১৮
আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।
.
রজনী গভীর।
বেঘোরে পড়ে আছে একলব্য।
শয্যার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে সে। মুদিত চোখ। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ধূলিমলিন দেহ। অদূরে মাটির প্রদীপ ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে। আঙিনার মধ্যিখানে তিনটি শিবা ঘাপটি মেরে বসে আছে। একলব্য মৃত না জীবিত বুঝে উঠতে পারছে না। মৃত বলে নিশ্চিত হলে হয়তো দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সন্ধ্যা নাগাদ উঠানে এসেছে তারা। কদলিপত্রের রক্ত চেটেপুটে খেয়েছে। বুড়ো আঙুলটি চিবানোর চেষ্টা করেছে। বড় শক্ত কর্তিত আঙুলটি। নিত্যদিন জ্যা-এর ঘর্ষণে ঘর্ষণে আঙুলটির চামড়া জমাট বেঁধে গেছে। মাংস শুকিয়ে জট পাকিয়ে গেছে আঙুলটায়। বুড়ো আঙুলটি চিবিয়ে স্বাদ পেল না শিবারা। ধুলায় পড়ে থাকল আঙুলটি। লোভী চোখে, সেই সন্ধ্যা থেকে, একলব্যের দিকে তাকিয়ে আছে শিয়ালরা।
দ্রোণরা চলে গেলে একলব্যের নিকটে এগিয়ে এসেছিল কর্ণ। মাটি থেকে টেনে দাঁড় করিয়েছিল একলব্যকে। তখনো হাতের কর্তিত জায়গাটি থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছিল। একলব্য স্থির। তার চোখের পলক নিষ্কম্প। কোনো ক্রোধ বা সন্তোষের চিহ্ন নেই তার মুখে-কপালে। তার যেন কিছুই হয় নি। তার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, ভাবনা নেই, যাতনা নেই। সে যেন এক রক্তমাংসহীন মানুষ।
উঠানের ধারে তাকে টেনে নিয়ে গেল কর্ণ। একটা বড় গাছের ছায়ায় বসাল। একলব্যের বাম হাতখানি দিয়ে কর্তিত অংশটি চেপে ধরাল। ‘আসছি’ বলে দ্রুত স্থানান্তরে গেল কৰ্ণ।
পরশুরামের মাহেন্দ্র বিদ্যালয়ে অস্ত্রবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে ভেষজবিদ্যার শিক্ষাও দেওয়া হয়েছিল কর্ণকে। অস্ত্রপাঠশালার এটাই নিয়ম। অস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্রাঘাতের নিবিড় সম্পর্ক। অস্ত্রাঘাতে মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়। ক্ষতের শুশ্রূষার প্রয়োজন পড়ে তখন। ক্ষত নিরসনের তাগিদ থেকেই প্রত্যেক অস্ত্রপাঠশালায় ভেষজবিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা। মাহেন্দ্র বিদ্যালয়ে কর্ণ অস্ত্রবিদ্যার পাশাপাশি ভেষজবিদ্যাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। একলব্যকে গাছতলায় বসিয়ে রেখে সে গহিন অরণ্যে ঢুকে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে কিছু লতাগুল্ম ও পাতা নিয়ে ফিরে এল। হাতের তালুতে কচলে তা কর্তিত অংশে বেঁধে দিল। তৎক্ষণাৎ রক্তপড়া বন্ধ হলো। কিছু ভেষজাঙ্গ একলব্যকে খাইয়ে দিল। তারপর বামহস্ত আকর্ষণ করে কর্ণ একলব্যকে কুটিরের দাওয়ায় নিয়ে গেল। কলসি থেকে জল গড়িয়ে জলপাত্রটি মুখের কাছে ধরল। ঢক ঢক করে সম্পূর্ণ জল খেয়ে ফেলল একলব্য। একলব্যকে বিছানায় শুইয়ে দিল কর্ণ। তারপর নির্বাক কৰ্ণ বসে থাকল একলব্যের পাশে।
দুজনের মধ্যে একটি কথাও বিনিময় হলো না। সূর্যের রথ মধ্যগগন পেরিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। তখনো একলব্য স্থিরনেত্র, নির্বাক। কর্ণ ভেতরে ভেতরে ভীষণ অবাক হলো। এ কেমন মানুষরে বাবা! এত বড় অন্যায় কাজের পর, নিজের মূল্যবান অঙ্গ হারানোর পর, নিদারুণ লাঞ্ছনার পরও কোনো ভাবান্তর নেই! রোষে জ্বলে ওঠা নেই, কান্নায় ভেঙে পড়া নেই, উন্মাদের মতো আচরণ নেই, শুধু ধীরস্থির হয়ে থাকা। এ কেমন নিষাদ! নিষাদদের কি জ্বালাযন্ত্রণা নেই? তারা কি বেদনায় কাঁদে না? তারা কি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখে নি?
এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা নেমে এল। এবার কর্ণকে যেতে হবে। একলব্যের দিকে তাকাল কর্ণ। বলল, ‘তোমার ভেতরে কী হচ্ছে অনুমান করছি। আমাকে যেতে হবে। বহুদূরের পথ। রাত্রি নামার আগে অরণ্যপথ অতিক্রম করে যেতে হবে আমায়। আশা করছি, তুমি সেরে উঠবে। তোমার দেহ সারলে কী হবে, জানি–তোমার মনের ঘা শুকাবে না কোনোদিন।’
তার পর আরও কিছুক্ষণ বসে থাকল কর্ণ, একলব্যের পাশে। তারপর উঠে দাঁড়াল। ‘যাওয়ার আগে তোমাকে একটা কথা বলে যাই-থেমে যেয়ো না তুমি। তুমি প্রমাণ কোরো—ব্রাহ্মণদের হাজারো বিরোধিতার মধ্যেও তথাকথিত হীনজাতের মানুষরা মাথা তুলে দাঁড়াতে জানে। আমার দিকে তাকাও। আমি কর্ণও সেরকম একজন মানুষ।’ বলে আর দাঁড়াল না কর্ণ। দূরের বৃক্ষগুঁড়ি থেকে অশ্বের বাঁধনটি খুলে চড়ে বসল।
একলব্য মূর্ছা গেল। সেই অচেতন অবস্থা এখনো চলছে। মৃদু লয়ে শ্বাস পড়ছে। অনাবৃত বুকটি সামান্য ওঠানামা করছে।
.
অতি ভোরে চেতনা ফিরে এল একলব্যের। চোখ খুলল সে। মাথাটা হালকা লাগছে। শরীর থেকে ব্যথা অনেকটাই তিরোহিত। চট করে উঠে বসল একলব্য। দ্রুত ডানহাতের দিকে তাকাল। কর্ণের কথা মনে পড়ল একলব্যের। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল সে। বুক ফেটে কান্না এল তার। অনেকক্ষণ কাঁদল একলব্য। যখন তার কান্না থামল, পুবাকাশে সূর্য তখন অনেক দূর উঠে এসেছে। সে দাওয়া থেকে নামল।
ধীর পায়ে দ্রোণের মৃন্ময় মূর্তির নিকটে হেঁটে গেল একলব্য। স্পষ্ট চোখে তাকাল মূর্তিটির দিকে। এরপর কদলিপত্রটির দিকে এগিয়ে গেল। পত্রটি এখন ছিন্নভিন্ন। শেয়ালের পায়ের আঁচড়ে, আর জিহ্বার ঘর্ষণে পাতাটি ছিঁড়ে গেছে। নিকটেই তার বৃদ্ধাঙুলটি পড়ে আছে। আঙুলটির চামড়া এখানে ওখানে উবে গেছে। অনেকটা নির্মোহ দৃষ্টিতেই একলব্য তাকিয়ে থাকল কর্তিত আঙুলটির দিকে। তারপর তাকাল ডানহাতের দিকে। উষ্ণ ক্ষুব্ধ বায়ু তার বুকের ভেতর থেকে নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রোণের মূর্তিটির দিকে আবার এগিয়ে গেল একলব্য। কী চমৎকার মূর্তি, কিন্তু কী নিষ্ঠুরতায় ভরা! এই সেই আচার্যের মূর্তি, যার পায়ের কাছে বসে সে দিন ও রাত্রিকে এক করে ছেড়েছে। কখন সূর্য উঠল, কখন অস্ত গেল, কখনই বা রাত্রি গভীর হলো, কখন পূর্ণিমা হলো, কখন অমাবস্যার তুমুল অন্ধকার পৃথিবীকে ঢেকে দিল— কোনো কিছুরই খবর রাখে নি একলব্য। গ্রীষ্মের খররোদ, শীতের দন্তবিস্তারি কামড় বা ঘোর বর্ষার দাপট সাধনা থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারে নি। এই মূর্তিকে জ্যান্ত দ্রোণাচার্য ভেবে নিবিড় শ্রদ্ধায় অবিরত অস্ত্রসাধনা করে গেছে একলব্য। কোনো শারীরিক কষ্ট বা প্রকৃতির অত্যাচার সাধনপথ থেকে তাকে টলাতে পারে নি।
কিন্তু আজ, আজ যে সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এতদিন দ্রোণাচার্যই তার বেঁচে থাকার সম্বল ছিলেন; তার আদর্শ, তার সাধনার উজ্জীবনী শক্তি ছিলেন। আজ তো সবই ফুরিয়ে গেল। তার গুরু নেই, তার কোনো অবলম্বন নেই আজ।
‘হায় আচার্য, এত নির্দয় নিষ্ঠুর আপনি! কিছুই তো দাবি করি নি। আপনার কাছে শুধু স্বীকৃতিটুকু চেয়েছিলাম। সেই স্বীকৃতির বিনিময়ে আমার এত বড় ক্ষতি করলেন আপনি! আমার জীবনের সবকিছু কেড়ে নিলেন! আজ আমাকে একেবারে রিক্ত করে পথের ধূলিতে বসিয়ে দিলেন! তার চেয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলেই তো ভালো করতেন। তা না করে মৃত্যুর চেয়ে অধিক যাতনা দিয়ে গেলেন। ধনুর্বিদ্যাই আমার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। আপনার আশীর্বাদে, আপনার প্রত্যক্ষ সাহচর্য ছাড়া এই বিদ্যার্জনে আমি বেশ কিছুদূর এগিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই এগোনোর পথ রুদ্ধ করে দিলেন আপনি। আমাকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়লেন।
‘আপনি মানুষ? আপনি গুরু? মানুষ তো বটেই। মানুষ না হলে গুরু হলেন কী করে? তবে আপনি সাধারণের গুরু নন। উঁচুবর্ণের গুরু আপনি। নিজে দরিদ্র হয়েও ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আপনার। অতিসহজেই অতীতকে ভুলেছেন আপনি।’
একলব্যের অন্তরের যন্ত্রণা তার মস্তিষ্ককে আবৃত করল। মনে হলো গতকাল দ্রোণ শুধু তার বুড়ো আঙুলটি কেটে নেন নি, তীক্ষ্ণ তরবারি দিয়ে তার হৃৎপিণ্ড, তার সকল স্বপ্নসাধকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করেছেন।
কত অল্প বয়সে তার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রাসাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! একলব্যের প্রতিভার কোনো মূল্য দিলেন না দ্রোণ। জাতপাতের দোহাই দিয়ে, নিষাদ বলে ঘৃণা করে দূরে ঠেলে দিলেন। কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির সময় ঠিকই কাছে এলেন। হেলায় তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চলে গেলেন।
আচার্য দ্রোণের সঙ্গে একলব্যের একটা হার্দিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। এ সংযোগ শুদ্ধভক্তির। কিন্তু একলব্যের সরলতার সুযোগ নিয়ে দ্রোণ মস্তবড় ডাকাতিটা করলেন। পাছে অর্জুন শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদের সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়, তাই কৌশলে একলব্যের বৃদ্ধাঙুলটি হরণ করলেন।
এসবকিছু ভাবতে ভাবতে ছটফট করে উঠল একলব্য। বিধাতার রাজ্যে সকল মানুষই তো এক। মানুষই মানুষের মধ্যখানে দেয়াল তুলল। ছোট জাত বড় জাত, উঁচু বর্ণ নিচু বর্ণ বলে বলে কী রকম আলাদা আলাদা হয়ে গেল। একদল অন্যদলের হাতে পীড়িত-লাঞ্ছিত হলো। একদল শাসন করল, অন্যদল শাসিত হলো। এই বৈষম্য আর বিদ্বেষে মানুষ জর্জরিত হতে থাকল। এই অসাম্য আর বিদ্বেষ ছড়াতে যারা সবার আগে এগিয়ে এল, তারা ব্রাহ্মণ। নিষ্কর্মা একটা শ্রেণি। তারা শুধু পঠনপাঠন আর শাস্ত্ররচনাকে মূলধন করে মানুষের বিশ্বাস আর আবেগের ওপর গভীর একটা রেখাপাত করল। ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে মিশে মানুষের মস্তকে পাদুকা রাখল তারা। তারাই আজ মনুষ্য- বিশ্বাসের হর্তাকর্তাবিধাতা।
হঠাৎ ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল একলব্য। বুনো শুয়োরের মতো পৃথিবীকে খানখান করতে ইচ্ছে করল তার। টুকরো টুকরো পৃথিবীকে ছুড়ে ছুড়ে মেরে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই অহংদীপ্ত সমাজপ্রথাকে ছিন্নভিন্ন করতে চাইল সে। হাতের কর্তিত অংশের দিকে তাকিয়ে একলব্যের ভেতরে ঘৃণার প্রবল একটা পিণ্ড পাকিয়ে উঠল। দ্রোণরা এই অবাক করা সুন্দর পৃথিবীকে মনোহর থাকতে দেবেন না। এঁদের মস্তিষ্ক নেই, এদের হৃৎপিণ্ড নেই, বোধশক্তি নেই, ভালোবাসা নেই, কিছুই নেই। সামনে দাঁড়ানো দ্রোণের মূর্তিকে ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করল একলব্যের। এ তো এখন সুশোভন শ্রদ্ধার মূর্তি নয়, এ তো শুধু একতাল মাটি।
পাশ থেকে বামহাতে একটা মুগুর কুড়িয়ে নিল একলব্য। প্রচণ্ড আক্রোশে একের পর এক আঘাত করতে লাগল দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তিটির ওপর। ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়তে লাগল মাটি। একলব্য চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘তুমি আমার গুরু নও, তুমি আমার আদর্শ নও। তুমি লোভী, তুমি স্বার্থপর। তুমি পক্ষপাতী। তুমি পাষণ্ড। তুমি হত্যাকারী। তুমি হত্যা করেছ আমার আজন্মলালিত বাসনাকে। তুমি দস্যুর মতো আমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছ আমায়।’
তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে একলব্য গর্জন করে উঠল, ‘দ্রোণ, এখন থেকে তুমি আমার গুরু নও। অর্জুন, তোমাকে আমি দেখে নেব।’
.
পরদিন থেকে একলব্য অন্যমানুষে রূপান্তিত হলো। দৃঢ়, বাস্তববাদী, আবেগবর্জিত। একলব্যের মন একেবারে শক্ত হয়ে গেল। স্রষ্টা মানুষকে দুটো হাত দিয়েছেন কাজ করার জন্য। কোনো হাত ছোট, কোনো হাত বড় করেন নি। তার তো সবই ঠিক আছে। শুধু ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি নেই। তাতে কী হয়েছে?
‘মানুষের গোটা শরীরের তুলনায় আঙুলটি নিতান্ত ক্ষুদ্র একটি প্রত্যঙ্গ। এই প্রত্যঙ্গ ছাড়াই আমি উঠে দাঁড়াব। আমার তো বুদ্ধি, মেধা, কর্মতৎপরতা-সবই ঠিক আছে। আমার কিছুই তো অকেজো হয়ে যায় নি। এই তো ডান হাতটা আগের মতো সচল আছে। তাহলে ম্রিয়মান হব কেন? আমি আবার উঠে দাঁড়াব। উঠে দাঁড়াতেই হবে আমাকে। জগতকে দেখিয়ে দিতে হবে দ্রোণের মতো গুরু ছাড়াও শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হওয়া যায়।’ এরকমই ভাবল একলব্য।
একটা সময়ে ক্ষতস্থানটা শুকিয়ে গেল একলব্যের। সে ডান হাত দিয়ে আবার ধনুকে তীর যোজনা করবে, আবার লক্ষ্যভেদ করবে, বুড়ো আঙুলবিহীন ওই ডান হাত দিয়েই। কিন্তু শুধু প্রতিজ্ঞা করলে তো হবে না, চাই অধ্যবসায়, প্রতিদিনের কষ্টলগ্ন শিক্ষণ।
বৃদ্ধাঙুলটি কর্তন করে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার পরে একলব্য আবার কঠোর অস্ত্রসাধনা শুরু করল। বুড়ো আঙুল ছাড়া ডানহাতের অন্য চারটি আঙুল দিয়ে আগের মতো দূরে, আগের মতো ক্ষিপ্রতায় শরনিক্ষেপের সাধনা করে যেতে লাগল একলব্য। বুড়ো আঙুল না থাকায় তার বাণের গতি কমে এসেছিল, বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল তার নিক্ষেপিত তীর। যত শিগগির পরের পর পর বাণ নিক্ষেপ করতে পারত একলব্য, এখন তা আর পারে না। কিন্তু একলব্য দমবার পাত্র নয়। দাদু বলেছিলেন, অভ্যাসই মানুষের মূল চালিকাশক্তি। অভ্যাস মানুষকে অপটু থেকে নিপুণ করে তোলে। অভ্যাসে নিষ্ঠাবান থাকলে যে-কোনো মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে পারে।
দাদু অনোমদর্শীর বাক্যকে সম্বল করে একলব্য তীর নিক্ষেপের অভ্যাস চালিয়ে যেতে লাগল। অঙ্গবৈকল্য থাকা সত্ত্বেও নিজের মতো করে তীর চালনা অব্যাহত রাখল একলব্য। ধীরে ধীরে তার অসংগতি কেটে যেতে লাগল। তার নিক্ষেপিত তীর গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা শুরু করল। একলব্য বুঝল কর্মসাধনায় সে এগোচ্ছে। তবে পূর্ণ সাফল্য অর্জন এখনো অনেক দূর।
.
কী করে, কী করে নিষাদরাজ্যের রাজধানীতে সংবাদ গেল—দ্রোণাচার্য রাজপুত্র একলব্যের ডান হাত কেটে নিয়েছেন। সংবাদ কর্ণান্তর হলে যা হয়, তিল তাল হয়, মূষিক হাতি হয়, টিলা পর্বত হয়, একলব্যের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ডান হাতের বুড়ো আঙুল সম্পূর্ণ ডানহাত হয়ে গেল।
সংবাদ পেয়ে বিশাখা একেবারে ভেঙে পড়লেন—হায় হায়, ঈশ্বর, যে গুরুর কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে গেল, সেই গুরুই হাত কেটে নিল! হায় ভগবান, এ-কী হলো রে! আমার বাছাধনের সর্বনাশ হয়ে গেল রে!
হিরণ্যধনু ভেতরে ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ হলেন। বাইরের কাউকে কিছু বুঝতে দিলেন না। গুপ্তচর পাঠিয়ে একলব্যের অবস্থা ও অবস্থান জানার নির্দেশ দিলেন সেনাপতিকে।
কোনো ভাবান্তর হলো না শুধু অনোমদর্শীর। তিনি তাঁর নাতিকে যথার্থভাবে চেনেন। তাকে ঘিরে কোনো একটা কিছু হয়েছে এটা সত্য, তবে একলব্য যে বিধ্বস্ত হয় নি, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। ব্যাপারটি জানার জন্য তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
গুপ্তচর সংবাদ আনলে পুত্রের কাছে যাওয়ার জন্য হিরণ্যধনু প্রস্তুত হলেন। অল্পসংখ্যক দক্ষ অশ্বারোহী সৈনিক সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। প্রধান সেনাপতি সঙ্গে যেতে চাইলে হিরণ্যধনু নিষেধ করলেন।
বিশাখা পথ আগলে দাঁড়ালেন, ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’
হিরণ্যধনু বললেন, ‘বন্ধুর পথ, পাহাড়ি চড়াই-উত্রাই। গহিন বন, শ্বাপদসংকুল। যে-কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। যাচ্ছি একলব্যকে ফিরিয়ে আনতে। শিগগির তাকে নিয়ে ফিরব। তুমি যেয়ো না বিশাখা।’
বিশাখা বিরত হলেন। কিন্তু অনোমদর্শীকে থামানো গেল না। তিনি হিরণ্যধনুর সঙ্গে চললেন।
.
এক অপরাহ্ণে একলব্যের কুটিরের সামনে উপস্থিত হলেন তাঁরা। একলব্য তখন উঠানের মধ্যিখানে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে অনুশীলনে মগ্ন। জ্যা-এ তীর যোজনা করে তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে নিজের দিকে টানতে ব্যস্ত। তার মন একাগ্র, দৃষ্টি দূরবর্তী বস্তুতে স্থির নিবদ্ধ।
হিরণ্যধনু ডান হাত তুলে শব্দ করতে নিষেধ করলেন সবাইকে। ভালো করে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন ছেলের দিকে। এ-কী দেখছেন তিনি! এ কাকে দেখছেন! ও-ই কি রাজপুত্র একলব্য? যদি হয়, তবে তার রাজবসন কোথায়? শরীরের পেলবতা কোথায়? কাঁধ ঝুলানো চুল কোথায়? এই কি তার সন্তান একলব্য? এ একলব্যের মাথায় যে জটা! শুশ্রু যে তার মনোহর মুখমণ্ডলখানি ঢেকে ফেলেছে। সমস্ত শরীর যে ধুলায় মলিন। জীর্ণ বসনে নিম্নাঙ্গ ঢাকা, তা-ও হাঁটু পর্যন্ত। রাজপুত্রের শরীরে লাবণ্য কোথায়? হাড় জিরজিরে দেহের ওই তরুণটি কি তাঁর পুত্র, তাঁর প্রিয়তম আত্মজ!
অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে দমন করলেন হিরণ্যধনু। নিঃশব্দ পায়ে একলব্যের কাছে এগিয়ে গেলেন। অস্ত্রনিমগ্ন পুত্রের কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন।
ভীষণ চমকে পেছন ফিরল একলব্য। সামনে পিতাকে দেখে মুহূর্তকালের জন্য স্থির থাকল সে, তারপর বিদ্যুদ্বেগে পিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হিরণ্যধনুর বুকে নিজের মাথাটি রেখে ফুলে ফুলে কাঁদল একলব্য। সে একজন অবলম্বন খুঁজছিল। এই বিষণ্ণতাময় বেদনার দিনে সাহস ও শক্তি জোগাবার জন্য একজন সহানুভূতিশীল মানুষের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভব করছিল একলব্য। এই নিরাশার দিনে পিতা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার বুকে আশার সঞ্চার হলো। বিপুল কান্নাটা স্তিমিত হয়ে এলে একলব্য বলল, ‘বাবা, আমাকে সাহস দাও। বেঁচে থাকার শক্তি জোগাও।’
কখন অনোমদর্শী পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুজনের কেউ টের পান নি। গম্ভীর দরদভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমার মতো একজন দুঃসাহসীকে কে সাহস জোগাবে একলব্য? এত বড় ঝড়ের পরও যে টিকে থাকে, তার কখনো অন্যের সাহসের দরকার পড়ে না।’ বলতে বলতে নাতির হাত চেপে ধরলেন অনোমদর্শী।
‘নিজের ভেতরের সকল আবেগকে নির্বাসনে পাঠাও। তোমার সকল বিভ্রম কেটে যাবে।’ বললেন তিনি!
‘আমার ভেতরের সকল মোহ, সকল আবেগ কেটে গেছে দাদু। আমি এখন সম্পূর্ণ একজন পরিবর্তিত মানুষ।’ ধীরে ধীরে একলব্য বলল।
‘সন্ধ্যা নামল। ফিরে যাওয়ার সময় নেই এখন। রাতটা এই কুটিরেই কাটিয়ে দিই পিতা। কাল প্রত্যুষে যাত্রা শুরু করব।’ পিতার দিকে চেয়ে কথা শেষ করলেন হিরণ্যধনু।
অনোমদর্শী সম্মতি জানালেন।
কুটিরের চারদিকে সৈন্যরা পাহারা বসাল। স্থানে স্থানে প্রদীপ জ্বালাল। অদূরে উনুন জ্বালানো হলো। সৈন্যরা রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিতে থাকল।
আহার শেষে কুটিরের মধ্যে মুখোমুখি ত্রিভুজ আকারে বসলেন তিন প্রজন্মের তিনজন মানুষ। তিনজনই চুপচাপ। পিদিমের মৃদু আলো ঘরের ভেতর একধরনের মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। একলব্যকে ভিনজগতের মানুষ বলে মনে হচ্ছে হিরণ্যধনুর। আত্মজের সেই কোমল মুখখানি কী রকম অচেনা অচেনা লাগছে। চোখের নিচে কালি। কপালে কি বলিরেখার সামান্য উদ্ভাসন? ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। হাতের আঙুলগুলো সৌষ্ঠবহীন। ডানহাতের দিকে তাকাতেই হিরণ্যধনুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কিছু একটা বলবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন তিনি।
এইসময় অনোমদর্শী বলে উঠলেন, ‘একটা গল্প বলি শোনো।’ দুজনেই উৎকর্ণ হলেন।
‘বনবাস থেকে রাম ফিরে এসেছেন। রাজা হয়েছেন তিনি অযোধ্যার। সুখের সংসার রামের। রাজ্যে শুধু শান্তি আর আনন্দ। জরাজীর্ণতা দেশ থেকে নির্বাসন নিয়েছে। প্রজারা দারুণ সুখে জীবনযাপন করছে। রাজা হিসেবে রামের স্বস্তির অন্ত নেই। একদিন এক ব্রাহ্মণ এসে রামের সেই স্বস্তিতে ঠান্ডা জল ঢেলে দিল।’ বলে চলেছেন অনোমদর্শী। জিজ্ঞাসু চোখে একলব্য তাকিয়ে থাকল দাদুর দিকে।
অনোমদর্শী শুরু করলেন আবার, ‘সেই ব্রাহ্মণ রাজা রামচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলল, আমার পুত্র অকালে মারা গেছে। আর মৃত্যুর জন্য আপনার রাজ্যের অরাজকতাই দায়ী। বিস্মিত রাম জিজ্ঞেস করলেন, অরাজকতা! আমি তো জানি অযোধ্যায় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে কোনোরূপ অন্যায় প্রশ্রয় পায় না। ব্রাহ্মণটি গলা উঁচিয়ে বলল, ভুল জানেন আপনি। আপনার রাজ্যে বৈদিক নিয়মকানুন মানা হয় না। এই কারণেই তো শূদ্র বেদ-পুরাণ চর্চা করে। হু হু করে কেঁদে উঠল ব্রাহ্মণ। কাঁধের চাদর দিয়ে দু’চোখ মুছে শ্লেষের সঙ্গে বলল, শূদ্র শম্বুকের স্বর্গে যাওয়ার বাসনা হয়েছে, কঠোর তপস্যায় রত হয়েছে সে। শূদ্রের এই অনাধিকার চর্চার জন্য আমার পুত্রের অকাল মৃত্যু হয়েছে—বলে আকুল হয়ে রোদন করতে লাগল ব্রাহ্মণ।’
একলব্য বলল, ‘কী-না-কী অসুখে ব্রাহ্মণপুত্রের মৃত্যু হলো, দোষটা চাপিয়ে দিল শম্বুকের ওপর। রামচন্দ্র বিশ্বাস করলেন ব্রাহ্মণের কথা?’
অনোমদর্শী বললেন, ‘বিশ্বাস করলেন মানে! ক্ষত্রিয় রাজা ব্রাহ্মণপ্রজার কথা বিশ্বাস করবেন না তো কার কথা বিশ্বাস করবেন?
তারপর একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনোমদর্শী বললেন, ‘দ্বাপর যুগে শূদ্রের তপস্যা! এ তো ঘোর অন্যায়। সেই অন্যায় প্রতিহত করার জন্য খড়গহাতে বের হলেন রামচন্দ্র। খুঁজে বের করলেন তপস্যারত শম্বুককে। খড়গের এককোপে মুণ্ডপাত করলেন শম্বুকের।’ বলে হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করলেন অনোমদর্শী। হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেল। কণ্ঠ অনেকটাই বুজে এল তাঁর। ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘শম্বুককে হত্যার পর নাকি ব্রাহ্মণ সন্তানটি বেঁচে উঠেছিল।’
চারদিক নিস্তব্ধ। দূরে কোথাও শিয়াল ডেকে উঠছে। কাছের দূরের ঝোপে দলবেঁধে জোনাকিরা আলো ছড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ পর হিরণ্যধনু কথা বলে উঠলেন, ‘এই-ই হলো আর্য সমাজব্যবস্থা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য কাউকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না তারা।’
‘পায়ের তলায় পিষে মারবে। এইজন্য গুরুদক্ষিণার দোহাই দিয়ে তোমাকে পঙ্গু করে দিলেন দ্রোণাচার্য। বিচক্ষণ তিনি। তাই তোমার এমন প্রত্যঙ্গ চেয়ে বসলেন, যা হারালে তীরই নিক্ষেপ করতে পারবে না আর।’ অনোমদর্শী বললেন।
একলব্য বলল, ‘তাঁকে উত্তেজিত করেছে ওই অর্জুন। বুড়ো আঙুল কেড়ে নেওয়ার শতভাগ দোষের মধ্যে আশিভাগের জন্য দায়ী ওই পাণ্ডুপুত্র।’
হিরণ্যধনু বললেন, ‘তুমি যথার্থ বলেছ পুত্র। লোকমুখে যতটুকু শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, এই নৃশংস কাজে অৰ্জুনই প্ররোচিত করেছে দ্রোণকে।
‘হ্যাঁ বাবা, আমারও তা-ই বিশ্বাস।’ একলব্য বলল।
অনোমদর্শী গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘এই ভারতবর্ষকে বহিরাগত আর্যরা গিলে খেয়েছে। স্বার্থ অটুট রাখার জন্য ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় একত্রিত হয়েছে। রামের যুগে যেমন, এই সময়েও শূদ্রদের সকল অধিকার হরণ করতে চায় ওরা। তাই তো তোমার এই লাঞ্ছনা, এই পীড়ন।’
‘আমরা ওদের সঙ্গে পারব না বাবা। পদে পদে বঞ্চিত করবে ওরা আমাদের। ওরা আমাদের দাঁড়াতে দেবে না, বড় হতে দেবে না।’ গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবলেন হিরণ্যধনু। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে আবার বললেন, ‘বাবা একলব্য, তোমার কি প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে? এজন্যই দ্রোণাচার্যের কাছে আসতে নিষেধ করেছিলাম আমি। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছিলে, তোমার উন্নতির পথের অন্তরায় বলে আমাকে দোষারোপ করেছিলে।’
পিতার কথা শুনে মাথা নিচু করল একলব্য।
এইসময় অনোমদর্শী দ্রুত বলে উঠল, ‘থাক থাক হিরণ্য, পুরনো কথা থাক।’
তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা হয়েছে হয়েছে। অতীত অতীতই। তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। তুমি বাড়ি চলো একলব্য। কাল ভোরে আমরা যাত্রা করব। তোমার বিশ্রামের ভীষণ প্রয়োজন।’
চকিতে দাদুর দিকে তাকাল একলব্য। তার পর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো ফিরে যাব না দাদু।’
‘কেন?’ পিতা কিছু বলার আগে বিস্মিত কণ্ঠে দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন হিরণ্যধনু।
‘ওই যে দাদু বলেছেন—আমার ভবিষ্যতটা গড়তে হবে। এই অরণ্যে থেকে, কঠোর সাধনা করে আমি পূর্বের একলব্য হয়ে উঠতে চাই।’
‘পূর্বের একলব্য মানে?
‘হ্যাঁ বাবা, ভালোভাবে শিখে ফেলেছিলাম আমি তীর চালানোটা। যা অর্জুনরা জানে না, এমনকি দ্ৰোণও জানেন না, সেরকম শরসন্ধান করতে জানতাম আমি। বুড়ো আঙুল আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেক। অবিরত চেষ্টায় আবার অনেক দূর এগিয়ে এসেছি আমি। তারপরও বাকি রয়ে গেছে অনেক কিছু। তার জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন, সাধনার প্রয়োজন।
‘থাক তোমার সময়। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে এই আমার শেষ কথা।’ বললেন হিরণ্যধনু।
‘বিদ্যার্জন অসমাপ্ত রেখে ফিরে যাব বাবা! ধনুর্ধর হয়ে গোটা আর্যাবর্তকে তাক লাগিয়ে দেব না! আচার্যকে দেখিয়ে দিতে হবে না—তাঁর আশীর্বাদ ছাড়াও শূদ্ররা দাঁড়াতে পারে। আমি যদি দক্ষ তীরন্দাজ হয়ে না উঠি, তাহলে অর্জুনের ওপর প্রতিশোধ নেব কী করে বাবা?’
অনোমদর্শী বললেন, ‘থাক হিরণ্যধনু, থাক! একলব্যকে আর জোরাজুরি কোরো না। ওকে ওর মতো করে দাঁড়াতে দাও।’
হিরণ্যধনুর দিকে তাকিয়ে একলব্য বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, এই জগতসংসারকে আমি দেখিয়ে যেতে চাই…একলব্য নামে একদা এক নিষাদপুত্র ছিল। যে হেলায় জাতপাতের দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল ডিঙিয়ে, উচ্চবর্ণের অবহেলা-অপমানকে পাত্তা না দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিল।’
বলা শেষ করে বাবা এবং দাদুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল একলব্য।
হিরণ্যধনু বলল, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব পুত্র।’
.
একলব্যকে রেখে পরদিন সকালে স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করলেন হিরণ্যধনুরা।