একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

বুড়ো মাঝিটাকে তাড়া লাগানো বৃথা জেনেই অনিমেষ বহুক্ষণ আগে চুপ করেছিল৷ তার ফলে মাঝি আর আরোহী দুজনেই হাল ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছে৷ মাঝির বকাটাই রোগ—এমন কি ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল ঐটেই পেশা৷ ওর বউ কতদিন মরেছে, ছেলের বিয়ে দিয়ে কী ভুল করেছে, জামাই কেন মেয়েকে নেয় না—ছোট জামাইটা জুয়াড়ি, ছেলেটা নেশা করতে পেলে আর কিছু চায় না—খুব ছেলেবয়সে একবার ও কলকাতা গিয়েছিল কিন্তু অত হট্টগোলে মাথা ঠিক থাকে না বলে পালিয়ে আসতে পথ পায় নি—আবার একবার যাবে মা কালীকে দর্শন করতে, ইত্যাদি তথ্য পরিবেশন করবার ফাঁকে ফাঁকে কেবলমাত্র দম নেবার প্রয়োজনে যখন থামে তখনি শুধু দাঁড় বাইবার কথা মনে পড়ে ওর৷ সুতরাং শহরে যাবার বাস যে পাবে না তা অনিমেষ আগেই বুঝেছিল, কিন্তু এমন অবস্থায় যে পড়বে তা কল্পনা করে নি৷ বাস তো নেই-ই, আশেপাশে কোথাও মানববসতির চিহ্নও যেন চোখে পড়ে না৷

নৌকা এসে যেখানটায় ভেড়ে সেখানে বাঁশের মাচা মতো একটা আছে, জাহাজঘাটা হলে অনায়াসে জেটি বলা যেত৷ সেই মাচাতে নেমে অসহায় ভাবে অনিমেষ একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখল৷ নিচে ময়ুরাক্ষীর কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে৷ তার স্রোতের গতি থাকলেও তবু একটু প্রাণস্পন্দন বোঝা যেত—এত মন্থর তার স্রোত, এত নিস্তরঙ্গ— যে মনে হচ্ছে সমস্ত জলটা যেন জমাট বেঁধে স্তব্ধ হয়ে গেছে আর তার সেই অতল কালো বুকে কত কী রহস্যময় জীব স্পন্দনহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের হাসি হাসছে—

ওপারে ভগীরথপুর গ্রাম, বেশ সম্পন্ন গ্রাম তা সে জানে, বহু লোকের বাস, অনেক পাকা বাড়ি ইস্কুল ডাকঘর আছে কিন্তু এখান থেকে তার কিছুই দেখা যায় না৷ ঘাট থেকে উঠে যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে গিয়েছে তার সাদা বালির আভাস নিবিড় বনের অন্ধকারে মিশে গেছে একটুখানি গিয়েই৷ দু’দিকে বড় বড় গাছ—কী গাছ তা বোঝা যায় না, কিন্তু তারই অসংখ্য শাখাপল্লব সমস্ত গ্রামটাকে যেন চোখের আড়াল করে রেখেছে৷ একটা আলোর রেখা পর্যন্ত চোখে পড়ে না৷

ওপারেই যদি এই হয় তো, এপারের অবস্থা সহজেই অনুমেয়৷ এপারে যেদিন সে এসেছিল সেদিন দিনের বেলাও কোনো গ্রাম ওর চোখে পড়ে নি৷ বাসটা এসে একেবারে এই ঘাটের ধারে দাঁড়ায়, যাত্রীরা সবাই ভগীরথপুর চলে যায়৷ সেদিন অন্তত এমন কেউ ছিল না যে এপারে কোথাও যাবে৷ আসার সময়ও দুদিকে আম গাছের ঘন বন কাটিয়ে এসেছিল—বেশ মনে আছে৷ হয়তো ছিল কোথাও ঘরবাড়ি, কিন্তু তা ওর চোখে পড়ে নি৷

পারাপারের জন্য একটা খেয়া নৌকো আছে, চওড়া ভেলার মতো প্রকাণ্ড বস্তু—কিন্তু শেষ বাস চলে যাবার পর আর ওপার থেকে কেউ আসবার সম্ভাবনা নেই জেনে সে ইজারাদারও বহুক্ষণ বাড়ি চলে গেছে নৌকোটা ওপারে বেঁধে রেখে৷

‘বাবু ভাড়াটা?’—তাড়া লাগায় মাঝি৷

বিহ্বলতা কাটে কিন্তু যেন আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠে অনিমেষ৷

‘ভাড়াটা কিরে! এই অন্ধকার রাত্রিতে আমি এখানে কোথায় থাকব? তুই তো এক ঘণ্টার রাস্তা সাত ঘণ্টায় এনে আমাকে এই বিপদে ফেললি৷ এখন নিদেন ওপারে পৌঁছে দে৷ দেখি কোথাও একটু আশ্রয় পাই কিনা, এপারে এই জঙ্গলে শেষে কি বাঘের পেটে প্রাণ দেব! চল, ওপারে নিয়ে চল—’

‘উটি লারলম আজ্ঞা!’

‘সে কি! কেন রে? কী হয়েছে?’

তার উত্তরে মাঝি যা বলল তার অর্থ হচ্ছে এই যে, ওপারে অন্য নৌকো গেলে খেয়ার ইজারাদার বড্ড বকাবকি করে, পুলিশে ধরিয়ে দেয়৷ সুতরাং ওপারে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়৷

অনিমেষ তাকে অনেক করে বোঝাল৷ ওপারে তাকে ধরবার জন্য ইজারাদার যদি বসে থাকত তো অনিমেষ তাকেই ডাকত শুধু ইজারাদার কেন, জনমানবের চিহ্ন থাকলেও সে মাঝিকে এ অনুরোধ করত না৷ কোনোমতে নামিয়ে দিয়ে সে চলে যাক—তাতে যদি কেউ তাকে ধরে তো অনিমেষ তার দায়ী—ইত্যাদি সব কথার উত্তরে তার সেই একই উত্তর, ‘উটি লারলম আজ্ঞা!’

অনিমেষ তখন রাগ করে বলল, ‘তবে তুইও থাক, আমি তোর নৌকোতেই রাত কাটাই৷’

‘আজ্ঞা, উটিও লারলম!’ শুধু তাই নয়, দাঁড়ের একটা ধাক্কা দিয়ে নৌকোটা খানিক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল৷

‘টাকাটি ছুঁড়ে দ্যান কেনে—বাড়ি চলে যাই৷’

‘তবে টাকাও পাবি না যা!’ রাগ করে বলে অনিমেষ, কিন্তু যখন দেখে বুড়োটা সত্যি-সত্যিই একটা নিশ্বাস ফেলে ঘর-মুখো হচ্ছে তখন সে একখানা এক টাকার নোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়েই দেয়৷

‘যা বেটা যা৷ পথে ডুবে মরিস তো ঠিক হয়৷’ মনে মনে বলে অনিমেষ৷

ব্যস, এরপর সব পরিষ্কার৷ ওপারে ঘন বনের নিবিড় তমিস্রা, সামনে অতল শান্ত জলে তারই রহস্য যেন জমাট বেঁধে—আর এপারে তার চারপাশ ঘিরেও দৈত্যের মতো কতকগুলি গাছপালা, ভয়াবহ অন্ধকার বিস্তার করে সমস্ত সভ্যতার চিহ্ন, এমন কি আকাশকেও যেন আড়াল করে রেখেছে৷ ব্যস এসে দাঁড়ায় এবং ঘোরে যেখানটায় সেখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে বটে কিন্তু সে যেন আরো ভয়ঙ্কর৷

স্যুটকেসটা মাচার উপর পেতে সেখানেই জেঁকে বসল অনিমেষ৷ বাঘ ভাল্লুক যদি সত্যিই আসে তো জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে—এখানেই খানিকটা তবু নিরাপদ৷

খরখর ঝটপট শব্দ করে কী একটা পাখি উড়ে বসল মাথার ওপরে৷ ভয় পেয়ে চমকে উঠল অনিমেষ৷ কাছেই কোথায় শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কী একটা সরীসৃপ চলে গেল বোধ হয়৷ সামান্য, শব্দ, তবু বেশ স্পষ্ট৷ জলের মধ্যে হঠাৎ একটা মাছ ডিগবাজী খায়৷ ঐটুকু আওয়াজ—কিন্তু অনিমেষের মনে হল যেন বন্দুকের শব্দ উঠল কোথায়৷

বিশ্রী লাগছে৷ নক্ষত্রের আলোতে যতদূর দৃষ্টি চলে বহুক্ষণ ধরে ধরে হাতঘড়িটা দেখল—মাত্র রাত ন-টা৷ কলকাতায় সবে সন্ধ্যা৷ কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে নিশুতি রাত৷ এখনো দীর্ঘসময় তাকে এখানে অপেক্ষা করতে হবে৷ কখন ভোর হবে, তারপর কখন ইজারাদারের ঘুম ভাঙবে তবে সে একটু লোকালয়ের মুখ দেখতে পাবে৷ বাস একটা আসে এখানে সকাল আটটা নাগাদ—সন্ধ্যাতে যেটা এসেছে সেটা কাছাকাছি কোনো গ্রামে থাকে, সাতটা নাগাদ এখানে এসে দাঁড়ায়৷ অর্থাৎ প্রায় বারো ঘণ্টা এখনো—

আচ্ছা, হাঁটলে কেমন হয়? বাসের রাসাটা ধরে হাঁটতে থাকলে কি আর গ্রাম একটা পাওয়া যায় না কাছাকাছির মধ্যে?

কিন্তু সেখানে যদি তাকে আশ্রয় দিতে কেউ না চায়? ডাকাত বলে মনে করে? তাছাড়া দু’দিকে যা ঘন ঘন বন, যদি বাঘ আসে? মুর্শিদাবাদ জেলায় এসব অঞ্চলে প্রায়ই বাঘ বেরোয়৷

দরকার নেই৷ দশ-এগারো ঘণ্টা সময়—একরকম করে কেটেই যাবে৷

‘ও মশাই, শুনছেন? বাস মিস করেছেন বুঝি? কোথাও আশ্রয় পান নি?’

অস্ফুট একটা শব্দ করে চমকে ওঠে অনিমেষ, বরং আঁতকে ওঠে বলাই ঠিক৷ কখন নিঃশব্দে কে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে—কৈ একটুও তো টের পায় নি! সামান্য কুটো নড়ার শব্দের দিকেও তো সে কান পেতে ছিল!

কয়েক মুহূর্ত যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে, ঘাড় ফেরাতেও সাহস হয় না৷ কথাগুলো যে বলেছে সে একেবারে ওর পিছনে এসেই দাঁড়িয়েছে৷ অত্যন্ত দ্রুত, যেন একটা কথা শেষ হবার আগেই আর একটা শুরু হয়েছে—এইভাবে পর পর তিনটি প্রশ্ন করে আগন্তুকটিও চুপ করে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে৷

অবশেষে প্রায় মরীয়া হয়েই অনিমেষ ফিরে তাকায়৷

রোগা কালো গোছের একটি মানুষ, খুব বেঁটে নয়—তাই বলে ঢ্যাঙাও বলা চলে না৷ উসকো-খুসকো এক মাথা চুল ও ঘন দাড়িগোঁফ৷ ঘন দাড়ি কিন্তু আবক্ষ বিস্তৃত নয়৷ মধ্যে মধ্যে কামানো বা ছাঁটা হয়—এমনি দাড়ি, খোঁচাখোঁচা৷ একখানা খাটো আধময়লা কাপড় পরনে— কোঁচার খুঁট গায়ে জড়ানো৷ মোটা ভুরুর আড়ালে কোটরগত চক্ষুর তীক্ষ্মদৃষ্টি নিঃশব্দে শুধুমাত্র চাউনির দ্বারাই যেন অনিমেষের সমস্ত ইতিহাস পূর্বাপর আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছে৷…

‘বলছিলুম যে, আপনি বোধহয় কোথাও আশ্রয় পাচ্ছেন না—না? তাহলে বরং চলুন না-হয় আমার কুটিরেই—কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে দেবেন৷’

হায়রে! আগুলফলম্বিত-কুন্তলা বনমালা-শোভিতা কপালকুণ্ডলারা শুধু উপন্যাসেই দেখা দেয়!

যাক গে, নবকুমারের অদৃষ্ট তার নয় তা তো বোঝাই যাচ্ছে৷ তাই বলে কি ওর চেয়ে ভদ্র চেহারার কেউ জুটতে নেই! এ লোকটাকে দেখেই যেন পাগল বলে মনে হয়—শেষ পর্যন্ত এর আশ্রয়ে গিয়ে কি আরো বিপদে পড়বে!

‘কী বলেন? যাবেন নাকি?’

‘আ-আপনি এখানে—মানে—’ আমতা আমতা করে অনিমেষ৷

‘আমার এখানেই একটা ঘর আছে, এই যে!’

লোকটা আঙুল দিয়ে দেখায়৷

সত্যিই তো, এই তো, বলতে গেলে তার সামনেই পাড়ের ওপর একখানা খড়ের ঘর—ও অঞ্চলে যেমন হয় তেমনি৷ আশ্চর্য, এতক্ষণ তার চোখে কি হয়েছিল?

লোকটি বোধ হয় তার মনের ভাব বুঝেই হেসে বললে, ‘ঘরে আলো ছিল না কিনা, তাই অন্ধকারে টের পান নি৷ আমিও বাড়ি ছিলুম না, নদীর ধার দিয়ে দিয়ে একটু বেড়াতে গিয়েছিলুম৷ অন্ধকারে একা একা বেড়াতে আমার বেশ লাগে৷’

‘এখানে বাঘের ভয় নেই?’

‘আছে বৈকি৷ তবে আমার অত ভয় নেই৷…মরবার ভয় করি না৷ করে লাভই বা কি বলুন, মরতে তো একদিন হবেই৷’

না, লোকটাকে ঠিক পাগল বলে তো মনে হয় না!

‘চলুন চলুন, ঘরে বসেই কথাবার্তা হবে’খন৷’ লোকটা তাড়া লাগায়৷

‘চলুন’ বলে স্যুটকেসটা তুলে নেয় অনিমেষ৷

একখানা নয়—পাশাপাশি দুখানা ছোট ঘর, সামনে এক ফালি দাওয়া৷ ভেতরদিকে আরো কি আছে তা ওর নজরে পড়ল না৷ দাওয়া বেশ ঝকঝকে করে নিকানো, পরিচ্ছন্ন৷ লোকটি আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে ‘দাঁড়ান আলো জ্বালি’ বলে ওকে দাওয়াতেই দাঁড় করিয়ে রেখে দোর খুলে ভেতরে ঢুকল৷ তালাচাবির বালাই নেই, দোর শুধু ভেজানোই ছিল, ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে আশ্চর্যরকম ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটা আলো জ্বেলে লোকটি বলল, ‘আসুন—ভেতরে আসুন৷’

ঘরে আসবাবপত্র বেশি ছিল না৷ একটি তক্তপোশের ওপর একটা মাদুর বিছানো,—শয্যা বলতে এই৷ একটা বালিশ পর্যন্ত নেই৷ একপাশে একটি দড়ি টাঙানো, তাতে খান-দুই কাপড়, তার মধ্যে একটা লাল মেঝেতে জলের মেটে কলসী, একটা কাঁসার ঘটি এবং পিতলের পিলসুজে একটা মাটির প্রদীপ৷ এ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই৷

‘বসুন, বসুন৷ ঐ চৌকিটের ওপরই বসুন৷’

তারপর খানিকটা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে নিজের দুইহাত ঘষে কেন এক রকমের বিচিত্র হাসি হেসে বললে, ‘ভালো বিছানা আমার নেই৷ ঐ স্যুটকেসটা মাথায় দিয়েই শুতে হবে৷…আর খাবারও তো কিছু দিতে পারব না৷ ঘরে আমার কিছুই নেই৷…আপনি মদ খান?’

যেন একটা আকস্মিক উগ্রতা দেখা দেয় ওর প্রশ্ন করবার ভঙ্গিতে৷

‘না-না৷ রক্ষে করুন৷ কিচ্ছু ব্যস্ত হবেন না আমার জন্যে৷ আশ্রয় পেয়েছি এই ঢের৷’

‘ঐ আশ্রয়টুকুই যা৷ বাঘ-ভাল্লুকের হাত থেকে তো বাঁচলেন অন্তত৷—তা আশ্রয় ভালোই৷ ঘরখানা মন্দ নয়, কী বলেন?’

বলতে বলতে হেসে ওঠে সে৷ সাদা ঝকঝকে দাঁত কালো দাড়ির ফাঁকে চকচক করে৷

অনিমেষের যেন ভালো লাগে না ওর ভাবভঙ্গি৷ আবারও সেই সন্দেহটা মনে জাগে—পাগলের পাল্লায় এসে পড়ল নাকি?

‘আপনি এখানে কি করেন?’

‘আপাতত কিছুই না৷ আচ্ছা বসুন, আমি আসি৷ মুখহাত ধোবেন নাকি?’

ধুতে পারলে ভালোই হত, কিন্তু অনিমেষের তখন নড়তে ইচ্ছে করছে না৷ সে বললে, ‘না—দরকার নেই৷’

লোকটি বেরিয়ে গেল৷ অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে বসেই রইল৷ ভালো বোধ হচ্ছে না ওর৷ কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে৷ কী করে লোকটা এখানে, এমন একাই বা থাকে কেন? ঘরে কোনোরকম কিছু খাবার নেই তো ও নিজে খায় কি? চোরডাকাত নয় তো? লোকজনকে ভুলিয়ে এনে শেষে—

ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন—ব্যাগে ওর খানকতক পুরোনো কাপড়জামা ছাড়া আর কিছুই নেই৷ পকেটেও মাত্র টাকা-ছয়েক আছে৷ কিন্তু একটু পরেই সমস্ত দেহ হিম হয়ে ওর মনে পড়ে…এই সব উদ্দেশ্যে যারা নিয়ে আসে ভুলিয়ে, টাকা না পেলে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে৷ তা-ছাড়া মেরে ফেলে তো দেখবে কী আছে না আছে৷ ওদের দেশে একবার খুব ডাকাতের উপদ্রব হয়েছিল, তারা একটা লোককে খুন করার পর পেয়েছিল মাত্র একটি আধলা!

কখন গৃহস্বামী আবার নিঃশব্দে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, অনিমেষ টেরও পায় নি৷ যদিও খোলা দরজার দিকে চেয়েই বসেছিল সে৷ আশ্চর্য!

লোকটি বলল, ‘এখনই শুয়ে পড়বেন নাকি? যদি ঘুম পেয়ে থাকে তো স্বতন্ত্র কথা৷ নইলে একটু বসি৷ কতদিন লোকের সঙ্গে কথা কইতে পাই নি! বলেন তো দুটো কথা কয়ে বাঁচি৷…এখানে তেমন লোকজন তো নেই, আসেও না কেউ—’

অনিমেষ আবারও পূর্ব প্রশ্নের জের টানল, ‘তা এমন জায়গায় আপনি থাকেনই বা কেন?’

সেই হাসি গৃহস্বামীর মুখে, তেমনি নিঃশব্দ হাসি, দাড়ির ফাঁকে শুভ্র দন্তের সেই বিজলী প্রকাশ!

‘ভয় নেই—আমি চোর-ডাকাতও নই, পাগলও নই৷ ঘরে কিছু নেই মানে আমার কিছুর দরকার নেই৷ থাকারও দরকার হয় না আমার৷ কেন জানেন?’

তারপর যেন কতকটা অসংলগ্ন ভাবেই বলে ওঠে, ‘আমি সাধক৷ তান্ত্রিক সন্ন্যাসী৷’

‘সন্ন্যাসী?’ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চায় অনিমেষ৷

অপ্রতিভ হয়ে লোকটি বলে, ‘না—সন্ন্যাসী মানে ঠিক অভিষিক্ত সন্ন্যাসী নই—তবে সাধক বটে৷’

উবু হয়ে ঘরের মেঝেতেই বসল লোকটা, কিছুক্ষণ মৌনভাবে থেকে বললে, ‘তাহলে আপনাকে বলেই ফেলি সেটা৷ কাউকে কখনো বলি নি, বলবার সুযোগও পাই নি বিশেষ৷ এই অঞ্চলেরই লোক আমি, বুঝলেন? ছেলেবেলা থেকেই নানা বইতে তান্ত্রিক সন্ন্যাসীদের অদ্ভুত সব ক্ষমতার কথা পড়ে ঐদিকে মনটা ঝোঁকে৷ মনে হত আমিও ঐসব সাধনা করে সিদ্ধ হব, তারপর প্রাণভরে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য ভোগ করব—আর আমাকে পায় কে! হায় রে, তখন কি আর জানতুম যে ভোগের উদ্দেশ্যে সাধনা করতে এলে সিদ্ধি তো দূরের কথা, সমস্তই খোয়াতে হয় একে একে!’

এই পর্যন্ত বলে লোকটি চুপ করল৷ এতক্ষণে অনিমেষও অনেকটা সহজ হয়েছে৷ লোকটির ভাবভঙ্গি আর কথাবার্তায় সত্য কথা বলছে বলে মনে হয়৷ দুশ্চিন্তা অনেকখানি কমে গেল ওর৷

‘বাড়ি আমার এ অঞলে নয়৷ বাড়ি সেই পাঁচথুপির কাছে৷ এখানে কেন এলুম? বলছি দাঁড়ান৷…বলেছি আপনাকে, ছেলেবেলা থেকেই ঐদিকে ঝোঁক গিয়েছিল৷ ইস্কুলের পড়া হল না, তার বদলে যত সব ঐ ধরনের বই পড়তে লাগলুম৷ পড়তে পড়তে বিশ্বাসটা খুব পাকা হয়ে গেল৷ কিন্তু গুরু কৈ? দু-একটা সন্ন্যাসী যা হাতের কাছে পেলুম দেখলুম সব বাজে—কেউ কিছু জানে না৷ অথচ পথ দেখাবে এমন লোক না পেলে এগোব কি করে?…মনটা বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠল৷ খাবার চিন্তা ছিল না৷ মাথার উপর বাবা, বড় ভাই ছিল—জমিজমা তারাই দেখাশুনো করত৷ অবশ্য আমি বকুনিও খেয়েছি ঢের কাজকর্ম কিছু করি না বলে, কিন্তু সে সব গায়ে মাখি নি৷

‘তবে যত দিন যেতে লাগল মনটা ততই ব্যাকুল হয়ে উঠল৷ শেষমেষ আমার তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সের সময়ে বাড়ি থেকে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম৷ বেশ বুঝেছিলুম ঘরে বসে আর কিছু হবে না৷…এ-তীর্থ ও-তীর্থ করে অনেক দেশই ঘুরলুম৷ ভালো চাকরি বা ভালো বিয়ে করার অনেক সুযোগও পেয়েছিলুম সংসার—বুঝলেন মশাই, মায়ার ফাঁদ পেতে রেখে দেয় সারা জগতে—যাই হোক সেদিকে মন ছিল না বলে কেউ বাঁধতে পারল না৷ কিন্তু আসল যা উদ্দেশ্য তাও কিছু হল ন৷…এমনি ভাবে যখন ক্রমশ হতাশ হয়ে উঠেছি তখন একদিন—বাড়ি ফেরার পথে বলতে গেলে—বাড়ির কাছে এসে হঠাৎ একজনকে পেয়ে গেলুম৷ বক্রেশ্বরের শ্মশানে এক সাধু থাকেন শুনলুম, উলঙ্গ থাকেন শ্মশানে শুয়ে, কেউ খেতে দিলে খান নইলে এমনি থাকেন৷ কাঁচা মাংস, পাতালতা এমন কি বিষ্ঠা খেতেও তাঁর আপত্তি নেই বোধ হয়—এমন নিস্পৃহ তিনি৷’

‘খোঁজ করে করে গেলুম৷ প্রথম তো দেখাই পাওয়া যায় না৷ শেষে তিন দিন ধন্না দিয়ে পড়ে থাকতে দর্শন পেলুম৷ বিপুল দেহ, তীক্ষ্ন দৃষ্টি, পাগলের মতো ভাবভঙ্গি—কিন্তু পাগল নন৷ একদিন আমার চোখের সামনেই—দু’দিক থেকে দু’দল ভক্ত তাঁকে দর্শন করতে আসছে দেখে, আমার চোখের সামনে শিয়ালের দেহ ধরে বনের মধ্যে গিয়ে সেঁধুলেন, কেউ আর খুঁজেই পেল না৷ বুঝলুম যে এতদিন ধরে যাকে খুঁজছিলুম, এতদিন পরে তাকে পেয়েছি৷’

অনিমেষের মনেও ততক্ষণে গল্প জমে উঠেছে৷ লোকটি থামতেই সে বললে, ‘তারপর?’

‘লোক তো পেলুম—তাকে ধরি কী করে? কিছুতেই ধরা দেয় না৷ কিছু বলতে গেলে শ্মশানের পোড়া কাঠ তুলে তেড়ে আসে৷ একদিন খুব কান্নাকাটি করতে সব শুনলে মন দিয়ে, কিন্তু তারপর যা বকুনিটা দিলে—বললে, ভালো চাস তো এসব মতলব ছাড়! সাধনা করবি তুই, ঐ দেড় ছটাক কাঁপা নিয়ে? তোর কাজ নয়—বুঝলি, মরবি একেবারে৷ তা ছাড়া ভোগ করবার জন্যে এসব কাজ যে করতে আসে তার একূল ওকূল দুকূল যায়৷ রামকৃষ্ণ পরমহংসের গল্প পড়িস নি? মাকে বলেছিল, মা অষ্ট সিদ্ধাই দে—হৃদে বলছে চাইতে৷ মা বললেন, কাল সকালে এর উত্তর পাবি৷ পরের দিন সকালে দোর খুলতেই নজরে পড়ল একটি মেয়েছেলে ঐদিকে ফিরে শৌচ করতে বসেছে—পরমহংস অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে এসে ভাগ্নেকে এই মারে তো সেই মারে! বুঝলি—এমনি তুচ্ছ শুধু নয়, ছোট জিনিস ওসব৷ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা—বিয়ে-থা কর৷ নিজে-নিজেই ভগবানকে ডাক, নয়তো কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিস৷ অনেক কাকুতি-মিনতি করলুম, বাবার আর দয়া হল না৷ আমি কিন্তু মশাই হাল ছাড়লুম না৷ আমার তখন জেদ চেপে গেছে কি না৷…ঐখানই পড়ে রইলুম, বলতে গেলে না খেয়ে দেয়ে—আর গোপনে ওঁর দিকে নজর রাখলুম৷ যদি আসল প্রক্রিয়ার কিছু হদিস পাই—বুঝলেন না? এতদিন কি আর বৃথাই এ লাইনে ঘুরেছি! আসল মানুষ না পাই, ওদের ভেতরের কথা কিছু কিছু জেনেছি বৈকি৷ তারপর হল কি মশাই, আরো দু-একজনকে সাধক আর ভৈরবী ওখানে এল বাবার সঙ্গে দেখা করতে৷ গোপনেই এল কিন্তু আমি তো ঐখানেই পড়ে থাকি, আমাকে এড়াবে কি করে?…পরপর কদিন ওঁদের চক্র বসল৷ তাও দেখলুম৷—মনে হল যে, আর কি, সব শিখে গেছি…ওখান থেকে রওনা হয়ে আর বাড়ি ফিরলুম না, নির্জন স্থান অথচ শ্মশান, লোকালয় কাছে এই রকম খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়লুম৷ পথে নলহাটিতে একজন তান্ত্রিকের কাছে দীক্ষাও নিয়ে নিলুম৷

‘ও মশাই, এলুম তো এখানে, কিন্তু সাধনা আর হয় না৷ প্রথম দিন থেকে বিঘ্ন৷ উপকরণ জোটে তো দিন পাই না, দিন পাই তো উপকরণ নেই—শেষে অনেক কৌশল করে অনেক নিচে নেমে যদি বা সব যোগাড় করলুম, মঙ্গলবার অমাবস্যার রাত পেয়ে যেমন আসন করে বসেছি—কী বিঘ্ন! ধ্যানে মন দেব কি, কিছুতে মনই স্থির করতে পারি না…এখন এটা বাসের রাস্তা হয়ে শ্মশান এখান থেকে সরে গেছে, আগে এখানটাতেই শ্মশান ছিল, এখন যেখানে ঘর দেখছেন, এই যেখানে আমরা বসে আছি, এইখানেই সেদিন আসন করে বসেছিলুম—’

নিজের অজ্ঞাতেই অনিমেষ যেন একটু সরে বসে৷ তারপর বলে, ‘আচ্ছা বিঘ্ন কি রকমের? ভয় পেলেন? শুনেছি তো এ রকম সাধনায় বসলে প্রথম প্রথম নানা রকমের ভয় দেখায়—কিন্তু সেটা শুধুই পরীক্ষা করার জন্যে৷ আপনিও তো সে রকম শুনেছিলেন নিশ্চয়, তবে ভয় পেলেন কেন?

হাসল লোকটা আবারও৷ কাউকে ছেলেমানুষি করতে দেখলে বিজ্ঞ মানুষেরা যেমন হাসে কতকটা তেমনি হাসি৷ বললে, ‘জানে তো সবাই কিন্তু শোনা এক জিনিস আর অভিজ্ঞতাটা আর এক৷ তেমন অভিজ্ঞতা হলে বুঝতেন!…শুনবেন কেমন?…মড়ার বুকের ওপর বসেছি আসন করে, মড়ার খুলিতে করে মদ খাচ্ছি—মনে ভয়ডর কিছুই নেই, এই বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সেই লোকেরই বুকের মধ্যে হিম হয়ে গেল সে সব শুনে৷ না, না, তেমন ভয়ানক কিছু নয়, প্রথম শুরু হল ফিসফিস কথার শব্দ, খিলখিল হাসি, চাপা হাসিই৷ ক্রমে সেইটাই বাড়তে লাগল৷ মনে হল দশজন, বিশজন, একশজন—হাজার হাজার৷ আপনার চারপাশে যদি লক্ষলোকের ফিসফিস কথারই শব্দ হতে থাকে তো তেমন হয়? আর তার সঙ্গে চাপা এক ধরনের খিলখিল হাসি৷ তবু আমি স্থির হয়ে আসনেই বসে রইলুম—নড়লুম না৷ যদিও কাজে আর মন দিতে পারলুম না, এটাও ঠিক৷ তার পর মশাই—স্পষ্ট দেখতে লাগলুম শ্মশানের মাটি ফুঁড়ে ফুঁড়ে যেন মড়াগুলো উঠছে৷ কতকাল থেকে মরেছে সব—কত হাজার হাজার বছর ধরে৷ এক এক জনের বীভৎস চেহারা, রোগে যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ৷ কেউ বা খুন হয়েছিল, কেউ বা ঠ্যাঙাড়ের হাতে প্রাণ দিয়েছে, কেউ বা গলায়-দড়ির মড়া৷ ঠিক সেই অবস্থায় উঠেছে—তেমনি কন্ধকাটা কিংবা হাড়গোড় ভাঙা অবস্থায়৷ সকলেরই মুখে রাগ, চোখের দৃষ্টিতে আগুন৷ তারা সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে শাসাতে লাগল, পাপিষ্ঠ, তুই এখানে কেন? শ্মশান অপবিত্র করতে এসেছিস? চলে যা, দূর হয়ে যা! জানিস না, এখানে আমরা পাহারা দিচ্ছি? মনে পাপ নিয়ে তুই এসেছিস শ্মশান জাগাতে! চলে যা! তার মধ্যে একজনের আবার শুধু কঙ্কাল, বোধ হয় তাকে পুঁতে রেখেছিল কোথাও মেরে—তারপর তাকে তুলে পোড়াতে হয়েছে৷…সেটাই সবচেয়ে কাছাকাছি এল, মুখে সেই এক শব্দ, দূর হ! দূর হ! ভয় পেলুম খুব, তবু এও জানি, একবার ভয় পেলেই গেল—চিরকালের মতো৷ প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলুম, যাব না, যাব না৷ উঠব না আমি৷ ব্যস—আর যায় কোথা, সেই কঙ্কালটা আরো এগিয়ে এসে তার সেই অস্থিময় আঙুল কটা দিয়ে আমার গলাটা চেপে ধরলো৷ ওঃ, সে কী চাপ, যেন মোটা লোহার সাঁড়াশী! কত চেষ্টা করলুম মুক্ত হবার, কিন্তু সে বজ্রকঠিন মুষ্ঠি খোলে কার সাধ্য! দম বন্ধ হয়ে গেল, বুকে সে এক অসহ্য যন্ত্রণা—মনে হল যেন দেহের প্রতিটি শিরা ফেটে যাচ্ছে৷…আকুলিবিকুলি করতে লাগলুম এক ফোঁটা হাওয়ার জন্যে—সে হাওয়া চারিদিকেই রয়েছে তবু এক বিন্দু বুকের মধ্যে নিতে পারলুম না৷ বরং আরো চেপে বসতে লাগল সেই সাঁড়াশীর মতো আঙুলগুলো—৷…’

‘তারপর?’ রুদ্ধনিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে অনিমেষ৷

‘তারপর?’ আবার সেই হাসি, ‘তারপর আর কি, মুক্তি! সেই থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি এখানেই৷ কাজ নেই, কামাইও নেই৷ জায়গাটার মায়া ছাড়তে পারি নে৷৷…সবচেয়ে কষ্ট হয়, কথা কইবার লোক নেই বলেই—’

‘—কি—কিন্তু…’ কথা কইতে গিয়েও একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে অনিমেষের যেন গলা কেঁপে যায়, ‘আপনি মুক্তি পেলেন কি করে?’

‘তা আমিও জানি না৷ এক সময় দেখলুম যে, আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি আমারই ভূতপূর্ব আশ্রয় অর্থাৎ কিনা দেহটার পাশে৷ যারা এসেছিল তাদেরও তো কাজ শেষ, তারাও সব যে-যার মিলিয়ে গেছে৷ এককথায় সব কিছুর শান্তি৷’

তবু বুঝতে কয়েক মিনিট দেরি লাগে অনিমেষের, কথা কইতে গিয়েও গলার স্বর বিকৃত হয়ে যায়, ‘তার—তার মানে কি? আপনি কি বলতে চান যে আপনি তখন মা-মারা গেলেন? আ-আপনি কি মড়া?’

প্রশ্নের শেষ অংশটা আকস্মিক আর্তনাদের মতো চিৎকারে পরিসমাপ্ত হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন সে করছে কাকে? কেউ তো নেই! শুধু সে একা বসে আছে ঘরে, বাকি জিনিসগুলো ঠিক আছে, পিদিমটা তেমনি জ্বলছে৷ শুধু উবু হয়ে বসে যে লোকটা কথা বলছিল সে আর নেই—

কোথা দিয়ে গেল লোকটা, কখন উঠে গেল তার চোখের সামনে দিয়ে?

বার বার এই ব্যাকুল প্রশ্ন ওর মনে উঠতে লাগল কিন্তু উত্তর দেবে কে! খানিক পরে আসল প্রশ্নটা আবার প্রবল হয়ে উঠল, তাহলে কি লোকটা যা বলে গেল তাই সত্যি! ও লোকটা মানুষ নয়—অশরীরী, বিদেহী আত্মা! খাবার কিছু লাগে না ওর—বলেছিল বটে৷ মরবার ভয় নেই৷

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অনিমেষের কিন্তু সে শিক্ষিত ছেলে, বিজ্ঞান-পড়া ছেলে৷ এসব মিথ্যা—কল্পনা, আত্ম-সম্মোহন বলেই জানে৷ সে বিশ্বাস করবে না এ কথা যে, এই বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বসে সে ভূত দেখেছে!

আচ্ছা, পিছনে ছায়া পড়েছিল কি ওর? মনে করবার চেষ্টা করে অনিমেষ৷

সত্যিই কি—? না লোকটা তার সঙ্গে তামাশা করেছে? আগে যা ভেবেছিল তাই? ডাকাত বা ঠাঙাড়ে জাতীয়—ভয় দেখিয়ে গেল, এর পর কাজ হাসিল করা সোজা হবে ভেবে!

মনকে প্রবোধ দেয় সে, এইটে হওয়াই সম্ভব৷ ভূত হলে আলোয় থাকবে কি করে?…বদমাইশ! আরো বেশি ভয় দেখাবার জন্যে ম্যাজিকওয়ালাদের মতো চোখের নিমেষে সরে গেছে৷

দোরটা বন্ধ করে দেবে নাকি?

দেওয়াই উচিত৷

পালাবে?

কোথায় যাবে এই অন্ধকারে! আরো তো ওদের কবলে গিয়েই পড়তে হবে৷ সে দেখতে পাবে না ওদের, ওরা দেখবে৷ তার চেয়ে দোর বন্ধ করে বসে থাকা মন্দ নয়—যা হবার হবে, আলো তো থাকবে এখানে৷ লোকগুলোকে চোখে দেখা যাবে!

অনিমেষ অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াল৷ হাতে পায়ে যেন জোর নেই৷ কোনোমতে উঠে গিয়ে সন্তর্পণে দোরটা বন্ধ করে দিলে৷ ভাগ্যিস ভেতরে খিল আছে৷ বেশ মজবুত খিল৷ দেখেশুনে ভালো করে বন্ধ করল৷ যাক, নিশ্চিন্ত৷

কিন্তু এ কী?

হঠাৎ আলো নিভে গেল যে! মুহূর্তের মধ্যে, কোনোরকম নোটিশ না দিয়েই—ঘরটা তার চারপাশ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ভরে গেল৷ তেল ছিল না? কিন্তু তাহলে তো একটু একটু করে ম্লান হয়ে আসবে—

তবে—ভয়ে ওর গা-টা হিম হয়ে গেল—তবে কি ঘরের মধ্যে কেউ ছিল? এখন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে? সেই লোকটাই কি? হয়তো তক্তপোশের নিচে ঢুকে গিয়েছিল তখন, সেইখানেই লুকিয়ে ছিল, তাই সে ওর চলে যাওয়াটা লক্ষ্য করে নি৷ নিশ্চয়ই তাই৷

কী সর্বনাশ! এ যে হিতে বিপরীত হল! ওদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে একেবারে ওদের মুঠোর মধ্যেই এসে পড়ল৷ পকেটেতে দেশলাই পর্যন্ত নেই৷ যতদূর মনে পড়ে ব্যাগও নেই৷ ব্যাগটাই বা কোথায়? চৌকিটা যে ঠিক কোন দিকে, তাও তো মনে পড়ছে না!

উঃ—কী বদমাইশ লোকটা!

ক্রুদ্ধস্বরে, হয়তো বা একটু ভীত কণ্ঠেই অনিমেষ বলে উঠল, ‘কে? কে ওখানে? আলো জ্বালো বলছি শিগগির, নইলে ভালো হবে না, দেখিয়ে দেব মজা! কি, জ্বাললে না?’

নিস্তব্ধ চারিদিকে৷ কোথাও একটা জনপ্রাণী আছে বলে মনে পড়ে না৷ রহস্যময় সুগভীর স্তব্ধতা৷

ঘরে কি জানলা ছিল? তাও তো মনে পড়ছে না ছাই!

জানলা খুলে দিলে তবু একটু নক্ষত্রের আলো আসে৷

অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেও জানলা কোন দিকে মনে পড়ল না৷ আচ্ছা, একটু এগিয়ে গেলেই তো দেওয়াল, হাতড়ে দেখতে দোষ কি?

পরক্ষণেই মনে পড়ল, আরে, আচ্ছা বোকা তো সে! দোরটাই তো রয়েছে, খুলে বেরিয়ে পড়লেই তো হয়! ঘরের অন্ধকারের চেয়ে বরং বাইরের অন্ধকার ভাল, তারার আলো আছে৷ ব্যাগটা? থাকগে, প্রাণ তো বাঁচুক৷

যেদিকে দোর দিয়েছে এইমাত্র, সেইদিকেই হাত বাড়াল৷ কৈ সে দরজা? অথচ—ও তো সবে বন্ধ করে এপাশ ফিরেছে আর আলো নিভেছে!

তবে কি ও দিকভুল করেছে? এদিকে দরজা ছিল না?

আন্দাজে আন্দাজে এগিয়ে যায় সে৷ এইটুকু তো ঘর, দেওয়াল পেলে, দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে ঘুরলেই দরজা পাবে৷ শুধু ভয় হচ্ছে, ও লোকটা না এই সুযোগে পেছন থেকে মেরে বসে! কিন্তু উপায়ই বা কি? এদের কবলে যখন এসে পড়েছেই—

মরীয়া হয়েই এগোয় অনিমেষ৷ এক পা এক পা করে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোয়৷…এক দুই…একি, যে যে কুড়ি পা হয়ে গেল! ঘরটা যতদূর আন্দাজ হয়, দশ-বারো ফুটের বেশি হবে না লম্বায়৷ নেহাতই ছোট্ট ঘর৷ অথচ কুড়ি পা মানে অন্তত পনেরো ফুট!

আরো দু পা…আরো দশ—আরো কুড়ি৷

একি সে মাঠে চলেছে নাকি?

কী রকম হল? চল্লিশ পা চলার মতো ঘর তো নয়! কোনাকুনি হাঁটছে? তাতেই বা এতদূর হবে কেমন করে? তবু আরো কয়েক পা যায় সে৷ হয়তো চলতে চলতে তখন গতি বেঁকে গিয়েছে৷ সোজা হয়ে হাঁটে আরো খানিকটা৷

না, তবু দেওয়াল নেই৷ রহস্যময়, অন্ধকার, অনন্ত শূন্যতা৷ বাইরের মুক্ত শূন্যতা নয়, চার দেওয়াল চাপা—তবু তা অনন্ত৷

এইবার কপালে ঘাম দেখা দেয় অনিমেষের৷ এতক্ষণ ডাকাতের ভয়ে যা হয় নি এবার তাই হল, পা দুটো কাঁপতে লাগল থরথর করে৷…একেবারে যেন ভেঙে এল৷ অসহায় ভাবে সেইখানেই বসে পড়ল৷

এ তার কী হল? কী চক্রান্তে জড়িয়ে পড়ল সে?

তবে কি সে লোকটা অশরীরী—সত্যি-সত্যিই? সে কি তাহলে কোনো প্রেতযোনির মায়াতে এসে পড়েছে?

বিহ্বল হয়ে ভাবে অনিমেষ কি করবে, কিন্তু কোনো পথ দেখতে পায় না৷

ঐ যে কারা আসছে না? হ্যাঁ, ঐ তো কত লোকের পায়ের আওয়াজ! অন্তত আটদশ জনের কম নয়৷ কিংবা আরো বেশি৷ এই বাড়ির কাছেই আসছে, ঐ তো দাওয়ায় উঠল৷

‘ও মশাই, শুনছেন? ও মশাই—’

গলা দিয়ে স্বর বেরোল না৷ টাকরা শুকিয়ে গিয়েছে৷ গলা কাঠ৷

কিন্তু ওরাই যদি সেই ডাকাতের দল হয়? তা হোক, তবু তো তারা মানুষ৷ ভরসা হল একটু অনিমেষের৷ তাহলে অন্তত এটা প্রেতের মায়া নয়৷ আঃ—বাঁচা গেল!

হ্যাঁ—ডাকাতই৷

নইলে ওরা অমন ফিস ফিস করে কথা কইবে কেন? বহুলোক যেন পরস্পরের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা কইছে৷ আরো লোক বাড়ছে৷ আরো বহু পায়ের শব্দ, অসংখ্য, অগণিত ফিস ফিস করে কথা বলার আওয়াজ—

এ কি—ওরা কি ঘরে ঢুকেছে নাকি?

কেমন করে ঢুকল?

ওর যে চারিদিকে শব্দগুলো এগিয়ে আসছে! ওরই চারপাশে, খুব কাছে! খিল খিল করে চাপা হাসির শব্দ—অনেকে হাসছে তবু শব্দটা খুব জোর নয়৷

মাথা থেকে পা পর্যন্ত বরফ নেমে যায় যেন দেহের মধ্যে৷ হাত-পায়ে আর কোনো সাড় থাকে না৷ আতঙ্ক যে এমন জিনিস তা আগে অনিমেষ কল্পনাও করে নি৷ মস্তিষ্ক শুদ্ধ যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে আসছে…

চিৎকার করবে? সাধ্য নেই৷ পালাবে? পথ কৈ?

কিন্তু কিছু তো একটা করা উচিত৷

লোকগুলো যেন ওকে ঘিরে ধরেছে৷ তাদের নিঃশ্বাস, দূষিত তীব্র, উষ্ণ, নিঃশ্বাস ওর সর্বাঙ্গে…

মনে পড়ে গেল লোকটার বর্ণনা৷ সেও তো এমনি ফিস ফিস শব্দ শুনেছিল, এমনি হাসি৷ তারপর? তারপর? সেই মৃতের পুনরুত্থান, সেই কঙ্কালের অভিযান!

তারও অদৃষ্টে কি তাই হবে? সে তো কোনো দোষ করে নি৷ সে তো সাধনা করতে আসে নি শবের বুকের ওপর চড়ে?

অকস্মাৎ কে একজন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল তারই আশেপাশে কোথাও৷ তীক্ষ্ন চড়া গলার সে হাসি, মনে হল যেন তার পাশের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে, আবার চারিদিকের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে তারই চারিদিকে৷ বহুক্ষণ ধরে যেন সেই এক হাসির শব্দ ধ্বনিত আর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল তাকে ঘিরে৷ বিশ্রী, তীক্ষ্ন, একটা উপহাসের হাসি—সে হাসির জাল যেন তাকে চারিদিক থেকে বেড়ে ধরেছে, আর নিস্তার নেই—

প্রাণপণ চেষ্টায় মরীয়ার মতো চিৎকার করে উঠল একবার অনিমেষ, ‘হে ভগবান, এ কী করলে!’

সত্যিই তো৷ ভগবানের কথা তো তার মনে ছিল না৷ তাঁকে তো সে ডাকে নি৷

‘হে ভগবান, হে হরি, বাঁচাও—হে রামচন্দ্র!’ আর কিছু মনে এল না তার৷ গায়ত্রী মনে আছে কি? হ্যাঁ আছে৷ পৈতেটা কোথায়?…

সুগভীর ক্লান্তি আর অসহ তন্দ্রায় চৈতন্য শিথিল হয়ে আসে তার৷

ঘুম যখন ভাঙল অনিমেষের, তখনো সকাল হয় নি কিন্তু ফরসা হয়েছে একটু৷ খানিকটা সময় লাগল তার সবটা মনে করতে, তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ভালো করে চেয়ে দেখল যে সে বাস দাঁড়াবারই ফাঁকা জায়গাটায় পড়ে ঘুমিয়েছে কখন—সুটকেসটা খানিকটা দূরে একটা গাছতলায় পড়ে আছে৷…আরে—সে ঘর! সে ঘরটা কোথায় গেল? যতদূর দৃষ্টি যায়, কোথাও কোনো ঘরের চিহ্নমাত্রও তো নেই! সে কি বাস থেকে নেমে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল? তাই হবে হয়তো৷ হয়তো সবটাই ওর স্বপ্ন৷…

সে উঠে নদীতে গেল মুখ-হাত ধুতে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *