১৪
যৎ কৃতং তত্র পার্থেন তচ্চকার মহাবলঃ।
অর্জুন যা যা করে দেখাল, কর্ণও তার সবকিছু করে দেখাল।
.
‘মহামহিম পরশুরাম আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দান করেছেন।’ দ্রোণাচার্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল কর্ণ।
‘আপনি চাইলে এই রঙ্গভূমির আপামর জনগণকে আমার করায়ত্ত ব্রহ্মাস্ত্র-প্রয়োগ- কৌশল দেখাতে প্রস্তুত আমি।’ সমবেত রাজন্য আর জনসাধারণের ওপর দৃষ্টি ফেলে কথা শেষ করল কর্ণ। পরশুরামের অভিশাপের কথা চেপে গেল সে।
এই সময় দুর্যোধন হাততালি দিয়ে উঠল। বলল, ‘বাহবা, বাহবা মিত্র। তুমি ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেছ? কী আনন্দ! কী সুখের সংবাদ এটি!’
দ্রোণাচার্য বললেন, ‘তুমি থামো দুর্যোধন। বালকের মতো আচরণ করছ কেন? এটা রঙ্গভূমি। শতসহস্র চোখ আমাদের ওপর। তোমার বালখিল্য আচরণ দেখে ওঁরা তোমার সম্পর্কে কী ভাববেন?’
গুরুর ধমক খেয়ে আপাতত চুপ মেরে গেল দুর্যোধন। কিন্তু কৰ্ণ দমল না।
উপহাসের কণ্ঠে কর্ণ বলে উঠল, ‘সূতপুত্র বলে যে-আমাকে আপনি একদিন ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই কর্ণকে শিষ্যত্ব দিয়েছেন পরশুরাম।’
কর্ণের কথায় ভীষণ চিন্তান্বিত দেখাল দ্রোণাচার্যকে। গম্ভীর মুখে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
এই সময় অর্জুন বলে উঠল, ‘তুমি মিথ্যে বলছ কর্ণ। মিথ্যে বলে গুরুদেবকে বিভ্রান্ত করছ। মহাত্মা পরশুরাম তোমার মতো সূতপুত্রকে কখনো শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। যদি করেই থাকেন, তুমি তাঁর কাছে নিজের বংশপরিচয় লুকিয়েছ!’
কর্ণ দেখল, তাঁর জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আচার্য আর আমার মধ্যে কথা হচ্ছে। মাঝখানে তুমি কথা বলার কে? তুমি তো একজন সুবিধাবাদী। প্রবঞ্চক তুমি। আমাকে প্রবঞ্চিত করে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা হাতিয়ে নিয়েছ দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে।
অর্জুন প্রত্যুত্তর দিতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামালেন দ্রোণ। বললেন, ‘এখানে রাজপুত্রদের অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন চলছে। তুমি রাজপুত্র নও, সূত অধিরথপুত্র। তোমার এই রঙ্গভূমিতে থাকার অধিকার নেই। তুমি এই স্থান ত্যাগ কোরো কর্ণ।’
‘আবার জাতপাতের কথা তুললেন গুরুদেব! জাতপাত তো আপনাদেরই সৃষ্ট। শোষণ-শাসনের সুবিধার জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় মিলে বর্ণপ্রথার কঠিন নিগড়টি তৈরি করেছেন। কঠোর শৃঙ্খলে বেঁধেছেন রাজ্যের অধিকাংশ খেটেখাওয়া মানুষকে। দেশের অধিকাংশ মানুষই তো বৈশ্য আর শূদ্র।’
কর্ণকে আজ কথায় পেয়ে বসেছে। একদিন যে দ্রোণাচার্য তার গুরু ছিলেন, তাঁরই হাতে যে তার বাছা বাছা অস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল, কর্ণ তা ভুলে গেল। বলল, ‘রাজপুত্রের দোহাই দিয়ে আমাকে বিতাড়িত করতে চাইছেন এই রঙ্গভূমি থেকে। তা না হয় মানলাম। রাজপুত্র নই বলে রঙ্গভূমি ত্যাগ করলাম আমি। কিন্তু একলব্য তো রাজপুত্র ছিল, নিষাদরাজ্যের রাজপুত্র ছিল সে। তাকে কেন আপনি বঞ্চিত করলেন?’
বিস্ফারিত চোখে কর্ণের দিকে তাকালেন দ্রোণাচার্য। বললেন, ‘একলব্যের কথা তুমি জানলে কী করে? তখন তো তুমি পাঠশালায় ছিলে না।’
‘সত্য কখনো গোপন থাকে গুরুদেব? আপনি একলব্যকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন গুরুদেব। বলেছেন, হীনজাতে জন্ম তোমার, তুমি আমার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নও। ঠিক বলছি না আমি গুরুদেব?’
এই রকম বিব্রতকর অবস্থায় আগে কখনো পড়েন নি দ্রোণাচার্য। হ্যাঁ, আরেকদিন বিব্রত, উন্মত্ত, বাছাবাছা হয়েছিলেন তিনি। দ্রুপদের রাজসভায় যেদিন বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে রাজা দ্রুপদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি, সেদিন দ্রুপদ বন্ধুত্ব অস্বীকার করে তাঁকে অপমানে অপমানে জর্জরিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান দিনের সঙ্গে ওইদিনের পার্থক্য আছে। ওইদিন ক্রোধান্বিত দ্রোণ বলে উঠেছিলেন, ‘একদিন তোমার এই অপমানের প্রতিশোধ নেব আমি দ্রুপদ, পায়ের তলায় ফেলব আমি তোমাকে একদিন।’
কিন্তু আজ কী করবেন তিনি? একের পর এক যুক্তি দাঁড় করিয়ে কর্ণ তাঁকে যেভাবে ঘায়েল করছে, তার উপযুক্ত জবাব তো তাঁর কাছে নেই। শাস্ত্রের দোহাই দেবেন তিনি? আগে যেভাবে বলেছেন, সেভাবে বলবেন? বলবেন,
ক্ষত্রিয় ছাড়া অস্ত্রশিক্ষার বিধি নেই? এটাই শাস্ত্রনিয়ম। কিন্তু শাস্ত্রবিধি কি তিনি ভাঙেন নি? তিনি ব্রাহ্মণ হয়েও যজনযাজন আর শাস্ত্রপাঠ ত্যাগ করে অস্ত্রবিদ্ হন নি? খোঁড়া যুক্তি দিয়ে কর্ণের মুখ বন্ধ করা যাবে না আজ।
এই সময় কর্ণ আবার কথা বলে উঠল, ‘একলব্যের দুর্গতির কথা আমি মিত্র দুর্যোধনের কাছে শুনেছি।’
পরশুরামের মাহেন্দ্র বিদ্যালয় থেকে অভিশপ্ত কর্ণ ফিরে কুরুরাজপ্রাসাদে আশ্রয় নেয়। মিত্র দুর্যোধনকে তার আগমনবার্তা চেপে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বলে, ‘উপযুক্ত সময়ে আমি নিজের উপস্থিতি জানান দেব।’ সেই সময় গোটা রাজপ্রাসাদ জুড়ে, শুধু রাজপ্রাসাদ কেন, গোটা রাজধানী জুড়ে অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীর তোড়জোড় চলছিল। ‘ক’দিন তোমার নিকটে থাকতে দাও মিত্র।’ বলে কথা শেষ করেছিল কৰ্ণ।
দুর্যোধনের সাহচর্যে থাকার সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব তথ্য জেনে নিয়েছিল কৰ্ণ।
অর্জুনের মৃন্ময়পক্ষীর গলাকর্তন, যুধিষ্ঠির-দুর্যোধনাদিকে পরীক্ষা ছাড়া অকৃতকার্য ঘোষণা করা আর একলব্য-বিষয়ক ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দুর্যোধনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল কর্ণ। মোক্ষম সময়ে সেই তথ্যকে কাজে লাগাল সে। বলল, ‘আমি কিন্তু এখনো আমার উত্তর পাই নি গুরুদেব। রাজপুত্র হয়েও কেন একলব্য আপনার শিষ্য হওয়ার অনুমতি পেল না?’
‘আমার উত্তর তোমাকে অনেক আগেই দিয়েছি। যেদিন তুমি ব্রহ্মাস্ত্র করায়ত্ত করবার জন্য আমার কাছে গিয়েছিলে, সেদিনের উত্তরই আমার আজকের উত্তর।’ মৃদুকণ্ঠে বললেন আচার্য।
‘অর্থাৎ আপনি উচ্চবর্ণের গুরু। নিচুদের নন। বেছে বেছে উঁচুজাতের ধনাঢ্য সন্তানদের আপনি অস্ত্রশিক্ষা দেবেন। কর্ণ আর একলব্যের মতো তথাকথিত হীনজাতের মানুষরা আপনার কৃপা থেকে বঞ্চিত হবে, এই তো বলতে চাইছেন আপনি?’ কর্ণের সারা মুখে উপহাসের হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
দ্রোণাচার্য দেখলেন—এই বিতণ্ডায় রঙ্গভূমি ঔজ্জ্বল্য হারাতে বসেছে। সমবেত মানুষরা গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। কর্ণকে আর সুযোগ দিলে তাঁর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কর্ণকে থামানো দরকার।
কর্ণকে উদ্দেশ করে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘তোমার যদি আর কিছু বলার থাকে আমি শুনব। তবে এই রঙ্গভূমিতে নয়, একান্তে। এখন অর্জুনকে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দাও।’
‘তা হবে না গুরুদেব। অর্জুনকে আমি সেই সুযোগ দেব না। এই রঙ্গভূমিতে প্রমাণ করব, আমি অর্জুনের চেয়ে কোনো অংশে কম নই, বরং বাড়া।’ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল কর্ণ।
ওই দিকে রঙ্গভূমির মানুষরা উত্তাল হয়ে উঠলেন। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ উঠল, ‘আমাদের ধৈর্য শেষ। প্রদর্শনীর কাজ শুরু করুন গুরুদেব।’
কৌতূহলী জনতার চিৎকার শুনে দ্রোণ কর্ণকে অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন। এরপর অর্জুন অস্ত্র নিক্ষেপণ আর সংবরণের যতরকম কৌশল দেখাল, তার প্রত্যেকটি অতি দক্ষতার সঙ্গে করে দেখাল কর্ণ। এতক্ষণ একতরফাভাবে রঙ্গমঞ্চে শুধু অর্জুনেরই প্রশংসা চলছিল, সেই প্রশংসার সিংহভাগ চলে গেল কর্ণের দিকে।
কর্ণের বাণমুখর অন্ত্রকুশলতা দেখে দুর্যোধন-দুঃশাসনাদি শতভাই অতিশয় উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তারা কর্ণের নিকটে এগিয়ে এল।
সাভিনন্দনে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে দুর্যোধন বলল, ‘অর্জুনকে লা-জবাব করে দিয়েছ মিত্র। উচিত শিক্ষা দিয়েছ তাকে। তার গরিমা বড় বেড়ে গিয়েছিল, শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মাটিতে পা পড়ছিল না তার। তুমি অজস্র মানুষের সামনে তার দর্প ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিলে। আমাদের ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আমার সকল ভাইয়ের যেমন, তেমনি তোমারও আজ থেকে কুরুরাজ্যের সমস্ত ভোগ্যদ্রব্যের ওপর অধিকার বর্তাল।’
বিচক্ষণ কর্ণ দ্রুত বলে উঠল, ‘ওসবের কিছু চাই না আমি মিত্র। আমি শুধু তোমার বন্ধুত্বের প্রত্যাশী। আর অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই আমি।’
কর্ণের কথা শুনে শতভাই তাকে ঘিরে ধরে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল। অর্জুন বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। সমস্ত মাঠ কর্ণের পক্ষে জয়ধ্বনি দিচ্ছে তখন।
কর্ণ অর্জুনের দিকে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ চোখে ঘৃণা ছড়িয়ে বলল, ‘তোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই আমি। তোর গুরুর সামনেই যুদ্ধ করব, ওঁর সামনেই তোর মাথা কেটে মাটিতে নামাব আমি।’
সমস্ত রঙ্গভূমিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ভীষ্ম উদ্বেগাকুল হয়ে উঠলেন। উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ল কুন্তীর সমস্ত মুখে। ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারী ঘনঘন প্রশ্ন করে পরিস্থিতি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
বিদুর দেখলেন—পরিবেশ-পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। পাশে বসা কৃপাচার্যের দিকে ইংগিতময় চোখে তাকালেন তিনি। কৃপাচার্য যা বোঝার বুঝে গেলেন। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চিৎকার করে বললেন, ‘থামো তুমি কর্ণ। তোমার উল্লম্ফন থামাও।’
একটা ঢোঁক গিললেন কৃপাচার্য। তারপর সেই চরম অপমানজনক শব্দটি উচ্চারণ করলেন, ‘যুদ্ধের আগে নিজের গোত্রপ্রবরের কথা জানাতে হয়। অর্জুন রাজপুত্র। কর্ণ, তুমি কোন বংশের ছেলে বলো। তোমার জন্মপরিচয় জেনে অর্জুন তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে।’
আবার সেই জন্মযাতনা। এই জন্মপরিচয় তাকে যমদূতের মতো আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, এই জন্মপরিচয় তার জীবন্নোয়নের পথে বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল কিছু থাকা সত্ত্বেও শুধু জন্ম-হীনতার কারণে দ্রোণাচার্য তাকে মর্যাদা দেন নি। আচার্য পরশুরাম তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। এই সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আজ যখন নিজেকে প্রমাণিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সে, ঠিক তখনই আবার জন্মগোত্র পরিচয়ের কথাটি উচ্চারণ করলেন প্রথমগুরু কৃপাচার্য।
কৃপাচার্যকে অনেক উঁচুদরের মানুষ বলে জানত কর্ণ। সৎ, মননশীল, যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে আজীবন সে কৃপাচার্যকে সম্মান করে এসেছে। আজ সেই মানুষটি তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রয়াস পাচ্ছেন। গোত্রপরিচয় দিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে এমন কথা কোনো শাস্ত্রে লিখা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে কত জাতের মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এই প্রমাণ তো ‘রামায়ণ’ থেকে আরম্ভ করে বহু সমরগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। এই কথা আচার্য কৃপের না জানার কথা নয়। জানেন তিনি। জেনেও তিনি রাজাদের পক্ষ নিলেন।
এতক্ষণ দ্রোণাচার্যের সঙ্গে বাকযুদ্ধ করতে করতে দম ফুরিয়ে এসেছে কর্ণের। এই মুহূর্তে কৃপাচার্যের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধাচরণ করতে তার আর ইচ্ছে করল না। মহতের হীনাচরণের প্রতিবাদ করল না কর্ণ। এত বড় বীর যে কর্ণ, মুহূর্তে চুপ মেরে গেল। কূপের কথা শুনে প্রতিস্পর্ধী কর্ণের মুখটি লজ্জায় অবনত হয়ে গেল।
কৃপাচার্যের নিকটে দুর্যোধন এগিয়ে গেল। বলল, ‘আচার্য, রাজা তিন রকমের হয় – যিনি সকুলে জন্মেছেন, যিনি বীর এবং যিনি সৈন্যপরিচালনা করতে পারেন। এই মূহূর্তে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিলাম। এখন তো অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে কর্ণের আর কোনো বাধা নেই?’
কর্ণ অভিভূত। দ্রুত দুর্যোধনের নিকট এগিয়ে গেল সে। জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল, ‘এত বড় উপহারের বিনিময়ে আমি তোমাকে কী দেব মিত্র?
‘কিছুই না। শুধু আলিঙ্গন আর বন্ধুত্ব।’ নিবিড় গলায় বলল দুর্যোধন।
পাণ্ডববিরোধী দুই মহাবীর পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করল।
এই সময় ভীম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘ওরে সারথির বেটা কর্ণ। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছিস তুই? তুই কী যুদ্ধ করবি রে বেটা। অঙ্গরাজ্যের রাজা হওয়ার কী যোগ্যতা আছে তোর? তোর হাতে কি রাজদণ্ড শোভা পায়? তোর হাতে তো শোভা পাবে ঘোড়ার লাগাম। ওই তো দূরে একটা রথ দেখা যাচ্ছে। তুই এক কাজ কর। শিগগির ওই রথে লাফিয়ে ওঠ। রথটা চালিয়ে বরং রঙ্গভূমির মানুষদের দেখা। জন্মের নেই যার ঠিক, সে চায় রাজপুত্র অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে! ফুঃ।’
কর্ণ মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। কিন্তু দুর্যোধন ছাড়বার পাত্র নয়। সরোষে সে বলে উঠল, ‘ভীম, মূর্খের মতো প্রলাপ বকছ কেন? আমার তো জানা ছিল… শারীরিক শক্তির সঙ্গে তোমার কিছু জ্ঞানগম্যিও আছে। এখন দেখছি, দৈহিক মেদ তোমার মেধার বিকাশ ঘটতে দেয় নি।’
‘চুপ থাকো তুমি দুর্যোধন। অর্বাচীনের মতো মাঝখানে কথা বলতে এসো না।’ তীব্র কণ্ঠে বলল ভীম।
হো হো করে হেসে উঠল দুর্যোধন। শ্লেষ মিশানো গলায় বলল, ‘একজন মানুষের শক্তিই সবকিছু। কর্ণ একজন শক্তিমান বীর। বলবান পুরুষ আর নদীর উৎস খুঁজতে যেয়ো না। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। তুমি কর্ণের জন্মঠিকানা জানতে চাইছ, না? বলি তোমাকে বিশ্বামিত্র, গুরুদেব দ্রোণ, আচার্য কৃপ—এঁদের জন্মবিন্দুর রহস্য জানো? আর শোনো ভীম, তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের জন্ম কীভাবে হয়েছে তুমি জানো?’
এই সময় কর্ণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘থাক মিত্র থাক। ওভাবে বলতে নেই। ভীম উন্মাদের মতো আচরণ করছে বলে তুমি করতে যাবে কেন?’
‘তুমি থামো মিত্র। আমাকে বলতে দাও।’ তার পর ভীমের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গকণ্ঠে বলল, ‘আমি জানি তোমাদের জন্মরহস্য।’
দ্রুত এগিয়ে এসে কর্ণ দুর্যোধনের মুখে হাত চাপা দিল। বলল, ‘নারীর অপমান কোরো না তুমি মিত্র। আমার মা আছেন, তোমারও। তোমার কথায় পাণ্ডবদের মা’দের অপমান হচ্ছে। তোমায় মিনতি করছি, জননীদের অপমান কোরো না।
দুর্যোধন ক্রোধ সংবরণ করল। শান্তস্বরে বলল, ‘কর্ণের দিকে চেয়ে দেখো ভীম। সোনার বর্ম আর কুণ্ডল জন্ম থেকে ওর গায়ে আঁটা। সূর্যের মতো উজ্জ্বল গায়ের রং কর্ণের। এই রকম মানুষের জন্ম কি নীচুকুলে হতে পারে? হরিণের পেটে কি বাঘ জন্মায়? এই সসাগরা পৃথিবীর রাজা হওয়ার যোগ্যতা রাখে কর্ণ। আর হ্যাঁ, অর্জুনকে বলছি—কোরো না যুদ্ধ কর্ণের সঙ্গে। তোমার বাহুতে কী ক্ষমতা আছে দেখিয়ে দাও না।’
দুর্যোধনের কথা শুনে অর্জুন যুদ্ধের জন্য এগিয়ে এল। কর্ণ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। একা দূরে দাঁড়িয়ে দ্রোণাচার্য অসহায় দৃষ্টিতে প্রস্তুতয়মান দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দর্শকদের মধ্যে হাহাকার উঠল। ধীরে ধীরে বাদ্যিবাজনা বেজে উঠল।
ওই সময় টুপ করে সূর্য অস্ত গেল। সূর্যাস্ত হলে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। যুদ্ধ আর হলো না। অর্জুন আর কর্ণ—উভয়ে বুকে ক্রোধের জ্বালা নিয়ে যার যার আলয়ে প্রস্থান করতে উদ্যোগী হলো।
যাওয়ার আগে কর্ণ দ্রোণাচার্যকে উদ্দেশ করে বলল, ‘হীনবংশজাত বলে যাদের আজ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, এমন একদিন আসবে, এই হীনজাতের মানুষরাই পৃথিবী শাসন করবে। আর আপনারা হবেন এই হীনজাতির করুণাপ্রার্থী।’ বলে দুর্যোধনের হাত ধরে হনহন করে হাঁটা দিল কর্ণ।
নির্বাক দ্রোণাচার্য তাদের গমনপথের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।