১৬
মৃত্তিকার দ্রোণ-মূর্ত্তি করিয়া রচন।
নানা পুষ্প দিয়া তাঁর করয়ে পূজন।।
.
বিড়ম্বিত একলব্য হাঁটতে থাকল।
তার গন্তব্য স্থির নয়। লক্ষ্যহীনভাবে অবিরাম সে হেঁটে যেতে লাগল। পা দুটো তার রক্তাক্ত। অরণ্যের ঝোপঝাড়ে আর কাঁটায় লেগে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড়টি শতচ্ছিন্ন। পরিধেয়বসনেরও এখানে ওখানে ছিঁড়ে গেছে। শরীরের নানা জায়গায় গাছের শাখার আর কাঁটার খোঁচায় ছিঁড়েফুঁড়ে গেছে। কোনো কোনো স্থান থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। কোনো দিকে খেয়াল নেই তার, না শরীরের দিকে, না বসনের দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে একলব্য।
সেই সকাল থেকে কতক্ষণ হাঁটছে একলব্য হিসেব রাখে নি। সে অনেকটা বাহ্যজ্ঞানরহিত। চোখ খোলা থাকা সত্ত্বেও সে ঠিকঠাকমতো দেখছে না, মস্তিষ্ক সচল থাকা সত্ত্বেও সে যথাপূর্ব ভাবতে পারছে না। শুধু তার কানে বাজছে গুরু দ্রোণের কথা ‘অপাঙ্ক্তেয় কোনো জনগোষ্ঠীর সন্তানকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দিই না।’
আচার্যের এই বাক্য তার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। গুরুর যেমন কোনো গোত্রাগোত্র পরিচয়ের দরকার হয় না, তেমনি শিষ্যেরও। তাহলে? তাহলে গুরুদেব তার প্রতি এমন নিষ্ঠুর তাচ্ছিল্য দেখালেন কেন?
গুরুরা তাঁদের নিজস্ব জ্যোতিতে উদ্ভাসিত, ছাত্ররাও নিজেদের নম্রতায় আর শ্রদ্ধাবোধে চিহ্নিত। যথার্থ গুরুর কাছে একজন ছাত্রের ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্বের পরিচয়টা মুখ্য নয়, গণনীয় বিষয় হলো ছাত্রটি কতটুকু মেধাবান, অধ্যবসায়ী আর নিষ্ঠাবান। একজন শিষ্য বর্ণ-ইতর হলেই মানবেতর প্রাণীর মতো তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে? দ্রোণের বিদ্রূপময় কথাগুলো একলব্যকে রক্তাক্ত করতে থাকে। তার ভাবনাগুলো গলন্ত সীসা হয়ে তার চোখ-কান-নাসিকা দিয়ে বেরোতে থাকে।
একলব্য দিশাহীনভাবে হাঁটছে আর ভাবছে আচার্য দ্রোণের কাছে একজন মানুষের পরিচিতি শুধু তার উচ্চবর্গীয়তার জন্য? আদর্শ, সত্যপ্রিয়তা, একনিষ্ঠতা, মেধা—এসব সদ্গুণ আচার্যের কাছে তাহলে বিবেচ্য নয়? কোন ঘরে জন্মাল, কোন বংশে জন্মাল – সেটাই কি একজন মানুষের সব? সেই মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলে কিছুই নেই?
অখ্যাত কোনো স্থানে বা বংশে একজন মানুষ জন্মালেও নিজের চেষ্টায় সে বড় হয়, দুর্গম জীবনপথ অতিক্রম করে সে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়, নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করে। একলব্যও তা-ই চেয়েছিল। নিষাদবংশে জন্মেও এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল দুর্দান্ত ধনুর্ধর। সে তো কাউকে অতিক্রম করতে চায় নি, হতে চায় নি কারও প্রতিদ্বন্দ্বীও। কুরুবাড়ির রাজপুত্ররা তো কুরুবাড়ির রাজপুত্র। তাদের আলাদা একটা জৌলুস আছে, আছে পৃথক একটা মর্যাদা। তাদের প্রতিযোগী হয়ে নিজেকে তৈরি করার চিন্তা ঘুণাক্ষরেও তার মাথায় আসে নি।
সে শুধু চেয়েছিল রাজপুত্রদের পাশে বা দূরে, দ্রোণাচার্যের সামনে বসার একটা আসন। ওই আসনে বসে গুরুর সাহচর্যে নিজের বিদ্যাকে ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিল সে। ওদের শিক্ষাদান শেষে গুরু সামান্যটুকু সময়ের জন্য তার দিকে তাকালে হতো। শুধু একটু মিষ্টি হেসে অস্ত্রকৌশলের সামান্যতম প্রশিক্ষণ তাকে দিলেই তার স্বর্গপ্রাপ্তির মতো আনন্দ হতো। কিন্তু গুরুদেব এরকম তো কিছুই করলেন না। বললেন, ‘তুমি আসো এখন।’
আহ! এসব কী ভাবছে সে! আচার্য দ্রোণ সম্পর্কে এরকম মন্দ ভাবছে কেন সে! আচার্য তো তার গন্তব্য, তার তীর্থভূমি। তিনি তো তার স্বপ্নপূরণের জায়গা। মানস- সরোবর। মানস-সরোবরের জলে স্নান করে মানুষ নাকি যা কামনা করে, তা পায়। এই দ্রোণাচার্য-সরোবরে অবগাহন করে সে ঐশ্বর্যশালী হতে চেয়েছিল, চেয়েছিল অস্ত্রকৌশলী হতে।
তার মনস্কামনা পূরণ হয় নি। তাতে কী আসে যায়! রক্তমাংসের আচার্য ক্রোধের বা মোহের বা লোভের অথবা সামাজিক কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তাতে তো একলব্যের কিছু যাওয়া আসার কথা নয়। তার ভেতরে, তার মস্তিষ্কের কোষে কোষে, তার ভাবনার পবিত্রভূমিতে আরেকজন দ্রোণাচার্য তো দাঁড়িয়ে আছেন। ওই তো তিনি ডান হাতে বরাভয় করছেন। ওই তো তাঁর মুখমণ্ডলে স্নিগ্ধ পবিত্র হাসি। ওই তো তাঁর দুটো চোখে স্নেহাভা জ্বলজ্বল করছে। ওই তো তিনি বলছেন—’ভয় পেয়ো না বৎস, থেমে যেয়ো না। রিপুবশীভূত রক্তমাংসের আমি তোমাকে অস্বীকার করেছি তো কী হয়েছে? তোমার মনোভূমিতে আরেকজন যে দ্রোণ আছেন, তিনি তো তোমার অনুকূলে। তাঁকে ঘিরে তুমি তোমার নিজস্ব জগৎ গড়ে তোলো। তাঁকে প্রণিধানযোগ্য করে তুমি তোমার সাধনা চালিয়ে যাও।’
থমকে দাঁড়াল একলব্য। তাই তো, এতক্ষণ সে পাগলের মতো এই গহিন অরণ্যের মধ্যে হাঁটছে কেন? কেন সে সৎচিন্তা থেকে বিচ্যুত হয়েছে? কেন গুরুকে নিয়ে এরকম অপবিত্র কথা ভেবেছে? ছিঃ ছিঃ! গুরু দ্রোণ যে তার প্রণম্য, প্রাতঃস্মরণীয়!
দুদিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল একলব্য। কলুষিত চিন্তা এক ঝটকায় মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। চারদিকে চোখ তুলে তাকাল সে। দেখল—সামনে ছোটোবড়ো নানা গাছগাছড়ার মাঝখানে একফালি খালি জায়গা। অদূরে কদলিগাছের বন। দু-চারটা আম কাঁঠালের গাছ এদিকে ওদিকে। বিশাল বিশাল তিন-চারটি বৃক্ষ স্থানটিকে ছায়াশীতল করে রেখেছে। বেশ কিছু দূরে জলাশয়ের আবছা অবস্থান তার চোখ এড়াল না।
একলব্য মনস্থির করল—এই স্থানটিই হবে তার সাধনার স্থল। তার অর্জনের জায়গা। ভেতরের সকল কলুষযুক্ত ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে অর্জনের সাধনায় মগ্ন হবে সে এই স্থানটিতেই। অদ্ভুত একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল একলব্যের সারা মুখে। এই হাসি কি আশাভঙ্গের? না স্বার্থপর এই পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়ার যে, তুমি যতই আমাকে দমিয়ে রাখতে চাও না হে ধরিত্রী মাতা, একটা সময়ে আমি মাথা তুলে দাঁড়াবই।
স্থানটি পরিষ্কার করল একলব্য। ক’দিনের চেষ্টায় সে একটা কুটিরও তৈরি করল সেখানে। উঠানটা বেশ প্রশস্ত রাখল। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষার্থীর মতো পোশাক-পরিচ্ছদ ধারণ করল। ফল-মূল-লতা-গুল্মকে আহার্য করে তুলল। পানীয়জল সংগ্রহ করল সেই জলাশয় থেকে।
এবার গুরুর মূর্তি নির্মাণের পালা। যে-কিছুক্ষণ দ্রোণাচার্য-সান্নিধ্যে ছিল একলব্য, গভীর অভিনিবেশে লক্ষ করেছে তাঁকে। তাঁর দেহসৌষ্ঠব, বাহুর দৈর্ঘ্য, শরীরের গৌরবর্ণতা বিশেষ করে শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখের গড়নকে অবলোকন করেছে সে। বাস্তবগুরুর চেহারার সঙ্গে মানসগুরুর স্নিগ্ধতা মিশিয়ে এক মৃন্ময় মূর্তি তৈরি করল একলব্য। নিপুণ খেয়াল আর অপরিসীম শ্রদ্ধার ফল যেন দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তিটি।
দ্রোণাচার্য ছাড়া আর কারও কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করবে না একলব্য। দ্রোণ ছাড়া আর কাউকে সে গুরুর আসনে বসাতে পারবে না। মনে মনে দ্রোণাচার্যকে গুরু হিসেবে বরণ করে তাঁর মৃন্ময় মূর্তিটি গড়ল একলব্য। এবং এই মূর্তিটির কাছ থেকেই মনে মনে দীক্ষা গ্রহণ করল সে।
গুরুর কাছে দীক্ষিত হওয়ার অপর নাম চরম আত্মসমর্পণ। এই আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে নিজের লজ্জা-ভয়-মান-অপমান-সুখ-দুঃখ-ভাবনা সব বিলীন হয়ে যায়। মূর্তিকে প্রণিপাত করার পর একলব্যের ভেতর থেকে এসবকিছু একেবারে দূরীভূত হয়ে গেল। থেকে গেল শুধু বিনয়াবনত শ্রদ্ধা আর ধনুর্বিদ্যার্জনের নিষ্ঠা। মনে মনে সে বলল, হে গুরুদেব, আমার যা কিছু অস্ত্রশিক্ষা হবে, তা শুধু আপনার করুণায় হবে, আমি যা কিছু শিখছি বা শিখব, তা শুধু আপনার আনুকূল্যের কারণে হবে।
মৃন্ময় মূর্তির মধ্যে দ্রোণের আচার্যস্বরূপটি প্রতিষ্ঠা করে একলব্য ধনুক বাণের অভ্যাস শুরু করল।
যথার্থ শিক্ষার জন্য জীবনের অন্যসমস্ত আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিতে হয়। কোনো বিষয়ে চরম নৈপুণ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা। ইন্দ্রিয় সংযম, একাগ্রতা আর ত্যাগ মানুষকে চরম প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত করে তোলে। একলব্যের মধ্যে ধীরে ধীরে এসব গুণ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
দিন কাটল। সপ্তাহ-মাস গেল। বছরও অতিক্রান্ত হতে লাগল একের পর এক। পরম একাগ্রতায় একলব্য ধনুঃশরের সাধনা করে যেতে লাগল। আমি অবশ্যই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হব-এই নিষ্ঠায় সে অস্ত্রের গ্রহণে, সন্ধানে এবং নিক্ষেপণে একটা সহজ অথচ ক্ষিপ্র গতিময়তা দান করতে সক্ষম হলো। নিজে নিজে সে এমন এমন বাণ আবিষ্কার করল, যা সে ছাড়া এই পৃথিবীর অন্য কেউ জানে না। দ্রোণাচার্যের প্রতি নিষ্ঠা আর শ্রদ্ধার গুণেই সে এসব স্বকল্পিত অস্ত্রের সন্ধান করতে শিখে গেল।
.
কুরুরাজকুমাররা মৃগয়ায় বেরিয়েছে। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। দুর্যোধনের সঙ্গে দুঃশাসন, দুর্বিষহ, দুর্মুখ, বিকর্ণসহ নিরানব্বইজন ভ্রাতা। আর আছে মিত্ৰ কৰ্ণ।
এই মৃগয়া ছিল শুধু কুরুবাড়ির রাজপুত্রদের জন্য, কর্ণ সে যাত্রায় অগ্রহণীয়। কিন্তু দুর্যোধনের এককথা—’মিত্র কর্ণ আমাদের সঙ্গে যাবে।’
দ্রোণাচার্য এই আবদারে প্রীত ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্র যেন দ্রোণের ভাবনারই প্রতিধ্বনি করলেন দুর্যোধনের সামনে। মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘রাজ ঐতিহ্য বলে একটা কথা আছে পুত্র। এই মৃগয়া শুধু পশুশিকার নয়, রাজ-ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণও বটে। রাজপুত্রদের মৃগয়ায় কর্ণ বেমানান।’
‘আমি আপনার এই যুক্তি মেনে নিতে পারছি না তাত। মৃগয়া-যাত্রায় শুধু কি রাজপুত্ররাই যায়? রথচালকরা যায় না, হাতি-ঘোড়ার যত্ন নেওয়ার লোকগুলো যায় না? পাচক-পাঠিকারা যায় না? দড়ি-কাছি নিয়ে কাঠুরেরা যায় না? মালামাল বহনকারীরা যায় না? ওরা সবাই কি রাজপুত্র? নিশ্চয় নয়। ক্ষত্রিয় এবং ক্ষত্রিয়-ইতর মানুষ তারা। তারা যদি যেতে পারে, কর্ণ যেতে পারবে না কেন?’ একটু থেমে কী যেন ভাবল দুর্যোধন। তারপর বলল, ‘আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পিতা, আপনি অন্ধ। দৃষ্টিশক্তি থাকলে দেখতেন—কী দিব্য চেহারা কর্ণের! যে-কোনো ক্ষত্রিয়কে হার মানাবে তার চেহারা। আর কর্ণের গুণের কথা তো নিজ কানে শুনেছেন। এই মৃগয়ায় যারা যাচ্ছে সবাই রাজপুত্র, রাজা নয় কেউ। কর্ণ কিন্তু রাজা, অঙ্গদেশের রাজা সে এখন। ফলে এই মৃগয়ায় যাওয়ার সকল অধিকার কর্ণের আছে। আপনি কর্ণের যাত্রাপথের অন্তরায় হবেন না।’
জ্যেষ্ঠপুত্রের যুক্তি শুনে ধৃতরাষ্ট্র চুপ মেরে গেলেন। কর্ণও দুর্যোধনাদির সঙ্গে মৃগয়ায় গেল। সঙ্গে রথ, হাতি, ঘোড়া তো গেলই, আরও গেল শিকারি কুকুর। মৃগয়ার নানা উপাচার যেমন জাল, রজ্জু প্রভৃতি নিয়ে প্রশিক্ষকও সঙ্গে চলল।
যে-অরণ্য অতিক্রম করে দ্রোণাচার্য পাঞ্চাল থেকে হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, যে- অরণ্যে দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তির সামনে বসে একলব্য অস্ত্রসাধনায় মগ্ন, সেই অরণ্যে কুরুবাড়ির রাজকুমাররা মৃগয়ায় গেল।
বনে ঢুকে রাজকুমাররা ইতস্তত পশুর অন্বেষণ আরম্ভ করল। কেউ কেউ পশুর পেছনে রথ ছোটাল, কেউ ঘোড়ায় চড়ে পশুর অনুসন্ধানে রত হলো। আবার কেউ হাতির পিঠে আরোহণ করে গদাই লস্করি চালে পশুর খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। মৃগয়া চলতে থাকল আপন প্রক্রিয়ায়।
শিকারি কুকুরটিও বেশ মজা পেয়ে গেল। সে একবার রথের পেছনে ছোটে, আবার ঘোড়ার পেছনে। কখনোবা হাতির সঙ্গী হয়ে তীব্র স্বরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। কুকুরটির কর্কশ অথচ গম্ভীর শব্দে পশুরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করল।
একটা সময়ে পশু অন্বেষণকারী কুকুরটি ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের সামনে এসে পৌঁছাল। নির্জন বনের মধ্যে নিকষ কালো একজন মানুষকে দেখে প্রথমে থমকে দাঁড়াল কুকুরটি। এ কাকে দেখছে সে? সারা গায়ে ধুলোমাটির আস্তরণ, জটপাকানো চুল, এক টুকরা মৃগচর্ম পরনে, হাতে তীর ধনুক! এ কে? এরকম কিম্ভূতকিমাকার চেহারার কেউ তো তার স্মৃতিতে নেই। খুব ছোটবেলা থেকেই রাজবাড়িতে প্রতিপালিত হচ্ছে সে। তার সামনে যাদের যাদের সে দেখতে পেয়েছে তাদের সবাই সুবেশি সুপুরুষ, গৌর তাদের গায়ের রং। যাকে একটু মলিন বসনের দেখেছে, সে তার প্রশিক্ষক। তারপরও প্রশিক্ষকটির তো এরকম অদ্ভুতুড়ে চেহারা-বসন নয়! তাহলে এ কে? নিশ্চয় শত্রুশ্রেণির কেউ। তার হাতে যে তীর ধনুক! নিশ্চয় তার প্রভুদের অকল্যাণ করার জন্য সে এখানে ঘাপটি মেরে আছে। একে তো ছাড়া যাবে না। আক্রমণ করে লোকটিকে কুপোকাত করাই বিধেয়। কিন্তু আক্রমণ করবেই বা কীভাবে? তার হাতে যে তীর-ধনুক। তাই স্বভাবজ স্বভাবে সে চিৎকার করে উঠল, ঘেউ ঘেউ। তার চেঁচানো একলব্যকে লক্ষ্য করে।
একলব্য সে-সময় তীর-নিক্ষেপণে একাগ্রমনা ছিল। কুকুরটি চেঁচিয়ে ওঠায় তার একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটল। তীর লক্ষ্যচ্যুত হলো।
কিন্তু তীর তো লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার কথা নয়! গত ক’বছরের সাধনায় একলব্য এমনই দক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সত্যিই তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। বিরক্ত হলো একলব্য। নির্জন গভীর অরণ্যে এই আপদটা এল কোথা থেকে? বিরক্ত হলেও মানবেতর প্রাণীটিকে থামাতে চাইল একলব্য। মুখে শো শো আওয়াজ করে এবং নানা দেহভঙ্গি করে সে তার আশ্রমের গণ্ডি থেকে কুকুরটিকে তাড়াতে চাইল। কিন্তু কুকুরটি আরও তীক্ষ্ণ কর্কশ স্বরে চিৎকার করতে লাগল। একলব্য ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল
একাগ্রতা ভঙ্গের অপরাধে একলব্য কুকুরটির মুখ লক্ষ্য করে সাতটি বাণ ছুড়ল। ক্ষিপ্রগতিতে গিয়ে সাতটা তীর কুকুরটির মুখ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। ধনুর্বেদীয় ভাষায় একে বলে লাঘব। নিজের বিরক্তি নিবারণের জন্য একলব্য অস্ত্রলাঘব করেছে।
শরাহত কুকুরটির আওয়াজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সেই অবস্থাতেই রাজকুমারদের খুঁজে বের করল কুকুরটি। কুরুকুমাররা বিস্ময়ে কুকুরটির দিকে তাকিয়ে থাকল—এ কী দশা কুকুরটির! চেঁচানোর ক্ষমতা নেই যে তার! কুকুরটির মুখ তো তীরবিদ্ধ দেখা যাচ্ছে! কী আশ্চর্য, একফোঁটাও রক্ত পড়ছে না কুকুরটি মুখ থেকে! কে কুকুরটির এই দশা করল? যে-ই করুক, সে ধনুর্বেদের চরম দুটো রহস্য জানে। ক্ষিপ্রতা আর চরমতম হস্তলাঘব সেই ধনুর্ধরের অধীন। দূর থেকে যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে, লক্ষ্যবস্তু দেখার প্রয়োজন হয় না যার, সে-ই শুধু এরকম দক্ষতা দেখাতে পারে। এই দক্ষ ব্যক্তিটিকে তো খুঁজে বের করতেই হবে।
অন্যান্য ভাইয়েরা বিস্মিত হলেও অর্জুন ভাবিত হলো। এ কোন ধনুর্ধর যে, তাকে অতিক্রম করেছে। পৃথিবীখ্যাত দ্রোণাচার্যের কাছে তার অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ। তাঁর সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে অর্জুনকে শিখিয়েছেন তিনি। কিন্তু এরকম অস্ত্রচালনা তো তিনি তাকে শেখান নি! তাহলে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর এই পৃথিবীতে আছে। রহস্যময় সেই ব্যক্তিটির সন্ধান করা অতীব জরুরি। অসূয়া জর্জরিত অর্জুন এবং তার সঙ্গে অপরাপর ভাইয়েরা চলল একলব্যের অনুসন্ধানে।
বাকবন্দি কুকুরটিকে অনুসরণ করে অর্জুনাদি ভাইয়েরা একলব্যের কুটিরের সামনে উপস্থিত হলো। দেখল—তাদেরই বয়সি এক যুবক বিরামহীনভাবে অস্ত্রাভ্যাস করে চলেছে। তাকে দেখে রাজকুমারদের পছন্দ হলো না। তার মুখ-চোখ-কান, তার হনুদ্বয়ের সংস্থান, তার গায়ের রং, তার উচ্চতা কোনো কিছুই মনঃপূত হলো না তাদের। কারণ এ তো তাদের জনজাতির ঘনিষ্ঠ কেউ নয়। একলব্যকে বিকৃত চেহারার বলে মনে হলো তাদের।
ভেতরে অবহেলা তীব্র হয়ে উঠল অর্জুনের। ক্ষুব্ধকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? কার ছেলে?’
নিজের পরিচয়টাই কি সবকিছু নয়? পিতৃপরিচয়ের দরকার কী? তার তো পিতৃপরিচয় আছে। অর্জুনের আছে কি? এ যে অর্জুন, এরা যে কুরুপ্রাসাদের রাজকুমার, চিনতে এতটুকুও ভুল হলো না একলব্যের। সেদিনের সেই দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায় অর্জুনকে দেখেছে সে। সেই দেখার স্মৃতিটি একলব্যের করোটিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে। সামান্য সময়ের জন্য দেখা অর্জুনকে। তারপরও তাকে ভুলতে পারে নি একলব্য। সেদিন অর্জুনের সারা মুখে ছিল গাঢ় অবহেলা, তীব্র ঘৃণা। সেই ঘৃণার আর সেই ক্ষুব্ধ চেহারার অর্জুনকে ভুলে কী করে একলব্য? আজ সেই অর্জুন তার পিতার পরিচয় জানতে চাইছে। এখন, এই মুহূর্তে যদি একলব্য অর্জুনের পিতৃপরিচয় জানতে চায়, যদি জিজ্ঞেস করে, ‘অর্জুন, তোমার প্রকৃত জন্মাদাতা কে? কী জবাব দেবে অর্জুন? প্রশ্নটা খলবলিয়ে উঠল একলব্যের গলা বেয়ে। সৌজন্যবোধ সামনে এসে দাঁড়াল। অর্জুন জিজ্ঞেস করতে পারে, সে তো পারে না। নিজেকে সংযত করল একলব্য। সে কয়েক মূহূর্তের জন্য অস্ত্রানুশীলন থামাল।
অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘একলব্য আমার নাম। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলছি নিষাদগোষ্ঠীর অধিপতি হিরণ্যধনু আমার পিতা।’
‘একলব্য! এই নামটি কোথায় শুনেছি যেন!’ অর্জুন একলব্যের নামটি স্মরণ করবার চেষ্টা করল।
পাশ থেকে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘তুমি সেই নিষাদপুত্র একলব্য না, যে একদা গুরু দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার জন্য গিয়েছিলে?’
‘যথার্থ বলেছ তুমি।’ নিস্পৃহ গলায় বলল একলব্য।
একলব্য গুরুদেবের কাছে গিয়েছিল অস্ত্রবিদ্যা শিখতে?’ বিস্মিত কণ্ঠ অর্জুনের। ‘হ্যাঁ গিয়েছিলাম। তোমার চোখেমুখে প্রচণ্ড তাচ্ছিল্য ছিল সেই সকালে। তোমার মনটা অন্ধকারে ঢাকা ছিল। তাই তুমি আমাকে দেখেও দেখতে পাও নি। আমি কিন্তু তোমাদের প্রায় সবাইকে মনে রেখেছি, যেমন ধরো—তুমি অর্জুন, ও দুর্যোধন, এ ভীম। আর ওই যে দূরে দাঁড়িয়ে আছে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে, ও যুধিষ্ঠির। আর এই যে ঘুরে ঘুরে আচার্যের মূর্তিটি দেখছে, সে বিকর্ণ।’
‘দ্রোণাচার্যের মূর্তি! তোমার এখানে!’ অর্জুন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
এবার শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে একলব্য বলল, ‘হ্যাঁ, গুরুদেব দ্রোণের মূর্তি গড়েছি আমি। ওই দেখো উঠানের এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর পদতলে বসে আমার অস্ত্রবিদ্যা শিখা।’
চকিতে মূর্তিটির দিকে তাকাল অর্জুন।
একলব্য বলল, ‘আমি আচার্য দ্রোণের শিষ্য।
‘আচার্য দ্রোণের শিষ্য! তুমি!’
‘আমার বাণ নিক্ষেপের যত রহস্য তার সবকিছু দ্রোণাচার্যের কাছেই শেখা।’ অবনত মস্তকে বলল একলব্য। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই বুঝি বা একলব্যের মস্তক অবনত হওয়া।
একলব্যের এই কথা শুনে পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র-পুত্ররা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল।
মুচকি মুচকি হাসতে লাগল শুধু কর্ণ।
‘আর এই শরনিক্ষেপণ, কুকুরের প্রতি চরমতম হস্তলাঘবের প্রক্রিয়াটিও কি আচার্যের কাছ থেকে শিখেছ তুমি?’ অর্জুন পুনরায় প্রশ্ন করল।
এবার অর্জুনকে নিয়ে একটু খেলতে ইচ্ছে করল একলব্যের। বলল, ‘শুধু এই হস্তলাঘব কেন, এর চেয়ে আরও দুর্দান্ত, আরও ভয়ংকর অস্ত্রবিদ্যা আমার অধিগত। যার অনেকটাই হয়তো তুমি জানো না। ও হ্যাঁ, এসব কিছু গুরুদেব দ্রোণের কাছেই শিখেছি আমি। তিনিই আমাকে এই বিচিত্র, বিধ্বংসী অস্ত্রগুলোর চালনা শিখিয়েছেন।’
একলব্যের কথাগুলো অর্জুনের কান দিয়ে আর ঢুকছিল না। তার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। পরিপার্শ্ব তার চোখে আবছা হয়ে এল।
এই সময় কর্ণের কণ্ঠ শুনতে পেল অর্জুন, ‘কী অর্জুন, ভাবছ—গুরুদেব তো শুধু আমারই ছিল। তাঁর অস্ত্রভাণ্ডার তো আমার দখলেই থাকার কথা। গুরুদেব তো সেরকমই কথা দিয়েছিলেন তোমাকে। মাঝখানে ভূঁইফোঁড়ের মতো এই নিষাদপুত্র একলব্য কোথা থেকে হাজির হলো? একলব্যের মতো অপাঙ্ক্তেয়দের তো পায়ের কাছে থাকার কথা। এ কোন একলব্য, যে সদর্পে গুরুদেবের শিষ্যত্ব দাবি করছে? তাও না হয় তুমি মেনে নিতে। কিন্তু একলব্যের তুলনাহীন অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষাকে কীভাবে মানবে তুমি? আমি কি ভুল বললাম অর্জুন? এরকম ভাবছ না তুমি?’
কর্ণের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না অর্জুনের। শুধু ভাবল-এ কী করে সম্ভব! দ্রোণাচার্য একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন! এই রকম অভূতদর্শন অস্ত্রগুলো তুলে দিয়েছেন একলব্যের হাতে? একলব্য নিজেকে দ্রোণের শিষ্য বলে পরিচয় দিচ্ছে অথচ অর্জুন তাকে চেনেই না
মৃগয়া অসমাপ্ত রেখে রাজকুমাররা হস্তিনাপুরে ফিরে এল।