একদিন অপরাহ্নে – ২

২.

পরের দিন বাগানে ছবি আঁকতে গিয়ে মাজল খাটাবার সময় আব্বার কথা তনির মনে পড়ল, মনে হয় পোস্টমাস্টার ইমাম সাহেবের চেয়ে বড় আলেম। তারপর ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে গেল। হঠাৎ ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এসে চিন্তা করল, এখন শরৎকাল, বউ কথা কও পাখি এসময় ডাকে না। ডাকটা অল্প দূর থেকে হচ্ছে মনে হতে এদিক ওদিক তাকাতেই গালিবকে একটা গাছের আড়ালে দেখতে পেল। পরক্ষণে তাকে হাসি-হাসি মুখে আসতে দেখে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

গালিব কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

তনি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর বলল, আপনার বউ কথা কও পাখির ডাক আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। আর দু’তিনবার ডাকুন তো?

গালিব বলল, আজ নয়, অন্য দিন।

আজ নয় কেন?

যে জিনিস ভালো লাগে, তা বেশি হলে আগের মতো আর ভালো লাগে না।

তা হলে অন্য কোনো পাখির ডাক ডাকুন।

আজ আর কোনো পশু পাখির ডাক ডাকতে ইচ্ছা করছে না।

তা হলে বলুন, আপনি কি সব পশু পাখির ডাক ডাকতে পারেন?

সেদিন বললাম না, যেসব পশু-পাখির সঙ্গে আমরা পরিচিত তাদের ডাক ডাকতে পারি? এমন কি যে কোনো পুরুষ ও নারীর গলা অনুকরণ করতে পারি। তারপর তনির গলা অনুকরণ করে বলল, আচ্ছা, আপনি কি সব পশু পাখির ডাক ডাকতে পারেন?

তনি এত অবাক হল যে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

গালিব মৃদু হেসে বলল, এতে অবাক হবার কি আছে? আপনিও চেষ্টা করলে পারবেন। তারপর বলল, ঐ সামনের তালগাছের মাথার দিকে তাকান। তনি তাকাতে গালিবের গলা শুনতে পেল, “তনি আপনি খুব ভালো মেয়ে। ছবি আঁকার চেয়ে পড়াশোনায় মন দিলে ভালো রেজাল্ট করতে পারতেন।”

তনির মনে হল, কথাগুলো তালগাছের মাথা থেকে আস্তে আস্তে নেমে এসে ইজেলের কাছে এসে থেমে গেল। আরও বেশি অবাক হয়ে বলল, আপনি নিশ্চয় যাদু জানেন। কথাটা শেষ করে গালিবের দিকে তাকিয়ে দেখতে না পেয়ে বাগানের গেটের দিকে তাকাল। কিন্তু তাকে দেখতে পেল না। এমন সময় ইজেলের পিছন থেকে তার গলা শুনতে পেল, “মনে কিছু নেবেন না, বিশেষ কারণে চলে যেতে হল। ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে।”

তনি তাড়াতাড়ি ইজেলের পিছনে উঁকি দিয়ে দেখল, কেউ নেই। ঘটনায় তনি শুধু মুগ্ধ নয়, এত অবাক হল যে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চিন্তা করল, গালিব নিশ্চয় যাদু জানে।

পরের দিন কলেজে তনি গতকালের ঘটনা কণাকে বলল।

কণা বলল, পুরিয়া ছাড়ার আর জায়গা পেলি না।

তনি বলল, তোকে আর দোষ দেব কি? তুই আমার কাছে শুনে বিশ্বাস করতে পারছিস না আর আমি নিজের কানে শুনে ও নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি। তোকে একটা কথা রোজ জিজ্ঞেস করব ভাবি; কিন্তু কলেজে এসে ভুলে যাই। গালিব সাহেব যে মাকে নিয়ে ঐ ভূতুড়ে বাড়িতে বাস করছেন। কোনো অসুবিধে হচ্ছে না?

কণা বলল, তা বলতে পারব না। তবে মনে হয় কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। হলে কিছু না কিছু শোনা যেত।

এ বাগান ছিল হিন্দু জমিদারের। জমিদার এখানে দু’কামরা পাকা ঘর করে ঢাকা থেকে বাঈজী নিয়ে এসে নাচ, গান ও ফুর্তি করতেন। জনশ্রুতি আছে, এই বাড়ির নিচে একটা রুম আছে। কোনো প্রজা বড় কোনো অন্যায় করলে বা ওনার আদেশ না মানলে তাকে ঐ রুমে বন্দি করে রাখতেন। সেই প্রজা আর কোনো দিন ফিরে আসত না। সেখানেই খেতে না পেয়ে মারা যেত। মুরুব্বীদের মুখে শোনা যায়, গভীর রাতে ঐসব বন্দিদের আত্মার কান্না তারা শুনেছেন। জমিদারের শেষ বংশধর এই বাগান বাড়ি খালেক উজ্জামান কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে গেছেন। খালেক উজ্জামান বাগানে নতুন করে অনেক রকম ফলের গাছ লাগিয়েছেন। দুই রুমের বাড়িটা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন ভেঙে ফেলার জন্য লোকের ব্যবস্থা করেন, তার আগের দিন রাতে স্বপ্নে কেউ যেন ওনাকে ভাঙতে নিষেধ করে বলেন, নিষেধ অমান্য করলে ওনার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। তাই তিনি বাড়িটা না ভেঙে সংস্কার করেন। তারপর স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছে ভাড়া দিতেন। কিন্তু কেউ-ই বেশি দিন থাকতে পারেন নি। কারণ প্রতিদিন গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ইট-পাটকেল পড়ে এবং বাড়ির পাশে যে সানবাঁধান ঘাটসহ বেশ বড় একটা পুকুর আছে, পূর্ণিমার রাতে ঐ পুকুরের মাঝখানে রুপার নৌকা ভাসতে দেখা যায়। আগে যারা এই বাড়িতে ভাড়া থেকেছেন, তারা স্বপরিবারে নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারলেও কিছু দিন আগে যে পোস্ট মাস্টার ভাড়া ছিলেন, তিনি ফিরে যেতে পারেন নি। কেউ যেন তাকে গলাটিপে মেরে ফেলেছেন। লোকজন বলাবলি করে কোনো অশরীরি আত্মা গলা টিপে পোস্ট মাস্টারকে মেরে ফেলেছে। কিছুদিন আগে গালিব যখন এই বাড়ি ভাড়া নিতে চাইল তখন খালেক উজ্জামান ভূতুড়ে বাড়ি বলে না করে দেন এবং আগের পোস্ট মাস্টারকে ভূতেরা মেরে ফেলেছে সে কথাও জানান।

কিন্তু গালিব সবকিছু শুনেও মাকে নিয়ে ঐ বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছে। তাদের সঙ্গে পিয়ন রহিম চাচাও থাকে। তার বাড়ি চার পাঁচ মাইল দূরের গ্রামে। প্রতিদিন সে আট দশ মাইল হেঁটে যাতায়াত করে জেনে গালিব তাকে তাদের সঙ্গে থাকতে বলে। রহিম চাচাও ঐ বাড়ির সম্পর্কে মুরুব্বীদের মুখে অনেক কিছু শুনেছে। তাই গালিবকে ঐ বাড়িতে থাকতে নিষেধ করে আর নিজেও থাকার জন্য অমত প্রকাশ করে। গালিব তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সাহস দিয়ে রাজি করিয়েছে। রহিম চাচা সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি যায়। সে গালিবের বাজার-হাট করে দেয়। তাদের সঙ্গে তিন বেলা খায়। দুই রুমের একরুমে গালিব থাকে। অন্য রুমে তার মা থাকনে। আর বারান্দা ঘিরে রহিম চাচার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে গালিব।

গালিবের মা আমেনা বেগম একজন আলেমা। তিনি কামিল পাস করেছেন। ওনার স্বামী আব্দুল বাসিত ছয় বছর আগে মারা গেছেন। তিনিও খুব বড় আলেম ছিলেন। ছেলে গালিবকে ওনার বড় আলেম করার জন্য কামিল পাস করিয়েছেন। তারপর আরও উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য মিশরের আলহামরা মাদরাসায় পাঠাবার মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর গালিব মিশরে না গিয়ে ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংলিশে অনার্স নিয়ে মাস্টার্স করে। দাখিল পর্যন্ত গালিব তিন গোয়েন্দা সিরিজ পড়ত। আলিমে পড়ার সময় থেকে মাসুদ রানা সিরিজ পড়ে ভবিষ্যতে গোয়েন্দা হবার আশা পোষণ করত, তাই ছাত্র জীবনেই সখের গোয়েন্দাগিরী করত। মাস্টার্স করার পর পুলিশে ভর্তি হয়। তারপর গোয়েন্দা হওয়ার জন্য ট্রেনিং নেয়। শেষে এখানে পোস্ট মাস্টার হয়ে আসার সময় মাকে সঙ্গে নিয়ে আসে।

ইমাম সাহেবের সঙ্গে গালিবের গণ্ডগোল হবার তিন দিন পর যারা ঢাকা গিয়েছিলেন মুফতি বোর্ড থেকে ফতোয়া জানার জন্য, তারা ফিরে এসে জানালেন, ইমাম সাহেবের ফতোয়া ঠিক নয়, পোস্ট মাস্টার গালিব ঠিক কথা বলেছেন।

গালিব মাকে নিয়ে ভূতুড়ে বাড়িতে নির্বিঘ্নে বাস করছে দেখে গ্রামের লোকজন তাকে বেশ সম্মানের নজরে দেখত। আজ যখন মাগরিবের নামাযের পর ঢাকার মুফতি বোর্ডের রায় শোনান হল তখন গালিবের প্রতি সবার ভক্তি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। মসজিদের সেক্রেটারি খালেক উজ্জামান কি বলেন শোনার জন্য সবাই চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল।

খালেক উজ্জামান কি বলবেন চিন্তা করছিলেন। উনি কিছু বলার আগে তনির বাবা রুহুল আমিন বললেন, আমার মতে বর্তমান ইমাম সাহেবকে বাদ দিয়ে পোস্ট মাস্টার গালিবকে ইমাম রাখলে ভালো হয়। ওনার কথা শেষ হতে অনেকে বলে উঠল, আমরাও তাই চাই।

খালেক উজ্জামানের দলের কয়েকজন লোক প্রতিবাদ করে বলল, পোস্ট মাস্টার এখনও বিয়ে করেন নি। ওনার পিছনে নামায সহি হবে না।

কেউ কিছু বলার আগে গালিব বলল, কথাটা ঠিক নয়। যিনি নামাযের আহকাম ও আরকান জানেন এবং সূরা ক্বেরাত শুদ্ধভাবে পড়তে পারেন, তার পিছনে নামায পড়া যাবে, চাই বিবাহিত হোক অথবা অবিবাহিত হোক। আমার কথা শুনে আপনারা ভাববেন না, আমি ইমাম হওয়ার জন্য একথা বলছি।

আমার দ্বারা ইমামতি করা সম্ভব নয়। প্রথমত আমি পোস্ট মাস্টারের চাকরি করি। দ্বিতীয়ত আমি এখানে এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে চাই যেখানে যেসব গরিব ছেলেমেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করতে পারে না, সেই সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কুরআন ও নামায পড়া যেমন শিখবে তেমনি মাতৃভাষাও শিখবে এবং বয়স্কদেরকেও শুদ্ধভাবে নামায কালাম শেখার ও ইসলামকে জানার, মানার ও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হবে। অবশ্য বয়স্ক মেয়েদেরকে আমার মা আলাদাভাবে ঐসব শিক্ষা দেবেন। আপনারা অনুমতি দিলে আপতত প্রতিদিন এশার নামাযের পর মসজিদেই বড়দের ঐ সব শিক্ষার ব্যবস্থা করার ইচ্ছা রাখি। এখন আপনারই বলুন, আমার দ্বারা কি ইমামতি করা সম্ভব? আমার মতে যিনি এখন ইমামতি করছেন, উনিই থাকুন। বর্তমানে বাংলা ভাষায় অনেক কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা ও মসলা মসায়েলের বই অনুবাদ হয়েছে, সেগুলো পড়ার জন্য ওনাকে অনুরোধ করছি। অবশ্য ঐ সমস্ত কেতাব খরিদ করার জন্য অনেক টাকা লাগবে। তাই আমি চাই আমরা, মানে গ্রামবাসীরা যার যেমন সামর্থ সেরকম টাকা-পয়সা দিয়ে মসজিদেই একটা পাঠাগার করতে। তা হলে আমরা সবাই পড়ার যেমন সুযোগ পাব তেমনি সহি শুদ্ধভাবে নামায কালাম পড়ার ও ইসলামকে জানার সুযোগ পাব। আর যে যত বেশি ইসলামকে জানবে, সে তত বেশি ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলার প্রেরণা পাবে।

“কুরআন পাকে আল্লাহ বলিয়াছেন, আলেমরাই (জ্ঞানীরাই) আমার বিধি নিষেধ মেনে চলে ও আমাকে ভয় করে।”

মসজিদ পাঠাগার ও মসজিদে বয়স্কদের শিক্ষার দায়িত্ব ইমাম সাহেবের ওপর থাকবে। আমি শুধু সঙ্গে থেকে ওনাকে সাহায্য করব। এখন আপনারা বিবেচনা করে বলুন, আমার কথাগুলো রাখবেন কিনা।

কেউ কিছু বলার আগে রুহুল আমিন বললেন, আপনি যা কিছু করতে চাচ্ছেন তা মহৎ কাজ। আপনাকে সহযোগিতা করাই তো আমাদের উচিত।

রুহুল আমিন থেমে যেতে কণার বাবা আফজাল হোসেন বললেন, নিশ্চয় উচিত। তারপর লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা কিছু বলছেন না কেন?

যারা গালিবকে ভালো জানে ও ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তারা সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ, আমরা যে যতটুকু পারি এই মহৎ কাজে সহযোগিতা করব।

খালেক উজ্জামান কিছু বলছেন না দেখে গালিব ওনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কিছু বলছেন না কেন?

উনি গালিবের ওপর অসন্তুষ্ট থাকলেও এখন তার কথা শুনে খুশি হয়েছেন। তা ছাড়া এখন কিছু না বললে সবার সামনে ছোট হয়ে যাবেন। তাই বললেন, এটা শুধু মহৎ কাজ নয়, বরং এ ধরনের কাজ করা প্রতিটি মুসলমানের উচিত। শুক্রবার জুম্মা নামাযের পর মিটিং করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা করা যাবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *