একটু পরে রোদ উঠবে – ৫

পাঁচ

অর্চিনের মুখ তেতো।

মাসখানেক যাবৎ এই সমস্যা হয়েছে। সকালে অর্চিনের ঘুম ভাঙছে মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে। স্বাদটা চট করে চলে যায় না। একসময়ে মনে হত চা এবং সিগারেট খেলে চলে যাবে। যায়নি। দ্বিতীয় দফায় চা এবং সিগারেট খেওে যায়নি। বরং তেতো ভাবের সঙ্গে সিগারেটের কষা ভাব যুক্ত হয়েছে। মুখটাকে আরও বিচ্ছিরি করে দিয়েছে।

এ বাড়িতে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। কেউ খায় না বলেই হয়তো নিয়ম নেই। কে-ই বা খাবে? পুরুষমানুষ বলতে বিমলকান্তি সেন, কমলকান্তি সেন। আর দারোয়ান ভবানী। এরা কেউই ধূমপায়ী নয়। মেঘবতীর স্বামী জ্যোতিষ্ক সিগারেট খায় ঠিকই, কিন্তু এ বাড়িতে এলে খায় না। তার বউ কড়া নজর রাখে। সেন অ্যাসোসিয়েটসের অফিসার, কর্মচারীরা আসে। মালিকের বাড়িতে তাদের সিগারেট খাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ফলে গোটা বাড়িটাই নো স্মোকিং জোন। অর্চিনের ঘর একতলার পিছন দিকে। একসময় বাড়ির গেস্টরুম ছিল। পিছন দিয়ে যাতায়াতের পথ আছে। অর্চিন গত তিন বছর এখানেই রয়েছে। গেস্টরুমের ব্যবস্থা খুবই ভালো। দরজা বন্ধ করে সিগারেট খেলে কেউ বুঝতে পারবে না। বুঝলেও কোনও ব্যাপার নয়। বিমলকান্তিবাবু তাঁর স্ত্রীর কাছে খানিকটা রাগারাগি করতে পারেন এই পর্যন্ত। অর্চিনকে সরাসরি উনি কিছু বলবেন না। তিন বছরে এটা বোঝা হয়ে গেছে। বিমলকান্তিবাবু এই ছেলের সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। দুজনেই একধরনের দূরত্ব বজায় রাখে। তবে কর্তব্যের ব্যাপারে বিমলকান্তিবাবু আর-পাঁচটা বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও সিরিয়াস। আড়ালে অর্চিনের খোঁজখবর নেন, মুখোমুখি হলে নিজেই জানতে চান।

‘কেমন আছ অর্চিন?’

অর্চিন মাথা নামিয়ে বলে, ‘ভালো আছি।’

‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’

অর্চিন ঘাড় কাত করে বলে, ‘ঠিক আছে।’

‘ভেরি গুড। অন্য কোনও অসুবিধে নেই তো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে? রাতে ঘুম?’

অর্চিন খানিকটা লজ্জা পেয়েই বলে, ‘সব ঠিক আছে।’

‘অসুবিধে হলে তোমার মাসিকে বলবে।’

অর্চিন কোনও কথা না বলে ঘাড় কাত করে। মণিকুন্তলা সেন তার মাসি ঠিকই, তবে অনেকটা দূরসম্পর্কের। অর্চিনের মা মণিকুন্তলার খুড়তুতো বোন। কাজিন। তাও প্রথম পক্ষের নয়, দ্বিতীয় পক্ষের। প্রথম স্ত্রী নি:স্তান অবস্থায় মারা গেলে, মণিকুন্তলাদেবীর কাকা আবার বিয়ে করেন। এবার তার মেয়ে হয়। একটা নয়, তিন বছরের ব্যবধানে দুটি মেয়ে হয়। বড় মেয়ে বাড়ির প্রবল আপত্তিতে এক যুবককে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেছে। সে আর কোনও সম্পর্ক রাখেনি। ছোট মেয়ের একমাত্র সন্তান এই অর্চিন। প্যাঁচালো সম্পর্ক। আজকাল এই ধরনের সম্পর্ককে আত্মীয়তার মধ্যে ধরা হয় না। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে, নেমন্তন্নর তালিকা থেকে অনায়াসে নাম বাদ দেওয়া যায়। তাই এই বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে অর্চিনের আচরণ যে খানিকটা ফর্মাল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী? উল্টোটাও সত্যি। বাড়ির লোকদেরও একটা বাধো বাধো ভাব আছে। অর্চিন যখন এ বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে সিদ্ধান্ত হয়, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিল। বাড়ির ভিতের যেমন হয়েছিল, বাইরেও হয়েছিল। বারিধারা, মেঘবতী থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ভুরু কোঁচকায়। এই ছেলে কে যে তাকে একেবারে বাড়িতে এনে তুলতে হবে? ছেলের বাড়ি কলকাতা থেকে খানিকটা দূরে। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় পড়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু তাতে কী হয়েছে? হস্টেল, মেস, পেয়িং গেস্ট নেই? বাইরের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কলকাতায় থেকে কীভাবে পড়াশোনা করে? এই ছেলেকে বাড়িতে এনে তোলার কারণ কী?

বাইরের লোকের কথায় পাত্তা দেননি বিমলকান্তিবাবু। বাড়িরও নয়। শুধু বৃদ্ধ বাবাকে জানিয়েছিলেন। তাও দরজা বন্ধ করে।

‘বাবা, একটা পারমিশন চাই।’

কমলকান্তি সেন বই পড়ছিলেন। মুখের সামনে থেকে বই না সরিয়ে বললেন, ‘অফিস সংক্রান্ত কিছু হলে পাবে না। তুমি জানো, আমি অফিসের ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘না, অফিস নয়। বাড়ির বিষয়।’

কমলকান্তি বই সরিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের অনুমতি দিলাম।’

বিমলকান্তি বিরক্ত হলেন। এটা কোনও সিরিয়াস কথা হল? ঘটনা না শুনেই রায়! অন্য কেউ হলে ধমক দিয়ে বসতেন। বাবাকে ধমক দেওয়া যায় না। নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি।

‘বাবা, তুমি কি আগে বিষয়টা শুনবে।’

কমলকান্তি সেনের হাতে রান্নার বই। এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। বয়েস বেশি হলে মানুষ সাধারণত হাতে ধর্মগ্রন্থ রাখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চোখের কারণে পড়তে পারে না। তারপরেও রাখে। স্পর্শে যদি পুণ্যি হয়। কমলকান্তি সেনের ঘটনা অন্যরকম। কয়েকবছর হল বুড়োমানুষটা রান্নার বইতে মজেছে। রেসিপি পড়ে একইসঙ্গে প্রভূত আনন্দ পাচ্ছেন, আবার মুগ্ধও হচ্ছেন। একই জিনিস এতরকমভাবে রান্না করা যায়! সেসবের আলাদা আলাদা স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, চেহারা! কই এসব তো তাঁর জানা ছিল না। এ যেন ম্যাজিকের মতো। অথচ ম্যাজিক নয়। মানুষই মাথা খাটিয়ে বের করেছে! নিরন্তর করে চলেছে। রান্নাঘর যেন একটা বড় রসায়নাগার! পরীক্ষার পর পরীক্ষা, আবিষ্কারের পর আবিষ্কার! মজার কথা হল, এই গবেষণার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কখনও ফর্মুলা তৈরি হচ্ছে, কখনও ভাঙছে। কখনও অনেক আয়োজন দিয়ে ছোটখাটো খাবার বানিয়ে ফেলা যাচ্ছে, কখনও সামান্য আয়োজন থেকে অসাধারণ কোনও ‘ডিশ’ হচ্ছে। এতদিন কমলকান্তি সেনের ধারণা ছিল খাবার শুধু পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। রান্নার বই পড়ে সেই ধারণা থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর বিশ্বাস, খাবার শুধু পেট নয়, মনের ক্ষুধাও মেটায়। তিনি নানা ধরনের দেশি-বিদেশি রান্নার বই কিনে আনাচ্ছেন। ফোন করে বইয়ের দোকান, পাবলিশার্সকে অর্ডার দিচ্ছেন। ছোট নাতনিকে দিয়ে অনলাইনে বই কেনাচ্ছেন। নিজে জীবনে কখনও রান্না করেননি। রান্নার ব্যাপারে তাঁর কোনও ইন্টারেস্টও ছিল না। বাড়িতে কখনও জানতে চাননি কী রান্না হচ্ছে। যেমন দেওয়া হত তেমনটাই খেয়ে নিতেন। রান্নার মধ্যে যে এত বিস্ময়, এত রহস্য লুকিয়ে আছে তাঁর জানা ছিল না।

সেদিনও কমলকান্তির হাতে রান্নার বই ছিল। বইয়ের নাম, ‘দ্য নাইফ’। জেফরি কর্ড নামে এক ব্রিটিশ সেফের লেখা। প্রায় একশো বছর আগে লেখা। এটা ঠিক রেসিপির বই নয়। প্রাক রান্না প্রস্তুতি। জেফরি কর্ড দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের আনাজপাতি বিভিন্ন মাপে, চেহারার কাটা যায়। এতে রান্নার স্বাদও বদলে দেওয়া যায়। আলু গোল করে কাটলে একরকম, চিরে কাটলে আরেকরকম। আবার মোটা করে চিরলে একরকম, সরু করে চিরলে আরেকরকম। ছুরি দিয়ে কাটাকুটির ব্যাপার বলে বইয়ের নাম ‘দ্য নাইফ’। নাম শুনলে মনে হবে খুনের গল্প। কমলকান্তি সেন মন দিয়ে পড়ছিলেন। আচ্ছা, এই বই যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে নাম কী হবে? বঁটি? বঁটি নামে কোনও বই কি মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়বে?

খানিকটা অন্যমনস্কভাবেই ছেলেকে বললেন, ‘বলো শুনছি। কীসের ব্যাপারে অনুমতি চাই?’

বিমলকান্তিবাবু নীচু গলায় বললেন, ‘একজন আমাদের বাড়িতে থাকবে।’

কমলকান্তি সেন বললেন, ‘ভালো কথা, থাকবে। বাড়িতে লোক থাকা ভালো। বাড়ি হল ফুলদানির মতো। ফাঁকা মানায় না।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘মণিকুন্তলার দূরসম্পর্কের এক বোনের ছেলে। বাইরে থাকে। আমাদের এখানে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে।’

‘আরও ভালো কথা। বাড়িতে পড়াশোনা হবে। এর জন্য অনুমতি কীসের? তাছাড়া বাড়ি আমার একার নয়। বাড়ি সবার। মণিকুন্তলারও। আমার অনুমতির কী প্রয়োজন?’

বিমলকান্তিবাবু এবার দ্বিধার সঙ্গে বললেন, ‘ছেলেটি অন্য কোথাও না থেকে আমাদের এখানে কেন থাকবে এই বিষয়ে কি তুমি কিছু জানতে চাও বাবা?’

‘অবশ্যই চাই না। আমি চাই, এবার তুমি যাও। আমি একটা জরুরি বই পড়ছি।’

বিমলকান্তি গম্ভীরভাবে চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি না চাইলেও আমি বলব বাবা। বাড়ির আর কারও না হোক, তোমার জেনে রাখা দরকার।’

কথা শেষ করে বিমলকান্তি উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে এলেন।

এই ছেলের সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক যে গভীর হবে না সেটা বোঝাই যায়। খানিকটা ব্যতিক্রম বারিধারা। বয়েসে কাছাকাছি। বারিধারা ‘অর্চিদা’র সঙ্গে মাঝেসাঝে গল্প টল্প করে, ঠাট্টা ইয়ার্কি করে। মেঘবতীও হইচই করতে চেষ্টা করেছে। খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। শুধু সম্পর্কের দূরত্ব নয়, অর্চিন গোটানো ধরনের ছেলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। বাড়ির সকলেই এ কথা বুঝে গেছে। কেউ তাকে আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করে না। সবথেকে বড় কথা হল, ছেলেটা ভালো। শুধু পড়াশোনায় নয়, স্বভাবেও ভালো। কোনও চাহিদা নেই। খাওয়া, পরা নিয়ে মাথা ঘামায় না। পেলেই হল। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে আগ বাড়িয়ে ব্যস্ততা দেখায় না, কিন্তু ঘরের বাইরে চুপ করে বসে থাকে। শান্তভাবে খোঁজ নেয়। রাত করে বাড়ি ফেরে না। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব এনে আড্ডা দেয় না।

অর্চির সিগারেট খাবার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। মেকানিক্যাল। তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের নেশা করে। অর্চিন করে না। সে শুধু সিগারেট খায়। তবে বাড়িতে খায় না। রাতেও চেষ্টা করে না খেতে। তারপরেও কোনও কোনও রাতে খুব ইচ্ছে হলে পা টিপে টিপে ছাদে চলে যায়। সকালে কমলাদি চা এনে দরজা ধাক্কায়। তাকে বলা আছে, তিনবারের বেশি ধাক্কা দেওয়ার দরকার নেই। তিনবারেও যদি দরজা খোলা না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, সে ঘুমোচ্ছে। কমলাদি এরপরেও দরজা ধাক্কা দিয়ে যায়। যতক্ষণ না দরজা খোলা হয় ততক্ষণ ধাক্কা চলে। অর্চিন বাধ্য হয়ে দরজা খুলে চা নেয়। চা খেয়ে অর্চিন বাড়িরে বাইরে বেরোয়। গলির মোড়ে আসে। বড় রাস্তা পার হলে ফুটপাথে পরপর চায়ের ঝুপড়ি। সেখানে বসলে খানিকটা আড়াল হয়। বাড়ির কেউ বেরোলে তাকে চট করে দেখতে পাবে না। সেখানে বসে অর্চিন খবরের কাগজ পড়ে, সিগারেট খায়।

মুখের তেতো স্বাদ নিয়ে গোড়ার দিকে ঋষা ঠাট্টা করত।

‘ও তাই বল, এই কারণে তোর কথাগুলো দিন দিন এমন তেতো হয়ে যাচ্ছে।’

অর্চিন সহজভাবে বলেছে, ‘হতে পারে। এবার পকেটে মধুর শিশি নিয়ে ঘুরব। কথা বলবার আগে পকেট থেকে বের করে কয়েক ফোঁটা খেয়ে নেব। তারপর তোর সঙ্গে কথা বলব। তখন কথাগুলো মিষ্টি লাগবে।’

ঋষা বলেছে, ‘লাভ হবে না। তোর মুখের অন্য টেস্ট বাডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অর্চি। শুধু একটাই কাজ করছে। বিটার সেনসিটিভ পার্ট। তুই যা বলবি, সবই তেতো লাগবে। যাকে বইয়ের ভাষায় বলে তিক্ত।’

অর্চিন হাই তুলে বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হল। অনেককে বাধ্য হয়ে তিক্ত কথা বলতে হয়। এখন আর তার প্রয়োজন হবে না। যদি বলি, তুমি কী ভালো! তাহলেও তেতো শোনাবে। এটা একটা বিরাট সুবিধে।’

আজ আর বিষয়টাকে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে রাখল না ঋষা।

সকালেই ফোন করেছে। অর্চিন ঝুপড়িতে বসে আছে। তার পকেটের মোবাইল বাজল।

‘কী করছিস?’

অর্চিন বলল, ‘বসে আছি। ফোন করেছিস কেন?’

ঋষা বলল, ‘সাতসকালের ব্যাপার বলে সাতসকালে ফোন করেছি। একটু আগে মনে হল, তোর রোজ সকালে উঠে খালি পেটে এক গ্লাস করে জল খাওয়া দরকার।’

অর্চিন হেসে বলল, ‘ডাক্তারি করছিস?’

ঋষা বলল, ‘হ্যাঁ করছি। নিশ্চয় তোর অ্যাসিডের সমস্যা হচ্ছে। জল খেলে কমবে।’

অর্চিন বলল, ‘হতে পারে। হলেও সকালে উঠে জল খেতে পারব না। এরপর তো বলবি, যোগাসন করতে। তারপর বলবি ছোলা সিদ্ধ খেয়ে মর্নিংওয়াকে যেতে।’

ঋষা বলল, ‘দরকার হলে তাই যাবি।’

‘সরি, পারলাম না। ছোট বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করিস না। সময় নষ্ট হবে।’

ঋষা বলল, ‘আমার সময় আমাকে বুঝতে দে। তুই ডাক্তার দেখা। মুখে সারাক্ষণ তেতো ভাব ঠিক নয়। অনেক সময় লিভার বা গলব্লাডার থেকেও প্রবলেম হতে পারে।’

অর্চিন বলল, ‘বাদ দে। শরীর একসময় বিষয়টা মানিয়ে নেবে। সে জানবে তেতো স্বাদটা তার জন্য স্বাভাবিক। মানুষের শরীরের এটাই মজা ঋষা। সে ভালো এবং মন্দ দুটোর সঙ্গেই নিজেকে অ্যাডপ্ট করে নিতে পারে। যেমন ধর…যেমন ধর…যে মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না, তার শরীরও একটা পর্যায়ের পর থেকে মানিয়ে নিতে শেখে। আমরা যেমন খাবার থেকে ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রাোটিন, জল এসব বের করে নিই, না খেতে পাওয়া মানুষের শরীর অনাহার, অপুষ্টি থেকে তার নিজের মতো করে ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রাোটিন সংগ্রহ করে। করতেই হয়। নইলে বাঁচবে কী করে?’

ঋষা বিরক্ত গলায় বলল, ‘বাঁচে না। বাঁচলে ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচে।’

অর্চিন গম্ভীরভাবে বলল, ‘বাঁচা অনেকরকম হয় ঋষা। মরাই বরং একরকম। সবাই একরকমভাবে মরে। হার্ট বন্ধ। ধনী মানুষের যা, গরিবেরও তাই। কিন্তু বাঁচা একেকজনের কাছে একেকরকম। আমাদের বাড়িতে কমলকান্তি সেন একানব্বই বছর বয়েসে দুধে-ভাতে বেঁচে আছে। পৃথিবীর কোথাও আবার আট বছরের আদিবাসী ছেলে গাছের পাতা শিকড় খেয়ে বেঁচে আছে। সবটাই বাঁচা। একটা মানুষের বাঁচা, একটা পশুর।’

ঋষা একটু চুপ করে বলল, ‘লেকচার স্টপ কর। আজ রেজাল্ট।’

এই কথার উত্তর দিল না অর্চিন। সে জানে এই সেমিস্টারেও সে ফার্স্ট হবে। তার কিছু এসে যায় না। সে ঠিক করে ফেলেছে, সে আর লেখাপড়া করবে না। লেখাপড়া করা মানে সময় নষ্ট। সে একজন পাতি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পেটি বুর্জোয়া কেরিয়ার করবার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। তার জন্য অনেক বড় কাজ অপেক্ষা করছে।

সবার আগে মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

ছয়

‘বাবা, কেমন আছ?’

কমলকান্তি সেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর চোখ বোজা। ছেলের প্রশ্নের তিনি জবাব দিলেন না। তিনি কি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছেন? অসম্ভব কিছু নয়। নম্বই পেরোনো একজন মানুষের ঘুম, জেগে থাকা সবসময় নিয়ম মেনে হয় না।

বিমলকান্তিবাবু একটু থমকে আবার ডাকলেন।

‘বাবা, বাবা…।’

কমলকান্তি সেনের ইজিচেয়ারটা অ্যান্টিক। সেগুন কাঠ আর লেদারের। পালিশ করা কালো রং ঠিকরে বেরোয়। আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের অকশন হাউস থেকে কমলকান্তি নিজে দাম হেঁকে কিনেছিলেন। দরাদরির শেষ লড়াই হয় এক ফিরিঙ্গি সাহেবের সঙ্গে। কম্পিটিটরের গায়ের রং ফর্সা বলে কমলকান্তির রোখ চেপে যায়। যে-কোনও বিষয়ে সাহেবদের হারাতে পারলে বাঙালির আলাদা আনন্দ হয়। তিনি হড়বড়িয়ে দাম তুলে দিয়েছিলেন। চেয়ার সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। তখনও অফিসে অ্যান্টি চেম্বারের প্রথা চালু হয়নি। বড় কর্তাদের ঘর ছিল একটাই। রাজকীয় চেয়ার-টেবিলে বসে তিনি কাজকর্ম করতেন। ঘরের একপাশে একটা করে ইজিচেয়ার রাখা থাকত। লাঞ্চ আওয়ারে বা কাজের ফাঁকে এই ইজিচেয়ারেই বিশ্রাম। কমলকান্তি যতদিন অফিস করেছেন এই ইজিচেয়ারেই বিশ্রাম নিয়েছেন। তার পুত্র কিন্তু অফিসে বা ওয়ার্কশপে বাবার ব্যবহার করা কোনও চেয়ারে বসেন না। মণিকুন্তলাদেবীর কারণেই এমনটা হয়েছে। কমলকান্তি সেন যেদিন থেকে ব্যবসার কাজে বেরোনো বন্ধ করলেন, সেদিনই মণিকুন্তলাদেবী তার স্বামীর সঙ্গে তর্ক করেন।

‘অফিসে তুমি বাবার চেয়ারে বসবে না।’

বিমলকান্তি অবাক হয়ে বলেন, ‘কেন? আজ থেকে আমাকে তো বাবার ঘরেই বসতে হবে।’

মণিকুন্তলাদেবী শান্তভাবে বললেন, ‘ঘরে বসবে, কিন্তু চেয়ারে বসবে না।’

বিমলকান্তি বিরক্ত হলেন। কিন্তু বিরক্ত হলেও উপায় নেই। এই মহিলার তর্ক তিনি অ্যালাও করেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কারণটা কি জানতে পারি?’

‘কারণ কিছুই নয়। তাঁর চেয়ারে না-বসা মানে মানুষটাকে সম্মান দেওয়া।’

বিমলকান্তি দু’পাশে হাত ছড়িয়ে ব্যঙ্গের হেসে বললেন, ‘কী অদ্ভুত কথা! তাঁর অফিসে বসব, তাঁর ঘরে বসব, তার হয়ে কাজ করব—তাতে কিছু হয় না, চেয়ারে বসলে ক্ষতি?’

মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘ক্ষতি তো বলিনি। বলেছি, যে মানুষটা এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন, এতদিন ধরে সফলভাবে পরিচালনা করলেন, তাঁর চেয়ারটা দখল না করাই উচিত। থাকলই বা খালি, সমস্যা কী? চেয়ার খালি থাকলেও মনে হবে, তিনি সেখানে আছেন।’

বিমলকান্তি রেগে যান। বলেন, ‘এ সব বস্তাপচা ভ্যালুজ আমাকে শেখাতে যেও না। আমি কি স্কুলের ছাত্র যে মাস্টারমশাইয়ের চেয়ারে বসব না? সব কিছু নিয়ে আর্গুমেন্ট করবে না। আমার অফিসের ব্যাপারে আমাকে বুঝতে দাও।’

মণিকুন্তলাদেবী হেসে ফেলেন। মহিলার এই একটা ক্ষমতা। স্বামীর রাগারাগির সামনে তিনি হাসতে পারেন।

‘অবশ্যই তুমি ছাত্র। তোমার বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছ। তাই না? তাঁকে সম্মান জানানোটা বস্তাপচা ভ্যালুজও যদি হয়, লজ্জার কী আছে? হলে হবে। বুড়ো বাবা-মাকে না দেখাশোনা করাটা আজকাল খুবই আধুনিক একটা বিষয়। তাঁদের নিয়ে গিয়ে পাশের পাড়ার বৃদ্ধাশ্রমে পুরে দেওয়া আরও আধুনিক। আমারটা যদি বস্তাপচা হয়, এগুলো একেবারে খেতের তাজা তরকারি। পটল, ঝিঙে। তুমি কি তবে বস্তাপচা ভ্যালুজের বদলে পটল, ঝিঙে ভ্যালুজ মেনেই চলবে?’

বিমলকান্তি বলেন, ‘পটল-ঝিঙে ভ্যালুজ! এসব কী কথা? তুমি কি রসিকতা করছ মণি?’

‘রসিকতা করছি না, তবে একটা সহজ বিষয় নিয়ে তোমার মতো সিরিয়াস ভাবও করছি না।’

বিমলকান্তিবাবু বলেন, ‘তর্ক কোরো না… তর্ক কোরো না মণি। এমনিতেই চিন্তায় আছি। এতদিন মাথার ওপর বাবা ছিলেন। এখন বলছেন, অবসর মানে ফুল অবসর। আর কাজের কোনও কথা শুনবেন না। ঝামেলায় পড়লেও নয়। আমাকে একা বিজনেস চালাতে হবে। কী যে করব বুঝতে পারছি না। তার ওপর তোমার তর্ক। উফ!’

মণিকুন্তলাদেবী এগিয়ে এসে স্বামীর গায়ে হাত রাখলেন। বললেন, ‘মাথা ঠান্ডা করো। ঠিক পারবে। বাবার চেয়ার পাশে রাখলে সব ঝামেলা সামলাতে পারবে। বড় বড় রাজা-বাদশারাও বাবার সিংহাসন পাশে রেখে নতুন সিংহাসনে বসত। আজকালকার দু-চার আনার ছেঁদো বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আধুনিকতা নিয়ে মাথা ঘামিও না। যারা ছেঁদো ছেলেমেয়ে হয় তারা বাপ-ঠাকুরদার সম্পত্তি নেওয়ার ব্যাপারে আধুনিকতা দেখায় না। সম্পর্ক বলে কিছু হয় না, কেরিয়ারের জন্য জন্মেছি, কেরিয়ারের জন্য মরব বলে বুক বাজিয়ে বেড়ায়, অথচ বাবা মরল কি মরল না, জমি-বাড়ির হিসেব নিতে ছুটে আসে। এরাই বুড়ো বাবা-মাকে সম্মান দেখাতে কুণ্ঠা বোধ করে। নীচু হয়ে প্রণাম পর্যন্ত করে না। পারলে বাবার সঙ্গে বিজয়ার হ্যান্ডশেক করে। এই যুগে নাকি মাথা নোয়ানো খারাপ। অথচ বাড়ির দলিল খুঁজতে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে যায়। এরা কী ভ্যালুজ ঠিক করে দেবে?’

বিমলকান্তি বলেন, ‘তুমি থামবে মণি? আর লেকচার সহ্য হচ্ছে না।’

স্ত্রীর কাছে রাগ দেখালেও সেদিন অফিসে পৌঁছেই বিমলকান্তি প্রথমে বাবার চেয়ারটা সরিয়ে রাখলেন। নিজের জন্য অন্য চেয়ার এসেছে। সেদিনই বেলা তিনটের পর কোম্পানির ভ্যানে কমলকান্তি সেনের প্রিয় ইজিচেয়ার চলে এসেছে বাড়িতে। মণিকুন্তলাদেবী মুখ টিপে হেসেছেন। মুখে কিছু বলেননি। তিনি এতদিনে বুঝে গেছেন, তার স্বামী মানুষটা সিরিয়াস এবং ভালো। ভালো এবং ছেলেমানুষ।

বিমলকান্তি অফিসে বেরোনোর আগে রোজই একবার বাবার কাছে আসেন। খোঁজখবর নেন। আবার আসেন সন্ধেবেলা। অফিস থেকে ফেরবার পর। কোনও দিন অল্প কথাবার্তা হয়, কোনও দিন শুধু কেমন আছে জেনেই চলে যান। কথা হবে কিনা কমলকান্তির মুডের ওপর নির্ভর করে। তবে কথা হলেও সেখানে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ের প্রবেশ নিষেধ।

দু’বার ডাকাতেও বাবা চোখ না খোলায় বিমলকান্তিবাবু খানিকটা অস্বস্তি অনুভব করলেন। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অফিসে জরুরি মিটিং আছে। একটা এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বাইরের বড় অর্ডার এসেছে। সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, ফিনাইল, রুমফ্রেশনার সবকিছুর অর্ডার হয়েছে। এইভাবে কোম্পানির সবক’টা প্রডাক্টের অর্ডার চট করে হয় না। প্রায় কোটি টাকার ব্যবসা। এই সময় কোনও সমস্যা হলে বড় লোকসান হয়ে যাবে। অন্য কেউ অর্ডার তুলে নেবে। এই ব্যবসার সব থেকে ঝামেলা হল নামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে লড়াই। তারা যদি জানতে পারে সেন অ্যান্ড অ্যাসেসিয়েটস এলসির জটে পড়েছে, অর্ডার তুলে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিষয়টা নিয়ে বিমলকান্তিবাবু চিন্তিত। তার ওপর প্রহ্লাদ নামের লোকটার ঘটনায় খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে নিজেকে অন্য একটা মানুষ মনে করা বিব্রত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুধু লোকটার মনের কথা নয়, লোকটার মতো পেট চুলকোনো, ঢেঁকুর সবই হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। দুম করে নিজেকে একটা অন্য মানুষ মনে হলে মন খারাপ তো হবেই। যে কারও হবে। তার ওপর প্রহ্লাদের মতো অধস্তন কর্মচারীর মতো। আপসেট হওয়ার পক্ষে এই ঘটনা যথেষ্ট। পরে অবশ্য সামলে নিয়েছেন। নিজেকে বুঝিয়েছেন, বয়স বাড়ছে। মস্তিষ্কের নানা কোষ যে মাঝে মাঝে নিয়ম ভেঙে নিজের ইচ্ছেমতো আচার-আচরণ করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? সেখান থেকে তৈরি হয় হ্যালুসিনেশন। কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রহ্লাদ নামের লোকটা হয়ে যাওয়া সেরকমই কিছু ছিল। সত্যি নয়, বিভ্রম। লোকটার ওপর বিরক্তি থেকেই হয়তো হয়েছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। নিজেকে এই যুক্তিতে শান্ত করেছেন।

স্নান খাওয়া করে যখন ওপরে বাবার কাছে আসছেন, তখন ছোট মেয়ের সঙ্গে দেখা। বারিধারা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। এই মেয়েটিকে নিয়ে বিমলকান্তিবাবু সব সময়ই চিন্তার মধ্যে থাকেন। কোনও মানুষ যে জীবনকে এমন হালকা চালে নিতে পারে, বারিধারাকে না দেখলে তিনি জানতেও পারতেন না।

এই মেয়ে যখন যা খুশি করতে পারে, বলতে পারে। ভয়ডর বলে কোনও ব্যাপারই নেই। সব থেকে বড় কথা, লোকে কী ভাববে তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। তার ওপর বড্ড জেদি। অথচ লেখাপড়ায় অতি ভালো। ছবি আঁকতে পারে। স্কুলে পড়বার সময় গান শিখতে যেত। দুম করে একদিন দিল ছেড়ে। বাড়ি এসে বলল, ‘আমি আর গান শিখতে যাব না। ওখানে পরীক্ষা হবে। আমি পরীক্ষা দেব না। গান কোনও পরীক্ষা নয়, গান হল পরীক্ষার পর ছুটি।’

স্ত্রীর কাছে ঘটনা শুনে বিমলকান্তিবাবু মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। যত্ন করে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। ‘এটা ঠিক নয় বৃষ্টি। জীবনের সব কিছুই সিরিয়াস ভাবে দেখতে হয়। গানটাও একটা সিরিয়াস বিষয়। আর পাঁচটা সিরিয়াস বিষয়ে যেমন পরীক্ষা আছে, গানের বেলাতেও আছে। পরীক্ষা না দিলে বুঝবে কী করে, তুমি কতটা শিখেছ? তা ছাড়া তুমি তো গান খুব খারাপ করোও না। তোমার ভয় কীসের? পরীক্ষায় তুমি বেশি নম্বর পাবে।’

মেয়ে মুখ গোঁজ করে বলেছিল, ‘আমি জানি গান, আমি খারাপ করি। গানে আমার নম্বর দরকার নেই বাবা, আনন্দ দরকার। আমি গান শিখব না, আমি গান গাইব।’

সেদিনই বিমলকান্তি বুঝেছিলেন এ মেয়ে পরে গোলমাল করবে। তিনি মণিকুন্তলাদেবীকে সাবধানও করেছিলেন।

‘ছোট মেয়েকে মানুষ করতে পারছ না মণি। মেয়ে বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে। পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছে। জীবনটা লম্বা। এক লাফে পাকা হওয়ার দরকার নেই। কাঁচা থেকে ধাপে ধাপে পাকার দিকে যেতে হয়। মেয়েকে কন্ট্রোল করো।’

মণিকুন্তলাদেবী বারিধারাকে বকাঝকা করে গানের পরীক্ষায় বসালেন। বারিধারা বেসুরো গান গেয়ে পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে এবং হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে। এই ঘটনায় বিমলকান্তি আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

সিঁড়িতে মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন বিমলকান্তি।

‘কোথায় চললে? ইউনিভার্সিটি?’

বারিধারা এমনভাবে মাথা নাড়ল, যার মনে হ্যাঁও হয়, নাও হয়। বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমায় ড্রপ করে দেব।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না বাবা। আর্জেন্ট কেস।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি ছোট গাড়িটা নিয়ে যাও। নন্দ এসে গেছে।’

বাড়িতে দুটো গাড়ি। একটা বিমলকান্তিবাবুকে নিয়ে যাতায়াত করে, দ্বিতীয়টি বাড়ির অন্য সবার। এই গাড়ি চেহারায় প্রথমটির থেকেও বড়। তার পরেও গাড়ির নাম ”ছোট গাড়ি”।’ বারিধারা, মেঘবতী ছোটবেলায় এই বিষয়ে তাদের মাকে প্রশ্ন করত।

‘মা, গাড়ি বড় কিন্তু নাম ”ছোট গাড়ি” কেন?’

মণিকুন্তলাদেবী হেসে বলতেন, ‘তোমরা ছোটরা এই গাড়িতে চড়ো বলে গাড়ির নাম ”ছোট গাড়ি”।’

বারিধারা বলত, ‘আমরা বড় হলে কি গাড়ির নাম বদলে যাবে?’

মণিকুন্তলাদেবী উৎসাহ নিয়ে বলতেন, ‘অবশ্যই যাবে।’

বারিধারা হাততালি দিয়ে বলত, ‘খুব মজা হবে, আমরা তখন বড় গাড়িতে চড়ব।’

বারিধারা, মেঘবতী বড় হয়ে গেছে। এর মধ্যে তিনবার গাড়ি বদলেছে। নতুন গাড়ি এসেছে। কিন্তু গাড়ির নাম বদলায়নি। সেই ‘ছোট গাড়ি’ই রয়ে গেছে। বারিধারা, মেঘবতীরা এই নিয়ে কথা বলে না। সম্ভবত ‘ছোট গাড়ি’তে চাপলে তারা এখনও ছোটবেলার মজা পায়। সামান্য নাম বদলে এই অসামান্য মজা তারা নষ্ট করবে কেন? ছোট গাড়ির চালক নন্দ। গত তিরিশ বছর এ বাড়িতে গাড়ি চালাচ্ছে। আগে অফিসের গাড়ি চালাত। পরে বাড়ির গাড়িতে পদোন্নতি হয়েছে। বারিধারা, মেঘবতী ডাকে ‘নন্দকাকা’। বয়স্ক এই মানুষটি বহুবিধ গুণের অধিকারী। সৎ, প্রখর সময়জ্ঞান, দায়িত্ব সম্পর্কে অতি সচেতন। তেল চুরি, মেরামতি থেকে কমিশন, গ্যারেজ থেকে দু’নম্বরী পার্টস কেনা ধরনের কোনও বদভ্যাস তার নেই। বরং অনেক সময় নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে গাড়ির কাজ করিয়ে নেয়। এমন পাংচুয়াল ড্রাইভার খুব কমই দেখা যায়। ভোর সাড়ে তিনটে বললেও এক মিনিট নড়চড় হবে না। তিনটের সময় এসে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে, তেল মবিল চেক করে, টায়ারের হাওয়া টিপেটুপে, ধুলো ঝেড়ে রেডি হয়ে যাবে। দায়িত্বজ্ঞানও মারাত্মক। ছোটবেলোতেও বারিধারা, মেঘবতীকে কোথাও নিয়ে গেলে বাড়ির লোক নিশ্চিন্ত থাকত। নন্দ যখন গেছে চিন্তা নেই। মানুষটার একটাই দোষ। যে দোষ আর সবার থাকলে মেনে নেওয়া যায়, গাড়ির চালকের থাকলে মানা যায় না। অতি অল্প দিনে চাকরি নট হয়ে যায়। গাড়ি চালাতে গিয়ে নন্দ প্রায় সব সময়েই রাস্তা ভুল করে ফেলে। অতি চেনা রাস্তাও সে অতি সহজে গুলিয়ে ফেলে। হাজারবার যে পথে সে গেছে, হাজারবার সেই পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। মজার কথা হল, পথ গুলিয়ে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। মথা চুলকে, লজ্জা লজ্জাভাবে হাসে। যেন ভুল পথে চক্কর কাটা একটা আনন্দের বিষয়। পিছনে বসা যাত্রীদের উদ্দেশে বলে, ‘পথ ব্যাপারটাই গোলমেলে। বার বার হারিয়ে যায়। অবার বার বার ফিরে আসে। এই কারণে পথ হারালে বেশি চিন্তা করতে নাই। পথ নিজে ফিরে আসে।’

নন্দর এই দার্শনিক বোধে বাড়ির সকলে একই সঙ্গে বিরক্ত এবং মুগ্ধ। ফলে বিভ্রান্ত। সম্ভবত এই বিভ্রান্তির কারণেই এই লোকের চাকরি নট হয় না।

‘থ্যাঙ্কু বাবা। তা হলে নন্দকাকার সঙ্গেই চললাম। বাই।’

বারিধারা ফড়ফড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বিমলকান্তি ভুরু কোঁচকালেন। তিনি তার ছোট মেয়েকে এত ভালোবাসেন কেন? গোলমেলে বলে? এটা কোনও কাজের কথা নয়। কোঁচকানো ভুরু নিয়েই বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন বিমলকান্তি।

দু’বার ডাকার পরও কমলকান্তি সেন চোখ খোলেননি। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? ঘুমিয়ে থাকলে বিরক্ত না করাই ভালো। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিমলকান্তিবাবুর শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি চমকে উঠলেন।

এ কী! কী হচ্ছে এ সব?

সাত

আলমারি থেকে ঝুপ ঝুপ করে দুটো বই মাটিতে পড়ে গেল।

বিমলকান্তিবাবু চমকে উঠে আলমারিটা ধরেছিলেন। সেই নাড়াতেই বই পড়েছে। এটা ঠিক বইয়ের আলমারি নয়, চারটে খোলা তাক। অর্ডার দিয়ে বানানো। বুক সমান হাইট। একেবারে নীচের তাকটা বেশ খানিকটা উঁচুতে। বই নেওয়ার জন্য যাতে কোমর ভেঙে খুব নীচু হতে না হয়। ঠাকুরদার অবসর উপলক্ষ্যে দুই নাতনি এই বইয়ের তাক উপহার দিয়েছিল। দুটো-একটা করে বই জমতে জমতে এখন তাক উপচে পড়বার মতো অবস্থা।

বিমলকান্তিবাবু শুধু চমকাননি, ভয়ও পেয়েছেন। ভয় পাওয়ার মতোই ঘটনা। সেদিন প্রহ্লাদ নামের লোকটার সঙ্গে যেমন হয়েছিল, আবার সেই একই ঘটনা ঘটেছে। মুহূর্তের জন্য মনে হল, তিনি বিমলকান্তি নন, তিনি অন্য মানুষ। শরীর, মন সব অন্য মানুষের। তবে এবার আর অধস্তন, দরিদ্র কর্মচারী নয়, এবার তিনি হয়ে গেছেন সেন অ্যাসোসিয়েটসের কমলকান্তি সেন!

কী ভয়ংকর!

বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিমলকান্তিবাবুর মনে হল, এক ঝটকায় বয়স তিরিশ বছর বেড়ে গেল। তিনি দাঁড়িয়ে নেই। চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে আছেন ইজি চেয়ারে। হাতদুটো হাতলে রাখা। বাঁ পায়ের পাতাটা ভারী। গায়ে ফতুয়া জামা আর লুঙ্গি। পায়ে ঘরে পরবার স্লিপার। ডান পায়ের স্লিপারের তলায় কিছু একটা আটকে গেছে। মেঝেতে পড়ে থাকা সেলোটেপ? চুইংগাম? নাকি কাগজ জড়িয়েছে? বাঁ-হাতের কনুইয়ের কাছটা একটু জ্বালা করছে। সকালে বাথরুমের দেওয়ালে ঘসা লেগেছিল। বিমলকান্তিবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি চোখ বুজে মনে মনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। কোনও মহিলার সঙ্গে। মহিলার গলা ভারী। বয়স্ক? মহিলার কণ্ঠস্বরে অনুযোগ। বললেন, ‘তুমি এখনও কিছু করলে না?’

‘করব। অবশ্যই করব।’

এবার মহিলার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি। বললেন, ‘আর কবে করবে? এবার তো ফট করে একদিন মরে যাবে। বয়স কত হল খেয়াল হয়েছে? একানব্বই কোনও সহজ বয়স নয়।’

চিন্তা কোরো না, চট করে মরছি না। শরীরের কলকবজা বিগড়োয়নি। আসলে ঠিক কী করা উচিত, কোনটা করলে ভালো হয়, কোনটার বেশি প্রয়োজন, তাই নিয়ে একটা দোনামোনার মধ্যে ছিলাম।’

মহিলা কণ্ঠস্বর বললেন, ‘দোনামোনা বন্ধ করো। দোনামোনার কারণে বেশিরভাগ সময়ে ভালো কাজ করে ওঠা হয় না। সময় ফুরিয়ে যায়।’

‘ঠিকই বলেছ। সময় কমে আসছে। কাজটার শেষ দেখে যেতে পারব না।’

মহিলা কণ্ঠস্বর চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘শেষ দেখবার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি কি উদ্বোধন করে কাগজে ছবি ছাপাতে চাও। পাশে মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকবে? ছি:। তোমার কাজ তুমি করবে। শুরু করবে। বিমল আছে, সে বাকিটা সামলাবে। সে খুবই কাজের ছেলে।’

‘বিমল কাজের ছেলে, কিন্তু বোকা। বেশি সিরিয়াস বলেই বোকা। এই কাজে সিরিয়াস হওয়ার থেকে অনেক বেশি আবেগ দরকার। আমি অন্যরকম ভেবেছি। কাজটার দায়িত্ব অন্য একজনকে দেব। আমার বিশ্বাস, সে-ই সব থেকে ভালোভাবে করবে। সে বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দেরি হওয়ার পিছনে এটাও একটা কারণ।’

ব্যস এখানেই শেষ। কথাবার্তা যেমন দ্রুত এলও, মিলিয়েও গেল দ্রুত। মহিলা কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগলেও বিমলকান্তিবাবু ঠিক ধরতে পারলেন না। হয়তো ঘোরের মধ্যে ছিলেন বলেই ধরতে পারেননি। আবার এমনটাও হতে পারে, এইমুহূর্তে তিনি ছিলেন কমলকান্তি। কার সঙ্গে কথা বলছেন জানেন। আলাদা করে কণ্ঠস্বর চেনবার প্রয়োজন হয়নি। সেই কারণেই মাথাও কাজ করেনি। নিজের মধ্যে ফিরে আসবার পর অস্বস্তি হচ্ছে।

অস্বস্তির সঙ্গে ভয়। প্রহ্লাদের ঘটনার থেকে অনেকটা বেশি ভয়। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা ভয়। মাত্র কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে দু’বার এক ঘটনা কী করে ঘটল! এক ভুল! বাবার কনুইয়ের জ্বালা তিনি অনুভব করবেন কেন? গায়ের ফতুয়াটা না হয় চোখে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু লুঙ্গির আড়ালে থাকা পা? সেটা যে ফুলে ভারী লাগছে, এটা তো বোঝা সম্ভব নয়। চটির নীচে আটকে থাকা সেলোটেপ? তার খবর জানবেন কী করে? বাবার পায়ের চটি তো উলটনো নেই। তার ওপর কথা। দুজনের কথা শুনতে পেয়েছেন। যা অসম্ভব। হতেই পারে না। যার সঙ্গেই বাবা কথা বলুন না কেন, মুখে বলেননি, মনে মনে বলেছেন। শুনতে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু শুনেছেন। সবমিলিয়ে ঘটনা বেশ কয়েক মিনিটের। সকালের মতো পনেরো-বিশ সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায়নি। নরমাল অবস্থায় ফিরতে সময় লেগেছে। নরমাল হয়ে কোট প্যান্ট পরে বাবার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন ফের। অফিসে বেরোবার সময় রোজ যেমন দেখা করতে আসেন।

কী হচ্ছে এসব! এ কী জটিল সমস্যায় পড়তে হল? একই ভুল বারবার হবে কেন? হতেই পারে না। সমস্যা অন্য কোথাও হচ্ছে।

বই পড়বার শব্দে কমলকান্তি সেন চোখ খুললেন। বিমলকান্তি তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে বই দুটো তুলে আলমারির তাকে রাখলেন। নিজেকে সামলে বললেন, ‘সরি বাবা, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।’

কমলকান্তি সেন আধশোওয়া অবস্থা থেকে সোজা হলেন। ছেলের ‘সরি’ পাত্তা দিলেন না। বললেন, ‘তাক থেকে কী বই পড়ল?’

আলমারিতে রেখে দেওয়া বই দুটো আবার টানলেন বিমলকান্তি। একটা পড়ল হ্যামলিনের রোমান মিথলজি, আর একটা শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প। শিবরাম চক্রবর্তীর নাম শুনে কমলকান্তি সেনের মুখ উজ্জ্বল হল। বললেন, ‘গল্পের বইটা আমার হাতের কাছে এই টেবিলে রাখো। এটা একটা ওয়ান্ডারফুল বই। এতে রেসিপির ওপর দুর্দান্ত একটা গল্প আছে। পড়বার সময় এত হেসেছিলাম যে, পেটে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। বুঝলে বিমল, বয়সকালে এইসব গল্পের কথা আমি কিছুই জানতাম না। এটা একটা আপশোসের ব্যাপার। আগে শুরু করলে আরও অনেক কিছু পড়তে পারতাম। তবে এখন যে পারছি, এটাও বিরাট সৌভাগ্যের। যাক, গল্পটার কথা বলি। আমি ঠিক জানি না, রান্না নিয়ে এমন ভালো গল্প পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষায় লেখা হয়েছে কিনা। আমার বিশ্বাস, হয়নি। গল্পটার নাম ”পাক প্রণালী বিপাক”। তুমি কি গল্পটা জানো?’

বিমলকান্তিবাবু এমনিতেই খুব থতমত অবস্থায় আছেন। এই প্রশ্নে আরও থতমত খেয়ে গেলেন।

বিমলকান্তিবাবু বইটই পড়বার মধ্যে বিশেষ নেই। গল্প উপন্যাস তো একেবারেই নয়। মোটে ভালো লাগে না। গল্প উপন্যাস বানানো ব্যাপার। সিরিয়াস ভাবনাচিন্তার অভাব। লেখকরা যা খুশি লেখেন। লেখালেখির ব্যাপারে কোনও নিয়মকানুন, নিষেধাজ্ঞা নেই বলেই এই হাল। ক’দিন আগে বারিধারার ঘরে একটা গল্পের বই দেখেছিলেন। অন্যমনস্কভাবে সেই বইয়ের কয়েকটা পাতা উলটেও ফেলেন। মাথায় আগুন ধরে যায়। মনে হচ্ছিল, এই বই এখনই জানলা দিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া দরকার। ফেলবার আগে পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে, যাতে কুড়িয়ে নিয়েও কেউ পড়তে না পারে। এটা একটা বই! এ তো ফাজলামি! শব্দ ন্যালবেলে, বাক্য নড়বড়ে। ঘটনার বাস্তব ভিত্তি নেই। ভাবনায় শিক্ষার ছাপ নেই। গভীর কথা নেই। বারিধারাকে পরদিন বলেও ছিলেন।

‘এসব কী পড়িস বৃষ্টি? এ তো খুবই সাবস্ট্যান্ডার্ড লেখা। অতি নিম্নমানের।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘খেপেছ বাবা? এই বই কি আমি পড়বার জন্য এনেছি? আমার পড়ার টেবিলের পায়ার নীচে রাখবার জন্য এনেছি। পায়া নড়বড় করছে। শুনলে তুমি খুশি হবে বাবা, বই এত খারাপ যে টেবিলও রিফিউজ করছে। এই বই দিলে আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা, গাছের মতো টেবিলেরও প্রাণ থাকে। পড়ার টেবিল বই পড়তে পারে, খাবার টেবিল খেতে পারে, অফিসের টেবিল ফাইলে নোট দিতে পারে, হসপিটালের অপারেশন টেবিল রোগীর পেট কাটতে পারে। এই কারণেই আমার পড়বার টেবিল এই জঘন্য বই পড়তে পেরেছে এবং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে।’

বিমলকান্তিবাবু সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘এসব কী কথা! টেবিলের পায়া গোলমাল করছে বলে তুমি এই ধরনের নিম্নমানের বই বাড়িতে নিয়ে আসবে? আজই নতুন টেবিল কিনে নাও।’

এরপরেও বিমলকান্তিবাবু মাঝে মাঝে যেটুকু পড়েন, তার বেশিটাই বিজ্ঞান, ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থ। তা-ও বিশেষ পড়া হয় না। সত্যি কথা বলতে বই পড়ার প্রতি তার টান নেই। বাবার প্রশ্নে আমতা আমতা করে মাথা চুলকোতে থাকেন। চোখ মুখ দেখে কি বোঝা যাচ্ছে, তিনি নার্ভাস? বাবা সম্পূর্ণ অন্য একটা বিষয় নিয়ে মেতে গেছেন। অপ্রয়োজনীয়, ফালতু একটা বিষয়। ছেলের দিকে খেয়াল করবার অবকাশ নেই। এটা ভালো হয়েছে। আজ অফিস বাদ দিলে কেমন হয়? বাড়িতে বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। কেন এমন হচ্ছে? একটা মানুষ কখনোই আর একটা মানুষ হয়ে যেতে পারে না। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও নয়, অনেক বেশি সময়ের জন্য হলেও নয়। অলৌকিক ব্যাপার বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সবকিছুর পিছনে কারণ আছে। বিজ্ঞান, যুক্তি আছে। এই ঘটনার পিছনেও আছে। সেটা হল ভুল। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। মনের ভুল। একবার পর্যন্ত মনের ভুল বলে এড়িয়ে থাকা যায়। বারবার হলে কীভাবে এড়ানো সম্ভব? নাকি সেটা উচিত। ভাবতে হবে। কাজকর্ম বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভাবনা চাই। আজ অফিস বাদ দেওয়া ভালো।

কমলকান্তি সেন ইতিমধ্যে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ফেলেছেন এবং বেশ জমিয়ে হাসি হাসি মুখে শিবরাম চক্রবর্তী গল্প বলতে শুরু করেছেন। এত উদ্বেগের মধ্যেই বিমলকান্তিবাবু দেখলেন, তার বাবা এই বৃদ্ধ বয়েসেও কত তুচ্ছ অহেতুক বিষয় নিয়ে খুশি।

‘গল্পটা এরকম…শিবরামবাবুর বোন বিনু ক’দিনের জন্য গেছে বাইরে…যাবার আগে দাদাকে একটা রেসিপির বই দিয়ে গেছে। প্রাক প্রণালী। ক’দিন বই দেখে নিজে রান্না করে খেতে হবে। শিবরামবাবু বললেন, এ তো কোনও ব্যাপারই নয়, রান্নার বই যখন আছে রান্না করা অতি সহজ হবে…হা হা…বই দেখে ঠিক করলেন পেঁয়াজের স্যুপ বানাবেন। বইতে লেখা আছে। প্যানে জল গরম করে দিতে হবে আলু, পেঁয়াজ, গোলমরিচ। মজা শুরু হয়েছে খোসা ছাড়ানো আলু থেকে। লেখক বাড়িতে খোসা ছাড়ানো আলু খুঁজে পাচ্ছে না। সব আলুতেই নাকি খোসা…হা হা…তারপর পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে কান্নাকাটি অবস্থা। বইয়ে লেখা রেসিপি হল, পিঁয়াজ দিতে হবে ফুটন্ত জলে। দিতে হবে ছুড়ে। লেখক দূর থেকে পিঁয়াজ ছুড়লেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছেন বার বার…হা হা…একসময় স্যুপ প্যান ছাপিয়ে…স্টোভ ছাপিয়ে এসে লেখককে তাড়া করল। লেখক স্যুপে পা পিছলোলেন। লাফিয়ে উঠলেন খাটে…হা হা…।’

এত পর্যন্ত বলে দম নেওয়ার জন্য থামলেন কমলকান্তি সেন। হাসির চোটে ফর্সা মানুষটার চোখ-মুখ লালচে হয়ে গেছে। বিমলকান্তি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তারও কি হাসা উচিত? মনের এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় হাসবেন কী করে? তারপরেও বানিয়ে হাসবার চেষ্টা করলেন বিমলকান্তি। হাসি হল না।

কমলকান্তি সেন বললেন, ‘বুঝলে বিমল এই গল্পটাকে নিছক হাসির হলেও, আসলে একটা দর্শন। ফিলসফি। লিখে রাখা নিয়ম, পদ্ধতি, কারিকুরিতে যে স্বাদু জীবন তুমি তৈরি করতে চাইবে, সে জীবন যে বইয়ের কথামতো নিয়ম মানবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সে জীবন এখন কাণ্ড করতে পারে যা তুমি কল্পনাও করতে পারোনি। সে হাসাবে, কাঁদাবে। উপচে পড়ে ভাসিয়ে দেবে। কখনও পিছনে তাড়া করবে, কখনও ফেলেও দেবে ধাক্কা দিয়ে। শিবরাম চক্রবর্তী খুব বড় লেখক বলে হাসতে হাসতে এই দর্শনের কথা বলেছেন। আবার যদি মনে করো ওসব কিছু নয়, শুধুই হাসাতে চেয়েছেন, প্রাণখোলা হাসি, তাতেও কোনও সমস্যা নেই। তুমি যদি চাও এই গল্পটা পড়তে পারো। আমার মনে হয়, লেখাপড়া জানা বাঙালির এইসব গল্প না-পড়াটা একটা লজ্জার।’

বিমলকান্তিবাবু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, না অফিসে যাবেন। এখন যদি ঘরে গিয়ে কোট প্যান্ট ছেড়ে ঘরের পোশাক পরে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন, একটা বিচ্ছিরি হইচই শুরু হয়ে যাবে। বাড়ির সবাই লাফালাফি শুরু করবে। কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? পেট ব্যথা? মাথা ঘুরছে? বুক ধড়ফড়? প্রেসার? হয়তো ডাক্তারও ডেকে আনবে। হয়তো কেন, অবশ্যই আনবে। কী বলবেন? আমার কিছু হয়নি? তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি একটা ভুল নিয়ে গোলমালে পড়েছি। ঠান্ডা মাথায় ভুলটা ভাবতে চাই। বাড়ির লোক সে কথা মেনে নেবে? অসম্ভব। আরও উত্তেজনা তৈরি করবে। না, তার থেকে অফিসে চলে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের। জীবন কি লেখার নিয়ম মেনে তৈরি করা যায়? সে হাসায়, কাঁদায়, উপচে পড়ে, তাড়াও করে। অন্য মানুষ হওয়ার ভুলটা কি সেরকম কিছু? তাড়া করছে?

‘বাবা, গল্পটা আমি পড়ব। আজ অফিসে চললাম।’

কমলকান্তি সেন খুশি হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বইটা তোমার ঘরে পাঠিয়ে দেব।’

বিমলকান্তিবাবু ঘুরতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। একটু থমকে থেকে বললেন, ‘বাবা, তোমার কি হাতে ছড়ে গেছে? হাতের কনুই?’

কমলকান্তি সেন ছেলের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।

‘কে বলল?’

বিমলকান্তিবাবু লজ্জা পেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘কে যেন বলল…।’

কমলকান্তি সেন ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ভুল বলেছে। অথবা তুমি গুলিয়ে ফেলছ। আমার এরকম কিছু হয়নি।’

বিমলকান্তি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। না, তাহলে সবটাই ভুল। জিগ্যেস করলে হয়তো জানা যেত, বাবার পায়েও কোনও সমস্যা হয়নি।

ছেলে ঘর থেকে বেরোনোর পর কমলকান্তি আবার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ছেলেকে একটা মিথ্যে বললেন। আজ সকালে স্নান করবার সময় তার বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছটা ছড়ে গেছে। খুবই সামান্য। তবে এখনও জ্বালা জ্বালা ভাবটা রয়েছে। কিন্তু বিমল জানল কী করে? কোইন্সিডেন্স? তাই হবে।

কমলকান্তি মনে মনে তিরিশ বছর আগে মারা যাওয়া স্ত্রীর সঙ্গে ফের কথা বলা শুরু করলেন। এটা উনি মাঝে মাঝেই করে থাকেন।

আট

শ্রবণ পড়েছে মুশকিলে। সে আজ বাড়ি থেকে পালাবে, কিন্তু কী ধরনের ব্যাগ নেবে বুঝতে পারছে না। বাড়ি থেকে পালানোর সঙ্গে কোন ধরনের ব্যাগ মানায়? চাকা লাগানো ঢাউস ট্রলি ব্যাগ? নাকি পিঠে ঝোলানো রুকস্যাক? নাকি পুরোনো আমলের ট্র্যাঙ্ক, বেডিং? ব্যাগ কোম্পানিরা কত ধরনের ব্যাগ, সুটকেস বের করেছে। ট্র্যাভেল ব্যাগ, অফিস ব্যাগ, ট্রেকার্স ব্যাগ, হানিমুন ব্যাগ, ফ্যামিলি ট্যুর ব্যাগ। পালানোর জন্য কোনও ব্যাগ কি তারা তৈরি করেছে? শ্রবণ কি দোকানে গিয়ে জিগ্যেস করতে পারে? আজকাল সব কিছুই কাচঘেরা বড় বড় দোকানে বিক্রি হয়। যদিও এখন আর দোকানকে দোকান বলা যায় না, দোকান বললে প্রেস্টিজে লাগে। বলতে হয় শোরুম, আউটলেট। জামাকাপড়, জুতো, ব্যাগ, টিভি, কম্পিউটার থেকে শুরু করে ভেলি গুড়, ঘুঁটে, হ্যারিকেন, চরণামৃত পর্যন্ত সব কিছুর শোরুম হয়ে গেছে। কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেই এয়ারকন্ডিশন মেশিনের ফিনফিনে ঠান্ডা বাতাস দেয়। শার্ট-প্যান্ট-টাই পরা স্মার্ট ছেলেমেয়েরা স্মিত হেসে এগিয়ে আসবে।

‘বলুন স্যার।’

শ্রবণকে হাসি পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে হবে, ‘ব্যাগ দেখান।’

বিক্রেতা অতিরিক্ত স্মার্ট হওয়ার জন্য গলা নামিয়ে বলবে, ‘ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। আপনি একজন ব্র্যান্ড কনসাস মানুষ। নামীদামি কোম্পানির প্রতি আস্থাশীল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের বহু কাস্টমার আজও ব্র্যান্ড ব্যাপারটা বুঝতে চান না। তাঁরা প্রাোডাক্টের ভ্যালু দেখেন, ব্র্যান্ডভ্যালু দেখেন না। এঁদের নিয়ে আমরা খুবই সমস্যায় পড়ি। কিছুতেই বোঝাতে পারি না, জিনিস সস্তা বা টেকসই বলে কথা হয় না। কথা হয় ব্র্যান্ডের। জাপানের নিকিতানি, আমেরিকার ভিলাইস, হনলুলুর টিকিমাটা কোম্পানির জিনিস বাড়িতে পৌঁছোনোর আগেই ছিঁড়ে, ভেঙে বা রং চটে যাওয়াও একটা আনন্দের ঘটনা। গর্ব করে পাঁচজনকে বলা যায়। সস্তা বা টেকসই জিনিসে এই গর্ব নেই। কথাটা কে বুঝবে বলুন স্যার? সবথেকে বড় কথা কী জানেন স্যার? সব থেকে বড় কথা হল, ব্র্যান্ড আপনার সব প্রয়োজন মেটাতে পারে। অল পারপাস।’

এই সময়ে শ্রবণকে হয়তো হাত নেড়ে বলতে হবে, ‘চিন্তা করবেন না। এ সমস্যা থাকবে না। আমার কাছে খবর আছে, খুব শিগগিরই স্কুল সিলেবাসে ব্র্যান্ড বিষয়টা ঢোকানো হচ্ছে। ইংরেজি, অঙ্ক, ফিজিক্সের সঙ্গে ব্র্যান্ড পরীক্ষায় পাস করতে হবে। দেরিতে হলেও আমাদের দেশের বড় বড় মানুষজন পেরেছেন, ছোটবেলা থেকে ব্র্যান্ড সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের জ্ঞান বাড়ানো প্রয়োজন। যাকে বলে ব্র্যান্ডজ্ঞান। মানবজীবনের একটা বড় অংশ বেচাকেনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্য ব্র্যান্ডজ্ঞান থাকতে হবে। সমস্যা একটাই। সিলেবাসে নতুন বিষয় ঢোকাতে হলে কিছু বাদ দিতে হয়। নইলে ছোট ছেলেমেয়েদের পক্ষে সিলেবাস কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে ইতিহাস বই থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের খানিকটা বাদ দেওয়া যেতে পারে। বিদেশের ব্র্যান্ড আগে না দেশের স্বাধীনতা আগে? অবশ্যই ব্র্যান্ড আগে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়! যাই হোক, আমাকে ব্যাগ দেখান।’

বিক্রেতা এবার স্তূপাকৃত ব্যাগের সামনে দাঁড় করাবে। হাত পাশে ছড়িয়ে বলবে, ‘দেখুন, কোনটা আপনার পছন্দ। আমাদের প্রায় আড়াইশো রকমের ভ্যারাইটি আছে। সাইজ আছে দেড় হাজার রকমের।’

ভুরু কুঁচকে বলতে হবে, ‘না না, এ সব নয়। এ সব আমি জানি। বেড়ানোর ব্যাগ, অফিসের ব্যাগ… এ সব আমার জানা আছে…আপনার কাছে পালানোর কোনও ব্যাগ আছে?’

‘সরি, আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। কী বলছেন স্যার?’

এবার শ্রবণকে একটু গলা তুলে বলতে হবে, ‘বলছি, আপনাদের কোম্পানি বাড়ি থেকে পালানোর সময় নেওয়া যায় এমন কোনও ব্যাগ কি বের করেছে?’

বিক্রেতা ঢোঁক গিলবে। বলবে, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। পালানোর ব্যাগ! সে আবার কী জিনিস?’

এবার একটু রাগ দেখালে কেমন হয়?

‘কী জিনিস মানে! পালানো কাকে বলে জানেন না? পৃথিবীর বড় বড় মানুষ ঘরসংসার, রাজ্যপাট ছেড়ে পালিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধর নাম শোনেননি? সম্রাট অশোক? হিউয়েন সাঙ? কেউ চুপিচুপি পালিয়েছেন, কেউ ঘোষণা করে বাড়ি ছেড়েছেন। কেউ ধর্মপ্রচারে, কেউ বিশ্বভ্রমণে। আসলে সবই পালানো। পৃথিবীতে রোজ কত মানুষ পালায়, তার হিসেব রাখেন? আমি রাখি। প্রতি সেকেন্ডে আড়াইজন। আপনি বলছেন কিনা, পালানো কী জিনিস!’

বিক্রেতা রুখে দাঁড়াতে পারে। বলবে, ‘সরি। এ ধরনের কিছু আমাদের স্টকে নেই। আপনি অন্য কোথাও খোঁজ করুন।’

এই রুখে দাঁড়ানো দেখে ঘাবড়ালে চলবে না। গলা চড়িয়ে বলতে হবে, ‘নেই বললেই হবে? জাপানের নিকিতানি, আমেরিকার ভিলাইস, হনলুলুর টিকিমাটা কোম্পানি নিয়ে এত দরদ দেখালেন আর কাজের সময় লবডঙ্কা? এই তো এতক্ষণ ব্র্যান্ডের জয়গান করছিলেন। করছিলেন কিনা? বলছিলেন, তারা নাকি সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। ঘোড়ার ডিম দেয়। ওদের বলুন, পালানোর জন্য আলাদা ব্যাগ চাই।’

চেঁচামেচির কারণে শোরুমের আরও পাঁচজন কর্মী এগিয়ে আসতে পারে। পারে কেন, অবশ্যই আসবে। হয়তো ম্যানেজারও আসবে। সিকিউরিটিকে নিয়ে আসবে। এতেও ঘাবড়ালে চলবে না। তর্ক চালিয়ে যেতে হবে। এতে দু ধরনের এফেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা। এক, ওরা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মাথা ঠান্ডা করাবে। দুই, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। দ্বিতীয়টাই ঘটবে। বোঝানো অনেক কঠিন কাজ। ঘাড়ধাক্কা অনেক সহজ ব্যাপার।

শ্রবণ এই সবের মধ্যে যাবে না। সে ঝামেলার মধ্যে নেই। সে ঠিক করল, রোজ যে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে, সেটাই নেবে। সেখানে ল্যাপটপের পাশে কটা জামাকাপড় অনায়াসে ঢুকিয়ে নেওয়া যাবে। আর কী লাগবে? একটা ল্যাপটপ এবং কটা জামাকাপড় জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পকেটে পয়সা থাকলে বাকি সব বাইরে পাওয়া যায়। সবথেকে বড় কথা, রোজকার ব্যাগ সঙ্গে নিলে বাড়ির কেউ সন্দেহ করবে না।

পঁচিশ বছরের শ্রবণ বাড়ি থেকে কেন পালাচ্ছে? বাবা-মা, বড়দা, বউদির সংসারে তার সমস্যা কী?

কোনও সমস্যা নেই। এমন নয় যে, সে কারও ঘাড়ে বসে খায়। নামকরা এক বিজ্ঞাপন সংস্থার কলকাতা শাখায় কাজ করে। তার কাজ কনসেপ্ট ডেস্কে। এই ডেস্কে বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি হয়। পত্রপত্রিকায়, টিভিতে, সিনেমা হলে, হোর্ডিংয়ে যেসব বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তার প্রথম কাজ কনসেপ্ট ডেস্কেই তৈরি হয়। ছবি আঁকা, ফটো তোলা, কপি লেখা হয়। সেই ভাবনা দেখে বিজ্ঞাপন চূড়ান্ত হয়। শ্রবণ কপি লেখে। কখনও কখনও বিজ্ঞাপন কেমন হবে, সে পরিকল্পনাও দেয়। তবে তার চাকরি পাকা নয়। ফ্রিলান্স। আজকের দিনে বেশিরভাগ চাকরিই পাকা হয় না। টাকাপয়সা যদিও খারাপ পায় না শ্রবণ। ভালোই পায়। এদিক-সেদিক আরও কিছু কাজ করে। মাস গেলে বাড়িতে টাকাও দিতে চেয়েছিল সে। বাবা, দাদা, বউদি কেউই রাজি হয়নি। উলটে ধমক-ধামক দিয়েছে এবং ঠাট্টা করেছে। আসলে তারা শ্রবণকে এখনও সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে ধরে না। তার বুদ্ধি সম্পর্কেও ধারণা ভালো নয়। তার কাজকর্মকে এ বাড়ির কেউ মোটে গুরুত্ব দেয় না।

‘বাবা, এ মাস থেকে আমি কিছু কিছু টাকা দিতে চাই।’

শ্রবণের বাবা দীপ্ততোষবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘কাকে টাকা দিতে চাও?’

শ্রবণ বলল, ‘বাড়িতে।’

দীপ্ততোষবাবু আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন? বাড়িটা কি ব্যাঙ্ক, যে এখানে তুমি মাসে মাসে টাকা জমা করবে?’

শ্রবণ বলে, ‘তা কেন? আমি খাওয়াদাওয়ার খরচ দিতে পারি না?’

দীপ্ততোষবাবু একটু চুপ করে থেকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘অবশ্যই পারো। হোটেলে পারো। তোমার কি ধারণা বাড়িটা হোটেল? তুমি সুটকেস নিয়ে সেখানে এসে উঠেছ?’

শ্রবণ বলল, ‘হোটেল কেন হবে? বাড়িতে কি টাকাপয়সা দিতে নেই? সংসারে খরচ শেয়ার করা যায় না? তুমি দাও, দাদা দেয়। এবার থেকে আমিও দেব। আমিও তো এ বাড়ির একজন মেম্বার। খাইদাই, জল, ইলেকট্রিক খরচ করি।’

দীপ্ততোষবাবু বললেন, ‘ও এই কথা। বেশ ভালো। সংসারের খরচ যদি তুমিও খানিকটা দিতে চাও দেবে। চাকরিবাকরি করে উপার্জন করো, তখন দেখা যাবে। এখন বিরক্ত করছ কেন?’

শ্রবণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি তো এখনই উপার্জন করি বাবা।’

দীপ্ততোষবাবু ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলেন, ‘উপার্জন করো? কীভাবে করো?’

‘বা:, তুমি জানো না? আমি যে…আমি যে বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকি, কনসেস্ট বানাই, কপি লিখি…তারপর ধরো…কিছু কিছু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করি…ভালোই তো টাকাপয়সা পাই।’

দীপ্ততোষবাবু হাত তুলে বললেন, ‘চুপ করো। এসব যে কোনও চাকরি নয় এবং এগুলো যে কোনও উপার্জন নয় তুমি ভালো করেই জানো শ্রবণ।’

শ্রবণ অবাক হয়ে বলে, ‘তাহলে এগুলো কী!’

‘এগুলো…এগুলো মূলত ইয়ার্কি।’

শ্রবণ এই কথায় আকাশ থেকে পড়ে।

‘বাবা, এ তুমি কী বলছ। তুমি জানো আজকাল কত ছেলেমেয়ে এই ধরনের কাজ করে? এইসব কাজই তো এখন ইনথিঙ্ক। ইনোভেটিভ কাজ সব। এখন কি আর আদ্যিকালের মতো দশটা-পাঁচটার অফিস বলে কিছু আছে? বগলে ছাতা আর টিফিন বাক্স নিয়ে ছুটতে হবে? এখনকার জেনারেশন ধ্যাড়ধ্যাড়ে চাকরি খোঁজে না, নিজের পছন্দমতো কাজ খোঁজে। যাদের একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, কল্পনাশক্তি আছে, ছবি আঁকতে পারে, ফিল্ম তুলতে পারে, গাইতে পারে, কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, তারা কোথাও বাঁধাধরা কাজ করে না। আর তুমি বলছ এগুলো কাজ নয়, ইয়ার্কি!’

দীপ্ততোষবাবু ঠান্ডা অথচ কঠিন গলায় বলেন, ‘তোমার লেকচার শেষ হয়েছে শ্রবণ?’

শ্রবণ ফোঁস ফোঁস করে বলে, ‘হয়েছে।’

‘তাহলে মন দিয়ে যা বলছি শোনো। আবার বলছি, এসব কোনও কাজ নয়, এসব হল ইয়ার্কি। ইয়ার্কি করে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করা যেতে পারে কিন্তু তাকে উপার্জন বলা হয় না। তাকে বলা হয় কুড়িয়ে-বাড়িয়ে চলা। আমার সংসারে এখনও কুড়িয়ে-বাড়িয়ে চলা টাকার প্রয়োজন নেই। যখন প্রয়োজন হবে, অবশ্যই বলব। তুমি তখন দিও। এখন বরং মন দিয়ে ভদ্রলোকের মতো কোনও চাকরি-বাকরির চেষ্টা করো। তোমার দাদার মতো ব্যাঙ্কের অফিসার হতে তুমি পারবে না, সে যোগ্যতা তোমার নেই, অন্তত সরকারি অফিসে কেরানি হওয়ার চেষ্টা করো। তখন মাস গেলে উপার্জনের টাকা নিয়ে আসবে। আমি অবশ্যই নেব।’

অপমানিত শ্রবণ এর পর তার দাদা-বউদির কাছে যায়। দাদা বলে, ‘এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল শ্রবণ। কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য কোনও একটা কোচিং-ফোচিংয়ে ঢুকে যা। ক’মাস পরেই রেলে আর পোস্টাপিসে লোক নেবে শুনছি। ভালো করে পরীক্ষাটা দে।’

বউদি হাসতে হাসতে বলে, ‘ও রেলে কী কাজ করবে? রেল চালাবে?’

দাদা বলে, ‘দরকার হলে তাই চালাবে? ক্রিম দিয়ে দাঁত মেজে ফর্সা হোন লেখার থেকে তো বেটার।’

বউদি চোখ বড় বড় করে বলে, ‘হ্যাঁগো শ্রবণ, সত্যি সত্যি তোমাদের ওই ক্রিম দিয়ে দাঁত মাজলে ফর্সা হওয়া যায়?’

শ্রবণ রাগ দেখিয়ে বলে, ‘আমি জানি না বউদি। আমি ওই ক্রিমের বিজ্ঞাপনের কপি তো লিখিনি। যে লিখেছে সে বলতে পারবে। দাদা, তাহলে সংসারে আমার টাকার শেয়ার তোরা নিবি না?’

দাদা বলে, ‘কে বলেছে নেব না? অবশ্যই নেব। বড় হও, মানুষ হও, তবে নেব। এত হড়বড় করছিস কেন? টাকা দিস না বলে কি তোর কোনও সমস্যা হচ্ছে; খাওয়াদাওয়া কম দেওয়া হচ্ছে?’

মানুষ হও। পঁচিশ বছর শেষ হতে চলল, এখনও কি সে মানুষ হতে পারেনি! এরা তাকে মানুষ বলেই মনে করে না! তবে সে কী? এলেবেলে? এদের সঙ্গে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শ্রবণ চুপ করে গেছে।

তারপরেও শ্রবণ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে কেন?

পালাচ্ছে বাধ্য হয়ে। বারিধারা তাকে বলেছে। বলেছে, ভালোবাসার জন্য পৃথিবীতে মেয়েরাই শুধু বাড়ি থেকে পালায়। পালিয়ে বিয়ে করে। তা কেন হবে? ছেলেদেরও পালাতে হবে। এই কথায় শ্রবণ ঘাবড়ে যায়। বলে, ‘আমাদের তো এখন বিয়ের কোনও ব্যাপার নেই বারি! খামোকা পালাতে যাব কেন?’

বারিধারা গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছে, ‘টেস্ট করে দেখছি। এরকম সিচ্যুয়েশন হলে কী হবে, সেটা আগে থেকে দেখে রাখতে চাইছি। দেখছি, তুমি কি তখন পারবে?’

শ্রবণ বলে, ‘পারবার প্রশ্ন উঠছে কেন? তোমার মতো চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করলে আমার বাড়ি থেকে আপত্তি করবে কেন?’

বারিধারা সহজভাবে বলে, ‘আমার বাড়ি থেকে করবে। তোমার মতো বোকা ও বেকার ছেলের সঙ্গে আমার বাবা কিছুতেই বিয়ে দেবে না। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর। পালানো ছাড়া আমার কোনও উপায় থাকবে না।’

শ্রবণ জোর করে হেসে বলে, ‘যখন হবে তখন দেখা যাবে ধারা। এখন চাপ নিও না।’

বারিধারা মিটিমিটি হেসে বলে, ‘কী দেখা যাবে? তখন আমি বাড়ি থেকে পালাব, তাই তো? যেমন সব মেয়েরা করে? সেটি হচ্ছে না চাঁদু, আগে তোমাকে পালিয়ে দেখাতে হবে। এবং সেটা এখনই দেখাতে হবে। আমি জানতে চাই ভালোবাসার জন্য ছেলেরাও বাড়ি থেকে পালাতে পারে কিনা। যদি দেখাতে পারো ভালো, নইলে গুডবাই।’

শ্রবণ এই মেয়েকে হাড়ে হাড়ে চেনে। এ হল ইয়েস-নো মেয়ে। একবার ইয়েস তো ইয়েস, একবার নো তো নো। নড়চড় নেই। বলতে লজ্জা করে, কিন্তু ঘটনা সত্যি যে, সেই এই মেয়েটিকে খুবই ভয় পায়। সকালে হুমকি দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।

তাই কোনওরকম কারণ ছাড়াই শ্রবণ আজ বাড়ি থেকে পালাচ্ছে।

নয়

হাম্বা…হাম্বা…

বারিধারার মোবাইলে মেসেজ ঢুকল।

মেসেজ পাঠিয়েছে শ্রবণ। বারিধারা শ্রবণের মেসেজ অ্যালার্ট টোনে গরুর ডাক লাগিয়ে রেখেছে। রোগাভোগা গরুর ডাক নয়, যাকে বলে ‘হৃষ্টপুষ্ট গাভি’র ডাক। গম্ভীর, বিজ্ঞ, খানিকটা দার্শনিক। বারিধারা এই কাজ লুকিয়ে করেনি, শ্রবণকে জানিয়েই করেছে। শ্রবণ কিন্তু কিন্তু করেছিল।

‘আমার মেসেজ টোনে গরুর ডাক! এটা কি ঠিক হবে বারি?’

বারিধারা দেখতে সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। তার না-রোগা না-মোটা চেহারায় এক ধরনের স্মার্ট, ডোন্ট কেয়ার ব্যাপার আছে। মেয়েরা হিংসে করে, ছেলেরা তাকিয়ে দেখে। মুখের গড়নে তীক্ষ্ণ ভাব। চোখ দুটো বড় এবং উজ্জ্বল। গায়ের রং কালোর দিকে। গায়ের রং কালোর দিকে হওয়ায় বারিধারা গর্বিত। সে মনে করে, যেসব মেয়ের গায়ের রং কালো বা কালোর দিকে, তাদের বুদ্ধি বেশি হয়। এই বিশ্বাসের পক্ষে তার কাছে কঠিন কোনও যুক্তি নেই। সে নাকি বিভিন্ন উদাহরণ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তার দিদি মেঘবতী অতি ফর্সা একজন মেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই বোনের এই উদ্ভট বিশ্বাসে তার বিরাট আপত্তি। স্কুলে পড়ার বয়সে ঝগড়া, মারপিটও হয়েছে। মেঘবতী বলত, ‘তুই একটা উদাহরণ দেখা তো বৃষ্টি, কোন ফর্সা মেয়ের বুদ্ধি কম?’

বারিধারা গম্ভীর মুখে বলেছে, ‘কেন! তোর।’

মেঘবতী প্রথমটায় হকচকিয়ে যায়। সামলে নিয়ে বলে, ‘আমি বোকা?’

বারিধারা বলে, ‘অবশ্যই বোকা।’

মেঘবতী চোখ পাকিয়ে বলে, ‘এবার পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি জানিস? অঙ্কে নাইনটি সিক্স। বোকারা অঙ্কে এত নম্বর পায়?’

বারিধারা বলল, ‘এই তো তোর বোকামির বড় উদাহরণ। অঙ্কের নম্বর দিয়ে বুদ্ধির বিচার করছিস। শেলি, কিটসের অঙ্কের নম্বর জানিস? খোদ আইনস্টাইন একবার অঙ্কে ফেল মেরেছিলেন জানা আছে তোর? সালভাদোর ঢালি ক্লাস এইটে অঙ্কে কত পেয়েছিলেন বলতে পারবি?’

মেঘবতী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সালভাদোর ঢালি? সে কে?’

বারিধারা ফিক করে হেসে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের মোনালিসা ঢালির ছোটমামা। কুস্তিগির।’

মেঘবতী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘রাখ তোর কুস্তিগির, আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল শিমলি ফর্সা টুকটুকে মেয়ে। গায়ে হাত দিলে মনে হয় খানিকটা সাদা রং আঙুলে উঠে আসবে। যেমন দেখতে, তেমন বুদ্ধি। জেনারেল নলেজে চ্যাম্পিয়ন। স্কুলের হয়ে যেখানে কুইজে যাবে প্রাইজ নিয়ে ফিরবে। ফর্সা শিমলি বোকা আর তুই কালো হয়ে বিরাট চালাক, না? তোর খালি উদ্ভট কথা।’

বারিধারা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘তোর বন্ধু বোকা কিনা বলতে পারব না, তবে জেনারেল নলেজ পারাকে যারা বুদ্ধি বলে তারা যে বোকা, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাহলে তো গুগলস সব থেকে বেশি বুদ্ধি। কী বোর্ড টিপে খটাখট প্রশ্ন করবি, স্ক্রিনে ফটাফট উত্তর পেয়ে যাবি। তা বলে কম্পিউটার কি মানুষের থেকেও বেশি বুদ্ধি ধরে? জিকে পারাটাই বুদ্ধির পরিচয়?’

মেঘবতী বলল, ‘অবশ্যই।’

বারিধারা বলল, ‘এই জন্য তোকে বোকা বলি দিদি। অঙ্কে নাইনটি সিক্স কাজে লাগছে না। কম্পিউটারের যা থাকে, তা হল ডেটা, ইনফর্মেশন, মেমারি। একে বুদ্ধি বলে না। যাদের বুদ্ধি নেই তারা ডেটা, মেমারি এসব নিয়ে বড়াই করে। মানুষের বুদ্ধি আর মেশিনের ডেটার মধ্যে অনেক পার্থক্য। বুদ্ধি মানে দশটা দেশের নাম জানা নয়, অঙ্কের কটা ফর্মুলা মুখস্থ থাকা নয়, বুদ্ধি সামথিং ডিফারেন্ট। ওসব তো কম্পিউটারেই পাওয়া যাবে। আগেকার দিনে স্মৃতিধরকে বিরাট পণ্ডিত বলা হত। যার স্মৃতি বেশি, সেই নাকি বুদ্ধিমান! বোঝো ঠেলা! এখন স্মৃতির কোনও প্রয়োজন নেই, দামও নেই। একশো উনিশের নামতা খামোকা মুখস্থ রাখব কেন? হাতের মোবাইল ফোনেই তো ক্যালকুলেটর পাওয়া যায়। ফালতু ডেটা মাথায় রেখে অহেতুক ব্রেনকে ভারাক্রান্ত করে বোকারা। একশো বছর আগে এসব ধারণা ছিল।’

মেঘবতী বলে, ‘তুই বেশি ফরফর করিস বৃষ্টি, বড্ড পাকা হয়েছিস। তাহলে বুদ্ধি কাকে বলে?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক জেনে মানুষ যখন সেটাকে কাজে লাগায়, সেটাকেই বুদ্ধি বলে। কম্পিউটার তোকে ডেটা দেবে দিদি, কিন্তু কাজে লাগাতে পারবে না। কাজ তোকেই করতে হবে। তার জন্য যে জিনিসটা লাগে, সেটাই বুদ্ধি।’

মেঘবতী ঠোঁট উলটে বলে, ‘কী কাজ? অঙ্কে ছিয়ানব্বই পাওয়াটা কাজ নয়? কুইজ কম্পিটিশনে ফার্স্ট হওয়াটা ফালতু?’

‘ফালতু বলিনি, তবে বিরাট কোনও কাজ নয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ হচ্ছে। রোজই কেউ না কেউ নম্বর পাচ্ছে, কুইজে প্রাইজ পাচ্ছে। তাতে কী হবে? আসলে নিজের জানাটাকে আর পাঁচজনের জন্য ব্যবহার করা গেলে তবেই সেটা কাজ। সেটা বিজ্ঞানের কোনও ইনভেনশান হতে পারে, ছবি আঁকা হতে পারে, স্টুডেন্টদের ভালো করে পড়ানোও হতে পারে। দেশের জন্য, সোসাইটির জন্য কিছু করাটা সবথেকে বড় কাজ। যাঁরা করেন, তাঁরা কতটা স্মৃতিধর আর অঙ্কে কত নম্বর পেয়েছিলেন কেউ ভাবে না। গান গেয়ে, বাজনা বাজিয়ে, অভিনয় করে, কবিতা লিখে মানুষকে আনন্দ দেওয়াটা বা জীবনের কথা, সমাজের কথা বলাটা খুব কঠিন কাজ। এরা নিজের অনুভূতি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই কাজ যাঁরা ঠিকমতো পারেন, সবাই তাঁদের মাথায় তুলে রাখে। যুগে যুগে এটা হচ্ছে। এর জন্য ইচ্ছে লাগে, মনের জোর লাগে, কল্পনা লাগে, সাহস লাগে। আমাদের মায়ের মতো যেসব মহিলা চাকরিবাকরি বা অন্য কিছু করে না, কিন্তু সংসার সামলানোর মতো সব থেকে জটিল আর কঠিন কাজটা সামলায়, তাদের জানবি সব থেকে বেশি বুদ্ধি। সবার প্রয়োজন দেখতে হয়। মান অভিমান বুঝতে হয়। ভাব তো যে বাড়িতে টাকা-পয়সার টানাটানি, সে বাড়ির গৃহিণীকে কত অঙ্ক জানতে হয়! এই খরচ কমিয়ে, ওই খরচ সামলে, এটা এবার বাদ রেখে, ওটা সেবার দিয়ে…পারমুটেশন কম্বিনেশন করতেই থাকে। নইলে তো সংসারই চলত না। এদের তুই অঙ্কে কত দিবি? একশোয় তো দুশো দেওয়া উচিত। কেউ দেয় না। তাদের বুদ্ধির কোনও হিসেবও হয় না। এই যে বাবার মতো মানুষের সঙ্গে মা এতদিন টিকে আছে, তার জন্যও তো বিরাট বুদ্ধি লাগে। আমি হলে কবে ডিভোর্স নিতাম। আসলে সব মিলিয়ে বুদ্ধির বিচার হয়। স্কুল কলেজের পরীক্ষার নম্বর দিয়ে বড় চাকরি হতে পারে, আর কিছু হয় না। চাকরি চলে যাওয়ার পর তাদের কেউ পাত্তাও দেয় না।’

মেঘবতী বলল, ‘ইচ্ছে করে তুই বিষয়টা গুলিয়ে দিচ্ছিস বৃষ্টি। বড় চাকরি মানে বড় কাজ নয়? এই যে একজন ইঞ্জিনিয়ার নদীতে ব্রিজ বানান, এটা বড় কাজ নয়?’

বারিধারা বলল, ‘অবশ্যই বড় কাজ। খুব ইমপর্টান্ট। তবে জানবি সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি অঙ্কে একশোতে একশো পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ব্রিজ বানাচ্ছেন, তিনি খুব জরুরি কাজ করছেন। ব্রিজ না থাকলে মানুষ নদীটাই পেরোতে পারত না। নদীর ধারে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হত কখন নৌকা আসবে আর গান গাইতে হত, নদী আপন বেগে পাগলপারা…। আবার যিনি জীবনে এক ফোঁটা পড়াশোনা না করে রোজ সকালে এসে আমাদের বাড়ির ময়লা নিয়ে যান, তিনিও জরুরি কাজ করেন। তিন দিন ময়লা না নিয়ে গেলে অবস্থা হাঁড়ির হাল হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে নদীর ব্রিজে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হবে আর অঙ্ক চিবিয়ে খেতে হবে।’

মেঘবতী বলল, ‘উইক লজিক। তবু তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম। কিন্তু এসবের সঙ্গে গায়ের রঙের কী সম্পর্ক?’

বারিধারা বলে, ‘অবশ্যই আছে। যেমন ধর, আমি বুদ্ধি বিষয়টা কেমন সুন্দর বুঝি, আর তুই তোর ক্লাসের শিমলিকে বিরাট বুদ্ধিমতী ধরে বসে আছিস। তার কারণ তুই বোকা… আমার ধারণা, ফর্সা না হলে এতটা বোকা হতে পারতিস না।’

হেসে ওঠে বারিধারা। মেঘবতী বারিধারার প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়ে। চড়, কিল মারতে থাকে। আদরের মার।

বারিধারা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, ‘এই দেখ তুই কত বড় বোকা! বোকা না হলে কেউ গায়ের রং নিয়ে রাগারাগি করে? আহা, ফর্সা বলে তোর তো কোনও দোষ নেই। তুই কেন রাগ করবি? গায়ের রং কি কারও হাতে থাকে রে দিদি? এ হল জিনঘটিত ব্যাপার। জিন যদি না বুঝিস, তাহলে জানবি, ভগবানের হাত। ফর্সা হয়ে জন্মেছিস যখন মেনে নিতে হবে, তাই নিয়ে মাথা কুটে লাভ কী?’

কথা শেষ করে বারিধারা আরও জোরে হেসে উঠত। মেয়েদের ফর্সা হওয়াটা যে দু:খের ঘটনা, এই অভিনব তত্ব পেশ করতে পেরে সে খুবই আহ্লাদিত। মেঘবতী বলত, ‘তোকে আজ মেরেই ফেলব।’

মেঘবতী বোনের ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। বারিধারা চিৎকার করে ওঠে, ‘ওরে বাবা মরে গেলাম রে…।’

এই ঝগড়া দুই বোন অনেকদিন পর্যন্ত চালিয়েছে। কোনও মীমাংসা হয়নি। তবে এটা সত্যি যে বারিধারার সৌন্দর্যে এক ধরনের বুদ্ধির ছাপ আছে। সেটা তার গায়ের রং কালোর দিকে বলে না উজ্জ্বল চোখের জন্য, নাকি লেখাপড়া, আচরণ সবটা মিলিয়ে কে জানে! এসব সঠিকভাবে বলবার মতো কোনও অঙ্কের ফর্মুলা নেই, জেনারেল নলেজও নেই। প্রেমিকার বুদ্ধির এই ছাপকে শ্রবণ অবশ্য ‘রাগ’ ভাব বলে মনে করে। তার ধারণা, বারিধারা তার ওপর বেশিরভাগ সময়েই রেগে থাকে। যে-কোনও সময় বকাবকি শুরু করে দেবে। প্রেমিকার বকাবকিতে তার কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা হল, কেন রাগ, সেটাই বেশিরভাগ সময় বোঝা যায় না। সে কি বোকা প্রেমিক? নার্ভাস? নাকি গদগদ টাইপ? মনে হয় শেষেরটাই হবে। এই যুগে একজন স্মার্ট, বুদ্ধিমান ছেলের গদগদ টাইপ প্রেমিক হওয়া খুবই দু:খের ঘটনা। একথা শ্রবণ জানে না এমন নয়, জানে, তবু নিজেকে বদলাতে পারে না। বারিধারাকে দেখলে বা কথা বললে তার যেমন নার্ভাস লাগে, তেমন প্রেমও উথলে ওঠে। মোবাইল মেসেজে হাম্বা রবের ঘটনাটাই ধরা যাক না কেন। এই ব্যাপারে তার আপত্তি হওয়া উচিত ছিল জোরালো। কিন্তু পারেনি। মৃদু আপত্তিতেই বারিধারা ধমক দিয়েছিল।

‘কেন? ঠিক হবে না কেন?’

শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘না, কোনও কারণ নেই, তবে একেবারে গরু?’

বারিধারা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘গরুর ডাক খারাপ নাকি? তুমি জানো এই ডাক আমি কত কষ্ট করে খুঁজে বের করেছি? ইউ টিউব ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাঘ, সিংহ সব পাই, গরু পাই না। শেষে অনেক কষ্টে পেয়েছি। তাছাড়া এটা তো এদেশের গরুর ডাক নয়, অস্ট্রেলিয়ার গরুর ডাক।’

শ্রবণ মাথা চুলকে বলে, ‘অস্ট্রেলিয়ান হোক আর জাপানি হোক, ধারা, গরু তো গরুই…।’

বারিধারা খেপে যায়। বলে, ‘তাহলে কি তোমার মেসেজে পাখির ডাক লাগাব? কোকিলের মতো কু কু করে ডাকবে? আর সত্যি কথা বলতে কী, তোমার মেসেজগুলোর সঙ্গে গরুর ডাক মানানসই বলে আমার মনে হয়।’

শ্রবণ হতাশ গলায় বলে, ‘কেন?’

বারিধারা মুচকি হেসে বলল, ‘সে বলা যাবে না।’

গাড়ির মধ্যে বারিধারা মোবাইল তুলে মেসেজ পড়ল। শ্রবণ লিখেছে—

‘তোমার কথা শুনে বাড়ি থেকে পালালাম।’

বারিধারা হেসে ফেলল। এই কারণে ছেলেটাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তার কথা শোনে বলে নয়, ছেলেমানুষির জন্য। পাগল একটা। শ্রবণের নম্বর টিপতে গেল বারিধারা। মেসেজের টোনে গরুর হাম্বা ডাক রাখলেও, ফোনের লিস্টে শ্রবণকে সে রেখেছে ‘চিরসখা’ নামে। এটা কেউ জানে না। শ্রবণও না। এই নাম তার গোপন। রবি ঠাকুরের চিরসখা… গানটা তার মা বড় চমৎকার গায়। মায়ের গানের কোনও চর্চা নেই। কোনও দিন গুছিয়ে গান গাইতে বসেছে বলে মনে পড়ে না। যখন ইচ্ছে হয়, ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে গান করে। কখনও রান্না করতে করতে, কখনও ঘর গোছাতে গোছাতে। দুই বোন চাপাচাপি করলেও লাভ হয় না। শুধু কমলকান্তি সেন ব্যতিক্রম। বুড়োমানুষটা বললে ‘না’ করতে পারে না। তবে তিনি বলেনও ন’মাসে, ছ’মাসে একবার। মায়ের গলায় বারিধারা এই গান প্রথম শোনে। শুনেছিল ঠাকুরদার ঘরে। মা মোড়ায় বসে খালি গলায় গাইছিল। কমলকান্তি তাঁর ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুনছিলেন। বারিধারার মনে হয়েছিল, কত স্বচ্ছন্দে মা গাইছে! যেন বাইরে কোথাও নয়, এই গান তৈরি হয়েছে মায়ের ভিতরে। শান্ত নির্জন দিঘিতে যেমন আপনমনে ঢেউ তৈরি হয়, কেন হল, কীভাবে হল তাতে কিছু যায় আসে না, যেমন অল্প বাতাস কাউকে না বলে গাছের পাতা আলতো ছুঁয়ে দেয়, কেন ছুঁল কাউকে বলে না, অনেকটা সেরকম! বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। মা গাইল—

”চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।

সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো।।

অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।

জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধসাগর।।”

কমলকান্তি সেনকে সেদিন কাঁদতে দেখেছিল বারিধারা। গান শেষ হলে তিনি চোখ খুলে এবং জল না মুছে এক গাল হেসে মাকে বললেন, ‘তোমার গান শুনে খুব আনন্দ পেলাম মণিকুন্তলা। দু:খে চোখের জল ফেলা বড় কথা নয়, আনন্দে চোখে জল আনা খুব কঠিন কাজ। তুমি সেই কঠিন কাজ পেরেছ।’

মা মুখ নামিয়ে বলেছিল, আমি পারিনি বাবা, রবি ঠাকুর পেরেছেন। সেদিনই বারিধারা তার মোবাইল ফোনে শ্রবণের নাম মুছে লেখে ‘চিরসখা’।

বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ‘চিরসখা’কে ফোন করতে গিয়ে বারিধারা থমকে গেল। গাড়ির চালক নন্দকাকা যথারীতি দিদির বাড়ির রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে। গাড়ি ঢুকেছে বালিগঞ্জের ভুল গলিতে। চক্কর খাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *