2 of 2

একমুঠো ছাই – হর্ষ দত্ত

একমুঠো ছাই – হর্ষ দত্ত

এত জোরে বৃষ্টি আর ঝড় কখনো দেখেছে কিনা শাশ্বত মনে করতে পারল না। কতক্ষণই বা ঝড়—জল হল? বড়োজোর আধঘণ্টা? কিন্তু তাতেই চতুর্দিক তছনছ। তপসিয়া জায়গাটা ভীষণ ঘিঞ্জি। ফলে ছোটো বিপর্যয় ঘটলে যেমন দেখতে লাগে, চারপাশে তাকিয়ে তেমনই মনে হচ্ছে। ঘণ্টাখানেক আগে শাশ্বত তপসিয়ায় এসেছে এক বিচিত্র উদ্দেশে। গত মাসে মা—কে ও একটা মাইক্রোআভেন কিনে দিয়েছে। অফ হোয়াইট রঙের মাঝারি মাপের আভেনটা শুধু কাজেরই নয়, রান্নাঘরের শোভা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ গত পরশু বাড়িতে একটা চিঠি এল আভেন কোম্পানির নয়ডা অফিস থেকে। চিঠির বক্তব্য,আমাদের ব্র্যান্ডের আভেন কেনার জন্য ধন্যবাদ। আপনার ক্যাশমেমো নম্বরটি—লটারিতে একটি গিফট পেয়েছে। আপনি তপসিয়া রোডে অবস্থিত আমাদের পাবলিক রিলেশন অফিস থেকে উপহারটি দশদিনের মধ্যে সংগ্রহ করলে বাধিত হব।

কিছু কিনলেই তৎক্ষণাৎ একটা বা দুটো ফ্রি কোনো জিনিস উপহার পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে শাশ্বতর কোনো আগ্রহ নেই। ওর মতে, এসব ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করার ফন্দি। কিন্তু চিঠিটার কথা বলে বলে দিদির মেয়ে বিন্নি ওকে অতিষ্ঠ করে ছাড়ল। ফোন করে, বাড়িতে এসে ওর একটাই কথা, যাও না রূপমামা, ওঁরা কী দেবেন নিয়ে এসো না! নিশ্চয়ই ভালো কিছু পাবে। এত বড়ো কোম্পানি! কেউ আদর করে ডেকে কিছু দিলে নিতে হয়।

বিন্নির কথা শুনে হাসি পেয়েছিল। তেরো বছরের মেয়ে, অথচ পাকা বুড়ির মতো কথা। হাসি চেপে নিমরাজি হয়েছে শাশ্বত, ঠিক আছে, যাব। তবে সস্তা বাজে মাল যদি গছিয়ে দেয়, তা হলে তোদের বাড়িতে ফেলে দিয়ে আসব। বিন্নি তাতেই রাজি হয়েছে।

পড়ন্ত বিকেলে শাশ্বত যখন তপসিয়ায় আসে, তখন আকাশে সামান্য মেঘ ছিল। কিন্তু সেই মেঘের আড়াল প্রকৃতি যে এমন রুদ্ররূপ নিয়ে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে, ভাবতেই পারেনি। তার ওপর আভেন কোম্পানির পিআর অফিসে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। শাশ্বতকে ওঁরা খুব আনন্দের সঙ্গে জানিয়েছেন, আপনি আর আপনার কোনো সঙ্গী যদি আগামী পুজোয় গোয়া বেড়াতে যান, তা হলে আমাদের লিসবন টাচু রিসর্টে দু—রাত্রি ফ্রি থাকতে পারবেন, আর বুফে লাঞ্চ ও ডিনারে ফিফটি পার্সেন্ট অফ। শাশ্বতর ইচ্ছে হচ্ছিল, পি আর পার্সোনেলদের মুখের ওপর বলে, গোয়া যাতায়াতের ভাড়াটা কে দেবে? আপনাদের অফ তো সেই গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল মশাই।

এমন অফার নেব কী নেব না পরে জানাব— এই বলে শাশ্বত ট্যাক্সি ধরার জন্য পার্ক সার্কাস—বাইপাস কানেকটরের দিকে এগিয়ে আসছিল। তখনই ঝড়টা এল, তার একটু পরেই অঝোরে বৃষ্টি। পড়িমরি করে ও একটা চায়ের দোকানের ছোট্ট শেডের তলায় এসে দাঁড়িয়েছিল বটে। কিন্তু বেশ ভিজে গেছে। তার ওপর তার ছিঁড়ে যাওয়াতে বা অন্য কোনো কারণে কারেন্ট নেই, চারদিক অন্ধকার!

অকস্মাৎ যেমন এসেছিল, তেমনই ঝপ করে জল পড়া থেমে গেল। হাত, মুখ আর চশমার কাচ মুছে সামান্য এই শেডের তলা থেকে বেরোতে যাবে শাশ্বত, ওর চোখে পড়ল রাস্তার ওপারে একটু কোনাকুনি, একটা মস্ত দরজার ওপর বিশাল সাইনবোর্ড। সম্ভবত গ্লো—সাইন। এপাশ—ওপাশ থেকে ছিটকে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় শাশ্বত দেখল, নীল প্লাস্টিকের ওপর বেশ বড়োসড়ো সাদা অক্ষরে বাংলায় লেখা— তপসিয়া হিন্দু কবরস্থান। অবাক হয়ে গেল শাশ্বত। হিন্দুদের আবার কবর দেওয়া হয় নাকি? আশ্চর্য তো! এমন একটা সৎকার প্রথার কথা ও জানতই না। সাইনবোর্ডটার দিকে আঙুল দেখিয়ে শাশ্বত চাওয়ালাকে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল, হিন্দুরা মারা গেলে কি এখানে কবর দেওয়া হয়? আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?

দোকানি শাশ্বতর দিকে একঝলক তাকালেন। তারপর একজন খদ্দেরের হাতে একটা চা—ভরতি ভাঁড় ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ছোটো ছোটো হিন্দু বাচ্চা মরে গেলে এখানে গোর দেয়। কভি কভি কোই হিন্দু জাত, জাদা ওমরের আদমিও লিয়ে আসে।

এমন একটা কবরস্থানের কথা শাশ্বতর জানাই ছিল না। তবে এটুকু জানত, দুধের শিশু মারা গেলে তাদের দাহ করা হয় না। ওর বিস্ময়াপন্ন মুখের দিকে এবার তাকিয়ে বিহারি চা—ওয়ালা বললেন, কবরখানার ভিতরে যান, গেট খুলা। দেখবেন কর্পোরেশনের লোক আছে। সব বলে দেবে।

আর একটু ডিটেলে জানার জন্য শাশ্বত বেরিয়াল গ্রাউন্ডের বিরাট দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ জায়গা, শেষ দেখা যাচ্ছে না। মাঠের মতো জমির বুক চিরে এধার—ওধার সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে। দূরে দূরে হয়তো গাছপালা, ঝোপঝাড় আছে। ওর মনে হল, ভেতরের আনাচেকানাচে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের আলোর টুকরো। হাঁটি—হাঁটি পা—পা শিশুদের মতো!

ভিতরে খানিকটা ঢুকে এসে কাউকে দেখতে পেল না শাশ্বত। বাঁ—হাতি একটা দোতলা ভাঙাচোরা—বাড়ি। বাড়িটার একপাশে বৃষ্টির জল জমে আছে। হারিকেন জাতীয় কোনো আলো জ্বলছে একতলায়। উঁকিঝুঁকি দিয়ে খানিকটা হতাশ হয়ে ঘাড় ঘোরাতেই চমকে গেল শাশ্বত। মাথায় অর্ধেক ঘোমটা দেওয়া এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন ওর পিছনে। মুখটা খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মহিলার শাড়ির রং ধূসর। গজের মতো কাপড়ে জড়ানো একটি শিশুকে পেটের কাছটায় দু—হাতে আঁকড়ে ধরে আছেন।

শাশ্বত কিছু বলার আগেই হিমস্তব্ধ গলায় মহিলা অনুনয় করলেন, কিছু সাহায্য করবেন? আমার মেয়ে খুব অসুস্থ।

কী হয়েছে আপনার মেয়ের? শাশ্বত অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল।

ঠিক ততক্ষণাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মতো একঝলক নীল আলো ছুঁয়ে গেল মহিলার মুখ। শাশ্বত স্পষ্ট দেখল, বিষাদগ্রস্ত, রক্তশূন্য এক তরুণী অপলকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কোনো প্রাণ নেই, প্রাণের স্পর্শও নেই। শিশুটি ততোধিক নিস্পন্দ। উত্তরের অপেক্ষা না করে পার্স থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরল শাশ্বত। যেন তৃতীয় একটা হাত বের করে টাকাটা নিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর কবরখানার দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। শাশ্বতর সারা শরীর কেমন যেন শিরশির করে উঠল।

দুই

খবরের কাগজের দু—নম্বর পাতায় যত রকমের সচিত্র বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখা শাশ্বতর মায়ের একটা নেশা। সভা—সমাবেশ, দিনপঞ্জিকা, আবহাওয়া আপনার আজকের দিনটি তো আছে, সেইসঙ্গে স্মৃতির উদ্দেশে, শোকসংবাদ, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, কর্মখালি থেকে শুরু করে জ্যোতিষীদের নানা চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন। মা শুধু পড়ে না, মর্মস্পর্শী বা অদ্ভুত কোনো কিছু নাড়া দিয়ে যায়, তা হলে একে—তাকে বলে। শাশ্বতও বাদ যায় না। কোনো সন্দেহ নেই, বিজ্ঞাপনগুলো নানা তথ্য আর চমকের খনি। দেখতে শুরু করলে নেশা ধরে যায়।

দ্রুত চোখে বারো পাতার কাগজ উলটেপালটে দেখে শাশ্বত স্নান করতে গিয়েছিল। জামা—প্যান্ট পরে খাওয়ার টেবিলে এসে বসতেই মা বলল, দুর, সকাল বেলাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী সাংঘাতিক একটা শোকসংবাদ বেরিয়েছে, পড়েছিস?

কাগজটা খাওয়ার টেবিলে পড়ে আছে। শাশ্বত হাতে তুলে নিল। শোকসংবাদ মানে সেই দু—নম্বর পৃষ্ঠা। একেবারে প্রথম কলমে ওপর থেকে নীচের দিকে সার সার ছবি আর ছবির তলায় কয়েক ফোঁটা চোখের জলের মতো খবর। তিন আর চার নম্বর ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই শাশ্বতর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগাড়! এ কী দেখছে চোখের সামনে! ইনি তো সেই ভদ্রমহিলা, যিনি সেদিন বেরিয়াল গ্রাউন্ডের সামনে ওর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছিলেন। ছবির মুখটায় শুধু বিষণ্ণতাটুকু নেই। কিন্তু তা ছাড়া সব এক। সেই চোখ, নাক, কপাল এমনকী মাথায় অর্ধেক ঘোমটা। ওঁর নীচের ছবিটি একটি শিশুকন্যার। কী মিষ্টি দেখতে। চোখ ভরতি কাজল, ছোট্ট কপালে চাঁদের মতো গোল কালো টিপ! এই বাচ্চাটিই কি সেদিন মহিলার কোলে ছিল? ওর মুখ সেদিন স্পষ্ট দেখতে পায়নি শাশ্বত। তবু এতটুকু ভুল হচ্ছে না। মহিলার মুখটা যে—কোনো কারণেই হোক ওর স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আর ঘটনাটাও তো এই পরশু দিনের! কিন্তু এরা মারা গিয়েছে কবে? ভদ্রমহিলার ছবির নীচে চার লাইনের একটি লেখা: মা অদিতি, পৃথাকে নিয়ে তুই পনেরো দিন আগে পরপারে চলে গেছিস। আজ তোদের স্মরণ অনুষ্ঠান। যাদের চক্রান্তে তোরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলি, তাদের কখনো ক্ষমা করিস না। ইতি বাবা, মা ও ভাইদা।

মুহূর্তে হাত—পা ঠান্ডা হয়ে গেল শাশ্বতর। যারা পনেরো দিন আগে মারা গেছে, তাদের সঙ্গে গত পরশু কী করে দেখা হল? এ হতে পারে না। ওর যুক্তিবাদী মন বিদ্রোহ করে উঠল। কিন্তু ছবি দুটোর দিকে আবার তাকাতেই হিম হয়ে এল সারা শরীর। ভদ্রমহিলা যেন স্তব্ধ মুখে ওর দিকে তীব্র ব্যঙ্গে তাকিয়ে আছেন।

রান্নাঘরে মা ওর ভাতের থালা সাজাচ্ছে। বেশ ভয়ার্ত স্বরে শাশ্বত ডাকল, মা!

ছেলের অস্বাভাবিক ডাকে খানিকটা অবাক হয়ে মা ওর সামনে এসে বলল, কী রে মুখ শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

শাশ্বত ছবি দুটোর দিকে আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এই বিজ্ঞাপনটার কথা বলছিলে? নিজের গলার স্বর শাশ্বতর কানে কেমন যেন নিস্তেজ শোনাল।

হ্যাঁ রে, এইটে। মা—মেয়ে দু—জনে একই দিনে মারা গেছে! আশ্চর্য। কীভাবে যে মারা গেল। এখানে তো কিছুই লেখেনি। আহা, মেয়েটা কী ফুটফুটে! একেবারে ফুলের মতো।

জানো, শাশ্বত প্রায় ভাঙাভাঙা স্বরে বলল, পরশু হিন্দু বেরিয়াল গ্রাউন্ডের সামনে এই ভদ্রমহিলাকে টাকা দিয়েছিলাম! তোমায় ঘটনাটা বলেছি… এঁকেই…

কী যা—তা বকছিস। মা দু—চোখ কপালে তুলে বলল, এরা তো পনেরো দিন আগে মারা গেছে! পরশু এদের কী করে দেখবি?

শাশ্বত ভয়ংকর জোর দিয়ে বলল, না, আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। মেমরিও ফেল করেনি।

মা ঠোঁট উলটে বলল, কী জানি বাবা, যত সব অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! মরা মানুষ তোর সামনে এসে সাহায্য চাইবে কোন দুঃখে। সে তো তখন সব দুঃখ—কষ্টের পার! নে, দুটি খেয়ে নে। আপিসে দেরি হয়ে যাবে। তখন আমার ওপরে চেঁচাবি।

সামান্য ভাত—মাছের ঝোলটুকুও শাশ্বত তৃপ্তি করে খেতে পারল না। দু—তিন গ্রাস খাওয়ার পরই মনে হল, বমি উঠে আসছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর মুহূর্তে শাশ্বত মা—কে বলল, কাগজটা তোমার পড়া হয়ে গেলে গুছিয়ে রেখে দেবে তো। আমি ফিরে এসে আবার দেখব। কাউকে দেবে না।

‘কাউকে দেবে না’ মানে শাশ্বত পাশের বাড়ির বিভূতিবাবুকে ইঙ্গিত করল। সত্তরোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক একটু বেলার দিকে এসে কাগজটা পড়বেন বলে নিয়ে যান। কিন্তু প্রায়ই ওঁর ফেরত দেওয়ার কথা মনে থাকে না। খুব সংকোচের সঙ্গে মা—কে চেয়ে নিতে হয়।

অফিসে ওর পাশে বসে কুন্তল। বেশ হুল্লোড়বাজ ছেলে। পাড়ার গলিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে শবযাত্রা— সব আইটেমেই কুন্তলকে দেখতে পাওয়া যায়। ওকে ঘটনাটা বলে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করবে ভেবেছিল শাশ্বত। কিন্তু টিফিন টাইমের আগে পর্যন্ত বলতেই পারল না। টিফিনের পর কুন্তলই হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে? আজ এত গম্ভীর আর চুপচাপ হয়ে আছিস? এনি প্রবলেম?

প্রথমে মাথা ঝাঁকিয়ে শাশ্বত বলল, না কিছু হয়নি। ঠিক আছি। তারপর একটু ভেবে কুন্তলকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি ভূত, আত্মা, স্পিরিট, ঘোস্ট— এসবে বিশ্বাস করিস?

বেশ অবাক হয়ে গেল কুন্তল? বলল, কেন বল তো?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শাশ্বত হিন্দু কবরখানা থেকে আজকের খবরের কাগজ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা জানাল। হুল্লোড়বাজ হলেও কুন্তল ওর কোনো কথাই উড়িয়ে না দিয়ে বলল,হয়তো ভদ্রমহিলার ছবিটা আইডেনটিক্যাল। এমন তো হতেই পারে!

কিন্তু বাচ্চাটা! শাশ্বত চাপা আর্তনাদ করে উঠল যেন।

খটকাটা তো ওখানেই! যদিও তুই বাচ্চাটার মুখ দেখতে পাসনি।

সব শিশুর মুখ প্রায় একরকম। সুন্দর, নিষ্পাপ….

কুন্তল চিবুকে হাত ঘষল, তা ঠিক। এটাকে একটা অকাল্ট এক্সপেরিয়েন্স বলে ভাবতে পারিস। এ ছাড়া আর কী হতে পারে! তবে ওই ভূত আত্মা, অশরীরী— এসব পুরো ধাপ্পা, বাজে কথা, গাঁজাখুরি ব্যাপার। ডোন্ট ওরি…

কথা বলতে বলতে কুন্তল কম্পিউটারে চোখ রাখল। শাশ্বত নিজেও কুন্তলের মতো ভাবতে চায়। মৃত্যুর পরে মানুষ কেবল নানা স্মৃতিতে বেঁচে থাকে। পুড়িয়ে দেওয়া বা সমাধি দেওয়া দেহ পুনরায় দেখতে পাওয়াই অসম্ভব। কেননা মানুষের সারা শরীর ওই প্রক্রিয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র যুক্তি সাজাতে থাকল শাশ্বত। কিন্তু কিছুতেই ভদ্রমহিলার মুখটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারল না।

তিন

অফিস থেকে বেরোতে আজ অস্বাভাবিক দেরি হয়ে গেল, একটা জরুরি ফাইল কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না শাশ্বত। যে—কাবার্ডে ফাইলটা থাকার কথা সেখানে গতকালই দেখেছিল। কারও ওটা নেওয়ার কথা নয়। খুঁজতে খুঁজতে একসময় দিশেহারা লাগছিল। জরুরি ফাইল, হারিয়ে গেলে কোম্পানির ক্ষতি, সেই সঙ্গে ওর সম্মান ও চাকরি নিয়ে টানাটানি। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফাইলটা পেয়েছে ওর টেবিলের নীচের ড্রয়ারে। অথচ ড্রয়ারগুলো খুঁজতে বাকি রাখেনি শাশ্বত। ফাইলটা ড্রয়ারের মধ্যে দেখতে পেয়ে শাশ্বতর মনে হয়েছিল, এইমাত্র ওর চোখে ধুলো দিয়ে যেন কেউ রেখে দিয়েছে! কুন্তল,আশিসদা, দাসবাবু এবং আরও কেউ কেউ ওকে জিজ্ঞেস করছিল, কী খুঁজছ? কী হারালে? কাউকেই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি শাশ্বত। ভাসাভাসা উত্তর দিয়েছিল। অথচ অস্পষ্টতা ওর স্বভাব নয়। আজ কেন যে এমন ব্যবহার করল। কে কী ভাবল কে জানে।

দেরির ওপর দেরি যোগ হল মেট্রোতে। শোভাবাজার থেকে শ্যামবাজারের মধ্যবর্তী টানেলে হঠাৎ ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলেই যেখানে কারণ জানা যায় না, সেখানে সুড়ঙ্গের ভেতরে অথই পাথারে ভাসতে থাকার মতো অবস্থা। রাত হয়ে গেলেও নানা কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার ভিড় প্রতিটি কামরায়। যদিও প্রাণান্তকর পরিবেশ তৈরি হয়নি, তবে একটু পরেই গরম লাগতে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে অল্পস্বল্প নিশ্বাসের কষ্ট। ভেস্টিবিউলের এন্ট্রির দিকে দাঁড়িয়ে ছিল শাশ্বত। এখানে বেশ হাওয়া পাওয়া যায়, ধাক্কাধাক্কি কম। আচমকা ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়ে যদিও সব সুখই তখন হারিয়ে গেছে। চোখ বুজে অসহায় ভাবে প্রহর গুনছিল শ্বাশ্বত। তখনই স্পষ্ট শুনতে পেল একটি শিশুর কান্না। একবছর দেড়বছরের বিন্নি ঠিক ওইভাবেই কাঁদত। খিদে পেলে, শরীরে কোনো কষ্ট হলে কিংবা নিছক সাফোকেশনে।

শাশ্বত ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করেছিল কোনখান থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। নিশ্চয়ই গরমে বাচ্চাটার খুব কষ্ট হচ্ছে। ফাঁক দিয়ে, পাশ দিয়ে, অন্য যাত্রীদের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়েও শাশ্বত দেখতে পায়নি। ভেস্টিবিউলে অর্ধেক শরীর ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইশ—তেইশ বছরের এক যুবক ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, কাউকে খুঁজছেন?

কই না তো! শাশ্বত গভীর বিস্ময়ে বলেছিল, একটা বাচ্চা কোথায় কাঁদছে না! কোনখানে বলুন তো! সেটাই দেখতে চেষ্টা করছি!

যুবকটি প্রথমে হতবাক হয়ে গেছিল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছে, কেউ কাঁদছে না তো! আপনি বলছেন বাচ্চার কান্না! কিন্তু কোথায়? নাহ…! কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিল তরুণটি। সামান্য পরে ওর দিকে সন্দেহ ও অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

ওরই মধ্যে দু—বার ফোন করেছিল বিন্নি। কিন্তু কথা বলতে গেলেই লাইন কেটে গেছে। বিন্নি বিরক্ত হয়ে এসএমএস পাঠিয়েছে। কিন্তু তাতেও সাম টেক্সট মিসিং। শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনের পুরোটা আর তৃতীয় লাইনের অর্ধেক এসেছিল : রূপমামা, ডু ইউ নো, হাউ মেনি বেরিয়াল গ্রাউন্ডস ইন ক্যালকাটা? ক্যান ইউ গিভ মি আ পিকচার… অফ…। আধখামচা এসএমএসটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাশ্বত মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। সেই বেরিয়াল গ্রাউন্ড। কিন্তু বিন্নি হঠাৎ এসব জানতে চাইছে কেন? কলকাতা সংক্রান্ত কোনো জেনারেল নলেজের প্রশ্ন? কিংবা বিন্নি কি ওর দিদার কাছ থেকে কিছু শুনেছে? মা কি এরই মধ্যে ব্যাপারটা পাঁচকান করে দিয়ে বসে আছে?

এসব ভাবতে ভাবতে শাশ্বত বাড়ি ফিরেছে প্রায় পৌনে দশটায়। দুর্যোগ আর দুর্ভোগ আজ সকাল থেকে ওর পিছু নিয়েছে। ওর দেরি হচ্ছে দেখে চিন্তায় আকুল মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। শাশ্বত বাড়ি ঢুকতেই গভীর স্বস্তি পেয়েছে। মা দেরির কারণ জিজ্ঞেস না করে বলেছে, জানিস, বিভূতিবাবু খবরের কাগজটা নিতে এসেছিলেন। আমি দিইনি। ওটা তোর আলমারিতে রেখে দিয়েছি।

ভালো করেছ। ক্লান্ত স্বরে বলেছে শাশ্বত, খুব খিদে পেয়েছে মা। চা—টা আর খাব না। তুমি আমাকে রাতের খাবার দিয়ে দাও।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মা কিছু একটা ভেবেছিল। তারপর নিঃশব্দে ছেলের ইচ্ছে পূরণ করেছে।

এই একটু আগে খেয়ে উঠেছে শাশ্বত। বিছানায় একটু গড়িয়ে নেওয়ার জন্য ও শুয়ে পড়ল। ভাবল, একটু পরে খবরের কাগজটা দেখবে। কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে। ভুল থেকে যত সব ইলুশন, হ্যালুসিনেশন! মনটা অকারণে চঞ্চল হয়ে আছে। কোনো মানে হয়! মঙ্গল গ্রহে প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে বিজ্ঞান যেখানে মরিয়া, সেখানে, সেই সময়ে বসে প্রাণহীনদের নিয়ে শাশ্বত উলটোপালটা চিন্তা করছে!

সহসা ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল শাশ্বত জানেই না। ঘরের আলো মনে হয় মা নিভিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু কীসের শব্দ? একবার ছাদ থেকে কার্নিশে মাটি ভরতি গাছের টব পড়ে যেতে এরকম শব্দ হয়েছিল। ওর ঘরের পশ্চিম দিকের জানলা দিয়ে রাস্তার আলোর একটা ফালি ঢুকে আসে। আজ সেই আলোটা নেই। তা হলে কি লোডশেডিং? তাই বা কী করে হবে! ওই তো সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা পাখাটা বনবন করে ঘুরছে। রাস্তার আলোটা হয়তো কোনো কারণে জ্বলছে না। বালিশের দু—পাশে হাত দিয়ে চশমাটা খুঁজল শাশ্বত। শোওয়ার আগে আশেপাশে কোথাও খুলে রেখেছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে খুঁজে পেল না।

তরাসে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ দুটো জ্বালাজ্বালা করছে। বাথরুমে গিয়ে চোখে—মুখে একটু জল দিয়ে এলে হয়তো আরাম লাগবে। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে শাশ্বত মাত্র অর্ধেক উঠেছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘরের কাঠের আলমারির একটা পাল্লা ধড়াস খুলে গেল। কেউ যেন ভেতর থেকে ঠেলে খুলে দিল দরজাটা। শাশ্বত আর নড়তে পারল না। ন্যাপথলিনের হালকা গন্ধের সঙ্গে একটা ভয় যেন সারা ঘরে ছড়িয়ে গেল।

ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল শাশ্বত, কে?

কেউ সাড়া দিল না। পরক্ষণে ওর মনে হল, কোনো মানুষ এসব করছে না। অন্য কেউ। কিন্তু কে সে? যা কিছু ঘটছে কোনোটাই স্বাভাবিক নয়। আলমারিটা বেশ পুরোনো, সেগুন কাঠের তৈরি। পাল্লাটা কি হাওয়ায় কাঁপছে? আরও একটা শব্দ পাচ্ছে শাশ্বত। খুব নির্জন জায়গায় ঝরাপাতা কিংবা টুকরো ছেঁড়া কাগজ হাওয়ার ধাক্কায় সরে সরে গেলে যেমন শব্দ হয়, তেমন।

দপ কর একঝলক আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সেই ক্ষণিক আলোর ঝলকানিতে শাশ্বত স্পষ্ট দেখল মেঝেতে পড়ে আছে অগ্নিদগ্ধ একটি শিশু ও এক মহিলার দেহ। মহিলার আধপোড়া ডান হাতটা শিশুটিকে ছোঁয়ার জন্য যেন নড়ছে। চিৎকরে করে উঠল শাশ্বত। কিন্তু বুঝতে পারল, ওর মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। অচেতনের আবর্তে তলিয়ে যেতে যেতে শাশ্বত আবার প্রাণপণ আর্তনাদ করে উঠল।

চার

মা আর নন্দামাসির চেঁচামেচিতে শাশ্বতর ঘুম ভেঙে গেল। একী, ঘড়িতে ন—টা পাঁচ! এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল ও! কেউ ডাকেনি কেন? কখন তৈরি হবে, কখনই—বা অফিসে যাবে! সব—কটা ইন্দ্রিয় সজাগ হতেই শাশ্বত বুঝতে পারল নন্দামাসি জোর দিয়ে বলছে, আমার তিন কুড়ি বয়েস হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু চোখের মাথা এখনও খাইনি গো বউদি! আমি স্পষ্ট দেখলুম, শাশ্বতর ঘর থেকে অরু বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল!

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নন্দা! কী উলটোপালটা বলছ! অরু কোত্থেকে আসবে? ও এল, অথচ আমি জানতে পারলাম না! মায়ের গলা আরও চড়ে গেল, নেশা—ভাঙ করলে লোকজনের কথা এমন অদ্ভুত হয়ে যায়। তোমার চোখে কি ছানি পড়েছে! যত বাজে কথা!

অরু ওর দিদির ডাকনাম। নন্দামাসি ওদের বাড়িতে বহুদিন ধরে কাজ করছে। যদিও ঠিকে কাজ, কিন্তু অনেকটা সময় এখানে থাকে। একটু নিটপিটে ধরনের, তবে কাজকর্ম ভীষণ পরিষ্কার। মায়ের সঙ্গে ওর খুব ভালো সম্পর্ক। কিন্তু আজ নন্দামাসির কথায় মা রেগে আগুন। বিষয়টাও বড়ো অদ্ভুত! নন্দামাসি দিদিকে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছে। সত্যিই এ এক আজগুবি কল্পনা! না—জানিয়ে দিদি কক্ষনও বাপের বাড়ি আসে না। তা হলে? কাকে দেখল নন্দামাসি? দিদির মতো কে ওর ঘর থেকে বেরিয়েছে? শাশ্বত ভেবে পেল না।

তা তো বলবে। এই তো শতর খাটের তলায় ঝাঁট দিতে গিয়ে দেখি একটা লাল রঙের বল আর রুপোর ঝুমঝুমি পড়ে আছে। গিয়ে দেখো না। ওগুলো শতর ঘরে কোত্থেকে এল? হয়তো বিন্নির ছোটোবেলার খেলনা। কোনো কারণে অরু নিয়ে এসে ভাইয়ের ঘরে রেখে গেছে। শত ঘুমোচ্ছিল দেখে আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনি। জিনিসগুলো সরিয়ে ঝাঁট দিয়েছি।

শাশ্বতর মাথার মধ্যে যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওর খাটের তলায় ঝুমঝুমি আর লাল বল। খাটের ওপর থেকে শরীর ঝুঁকিয়ে দেখল শাশ্বত। কিছুই নেই। শুধু বাড়িতে পরার হাওয়াই চটিটা এক কোণে পড়ে আছে। আশ্চর্য, নন্দামাসি কি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়েছে! নীচ থেকে মাথা তুলতেই কাঠের আলমারিটার দিকে ওর চোখ চলে গেল। তৎক্ষণাৎ শাশ্বতর চোখে ছবির মতো ভেসে উঠল কাল রাতের প্রতিটা মুহূর্ত। হাড়হিম করা এক—একটা দৃশ্য। দৃশ্য, নাকি স্বপ্ন! ও কি শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে গেছিল? আলমারির দরজাটা এখন দিব্যি বন্ধ। খাট থেকে লাফিয়ে নেমে দুটো পাল্লা টেনে খুলে ফেলল শাশ্বত। মা বলেছিল, কাগজটা আলমারির ভেতর রেখেছে। কিন্তু কোথায়? কাগজটা তো নেই! তা হলে কি জামাকাপড়ের ভাঁজের নীচে লুকিয়ে রাখা আছে! শাশ্বত চেঁচিয়ে ডাকল, মা!

কী হয়েছে বাবা! নন্দামাসিকে নিয়ে মা এরই মধ্যে ঘরে ঢুকে এসেছে। সম্ভবত লাল বল আর ঝুমঝুমি দেখতে।

কাগজটা কই! কোথায় রেখেছ! শাশ্বতর নিজের কানেই নিজের কণ্ঠস্বর ভীষণ রুক্ষ শোনাল।

রীতিমতো চমকে গিয়ে মা বলল, ওই তো দু—নম্বর তাকটায় তোর গেঞ্জিগুলোর ওপর রেখেছিলাম। সে কী রে সত্যিই তো নেই! সর, সর, কোথাও ঢুকে গেল কিনা দেখি!

মা আলমারিটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে। এদিকে খাটের তলায় অর্ধেক ঢুকে নন্দামাসি হাঁউমাউ করে উঠল, এ কী অলুক্ষনে, অনাছিষ্টি। আমি নিজের হাতে ঝুমঝুমিটা সরালুম গো। এখন তো দেখছি হাওয়া। হায় হায়, তোমাদের কাছে বেমালুম মিথ্যেবাদী হয়ে গেলুম!

এদিকে মায়ের নাটক, ওদিকে নন্দামাসির। মেজাজ হারাল শাশ্বত, আমার ঘর থেকে সবাই এখুনি বেরিয়ে যাও। যাও বলছি! মা, তুমি আমাকে ডাকোনি কেন? কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে উঠতে পারলাম না, তুমিও জাগিয়ে দিলে না। অফিসটা ফালতু কামাই হয়ে গেল।

খবরের কাগজটা খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থ ক্লান্ত মা ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল, আজ তো পয়লা মে। তোর অফিস বন্ধ, ছুটি। তাই ডাকিনি। অঘোরে ঘুমোচ্ছিলি।

নিজের আচরণে লজ্জা পেল শাশ্বত। আজ যে পয়লা মে ভুলেই গেছিল। ক—দিন ধরে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! মাথা নীচু করে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মা অনুচ্চ স্বরে বলল, কাগজটা ঠিক ওখানেই গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু গেল কোথায়!

চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল নন্দামাসি। ওর দুটো হাত ধরে বলল, বিশ্বাস করো শতবাবু, অরুর মতো ছিপছিপে, শাড়ি পরা একটা মেয়েকে তোমার ঘর থেকে বেরোতে দেখেছি। ঝুমঝুমি আর লাল রঙের বলও…। আমি এতটুকু বাজে কথা বলছি না। এসব বলে আমার কী লাভ!

মেয়েটির কোলে কি কোনো বাচ্চা ছিল? নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে আনমনে জিজ্ঞেস করল শাশ্বত।

চোখ বড়ো বড়ো করে, একটু ভেবে নন্দামাসি বলল, তা তো দেখিনি। আমি বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে বাসনের জল মুছছিলাম। মেয়েলোকটা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল, খুঁটিয়ে দেখতে পাইনি। মনে হল অরু, তাই অত মাথাও ঘামাইনি।

নন্দামাসিকে আশ্বস্ত করে শাশ্বত বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোথাও একটা গন্ডগোল হচ্ছে। তাই এসব উলটোপালটা…। তুমি কাজে যাও।

চোখে দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সর্বত্র একটা তছনছ অবস্থা! টয়লেট থেকে ঘুরে এসে মোবাইল অন করে শাশ্বত দেখল লগবুকে কুন্তলের কল। রিং ব্যাক করল শাশ্বত, কী রে, ফোন করেছিলি?

শোন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। তোর ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কথা মনে পড়ল। তিনি ওই কাগজেই কাজ করেন। ভদ্রলোক অ্যাডভার্টাইসমেন্ট ডিপার্টমেন্টে আছেন। যাঁরা ওই ছবিসহ শোকসংবাদটা দিয়েছেন তাঁদের কোনো কনটাক্ট নম্বর যদি জানা যায়, এই আশা নিয়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তা ভদ্রলোক কাগজের ফাইল দেখে আমাকে স্পষ্ট বললেন, ওইদিন ওরকম কোনো শোকসংবাদ বেরোয়নি।

তার মানে? শাশ্বত চমকে গেল।

ইয়েস। তা ওঁকে আমি বললাম, হয়তো অন্য কোনো এডিশনে বেরিয়েছে— লেট সিটি বা রিজিওনাল। উনি বললেন, ক্লাসিফায়েড অ্যাড সব এডিশনেই প্রকাশিত হয়। তুই তারিখটা ভুল বলেছিস ভেবে ওঁকে গত একসপ্তাহের কাগজ দেখতে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোক আমার আবদারে বিরক্ত হননি, তবে একটু পরে বিস্ময় ঝরিয়ে বললেন, এক সপ্তাহ কেন, গত একমাসেও নেই। কী ব্যাপার বলো তো! আমি তো….

হাতের মুঠো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। কানের ওপর থেকে মোবাইলটা নামিয়ে আনল শাশ্বত। এইসব অবিশ্বাস্য, যুক্তিহীন ঘটনার পরম্পরাগুলো মেলাতে চেষ্টা করল। এক অতীন্দ্রিয় জগতের রহস্যে ঘটনাগুলো আবৃত হয়ে আছে। সবকিছুই কি তবে দৃষ্টিভ্রম? মায়াবী মিথ্যা! কোনো উত্তর খুঁজে পেল না শাশ্বত। সাঁড়াশির মতো যত রাজ্যের অস্বস্তি ওকে পিষে ধরল যেন।

দুপুরের মুখে হন্তদন্ত হয়ে এলেন বিভূতিবাবু। শাশ্বত দেখল, ওঁর হাতের মুঠোয় বাসি খবরের কাগজটা অল্প অল্প কাঁপছে। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে ভদ্রলোক শাশ্বতকে বললেন, দেখো কী কাণ্ড, কাল তোমার মায়ের কাছ থেকে কাগজটা নিতে এসেছিলাম। তা তখন উনি কোনো কারণে দিতে পারেননি। আজ দেখছি আমাদের লেটার বক্সে লম্বা করে এটা ঢুকিয়ে রাখা আছে। তোমাদের বাড়ি থেকেই কেউ নিশ্চয় রেখে এসেছে।

বিস্ফারিত চোখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে শাশ্বত বলল, ওটা আপনি নিয়ে যান।

সামান্য মুখ বিকৃতি করে বিভূতিবাবু বললেন, না ভাই। কোনো দরকার নেই। লেটার বক্সের তালা খুলে কাগজটা যখন বের করছি, মনে হল কারেন্ট খেলাম। তারপর এইটুকু রাস্তা আসছি, হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলাম! স্পষ্ট ফিল করলাম, কে যেন ধাক্কা মারল! পেছন ফিরে দেখি কেউ নেই! এসব পরের দ্রব্য না বলে ছোঁয়ার শাস্তি। এই রইল তোমাদের কাগজ।

দোমড়ানো—মোচড়ানো পাতাগুলো ওর সামনে নামিয়ে রেখে বিভূতিবাবু অজানা ভয়ে গা মুচড়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।

শাশ্বতর মনে হল, খবরের কাগজটা নয়, ওর চোখের সামনে পড়ে আছে একমুঠো মানুষ পোড়া ছাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *