১২
অর্জুনেনৈবমুক্তন্তু দ্রোণ হৃষ্টতনূরুহঃ।
অর্জুন যখন উত্তর দিল, তখন দ্রোণাচার্যের শরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হলো।
.
দিন সপ্তাহ মাস করে করে বছর অতিক্রান্ত হলো।
একটি বছরের পর আরেকটি বছর গেল। এইভাবে এক-দুই-তিন করে করে অনেকটা বছর অতীতের দিকে সরে গেল। দ্রোণাচার্যের প্রশিক্ষণ শেষ হলো। বহির্দেশাগত ছাত্ররা অস্ত্রবিদ্যা গ্রহণান্তে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেল। কৌরব আর পাণ্ডবরা অস্ত্রচালনায় যথেষ্ট পারঙ্গম হলো। ওরা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে নি। কৃপাচার্য তাদের প্রাথমিক ভিত্তি পূর্বেই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। ফলে দ্রোণাচার্যকে তেমন বেগ পেতে হয় নি। প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে এসেছিল বলে সহজেই কৌরব-পাণ্ডবরা উন্নত অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করতে পেরেছিল। দ্রোণাচার্যের কাছেই তারা অস্ত্রনীতি ও এর চূড়ান্ত প্রয়োগকুশলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেল। অর্জুন আর অশ্বত্থামার মতো বীরেরা ধনুর্বিদ্যায় দক্ষ হয়ে উঠল। ভীম আর দুর্যোধনের আগ্রহ গদার প্রতি। আচার্যের প্রশিক্ষণে এই দুজন গদাযুদ্ধে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠল।
এইভাবে কুরুপ্রাসাদের রাজকুমারদের কেউ অসি যুদ্ধে, কেউবা রথযুদ্ধে, কেউ হস্তিযুদ্ধে, কেউবা গুপ্ত অস্ত্র ব্যবহারে নিপুণতা অর্জন করল। আচার্য দেখলেন—কৌরব- পাণ্ডব শিষ্যদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুশিক্ষিত হয়ে উঠেছে। অস্ত্রবিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠার পর দ্রোণাচার্য সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজপরিবারের লোকদের সামনে রাজকুমাররা তাদের অর্জিত অস্ত্রবিদ্যার নমুনা প্রদর্শন করবে। কিন্তু তারও আগে কুমারদের একটা প্রাথমিক পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। লোকসমক্ষে দেখানোর পূর্বে তাঁর তো জানা কর্তব্য যে, ছাত্ররা এতদিন তাঁর অধীনে কী শিখল।
রাজকুমারদের উদ্দেশে আচার্য বললেন, ‘আগামী পরশু তোমাদের অর্জিত অস্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রস্তুত থেকো সবাই।’
এরপর রাজকুমারদের চোখ এড়িয়ে তিনি বাজারে গেলেন। একে তাকে জিজ্ঞেস করে একজন মৃৎশিল্পীকে খুঁজে বের করলেন। শিল্পীকে বললেন, ‘কালকে বিকেলের মধ্যে আমার একটা পক্ষী দরকার। তুমি মাটি দিয়ে মনোহর একটা পক্ষী তৈরি করবে এবং লোকচক্ষু বাঁচিয়ে আমার আশ্রমে পৌঁছে দেবে।’
যথাসময়ে শিল্পী মৃন্ময়পাখিটি দ্রোণাচার্যের কাছে পৌঁছে দিল। অরণ্যমধ্যের একটা উচ্চচূড় বৃক্ষের শাখায় অতিগোপনে পাখিটি স্থাপন করে রাখলেন আচার্য।
পরদিন সকালে সশিষ্য ওই বৃক্ষতলে উপস্থিত হলেন দ্রোণ। ছাত্ররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল। একে একে সবার মুখের ওপর দৃষ্টি ফেললেন গুরুদেব। বললেন, ‘আজ তোমাদের লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা। লক্ষ্যভেদের জন্য তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হও তোমরা।’
প্রথমেই তিনি তাকালেন যুধিষ্ঠিরের দিকে। এই শিষ্যটিকে বিশেষ স্নেহের নজরে দেখেন তিনি। শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির যুধিষ্ঠির। মানববোধের প্রতি তার গভীর টান। কঠিন সংকটেও মিথ্যে বলে না। সত্যের প্রতি তার একান্ত অনুরাগ। তাকেই প্রথমে নিকটে ডাকলেন আচার্য। সমরক্ষেত্রে যোদ্ধারা শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে না, অস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের স্থৈর্য। যার মানসিক দৃঢ়তা যত প্রবল, সে-ই যুদ্ধক্ষেত্রে সবিশেষ পারঙ্গমতা দেখাতে পারে। তাই যুধিষ্ঠিরের অস্ত্রদক্ষতার পূর্বে নিষ্ঠার একাগ্রতার পরীক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
শরক্ষেপণের আদেশ দেওয়ার আগে দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎস যুধিষ্ঠির, বৃক্ষশাখায় তুমি পাখিটি দেখতে পাচ্ছ তো?’
যুধিষ্ঠির সহজকণ্ঠে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ আচার্য, দেখতে পাচ্ছি।’
আচার্য বললেন, ‘তুমি কি ওই গাছটাকে, তাকে জড়ানো লতাগুল্মগুলোকে, বৃক্ষে শোভিত ফলগুলোকেও দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, গুরুদেব, দেখতে পাচ্ছি।’
‘আর কী কী দেখতে পাচ্ছ তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন আচার্য।
‘আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি, সবাইকে দেখতে পাচ্ছি।’
‘সবাই মানে!’
‘এই আপনি। ভীম, অর্জুন, সহদেব, নকুল। দুর্যোধন এবং তার নিরানব্বইজন ভ্রাতা সবাইকে দেখতে পাচ্ছি।’
‘আর অশ্বত্থামাকে দেখতে পাচ্ছ না?’
লজ্জার হাসি হাসল যুধিষ্ঠির। বলল, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে গুরুদেব। গুরুভ্রাতা অশ্বত্থামাকে স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি।’ নিকটে দণ্ডায়মান অশ্বত্থামার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে কথা শেষ করল যুধিষ্ঠির।
ব্যাখ্যাতীত একধরনের হাসি আচার্যের চোখেমুখে ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। কী যেন বলতে চাইলেন তিনি, বললেন না। যুধিষ্ঠির যে তাঁর প্রিয় শিষ্য!
জনসমক্ষে তাকে ছোট করতে চান না গুরুদেব। লক্ষ্যভেদে প্রয়োজন স্থির মানসিকতা। প্রয়োজন একাগ্রতা। যার একাগ্রতা নেই, সে কখনো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। লক্ষ্যভেদ করতে এসে যুধিষ্ঠির মৃৎপক্ষীটি ছাড়াও চারপাশের সবাইকে, সবকিছুকে দেখতে পাচ্ছে। অর্থাৎ সে অনন্যমনা নয়। লক্ষ্যভেদে যুধিষ্ঠিরের ব্যর্থতা অনিবার্য।
দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে আর শরক্ষেপণ করালেন না। বললেন, ‘তুমি যাও যুধিষ্ঠির। তোমার লক্ষ্যভেদের প্রয়োজন নেই। সারিতে গিয়ে দাঁড়াও।’
যুধিষ্ঠির নীরবে অন্যান্যদের নিকটে গিয়ে দাঁড়াল।
শুধু লক্ষ্য মাথায় রেখে অধ্যবসায় করে গেলে লক্ষ্য করতলগত হবেই। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে চাই একাগ্রতা। সেই একাগ্রতা যুধিষ্ঠিরের মধ্যে নেই। যেমন নেই অর্জুন ছাড়া অন্যান্য ভাইদের মধ্যেও, এমনকি অশ্বত্থামার মধ্যেও।
কৌরব-পাণ্ডব সকল ভাই যুধিষ্ঠিরকে সর্বাধিক জ্ঞানবান মনে করত। এই গুণী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাটিকে সবাই মনে মনে আদর্শ মানত। তাই যখন গুরুদেব একে একে ভীম- নকুল-সহদেব এবং শত ভ্রাতাকে ডাকলেন, যুধিষ্ঠিরের দেখাদেখি সবাই একই কথা বলল। অশ্বত্থামাও তা-ই বলল। দ্রোণাচার্য কারও উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না। প্রত্যেককে বললেন, ‘তোমার দ্বারা লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব হবে না।’
এরপর সমবেত শিষ্যদের উদ্দেশে বললেন, ‘অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, অন্যের দেখাদেখি কাজ করলে চলে না। অভীষ্ট সাধনে প্রয়োজন স্বতন্ত্র স্বাধীন চিন্তা। তোমাদের কারও স্বাধীন চিন্তা নেই।’
তারপর আচার্য চোখ ফেরালেন অর্জুনের দিকে। বললেন, ‘আমার সকল প্রচেষ্টা সকল প্রশিক্ষণ ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে। অর্জুন তুমি বলো এই বৃক্ষশাখায় কী দেখতে পাচ্ছ?’
অর্জুন দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘শুধু পাখিটির মাথাটিই দেখতে পাচ্ছি আমি। ওই মাথাটিই তো কেটে নামাতে হবে আমায়?’
আচার্য অর্জনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাখির মাথা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছ না তুমি?’
‘না, গুরুদেব।’
‘তোমার আশপাশে এত মানুষজন! অরণ্যের এত বৃক্ষলতা! বিশাল এই গাছটির এত শাখা-প্রশাখা, পত্রপল্লব! পাখিটি ছাড়া আর কিছুই দেখছ না তুমি?’
‘গোটা পাখি নয় আচার্য, শুধু পাখিটির মাথাটিই দেখতে পাচ্ছি।’
তৃপ্তির হাসি হাসলেন দ্রোণাচার্য। ভাবলেন, এইজন্যই তো অর্জুন। যেখানে অপরাপর শিষ্যরা আশপাশের সবকিছু দেখছে, সেখানে পাখিটির মস্তক ছাড়া অন্যকিছু অর্জুনের নজরে পড়ছে না। লক্ষ্যনিষ্ঠ ছাত্রের এই তো প্রধান বৈশিষ্ট্য। আপন স্বাতন্ত্র্যে অর্জুন উত্তর দিয়েছে। এই স্বাতন্ত্র্য মহাবীরের বিশেষত্ব।
নিরলস পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং একাগ্র ভাবনার ফলে অর্জুনের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে। ভাবতে ভাবতে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন আচার্য। অর্জুনের অসাধারণ উত্তর শুনে অদ্ভুত এক আনন্দে তাঁর সমস্ত দেহ, স্নায়ুতন্ত্র ভেসে যেতে লাগল। পরম মমতাভরা কণ্ঠে অর্জনকে কাছে ডাকলেন তিনি। গাঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘পাখিটির মস্তক বিচ্ছিন্ন করে বৃক্ষশাখা থেকে নামিয়ে আনো বস।’
অর্জুন একাগ্রমনে কৃত্রিম পাখিটির ঘাড় লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করল। পক্ষীটির দেহবিচ্ছিন্ন শির দ্রোণাচার্যের পদতলে লুটিয়ে পড়ল।
আচার্য ভীষণ রোমাঞ্চিত হলেন। তাঁর দ্বিতীয়বার অদ্ভুতানন্দের অন্যতর একটা কারণ আছে। তিনি লক্ষ্যপূরণের দিকে এগোচ্ছেন। পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে অপমান- প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন একদা। এই লক্ষ্যের ওপর দৃষ্টি রেখেই পাণ্ডব- কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা দান করেছেন তিনি। এই প্রশিক্ষিত শিষ্যদের দিয়ে দ্রুপদকে পরাজিত করে তিনি রাজ্য লাভ করবেন। তিনি স্বয়ং যুদ্ধে অংশ নেবেন না। ছাত্ররাই যুদ্ধ করবে দ্রুপদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে যে জয়ের মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে, সে এই অর্জুন। জয়ের আগাম আনন্দে দ্রোণাচার্যের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। অর্জুনকে বুকের কাছে টেনে উচ্চস্বরে আচার্য বললেন, ‘বৎস, এই জগতে তোমার মতো ধনুর্ধর দ্বিতীয় কেউ হবে না।’
কৌরব-পাণ্ডবদের ব্যক্তিগত শিক্ষা এবং পরীক্ষা শেষ হলো। দ্রোণাচার্য তাঁর অস্ত্রাশ্রম পরিত্যাগ করলেন। সশিষ্য উপস্থিত হলেন রাজপ্রাসাদে। রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে জরুরি সভা আহ্বান করার জন্য অনুরোধ করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের আহ্বানে সভায় উপস্থিত হলেন পিতামহ ভীষ্ম, বিদুর, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, কৃপাচার্য প্রমুখরা।
সবাইকে সাদর সম্ভাষণ করে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘একদা আমার হাতে এই প্রাসাদের রাজকুমারদের অস্ত্রবিদ্যা শেখানোর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল।’
কৃতজ্ঞচিত্তে ভীষ্মের দিকে একপলক তাকালেন আচার্য। এই ভীষ্মই তাঁকে গুরু হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ‘আপনাদের রাজপুত্ররা তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। কী শিখেছে তারা আমার কাছে? জানার জন্য সবার ইচ্ছা জাগতে পারে। অনুমতি পেলে, ওরা আপনাদের সামনে অস্ত্র প্রয়োগ কৌশল প্রদর্শন করবে।
দ্রোণের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র সবিশেষ আনন্দিত হলেন। একসময় এই বাড়ির ছেলেরা খেলাধুলা আর হইহল্লায় ভীষণ মেতে উঠেছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। কৃপাচার্যের বিধিনিষেধকে তেমন করে আমল দিচ্ছিল না তারা। দ্রোণাচার্যই তাদের নিয়ম আর শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছেন। আর এখন বলছেন, ওদের অস্ত্রচালনাশিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে একেবারে উচ্ছন্নে যায় নি রাজকুমাররা?
ধৃতরাষ্ট্র সোল্লাসে বলে উঠলেন, ‘আচার্য, আপনি তো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। ধন্য আপনি। অস্ত্রকুশলতা প্রদর্শনের জন্য যা কিছু করা দরকার, আপনি করুন। সকল প্রকার স্বাধীনতা আপনাকে দেওয়া হলো।’
তারপর জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র আন্দাজে সভাসদদের দিকে মুখ ঘোরালেন। তাঁদের সমর্থন আদায়ের জন্য বললেন, ‘আপনাদের অভিমত কী?’
‘সাধু, সাধু। যথার্থ বলেছেন মহারাজ।’ বলে উঠলেন সবাই।
এরপর দ্রোণাচার্যকে লক্ষ্য করে আবেগায়িত কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘আপনি যে স্থানে, যে সময়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চান, করুন। আমি অন্ধ। রাজকুমারদের অস্ত্রকুশলতা দেখতে বড় ইচ্ছে করছে আমার। চক্ষুষ্মানদের মতো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে বড় বাসনা জাগছে মনে।’
নিজের অসংযত আবেগকে সংযত করলেন ধৃতরাষ্ট্র। বললেন, ‘বিদুর এই কাজে আপনাকে সাহায্য করবে।’ তারপর বিদুরকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ভাই, অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীমঞ্চ তৈরি করতে যা অর্থের প্রয়োজন হবে, তা কোষাগার থেকে নিয়ে যাও।’
অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীর জন্য গাছপালাহীন বিশাল সমতলভূমির দরকার। বিদুরকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে সেই ভূমি নির্বাচন করলেন দ্রোণ। একদিকে রাজা-রাজন্যদের বসবার মঞ্চ তৈরি করালেন। রাজবাড়ির নারীদের জন্য দর্শনগৃহ নির্মাণের আদেশ দিলেন নির্মাণশিল্পীদের। হস্তিনাপুরের ধনশালী জনপদবাসীরা সেই মাঠের একদিকে নিজেদের খরচে উঁচু উঁচু মঞ্চ তৈরি করলেন।
জনপদবাসীরা ভবিষ্যতের রাজাদের অস্ত্রপ্রয়োগ কুশলতা দেখার জন্য নির্ধারিত দিনে দলে দলে এসে সেই মঞ্চে অবস্থান নিল। পালকি করে ঘরের বউ-ঝিরাও এল। অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনীর নির্ধারিত দিন উপস্থিত হলো। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী-
অমাত্যসহ মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন।
এলেন পিতামহ ভীষ্ম আর এলেন প্রথমগুরু কৃপাচার্য। কুরুকুলের রাজরানি গান্ধারীও নির্ধারিত আসনে এসে বসলেন। মাতা কুন্তী ও অন্যান্য নারীরা তাঁর তিনপাশে আসন গ্রহণ করলেন।
রঙ্গভূমিতে পুত্র অশ্বত্থামাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। তাঁর সাদা চুল, শুভ্র দাড়ি। পরিধেয় বস্ত্রও শ্বেতশুভ্র। তাঁর কাঁধ ছাড়িয়ে নামা শুভ্র যজ্ঞোপবীতখানি ভিন্ন এক অনুপম মাত্রা এনে দিয়েছে দর্শকদের চোখে।
তারপর রাজকুমাররা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করল। ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র আর পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র পাশাপাশি দাঁড়ালেও প্রকৃতপক্ষে কুরুবাড়ির রাজকুমাররা দ্বিধাবিভক্ত। মানসিকভাবে পরস্পরবিরোধী। একদিকে পঞ্চপাণ্ডব, অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র। পাণ্ডবদের নেতৃত্বে ধনুর্ধর অর্জুন, আর শতভ্রাতার পুরোধা দুর্যোধন।
সবচেয়ে বেশি রেষারেষি ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে। উভয়েই গদাধর। গদাযুদ্ধে উভয়েই সবিশেষ পারঙ্গম। ধনুর্বিদ্যা প্রদর্শনের জন্য প্রতিপক্ষের প্রয়োজন নেই। কিন্তু গদাদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রয়োজন।
অস্ত্রদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য ভীম আর দুর্যোধন মুখোমুখি দাঁড়াল।
কিন্তু তার আগে যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, দুঃশাসনসহ অন্যান্য কুরুপুত্রদের নিজ নিজ পারঙ্গমতা দেখানোর জন্য দ্রোণাচার্য নির্দেশ দিলেন।
অল্পসময়ের মধ্যে রঙ্গভূমি অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মুখরিত হয়ে উঠল। ধনুর টঙ্কারে, অসির ঘর্ষণে, বল্লমের শব্দে, গতিমান বর্শার শাঁ শাঁ ধ্বনিতে গোটা রঙ্গভূমি ভীষণাকার একটা যুদ্ধভূমিতে পরিণত হলো। করতালিতে আর বাহবা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল।
এল ভীম-দুর্যোধনের পালা। উভয়ের হাতে গদা। দুটি গদাই লৌহনির্মিত। ভীমের গদার হাতল বড়। গদার মাথাটি ক্রমশ বড় হয়ে বর্তুলাকার হয়েছে। সেই বর্তুল আকারের চারদিকে বৃত্তাকারে কয়েক সারি ছুঁচালো লৌহদণ্ড। দুর্যোধনের গদার হাতল ছোট। গদার আকারও ভীমের গদার চেয়ে ছোট। গদা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ক্ষিপ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দুর্যোধনের বাড়া নেই।
উভয়ের বাম হাতে ঢাল। দুর্যোধনের ঢাল ভীমের ঢালের চেয়েও বড়। নানা রকমের নকশা আঁকা দুর্যোধনের ঢালে। ভীমের ঢাল সাদামাটা। দুর্যোধন কাঁসার তৈরি বর্ম পরিধান করেছে। ভীমের ওসবে তোয়াক্কা নেই। উভয়ের মস্তকে শিরস্ত্রাণ। লৌহ আর কাঁসামিশ্রিত ধাতুতে তৈরি এই শিরস্ত্রাণ প্রতিপক্ষের গদার আঘাত থেকে মস্তককে বাঁচাবে। ভীম আর দুর্যোধনের পায়ে পদত্রাণ।
উভয়ে প্রস্তুত হয়ে গুরু দ্রোণের ইশারার জন্য অপেক্ষা করছে। অঙ্গুলি নির্দেশ পেলেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে তারা।
এই সময় ধুন্ধুমার শব্দে রণবাদ্য বেজে উঠল। করতাল, কর্ণাল, কাড়া, খঞ্জনি, খমক, ঘণ্টা, জগঝম্প, জয়ডাক, ঝাঁঝরি, দগড়, দুন্দভি, ঢোল, শঙ্খ আর শিঙ্গার শব্দে চতুর্দিক উচ্চকিত হয়ে উঠল।
দ্রোণাচার্য ডান হাত দিয়ে বাতাসে তরঙ্গ তুলে গদাযুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দিলেন। গদাদ্বন্দ্ব শুরু হলো। উভয়ের গদার ঘর্ষণে ঘর্ষণে বিকট শব্দের জন্ম হলো।
বিদুৎ ঝলসিত হতে লাগল উভয়ের গদা থেকে। এই দুর্যোধনের গদাক্রমণ থেকে ঢাল দিয়ে নিজেকে রক্ষা করছে ভীম, পলকে ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধন ভূপতিত হচ্ছে। আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের রণকৌশলে সমবেত দর্শকমণ্ডলী মুহূর্তে মুহূর্তে চমকিত হচ্ছে।
হঠাৎ দ্রোণাচার্য লক্ষ করলেন, দুর্যোধন গদাযুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে ভীমের ঊরুতে গদাঘাত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ভীমও চক্ষু রোষষায়িত করে দুর্যোধনের আক্রমণের প্রত্যুত্তর দিতে চাইছে। বিচক্ষণ গুরুদেব মুহূর্তেই বুঝে গেলেন, উভয়ের মধ্যে ক্রোধ ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। এদের এই মুহূর্তে থামিয়ে না দিলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা।
আচার্য তাঁর শঙ্খে ফুঁ দিলেন। শঙ্খধ্বনি শুনে উভয়ে গদাযুদ্ধ থামাল। পরস্পর পরস্পরের দিকে অগ্নিঝরা চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর পেছনে ফিরে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল।
সর্বশেষে অস্ত্রগুরু অর্জুনকে রঙ্গভূমিতে আহ্বান জানালেন। অর্জুন অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীর শেষ-চমৎকার। অর্জুন দ্রোণাচার্যের মানসপুত্র। তার মাধ্যমে রাজা, রাজন্য আর প্রজাকুলকে তাক লাগাতে চাইলেন আচার্য। অর্জুন পরাক্রমী, সকল অস্ত্রে নিপুণ
জলদগম্ভীর কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘আমার পুত্রের চেয়েও যে আমার প্রিয়তর, ভগবান বিষ্ণুর মতো যে পরাক্রমশালী, সকল রকম অস্ত্র চালনায় যে অতিশয় দক্ষ, সেই অজুর্নকে এবার আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা আপনারা দেখুন।’
ধৃতরাষ্ট্র তাঁর আসনে নড়েচড়ে বসলেন। পাশে দণ্ডায়মান সঞ্জয়কে উদ্দেশ করে নিম্নকণ্ঠে বললেন, ‘আচার্য এসব কী বলছেন সঞ্জয়? আমার সন্তানদের মধ্যে কি কেউ অর্জুনের সমতুল্য নয়? ‘
ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিহীন। সঞ্জয় সর্বদা তাঁর পাশেপাশে থাকে। দেখার কিছু হলে সঞ্জয় দেখে। দেখে মহারাজাকে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়।
মহাধিপতি ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে সঞ্জয় অনুচ্চ কণ্ঠে জবাব দিল, ‘অর্জুনের সাজসজ্জা, দেহভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস আর গুরু দ্রোণাচার্যের আচরণ দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, অর্জুনই আচার্যের অস্ত্রপাঠশালার শ্রেষ্ঠতম ছাত্র। আপনার পুত্রদের মধ্যে অর্জুনের সমকক্ষ ধনুর্ধর কেউ নেই বলে মনে হচ্ছে। কারণ দ্রোণাচার্যের ঘোষণা শুনে আপনার সকল পুত্র অধোমুখে দাঁড়িয়ে আছে।’
সঞ্জয়ের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
অর্জুন অস্ত্রকৌশল-দক্ষতা প্রদর্শন শুরু করল। ঘনঘন করতালিতে সমস্ত রঙ্গভূমি ফেটে পড়তে লাগল। নগরবাসীরা সোল্লাসে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। এইসময় হঠাৎ কোথা থেকে কর্ণ সেই রঙ্গভূমিতে, ঠিক অর্জুনের সামনে, এসে উপস্থিত হলো। অস্ত্ররঙ্গের প্রসারিত ভূমি হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল।
কর্ণ সদর্পে বলল, ‘প্রতিদ্বন্দ্বীহীন খালি মাঠে নিজেকে সর্বোত্তম অস্ত্রকৌশলী বলে প্রতিপন্ন করছ তুমি অর্জুন। এ মিথ্যে, এ অলীক। তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ নও। এই অস্ত্রকৌশল আমার বাম হাতের খেল। তুমি যা যা দেখিয়েছ বা যা যা দেখাবে, তার সবকিছুই আমার জানা। তার সবটুকুই আমি হেলায় করে দেখাব। তুমি যে শ্রেষ্ঠতম নও তার প্রমাণ দেব আমি।’
কর্ণের দর্পিত কথা শুনে দ্রুতপায়ে নিকটে আসতে আসতে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘কী বাতুলতা করছ তুমি, কৰ্ণ?
‘কোন বাতুলতার কথা বলছেন গুরুদেব?’ জোড়হাত করে জিজ্ঞেস করল কর্ণ।
কর্ণের চোখমুখের ভাব দেখে আচার্য বুঝতে পারলেন কর্ণের জোড়হাত করার ব্যাপারটা লোকদেখানো। কর্ণের ভেতরে গুরুর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার লেশমাত্র আছে বলে মনে হলো না দ্রোণাচার্যের। ‘এই যে তুমি বলছ, অর্জুন শ্রেষ্ঠতম ধনুর্ধর নয়। এই যে তুমি বলছ, অর্জুন যা জানে, তার সবটুকু তুমি জানো!’ বললেন আচার্য।
‘ঠিকই বলেছি আমি। অর্জুন যা জানে, তার চেয়ে বিন্দুমাত্র কম জানি না আমি।’
‘তুমি শিক্ষাগ্রহণ অর্ধসমাপ্ত রেখে আমার পাঠশালা ত্যাগ করেছ। তোমার শিক্ষা পূর্ণ হয় নি।
‘আপনার হাতে আমার শিক্ষাগ্রহণ সম্পূর্ণ হয় নি সত্য। কিন্তু আমার অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ অসম্পূর্ণ থাকে নি।’ সদম্ভে বলল কর্ণ।
গোটা রঙ্গভূমি নির্বাক। উৎকর্ণ হয়ে কর্ণ-দ্রোণাচার্যের কথোপকথন শুনতে চাইছে রঙ্গভূমির প্রতিটি মানুষ।
‘কার কাছে শিখেছ তুমি?’ বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন আচার্য।
‘আপনার গুরু পরশুরামের কাছে।’ বলল কৰ্ণ।
‘গুরুদেব পরশুরামের কাছে?’ বিস্ময় বিহ্বল প্রশ্ন দ্রোণাচার্যের।
‘তোমাকে অস্ত্রশিক্ষা দিলেন তিনি? সূতপুত্রকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন গুরুদেব?’ নিম্নকণ্ঠে প্রশ্নগুলো করে গেলেন আচার্য।
এই সময় রঙ্গভূমিতে গুঞ্জন উঠল। গুঞ্জন কোলাহলে পরিণত হলো। সবাই জানতে চান কী বিষয়ে কথা হচ্ছে দ্রোণাচার্য আর কর্ণের মধ্যে। অর্জুন নির্বাক, বোঝা যাচ্ছে। কারণ সামান্য দূরে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অঙ্গভঙ্গি আর ঠোঁট নাড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে কর্ণ আর দ্রোণ বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু বিতণ্ডার বিষয় ও কারণ সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছেন না দর্শকমণ্ডলী। জনকোলাহলে কর্ণের উত্তর হারিয়ে যাচ্ছে। আচার্য স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন না কর্ণকে।
আচার্য হঠাৎ তাঁর দুটো হাত ওপর দিকে তুললেন। জনতার উদ্দেশেই হাত তুললেন তিনি। দু’হাতে একধরনের তরঙ্গ তুলে জনগণকে থামতে বললেন দ্রোণাচার্য। মুহূর্তে কোলাহল থেমে গেল।
ধীরস্থির ভীষ্মের মুখে স্মিত হাসির রেখা দেখা দিল। কর্ণ আর আচার্যের কথোপকথনের বিষয়বস্তু তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। তিনি বিচক্ষণ। অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান তাঁকে দূর-শ্রোতা করে তুলেছে। কর্ণ যে বিদ্যার্জন অসম্পূর্ণ রেখে আচার্যের অস্ত্রপাঠশালা ত্যাগ করেছিল, সে সংবাদ ভীষ্মের কাছে পৌঁছেছিল।
বিদুর একবার ভীষ্মের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রঙ্গভূমির দিকে চোখ ফেরালেন।
গান্ধারী পার্শ্ববর্তিনী কুন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জনকোলাহল হঠাৎ করে থেমে গেল কেন কুন্তী?
গান্ধারী চক্ষুষ্মতী। কিন্তু স্বতো অন্ধ। স্বামী ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। স্বামীর প্রতি আনুগত্য, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখাবার জন্য বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার দিন থেকেই দুচোখে পট্টি বেঁধেছেন গান্ধারী, বস্ত্রখণ্ড দিয়ে। দু’চোখ বেঁধে স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকে বরণ করে নিয়েছেন তিনি। চক্ষুষ্মতী হয়েও অন্ধ তিনি। তাই তিনি কুন্তীকে এরকম প্রশ্ন করলেন।
কুন্তী বললেন, ‘প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারছি না দিদি। অর্জুনের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনের মাঝখানে রঙ্গভূমিতে হঠাৎ করে কর্ণ উপস্থিত হয়েছে। নিম্নস্বরে কী যেন বলছে সে গুরুদেবকে। গুরুদেব বোধহয় কর্ণের বক্তব্যকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। গুরুদেব হঠাৎ ওপর দিকে দু’হাত তুলেছেন। এজন্য কোলাহল থেমে গেছে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না দিদি।’ শেষের দিকে তাঁর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মন বলছে—তাঁর দুইপুত্রের মধ্যে গভীর একটা সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
‘সঞ্জয় রঙ্গভূমি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল কেন? ধনুষ্টঙ্কার শুনছি না যে! গদার ঘর্ষণধ্বনি থেমে গেছে। দ্বিশূল-ত্রিশূলের শাঁ শাঁ শব্দ কোথায়? কুরুপুত্রদের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনী কি শেষ হয়ে গেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন ধৃতরাষ্ট্র।
‘না মহারাজ, প্রদর্শনী শেষ হয়ে যায় নি এখনো। অর্জুন তাঁর অস্ত্রকৌশল দেখাচ্ছিলেন। মাঝপথে কর্ণ এসে এই প্রদর্শনীতে বোধহয় বাধা দিচ্ছেন। শেষের কথাটা আমার অনুমান মহারাজ।’ সঞ্জয় ধীরে ধীরে বলল।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘বাধা দিচ্ছে? কর্ণ? তার এত বড় সাহস? কুরুপুত্রদের প্রদর্শনীতে বাধা দিচ্ছে সে?’
কণ্ঠস্বর উঁচুতেই পৌঁছে গিয়েছিল ধৃতরাষ্ট্রের। ভীষ্ম আর বিদুর তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁদের চোখে কৌতুক আর কৌতূহল।
সঞ্জয় নিতান্ত নিচুকণ্ঠে বলল, ‘দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই কর্ণ। আপনি উত্তেজিত হবেন না মহারাজ। নিশ্চয় কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে। দুর্যোধনকেও পায়ে পায়ে কর্ণার্জুন আর আচার্যের দিকে এগিয়ে যেতে দেখছি।’
ধৃতরাষ্ট্র সংযতবাক হলেন।