একলব্য নিষাদ
আমি যখন এম এ ক্লাসে পড়ি, তখন একটি মেয়ে আমাদের সঙ্গে ফার্স্ট হয়েছিল। ফার্স্ট হওয়াটা বড় কথা নয়, কেন না প্রতি বৎসরেই কেউ-না-কেউ ফার্স্ট হয়। আমাদের বারের প্রথম হওয়া ছাত্রীটির বিশেষত্ব ছিল— তাঁর অনার্স ছিল না, যদি বা থেকেও থাকে তবে একেবারেই ফেল-করা থেকে কোনও-মতে-বাঁচা নম্বর। স্বাভাবিক কারণেই এই হঠাদুদিতা ছাত্রীটির জন্য প্রচুর সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীদের মনে অনেক আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রশ্নও উঠেছিল নানা— অনার্স-লেভেলে উপযুক্ত নম্বর না-পাওয়া কোনও ছাত্র-ছাত্রী হঠাৎ করে এম এ-তে ফার্স্ট হয়ে যায় কী করে! আমি যেহেতু এই ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার দৌড়ে নগণ্য শেষ প্রাণীটি ছিলাম, অতএব সম্ভাবনাময়দের মনের ভাবনায় আরও দোলা লাগিয়ে দিয়ে বলেছিলাম— এমন তো হতেই পারে। অনার্স-লেভেলে ও হয়তো তেমন পড়াশুনো করতে পারেনি, হয়তো কোনও অসুবিধেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন ও সুযোগ পেয়েছিল, প্রচুর পড়াশুনো করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে। এর উত্তরে অতি উৎসাহী সর্বজ্ঞ ছাত্রেরা আমাকে ভেংচি কেটে বলেছিল— ওরে নারু! তোর মাথাটা চিরকালই নারকোলের মতো, এক্কেবারে ভিতরে একটু জল আছে, ওইজন্য কোনও মতে পাশ করে গিয়েছিস, এই যা। অন্যজন বলল ওরে পাঁঠা! আজকে যদি অমুক স্যার আর তমুক স্যার না থাকত, তা হলে আর ওকে ফার্স্ট হতে হত না। ওই এম এ পাশ করত এই যা।
অমুক স্যার, আর তমুক স্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম নাকি হয়। ওখানে নাকি নবম পত্র বলে একটা ব্যাপার আছে নির্ধারিত অষ্টম পত্রেরও পরে। এবং অনেকেই বলেন— নবম পত্রেরই নাব্যতা সবচেয়ে বেশি— কেন না এই পথেই অধ্যাপক-পরীক্ষকদের হাতে বিশেষ বিশেষ ছাত্র অথবা ছাত্রীর বিশেষ বিশেষ উপঢৌকন এসে পৌঁছয়, সে শুধু কথাও হতে পারে, হতে পারে মায়া-কাড়া কথাও, অথবা অন্য কিছু যাতে অতি বৃহৎ ব্যক্তিত্বও বিচলিত এবং বিমূঢ় বোধ করেন কখনও কখনও। সত্যি কথা বলতে কী, ক্ষুদ্র এবং মধ্য ব্যক্তিত্বদের এই বিচলন ঘটতে পারে— এটা কোনও অস্বাভাবিক কথা নয়। কিন্তু মহৎ এবং বৃহৎ ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে যে এই বিমূঢ় ভাব আসে, সেটা আপাতত অস্বাভাবিক লাগলেও আমরা কিন্তু জানি— তেমন ঘটনাও খুব কম ঘটে না। একবার ভাবুন সেই ধীর-গম্ভীর উদারসত্ত্ব রামচন্দ্রের কথা। সুগ্রীব-সখা তাঁকে যা বোঝালেন, তিনি তাই বুঝলেন। তাঁর কথার কোনও পূর্বাপর বিচার করলেন না, সুগ্রীব যে তাঁর কাছে দু’-একটি কথা চেপে গেছেন, সেটা তাঁর ধারণার মধ্যেও আসেনি। অথচ সুগ্রীবের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে তিনি বালি-বধ করে ফেললেন। এই ঘটনার জন্য রামচন্দ্রকে যথেষ্ট অপবাদ শুনতে হয়েছে এবং কৃত্তিবাস ওঝার মতো অমন রাম-চরণাশ্রিত পাঁচালীকারকেও বিভ্রান্ত হয়ে লিখতে হয়েছে—
কৃত্তিবাস, পণ্ডিতের হইল বিষাদ।
বালি-বধ করি রাম ঘটালে প্রমাদ॥
তবে কিনা কৃত্তিবাস যা বলেছেন, সেটা একটা ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি গোছের কথা। ভক্তির সঙ্গে কবিত্ব মিশিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বালি-বধের ব্যাপারটায় রামচন্দ্রকে ঠিক ‘সাপোর্ট’ দেওয়া গেল না। আমরা বরঞ্চ বলি— যাঁরা ভক্তিরসে শরীর-মন সম্পূর্ণ সিক্ত হয়েছেন, তাঁরা অনেক স্পষ্ট নির্দ্বন্দতায় রামচন্দ্রের সমর্থনে যুক্তি সাজিয়েছেন। চৈতন্য-ভাগবতের কবি বৃন্দাবন দাস পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন— মানুষের দিক থেকে স্তুতি-নতি, আত্মনিবেদন এবং শরণাগতি যদি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়, তবে সেই ভক্তি ভগবান পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারেন না, ভক্ত-বাৎসল্যে ধরা দিয়ে তিনি অন্যায় কাজ পর্যন্ত করে ফেলেন। প্রভু রামচন্দ্র সখিত্বের বন্ধনে সেই অন্যায়টিই করেছেন সুগ্রীবের জন্য বালি-বধ করে— চৈতন্য-ভাগবতের কবি বৃন্দাবন দাসের উক্তি-ভাষ্য—
অকর্তব্যো করে প্রভু সেবকে রাখিতে।
তার সাক্ষী বালিবধ সুগ্রীব-নিমিত্তে॥
বক্তব্য হল— এই যে স্তুতি-নতি-আত্মনিবেদন-শরণাগতি— ভক্তজনোচিত এইসব বৃত্তিগুলিতে সর্বেশ্বর ভগবৎপ্রতিম মানুষও যেখানে বশীভূত হয়ে অন্যায় করে ফেলেন, সেখানে ক্ষুদ্র, মধ্য এবং বৃহৎ-মহৎ ব্যক্তিত্বও যে তদীয় শরণাগত-ভক্ত-বাৎসল্যে অন্যায় কাজ করে ফেলবেন, তাতে আশ্চর্য কী। শুধু এই প্রেক্ষিতে মহাভারতের এই চরিত্রটি নিয়ে কত যে আমাকে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিশেষত, আজকের এই একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত ধারণায় নিষ্ণাত মানুষেরা তো স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্ন তোলেন— এ হল সেই কুখ্যাত দৃষ্টান্ত, যেখানে একটি যোগ্যতম ধনুর্ধর পুরুষকে শুধুমাত্র অন্ত্যজ-গৃহে জন্মের কারণে সারাজীবন বঞ্চিত হয়ে থাকতে হল। এই প্রশ্নও আমাকে সত্যি জর্জরিত করে যে, কেমন মানুষ এই দ্রোণাচার্য; গুরু কিংবা আচার্যস্থানীয় ব্যক্তির এ কেমনতর আচরণ, যিনি একটি সুযোগ্য ছাত্রের জীবন চিরতরে ধ্বংস করে দিলেন। আসলে প্রশ্নটা শুধুমাত্র একলব্যকে নিয়ে নয়, তিনি নিমিত্তমাত্র, এক বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিমাত্র। ভারতবর্ষের জাতি-বর্ণদীৰ্ণ সমাজের মধ্যে আরও কত মানুষ উচ্চতর বর্ণের সহায়তার অভাবে অথবা প্রতিবন্ধকতায় তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারল না, একলব্য তাদের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হয়তো। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য বুঝি এই যে, শুধু নিষাদপুত্র বলে নয়, শুধু হীনজন্ম নয়, একলব্য তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন অন্যের কারণে, নিজের কারণে নয়। নিজের কারণটা যা ছিল, সেটা তাঁর হীনতার জায়গা নয়, গর্বের জায়গা। কিন্তু সবকিছু সেইভাবে দেখতে হবে বস্তুবিচার করে, হীনজন্মের কারণে যে বঞ্চনা আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজে লাভ হয়, তার থেকে বেশি বাজে ঈর্ষা-অসূয়ার আস্পর্ধা, যখন সেই হীনজন্মা পুরুষ তথাকথিত সার্থকজন্মা পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন অথবা তাঁদের চেয়েও বড় হয়ে ওঠেন।
আমি সবচেয়ে অবাক হই— মহাভারতের কবির সুদূর প্রসারিত উদার দৃষ্টি দেখে। একলব্য নিষাদপুত্র, রাজধানীর একান্তে বনের ছায়ায় অস্ত্রচর্চা করেন। অথচ উপযুক্ত ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি উপযুক্ত গুরুর কাছে সঠিকভাবে বিদ্যালাভ করতে পারছেন না অথবা কোনওভাবে যদি তিনি কৃতবিদ্য হয়ে ওঠেন, তবু সমাজ তাঁকে বঞ্চনা করে— এই উদাহরণটি মহাভারতের কবি উপস্থাপিত করলেন মহাভারতের নায়কদের পাশাপাশি রেখে। ঘটনাটা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ছিল, কিন্তু মহাকাব্যের রচনা এবং ঘটনা-ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে সামাজিক অভিশাপগুলি তাঁর নজর এড়ায় না। যাঁরা মক্ষিকা-বৃত্তিতে শুধু স্থূলভাবে প্রাচীন সমাজের দোষ খুঁজে বার করেন, যখন স্থূলস্বভাবেই অশোভন ইঙ্গিত করে বলেন— এই দেখুন, সেকালের গুরুরা কেমন পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন; এই দেখুন, সেকালের সমাজে জন্ম-গোত্রে অকুলীন মানুষদের প্রতি বিষম আচরণ করা হয়েছে, তখন এই সমস্ত স্থূল চিৎকার-পরায়ণ মানুষদের প্রতি আমার বড় মায়া হয়। এঁরা তিন হাজার বছর ধরে চিৎকার করেছেন, তিন হাজার বছর ধরে সদুপদেশ দিয়ে নিজেরা যে আচরণ করেন না অথচ সমাজকে সেই উপদেশ বিতরণ করে এসেছেন, তিন হাজার বছর ধরে নিজেদের শোধন করতে না পেরে শুধু প্রাচীনের দোষ ধরে গেছেন, সেই সব নিকৃষ্ট সমাজধ্বজী মানুষদের প্রতি আমার বক্তব্য এই যে, মহাভারত-রামায়ণের কবিরা কেউ সমাজ-সংস্কারক নেতা নন, কিন্তু তাঁদের শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ এতটাই গভীর এবং সূক্ষ্ম যে, সমাজের প্রান্তবাসী এই অন্ত্যজ জাতিটির প্রতি মহাকুলজন্মাদের আচরণ, ব্যবহার, ঈর্ষা এমনকী ভালবাসাও তাঁরা লিপিবদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। এই কাজ যে তাঁরা বড় সচেতনভাবে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকের টিপ্পনীর কাজে লাগবে বলে লিপিবদ্ধ করেছেন, তা কখনওই নয়। বরঞ্চ বলব, বড় বড় মানুষের আদর্শ ব্যবহার এবং জীবন বর্ণনার মধ্যে মধ্যে এই যে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে একলব্যের ঘটনাটা সযত্নে নিবেশ করে গেলেন দ্বৈপায়ন ব্যাস, ঠিক এইখানেই মহাকাব্যের কবি যেন সামাজিক ঐতিহাসিকের টিপ্পনীটুকু রেখে যান এবং এই টিপ্পনী জাতিবর্ণের বৈষম্যবোধনের জন্য যতখানি, তার চাইতে অনেক বেশি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-নিরূপণের জন্য— যে প্রবৃত্তি এখনও স্বপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবম পত্রের নাব্যতায়, যে প্রবৃত্তি চাকুরিস্থলে স্তুতি-নতি-মধুর অধস্তনের উন্নতি বিধান করে, যে প্রবৃত্তি রাজনৈতিক মূর্খদের গণতান্ত্রিক কৌশলে অভাবিত পদে সুস্থিত করে।
লক্ষ করে দেখুন, জাতি-বর্ণের বৈষম্য-ভাবনা রামায়ণ-মহাভারতে কিছু কম নেই। কিন্তু সেই বৈষম্য তৎকালীন সমাজের অভিশাপ যতখানি, তার চেয়ে বেশি তো আধুনিক সমাজের অভিশাপ— বর্ণ-বৈষম্য তখন একভাবে ছিল, এখন আর একভাবে আছে। অতএব বিষমতায় কোনও তফাত নেই। মানুষ শিক্ষিত হলেই এই বিপদ ঘুচবে। কিন্তু সেই বৈষম্যের নিরিখে যদি বস্তু-বিচার করেন, তা হলে মহাকাব্য-বিচারে ভুল থেকে যাবে। ওই যে আর এক মহাকাব্য রামায়ণের দিকে তাকান— আমাকে এক অতি-সুশিক্ষিত আদিবাসী অধ্যাপক রসিকতা করে বলেছিলেন— আপনাদের সবচেয়ে দুষ্টু লোকটি হলেন আদিকবি বাল্মীকি। সেই যে তিনি ক্রৌঞ্চবিরহে বিরহী হয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন— ওরে নিষাদ! তুই কোনওকালে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাবি না— মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ— ওই অভিশাপেই তো আমরা শবর-ব্যাধ-নিষাদেরা সামাজিক বৈষম্যে ভুগছি চিরকাল, আর আপনারা বামুনেরা রাজত্ব করে যাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম— অমন করে আমাদের ক্রৌঞ্চবিরহী কবিকে দুষবেন না। ওঁরা সমস্ত মানুষের বিচিত্র ভাব নিয়ে খেলা করেন, বর্ণ-বৈষম্যের ওপরেই যদি তাঁর এত পক্ষপাত থাকত, তাহলে শৃঙ্গবের-পুরের নিষাদরাজ্যের অধিপতি গুহক চণ্ডালকে মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্রের পরমসখা বানিয়ে তুলতেন না ক্রৌঞ্চবিরহী কবি। তিনি সচেতনভাবে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন। আর এদিকে মহাভারতের মধ্যেও পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষার বহুল বর্ণনার মধ্যেও হঠাৎ করে একলব্যের প্রসঙ্গ আসত না, যদি না একলব্যকে দ্রোণাচার্য কিংবা অর্জুনের চেয়েও তাঁর বেশি ভাল লাগত।
অতএব, এ হল— মানুষের ভাব, প্রবৃত্তি এবং আচরণের ওপর সমাজ-সংস্কারক কবির টিপ্পনী— এখানে তাঁর ব্যথা লাগে। লেখা-পড়া-না-জানা মূর্খও এটা জানেন যে, ভারতবর্ষে আর্য জনজাতি সর্বত্র থিকথিক করছে না। এবং আর্যেতর গোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা প্রায় সবচেয়ে পুরাতন, সেই নিষাদরা ভারতবর্ষের প্রায় প্রত্যেক জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিলেন। কোথাও বা আর্য জনজাতির চাপে তাঁদের নিজস্ব ভদ্রাসনগুলি খানিকটা প্রান্তিক হয়ে উঠেছিল। যদিও যুদ্ধের প্রয়োজনে এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে এইসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর্য জনজাতির আদান-প্রদান যথেষ্টই ছিল। রামায়ণে নিষাদ-রাজ্যের ওই অবস্থানটা এখনও বুঝি সার্থকভাবে নির্দেশ করা যায়। সাধু শব্দটা অপভ্রষ্ট হয়েছে অবশ্য— শৃঙ্গবের-পুর, নিষাদ-রাজ্যের রাজধানী এখন মানুষের মৌখিক টানে এবং কালের গতিতে ‘সিঙ্গ্রোর’ হয়ে গেছে। পণ্ডিতেরা মনে করেন— এখনকার ইলাহাবাদ থেকে বাইশ মাইল গেলে উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গার বাঁ পারে এখনকার ‘সিঙ্গ্রোর’ গ্রামটিই নাকি নিষাদাধিপতি গুহকের রাজধানী ‘শৃঙ্গবের-পুর’। পান্থজনের সখার মতো রামায়ণের নায়ক এখানে রাত কাটিয়েছিলেন মিতা গুহকের সঙ্গে। সত্যি কথা বলতে কী, রামায়ণের এই একটা মাত্র জায়গা থেকে নিষাদ-রাজ্যের ঠিকানা নির্দিষ্ট করে ফেললে বেশ বড় ভুল হবে। আসলে নিষাদ-রাজ্য, অথবা বলা উচিত, নিষাদদের বসতি এক জায়গায় ছিল না, ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে নিষাদগোষ্ঠীর মানুষেরা, গোষ্ঠীর জন-নায়কেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। মহাভারতের ভূগোল ঘাঁটলে দেখা যাবে— যেখানে নিষধ-রাজ্য, দ্বারকার কাছে যে আনৰ্ত-দেশ তারই পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে নিষাদ-রাজ্য। তার মানে, মহাভারতে উল্লিখিত এই নিষাদ-রাজ্যটি ভারতবর্ষের মোটামুটি পশ্চিমে।
আবার দেখুন, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ভীম যখন ভারতের পূর্ব দেশগুলি জয় করতে গেলেন, তখন বৎসদেশের কাছাকাছি ভর্গ নামের এক উপজাতীয় নেতাকে দমন করার পর নিষাদ-রাজ্যের এক অধিপতিকেও তিনি পরাজিত করেছিলেন— ভর্গানামধিপঞ্চৈব নিষাদাধিপতিং তথা। এই ভর্গদের জায়গাটা বর্তমান চুনার-মির্জাপুরের কাছাকাছি বলে মনে করেন পণ্ডিতেরা। আমাদের কথা হল— তা হলে এখানেও নিষাদ-গোষ্ঠীর রাজ্য ছিল। আবার ওই রাজসূয় যজ্ঞে সহদেব যখন দক্ষিণ-বিজয়ে গিয়েছিলেন, তখন একবার তিনি গোশৃঙ্গ পর্বতের কাছে এক নিষাদ-জনপদকে আক্রমণ করছেন, আর একবার বিখ্যাত দণ্ডক বনের কাছে অন্য এক নিষাদ গোষ্ঠীকে পরাজিত করছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ-দেশেও দুই স্থানে নিষাদ-রাজ্যের ঠিকানা আছে। ভারতবর্ষের এইসব জায়গায় নিষাদ জনগোষ্ঠীর অবস্থান দেখে পণ্ডিতেরা মনে করেন— বিন্ধ্য পর্বতমালার বহুতর স্থানেই নিষাদ জনজাতির বসতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এ-কথা পরে আরও ভাল করে প্রমাণিত হবে।
সবচেয়ে বড় কথা যাঁর সম্মাননায় এই প্রবন্ধের আরম্ভ সেই একলব্যের পিতা হিরণ্যধনু যে বনগ্রামে আধিপত্য করেন সে জায়গাটা তো হস্তিনাপুর, মানে প্রাচীন দিল্লির যথেষ্ট কাছাকাছি। আমরা মহাভারতীয় নিষাদ-রাজ্যের সন্নিবেশগুলি যদি নিবিষ্ট মনে ভৌগোলিক চাতুরীতে বিচার করি, তা হলে দেখব— সেকালের ভারতবর্ষে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব দিকেই কোথাও-না-কোথাও নিষাদ-রাজ্যের অবস্থান লক্ষিত হয়েছে। পণ্ডিতেরা পশ্চিম-উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণের দিগ্বিভাগে যেভাবে নিষাদ-রাজ্যের অবস্থিতি দেখেছেন, তাতে বিন্ধ্য-পর্বতমালার এদিক-ওদিক বহুতর স্থানে নিষাদ-জনগোষ্ঠীর বসতি লক্ষ করেছেন। মহাভারতে খুব সুনির্দিষ্টভাবে নিষাদ-বসতির আরও একটা উল্লেখ আছে— সরস্বতী-নদীর অন্তর্ধান-প্রসঙ্গে।
মনে রাখতে হবে, পঞ্চনদীর দেশ ছেড়ে আর্যগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর প্রথম যেখানে আবাস গড়ে তুলেছিলেন, সে জায়গাটা ছিল সরস্বতী-দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী ভূমি। আর সরস্বতী নদী যে জায়গাটায় অদৃশ্য হয়ে গেছে— যে জায়গাটাকে ‘অদর্শন’ বা ‘বিনশন’ বলা হয়, যে জায়গাটা নাকি কুরুক্ষেত্রের কাছাকাছি কোনও মরু-অঞ্চল। এই ‘বিনশন’-এর পরেই নিষাদ-রাষ্ট্রের দ্বার— এতদ্ বিনশনং নাম সরস্বত্যা বিশাম্পতে। দ্বারং নিষাদরাষ্ট্রস্য…। মহাভারত বলেছে— এই মরু-অঞ্চলের যে জায়গাটায় দেবনদী সরস্বতী অদৃশ্য বা অদর্শন হয়ে গেলেন, সেই অদর্শনের একটা হেতু আছে। তিনি ভাবলেন— আর নয়, এই পর্যন্তই। এর পরেও যদি আমি প্রবাহিনী হয়ে সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করি, তা হলে নিষাদেরা আমাকে দেখতে পাবে। কারণ তার পরেই নিষাদ-রাষ্ট্র। অতএব নিষাদ-রাজ্যের সংস্পর্শ এড়ানোর জন্যই সরস্বতী পৃথিবীর বিবরে প্রবেশ করলেন, আর তাঁকে দেখা গেল না— দ্বারং নিষাদরাষ্ট্রস্য যেষাং দোষাৎ সরস্বতী। প্রবিষ্টা পৃথিবীং বীর মা নিষাদা হি মাং বিদুঃ।
এই হল মহাকাব্যের বর্ণনা-কৌশল। আর্যগোষ্ঠীর প্রাণারাম নদীমাতা যেভাবে যেখান থেকে প্রবাহিনী হয়ে এসেছিলেন, তাতে আর তাঁর দম ছিল না এগোবার। ফলে আপন বিলুপ্তির দোষ চাপিয়ে দিলেন নিষাদ-জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে। আসল কথা বেশ বুঝি— সরস্বতীর জল-ধোয়া অঞ্চলে যুদ্ধপ্রিয় আর্যরা এসে বসতি তৈরি করায় সেখানকার প্রাচীন অধিবাসী নিষাদদের আরও দূরে পশ্চিমে সরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু যেখানে তাঁরা দূরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, সেখানে তাঁদের শক্তি কম ছিল না, ফলে আর্যরাও ওই নিষাদ-রাষ্ট্রের দুয়োর পেরনোর সাহস করেননি আর সরস্বতী নদীও ‘অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়’ নিরর্থক অভিমানে অদৃশ্যা হয়ে গেলেন চিরতরে, অভিমানে বলে গেলেন— নিষাদেরা যাতে আমায় জানতে-বুঝতে না পারে, তাই আমি প্রবেশ করলুম পৃথিবীর বিবরে।
এই যে সরস্বতীর অদর্শন-তীর্থে আমরা আর্য-জনপদের পাশাপাশি নিষাদরাষ্ট্রের অবস্থিতি দেখালাম, এই ঘটনা থেকে আমরা প্রমাণ করতে চাই যে, ভারতবর্যের নিষাদ জনগণেরা আর্যদের সমবয়সি তো বটেই— বলা উচিত তাঁদের চেয়েও অনেক প্রাচীন অধিবাসী। যুদ্ধপ্রিয় আর্যরা তাঁদের অনেককেই স্বভূমি থেকে উৎখাত করেছেন বটে, তবে তাঁরাও চিরতরে উবে যাননি; নিষাদরাও ভালই যুদ্ধ জানতেন, অতএব খানিক দূরে তাঁরাও আপন সংস্কৃতির স্বাভিমান নিয়ে নিজেদের বসত গড়ে তুলেছেন আর্যদের পাশাপাশি। এতে শত্রুতা যতই থাকুক পরস্পর, এঁদের মধ্যে মেলামেশা অনেক বেড়েছে এবং ঘৃণা কমেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কথাটা প্রমাণ করার জন্য মহাভারত-রামায়ণের চেয়েও প্রাচীন গ্রন্থের অবতারণা করব আমরা।
প্রশ্ন উঠবে— এত ভণিতা কেন? কথা ছিল একলব্যকে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখব। সেখানে ভূগোল, ইতিহাস, সমাজতত্ত্বের ভণিতা আরম্ভ করলে মূল প্রবন্ধটাই হারিয়ে যাবে। উত্তরে বলি— একটি মানুষ, তাও আবার তথাকথিতভাবে সামাজিক অন্যায়ে বঞ্চিত মানুষ, তাঁর কথা পূর্ণভাবে জানতে হলে শুধু তাঁর তৎকালীন পরিপার্শ্বের জ্ঞান থাকলেই চলে না। মহাভারতের কালের বঞ্চিত মানুষের তাত্ত্বিক পরিপার্শ্ব সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অনেক পূর্বকাল থেকে। সেখান থেকেই বোঝা যাবে যে, তাঁর প্রতি বঞ্চনার পিছনে সামাজিক পরম্পরা কতটা এবং সেখানে ভূগোল ইতিহাসও ভাল করেই জড়িয়ে যায়।
এই যে একলব্য নিষাদ, তাঁর পিতা হিরণ্যধনু নিষাদগোষ্ঠীর রাজা, এটা তো পরম অবহেলিত শূদ্র জনগোষ্ঠীর চাইতে অনেক বেশি সম্মানের কথা। বিভিন্ন স্থানে ‘নিষাদ-রাষ্ট্র’ বলে বারবার উল্লেখ পাচ্ছি মহাভারতে, রামায়ণে এবং আরও বহু প্রাচীন গ্রন্থে। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, বেদ এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতেই যেহেতু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রধান প্রতিষ্ঠা, সেখানে তৈত্তিরীয় সংহিতা, কাঠক সংহিতা, মৈত্ৰায়ণী সংহিতা অথবা বাজসনেয়ী সংহিতার মতো প্রাচীন সংহিতা-গ্রন্থে নিষাদদের গোষ্ঠী-নাম বারবার উল্লিখিত হয়েছে। আপনারা শূদ্রগোষ্ঠী বা শূদ্ররাষ্ট্রের কথা পাবেন না, কিন্তু নিষাদ-রাষ্ট্রের কথা পাবেন মহাভারত-রামায়ণে। পাশ্চাত্য সুধীজনেরা এই তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন— নিষাদ জনগোষ্ঠীকে ঠিক কোনও বিশেষ উপজাতি বলা যায় না; এঁরা হলেন সেই অনার্য-গোষ্ঠীর অন্যতম অংশ যাঁরা আর্য জনগোষ্ঠীর আধিপত্য পুরোপুরি মেনে নেননি কখনও। বরঞ্চ বলব— আর্য জনগোষ্ঠীর দিক থেকে এইরকম একটা সম্মতিসূচক প্রশ্রয়ও ছিল নিষাদগোষ্ঠীর প্রতি যে,— আচ্ছা! তোমরাও থাকো এখানে, আমরাও থাকি। তোমরা বাঁয়ে থাকো, আমরা দক্ষিণে থাকি— এইরকম। হ্বেবার-সাহেব বলেছিলেন— নিষাদেরা হলেন ভারতবর্ষের এককালের স্থায়ী বাসিন্দা, যাঁরা ঠিক সভ্য মানুষ নন— ওঁদের ভাষায়— ‘Settled aborigines’, আসলে, ‘নিষাদ’ শব্দটা নি-পূর্বক সদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হওয়ায় হ্বেবার-সাহেব ভেবেছেন— সদ্ ধাতুর অর্থ যেহেতু থাকা, বসতি করা অথবা বসে থাকা, অতএব এর সঙ্গে ‘নি’ উপসর্গটা লাগালে মানে হবে আর্যগোষ্ঠীর পূর্বে অবস্থিত তথাকথিত অসভ্য জনগোষ্ঠী— Settled aborigines.
আমরা ঠিক এইভাবেই ‘নিষাদ’ শব্দের নিষ্পত্তি মেনে নিতে রাজি নই। এমনকী বাজসনেয়ী সংহিতায় উল্লিখিত নিষাদ শব্দের অর্থ করতে গিয়ে প্রাচীন টীকাকার মহীধর যে, নিষাদদের ‘ভিল্ল’ বা ‘ভিল’ বলে চিহ্নিত করেছেন, সেটাও আমরা ঠিক মানতে রাজি নই। কেন না, আর্যগোষ্ঠীর শাসনতন্ত্রের বাইরে এই উপজাতীয় গোষ্ঠীকে মহীধর জানতেন বলেই যে নিষাদরা ঠিক ‘ভিল’ উপজাতির গোষ্ঠীর মানুষ, তা আমরা মানতে পারি না। বরঞ্চ উপসর্গ-ধাতু-প্রত্যয়ের নিষ্পত্তিতে হ্বেবার-সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা আরও একটু সদর্থকভাবে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি প্রাচীন পৌরাণিকদের টিপ্পনী থেকে। অন্তত তাতে বোঝাতে পারব যে, নিষাদরা ভারতবর্ষে কতটা পুরাতন জনজাতি। তবে সে-কথায় আমরা পরে আসব।
প্রায় সব পুরাণেই এই কাহিনি আছে যে, পৃথিবীর প্রথম রাজা ছিলেন বেণ। বেণের পিতা বিখ্যাত ধ্রুব-রাজার কিছু পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ। তাঁর নাম অঙ্গ। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় মৃত্যুর অধিপতি যমের মেয়ে সুনীথার। তাঁরই গর্ভে বেণের জন্ম। ঋষিরা তাঁকে প্রথম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু বেণের স্বভাব ভাল ছিল না এবং স্বভাবতই তিনি অত্যাচারী পুরুষ ছিলেন। রাজা হবার পরেই তিনি আদেশ দেন— এ-রাজ্যে অন্য কারও পূজা-অর্চনা চলবে না। ভগবান-টগবান কেউ নেই, আমিই ভগবান। রাজার শরীরে সমস্ত দেবতার বাস। কাজেই শ্রদ্ধা করতে হলে আমাকেই করো, আমার আদেশই ভগবানের প্রত্যাদেশ। এমন একটা রাজার স্বেচ্ছাচার সেকালের সবচেয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায়— ঋষিরা মেনে নিলেন না, তাঁদের অভিশাপ-নিন্দা এবং আঘাতে বেণ নিহত হলেন। পরে রাজপরম্পরা চলমান রাখার জন্য ঋষিরা নিঃসন্তান রাজার ঊরু মন্থন করা আরম্ভ করলেন। বেণের মথ্যমান ঊরু থেকে খর্বমুখ এবং হ্রস্বকায় পুরুষ জন্মাল এবং সে উঠে দাঁড়িয়ে ঋষিদের বলল— আমি কী করব? ঋষিরা বললেন ‘নিষীদ’, মানে বসে থাকো। বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে যে, অত্যাচারী অধার্মিক বেণের পাপের অংশ নিয়ে এই মানুষটি জন্মেছিল এবং ঋষিরা তাঁকে বসে থাকতে বলেছিলেন বলেই ‘নিষীদ’ থেকে নিষাদ কথাটি এসেছে— নিষীদেতি তমুচুস্তে নিষাদ স্তেন সোহভবৎ। বিষ্ণুপুরাণ আরও জানিয়েছে— তার পর থেকেই নিষাদেরা বিন্ধ্যপর্বতের শৈলভূমিতে থাকতে আরম্ভ করে এবং নিষাদদের মাধ্যমে বেণের পাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলেই বেণের পাপাংশে তাদের জন্ম বটে, কিন্তু তারা বেণ-পাপ-বিনালন নামে খ্যাত। এরপরেই বেণের দক্ষিণ বাহু মন্থন করার ফলে পৃথুর জন্ম হল, যার নামে এই পৃথিবী, পৃথ্বী অথবা প্রথম সভ্যতা। তার মানে নিষাদ জনগোষ্ঠী আমাদের সভ্যতার সমবয়সী। বেণের কাহিনি দিয়ে নিষাদদের পুরাতনত্ব বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে দ্রোণাচার্য যেমন একলব্যকে বসিয়ে দিলেন, পৃথুর হস্তমর্দী ব্রাহ্মণরাও নিষাদদের বসিয়েই দিয়েছিলেন।
মহাভারতে প্রথম যেভাবে একলব্যের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, সেটা কিন্তু শিক্ষার আসর। মহামতি দ্রোণাচার্য কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সকলকে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন শত্রু-মিত্র-নির্বিশেষে। অস্ত্রশিক্ষায় তাঁর সুনাম এত যে, নানা দিক্-দেশ-রাজ্য থেকে রাজা-রাজপুত্রেরা এসে তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করে— রাজানঃ রাজপুত্রাশ্চ সমাজগ্মুঃ সহস্রশঃ। রাজা এবং রাজপুত্রেরা যখন দ্রোণের কাছে আসছেন, তখন রাজপুত্র হলেই তাঁর ছাত্র হওয়া যাবে— প্রধানত এই ভরসাতেই নিষাদগোষ্ঠীর রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য— ততো নিষাদরাজস্য হিরণ্যধনুষঃ সুতঃ— দ্রোণের কাছে উপস্থিত হলেন অস্ত্রশিক্ষা লাভের জন্য।
খুব যে জাতিবিদ্বেষ, তা নয়, তবু দ্রোণ তাঁকে নিজের বিদ্যাস্থানে গ্রহণ করলেন না— নিষাদ-গোষ্ঠীর ছেলে বলেই— ন স তং প্রতিজগ্রাহ নৈষাদিরিতি চিন্তয়ন্। আবারও বলি— খুব যে জাতি-বর্ণবিদ্বেষ, তা নয়। কিন্তু নিষাদরাজের ছেলে একেবারেই এক পৃথক জনগোষ্ঠীর মানুষ, তাঁর আচার-ব্যবহার, শুচিবোধ-সদাচার— সবটাই আর্য-জনজাতি থেকে আলাদা। তার সঙ্গে মিলে-মিশে বড় হয়ে ওঠাটা হস্তিনাপুরের রাজপুত্রদের পক্ষে খুব স্বাস্থ্যকর হবে কিনা, সে-বিষয়ে দ্রোণাচার্যের সবিশেষ চিন্তা ছিল— নৈষাদিরিতি চিন্তয়ন্। মহাভারতের কবি দ্রোণের শিক্ষানীতির বিষয় স্পষ্ট করে দিয়ে লিখেছেন— নিষাদগোষ্ঠীর ছেলে রাজপুত্রদের সঙ্গে একত্রে ওঠা-বসা করবে, একত্রে শিক্ষা গ্রহণ করবে— এটা ঠিক হবে না ভেবেই দ্রোণাচার্য তাঁকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না— শিষ্যং ধনুষি ধর্মজ্ঞঃ তেষামেব অন্ববেক্ষয়া।
দ্রোণাচার্যকে দোষ দেব কী, তিনি তো রীতিমতো আধুনিক শিক্ষা-পদ্ধতি মেনেই চলছেন। আমি এটা বুঝি যে, আধুনিক শিক্ষানীতি জাতি-বর্ণ-বিভেদের কথা বলে না এবং আমি বলব— দ্রোণাচার্যও সেই বিভেদ করেননি। কিন্তু যে বিভেদ তিনি করেছেন, আমি আধুনিক শিক্ষানীতিতে সে-কথা পড়েছি। বেশ কিছু বছর আগে এজুকেশন-এর জব্বর-জব্বর বইতে দেখেছি— ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে কতগুলি নীতি-নিয়ম মেনে চলেন শিক্ষাবিদেরা। যেমন একই ক্লাসে ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে একটি বয়োজ্যেষ্ঠ অধিক-বয়সি ছেলেকে একত্রে পড়তে দেওয়া মোটেই কাজের কথা নয়। অথবা অষ্টম/সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়েদের মধ্যে একটি নতুন বউ এসে ভর্তি হল অলব্ধ বিদ্যা শেষ করবে বলে। তারপর তার স্বামী-সোহাগের গল্পের চোটে অন্যান্য বালিকাকুলের লব্ধ-বিদ্যা বিস্মৃত হয়ে উঠবে বলে এই ধরনের বিষমতা শিক্ষাবিদেরা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন। একইভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং প্রতিবন্ধী ছাত্রদের সাধারণের সঙ্গে একত্র পড়ার ব্যবস্থাতেও সমস্যা হয়। সাধারণের সুস্থ অত্যাচারেও মানসিক বিকার আরও বাড়ে, সাধারণ প্রতিবন্ধী শেষে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠে।
শিক্ষাবিদেরা এই ধরনের বিষম ক্ষেত্রগুলিকে কড়া নীতি-নিয়ম হিসেবে দেখেন না, কিন্তু একটা ঔচিত্য-বিচার-চর্চা এখানে কাজ করে এবং সেটা হয়তো অধিকাংশ এবং একক— উভয়পক্ষেরই মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে। দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে অস্ত্রশিক্ষার গুরু নিযুক্ত হয়েছেন, যতই তাঁর গুরুর স্বাধীনতা থাক, তবু তিনি রাজবাড়ির অর্থপুষ্ট শিক্ষক। দ্বিতীয়ত নিষাদ একলব্য যতই রাজপুত্র হোন, তিনি নিষাদ-জাতিভুক্ত। ছাত্র হিসেবে তিনি ভাল করলেও ক্ষত্রিয় রাজকুমারদের ঈর্ষা-অসুয়া এবং অপছন্দের কারণ হবেন, আবার খারাপ করলে নিন্দা, তিরস্কার এবং অযথা কটূক্তির বিষয় হয়ে উঠবেন। আমাদের ধারণা, নিষাদ একলব্যকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে দ্রোণাচার্যের নিজের যে কোনও আপত্তি ছিল তা নয়, কিন্তু ওই যে মহাভারতের কবি কারণটা বলেছেন— তেষামেব অন্ববেক্ষয়া— অর্থাৎ রাজপুত্রেরা নিষাদ একলব্যের বিষম সাহচর্যে কীভাবে প্রতিক্রিয় হয়ে উঠবেন, সে-কথা ভেবেই দ্রোণাচার্য তাঁকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না। আরও স্পষ্টভাবে বললে এইটাই বলা ভাল যে, দ্রোণাচার্য যাঁদের কাছে চাকরি নিয়েছেন, সেই রাজপুত্রদের স্বার্থ এবং মানসিকতা মাথায় রেখেই (অন্ববেক্ষণ=অনু+অবেক্ষণ) দ্রোণ একলব্যকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না— ন স তং প্রতিজগ্রাহ… তেষামেব অন্ববেক্ষয়া। নইলে শুধুই জাতি-বর্ণ-বিদ্বেষে দ্রোণ তাঁকে গ্রহণ করলেন না, তা নয়। জাতির ব্যাপারে যদি অত সচেতনতা থাকত তা হলে যজ্ঞকর্মের হরিঃ-পুরোডাশ-স্রুক্-স্রুব ছেড়ে তিনি ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করতেন না। ব্রাহ্মণের যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ছেড়ে যিনি ধনুক-বাণ ধরেছেন মহাভারতের কালে, তিনি আর অত জাতের বিচার করবেন কোন মুখে, কোন মানসিকতায়!
সবচেয়ে বড় কথা, জাতি-বর্ণের প্রশ্ন এখানে খুব একটা ওঠার কথাও নয়। দ্রোণাচার্য তো বেদমন্ত্র শেখাচ্ছিলেন না, অপিষ্ঠোম যজ্ঞের নিয়মও শেখাচ্ছিলেন না। তিনি অস্ত্রশিক্ষা দেন এবং সেকালের দিনে শূদ্রবর্ণের বহুতর মানুষই রাজার সৈন্যবাহিনীতে থাকতেন। সেদিক দিয়েও নিষাদ একলব্যের কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। কেন না বেদের আমল থেকেই নিষাদ-গোষ্ঠীর একটা নিজস্ব ‘আইডেনটিটি’ ছিল এবং তা শূদ্রবর্ণের চেয়ে অনেক স্পষ্টতর ‘আইডেনটিটি’, যেটা আর্যভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে মোটেই হেলার বস্তু ছিল না, বস্তুত হেলা করাটা অত সহজই ছিল না।
আমরা অবশ্য এত তড়িৎ-গতিতে সিদ্ধান্ত করতে রাজি নই। আমরা মনে করি— আর্যদের পূর্বস্থিত জনগোষ্ঠী হলেও নিষাদেরা তত অসভ্য ছিলেন না, আর্যরা তাঁদের অসভ্য মনে করতেন আপন কৃষ্টির গরিমায়, কিন্তু সেটা অন্য কথা। আমরা মনে করি— নিষাদ জনজাতির মানুষেরা নিজের ভাষা বলতেন এবং তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি ছিল এবং তাঁরা যুদ্ধবিদ্যাটা তাঁদের প্রতিস্থাপক তথা সহস্থিত আর্যজনগোষ্ঠীর চেয়ে কম জানতেন না— যে কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডব-কৌরব দুই পক্ষেই প্রচুর নিষাদ-যোদ্ধা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধ-বিদ্যায় এই আধিপত্য ছিল বলেই বহুলভাবে নিষাদ-রাষ্ট্রের কথা আমরা ইতস্তত শুনি এবং এই আধিপত্যের জন্যই আগ্রাসনের চেয়ে নিষাদদের সঙ্গে মানিয়ে চলাটাই আর্যনীতি ছিল বলে মনে হয়। আমাদের এই মনে হওয়াটা খুব কল্পিত ব্যাপার নয়। তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বেদ-বেদাঙ্গে, পুরাণে-মহাভারতে।
এই যে একলব্য নৈষাদিকে দেখলাম, দ্রোণ তাঁকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না, কিন্তু তাই বলে একলব্য সেই একবারের পরে দ্বিতীয়বার কিন্তু অনুরোধ করেননি দ্রোণাচার্যকে। গুরুস্থান বলে দ্রোণকে তিনি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছেন সদাচার-সম্মতভাবে— স তু দ্রোণস্য শিরসা পাদৌ গৃহ্য পরন্তপ— এবং সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেছেন আপন অরণ্যকুটিরে, যেখানে তাঁর আপন স্থান, যেখানে তাঁকে কেউ বিরক্ত করবে না। অরণ্যের এই নির্জন সুন্দর ভূমি তাঁর পিতৃরাজ্যের একান্ত কোনও স্বাধিকৃত স্থান কিনা, মহাভারতের কবি তা বলেননি স্পষ্টত, কিন্তু নিষাদ-অধিপতি হিরণ্যধনুর পুত্র যেখানে এসে পৌঁছলেন সেটা হস্তিনাপুর থেকে খুব দূরে নয়, সে তাঁর নিজের জায়গা, নিজ প্রিয় মর্যাদার স্থান।
নিষাদ-গোষ্ঠীর মর্যাদা আর্যনিবাসে কিছু ছিলই। নিতান্ত আর্যসম্মত যে চতুর্বর্ণবিভাগ অতিপ্রাচীনকালে চালু হয়েছিল, সেখানে একসময় নিষাদ-গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে পৃথক মর্যাদায়। বেদ এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘পঞ্চজন’ বলে একটি বিখ্যাত শব্দ পাওয়া যাবে। শব্দটা প্রায় সময়েই বহুবচনে ‘পঞ্চ জনাঃ’ বা ‘জনেষু পঞ্চষু’ এইরকম মন্ত্রবর্ণে পঠিত হয়। এই শব্দের অর্থ করার সময় নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করলেও ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন আভিধানিক যাস্ক তাঁর ‘নিরুক্ত’ গ্রন্থে নিজের চেয়েও অনেক প্রাচীন এক আচার্য-সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে বলছেন— ‘পঞ্চজন’ মানে অনেকে বলেন— এই পাঁচ জন হলেন গিয়ে গন্ধর্বরা, আমাদের পিতৃগণ, দেবতা, অসুর এবং রাক্ষস। কিন্তু আমার পূর্ব আভিধানিক উপমন্যুর সম্প্রদায় বলেছেন— পঞ্চজন হল আসলে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি চতুবর্ণ এবং পঞ্চম বর্ণ হলেন নিষাদেরা— চত্বারো বর্ণা নিষাদ-পঞ্চম ইতি ঔপমন্যবঃ।
জেনে রাখুন, নিরুক্তের লেখক যাস্ক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের জাতক পাণিনির চেয়ে বেশ খানিক প্রাচীন। তিনি আবার প্রাচীনতর উপমন্যু আচার্যের নাম করে যা বললেন, তাতে বোঝা যায়— আর্যরা বহুকাল ধরেই অথবা বহুকাল আগেই নিষাদ জনজাতিকে নিজেদের বর্ণ-বৃত্তের মধ্যে টেনে এনেছিলেন। না এনে বোধহয় উপায়ও ছিল না। এঁদের অস্ত্ৰক্ষমতা, শারীরিক পটুত্ব এবং সংখ্যাবাহুল্যের নিরিখে এঁদের না মেনে উপায় ছিল না বলেই আর্যজনজাতিকে এঁদের মানিয়ে নিয়েই চলতে হত। কৌষিতকী বা লাট্যায়ন ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন গ্রন্থে দেখবেন— বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজাকে কোনও-না-কোনও সময় একজন নিষাদের গৃহে বসতি করতে হত— নৈষাদে বসেদ্ এতদ্বা অবরার্ধ্যম্ অন্নাদ্যম্। বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণদের মতো উচ্চ বর্ণের সঙ্গে নিষাদদের নাম, অথচ শূদ্রদের নাম নেই— তাতে বুঝি বিভিন্ন জন-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে শক্তি বা বল সঞ্চয়ের এই প্রক্রিয়া যদি বিশ্বজিৎ যজ্ঞের অঙ্গ হয় এবং সেখানে যদি নিষাদ-জনজাতির গৃহে বাস করাটা যজ্ঞের অন্যতম উপাচার হয়, তবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতের এই কথা মানতেই হবে যে, নিষাদ হল সেই শব্দ, যা নাকি— the general term for the non-Aryan tribes who were not under Aryan control, as the Sudras were… for the Nisadas who would permit an Aryan to reside temporarily amongst them must have been partially amenable to Aryan influences.
সত্যি বলতে কী, amenable এঁরাও বটে, ওঁরাও বটে। দুই পক্ষের মধ্যেই দুই পক্ষের পারস্পরিক প্রভাব এবং মেশামেশি বেশ প্রকট ছিল। নইলে একলব্যের নাম বা তাঁর বাবা হিরণ্যধনুর নাম শুনলে কেউ কি বুঝবেন যে, এটা কোনও আর্যজনোচিত সংস্কৃত নাম নয়। তবু যে দ্রোণাচার্য একলব্যের শিষ্যত্ব পরিহার করলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় নিষাদ-জনজাতির স্বাভাবিক অস্ত্রনিপুণতার কথা স্মরণ করে, কেন না গুরুদত্ত শিক্ষায় সে নিপুণতা এমন স্তরে পৌঁছতে পারে, যাতে রাজপুত্রদের অসুবিধে হতে পারে। আর দ্বিতীয়ত যত মেলামেশাই থাকুক, কৃষ্টি, ঘরানা এবং আচারভেদ এমনই এক বাহ্য এবং পৃথক জটিলতা তৈরি করে যে, একলব্যকে শিষ্য হিসেবে নিলে দ্রোণ এবং দ্ৰোণশিষ্যেরা অদ্ভুত কোনও ভেদ-ভাবনায় আবিষ্ট হতেন বেশি, তাতে অস্ত্রশিক্ষার চেয়ে কূট-কচালি বেশি হত। কেন না আমি তো দেখেছি— কোনও উপজাতি ব্যাঙ খায়, কি সাপ খায়— এই নিয়েই তথাকথিত সভ্যদের কত আলোচনা, কত আলাপ ব্যয়িত হয়, সেখানে একলব্য যদি দুটো সাপ খেয়ে কাপড়ে হাত মুছেই ব্রহ্মাস্ত্রের মতো শুদ্ধ অস্ত্রে হাত দিতেন, তা হলে আর্য রাজপুত্রদের দিক থেকে এইটুকু আক্ষেপণ অস্বাভাবিক নয়— আরে নিষাদ তো! আর কত হবে। আমাদের ঘরের নিয়ম— আহারশুদ্ধিতে সত্ত্বশুদ্ধি।
আচার-বর্ণ বিচার করতে গিয়ে একটু সরে এসেছি বটে, কিন্তু একলব্যের সসম্মান প্রত্যাহার আমরা পূর্বেই দেখেছি। দ্রোণের প্রতি কোনও প্রশ্নোচ্চারণ না করে প্রণামান্তে একলব্য চলে এসেছেন তাঁর অরণ্য-কুটিরে। দ্রোণকে তিনি অনেক কাল ধরে দেখেছেন এবং লক্ষ করেছেন নিশ্চয়। নিপুণভাবে খেয়াল করেছেন তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতি। আর ঠিক সেই কারণেই দ্রোণ ছাড়া আর কাউকে তিনি গুরুর আসনে বসাতে পারেন না, দ্রোণ অস্বীকার করলেও তা পারেন না একলব্য। অতএব মনে মনে দ্রোণাচার্যকে গুরু হিসেবে বরণ করেই তাঁর এক মৃন্ময় মূর্তি গড়লেন একলব্য— অরণ্যমনুসম্প্রাপ্য কৃত্বা দ্রোণং মহীময়ম্। ভারতীয় দর্শনে গুরুর সঙ্গে ইষ্টদেবতার স্বরূপগত ভেদ নেই কোনও। গুরুর কাছে দীক্ষিত হওয়া মানে চরম এক আত্মসমর্পণ, যেখানে নিজের লজ্জা-ভয়, মান-অপমান, সুখ-দুখ-ভাবনা সব বিলীন হয়ে যায়। দ্রোণ একলব্যকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না বটে, কিন্তু শিষ্য হবার যে পরোক্ষ পদ্ধতি— মান-অপমান-অভিমান বিসর্জন দিয়ে গুরুর কাছে আত্মনিবেদন করা— একলব্য তাই করলেন। গুরুর মৃন্ময় মূর্তি তৈরি করে মনে মনে বললেন— আপনিই আমার অস্ত্রশিক্ষার আচার্য, আমি যা শিখছি, আপনার কাছেই শিখছি। মৃন্ময়ী মূর্তির মধ্যে দ্রোণের আচার্যস্বরূপ প্রতিষ্ঠা করে— তস্মিন্ আচার্যবৃত্তিঞ্চ পরমামাস্থিতস্তদা— একলব্য ধনুক-বাণের অভ্যাস আরম্ভ করলেন। শিক্ষার জন্য জীবনের অন্য সমস্ত আকাঙক্ষাকে যেহেতু নিগৃহীত করতে হয়, কোনও বিষয়ে চরম নৈপুণ্য লাভ করার জন্য যে একাগ্রতা লাগে, সেই ইন্দ্রিয় সংযম, ত্যাগ এবং একাগ্রতাই যে শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর চরম উত্তরণ ঘটায়, সেই সব বিশেষণগুলিই নিষাদ একলব্যের জন্য চিহ্নিত করেছেন দ্বৈপায়ন ব্যাস— ইষ্বস্ত্রে যোগমাতস্থে পরং নিয়মমাস্থিতঃ।
মহাভারতের কবি পাণ্ডব-কৌরবের মাধ্যম গ্রহণ করে আর্য-জনজাতির ইতিহাস লিখতে বসেছেন, অথচ সেই পরিমণ্ডলের মধ্যে অন্যান্য অধম জনজাতির সক্ষমতার ইতিহাসকে তিনি কবিজনোচিত বেদনায় অগ্রাহ্য করে রাখেননি। তিন-চারটি মাত্র অসাধারণ শব্দ প্রয়োগ করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ যদি শিক্ষা লাভ করতে চায়, তবে তিনটি মাত্র বস্তুর অপেক্ষা আছে। এক হল আদর্শ ঠিক করা— আমি কী হতে চাই, কতটা চাই সেটা বোঝা। একলব্য দ্রোণাচার্যকে আদর্শ মেনেছেন, অর্থাৎ তিনি দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রবিদ হতে চান, গুরু তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করুন বা না করুন, এটাই একলব্যের প্রাপ্য স্থান, ‘টারগেট’। এই আদর্শ বা চরম স্থান লাভ করার জন্য, ‘অ্যাচিভ’ করার জন্য প্রথম যেটা একতম উপায়, সেটা হল শ্রদ্ধা। একলব্য তাঁর শ্রদ্ধাটাকে রূপ দিয়েছেন দ্রোণের মূর্তি গড়ে— পরয়া শ্ৰদ্ধয়োপেতঃ। দ্বিতীয় প্রয়োজন— নিয়ম। এটা কোনও ব্যবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া নয়, এটা সময়ের যথাশক্তি ব্যবহার, মনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন অনুধ্যানে সময়ের সার্থক ব্যবহারই নিয়ম হয়ে ওঠে। তৃতীয় হচ্ছে একাগ্রতা— যাকে মহাকবি বলেছেন ‘যোগ’— এখানে অন্তত সেটা প্রাণায়াম-রেচক-কুম্ভক নয়, নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একাগ্রতা— যে একাগ্রতায় ভবিষ্যতে অর্জুন পাখির চোখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবেন না, সেই একাগ্রতায় একলব্য ধনুঃশরের সাধন আরম্ভ করলেন— শ্ৰদ্ধয়া পরয়োপেতঃ যোগেন পরমেণ চ। অরণ্যের নির্জন স্থানে নিষাদ একলব্য এই তিন প্রক্রিয়ায়— আমি অবশ্যই সেই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হব, তাঁর জন্য নিয়ম এবং একাগ্রতা— এই তিন প্রক্রিয়ায় একলব্য অস্ত্রের গ্রহণ, সন্ধান এবং নিক্ষেপে এমন একটা সহজ গতিময়তা বা ‘স্পিড’ তৈরি করে ফেললেন যেখানে, তিনি নিজেই নিজের শিক্ষক-সিদ্ধি লাভ করে ফেললেন— বিমোক্ষাদান-সন্ধানে লঘুত্বং পরমাপ সঃ।
এর পরের ঘটনা আপনাদের জানা থাকলেও মহাকবির হৃদয়টুকু আপনাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। এরপর একদিন যেখানে গুরু দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার ইস্কুলেও ছাত্রদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, সেই সময় একদিন দ্রোণাচার্যের অনুমতি নিয়ে পাণ্ডব-কৌরবরা রথে করে মৃগয়া করতে বেরোলেন। অনেক অস্ত্র-পরিশ্রমের মধ্যে এটা ‘রিলাক্সেশন’। সেকালের দিনে মৃগয়ায় যেতে হলে রাজা-রাজড়ারা শিক্ষিত শিকারি কুকুর নিয়ে বেরোতেন, সেই কুকুরের ‘ট্রেইনার’-টিই মৃগয়ার অন্য উপচার জাল, রজ্জু এবং অবশ্যই সেই শিক্ষিত কুকুরটিকে নিয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে চলল— তত্রোপকরণং গৃহ্য… শ্বানমাদায় পাণ্ডবান্। রাজকুমারেরা বনে গিয়ে ইতস্তত পশুর অন্বেষণ করতে আরম্ভ করলেন, কোনও কোনও পশুর পিছনে রথ ছুটিয়ে দৌড়লেন, মৃগয়া চলতে লাগল আপন প্রক্রিয়ায়। এদিকে পশু-অন্বেষণকারী কুকুরটি এদিক-ওদিক চরতে চরতে, ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের সামনে এসে পৌঁছোল। নির্জন বনের মধ্যে নিকষ কালো একটি মানুষ, সারা গায়ে ধুলো-মাটির আস্তরণ, জট-পাকানো চুল বাঁধা হয়নি, পরনে এক টুকরো মৃগচর্ম, হাতে ধনুক-বাণ— স কৃষ্ণং মলদিগ্ধাঙ্গং কৃষ্ণাজিন-জটাধরম্। এমন অদ্ভুত চেহারার মানুষ মনুষ্য-সঞ্চার-বিরহিত স্থানে দেখলে কুকুর অবশ্যই চেঁচায়। এই শিক্ষিত কুকুরটিও চেঁচিয়ে উঠল একলব্যকে লক্ষ্য করে। শব্দ শোনামাত্রই নির্জনে আপন তপস্যাভঙ্গের অপরাধে একলব্য পরপর সাতটা বাণ ছাড়লেন কুকুরটির মুখ লক্ষ্য করে— তদা তস্যাথ ভষতঃ শুনঃ সপ্ত শরান্ মুখে।
পাণ্ডবদের সহচারী কুকুরটি একবার কি দু’বারের বেশি ডাকার সুযোগ পায়নি, তার মধ্যে সাত-সাতটি শর একযোগে মুখে এসে পড়ল— একে বলে ক্ষিপ্রতা— যাঁর ধনুর্বেদগ্রাহ্য পারিভাষিক নাম ‘লাঘব’— একলব্য সেই অস্ত্রলাঘব প্রদর্শন করেছেন নিজের বিরক্তি উৎপন্ন হয়েছে বলে, কাউকে দেখানোর জন্য নয়— লাঘবং দর্শয়ন্নস্ত্রে মুমোচ যুগপদ্ যথা। সারা মুখ অস্ত্র নিয়ে শিকারি কুকুর পাণ্ডব-ভাইদের খুঁজে বার করল, দাঁড়াল তাঁদের সামনে, চেঁচানোর ক্ষমতা নেই একটুও। পাঁচ পাণ্ডব-ভাইই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কুকুরের দিকে এবং আবিষ্কার করলেন কুকুরের মুখ বন্ধ হবার রহস্য। তাঁরা বুঝলেন— যে-মানুষ এইভাবে তির দিয়ে কুকুরের চিৎকার-শব্দ বন্ধ করতে পারে, সে-মানুষ ধনুর্বেদের চরম দুটি রহস্য জানে— এক হল ক্ষিপ্রতা অর্থাৎ চরমতম হস্তলাঘব, আর দ্বিতীয়ত সে দূর থেকে শব্দ শুনেই লক্ষ্য ভেদ করতে পারে, লক্ষ্যবস্তু তার চোখে দেখার প্রয়োজন হয় না— লাঘবং শব্দবেধিত্বং দৃষ্টা তৎ পরমং তদা। পাণ্ডব-ভাইরা এই অদ্ভুত অস্ত্রশিক্ষা দেখে যতখানি আশ্চর্য হলেন, তার চেয়ে বেশি লজ্জা পেলেন। আর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যাঁর মন সক্ষমের অসূয়ায় শঙ্কিত হয়ে উঠল তিনি হলেন দ্রোণাচার্যের সবচেয়ে সুযোগ্য শিষ্য অর্জুন।
এবারে আর কুকুর দিয়ে নয়, বিস্মিত-চকিত পাণ্ডবেরা নিজেরাই চললেন সেই অচেনা মানুষটিকে খুঁজে বার করতে। খুঁজতে খুঁজতে সেই নির্জন বন্য প্রদেশে এসে দেখলেন— তাঁদেরই বয়সি একটি ছেলে বিরামহীন অস্ত্রাভ্যাস করে চলেছে স্বনির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপর— দদৃশুঃ পাণ্ডবা রাজন্ অস্যন্তমনিশং শরান্। লোকটার চেহারা তাঁদের পছন্দ হল না। পছন্দ হল না, কারণ ছেলেটি তাঁদের মতো নয়, তাঁর মুখ, চোখ, কান এবং হনুদ্বয়ের সংস্থান দেখে তাঁদের মনে হল না যে, ছেলেটি তাঁদের স্বজাতীয় জনজাতির ঘনিষ্ঠ কেউ। ফলত চেহারাটা তাঁদের কাছে বিকৃত মনে হল। যেহেতু তাঁকে চেনার প্রশ্ন নেই, অতএব অবধারিত জিজ্ঞাসা ছিল— তুমি কে, কার ছেলে— কো ভবান্ কস্য বেত্যুত। একলব্য এক মুহূর্তের জন্য অস্ত্রাভ্যাস বন্ধ করে সৌজন্যসূচক জবাব দিলেন, কিন্তু সে জবাব বড় সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ, সচেতন এবং মেদ-বর্জিত। একলব্য বললেন— নিষাদ-গোষ্ঠীর অধিপতি হিরণ্যধনু আমার পিতা, আমাকে দ্রোণাচার্যের শিষ্য বলে জানবেন। আমি একলব্য, অন্তত এই ধনুক-বাণের রহস্য জানতে আমি বিপুল পরিশ্রম করেছি— দ্রোণশিষ্যঞ্চ মাং বিদ্ধি ধনুর্বেদকৃতশ্রমম্।
পাণ্ডবরা একলব্যের পরিচয় শুনে অবাক হলেন। সে নিজেকে দ্রোণের শিষ্য বলছে, অথচ পাণ্ডবরা তাকে চেনেনই না। অল্প সময়ে যথাসম্ভব একলব্যের খবর নিয়ে পাণ্ডবরা দ্রোণের কাছে ফিরে এসে সব বললেন— সেই কুকুরের মুখে শরপতন থেকে আরম্ভ করে তার সমস্ত খোঁজখবর। দ্রোণ মুখে কিছু বললেন না, হয়তো তাঁর ভাল করে মনেও নেই। একে একে পাণ্ডবভাইরা সকলে চলে গেল, কিন্তু একান্ত নির্জনে রয়ে গেলেন অর্জুন। গুরুকে একা পেয়ে তিনি শুধোলেন— আমি এই রহস্য বুঝিনি কিছু। সেই আমি যেদিন রাত্রির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ অভ্যাস করছিলাম, সেদিন খুশি হয়ে আপনি আমাকে সগৌরবে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন— তোমার চেয়ে বেশি জানবে এমন অস্ত্রশিষ্য আমার আর কেউ থাকবে না— ভবতোক্তো ন মে শিষ্যস্ত্বদ্বিশিষ্টো ভবিষ্যতি। তা হলে আজকে কী দেখে এলাম, গুরুদেব! দেখে এলাম— আপনার আরও একজন শিষ্য আছে, যে আমার চেয়ে অনেক বড় তো বটেই, পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রবিদের চেয়েও সে অনেক বড়। সে নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর ছেলে একলব্য— অন্যোহপি ভবতঃ শিষ্যো নিষাদাধিপতেঃ সুতঃ।
গুরু দ্রোণাচার্য তাঁর ঘটনা-বহুল জীবনে বহু বিপরীত বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু এই প্রিয়শিষ্য অর্জুনের কাছে যেন মিথ্যাচারিতার দায়ে ধরা পড়লেন। সেদিনকার কথাটা তাঁর অবশ্যই মনে আছে যেদিন অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন— তোমার চেয়ে অধিক কোনও অস্ত্রবিদ আমার শিষ্যদের মধ্যে থাকবে না। কিন্তু এটা তিনি একেবারেই বুঝতে পারছেন না অথবা ভাবতেও পারছেন না যে, নৈষাদি একলব্য তাঁর শিষ্য হল কবে থেকে এবং তাঁকে তিনি এমন শিক্ষা দিয়েছেন, যার রহস্য অর্জুনের চেয়েও বেশি। একথা ক্ষীণ এবং অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে আছে বটে যে, নৈষাদি একলব্য তাঁর কাছে শিক্ষার জন্য এসেছিল বটে, কিন্তু দ্রোণ তো তাঁকে রাজপুত্রদের স্বাতন্ত্র্য এবং স্বতন্ত্র আভিজাত্যের নিরিখেই শিষ্যত্বে স্বীকার করেননি, তা হলে আজ অর্জুন এমন সাধিক্ষেপে আপন অভিমান জানাচ্ছেন কেন! তা ছাড়া অর্জুনের অভিমানটাও তো নিরর্থক, মিথ্যা নয়।
দ্রোণাচার্যের মনে পড়ে— চোখে না-দেখে শুধু শব্দ শুনে শরাঘাতে লক্ষ্য ভেদ করার রহস্য তিনি অর্জুনকে শেখাতে চাননি। ভেবেছিলেন, পুত্র অশ্বত্থামাকে এই রহস্যটা তিনি শিখিয়ে দেবেন, যাতে অন্তত এই একটি ব্যাপারে অশ্বত্থামা অর্জুনের থেকে একটু এগিয়ে থাকেন। কিন্তু ঘটনার এমনই সমাপতন যে, দ্রোণের আন্তরিক ইচ্ছে না থাকলেও একদিন তিনি দেখলেন— অর্জুনকে হাতে ধরে কিছুই শেখাতে হল না। রাতের অন্ধকারে, অন্য সমস্ত রাজপুত্রেরা যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তখন দ্রোণাচার্যের চকিতে ঘুম ভেঙে গেল ধনুকের জ্যা-আস্ফালনের শব্দে। দ্রোণ এসে দেখলেন— অন্ধকার বনস্থলীর মধ্যে দাঁড়িয়ে অর্জুন নিজেই আপন অভ্যস্ত বিদ্যায় শব্দবেধ-রহস্য শিখে ফেলেছেন। সার্থক গুরু হিসেবে দ্রোণাচার্যের এত আনন্দ হল যে, তিনি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। সেই রাতের আঁধারেই অর্জুনকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন বুকভরা গর্ব নিয়ে। বললেন— অর্জুন! তোমার অস্ত্রশিক্ষার চরম নৈপুণ্য ঘটাতে আমি এখন চেষ্টা করব, যাতে অন্য কোনও ধনুর্ধর পুরুষ তোমার সমান না হতে পারে— ত্বৎসমো ভবিতা লোকে… যথা নান্যো ধনুর্ধরঃ।
সুশিক্ষিত অধ্যাপকের মনে যদি ছাত্রের জন্য এই মার্মিকতা থাকে তবে তার উপযুক্ত শিক্ষার জন্য গুরু দ্বিগুণ, তিনগুণ পরিশ্রম করেন, সঙ্গে ছাত্রও পরিশ্রম করে। দ্রোণাচার্যও সেইরকম আরম্ভ করলেন। তিনি অর্জুনকে নিয়ে পড়লেন। ধনুক-বাণ সন্ধান করে লক্ষ্যবেধ করার চরম অভ্যাস অর্জুনের হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু হাতি-ঘোড়া-রথ ইত্যাদি চলমান বাহনের ওপর থেকে চলমান বাহনে বিচরণকারী শত্রুকে কীভাবে সময়াঙ্কে ধনুঃশরের আওতায় আনতে হয়, দ্রোণাচার্য সেটা চরম অভ্যাস করিয়ে দিলেন অর্জুনকে— ততো দ্রোণোহর্জুনং ভূয়ো হয়েষু চ গজেষু চ। আর অর্জুন! এমন আজ্ঞাবর্তী শিষ্য তো পাওয়া যায় না। দিন-রাত একাকার করে তিনি পরিশ্রম করতে লাগলেন আচার্যের প্রতিটি শিক্ষা মনে রেখে। রথে চড়ে, মাটিতে দাঁড়িয়ে, চলমান অশ্ব থেকে চলমান লক্ষ্য বিদ্ধ করতে তাঁর যাতে এতটুকু ভ্রান্তি না হয়— দ্রোণ সেই শিক্ষায় চরম অভ্যস্ত করে ফেললেন অর্জুনকে— রথেষু ভূমাবপি চ রণশিক্ষামশিক্ষয়ৎ।
দিন-রাত অস্ত্রশিক্ষার জায়গা থেকে এবার মানুষের ধর্মকথা বলি। যে আচার্য শিক্ষা দেন, তিনিও প্রথমত মানুষ তো। আমার নিজের জীবনে আমি দেখেছি— বিদ্যা-শিক্ষায় যিনি যত বড় আচার্যই হোন না কেন, আচার্যবৃত্তির সঙ্গে মানুষের মার্মিকতা একান্তভাবে জড়িয়ে থাকে। উপযুক্ত শিষ্যের ওপরে গুরুর পক্ষপাত আসে— এ আমার নিজের চোখে দেখা। আমি আমার আচার্য প্রয়াত ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায় এবং সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস ভট্টাচার্যকে দেখেছি। ভাল ছাত্র হলেই শুধু হয় না, ভাল ছাত্র হবার জন্য গুরু যদি ছাত্রের বশ্যতা এবং নিরন্তর পরিশ্রম দেখেন, তবে তার ওপরে গুরুর পক্ষপাত আসবেই। সেটা যে খুব দোষের তাও নয়। দোষ হয় তখনই, যখন পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়হীন মধ্যমানের ছাত্র-ছাত্রীও গুরুর পক্ষপাত লাভ করে, আর ঠিক এইখানেই পুরুষ ছাত্র হলে অর্থ এবং ছাত্রী হলে তাঁর দৈহিক রমণীয়তা বিপণনের অবিশ্রাম জনবাদ শোনা যায়। তবে দেখেছি, ছাত্র-ছাত্রীর চাইতেও মধ্যম মানের অধ্যাপকরাই মধ্যমেধার ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন বেশি এবং সেইখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নবম পত্রের অধিক নাব্যতা তৈরি হয়।
তবে আমার নিজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় যেহেতু আমি লবডঙ্কা পেয়েছি, তাতে বলার শক্তিটা জোরালো হয়ে উঠেছে এইজন্য যে, তেমন মাস্টার যদি তেমন মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছাত্রের আচার্যবৃত্তি করেন, তবে তাঁর পক্ষপাত আসতে বাধ্য; ছাত্রের পরিশ্রম এবং মেধাই এই পক্ষপাত ডেকে আনে। দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। যে-সব মূর্খেরা একলব্যকে বর্ণবিদ্বেষের বলি হিসেবে দেখেন, তাঁরা মহাভারতের কবির আশয় কিছু বোঝেননি। বিশেষত সেকালের দিনের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রের ওপরে পিতা-মাতার কোনও অভিভাবক-সুলভ অধিকার থাকত না। আচার্যই ছাত্রের দ্বিতীয় পিতা, বিদ্যাবংশের সেইটেই রেওয়াজ। ছাত্র-শিক্ষক যেখানে দিনরাত ওঠা-বসা করছে, ‘সহ নাব্বতু সহ নৌ ভুনক্তু’ আর সহবীর্যাধান যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের চিরন্তনী প্রার্থনা, সেখানে মেধাবী এবং পরিশ্রমী শিষ্যের ওপরে আচার্যের পক্ষপাত থাকবেই, চিরকাল ছিল, এখনও আছে।
অতএব অর্জুন যখন সাভিমানে আচার্যকে জানালেন— আপনিই না আমাকে বলেছিলেন— তোমার চাইতে বড় ধনুর্ধর আমার শিষ্যকুলে কেউ থাকবে না— তখন দ্রোণাচার্যের মনে চরম বিভ্রান্তি নেমে এল। তিনি তো মনেও করতে পারছেন না— পাণ্ডব-কৌরবদের সমান্তরাল আর কাকে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকী নিজের ছেলে অশ্বত্থামাকেও তিনি অর্জুনের চেয়ে বেশি শিক্ষা দেননি। আর অর্জন বলার পর নৈষাদি একলব্যের কথা তাঁর মনে পড়ছে, কিন্তু তিনি তো শিক্ষানীতির মনস্তত্ত্ব মেনে রাজপুত্রদের সঙ্গে একত্র তাঁকে শিক্ষা দিতে রাজি হননি, সেখানে তাঁর ‘রিজারভেশন’ ছিল; হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির আচার্য-নিয়োগের ভাবনা মাথায় রাখলে এখানে তাঁর ‘লিমিটেশন’ও ছিল। অতএব সে কী করে দ্রোণের শিষ্য হল! অথচ অর্জুন জোর গলায় সাভিমানে বলছেন— দেখে এলাম তাঁকে। হিরণ্যধনুর পুত্র নৈষাদি একলব্য। সে আপনার শিষ্য এবং শুধু আমি কেন, পৃথিবীর যে কোনও বড় ধনুর্ধর পুরুষের চেয়েও সে অনেক ওপরে। আপনি আমাকে যে কথা দিয়েছিলেন, তা যে সত্য নয়, বুঝলাম সেটা— অথ কস্মাদ্ মদবিশিষ্টঃ লোকাদপি চ বীর্যবান।
প্রিয়তম শিষ্যের মুখে এই অধিক্ষেপ অথচ তিনি একলব্যকে সাক্ষাৎভাবে শিক্ষা দেননি— দ্রোণাচার্য বিরাট ধন্ধে পড়ে গেলেন বটে, তবে অনেক বড় মানুষ বলেই কর্তব্য নির্ধারণ করতে তাঁর দেরি হল না— মুহুর্তমপি তং দ্রোণশ্চিন্তয়িত্বা বিনিশ্চয়ম্। তিনি সব্যসাচী অর্জুনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন নৈষাদি একলব্যের অরণ্য আবাসে— সব্যসাচিনমাদায় নৈষাদিং প্রতি জগ্নিবান্। দূর থেকেই দ্রোণ দেখতে পেলেন তাঁর ধূলিধূসর দেহ, মাথায় জটা পাকিয়ে গেছে যত্নের অভাবে, পরিধানে কৌপীন-মাত্র সার, অথচ অনবরত ধনুর্জ্যার আস্ফালনে বনস্থলীতে অন্য শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন— দদর্শ মলদিগ্ধাঙ্গং জটিলং চীরবাসসম্। নিন্দুক এক পণ্ডিত বলেছিলেন— এই যে দেখুন, দেখুন, আপনাদের ব্রাহ্মণ্যমণ্ডিত কবির ইঙ্গিতটা দেখলেন? যেই না আর্যেতর নিষাদ-জনের বর্ণনা, অমনি তার চেহারায় নোংরা, মাথায় জটা, পরার কাপড়টুকু পর্যন্ত জোটে না।
আমি বললাম— ভুল বুঝেছেন একেবারে। আমাদের মহাকাব্যের কবির নিজেরই কোনও ঠিক নেই, তাঁর নিজের জন্ম নিয়ে নিজেরই কত দুর্ভাবনা আছে, সেখানে তিনি অন্যের বর্ণ নিয়ে ভাবেন না, তিনি বরঞ্চ তপস্যা নিয়ে ভাবেন। একলব্যের যে চেহারা তিনি দেখিয়েছেন, এ হল খাঁটি তপস্বীর চেহারা, তিনি নিজেই এই চেহারায় এসেছিলেন অম্বিকা-অম্বালিকার বাসর-শয্যায় তপস্যার ফল দিতে। একলব্যের চেহারায় তিনি শর-সাধনার তপস্বী মূর্তি প্রকট করে তুলেছেন, একলব্যের জন্য তাঁর অনন্ত মায়া আছে।
দ্রোণাচার্য আস্তে আস্তে এসে পৌঁছলেন একলব্যের কাছাকাছি। অসাধারণ প্রতিক্রিয়া হল একলব্যের মধ্যে। যে গুরুর কাছে এককালে তাঁর শিষ্যত্ব প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, সে গুরু আজ নিজে এসেছেন তাঁর কাছে। একলব্য নিশ্চয়ই বুঝেছেন মনে মনে— গুরু বিনা কারণে আসেননি, এতকাল ধরে একাকী বাণাভ্যাস করতে করতে যার করাঙ্গুলিগুলি কর্কশ হয়ে গেছে, অথচ উপযুক্ত সংকেত এবং প্রশিক্ষণ দিতে আসেননি কেউ, আজ তাঁর কাছে সেই আচার্য এসে উপস্থিত হয়েছেন— আজন্ম-সাধনের আদর্শ। গুরু কী মনে করে তাঁর কাছে এসেছেন একলব্য জানেন না, কিন্তু গুরু তাঁকে শিষ্য বলে না মানলেও তিনি যাঁকে গুরু বলে মেনেছেন, সেই গুরুর কাছে প্রথম দিন তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, আজ তিনি তাই করলেন— আত্মসমর্পণ। যে কোনও দীক্ষার সময় গুরুর কাছে কায়-মনোবাক্যে আত্মসমর্পণ করতে হয় শিষ্যকে— সেটা গায়ত্রীদীক্ষার সময়েই হোক, অস্ত্রদীক্ষার সময়েই হোক, অথবা তান্ত্রিকী দীক্ষা। একলব্য সেদিন সে দীক্ষা পাননি, কিন্তু এতকাল পরে গুরুকে দেখে, বিশেষত আজ তিনি নিজে এসেছেন তাঁর কাছে— একলব্য সম্পূর্ণ শিষ্যের নম্রতায় গুরুর চরণে অবনত হলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন, দ্রোণের চরণ স্পর্শ করে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ছোঁয়ালেন মাটিতে দ্রোণের পায়ে— অভিগম্যোপসংগৃহ্য জগাম শিরসা মহীম্॥
তখনকার দিনে প্রণাম করতে গেলে নিজের নাম বলতে হত। একলব্য একেবারে ব্রাহ্মণ্য-চিহ্নিত নিয়মে গুরুর পূজার্চনা করে নিজের নাম বলে গুরুর কাছে আত্মনিবেদন করলেন উপযুক্ত শিষ্যের মতো— নিবেদ্য শিষ্যমাত্মানং তস্থৌ প্ৰাঞ্জলিরশ্রুতঃ। এইরকম দীন-বিনীত আচরণের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে নিজের মতে স্থির থাকা খুব কঠিন, বিশেষত যে মানুষ বহু দূর থেকে একজনকে আচার্যের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দ্রোণাচার্য নিশ্চয়ই একলব্যের শ্রদ্ধানির্মিত হাতে-গড়া নিজের মৃন্ময়ী মূর্তিখানি দেখেছিলেন। কিন্তু যতই খারাপ লাগুক, তিনি কী করবেন, সেটা নিশ্চয়ই আগেই ঠিক করে এসেছিলেন। অর্জুন তাঁর কাছে অভিমান প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই সিদ্ধান্ত তাঁর ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল— মুহূর্তমপি তং দ্রোণশ্চিন্তয়িত্বা বিনিশ্চয়ম্।
অতএব অধিকতর বন্দনায় অধিকতর দুর্বল হবার আগেই দ্রোণ একলব্যকে বলে ফেললেন— হে বীর! তুমি যদি আমার শিষ্যই হও, তবে আমার শিক্ষার বেতন দিতে হবে তো, বাছা! একটা দক্ষিণা তো দিতে হবে— যদি শিষ্যোহসি মে বীর বেতনং দীয়তাং মম। মহাভারতে দ্রোণাচার্যের এই উক্তিটি নিপাট এক অন্যায়ের চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, কেন না এরপর কী হবে আমরা জানি। কিন্তু এই পংক্তির গভীরে একটি গভীরতর সত্যও আছে। কারও কাছে গুরু তাঁর প্রশিক্ষণের বেতন প্রাপ্য দক্ষিণা চাইছেন মানেই কিন্তু তাঁকে শিষ্য বলে মেনে নিচ্ছেন প্রথমত। শিষ্য বলে স্বীকার না করলে তার কাছে দক্ষিণা চাওয়া যায় না। এটাই প্রমাণ করে যে, হীনবর্ণের কারণে দ্রোণাচার্য একলব্যকে শিষ্যত্বে বরণ করেননি, একথা ঠিক নয়। দক্ষিণা যখন চাইছেন, তখনই একলব্যের শিষ্যত্ব সিদ্ধ হয়ে গেছে। আর দ্রোণের মতো আচার্য তাঁকে শিষ্য বলে স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই একলব্য অভিভূত হয়েছেন এবং আচার্যের প্রতি এতটুকু সংশয় প্রকট না করেই তিনি বলেছেন সানন্দে— বলুন, আচার্য! আপনি কী চান আমার কাছে, আপনি নিজ মুখে বলুন, আমি দেব— কিং প্রযচ্ছামি ভগবন্ আজ্ঞাপয়তু মাং গুরুঃ— আপনি আমার কাছে যা চাইবেন, তার কোনওটাই আমার অদেয় নয়। আপনি আদেশ করুন।
দ্রোণাচার্য দ্বিতীয় চিন্তা না করে একলব্যকে বললেন— তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি আমায় দিতে হবে, সেটাই তোমার গুরুদক্ষিণা— তমব্রবীত্ ত্বয়াঙ্গুষ্ঠো দক্ষিণো দীয়তামিতি। কী নির্মম, কী কঠিন ছিল গুরুর মুখে এই উচ্চারণ। সে কালের ব্রহ্মবিদ গুরুরাও অনেক সময়ে এমন অপ্রাপ্য বস্তু শিষ্যদের কাছে প্রার্থনা করেছেন, যার দানাদানের মাধ্যমে শিষ্যের আনুগত্য তথা সেই দানসংপৃক্ত অন্য মানুষজন, রাজা-রাজড়ারও পরীক্ষা হয়ে যেত। কিন্তু তাতে শিষ্যদের সাংঘাতিক কিছু ক্ষতি হয়ে যায়নি। কিন্তু এ তো এমন এক গুরুদক্ষিণা দ্রোণ চাইছেন, যেখানে আচার্য সম্বোধনের সুযোগ নিয়েই তিনি শিষ্যস্থানীয় ব্যক্তির চরম ক্ষতি করতে চাইছেন। দ্রোণ একদিনের জন্যও একলব্যকে অস্ত্রশিক্ষা দেননি, অথচ একলব্য তাঁকে শুধু গুরু বলে মানেন বলেই গুরু তাঁর চরম ক্ষতি করে দিতে চাইছেন। এখানে যুক্তিতর্কের আশ্রয় নিয়ে একলব্য প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন গুরু দ্রোণাচার্যকে; কিন্তু অস্ত্রশিক্ষায় যে নিজেকে দীক্ষিত করেছে, তার কাছে নিজের প্রতিজ্ঞাও অনতিক্রম্য বলেই একলব্য ক্ষত্রিয়োচিত উদারতায় এতটুকুও মলিন হতে দিলেন না নিজের মনকে। যে উদারতায় তিনি দ্রোণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই উদারতাতেই তিনি দ্রোণগুরুর প্রার্থনা শোনামাত্রেই অবিচারে নিজের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করে দ্রোণের হাতে দিলেন— ছিত্ত্বাবিচাৰ্য্য তং প্রাদাদ্ দ্রোণায়াঙ্গুষ্ঠমাত্মনঃ।
যাঁরা আজকের দিনে জাতিবর্ণের বিচারে এই ঘটনাকে উচ্চতর বর্ণ কর্তৃক নিম্নবর্ণের দমন-প্রক্রিয়া বলে ভাবেন, তাঁদের জানাই— এই ঘটনা তার চেয়েও বড় কিছু। বস্তুত মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস মাতৃকুলে হীনজঠরে জন্মগ্রহণ করেছেন। একলব্যের ঘটনা বর্ণবিদ্বেষের ভাবনায় ভাববার মতো শীর্ণ কবিত্ব নিয়ে তিনি জন্মাননি। আমরা যেহেত বর্ণ-বিদ্বেষের মতো অতিসরল যুদ্ধ করেই প্রগতিশীল হই, অতএব এটা ছাড়া আর কিছুই আমাদের মাথায় আসে না। মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কবি যতখানি কবি, ততখানি ঐতিহাসিক এবং তার চেয়েও বড় তিনি অতি বড় এক সংবেদনশীল মানুষ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার উত্তরণ নিয়ে তাঁর মতো এমন করে কেউ ভেবেছেন কি না জানি না। মহাভারতের প্রতিপদ-চিন্তা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন— একলব্যের কাহিনিতে অন্তত তিনটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে, যার সঙ্গে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বগুলি মিশে গেছে। একটু বোঝাবার চেষ্টা করি।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে— একলব্যকে দ্রোণাচার্য যে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন না, তার সবচেয়ে বড় কারণ কিন্তু একলব্যের হীনবর্ণতা নয়, একজন হীনবর্ণ নিষাদ— সে রাজপুত্রদের সঙ্গে একত্রে শিক্ষা লাভ করলে কী কী সমস্যা হতে পারে, সেই চিন্তা করেই দ্রোণাচার্য একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন— তেষামেব অন্ববেক্ষয়া। মহাভারতের এই শ্লোকার্ধের ওপর টীকাকার নীলকণ্ঠের সামান্য একটু টিপ্পনী আছে। তিনি লিখেছেন— নৈষাদি একলব্য যাতে রাজপুত্রদের চেয়ে অস্ত্রশিক্ষায় অধিক না হয়ে যান, সেই চিন্তাতেই দ্রোণ একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন— তেষামন্ববেক্ষয়া তেভ্যোহধিকো মা ভূদিতি বুদ্ধ্যা। কথাটা নীলকণ্ঠ একটু ঘুরিয়ে বলেছেন এবং তা বলেছেন ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ আচার্যের প্রতি সম্মানবশত। দ্রোণাচার্যের চরিত্র-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে— অর্থ এবং ঐশ্বর্যের ব্যাপারে তাঁর লিপ্সা ছিল এবং সেই কারণেই নিজের মাতৃভূমি পাঞ্চাল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেক কষ্টে শ্যালক কৃপাচার্যের শংসাপত্রে তিনি কুরুবাড়ির চাকরি পেয়েছেন, নৈষাদি একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে কোনও ক্রমে সে যদি রাজপুত্রদের চেয়ে ভাল অস্ত্রশিক্ষা লাভ করে অথবা নৈষাদির সাহচর্যে যদি রাজপুত্রদের চরিত্রে কোনও অনার্যতা চলে আসে, তা হলে দ্রোণাচার্যের পাকা চাকরিটি যাবে এবং দুগ্ধ-ক্ষীরের জীবন নষ্ট করে তাঁকে আবার ফিরতে হবে পিটুলিগোলা দরিদ্র জীবনে। নইলে একলব্যকে অর্থের বিনিময়ে অথবা উপযুক্ত গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে অস্ত্রাভ্যাস করাতে দ্রোণের খুব আপত্তি থাকবার কথা নয়। দক্ষিণা চাইবার সময় তিনি একলব্যকে শিষ্য হিসেবে মেনেও নিয়েছেন, নইলে দক্ষিণা চাইবারই প্রশ্ন আসে না।
আমাদের দ্বিতীয় প্রস্তাব পেশ করতে গেলে জীবনের বাস্তব এক সত্য স্বীকার করে নিতে হবে নির্লজ্জভাবে। আমি আমার জীবনের সত্য যতটুকু উপলব্ধি করেছি তা অন্যের অভিজ্ঞতাতেও সত্য হতে পারে বলেই মহাভারতীয় চরিত্রের ক্ষেত্রেও একান্ত বাস্তব হয়ে উঠবে। এটা তো মানতেই হবে যে, শিশুশিক্ষা থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত যে কোনও একটি ক্লাসের সমস্ত ছাত্র একরকম হয় না। বুদ্ধিবৃত্তির ভেদ থাকে, গ্রহণ-মনন-অবধারণের ভেদ থাকে, সাহচর্যের ভেদ থাকে এবং অবশ্যই গুরুমশাইদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও ওই একই রকম ভেদ কাজ করে। কিন্তু কল্পিতভাবে যদি সার্থক পণ্ডিত অধ্যাপকের কথা ভেবে নিই— সত্যি বলতে কী, আমার নিজের জীবনেই এমন দেখেছি যে, ভাল ছাত্র, পরিশ্রমী এবং মেধাবী ছাত্রের ওপর নিরপেক্ষ শিক্ষকের পক্ষপাত তৈরি হয়। আমি সেই সব নিম্ন মানের অধ্যাপকের কথা বলছি না, যাঁরা অর্থ অথবা অন্য কোনও সরস আকর্ষণে ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দেন এবং সজীব প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করে দেন। বস্তুত সার্থক শিক্ষকের ক্ষেত্রে এ-প্রশ্নই আসে না, তাঁদের পক্ষপাতের স্পর্শ পাওয়া যায় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। মেধাবী পরিশ্রমী ছাত্রের জন্য সেইসব শিক্ষকের ব্যক্তিগত চেষ্টা, অনুধ্যান, অর্থসাহায্য এমনকী ব্যক্তিগত ত্যাগও আমি কত দেখেছি। বলতে পারেন— এমনটা হয়। আপনি সার্বিক গণতান্ত্রিকতা দেখিয়ে শিক্ষকের এই সংবেদনশীল অনুভূতি দূর করতে পারবেন না। অযৌক্তিক হলেও উপযুক্ত ছাত্রের প্রতি উপযুক্ত শিক্ষকের এই পক্ষপাত থাকে।
দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার ক্লাসে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র হলেন অর্জুন। তাঁর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, বিনয় এবং বুদ্ধি এতটাই ছিল যে, দ্রোণাচার্য নিজের ছেলে অশ্বত্থামাকেও সেই মূল্য দিতে পারেননি, যা তিনি অর্জুনকে দিয়েছেন। অর্জুনের বিনয়সম্পন্ন মেধা তাঁকে এতটাই আপ্লুত করেছিল যে, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন— তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আর কাউকে তিনি অর্জুনের সমান হতে দেবেন না। হয়তো এই প্রতিজ্ঞা এবং শিষ্য-বাৎসল্যের কারণেই একলব্যের প্রতি তাঁর এই নিষ্ঠুর আচরণ খানিকটা সযৌক্তিক হয়ে ওঠে, খানিকটা বা বিপরীত অনুভূতিতে সহনযোগ্যও হয়ে ওঠে। বিশেষত যে-অর্জুনের জন্য তিনি নিজপুত্র অশ্বত্থামাকেও রেয়াত করেননি, সেই তিনি একলব্যের প্রতি নিষ্ঠুর হবেন, তাতে আশ্চর্য কী!
যেটা বলতে চাই, সেটা হল— দ্বৈপায়ন ব্যাসের মতো মহাকাব্যের কবি স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষত বর্ণবিদ্বেষের আগুন পোয়ান না, বরঞ্চ মহাকবির কাজ হল— কাব্য লিখতে লিখতে, কাব্যের চরিত্র বর্ণনা করতে করতে মনুষ্যজীবনের বিচিত্র অভিসন্ধিগুলি নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরা। এখানে তিনি নিজের প্রিয়তম নায়কটিকেও রেহাই দেন না এবং সেটাই আমাদের তৃতীয় প্রস্তাব।
একটা সজীব সমাজের মধ্যে শিক্ষক অধ্যাপকদের মেধার প্রতি পক্ষপাতটাও যেমন নিতান্ত বাস্তব, তেমনই বাস্তব হল— যিনি নায়ক হয়ে ওঠেন, তাঁকে নিজের নায়কত্ব ধরে রাখবার জন্য উপযুক্ত প্রয়াসও নিতে হয়। এটা লিডারশিপ তৈরির অন্যতম অঙ্গ। আজকের দিনের করপোরেট অফিসেই দেখুন, অথবা দেখুন বহুদলীয় রাজনীতিতে অথবা কীর্তিমান পুরুষের মধ্যেও— নিজের প্রভাব, নিজের স্বতন্ত্রতা, নিজের নায়কত্ব এবং নিজের কীর্তি বজায় রাখার জন্য অন্যের প্রভাব, অন্যের ক্ষমতা দমিয়ে রাখার কৌশলও জানতে হয়। হয়তো এর মধ্যে একটা ‘প্রোফেশনালিজম’ও আছে এবং দৈনন্দিন উচ্চাকাঙক্ষার দর্শনে সেটা হয়তো অন্যায়ও নয়। লক্ষ করে দেখবেন— অর্জুন যখন অস্ত্রজীবীদের আপন ক্ষেত্রে শ্রুতকীর্তি নায়ক হয়ে গেছেন, তখন তিনি অনেক উদার, অনেক বিরাগসম্পন্ন, কিন্তু যেদিন তিনি নায়ক হয়ে উঠছেন এবং এখনও যখন তিনি প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত নন, সেদিন তিনি কতটা ‘প্রোফেশনাল’।
অর্জুন একলব্যের অস্ত্রচালনা দেখে, অস্ত্রচালনার ক্ষিপ্রতা দেখে এক মুহূর্তেই বুঝে ফেলেছিলেন যে, এই মানুষটি ভবিষ্যতে তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি হন, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই শত্রুপক্ষে থাকবেন সবসময়। অর্জুনের মধ্যে সেদিন কোনও ক্ষত্রিয়োচিত বিশালতা কাজ করল না, কাজ করল না কোনও রাজোচিত ঔদার্য। তিনি বলতে পারলেন না— এসো, আমরা সম্মুখ যুদ্ধ করি, পরস্পর প্রহার করি একে অপরকে, যত পারি দেখাই ধনুক-বাণের প্রয়োগ-নৈপুণ্য। অর্জুন এই সব আদর্শ ক্ষত্রিয়নীতির ধারে-কাছে গেলেন না। মহাকাব্যের কবি কিন্তু লুকোননি, ভবিষ্যতে যে অর্জুন তাঁর মহাকাব্যের ছন্দে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধনায়ক হয়ে উঠবেন, সেই অর্জন তাঁর নায়কত্ব গঠনের দিনে কতটা কৌশলী, কতটা নির্মম এবং কতটা ‘প্রোফেশনাল’— সেটা কিন্তু লুকিয়ে রাখলেন না মহাকবি। অর্জুনের মাধ্যমে তিনি বাস্তব জীবনের সত্যগুলি উদ্ঘাটন করছেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন— কীর্তিমান হবার জন্য অন্যের কীর্তিকে কীভাবে দমন করতে হয়, বীরোচিত উদারতায় নয়, বরঞ্চ প্রয়োজনে, কৌশলে। অর্জুন নির্লজ্জের মতো গুরু দ্রোণের কাছে সাভিমানে বলেছিলেন— আপনি বলেছিলেন, আমার চাইতে অস্ত্রদক্ষ শিষ্য আর আপনার কেউ থাকবে না, আজ দেখে এলাম— আমার চাইতেও কুশলী শিষ্য আপনার আছে। অর্জুনের মতো অস্ত্ৰকুশল প্রিয়শিষ্যের কথা শুনে দ্রোণ লজ্জা পেয়েছেন এবং তিনি তাঁর কথা রেখেছেন একলব্যকে চিরজন্মের মতো খুঁতো করে দিয়ে।
ব্যাস সমাজের সত্যটুকু প্রকাশ করে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন— যত বড় মানুষই তুমি হও না কেন, নায়ক হতে গেলে সেই নায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথে চরম সংকীর্ণতার আশ্রয় নিতে হয়, নিজের কীর্তি স্থাপনের পাশাপাশি সেখানে অন্যের কীর্তি নষ্ট করতে হয় ছলে, বলে, কৌশলে। অর্জুন এই কাজটা করেছেন দ্রোণাচার্যের মাধ্যমে, তাঁর স্নেহ-প্রতিজ্ঞার সুযোগ গ্রহণ করে, তাঁর স্নেহকে ‘একসপ্লয়েট’ করে। আজও একজন ‘প্রোফেশনাল’ সফল মানুষের বড় হওয়ার পথে এই সব ছোট-বড় সংকীর্ণতা আছে; উচ্চতর প্রভাবশালীর মাধ্যম গ্রহণ করে সমস্তরীয় তখা ঈষদুচ্চ ব্যক্তিত্বের প্রভাব খর্ব করা হয় অথবা তাঁর ডানা ছাঁটার ব্যবস্থা হয় নিপুণতর কৌশলে, হঠক্রিয়ার মারণ-উচাটন-বশীকরণ পদ্ধতিতে।
একলব্যের শরচালনার প্রধানতম সহায়— তাঁর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠই এখানে কাটা গেল। দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করে অর্জুনের অপ্রতিম নায়ক হবার পথ পরিষ্কার করে দিলেন। একলব্য ক্ষত্রিয়োচিত ভঙ্গিতে বিনা বিচারে অন্তশ্চিন্তিত গুরুর আদেশ মেনে নিলেন বটে, কিন্তু নিজেই নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করার পর কী অসহায় লাগছিল তাঁকে! কী অসহায় করুণভাবে একলব্য তাঁর অবশিষ্ট চার আঙুল দিয়েই ধনুকে বাণ যোজনা করার চেষ্টা করছিলেন বার বার! বার বার তিনি দেখছিলেন, পরীক্ষা করে দেখছিলেন— চার আঙুলে বাণ ছুড়লে কতটা দূর যাচ্ছে তাঁর বাণ, কতটাই বা তাঁর গতি— ততঃ শরন্তু নৈষাদিরঙ্গুলীভির্ব্যকর্ষত। কিন্তু না, যেমনটি তিনি ভাবছিলেন, সেই উত্তপ্ত মানসিক গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণগুলি আর তেমন জোরে ছুটছিল না। নির্বিচারে গুরুবাক্য পালন করলে অভিমত পুণ্যসঞ্চয়ের মাধ্যমে পুনরায় যে পূর্বশক্তি ফিরে আসে, সে শক্তিও তো ফিরে এল না তার চার আঙুলে। এমনও তো দৈব সুধাপাক ঘটল না তাঁর জীবনে যে, দ্রোণাচার্য পরম প্রসন্ন গুরুর মতো বলবেন— যাও বৎস! আমি তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। তোমার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পুনরায় যুক্ত হোক তোমার ধনুর্জ্যাস্ফালন-কর্কশ দক্ষিণ হস্তদণ্ডে। সেসব কিছুই হল না। বার বার একলব্য তাঁর অবশিষ্ট অঙ্গুলগুলি দিয়ে শরাকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকলেন, আর বারবার সেই শরগুলি তাঁর পূর্বনির্দিষ্ট, অভীষ্ট লক্ষ্যস্থল ভ্রষ্ট হয়ে অনেক আগেই পড়ে যেতে লাগল।
মহাভারতের কবি একলব্যের এই অক্ষমতার বিপ্রতীপ চিত্রে একলব্যের ওপর নিজের মমতাটুকু বিবৃত করেছেন দ্রোণ এবং অর্জুনের অন্তর ব্যাখ্যান করে। দেখিয়েছেন— যেই না একলব্যের চতুরঙ্গুলি-নিক্ষিপ্ত বাণগুলি পূর্বের গতিবেগ হারিয়ে লক্ষ্যস্থল ভ্রষ্ট হতে আরম্ভ করল, অমনই দ্রোণাচার্য ভাবলেন— যাক! আমি অর্জুনকে কথা দিয়েছিলাম। আমি কথা রেখেছি, আমার সাক্ষাৎ শিষ্য অর্জুনকে আর কেউ কোনওদিন পরাজিত করতে পারবে না— দ্রোণস্য তস্য বাগাসীন্নান্যেহভিভবিতাহর্জুনম্। আর অর্জুন! যিনি ভবিষ্যতে মহাভারতের মহানায়ক হয়ে উঠবেন— তাঁর গা থেকে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নামল। বনের মধ্যে একাকী স্বশিক্ষিত নিষাদ-পুত্র যেভাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সঙ্গে বিনা প্ররোচনায় যুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর যদি বা ইচ্ছাকৃত তির্যক যুক্তিতে তাঁকে প্ররোচিত করে একলব্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতেনও, তা হলেও জয়ের সম্ভাবনা ছিল না বলেই ভবিষ্যতের এই দুর্দম্য শত্রুর মূল শক্তিটুকুই তিনি কেড়ে নিলেন গুরুকে ব্যবহার করে। একলব্যের শরগতির তীব্রতা কমে যেতেই তাঁর দুর্ভাবনার জ্বর নেমে গেল— ততোহর্জুনঃ প্রীতমনা বভূব বিগতজ্বরঃ।
অর্জুন বড় খুশি হলেন বটে, কিন্তু মহাভারতের কবি তাঁর সমুদ্রগম্ভীর কবির হৃদয় থেকে আর একটি শব্দও উৎসারিত করলেন না। তিনি খুশি হননি, তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সমস্ত সমাজের মধ্যেই এই সার্বকালিক অভিসন্ধি থাকে, যেখানে একজন নিম্নবর্গের মানুষ, যে আপন শিক্ষায় নিতান্ত আত্মগুণে সমাজের সবচেয়ে বড় মানুষটি হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, তাকে বড় ঘরের সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ কীভাবে কোনও কৌশলে স্তব্ধ করে দেয়। মহাভারতের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস এই সমাজটাকে দেখেছেন, তিনি নিজে এই বিখ্যাত রাজবংশের অন্যতম পিতা। যাঁদের সঙ্গে তিনি ওঠাবসা করেন, যাঁদের সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক এবং সহবাসের পরিচয় আছে, তাঁদের তিনি পথে বসিয়ে দেন না, তীব্র নিন্দায় তাঁদের পঙ্কলিপ্ত করেন না; কিন্তু তাঁর ঋষির নৈর্ব্যক্তিক সন্ন্যাসী হৃদয় এবং কবিজনোচিত বেদনাবোধ রাজবাড়ির শিক্ষাস্রোতের মধ্যে হঠাৎই নিষাদপুত্র একলব্যের কাহিনির অবতারণা করে এবং তা প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে— স্রোতের ওপরে ভাসা খড়কুটোর মতো। তবু তারই মধ্যে বাস্তবটা তিনি বুঝিয়ে দেন, যে কোনও সমাজের কঠিন বাস্তব— যা এখনও হয়। সমাজের নিম্নবর্গ, স্বশিক্ষার প্রয়াস এবং তার চেয়েও বড় উচ্চতর সামাজিকের মুখোশ— যেখানে একতরের নায়কত্বলাভের পথ মসৃণ হয়। দ্রোণাচার্যের মতো বিশিষ্ট পুরুষের অন্যকৃত অপব্যবহারে, যেমনটি এখনও হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনীতির কলঙ্কিত ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত অভ্যুদয়ে।
মহাকাব্যের কবি খুশি হননি। যেমন আকস্মিকভাবে তিনি নৈষাদি একলব্যের সম্ভাবনাময় চরিত্রটির অবতারণা করেছিলেন, তেমনই আকস্মিক ভাবে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেছেন স্বশিক্ষিত বিদ্যার অপমানে। বর্ণাভিমানী ক্ষত্রিয় রাজপুত্রেরা সবচেয়ে উপযুক্ত গুরুর কাছে অর্থের বিনিময়ে সবচেয়ে ভাল প্রশিক্ষণ পেলেও হীনবর্ণ অন্য জন স্বশিক্ষায় যে বিদ্যালাভ করেছে, তার তীক্ষ্ণতা, তার মনঃসংযোগ অথবা তার ক্ষমতা যে অনেক বেশি হতে পারে, সেটা আকস্মিক এই একলব্যের কাহিনি বলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কৃষ্ণবর্ণ কবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস।
খুব আশ্চর্য লাগে ভেবে— যে সক্ষম চরিত্রটির ওপর কবির এত মমতা, যাঁকে অর্জুন এবং দ্রোণাচার্যের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের বিপ্রতীপ ধারায় মহান করে দিয়েছেন, যাঁর জন্য গুরু এবং শিষ্যকে একত্রে ছলনার আশ্রয় নিতে হল, সেই চরিত্রকে মহাভারতের কবি অসাধারণ নির্মমতায় ভুলেই গেলেন বুঝি! আমরা জানি— না ভুলে তাঁর উপায় নেই। মহাকাব্যের বিরাট পরিমণ্ডলের মধ্যে প্রধান কাহিনিসূত্রের প্রতি যেখানে নিষ্ঠা রাখতেই হয়, সেখানে না ভুললে মহাকবির উপায় কী? আরও একটা ব্যাপারও আছে— অর্জুনকে যেখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছে মহাকবিকে, সেখানে তাঁর নায়কত্ব-প্রতিষ্ঠার অন্যতম কণ্টক উন্মূলিত হতেই তিনি একলব্য সম্বন্ধে নীরব হয়েছেন। তবে অসাধারণ নিপুণতায় এবং একলব্যের প্রতি কবিজনোচিত বেদনা-বোধে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, নায়ক হয়ে ওঠার পিছনে অতিশুদ্ধ অর্জুনের মতো নায়কত্বের অশুদ্ধতার পথ বেছে নিতে হয় কখনও কখনও। আর তিনিই যখন অপ্রতিম নায়ক হয়ে ওঠেন, তখন লোকে তাঁর পূর্ব কলঙ্ক ভুলে যায়; মহাকবি নিজেই তাঁকে ভুলে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, লোকে কীভাবে ভোলে অথবা ভুলতেই হয়।
লক্ষণীয়, একলব্য অঙ্গুষ্ঠ কর্তন করে গুরুদক্ষিণা দেবার পরেও তিনি অস্ত্রসাধনা চালিয়ে যেতে ভোলেননি। গুরুর সামনে যে সাবলীল বলিষ্ঠ আচরণ করেছিলেন তিনি, তার জন্য সামান্য অনুতাপও তাঁকে করতে দেখিনি, এমনকী দ্রোণ এবং অর্জুনের মূল উদ্দেশ্য প্রকট হয়ে ওঠার পরেও একটি তিরস্কার শব্দও উচ্চারিত হয়নি একলব্যের মুখ থেকে। আর কী অসহায়ভাবে তাঁকে দেখেছি— বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চলে যাবার পরেও একলব্য বোঝার চেষ্টা করছেন— অবশিষ্ট অঙ্গুলিগুলি দিয়ে কতদূর এবং কত শীঘ্র তিনি বাণমোচন করতে পারেন— ততঃ শরন্তু নৈষাদিরঙ্গুলীভি ব্যকর্ষত। আমরা জানি— বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ না থাকায় তাঁর বাণের গতি কমে গিয়েছিল এবং যত শীঘ্র তিনি পরের পর বাণ নিক্ষেপ করতে পারতেন, সেটাও বুঝি আর সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু অভ্যাস, অভ্যাস মানুষকে কোন জায়গায় না পৌঁছতে পারে! অঙ্গুষ্ঠ হারানোর অব্যবহিত পরমুহূর্তে একলব্যের যতই অসহায়তা থাক, অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ যেমন অঙ্গবৈকল্য থাকা সত্ত্বেও নিজের মতো করেই কর্ম-সম্পাদনের অভ্যাস করেন, একলব্য সেই অভ্যাসে আপন চতুরঙ্গুলি ব্যবহার করেই বাণমোক্ষের নিজস্ব উপায় বার করে নিলেন। হয়তো এই চেষ্টায় তিনি অর্জুনকে অতিক্রম করতে পারলেন না, কিন্তু অন্য অনেকের চেয়েই তিনি খ্যাতিমান বীর বলে গণ্য হয়েছিলেন। অন্তত প্রতিপক্ষ যোদ্ধারা তাঁকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখতেন।
একলব্যের পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে আমাদের কাছে কাহিনিগত প্রমাণ খুব বেশি নেই। কিন্তু নিষাদগোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে তিনি কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। এই রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে তাঁদের বিরোধী রাজাদের যতই যুদ্ধ হোক এবং সেই যুদ্ধে ভীম-অর্জুন, নকুল-সহদেবই সকলেরই জয়-ঘোষণা হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি— এই বিজয়গুলির মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে, হয়তো বা রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানকারীর প্রতি একটা কৃত্রিম সম্মানও। নইলে, শিশুপাল, রুক্মী— এদের মতো শাশ্বত শত্রুরা যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপস্থিত হতেন না। এই রাজসূয় যজ্ঞের আসরেই মহামতি ভীষ্ম যখন যুধিষ্ঠিরের অর্ঘ্যদানের জন্য কৃষ্ণের নাম প্রস্তাব করলেন, সেখানে শিশুপাল কৃষ্ণ ছাড়া অন্যান্য কিছু উপযুক্ত রাজাদের নাম করেছিলেন। সেখানে যেমন বিরাট, দ্রুপদ, দ্রোণাচার্যের মতো পাণ্ডব অনুকূল ব্যক্তিত্বের নাম ছিল, তেমনি পাণ্ডব-প্রতিপক্ষদের মধ্যেও বেশ কিছু মহাস্ত্রবিদ পুরুষের নাম ছিল। এখানে কর্ণ, অশ্বত্থামা, রুক্মীর মতো মানুষের পরে নিষাদরাজ একলব্যের নামও কিন্তু পরম মর্যাদায় উচ্চারিত হয়েছে। শিশুপাল বলেছেন— রুক্মিণীর ভাই রুক্মী থাকতে, অথবা একলব্যের মতো মহাবীর থাকতে তুমি কৃষ্ণকে অর্ঘ্যদান করলে কেন, যুধিষ্ঠির— নৃপে চ রুক্মিণি শ্রেষ্ঠে একলব্যে তথৈব চ।
এই উল্লেখ থেকে বুঝতে পারি যে, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠহীন একলব্যের মর্যাদা কিছু কম নয় এবং মহাবীর হিসেবেও তাঁর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। আরও একটা সংবাদ পরিষ্কার হয়ে যায়। সেটা হল— যে ছলনায় এবং যে মন্ত্রণায় অর্জুন গুরু দ্রোণাচার্যের মাধ্যমে স্বকার্যসাধন করেছিলেন, তা নৈষাদি একলব্যকে পাণ্ডবদের চিরশত্রুতে পরিণত করে। কৃষ্ণের চিরশত্রু রুক্মীর সঙ্গে একত্রে এক নিশ্বাসে একলব্যের নাম উচ্চারিত হওয়ায় আমরা বুঝতে পারি— গুরুস্বরূপ দ্রোণাচার্যকে মুখে কিছু না বললেও অর্জুনের এই নির্মম ছলনা তিনি ক্ষমা করেননি। তিনি পাণ্ডবদের তথা পাণ্ডব-পক্ষপাতী কৃষ্ণকে একেবারেই ক্ষমা করেননি। তাঁরা তাঁর শাশ্বত শত্রুতে পরিণত হয়েছেন।
তবু এরই মধ্যে কতগুলো কৃত্রিম এবং যান্ত্রিক ঘটনা ঘটে যায়। যেখানে শত্রুতার মধ্যেও বন্ধুত্বের প্রার্থনা থাকে। এ অনেকটা চিহ্নিত বিরোধী ভোটারের কাছে ভোট ভিক্ষা করার মতো চটুল এবং অর্থহীন গণতান্ত্রিকতা। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে যখন কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধ-বাজনা বেজে উঠল, তখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ শত্রু-মিত্র সবার কাছে দূত পাঠাতে বললেন পাণ্ডবদের। তাঁর এইরকম মত ছিল যে, আগে আগে স্বপক্ষে যোগ দেবার প্রার্থনা জানালে পূর্বপ্রার্থীদের দলেই যোগ দেন রাজারা। অতএব অনেক রাজাদের সঙ্গে তিনি একলব্যকেও তাঁর ছেলেদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য পাণ্ডবদের পরামর্শ দিয়েছিলেন— ভূরিতেজা দেবকশ্চ একলব্যঃ সহাত্মজৈঃ।
তবে মহাভারতের অন্যান্য প্রমাণে একলব্যের প্রসঙ্গটা এখানে ঠিক নয় বলেই মনে হয়। অথবা ইনি অন্য কোনও একলব্যও হতে পারেন। ‘নিষাদ’ শব্দটি একলব্যের সঙ্গে উচ্চারিত না হওয়ায় অন্য কোনও একলব্য হওয়া অসম্ভব নয়। অথবা এমনও হতে পারে যে, একলব্যের ছেলেদের কথা বলতে গিয়ে পরম গৌরবে একলব্যের নাম উল্লেখ করেছেন দ্রুপদ। কেন না মহাভারতের দ্রোণপর্বে কৃষ্ণের মুখে দু’-দু’বার একলব্যের কথা যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে তাতে মনে হয়— পাণ্ডব-কৌরবের মহাযুদ্ধের পূর্বেই একলব্য নিহত হয়েছিলেন, তবে সেটা কৃষ্ণের হাতে, না বলরামের হাতে, সেটা নিয়ে সামান্য সংশয় থাকতে পারে।
মহাভারতের দ্রোণপর্বে ভীমপুত্ৰ ঘটোৎকচ মারা যাবার পর পাণ্ডবদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, কিন্তু কৃষ্ণ এই মৃত্যুতে খুশিই হয়েছিলেন। তাঁর খুশির কারণ হল— কর্ণ যে মহাশক্তি অর্জুন-বধের জন্য রেখে দিয়েছিলেন, সেই শক্তি ঘটোৎকচের ওপর প্রয়োগ করতে বাধ্য হন কর্ণ। এতে অর্জুনের জীবন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়ায় কৃষ্ণ তাঁর শোকাহত সখা অর্জুনকে বলেছিলেন— তোমার অথবা তোমাদের হিতের জন্য বিভিন্ন উপায়ে আমাকে একে একে অনেক শত্রুকেই আগেভাগে নিধন করতে হয়েছে। তা নইলে আজকে এত সহজে যুদ্ধ করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব হত না— একৈকশো নিহতাঃ সর্ব এতে। এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণ যে নামগুলি করেন, সেই সব শত্রুগোষ্ঠীর রাজাদের মধ্যে যেমন জরাসন্ধ, শিশুপালের মতো ভয়ংকর নাম আছে, তেমনই আছে নিষাদরাজ একলব্যের নাম—
জরাসন্ধশ্চেদিরাজো মহাত্মা/মহাবাহুশ্চৈকলব্যো নিষাদঃ।
কৃষ্ণের বক্তব্যের মধ্যে যে একটা জোরালো যুক্তি আছে, সেটা মানতেই হবে এবং একবার যদি বা জরাসন্ধ-শিশুপালের সঙ্গে একলব্য নিষাদের নামোল্লেখ শুধুমাত্র সাধারণীকরণের পর্যায়ে পড়ে, তা হলে দ্বিতীয়বার একলব্যের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করে কৃষ্ণ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, একলব্যও খুব কম বীর ছিলেন না, এমনকী নিরঙ্গুষ্ঠ অবস্থাতেও যে তাঁর শক্তি কম ছিল না, সেটা কৃষ্ণের বক্তব্য থেকে বেশ বোঝা যায়। অবশ্য অর্জুনের বন্ধুকৃত্য করার কথা বলতে নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে একটু হয়তো বাড়িয়েই বলেছেন কৃষ্ণ। তিনি অর্জুনকে বলেছেন— ভবিষ্যতে যাঁরা তোমার অপ্রতিরোধ্য প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারতেন, ওঁদের আমি নানা উপায়ে আগে থেকেই হত্যা করেছি বা করিয়েছি। যেমন জরাসন্ধ, যেমন শিশুপাল। এঁদের কারও সঙ্গেই কৃষ্ণ সম্মুখযুদ্ধ করেননি। কৃষ্ণ এঁদের প্রত্যেককে কূটযুদ্ধে পরাস্ত করেছেন, হত্যাও করেছেন— যোগৈ স্তৈ-স্তৈ-স্তদ্ধিতার্থং ময়ৈব। এই উপায়ের কথা বলতে গিয়েই কৃষ্ণ নিষাদ একলব্যের কথা বলেছেন এবং বলতে গিয়ে কথার তোড়ে একটু বেশিই বলে ফেলেছেন। কৃষ্ণ বলেছেন— তোমার ভালর জন্যই আমি নিষাদ একলব্যের আঙুল যাতে কাটা যায় সেই ব্যবস্থা করেছিলাম— তদ্ধিতার্থঞ্চ নৈষাদিরঙ্গুষ্ঠেন বিয়োজিতঃ। কীভাবে নৈষাদি একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কাটা যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন? কৃষ্ণ বলেছেন— আমি আচার্য দ্রোণের মাধ্যমে, তাঁকে একলব্যের গুরুস্থানে বসিয়ে তাঁরই আদেশ-বলে একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ-কর্তনের ব্যবস্থা করেছিলাম— দ্রোণেনাচার্যকং কৃত্বা ছদ্মনা সত্যবিক্রমঃ।
পাণ্ডব অর্জুনের জন্য কৃষ্ণ অনেক কিছুই করেছেন বটে, কিন্তু একলব্যের আঙুলকাটার ব্যবস্থাও তিনিই করেছেন— এই কথাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আসলে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠযুক্ত একলব্য নিষাদ যে কী ভয়ংকর এবং কতটা অপ্রতিরোধ্য সেটা বলতে গিয়েই এই অতিশয়োক্তিটুকু কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন— একলব্য বনচর নিষাদ হলে কী হবে, নিজের মর্যাদা এবং নিজের বীরত্ব সম্বন্ধে সে এতটাই সচেতন যে, তাঁকে যুদ্ধে অতিক্রম করা ভীষণই কষ্টসাধ্য ছিল— অতিমানী বনচরো… নৈষাদির্দৃঢ়বিক্রমঃ। তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ যদি দ্রোণের কৌশলে কাটা না পড়ত, তা হলে দেবতা, দানব সর্প, গন্ধর্ব— কারও পক্ষে একলব্যকে যুদ্ধে পরাস্ত করা সম্ভব হত না, সেখানে মানুষ তো কোন ছার— একলব্যং হি সাঙ্গুষ্ঠম্ অশক্তা দেবদানবাঃ।
সাঙ্গুষ্ঠ একলব্যের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল, সেই কবেই তো তাঁর অঙ্গুষ্ঠ চলে গেছে গুরুদক্ষিণায়, কিন্তু নিরঙ্গুষ্ঠ একলব্যও যে শুধুমাত্র নিরন্তর অস্ত্রাভ্যাসে নিজেকে আরও একভাবে তৈরি করে নিয়েছিলেন এবং তাঁকেও যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে অর্জুনের হিতের জন্যই জগৎ থেকে সরিয়ে দিতে হয়েছে, সেটা কৃষ্ণের কথায় বোঝা যায়। কৃষ্ণ বলেছেন— অঙ্গুষ্ঠ গেলে কী হবে, বাণগুলিকে সে এখনও মুষ্টি পাকিয়ে ধরে দৃঢ়ভাবে এবং দিন-রাত অবিরাম এইভাবে বাণমোক্ষণ অভ্যাস করতে করতে পূর্বের ক্ষমতা অনেকটাই সে ফিরে পেয়েছে— দৃঢ়মুষ্টিঃ কৃতী নিত্যমস্যমানো দিবানিশম্। এতটা বিক্রান্ত হয়ে ওঠার ফলেই হয়তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই তাঁকে নিধন করার কথা ভাবতে হয়েছে কৃষ্ণকে। আর কৃষ্ণ যেহেতু অর্জুনকে বলেছেন— তোমাদের কারণেই আমাকে এই মহাবীরকে সম্মুখ যুদ্ধে হত্যা করতে হয়েছে— তদ্ধিতার্থঞ্চ স ময়া হতঃ সংগ্রাম-মূর্ধনি— তাতে বুঝি উদ্যোগপর্বে দ্রুপদের মুখে একলব্যের সহায়তা-কামনার অন্য কোনও অর্থ আছে। হয় তিনি এই একলব্য নন, নয়তো তিনি একলব্যের পুত্র অথবা পুত্রেরা।
কৃষ্ণের ওই বক্তব্যের পিছনে যে যথেষ্ট দৃঢ় কারণ আছে, তা আমরা সামগ্রিক মহাভারত-চর্চার ফলে বুঝতে পারি। আমি অন্য একটি গ্রন্থে এই বিষয় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছি, এখানে শুধু এইটুকু মনে রাখলেই হবে যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে কৃষ্ণের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ এবং তাঁর আত্মীয় তথা মিত্রগোষ্ঠী। পরম আত্মীয় এবং জামাই কংসকে কৃষ্ণ যখন হত্যা করালেন, তখন জরাসন্ধ এবং তাঁর মিত্রগোষ্ঠী সার্বিকভাবে কৃষ্ণকে শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করলেন। এই মিত্রগোষ্ঠীর মধ্যে চেদিরাজ শিশুপাল, সৌভপতি শাল্ব, পুণ্ড্রবর্ধনের অধিপতি প্রবল পরাক্রান্ত পৌণ্ড্রক বাসুদেব, প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকাসুর এবং অবশ্যই একলব্য নিষাদও ছিলেন।
আমরা জানি— কৃষ্ণ অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছেন, মথুরা থেকে রাজধানী দ্বারকায় স্থানান্তরিত করেছেন জরাসন্ধের ভয়ে, অবশেষে পাণ্ডব-কৌরবের জ্ঞাতিবিরোধের মধ্যে প্রবেশ করে তিনি নিজেও একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছিলেন। আপন বিশালবুদ্ধির তন্মাত্ৰতায় জরাসন্ধকে তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বেই হত্যা করান কৌশলে— সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে। জরাসন্ধের ছত্রহীন শিশুপালকে হত্যা করেন রাজসূয়-যজ্ঞের কালেই। এর পরেই জরাসন্ধের অভিন্নহৃদয় বন্ধু পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণকে আক্রমণ করেন জরাসন্ধ-হত্যার প্রতিশোধ-পূরণের জন্য। ঠিক এইখানেই পৌণ্ড্রক বাসুদেবের যোদ্ধা-শিরোমণিদের মধ্যে আমরা নিষাদ একলব্যের দেখা পাই।
মহাভারত এবং হরিবংশ পুরাণ একত্রে মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখা যাবে— দ্রৌপদীকে নিয়ে যখন পাশাখেলা হচ্ছে, তখন সৌভপতি শাল্বের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ হয় এবং তিনি মারা যান। ওদিকে মগধরাজ জরাসন্ধ এবং বন্ধু নরকাসুরের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পৌণ্ড্রক বাসুদেব রাতের অন্ধকারে দ্বারকা আক্রমণ করলেন। এবং সমস্ত ঘটনাগুলি চলছে যখন, পাণ্ডবরা তখন বনবাসে। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের বাহুবীর্য এখানে বিবেচ্য নয়, কিন্তু একলব্যের কথা তো এখানে বলতেই হবে। কৃষ্ণ বলেছিলেন— নিরন্তর অভ্যাসে একলব্য নিজেকে তৈরি করেছে। সেই কালরাত্রির অন্ধকারে কৃষ্ণের অনুগামী যাদব-বৃষ্ণিরা সেখানে মশাল জ্বালিয়ে নিজেদের অস্ত্রক্ষেপণ সহজ করার চেষ্টা করছেন, সেখানে নিষাদ একলব্যের বর্ণনা এইরকম— মহাকাল অন্তক যমের মতো তিনি ভয়ংকর। ভয়ংকর এক ধনুক হাতে নিয়ে— ধনুর্গৃহ্য মহাঘোরং কালান্তকযমোপমঃ— শতাধিক বাণে যাদব-সৈন্যদের বিধ্বস্ত করে দিলেন। যাদব-বৃষ্ণিদের মধ্যে সেদিন এমন কোনও মহাবীর ছিলেন না, যিনি একলব্য নিষাদের ভয়ংকর বাণবর্ষণে আহত হননি— এবম্ একৈকশঃ সর্বে নিহতা নিশিতৈঃ শরৈঃ।
এই যুদ্ধেই কৃষ্ণ বুঝে গিয়েছিলেন যে, নিরঙ্গুষ্ঠ অবস্থাতেও একলব্য কত ভয়ংকর। তাঁর বাণমোক্ষণের ক্ষমতা এখনও কত ক্ষিপ্র যে, পঁচিশ-তিরিশটা করে বাণ এক-একজনের ওপর ক্রমান্বয়ে বর্ষণ করে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বয়ং কৃষ্ণও এই শরাঘাত থেকে মুক্ত থাকেননি। সেদিনকার রাত্রিতে যাদব-বৃষ্ণি বীরেরা আকস্মিক এই যুদ্ধে প্রথমে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন এবং একলব্য অবিরাম বাণবর্ষণ করে তাদের প্রায় ঝেঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রণক্ষেত্র থেকে— বিদ্রাব্য যাদবীং সেনাং… বীর্যবান্ বলবাহনম্। নিষাদ একলব্য যাদবদের এই বিধ্বস্ত ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে বেশ গর্বিত বোধ করেছেন। যাদব-বৃষ্ণিদের বড় বড় বীরদের নিজের নাম শুনিয়ে— নাম বিশ্রাব্য বীর্যবান্— তিনি বলেছেন— ওরে! শুনে রাখ্ সব। আমি একলব্য, মহাবীর একলব্য। ওই যে সাত্যকি, নিজেকে খুব শক্তিমান ভাবে। এখন এই সময় আমার হাত থেকে বেঁচে কোথায় যাবে— ইদানীং সাত্যকি বীরঃ ক্ক যাস্যতি মহাবলঃ। আর ওই যে লাঙল-কাঁধে হলধর বলরাম, গর্বে তো তার মাটিতে পা পড়ে না, হঠাৎ এখন হাতে একখানি গদা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? পালাচ্ছে নাকি? মদমত্তো হলী সাক্ষাৎ ক্ক যাতীহ গদাধরঃ?
সত্য কথা বলতে কী, যাদব-বৃষ্ণি বীরেরা এমন রাত্রিকালের আকস্মিক আক্রমণের জন্য তেমন প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে তাঁদের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে একটু হতচকিত ভাব ছিল। একলব্যের তর্জন-গর্জন সেই কারণেই হয়তো। হরিবংশের কথক-ঠাকুর খুব মজাদার একটা মন্তব্য করেছেন এখানে। বলেছেন— একলব্য তাঁর প্রস্ফুরিত সিংহনাদে সিংহদেরও যেন একটু অবাক করে দিলেন— ইত্যাহ সিংহনাদেন সিংহান্ বিস্মাপয়ন্নিব। যদু-বৃষ্ণি-বীরেরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার পর আসল যুদ্ধটা কিন্তু বলরামের সঙ্গেই হল একলব্যের। সাত্যকি পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। অতএব একলব্য ধনুক নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন বলরামের সঙ্গে। এই যুদ্ধের বেশ একটা জুৎসই বর্ণনা হরিবংশঠাকুর বিবৃত করেছেন আপন শব্দ-চমৎকারে। কিন্তু বর্ণনার আতিশয্য থেকে সারটুকু নিষ্কৃত করে নিলেও বোঝা যায়— একলব্যের বিশেষত্ব এখনও সেই বাণমোক্ষণের ক্ষিপ্রতায়। যুদ্ধারম্ভেই কথকঠাকুরকে এই সত্যটুকু লিখতে হচ্ছে যে, একলব্য প্রথমেই দশটা নারাচ-অস্ত্র, তারপরেই দশটা বাণ ছেড়ে দিলেন পরপর। ইত্যবসরে বলরাম তাঁর রথের ধ্বজাটুকু কাটতে সমর্থ হয়েছেন মাত্র আর সামান্য আহত করতে পেরেছেন একলব্যের সারথিকে।
লক্ষণীয়, হরিবংশ তো মহাভারত নয়, অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে একলব্যের চরিত্রটুকু এমনকী তাঁর অভ্যাসটুকুও ঠিক রাখতে পেরেছেন পৌরাণিক কথকঠাকুর। ধনুকের প্রতি একলব্যের টান ছিল, সর্বজনবিদিত সেই আকর্ষণ, কিন্তু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ না থাকায় পরিপূরক হিসেবে তিনি হয়তো একটা ভারী এবং বিরাট ধনুক ব্যবহার করতেন। এমনটা না হলে হরিবংশ ঠাকুর সেই ধনুকের আয়তন, পরিমাণ এবং ছিলার গুণ নিয়ে কথা বলবেন কেন! হরিবংশ বলেছে— একলব্য এবার এমন একটা ধনুক হাতে নিলেন— যার ছিলাটি অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং লম্বায় সাড়ে চার হাত— দৃঢ়মৌর্ব্যা সমাযুক্তং দশতাল-প্রমাণতঃ। এই ধনুক থেকে একলব্যের ক্ষিপ্রবাণগুলি নিঃসৃত হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত যে বিপদ ঘটবে, সেটা বুঝেই বলরাম যুদ্ধ কৃতিত্বের বিচিত্র কৌশল দেখানো বন্ধ করে আগেভাগে একলব্যের ধনুকটাই কেটে ফেললেন সেই জায়গায়, যেখানে মুঠো করে ধরতে হয় ধনুকটাকে— চিচ্ছেদ মুষ্টিদেশে তু… শরৈ সর্পসমৈর্বলঃ।
এই যুদ্ধের আনুপূর্বিক বর্ণনা দেওয়া বাতুলতা-মাত্র। একটা সময় বলরামের শক্তির আঘাতে একলব্য মাটিতে বসে পড়লেন। এই মুহূর্তেই তাঁকে মেরে ফেলা যেত, কিন্তু সেটা সমর-নীতির কোনও নৈতিকতায় অনুমোদিত হয় না। অন্তত সে শত্ৰু যদি একান্তই দুর্বধ্য না হয়। একলব্য নিষাদ এমন নন যে তাঁকে বহু দিন ধরে কৃষ্ণ-বলরাম খুঁজে বেড়াচ্ছেন মারবার জন্য। তিনি প্রধানত পাণ্ডব অর্জুনের শত্রু। এখানে একলব্য এসেছেন বন্ধুকৃত্য করতে পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সহায় হয়ে— যদি অর্জুনের বন্ধুর ক্ষতি করা যায়। একলব্য মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে বধ করার কথা যদিবা বলরাম ভেবেও থাকেন, তবুও তা পারেননি, কেন না একলব্যের অনুগামী শত-শত নিষাদ-সৈন্য বলরামকে তখন ছেঁকে ধরেছিল। নিষাদ-সৈন্যদের অনেকেরই প্রাণান্ত হল বলরামের হাতে, ওদিকে একলব্য খানিকটা সুস্থ হতেই বলরামের সঙ্গে তাঁর গদাযুদ্ধ আরম্ভ হল। নিরঙ্গুষ্ঠ নিষাদরাজ কীভাবে গদা ধরতেন অথবা তিনি বাম হাতে গদা-চালনা করতেন কিনা, সে খবর হরিবংশ-ঠাকুর দেননি, কিন্তু গদাযুদ্ধে অতিকুশল বলরামের হাতে একলব্য এতটুকু পর্যদস্ত হননি। বরঞ্চ দুইজনের গদাযুদ্ধের পরিণতি বর্ণিত হয়েছে তুমুল শব্দের অভিঘাতে— যে শব্দ সমুদ্রের তরঙ্গ-অভিঘাতের মতো অথবা যুগান্তের প্রলয়-ঘোষের সমতুল— সমুদ্ৰাণাং যথা ঘোষঃ/কল্পক্ষয়ে মহারাজ শব্দঃ সুতুমুলোহভবৎ।
ইতিমধ্যে পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণের হাতে মারা গেছেন। একলব্যেরও শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। গদাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে একলব্য তাঁর নিজের গদাটি ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলেন বলরামের দিকে। বর্মপরিহিত বলরাম একটু আঘাত পেলেন বটে, কিন্তু তিনি নিজে গদাযুদ্ধের গুরু বলে খ্যাত, এই গদাটিই তিনি পুনরায় ঘুরিয়ে এমনভাবে লক্ষ্য করে ছুড়লেন একলব্যের দিকে যে, সেই লক্ষ্য এড়াতে তাঁকে রথ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল এবং রথ থেকে মাটিতে নামার পরেই তাঁকে ধাওয়া করলেন বলরাম। একলব্যের কাছে উপায়ান্তর ছিল না কিছু। তিনি ছুটতে লাগলেন। ওদিকের যুদ্ধনায়ক পৌণ্ড্রক মারা গেছেন, অতএব পালানো ছাড়া কোনও উপায় তাঁর ছিল না। কিন্তু একলব্য যেখানে যেখানে যাচ্ছেন, বলরামও সেখানে সেখানেই উপস্থিত হচ্ছেন— ধাবত্যেবঞ্চ রামোহপি যত্র যাতো নিষাদপঃ।
পালিয়ে যেতে যেতে দ্বারকা নগরীর প্রান্তশায়ী সমুদ্র এসে গেল। একলব্য এবার নিরুপায় হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। হরিবংশ বলেছে— একলব্য সমুদ্রে প্রবেশ করে সাঁতারে-ডুবসাঁতারে অন্তত পাঁচ যোজন পথ অতিক্রম করে গেছেন— সাগরং চ প্রবিশ্যাশু গত্বা যোজনপঞ্চমম্। হয়তো এই সময়েই বলরাম একলব্যের দিশা হারিয়ে চলে আসেন দ্বারকার সুধর্মা-সভায়। হরিবংশে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী একলব্য নাকি সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে ডুবতে ডুবতে অবশেষে একটি দ্বীপের গায়ে এসে ঠেকেন এবং সেই দ্বীপেই শেষ পর্যন্ত থাকতে আরম্ভ করেন— কঞ্চিদ্ দ্বীপান্তরং রাজন্ প্রবিশ্য ন্যবসত্তদা। কিন্তু দ্বীপে যে বাস করতে থাকলেন, সেও খানিকটা ভয়ে ভয়েই, বলরামের ভয়ে— ভীত এব তদা রাজন্ একলব্যো নিষাদপঃ।
এইখানেই কিন্তু সেই বিশাল তর্কটা উঠে যায়। মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন— তোমার ভালর জন্য ওই একলব্য আমার হাতে মারা গেছে এক ভয়ংকর যুদ্ধে— তদ্ধিতার্থঞ্চ স ময়া হতঃ সংগ্রাম-মূর্ধনি— আর এদিকে মহাভারতের পরিশিষ্টকল্প হরিবংশে কৃষ্ণের সঙ্গে আমরা তাঁর সম্মুখযুদ্ধের কোনও সংবাদ পাইনি। তিনি বলরামের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর ধাওয়া খেয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়েছেন। কেমন করে তা হলে কৃষ্ণের বক্তব্যের সঙ্গে একলব্যের শেষ পরিণতিটুকু মেলানো যায়! আমরা বলি— পৌরাণিক তথ্য পৌরাণিক বৃত্তি দিয়েই মেলাতে হয়। আমরা মহাভারতের কৃষ্ণের কথাও বিশ্বাস করি, হরিবংশে একলব্যের পিছনে বলরামের পশ্চাদ্ধাবনেও বিশ্বাস করি, আবার একলব্যের দ্বীপান্তর-নির্বাসন অথবা মৃত্যুকেও বিশ্বাস করি। আসল কথা, পৌরাণিকের কথার মর্ম পৌরাণিক হৃদয়বৃত্তি দিয়েই বুঝতে হবে।
মনে রাখতে হবে, হরিবংশে কৃষ্ণের হাতে পৌণ্ড্রক বাসুদেবের মৃত্যুই একটা বিশাল ঘটনা। পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণকে মারতে এসেছিলেন জরাসন্ধ-হত্যার প্রতিশোধ নিতে, একলব্য তাঁর মিত্রগোষ্ঠীর অন্যতম রাজা, আপাতত তাঁর সৈন্যবাহিনীর অন্যতম নায়ক। তাঁর মানে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখানে দু’জন— কৃষ্ণ বাসুদেব এবং পৌণ্ড্রক বাসুদেব। এই দুই প্রধানের যুদ্ধে অন্যতর যুদ্ধবীর যদি প্রতিপক্ষের অন্যতর কারও হাতেও মারা যান, সেখানে কিন্তু প্রধানেরই নাম হতে পারে। তিনি বলতেই পারেন— আমি তাঁকে যুদ্ধে মেরেছি। এটা তো মানতেই হবে যে, কৃষ্ণ তো জরাসন্ধকেও নিজে মারেননি, কিন্তু এটাও তো অসত্য নয় যে, কৃষ্ণের বুদ্ধি-নায়কত্ব ছাড়া জরাসন্ধ-বধ অসম্ভব ছিল। একইভাবে একলব্যের চরম শাস্তি বলরামের হাতে হলেও সেটা কৃষ্ণের কৃতিত্ব বলে গণ্য হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, একলব্যের দৈহিক মৃত্যু না ঘটে যদি দ্বীপান্তরে সঙ্গীহীন সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাঁকে দিন কাটিয়ে থাকতে হয়, তবে সেটা তাঁর মতো মহাবীরের পক্ষে মৃত্যুই বটে! এই সেদিন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে বৈকল্পিক দ্বীপান্তর-নির্বাসন দেওয়া যথেষ্টই প্রচলিত ছিল। আমাদেরও ধারণা— একলব্য পুনরায় আর তাঁর নিষাদরাজ্যের চৌহদ্দিতে ফিরতে পারেননি। ফলে তাঁর মতো বীরের পক্ষে এই অবমাননাকর জীবন মৃত্যুর চেয়ে কিছু কম নয় বলেই আমরা মনে করি। আর এইভাবে কোনও দ্বীপান্তরে তাঁর অস্তিত্ব থেকে থাকলেই কিন্তু উদ্যোগপর্বে দ্রুপদের সেই পরামর্শটুকুও সদর্থক হয়ে ওঠে— অর্থাৎ তিনি যে পাণ্ডবদের বলেছিলেন— তোমরা একলব্যের কাছেও যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য দূত পাঠাও— এই পরামর্শটুকু অসত্য হয়ে ওঠে না। তবে হ্যাঁ, পাণ্ডবীয় কোনও দৃত সত্যিই তাঁর কাছে গিয়েছিল কি না, সে খবর আমরা মহাভারত থেকে পাইনি এবং এটাও সঠিক যে, দূত গিয়ে থাকলেও একলব্য আর পুনরায় যুদ্ধজীবনে ফিরে আসেননি— কৃষ্ণ অথবা অর্জুন যে পক্ষে আছেন, সে পক্ষে যোগ দিতে ঘৃণা বোধ করেছেন নিশ্চয় এবং হয়তো এই সার্বিক অনুপস্থিতির সুযোগেই কৃষ্ণ অর্জুনকে বলতে পেরেছেন— তোমারই ভালর জন্য আমি একলব্য নিষাদকে সম্মুখযুদ্ধে মেরেছি। যদি তা না হত তা হলে জরাসন্ধ, শিশুপালদের মতো একলব্যও তোমার পক্ষে ভয়ংকর হয়ে উঠতেন— যদি ন স্যুর্হতা পূর্বম্ ইদানীং স্যুর্ভয়ঙ্করাঃ।
একলব্যের মতো এক মহা-সম্ভাব্য নায়কের এই পরিণতি দেখে একটা-দুটো প্রশ্ন জাগে মনে। প্রথমেই মনে হয়, একলব্য নিষাদ এত বড় স্বশিক্ষিত বীর, অথচ স্বশিক্ষায় যিনি বড় হয়ে ওঠেন, তাঁর কাছে যেটুকু বাস্তব জ্ঞান আশা করা যায়, তা তাঁর ছিল না। নইলে অমন আবেগতাড়িত হয়ে আর্যসমাজের অমন এক অমহিম গুরুর কাছে দীক্ষা না পেয়েও দক্ষিণা দেবার কী কারণ ছিল! আর এমন করে দক্ষিণা দিয়েও তো তিনি সেই মানুষগুলোর মতো পরিচিতি পেলেন না, যেমন পেয়েছেন উপনিষদের উদ্দালক, আরুণি অথবা শ্বেতকেতু। নিজের আঙুল কেটে যখন দক্ষিণাই দিলেন, তখন দ্রোণের অনুগামী হলেও তো তাঁর লাভ ছিল, অন্তত দুর্যোধনের গৃহস্থ রাজনীতিতে তাঁর পাকা আসন জুটে যেত। তিনি তাও করেননি।
এই বিবর্জন-বিসর্জনের বৃত্তি থেকে বুঝি, রাজনীতির ক্লিন্ন পঙ্কিল পথের চেয়েও একলব্য তাঁর আপন স্বকীয়তায় নিজেরই এক মর্যাদার স্থান নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন। তাঁর নিষাদ-রাজ্যের সংক্ষিপ্ত পরিধির মধ্যেই একলব্য এমন একটা ভরা সংসার তৈরি করে নিয়েছিলেন যেখান থেকে আর্য-সভ্য দ্রোণ-দুর্যোধন-অর্জুনের মতো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখেও তাঁর দিন কেটে গেছে। বরঞ্চ যোগাযোগ রেখেছেন তাঁদের সঙ্গে, যারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখন বৃহত্তর গোষ্ঠী বলেই পরিচিত ছিলেন— অর্থাৎ জরাসন্ধ, শিশুপাল, পৌণ্ড্রক বাসুদেব। সংসার জীবনে একলব্যের ছেলেপিলে অনেকগুলি ছিল কিনা বলা মুশকিল। হয়তো অনেকগুলিই, যেমনটি দ্রুপদ বলেছিলেন বহুবচনে— একলব্যং সহাত্মজৈঃ। একলব্যের মৃত্যু অথবা অনুপস্থিতিতে তাঁর কোনও জ্যেষ্ঠপুত্ৰই রাজা হয়েছিলেন নিষাদ-রাজ্যে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর রাজা যুধিষ্ঠির যে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তাঁর অশ্বরক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন অর্জুন। কাশী-কোশল-দশার্ণ ছেড়ে অর্জুন প্রবেশ করেছিলেন অতি-পুরাতন পরিচিত সেই নিষাদ-রাজ্যে, একলব্যের নিষাদ-রাজ্য— নিষাদারাজ্ঞো বিষয়ম্ একলব্যস্য জগ্নিবান্।
কেমন লেগেছিল এখানে অর্জুনের। যখন প্রথম তিনি এই অরণ্যরাজ্যের প্রান্তভাগে মৃগয়া করতে এসেছিলেন, তখন একলব্য এখানে রাজা ছিলেন না। পিতা হিরণ্যধনু তখন রাজা, আর একলব্য শিক্ষার্থী— একমনে তিনি বাণাভ্যাস করেন। অর্জুন সেদিন অন্যায়ভাবে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর শরচালনার প্রধান উপায়টিকেই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং খুশিও হয়েছিলেন তাতে। আজ তাঁর কেমন লাগল! কোনও বিক্রিয়া নেই, কোনও বিক্ষোভ নেই আজও। হয়তো একলব্যও নির্জন দ্বীপে তাঁর শেষ অনভ্যস্ত অলস জীবন কাটাচ্ছেন মৃত্যুর শেষতম আস্বাদ গ্রহণ করতে করতে। আর অর্জুন একলব্যের ছেলের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছেন। একলব্যের ছেলে এই মহাবীরকে বিনা যুদ্ধে মেদিনী ছেড়ে দেননি— একলব্য-সুতশ্চৈনং যুদ্ধেন জগৃহে তদা। বেশ ভালই যুদ্ধ হয়েছিল বুড়ো অর্জুনের সঙ্গে বালক-বীর একলব্য-পুত্রের— সংগ্রামং লোমহর্ষণম্। অবশেষে অর্জুন এই যুদ্ধে জিতেছেন এবং রাজকর দিতে বাধ্য করেছেন একলব্যের পুত্রকে। এই জয় কিছু অপূর্ব নয়। মহাবীরেরা জিতে যান এইভাবেই, সব সময়। কিন্তু একবারের তরেও যদি এই রাজ্যে প্রবেশ করে তাঁর মনে পড়ত যে, তাঁর চেয়ে অনেক বড় বীর বলেই এই বালক-বীরের পিতার সঙ্গে একবারও তিনি যুদ্ধ করার সাহস দেখাতে পারেননি, তাঁকে গুরুস্থান অপব্যবহার করে নিজের প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করতে হয়েছিল— যদি একবারের জন্যও তিনি ভাবতেন! না, অর্জুন এসব ভাবেননি কিছুই। তিনি ‘প্রোফেশনাল’ ক্ষত্রিয়ের মতো একলব্যের পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে হারিয়ে দিলেন। কী জয় হল মহাবীর অর্জুনের! বরঞ্চ একলব্য বেঁচে রইলেন প্রবঞ্চিত, ক্ষুব্ধ, বিজিত সেই সব যুবকের মনে, যাঁদের গুরুরা হারিয়ে দেন আপন তঞ্চকতায়, সতীর্থরা যাঁদের আড়ালে বসে প্রবঞ্চনার ছক কষে— অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।