২১
পুত্রব্যসনসন্তপ্তো নিরাশো জীবিতে ভবৎ।
পুত্রের মৃতুর কথা শুনে তাঁর শরীরে আর যুদ্ধ করবার শক্তি রইল না।
.
ভীষ্মের সেনাপতিত্বে দশ দিন ধরে ভীতিজনক যুদ্ধ করেছেন দ্রোণাচার্য।
যুদ্ধের শুরুতে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে এক অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিনায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অস্ত্রক্ষমতা আর অভিজ্ঞতা প্রদর্শন ভীষ্মের সেনাপতিত্বের আড়ালে ঢেকে গিয়েছিল। সেই সুযোগ এল তখন, যখন তিনি সেনাপতি নিযুক্ত হলেন।
দশ দিনের যুদ্ধ শেষে ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করলে কৌরবশিবিরে ভীষণ একটা সংকট দেখা দিল। ভীষ্মের পর কে সেনাপতি হবেন—দ্রোণাচার্য না কর্ণ? দুর্যোধনের ঝোঁক কর্ণের দিকে। কিন্তু মর্যাদা, বয়স, যুদ্ধাভিজ্ঞতা এবং অস্ত্রচালনার দক্ষতার নিরিখে দ্রোণাচার্য অগ্রগণ্য।
কর্ণের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসল দুর্যোধন। কর্ণ সহজ সমাধান দিল। সারা জীবন দ্রোণাচার্যের বিরোধিতা করে এসেছে কর্ণ, কিন্তু সংকটকালে যথাযথ পরামর্শ দিল দুর্যোধনকে। কর্ণ বলল, ‘কৌরবপক্ষের সেনাপতি হওয়ার মতো যোগ্য লোকের অভাব তোমার শিবিরে নেই। কিন্তু তোমার অধিকতর যোগ্য লোককে সেনাপতি করা উচিত। সমগুণসম্পন্ন একজনকে বেছে নিলে অন্যরা অসন্তুষ্ট হবেন। ফলে যুদ্ধ পরিচালনাটাই ভেস্তে যাবে।’
এরপর কর্ণ নির্বাক থাকল কিছুক্ষণ। যেন কর্ণ নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করল এই সময়টায়। তারপর স্থির চোখে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে কর্ণ বলল, ‘তোমার শিবিরের বড় বড় যোদ্ধাদের মধ্যে আচার্যস্থানীয় হলেন দ্রোণ। তাঁকে পরবর্তী সেনাপতি কোরো। শুক্রাচার্য ও বৃহস্পতির মতো তাঁর রাজনৈতিকজ্ঞান। ইন্দ্র আর পরশুরামের মতো তাঁর সমরদক্ষতা। পৃথিবীতে এমন যোদ্ধা নেই, তাঁকে পরাস্ত করে।’
চিরন্তন দ্রোণবিরোধী কর্ণের মুখে এরকম কথা শুনে দুর্যোধনের দ্বিধা কেটে গেল। সেনাপতিত্ব গ্রহণ করার জন্য সে দ্রোণাচার্যকে অনুরোধ করল। দ্রোণ সম্মত হলেন। আর যুদ্ধারম্ভ করতে সম্মত হলো কর্ণ। ভীষ্মের পতনের পর হাতে অস্ত্র তুলে নেবে, এরকমই প্রতিজ্ঞা ছিল কর্ণের।
দ্রোণ দুর্যোধনকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমার সেনাপতিত্বকালে পাণ্ডবপক্ষ স্বস্তিতে থাকবে না। তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তবে একটি শর্ত।
‘আবার কী শর্ত? পিতামহেরও শর্ত ছিল পাণ্ডবদের মারবেন না তিনি। আপনিও সেকথা বলবেন নাকি?’ দুর্যোধন বলল।
‘অনেকটা সেরকমই। তবে বিষয়টা পাণ্ডবদের নিয়ে নয়। আমি দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করব না। দ্রোণবধের জন্যই তার জন্ম এবং এটা অনিবার্য।’
ওদিকে দ্রোণাচার্যের সেনাপতি নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হলে একলব্যের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সেই দ্রোণ সেনাপতি হলেন? নির্মম, পক্ষপাতী, বর্ণগরিমায় দীপ্ত দ্রোণের অধীনে যুদ্ধ করবে কি না—এ নিয়ে একলব্যশিবিরে দ্বিধা নেমে এল। সপারিষদ মন্ত্রণাসভায় বসল একলব্য, সেই রাতে।
একলব্য বলল, ‘কর্ণ যেমন ভীষ্মের অধীনে যুদ্ধ করেন নি, আমিও তেমনি দ্রোণের সেনাপতিত্বে যুদ্ধ করব না।’
‘সেটা কি ঠিক হবে মহারাজ?’ সমর-উপদেষ্টা বলল।
‘কেন ঠিক হবে না? যাঁর মন জাতিবিদ্বেষে পরিপূর্ণ, পুত্রবয়সি কারও অঙ্গচ্ছেদন করতে যিনি মুহূর্তকাল দ্বিধা করেন না, সেই দ্রোণের অধীনে যুদ্ধ করাকে পাপ মনে করি আমি।’
‘মহারাজ, সেভাবে না ভেবে আপনি অন্যভাবে ভাবুন।’
‘কীভাবে ভাববো?’
‘ধরুন, পাণ্ডবদের হাতে দ্রোণাচার্য নাজেহাল হচ্ছেন, ধরুন—যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে লেজ গুটিয়ে শিয়ালের মতো পালাচ্ছেন তিনি, এ দৃশ্য দেখতেও তো সুখ। আর আপনি যদি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত না থাকেন, এমন দৃশ্য দেখবেন কী করে? এমনও তো হতে পারে, পাণ্ডবদের সঙ্গে পেরে না উঠে আপনার সাহায্য চাইছেন দ্রোণাচার্য, আপনার সেই সময়ের আনন্দের কথা চিন্তা করুন। আস্তে আস্তে বলল সমর-উপদেষ্টা। একলব্য কিছু বলার আগে সে আবার বলল, ‘তা ছাড়া…।’
সমর-উপদেষ্টার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একলব্য জিজ্ঞেস করল, ‘তা ছাড়া কী?’
নম্রকণ্ঠে উপদেষ্টা বলল, ‘আপনি যুদ্ধ করতে এসেছেন দুর্যোধনের পক্ষে, যদিও কর্ণের আহ্বানটা আপনার কাছে মুখ্য ছিল। আপনার প্রধান উদ্দেশ্য অর্জুনকে নিধন করা। যুদ্ধ থেকে বিরত থাকলে দুর্যোধন আপনার প্রতি বিরক্ত হবেন আর অর্জুনের ওপরও আপনার প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। আপনার যুদ্ধবিরতির সময় অর্জুনকে যদি অন্য কেউ হত্যা করে ফেলে, তাহলে আপনার উদ্দেশ্যটাই বিফল হবে।’
সমর-উপদেষ্টার কথা শুনে অন্যান্য পরামর্শকের দিকে তাকালেন একলব্য। সবারই চোখেমুখে যুদ্ধ করার পক্ষে সম্মতির আভাস। একলব্য বলল, ‘ঠিক আছে। আগের মতোই যুদ্ধ চালিয়ে যাব আমরা।’
.
একাদশ দিবস থেকে প্রবল প্রতাপে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন দ্রোণাচার্য। দ্রোণাচার্য জানতেন—শুধু অস্ত্র প্রয়োগ করে যুদ্ধ জেতা যায় না, যুদ্ধ জেতার জন্য ব্যূহ রচনার কৌশলটা জরুরি। তিনি সেনা-সংস্থানের এদিক-ওদিক করে এমন একটা যুদ্ধ পরিচালনা করলেন, যাতে পাণ্ডবদের অনেক সৈন্য নিহত হলো। কৌরবদের অস্ত্রাঘাতে পাণ্ডবপক্ষ দিশেহারা হয়ে পড়ল। কৌরবদের জয় দিয়েই একাদশ দিবসের যুদ্ধ শেষ হলো।
দুর্যোধনের আনন্দের অবধি থাকল না। দ্রোণাচার্যের সঙ্গে দেখা করে সে তাঁকে যথেষ্ট বাহবা দিল। বলল, ‘আপনি ভুবনখ্যাত সেনাপতি। আপনার সেনাপতিত্বে আমরা অচিরেই পাণ্ডবদের পদানত করতে পারব।’
তাঁকে সেনাপতি করায় দ্রোণাচার্য এমনিতেই খুব খুশি, উপরন্তু দুর্যোধনের কথা শুনে, তাঁর সেই আনন্দ বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। উদ্বেলিত দ্রোণ বলে ফেললেন, ‘সেনাপতি করে তুমি আমাকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছ। আমি ভীষণ আনন্দিত। আমি তোমাকে বর দিতে চাই। বলো, তুমি কী চাও?’
দুর্যোধন বলল, ‘যদি বরই দিতে চান আচার্য, যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত ধরে আনুন আমার কাছে।’ তারপর স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘আবার পাশা খেলায় বসাতে চাই তাকে, খেলায় জিতে আবার বনবাসে পাঠাতে চাই পঞ্চপাণ্ডবকে।’
শুনে দ্রোণাচার্য একটু দ্বিধান্বিত হলেন। প্রকৃত মনোভাবটা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে বললেন, ‘যুধিষ্ঠিরকে তোমার সামনে ধরে আনা আমার জন্য অতি সহজ একটা ব্যাপার। তবে একটা কথা, অর্জুন যেভাবে ক্রমাগত যুধিষ্ঠিরকে নিরাপত্তা দিয়ে যায়, তাতে ইন্দ্রও যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনতে পারবেন না।’
‘আপনার পরামর্শ কী তাহলে?’ দুর্যোধন জিজ্ঞেস করল।
‘আগামীকাল তোমরা সমরক্ষেত্রের একদিকে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দেবে। পাণ্ডবসৈন্যদের বাঁচানোর জন্য অর্জুন সেদিকে ছুটে যাবে। এই সুযোগে আমি যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করব।’ বললেন দ্রোণাচার্য।
গুপ্তচরের মাধ্যমে কথাটা পাণ্ডবশিবিরে পৌঁছে গেল। পরদিন সর্বশক্তি দিয়ে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করল। তার পরের দিন কৌরবপক্ষের ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা অর্জুনকে অস্ত্রের তীব্রতা দিয়ে যুধিষ্ঠির থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ধৃষ্টদ্যুমের ওপর যুধিষ্ঠিরের ভার দিয়ে অন্যত্র যুদ্ধ করতে গেল অর্জুন। প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন দ্রোণাচার্য। পাণ্ডবপক্ষের বড় বড় যোদ্ধা এমনকি ধৃষ্টদ্যুম্নও যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে রথ থেকে নেমে এল যুধিষ্ঠির। একটা ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করল সে। যুধিষ্ঠির অধরা থেকে গেল।
পরদিন দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ রচনা করলেন। বললেন, ‘আজকে পাণ্ডবপক্ষের কোনো বড় যোদ্ধাকে আমি যমালয়ে পাঠাবই।’
ব্যূহের বিভিন্নস্থানে দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামার মতো মহাবীররা প্রাণান্তক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীম, সাত্যকি কেউ এই ব্যূহ ভেদ করতে পারল না। এই ব্যূহভেদের কৌশল শুধু অর্জুনেরই জানা। অর্জুন আজ কুরুক্ষেত্রের সর্বদক্ষিণে যুদ্ধ করছে। নিরুপায় যুধিষ্ঠির অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকেই ব্যূহে প্রবেশের অনুরোধ করল। অভিমন্যু মাতৃজঠরে থাকাকালীন পিতার মুখে চক্রব্যূহের ভেতরে ঢোকার কৌশল শুনেছে, কিন্তু মা ঘুমিয়ে পড়ায় বেরোবার কৌশলটি জানা হয় নি তার।
যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে অভিমন্যু সোৎসাহে বলল, ‘আমি চক্রব্যূহ ভেঙে প্রবেশ করছি। কিন্তু বেরোবার কৌশল আমার জানা নেই। বিপদ হলে আপনারা বের করে আনবেন আমাকে।’ বলে চক্রব্যূহে সশস্ত্র অভিমন্যু ঢুকে গেল।
চারদিক থেকে কৌরবযোদ্ধারা অভিমন্যুকে ঘিরে ধরল। যুধিষ্ঠির, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম, সাত্যকির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল ধৃতরাষ্ট্রের জামাই জয়দ্রথের কাছে। সপ্তরথীর তীব্র তীক্ষ্ণ শরাঘাতে ব্যূহের মধ্যেই অভিমন্যু মারা গেল।
অর্জুনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল জয়দ্রথের ওপর। পরদিন সায়াহ্নে কৌশলে অর্জুন জয়দ্রথকে হত্যা করল।
বোনজামাই জয়দ্রথের মৃত্যুতে দুর্যোধন ভেঙে পড়ল। তার সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ল দ্রোণের ওপর। চোখা চোখা বাক্যে দ্রোণকে পর্যুদস্ত করে ছাড়ল দুর্যোধন। জয়দ্রথের হত্যার সকল দায় দ্রোণাচার্যের ওপর চাপিয়ে দিল সে।
সমস্ত দিনের যুদ্ধক্লান্তিতে এমনিতেই অবসন্ন ছিলেন আচার্য, তার ওপর দুর্যোধনের নিদারুণ বাক্যে ভীষণ মর্মাহত হলেন তিনি। নিজেকে রোধ করতে না পেরে দ্রোণাচার্য বলে উঠলেন, ‘আমি না হয় বৃদ্ধ, যুদ্ধ করার ক্ষমতা না হয় আমার নাই, তোমাদের তো ছিল? অর্জুন যখন জয়দ্রথকে শরাঘাতে জর্জরিত করছে, তখন তো তার পাশে তুমি ছিলে, কর্ণ ছিল, কৃপ ছিলেন, এমনকি আমার পুত্র অশ্বত্থামাও ছিল। তোমরা এত এত মহাবীর মিলে জয়দ্রথের মৃত্যুকে তো ঠেকাতে পারো নি। ধিক্কারটা কার দিকে যায় দুর্যোধন, ভেবেচিন্তেই বলো।’
দুর্যোধন আপাতত চুপ মেরে গেল। কিন্তু তার মধ্যে সন্দেহটা থেকে গেল। সে ভাবল পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে আচার্যের। না হলে কেন নানাসময়ে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির বা অর্জুনকে হত্যা করলেন না তিনি?
মিত্র কর্ণের কাছে সন্দেহের কথা বলল দুর্যোধন, ‘আমার সব গেল রে মিত্র। হাজার হাজার সৈন্য গেল, অনেক সহোদর গেল, আজ গেল একমাত্র বোন দুঃশলার স্বামী জয়দ্রথ। এসব হয়েছে দ্রোণের কারণে। পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট।
দ্রোণবিরোধী কর্ণ বলল, ‘এমন করে বুড়ো মানুষটাকে দোষ দিয়ো না মিত্র। নিজের ক্ষমতানুসারে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তিনি। অর্জুনের বয়স আর আচার্যের বয়সের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আর তোমাদের গুরুদেব যা জানেন, তার সবটাই তো প্রিয়পাত্র অর্জুনকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন। অর্জুনকে আটকানোর মতো কোনো অস্ত্র তো নিজের জন্য আলাদা করে রাখেন নি তিনি।’
একটু থেমে কর্ণ আবার বলল, ‘আমি তো দিব্যচক্ষে অর্জুনের হাতে দ্রোণের পরাজয় দেখছি।’
কর্ণের কথা শুনে ভীত এবং উত্তেজিত হয়ে উঠল দুর্যোধন। দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে নানা সৌজন্যবর্জিত কথাবার্তা বলল। এতে আচার্যের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অধৈর্য কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তুমি অহেতুক সকলকে সন্দেহ কোরো দুর্যোধন। তোমার হৃদয় অত্যন্ত নিষ্ঠুর। পাপ, লোভ আর অহংকার তোমাকে অন্ধ করে ছেড়েছে। তুমি নিজে যাও না কেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।’
দ্রোণের ভেতরে এতদিন অপমানের যে জ্বালা জমা হয়েছিল, তা তিনি আজ উগরে দিলেন। বললেন, ‘যুদ্ধে তুমি একা যেয়ো না, ওই যে পাশাড়ে শুকুনিমামা, তাকেও সঙ্গে নিয়ে যেয়ো। ব্যাটা কুটিল, প্রবঞ্চক শকুনি। তোমাদেরকে যুদ্ধে ঠেলে দিয়ে প্রাসাদে আরামে আয়াসে দিন কাটাচ্ছে এখন। শোনো দুর্যোধন, তুমি তো সর্বদা বলে এসেছ কর্ণ, তুমি আর দুঃশাসন মিলে পাণ্ডব ভাইদের নিধন করতে পারবে। তো যাও না কেন আজকে? গিয়ে শেষ করে আসো না ওদের।’ বলে আর সেখানে দাঁড়ালেন না দ্রোণাচার্য।
দ্রোণাচার্য যখন ফিরলেন, রাত্রির তৃতীয়াংশ তখন শেষ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে এক ভাগ। দুর্দমনীয় রাগে ফুলতে ফুলতে ওই সময়েই তিনি যুদ্ধারম্ভের ঘোষণা দিলেন। ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল শেষ রজনীতে। এই রাত্রির যুদ্ধে দ্রোণের লক্ষ্য পাঞ্চালসৈন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে আচার্য দ্রোণ ভয়ংকর হয়ে উঠলেন।
সেই রাত্রিতে দ্রুপদ আর দ্রোণ মুখোমুখি হলেন। ঘোরতর যুদ্ধ লাগল দুজনের মধ্যে। যুদ্ধের ভয়ংকরতা দেখে রাজা বিরাট দ্রুপদকে সাহায্য করতে এলেন। দ্রোণের ভল্লের আঘাতে রাজা দ্রুপদ আর রাজা বিরাট দুজনেই নিহত হলেন সেই রাতে। শেষরাতের আলো-আঁধারির যুদ্ধেই দ্রুপদ নিহত হলেন। শোক প্রকাশ করার সুযোগ পেল না পাণ্ডবরা আর ধৃষ্টদ্যুম। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ভয়াল রূপ নিল। দ্রোণাচার্য ওই দিন শুধু পাঞ্চালসৈন্য নিধন করে গেলেন। পাঞ্চালসৈন্য ছত্রখান হয়ে পড়ল। দ্রোণকে রোধ করা পাণ্ডবদের জন্য সুকঠিন হয়ে দাঁড়াল।
পাণ্ডবপক্ষ বড় ভাবিত হয়ে পড়ল। এভাবে চলতে দিলে অচিরেই পরাজয় নিশ্চিত } পরামর্শের জন্য পাণ্ডবরা জমায়েত হলো। পরামর্শসভার কৃষ্ণই প্রধান-পুরোহিত। কৃষ্ণের দিকে চেয়ে অর্জুন বলল, ‘কী করা যায় এখন?’
কৃষ্ণ বললেন, ‘দেখো অর্জুন, দ্রোণাচার্যকে নিরস্ত্র না করলে তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। আচার্য দ্রোণকে এমন কঠিন সংবাদ দিতে হবে, যা শুনে তিনি অস্ত্রত্যাগ করবেন।’
‘কী কঠিন সংবাদ?’ যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল।
যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বদা যে সত্য মেনে চলা যায় না, প্রয়োজনে মিথ্যেকেও ঢাল করে শত্রুকে ঘায়েল করতে হয়, সেটা সবাইকে বোঝালেন কৃষ্ণ। তিনি বললেন, ‘দ্রোণাচার্যের সবচাইতে প্রিয়বস্তু তাঁর একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামা। আগামীকাল তাঁকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দিতে হবে।’
নির্বাক বিস্ময়ে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘মৃত্যুসংবাদ! অশ্বত্থামা তো মরে নি!’
এই মিথ্যেটুকু না বললে দ্রোণাচার্যকে থামানো যাবে না। তিনি আর কিছুদিন যুদ্ধ করলে পাণ্ডবপক্ষের সবাইকে যমালয়ে যেতে হবে।’ একটু থেমে কৃষ্ণ আবার বললেন, ‘আগামীকাল তাঁকে কেউ এই কঠিন মিথ্যে সংবাদটি শোনাক।’
অর্জুন স্তম্ভিত স্বরে বলল, ‘এ-কী বলছেন সখা? গুরুদেব আমার! ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিরস্ত্র করব তাঁকে?’
কৃষ্ণ বরফশীতল গলায় বললেন, ‘এ ছাড়া আর কী করা যায় বলো সখা? আচার্যের অস্ত্রাভিজ্ঞতার কথা অন্যে না জানলেও তুমি তো জানো। ভূভারতে এমন যোদ্ধা আছে, যে দ্রোণাচার্যকে সম্মুখযুদ্ধে পরাস্ত করে? তুমি নীতির কথা, বিবেকের কথা বলতে চাইছো—দ্রোণ তোমার গুরু, তোমার পিতার তুল্য, সেই তাঁকে ছলনার ফাঁদে ফেলবে কী করে? এই তো বলতে চাইছো তুমি? আচ্ছা ধরো, তুমি যে নৈতিকতার কথা বলছো, দ্রোণাচার্য কি সেই নৈতিকতার ব্যাপারটি মানেন? যুদ্ধে কি তিনি তোমাকে শরাঘাতে জর্জরিত করেন নি? সুযোগ পেলে তিনি কি তোমাকে হত্যা করতেন না? তা ছাড়া তোমাদের আগেও বলেছি, যুদ্ধে নিয়মের ও বিবেকের বালাই থাকতে নেই। তাহলে তোমাদের পরাজয় নিশ্চিত। পরাজয়ের অর্থ তো জানো—ভারতবর্ষ থেকে পাণ্ডবধারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।’
একটু থেমে কৃষ্ণ আবার বললেন, ‘অর্জুন, ভুলে যেয়ো না, এই দ্রোণই তোমার শ্বশুরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।’ অর্জুনের চোখে চোখ রেখেই কথা শেষ করলেন কৃষ্ণ। অর্জুনের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে চাইলেন তিনি। কৃষ্ণ দেখলেন, তাঁর বক্তৃতায় কাজ হয়েছে। অর্জুনের অবাক করা মুখে ধীরে ধীরে ক্রোধ ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।
সিদ্ধান্ত হলো—পরদিন ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রোণাচার্যকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শোনাবে।
.
পরের দিনের যুদ্ধে ভীম মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার মুখোমুখি হলো। দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড গদাযুদ্ধ হলো। অশ্বত্থামা নামের এক হাতির পিঠে চড়ে ইন্দ্রবর্মা যুদ্ধ করছিল। যুদ্ধের একটা সময়ে ভীম গদার বজ্রকঠিন আঘাতে অশ্বত্থামা নামের হাতিটিকে মেরে ফেলল। ইন্দ্রবর্মা অন্যের রথে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করল।
ভীম দ্রোণাচার্যের সামনে গিয়ে দু’বাহু তুলে নাচতে নাচতে বলতে লাগল, ‘অশ্বত্থামাকে যমালয়ে পাঠিয়েছি। আমার গদার আঘাতে অক্কা পেয়েছে সে।’
ভীমের কথা শুনে আচার্যের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। কিছুটা বিভ্রান্তও হলেন তিনি তারপর ভাবলেন, অশ্বত্থামা যে-সে যোদ্ধা নয়। অর্জুনের সমতুল্য তীরন্দাজ সে। সামান্য ভীমের গদার আঘাতে মারা যাবে অশ্বত্থামা! বিশ্বাস হচ্ছে না। এই ভাবনা তাঁকে দ্বিগুণ তেজোদীপ্ত করে তুলল। দুর্দম্য প্রতিশোধস্পৃহায় তিনি পাণ্ডবসৈন্য নিধনে মনোনিবেশ করলেন। ক্রোধান্ধ দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। দ্রোণের শরাঘাতে শত সহস্র পাঞ্চালসৈন্য মারা গেল। দ্রোণের তাণ্ডবে গোটা কুরুক্ষেত্র শ্মশানে পরিণত হতে থাকল।
।কৃষ্ণ ছুটে গেলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। চিৎকার করে বললেন, ‘এখন কী করবে যুধিষ্ঠির? দ্রোণাচার্য আর একবেলা যুদ্ধ করলে পাণ্ডবপক্ষে বাতি জ্বালানোর কেউ থাকবে না।’
‘আমি কী করতে পারি?’
‘আচার্য তোমার কথা বিশ্বাস করবেন। তিনি জানেন, তুমি কখনো মিথ্যে বলো না।’
‘তা তো ঠিক।’
কৃষ্ণ বললেন, ‘সামান্য মিথ্যেটুকু না বললে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।’
এই সময় ভীম সেখানে উপস্থিত হলো। বলল, ‘আমি আবার গুরুদেবকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দিতে গিয়েছিলাম। তিনি অট্টহাস্য করে বলেছেন, ভীম, তুমি মিথ্যেবাদী। একমাত্র যুধিষ্ঠির বললেই কথাটা বিশ্বাস করব আমি।’
কৃষ্ণ চাপাকণ্ঠে বললেন, ‘এবার ভেবে দেখো যুধিষ্ঠির, কী সিদ্ধান্ত নেবে। পাণ্ডবধারাকে ধ্বংস করবে, না যুদ্ধজয় ছিনিয়ে নেবে?’
যুধিষ্ঠির অস্থির সময় কাটাল কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের চাপাচাপি, ভীমের অনুরোধ, সর্বোপরি পাণ্ডবপক্ষীয় সেনাদের ধ্বংসের কথা বিবেচনা করে মিথ্যে বলতে রাজি হলো যুধিষ্ঠির।
যুদ্ধরত দ্রোণাচার্যের সামনে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল, ‘অশ্বত্থামা হতঃ।’ নিচু স্বরে বলল, ‘ইতি গজঃ।’
দ্রোণের শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। যুধিষ্ঠির সত্যবাদী, জীবনের বিনিময়েও সে কখনো মিথ্যে বলবে না। তাহলে কি পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে?
দ্রোণের পাশে যুদ্ধ করছিল একলব্য। নিষাদসৈন্যরা আজ মারমুখী। যুদ্ধ চলছিল সরস্বতী নদীর বেলাভূমিতে। একলব্যের এক একটা অস্ত্রের আঘাতে শত শত পাণ্ডবসৈন্য ধরাশায়ী হচ্ছিল। যুধিষ্ঠিরের কথা একলব্যের কানে গেল। তার ভেতরের এতদিনের লালিত ক্রোধ হঠাৎ কোথায় উবে গেল। দ্রোণের প্রতি সে শ্রদ্ধার্দ্র হয়ে উঠল। এত বড় মিথ্যে দিয়ে গুরুদেবকে নিরস্ত্র করবে যুধিষ্ঠির! তা হবে না। চিৎকার করে বলল, ‘বিভ্রান্ত হবেন না গুরুদেব। যুধিষ্ঠির মিথ্যে বলছে। কিছুক্ষণ আগে কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণাংশে অশ্বত্থামাকে যুদ্ধ করতে দেখে এসেছি আমি। তার চারদিকে সশস্ত্র কৌরবসৈন্য। তার বিজয়রথ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।’
একলব্যের কথা দ্রোণাচার্যের কানে গেল। কিন্তু একলব্যের কথা বিশ্বাস করলেন না তিনি। শিষ্যদের মধ্যে অর্জুন তাঁর আস্থার জায়গা। আর সবচাইতে বড় বিশ্বাসের জায়গা এই যুধিষ্ঠির। বাল্যবেলা থেকে দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে চেনেন। সে কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারে না।
ভাবতে ভাবতে রথে বসে পড়লেন দ্রোণাচার্য। পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ দ্রোণ একেবারে ভেঙে পড়লেন। অস্ত্রত্যাগ করলেন তিনি।
একলব্য সমানে বলে যেতে লাগল, ‘ভুল করছেন গুরুদেব। যুধিষ্ঠির মিথ্যাবাদী। মিথ্যাবাদীর কথা বিশ্বাস করবেন না। যুধিষ্ঠির যেমন আপনার শিষ্য, আমিও আপনার শিষ্য। আমি আপনার কাছে কোনোদিন মিথ্যে কথা বলি নি। অরণ্যমধ্যে আপনি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি আপনার ছাত্র কি না, ভেবে দেখুন, অকপটে সত্য বলেছিলাম আমি। সেই শিষ্যত্বের দোহাই দিয়ে বলছি—যুধিষ্ঠিরকে বিশ্বাস করবেন না আপনি।’
এই সময় সহস্ৰ পাণ্ডব- পাঞ্চাল সৈন্য একলব্যকে ঘিরে ধরল। যুদ্ধের হুঙ্কারে আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে একলব্যের কণ্ঠ হারিয়ে গেল।
ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রথমে শরাঘাতে শরাঘাতে দ্রোণাচার্যকে জর্জরিত করল। দ্রোণাচার্যের সারথি মারা গেল, অশ্বগুলো আহত হলো। শোকাচ্ছন্ন দ্রোণাচার্য হেষ্টমুণ্ড হয়ে রথের ওপর বসে থাকলেন। আহত অশ্বগুলো রথটাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে বলবান ভীম রথের চাকা জাপটে ধরল। দ্রোণের রথ আর এগোতে পারল না।
এবার দ্রোণাচার্য রথের ওপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘কর্ণ, কর্ণ কোথায় আছ তুমি? আমি অস্ত্রত্যাগ করে সেনাপতির ভারমুক্ত হলাম। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেয়ো।’ তারপর গভীর কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হা পুত্র, হা অশ্বত্থামা!’ বলে ওপর দিকে চাইলেন দ্রোণাচার্য।
এই সময় দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন খড়গ হাতে দ্রোণের রথের দিকে এগিয়ে গেল। লাফিয়ে রথে উঠল। মুখটি সামান্য উঁচু করে ধৃষ্টদ্যুমের দিকে তাকালেন আচার্য। তারপর চক্ষু নিমীলিত করলেন তিনি। বুকের ওপর দুটো হাত জড়ো করলেন। ধৃষ্টদ্যুম আচার্যের চুল আঁকড়ে ধরে খড়গের এক কোপে দ্রোণাচার্যের মস্তকটি ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।
চতুর্থ দিনের সেনাপতিত্বের সময় নিহত হলেন দ্রোণাচার্য।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিবস অতিক্রান্ত হলো। এইদিনে কৌরবপক্ষেরই ক্ষতি হলো সবচাইতে বেশি।
দ্রোণাচার্যের হত্যার মধ্যদিয়ে কৌরবপক্ষ আবার সেনাপতিশূন্য হয়ে পড়ল।