একদম রূপকথা
বাবলুর ছোটমামার একটু ডান দিকে বেঁকে যাওয়ার দোষ আছে। তাঁর শরীরটা ডান দিকে বেঁকে যায় না, শরীর ঠিকই থাকে, কিন্তু একটু অন্যমনস্ক হলেই ডান দিক ছাড়া অন্য কোনো দিকের কথা তাঁর মনেই পড়ে না। বেলগাছিয়া থেকে ট্যাক্সি করে হয়তো যাচ্ছেন কলেজ স্ট্রীটে, শ্যামবাজারে এসে ড্রাইভার যেই জিজ্ঞেস করল, ‘আভি কিধার সাব?’ ছোটমামা অমনি বললেন, ‘ডাইনা!’ ব্যস, চলে গেলেন টালার দিকে। খানিক বাদে রাস্তার পাশে একটা বিরাট গম্বুজ দেখে তাঁর খেয়াল হল, এটা তো কলেজ স্ট্রিটের দিকের রাস্তা নয়। ড্রাইভারকে তিনি বললেন, ‘ইধার কাঁহে লে আয়া? অ্যাঁ?’ ড্রাইভারকে বকাবকি করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বললেন তক্ষুণি। খানিক বাদেই ছোটমামা আবার অন্যমনস্ক। শ্যামবাজারে এসে ট্যাক্সি ড্রাইভার ফের জিজ্ঞেস করল, ‘বলিয়ে আভি কিধার?’ ছোটমামা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ডাইনা!’ ব্যস, কলেজ স্ট্রিটের বদলে ট্যাক্সি চলে গেল অন্যদিকে।
এ রকম যে কতবার হয়েছে তার ঠিক নেই!
কারুর ঠিকানা খুঁজে বার করতে হলেই ছোট মামার পক্ষে দারুণ বিপদ। উনি রাস্তার বাঁ দিকের বাড়িগুলো একদম দেখবেন না। দুদিকে দুটো গলি থাকলে ঠিক ডান দিকে বেঁকবেন।
সবচেয়ে মজা হল ওঁর নিজের কলেজে।
বাবলুর এই ছোটমামার নাম হারানচন্দ্র রক্ষিত। বেশ নামকরা লোক। অঙ্ক আর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে তিনখানা বই লিখেছেন! সেই বই এখনো অনেকে পড়ে। সেই বইগুলো যে প্রকাশক ছাপিয়েছেন তাঁর বেশ সুবিধে। ছোটমামাকে পয়সা দিতে হয় না। দোকানটা কলেজ স্ট্রিটের বাঁ ফুটপাথে কি না! ছোটমামা ডান দিকটা খুঁজে খুঁজে সেই দোকানের সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসেন।
ছোটমামা যে অঙ্কে এত ভালো, তার কারণ, সব অঙ্কই ডান দিকে থেকে শুরু করতে হয়। যদি অঙ্ক জিনিসটা বাঁ দিকে থেকে শুরু হত, তা হলে ছোটমামার বোধহয় লেখাপড়া শেখাই হত না।
ছোটমামা একটা কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক। ওঁর প্রথম ক্লাসটা থাকে তিনতলায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের ঘরে। প্রায় প্রত্যেক দিনই ছোটমামা খুব ব্যস্ত—সমস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকের ঘরটায় ঢুকে পড়বেন, সেখানে তখন সেকেন্ড ইয়ারের ইংরিজির ক্লাস হবার কথা। ছেলেরা ছোটমামাকে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে। ‘হারান—স্যার আজ আবার ঘর হারিয়ে ফেলেছেন!’
অনেকদিন এ রকম হবার পর কলেজের প্রিন্সিপাল ঘর দুটো বদলে দিলেন। ছোটমামার প্রথম অঙ্কের ক্লাসটা ডান দিকের ঘরেই হবে। তাতেও তবু সুবিধে হল না। কারণ! ছোটমামার দ্বিতীয় ক্লাসটা দোতলায়। প্রথম ক্লাসটা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়েই ছোটমামা ডান দিকে হাঁটতে শুরু করেন। সিঁড়ি রইল পড়ে বাঁ দিকে। ডান দিকের লম্বা বারান্দাটার একেবারে শেষ কিনারায় গিয়ে ছোটমামা আপন মনে বলে ওঠেন, ‘দুর ছাই, সিঁড়িটা গেল কোথায়?’
ছোটমামার এই ডান দিকে বাঁকার রোগ নাকি সেই একেবারে ছেলেবেলা থেকে। বাবলুর দিদিমা বলেন, ‘নিশ্চয়ই বাচ্চা বয়সে ওর দিকে কোনো ডাইনি নজর দিয়েছিল, তাই ডান দিকে ছাড়া আর কিছু চেনে না।’
বাবলুর মা তাই শুনে বলেছিলেন, ‘তোমাকেও মা বলিহারি! তুমি কেন ছোড়দার নাম হারান রেখেছিলে? তাই তো ছোড়দা সব সময় হারিয়ে যায়!’
বাবলু বলেছিল, ‘ভাগ্যিস পদবীটা রক্ষিত! তাই ছোটমামা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে যান।’
এই ছোটমামাকে কখনো কলকাতার বাইরে যেতে হলে আত্মীয়—স্বজনদের মধ্যে কেউ—না কেউ সঙ্গে যায়। নইলে ছোটমামা বারবার দিক ভুল করে সব কাজ পণ্ড করে ফেলবেন।
একবার ছোটমামাকে যেতে হল মুর্শিদাবাদে। ওখানে ছোটমামাদের খানিকটা জমি আছে। মুর্শিদাবাদে আর যাওয়া হয় না, জমিটাতে চাষবাসও করা হয় না, এমনি—এমনি পড়ে আছে বলে ছোটমামা ঠিক করেছেন, এ জমি গভর্নমেন্টকে দান করে দেবেন। চিঠিপত্র লিখে সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, শুধু মুর্শিদাবাদ গিয়ে সেটলমেন্ট অফিসে ছোটমামাকে সই করে আসতে হবে। সঙ্গে যাবার আর কেউ নেই। তাই ঠিক হল বাবলু যাবে। বাবলুর পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে, স্কুল ছুটি।
বাবলুর বয়স চোদ্দ বছর, সে একা—একা রাস্তাঘাট চিনে যেতে পারে, সে ঠিক ছোটমামাকে সামলাতে পারবে।
প্রথমেই তো গোলমাল হয় শিয়ালদায় গিয়ে।
প্ল্যাটফর্মের দু’পাশে দুটো ট্রেন দাঁড়িয়ে। ছোটমামা গেট দিয়ে ঢুকেই গটমট করে উঠে পড়লেন ডান দিকের ট্রেনটায়। বাবলু ছোটমামার হাত ধরে টেনে নামিয়ে এনে বললো, ‘এ কী করছ ছোটমামা? এটা তো যাবে দার্জিলিং! আমাদের মুর্শিদাবাদ লোকাল ওই বাঁ দিকেরটা।’
ছোটমামার একটা গুণ এই যে, ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তক্ষুণি তা মেনে নেন। একগাল হেসে বললেন, তাই তো, খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল তো! গরম কোট সোয়েটার আনিনি, এই অবস্থায় কি দার্জিলিং যাওয়া যায়? তোর খুব কষ্ট হত!’
বাবলু ছোটমামাকে নিয়ে উঠে বসল বাঁ দিকের ট্রেনটায়। বলাই বাহুল্য, ছোটমামা বসলেন ডান দিকের জানালার পাশে।
তিন—চারটে স্টেশন পেরুবার পর সেই কামরায় উঠলেন টিকিট চেকার। টিকিট ছোটমামার কাছে। ছোটমামা পরে আছেন ধুতি—পাঞ্জাবীর ওপর একটা পাতলা জহর কোট। মুখে চুরুট। ছোটমামা চুরুটটা নামিয়ে রেখে বললেন,…দিচ্ছি!…
তারপর ছোটমামা জহর—কোটের পকেট, পাঞ্জাবীর পকেট সব খুঁজলেন। তারপর বললেন, ‘এই রে, টিকিট বোধহয় তাহলে ভুল করে বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছি!’
বাবলু সব নজর রাখছিল। বাঁ দিকের জানলার কাছ থেকে এসে সে খপ করে ছোটমামার পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। অমনি পাওয়া গেল টিকিট।
ছোটমামা বললেন, ‘তাই তো! ইশ, মনেই পড়েনি।’
টিকিট চেকারটি কেমন যেন অবাকভাবে তাকালেন ছোটমামার দিকে।
একটু বাদে বাবলুকে কাছে ডেকে ছোটমামা কানে—কানে ফিসফিস করে গোপন কথা বলার মতন ভঙ্গি করে বললেন, ‘শোন বাবলু, তোকে একটা কাজের কথা বলি। মুর্শিদাবাদে স্টেশনে নেমে কিন্তু বাঁ দিকে গেলে সেটলমেন্ট অফিস। ভুল করে ডান দিকে চলে গেলে কিন্তু অনেক ঘুরপাক খেতে হবে!’
বাবলু অবাক। ছোটমামার তা হলে মাঝে—মাঝে বাঁদিকের কথাও মনে থাকে দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য এর পর দু’বার ছোটমামা বাথরুমে যেতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। বাথরুমটা কামরার বাঁ দিকে। দু’বারই বাবলু আবার ছোটমামার হাত ধরে বাথরুমের কাছে নিয়ে গেল।
মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নেমে একটা সাইকেল—রিকশায় চেপেই ছোটমামা বললেন, ‘ডাহিনা চলো!’
বাবলু বললো, ‘বাঃ, তুমি যে নিজেই বলেছিলে, সেটলমেন্ট অফিস বাঁ দিকে।’
ছোটমামা বললেন, ‘তাই বলেছিলাম বুঝি! চল তা হলে। অবশ্য ডান দিক দিয়েও যাওয়া যায়। তোরা বুঝিস না, শুধু ডান দিকে ঘুরেও পৃথিবীর সব জায়গায় যাওয়া যায়। এটা হল সিম্পল ম্যাথমেটিকস!’
যাই হোক, সেটলমেন্ট অফিসের কাজকর্ম খুব সহজেই মিটে গেল। ফেরার ট্রেন আবার রাত্তিরে। কিন্তু ছোটমামা আগেই ঠিক করেছেন, একদিন দু’দিন এখানে হোটেলে থেকে বাবলুকে মুর্শিদাবাদের সব ভালো ভালো ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন।
সই—টই করে বেরিয়ে আসবার পর ছোটমামা বললেন, ‘আগে একবার আমাদের জায়গাটা দেখে এলে হয় না? দিয়েই তো দিলাম, একবার শেষ দেখা দেখে নিই! ছোটবেলা ওখানে অনেকবার এসেছি। অনেকখানি জমির সঙ্গে একটা ছোট বাড়ি আছে, পুকুর আছে, পেয়ারা গাছ আছে…।
বাবলু বললো, ‘হ্যাঁ চলো, সেই জায়গাটা দেখে আসি। পেয়ারা গাছে পেয়ারা হয়?’
ছোটমামা বললেন, ‘হ্যাঁ, হবে না কেন! আমি ছোটবেলা গাছে চড়ে কত পেয়ারা পেড়েছি। ডান দিকে একটা ডালে এই অ্যাত বড় বড় পেয়ারা!’
একটা সাইকেল—রিকশায় উঠে ছোটমামা ডান দিকে না—বলে বললেন ‘চলো কাটরা মসজিদের দিকে। ওখানে গেলেই আমি ঠিক চিনতে পারব।’
কাটরা মসজিদের কাছে এসে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু এবার কোন দিকে?’
ছোটমামা বললেন, ওই তো ডান দিকে একেবারে সোজা রাস্তা।’
ডান দিকে খানিকটা যাবার পর রাস্তাটা এক জায়গায় বাঁ দিকে বেঁকে গেছে। সেখানে পৌঁছেই ছোটমামা বললেন, ‘ও দিকে নয়, ও দিকে নয়, আবার ডান দিকে।’
বাবলু বললো, ‘ছোটমামা, ডান দিকে তো রাস্তা নেই, শুধু মাঠ। বাঁ দিকেই যেতে হবে নিশ্চয়ই!’
ছোটমামা বললেন, ‘তুই থাম তো! আমি স্পষ্ট চিনতে পারছি। তুই খালি বাঁ দিকে যেতে চাস। আমার ডান দিকে ঘোরা রোগের মতন তোরও কি বাঁ দিকে ঘোরা রোগ হয়ে গেল নাকি? যখন সত্যিই ডান দিকে যাওয়া দরকার, তখনও বাঁ দিকে যেতে হবে?’
বাবলু থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
এবড়ো—খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে সাইকেল—রিকশাটা লাফাতে লাফাতে চলল। আরও খানিকটা যাবার পর রিকশাওয়ালা বললো, ‘বাবু আর কোথায়? এদিকে যে ধু—ধু মাঠ!’
ছোটমামা প্রবল উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘আরে, তুমি চলোই না! যে তালগাছটা দেখছ, ওর ডান দিকে গেলেই…’
তালগাছের কাছে এসেও বাড়ি—ঘর কিছুই দেখা গেল না। তখন রিকশাওয়ালা জানাল যে, সে আর যেতে পারবে না।’
ছোটমামা নেমে পড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, এর পর আমরা হেঁটেই যাব।’
বাবলু বললো, ছোটমামা, এরপর আমরা ফিরব কী করে? রাস্তাই তো চিনতে পারব না।’
ছোটমামা বললেন, ‘তুই আয় না! মুর্শিদাবাদের সব আমার চেনা।’
রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছোটমামা হন হন করে হাঁটতে লাগলেন। ডান দিকে দূরে কতকগুলো গাছপালা দেখা যাচ্ছে, ছোটমামার মুখ সেই দিকে। বাবলুও বাধ্য হয়েই পেছনে চলল।
মিনিট দশেক হাঁটার পর সেই গাছগুলোর মধ্যে একটা বাড়ি দেখা গেল।
ছোটমামা বললো, ‘ওই যে দ্যাখ! দেখলি, আমি বলেছিলাম না যে, ঠিক চিনতে পেরেছি জায়গাটা! ওই তো আমাদের বাড়ি।’
কাছে গিয়ে বোঝা গেল, একসময় বেশ শৌখিন বাড়ি ছিল, সামনে পুকুর আর বাগান। এখন অনেক কিছুই ভেঙেচুরে গেছে, আগাছা গজিয়েছে চারদিকে। দেখলেই বোঝা যায়, এ—বাড়িতে অনেকদিন কোনো মানুষ থাকে না।
ছোটমামা ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে বাগানে ঢুকে বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ঘাড় চুলকোতে—চুলকোতে বললেন, ‘হুঁ—উ—উ, এই তো সেই বাড়িটা। অবশ্য তখন একতলা ছিল, এখন দোতলা হয়ে গেছে। তা তো হবেই, অনেকদিন অযত্নে পড়ে ছিল কি না।’
বাবলু ফিক করে হেসে ফেলল। অযত্নে পড়ে থাকলে বুঝি একতলা বাড়ি দোতলা হয়ে যায়?
ছোটমামা বললেন, ‘পুকুরটাও গোল ছিল, এখন চৌকো হয়ে গেছে…দেখাশুনা করার কেউ নেই তো!’
বাবলু জিজ্ঞেস করল, ‘পেয়ারা গাছ কোথায়?’
‘কেন পুকুরের ডান দিকে, দু’তিনটে পেয়ারা গাছ আছে।’
বাবলু সেদিকে দৌড়ে চলে গেল। তারপর অনেক খুঁজল। সেখানে অনেক ঝোপঝাড়, দু’একটা আম আর জামগাছ থাকলেও পেয়ারা গাছ একটাও নেই।
বাবলু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ছোটমামা, কোন ডান দিকে?’
‘তার মানে?’
‘এখান থেকে আমার ডান দিকে, না ওখান থেকে তোমার ডান দিকে?’
‘এবার তোর ডান দিকটায় খুঁজে দ্যাখ।’
সমস্ত বাগান তন্ন—তন্ন করে খুঁজে বাবলু কোনো পেয়ারা গাছ দেখতে পেল না।
ছোটমামার কাছে ফিরে এসে বাবলু বললো, ‘দেখা তো হল, এবার ফিরে চলো!’
ছোটমামা বললেন, ‘দেখলি, বলেছিলাম কি না, কী সুন্দর বাড়ি আর বাগান! যাক, শেষ দেখাটা হয়ে গেল। ছোটবেলায় এখানে কত খেলা করেছি! আর একটা জিনিস দেখা বাকি আছে।’
‘কী?’
‘যে—ঘরটায় আমি শুতাম, সেই ঘরটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডান দিকের ঘর, রং—পেন্সিল দিয়ে দেয়ালে আমার নাম লেখা। চল, তোকে দেখাচ্ছি।’
বাবলু আবার হেসে ফেলল, ছোটমামা যে সম্পূর্ণ কোনো ভুল বাড়িতে এসেছেন, তাতে তার কোনো সন্দেহই নেই।
বাড়িটার সামনের দিকে কয়েক থাক চওড়া সিঁড়ি, তারপর মস্ত বড় রক, তার ওপাশে একটা লম্বা হলঘর। দরজা—জানলা সবই ভাঙা।
ছোটমামা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে বললেন, ‘হুঁ—উ—উ, এই বারান্দা আগে ছিল না বটে, সে যাই হোক, ভেতরের ডান দিকের ঘরটা…নিশ্চয়ই দেখবি দেয়ালে আমার নাম লেখা আছে এখনও।’
হলঘরটা পেরিয়ে ভেতরে গিয়ে ছোটমামা ডান দিকের ঘরের দেয়ালে মনোযোগ দিয়ে নিজের নাম খুঁজছেন, এমন সময় বাবলু একটা আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল। মানুষের গলার আওয়াজ। খুঁ—খুঁ—খুঁ শব্দে কে যেন কাঁদছে।
বাবলু শিউরে উঠল একেবারে। প্রথম থেকেই তার সন্দেহ হয়েছিল, এ বাড়িতে ভূত আছে।
সে ছোটমামার জামা চেপে ধরে বললো, ‘শুনতে পাচ্ছ?’
‘কী বল তো ওটা?’
‘আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে?’
‘হাওয়া—টাওয়া হবে বোধহয়। চল তো দেখা যাক।’
সে—ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই আওয়াজটা আরও জোরে শোনা গেল। এবার বোঝা গেল আওয়াজ হচ্ছে ভেতর দিকের বাঁ দিকের একটা ঘর থেকে। একমাত্র সেই ঘরটারই দরজা অক্ষত আছে, সেই দরজার বাইরে তালাবন্ধ।
ছোটমামা বললেন, ‘ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে হয়। চল তো।’
সেই ঘরের দরজায় কান পেতে ওরা শুনতে পেল একটা বাচ্চাছেলের মতন গলা। অনেকটা যেন দমবন্ধ—মতন অবস্থায় কাঁদছে।
দরজা ঠেলে একটু ফাঁক করে ভেতরে তাকিয়ে আরও চমকে উঠল বাবলু।
ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে একটা বাচ্চা ছেলে, তার হাত—পা মুখ বাঁধা। তার সামনে একটা ভাতের থালা, জলের গেলাস। ছেলেটা ওদের দিকেই ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে।
বাবলু বললো, ‘ছোটমামা, কী ব্যাপার?’
‘তাই তো। ছেলেটাকে কে এখানে বেঁধে রেখে গেছে?’
‘তালাটা ভাঙা যায় না?’
‘দরজাটাও পুরনো। আয় দু’জনে মিলে ঠেলি।’
দু’জনে মিলে একসঙ্গে খুব জোরে ধাক্কা দিতেই দরজাটার একটা পাল্লা খুলে গেল। বাবলু সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে ছেলেটার মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে? তোমাকে এখানে এই অবস্থায়…?’
ছেলেটা বললো, ‘পরে বলব…পরে সব বলব। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আপনাদেরও দেখতে পেল মেরে ফেলবে। শিগগির আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।’
ছোটমামা চটপট ছেলেটার হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরা মানে কারা?’
ছেলেটা বললো, ‘ডাকাত! আমাদের বাড়ি থেকে আমাকে চুরি করে এনেছে। আমাদের বাড়ি চন্দননগর। তিন দিন আমাকে এখানে…শিগগির চলুন, এক্ষুণি ওদের কেউ এসে পড়বে।’
ছেলেটা নিজেই তীরের মতন দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ছোটমামা আর বাবলুও ছুটতে লাগল ওর সঙ্গে সঙ্গে।
মাঠের মধ্যে অনেকটা ছোটার পর পিছনে ধপ করে একটা শব্দ হতেই বাবলু মুখ ফিরিয়ে দেখল সেই বাড়িটার পাশ থেকে দুটো ষণ্ডামার্কা লোক ওদের দিকে তেড়ে আসছে আর ইঁট ছুঁড়ছে।
বাবলু বললো, ‘আরও জোরে ছোটো, ছোটমামা, ওরা আসছে।’
ছেলেটা বললো, ‘ওদের কাছে বন্দুক আছে।’
ছোটমামা বললেন, ‘এঁকে—বেঁকে ছোট এঁকে—বেঁকে, তা হলে ওরা টিপ করতে পারবে না।’
সে তালগাছটার কাছে এসে ছোটমামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার কোন দিকে রে বাবলু? ডাকলেন দিকে তো? বাবলু বললো, ‘না, এবার বাঁ দিকে গেলেই বড় রাস্তা।’
‘ঠিক বলেছিস।’
ওরা বড় রাস্তায় পৌঁছে আবার পেছন দিকে তাকাল। তখন আর ডাকাতদের দেখতে পাওয়া গেল না।