একটু পরে রোদ উঠবে – ২৫

পঁত্রিশ

বারিধারার দিকে তাকিয়ে কমলকান্তি সেন মুচকি মুচকি হাসছেন।

হাসবারই কথা। খানিক আগে তিনি নাতনিকে মারাত্মক একটা প্ল্যান বাতলেছেন। এমন প্ল্যান যে বারিধারার মতো সাহসী মেয়েও চমকে গেছে। তার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। চোখ হয়ে গেছে বড় বড়। কমলকান্তির মনে হল, অবাক হওয়ার কারণে তার ছোট নাতনিকে বেশি সুন্দর লাগছে।

নাতনিদের সৌন্দর্যের ব্যাপারে কমলকান্তি চিরকালই বাড়াবাড়ি ধরনের দুর্বল। তার বিশ্বাস, তাঁর দুই নাতনি পৃথিবীর এক নম্বর এবং দু’নম্বর সুন্দরী। কে ‘এক’ আর কে ‘দুই’ চট করে বলা যাবে না। একেক সময় একেক জন। এই জিনিস তিনি আজ হঠাৎ করে মনে করছেন না। নাতনিদের জন্মের পর থেকেই মনে করছেন। মেঘবতী হওয়ার পর নার্সিংহোমে নাতনিকে দেখে বাড়ি ফিরে ঘোষণা করেছিলেন, ‘দুনিয়ার সবথেকে সুন্দরী মেয়ে সেনবাড়িতে জন্ম নিল। রূপে এই মেয়েকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এরপর যখন বারিধারা হল, তখন বললেন, ‘এতদিনে আমার বড় নাতনিকে টক্কর দেওয়ার মতো একজন সুন্দরীকে পেলাম। ব্যাপারটা ওয়ান সাইডেড হয়ে যাচ্ছিল। একতরফা কোনও কিছুই ঠিক নয়। এখন কে বেশি সুন্দর তাই নিয়ে দুই বোনে লড়াই হবে মনে হচ্ছে।’

স্বাভাবিকভাবেই এই কথায় সবাই হাসাহাসি করত। বলত, নাতনিদের নিয়ে দাদুর বাড়াবাড়ি। মেঘবতী, বারিধারাও মজা পেত। ছোটবেলায় তারা দাদুর কাছে এসে বলত, ‘আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দর দাদু?’

কমলকান্তি চোখ-নাক কুঁচকে চিন্তার ভাব করতেন। বলতেন, ‘একটু পরে বললে হবে? বিষয়টা জটিল। ভাবনাচিন্তার জন্য সময় লাগবে।’

মেঘবতী কাঁদো কাঁদোভাবে বলত, ‘না, এখনই বলতে হবে।’

বারিধারা ঠোঁট উলটে কান্না কান্না গলায় বলত, ‘দিদি আমার সঙ্গে ঝগড়া করছে। বলছে ও নাকি আমার থেকে বেশি সুন্দর। বড় হয়ে আমরা যখন বিউটি কনটেস্টে নাম দেব ও মিস ইউনিভার্স হবে।’

মেঘবতী তেড়েফুঁড়ে বলত, ‘অবশ্যই আমি বেশি সুন্দর। আমার গায়ের রং ফর্সা।

বারিধারা বলত, ‘আমার নাক টিকোলো, গালে টোল, চোখ টানা। সেটা কিছু নয়?’

কমলকান্তি হাত তুলে বলতেন, ‘দুজনেই সুন্দর।’

মেঘবতী গোঁ ধরে বলত, ‘তা বললে চলবে না দাদু। ঠিক করে বলতে হবে।’

কমলকান্তি হেসে বলতেন, ‘আমার চোখে তো দুজনেই সমান রূপসি। পৃথিবীর রূপসিরা ডানাকাটা পরি হয়, আমার দুই নাতনির অদৃশ্য ডানা আছে। তোমরা যদি চাও আমি রাংতা দিয়ে তোমাদের জন্য ডানাও বানিয়ে দিতে পারি।’

বারিধারা দাদুর গলা জড়িয়ে বলত, ‘এসব তোমার ফাঁকিবাজির কথা দাদু। তুমি আগে বলো, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দর।’

কমলকান্তি তখন দুই নাতনিকে আদর করে দুপাশে বসাতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘মানুষ কি গায়ের ফরসা রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ দিয়ে সুন্দর হয়? মোটেও নয়। ওসব তো বাইরের ব্যাপার। তোমরা যখন বড় হবে তখন দেখবে বাইরের রূপ রং-চং দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায়। আর ক’টা দিন বাদে আমি যখন ফোকলা হয়ে যাব, বাঁধানো দাঁত লাগিয়ে ঘুরে বেড়াব। সবাই বলবে, আরে বাবা! বুড়োমানুষটার কী সুন্দর দাঁত! কথাটা তো ঠিক নয়। ওটা তো নকল দাঁত। কেউ বুঝতে পারে না, ঠকে যায়। ভুল বিচার করে। আসলে মানুষ সুন্দর হয় ভিতর থেকে। যে মানুষের ভিতরটা যত ভালো, সে তত সুন্দর। এই সৌন্দর্য রং-চং দিয়ে বানানো যায় না। মনের ভিতর থেকে আলো জ্বালাতে হয়। আমি যে আমার দুই নাতদিকে সুন্দর বলি সে কি তাদের গায়ের রং বিচার করে বলি? একেবারেই নয়। আমি দেখতে পাই আমার দুই নাতনির মনের ভিতরটা আলো ঝলমল করছে। ভালো হওয়ার আলো। আর সেই কারণেই তারা সবথেকে সুন্দর। যত বড় হবে ভিতরের ভালোটাকে যত্ন করে ধরে রাখবে। দেখবে কোনওরকম রং-চং, মেকাপ ছাড়াই সুন্দর হয়ে গেছ। শুধু বিউটি কনটেস্ট নয়, পৃথিবীর সব কনটেস্টেই তখন জিতে যাবে। সবাই বলবে, এই মেয়ে দুটো সবথেকে সুন্দর। মনে রাখবে, মানুষ অতি অভাগা। সে ‘সুন্দর’ শব্দটার মানে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। যদি বুঝতে পারত, পৃথিবীটা মাঝে মাঝে এত খারাপ হত না।’

দুই বোন অবাক হয়ে দাদুর কথা শুনেছিল। বেশিটাই বুঝতে পারেনি। তবে ভালো লেগেছিল। বারিধারা বলেছিল, ‘দাদু, মনের ভিতরে আলো কী করে জ্বালাতে হয়?’

কমলকান্তি বললেন, ‘ওই যে বললাম, ভালো হয়ে। মানুষ হয়ে।’

মেঘবতী বলল, ‘ভালো মানে কি শান্ত মেয়ে? মা যে বলে, শান্ত মেয়েরা ভালো।’

কমলকান্তি দরজার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘মাকে যদি না বলিস তো তা হলে একটা কথা বলব।’

বারিধারা দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলো।’

কমলকান্তি বললেন, ‘সবসময় শান্ত হলে ভালো হওয়া যায় না। যেখানে অশান্তি দরকার সেখানে গোলমাল পাকাতে হবে। দুষ্টুমি করতে হবে।’

ভালো হতে গেলে অশান্ত হতে হয়, গোলমাল পাকাতে হয়, দুষ্টুমি করতে হয় এমন কথা দুই বোন সেই বয়সে শোনেনি। বরং সবসময়ে উলটোটাই জেনেছে। তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

মেঘবতী চোখ বড় করে বলল, ‘কীরকম গোলমাল দাদু?’

বারিধারা ফিসফিস করে বলে, ‘চিৎকার?’

কমলকান্তি গল্প বলবার ঢঙে বললেন, ‘অবশ্যই চিৎকার করতে হবে। সেরকম হলে দু-ঘা দিতেও হবে।’

মেঘবতী ছোটবেলা থেকেই শান্ত। সে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কাকে দু-ঘা দিতে হবে দাদু?’

কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘কাকে দিতে হবে নিজেরাই বুঝতে পারবে। যত বড় হবে বুঝতে পারবে, চারপাশে দু-ঘা দেওয়ার মতো অনেক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যায় দেখলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। হাত-পা চালাতেও হবে। অন্যায় দেখে মুখ বুজে থাকলে ভালো হওয়া হবে না। তখন আর তোমাদের কেউ সুন্দরও বলবে না। সে যতই ফরসা হও আর যতই চোখ টানা টানা হোক।’

বড় হওয়ার পর দুই বোন ‘সুন্দর’ হওয়ার কথা মনে রাখেনি, তবে দাদুর ‘দু-ঘা’-র কথা মনে রেখেছে। বাসে, ট্রামে, বাজারে কেউ অসভ্যতা করলে ‘দু-ঘা’ দিতে বিশেষ কুণ্ঠা বোধ করেনি। তবে একবার লজ্জায় পড়েছিল। অমনটা যে ঘটতে পারে ভাবতেও পারেনি।

মেঘবতীর তখনও বিয়ে হয়নি। এক বিকেলে এসপ্ল্যানেড যাচ্ছিল মেট্রোতে। ভিড় বিশেষ ছিল না। তাও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রসভ্য দেখতে বয়স্ক একজন বারবার ঘেঁষে আসে এবং নানা কায়দায় গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করে। মেঘবতী সরে গেলে লোকটাও সরে আসে। কয়েকবার কড়া চোখে তাকায় মেঘবতী। চাপা ধমকও দেয়।

‘ঠিক করে দাঁড়ান।’

ধমকের কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লোকটি মেঘবতীর ডানদিকের বুকে হাত দিয়ে বসে। হাত সরিয়ে নেওয়ার ফাঁকেই ঘুরে দাঁড়ায় মেঘবতী। তার মাথায় আগুন ধরে যায়। লোকটাকে খপ করে চেপে ধরে হাত মুচড়ে ধরে। টি শার্ট, জিনস পরা শান্ত মুখের সুন্দরী এরকম একটা কাজ করতে পারে লোকটার সম্ভবত ধারণা ছিল না। সে হকচকিয়ে যায়। তারপর যথারীতি কাঁউমাঁউ করে ওঠে।

‘ব্যাপারটা কী? আমার হাত ধরেছেন কেন?’

মেঘবতী দাঁত চেপে বলে, ‘ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছেন না?’

লোকটা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘হাত ছাড়ুন। ভালো হবে না বলছি।’

মেঘবতী দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হাত ছাড়া ছিল বলে আপনি এতক্ষণ কী করছিলেন?’

বয়স্ক হম্বিতম্বি করে বলল, ‘আপনি ভুল করছেন। ভিড় ট্রেনে উঠলে অমন হতেই পারে…আপনি হাত ছাড়ুন…আপনি মিথ্যে অভিযোগ করছেন…।’

মেঘবতী বলে, ‘আপনি ইনটেনশনালি বারবার আমার গায়ে হাত দিচ্ছিলেন। আমি আপনাকে সতর্ক করি, তারপরেও করেছেন।’ বলতে বলতে হাতটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে মেঘবতী। বলে, ‘বলুন দিচ্ছিলেন কি না। সবার সামনে স্বীকার করুন।’

ট্রেনের যাত্রীকুল ততক্ষণে মজা পেয়ে গেছে। তারা নানারকম মন্তব্য করতে শুরু করে। তড়পাতে থাকে।

‘কান ধরে ওঠবোস করান।’

‘পুলিশের হাতে দিন।’

‘পুলিশকে দিয়ে কী হবে? দশ টাকা পকেটে গুঁজে ছাড়া পেয়ে যাবে।’

‘বরং সবাই মিলে চাঁদা করে পেটানো উচিত।’

মেঘবতী পাত্তা দেয় না। এ সব সময়ে যারা বেশি হম্বিতম্বি করে তারা এই ধরনের কাজ বেশি করে। সে লোকটার হাত মুচড়ে বলে, ‘আগে স্বীকার করুন অন্যায় করেছেন, তারপর আপনার হাত ছাড়ব।’

বয়স্ক লোকটা খানিকটা বেঁকে দাঁড়িয়ে ‘আ’, ‘উ’ করতে থাকে।

‘খুব ভালো হয়েছে মেয়ে।’

‘ছাড়বেন না দিদি।’

‘আরও জোরে মোচড় দাও বোনটি।’

‘এ সব লোকের হাত ভেঙে দেওয়া উচিত ম্যাডাম।’

অন্যদের মন্তব্য তখন মেঘবতীর কানে ঢুকছে না। রাগে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। তার জেদ চেপে গেছে। এত বড় সাহস! লোকটাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করিয়ে তবে ছাড়বে। এর মাঝেমাঝেই ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ায়। কামরার দরজা খুলে যায়। কয়েকজন নামলে, উঠেও আসে বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে একদল কমবয়সি ছেলেমেয়ে রয়েছে। ট্রেন ছাড়লে তারা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। একটি শাড়ি পরা মেয়ে সিট খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসে। মেয়েটির বয়স মেঘবতীর কাছাকাছি। হঠাৎই তার চোখ পড়ে মেঘবতীদের দিকে। দৃশ্যটা দেখে থমকে দাঁড়ায়। সামনের সিট থেকে একজন চাপা গলায় হেসে ওঠে।

‘বেটা মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার সাজা পাচ্ছে। সত্যি কথা না বলা পর্যন্ত সাজা চলবে।’ মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে লোকটির দিকে তাকায়। বয়স্ক লোক মুখ নামায়। মেয়েটির কাঁধে একটা হালকা নীল রঙের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ছিল। সে ব্যাগটা চেপে ধরে। মেঘবতীর উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলে, ‘কী হয়েছে?’

মেঘবতী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কী আর হবে, এই ধরনের নোংরা লোক বাসে-ট্রামে-ট্রেনে যা করে। ভদ্র পোশাকে থাকে, সুযোগ পেলে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। তারপর ছুঁচোর মতো অস্বীকার করে। তবে এই লোক যতক্ষণ না সবার সামনে অপরাধ স্বীকার করছে ততক্ষণ ছাড়ব না।’

মেয়েটি মাথা নামিয়ে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর মুখ তুলে বলল, ‘দিদি, এই ভদ্রলোক আমার বাবা। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে অপরাধ স্বীকার করতে বলছি।’

মেয়েটি বয়স্ক লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, তুমি অপরাধ স্বীকার করো।’

এবার মেঘবতীর কেঁপে ওঠবার পালা ছিল। এমন একটা বিশ্রী ঘটনা যে এরকম নাটকীয় মোড় নেবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। গল্প-উপন্যাসেও এরকম শোনা যায়নি। তার বয়সি এই ফুটফুটে মেয়েটি এই নোংরা লোকের মেয়ে! মেঘবতী দ্রুত লোকটির হাত ছেড়ে দেয়। বিব্রত ভঙ্গিতে বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে…আমি ঠিক বুঝতে পারিনি….ঠিক আছে আপনি যান…।’

মেয়েটি কঠিন গলায় বলে, ‘কিছুই ঠিক হয়নি। বাবা, তুমি অপরাধ স্বীকার করো। ওর সামনে বলো, তুমি কী বিশ্রী কাজ করেছ। বলো তুমি।’

কাছে থাকা যেসব যাত্রী ঘটনা পুরো দেখেছে তারা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। মেঘবতী অস্বস্তিতে পড়ে। সে আবার বলে, ‘ঠিক আছে বললাম তো। কিছু বলতে হবে না। যান স্টেশন এসে গেছে, নেমে যান।’

মেয়েটির শান্ত মুখে যেন আগুন লেগেছে। রাগে-অপমানে-দু:খে লাল হয়ে সে এগিয়ে গিয়ে লোকটির হাত ধরে। চাপা গলায় বলে, ‘বাবা, আগে তুমি সবার সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করো। তারপর গাড়ি থেকে নামবে।’ বলতে বলতে মেয়েটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।

ঘটনাটা মেঘবতী অনেকদিন পর্যন্ত মনে রেখেছিল।

আজকের ঘটনা বারিধারা মনে রাখবে। খানিকক্ষণ ‘হাঁ’ অবস্থায় থাকবার পর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু দাদু…।’

কমলকান্তি ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে হাত তুললেন।

‘আর কিন্তু নয় বৃষ্টি। এবার তোমার ব্যাপার। তোমার এই মধুজা ম্যাডাম, তার বন্ধু মানিনী আর ওই বদ ছেলেটা, কী যেন নাম বললে ছোকরার? দর্শন না সুদর্শন কী যেন? যে নামই হোক, এদের শায়েস্তা করবার জন্য তোমাকে প্ল্যান দিলাম। সেই প্ল্যান তুমি কাজে লাগাতে পারবে কি না সেটা তোমার ব্যাপার।’

বারিধারা বলল, ‘সে তো বুঝলাম দাদু, কিন্তু…।’

কমলকান্তি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘আবার কিন্তু?’

বারিধারা হেসে ফেলল। বারিধারার সবথেকে বড় গুণ হল, টেনশনের মধ্যেও সুন্দর করে হাসতে পারে।

‘আচ্ছা, আর কিন্তু নয়। তবে এমন মারাত্মক একটা প্ল্যান দেওয়ার জন্য তোমাকে কি আমি একটা হামি খেতে পারি?’

কমলকান্তি ফের ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, ‘না পারো না। কারণ তুমি এতক্ষণ নিজের কথা বললে, কিন্তু আমার ইম্পর্ট্যান্ট কথাটা শোনোনি।’

বারিধারা ঝুঁকে পড়ে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরল। হেসে বলল, ‘কী কথা?’

ছাব্বিশ

কমলকান্তি সেন নাতনির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী হল দাদু, হাসছ কেন?’

কমলকান্তি বললেন, ‘তোকে এমন একটা কথা বলব, তুই খুব খুশি হবি।’

বারিধারা বলল, ‘ইউনিভার্সিটির ব্যাপার নিয়ে যা বললে তাতেই আমি খুশি। তোমার প্ল্যানটা কাজে লাগাতে পারলে ভালো হবে। সবাই জব্দ হবে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘এটা তার থেকে অনেক ভালো। ওটা তো শাস্তি, আর এটা হল পজিটিভ একটা বিষয়।’

বারিধারা চোখ বড় করে বলল, ‘তাই নাকি! শুনি কী কথা!’

কমলকান্তি একটু চুপ করে রইলেন। গলা নামিয়ে বললেন, ‘বৃষ্টি, আমরা যদি একটা স্কুল তৈরি করি কেমন হয়?’

বারিধারা খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। একানব্বই বছরের একজন মানুষের মুখে এ কী কথা! স্কুল তৈরি করবে! বৃদ্ধ এই মানুষটির তো এখন শান্ত হয়ে অপেক্ষা করার সময়। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। তিনি বলছেন, নতুন কিছু করবেন! স্কুল গড়বেন! বারিধারা ঢোঁক গিলে বলল, ‘আমরা করব? আমরা কারা দাদু?’

কমলকান্তি জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, ‘কেন? আমরা সবাই। এই আমি, তুই, মেঘ, জ্যোতিষ্ক, তোর মা, অর্চিন, আমাদের পরিচিত, বন্ধুবান্ধব সবাই তো আছে, আমরা কি কম লোক হলাম?’

বারিধারা ঘাবড়ে গেল। মানুষটার হঠাৎ হল কী! বয়স হয়েছে বলে দাদু ঝিমিয়ে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু ‘কিছু করা’ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে বহুদিন। এখন তার জীবনযাপন হল, খাব, ঘুমোব, নাতনিদের সঙ্গে গল্প করব আর বই পড়ব। ব্যস, এর বেশি নয়। এমনকী অফিসের কোনও কাজেও নাক গলায় না। বাবা বললেও নয়। তবে কি এখন চুপচাপ বসে এটাই চিন্তা করতেন?

বারিধারা নিজেকে সামলে বলল, ‘স্কুল করবে? সে তো অনেক হ্যাপা।’

কমলকান্তি সেন উৎসাহ নিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, স্কুল। সেখানে গ্রামের মেয়েরা পড়বে।’

বারিধারা বলল, ‘গ্রামে তো স্কুল আছে দাদু। আজকাল প্রায় সব গ্রামেই স্কুল হয়ে গেছে। সেখানে মেয়েরা পড়ে। আজকাল গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা কত ভালো রেজাল্ট করছে জানো? খবরের কাগজে বেরোয়। দরিদ্র ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় খুব সাইন করছে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘আমি জানি। তবে এটাও জানি, যত ছেলেমেয়ে পড়ছে তার থেকে বেশি ছেলেমেয়েরা পড়ছে না। বিশেষ করে মেয়েরা। গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের স্কুল ড্রপ আউট ভয়াবহ জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। একটা সময়ের পর নিজেরাও যায় না, বাড়ি থেকেও যেতে দেয় না। কয়েক বছর আগে আমি একটি রিপোর্ট পড়েছিলাম। ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো রিপোর্ট।’

বারিধারা বলল, ‘তুমি কি তাদের সব ধরে ধরে এনে স্কুলে ভর্তি করবে ভেবেছ?’

কমলকান্তি সেন বললেন, ‘এই স্কুলটা সেরকম হবে না বৃষ্টি, অন্যরকম হবে। এমন স্কুল যা আগে কখনও হয়নি। এখানে মেয়েদের ধরে আনতে হবে না, তারা নিজেরাই আসবে। তাদের বাড়ি থেকে পাঠাবে।’

বারিধারা আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আগে কখনও হয়নি! সেটা কীরকম?’

কমলকান্তি ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকালেন। তিনি যেন ছবির মতো তার স্বপ্নের স্কুলটা দেখতে পাচ্ছেন।

‘এই স্কুলে বাঁধাধরা কোনও সিলেবাস থাকবে না। পরীক্ষা, পাস-ফেল—এ- সব থাকবে না। যেসব গরিব মেয়ে নিয়ম করে স্কুলে যেতে পারে না বা শুরু করেও স্কুল ছেড়ে চলে গেছে, যাদের বাড়ি থেকে পড়তে দেওয়া হয় না তারা এখানে পড়বে। ছোট, বড় সবাই পড়তে পারবে। বয়েসের বার থাকবে না।’

বারিধারা হেসে ফেলল। দাদুর গায়ে হাত দিয়ে বলল, ‘যারা ইচ্ছে থাকলেও পড়তে পারে না, তারা তোমার স্কুলে পড়তে আসবে কী কারণে?’

কমলকান্তি সোজা হয়ে বসলেন।

‘আমরা ব্যবস্থা করব।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘কী ব্যবস্থা? ধরো, গ্রামের কোনও গরিব ফ্যামিলি চায় মেয়ে লেখাপড়া করবে না, বিয়ে করবে। তুমি কী করবে? পুলিশ দিয়ে স্কুলে ধরে আনবে?’

কমলকান্তি বললেন, ‘সেটাই তো আমাদের স্কুলের আসল মজা হবে। আমাদের স্কুলে যে মেয়ে লেখাপড়া শিখবে সেই মেয়ের বিয়ের যাবতীয় খরচ আমাদের স্কুল থেকে বহন করা হবে। এটা শুধু নিছক একটা স্কুল নয়। একটা প্রাোজেক্ট। একটা প্রকল্প।’

বারিধারার এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা হল।

‘বলো কী দাদু! আর ইউ ইন সেন্স?’

কমলকান্তি সাদা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মাই ডিয়ার বৃষ্টিরানি, তুমি কি কখনও দেখেছ কমলকান্তি সেন সেন্সের বাইরে গিয়ে কথা বলছে? দেখেছ কখনও?’

বারিধারা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, না, তা বলছি না, কিন্তু এই প্রাোজেক্ট তো বিরাট খরচের ব্যাপার দাদু। এত খরচ সামলাবে কী করে?’

কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘সে কি আমি জানি না? আমার অনেকটা ভাবনাচিন্তা করা হয়ে গেছে। বাকিটা আমরা সবাই মিলে বসে ঠিক করব। সবার আইডিয়া নেব। সবাই মিলে একদিন বসতে হবে। শুধু বিয়ের খরচ নয়, আমাদের স্কুলে যে মেয়েরা পড়বে তারা যাতে পরে নিজেরা উপার্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থাও থাকবে।’

বারিধারা বিড়বিড় করে বলল, ‘কীভাবে এসব হবে জানি না। তবে একসাইটিং লাগছে। কবে বসব দাদু?’

কমলকান্তি বললেন, ‘তোমার ঝামেলাটা মিটলেই বসব।’

বারিধারা বলল, ‘আমার ঝামেলার জন্য এত ভালো একটা কাজ আটকে থাকবে?’

কমলকান্তি বললেন, ‘আটকে থাকবে না। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আটঘাঁট বেঁধে এগোতে হবে।’

বারিধারা বড় করে হেসে বলল, ‘এরকম একটা কিছু করতে পারলে খুব ভালো হবে।’

কমলকান্তি বাইরের জানলা দিয়ে বাইরে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের এই গোটা প্রাোজেক্টটার একটা নাম ভেবে ফেলেছি রে বৃষ্টি।’

‘নাম ভাবাও হয়ে গেছে! ওয়ান্ডারফুল দাদু।’

কমলকান্তি নাতনির দিকে মুখ ফিরিয়ে লজ্জা লজ্জা হেসে বলল, ‘নামটা একটু বড়। সবাই মিলে যখন বসব তখন যদি অ্যাপ্রুভ হয় তবেই নামটা থাকবে। নইলে বাদ।’

বারিধারা ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আগে নামটা তো বলো! তারপর অ্যাপ্রুভের কথা দেখা যাবে।’

কমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘আমাদের এই প্রাোজেক্টের নাম হবে ”একটু পরে রোদ উঠবে”।’

বারিধারা চুপ করে গেল। তার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। ভালো কাজের এমন সুন্দর নাম হতে পারে! এত আধুনিক আর ইন্টারেস্টিং! সত্যি তো এটা মেয়েদের জীবনের মেঘ কেটে গিয়ে রোদ ঝলমল হয়ে ওঠবার প্রাোজেক্ট। এই রোদ তো আর চট বলতে উঠবে না, তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। সময় লাগবে। দাদু ঠিকই বলেছে। একটু পরে রোদ উঠবে।

বারিধারার ইচ্ছে করল, এখুনি দিদি আর মাকে ঘটনা গিয়ে বলে। কিন্তু আজ হাতে একদম সময় নেই। ইউনিভার্সিটির ঝামেলা রয়েছে। সে উঠে দাঁড়াল। কমলকান্তি সেনের মাথার সাদা চুল এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ইউ আর গ্রেট ডার্লিং। আই লাভ ইউ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি বিয়ে করি তা হলে তোমাকেই বিয়ে করব। এরকম ইনোভেটিভ মাথাওলা বর আমার খুব প্রয়োজন।’

কমলকান্তি দু:খ দু:খ মুখ করে বললেন, ‘সরি বৃষ্টিরানি। তুমি যতই চাও, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার দিদির সঙ্গে আমার বিয়ের কথা অনেক আগে থেকেই পাকা হয়ে গেছে। মেঘ রাজকুমারীকে বিয়ে করলে শুধু তাকেই আমি কাছে পাব এমন নয়, তার বাবা আমাকে রাজত্ব দেবে বলেছে। এই অবস্থায় তোমাকে কী করে বিয়ে করি?’

বারিধারা ঠোঁট উলটে বলল, ‘তোমাকে বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে। আমার অনেক ভালো বর জুটবে।’

দাদু-নাতনি দুজনেই ‘হো-হো’ আওয়াজ করে হেসে উঠল।

বারিধারা বলল, ‘এখন আমি কাটলাম দাদু। পরে সব কথা হবে। একটু পরে রোদ উঠবে জিন্দাবাদ।’

বারিধারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কমলকান্তি ইজিচেয়ারে মাথা রেখে চোখ বুজলেন। চোখ বুজে তিনি যেন তার প্রাোজেক্টের গেটটা দেখতে পেলেন। গেটের মাথায় বড় বড় করে লেখা—

‘একটু পরে রোদ উঠবে’

নামটা কি কাব্যিক হয়ে গেল? মানুষের স্বপ্ন তো আসলে কবিতাই। এই প্রাোজেক্টে ঢোকবার সময়ে সবাই যেন ভাবে, এবার দু:খ-দুর্দশার অন্ধকার কেটে ঝলমলে আলোর জীবন আসবে। তাতে নাম যদি বড় হয় ক্ষতি কী?

কমলকান্তি মনে-মনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা শুরু করলেন।

‘নাম পছন্দ হয়েছে গিন্নি?’

‘পছন্দ হয়েছে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘একবার ভেবেছিলাম, তোমার নামেই করব। নীহারিকা। যেমন সবাই স্কুল-কলেজ, মন্দির, লাইব্রেরিতে মৃত মা, বাবা, বউয়ের নাম ব্যবহার করে। তারপর ভেবে দেখলাম, তুমি বিরক্ত হবে।’

‘শুধু বিরক্ত নয়, আমি খুব রেগে যেতাম। নাম দিয়ে ভালো কাজের মধ্যে ঢুকে পড়া এক ধরনের হামবড়াই ভাব থাকে। কাজের থেকে নামটা বড় হয়ে যায়। একটু পরে রোদ উঠবে খুব সুন্দর নাম হয়েছে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘তোমার ছোট নাতনিরও পছন্দ হয়েছে।’

‘আমি খুশি।’

কমলকান্তি বললেন, ‘আমি জানি তুমি খুশি হবে। তবে কাজটা অনেক বড় করে ভেবে ফেলেছি।’

‘তোমাকে বড় কাজই মানায়।’

কমলকান্তি মনে-মনে হাসলেন। বললেন, ‘তোমাকে পাশে পেলে সুবিধে হত।’

‘আমি তো তোমার পাশেই আছি।’

কমলকান্তি বললেন, ‘তা ঠিক। তুমি আছ বলেই তো সাহস করে এত বড় একটা কাজের কথা ভাবতে পারলাম। নীহারিকা, আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই। সময় ফুরিয়ে এসেছে। এবার আমার যাওয়ার পালা। তার আগেই কাজটা শুরু করে দিতে চাই।’

‘কতদিন বাঁচলে এটা কোনও কথা নয়। বেঁচে কী করলে সেটাই কথা।’

কমলকান্তি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আজকাল তোমার জন্য মন কেমন করে।’

‘মন কেমন কোরো না। আমাদের তো দেখা হবে।’

কমলকান্তি মলিন হাসলেন। বললেন, ‘অপেক্ষা করছি।’

‘এখন এসব নিয়ে ভেবো না। একটু পরে রোদ উঠবে নিয়ে ভাবো।’

কমলকান্তি মুচকি হেসে বললেন, ‘যথা আজ্ঞা মেমসাহেব।’

কমলকান্তি সেনের স্ত্রী নীহারিকা সেনকে সত্যি মেমসাহেবের মতো দেখতে ছিল। গায়ের রং ফর্সা টকটক করত। ব্রোচ লাগানো শাড়ি, কনুই পর্যন্ত জামা পরে, উঁচু হিলের জুতো পরে যখন হাঁটতেন তখন সকলে তাকিয়ে দেখত। পাতলা শরীরের এই মেয়েটির চোখে-মুখে ছিল বুদ্ধির ঝলকানি। চাপা ব্যক্তিত্বের কারণে সবাই কমবেশি সমীহও করে চলত। সবথেকে বড় কথা, সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস আর তার কর্মচারীদের খুব ভালোবাসতেন নীহারিকা সেন। কর্মচারীরাও তাদের মালকিনকে বিশেষ পছন্দ করত। সাতদিনের অসুখে একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিলেন নীহিরিকা। তবে মৃত্যু যে এমন দ্রুত আসবে কেউ ভাবতে পারেনি। যদিও এমনটাই হয়। জন্মের মতো দশ মাস ধরে সাজো সাজো রব তুলে নয়, মৃত্যু আসে অতর্কিতে। সাপের মতো চকিতে ছোবল দিয়ে চলে যায় নি:শব্দে। শোক সামলাতে পারেননি কমলকান্তি সেন। ঠিক করেছিলেন, অফিস, ওয়ার্কশপ সব ছেড়েছুড়ে বাইরে চলে যাবেন। একমাত্র সন্তান বিমলকে কোনও বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেবেন। ব্যবস্থাও প্রায় করে ফেলেছিলেন। মৃত নীহারিকাই বারণ করলেন। একদিন তিনি এলেন চিন্তায়।

‘এটা তুমি কী করছ। কাজকর্ম সব ছেড়ে দিচ্ছ?’

‘ভালো লাগছে না নীহারিকা।’

‘ভালো-মন্দ লাগবার প্রশ্ন নয়, এত বড় প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করাটা তোমার দায়িত্ব।’

‘কী হবে রক্ষা করে? আমার যা টাকাপয়সা আছে, ছেলে আর আমার চলে যাবে।’

‘আর কোম্পানির এতগুলো কর্মচারী? তাদের কী হবে?’

‘নতুন কেউ দায়িত্ব নেবে।’

‘না, দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। তুমি সেন অ্যাসোসিয়েটসকে বড় করবে। তোমার চিন্তা কী? আমি তো তোমার সঙ্গে সবসময় আছি। তুমি ডাকলেই আসব।’

তারপর থেকে তিনি মাঝে মাঝেই মৃত স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই নতুন প্রাোজেক্ট করবার তাগাদা স্ত্রীরই।

‘একটু পরে রোদ উঠবে’র প্রাথমিক খরচের একটা বড় অংশ নীহারিকা সেনের নামে রাখা টাকা থেকে নেওয়া হবে।

গত চল্লিশ বছর ধরে এই টাকা কোম্পানি থেকে ব্যাঙ্কে রাখা হয়। এটা নীহারিকা সেনের শেয়ার। এই টাকা দু’কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ঝাড়গ্রামের ভুলাভেদায় সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের যে জমি পড়ে আছে প্রাোজেক্ট হবে সেখানে। কলকাতা থেকে খুব দূরে হল না, আবার শহুরে হট্টগোলের বাইরেও হল। জমির পরিমাণও অনেক। স্কুলবাড়ি, হস্টেল, ট্রেনিং সেন্টার বানানোর পরও অনেকটা জায়গা পড়ে থাকবে। বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে হ্যান্ডিক্র্যাফটসের ওস্তাদদের এনে মেয়েদের ট্রেনিং দেওয়ানো হবে। তাঁতে কাপড় বোনা থেকে, পুতুল, মুখোশ, পিতল, ডোকরা, বাঁশ, মাটির কাজ শেখানো হবে। ধাপে ধাপে এসব জিনিস মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন শহরে শো-রুম হবে। এখানে থেকেই মেয়েদের বিয়ে, লেখাপড়ার খরচ উঠবে। সবাই মিলে বসলে নিশ্চয় আরও ভাবনার কথা জানা যাবে।

কমলকান্তির মন শান্ত লাগছে। ভালো লাগছে। বেঁচে থাকবার একটা মানে বোঝা যাচ্ছে। বাইরের মেঘ কেটে একটু রোদও উঠেছে।

এরকম একটা সময়ে একতলায় বাড়ির গেটের কাছে একটা ঘটনা ঘটল।

অর্চিন হন হন করে বাড়িতে ঢুকতে গেলে ভীম আটকাল।

অর্চিন বলল, ‘কী হয়েছে ভীমদা?’

ভীম নীচু গলায় বলল, ‘তোমাকে থানা থেকে খুঁজতে এসেছিল।’

অর্চিন চমকে উঠে বলল, ‘থানা থেকে!’

ভীম আরও গলা নামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, একজন সাদা পোশাকের পুলিশ। স্যারের সঙ্গে কথা বলেছে।’

অর্চিন বলল, ‘তারপর?’

ভীম ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘তোমাকে সন্ধের পর থানায় যেতে বলেছে।’

অর্চিন একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চিন্তিত মুখে বলল, ‘আচ্ছা’ বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল অর্চিন।

সে জানতেও পারল না বাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথ থেকে মাঝবয়সি এক মহিলা তার দিকে পরম মমতা মাখা চোখে তাকিয়ে আছে।

সাতাশ

‘ও মাটি জননী মাগো, আমি তোর উদরের ধুলো

অপার আঁচলে আজ মুছে নেব ভুল ত্রুটিগুলো।’

এটি একটি কবিতার শেষ দুই লাইন। কবিতার নাম ‘মাটিবতী’। বাংলাদেশের অতি বিখ্যাত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতাটা লিখেছেন। এই লাইন দুটি শেখর গুপ্ত তার একটি লেখার শুরুতে ব্যবহার করেছেন। কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করলেও লেখার বিষয় সহজ নয়। লেখার বিষয় জটিল। লেখার বিষয় হল, ‘বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং বামপন্থার সংকট।’

আজ সকাল থেকে শেখর লিখতে বসেছে। দমদমের একটা পত্রিকা বেশ কয়েকদিন ধরে লেখা চাইছে। দেব দেব করেও হয়ে উঠছিল না। নানা কারণ ছিল। খানিকটা হাতে সময় নেই, খানিকটা আলিস্যি, খানিকটা লেখার জন্য যে বইগুলো দরকার সেগুলো হাতের কাছে নেই। তবে মূল কারণ অন্য। শেখর হালকা খবর নিয়ে জেনেছে, পত্রিকাটি কোনওরকম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। ব্যস এতেই শেখর উৎসাহ হারিয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়, এমন কোনও পত্রিকায় লেখালিখিতে তার চিরকালের অনীহা। সে যে খুব লেখালিখি করে এমন নয়। কালেভদ্রে একটা-দুটো। আগে তো অন্য কাজের চাপে একেবারেই পারত না। পার্টি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তাও কিছুটা সম্ভব হয়েছে। গত কয়েক বছরে খানকতক প্রবন্ধ লিখেছে। সবই পার্টির সঙ্গে যুক্ত পত্রপত্রিকায়। বিভিন্ন গণসংগঠনের কাগজে। তবে সবসময়েই মনে হত, রাজনীতির ধারকাছ দিয়ে যায় না, এমন পত্রিকায় লেখা অর্থহীন। সে তো গল্প উপন্যাস লিখতে বসেনি যে, যে-কোনও পত্রিকায় লিখবে আর মানুষ পড়বে। সে লিখছে রাজনীতির কথা। তাও আবার নির্দিষ্ট মতাদর্শের কথা। এটা এমন একটা মতাদর্শ যা রসাল ভাষায়, তরল ভঙ্গিতে লেখা সম্ভব নয়। শেখর লিখছেও না। তার পছন্দ নিরস, কঠিন ভঙ্গি। এই ধরনের লেখার জন্য আলাদা পত্রিকা থাকে, আলাদা পাঠক থাকে। সাধারণ পত্রিকায় এসব কথা কে পড়বে? পড়লেই বা কে বুঝবে? বেশিভাগই তো পাতা উলটে যাবে। তার পরেও এক-দুজন পড়তে পারে। সে পড়ার অর্থ কী? পরিশ্রম করে লেখা হল, অথচ কোনও কাজে লাগল না—এতে লাভ কী? এইসব ভেবে সাধারণ পত্রিকায় লেখালেখি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে শেখর। এবারও রেখেছিল। দমদম থেকে আসা অনুরোধ পড়েই ছিল। তমসাই জোর করল। দিন তিনেক আগে চেপে ধরল। শুধু চেপে ধরল না, জোরে চেপে ধরল। কথা এক ধরনের বিতর্কের দিকে চলে গেল। পার্টির চলবার পথ কেমন হবে? কাকে সে বেছে নেবে? কোয়ান্টিটি না কোয়ালিটি? আলোচনা যদিও শুরু হয়েছিল সহজ ভঙ্গিতে।

তমসা সেদিন বেশ রাগ রাগ করেই বলেছিল, ‘ওরা এতবার বলছে, তারপরেও লিখছ না কেন? আজও তো ফোন করেছিল। করেছিল না?

শেখর এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ‘হ্যাঁ করেছিল, কিন্তু লেখা নিয়ে বসবার সময় পাচ্ছি না।’

তমসা বলল, ‘কী এমন কাজ করছ যে তিন মাস ধরে তিনপাতা লেখবার সময় পাচ্ছ না?’

শেখর আত্মরক্ষার কায়দায় খানিকটা আমতা আমতা করেই বলল, ‘আহা, লিখব বললেই তো চট করে লিখতে বসে যাওয়া যায় না তমসা। কী লিখব ভাবতে হয়, তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। বই ঘাঁটতে হয়। সময় লাগে। হাতে এখন সেই সময় কোথায়? সবে কনফারেন্সগুলো শেষ হল। এবার তো রিপোর্ট গোছগাছ করতে হচ্ছে। দেখছ না সর্বক্ষণ গাদাখানেক কাগজ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।’

স্বামীর এই উত্তর পছন্দ হল না তমসার। থম মারা গলায় বলল, ‘না লিখলে বলে দাও ওদের। ঝুলিয়ে রেখেছ কেন? হয়তো তোমার লেখার জন্য অপেক্ষা করছে বেচারিরা। তুমি তো আর বিরাট কোনও লেখক নও যে, তোমার লেখা ছাড়া পত্রিকা চলবে না।’

শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘এটাই তো সমস্যা তমসা। ”না” বলতে পারছি না। এটা আমাদের কঙ্কণদার শ্যালকের ম্যাগাজিন। কী যেন নাম ম্যাগাজিনের? আগুনের ঝরণা, না আগুনের নদী, না, না মনে পড়েছে আগুনের স্রোত। দমদম থেকে বের করে। নিজেদের গল্প কবিতা ছাপে। এবার কী শখ হয়েছে, ঠিক করেছে, এখন থেকে পলিটিক্সও ছাপবে। কঙ্কণদাকে বলেছিল, লেখা চাই। যে কারও লেখা নয়, এমন লোকের লেখা চাই যে নিজে অ্যাকটিভলি পলিটিক্স করে। কঙ্কণদা আমাকে ফাঁসিয়েছে। বলেছে, ওরে বাবা, আমি ওসব রাজনীতি টাজনীতিতে নেই। একজনকে চিনি, সে বেটা এসবে আছে। দেখো বাপু তাকে ধরে যদি রাজি করাতে পারো। আমাকে ওরা কঙ্কণদার রেফারেন্সে ফোন করল। আমি বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও। ওরা বলল, তা হবে না দাদা। আপনি সময় নিন, কিন্তু লিখতে হবে। আমি বললাম, নিজের ইচ্ছেমতো লিখতে পারব তো? ওরা বলল অবশ্যই। আপনি যা ভালো বুঝবেন। আমি জিগ্যেস করলাম, এই সময় আমার কথা ছাপতে পারবে? আমার রাজনীতি কিন্তু অন্যরকম? ওরা বলল, সব জানি দাদা। কঙ্কণদা সব বলেছে। আমাদের কোনও সমস্যা নেই। আপনি আপনার মতো লিখবেন। আমি বললাম, কতদিন সময় দেবে? ওরা বলল, মাসখানেক নিন।’

শেখর থামলে তমসা বলল, ‘এই তো, তাহলে তো তুমি রাজি হয়েছিলে। এত কথা বলা মানে তো রাজি হওয়া। এবার তাহলে ঝুলিয়ে রাখছ কেন?’

শেখর মুখ নামিয়ে একটা ছোট নি:শ্বাস ফেলল। বলল, ‘আসলে কী জানো তমসা, তখনও আমি জানতাম না, পরে খবর নিলাম। ম্যাগাজিনটার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যারা এটা বের করে তারাও যে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড এমনটা নয়।’

তমসা দাঁড়িয়ে শাড়ি ভাঁজ করছিল। থমকে বলল, ‘তাতে কী?’

‘না মানে, ওখানে আমি লিখে কী করব?’

তমসা বলল, ‘ওখানেই তো এখন লিখতে হবে।’

শেখর মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কাজ করছিল। এটা তমসার নিয়ম। সে বিছানায় বই, ফাইল, কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজ করলে রাগ করে। বাড়িটা পার্টি অফিস নয়। এখানে বিছানা বিছানা। কাজ করতে হলে হয় টেবিল-চেয়ারে, নয় মেঝেতে। শেখর আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘তমসা, এসব জায়গায় আমাদের মতো লোকদের লিখে কী হবে বলো তো? ক’জন পড়বে? আমি প্রচারের কথা বলছি না, বলছি, যে ক’জন পড়বে তারাও কি বুঝবে? এই পাঠকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্তই নয়। আমার পরিশ্রমটাই মাঠে মারা যাবে। আর তুমি তো জানো তমসা, লিখব ভাবলে, আমি খেটেখুটেই লিখব। ফাঁকি দিতে পারব না।’

তমসা বলল, ‘এটা কী বলছ? এখন তো এসব জায়গাতেই নিজেদের কথা বলবার সময়। যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের কাছে পৌঁছতে হবে। এই আগুনের স্রোত ম্যাগাজিনের একজন পাঠকও যদি তোমার লেখা ভালোবেসে ফেলে, সেটাই আমাদের লাভ।’

শেখর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘অত খেটেখুটে তৈরি করা লেখা একজন পড়লেই হবে! এটা তুমি কী বলছ।’

তমসা শক্ত গলায় বলল, ‘ঠিকই বলছি। অনেক কোয়ান্টিটি আমরা দেখেছি, এবার কোয়ালিটি খোঁজবার পালা। মিটিং, মিছিলের লোক কম দেখেছি? লাভ কী হয়েছে?’

শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘তোমার কোয়ালিটির কথাটা ফেলতে পারলাম না তমসা, কিন্তু আমাদের মিটিং মিছিল নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট মানতে পারছি না। ভোটে হেরে যাওয়ার পর অনেককেই এসব বলতে শুনেছি। ব্রিগেডে অত বড় মিটিং করে লাভ কী হল? ভোটের আগে বর্ধমান, হাওড়া, যাদবপুরে অত বড় বড় মিছিল করে লাভ কী হল? সেই তো হারতে হল। তুমিও একই কথা বললে তমসা। মিটিং-মিছিলের স্ট্রেংথ দিয়ে সরকার সমর্থনের বিচার হয় না। যদি কেউ বিচার করে থাকে সে ভুল করেছে। সেটা পদ্ধতির ভুল। মিটিং, মিছিলের ভুল নয়। ধরো, সেই সময় মিটিং, মিছিলগুলো যদি ছোট হত, তাহলে কী হত? যা হওয়ার তাই হত। না আমরা ভোটে জিততাম, না আমাদের অ্যাসেসমেন্ট ঠিক হত? অবশ্যই যারা ভুল অ্যাসেসমেন্ট করবার জন্য মুখিয়ে ছিল, তাদের কথা বলছি। তারা সবসময়ই ভুল ভাবত। কারণ তারা ভুল ভাবতে চাইছিল।’

তমসা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুমি কী বলছ, এরকম বিচার হয়নি? শুধু ভোট কেন, একটা সময় ছিল যখন বছরের পর বছর আমরা মিটিংয়ের লোক দেখে খুশি হয়েছি। যত বেশি লোক, তত বেশি খুশি। কত বড় মিটিং, কত বড় মিছিল বলে পিঠ চাপড়ে দিয়েছি নিজেদের। মিটিং, মিছিল যাতে বড় হয় তার জন্য জেলা কমিটিগুলো লোকাল কমিটি, ব্রাঞ্চ কমিটিকে কোটা বেঁধে দিয়েছে। এই ঘটনা তো বছরের পর বছর ঘটেছে। কোয়ান্টিটি আমাদের গ্রাস করেছে। বাইরে যতই আমরা অন্য কথা বলি, ঘরের ভিতর এই কথা তুমি অস্বীকার করতে পারো?’

শেখর এবার পুরো উঠে বসল। শান্ত গলায় বলল, ‘আমি তোমার কথা অস্বীকার করছি না, আবার পুরোটা স্বীকারও করছি না তমসা। পার্টি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন নানা ধরনের ভাইসেস তাকে ঘিরে ফেলে। যে-কোনও পার্টির জন্যই একথা সত্য। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে এই সত্য অনেক বেশি। দীর্ঘদিন মার খাবার পর ক্ষমতা এক ধরনের মুক্তি। কমিউনিস্টরা যুগযুগান্ত ধরে শুধু মারই খেয়েছে। কখনও মালিকের হাতে মার খেয়েছে, কখনও রাষ্ট্র তাকে মেরেছে। তারপর কোনও কোনও দেশে কেউ কেউ ক্ষমতা পেয়েছে। কেউ ভোটে, কেউ বিপ্লবে, কেউ জোর করে। এই ক্ষমতা পেয়ে মার খাওয়া কমিউনিস্টরা যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে গেল। এই ঘটনায় বিশৃঙ্খল হওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ারই কথা। সেই প্রবণতা আমরা জিনে ক্যারি করছি। আমাদের পার্টির জিনে। আমাদের পার্টির বেলাতেও তাই হয়েছে। অনেকের বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। নিজেকে যেমন অ্যাসেস করতে পারেনি, পার্টিকেও পারেনি। ভাবতেও পারেনি, কখনও ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। তাই মিটিং, মিছিলের ভিড় দেখে সমর্থনের হিসেব কষত। কিন্তু তার মানে এই নয়, সবার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল তমসা। সবাই ভুল হিসেব কষেছে। আমাদের লিডারশিপের অনেকেই বুঝেছিল, দিন ফুরিয়ে আসছে। নতুন দিনের জন্য তৈরি হতে হবে।’

তমসা বলল, ‘তাহলে মিটিং, মিছিলের ভিড় নিয়ে আমরা এত হইচই করতাম কেন?’

শেখর বলল, ‘ঠিকই করতাম। হইহই করবার মতো জিনিস বলেই করতাম। মিটিং, মিছিল বড় হওয়া মানে আমাদের দাবি, আবেদন মানুষের কাছে বেশি জোরে পৌঁছে দেওয়া। আমরা তা করেছি। পাঁচ-দশজনের মিছিল যতটা জোরে কোনও কথা বলতে পারে, পাঁচ হাজারের মিছিল তার থেকে অনেক বেশি জোরে সে কথা বলতে পারে। মানুষ সে কথা মানতে নাও পারে, কিন্তু ইগনোর করতে পারে না। বছরের পর বছর আমরা এভাবে মানুষের কাছে পৌঁছেছি। বহু ভোটে জয়ী হয়েছি। বহু দাবি জোগাড় করেছি। মানুষকে যতটা সম্ভব রিলিভ দিয়েছি। এতে ভুল কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না।’

তমসা বলল, ‘আবার সেই কোয়ান্টিটি আর কোয়ালিটির প্রশ্ন। মিছিল, মিটিং-এ কত বাজে লোক ঢুকেছে। সুযোগ নিয়েছে।’

শেখর এবার বিরক্ত হল। বলল, ‘উফ তমসা, আজ তোমার হঠাৎ কী হল বলো তো? বাজে লোক কি শুধু মিটিং, মিছিলে ঢুকেছিল? যেখানে হাজার, দশ হাজার, এক লক্ষ মানুষ ছিল সেখানে? যেখানে তিনজন, পাঁচজন, দশজন সেখানে বাজে লোক ঢোকেনি? বাজে লোক, ভুল লোকের প্রবেশ সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। করেওনি। যাক। সেই জন্যই পার্টিতে তো রেক্টিফিকেশনের চেষ্টা হচ্ছে। তার মানে এই নয়, সুযোগ পেলে আমরা আবার বড় মিটিং, মিছিল করব না। একশোবার করব। তাতে দু-পাঁচটা পুরোনো মন্দ মানুষ এলে আসবে। তবে একজন নতুন ভালো মানুষকে পেলে সেটা হবে বড় অ্যাচিভমেন্ট। কোয়ান্টিটি দিয়ে কোয়ালিটি ধরে আনতে তবে তমসা। কোয়ান্টিটি অস্বীকার করা বোকামি। তা ছাড়া…তা ছাড়া… মিটিং-এ লোক আনো, মিছিলে লোক আনো বলে পার্টিরা কর্মী, সাপোর্টারদের অ্যাকটিভ রাখা হত। এটা তো মিথ্যে নয়।’

তমসা থুতনির নীচে শাড়ি চেপে ধরে ভাঁজ শেষ করল। বলল, ‘আমি কোনওটাই মিথ্যে বলছি না, তবে এটাও বলছি, মিটিং, মিছিলে মানুষের সংখ্যা যখন কম, তখনও সেটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। দাবিটা কী, সেটাই আসল কথা। লোকটা নয়।’

শেখর উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই। দশটা লোকও যদি ঠিক দাবিতে, ঠিক প্রতিবাদে একসঙ্গে হয়, তার মূল্য আছে। ভুল দাবিতে দশ হাজার মানুষের সমাবেশের থেকে সেই মূল্য অনেক বেশি। তবে দশ হাজার মানুষ একসঙ্গে হয়েছেন বলেই তাকে বাজে লোকের ভিড় বলে ছোট করব, এটাও ঠিক নয়।’

তমসা বলল, ‘তাহলে তুমি লিখতে শুরু করো। সেই লেখা যদি ঠিক তিনজন পাঠকও পড়ে সেটার মূল্য অনেক। অন্তত ভুল তিনশো পাঠকের থেকে তো বটেই।’

শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘তোমার যুক্তির কাছে হার মানছি তমসা। তোমার কথা আমার কাছে একরকম শিক্ষার মতোই হল। আমি অবশ্যিই লিখব।’

তারপরেই শেখর লিখতে বসছে। কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করে বেশ ভালো লাগল শেখরের। তরতর করে লেখা এগিয়ে চলল।

‘আমাদের দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটটি যদি চালচিত্রের মতো খুলে ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে, তার বড় অংশটাই মধ্যবিত্তের দখলে। কমিউনিস্ট দলগুলি, যারা সব সময় শ্রমিক-কৃষক সর্বহারার নেতৃত্বের কথা বলে, তারাও এখন স্বীকার করে, তাদের পার্টি চালায় মধ্যবিত্ত। এর অর্থ, কমিউনিস্ট পার্টিগুলির শ্রেণিচরিত্রে এখন বড় রদবদল ঘটেছে। মধ্যবিত্তের আধিপত্য দেখা দিয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি এখন মধ্যবিত্তের পার্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য দু:সময়? নাকি এই ছিল ভবিতব্য? মধ্যবিত্তর এই সর্বগ্রাসী দখলদারি বামপন্থার জন্য কতটা সর্বনাশের, সে বিচার করবার আগে দেখা যাক, অতীতে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাম আন্দোলনে কতটা অবদান রাখতে পেরেছে…।’

মোবাইল বেজে উঠল। শেষের লেখা থামিয়ে বিরক্তি মুখে ফোন তোলে। কঙ্কণদা।

‘কী হয়েছে কঙ্কণদা?’

‘শেখর, ভালো আছিস?’

শেখর হেসে বলল, ‘ভালো আর থাকতে দিলে কই কঙ্কণদা? ঘাড়ে যা চাপিয়েছ। তোমার শালার জন্য লিখতে হবে না? তারই মকসো করছিলাম।’

ওপাশে কঙ্কণদা একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘একটা কথা বলতে হচ্ছে, কিছু মনে করিস না।’

‘আরে বলো, কী হয়েছে? আমতা আমতা করছ কেন?’

‘না, বলতে বাধো বাধো ঠেকছে।’

শেখর হালকাভাবে বলল, ‘আবার লেখার অনুরোধ না হলে অনায়াসে বলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।’

‘আমার শ্যালক তোকে যে লেখাটার জন্য বলেছিল, ওটা ছেড়ে দে।’

শেখর অবাক হয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেব মানে!’

কঙ্কণদা বলল, ‘লিখতে হবে না তোকে। ওরা নিজেরা তোকে কথাটা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। আমাকে ফোনে ধরল। বলল, তোর লেখা ছাপায় ওদের সমস্যা হবে। যে লোক পত্রিকা ছাপার টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে, সে নাকি আপত্তি করেছে। বলেছে, তোদের পলিটিক্সের কথা ছাপা হলে সে আর থাকবে না। বুঝতেই তো পারছিস, ছোট পত্রিকা…আমার খুব খারাপ লাগছে। আই অ্যাম সরি শেখর।’

শেখর আবার হেসে বলল, ‘দুর, সরির কী আছে? কথাটা তো সত্যি। বেচারিরা এখন আমাদের লেখা ছেপে বিপদে পড়বে নাকি? থাক ও সব। তুমি আছ কেমন বলো?’

দু-একটা কথার পর ‘কঙ্কণদা’ ফোন ছাড়লে শেখর গুপ্ত আবার উপুড় হয়ে শুয়ে লিখতে শুরু করল। এই লেখা কে পড়বে সেটা বড় কথা নয়, লিখতে হবে এটাই আসল কথা।

আঠাশ

তমসার আজ মন ভালো। আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। প্রতি বছর ঘুম থেকে উঠেই তমসার তারিখটা মনে পড়ে যায় আর ভালো লাগে। আবার লজ্জাও করে। আশ্চর্য লাগে, এত বছর হয়ে গেল তারপরে দিনটা সে ভুলতে পারেনি। তমসা জানে, এ তার ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই নয়। ছেলের দশ বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও এসব মনে থাকবার কথা নয়! নেহাত তমসাকে যারা চেনে তারা কিছুতেই তাকে ‘নেকা’ বলতে পারবে না, নইলে তারাও এই কথা শুনলে ‘নেকা’ বলত। অবশ্য এই ঘটনা কেউ জানে না। এটা তমসার গোপন কথা। কাউকে গল্প করবার মতো নয়।

আজ তমসাদের স্কুল ছুটি। স্কুলের গভর্নিং বডির এক মেম্বার মারা গেছেন। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছিল। তমসারা তাকে কখনও চোখেও দেখেনি। স্কুলের মিটিংয়েও আসতেন না। নামকাওয়াস্তে গভর্নিং বডিতে ছিলেন। তার পরেও একটা ছুটি পাওয়া গেল। আমাদের দেশে মানুষকে সম্মান জানানোর শর্টকাট পথ হল ছুটি। শুধু সম্মান কেন, কিছু একটা হলেই হল। শোকের ঘটনায় ছুটি, আনন্দের ঘটনায় ছুটি। ছুটি পেলে সবাই খুশি। তমসা খুশি নয়। সামনে পরীক্ষা আসছে। মেয়েদের সিলেবাস শেষ হয়নি। চাপ তো টিচারদের ওপরই পড়বে। কিন্তু করার কিছু নেই। তবে বাড়ির কাজ সারবার জন্য হঠাৎ একটা ফাঁকা দিন পাওয়া গেল।

তবে শুধু বাড়ির কাজ নয়, আজ পার্টি অফিসেও খানিকটা সময় দেবে তমসা। এলাকার মহিলাদের নিয়ে একটা আলাদা কিছু করবার কথা ভাবা হচ্ছে। পুরোনো সমিতি নয়, তার থেকে আলাদা। আগের সমিতিগুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো নয়। ভালো না হওয়ারই কথা। একটা সময় সমিতির মহিলারা রাজনীতির থেকে বেশি পাড়ায় পাড়ায় খবরদারি করত। অন্যের সংসারে নাক গলাত। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াতেও ঝান্ডা হাতে চলে যেত। ওই চেহারা এখন চলবে না। সবাই দুচ্ছাই করে তাড়িয়ে দেবে। সেই কারণে অন্য ধরনের মঞ্চ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। লেডিস গ্রুপের মতো যদি কিছু করা যায়। তারা সারাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। বাইরে কাজ করবে। সমস্যা হচ্ছে, শহরে এই ধরনের গ্রুপ কী কাজ করবে এবং কীভাবে কাজ করবে সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। গ্রাম, কলোনি, বস্তি হলে কাজ সহজ হত। শহরের মেয়েরা এসব জায়গায় কতটা আসবে তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। পার্টি তমসাকে ভাবতে দিয়েছে। তমসা দু-তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। আজও করবে। তমসার ইচ্ছে অন্যরকম। একেবারে পার্টি থেকে বেরিয়ে কাজটা হবে। ক্লাবের মতো একটা কিছু তৈরি করতে হবে। গান-বাজনা-নাটক, এগজিবিশনের ক্লাব। পার্টির গণসঙ্গীত নয়, সাধারণ গানবাজনা। পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, মহালয়ায় কমিউনিটি হল নিয়ে ফাংশন হবে। এই কনসেপ্টে পার্টি রাজি হলে হয়। এটা যে আসলে কিছু মেয়েদের একসঙ্গে করবার একটা কৌশল সেটা কি নেতাদের মাথায় ঢুকবে? ঢোকা কঠিন। কমিউনিস্টরা চিরকালই নিজেদের ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে বসে থাকে। বইতে যেমন লেখা আছে তেমনভাবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দল যে তাতে এগোচ্ছে না কে বোঝাবে? পার্টি ভোটের সময় ক্লাবকে কাজে লাগায়, কিন্তু নিজেরা ক্লাব মনোবৃত্তিকে সমর্থন করে না। এই ধরনের ফ্যালাসি নিয়ে চলা মুশকিল। দেখা যাক। তমসা ঠিক করেছে, দরকার হলে নেতাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে।

ছেলে স্কুলে গেছে। ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো হয়েছে যে। ভালো হয়েছে না বলে, লেখাপড়ায় মন হয়েছে বলা ঠিক হবে। নিজের পড়া নিজে করে নেয়। স্কুলে যেতে ভালোবাসে। ঝড়বৃষ্টিতেও কামাই করতে চায় না। নামে শান্ত, স্বভাবেও শান্ত হয়েছে। অনেকটা তার বাবার মতো। খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা তেমন নেই। যা দেওয়া হবে খেয়ে নেবে। শুধু রাতে শোয়ার পর গল্প শোনানোর বায়না করে। কোনও কোনওদিন তমসার ভালো লাগে না। ক্লান্ত লাগে। সেদিন বলে, ‘আজ গল্প-টল্প নয়, চুপ করে শুয়ে পড়।’

তারপরেও শান্ত ঘ্যান ঘ্যান করে। তমসা রেগে যায়।

‘এবার কিন্তু চড় দেব। পাশ ফিরে ঘুমোও।’

শেষপর্যন্ত শেখর উদ্ধার করে। সে তার বাইরের ঘর থেকে উঠে এসে ছেলেকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। শান্ত বড় হয়ে যাওয়ার পর শেখর বাইরের ঘরে শোয়।

তমসা ঘুম থেকে উঠে ঘর গোছাল। দু’কামরার বাড়ি। ভাড়াবাড়ি। জায়গা কম। ছেলে বড় হচ্ছে, জায়গা দিন-দিন আরও কমছে। বাড়িটা যেন সবসময় অগোছাল থাকতে চায়। তমসা গোছানো মেয়ে বলে সামলে চলে। আজও নিজেদের কোনও ঘরবাড়ি হল না। হওয়ার কথাও নয়। বাড়ির প্রধান মানুষ যদি উপার্জন না করে তা হলে বাড়ি হয় না। কথাটা সবাই মানতে চায় না। সবাই কেন, আজকের দিনে বেশিরভাগই মানে না। একবার এক মামির সঙ্গে তমসার এই নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছিল। তখন পার্টি সরকারে ছিল। মামিমা খুব অপমানজনক কথা বলেছিল। ঝগড়ার পর এক বছর সেই মামির বাড়িতে তমসা যায়নি।

মামিমা বলেছিল, ‘শেখরকে এবার একটা ফ্ল্যাট-ট্যাট কিছু করতে বল তমসা। ক’দিন ভাড়াবাড়ির ঘুপচিতে পড়ে থাকবি? ছেলেটাও তো বড় হচ্ছে।’

তমসা বলেছিল, ‘কী যে বলো মামি। শেখর ফ্ল্যাট করবে কোথা থেকে? তার টাকা কই?’

মামিমা চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ‘তার মানে! ফ্ল্যাট করবে কীভাবে মানে! এতদিন পার্টি করছে একটা ফ্ল্যাট করতে পারবে না?’

তমসা হেসে বলেছিল, ‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন পার্টি একটা বিজনেস। মিটিং, মিছিল করা মানে লাভ করা। ওর রোজগার কোথায় মামিমা? তুমি তো জানো শেখর পার্টির হোলটাইমার। মাস গেলে পার্টি থেকে ওয়েজ পায়। সে আর কত টাকা? আমার স্কুলের চাকরিটাই ভরসা। এতে ফ্ল্যাট-ট্যাট হয় না। কোনওরকমে সংসার চলে।’

মামিমা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘বাজে কথা বলিস না তমসা। আমাকে টাকার গল্প শোনাস না।’

তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘টাকার গল্প শোনাচ্ছি মানে! তুমি কী বলছ? আমি বুঝতে পারছি না।’

মামিমা বলল, ‘বুঝে কাজ নেই। আমাকে বললি ঠিক আছে, বাইরের কাউকে এসব বলতে যাস না তমসা। হেসে গড়িয়ে পড়বে। খবরদার বলতে যাসনি।’

তমসা আরও অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলতে যাব না?’

মামিমা বলল, ‘পার্টি করে অথচ টাকা নেই এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন পার্টি করে সবাই গাড়ি-বাড়ি হাঁকাচ্ছে। দমদমে আমার বাপের বাড়ির ওখানে দেখছি না? আগে টালির ঘরে থাকত, এখন পার্টির লোকগুলো সব তিনটে-চারটে করে ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলেছে। নামে, বেনামে সম্পত্তি। তোর মামার অফিসে কাজ করে দাসবাবু। নির্মল দাস। কর্মচারী নাকি কী গুষ্টির পিণ্ডি ইউনিয়ন করে, এক সময়ে তোর মামার কাছ থেকে ধার করে সংসার চালাত। এখন তারও নাকি দুটো গাড়ি। কাজ তো কিছুই করে না। অফিসের ইউনিয়ন রুমে বসে বিড়ি ফোঁকে আর সময় সময় গেটে গিয়ে ঝান্ডা নাচিয়ে মানব না মানছি না করে। এরপরেও তুই বলছিস পার্টি করে পয়সা হয় না?’

তমসা শুকনো গলায় বলেছিল, ‘সবাই সমান হয় না মামিমা।’

মামিমা তেড়েফুঁড়ে বলেছিল, ‘সবাই সমান। পার্টির লোকগুলো সব চোর। প্রাোমোটার, বিজনেসম্যানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে আর টাকা কামায়। আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। তুই কাকে সাধুপুরুষ বলবি?’

তমসা খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সবাই চোর কথাটা তোমার বলা উচিত নয় মামিমা। পার্টিতে অনেক সৎ মানুষও আছে। একটা পয়সাও ছুঁয়ে দেখে না।’

মামিমা বিদ্র+পের ঢঙে বলল, ‘আছে নাকি! আমার তো বাপু বিশ্বাস হয় না। তারপরেও তুই যখন বলছিস আছে হয়তো। লুকিয়ে আছে। মুখ দেখাতে লজ্জা পায়।’

তমসা শান্তভাবে বলেছিল, ‘তোমার অভিযোগ সবটা মিথ্যে বলছি না। কিন্তু তোমার জানার বাইরেও বহু মানুষ আছে। তারা কষ্ট করে রাজনীতি করে, কষ্ট করে জীবনযাপন করে।’

অপমানিত হয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল তমসা। রাতে শেখর বলেছিল, ‘তুমি বিষয়টাকে এত কঠিনভাবে নিচ্ছ কেন তমসা?’

তমসা বলল, ‘কী বলছ! তোমাকে চোর বলছে, সেটা সহজভাবে নেব?’

শেখর হেসে বলল, ‘আমাকে নয়, পার্টির লোকদের বলছে।’

‘তাই বা বলবে কেন?’

শেখর গম্ভীর মুখে বলে, ‘এটাই তো আমাদের ভাবা উচিত তমসা। যে পার্টিতে এত লড়াই, এত স্যাকরিফাইজ, এত অনেস্টি সেই পার্টির লোকদের মানুষ চোর বলবে কেন? একটা মানুষও বলবে কেন? আমরা কি বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবি? ভাবি না। অনেক অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা হয়তো কমিশন-টমিশন বসিয়ে পার্টি থেকে বহিষ্কার করি, তাও বছরে একটা-দুটো, তার বেশি নয়। ব্যস, মানুষ কী বলছে সেদিকে তাকাই না। বরং গাল দিলে, সমালোচনা করলে তার ওপর রাগ করি। কোণঠাসা করি।’

তমসা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘মানুষের এই সব অভিযোগ তো সত্যি নয়। কানাইবাবু, কেষ্টদা, নিতাই সরকার, তালুকদারকাকা, অমিয় এরা তো ভয়ঙ্কর দুর্দশার মধ্যে সময় কাটায়। কেষ্টদা তো হস্টেলের বারান্দার মাদুর পেতে শোয়। রুমরেন্ট দিতে পারেনি বলে ঘরে জায়গা পায় না। এ সব কি মানুষ জানবে না?’

শেখর বলল, ‘না জানবে না। কারণ আমরা জানানোর কথা ভাবি না। সৎ ভাবে বেঁচে থাকাটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। ফলে মানুষ সামনে যে খারাপটাকে দেখতে পায়, সেটাকেই সব ভাবে। আলটিমেট বলে মনে করে।’

তমসা বলে, ‘ভাববে কেন?’

শেখর হেসে ফেলে।

‘কেন ভাববে এটা তুমি জিগ্যেস করতে পারো না তমসা। পারসেপশনটাই এরকম হয়ে যাচ্ছে। পার্টির লোক মানে চোর। চোর আছেও তো। অনেক চোরই আছে। আমরা একদিকে যেমন তাদের তাড়াতে পারি না, তেমন ভালো লোকদের সামনে আনি না। তার থেকে ভয়ের কথা, আমরা মানুষের সামনে নীতি, আদর্শের কথা তুলে ধরতে পারছি না। তার ফলে ব্যক্তির জীবন, বাহুল্য দিয়ে পার্টির কথা প্রচার হচ্ছে। একজন মন্ত্রী সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে গেলে রাস্তার লোক গাল দেয়। তাদের দোষ নেই। তারা তো জানে না যে মানুষটা মন্ত্রী হয়েছে, সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে তার অতীত কী? সে কত লড়াই করেছে? সোসাইটিতে তার কন্ট্রিবিউশন কী? কেন তাঁকে সাইরেন বাজিয়ে আগে যেতে হবে? আমরা মানুষকে এসব বোঝানোর চেষ্টাও করি না। ইগনোর করি। আমার ধারণা এর ফল ভালো হবে না। যে গুন্ডা মস্তান সাইরেন ছাড়াই পথ চলে সে গাড়িতে চড়লেও খারাপ, না চড়লেও খারাপ। তুমি তোমার মামিমার কথা নিয়ে মাথা ঘামিও না। উনি আমাদের কারণেই ভুল বুঝে আছেন।’

তমসা গজগজ করে বলেছিল, ‘যা-ই হোক, আমি ওর বাড়িতে আর কখনও যাব না।’

তমসা বাইরের ঘরে এল। শেখর উপুড় হয়ে লিখছে। নিশ্চয় দমদমের ওই পত্রিকার জন্য। খুব ভালো লাগল তমসার। মানুষটা এই যুগের সঙ্গে খাপ খায় না। সেই কারণেই বোধহয় এত ভালো। শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস নয়, নিজের জীবনের প্রতিও গভীর বিশ্বাস আছে। পায়ের আওয়াজে মুখ তুলল শেখর। হেসে বলল, ‘এসো তমসা। ঘর গোছানো হল?’

তমসা বহুদিন পর শেখরের পাশে মাদুরের ওপর বসে পড়ল। আঁচল দিয়ে কপালের গলার ঘাম মুছল। শেখর স্থির চোখে তাকিয়ে রইল স্ত্রীর মুখের দিকে।

তমসা গাঢ় স্বরে বলল, ‘কী দেখছ?’

শেখর মুচকি হেসে বলল, ‘তোমাকে। এই সময় তোমাকে কতদিন দেখিনি।’

তমসার গা শিরশির করে উঠল। শেখরের গায়ে হাত দিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘ধুত যত বাজে কথা। উনি যেন আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।’

শেখর খাতার ওপর খোলা পেন রেখে সোজা হয়ে বসল। তমসার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কে বলল থাকি না?’

তমসা শেখরের হাত সরিয়ে দিতে দিতে অভিমান করা গলায় বলল, ‘বাজে কথা। আমার জন্য অপেক্ষা করতে বয়ে গেছে তোমার। খালি কাজ আর কাজ। এই মিটিং, সেই মিটিং। আমি যে একটা মানুষ মনেই থাকে না।’

শেখর তমসাকে কাছে টানল।

‘তোমাকে মনে না রাখলে এত কাজ করতেই পারতাম না তমসা। সত্যি কথা।’

স্বামীর স্পর্শে বহুদিন পর তমসার শরীর কেঁপে উঠল। মনে হল, নতুন মানুষ। এই প্রথম বুঝি কোনও পুরুষ তার গায়ে হাত দিল। ভালোবাসার হাত। ছেলে বড় হওয়ার পর এই সুযোগ কমে গেছে। দুজনের কাছে আসাই হয়ে ওঠে না। আজ শান্ত নেই। অসময়ে বাড়িতে দুজনে। তাই কি এই শিহরন? তমসা লজ্জা পেল। শেখরকে ঠেলে সরিয়ে দিতে গেল। শেখর চেপে ধরল। তমসা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘অ্যাই কী হচ্ছে?’

শেখর চাপা গলায় বলল, ‘কতদিন আদর করিনি বলো তো?’

‘বয়ে গেছে তোমার।’

শেখর তমসার মুখের দিকে মুখ এগিয়ে বলল, ‘না বয়ে যায়নি। খুব ইচ্ছে করছে তমসা। প্লিজ।’

তমসা বাঁ হাত দিয়ে স্বামীর মুখ সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ইস দিনের ফটফটে আলোয় বাবুর খুব ইচ্ছে না?’

‘রাতে আর তোমাকে পাই কোথায়?’ ছেলে ঘুমিয়ে পড়বার আগেই তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’

তমসা চাপা স্বরে বলল, মিধ্যে কথা। নিজের মনে পড়ে না সেটা বলো।’

শেখর হেসে বলল, ‘আচ্ছা, বেশ মনে পড়ে না। এবার তো এসো। এবার মনে পড়েছে।’

কাছে টেনে তমসার বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল শেখর। তমসা বাধা দিল আবার দিলও না। সে চোখ বুজল।

বিড়বিড় করে বলল, ‘মাগো! কত আলো।’

শেখর তমসার বুকের ওপর মুখ নামাতে নামাতে বলল, ‘কী সুন্দর!’

তমসা ব্লাউজ খুলতে খুলতে মাদুরের একপাশে শুয়ে পড়ল। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। কী অদ্ভুত ঘটনা! একেই কি কোইন্সিডেন্স বলে? আজ থেকে বারো বছর আগে আজকের এই দিনটায় শেখর তাকে প্রথম আদর করেছিল। তখনও তাদের বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথাও হয়নি। শুধু ভালোবাসার টান দুজনে অনুভব করেছিল। এরকমই এক সকালে তমসা এই বাড়িতে এসেছিল। এসেছিল পার্টির কাজে। কাজটাও মনে আছে। লোকাল কমিটির সম্মেলন হবে। সম্মেলন উপলক্ষ্যে সেমিনারের দায়িত্ব ছিল তমসা আর তার টিমের ওপর। সেই সেমিনারের বিষয় ফাইনাল করতে এসেছিল। ব্যবহারিক জীবনে মার্কসবাদের প্রয়োগ কি আজকের দিনে বাস্তবসম্মত? কথা শেষ করে তমসা যখন উঠে পড়েছিল, শেখর খুব সহজভাবে তাকে বলেছিল, ‘তমসা কথাটা বলা উচিত নয়, তারপরেও যদি বলি তুমি কি রাগ করবে?’ তমসা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

শেখর বলেছিল, ‘আমরা দুজনেই আমাদের সম্পর্কের কথা জানি। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। সেই সম্পর্কের জেরে আজ যদি আমি আদর করতে চাই তুমি কি প্রত্যাখ্যান করবে তমসা? করলে সমস্যা নেই। আমি সহজভাবেই মেনে নেব। কিন্তু দয়া করে সত্যি কথা সরাসরি বলার জন্য আমার ওপর রাগ কোরো না। কোনও মানুষের তার ভালোবাসার জনকে আদর করতে চাওয়াটা অনুচিত হতে পারে, কিন্তু অপরাধ নয়!’

এমন সহজভাবে, কোনওরকম ভনিতা ছাড়া সরাসরি একজন পুরুষমানুষ কোনও মেয়েকে এই কথা বলতে পারে! তমসা বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিল দীর্ঘক্ষণ। যতক্ষণ না পর্যন্ত শেখর গিয়ে দরজার ছিটকিনি দেয় এবং এসে তার হাত ধরে।

ঘরের ভিতর, মেঝেতে পাতা মাদুরে দুটো নগ্ন শরীর যখন জগৎসংসার ভুলে মত্ত, দরজার বাইরে তখন এক তরুণ এসে দাঁড়াল। তার চেহারা বিধ্বস্ত। চোখে-মুখে গভীর দুশ্চিন্তা। তাঁকে পুলিশ খুঁজছে।

অর্চিন দরজায় ধাক্কা দিল। চাপা গলায় বলল, ‘শেখরদা, শেখরদা।’

উনত্রিশ

নিজের ঘরে মধুজা রায় গুম মেরে বসে আছেন। টেবিলের ওপর নানা ধরনের জরুরি কাগজপত্র। তিনি সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু দেখছেন না।

মধুজা রায়ের মেজাজ খারাপ। মেজাজ বেশি খারাপ হলে মানুষের নানারকম সমস্যা হয়। প্রেসার বাড়ার কারণে কারও ঘাড় মাথা চিনচিন করে, কারও রাগে কান ভোঁ ভোঁ করে, কারও মুখ তেতো হয়ে যায়। চিনির সরবত খেলেও মনে হয় নিমপাতার রস খাচ্ছি। মধুজা রায়ের ঘটনা অন্যরকম। মেজাজ বিগড়নোর সময়ে তার নাকের ভিতর সুড়সুড় করে। বার বার নাকে হাত দিতে ইচ্ছে করে। নাকে হাত দেওয়া একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। মনে হয়, নাক খুঁটছে। মধুজা রায় একজন মহিলা এবং ডাকসাইটে প্রফেসর। তার পক্ষে প্রকাশ্যে এই কাজ অস্বস্তিকর। আবার না করে উপায়ও নেই। নাকের ভিতর সুড়সুড় এমন একটা ঝামেলা যে, মুক্তির দ্বিতীয় বিকল্প নেই। মনে হয়, নাকে হাত না দিলে এক্ষুনি মারা যেতে হবে। সব মিলিয়ে খুবই ঝামেলা। তাই যতক্ষণ নাক সুড়সুড় ধরনের মেজাজ খারাপ থাকে, ততক্ষণ মধুজা রায় টেনশনে থাকেন। যতটা না মেজাজের জন্য টেনশন, তার থেকে অনেক বেশি নাকের জন্য টেনশন।

লব ঘরে ঢুকল। তার মুখও থমথমে।

‘দিদি, চা খাবেন।’

মধুজা রায় এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা কেউ এসেছিল?’

লব বলল, ‘না, এখনও আসেনি।’

যেহেতু মধুজা রায় বেশিরভাগ দিনই ক্লাস নিতে পারেন না, এমনকী ইউনিভার্সিটিতে আসতেও পারেন না, তিনি এলে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে। সিলেবাস, পরীক্ষা, রেজাল্ট, গবেষণা নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা থাকে। প্রশ্ন থাকে। সেগুলোর সমাধান করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের রেকমেন্ডেশনে সই করানোর থাকে। অন্য প্রফেসরদের ফোন করানোর থাকে। সেই সঙ্গে ছেলেমেয়েরা জানতে চায়, ম্যাডাম আজ ক্লাস নেবেন কিনা। নাকি বসে থেকে থেকে চলে যেতে হবে? সব মিলিয়ে ঘরের বাইরে একটা জটলা থাকে। মধুজা রায় এই জটলা পছন্দ করেন। বাইরের কেউ এলে এই জটলা দেখে মনে করবে, ইউনিভার্সিটিতে তিনি একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। সেই কারণেই ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগে আছে। যদিও ঘটনা সেরকম নয়। মধুজা রায়ের কাছে ছেলেমেয়েদের আসবার মূল কারণ তিনি ‘পাওয়ারফুল’। দু:খের হলেও কথাটা সত্যি, আজকাল দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকেও ছাত্রছাত্রীদের পাওয়াফুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেশি প্রয়োজন। তারা নানা ধরনের ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে। মধুজা রায় এই ব্যাপারে তালিকার ওপর দিকে। ছেলেমেয়েরা ভয়ে এবং লোভেই তাঁর কাছে ভিড় করে।

লব বলল, ‘না, এখনও তো ছেলেমেয়েরা আসেনি।’

মধুজা রায় ভুরু কোঁচকালেন। এই তথ্য তাঁর পছন্দ হল না। তিনি চিন্তিত হলেন। উদ্বেগ চেপে রেখে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কেন! তাদের কী হল?’

লব এখানে তিরিশ বছর ধরে পিওনের কাজ করছে। প্রফেসর, অফিসারদের মেজাজমর্জি তার ভালো জানা আছে। মধুজা রায়কেও সে হাড়ে হাড়ে জানে। তার রাগ, মেজাজ, বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না। তার ওপর ইদানীং এই মহিলার ওপর রাগ হয়েছে। বাঁকুড়ার এক কলেজের অফিসে ভাগ্নেকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিল। ক্লার্কের পোস্ট। তার কাছে খবর ছিল, ওই কলেজের গভর্নিং বডিতে মধুজা রায়ের তিনজন চেনাজানা আছে। বললেই হয়ে যেত। তার পরেও মহিলা কিছু করেনি। শুধু করেনি বললে ভুল বলা হবে, এই ফাঁকে অন্য একজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই ছেলে অতি বদ। মধুজা রায়ের সঙ্গে চেনাজানার কথা নিজেই বলে ফেলেছে। একদিন ঝগড়ার সময় অফিসে গলা চড়িয়েছিল। সেখান থেকে জানাজানি হয়েছে। লবের কাছেও খবর এসে গেছে।

‘আমি কলকাতার মধুজা ম্যাডামের পরিচিত। আমাকে কেউ কিস্যু করতে পারবে না।’

এরপরই লবের রাগ বেড়ে গেছে। সেও বিরক্ত গলায় বলল, ‘ছেলেমেয়েরা কেন আসেনি, তা তো বলতে পারব না দিদি। আমি তো ছেলেমেয়েদের কাজ করি না। আমি আপনাদের কাজ করি।’

মধুজা রায় লবের বিরক্তি আঁচ করতে পারলেন। মাথায় সাৎ করে রক্ত চড়ে গেল। তার পরেও চুপ করে গেলেন। এদের ঘাঁটানো বিপদ। এরা স্টুডেন্টদের মতো চুপ করে থাকবে না। হয় ফস করে মুখের ওপর একটা অপমানজনক কথা বলে দেবে, নয় এমন কলকাঠি নাড়বে যে, কঠিন গোলমালে পড়ে যেতে হবে। তবে ছেলেমেয়েদের না-আসাটা ভালো লাগছে না। মনের ভিতর খচখচ করছে। কী হল?

‘চা খাবেন দিদি?’

‘না। তুমি এখন যাও লব। দরকার হলে ডাকব। আর স্টুডেন্টরা কেউ এলে বলবে, আজ দেখা করতে পারব না। আজ আমি ক্লাসও নেব না। আমার অন্য কাজ আছে।’

লব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মধুজা রায়ের মোবাইল বেজে উঠল। রিং টোনে পিয়ানোয় রবীন্দ্রনাথের গান। কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া…। চড়া নয়, চাপা বাজনা। এই গান মধুজা রায়ের পছন্দ নয়। আজকের দিনে আপনা ভুলিয়া বলে কিছু হয় না। এসব কথা রবীন্দ্রনাথের আমলে ছিল। এখন অবসলেট হয়ে গেছে। তার পরেও মধুজা গানটা মোবাইলে রেখেছেন। তাঁর কাছে খবর আছে, রাজ্যের একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী মোবাইলে এই গান রিং টোন করেছেন। যদি তার সঙ্গে কোনওদিন দেখা হয় এবং সেই সাক্ষাতে মোবাইল বেজে ওঠে, তাহলে কিছু একটা হলেও তো হতে পারে। এই আশায় রাখা। আদৌ তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা, দেখা হলে মোবাইল বাজবে কিনা, বাজলে মন্ত্রীসাহেব খুশি হবেন কিনা, হলে তিনি কিছু পাইয়ে দেবেন কিনা, সেসব কিছুই এখন বলা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি হয়? যদি কখনও কোনওদিন তার সঙ্গে দেখা হয় আর তখন যদি ফোন বেজে ওঠে অথচ সেই ফোনে আপনা ভুলিয়া গান না বাজে? তাহলে একটা আপশোসের ঘটনা হবে। মধুজা রায় চান্স নিয়ে রেখেছেন। অতি তুচ্ছ ঘটনাও জীবনে বড় মোচড় আনতে পারে। এরকম একটা ব্যাপার তাকে একসময়ে অনেক উপকার দিয়েছিল। সেও গান ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান নয়, অগ্নিগর্ভ বিপ্লবের গান। আগের গভর্নমেন্টের আমল তখন। পার্টি অফিসে শিক্ষা সেলের এক নেতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল একদল অধ্যাপক। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ঠিক করা নিয়ে জটিলতা হচ্ছিল। কাউন্সিলে দুজন অন্য মতের অধ্যাপক ঢুকে পড়েছিল। তাদের কীভাবে ঠেকানো যায় তাই নিয়ে মিটিং। মধুজা রায় তখন অল্প অল্প করে ক্ষমতাবানদের কাছাকাছি আসছেন। আরও আসবার জন্য ব্যগ্র। তিনি ম্যানেজ করে অধ্যাপকদের দলে ঢুকে পড়লেন। পৌঁছে গেলেন পার্টি নেতার কাছে। শিক্ষা সেলের নেতা খুবই পরিশীলিত মানুষ। পার্টির ভ্যাদভ্যাদে অশিক্ষিত মিটিং, মিছিল করা কর্মীদের থেকে শিল্পী সাহিত্যিক শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। শিক্ষার সঙ্গে সুন্দরী মহিলা যুক্ত থাকলে তো কথাই নেই। কথা বলবার উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে যেত। যাবেই তো। নারী শিক্ষাই তো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নেতা অতি উৎসাহে সেদিন নিজের গল্প শুরু করেন।

‘সে একটা সময় ছিল বুঝলেন। আমার তরুণ বয়েসের সময়। আমরা কমিউনিস্টরা তখন উদ্দাম, আমরা কমিউনিস্টরা তখন আগুন, আমরা কমিউনিস্টরা তখন সমাজ গড়বার লক্ষ্যে মাতোয়ারা। এই সময় সরকার আমাদের ওপর নামিয়ে এনেছে প্রবল দমনপীড়ন। একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আপনাদের মতো বড় মানুষদের কাছে সেই কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। সেদিন ছিল আমাদের সভা। আমরা গাইছিলাম গান। সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখ, পথে দেখ, পথে দেখ…’ ফাটা রেকর্ডের মতো কয়েকবার ‘পথে দেখ পথে দেখ’ বলে শিক্ষা-নেতা থমকে গিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘উফ! কী যেন পরের কথাটা…কী যেন…আহা! আমাদের যৌবনের সেই গান…আজ আর পুরোটা মনে পড়ে না।’

পিছনে বসা মধুজা রায় ভয়ে ভয়ে বলছিলেন, ‘আমি বলব স্যার?’

নেতা চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। খানিকটা বিস্মিত, খানিকটা মুগ্ধ।

‘বলুন।’

মধুজা বললেন, ‘সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখ হায়নার আনাগোনা।’

নেতা চওড়া হেসে বললেন, ‘ইয়েস হায়না, মনে পড়েছে হায়না, দে আর হায়নাজ। থ্যাঙ্কু ম্যাডাম। থ্যাঙ্কু ভেরি মাচ। তারপর কী হল শুনুন। আমরা তো স্টেজে গান ধরেছি। হঠাৎ দেখি পুলিশ…।’

এর সাত দিনের মধ্যে সেই নেতা মধুজা রায়কে ফোন করলেন।

‘আছেন কেমন? শুনুন নর্থবেঙ্গলের শিক্ষামেলায় একটা সেমিনার হচ্ছে। আমি আপনার নাম বলেছি। আপনি কিন্তু না করবেন না। আপনাদের মতো লেখাপড়া জানা মানুষ এগিয়ে না এলে হবে না।’

একেবারেই হঠাৎ শিকে ছিঁড়ল। পাড়ার মোড়ে শোনা গানের কলি মনে ছিল বলেই না চেনা পরিচয় হয়েছিল অত বড় নেতার সঙ্গে। তারপর কতবার যাতায়াত। থাক সে কথা। আসল কথা, কী থেকে কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে! একটা সময় ‘হায়না’ যখন এই কাণ্ড করতে পেরেছে, এখন খোদ রবিঠাকুর কতটা পারবেন তার ঠিক আছে? যদি দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রীর মনে ধরে যায়?

এই কারণেই মোবাইলে গান রাখা। অতীতের শিক্ষা।

ফোন তুললেন মধুজা। ফোনে নাম দেখলেন, অভ্রনাথ। উফ ছেলেটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে। বউয়ের ট্রান্সফার চায়। একটা ধমক দেওয়া উচিত।

মধুজা রায় নিজেকে সামলালেন।

‘তোমাকে তো বলেছি অভ্রনাথ, আমি কথা বলব। নর্থবেঙ্গল থেকে কলকাতার কলেজে নিয়ে আসা তো হুট বলতে হয় না। তুমি ধৈর্য ধরো।’

ওপাশ থেকে অভ্রনাথ গদগদ গলায় বলল, ‘অবশ্যই ধৈর্য ধরব মধুজাদি। শুধু ধৈর্য কেন, আপনি যা বলবেন তাই ধরে বসে থাকব। আপনি যেরকম বলবেন সেরকমটাই করব।’

মধুজা রায় গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, ‘করছ কই অভ্রনাথ? আরে ট্রান্সফারের জন্য তো পদ্ধতি প্রকরণ আছে। সেগুলো মানতে হয়। আমি না হয় কয়েকটি স্টেপ কমিয়ে দেব। সবক’টা তো পারব না। তুমি আমাকে আর ফোন কোরো না। সময় হলে আমি যোগাযোগ করে নেব’খন।’

‘আপনি যা বলবেন, তাই হবে মধুজাদি। আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে চিনি না।’

ন্যাকা। মুখে আপনি কাউকে চিনি না বলছে, এদিকে আরও তিনজনকে ধরে বসে আছে। কিছু করার নেই। লবি রাখতে এসব সহ্য করতে হয়। নইলে অভ্রনাথরাই অন্য দিকে চলে যাবে। ফোন কেটে মধুজা রায় দেখলেন, মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে। নাক সুড়সুড়ানি বাড়ছে।

মেজাজ বিগড়ানোর ঘটনা সকাল থেকে পরপর ঘটছে।

প্রথমটা ঘটিয়েছে কমলা। রান্নার লোক। আজ আবার কামাই। গত দু’মাসে দু’বার হয়ে গেছে। তবে সেগুলো ছিল জানিয়ে। আজ না জানিয়ে। রান্নার লোক কামাই করা মানে সব ঘেঁটে যাওয়া। ইন্টেলেকচুয়্যালপনা, সকাল থেকে ফোনে ধান্দাবাজি, গ্রুপবাজি সব সব বন্ধ। রান্নাঘরে ঘেমেনেয়ে একসা হয়ে রান্না করতে হয়। সুশান্ত আবার আজ বাজার করেছে বোকার মতো। গাদাখানেক মাছটাছ এনে একাকার কাণ্ড। মধুজার ইচ্ছে করছিল, ছুড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিই। প্রথমে খুব একচোট চেঁচামেচি করলেন। সুশান্ত বেচারি ভয়ে জড়সড় মেরে গেলেন। আমতা আমতা করতে থাকেন।

‘আমি তো জানতাম না কমলা আসছে না।’

‘কেন জানবে না? সংসার কি শুধু আমার? সব জানা আমাকে জানতে হবে?’

সুশান্ত স্ত্রীর চেঁচামেচিতে ভীত হয়ে বললেন, ‘তা নয়। বাজারে যাওয়ার আগে যদি একবার বলতে…।

‘কী করে বলব? কমলা কি আমাকে জানিয়েছে? বজ্জাত কোথাকার। জানালেই বা কী? মনে করে তোমাকে বলতে হবে? দেখতে পাচ্ছ না সকাল থেকে আমি লেখাপড়া করছি। ক্লাস আছে না আজ। তোমাদের মতো তো চাকরি নয়। দুটো কম্পিউটার টিপলেই হয়ে গেল। মাস গেলে গাদাখানেক মাইনে। প্রতিদিন আমাদের লেখাপড়া করে উপার্জন করতে হয়। ইস কেন যে মরতে এত পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। তার থেকে বাড়ির বউ হয়ে সকাল থেকে আনাজপাতি নিয়ে বসা ভালো। বদ মেয়েছেলেটা একবারও কি আমাকে জানাতে পারল না?’

এই ধাক্কা সামলানোর আধঘণ্টা পরে ফোন করল বীতশোক। ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র। খেলুড়ে ছেলে। সবদিক হাতে রেখে চলে। বাড়িতে ফোন করে ল্যান্ড ফোনে। ইচ্ছে করে ল্যান্ড। যাতে পরে কাউকে নম্বর দেখিয়ে চট করে প্রমাণ না করা যায় ফোন করেছিল। মধুজা রায় মাছ ধুচ্ছিলেন। আঁশটে হাতে কানে রিসিভার ধরলেন। ‘ম্যাডাম, জরুরি কথা আছে।’

‘কী হয়েছে?’ বিরক্ত গলায় বললেন মধুজা রায়।

বীতশোক নীচু গলায় বলল, ‘ডিপার্টমেন্টে কী প্রবলেম হয়েছে?’

মধুজা রায় থমকে গেলেন, ‘কী হয়েছে বলো তো?’

বীতশোক বলল, ‘আমি পুরোটা শুনিনি। ওভারহিয়ার করলাম। কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দমদা বলাবলি করছিল।’

মধুজা রায় বললেন, ‘চুপ করলে কেন? কী বলাবলি করছিল ওরা।’

বীতশোক খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘ফাইনাল ইয়ারের বারিধারা, বারিধারা সেন, তাকে নাকি কোন ছেলে অ্যাবিউস করেছে। সে প্রাোটেস্ট করেছে। চড়ও মেরেছে। আপনি…।’

মধুজা চাপা গলায় বললেন, ‘আমি কী?’

বীতশোক একটু থেমে বলল, ‘আপনি নাকি সেই ছেলেকে শেল্টার দিচ্ছেন। সে নাকি আপনার পরিচিত। আমি কিছু জানি না। যেটুকু শুনলাম মনে হল আপনাকে জানানো জরুরি। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অরিন্দমদা বলল, এরকম হলে ওরাও চুপ করে থাকবে না। ছেলেমেয়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। ঘটনার প্রতিবাদ করবে।’

শরীর ঝনঝন করে উঠল মধুজা রায়ের। কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দম দুজনেই তার বিরুদ্ধে। দুটোই পাজি। সমস্যা হল, এরা কোনও লোভেই বশ মানে না। ছেলেমেয়েদের কাছে পপুলার টিচার। শিক্ষিত লোক ধান্দাবাজ হলে যেমন মারাত্মক, তেমন মেরুদণ্ড শক্ত হলেও বিপজ্জনক। এরা তাই। মেরুদণ্ড শক্ত থাকা মানুষ। সামনে পাত্তা না দিলেও মনে মনে মধুজা রায় এদের সমঝে চলেন। হাতে ক্ষমতা নেই বলে, এরা কিছু বলে না, তবে চান্স পেলে ছাড়বে না। তবে বীতশোক ছোকরাকে কিছু বলা ঠিক নয়। বললেই হয়তো ওদের ফোন করে জানাবে। মধুজা রায় শান্ত গলায় বললেন, ‘ও কিছু নয় বীতশোক। তুমি চিন্তা কোরো না। ওই দুটো তো আমার পিছনে লাগবে বলে সমসময় রেডি হয়ে থাকে। লাভ হবে না। মধুজা রায়ের হাত অনেক বড়।’

ফোন ছাড়বার পর থেকে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল।

সেই মেজাজ বিগড়ানো ইউনিভার্সিটিতে এসে বাড়ছে। তিনি থম মেরে বসে আছেন। নাক সুড়সুড় করে উঠল। মধুজা রায় হাত তুললেন। ইস, হাতে এখনও মাছ কাটবার আঁশটে গন্ধ। লব আবার ঘরে ঢুকল।

‘লব, ডিপার্টমেন্টে তিথি নামের মেয়েটা এসেছে কিনা খোঁজ নাও তো। এলে বলো, আমি ডাকছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *