১
যখনি চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী,
তখনি এসেছে প্রভাত।
সকাল। উজ্জ্বল, আলোকিত।
‘বাবা, আপনি যতই নিষেধ করেন, আমি মানব না।’
চমকে উঠলেন হিরণ্যধনু। বললেন, ‘মানবে না! কেন মানবে না আমার নিষেধ!’
‘আপনার নিষেধ আমার বাসনা পূরণের অন্তরায়।’
‘বাসনা পূরণের অন্তরায়! আমার সাবধানবাণী তোমার বাসনা পূরণের অন্তরায়! তুমি এসব কী বলছ একলব্য?’ চিত্তচাঞ্চল্যে হিরণ্যধনুর কণ্ঠ বুজে এল।
পিতার কথা শুনে একটুখানিও ভড়কাল না একলব্য। কণ্ঠকে আরও দৃঢ় করে বলল, ‘পিতা পুত্রের উন্নতি চান, সর্বদা। এটাই মানববিধি। আপনি তার ব্যতিক্রম। পিতা হয়ে আপনি আমার উন্নতি চাইছেন না। উপরন্তু উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।’
হিরণ্যধনুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশাখা। বিশাখা একলব্যের মা। পুত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে বিশাখা স্তম্ভিত। বেদনাবিষাদময় চোখ দুটো বড় বড় করে বিশাখা একলব্যের উদ্দেশে কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে গর গর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না।
হিরণ্যধনু বাম হাত তুলে বিশাখাকে নিবৃত করলেন। তারপর ম্রিয়মাণ কণ্ঠে একলব্যকে বললেন, ‘তুমি ভুল বুঝেছ পুত্র। পিতা কখনো পুত্রের উন্নয়নপথের কাঁটা হয় না। আমিও তোমার সমৃদ্ধির অন্তরায় নই। তোমাকে সতর্ক করে পিতার কর্তব্য পালন করছি মাত্র।’
‘সতর্ক করছেন!’ এবার একলব্যের বিস্ময়ের পালা। ‘এমন কী বিপদের আভাস পাচ্ছেন যে, আমাকে সাবধান করতে হচ্ছে আপনাকে?’
হিরণ্যধনু বললেন, ‘তুমি ভুল করতে যাচ্ছ পুত্র। চরম ভুল করতে যাচ্ছ।’
‘একজন মহান অস্ত্রগুরুর কাছে একজন তরুণ শিক্ষা গ্রহণ করতে যেতে চাইছে। এতে ভুলের কী আছে বাবা?’
‘আছে, আছে।’ বলে নিশ্চুপ হলেন হিরণ্যধনু।
পিতা আরও কিছু বলেন কি না শুনবার জন্য অপেক্ষায় থাকল একলব্য। হিরণ্যধনু তাঁর নীরবতা ভাঙছেন না দেখে একলব্য নিচু স্বরে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভুল বাবা?’
হিরণ্যধনু যেন একলব্যের কথা শুনতে পান নি। গবাক্ষ দিয়ে দূর-পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বিশাখা স্বভাবসুলভ শান্ত স্বরে হিরণ্যধনুকে বললেন, ‘কিছু বলছ না যে! একলব্য তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছিল।’
সহধর্মিণীর দিকে কোমল চোখে তাকালেন হিরণ্যধনু। তারপর সেই চোখ ফেরালেন একলব্যের দিকে। বললেন, ‘তোমার জীবনপথে অন্তরায় সৃষ্টি করার জন্য আমি তোমাকে সতর্ক করছি না। ভুলের মাশুল গোনার আগে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি মাত্র। তুমি যেও না দ্রোণাচার্যের কাছে। তুমি ব্যর্থ হবে। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে না।’
একলব্য অস্থির গলায় দ্রুত বলে উঠল, ‘আপনি কি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন বাবা?’
এবার প্রশান্ত চোখে অনেকক্ষণ একলব্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন হিরণ্যধনু। তারপর স্নেহময় কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি আমার পুত্র, জীবনের অবলম্বন। উত্তরাধিকারীর মূলভূমি তুমি আমার। তোমার জন্য কি আমার অভিসম্পাত সাজে?’
‘তাহলে, তাহলে আমাকে বাধা দিচ্ছেন কেন বাবা?
‘বাধা দিচ্ছি–তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি বলে।’
‘কী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন? মন্দ কিছু কি?’ অস্পষ্ট শ্লেষ একলব্যের কণ্ঠে একটু করে ঝিলিক দিয়ে উঠল বুঝি।
পুত্রের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না হিরণ্যধনু। তাঁর সারা মুখে ইতস্তত ভাব। এক গভীর উদ্বেগ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। পুত্রের প্রশ্নের উত্তর দিলে রূঢ় সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এই অপ্রিয় সত্য একলব্যের হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেবে। তার চেয়ে মৌন থাকাই উত্তম। হিরণ্যধনু ভাবলেন—একলব্য নাছোড়। দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রচালনা শিখবার জন্য সে যাবেই। তার কথাবার্তা আর আচরণ বলছে—এ ব্যাপারে পিতার নিষেধ শুনতে সে রাজি নয়। সুতরাং বাধার প্রাচীরকে আর সুদৃঢ় করা উচিত হবে না।
হিরণ্যধনু ঠিক করলেন—একলব্যকে আর বাধা দেবেন না। একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে যেতে চায়, যাক। সে যুবক। তারুণ্যের অনুরণন তার শিরায় শিরায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে উদ্বেল করেছে। পিতার নিষেধ যে যথার্থ কারণে, তা খুলে বললেও একলব্য এখন বুঝবে না; বুঝতে চাইবেও না সে এই মুহূর্তে। তাই একলব্যকে দ্রোণাচার্যের কাছে যেতে দেওয়া উচিত। ঠেকে শিখুক সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন হিরণ্যধনু। তারপর বললেন, ‘তুমি প্রস্তুত হতে থাকো পুত্র। পুরোহিত ডেকে আমি তোমার যাত্রার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিচ্ছি। তুমি আচার্য দ্রোণের কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করে যথার্থ ধনুর্ধর হয়ে রাজধানীতে ফিরে এসো। রাজপ্রাসাদ প্রস্তুত থাকবে তোমাকে স্বাগত জানাবার জন্য। আমরা তোমার ফেরার দিনের অপেক্ষায় থাকব।’ স্ত্রী বিশাখার দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন হিরণ্যধনু।
পিতার কথা শুনে বিস্মিত চোখে কিছু একটা বলতে চাইল একলব্য। হিরণ্যধনু তাঁর ডান হাতটা তুলে একলব্যকে আর কিছু বলতে নিষেধ করলেন। তাঁর চোখেমুখে তখন বেদনা আর বাৎসল্যের মাখামাখি।