একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

বি.এস.সি পরীক্ষা সামনে এসে গেছে, পড়াশুনো কিছুই করি নি৷ মেজদার নতুন মোটরটায় সত্তর মাইল স্পিড দিয়ে ডায়মন্ডহারবারে কিম্বা চন্দননগরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হল্লা, এ-সবেই দিন কেটেছে৷ কিন্তু আর নয়, বই খুলে এবার ঘরে বসেছি৷ রাত বোধহয় অনেক হল৷ বৈঠকখানা থেকে বড়দার ব্রিজের আসরের তর্কাতর্কি আর কানে আসছে না৷ মেজদা ডাক্তার, অনেকক্ষণ রোগী দেখে ফিরে এসে তাঁর ঘরে শুয়ে পড়েছেন৷

কেটে গেছে আরো বেশ কিছুক্ষণ৷ এবার ঘুম পাচ্ছে, রীতিমতো ঢুলে পড়ছি, কিন্তু না, ঢুললে চলবে না, ঘুমোলে চলবে না৷ খাতা নিয়ে অঙ্ক কষতে শুরু করলাম৷ অঙ্ক কষছি তো কষছিই৷ এমন সময় দরজার পাল্লা ঠেলে হঠাৎ-ই মেজদার আবির্ভাব৷

বললেন, ওরে একটু আমার সঙ্গে চল তো৷ ড্রাইভার বাড়ি চলে গেছে৷ এদিকে ‘কল’-ও এসে গেছে জরুরি, না গেলেই নয়৷ যত জ্বালাতন এই এত রাত্রে! ডাক্তারি করা যে কী ঝকমারি!

বড় ভারিক্কি মানুষ এই মেজদা, এখনো বেশ সমীহ করে চলতে হয়৷ বড়দা হলে না-হয় একটু আপত্তির গুনগুনানি তুলতাম, কিন্তু মেজদা—? ওরে বাবা, তবেই সর্বনাশ!

নিরুত্তরে চললাম মেজদার সঙ্গে৷ গাড়ি বার করলাম গ্যারেজ থেকে৷ মেজদা এসে পাশে বসলেন৷ আর ভিতরের সিটে বসলো একটি মধ্যবয়স্ক গেঁয়ো লোক৷ এই লোকটিই বুঝি ডাকতে এসেছিল মেজদাকে! ঐ বোকা-বোকা ভালোমানুষ গোছের লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে যা চটলাম ওর ওপরে, তা বলার নয়৷ ব্যাটা এত রাত্তির করে এসেছে ডাক্তার ডাকতে! না হয় অন্য ডাক্তারকে ডাক! তা নয়, মেজদাকেই চাই, কেন, সারা শহর জুড়ে আর কোনো ডাক্তার ছিল না?

নির্জন রাস্তা, রেগেমেগে দিলাম স্পিড বাড়িয়ে, যতটা পারি৷

এ-রাস্তা সে-রাস্তা করতে করতে শহরের প্রায় বাইরে অন্ধকার এক কানা গলির সামনে লোকটা দাঁড় করালো আমাদের৷ তারপরে গাড়ি থেকে নেমে মেজদাকে বললো, একটু বসুন ডাক্তারবাবু, আমি লণ্ঠনটা নিয়ে আসি, বড় অন্ধকার! (ওদিকে তখন লোডশেডিং চলছিল বোধহয়)৷

লোকটা দেখতে দেখতে গলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ আর তার কয়েক মুহূর্ত পরে গলির মধ্য থেকে বেরিয়ে এল আর একটি মধ্যবয়সী লোক৷ (ঐ অন্ধকার থেকেই৷ হাতে কোনো লণ্ঠন বা টর্চ ছিল না৷) মোটরের কাছ-বরাবর এসে আমাদের দুজনকে দেখে একটু ধমকে দাঁড়ালো, বললো,—ডাক্তারবাবু বুঝি?

মেজদা মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলেন, হ্যাঁ, আমিই ডাক্তার৷ লোকটি বললে, আর দেখে কী করবেন বাবু, রোগীর ওদিকে হয়ে গেছে! বলেই আর দাঁড়ালো না, গাড়ির পাশ কাটিয়ে চলে গেল যেন কোনদিকে৷

আমরা নির্বাক৷ একটু পরেই এল সেই আগের লোকটি, লণ্ঠন হাতে৷ বললো, আসুন ডাক্তারবাবু৷

মেজদা যথারীতি গেলেন তার পিছনে পিছনে৷

কিন্তু কী আশ্চর্য, ফিরে এলেন একটু পরেই৷ যেন পলক ফেলতে না ফেলতে! একটা সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে ছিল, তার আর ফুরসৎ পেলাম না৷

মেজদা হাতের ব্যাগটা ভিতরে রেখে দিয়ে বসলেন এসে আমার পাশে৷ বললেন, দেরি করিস নি, শীগগির স্টার্ট দে!

গলাটা ওঁর যেন একটু ধরা-ধরা, স্বরটা কাঁপা-কাঁপা৷

দিলাম গাড়ি চালিয়ে৷ একটুক্ষণ চলবার পর মেজদা বললেন, হ্যাঁরে, যে-লোকটা আমাদের কাছে এসে বললে, ‘রোগী মরে গেছে’,—তার মুখখানা লক্ষ করেছিলি?

—হ্যাঁ৷ ন্যাড়ামাথা—কালোপানা মুখ৷ চোখ দুটো—

—সেই লোকটাই রোগী৷ গিয়ে দেখি বিছানায় মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে৷ কথাটা বলেই মেজদা আমার দিকে একটু ঘন হয়ে সরে বসলেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *