুলি কুশল বিনিময়ের পর জানাল, রিঙ্কার সঙ্গে থাকার কথা। সেদিনই ডিভোর্স চায়নি। চাইল আরও এক সপ্তাহ পর। বলল, আমরা যদি লিগালি সেপারেট হয়ে যাই, যে যার নিজের মতো বাঁচতে পারব।
অনন্যা বলেছিল, আমি তো আমার পছন্দ মতোই জীবন কাটাচ্ছিলাম। তুমি চলে যাওয়ার পরও খুব অসুবিধেতে নেই। খামোকা কাগুজে সেপারেশনে যাব কেন?
আমি রিঙ্কাকে বিয়ে করতে চাই অনন্যা। ও-ও চায়। তুমি ডিভোর্স না দিলে সেটা সম্ভব নয়। একেবারে সরাসরি বলেছিল সন্দীপন। ওর এই ভণিতাহীন স্বভাবটাই একসময় মুগ্ধ করত অনন্যাকে। তখনই সন্দীপনের কথার কোনও জবাব দেয়নি, কটা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিল অনন্যা। খুব কাঁদতে চেয়েছিল সেদিন। পারেনি। বুঝেছিল, নিজের জন্যে একা একা কাঁদা খুব কঠিন। পরের দুঃখকষ্টে দিব্যি কান্না আসে। তেমন কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনন্যার নেই, যার সঙ্গে মনের অবস্থাটা শেয়ার করা যাবে। সন্দীপনের পরের ফোনটার জন্যে ভয় পেতে শুরু করল অনন্যা। ফোন এলে কী বলবে? ডিভোর্স দেওয়া এবং না দেওয়া কোনও ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। ঠিকমতো ঘৃণাও তৈরি হচ্ছে না সন্দীপনের ওপর, ভালবাসাও তেমন তীব্র হচ্ছে না যে, ওকে অধিকার করার রোখ চেপে বসে। যতবাই চূড়ান্ত বিচ্ছেদের প্রসঙ্গটা ভাবতে যাচ্ছে, গলা ভারী হয়ে আসছে অনন্যার। মনে হচ্ছে, নিজের নগ্ন শরীর, যা আমার কাছেই অনেকটা অচেনা, পূর্ণ আলোকে দেখেছ প্রথম এবং শেষ তুমি। আলাদা হয়ে গিয়েও আমার এই গোপনীয়তা রয়ে যাবে তোমার কাছে। ডিভোর্সের বদলে পারবে কি সে ছবি ফেরত দিতে? তা হলে আমি রাজি সই করতে।… এ ধরনের কাল্পনিক কথোপকথনে ব্যস্ত অনন্যার সত্যিকারের কথা কমে এসেছে, শোনার ইচ্ছেটাও গেছে চলে। আবার ফোন এল সন্দীপনের। একই অনুরোধে। বেশি কথায় গেল না অনন্যা, আরও কিছুদিন সময় চেয়ে নিল।
ইতিমধ্যে চেনা পরিচিতদের কাছে হামেশাই শুনতে হচ্ছে, এত চুপচাপ কেন, এরকম সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার কী হয়েছে! একটু গানটান শোন, সিনেমা নাটক দেখ। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা কর। এখন তো আকছার এই ঘটনা ঘটছে। তারা কেউ তোর মতো থম মেরে যায় না।… যারা এগুলো বলে, জানে না সন্দীপন কাছে নেই বলে অনন্যার যত না কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি বিব্রত হচ্ছে, ডিভোর্স চেয়ে ফোন আসা নিয়ে।
একদিন এডিটর কস্তুরীদি চেম্বারে ডেকে বলল একই ধরনের কথা, একটু অন্য ভঙ্গিতে, হোয়াটস রং অনন্যা! এত ডিপ্রেসড দেখায় কেন তোকে? স্বামী-স্ত্রী বনিবনা হচ্ছে না, দুজনে আলাদা থাকছে। ইট্স কোয়াইট ন্যাচারাল। এর জন্যে যদি তুই দিনের পর দিন গুম মেরে থাকিস, দেন ইয়োর অ্যাটিটিউড উড ক্রুশ দ্য লিমিট অফ নর্মালসি।
আশঙ্কাটা সহানুভূতি বশেই করেছিলেন কস্তুরীদি। তবু মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল অনন্যার। ইদানীং একটা স্টাইল হয়েছে, জেনুইন মন খারাপের মধ্যেও লোকে পাগলামির ছায়া দেখে। কস্তুরীদিকে পালটা আঘাত করার জন্যে অনন্যা জানতে চেয়েছিল, আমার কাজে কি কোনও গোলমাল হচ্ছে?
অর্থাৎ, তা যতক্ষণ না হচ্ছে, আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কোনও অ্যাডভাইস শুনতে আমি বাধ্য নই।
অনন্যার বলা এবং না বলা দুটো কথাই কস্তুরীদি কপালে একবার ভাঁজ ফেলেই বুঝে নিলেন। সেটাই স্বাভাবিক, এডিটরের সিটে এমনি এতদিন ধরে বসে নেই, মুহূর্তে গলার
সুরে হালকা চাল এনে বললেন, তোর কী রাশি রে? শিয়োর স্যাজেটেরিয়াস।
নিজের রাশি নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই অনন্যার। তাদের ম্যাগাজিনে সাপ্তাহিক রাশিফল ছাপা হয়। সেটা কতটা ভিত্তিহীন, তাও ভাল করে জানে। একটা ব্যাপারেই অনন্যা অবাক হয়েছিল। তার রাশিটা কস্তুরীদি ঠিকঠাক বলে দিয়েছেন! নিজের রাশি মায়ের থেকে শুনেছিল অনন্যা। কস্তুরীদির আন্দাজটা হয়তো লেগে গিয়েছিল বাইচান্স। সেই কারণেই কস্তুরীদিকে কোনও কৃতিত্ব না দিয়ে অনন্যা জানতে চেয়েছিল, স্যাজেটেরিয়াস হলে কী হয়?
তোর মতো হয়। ভেতরটা নরম, ওপরে ভাব দেখায় কঠিন। ওই যে বলে না, ভাঙব তবু মচকাব না।
কস্তুরীদির কথার পিঠে অনন্যা বলেছিল, তোমার রাশি কী? পাইসেস।
ক দিনের জন্যে ধার দেবে? বদলে আমারটা নাও।
নিতে পারি। একটা শর্তে, রাশির সঙ্গে মন্দারমণি ট্রিপের খরচা দিতে হবে। তোর রাশির এখন ছোটখাটো একটা আউটিং-এর দরকার।
কথাবার্তাটা মজা করে শেষ হলেও, সমুদ্র-বাতাসের আহ্বান ছুঁয়ে গিয়েছিল অনন্যার মন। সত্যি, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। শেষ সেই সন্দীপনের সঙ্গে গোপালপুর। ওর সঙ্গে প্রতিটা বেড়ানোই ছিল কী রোমাঞ্চকর! এখন বাবা-মাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে তাড়া করে আসবে সেইসব স্মৃতি। তবু একবার গিয়ে দেখবে কি? বাবা-মায়ের মনটা একটু ঝরঝরে হয়। মেয়ের জন্যে তারাও তো কম দুশ্চিন্তায় নেই।… প্রোগ্রামটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে দুদিন গেল। আবার ফোন এল সন্দীপনের। অফিসে অনন্যার কাজ তখন শেষ। টয়লেট ঘুরে এসে টেবিলে রাখা মোবাইল সেট তুলে দেখে, দুটো মিসড কল। সুইচ টিপে দেখেছিল, এক মিনিটের ব্যবধানে দুবারই সন্দীপন করেছে। কলব্যাক করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ব্যাগ গুছিয়ে কিউবল থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, বেজে উঠেছিল ফোন। অফিস তখন প্রায় ফাঁকা। সিটে ফিরে এসে সন্দীপনের কলটা রিসিভ করেছিল অনন্যা, বলো।
ফোন রেখে কোথায় গিয়েছিলে? দুবার বেজে গেল, নাকি ধরছিলে না ইচ্ছে করে? এখন তো ধরলাম। বলো, কী বলবে? দেরি হয়ে যাচ্ছে, সাতটার মেট্রোটা পাব না। সন্দীপন বলেছিল, আমার আর কী কথা। সেই একই, মনস্থির করতে পারলে কিছু? দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অনন্যা বলেছিল, নাহ্।
সন্দীপন রাগল না। ওর মাথা চিরকালই ঠান্ডা। তবে সেবারের বক্তৃতাটা ছিল বেশ লম্বা। বলেছিল, একটা সামান্য সই করার মতো কাজ করতে তোমার কেন অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তুমি যদি ভেবে থাকো, কোনও একদিন আমি ফিরে যাব তোমার কাছে, হয়তো ফিরতেও পারি। তখন তো সেই আগের আমি ফিরব না। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী একজন ফিরবে। যে বউকে ফেলে অন্য মেয়ের সঙ্গে বছর কাটিয়ে এসেছে। সেই মানুষটাকে প্রশ্রয় দেওয়া তোমার দুর্বলতার পরিচয়। সেখানে সেই হেরেই যাবে তুমি। আবার এমন নয় তো,
আমার ঔরসের কোনও শিশুকে তুমি পৃথিবীর আলো দেখাতে চাও না? এক্ষেত্রে তুমি যদি মনে করো, সই না করে আমায় শাস্তি দেবে, তাও কিন্তু হচ্ছে না। সন্তানাকাঙ্ক্ষা আমার প্রায়রিটি ছিল না কোনওদিনই। তাই এখনকার জীবনযাপন করতে কোনও সমস্যা হবে না আমার। আমি আসলে তোমাকেই রিলিজ করতে চেয়েছিলাম। আমার কথা ভুলে তুমি যাতে নিজের মতো বাঁচতে পারো।
সন্দীপনের বলা প্রতিটা বাক্য পরতে পরতে বাষ্প জমা করছিল অনন্যার গলায়। ওকে ভোলার কথা উঠতেই অনন্যার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে আসে, ভুলতে পারছি কই! যতবারই সম্পর্কটা শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছি, মনে পড়ছে আমাদের একসঙ্গে কাটানো প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘণ্টা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার পেপার্সে আমি ঠিকঠাক সই করে উঠতে পারব না। এঁকেবেঁকে যাবে। আমাকে আরও একটু সময় দাও, মনটা গুছিয়ে নিই।
অনন্যার কানে নিজের গলাটা কেমন যেন ভিখারিনির মতো লাগছিল। অপমানে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। এই অপরিচিত কণ্ঠস্বরটিকে অভিসন্ধিমূলক হিসেবে গণ্য করল সন্দীপন। চিবিয়ে চিবিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বলল, তুমি যে নিজেকে কী পরিমাণ ভালবাসো, আমি আগেও টের পেয়েছি। কিছুতেই হারতে চাও না। সবসময় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাও। কিন্তু খেলা তো শেষ। কতদিন আর ছায়া-প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করে যাবে। তোমার এই হাস্যকর লড়াই দেখার কোনও দর্শকও আর অবশিষ্ট নেই গ্যালারিতে।
ফোন কেটে দিয়েছিল সন্দীপন। বুকের কাছে কষ্ট হতে শুরু করেছিল অনন্যার। জ্বালা জ্বালা করছিল চোখ। দমকে দমকে কান্না চলে এল। অফিস ফাঁকা যেহেতু, কান্নাটাকে তাই বাঁধ দিল না। মাথাটা নামিয়ে রেখেছিল টেবিলে।
এভাবে কতটা সময় কেটেছিল খেয়াল নেই, কে যেন হাত রেখেছিল পিঠে। এত কিছুর পরেও অনন্যার মনে হয়েছিল, হাতটা বুঝি সন্দীপনের। ফিরে তাকালেই বলবে, ফোন করতে করতে তোমার অফিসে ঢুকলাম। কী দিলাম তো কাঁদিয়ে…
ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মু’ছে অনন্যা দেখেছিল দীপাকে। নিজেকে মোটামুটি সামলে অনন্যা বলেছিল, তুই এখনও যাসনি!
কথাটার উত্তর না দিয়ে পাশের চেয়ারে বলেছিল দীপা। পিঠে রাখা হাতটা তখনও তোলেনি। মেয়েটা বোঝে অনন্যা ওকে অ্যাভারেজ বুদ্ধির মানুষ হিসেবে গণ্য করে। তবু গলায় সামান্য কর্তৃত্ব এবং দৃষ্টিতে অপার সহানুভূতিসহ বলেছিল, তুমি কেন কাঁদছ, জিজ্ঞেস করব না। কিছুটা তো আন্দাজ করতে পারি। তাই বলি কী, এভাবে একটানা মনের ভিতর কষ্ট পুষে রাখার কোনও মানে হয় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে স্বাভাবিক হতে হবে।
অন্য সময় দীপার পরামর্শে কান দিত না, সেই মুহূর্তে অনন্যার মনের অবস্থা এমনই ছিল, জিজ্ঞেস করেই ফেলে, কীভাবে স্বাভাবিক হব বল?
জ্যোতিষীর কাছে চলো। আমার চেনা একজন আছে। জ্যোতিষী! দীপার কথাটাই বিষম বিস্ময়ে রিপিট করেছিল অনন্যা।
দীপা বলে, জানি তুমি এসব বিশ্বাস করো না। আমি কিন্তু ফল পেয়েছি। ঠিকুজি, কুষ্ঠি, হাত দেখানোর চল আমাদের বাড়িতে আছে। বেশিরভাগ লোকই বিশ্বাস করে ভাগ্য গণনা, বাইরে স্বীকার করে না।
বোকা বোকা কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়েছিল অনন্যা। মনে মনে দীপাকে বলেছিল, যারা হাতটাত দেখায়, মুখে না বলুক, ব্যক্তিত্বে ছাপ পড়েই, যেমনটা তোর আছে।
অনন্যাকে চুপ থাকতে দেখে দীপা ফের বলে, কী হল যাবে? এত অনিশ্চয়তায় ভুগছ, ভবিষ্যৎ খানিকটা জানতে পারলে অনেক রিলিফ ফিল করবে। বলো তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করি। ঘ্যাম ঘ্যাম লোক ওঁর কাছে যায়।
কী করবেন উনি? ঝুটো আংটি গছিয়ে মন ভাল করে দেবেন! বশীকরণ করে বাড়ি এনে দেবেন আমার বরকে! বিরক্তি মিশিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিল অনন্যা।
দীপা বলে, এই তোমাদের এক দোষ। আগ বাড়িয়ে একগাদা ধারণা করে বসো। নিজের তো কোনও এক্সপেরিয়েন্স নেই, যাওনি কোনওদিন। একবার চলো না। ধরে নাও, তোমার প্রবলেমটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছ। তুমি তো এই অবস্থা থেকে বেরোতে চাও, নাকি? তারপর উনি যা যা তোমায় করতে বলবেন, ভাল না লাগলে কোরো না।
এই পয়েন্টে এসে দীপার প্রস্তাবটা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছিল। তবু অনন্যা আর একটু খতিয়ে দেখতে চায়, জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে কী কী উপকার হয়েছে তোর শুনি?
সে অনেক কিছু হয়েছে। মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারির সময় আমাদের দুটো পাড়া পরে এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যেত মা। গ্র্যাজুয়েশন, চাকরির জন্য আমি নিজে গেছি। কিন্তু এখন যে জ্যোতিষীর কথা বলছি, খুব নাম আছে। আগে টিভি চ্যানেলে বসতেন, এখন সময় পান না। আমার কাকিমা ওঁর কাছে হামেশাই যায়। একদিন নিয়ে গেল আমাকে। বিয়ের যোগাযোগটা হয়ে গেল আমার। কোনও আংটিফাংটি নয়, একটা শেকড় পরতে দিয়েছিলেন হাতে আর খাওয়া-দাওয়ার কিছু নিয়মকানুন।
তাই। কবে বিয়ে তোর? সাগ্রহে জানতে চেয়েছিল অনন্যা।
এই তো সামনে, মিডল অফ ডিসেম্বরে, নেমন্তন্ন তো পাবেই।
খবরটা দেওয়ার সময় লজ্জা পাচ্ছিল দীপা। খুব মিষ্টি লাগছিল ওকে। অনন্যা প্রার্থনা করেছিল, ওর দাম্পত্য যেন সুখের হয়।
অবশেষে নিজের টেবিল ছেড়ে যখন বেরিয়ে আসছে অনন্যা, দীপা বলেছিল, সামনের বৃহস্পতিবার তা হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করি?
খুব ক্যাজুয়াল ঢঙে, কর, বলে অফিস থেকে বেরোনোর জন্যে পা বাড়িয়েছিল অনন্যা।
মাঝে তিনদিন কেটে গেছে। অনন্যার অফিসের কাজে দীপাকে বড় একটা প্রয়োজন হয় না। তাই কথা হয়নি। একসময় কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেছে, নাম লিখিয়ে দিয়েছি।
অনন্যা কোনও জবাব দেয়নি। আজ শাড়ি পরে আসাটাই উত্তর। যা দেখে দীপা আশ্বস্ত
হয়েছে, চোখের ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে সেটা। …ইন্টারনেট থেকে একটা স্বাস্থ্য বিষয়ক আর্টিকল তর্জমা করতে করতে এত কিছু ভেবে ফেলল অনন্যা। ভাবনা আর লেখার বিষয়ে যেহেতু সংযোগ নেই, কাজটা শেষ করতে দেরি হচ্ছে। পেন নামিয়ে আড়মোড়া ভাঙে অনন্যা। চোখ যায় টেবিলে রাখা নিজের মোবাইল সেটটায়। আজকাল ওটার দিকে তাকালেই মনে হয়, এই বুঝি সন্দীপনের ফোন এল। কেমন একটা আতঙ্ক হয়ে গেছে। আজ সন্ধের পর এটার থেকে কি মুক্তি পাবে অনন্যা? পেলে তো ভালই হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত জ্যোতিষীর ওপর এতটুকু নির্ভর করতে পারছে না, করার কোনও যুক্তিও নেই। একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হবে, এই যা।
ফোনের পাশে পড়ে ছিল নিউজ-পেপারটা, তুলে নেয় অনন্যা। পাতা উলটে যায় রাশিফলের পাতায়। স্যাজেটেরিয়াসে লেখা আছে, ডু প্ল্যান ফর দ্য ফিউচার। ডোন্ট বি জাজমেন্টাল। এক্সপেক্ট টু বি অ্যাট্রাক্টেড টু এ স্ট্রেঞ্জার।
কেমন যেন মিলতে পারে মনে হচ্ছে। আজকের দিনটা তো এরকমই হওয়ার কথা। এই কারণে কলামটা এত পপুলার। কস্তুরীদির সঙ্গে বহুবার তর্ক করেও, অনন্যা নিজেদের পত্রিকায় সাপ্তাহিক রাশিফল ছাপা বন্ধ করতে পারেনি।
সাড়ে ছটা নাগাদ দীপা আর অনন্যা অফিস থেকে রাস্তায় নেমে এল। অনন্যা বলল, চল, ট্যাক্সি ডেকে নিই।
দীপা বলে, কী দরকার, চারটে তো স্টপ। মিছিমিছি পয়সা নষ্ট।
অনন্যা শুনল না দীপার কথা। আসছিল একটা ফাঁকা ট্যাক্সি, হাত দেখিয়ে দাঁড় করাল। দুজনকে নিয়ে স্টার্ট নিল ট্যাক্সি। বাজে খরচ কেন করছে, প্রশ্নটা যদি ফের করে দীপা,
এই আশঙ্কায় অনন্যা পালটা জিজ্ঞাসায় যায়, আজ শাড়ি পরে এলাম কেন বল তো? ভেরি সিম্পল। ঠাকুরদেবতার ব্যাপার বলে পরেছ। অফিস থেকে বেরোনোর আগে সিঁদুরও লাগিয়ে নিয়েছ দেখছি।
দুটো ধারণাই ভুল। সংশোধন করে দিতে ইচ্ছে হয় না অনন্যার। ট্যাক্সি নেওয়ার ব্যাপারে আর কোনও প্রশ্ন করবে না দীপা, প্রসঙ্গ ঘুরে গেছে।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে চলেছে অনন্যারা। অফিস ছুটির টাইম, রাশ আছে ট্রাফিকের। ট্যাক্সি নেওয়ার কারণ, নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়। বাসে চেনাজানা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে জিজ্ঞেস করবে, কোথায় চললে? তুমি তো এই রুটে বাড়ি ফেরো না –তখন আবার গাদাখানেক মিথ্যে কথা বলো।
শাড়ি পরাটা হচ্ছে, এক ধরনের সাবধানতা। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা কেজো চেহারার অনন্যাকে দেখলে জ্যোতিষীর সন্দেহ হতে পারে, হয়তো নিউজ চ্যানেল থেকে তদন্ত করতে এসেছে। জ্যোতিষঠাকুর তখন অতি সাবধানতা অবলম্বন করে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন। আর সিঁথিতে চিলতে সিঁদুর আঁকার আসল উদ্দেশ্য, জ্যোতিষীকে কোনওভাবেই আন্দাজ করতে না দেওয়া, বিবাহ সংক্রান্ত কোনও সমস্যায় তাঁর কাছে আসা হয়েছে।
এত সব বোঝার ক্ষমতা দীপার নেই, বুঝিয়ে কোনও লাভ হবে না। তা ছাড়া অনন্যা তো এখন দীপার মতোই ভাগ্যবিশ্বাসীর দলে।
বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ঢুকে পড়েছে ট্যাক্সি। দীপা ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয়, এবার বাঁদিক ধরে চলো। ওই যে হলুদ বাড়িটার সামনে।
ট্যাক্সি দাঁড়াল ফুটপাত ঘেঁষে। বাড়ির সদরে গ্লো-সাইন বোর্ড লাগানো। সেখানে জ্যোতিষীর ছবি সমেত নাম লেখা। ট্যক্সি থেকে নেমে ফুটপাতটা আড়াআড়ি পার হতে হবে। তাতেই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে অনন্যার। অলীক কল্পনা ভর করছে মাথায়, এইটুকুর মাঝেই যদি সন্দীপনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হয়তো কোনও কাজে এসেছিল এদিকে। ভিতরে গিয়ে দেখা হয়ে যেতে পারে কোনও আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে, তখন সে এক অপ্রস্তুত অবস্থা!
কী হল, নামো!
দীপার ঠেলাতেই ট্যাক্সি থেকে নেমে হলুদ বাড়িটায় ঢুকে পড়ল অনন্যা। ট্যাক্সিতে বসে চিন্তার মাঝেই ভাড়া মিটিয়েছিল সে।
সদর পেরোতে ঘেরা বারান্দা। ভিজিটরদের বসার বেঞ্চ সেখানেই। তার পরই ফেং শুই মার্কা দরজার কিছুটা দেখা যাচ্ছে, ওটাই বোধহয় চেম্বার। কিন্তু বারান্দার পরিস্থিতিটা কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে আছে। ক্লায়েন্টরা কেউ সিটে বসে নেই। দাঁড়িয়ে আছে হতবুদ্ধি হয়ে। দুটো সালোয়ার কামিজ, একটা জিন্স পরা মেয়ে বারান্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাকে যেন প্রচণ্ড ধমকধামক দিচ্ছে।
চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে আসে অনন্যা। তিনটে মেয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে পায় যাঁকে, তিনি অবশ্যই ত্রিকালদর্শী মহর্ষি অমুক। বাইরের বোর্ডে এঁরই ছবি ছিল। চল্লিশের ওপর বয়েস। খালি গা। গলায় নানা ধরনের মালা। ছবির সেই হাসি এখন উধাও, লোকটা প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলছেন, প্লিজ ছেড়ে দিন। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর হবে না। যদি কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে হয় তো বলুন।
তিনটে মেয়ের মধ্যে যে লিডার টাইপের, বলে ওঠে, ঘুস দিতে চাইছেন! যাতে কেসটা চেপে যাই। আপনার সাহস তো কম নয়!
কথা শেষ করে মেয়েটা এবার থতমত খেয়ে যাওয়া ক্লায়েন্টদের উদ্দেশে বলে, আপনারা আসুন তো। লোকটাকে একটা করে চড় কষান। এই যে,
কেউ এগোয় না। কেন কে জানে, অনন্যার হাতের তালু শিরশির করতে থাকে। সেই কি শুরু করবে চড় মারা? কিন্তু এখনও তো অনন্যা জানে না, লোকটার অপরাধ। নাকি মানে মানে এখান থেকে সরে পড়াই ভাল। দীপা অলরেডি কনুই ধরে টানা শুরু করেছে। অনন্যা ঘুরতে যাবে, ওই তিনটে মেয়ের একজন এগিয়ে এল, অনন্যাদি, আপনি এখানে।
খুবই বিব্রত বোধ করে অনন্যা। এদিকে মেয়েটাকে আবার চিনতে পারছে না। মেয়েটিই সাহায্য করে, আমাকে আপনার মনে থাকার কথা নয়। একবার আপনাদের ম্যাগাজিনে অ্যাপ্রেন্টিসশিপের জন্যে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন বোর্ডে। কাজটা হয়নি। সে যাক। আমি কিন্তু আপনার লেখার খুব ভক্ত। আপনার সব আর্টিকেল পড়ি।
অনন্যা সৌজন্যমূলক হাসি হাসে। তারপর মেয়েটির প্রথমে করা প্রশ্নের উত্তর দেয়, এসেছিলাম অফিসের একটা কাজে, পাশেই। এখানে গন্ডগোল দেখে ঢুকে পড়লাম।
মেয়েটি ফিরে যায় ঘটমান পরিস্থিতির উত্তেজনায়। বলে, আর বলবেন না। এই জ্যোতিষীটা কী মারাত্মক এলিমেন্ট, ভাবতে পারবেন না আপনি! এটুকু বলে মেয়েটি ফাঁকা জায়গায় পিছিয়ে গিয়ে আঙুল তোলে ভিজিটার্স বেঞ্চের কোনায়। সেখানে মাত্র একজনই বসে আছে জড়সড় হয়ে, এক মহিলা। দূর থেকে যতটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে, বিবাহিতা। এবার গলাটা খাদে নিয়ে এসে মেয়েটি বলে, ওই মহিলাকে সেক্সুয়ালি অ্যাবিউড্ড করেছে ভণ্ডটা। ভাগ্য গণনা করাতে এসেছিলেন। হাজব্যান্ড ড্রিঙ্ক করে, গায়ে হাত তোলে৷ প্রতিকারের উপায় হিসেবে জ্যোতিষী শিকড় দেয় হাতে বাঁধতে। কোনও লাভ হয় না। বর যেমনকার তেমন। জ্যোতিষী পাঁচশো টাকা খেয়ে বসে গেছে। বউটি ফের আসে এখানে। জ্যোতিষী, মা, অন্যভাবে নেবেন না এসব ভণিতা করে বলে, আপনি বাড়ি গিয়ে লক্ষ করবেন তো আপনার স্তনের বৃত্তমণ্ডলী কালচে আর খসখসে হয়ে যাচ্ছে কিনা? ভাবুন অবস্থা! বলে মেয়েটি বিস্ময় ভাগ করে নেয় অনন্যার সঙ্গে। অনন্যা পুরোপুরি থ। দীপাও ছমছমে মুখ করে সব কথা শুনছে।
মেয়েটি বলতে থাকে, ভণ্ডটা আবার একটা শিকড় দেয়। বলে, যদি দেখেন ওরকম হচ্ছে, সামনের অমাবস্যায় নিরামিষ আহার করে এটা পরে নেবেন।— ভদ্রমহিলা অন্ধবিশ্বাসে সবই মেনে চললেন। তাও ভাগ্যের চাকা ঘুরল না। গতকাল এসেছিলেন ফের। জ্যোতিষী ভীষণ অবাক এবং অবিশ্বাসের ভাব করে মহিলার স্তন দেখতে চান। অবশ্যই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। লজ্জায় অপমানে পালিয়ে বাঁচেন মহিলা। কাল পুরো দিনটা আত্মগ্লানিতে কাটিয়েছেন। আজ সকালে আমাদের এন জি ও-র অফিসে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘটনাটা বলেন। আমাদের অফিসটা ওঁর পাড়াতেই, তাই চট করে চলে আসতে পেরেছেন। দূরের ভিকটিমরা এসে পৌঁছোতে পারে না।
হাতের শিরশিরানি আরও বেড়ে গেছে অনন্যার। চোখ অনেকক্ষণ চলে গেছে নিগৃহীতার দিকে। আঁচল জড়িয়ে এমন কুঁকড়ে আছেন, যেন ভিতরে ব্লাউজ, ব্রা কিচ্ছু নেই। দৃষ্টি ফিরিয়ে অনন্যা বলে, লোকটাকে পুলিশে দিচ্ছ না কেন? তেমন বুঝলে কোনও নিউজ চ্যানেলে খবরটা পাঠিয়ে দাও।
ভদ্রমহিলার মুখ চেয়ে সেটা করতে পারছি না। এক্সপোজড হয়ে যাবেন। সোশ্যাল কিউরিসিটি সামলানোর মতো মনের জোর নেই। পাড়ায়, বাড়িতে জানাজানি হলে ভালমন্দ কিছু একটা করে বসতে পারেন, তবে এই রাস্কেলটার কারবার আমরা বন্ধ করবই। এমন শিক্ষা…
কথার মাঝে অনন্যা বলে ওঠে, ঠিক আছে। আই অ্যাম অলরেডি লেট। আমার, মানে ম্যাগাজিনের দিক থেকে যদি কোনও হেল্প লাগে, এসো।
নিশ্চয়ই যাব। বলে, মেয়েটি ফিরে যায় জ্যোতিষীকে শিক্ষা দিতে। বারান্দার চেঁচামেচি আরও এক ধাপ বাড়ল। সেসব কানে নিয়ে অনন্যা, দীপা তড়িঘড়ি পায়ে নেমে আসে ফুটপাতে। দীপা মাথা নিচু করে আছে। অনন্যা হাত রাখে কাঁধে। বলে, তুই এত গিলটি ফিল করছিস কেন? আমরা আসি বলেই তো এরা এত সাহস পায়।
পরের দিন আলো ফোটার আগেই বিছানা থেকে উঠে পড়ল অনন্যা। ভাল ঘুম হয়নি। বিতিকিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখেছে গোটা রাত। একটা স্বপ্ন বেশ কয়েকবার রিপিট হল, আলো আবছায়া আয়নার সামনে খোলা বুকে দাঁড়িয়ে আছে সে। খুঁটিয়ে দেখছে বৃত্তমণ্ডল। আলো কম বলে বিরক্ত হচ্ছে। অন্য স্বপ্নটা দেখল শেষ রাতে, জ্যোতিষীর ভিজিটার্স বেঞ্চে নিগৃহীতার জায়গায় সে বসে আছে জড়সড় হয়ে। বারান্দায় আর কেউ নেই। পাশেই চেম্বারের দরজা। খুলে গেল। বেরিয়ে এল একটা হাত। সেই হাতে ধরা লাল ব্লাউজ। দরজার ওপারের লোকটা বলে উঠল, এটা পরে নাও।… সেই যে ঘুম ভাঙল, আর এল না।
বাথরুম ঘুরে এসে অনন্যা খুলে দিল ওর চারতলা ফ্ল্যাটের সব কটা জানলা। হাওয়ায় শীত আসার গন্ধ। ওর ধারণা ছিল না ভোরবেলা এই এলাকায় এত পাখি ডাকে। জানলা দিয়ে দেখল, আশপাশের বাড়ি, ফ্ল্যাটবাড়ি সব ঘুমিয়ে আছে। তাদের বাগানের গাছগুলো বেশ ঝরঝরে, ভোরের আলোয় তাজা। ফোনটা কি এখনই করবে?
করেই ফেলা যাক। কাল থেকে এখন পর্যন্ত হাতের নিশপিশে ভাবটা কাটেনি। সোফায় বসে ল্যান্ডফোন থেকে সন্দীপনের মোবাইলে ফোন করে অনন্যা। ও প্রান্তে ঘুম জড়ানো গলা, এত সকালে, কী ব্যাপার!
আমি অফিস বেরোনোর আগেই পেপার্স নিয়ে এসো, সই করে দেব। সে কী, হঠাৎ এত মেন্টাল স্ট্রেংথ কোথায় পেলে? সন্দীপনের প্রশ্নে বিস্ময় মেশানো। সেটা জানার থেকে তোমার বোধহয় সইটা বেশি জরুরি। ওকে, আসছি বলে, ফোন কেটে দেয় সন্দীপন।
এতক্ষণে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। তালুর অস্বস্তিটাও গেছে কেটে। অনন্যা কিচেনে যায় চায়ের জল বসাতে।
পুরনো প্রেমিক আসবে। পোশাক বদলায়নি অনন্যা। নাইট গাউন পরেই আছে। ঠিক করেছে, সন্দীপন এলে পুরো দরজা খুলবে না। কাগজটা নেবে, সই করে ফেরত দেবে দরজার ফাঁক দিয়েই, যেভাবে স্বপ্নের লোকটা তার দিকে লাল ব্লাউজ এগিয়ে দিচ্ছিল। …এতটা ভেবে ফিক করে হেসে ফেলল অনন্যা, ব্যাপারটা অতি নাটকীয় হয়ে যাবে। তবে সন্দীপনকে এখানে বসতে দেওয়া যাবে না। সোফায় বসে অনন্যা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক মারে। দিনের প্রথম আলোতে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎ অন্যমনস্কভাবে আবিষ্কার করে, একলা শব্দটা কিছুতেই একা শব্দের সমার্থক হতে পারে না। একা অনেক পরিপূর্ণ, একলার মতো নিঃসঙ্গ নয়।
সানন্দা পার্বণী, ২০০৯