একপাটি জুতো
একটা তদন্ত সেরে বাড়িমুখো হয়েছে জয়ন্ত ও মানিক৷ সঙ্গে একজন সেপাই ও একজন দারোগা৷ রাস্তা দিয়ে তারা গল্প করতে করতে আসছে, হঠাৎ একখানা বাড়ির দোতলা থেকে ডাক এল-‘ও জয়ন্ত, ও মানিক!’
তারা মুখ তুলে দেখে বারান্দার উপরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের পুরাতন বন্ধু নবীনচন্দ্র৷ সে জমিদার৷ জয়ন্ত ও মানিককে নিয়ে মাঝে মাঝে নিজের জমিদারিতে শিকার করতে যান৷
নবীন বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ আছে৷ ভিতরে এসে বৈঠকখানায় বসো৷ আমি যাচ্ছি৷’
বৈঠকখানায় ঢুকেই জয়ন্তের হুঁশিয়ার চোখ দেখল দুটো ব্যাপার৷ দেয়ালের বড়ো ঘড়িটা নামিয়ে রাখা হয়েছে মেঝের উপরে৷ এবং পূর্বদিকের জানালায় একটা গরাদ নেই, সেটাকেও কে খুলে মেঝের উপরে ফেলে রেখেছে৷ জানালার কাছে গিয়ে সে বুঝতে পারল, জানালার তলাকার কাঠের ফ্রেমে বাটালি বা কোনো অস্ত্র চালিয়ে কেউ স্থানচ্যুত করেছে গরাদটাকে৷
সে ফিরে বলল, ‘মানিক, এই ঘরে কেউ অনাধিকার প্রবেশ করেছে৷ নবীন বোধ হয় সেইজন্যেই আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চায়৷’
‘ঠিক আন্দাজ করেছ, জয়ন্ত৷ সেইজন্যেই আমি তোমাকে ডেকেছি বটে৷’-বলতে বলতে নবীন ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল৷
আসন গ্রহণ করল সকলে৷ বেয়ারাকে চা, টোস্ট, এগপোচ আনবার হুকুম দিয়ে নবীন বলল, ‘কাল রাতে এই ঘরে চুরি হয়ে গিয়েছে৷ গুরুতর চুরি নয়, তোমার মতো ধুরন্ধর গোয়েন্দার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার বলেই মনে হবে৷ চুরি গিয়েছে আমার একটি রেডিয়ো৷’
মানিক বিস্মিত স্বরে বলল, ‘তোমার ঘরে রেডিয়ো!’
নবীন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ মানিক৷ তোমরা সকলেই জানো, রেডিয়োর একটানা একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানানি আমার ধাতে সহ্য হয় না, তাই এতদিন এ বাড়িতে রেডিয়োর ছিল না কোনো ঠাঁই৷ কিন্তু বড়ো মেয়েটা রেডিয়োর জন্যে এমন বিষম আব্দার ধরেছে যে, কাল বৈকালে নগদ একশত পঞ্চাশ টাকা মূল্য দিয়ে একটা রেডিয়ো না কিনে এনে আর পারা গেল না৷ যন্ত্রটা টেবিলের উপর রেখে ঘর থেকে চলে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু চোর তাকে এখানে রাত্রিবাসও করতে দেয়নি৷’
জয়ন্ত বলল, ‘চোর এসেছে ওই গরাদটা খুলে?’
‘হ্যাঁ৷’
‘পূর্বদিকের ওই সরু গলিটা কী?’
‘মেথর আসবার পথ৷ চোর বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ওই গলিতে দাঁড়িয়ে ফ্রেম কেটে গরাদ খোলবার সুযোগ পেয়েছিল৷’
‘ঘড়িটা মেঝেয় নামানো কেন?’
‘ওটাও চোরের কীর্তি৷ তার ইচ্ছা ছিল ঘড়িটাও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে৷ কিন্তু ঘরে সন্দেহজনক শব্দ শুনে বেয়ারা এসে পড়ায় সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে৷ তাড়াতাড়ি পালাবার সময়ে সে নিজের একপাটি জুতোও নিয়ে যেতে পারেনি৷’
এইবার জয়ন্ত কিঞ্চিৎ আগ্রহ প্রকাশ করে বলল, ‘জুতো? কোথায় সেই জুতো?’
‘ওই যে, জানালার তলাতেই পড়ে রয়েছে৷’
জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে জুতোর পাটিটা তুলে নিল, বেশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে৷ তারপর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলল-‘নবীন এ হচ্ছে এমন কোনো লোকের জুতো যার ডান পদতল বিকৃত, জুতোর বেডৌল গড়ন দেখেই তা ধরা যায়৷ বাটার কারখানায় তৈরি সস্তা দামের ছয় নম্বরের রবারের জুতো৷ এর ভিতরে সাদা সাদা কী রয়েছে দেখেছ!’
‘বোধ হয় গুঁড়ো চুন!’
জয়ন্ত মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, না৷
বেয়ারা চা প্রভৃতি নিয়ে এল এমন সময়৷
একটা টেবিলের কাছে গিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘রেডিয়োটা কাল রাতে এই টেবিলের উপর ছিল তো? বেশ, আমি এখানে বসেই চা পান করব৷’
জয়ন্ত নীরবে চা ও খাবার খেতে খেতে উত্তর দিকের জানালাগুলো দিয়ে বারংবার রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল৷
পানাহার শেষ করে জয়ন্ত বলল, ‘নবীন, তোমার বাড়িতে রেডিয়োর গণ্ডগোল কেউ কোনোদিন শোনেনি; এ বাড়িতে ওই উপসর্গ আছে, বাইরের লোকেরা এমন সন্দেহ করতে পারে না৷ অথচ যেদিন তুমি রেডিয়ো কিনেছ, ঠিক সেই দিনই তা চুরি হয়ে গেল৷ সুতরাং বেশ বোঝা যায় এ হচ্ছে পাড়ার কোনো সন্ধানী চোরের কাণ্ড৷ যন্ত্রটা সে বৈকালেই রাস্তা থেকে দেখতে পেয়েছিল৷’
নবীন বলল, ‘কিন্তু সে যে কে, বুঝতে পারব কেমন করে?’
‘এখান থেকে রাস্তার ওপারে দেখতে পাচ্ছি দু-খানা বাড়ি৷ ও বাড়ি দু-খানা কাদের?’
‘লাল বাড়িখানায় থাকেন হাইকোর্টের এক উকিল৷ পাশের হলদে বাড়িখানা ভাড়াটে-বাড়ি৷ একখানা কি দু-খানা ঘর নিয়ে ওখানে বাস করে ছয়-সাতটি পরিবার৷ আমাদের সরকারবাবুও থাকেন ওই বাড়ির দোতলায়৷’
‘বটে, বটে! একবার তাঁকে এখানে আসতে বলবে?’
অবিলম্বে সরকারবাবুর প্রবেশ৷ জয়ন্ত সুধোল, ‘আপনার নাম?’
‘শ্রীবিনয়কুমার প্রামাণিক?’
‘সামনে ওই বাড়িতে কতদিন বাস করছেন?’
‘প্রায় তিন বৎসর৷’
‘ওখানকার আর সব ভাড়াটেকে আপনি চেনেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ প্রায় সকলকেই৷’
‘দোতলায় আপনার সঙ্গে থাকেন কারা?’
‘পরিবার নিয়ে আর তিনটি ভদ্রলোক৷’
‘তাঁদের পেশা?’
‘দু-জন কেরানী, একজন স্কুলমাস্টার৷’
‘নীচে কারা থাকেন?’
‘সবাই পূর্ববঙ্গের লোক৷’
‘তাঁরা কী কাজ করেন?’
‘বেশির ভাগ লোকই কাটা কাপড়ের ব্যাবসা করে৷ একজন কেবল শাঁখারিদের দোকানের কারিগর৷’
‘নাম জানেন?’
‘হ্যাঁ, দুলাল৷’
‘বিনয়বাবু, একটা কাজ করুন৷ দয়া করে দুলালকে একবার এখানে ডেকে আনুন৷ তাকে বলবেন, নবীনবাবুর স্ত্রী দু-ডজন খুব ভালো শাঁখা কিনতে চান, তিনিই তাকে ডেকেছেন৷’
‘যে আজ্ঞে৷’
সরকারের প্রস্থান৷ নবীন সবিস্ময়ে বলল, ‘তোমার এ কী অদ্ভুত খেয়াল জয়ন্ত৷ দু-ডজন কি, আমার স্ত্রী এক গাছাও শাঁখা কিনতে চান না৷’
‘তোমার স্ত্রী আজ আলবত দু-ডজন শাঁখা কিনতে চান৷ তুমি জানো না৷’
‘আমি জানি না, তুমি জানো?’
‘নিশ্চয়৷’
‘জয়ন্ত, তুমি একটি পাগল৷’
‘নবীন, তুমি একটি সুবৃহৎ হাঁদারাম!’
‘মানে?’
‘মানে এখনই বুঝতে পারবে৷’
‘দেখা যাক৷ কিন্তু দু-ডজন শাঁখার দাম দিতে হবে তোমাকেই৷ ঘরের বাইরে পদশব্দ৷ সরকারবাবুর পিছনে একটি মূর্তির আবির্ভাব! বয়স উনিশ-বিশের বেশি হবে না৷ সংকুচিত ভাবভঙ্গী, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি! পরনে আধ-ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি৷ খালি পা৷
জয়ন্ত শুধোল, ‘তোমার নাম দুলাল?’
আগন্তুক ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
জয়ন্ত লক্ষ করল, দুলালের ডানপায়ের পায়ের পাতা এমনভাবে বিকৃত যে সোজাভাবে মাটিতে পা ফেলে সে দাঁড়াতে পারে না৷ তার দুই পায়ের নীচের দিকে লেগে রয়েছে সাদা সাদা কীসের গুঁড়ো!
জয়ন্ত বললেন, ‘দুলাল, আমার কাছে এসো৷’
দুলাল প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এল৷
ফস করে সেই রবারের জুতোর পাটি বার করে জয়ন্ত শান্ত স্বরে বলল, ‘দুলাল, কাল রাতে তোমার একপাটি জুতো এই ঘরে ফেলে রেখে গিয়েছিলে৷ ফিরিয়ে নাও তোমার জুতো৷’
প্রথমটা চমকে উঠে, তারপর সবেগে মাথা নেড়ে দুলাল বলে উঠল, ‘ও জুতো আমার নয়!’
‘জুতো তোমারই৷ পায়ে পরে দেখো-তোমার দুমড়ানো পায়ের সঙ্গে ঠিক খাপ খেয়ে যাবে৷’
দুলাল চুপ করে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ তার মুখ ধরা-পড়া চোরের মতো৷
জয়ন্ত বলল, ‘নবীন, এই একপাটি জুতোর মধ্যেই আছে চোরের স্বাক্ষর৷ জুতোর ভিতরে যে সাদা গুঁড়োগুলোকে তুমি চুনের গুঁড়ো বলে ভ্রম করেছিলে, আসলে তা হচ্ছে শাঁখের গুঁড়ো; আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম৷ শাঁখারিরা ঠিক দুই পায়ের উপর শাঁখ রেখে যখন করাত চালায়, তখন তাদের দুই পায়ের উপরেই ছড়িয়ে পড়ে শঙ্খচূর্ণ৷ দুলালের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখো- শাঁখার পাউডার মেখে ওর পদযুগল এখনও শ্বেতবর্ণ হয়ে রয়েছে৷ ওর দুই পদ জুতোর মধ্যে প্রবেশ করলে তার ভিতরেও লেগে থাকে শাঁখের গুঁড়ো৷ বেডৌল জুতোর পাটি পরীক্ষা করে খুব সহজেই ধরে ফেলেছিলাম যে, এর মালিক হচ্ছে এমন কোনো শাঁখারি, যার দক্ষিণ পদতল বিকৃত৷ তবু যদি দুলাল এখনও অপরাধ স্বীকার না করে, তুমি এই দারোগাবাবুটির সাহায্য নিতে পার৷ এসো মানিক, আমাদের এখন বিদায় নেবার সময় হয়েছে৷’