একলব্য – ২৩

২৩

ঘোর তমসাচ্ছন্ন রাত্রি। উছলিত আলোর ইশারা। 

.

একলব্যের অন্তরে প্রবল প্রদাহ। 

মনের ভেতর রক্তক্ষরণ চলছে অবিরাম। কিছুতেই সুখ পাচ্ছে না, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। শুধু অবিরত উচাটন। গ্লানিযুক্ত অতীত তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্ত্রী- সান্নিধ্য তার ভালো লাগছে না। মাতা-পিতার স্নেহাতিশয্য তার বিরক্ত লাগছে। রাজ্য পরিচালনায় আগের মতো তৃপ্তি পাচ্ছে না। মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, রাজন্যদের আনুগত্য তার মধ্যে কোনো স্বস্তির জায়গা তৈরি করছে না। তার মনে বারবার হানা দিচ্ছে—মহাবীর কর্ণের নির্মম হত্যাদৃশ্য। কুরুক্ষেত্রের লক্ষ কণ্ঠের যন্ত্রণাদগ্ধ হাহাকার তার কানে ইন্দ্রের বজ্রের মতো বাজছে। এত রক্ত! দিগন্তবিস্তৃত বিশাল রণক্ষেত্রের প্রতিটি ইঞ্চিতে রক্তবিন্দু। এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তাদের নাড়িভুঁড়ি, তাদের চূর্ণ মস্তক, তাদের উৎপাটিত চক্ষুগোলক তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতে পারছে না একলব্য। চোখ বন্ধ করলেই দুর্যোধনের আর্তনাদ কানে ভেসে আসছে, দুচোখ জুড়ে ভেসে উঠছে মহারথী কর্ণের অসহায় চোখের খণ্ডিত মস্তকটি। সেই কাটা মুণ্ডটির পাশে ধড়টি কাদায় মাখামাখি, রত্নখচিত কিরীটটি একটু দূরে উল্টে পড়ে আছে। এইসব দৃশ্য যখন চোখে ভেসে ওঠে, দিশেহারা হয়ে পড়ে একলব্য। এই রাজত্ব এই সংসার অর্থহীন ঠেকে তার কাছে। 

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে, দশ দিন দশ রাত্রি দুর্গম পথ অতিক্রম করে নিজ রাজধানীতে এসে পৌঁছেছিল একলব্য। সঙ্গে যুদ্ধক্লান্ত ও যুদ্ধাহত কিছু সৈন্য। বিপুল সৈন্যসম্ভার নিয়ে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল সে। নিষাদরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। গোটা কুরুক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছে নিষাদসৈন্যরা। বিপুল বিক্রমে শত্রুপক্ষকে নিধন করেছে। কিন্তু যেদিন কর্ণের মৃত্যু হলো, সেদিনই পাণ্ডব-পাঞ্চালসৈন্যের হাতে নিষাদসৈন্যের বড় একটা অংশ আহত-নিহত হলো। 

কর্ণের মৃত্যুতে এমনিতেই ভেঙে পড়েছিল একলব্য, নিষাদসৈন্য ক্ষয়ের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠল সে। সে বুঝল, কর্ণের পরে কৌরবপক্ষে আর তেমন সেনাপতি নেই, যিনি জয় এনে দিতে পারেন। সে আরও বুঝতে পারল—দুর্যোধনের ধ্বংস অনিবার্য। এর পরে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকলে পাণ্ডবরা চিবিয়ে খাবে তাকে। সে ঠিক করল—যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করবে। আশপাশে যা কিছু সৈন্য ছিল, তাদের নিয়ে রাতের আঁধারে নিজ রাজধানীর দিকে রওনা দিয়েছিল সে। 

বাবা হিরণ্যধনুর হাতে রাজ্যপরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিল একলব্য। রাজ্যব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ ছিল। অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়েই ফিরেছিল একলব্য। প্রধান কবিরাজের চিকিৎসায় কয়েকদিনের মধ্যে সেরে উঠেছিল সে। তারপর রাজকার্যে মনোনিবেশ করেছিল। কিন্তু স্থিরচিত্তে আগের মতো রাজ্যশাসন করতে পারছিল না একলব্য। যুদ্ধদিনের রক্তস্নাত স্মৃতি বারবার তাকে আবৃত করছিল। 

প্রতিশোধ নেওয়ার ক্রোধে এবং ঋণশোধের বাসনায় কুরুক্ষেত্রের সমরে যোগদান করেছিল একলব্য। অর্জুনের প্রতি তার দুর্দমনীয় ক্রোধ ছিল আর দ্রোণের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। অর্জুনের হত্যা আর দ্রোণাচার্যের ধ্বংস কামনায় সে সর্বদা উন্মুখ ছিল। কর্ণের প্রতি ছিল তার অশেষ ঋণ। স্বার্থান্ধ অর্জুনের প্ররোচনায় দ্রোণ যখন গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার ডানহাতের বুড়ো আঙুলটি কর্তন করালেন, আঙুলের দিকে মুহূর্তমাত্র না তাকিয়ে ব্রাহ্মণটি আর ক্ষত্রিয়টি যখন তার পর্ণকুটিরের আঙিনাটি ত্যাগ করে গেলেন, যখন অসহায় সে রক্তাক্ত কাটা আঙুলটির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ছিল, তখন এই কর্ণই এগিয়ে এসেছিলেন। পরমাত্মীয়ের মতো তার শুশ্রূষা করেছিলেন, বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন এই মহাবীর কর্ণ। যুদ্ধে কি কর্ণের সেই ঋণ শোধ করতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে তাহলে অনেকটা তার চোখের সামনেই অর্জুন কর্ণকে নিধন করে কী করে? দূর থেকে নির্মম সেই হত্যাদৃশ্যটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না তার। 

কর্ণ যখন মাটিতে আটকে যাওয়া তার রথের চাকা ঠেলে তুলতে চাইছে, যুদ্ধ করতে করতে দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল একলব্য। প্রথমে ভেবেছিল কর্ণের মতো মহাশক্তিধর অতি সহজেই রথচক্রটি টেনে তুলতে পারবেন। এরকম তো কতই হয় যুদ্ধক্ষেত্রে-রথ আটকে যাওয়া, রথধ্বজা ভেঙে পড়া, ঘোড়ার লাগাম ছিঁড়ে যাওয়া, কোনো একটি ঘোড়া আহত হওয়া। এসব সমস্যা সারথি আর রথারোহী যোদ্ধাটি মিলে সমাধান করে। কর্ণের ক্ষেত্রেও তা-ই ভেবেছিল একলব্য। ভেবেছিল—মহাবীরদের পরাজয় অসহায়ভাবে হয় না। কর্ণ রথসমস্যা মিটিয়ে আবার যুদ্ধমগ্ন হবেন। ভাবতে ভাবতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল একলব্য। 

কিন্তু মন বুঝ মানছিল না। কর্ণ রথচক্রটি মাটি থেকে তুলতে পেরেছেন তো? তিনি পুনরায় যুদ্ধলগ্ন হয়েছেন তো? ভাবতে ভাবতে আবার তাকিয়েছিল একলব্য। দেখেছিল—অসি হস্তে অর্জুন হাঁটুগেড়ে বসা কর্ণের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। বুকটা ধড়ফড় করে উঠেছিল তার। একী! এ তো নিধন-ইচ্ছু অর্জুন। তার দ্রুত পদক্ষেপ, তার দেহভঙ্গি তো তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। রক্ষা করতে হবে, যে করেই হোক কর্ণকে অর্জনের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সারথিকে সেদিকে দ্রুত রথ চালাতে বলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য একলব্যের। কর্ণের কাছে পৌঁছানোর আগেই অর্জুন মুণ্ড বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল কর্ণের। সে যখন রথের কাছে পৌঁছেছিল, কাটা মুণ্ড থেকে গর গর শব্দ বেরোচ্ছিল। 

কর্ণকে হত্যা করে মুহূর্তকাল সেখানে অপেক্ষা করে নি অর্জুন। লাফ দিয়ে রথে চড়ে বসেছিল। দ্রুতবেগে রথ চালিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। শোক কাটিয়ে একলব্য যখন হাতে তীর-ধনুক তুলে নিয়েছিল, তখন অর্জুনের রথ চোখের আড়ালে চলে গেছে। ছিন্নমস্তক কর্ণের ধড়ের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে অঝোর ধারায় কেঁদে গিয়েছিল একলব্য। 

আর অর্জন-দ্রোণাচার্য হত্যা? তা-ও তো করতে পারে নি একলব্য? এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো সে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিল। দ্রোণার্জুন-শূন্য করবে এই পৃথিবীকে। কিন্তু পারল কোথায়? দ্রোণ নিহত হয়েছেন বটে, কিন্তু এই হত্যায় তার তো কোনো প্রত্যক্ষ অবদান ছিল না। পরোক্ষভাবে অর্জুনই হত্যা করেছে তাঁকে। হত্যার আগে অর্জুন শরাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল চারদিক, শরাঘাতে শয়ে শয়ে কৌরবসৈন্য নিহত হয়েছিল। দ্রোণাচার্যকে ঘিরে থাকা কৌরবসৈন্যরা যে যেদিকে পেরেছিল, পালিয়ে বেঁচেছিল। তার ফলেই তো খড়গহস্তে দ্রোণাচার্যের দিকে তেড়ে যেতে সাহস দেখিয়েছিল ধৃষ্টদ্যুম্ন। অর্জুনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণেই তো ধৃষ্টদ্যুম্ন আচার্যের ধড় থেকে মস্তকটি আলাদা করে ফেলেছিল। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। যে অর্জুনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করবার জন্য সর্ববিদ্যা বিলিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, তার আঙুল কেটে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি যে দ্রোণ, সেই দ্রোণহত্যার নিমিত্ত হলো অর্জুন। 

দুজন শত্রুর একজন নিহত হয়েছেন, আর অন্যজন? অন্যজন তো দিব্যি বেঁচে থাকল! কী করে সে বেঁচে থাকতে পারল? পারল শুধু কূটবুদ্ধি কৃষ্ণের জন্য। এই আঠারো দিনের যুদ্ধে অনেকবার পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে অর্জুন। তার জীবনসংশয় হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী কৃষ্ণ সামনে এগিয়ে এসেছেন। কখনো কূটকৌশলে, কখনো সুদর্শনচক্র ব্যবহার করে অর্জুনকে রক্ষা করেছেন কৃষ্ণ। যদি তিনি অর্জুনকে আড়াল না করতেন, তাহলে অনেকবার মরতে হতো অর্জুনকে। ওই কৃষ্ণই কৌরবপক্ষের সকল অনিষ্টের মূল। 

একলব্যের সমস্ত ক্রোধ কৃষ্ণের ওপর গিয়ে পড়ল। এর প্রতিবিধান করতে হবে, কৃষ্ণের অপকর্মের প্রতিশোধ নিতে হবে। কৃষ্ণকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তার মনে স্বস্তি আর আনন্দ ফিরে আসবে। 

.

বেশ কিছু বছর ধরে সৈন্য জোগাড় করল একলব্য। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করল তার সৈন্যবাহিনীকে। তারপর একদিন দ্বারকা আক্রমণ করে বসল একলব্য। 

.

কৃষ্ণের তখন শ্রমক্লান্ত দেহ, মনও বিপর্যস্ত। একজন নারী আর একখণ্ড ভূমির জন্য কী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাই না হয়ে গেল! ভাই ভাইকে মারল, আত্মীয় আত্মীয়কে হত্যা করল। গোটা হস্তিনাপুর, শুধু হস্তিনাপুর কেন, গোটা ভারতবর্ষের আকাশবাতাস স্বজন হারানোর হাহাকারে ভরে গেল। 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শুধু তো পাণ্ডব আর কৌরবরা অংশগ্রহণ করে নি, ভারতবর্ষের প্রায় সকল দেশের রাজারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এই যুদ্ধে। ফলে কুরুক্ষেত্র নামক সামান্য একটা যুদ্ধমাঠ থেকে হত্যার সঘন চিৎকার ভারতের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিল। আঠারো অক্ষৌহিণী মানুষের হত্যার মধ্যদিয়ে পাণ্ডবদের জয় এল বটে, সেই জয়ের স্বাদ কি যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব নিতে পারছে? 

তারপরও এই যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। নারী লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেবে না পাণ্ডবরা? তাদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে রাজসভায় প্রায় বিবস্ত্র করে দুর্যোধন-কর্ণরা। তাদেরকে কি এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া উচিত? পাঁচখানি গ্রাম চেয়েছিল পাণ্ডবরা, তাও দেয় নি দুর্যোধন- প্ররোচিত ধৃতরাষ্ট্র। একই বংশজাত হয়ে রাজ্যাধিকার পাবে না পাণ্ডুপুত্ররা? 

আর দ্রুপদ কি তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেবেন না? এই প্রতিশোধ নিতে গিয়েই তো দ্রোণহত্যা হলো। হ্যাঁ, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এই হত্যায়। যুধিষ্ঠির মিথ্যে বলে যুদ্ধরত দ্রোণাচার্যকে হতবুদ্ধি করেছে। এ তো স্বাভাবিক। যুদ্ধক্ষেত্রে তো এরকম একটু-আধটু করতেই হয়। আর কর্ণের তো মৃত্যুই প্রাপ্য। দুর্যোধন-দুঃশাসনাদির হত্যা তাদের কৃতকর্মের ফল। 

তারপরও কেন জানি গোটা যুদ্ধ প্রক্রিয়া আর পরিণতির বিষয়ে চিন্তা করলে কৃষ্ণের মন বিব্রত-বিচলিত হয়ে পড়ে। 

একলব্যের কথা কোনোদিন তেমন করে ভাবেন নি কৃষ্ণ। একলব্য একদা জরাসন্ধ-শিশুপালদের বন্ধু ছিল। কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে একদা জরাসন্ধদের সঙ্গে অংশগ্রহণও করেছিল। দাদা বলরাম তো তাকে খেদিয়ে দিয়েছিল এই দ্বারকা থেকে। ও হ্যাঁ, একবার-দুইবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একলব্যের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। অর্জুনের সঙ্গে ছোটোখাটো যুদ্ধও হয়েছে। কর্ণের হত্যার দিন দূর থেকে ধেয়ে আসতে দেখেছিলেন একলব্যকে। কর্ণহত্যা শেষে দুর্বার গতিতে রথ চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। একলব্যের পরবর্তী কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ হয় নি তাঁর। 

যুদ্ধশেষে পাণ্ডবরা অবশ্য বিজিত কৌরবপক্ষের খোঁজখবর নিয়েছিল। আহত- জীবিত বেশ কিছু কৌরবসৈন্য বন্দি হয়েছিল, কিছু নামি-অনামি নৃপতি যুধিষ্ঠিরের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। যুধিষ্ঠির অবশ্য বন্দি সবাইকে মুক্তি দিয়েছিল। সেদিন একলব্য ওই বন্দিরাজাদের মধ্যে ছিল না। জানা গিয়েছিল সসৈন্যে পালিয়েছে সে। পাণ্ডবরা যুদ্ধজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল। একলব্যের সন্ধান করা হয় নি আর! 

সেই একলব্য আজ তাঁর রাজধানী দ্বারকা আক্রমণ করেছে, ভাবতে বিস্ময় লাগে। কোথাকার সামান্য একজন নিষাদরাজা, সে করল দ্বারকা আক্রমণ! এই আক্রমণের উচিত মূল্য দিতে হবে একলব্যকে। 

যাদবসৈন্যদের যুদ্ধসাজে সজ্জিত হওয়ার আদেশ দিলেন কৃষ্ণ। এবার আর কারও সারথি নয়, নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। নিষাদদের ধ্বংস করে ছাড়তে হবে। 

.

উভয়পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলল। প্রতাপী একলব্যকে হারানো সহজ নয়। কৃষ্ণের সকল কূটকৌশল একলব্যের সমরবিদ্যার কাছে ভেস্তে গেল। 

কৃষ্ণ তাঁর সৈন্যদের উৎসাহ দিতে লাগলেন, ‘এই যুদ্ধে হারলে চলবে না। কোথাকার কোন হীনবংশজাত একলব্য আমাদের মাতৃভূমি আক্রমণ করেছে। প্রাণ দিয়ে হলেও মাতৃভূমি দ্বারকার পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। আমরা পরাজিত হলে নিষাদদের কদাকার পদভারে এই পবিত্র ভূমি কলঙ্কিত হবে। যুদ্ধ কোরো তোমরা, প্রাণপণ যুদ্ধ কোরো।’ 

কৃষ্ণের এই ভাষণ সৈন্যদের মধ্যে প্রেরণা জোগাল। বীরবিক্রমে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিষাদসৈন্যের ওপর। একদিকে কৃষ্ণের অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ, অন্যদিকে দেশপ্রেমবোধ যাদবসৈন্যদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলল। কুরুক্ষেত্রের এই সেদিনের যুদ্ধজয় কৃষ্ণ এবং তাঁর সৈন্যদের মধ্যে বিপুল যুদ্ধ জয়াকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলল। তাদের দাপটে একটা সময়ে একলব্য-সৈন্যরা ছত্রখান হয়ে গেল। 

কৃষ্ণের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে পিছু হটল একলব্য। কৃষ্ণ তাকে দ্বারকা নগরীর প্রান্তবর্তী সমুদ্রপাড় পর্যন্ত ঝেঁটিয়ে নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণতাড়িত নিরুপায় একলব্য সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। 

বহু অনুসন্ধানের পরও জলমধ্যে একলব্যকে পাওয়া গেল না। 

.

ডুবসাঁতারে অন্তত পাঁচ যোজন পথ অতিক্রম করে এক নির্জন নামহীন দ্বীপে আশ্রয় নিল একলব্য। 

ওই নির্জন দ্বীপে একলব্যের অন্যরকম এক জীবনযাপন শুরু হলো। 

.

নিষাদরাজ্যে একলব্যের নিখোঁজ সংবাদ পৌঁছাল। গোটা রাজ্যজুড়ে শোকের গভীর ছায়া নেমে এল। একলব্যের নামেই রাজ্যশাসন শুরু করল তার জ্যেষ্ঠপুত্র। 

.

সমুদ্র মধ্যকার নির্জন দ্বীপে প্রবঞ্চিত, ক্ষুব্ধ, বিজিত একলব্য বেঁচে রইল প্রতিশোধের আশায়। 

ক্রূর তঞ্চকতা, সতীর্থের প্রবঞ্চনার জ্বালা বুকে নিয়ে একলব্য অপেক্ষা করতে থাকল সেই ভবিষ্যতের জন্য, যে ভবিষ্যতে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের দ্বারা ভারতবর্ষ শাসিত আর শোষিত হবে না, শাসিত হবে জাতবর্ণ নির্বিশেষে প্রাকৃত মানুষ দ্বারা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *