একদিন অপরাহ্নে – ৯

৯.

আমজাদ একদিন গালিবকে বলল, তুই যে বাগান বাড়িতে এতদিন বাস করছিস, ভূতের উৎপাত হয় নি?

গালিব বলল, তুই ভূত বিশ্বাস করিস?

না।

তা হলে ঐ কথা বললি কেন?

সবাই বলে ঐ বাড়িতে ভূতের উৎপাত, তাই বললাম আর কি?

ভাবছি, তোর চাচার কাছে থেকে বাড়িসহ পুরো বাগানটা কিনে মাদরাসা করব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, তাই। এই এলাকাই স্কুল থাকলেও মাদরাসা নেই। আমি এমন একটা মাদরাসা করতে চাই যেখানে ধর্মীয় সবকিছুর শিক্ষার সাথে সাথে স্কুলের সমমানের শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষা পেয়ে যেন ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতের পারে।

তোর আইডিয়া খুব ভালো। এ ব্যাপারে আমি তোকে যথাসাধ্য সাহায্য করব। তবে কি জানিস, চাচা এই বাগান বিক্রি করবেন না।

কেন?

তা বলতে পারব না।

তুই জানলি কি করে উনি বিক্রি করবেন না?

বেশ কয়েক বছর আগে চেয়ারম্যান ন্যায্য দামের চেয়ে বেশি দিয়ে কিনতে চেয়েছিলেন, চাচা রাজি হননি।

চেয়ারম্যানের বাড়ি কোথায়?

এই তো পাশের গ্রামে।

তখন কোনো কারণে হয়তো বিক্রি করেন নি, মাদরাসা করার কথা বললে রাজি হতে পারেন। তোকে সঙ্গে নিয়ে একদিন যাব ওনার কাছে।

ঠিক আছে, তাই হবে। আচ্ছা, তুই যে কাজের জন্য এখানে পোস্ট মাস্টার হয়ে এসেছিস, তার কি হল? এতদিন হয়ে গেল কোন ব্লু পেয়েছিস?

এতদিন চেষ্টা করে না পেলেও এখন তোর সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে পেয়েছি।

বুঝলাম না।

বোঝারই কথা, কারণ তুই তো আর গোয়েন্দা না। তারপর ছাদে ইট পড়া থেকে শুরু করে দারোগা সাহেবের বাড়ি সার্চ করা পর্যন্ত সবকিছু বলে বলল, ছাদে ইট পড়া ও খালুকে হত্য করার পিছনে থানার দারোগা সাহেব জড়িত। আমি আসল হোতাকে ধরার জন্য ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা করছি। আল্লাহ আজ মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েছেন। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আসল হোতা। চেয়ারম্যান।

কি পাগলের মতো কথা বলছিস? চেয়ারম্যান শুধু শুধু তোর খালুকে হত্যা করতে যাবেন কেন? আর ছাদে ইট-ই বা ফেলতে যাবেন কেন?

সেই কেনটা আবিষ্কার করতে এসেছি এবং ইনশাআল্লাহ কিছু দিনের মধ্যে সফল হতে পারব।

আচ্ছা, তুই যে বললি বাগান বাড়িটা কিনে মাদারাসা করবি, এত টাকা পাবি কোথায়? আমি যতটুকু জানি, এত টাকা তোদের নেই।

আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে খুশি করার জন্য মায়ের কথামতো এটা করতে চাচ্ছি। তাই টাকার চিন্তা করিনি। আল্লাহই ব্যবস্থা করে দেবেন।

ভালো কাজে আল্লাহ সাহায্য করেন তা আমিও জানি কিন্তু ……

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে গালিব বলল, এসব কথা রেখে তোর কথা বল।

আমজাদ বলল, আমার আবার কি কথা?

প্রথম কথা মেমকে বিয়ে করে শান্তি না অশান্তি ভোগ করছিস, না অনুশোচনায় ভুগছিস?

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারব না। আমার মনে হয় আমাদের দেশের মেয়েরা ওর মতো স্বামীকে ভালবাসতে পারে না। সব থেকে বড় শান্তি কি জানিস, ও সময় পেলেই ধর্মীয় বই পুস্তক ও বিভিন্ন হাদিস যেমন পড়ছে, তেমনি সেসব মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

গালিবও আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, যাক, শুনে খুশি হলাম। “পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল ধার্মিক স্ত্রী” এটা হাদিসের কথা। এবার বল, ভাবিকে নিয়ে গ্রমেই থাকবি, না ঢাকায় থাকবি?

গ্রামেই থাকব।

ভাবি থাকবে?

থাকার কথা বলেই তো এসেছে। তা ছাড়া আমি থাকলে ও থাকতে বাধ্য। কারণ আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে পারবে না।

শুনে আরও খুশি হলাম। তুই গ্রামে থাকলে আমার পরিকল্পনা তাড়াতাড়ি সাকসেসফুল হবে।

কোনটা, মাদরাসা, গোয়েন্দাগিরি?

দুটোই। কিন্তু তোকে তো কিছু রোজগার করতে হবে। কথায় আছে, বসে বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও একদিন শেষ হয়ে যায়।

আমজাদ বলল, ভাবছি, বাজারে ডিপার্টমেন্টাল দোকান করব। সে ব্যাপারে আব্বার সঙ্গে আলাপ করেছি। উনি রাজি আছেন।

গালিব আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তা হলে ভালই হবে। তুই আমাকে সাহায্য করবি, আর ভাবি মাকে সাহায্য করবে।

বুঝলাম না।

তুই আমাকে কি সাহায্য করবি, সে কথা পরে জানতে পারবি। মা বয়স্ক মেয়েদের কুরআন ও বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেবে আর ভাবি তাদের বাংলা শেখাবে।

আমি মনে করি, পরিকল্পনার কাজ শুরু করার আগে তোর ও রায়হানের বিয়ের কাজ সেরে ফেলা উচিত।

তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস; কিন্তু বিয়ে করে বৌ রাখব কোথায়? তাই আপাতত বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে পরিকল্পনার কাজ শুরু করার সাথে সাথে অন্তত চার রুমের একটা বাড়ি করতে হবে।

তনির মনের খবর পেয়েছিস?

পুরোপুরি না পেলেও যতটুকু পেয়েছি তাতেই পজেটিভ বুঝেছি।

খালাম্মা কণাকে রায়হানের জন্য সিলেক্ট করেছেন। এ ব্যাপারে তোর কতটুকু মত?

তার আগে তোর মতামত বল। অনেকে তো বন্ধুর সঙ্গে বোনের বিয়ে দিতে চায় না।

আমি চাই। এবার তোরটা বল।

আমার একশভাগ মত।

রায়হান কণাকে পছন্দ করে কিনা জানিস?

জানি, পছন্দ করে। তবে বিয়ে করার মতো পছন্দ করে কিনা জানি না। অবশ্য মা বললে না করবে না।

তারা খালের ব্রিজের উপর বসে কথা বলছিল। এমন সময় মাগরিবের আযান শুনে মসজিদে গেল নামায পড়ার জন্য।

নামায পড়ে ঘরে এসে চা নাস্তা খাওয়ার সময় গালিব মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি না কি কণাকে রায়হানের বৌ করতে চাও?

আমেনা বিবি বললেন, হ্যাঁ, চাই। তারপর আবার বললেন, আমজাদ তোকে বলেছে তাই না?

রায়হানও তাদের সঙ্গে নাস্তা খাচ্ছিল। গালিব তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কিছু বলার আছে?

রায়হান বলার আগে আমেনা বিবি বললেন, কণাকে পছন্দ হওয়ার কথা ও আমাকে জানিয়েছে।

রায়হান গালিবকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই যে তনিমাকে বিয়ে করতে চাস, সেকথা মাকে বলিসনি?

এবারও গালিব কিছু বলার আগে আমেনা বিবি হেসে ফেলে বললেন, তুই আসার আগেই ও সেকথা জানিয়েছে। তাই তো তনির মা-বাবার সঙ্গে ও কণার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে আমজাদকে বলেছি।

গালিব বলল, কিন্তু মা তুমি এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? আমাদের বিয়ে দিয়ে দুটো বৌ রাখবে কোথায়? তাই আজ আমজাদ যখন তোমার কথা বলল, তখন বললাম, আগে জায়গা কিনে চার রুমের বাড়ি করি, তারপর বিয়ে করব।

মা কিছু বলার আগের রায়হান বলল, তুই ঠিক কথা বলেছিস।

গালিব বলল, তোমাদেরকে তো আমার প্ল্যান প্রোগ্রামের কথা বলেছি। দু’একদিনের মধ্যে আমজাদকে নিয়ে তার চাচার কাছে গিয়ে এই বাড়িসহ পুরো বাগানটা কেনার কথা বলব। পাঁচ কাঠা বসতবাড়ির জন্য রেখে বাকি অংশে মাদরাসা ও এতিমখানা করব।

আমেনা বিবি বললেন, আমজাদের চাচা এই বাগান বিক্রি করলে ভালো। না করলে অন্য জায়গা দেখার কথা আমজাদকে বলবি।

রায়হান বলল, তুই যে এত কিছু করতে চাচ্ছিস, টাকা কোথায় পাবি?

গালিব বলল, আল্লাহ দেবেন।

তা তো জানি কিন্তু আল্লাহ নিজের হাতে দেন না, কারো মারফত দেন। সেই মারফতটা কে শুনি?

আল্লাহ কার মারফাত দেবেন, তা তিনি জানেন, আমি জানব কি করে?

রায়হান মাকে বলল, তোমার বড় ছেলে অবুঝের মতো কথা বলছে। তুমি কিছু বলবে না?

আমেনা বিবি মৃদু হেসে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে খুশি করার জন্য কোনো কাজ করার মনস্থ করলে আল্লাহ সাহায্য করেন। আর আল্লাহ সাহায্য করলে, কোনো চিন্তা করার কারণ নেই। শোন, তুইতো জানিস, আমি তোর নানার একমাত্র সন্তান। যদিও তোর একজন খালা ছিল। সে তো নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছে। তাই তোর নানার সব সম্পত্তি আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন। আর তোদের আব্বাও মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাই তোদের দাদার সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তোদের বাবা। তা ছাড়া তোদের বাবা মারা যাওয়ার পর কয়েক লক্ষ টাকা অফিস থেকে পাওয়া যায়। আমি এইসব দিয়ে মাদরাসা ও এতিমখানা করতে চাই। এতে করে তোদের নানা, দাদা ও বাবা যেমন কেয়ামত পর্যন্ত সওয়াব পাবে, তেমনি আমরা মারা যাওয়ার পরও পাব। আর মাদরাসা ও এতিমখানা যাতে বন্ধ না হয় সে জন্য ছাত্রদের দ্বারা উৎপাদনমূলক কিছু ব্যবস্থা করা হবে। বাকি দেশের ধনবানরা যাতে সাহায্য করেন, সে ব্যবস্থাও করা হবে। বাকি আল্লাহ পাকের মর্জি।

রায়হান বলল, গালিব জানলেও আমি তো এতকিছু জানতাম না। তোমরা আমাকে মাফ করে দাও।

আমেনা বিবি বললেন, আল্লাহ সবাইকে মাফ করুন। তারপর আবার বললেন, এসব কথা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করবি না। এমন কি আমজাদের কাছেও না।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে রায়হান কণাকে একা যেতে দেখে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, তোমার সই আ সনি?

স্যারকে দেখেই কণার ভাইয়ার কথা মনে পড়তে লজ্জা পেয়েছে। এখন আবার তুমি করে বলেছে শুনে আরও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করেই হাঁটতে হাঁটতে বলল, ওর শরীর খারাপ তাই আসে নি।

রায়হান বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, মাইন্ড করবে না তো?

কণা বলল, মাইন্ড করার মতো কথা বললে সবাই মাইন্ড করে। তবু বলার অনুমতি দিলাম।

তনি যে গালিবকে পছন্দ করে, তা কি তুমি জান?

জানি।

তুমি কাউকে পছন্দ কর?

আপনার কি মনে হয়?

কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে তাকে প্রশ্ন করা উচিত নয়।

একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে এরকম প্রশ্ন করা কি উচিত?

শুধু ছাত্রী শিক্ষক হলে উচিত হত না। বন্ধুর বোন হিসাবে জিজ্ঞেস করেছি।

তা হলে তো ভাইয়ার বন্ধু হিসাবে আমিও আপনাকে ঐ একই প্রশ্ন করতে পারি?

হ্যাঁ, তা পার।

তা হলে আপনি আগে বলুন।

যতদিন ঢাকায় পোড়াশোনা করেছি ততদিন কোনো মেয়েকে পছন্দ করার কথা চিন্তা করিনি। এখানে আসার পর একটি মেয়েকে ভীষণ ভালো লেগেছে। মেয়েটি রাজি থাকলে তাকে বিয়েও করব ইনশাআল্লাহ।

কণা খুব লজ্জা পেলেও বলল, তাই না কি?

হ্যাঁ, তাই।

কণা ভনিতা করে বলল, মেয়েটির পরিচয় বলুন, ভাইয়াকে শুভস্য শিঘ করার ব্যবস্থা করতে বলব।

আমি সিওর, তুমি তোমার ভাইয়াকে কথাটা বলতে পারবে না।

বলেই দেখুন না, বলতে পারি কি না।

যদি বলি সেই মেয়েটি তুমি?

কণা এত লজ্জা পেল যে, কোনো কথা বলতে পারল না।

কি, ভাইয়াকে শুভস্য শিঘ করার কথা বলতে পারবে তো?

কণা কোনো রকমে বলল, আপনি কিন্তু আমাকে ভীষণ লজ্জা দিচ্ছেন।

সরি বলে রায়হান বলল, আমাকে তোমার পছন্দ কিনা বললেই আর লজ্জা দেব না।

আপনি কি জানেন না, মেয়েরা মুখ ফুটে এসব কথা বলতে পারে না?

তা জানব না কেন? যারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, তারা মূর্খ অথবা অল্প শিক্ষিত। কিন্তু তুমি তো তা নাও।

কথাটা ঠিক হলেও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। পাড়াগাঁয়ে কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত কেউ-ই এ ব্যাপারে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। কারণ পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের শহরের মেয়েদের থেকে লজ্জা বেশি।

ঠিক আছে, যা জানার জানা হয়ে গেছে। এবার একটা কথা বলব রাখবে তো?

রাখবার হলে নিশ্চয় রাখব।

আমাকে আপনি নয়, তুমি করে বলবে।

তা সম্ভব নয়।

কেন?

আপনি বয়সে বড়, তা ছাড়া শিক্ষক, তুমি করে বলা কি উচিত আপনিই বলুন?

উচিত অনুচিতের কথা বললে হবে না, কারণ ভাইয়ার বন্ধুকে তুমি করে বললে কোনো দোষ হবে না।

তা না হয় স্বীকার করলাম কিন্তু সবাই কি ভাববে? না, না, মাফ করবেন, আপনার কথা রাখতে পারব না।

তা হলে সবার সামনে আপনি করে বললেও যখন আমরা একাকি থাকব তখন তুমি করে বলবে বল।

ঠিক আছে, চেষ্টা করব। এবার আমার একটা কথার উত্তর দিন। আপনার মা কি জানেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন।

হ্যাঁ, জানেন।

কলেজ থেকে ফেরার সময় আগে রায়হানদের বাসা। ততক্ষণে তারা রায়হানদের বাসার কাছে এসে যেতে রায়হান বলল, এখন যাও, পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করব।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *