৭
সখায়ং বিদ্ধি মামিতি।
আমি তোমার বন্ধু। মনে নেই আমাকে?
.
এবার দ্রোণের অভীষ্ট লাভ হবে।
গৃহ থেকে অন্নাভাবের হাহাকার দূর হবে, মাথার ওপর একটা নিশ্ছিদ্র চালা থাকবে। কৃপীর গায়ে নতুন বস্ত্র শোভা পাবে। পুত্র অশ্বত্থামা ধনীপুত্রের মতো পোশাক পরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে। সর্বোপরি তাঁর গোয়াল থাকবে। দুগ্ধবতী গাভীরা সেই গোশালায় বাঁধা থাকবে। সকাল-সন্ধ্যা পাত্র পাত্র দুগ্ধ দোহন হবে। প্রতিদিন বারবার অনেকবার দুগ্ধ পান করবে অশ্বত্থামা। দুগ্ধ দিয়ে ছানা হবে, ঘৃত হবে, ক্ষীর হবে। হবে নানা রকম মিষ্টি। মিষ্টান্ন তৈরি করবেন কৃপী। সেখানে পর্যাপ্ত শর্করা মিশাবেন, বাদাম মিশাবেন। মুখের সামনে সেই মিষ্টান্ন এগিয়ে ধরে বলবেন, ‘খান আর্যপুত্র। আমি একটু দু’চোখ ভরে দেখি।’ খেতে খেতে দ্রোণ জিজ্ঞেস করবেন, ‘অশ্বত্থামা খেয়েছে তো?’ উত্তরে কৃপী বলবেন, ‘কী আর বলব আর্যপুত্র, দুধের জন্য যে অশ্বত্থামা একদা হা- পিত্যেশ করত, এখন সেই অশ্বত্থামা দুধ খেতে চায় না। বলে, দুধ খেতে ভালো লাগে না মা।’ শুনে হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠবেন তিনি।
‘এ রকম করে উচ্চহাস্য করলেন যে, আর্যপুত্র?’ স্বামীর অট্টহাস্য শুনে পাশে চলমান কৃপী জিজ্ঞেস করলেন।
দ্রোণ সংবিতে ফিরলেন। একটু লজ্জা পেলেন তিনি। মনে মনেই ভাবছিলেন কথাগুলো। হাসিটা হঠাৎ কেন যে ভেতর থেকে এ রকম করে বেরিয়ে এল!
স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘না না, তেমন কিছু নয়। হঠাৎ করেই হাসিটা বেরিয়ে এল। এমনি এমনি। এই হাসির কোনো কারণ নেই।’
মুখে বললেন বটে, কিন্তু ভেতরের স্ফূর্তিকে লুকাতে পারলেন না দ্রোণ। ভেতরের উল্লাস তাঁর চোখেমুখে ছড়ানো।
কৃপী আর কথা বাড়ালেন না। চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। এর মধ্যে আর্যপুত্র বেশকিছু দূর এগিয়ে গেছেন। অশ্বত্থামাকে ডান হাতে ধরে সামনের দিকে দ্রুত এগোতে লাগলেন কৃপী।
.
রাজা পৃষতের মৃত্যু হয়েছে। পৃষতের পূর্ব নাম বাজ্জসেন। যেদিন তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়, পিতা তাঁর কপালে চন্দনের পৃষত এঁকে দিয়ে সর্বতো মঙ্গল কামনা করেছিলেন। পৃষত মানে ফোঁটাচিহ্ন। রাজ্যাভিষেকের দিন থেকে বাজ্জসেনের নাম পাল্টে গিয়েছিল। প্রজা-অমাত্যরা তাঁকে পৃষত নামে সম্বোধন করা শুরু করলেন।
পৃষত খ্যাতিমান নৃপতি ছিলেন। প্রজামঙ্গলের চেষ্টায় সর্বদা রত থাকতেন তিনি। পৃষতের রাজ্যের সর্বত্র উন্নতির চিহ্ন। তাঁরই পুত্র দ্রুপদ। দ্রোণের বাল্যবন্ধু। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সুহৃদ। রাজা পৃষতের পরলোকগমনের পর পাঞ্চালরাজ্যের রাজা হয়েছেন দ্রুপদ। লোকপরম্পরায় এ সংবাদ শুনতে পেয়েছেন দ্রোণ। তাঁর আনন্দ আর ধরে না। যাঁর মিত্র নৃপতি হয়েছেন, তাঁর আবার দারিদ্র্য কী?
এক নিমেষেই অভাব-অনটন উড়ে যাবে। দ্রোণের সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুপদ কথা দিয়েছিলেন—রাজা হলেই তাঁর রাজ্য দ্রোণেরও ভোগ্য হবে।
এক বিকেলে তাঁর চতুর্পার্শ্বের ঘরবাড়ি, বৃক্ষতল, উঠান, আসন-বসন, রান্নার উপকরণ, এমনকি নিজের ও স্ত্রী-পুত্রের পোশাক-আশাক বড় জীর্ণ মনে হতে লাগল দ্রোণের। এই জীর্ণ-দীন অবস্থা থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হওয়া যায়, ততই ভালো। তিনি মন স্থির করলেন পরদিন প্রত্যুষেই সপরিবারে আশ্রম ত্যাগ করবেন। চলে যাবেন দ্রুপদরাজ্যের রাজধানীতে। দ্রুপদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলবেন, ‘বন্ধু, সুহৃদ আমার। কেমন আছ তুমি?’
পরদিন অতি ভোরে রাজধানীর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন দ্রোণ। যেতে যেতে ভাবছিলেন ওসব কথা। কৃপীর প্রশ্নে সেই ভাবনার জাল ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিছু একটা বলে বুঝ দিয়েছিলেন কৃপীকে। কিন্তু ভেতরের উচ্চাশা অন্যের সামনে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় লজ্জা পেতেও শুরু করেছিলেন দ্রোণ। স্ত্রীর সামনে থেকে মুখ লুকাবার জন্য চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
.
রাজপ্রাসাদের দৌবারিক পথ আটকে দিল।
‘কে আপনি? এই অসময়ে মহারাজাধিরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইছেন?’ দ্রোণের মলিন বসনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে জিজ্ঞেস করল দ্বারপাল।
অবহেলার হাসি হেসে দ্রোণ বললেন, ‘আমার পরিচয় তোমায় দিতে হবে? পরিচয় শনাক্ত করেই ঢুকতে দেবে আমাদের? আমাকে সাক্ষাৎ দিতে দ্রুপদের আবার সময়- অসময় কী?’
একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে গেলেন দ্রোণ। দৌবারিকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন না। উপরন্তু দ্বারপালকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করলেন।
দীনবেশী দ্রোণের উদ্ধত বাক্য শুনে দৌবারিক প্রথমে বিস্মিত হলো। বিস্ময় কেটে গেলে তার মনে ক্রোধ জন্মাল। ক্রোধান্বিত চোখে সে বলল, ‘আপনার সাহস তো কম নয় ব্রাহ্মণ? নিজের বসনভূষণের দিকে লক্ষ করেছেন? সঙ্গের জনেরা বোধহয় স্ত্রী আর পুত্র। ওঁদের দেখে তো মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন অনাহারে আছেন তাঁরা। আপনাকে দেখে অতি সাধারণ একজন দরিদ্র হীন ব্রাহ্মণ বলে মনে হচ্ছে। তবে আপনি যে বিদ্বান – সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাননীয় নরপতিকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয়, বিদ্বানের না জানার কথা নয়। কিন্তু আপনি আমাদের নরপতিকে শুধু দ্রুপদ বলে সম্বোধন করলেন। আপনার অর্জিত বিদ্যাতেও আমার সন্দেহ হচ্ছে।’ দম নেওয়ার জন্য থামল দৌবারিক।
দৌবারিকের কথা শুনে অপমানে ভেতরটা জ্বলে গেল দ্রোণের। ইচ্ছে হলো—ধনুকে তীর জুড়ে দৌবারিকের মস্তকটা উড়িয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে অতি কষ্টে দমন করলেন তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য তো মিত্র দ্রুপদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হোক, তারপর এই মূর্খ দৌবারিককে শায়েস্তা করা যাবে, অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যাবে।
শান্তকণ্ঠে দ্রোণ বললেন, ‘একসময় মহারাজ দ্রুপদ আর আমি সতীর্থ ছিলাম। অস্ত্রশিক্ষা করেছি একই গুরুর কাছে। বহু বছর পর মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। তুমি ভাই তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগটা দাও আমাদের।’
দ্রোণের নরম কথা শুনে দৌবারিক নমনীয় হলো। উপরন্তু দ্রোণের কাঁধে তীরভর্তি তৃণ আর ধনুক দেখে আগন্তুকের কথা তার বিশ্বাস্য বলে বোধ হলো। সে শুনেছে— তাদের মহারাজ বাল্যকালে ঋষি অগ্নিবেশ্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন। আগন্তুকের
কথা সত্য হলেও হতে পারে।
দৌবারিক বলল, ‘ঠিক আছে। মহারাজ এখন বিচারকার্যে ব্যস্ত। তাঁর ব্যস্ততা কমলে সামনে যাবেন। রাজসভার বাইরে অপেক্ষাগৃহ আছে। সেখানে অপেক্ষা করবেন। সেখানে প্রহরী আছে। তাকে আপনি আপনার সাক্ষাৎ-প্রার্থনার কথা জানিয়ে রাখবেন। সময়মতো সে আপনাকে রাজসভায় পৌঁছে দেবে।’
‘তোমার মঙ্গল হোক বৎস।’ ডান হাত তুলে দ্রোণ বললেন।
কৃপী আর অশ্বত্থামা দ্রোণকে অনুসরণ করে প্রাসাদাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।
.
‘সখা। কেমন আছ তুমি? কুশলে আছ তো?’ বিপুল আবেগ ঝরে পড়ছে দ্রোণের কথায়। প্রহরী দ্রোণকে সপরিবারে রাজসভায় নিয়ে এলে উচ্চ সিংহাসনে বাল্যবন্ধু দ্রুপদকে আসীন দেখে সবিশেষ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন দ্রোণ।
‘কে সখা! ব্রাহ্মণ, তুমি কাকে সখা বলে সম্বোধন করছ?’ বরফশীতল কণ্ঠে বললেন মহারাজ দ্রুপদ।
‘কী আশ্চর্য! তোমার মনে নেই আমাকে? আমি দ্রোণ।’
‘কোন দ্রোণ? তোমার সঙ্গে কি আগে আমার কখনো দেখা হয়েছে?’
‘ছোটবেলার রসিকতা দেখি তুমি এখনো ভুলতে পারো নি দ্রুপদ। রাজা হওয়ার পরও তোমার হাস্য-পরিহাসবোধ অটুট রয়ে গেছে।’ হাসতে হাসতে হালকা চালে বলে গেলেন দ্রোণ।
দ্রুপদ সারা মুখে রাজাসুলভ গাম্ভীর্য ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনতে পারছি না ব্রাহ্মণ। কোন কালে আমাদের দু’জনের মধ্যে পরিচয় ছিল, তাও আমার মনে পড়ছে না।’
এবার হা হা করে হেসে উঠলেন দ্রোণ। বললেন, ‘আর হেঁয়ালি কোরো না দ্রুপদ। অনেকদূর পথ অতিক্রম করে এসেছি। আমার মতো আমার পুত্র-পরিবারও ক্লান্ত সখা। আমি সেই দ্রোণ, যার সঙ্গে তুমি ঋষি অগ্নিবেশ্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছিলে।’ হাসতে হাসতে দু’বাহু সামনের দিকে প্রসারিত করে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেলেন দ্রোণ।
‘থামো ব্রাহ্মণ। আর এগোবে না। যেখানে আছ সেখানেই দণ্ডায়মান থাক।’ তারপর সভাসদদের দিকে তাকালেন দ্রুপদ। দেখলেন—সবার চোখেমুখে অপার জিজ্ঞাসা। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে সভাসদরা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।
এই সময় দ্রোণ আবার বললেন, ‘আমি তোমার বন্ধু বটে, মনে নেই আমাকে?’ দ্রুপদ রুষ্টকণ্ঠে বললেন, ‘ব্রাহ্মণ, তুমি শিক্ষাদীক্ষা ভালোভাবে অর্জন করতে পারো নি। তাই তোমার বুদ্ধি পরিপক্ব হয় নি। কোন দেশে কোন রীতি, কোন সমাজে কী রকম ব্যবহার করতে হয় তাও তুমি শেখ নি ব্রাহ্মণ। দ্রোণকে চিনেও না চেনার ভান করলেন দ্রুপদ।
একসময় যে দ্রুপদ অবিমিশ্র বন্ধুত্বের কথা অনর্গল বলতেন, কত প্রতিজ্ঞা, কত আশ্বাস এবং কত কথামালা রচনা করেছেন দ্রোণের জন্য, তা আজ দিব্যি অস্বীকার করলেন।
এ রকমই হয় এই পৃথিবীতে। দীর্ঘদিনের অদেখায় পুরাতন বন্ধুত্ব আর সজীব থাকে না। যে বন্ধুত্ব একদা সত্য ছিল, আন্তরিক ছিল, কালের ধুলায় মলিন হয়ে সেই সজীব সত্যলগ্ন বন্ধুত্ব একেবারে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। বাল্যকালের আবেগ পরিণত বয়সে এসে ফিকে হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ায়।
দ্রোণ প্রকাশ্য রাজসভায় যখন দ্রুপদকে ‘সখা’ বলে সম্বোধন করলেন, দ্রুপদের মধ্যে তখন রাজকীয় সত্তা জেগে উঠল। তিনি দরিদ্র দ্রোণকে একেবারে আমলে নিলেন না। চোখেমুখে উপহাস ছড়িয়ে কুৎসিতভাবে হেসে উঠলেন দ্রুপদ। তাঁর দেখাদেখি সভায় উপস্থিত সবাই অট্টহাস্য করে উঠল।
দ্রুপদের প্রকৃত অভিপ্রায় এতক্ষণে অনুধাবন করতে পারলেন দ্রোণ। তিনি এক নিশ্ছিদ্র গভীর আঁধারে ডুবে যেতে লাগলেন। রাজসভার প্রদীপের উজ্জ্বল আলো তাঁর চোখের সামনে নিবে আসতে লাগল। কৃপীর ম্লান মুখ, অশ্বত্থামার ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত চেহারা তাঁর দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যেতে লাগল।
এই সময় দ্রুপদের কর্কশ কণ্ঠ দ্রোণের কানে আবার ভেসে এল, ‘দরিদ্র ব্রাহ্মণ, তুমি আমাকে সখা সম্বোধন করে তৃপ্তি পেতে চাইছ? আমার মনে পড়ছে না, তারপরও তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যদি হয়েও থাকে, তা অস্বীকার করছি আমি। শোনো, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জীর্ণ-জড় হয়ে পড়ে, সময়ান্তরে পুরাতন বন্ধুত্বও তেমনি জীর্ণ হয়ে যায়। তোমার-আমার বন্ধুত্ব ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে এখন।’
দ্রোণ দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে স্থির করলেন। স্তম্ভিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন দ্রুপদের দিকে। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘গুরুদেব অগ্নিবেশ্যের আশ্রম, প্রতিশ্রুতি—সবই ভুলে গেলে তুমি দ্রুপদ? সবই বিস্মৃত হলে সখা?’
‘একদিন তোমার সঙ্গে আমার একসঙ্গে থাকা হয়েছে ঋষি অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে মানলাম।’ দ্রুপদ এবার স্পষ্ট করলেন সবকিছু। বললেন, ‘ওই সময় আমাদের দু’জনের উদ্দেশ্য আর অবস্থান এক ছিল। উদ্দেশ্য ছিল—অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা এবং অবস্থান ছিল তপাশ্রম। এখন তোমার উদ্দেশ্য আর আমার লক্ষ্য এক নয়। তুমি কৃপাপ্রার্থী আর আমি দাতা। আর দু’জনের অবস্থান দেখো—আমি রাজসিংহাসনে। আর তুমি? তুমি কোথা দাঁড়িয়ে আছ দেখ।’
‘তুমি আমাকে অপমান করছ সখা?’ দ্রোণ মার্জিত কণ্ঠে বললেন।
দ্রোণের কথা যেন কানে যায় নি দ্রুপদের। আগের মেজাজে বললেন, ‘তুমি নির্বোধ দ্রোণ। তুমি বারবার আমাকে সখা সম্বোধন করে গৌরবান্বিত হতে চাইছ। তুমি তো জানো—গরিব কখনো ঐশ্বর্যশালীর সখা হতে পারে না, মূর্খ কখনো পণ্ডিতের সখা হয় না, বলহীন কখনো বীরের সখা হয় না।’
দ্রোণ এসব অপমান নীরবে হজম করলেন। যে-কোনো উপায়ে দারিদ্র্য ঘোচাতে হবে তাঁকে। যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে এই রাজধানীর যে-কোনো একটা কোণে থিতু হতে হবে। তাই দ্রুপদের সকল উপহাস-অপমানকে একপাশে সরিয়ে রেখে দ্রোণ বললেন, ‘প্রতিশ্রুতি! প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে যে আমার সামনে।’
‘কোন প্রতিজ্ঞা? কীসের প্রতিশ্রুতি?’ দ্রুপদ অবহেলায় জিজ্ঞেস করলেন।
উৎকণ্ঠাভরা কণ্ঠে দ্রোণ বললেন, ‘তুমি বলেছিলে—রাজা হওয়ার পর তোমার যে রাজকীয় ভোগ আর যে ধনসম্পদ লাভ করবে তুমি, তা আমারও ভোগ্য হবে। তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা কোরো দ্রুপদ।
রাজা নয়, মহাধিপতি নয়, নৃপতি নয়, একেবারে দ্রুপদ বলে সম্বোধন! কী আশ্চর্য! মলিন বসন পরিহিত, জীর্ণপ্রায় দেহের এই ব্রাহ্মণের দুঃসাহস তো কম নয়! সম্বোধনের কথা না হয় বাদ দেওয়া যাক, রাজভাগ্যের অধিকার চেয়ে বসল! ক্রোধে দ্রুপদের মাথা ঘূর্ণিত হতে লাগল। দ্রোণকে কী বলবেন—ঠিক করতে পারছেন না তিনি। ব্রাহ্মণ হয়ে কাল হয়েছে। ব্রাহ্মণ না হয়ে অন্য কেউ হলে যমালয়ে পাঠাতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ হত্যা যে মহাপাপ।
‘শুধু রাজৈশ্বর্যের অর্ধেক নয়, রাজ্যেরও অর্ধেক আমাকে দেওয়ার সংকল্প করেছিলে দ্ৰুপদ।
দ্রোণের কথায় দ্রুপদের মুখে যেন হলাহল পড়ল। ঘূর্ণিত চোখে বললেন, ‘রাজ্যপাটের অর্ধেক? তোমাকে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি?’
‘হ্যাঁ, করেছিলে। সেই গুরুগৃহে, এক অপরাহ্ণে আমার গলা জড়িয়ে ধরে তুমি বলেছিলে—অহং প্রিয়তমঃ পুত্র পিতু-দ্রোণ মহাত্মনঃ। সেই বিকেলে তুমি আরও বলেছিলে—তুমি নিশ্চিন্ত থাকো দ্রোণ—তভোগ্যং ভবিতা রাজ্যং সখে সত্যেন তে শপে। আজকের সিংহাসনে আসীন এই তুমি দ্রুপদই তো বলেছিলে–যেদিন আমি রাজ্যে অভিষিক্ত হব, সেদিন থেকে আমার মতো আমার রাজ্য তোমারও ভোগ্য হবে। আজ আমি এসেছি তোমার কাছে। তোমার কাছ থেকে আমার অধিকার আদায় করতে।’
‘অধিকার! কোন অধিকার আদায়ের কথা বলছ তুমি দ্রোণ?’ দ্রুপদের অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসতে চাইছে।
‘প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে যে অধিকার তুমি আমাকে দিয়েছিলে। একদা রাজ্যাধিকার দিয়েছিলে তুমি আমায়।’ দ্রোণের কণ্ঠ থেকে নমনীয় ভাব তিরোহিত হয়ে গেল।
দ্রোণ বুঝে গেছেন—দ্রুপদ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন না। তাঁর ভেতরে বিস্মৃতি, অকৃতজ্ঞতা আর অহংকার উৎকট হয়ে উঠেছে। নমনীয় বাক্যে বা অনুরোধ-উপরোধে তাঁকে টলানো যাবে না। তাই দ্রোণ প্রতিশ্রুত অধিকারের কথা উচ্চারণ করলেন।
এতে দ্রুপদের ক্রোধ বেড়ে গেল। তীব্র ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘রাজসভায় উন্মাদের জায়গা নেই। সভাস্থলে ব্রাহ্মণকে অপমান করাও উচিত নয়। তাই আমার ক্রোধানল থেকে রেহাই পাচ্ছ তুমি। তুমি এখনই সভাস্থল ত্যাগ কোরো। নইলে…।’
‘নইলে কী করবে তুমি? বধ করবে আমায়? কারাগারে নিক্ষেপ করবে? এত সাহস তোমার?’ দ্রোণ গর্জে উঠলেন।
দ্রুপদ অমার্জিত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার মতো দীনদরিদ্র দু’কড়ির ব্রাহ্মণকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারি আমি। ভাগ্যিস, তোমার সঙ্গে তোমার ভার্যা আর পুত্র ছিল। ওদের সামনে তোমাকে অপদস্থ করতে চাই না। তা ছাড়া এই দ্রুপদরাজ্যের একটা মর্যাদা আছে। তোমাকে অপমান করে আমি সেই মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে চাই না। শিগগির তুমি আমার সামনে থেকে দূর হও।
ধনসম্পদের অধিকার চাইলে, হয়তো তা দিতেন দ্রুপদ। কিন্তু রাজ্যাধিকার চেয়ে বসলেন দ্রোণ! দ্রোণও প্রথমে সামান্য প্রাপ্তির আশায় এসেছিলেন পাঞ্চাল রাজসভায়। তাঁর মতো জ্ঞানবানরা জানতেন—রাজা-রাজপুত্ররা আবেগের বশে কত কিছুই না বলেন! বাস্তবে যে তা তাঁরা সচেতন বা অসচেতনভাবে ভুলে যান, তাও দ্রোণের অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল না। তাই সামান্যতেই তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। যেটুকু পেলে সংসারের অভাব দূর হবে, দু’বেলা দু’মুঠো স্ত্রী-পুত্র আর নিজের মুখে তুলে দিতে পারবেন, সেটুকু পাওয়ার বাসনা নিয়েই দ্রুপদের কাছে এসেছিলেন দ্রোণ। কিন্তু দ্রুপদ প্রথম থেকেই তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করলেন। এতদিনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বকে অস্বীকার করলেন। উঁচু-নিচুর কথা তুলে তিরস্কার করলেন তাঁকে। তাও আবার একান্তে নয়। ভরা রাজসভায় স্ত্রী এবং পুত্রের সামনে তাঁকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিলেন।
ব্ৰাহ্মণত্ব জেগে উঠেছিল দ্রোণের। তাঁর অহংবোধ এবং আমিত্ব তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছিল। তাই তিনি রাজ্যাধিকার চেয়ে বসলেন। এতে দ্রুপদ আরও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। এবং দ্রোণকে তাঁর রাজসভা ছেড়ে, তাঁর রাজ্য ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে নির্দেশ দিলেন দ্রুপদ। বললেন, তোমার বিপদ হবে দ্রোণ, যদি কালবিলম্ব না করে আমার সামনে থেকে চলে না যাও।
দ্রোণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। স্থিরদৃষ্টিতে দ্রুপদের দিকে দৃকপাত করলেন। তারপর চোখ ফেরালেন কৃপীর দিকে। দেখলেন—কৃপীর দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নামছে। নীরবে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। অকৃতবিদ্যদের মতো চিৎকার করে আকুল হয়ে কাঁদছেন না তিনি। কৃতবিদ্যের মতো নীরবে অশ্রুবিসর্জন করে বুক ভাসাচ্ছেন।
এবার অশ্বত্থামার দিকে তাকালেন দ্রোণ। থরথর করে কাঁপছে অশ্বত্থামা। মায়ের বাম হাত চেপে ধরে নিষ্পলক চোখে দ্রুপদের দিকে তাকিয়ে আছে যুবকপ্রায় অশ্বত্থামা। সমস্ত মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে তার। ফলে গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল সাদাটে হয়ে গেছে। কপালে স্বেদবিন্দু। তার চোখ থেকে অগ্নি ঝরছে যেন। মায়ের কান্নায় সংক্রমিত হয় নি অশ্বত্থামা। তার চোখে-চেহারায় ক্রোধানল ছড়িয়ে আছে। এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে দ্রুপদের ওপর-এ রকমই অভিব্যক্তি তার।
অশ্বত্থামা দ্বারা প্রভাবিত হলেন দ্রোণ। রোষে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘শুধু তোমার রাজসভা থেকে নয়, এই রাজধানী থেকে, এই পাঞ্চালরাজ্য থেকে আমি চলে যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে…।’
দ্রোণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দ্রুপদ বললেন, ‘হ্যাঁ তা-ই যাও। সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল। আর হ্যাঁ দ্রোণ, অনেক কষ্ট করে বহু পথ অতিক্রম করে তুমি আমার কাছে এসেছ। তোমাকে তো খালি হাতে ফেরানো যায় না।’
একটু থামলেন দ্রুপদ। দ্রোণের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তুমি যখন প্রার্থী হয়ে এসেছ, একরাত্রির উপযুক্ত ভোজনদ্রব্য নিয়ে যাও। ওইটুকুতেই তৃপ্ত থাকতে হবে তোমাকে। এর চেয়ে বেশি ভিক্ষা চাইলে ওই ভোজনদ্রব্যটুকুও পাবে না তুমি।’
কোটর থেকে মণি দুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে দ্রোণের। তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। থরথর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। বহুক্ষণ পরে আত্মস্থ হলেন। বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি এই অপমানের ফল ভোগ করবে শিগগির। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শাস্তি যে কী ভয়ংকর হতে পারে, হাড়ে হাড়ে টের পাবে তুমি।’
‘কী করবে তুমি আমার? শৃগাল হয়ে ব্যাঘ্রকে ভয় দেখাচ্ছ?’ দ্রুপদ জিজ্ঞেস করলেন।
‘না, সমুদ্র হয়ে ক্ষুদ্র জলাশয়কে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছি। হুতাসন হয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়ার পণ করছি।’ তারপর উচ্চকণ্ঠে বললেন দ্রোণ, ‘তোমার রাজসভায়, তোমারই মন্ত্রী-রাজন্যদের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি—আমি তোমার রাজধানী ধ্বংস করব। তোমাকে বন্দি করে আমার এই পাদুকার নিচে নিক্ষেপ করব। তোমার রাজ্য কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারি করে ছাড়ব তোমায়।’ বলে পেছন ফিরলেন দ্রোণ। স্ত্রী-পুত্রের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন।
পেছন থেকে দ্রুপদের অট্টহাস্য শুনতে পেলেন দ্রোণ। তিনি শুনতে পেলেন দ্রুপদের কণ্ঠ, ‘হীন নিরন্ন ব্রাহ্মণের সামর্থ্য কতটুকু আমি জানি। যজমানি করে যার দিনাতিপাত হয়, সে দেখাচ্ছে ভয়! ফুঃ!’
এবার ঘাড় ঘোরালেন দ্রোণ। কাঁধ থেকে ধনুকটা ডান হাতে নিয়ে বললেন, ‘এই ধনুক ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি—একদিন তোমাকে মাটিতে লুটাব আমি। তোমার এই রাজধানী রক্তে ভাসিয়ে দেব।’
হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন দ্রুপদ। তাঁর ভেতরটা কেঁপে উঠল।
দ্রুপদ দেখলেন—পুত্রের হাত ধরে উন্নত মস্তকে রাজসভা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন দ্রোণ। পেছনে কৃপী। তার পদক্ষেপও দৃঢ়তাপূর্ণ।