৯
অর্জুনস্তু ততঃ সর্বং প্রতিজজ্ঞে পরন্তপ।
অর্জুন বলল, আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করব আচার্য।
.
পাণ্ডব-কৌরব সকল কুমার নিয়ে দ্রোণাচার্য তাঁর শিক্ষাদান কার্যক্রম শুরু করলেন। দ্রোণাচার্যের ইচ্ছাতেই রাজপ্রাসাদের বাইরে তাঁর আবাসস্থল নির্ধারিত হলো। এই গৃহ সুসজ্জিত করে পানভোজনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হলো। আচার্যকে যাতে কোনো কিছু যাচনা করতে না হয়, সেজন্য তাঁর আবাসস্থলেই ধনধান্যের ভাণ্ডার মজুদ করা হলো।
অন্নময় অবস্থা দ্রোণাচার্য কামনা করেছেন বটে, কিন্তু এ রকম প্রাচুর্যময় জীবনের কথা স্বপ্নেও ভাবেন নি কোনোদিন। তাঁর সামনে বারবার ভেসে ওঠে একটি দুগ্ধবতী গাভীর জন্য সারা পাঞ্চালদেশ চষে বেড়ানোর দৃশ্যটি। তিনি কিছুতেই ওই দৃশ্যটি ভুলতে পারেন না। তাঁকে সর্বদা রক্তাক্ত করে ধনীপুত্রদের উপহাসধ্বনি। আর দ্রুপদের অপমানের কথা মনে হলে তাঁর বিনিদ্র রাত কাটে
যেখানে দ্রোণাচার্যের গৃহখানি, তার একটু দূরেই শিষ্যদের আবাসস্থল। আবাসস্থলের চারদিকে ঘন অরণ্য। অরণ্য শ্বাপদসংকুল। দীর্ঘ, বিশাল বিশাল বৃক্ষে পরিপূর্ণ সেই অরণ্য। বৃক্ষগুলো এমন ঘন নিবদ্ধ যে, সূর্যকিরণ পর্যন্ত সহজে প্রবেশ করতে পারে না অরণ্যভূমিতে। দ্রোণই ভীষ্মকে বলে এই আবাসগৃহগুলো তৈরি করিয়ে নিয়েছেন।
তিনি জানেন—ছেলেরা মাতৃপিতৃ-স্নেহছায়া থেকে বেরিয়ে না এলে, রাজপ্রাসাদের সুখৈশ্বর্য থেকে বিচ্ছিন্ন না করলে তাদের শিক্ষাজীবন সুসম্পন্ন হবে না। গুরুগৃহের অদূরে শিষ্যদের থাকার ব্যবস্থা এইজন্য যে, যাতে সার্বক্ষণিক তারা গুরুর তত্ত্বাবধানে থাকতে পারে। তাতে শিষ্যদের মঙ্গল। পরিবার-বিচ্ছিন্ন শিষ্যরা একাগ্রমনে অস্ত্র সাধনা করতে পারবে। তাই আচার্য দ্রোণ রাজকুমারদের অনেকটা নির্বাসনে নিয়ে গেলেন। সেই নির্জন অস্ত্রবিদ্যা পাঠাশ্রমে শিষ্যরা নববিদ্যাপাঠে আগ্রহী হয়ে উঠল। একাগ্র নিষ্ঠায় দ্রোণাচার্য রাজকুমারদের ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন।
দীর্ঘদিন কেটে গেল। গুরু আর শিষ্যদের মধ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হলো। অর্জনের পথেও শিষ্যরা বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল।
ইদানীং দ্রুপদের লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে দ্রোণাচার্যের। তাঁর মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা খাণ্ডবদাহের রূপ নেয়। একদিন তিনি পাণ্ডব-কৌরব সকল শিষ্যকে সামনে সমবেত করলেন। বললেন, ‘আমার মনের গভীরে একটা গোপন ইচ্ছা আছে। সেই ইচ্ছাটা দিনরাত আমার মধ্যে ঘুরপাক খায়।’
‘কী ইচ্ছা গুরুদেব?’ স্বভাবসুলভ নরম কণ্ঠে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করে।
যুধিষ্ঠিরের কথা যেন আচার্য শুনতে পান নি। চোখ নিমীলিত করে তিনি বললেন, ‘তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণত সম্পন্ন হয়ে গেলে, বলো তোমরা আমার সেই অভিলাষ পূরণ করবে?’
প্রবল একটা আকুলতা আচার্যের কথায় ঝরে পড়ছে। কিন্তু একী! কেউ কথা বলছে না কেন? গুরুর কথা শুনে কোথায় সবাই সমস্বরে সম্মতি জানাবে, তা না, প্রায় সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? একমাত্র অর্জুন ছাড়া একশ’ ভাই কৌরব, চার পাণ্ডব অধোবদনে দাঁড়িয়ে আছে। শিষ্যদের নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রোণাচার্য ভড়কে গেলেন। কী ব্যাপার! সবাই চুপচাপ কেন? তাহলে তাঁর শিক্ষা কি বৃথাই গেল? শিষ্যদের মনের মধ্যে একটুখানি শ্রদ্ধার জায়গা কি তাহলে তিনি তৈরি করতে পারেন নি? তাহলে তাঁর এতদিনের অভিলাষ, তাঁর মনে লালিত অভিপ্রায়—সবই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?
একটা গভীর বিষণ্নতাবোধ তাঁকে ঘিরে ধরতে লাগল। সামনে দাঁড়ানো শিষ্যরা কি তাঁর চোখে অস্পষ্ট হয়ে আসছে? দু’হাতের তালু দিয়ে চোখ দুটো কচলাতে লাগলেন দ্রোণাচার্য। এই সময় একজনের কণ্ঠ শুনতে পেলেন তিনি। সে অর্জুন। অর্জুন বলছে, ‘আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করব আচার্য।’
দ্রোণ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। চোখ তুলে তাকালেন তিনি অর্জুনের দিকে। ঠিক শুনছেন তো তিনি? তাবড় তাবড় শিষ্য তাঁর। যুধিষ্ঠির-ভীম- নকুল-সহদেব, দুর্যোধন-দুঃশাসন-বিবর্ণ-দুর্বিষহ-দুর্মুখরা শতভাই। অশ্বত্থামাও তো আছে। ও তাঁর পুত্র হলে কী হবে, শিষ্য তো! কেউ কথা বলল না, কেউ সম্মতি জানাল না। সম্মতি জানাল অর্জুন! বলল, ‘আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করব আচার্য।’
দ্রোণের চোখমুখ থেকে বিস্ময় কেটে গেল। একটা প্রশান্ত স্নিগ্ধভাবে তাঁর মুখমণ্ডল আবৃত হলো। তিনি নতমস্তকী শিষ্যদের দিকে তাকালেন এবার। তাঁর কপাল কুঁচকানো, দু’চোখে প্রচণ্ড ঘৃণা আর করুণার মেশামেশি। তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবার। অর্জুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎস অর্জুন, এই যে তুমি আমার ইচ্ছা পূরণ করার কথা দিলে, কী আমার ইচ্ছা তা তো জানতে চাইলে না! তোমার সাধ্যাতীত কোনো বাসনাও তো আমার থাকতে পারে!’
‘গুরুদেব দ্বিতীয় পিতা। শিষ্য আর পুত্র সমান। পিতার ইচ্ছা পূরণ করবার দায়িত্ব শিষ্য অথবা পুত্রের ওপর বর্তায়। আমার যা কিছু বর্তমানের অর্জন, সবই তো আপনার জন্যই। আর সাধ্যাতীতের কথা বলছেন আচার্য, আপনার বাসনা পরিপূরণের জন্য আমি প্রাণান্ত চেষ্টা করব। তার পরও যদি ব্যর্থ হই, তা তো আপনি দেখতে পাবেনই।’ আস্থার কণ্ঠে অর্জুন বলল।
‘যথার্থ বলেছ বৎস।’ স্মিত হেসে দ্রোণাচার্য বললেন।
এবার অর্জুন বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সেই অপূরিত বাসনাটা কী গুরুদেব?’
ঠোঁট টিপে হাসলেন দ্রোণাচার্য। প্রশান্ত চোখে বললেন, ‘সেই অভিলাষের কথা এখন বলব না তোমায়। সময় এলে জানতে পারবে।
তারপর কণ্ঠকে একটু উঁচুতে নিয়ে গিয়ে শ্লেষমিশ্রিত গলায় বললেন, ‘তোমরা এখন যাও বাছারা। তোমাদের খেলার সময় হয়ে এল।’
সবাই চলে যেতে উদ্যত হলে নিচু কণ্ঠে আচার্য বললেন, ‘অর্জুন আর অশ্বত্থামা, তোমরা অপেক্ষা কোরো।’
অর্জুনের শ্রদ্ধাবোধ আর মানসিক দৃঢ়তা দ্রোণাচার্যকে মুগ্ধ করেছে। বীরত্ব এবং শৌর্য যে এই ছেলেটির মধ্যে বর্তমান, তা তিনি যথার্থ বুঝতে পারলেন। তাই অর্জুনের প্রতিজ্ঞাবাক্য শুনে আচার্যসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। জড়িয়ে ধরলেন অর্জুনকে। সস্নেহে শিষ্যটির মস্তকাঘ্রাণ করলেন। আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে করতে অশ্বত্থামার ডান হাতখানি অর্জুনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘পুত্র, আজ থেকে এই অর্জুনকে তোমার প্রিয় সখা বলে জানবে।’
অর্জুন বিমোহিত। আচার্য দ্রোণ তাঁর পুত্রের হাত তার হাতে সমর্পণ করলেন! কিংকর্তব্যবিমূঢ় অর্জুন। প্রথমে অশ্বত্থামাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সে সংবিতে এল। ধর্মানুসারে তো গুরুপুত্র গুরুবৎ পূজ্য। সঙ্গে সঙ্গে অশ্বত্থামার চরণস্পর্শ করল অর্জুন। বলল, ‘আজ থেকে গুরুদেবের মতো আপনারও অধীন হলাম আমি। আপনি ও আমার গুরু বটে।’
ওই দিন থেকে অর্জনের প্রতি দ্রোণাচার্যের পক্ষপাতিত্ব শুরু হলো। দ্রোণাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালায় ছাত্র তো আর কম নয়। কৌরব-পাণ্ডবরা আছে। আর আছে বহির্দেশের রাজকুমাররা। শূরসেন মথুরা অঞ্চলের বৃঞ্চি-অন্ধক রাজবংশের কুমাররা দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে এসেছে। আরও এসেছে খ্যাত-স্বল্পখ্যাত দেশের রাজপুত্ররা। ছাত্রদলের মধ্যে আরও আছে কর্ণ। পাণ্ডব, কৌরব, কর্ণ এবং নানা দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচাইতে এগিয়ে গেল অর্জুন।
অর্জুনের জন্য গুরুর আনুকূল্য যেমন ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল স্বনিষ্ঠা। শিক্ষা, বাহুবল, উদ্যোগ আর ভালোবাসার গুণে অর্জুন দ্রোণাচার্যের কাছে প্রশংসিত হলো। তিনি দেখলেন—একজন ছাত্রের যে অনুসন্ধিৎসা, বলবতী জিজ্ঞাসা, শিক্ষার বিষয়ের প্রতি অনুরাগ থাকার কথা, সবই অর্জুনের মধ্যে আছে। সবাইকে সমান তালে অস্ত্রশিক্ষা দিলেও তীর চালানোর শীঘ্রতা এবং শিল্পীজনোচিত সৌষ্ঠব অর্জুনের মধ্যেই বেশি বর্তমান। তাই তিনি মনে মনে অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ ছাত্রের আসনে বসালেন।
অশ্বত্থামাও কিন্তু কম দক্ষ নয়। পিতা বলেও কথা। পুত্রের প্রতি আচার্যের অর্জুনাধিক ভালোবাসা। তাই তিনি অশ্বত্থামাকে আলাদা করে একটু বেশি তালিম দিতে মনঃস্থ করলেন। কিন্তু কী করে দেবেন? অর্জুন তো সার্বক্ষণিক পাঠশালার চৌহদ্দিতে থাকে। একটা বুদ্ধি বের করলেন আচার্য। সকালবেলায় ছাত্ররা জলঘাটে যায়। প্রত্যেকের হাতে একটা কমণ্ডলু দিয়ে আচার্য বললেন, আসবার সময় এটি ভরে জল নিয়ে এসো। আর অশ্বত্থামার হাতে দিলেন একটা কলসি। কমণ্ডলুতে জল ভরতে যত সময় লাগে, কলসিতে ভরতে তত লাগে না। অশ্বত্থামা জল নিয়ে আগে ফেরে। এই ফাঁকে বাড়তি বিদ্যা তাকে দান করেন দ্রোণাচার্য।
দু’দিনেই অর্জুন অশ্বত্থামার কলসি-রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলল। গুরুকে কিছু বলল না অর্জুন, কোনো অনুযোগও করল না। শুধু অস্ত্রের সাহায্যে দ্রুত কমণ্ডলুতে জল ভরে অশ্বত্থামার সঙ্গে ফিরতে লাগল। আচার্যের কী আর করা! যেটুকু বাড়তি কৌশল অশ্বত্থামাকে শেখাতেন, অর্জুনকেও তাই শেখাতে লাগলেন। অস্ত্রবিদ্যায় অশ্বত্থামা আর অর্জুনের মধ্যে কোনো তফাত থাকল না।
.
দীর্ঘদিন অস্ত্রশিক্ষা চলল। বালকরা প্রায়-যুবক হয়ে উঠল। সকলে যৌবন-ঝলসিত তরুণ। তাদের কাঁধনামা কেশভার, কর্ণে দুল, কণ্ঠে কণ্ঠমালা। পিঠে তীক্ষ্ণ তীরভর্তি তূণ। আর কাঁধে ঝুলানো ধনুক। প্রত্যেকের ভেতরে যৌবনদীপ্ত পৌরুষ টগবগ করছে। একদা যে পাঠশালা বালকদের ছোট ছোট পায়ের স্পর্শে স্পন্দিত হতো, আজ সেই পাঠশালার অন্তরঙ্গন-বহিরঙ্গন যুবকদের দৃঢ় পদভারে কম্পিত হচ্ছে।
ধনুর্বিদ শিষ্যদের পাঠ্যক্রম সমাপনের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু একটি বিদ্যা এখনো তারা অর্জন করতে পারে নি। তা হলো শব্দভেদাস্ত্র বিদ্যা। লক্ষ্যবস্তুকে চোখে না দেখে শুধু শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করা। অসীম ধৈর্য, নিদারুণ কষ্টসহিষ্ণুতা প্রয়োজন এই বিদ্যা অর্জনে। তাই আরাম-আয়েশপ্রবণ ছাত্ররা এই বিদ্যা অর্জন না করে বাড়ি ফেরে। দ্রোণাচার্যও জানেন, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে শুধু একজনই অধিকার রাখে শব্দভেদাস্ত্রের। সে অর্জুন। অর্জুন ধ্যানী, মেধাবী এবং সতত চেষ্টাশীল। কিন্তু সহজে তো এই দুষ্প্রাপ্য অস্ত্র অর্জুনের হাতে সঁপে দেওয়া যায় না। অর্জুনকে পরীক্ষা করা দরকার।
এক রাতে সব শিষ্য আহারে বসেছে। উতল হাওয়ায় প্রদীপ নিবে গেল। অন্যরা আহারে বিরত থাকল। অর্জুন ভোজনকার্য চালিয়ে গেল। সে দেখল—নিরেট অন্ধকারেও খাবার খেতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অন্নাধারে হস্ত প্রসারণ থেকে শুরু করে মুষ্টিবদ্ধ অন্ন মুখে প্রবেশ করানো পর্যন্ত কোনো কাজই তো অন্ধকারের কারণে আটকে থাকছে না! তাহলে অভ্যাসই সবকিছু। এই অভ্যাসই তাকে শব্দভেদে সাহায্য করবে।
সেই অন্ধকার রাতে সকল সহপাঠী ঘুমিয়ে পড়লে অর্জুন তীর-ধনুক নিয়ে আবাসস্থলের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর রাত্রিভেদী শব্দ শুনে অলক্ষ্য বস্তুর ওপর বাণ নিক্ষেপ শুরু করল।
বাতাসে বাণক্ষেপণের শন শন শব্দ। এই শব্দ দ্রোণাচার্যের কানে পৌঁছাল। আচার্য সেই রাত্রেই শয্যা ছেড়ে নির্জন বনপ্রান্তে এসে পৌঁছালেন। দেখলেন—অর্জুনের জ্যা থেকে শন শন শব্দে তীক্ষ্ণ তীরগুলো তড়িদ্বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রোণাচার্য নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। পরম মমতায় অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, ‘বৎস, তুমি আমার যথার্থ শিষ্য।
অর্জুন আচার্যের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করল। করজোড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পিতাকে হারিয়েছি শৈশবে। তাঁর স্নেহ পাই নি। তাঁর চেহারাও আজ আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। প্রথম দিন দেখেই আপনাকে পিতার জায়গায় স্থান দিয়েছি। আপনি আমাকে যেভাবে ভালোবাসেন, সেভাবে ভালো বোধহয় শুধু পিতারাই বাসতে জানেন।’
অর্জুনের কথা শুনে দ্রোণাচার্যের হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। অর্জুনকে কাছে টেনে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘কেউ যাতে এই পৃথিবীতে তোমার মতো ধনুর্ধর হয়ে না ওঠে, আজ থেকে তোমার শিক্ষার জন্য আমি সেই চেষ্টাই করব।’
তারপর তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই আমার প্রতিজ্ঞা। তোমার অস্ত্রশিক্ষার কাছে আমার পুত্র অশ্বত্থামার শিক্ষা তুচ্ছ বলে বিবেচিত হবে আমার কাছে।’
নিস্তব্ধ প্রান্তরের বাতাসে এই শব্দনিচয় প্রতিধ্বনি তুলল। একটা একটা শব্দ আলাদা আলাদা গাম্ভীর্য নিয়ে অর্জুনের কানে বাজতে লাগল—এই আমার প্রতিজ্ঞা। পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর করে তুলব আমি তোমাকে।
কর্ণ কৌরব-পাণ্ডবদের সঙ্গেই দ্রোণাচার্যের অস্ত্র পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিল। কৰ্ণ সূত অধিরথের পালিতপুত্র। জনসমাজে সূতপুত্র হিসেবে কর্ণের পরিচয়। দ্রোণাচার্যও তা জানতেন। সূতজাতীয় হওয়া সত্ত্বেও আচার্যের অস্ত্রাশ্রমে ভর্তি হতে কর্ণকে বেগ পেতে হয় নি। কারণ কর্ণের পালকপিতা অধিরথ কুরুপ্রাসাদে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কুরুবাড়ির রাজপুত্রদের সতীর্থ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল কর্ণ আরও একটি কারণে। তা হলো, দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কর্ণ। দুর্যোধনের মধ্যে ছিল জ্ঞাতিশত্রুতার বিষ। তার শোণিত-শিরায় ব্যাপ্ত ছিল পাণ্ডববিদ্বেষ। নিবিড় সাহচর্যের কারণে দুর্যোধনের বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা কর্ণ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
পাণ্ডব-কৌরবরা যখন কৃপাচার্যের শিষ্য ছিল, তখন থেকেই অর্জুনকে অবজ্ঞা করা শুরু করেছিল কর্ণ। অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কারণে-অকারণে অর্জুনকে খোঁচা দিত সে। নানাভাবে তাকে অপমান করে আনন্দ পেত কর্ণ। আর কর্ণ এসব করত দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে। দ্রোণাচার্যের শিষ্য হওয়ার পরও কর্ণ পূর্ব প্রবণতা ত্যাগ করে নি। কিন্তু আচার্যের অস্ত্রাশ্রমে কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিল না। তবে কর্ণ তেমন খারাপ ছাত্র ছিল না। অর্জুনের সমকক্ষ অস্ত্রবিদ্ হওয়ার জন্য কর্ণ উঠে পড়ে লাগল।
যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনের মা কুন্তী। কর্ণ এই কুন্তীরই কুমারী অবস্থার সন্তান। বলা যেতে পারে, অবৈধ সন্তান। সেই সূত্রে যুধিষ্ঠির ভীম-অর্জুনও কানীন সন্তান। কিন্তু পরপুরুষের মাধ্যমে সন্তান ধারণে কুন্তীকে সজ্ঞানে অনুমতি দিয়েছিলেন স্বামী পাণ্ডু। ফলে এই সন্তানরা বৈধতার স্বীকৃতি পেয়েছিল সমাজে, রাজপ্রাসাদে। কিন্তু কর্ণের জন্মের সময় কুন্তী ছিলেন কুমারী। সন্তানধারণের ব্যাপারে কারও অনুমতি নিতে পারেন নি কুন্তী। অনেকটা খেয়ালের বশে কর্ণকে পেটে ধরা। কিন্তু অবৈধ সন্তান বলে কর্ণ জন্মমুহূর্তেই পরিত্যক্ত হয়েছিল। স্বীকৃতি আর মাতৃস্নেহ-দুটো থেকেই বঞ্চিত হয়েছিল শিশু কৰ্ণ।
কুন্তী জন্মেছিলেন মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে। ওই রাজ্যের রাজা আর্যক শূর। এই রাজাই কুন্তীর জন্মদাতা পিতা। কিন্তু রাজা শূর কন্যা কুন্তীকে দত্তক দিয়ে দেন আপন পিসতুতো ভাই কুন্তিভোজের কাছে। কুন্তিভোজের প্রাসাদেই কুন্তীর বড় হয়ে ওঠা।
একদিন কুন্তিভোজের বাড়িতে এলেন ঋষি দুর্বাসা। কুন্তিভোজ কন্যা কুন্তীকে দুর্বাসার সেবা করার দায়িত্ব দিলেন। কুন্তীর সদাচার ও সেবাপরায়ণতা দেখে ঋষি দুর্বাসা তুষ্ট হলেন। দেবসম্ভোগের বর পেলেন কুন্তী দুর্বাসার কাছ থেকে।
মুনি চলে গেলেন। কুন্তীর ভেতর একধরনের ছটফটানি। দুর্বাসা যে বর দিলেন, তার তো পরীক্ষা করা দরকার। কুন্তীর মধ্যে মানসিক বিভ্রম তৈরি হলো। ঘোর লাগা মানসিক অবস্থায় তিনি সূর্যদেবকে স্মরণ করলেন। স্মরণমাত্র সূর্যদেব কুন্তীর সামনে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘দেহদান কোরো।’
বিব্রত কুন্তীর কণ্ঠনালি শুকিয়ে গেল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমি কুমারী। দেহ দেব কী করে?’
‘তুমি যে মন্ত্রোচ্চারণ করে আমাকে স্মরণ করেছ, তার নাম দেহসম্ভোগ মন্ত্র। এর একটি মাত্র পরিণতি দেহদান করা। কোনো গত্যন্তর নেই তোমার। আমার শয্যাসঙ্গিনী হতেই হবে তোমাকে।
নিরুপায় কণ্ঠে কুন্তী বললেন, ‘আমার কৌমার্য?’
‘কৌমার্য তোমার ঠিক থাকবে। তোমার অনুকূলে আমার আশীর্বাদ থাকবে।’ সূর্যদেবতা বললেন।
উভয়ের সম্মিলনে একটি পুত্র জন্মাল। কৌশলে আপন বস্ত্রাঞ্চলে গর্ভবতী অবস্থাকে রেখেঢেকে রেখেছিলেন কুন্তী। পুত্রটি ঠিক বাবার মতোই হলো। দেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য কবচ-কুণ্ডল নিয়ে জন্মাল সন্তানটি। কিন্তু এ যে কলঙ্ক! এই কলঙ্কচিহ্ন ত্যাগ করতে হবে। পিতা কুন্তিভোজ অথবা রাজপ্রাসাদের কেউ জানতে পারলে মৃত্যুর অধিক বেদনার সৃষ্টি হবে। তাহলে কী করা? ধাত্রী বুদ্ধি জোগাল—পুত্রটিকে নদীজলে ভাসিয়ে দিন রাজকুমারী। আপনি কলঙ্কচিহ্নমুক্ত হবেন। আর এই নবজাতকের ভাগ্য যদি ভালো হয়, কারও হাতে পড়বে। বেঁচেও যেতে পারে।
ধাত্রীর পরামর্শ কুন্তীর মনে ধরল। একটা বড়োসড়ো স্বর্ণপেটিকার মধ্যে নবজাতকটিকে শুইয়ে দিয়ে অশ্বনদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। নদীপারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে জোড় হাতে কুন্তী পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন—তুই যেখানেই যাস, বেঁচে থাকিস বাছা। তোর বাবা সূর্য কিরণচক্ষুতে সর্বত্র দেখতে পান। তিনি আকাশ থেকে তোকে সর্বদা পাহারা দেবেন।
অশ্বনদীর জলের ঢেউ আর স্রোত সেই সোনার পেটিকাটিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। পেটিকা চলে এল অশ্বনদী ছেড়ে চর্মন্বতী নদীতে। চর্মস্বতী শিশুসহ পেটিকাটিকে পৌঁছে দিল যমুনায়। যমুনা থেকে গঙ্গায়। গঙ্গার ধারেই চম্পানগরী। এই নগরীটি অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। অঙ্গরাজ্য হস্তিনাপুরের অন্তর্গত। এই অঙ্গরাজ্যে বাস করেন সূত অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী রাধা। অধিরথ হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু। এককালে রাজবাড়ির রথ চালাতেন। তাই তিনি সূত। এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় সেই পেশা ত্যাগ করেছেন। কিন্তু সকলের কাছে তিনি সূত অধিরথ নামে পরিচিত।
অধিরথ-রাধা দম্পতি নিঃসন্তান। ধর্মকর্ম করে দিন কাটান। সেদিন রাধা এসেছেন গঙ্গায় স্নান করতে। রাধা গঙ্গায় নেমেছেন, অধিরথ পারে দাঁড়িয়ে পরিচিতদের সঙ্গে কথালাপে মগ্ন। হঠাৎ রাধার চিৎকার শুনতে পেলেন অধিরথ, ‘ওগো, দেখে যান, দেখে যান। ওই যে অদূরে জলের ওপর একটা পেটিকা দেখা যাচ্ছে না?’
অধিরথ ভালো করে চেয়ে দেখলেন, তাই তো, পেটিকার মতো কী যেন একটা ভেসে যাচ্ছে গঙ্গাস্রোতে। বললেন, ‘পেটিকাই তো। বেশ বড়োসড়ো মনে হচ্ছে। কী হতে পারে বলো তো?’
‘যাই হোক, ওই পেটিকা কূলে ভেড়ানোর ব্যবস্থা করুন। ভেতরে কী আছে তা দেখার বড় কৌতূহল হচ্ছে আমার।’
স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন অধিরথ। তিনি স্ত্রীর কোলে একটা সন্তান উপহার দিতে পারেন নি সারা জীবনে। একজন নারীর পরিপূর্ণতা যে মাতৃত্বে, সেই মাতৃত্ব রাধার অনাস্বাদিত থেকে গেছে। অধিরথ ভেবেছেন—এই ব্যর্থতার জন্য তো তিনি স্বয়ং দায়ী। এই অপরাধবোধ থেকে রাধাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখতে চাইতেন তিনি। যা কামনা করতেন, যে-কোনো মূল্যে তা পূরণ করতেন। তাই রাধার কৌতূহল পূরণের জন্য লোকজন জড়ো করলেন অধিরথ। তাদের সাহায্যে স্বর্ণ পেটিকাটি তীরে তুললেন।
পেটিকা খুলতেই সবাই ঘুমন্ত এক শিশুকে দেখতে পেলেন। তার গায়ের রং প্রভাতের সূর্যরশ্মির মতো। রাধা সেই পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নিতেই দুখি দু’জন মানুষের সন্তানবাৎসল্য উথলে উঠল। রাধার অতৃপ্ত জননীহৃদয় আনন্দে বিগলিত হয়ে গেল। নবলব্ধ পুত্রকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তাঁরা।
গায়ে সোনার কবচ-কুণ্ডল দেখে তার নামকরণ করা হলো বসুষেণ। সূত অধিরথের বাড়িতে লালিতপালিত হতে হতে বসুষেণের পরিচয় হয়ে গেল—সূতপুত্র হিসেবে।
বড় গ্লানি জমতে লাগল অধিরথের মনে। তিনি নিজে না হয় সূত, দৈবপ্রেরিত এই বালকটি তো তাঁর ঔরসে জন্মায় নি। তারপরও সামাজিকগণ তার কপালে হীন অভিধা সেঁটে দিল। তাই একটু বয়স হতেই ছেলেটিকে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। পুত্রের সার্বিক বিদ্যালাভের আশায় বসুষেণকে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন অধিরথ। হস্তিনাপুর এসে বসুষেণের নাম হয়ে গেল কর্ণ।
ধৃতরাষ্ট্র আপন পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের সঙ্গে কর্ণকে কৃপাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালায় পাঠালেন। তারপর আচার্য দ্রোণের গুরুকুলে। আশ্রমের ভালো ছাত্র ছিল ভীম, দুর্যোধন, কর্ণ, অশ্বত্থামারা। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম ছিল অর্জুন। অর্জুনের ভীষণ ভালো হওয়াটাই কর্ণের ঈর্ষার প্রধান কারণ। ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের প্রয়োগ-নৈপুণ্য লক্ষ করে কর্ণ ধীরে ধীরে হতাশা বোধ করতে শুরু করল। এই হতাশা থেকে তৈরি হলো ক্রোধ। এই ক্রোধ অর্জুনের প্রতি। কর্ণ বুঝল—তার পক্ষে অর্জুনের অস্ত্রপ্রয়োগ-কৌশলকে ডিঙানো সম্ভব নয়। সে সিদ্ধান্ত নিল—শক্তি নয়, এমনকি কৌশলও নয়, মারণাস্ত্র দিয়ে অর্জুনকে সরিয়ে দেবে এই পৃথিবী থেকে।
এই মারণাস্ত্র আছে আচার্য দ্রোণের কাছে। যে করেই হোক, তাঁর কাছ থেকে এই অস্ত্র আদায় করে নিতে হবে। গুরুপরম্পরায় আচার্য এই অস্ত্রের অধিকারী হয়েছেন। কর্ণ নিজেও তো দ্রোণের শিষ্য। সুতরাং এই অস্ত্র পাওয়ার অধিকার তার আছে। একবার এই মারণাস্ত্রের প্রহার-সংহরণের প্রক্রিয়া গুরুর কাছ থেকে জেনে নিতে পারলে সহজেই অর্জুনকে শায়েস্তা করা যাবে। দুর্যোধনের কাছ থেকে যে পাণ্ডববিরোধিতা তার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো প্রচণ্ড ঈর্ষা। ফলে কর্ণ বেপরোয়া হয়ে উঠল।
এক অপরাহ্ণে কর্ণ দ্রোণাচার্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আশপাশে কেউ নেই। নেই অশ্বত্থামাও। গ্রীষ্মের অপরাহ্। চারদিক শুনশান। পাখিরা ধীরেসুস্থে তাদের কুলায় ফিরতে শুরু করেছে। সূর্যের গায়ে কালো মেঘের ছায়া। সমীরণ ধীরগতিতে প্রবহমান।
জোড়াসনে বসে দ্রোণাচার্য কী যেন একটা গ্রন্থ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। কর্ণের উপস্থিতি তিনি টের পান নি। কর্ণ একটু দূরে জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। একটা মূষিক ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে হঠাৎ দৌড়ে গেল। আচার্যের বিকর্ষণ সৃষ্টি হলো। গ্রন্থ থেকে মুখ তুললেন তিনি। দেখলেন, সামনে কর্ণ দাঁড়িয়ে। আচার্য ভালোরকমেই অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কর্ণ! তুমি এখানে! এই সময়ে!’
উত্তর না দিয়ে কর্ণ সাষ্টাঙ্গে গুরুদেবকে প্রণাম করল। প্রণাম শেষে করজোড়ে উঠে দাঁড়াল।
‘কী কৰ্ণ? কিছু বলছ না যে?’ কিছুটা নরম কণ্ঠে বললেন আচার্য।
‘আমি অস্ত্রদীক্ষা নিতে এসেছি আপনার কাছে।’
হো হো করে হেসে উঠলেন দ্রোণাচার্য। ‘কী আশ্চর্য! তুমি কি আমার শিষ্য নও? তুমি কি আমার কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিচ্ছ না?
‘আমি সাধারণ অস্ত্রের কথা বলছি না গুরুদেব।’
আচার্য বললেন, ‘কোন অস্ত্রের কথা বলছ তুমি?’
কর্ণ গুরুর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিল না। প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কর্ণ বলল, ‘এই ভারতবর্ষে কেন, সমস্ত ভূমণ্ডলে আপনার সমকক্ষ অস্ত্রগুরু নেই। পৃথিবীর যে-কোনো ধনুর্ধর আপনার সম্মুখে মুহূর্তমাত্র দাঁড়াতে পারবে না। এই ধরণীর যে-কোনো অস্ত্রগুরু আপনার নাম শুনলে কপালে ডান হাত ঠেকান।’
কী চায় কর্ণ? এ রকম চাটুকারিতা করছে কেন? তিনি যা নন, তা বলে তাঁকে সর্বোত্তমের আসনে অভিষিক্ত করতে চাইছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো দুরভিসন্ধি আছে কর্ণের। নইলে এই নির্জন অপরাহ্ণে সে আমার কাছে এল কেন? যে কর্ণ সর্বদা সরাসরি কথা বলতে অভ্যস্ত, সে কর্ণ এত তোষামুদে গলায় কথা বলছে কেন? তার অভিপ্রায় যে সৎ নয়, তা বুঝতে দ্রোণাচার্যকে বেগ পেতে হচ্ছে না। কিন্তু অভিপ্রায়টা কী তা বুঝে উঠতে পারছেন না আচার্য।
দ্রোণ বললেন, ‘তোমার অভিপ্রায় কী, শোনাও।’
কর্ণ আবার বাঁকা পথ বেছে নিল। বলল, ‘গুরুদেব, সূর্যকিরণ সব প্রাণীর ওপর সমানভাবে পতিত হয়। কারও ওপর কম আবার কারও ওপর বেশি নয়। তেমনি গুরুর কৃপাও সকল শিষ্যের ওপর বর্ষিত হয়। সকল শিষ্যের প্রতি আপনার সমদৃষ্টি।’
‘তুমি কী বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো কৰ্ণ।’
‘আপনার সমদর্শিতার পরও যেন কেউ বলতে না পারে কর্ণ আচার্যের শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও সঠিক বিদ্যা অর্জন করে নি।’
এবার স্থির চোখে গমগমে গলায় দ্রোণাচার্য বলে উঠলেন, ‘ভূমিকা রাখো। কী বলতে চাও তুমি?’
‘গুরুদেব, আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা দান করুন। এই ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়বার এবং সংবরণ করবার করণকৌশল আমাকে শিখিয়ে দিন।’
‘ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে তুমি কী করবে?’
দ্বিধাহীন কণ্ঠে এবার কর্ণ বলল, ‘অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাই। পরাজিত করতে চাই তাকে।’
‘পরাজিত করতে চাও? অর্জুনকে? কেন?’ স্তম্ভিত গলায় আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন দ্রোণাচার্য।
‘গুরুকুলে অর্জুন কেন শ্রেষ্ঠতম হবে? তার চেয়ে আমি কম কিসে? দেখেছি— আপনি তাকে সর্বদা আনুকূল্য দিচ্ছেন। অথচ এই আনুকূল্য পাওয়ার কথা দুর্যোধনের। ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র। রাজপুত্রই তো গুরু-আনুকূল্যের সর্বাধিক অধিকার রাখে। কিন্তু আপনার মমতা দুর্যোধনের জন্য নেই বললেই চলে। আপনার সকল স্নেহাতিশয্য অর্জুনকে ঘিরে। এমনকি আপনার পুত্র অশ্বত্থামাও আপনার স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত কেন? এটা কি আপনার পক্ষপাতিত্ব নয়।’
থামল কর্ণ। সে যে অনেক অপ্রীতিকর কথা এর মধ্যে বলে ফেলেছে, বুঝতে পারল। বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘অপরাধ ক্ষমা করবেন গুরুদেব। তারুণ্যসুলভ বাচালতায় অনেক কিছু বলে ফেলেছি।’
দ্রোণ বুঝলেন কর্ণ নাছোড়। তা ছাড়া সে যে-কথাগুলো বলল, মিথ্যে তো নয়। তাঁর আনুকূল্য অর্জনের জন্য সর্বাধিক—এও অসত্য নয়। কর্ণকে কী করে বোঝাবেন— অর্জুন তাঁর কাছে পুত্রাধিক। অর্জুনের প্রয়াস, প্রচেষ্টা, ধীরতা আর বিনয় তাঁকে পক্ষপাতী করে তুলেছে। কোন গুরু মেধাবী এবং বিনয়ী শিষ্যের প্রতি পক্ষপাতী না হবেন? এই কারণে তিনি অতি গোপনে অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছেন। শিখিয়েছেন এর প্রয়োগ ও সংবরণের করণকৌশল। এও বলেছেন, এই অস্ত্র দুর্বলের প্রতি প্রয়োগের জন্য নয়, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রয়োগের জন্যও নয়।
অসূয়াপ্রবণ, ক্রোধান্ধ কর্ণকে এই মারণাস্ত্র দেবেন? সে তো প্রতিহিংসাপ্রবণ এবং দুর্যোধনের প্রতি পক্ষপাতী। এ রকম অসদিচ্ছাপ্রবণ কর্ণের হাতে কিছুতেই ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেবেন না দ্রোণাচার্য —মনে মনে ঠিক করলেন। কিন্তু সরাসরি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করবেন কীভাবে? আচার্য চাতুর্যের আশ্রয় নিলেন। কর্ণের সঙ্গে কথা বলবার আগে নিজের ভেতরে তাকালেন দ্রোণ। সেখানে কর্ণের জন্য কোনো সমবেদনা খুঁজে পেলেন না। বরং দূরদৃষ্টিহীন, ক্রোধোন্মত্ত একজন তরুণকে দেখতে পেলেন। কর্ণের সমদর্শিতার নীতিকথায় বিগলিত হলেন না আচার্য। কর্ণের পাশাপাশি বিনীত আর মেধাবান অর্জুনকে দেখতে পেলেন তিনি। যে কর্ণ এখনো অস্ত্রপ্রয়োগ দক্ষতায় অর্জুনের সমকক্ষ হতে পারে নি, তার হাতে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেবেন না তিনি। আর তুলে দিলেই কি কর্ণ অর্জুনের সমকক্ষ হয়ে উঠবে? তা তো নয়। পক্ষপাতী, অভিসন্ধিপরায়ণ শিষ্যের শিক্ষা কখনো সুসম্পন্ন হয় না। কর্ণেরও হয় নি, হবেও না। তাই আচার্য সিদ্ধান্ত নিলেন–অপরিশীলিতবুদ্ধি কর্ণের হাতে এই মারাত্মক অস্ত্রের প্রযুক্তি কিছুতেই তুলে দেবেন না।
অত্যন্ত মৃদু গলায় দ্রোণাচার্য বললেন, ‘এই অস্ত্র তুমি পাবে না বৎস।’
‘কেন গুরুদেব?’
‘ব্রহ্মাস্ত্র পাওয়ার অধিকার তোমার নেই।
‘অর্জুনের যদি পাওয়ার অধিকার থাকে, আমার নেই কেন?’
এবার আরও নরম গলায় আচার্য বললেন, ‘ব্রহ্মাস্ত্রের সন্ধি জানবার অধিকার আছে শুধু ব্রাহ্মণের। আর…।’
‘অর্জুন তো ক্ষত্রিয়।’
‘তুমি তো আমাকে কথা শেষ করতে দিলে না।’
‘বলুন আচার্য।’ বিনীত গলায় বলল কর্ণ।
‘ব্রাহ্মণরা ব্রহ্মাস্ত্র লাভের অধিকারী হলেও এরা কখনো ক্রোধমগ্ন হয়ে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেন না। তা ছাড়া ক্ষত্রিয়ও এই অস্ত্র করলতগত করতে পারবে, তবে সেই ক্ষত্রিয়কে হতে হবে সদাচারী সচ্চরিত্র। অর্জুন সদাচারী। তাই সে ব্রহ্মাস্ত্র পাওয়ার অধিকার রাখে।’ ধীরে ধীরে বললেন দ্রোণাচার্য।
কর্ণ নিজের ক্রোধকে সংবরণ করার জন্য মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল।
আচার্য আবার কথা বলে উঠলেন, ‘ও হ্যাঁ, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও এই মারণাস্ত্র লাভ করতে পারেন।
‘ক্ষত্রিয় ছাড়া আর যাঁদের কথা বললেন, তাঁরা তো ক্রোধ-বিবর্জিত মানুষ। এই অস্ত্র প্রয়োগ করার কোনো প্রয়োজন পড়বে না তাঁদের। তাহলে এই অস্ত্রের অধিকারী হয়ে তাঁদের লাভ কী?’ যুক্তিজাল বিস্তার করল কর্ণ।
দ্রোণাচার্য শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এই অস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য বহুল হিতকর অথচ এক নিষ্কাম ঔদাসীন্য লাগে। সেটা ব্রাহ্মণ আর সন্ন্যাসীর মধ্যে আছে। আর আছে ক্ষত্রিয় হয়েও অর্জুনের মধ্যে।’
‘আমার মধ্যে নেই?’
‘তুমি ক্রোধোন্মত্ত। দুর্যোধন দ্বারা প্রভাবিত। অর্জুনের প্রতি অসূয়াপ্রবণ। বলেছ— অর্জুনকে পরাজিত করবার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করবে তুমি। এই অস্ত্র বহুজনের হিতের জন্য। তাই আমি তোমার হাতে এই মারাত্মক অস্ত্র তুলে দেব না।
কর্ণ ভক্তিমিশ্রিত গদগদ কণ্ঠে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে আমার। ব্যক্তি অর্জুনের বিরুদ্ধে আমি এই অস্ত্র প্রয়োগ করব না কখনো।’
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না কর্ণ। আর শুধু অবিশ্বস্ততার জন্য নয়, বর্ণের নীচতার জন্যও তুমি এই অস্ত্রের অধিকারী হতে পারো না।’
চমকে গুরুদেব দ্রোণের দিকে তাকাল কর্ণ। দ্রুত বলল, ‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না গুরুদেব।’
দ্রোণাচার্য এবার সরাসরি কর্ণের মুখের দিকে তাকালেন। কর্ণের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তুমি ব্রাহ্মণ নও, সন্ন্যাসীও নয়। এমনকি তুমি ক্ষত্রিয়ও নও। তুমি সূতপুত্র। রথচালক অধিরথের পুত্র তুমি। সূতপুত্রের এই মারণাস্ত্র পাওয়ার অধিকার নেই।’
তীব্র কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল কর্ণ, ‘আমার মা রাধা। রাধা ব্রাহ্মণকন্যা। সবাই আমাকে রাধেয় বলে। মায়ের দিক থেকে হলেও আমি ব্রহ্মাস্ত্র পেতে পারি।’
‘সমাজে পিতার পরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয়, মাতার পরিচয়ে নয়।’ দ্রোণ বললেন।
কর্ণ বুঝে গেল আচার্য কিছুতেই তাকে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ-সংবরণ কৌশল শেখাবেন না। প্রথমে অসংযমী ও অবিনীতের দোহাই দিয়ে, পরে অসূয়ার কথা বলে এবং সর্বোপরি হীনজাতের প্রসঙ্গ তুলে আচার্য তাকে মোক্ষমাস্ত্রের শিক্ষা দেবেন না। দেবেন না বলেই ব্রাহ্মণ, ব্রতচারী, ক্ষত্রিয় আর সন্ন্যাসীর নাম করলেন গুরুদেব।
কর্ণ বহুক্ষণ দ্রোণাচার্যের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তারপর হাঁটু গেড়ে গুরুদেবকে প্রণিপাত করল।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এল কর্ণ ।