৬
পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা।
.
অসাধারণ অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত যুবক দ্রোণ পিতার আশ্রমে ফিরে এলেন।
তখন দ্রোণ অন্য মানুষ। তাঁর চোখ খুলে গেছে, মন প্রসারিত হয়ে গেছে। আশ্রমের সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ—দ্রোণ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। পিতৃ-আশ্রমে ফিরে দেখলেন—সেই আগের মতোই আশ্রমের ক্রিয়াকর্ম চলছে, পূর্ববৎ স্বাহা স্বধা-বর্ষার ধ্বনিতে আশ্রমাঙ্গন মুখরিত। এই যজ্ঞক্রিয়া এবং ব্রাহ্মণের ওঙ্কার ধ্বনি দ্রোণের ভালো লাগল না।
তাঁর মন অনাগত দীপ্তিমান ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আগের মতো আশ্রমের কাজে মন লাগাতে পারছেন না তিনি। তপোবনের চেয়ে তপোবনের বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারলে তাঁর মন অধিকতর তৃপ্তি পাচ্ছে। একটা উদাসীন ভাব সর্বদা দ্রোণকে ঘিরে রেখেছে।
পিতা ভরদ্বাজ পুত্রের এই অন্যমনস্কতা, এই অস্থিরতা লক্ষ করেন। তিনিও এককালে দ্রোণের মতোই যুবক ছিলেন। যুবক মনের হাহাকার তিনি এই বৃদ্ধ বয়সেও অনুধাবন করতে পারেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস—কোনো নারীকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যৌবনঋদ্ধ পুরুষের মধ্যে যে হাহাকার জাগে, দ্রোণের মধ্যেও তা-ই জেগেছে। নইলে কেন ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও যাগযজ্ঞে মন নেই দ্রোণের? কেন দ্রোণ তপাশ্রমের শান্তসৌম্য পরিবেশ ছেড়ে বনে-অরণ্যে একা একা ঘুরে বেড়ান?
ঋষি ভরদ্বাজ একদিন দ্রোণকে কাছে বসালেন। বললেন, ‘পুত্র, আমি বৃদ্ধ হয়েছি। যে-কোনো সময় পরপারের ডাক আসতে পারে।’ বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ঋষি। দ্রোণ কিছু বলেন কি না তা শুনবার জন্য অপেক্ষা করলেন আরও কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুমি ভাবছ—কী কথা বলবার জন্য এই ভূমিকাটুকু করছি? তুমি যথার্থ ধরেছ। আমি তোমার বিয়ের কথাই বলছি। তুমি এখন যৌবনলগ্ন। শাস্ত্রপাঠ আর অস্ত্রপাঠ — দুটোই প্রায় সমাপন করেছ তুমি। তুমি বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছ। তুমি বিয়ে কোরো।’
কী আশ্চর্য! পিতা কী করে বুঝতে পারলেন তাঁর মনের কথা! পিতার কথার অবতরণিকা শুনে তাঁর একটা কথাই মনে হয়েছিল—পিতা তাঁর বিয়ের কথা বলতে চান। এবং বললেনও তা-ই। অন্তর্যামী নাকি তিনি!
দ্রোণ কোমল গলায় বললেন, ‘পিতা, আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, প্রাপ্য করতলগত নয়। দারিদ্র্যময় জীবন। এই সময় একজন নারীকে অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে টেনে আনা কি বিচক্ষণতার কাজ হবে? আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই না পিতা।’
‘মানুষ বাগান করে পুষ্পসৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। সেই পুষ্পে যখন মধু সঞ্চারিত হয়, বাগান আরও মনোলোভা হয়ে ওঠে। তুমি আমার বাগানের ফুল। বিবাহ সেই ফুলে সৌরভ সঞ্চার করবে। তোমার স্ত্রী, সন্তান—এদের দেখে যেতে পারলে আমার আনন্দের অন্ত থাকবে না পুত্র।’
‘আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত নই পিতা। কারণ ওদের আমি অনাদর-অনাহারের জীবন উপহার দিতে চাই না।’
‘কে বলল ওরা আদর যত্ন পাবে না? আমি গৃহী নই বটে, সন্তান-সংসার সম্পর্কে একেবারে তো অনভিজ্ঞ নই। তুমিই তো তার প্রমাণ।’
‘কিন্তু দারিদ্র্য থেকে তো ওরা মুক্তি পাবে না। দীনতা তো সর্বদা তাদের কুরে কুরে খাবে।
ভরদ্বাজের কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। দারিদ্র্য তাঁর আজন্ম সঙ্গী। পুত্র দ্রোণেরও তা-ই। তাঁর উত্তরাধিকারীরাও তো দৈন্য থেকে মুক্তি পাবে না কোনোদিন। ভরদ্বাজ অধোবদনে নিরুত্তর রইলেন।
দ্রোণ ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি আপনার কথা রাখব বাবা। তবে এখন নয়। যদি কখনো আমার ধনৈশ্বর্য লাভ হয়, সেদিন প্রথম যে কাজটি করব, তা হলো—বিয়ে।’
এই সময় দ্রোণ ভাবছেন-তাঁর অবস্থার পরিবর্তন তো একদিন হবেই। দ্রুপদ সত্য প্রতিজ্ঞা করে বলেছে-আমি রাজা হওয়ার পর যা ভোগ করব, তা তোমারও ভোগ্য হবে। পিতা পৃষতের মৃত্যুর পর সে পাঞ্চালরাজ্যের নৃপতি হবে। নৃপতির হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, কোষাগার ভর্তি সোনাদানা, কড়ি, মণিমুক্তা, প্রাসাদভর্তি দাস- দাসী। এসবের আস্বাদন তো তিনিও করতে পারবেন। শুধু সময়ের ব্যাপার। রাজা পৃষতের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এই যা।
পিতার কথায় সংবিৎ ফিরল দ্রোণের, ‘তাহলে তুমি এখন বিয়ে করবে না?’
‘আমাকে ক্ষমা করবেন পিতা।’
ভরদ্বাজ মৌন হলেন। দ্রোণের এ কথার পরে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করল না তাঁর। হাত ইশারায় পুত্রকে স্থানত্যাগ করতে বললেন।
বিয়ের ব্যাপারটি নিয়ে দ্রোণ আগে তেমন করে ভাবেন নি। একটা সময়ে বিয়ে করবেন, অন্য দশজন যুবক যে-রকম করে ভাবে, সে-রকম করেই হালকাভাবে ভেবেছিলেন হয়তো। কিন্তু পিতার সঙ্গে কথোপকথনে হঠাৎ করে যে কথাটি প্রথমে তাঁর মনে পড়ল, তা হলো দারিদ্র্য। পুরুষানুক্রমে অভাব-দীনতা তাঁদের সঙ্গী। দারিদ্র্যক্লান্ত জীবনে সৌন্দর্য আর ভালোবাসার যথার্থ বিকাশ হতে পারে না। সেই জায়গায় একজন নারীকে নিয়ে এসে তার জীবনটা বিষণ্ণ করে তোলার অধিকার তো দ্রোণের নেই। তাই তিনি পিতৃ-প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন।
পিতা ভরদ্বাজ তাঁকে গৃহী করবার জন্য অনুরোধ-উপরোধ করেছিলেন। তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন। পুত্রের যৌবনলগ্নে পুত্রবধূর মুখ দেখে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো তাঁর অন্তর্চক্ষে পৌত্র বা পৌত্রীর কোমল মুখও আবছা ভেসে উঠেছিল। তৃতীয় পুরুষের মুখ দেখে বিপুল তৃপ্তি পাওয়ার বাসনা হয়তো তাঁর হৃদয়ে জাগরুক হয়েছিল। এজন্য পুত্র দ্রোণকে এত সাধাসাধি, এত অনুরোধ-উপরোধ। কিন্তু ভাগ্য বিপরীতে। দ্রোণ বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করলেন।
.
ভরদ্বাজের জীবৎকালে দ্রোণ বিয়ে করলেন না। হঠাৎ মারা গেলেন ভরদ্বাজ। পিতার মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না দ্রোণ। তিনি মুষড়ে পড়লেন। পিতৃবিয়োগের ফলে তাঁর হৃদয়ে নিদারুণ শূন্যতা নেমে এল। বাবার কথাগুলোই বারবার মনে পড়তে লাগল তাঁর।
জননীকে তিনি কখনো চোখে দেখেন নি। মাতৃস্নেহ বলে যে একটা কথা আছে, তা থেকে বঞ্চিত তিনি। প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে পিতা ভরদ্বাজই তাঁর সবকিছু। সেই পিতাকেই কষ্ট দিয়েছেন—এ রকম চিন্তা তাঁকে অবসাদগ্রস্ত করল। তাঁর মনে গভীরভাবে বৈরাগ্যের সৃষ্টি হলো। বৈরাগ্যদীর্ণ হৃদয় তাঁকে পুনরায় তপস্যামুখী করে তুলল।
সাধনার জন্য পিতার আশ্রমের পরিবেশ অনুকূলে ছিল। অতঃপর সেই আশ্রমে বসেই দ্রোণ যোগ-ধ্যান-তপস্যায় মগ্ন হলেন। চঞ্চল মনকে স্থির করার সাধনা শুরু হলো। তপস্যা মনকে স্থির করে, একমুখী করে।
তপস্যার ঐকান্তিকতায় একটা সময়ে দ্রোণের মনের মালিন্য, অবসাদ এবং অনিষ্ট ভাবনা দূরীভূত হয়ে গেল। সবদিক ঠিক হলো বটে, কিন্তু মনের শূন্যতাটুকু গেল না। বিয়ে করার জন্য পিতার সানুনয় উপরোধ-বাক্য আবারও তাঁকে পীড়িত করতে শুরু করল। ধন-মান সম্পত্তির উচ্চচূড় অভিলাষ তাঁর কাছে অর্থহীন বলে মনে হাত লাগল। তিনি স্থির করলেন—বিয়ে করবেন। পিতার অনুরোধ এবং পিতৃঋণবোধ তাঁকে বিয়ে করার জন্য প্রণোদিত করল।
.
দার পরিগ্রহ করলেন দ্রোণ। কৃপের ভগ্নি কৃপীকে ভার্যারূপে গ্রহণ করলেন। মহর্ষি গৌতমের শরঃদ্বান নামে এক শিষ্য ছিলেন। জানপদী নামের এক অপ্সরাকে দেখে শরঃদ্বানের রেতঃপাত হয়। জন্ম নেন দুটো সন্তান—কৃপ আর কৃপী। পরিত্যক্ত এ দুটো শিশুকে কৃপা করে রাজা শান্তনু লালনপালনের মাধ্যমে বড় করলেন। এজন্য এঁদের নাম—কৃপ আর কৃপী। দ্রোণের দাবি ছিল, পাত্রীকে সুন্দরী হতে হবে এবং জ্ঞানী হতে হবে। কৃপী জ্ঞানী ছিলেন, রূপসি ছিলেন না। দুর্ভাগ্য দ্রোণের। পাত্রী জুটল এমন— সুন্দরী নন, কিন্তু পণ্ডিতা। কৃপীর আরেকটা অগুণ ছিল। তাঁর মস্তক ছিল কেশহীন ।
তার পরও কৃপীকেই বিয়ে করলেন দ্রোণ। তিনি ভাবলেন–স্ত্রীর রূপ যা-ই হোক, একটি ছেলে হবে আমার। স্ত্রীর অসৌন্দর্যের সান্ত্বনা হিসেবে তিনি তাঁর মহাপ্রাজ্ঞতা ব্রতনিয়মনিষ্ঠা আর আচারপরায়ণতার কথাও ভাবলেন। সর্বোপরি ভাবলেন–বিয়ে করলে একটি ছেলে হবে, সেই ছেলে ঋষি ভরদ্বাজের অস্তিত্বকে অনাগতকালের দিকে প্রবহমান রাখবে।
বাবার কথায় এবং পুত্রলাভের লোভে লোভিত হয়ে দ্রোণ বিয়ে করলেন কৃপীকে। জনক-জননী পরিত্যক্ত অন্য এক ব্যক্তির কৃপা যে-নারীটির মধ্যে বর্তমান, তাঁকেই বিয়ে করলেন দ্রোণ। জন্মগৌরব আর লালিতপালিত হওয়ার আভিজাত্য—কোনোটাই ছিল না কৃপীর। পিতার সাময়িক রতিতৃপ্তির বিকারে দ্রোণের মতোই জন্ম তাঁর।
উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্য আছে। দ্রোণ জননী পরিত্যক্ত শিশু হলে কী হবে, পিতা ভরদ্বাজ তাঁকে মানুষ করেছিলেন। কিন্তু কৃপী জনক ও জননী পরিত্যক্ত। সম্পর্কহীন একজন রাজার আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠা তাঁর। উভয়ের পিতার মধ্যে একটা বিষয়ে অদ্ভুত মিল। ভরদ্বাজ আর শরঃদ্বান-দু’জনেই অস্ত্রবিদ ও ধনুর্ধর।
ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মাবার পরও বেদবিদ্যা ভুলে ধনুর্বেদ চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা ব্রাহ্মণ সমাজে মান্যতা পেতেন না তেমন। জপে তপে-অধ্যয়নে মগ্ন ব্রাহ্মণরা অস্ত্রবিদ্যায় লগ্ন ব্রাহ্মণদের এড়িয়ে চলতেন। তাই দ্রোণ যখন বিয়ে করতে চাইলেন, ব্রাহ্মণসমাজ রাজি হলো না তাঁকে কন্যা দিতে। স্বধর্ম ও স্ববৃত্তি ত্যাগের কারণেই উপযুক্ত ব্রাহ্মণঘরের কোনো কন্যাকে দ্রোণ বিয়ে করতে পারলেন না। বিয়ে করতে হলো পালটি ঘরে, শরঃদ্বানকন্যাকে। শরঃদ্বান ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও দ্রোণের মতো বেদপাঠে রুচি দেখান নি, আগ্রহ দেখিয়েছেন ধনুর্বিদ্যায়। বৃত্তি ত্যাগের অপরাধে কুৎসিত অল্পকেশিনী কৃপীকে বিয়ে করা ছাড়া দ্রোণের আর কোনো উপায় ছিল না।
অপছন্দের কন্যাকে বিয়ে করলে দাম্পত্যজীবন তো সুখেশান্তিতে ভরা থাকার কথা নয়। দ্রোণের জীবনও তা-ই ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন বিচক্ষণ। ভেতরের অস্বস্তিকে তিনি কখনো টেনে বাইরে আনেন নি। নিজের মনোবেদনা ভেতরেই চেপে রেখেছিলেন।
কৃপী কিন্তু টের পেতেন। স্বামী যে তাঁকে তেমন করে ভালোবাসেন না—সেটা বুঝতে পারতেন তিনি। সেই বুঝতে পারার ব্যাপারটি একদিন স্পষ্ট করলেন স্বামীর সামনে, ‘আর্যপুত্র, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।’
এই রকম কথা শুনবার জন্য দ্রোণ প্রস্তুত ছিলেন না। স্ত্রীর কথা শুনে চমকে তাঁর দিকে তাকালেন দ্রোণ। দেখলেন—কৃপী নিষ্পলক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। অপ্রিয় অথচ সত্য কথার মুখোমুখি হলে মানুষ যেমন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, দ্রোণেরও তা-ই হলো। বিব্রত চোখে কৃপীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন শুধু।
শান্ত কণ্ঠে কৃপী আবার বললেন, ‘সুন্দরী নই আমি আর্যপুত্র। একজন স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য একজন নারীর যে রূপলাবণ্য আর অঙ্গসৌষ্ঠব থাকার কথা, তার কোনোটাই নেই আমার, তাই আপনার চিত্তের সন্তোষ সাধনের উপযুক্ত নই আমি।’
‘এসব কী বলছ তুমি কৃপী? যথার্থ বলছ না তুমি।’ দ্রোণের শেষ বাক্যে কণ্ঠটা একটু ধরা ধরা মনে হলো।
‘মুখে যা-ই বলুন না কেন, ভেতরের অস্বস্তিকে লুকাতে শেখেন নি আপনি। প্ৰকৃত মানুষদের ক্ষেত্রে এরকমই হয়। মূর্খরা ভেতরের বিষাদকে ঢাকতে জানে, জ্ঞানীরা পারেন না। আপনি জ্ঞানী। তাই আমাকে বিয়ে করার মালিন্য আপনার চেহারায় স্পষ্ট হয়ে আছে।’
বহুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেন দ্রোণ। বললেন, ‘তুমি কৃতবিদ্য। বৈদিকজ্ঞান তোমার আয়ত্তে। পণ্ডিত তুমি। পাণ্ডিত্য তোমার মর্যাদা। তোমার মর্যাদা তোমার দেহরূপের অনেক ঊর্ধ্বে। আমি তোমার পাণ্ডিত্যকে তোমার দেহসৌন্দর্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মনে করি।’
মৃদু হাসলেন কৃপী। তাঁর যা জানার জেনে গেলেন। অপ্রিয় কথা বাড়াতে নেই. পণ্ডিতরা ভালো করেই জানেন। কৃপীও এই অপ্রিয় প্রসঙ্গকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন আর্যপুত্র। হঠাৎ মনে এল, বললাম। কিছু মনে করবেন না। দ্বিপ্রহর গড়িয়ে যাচ্ছে। চলুন, আহার করবেন।’
দ্রোণ অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘স্ত্রীর সৌন্দর্য আর মাধুর্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার অভীষ্ট একটা পুত্রসন্তান। কৃপী, তুমি আমাকে একটা পুত্র উপহার দাও।’
কৃপী হৃষ্ট চোখে স্বামী দ্রোণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
দ্রোণের অভিলাষ পূর্ণ করলেন কৃপী। একটা পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। দ্রোণ- দম্পতি পুত্রের নাম রাখলেন অশ্বত্থামা। সন্তানের নাম রাখার ক্ষেত্রে মা-বাবা অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ পরিজনের বাসনাই প্রধানত কাজ করে। অশ্বত্থামার নাম রাখার ক্ষেত্রে সেই প্রথা রক্ষিত হলো না। একটা ঘটনা পুত্রের নাম অশ্বত্থামা রাখার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করল।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর স্বাভাবিক মানবসন্তানের মতো কাঁদল না শিশুটি। কান্নার পরিবর্তে হ্রেষাধ্বনি বেরিয়ে এসেছিল শিশুটির মুখ থেকে। দেবাসুরের সমুদ্র-মন্থনজাত উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের ধ্বনি করেছিল সে। তাই দ্রোণ ছেলের নাম রাখলেন অশ্বত্থামা।
অশ্বত্থামাকে পেয়ে দ্রোণ অনন্ত বাৎসল্যের আস্বাদ পেলেন। এতদিন অরূপা স্ত্রীর কারণে মনের মধ্যে যে বেদনার কাঁটাটি খচখচ করছিল, মনোলোভা চেহারার অশ্বত্থামা দ্রোণের অন্তর থেকে তা দূর করে দিল। পুত্রকে নিয়ে তাঁর আনন্দের অন্ত থাকল না।
অল্প বয়স থেকে অশ্বত্থামার শরীর-স্বাস্থ্য সুন্দর হয়ে উঠল, প্রকাশ পেতে লাগল তার তেজ। এই বয়সে শারীরিক সুগঠনের জন্য দরকার উপযুক্ত খাদ্য আর যথাযথ লালন। পুত্রকে লালনের ব্যাপারে পিতা দ্রোণের কোনো ত্রুটি ছিল না। যে ব্যক্তি পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষায় বিয়ে করেছিলেন, তাঁর সমস্ত মন-প্রাণ তো লভ্য পুত্রের ওপর নিবিষ্ট থাকবেই। পুত্রকে যথাস্বাচ্ছন্দ্যে বড় করা শুরু করেছিলেন দ্রোণ।
কিন্তু অর্থকষ্ট পুত্রলালনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিল। আশ্রমে জীবনযাপনের জন্য কত আর অর্থ লাগে। পিতার আশ্রম সুখেরই ছিল। বসবাসের সমস্যা তাঁর ছিল না, কিন্তু খাদ্যসমস্যা ছিল প্রকট। আশ্রমে যে শিষ্যরা ছিল, ভরদ্বাজের মৃত্যুর পর তারা একে একে আশ্রম ত্যাগ করল। গুরু না থাকলে শিষ্যরা থাকবে কেন? গুরুর স্থানটা দ্রোণ নিতে পারতেন। কিন্তু যাগযজ্ঞ করা, শিষ্য পড়ানো—এসব যে দ্রোণের ভালো লাগে না। শিষ্যরা ভরদ্বাজ-আশ্রম ত্যাগ করলে খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে দেখা দিল। শিষ্যদের শ্রমলব্ধ ভিক্ষান্নে আশ্রমের ভরণপোষণ হতো। শিষ্যহীন আশ্রম অন্নহীন হয়ে পড়ল।
কিন্তু দ্রোণ এই দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারতেন, যদি যজনযাজন-অধ্যয়ন- অধ্যাপনায় তিনি মন দিতেন। কিন্তু তাঁর মন তো পড়ে আছে ধনুর্বিদ্যায়। দ্রোণ যদি পৈতৃক বৃত্তি ত্যাগ না করতেন, তাহলে যাগযজ্ঞের দক্ষিণায় তাঁর সংসার চলত। কিন্তু তিনি কোনো যজমান তৈরি করেন নি। ফলে অর্থাগমের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। পুত্রলাভের পর অর্থসংকট তীব্র হলো দ্রোণের পরিবারে।
তারপরও ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিকে গ্রহণ করলেন না তিনি। বরং অস্ত্রবিদ্যায় কোনো অর্থলাভ ঘটে কি না, সেই চেষ্টায় ব্রতী হলেন দ্রোণ। অর্জিত ধনুর্বিদ্যা তিনি আরও ভালো করে অভ্যাস করতে লাগলেন।
দ্রোণের বাসস্থান পাঞ্চালরাজ্যের রাজধানীর অদূরে। রাজধানী এবং রাজধানীর আশপাশে ধনবানের বসবাস। সেই সূত্রে বালক অশ্বত্থামার সঙ্গে ধনীর দুলালদের চেনা- পরিচয়। ধনীদের গৃহাভ্যন্তরের নানা রীতিনীতি অশ্বত্থামা জানতে শুরু করল। ধনীর দুলালদের খাদ্য-উপাদান, খাওয়ার পদ্ধতি –এসব অশ্বত্থামার অজানা থাকল না। সে দেখল—ধনীপুত্রদের খাদ্য লোভনীয়।
তাকে সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করল গাভীদুগ্ধ। সে জানল, বড়লোকের ঘরের ছেলেরা নিয়মিত দুগ্ধ পান করে। অশ্বত্থামার দুধ খাওয়ার খুব ইচ্ছে জাগল, কিন্তু বয়সে ছোট হলেও সে বুঝতে শিখেছে, বাবা তেমন অর্থবান নন। একটা গাভী জোগাড় করার ক্ষমতা তার বাবার নেই। বালক অশ্বত্থামার মনে কষ্ট জমা হতে থাকে। কিন্তু একজন বালকের পক্ষে না-পাওয়ার কষ্ট কতদিনই বা চেপে রাখা সম্ভব!
একদিন পিতা-মাতার কাছে দুধ খাওয়ার বায়না আরম্ভ করল অশ্বত্থামা। কিন্তু স্বাভাবিক কারণে দুধ জুটল না। ফলে বালক অশ্বত্থামা কেঁদে বুক ভাসাল। পুত্রের কান্না দ্রোণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। মানসিক যন্ত্রণায় তিনি অধীর হয়ে উঠলেন।
পুত্রের জন্য একটা দুগ্ধবতী গাভী জোগাড়ে বের হলেন দ্রোণ। পাঞ্চালরাজ্যের এ- প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত তিনি অনেক ঘুরলেন। কিন্তু কেউ ভরদ্বাজ-সন্তান দ্রোণকে একটা গাভী দান করল না। অশেষ মানসিক ক্লেশ নিয়ে তিনি আশ্রমের দিকে রওনা দিলেন। ফেরার পথে একটা ঘটনা তাঁকে ভেঙেচুরে একেবারে দুমড়ে দিল।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। তেজ কমে এসেছে, শীতের শেষদিক। মাঠের ধারে নানা বয়সের বালকরা জমা হয়েছে। এদের কেউ কেউ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রোণ ফিরতে ফিরতে মাঠের একেবারে কিনারা ঘেঁষে বালকদের একটা জটলা দেখলেন। উৎসুক দ্রোণ এগিয়ে গেলেন সেদিকে। নিকটে গেলে জটলার মধ্যিখানে ধেই ধেই নৃত্যরত অশ্বত্থামাকে দেখতে পেলেন তিনি। পুত্রকে দু’বাহু তুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে দেখে বিস্মিত হলেন দ্রোণ। আরও কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। শুনলেন- অশ্বত্থামা নাচতে নাচতে বলছে—দুধ খেয়েছি, দুধ খেয়েছি! কী স্বাদ! কী স্বাদ! দেখলেন—অশ্বত্থামার এই উদ্বাহু নৃত্য আর আত্মহারা আনন্দধ্বনি শুনে ধনীপুত্ররা হাততালি দিয়ে তাকে উপহাস করছে। ওখানেই তারা থেমে নেই। উপহাসের ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তারা বলছে, ‘অশ্বত্থামা, তোর বাপ গরিব। টাকাপয়সা আয়ের ক্ষমতা নেই তোর বাপের। তাই পিটুলিগোলা সাদা জল খেয়ে নাচছিস তুই।’
আনন্দে মশগুল বলে অশ্বত্থামা ধনীর দুলালদের উপহাসধ্বনি শুনতে পেল না। কিন্তু দ্রোণ শুনতে পেলেন।
দুধের কথা শুনে শুনে অশ্বত্থামার মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই খেলার সঙ্গীদের সামনে সে দুধের প্রসঙ্গ তুলত। সঙ্গীরা তাকে নাচাবার জন্য দুগ্ধ বিষয়ে নানা অলীক শ্রুতিরোচক গল্প শোনাত। তাদের মিথ্যে গল্পকে সত্য বলে মনে করত অশ্বত্থামা। এইভাবে দুধ খাওয়ার জন্য প্রচণ্ড একটা আগ্রহ অশ্বত্থামার মধ্যে দানা বাঁধল। এই সুযোগটাই নিল খেলার সাথিরা। পিটুলিগোলা ফেনায়মান সাদা জলের পাত্রকে দুধের পাত্র বলে অশ্বত্থামার সামনে ধরল। অশ্বত্থামা তো বিহ্বল। এত ভালোবাসে ধনীপুত্ররা তাকে! সে ওদের প্রতারণা বুঝতে পারল না, উপহাস বুঝতে পারল না। এক ঝটকায় পাত্রটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করল অশ্বত্থামা। উল্লসিত অশ্বত্থামা তৃপ্তির আনন্দে নাচতে শুরু করল। ওই সময় সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন দ্রোণ।
দুঃখে-অপমানে বিচূর্ণ হতে হতে ছেলের হাত ধরে আশ্রমে ফিরেছিলেন দ্রোণ। অশ্বত্থামাকে কৃপীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন। আকুল হয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন দ্রোণ। নিজেকে বড় ব্যর্থ পিতা বলে মনে হয়েছিল তাঁর।
দ্রোণ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন—এই আশ্রমে আর না, এই জীর্ণ কুটিরে দীন জীবনযাপন আর না। অভাব ঘুচাতে হবে, স্বাচ্ছন্দ্য আনতে হবে দৈনন্দিন যাপিতজীবনে।
তিনি ঠিক করলেন- পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে যাবেন তিনি। দ্রুপদ যে তাঁর প্রিয় সখা, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সহপাঠী।