একটু পরে রোদ উঠবে – ২০

কুড়ি

কমলকান্তি সেন মুগ্ধ এবং বিস্মিত।

শুধু মুগ্ধ এবং বিস্মিত বললে কম বলা হবে। তিনি অতিরিক্ত মুগ্ধ এবং অতিরিক্ত বিস্মিত। তার কারণ বড় কিছু নয়। কারণ দুটি রান্নার বই। প্রথমটি একটি সংকলন। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দুই রান্না বইয়ের সংকলন। বাংলায় লেখা প্রথম রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’ ও ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। দ্বিতীয় বইটি মনিরা বেগমের লেখা ‘বেগমের বাদশাহি রান্না’।

কিছুদিন হল কমলকান্তি সেনের সংগ্রহে বই দুটি এসেছে। রান্নার বই যে এমন হতে পারে, তাঁর জানা ছিল না। গোটা জীবন খাওয়াদাওয়া বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত থেকেছেন। নব্বই পার হয়েও কখনও ভাবেন না আজ কী খাব? তিনি মনে করেন, জৈবিক কারণে মানুষ খেতে বাধ্য হয়। কোনও বিকল্প নেই। এই কাজ নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামানো সময়ের অপচয়। কিন্তু রান্না একটি শিল্প। আর পাঁচটা বই পড়বার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই রান্নার বইয়ের প্রতি কৌতূহল বোধ করেছিলেন। কয়েকটি বই উলটেপালটে দেখার পর সেই কৌতূহল আগ্রহে পরিণত হয়, তার পর থেকেই তিনি দেশি-বিদেশি নানা ধরনের রান্নার বই সংগ্রহে আনাচ্ছেন। এই বই দুটি সেই পথেই হাতে এসেছে। বইদুটি শুধু রেসিপি নয়, গবেষণাগ্রন্থও বটে। কত পরিশ্রম! কত যত্ন! এক যুগের মানুষ পরের যুগের মানুষের জন্য তার জ্ঞান, কীর্তি, সংস্কৃতি, রুচি সম্পদ হিসেবে রেখে যায়। এটাই নিয়ম। রান্নার আদবকায়দা জানিয়ে যাওয়াও তাই। যুগের পর যুগ খাবারের স্বাদ ধরে রাখবার আয়োজন। বিভিন্ন দেশ, ধর্ম, জাতি নিজেদের খাবারের স্বাদ, রুচি, সংস্কৃতিকে পরম আদরে অন্য দেশ, ধর্ম, জাতির হাতে তুলে দিয়েছে। কমলকান্তি জানেন, কিছু ভুয়ো ইনটেলেকচ্যুয়াল মনে করে, পাকপ্রণালী নিয়ে আলোচনা, চর্চা অর্থহীন। খাওয়ার মতো হেঁশেল বিষয়টাই নিম্নবুদ্ধির। কমলকান্তি সেন তাদের জন্য করুণা বোধ করছেন। বোকার দল। তিনি ক্রমশ বুঝতে পারছেন, রন্ধনশিল্প একটি উঁচুদরের শিল্প তো বটেই, সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সভ্যতা ও ইতিহাস ধরা আছে। গুহামানব এক সময় পশুর মতো কাঁচা মাছ মাংস খেত। বুনো গাছপাতা খেত। যত সে সভ্য হতে লাগল, বুঝতে পারল, সে পশু নয়, তার খাদ্যে স্বাদ প্রয়োজন। সেই স্বাদ তাকে তৈরি করে নিতে হবে। তাকে সভ্য হতে হবে। এই শিল্পে যে এতরকম মাত্রা আছে, তাঁর জানা ছিল না।

তবে শুধু বই নয়, আজ এই বয়সে কমলকান্তি সেনের মনে হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক কিছু না জেনেই চলে যেতে হবে। সেটা একদিক থেকে যেমন দু:খের, তেমন আনন্দেরও। মৃত্যুর মুহূর্তে মনে হবে, আরও ক’টাদিন বেঁচে থাকলে ভালো হত। পৃথিবীর মতো সুন্দর আর বিস্ময়কর জায়গা থেকে কত কম জেনে বিদায় নিতে হচ্ছে। এটা একটা মন খারাপের কথা। আর আনন্দের বিষয় হল, মনে হবে, ভাগ্যিস মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম। কোনও আপশোস নেই। যা পেয়েছি, তাই অনেক। এত পাবার কি আমি যোগ্য ছিলাম? না, ছিলাম না। পৃথিবী সুন্দর বলেই এই অকৃতী, অধমকে সে অনেক কিছু দেখাল, জানাল। তার কাছে আমি ঋণী রইলাম।

কমলকান্তি তাঁর ইজি চেয়ারে আয়েস করে বসেছেন। বাঁ হাতের কনুইয়ের জ্বালাটা কমেছে। খানিক আগে মণিকুন্তলা তার ঘরে চা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বড় মগের লিকার চা। ছেলের বিয়ের পর পরই কমলকান্তি বলে দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাইকে সেবা করবার জন্য তিনি ছেলের বিয়ে দেননি। বাড়িতে তিনি ছেলের বউ এনেছেন, তাঁর জন্য নার্স বা সেক্রেটারি আনেননি। সুতরাং চা, জল, খাবার, ওষুধ, চাদর, অফিসের ব্যাগ নিয়ে মণিকুন্তলা যেন তাঁর কাছে না আসে। এর জন্য নির্দিষ্ট কাজের লোক বাড়িতে আছে। তারা সেই কাজ করবে। এমনকী বিয়ের পর মণিকুন্তলা শ্বশুরমশাইয়ের খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

‘কী চাই?’

মণিকুন্তলা থতমত খেয়ে বললেন, ‘না, আপনি খাচ্ছেন…।’

কমলকান্তি ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আমি খাচ্ছি তো কী? তোমার তদারকিতে সবই তো সুন্দর করে গোছানো আছে। আমি চটপট খাব আর অফিসে ছুটব।’

মণিকুন্তলা আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘না, মানে যদি কিছু লাগে…।’

কমলকান্তি চাপা গলায় বললেন, ‘কিছু লাগলে তুমি কী করবে? বীণার মা নেই? এটা তো তার কাজ।’

মণিকুন্তলা এবার নিজেকে সামলে নেন। মৃদু স্বরে বলেছিলেন, ‘আমারও কাজ বাবা। আপনার খাওয়ার সময় পাশে থাকাটা এ বাড়ির বউ হিসেবে আমার কর্তব্য।’

কমলকান্তি বুঝতে পারলেন, এই মানসিকতা ভাঙতে গেলে কঠিন কথা বলতে হবে। তবে বিষয় কঠিন হলেও বলার ভঙ্গি যেন কড়া না হয়। মেয়েটি অতি ভালো। সে এতদিন যা জেনে এসেছে, সেটাই করছে।

কমলকান্তি মৃদু হেসে বললেন, ‘শ্বশুরবাড়ির প্রতি বাড়ির বউয়ের কর্তব্য বিষয়ে সিলেবাস কে তৈরি করেছে মণিকুন্তলা? সেই সিলেবাস কমিটিতে কারা ছিল? পুত্রবধূরা কি কেউ ছিল? নাকি শুধুই শ্বশুরমশাইদের মেম্বার করা হয়?’

মণিকুন্তলাও হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আপনার খাওয়ার সময় আমি দাঁড়ালে আমার কোনও সমস্যা নেই বাবা। আমার তো এখন কোনও কাজ নেই। তাছাড়া আমার ভালো লাগবে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘আচ্ছা, দাঁড়াতে হবে না। তুমি ওই চেয়ারটায় বসো। বসে আমাকে বলো, তুমি কি কখনও তোমার বাবার খাওয়ার সময় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে?’

মণিকুন্তলা মজা পেয়েছিলেন। এ কেমন মানুষ রে বাবা! চিরকাল সবার কাছ থেকে শুনে আসছেন, খাবার সময় শ্বশুর-শাশুড়ির পাশে হাজির থাকাটা অবশ্য কর্তব্য। তার বান্ধবী, আত্মীয়রা কতবার ‘এই রে শ্বশুরমশাইয়ের খাবার টাইম হয়ে গেছে। আমি এবার পালাব’—বলে আড্ডা ভেঙে ছুটেছে। চাকরি করলে, ফাইল দেখতে দেখতে বা মিটিং করতে করতে, স্কুল-কলেজ হলে ক্লাসে পড়াতে-পড়াতে বা টিফিন খেতে খেতে বাড়িতে ফোন করেছে। চাপা গলায় কাজের লোকের কাছে থেকে রিপোর্ট নিয়েছে। ‘হ্যাঁ গো রতনের মা, বাবা খেতে বসেছেন? ডালটা দিয়েছ তো…মুগ, মুসুর দুটোই দিয়েছ তো? ভেরি গুড। খান না খান, রোজ দুরকম ডাল দেবে…তরকারি ঠিক আছে?…অ্যাঁ! কী বলছ? একটু মুখে দিয়েই সরিয়ে রাখলেন…সর্বনাশ! কেন? কী হল আবার…ঝাল বেশি বলছে…উফ রতনের মা, তোমাকে না বারবার বলেছি…ঝাল কম দেবে, ঝাল কম দেবে…বাড়ি ফিরে আমাকে একচোট শুনতে হবে, বাবাও বলবেন, তোমাদের দাদাবাবুও বলবে…যাক, মাছ দুটো দিয়েছ তো? অ্যাঁ! দুটো দাওনি! করেছ কী! কেলেঙ্কারি করেছ…তোমাকে যে পইপই করে বলে এলাম, খাক না খাক দুটো মাছ দেবে…বাটিতে দুটো মাছ দেখলে মানুষটা শান্তি পায়…ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে…এত বোঝো আর এটুকু বোঝো না? আমাকে বিপদে না ফেলে তুমি ছাড়বে না দেখছি রতনের মা…আমাকে চাকরিটা ছেড়ে হেঁশেল ঠেলতে হবে…টক দইটা দিয়েছ…খাবে না বলছে? কেন! দই আবার কী করল? তার ওপর রাগ কেন? সে তো আর তার ছেলের বউয়ের মতো চাকরি করতে যায়নি…গলা ব্যথা বলছে?…কী ঝামেলা…মানুষটা তো জ্বালিয়ে মারবে দেখছি…মতলব অন্য…চাইছে আমি কাজকর্ম ছেড়ে বাড়ি বসে ওনার সেবা করি আর বলি, বাবা এটা নিন, বাবা ওটা নিন…ধ্যুস…’

এই মানুষটা তো একেবারে উলটোকথা বলছে!

কমলকান্তি বললেন, ‘চুপ করে আছ কেন? উত্তর দাও। বিয়ের আগে তুমি কি খাবার সময়ে তোমার বাবার পাশে দাঁড়াতে?’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘রোজ পারতাম না। মাঝে মাঝে দাঁড়াতাম। মা থাকেন।’

কমলকান্তি বললেন, ‘ভালো কথা। আমার এখানেও তাই হবে। মাঝে মাঝে আসবে। এসে গল্প করবে। খাবার টেবিলে গল্প হজমের জন্য ভালো। সাহেবরা করে। তবে অফিস বেরোনোর সময় গল্পের কতটা সময় থাকবে জানি না। একটা কাজ করা যাক, রাতে আমরা একসঙ্গে বসে খেতে পারি। তখন কথা হবে। কিন্তু নিয়ম করে আমার খাবার সময়ে এসে হাজিরা দেওয়া চলবে না।’

মণিকুন্তলা আর পারেননি। মুচকি হেসে ফেলেন। গলায় কৌতুক নিয়ে বলেন, ‘খাবার সময় আমি থাকলে আপনার সমস্যা কী?’

কমলকান্তি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘একটাই সমস্যা। আমি জমিদার নই এবং তুমি জমিদারের পুত্রবধূ নও। তুমি যদি বলো, বাবাকে যত্ন করে খাওয়াতে আমার ভালো লাগে, আমি বলব এটা সত্য বলছ না। কম্পালসারি লাই। বাধ্যতামূলক মিথ্যে বলছ। লজ্জার কথা হল, আজও ছেলের বউদের শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে বানানো আদিখ্যেতা দেখাতে হয়। আমি এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে।’

‘আপনি বেশি ভাবছেন বাবা। সত্যি খাবার সময় আপনার পাশে থাকতে আমার ভালো লাগছে। আপনার ঠিকমতো খাওয়া হয় না। মা থাকলে একটা কথা ছিল। আর একটু ভাত দিই বাবা?’

কমলকান্তি বললেন, ‘তোমার বাবা-মাও তো এখানে নেই। তোমারও তো অভ্যেস বদলেছে। আমি কি তোমার খাবার সময় পাশে গিয়ে দাঁড়াই? বলি, আর একটু ভাত দেব মণিকুন্তলা? সবটাই পারস্পরিক হওয়ার কথা। ভালোবাসা, ভালোলাগা একতরফা হলেই সেটা বানানো, আদিখ্যেতা হয়ে যায়। হয় আদিখ্যেতা, নয় ফিউডাল অ্যাপ্রাোচ। সুতরাং আর নয়। আমি কেমন খেলাম, কী খেলাম, আর খাব কিনা—এইসব নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে আমি বিরক্ত হব। অসুবিধে হলে তো তোমাকেই জানাব। তুমিও জানাবে।’

এই ঘটনার পর থেকে মণিকুন্তলা মানুষটাকে আরও বেশি পছন্দ করে ফেলেছিলেন। তিনি সামনে যেতেন না, তবে আড়াল থেকে কন্ট্রোল করতেন। এখনও করেন। আজও চা কাজের লোককে দিয়েই ওপরে পাঠিয়েছেন।

কমলকান্তি সেন বই খুললেন।

এই সব বই কি নিছকই সাজিয়ে-গুছিয়ে খিদে-তেষ্টা মেটানোর বই? এই বই কি ইতিহাস নয়?

বারিধারা ঘরে ঢুকে দাদুর ইজিচেয়ারের পাশে মোড়া নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। কমলকান্তি বই থেকে মুখ না সরিয়ে বললেন, ‘কী বৃষ্টি দিদিমণি, আজ ইস্কুল যাওয়া নেই?’

বারিধারা ঘরে ঢুকে দাদুর গায়ে হাত দিয়ে রাগ রাগ গলায় বলল, ‘না ইস্কুল যাওয়া নেই। আজ ইস্কুল ছুটি। আজ আমার ইউনিভার্সিটি যাওয়া আছে। তবে দেরিতে যাওয়া আছে।’

কমলকান্তি এবার মুখ ফেরালেন। হাত বাড়িয়ে নাতনির চুল ঘেঁটে হেসে বললেন, ‘ইস্কুল, ইউনিভার্সিটি একই হল।’

বারিধারা বলল, ‘দাদু তোমার সঙ্গে আমার ইমপর্ট্যান্ট কথা আছে।’

কমলকান্তি চোখ গোল গোল করে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার ভেরি ইমপর্ট্যান্ট কথা আছে বৃষ্টি।’

বারিধারা বলল, ‘আমারটা আগে শুনতে হবে। লেডিস ফার্স্ট।’

কমলকান্তি ঝগড়ার অভিনয় করে বললেন, ‘অসম্ভব। বুড়ো ফার্স্ট।’

বারিধারা বলল, ‘উফ দাদু, ঠাট্টা নয়। আমার কথা শুনলে তুমি ঘাবড়ে যাবে।’

কমলকান্তি ইজি চেয়ারেই একটু ঘুরে বসলেন যেন। কোমর বেঁধে লড়াই করবার ঢঙে বললেন, ‘আমার কথা শুনলে তোর চোখ কপালে উঠবে।’

বারিধারা বুঝতে পারল, দাদু এখন ঠাট্টার মেজাজে আছে। থামানো যাবে না। ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা, বলো। আগে তুমিই বলো। বুড়ো ফার্স্ট চান্স পাক।’

কমলকান্তি একটু চুপ করে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, বৃষ্টি, তোরা কুলফি খাস?’

বারিধারার চোখ চকচক করে উঠল। বলল, ‘কী বলছ দাদু! কুলফি খাব না! বেস্ট ডেসার্ট ইন ওয়ার্ল্ড। ভালো রেস্টুরেন্টের কুলফি খেলে তুমি পাগল হয়ে যাবে। খাবে?’

কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘ভাবছি খাব। তোর মা বানাতে পারবে?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘কেন পারবে না? তার ওপর তুমি খেতে চেয়েছ বলে কথা। খাওয়া নিয়ে যার কোনও চাওয়াচায়ি নেই, সেই মানুষটা মুখ ফুটে কিছু খেতে চাইলে মা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু এই কি তোমার ইমপর্ট্যান্ট কথা দাদু? কুলফি খাওয়া?’

কমলকান্তি বললেন, ‘একেবারেই না। ইমপর্ট্যান্ট কথা অন্য। বৃষ্টি, তুই কি জানিস, এখন যেভাবে কুলফি বানানো হয়, সেই পদ্ধতি কে তৈরি করেছিল?’

বারিধারা বলল, ‘ও তাই বলো। রেসিপি বুক পড়তে পড়তে তোমার মাথা গেছে। নিশ্চয় কোনও সাহেব বানিয়েছিল।’

কমলকান্তি ঘাড় নাড়িয়ে, গোয়েন্দা গল্প বলবার ঢঙে চাপা গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘একেবারেই নয়। নো সাহেব। মোগল সম্রাট আকবরের নাম শুনেছিস তো? সম্রাট জালাউদ্দিন মুহম্মদ আকবর? তাঁর ছিল বিশাল বাবুর্চিখানা। বাবুর্চিখানায় মেন শেফকে বলা হত মির বাকবাল। তাঁর আন্ডারে ছিল অসংখ্য বাবুর্চি। প্রতিটা খাবারের পাত্র কাপড় দিয়ে থাকত মোড়া। তার ওপর থাকত খাবারের নাম আর বাবুর্চির সিলমোহর। মানে, দিস ফুড ইজ সেফ। বৃষ্টি, তুই শুনলে এক্সাইটেড হবি যে আকবরের বাবুর্চিরা যে পদ্ধতিতে বাদশাহের জন্য কুলফি বানাত, আজও সেই একই টেকনিকে কুলফি বানানো হয়। এমনকী তোর জন্যও।’

বারিধারা চোখ বড় করে বলল, ‘বলো কী দাদু! রিয়েলি?’

কমলকান্তি বই এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বিশ্বাস না হলে এটা পড়ে দেখ।’

বারিধারা বলল, ‘ইন্টারেস্টিং।’

কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘আর ইমপর্ট্যান্ট নয়?’

বারিধারা সুন্দর হেসে বলল, ‘অবশ্যই ইমপর্ট্যান্ট। আজ যে আমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার থেকে বেশি ইমপর্ট্যান্ট তো বটেই।’

একুশ

কমলকান্তি শান্তভাবে বললেন, ‘কী করবি?’

বারিধারা বলল, ‘দাদু, তুমি জানো, আমি কী করব।’

কমলকান্তি বললেন, ‘আন্দাজ করতে পারছি। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টে এক নম্বরে যে বোকার নাম রয়েছে, এই ধরনের সিচুয়েশনে সে কী করতে পারে, তার একটা আন্দাজ হচ্ছে। তার পরেও বল। তোর মুখ থেকেই সরাসরি শুনি। অনেক সময় বোকার মুখ থেকে বোকামি শুনতে ভালো লাগে।’

বারিধারা বলল, ‘আমি মধুজা রায়কে গিয়ে বলব, সরি ম্যাডাম, আমি আপনার আদেশ মানতে পারলাম না। আমি যা করেছি, ঠিক করেছি। ক্ষমা চাইবার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।’

কমলকান্তি একটু ভাবলেন। তার পর হালকা করে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আমি আঁচ করছিলাম এই ধরনের কোনও কথাই তুই বলবি। আমি এখনকার সিস্টেমটা জানি না। আমাদের সময় স্কুল-কলেজে স্বদেশী করে অনেক দীপান্তরিত হত। এখন সম্মান বাঁচাতে গিয়ে কোন ধরনের সাজা হতে পারে, আমার জানা নেই। তুই তো জানিস বৃষ্টি খবরের কাগজ, টিভির সঙ্গে আমি নেই। ইন ফ্যাক্ট ওরাই আমার সঙ্গে নেই বলতে পারিস। এই ডিশিশনের কারণে তোর কী কী বিপদ হতে পারে আমি কি জানতে পারি?’

বারিধারা চুপ করে রইল। বিপদ যে অনেক রকম হতে পারে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মুখে যতই সাহস দেখাক, আজ সকাল থেকে তার নার্ভাস লাগছে। নার্ভাস লাগাটাই স্বাভাবিক। যত সময় যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে, সত্যি বড় ধরনের ঝামেলার মধ্যে সে জড়িয়ে পড়তে চলেছে। মধুজা রায় তাকে এমনি হুমকি দেয়নি। নিজের ক্ষমতা বুঝেই দিয়েছে। সব থেকে মুশকিল হয়েছে, ঘটনা কাউকে না বলায়। এতে বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। বাড়িতে বলবার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কাকে বলবে? কে বুঝবে? এক দিদিকে বলা যেতে পারত। ক্রাইসিস সত্যি হলে দিদির মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বংশীবাদককে নিয়ে নাজেহাল। বংশীবাদক বাঁশির অংশ বাদ দিয়ে নানাবিধ জ্বালাতন করছে। আজ নাকি ভোর চারটেতে উঠে বাঁশি বাজাতে শুরু করেছিল। জামাইবাবু ঘুম ভেঙে উঠে বলেছে, ‘রোমাঞ্চকর’! অ্যালার্মের বদলে বাঁশি শুনে ঘুম ভাঙা রোমাঞ্চকর ঠিকই, কিন্তু সেটা একদিনের জন্য। রোজ ভোর রাতে যদি এই কাণ্ড হয়, তাহলে বিপদ। বাঁশি তখন বাঁশি থাকবে না। গুঁতো হয়ে যাবে। সবথেকে যেটা বিপজ্জনক সেটা হল, জামাইবাবু আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে ঘোষণা করেছেন, বাঁশি শিখবেন। দরকার হলে অফিস থেকে লম্বা ছুটি নেবেন। বাঁশি শিক্ষা ঠিকমতো হলে, চাকরিবাকরি ছেড়েও দিতে পারেন। তারপর বিবাগী হয়ে বংশীবাদকের মতো পথে পথে বাঁশি বাজিয়ে ঘুরবেন। জামাইবাবুর এই সিদ্ধান্ত দিদি মেনে নিতে পারছে না। বাঁশি শেখা খুবই সুন্দর একটা ব্যাপার, কিন্তু তা বলে ঘরসংসার ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়বার ইচ্ছা ভয়ঙ্কর। সকালে বোনকে এই বিষয়ে টেলিফোন করে একপ্রস্থ বলা হয়েছে।

‘আমার কী হবে বৃষ্টি?’

‘কী আর হবে, তুইও জ্যোতিষ্কদার সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়বি। বাউলানির মতো তুই হবি বাঁশিয়ানী।’

দিদি কঠিন গলায় বলল, ‘ফাজলামি করছিস? বাড়িঘর, সংসার ফেলে আমি তোর জামাইবাবুর সঙ্গে পথে ঘুরব?’

বারিধারা সামান্য হেসে বলেছে, ‘বাড়িঘর, সংসার ফেলে ঘুরবি কেন! সঙ্গে নিয়ে ঘুরবি। বাউল ফকিরের ঘরসংসার তো তাদের পথ, তাদের মুক্তি। তারা ইটকাঠের ঘর সংসারের মায়ায় আটকে থাকে না। তুই এটা জানিস না?’

দিদি কান্নাভেজা গলায় বলছে, ‘তোর জ্যোতিষ্কদাকে তুই তো জানিস বৃষ্টি। একবার যখন মাথায় পাগলামি ঢোকে, তখন সেটা কিছুতেই বেরোতে চায় না। চেপে বসে। সত্যি যদি এখন অফিস-টফিস ছুটি নিয়ে সে বাড়িতে বাঁশি শিখতে বসে, তাহলে কী হবে? আমার কান্না পাচ্ছে।’

বারিধারা বলল, ‘জ্যোতিষ্কদার বাঁশি শেখাটা কোনও ব্যাপার নয় দিদি, বাঁশি বাজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাই চিন্তার। বংশীবাদককে তো এখন আমার আরও ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে রে দিদি। ঠিক যেন হ্যামলিনের বাঁশিওলা। জ্যোতিষ্কদা, তুই, তোদের রান্নার মাসি, গাড়ির ড্রাইভার সবাইকে বাঁশি শুনিয়ে, মেসমারাইসড করে টেনে নিয়ে চলে যাবে।’

‘চড় খাবি বৃষ্টি। আমি আর তোর সঙ্গে একটা কথা বলব না।’

দিদি রেগেমেগে ফোন কেটে দেয়। সম্ভবত কাঁদতে চলে যায়। এই মানুষকে এখন ইউনিভার্সিটির ঝামেলার কথা বলে কী হবে? মাথা কাজ করবে না। বারিধারা একবার ভেবেছিল, তিথিকে ফোন করে জানাবে। নিজেই পিছিয়ে গেল। তিথি ভীতু মেয়ে। ঘাবড়ে যাবে। হয়তো কাঁপা গলায় বলবে, ‘কী হবে বারিধারা?’

‘কী আবার হবে, যা হওয়ার তাই হবে।’

‘ম্যাম তো মারাত্মক খেপে যাবেন।’

‘গেলে কী করব? ওই নোংরা ছেলের পা ধরে ক্ষমা চাইব?’

‘আমার খুব ভয় করছে বারিধারা।’

‘তোর কেন ভয় করবে? তোকে তো কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি। হবেও না। চড় মেরেছি আমি, মধুজা ম্যাডামের কথা আমি অমান্য করব। উনি কোনও অ্যাকশন নিলে আমার বিরুদ্ধে নেবেন। তুই এর মধ্যে কোথা থেকে আসছিস? ঘটনাটা তোকে নিয়ে শুরু, তাই জানিয়ে রাখলাম।’

তিথি ঢোক গিলে হয়তো বলবে, ‘সেই জন্যই তো আমার বেশি ভয় করছে। ইস আমার খুব খারাপ লাগছে।’

‘তুই ফালতু চাপ নিচ্ছিস তিথি। আমি ঠিক সামলে নেব।’

তিথি বলবে, ‘তোকে ঘটনাটা না বললেই হত। সবাই আমার ওপর রাগ করবে। বলবে, তোর জন্য মেয়েটা মাথা গরম করে বিপদে পড়ল।’

‘মাথা গরম করাটাই বড় হল তিথি! অপমানটা কিছু নয়? অতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে ওই বাস্টার্ড তোকে অমন একটা নোংরা কথা বলল…সেটা কিছু নয়?’

তিথি হয়তো আমতা আমতা করে বলবে, ‘সে তো কত লোকেই নোংরা হয় বারিধারা। পথেঘাটে, বাসে-ট্রামে দেখিসনি? ছুতোনাতায় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। খারাপ কথা বলে।’

‘পথেঘাটে, বাসে-ট্রামের নোংরা লোক আর সহপাঠী, সহকর্মী, চেনা লোকের নোংরামি এক হবে?’

তিথি নিশ্চিত এসব যুক্তি কানে নিত না। বলত, ‘ইস, কেন যে মরতে তোকে বলতে গেলাম। আমারই দোষ। ওসব কথা গায়ে না মাখলেই হত। তোকে যদি আমি না বলতাম, তুইও চড় মারতিস না। মধুজা রায় খুব পাওয়ারফুল….তোর কেরিয়ারের সমস্যা করে দিতে পারে।’

‘শুধু মধুজা রায় কেন? তার সঙ্গে ছেলেটার এক রিলেটিভও জুটেছে। তার নাকি আরও বেশি পাওয়ার। দুই পাওয়ার মিলে সুপারপাওয়ার আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে।’

তিথি এসব শুনলে আরও ঘাবড়ে যাবে। অবশ্যই কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে, ‘এখনও ঠাট্টা করছিস বারিধারা! আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

‘তুই একটা কাজ কর তিথি। হট ওয়াটার ব্যাগে গরম জল নিয়ে বসে হাত-পা গরম কর। আমি আমার কাজ করি।’

শ্রবণের ব্যাপারও তাই। সে তিথির মতো ঘাবড়ে না গেলেও চিন্তিত হবে। ওর নিজের কাজকর্ম আছে। বেশিটাই ভাবনা-চিন্তার কাজ। মাথায় এসব ঢুকলে সেই কাজে গোলমাল হবে। প্রেমের ব্যাপারে যতই ক্যাবলা হোক না কেন, ছেলেটা যে গুণী, সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। বাঁধাধরা নিয়ম নয়, নিজের গুণ দিয়ে উপার্জন করতে চায়। বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট তৈরি এখন ইন থিঙ্ক। গোটা দুনিয়াই বিজ্ঞাপনের ওপর চলছে। আবার এই লাইনে ভিড়ও খুব হচ্ছে। ইনোভেটিভ, ইমাজিনেটিভ ছেলেমেয়েরা আসছে। কেউ গাইতে পারে, কেউ আঁকতে পারে, কেউ ফটো তুলতে পারে, কেউ ভাবতে পারে। কেউ আবার মার্কেট অ্যানালিস্ট, প্রাোডাক্ট এক্সপার্ট, ম্যানেজমেন্ট এফিসিয়েন্ট। প্রতিযোগিতাও খুব। তবে এখানে তেমন কাজ নেই। এখানে ছোটখাটো কাজ করতে করতে হাত পাকিয়ে চলে যেতে হবে মুম্বাই। শ্রবণও হয়তো তাই যাবে। এখন খুব খাটছে। কাল বিকেলে শাম্বদের চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে দুজনে ট্যাক্সি নিয়েছিল। সোজা নন্দন চত্বর। কলকাতায় এখন প্রেম করবার জন্য নানারকম জায়গা হয়েছে। সুন্দর সুন্দর পার্ক। গঙ্গার ঘাটটাও চমৎকার হয়েছে। বসবার জায়গা, হাঁটবার বাঁধানো পথ, আলো। শপিং মলে ঢুকে গেলেও হয়। এক কাপ চা বা কফি নিয়ে যে-কোনও জায়গায় বসে যাও। নিউ টাউনের ইকো পার্ক তো খুবই সুন্দর। আর পকেটে পয়সা থাকলে তো কথাই নেই। সিসিডি, বারিস্তা তো এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। তবে প্রেম করবার জন্য বারিধারার সবথেকে বেশি পছন্দ নন্দন, নয়তো হন্টন। হয় নন্দন চত্বরে বসো, নয় পথে হেঁটে হেঁটে গল্প, ঝগড়া ভাব-ভালোবাসা করো। নন্দনের ওপর বারিধারা দুর্বল। সেখানেই শ্রবণের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। আলাপের ইস্যু ছিল আছাড়। কোনও প্রেম হয় দর্শনে, কোনও প্রেম হয় আকর্ষণে, কোনও প্রেম হয় শাসনে। এই প্রেম হয়েছিল আছাড়ে।

সেদিনটা চিরকাল মনে থাকবে বারিধারার। সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। আকাদেমির পাশ দিয়ে নন্দন চত্বরে ঢোকবার মুখটা ছিল কাদা কাদা। মাথায় ছাতা নিয়ে বারিধারা ঢুকছিল। নন্দনে সিনেমা দেখবে। পা টিপে হাঁটছিল বারিধারা। পিছলে না যায়। হঠাৎই ধপাস আওয়াজে মুখ ফিরিয়ে দেখে, পাশে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, তাড়াহুড়োর কারণে পা হড়কেছে। ছেলেটির কাঁধের ব্যাগ ছিটকে পড়েছে। ব্যাগ থেকে কাগজের বান্ডিল, রংতুলি, প্যালেট উঁকি মারছে। আর্টিস্ট। নন্দন চত্বরে আর্টিস্ট কোনও বড় বিষয় নয়। আর পাঁচজন পা হড়কে পড়লে যেমন বোকার মতো হাসে, এই ছেলেও হাসছিল। বারিধারার তাড়া ছিল, তার পরেও থমকে দাঁড়াল। সহজভাবে হাত বাড়িয়ে দিল। ছেলেটি লজ্জা লজ্জাভাবে হাত ধরে বলল, ‘ধন্যবাদ। এত কাদা…।’

বারিধারা বলল, ‘ইটস ওকে। সাবধানে উঠুন।’

ছেলেটি বলল, ‘সাবধানেই উঠছি… আপনাকে ধন্যবাদ…।’

আধখানা উঠে ছেলেটি আবার পা হড়কাল এবং আছাড় খেল।

একটা কাদামাখা মানুষকে ছেড়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া কঠিন। তার ওপর মানুষটি একজন শিল্পী। ছোট হোক, বড় হোক, মেজো হোক শিল্পী তো বটে। বারিধারা নীচু হয়ে বসে মাটিতে ছড়িয়ে পড়া আঁকার সরঞ্জাম তুলতে থাকে। নিজের রুমাল দিয়ে কিছু কিছু মুছেও দেয়। শ্রবণ খুবই লজ্জা পেয়েছিল।

‘আমি করে নিচ্ছি। আপনি কাজে যান।’

বারিধারা সে কথায় পাত্তা দেয় না। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে বলে, ‘হাতদুটো পাতুন।’

শ্রবণ বলে, ‘না না, ঠিক আছে।’

বারিধারা কঠিন গলায় বলে, ‘হাত না ধুলে আপনি যেটাই ধরবেন কাদা লেগে যাবে। কাগজ, ছবি, রং, তুলিতে কাদা লাগলে ভালো হবে? নিন, হাতটা এগিয়ে দিন। দেরি করবেন না। আমার তাড়া আছে।’

হাত ধোওয়ার পর শ্রবণ নিজেকে অনেকটাই সামলে নেয়। বারিধারা বিদায় নিয়ে দ্রুত পা চালায়। সিনেমার দেরি হয়ে গেল। সে আরও দ্রুত হাঁটে। কয়েক পা এগিয়ে ছোট লাফ দিয়ে খানিকটা জল টপকাতে যায় এবং এবার সে আছাড় খেয়ে পড়ে।

শ্রবণ প্রায় ছুটে এসে তাকে তুলতে যায়। বারিধারা কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে, সে দাঁড়াতে পারছে না। তার বাঁ পা মচকেছে। তার যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ে অচেনা তরুণটির ওপর। তার জন্যই দেরি, তার জন্যই তাড়াহুড়ো, তার জন্যই আছাড়, তার জন্যই পা মচকানো। তারপর…।

তারপর যাই ঘটুক, এই হল আছাড় প্রেম। আর এই কারণেই নন্দন চত্তরের প্রতি বারিধারা দুর্বল। বিশেষ করে যেখানে দুজনে আছাড় খেয়েছিল, সেদিকটা। কালও শ্রবণকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। রবীন্দ্র সদনের টিকিট কাউন্টারের সিঁড়িতে বসে চা খেল। চা খেতে খেতে বুঝল, তার ঠোঁটটা একটু ছড়ে গেছে। জ্বালা জ্বালা করছে। নিশ্চয় চুমু খাবার সময় শ্রবণের দাঁতে লেগেছে। জ্বালাটা ভালো লাগছে।

শ্রবণ বলল, আমাকে একটু হেল্প করবে বারি?’

বারিধারা বলল, ‘কী হেল্প? বাড়ি পৌঁছে দেব?’

শ্রবণ হেসে বলল, ‘না ধারা, তুমি আমাকে একটা অ্যাড কনসেপ্ট বলে দাও।’

বারিধারা বলল, ‘কীসের অ্যাড?’

‘ছাতা।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘ছাতা!’

শ্রবণ চিন্তিত হয়ে বলল, ‘আমি দু-একটা বানিয়েছি, কিন্তু জমছে না। চেনা চেনা হয়ে যাচ্ছে। সেই রোদ, বৃষ্টি, সুইমিং পুল। ধ্যুস। এদিকে টাফ কম্পিটিশন।’

এই ছেলেকে মধুজা রায়ের ঝামেলা বলে লাভ কী?

তার পরেও মনে হল, কারও সঙ্গে শেয়ার করা দরকার। সে ঘটনাটা গোপন রাখবে। আবার পরামর্শও দেবে। এই কাজটা একমাত্র পারে ওই বুড়ো মানুষটা। কমলকান্তি সেন। একানব্বুই বছর বয়সেও চিন্তাভাবনা কী পরিষ্কার! নিজের দাদু না হলে বিশ্বাস হত না। মনে হত, মিথ্যে বলছে। বারিধারা তাই তিনতলায় দাদুর কাছে এসেছে।

তখনও সে জানত না, কমলকান্তি সেন তাকে একটা মারাত্মক কাজ করতে বলবেন। বারিধারা চমকে উঠল।

বাইশ

বিমলকান্তি সেন একতলার ঘরে বসে আছেন। সামনে, টেবিলের ওপর অফিসের কাগজপত্র ছড়ানো। তিনি সেদিকে তাকাচ্ছেন না।

বিমলকান্তির মতো সিরিয়াস মানুষকে এ ধরনের আচরণে দেখা যায় না। তিনি কাজ সামনে নিয়ে বসে থাকায় বিশ্বাস করেন না। হয় কাজ করেন, নয় কাজ সরিয়ে রাখেন। যদি কখনও মনে করেন, এখন খাতায়-কলমে কাজ নয়, কাজ হবে মাথার ভিতরে, তাহলে তাই হবে। তিনি আর পাঁচটা বিষয়ের মতো ভাবনাকেও সিরিয়াসভাবে দেখেন। তিনি মনে করেন, যদি ভাবার দরকার হয়, তাহলে মন দিয়ে ভাবা উচিত। অনেকেই একটা কাজ করতে করতে অন্য কিছু নিয়ে ভাবে। অনেকটা প্যারালাল থিঙ্কিং-এর মতো। একটার সঙ্গে একটা কাজ করার অর্থ, কোনওটাতেই উপযুক্ত গুরত্ব না দেওয়া। বিমলকান্তি মনে করেন, এটা ঠিক নয়।

আজ তার নিজের কী হল?

খানিক আগে গেট থেকে ভীম ইন্টারকমে ফোন করেছিল। একজন দেখা করতে চায়। বিমলকান্তি বিরক্ত হয়েছিলেন। চিন্তায় ছেদ পড়েছিল বলে বিরক্ত।

‘আজ তো বুধবার নয় ভীম! তুমি জানো না, আমি শুধু বুধবার ভিজিটর মিট করি? নাকি দিনটা ভুলে গেছ?’

ভীম নীচু গলায় বলল, ‘স্যার, একজন মেয়েমানুষ এসেছে।’

বিমলকান্তি আরও বিরক্ত হলেন। তার পরেও শান্ত গলায় বললেন, ‘মেয়েমানুষ আর পুরুষমানুষের জন্য কি দেখা করবার দিন আলাদা হয়েছে? কই, আমি তো জানতাম না!’

ভীম আমতা আমতা করে বলে, ‘না, মানে… বলেছে অনেক দূর থেকে এসেছে। ফুলিয়া না কৃষ্ণনগর।’

বিমলকান্তি আর গলা শান্ত রাখতে পারলেন না। কঠিন গলায় বলেন, ‘ফুলিয়া, কৃষ্ণনগর কেন? দিল্লি, মুম্বই থেকে এলেও আজ আমি কারও সঙ্গে দেখা করব না।’

‘স্যার, আমি বলেছি। তার পরেও বলছে জরুরি দরকার।’

বিমলকান্তি ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, ‘মুখের ওপর কথা বলছ কেন? ওর দরকার থাকতে পারে, আমার দরকার নেই। চলে যেতে বলো।’

ভীম ইন্টারকাম কেটে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ এবং বিধ্বস্ত চেহারার মহিলাটিকে ধমক দেয়। মহিলা কিছু বলার চেষ্টা করে। এবার ভীম তাকে হাত নেড়ে তাড়ায়। সে এই মহিলার ওপর রেগে গেছে। এর জন্যই স্যারের কাছ থেকে বকুনি খেতে হল। হতাশভাবে মহিলাটি ফুটপাথ বদল করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার ভীমের ইন্টারকম বেজে ওঠে। ‘স্যার’-এর নম্বর। ভীম দ্রুত রিসিভার তোলে।

‘স্যার।’

বিমলকান্তি চাপা গলায় বললেন, ‘ভীম, সেদিনও তুমি একই অন্যায় করেছ। প্রহ্লাদ নামে আমার অফিসের একজন স্টাফকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলে। সেদিন দেখা করবার দিন ছিল না, তার পরেও এনেছিলে। আজ আবার সেই অন্যায় করতে যাচ্ছিলে।’

ভীম থতমত গলায় বলল, ‘আর হবে না স্যার। আমি বুঝতে পারিনি।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘বাড়ির গার্ড যদি নিয়ম বুঝতে না পারে, তাহলে সেটা চিন্তার। গোটা বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেম নড়বড়ে হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাড়ির সিস্টেম নড়বড়ে হওয়ার আগেই কথাবার্তা বলে আমাদের একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মনে হচ্ছে, কাজটা তুমি আর সিরিয়াসভাবে নিতে পারছ না। সে ক্ষেত্রে আমরা অন্যভাবে ভাবতে পারি।’

ভীম এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আর হবে না স্যার।’

বিমলকান্তি একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘আর একটা কথা ভীম। মহিলাদের মেয়েমানুষ বলাটা ঠিক নয়। এই কাজ তুমি আর কখনও করবে না।’

‘আচ্ছা, স্যার, আর হবে না।’

বিমলকান্তি ইন্টারকম নামিয়ে আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন। তাঁর চিন্তিত হওয়ার কারণ অনেকগুলো। এই যে তিনি মাঝে মাঝেই আরেকজন মানুষ হয়ে যাচ্ছেন, সেই মানুষটার মতো করে দুনিয়াটাকে দেখছেন, সামনের মানুষটাকে চিনছেন এটা যে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, এতে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু অসুস্থতা কতটা জটিল? অসুখটা কি শেষ পর্যন্ত ভায়োলেন্সের দিকে যাবে? অনেক মানসিক অসুস্থতাই মারধর, ভাঙচুরের দিকে ঘুরে যায়। তার এক খুড়তুতো ভাইয়ের এইরকম হয়েছিল। এমনিতে শান্ত স্বভাব। কিন্তু একটা সময়ের পর যাকে কাছে পেত কামড়ে দিতে চাইত। তাকেও তেড়ে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এই কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে ভয়ও করেছে। ডাক্তার যদি ভয়ের কিছু খুঁজে পায়। জীবনে নানা ধরনের জটিলতা, সমস্যা সাহসের সঙ্গে দেখেছেন। নিজের মানসিক সমস্যার ব্যাপারে সাহস দেখানো কঠিন। দ্বিতীয় চিন্তার কারণ হল, বাবা। বাবা কি সত্যি নিখিলেশ উপাধ্যায়কে অফিসে পাহারাদার হিসেবে রেখেছেন? তিনি সুযোগ বুঝে ‘কোপ’ মারবার কথা ভাবছেন। সেই ‘কোপ’ কী? সেন অ্যাসোসিয়েটসের কোনও ক্ষতি করতে চাইছেন? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? উপাধ্যায়বাবু সর্বক্ষণ কোম্পানির ভালো করবার চেষ্টা করেন। এমনকী এবারও করেছেন। অত বড় একটা অর্ডার যাতে হাত ফসকে না যায়, তার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে? কথাটা বাবাকে জিগ্যেস করাটা উচিত। কিন্তু গোটা বিষয়টাই যদি ভুল হয়, তাহলে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা ছেলেমানুষি হবে। বাবা এই বাষট্টি বছরের ছেলের ছেলেমানুষি খুব সহজভাবে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। চিন্তিত হওয়ার সব থেকে বড় কারণ হল, গোটা বিষয়টা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করা যাচ্ছে না। মণিকুন্তলাকে সমস্যাটা জানানো উচিত। কিন্তু মন চাইছে না। সে ঘাবড়ে গেলে মুশকিল। বাড়িসুদ্ধ সবাই জানতে পারবে। একটা হট্টগোল শুরু হবে। আবার স্ত্রী হিসেবে স্বামীর এই ধরনের সমস্যা সবার আগে তার জানা উচিত। এটা নিয়েই মনের মধ্যে দোনামোনা চলছে। তবে প্রথমে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।

আবার ইন্টারকম বেজে উঠল।

‘কী হয়েছে ভীম?’

‘ভীম ভয় পাওয়া চাপা গলায় বলল, ‘আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে।’

বিমলকান্তি সেন অবাক হলেন। ভীমেরও কি মাথায় সমস্যা হল? এতটা বঝাঝকা, এমনকী চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেওয়ার ভয় দেখানোর পরও লোক পাঠাতে চাইছে?

বিমলকান্তি কিছু বলবার আগে ভীম গলা আরও নামিয়ে বলল, ‘স্যার, বলছে পুলিশের লোক।’

বিমলকান্তি নড়েচড়ে বসলেন।

‘কী বললে? কীসের লোক?’

ভীম গলা নামিয়ে বলল, ‘পুলিশের লোক। প্রথমে অর্চিনদাদাকে খুঁজছিল।’

অর্চিনকে পুলিশ খুঁজছে! বিমলকান্তি সেনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘অর্চিন কোথায়?’

‘সকালবেলা যেমন প্রতিদিন বের হয়, আজও বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। সে-কথা শুনে ওই লোক বলছে, আপনার সঙ্গে দেখা করবে।’

বিমলকান্তি একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। ভিতরে নিয়ে এসো।’

বিমলকান্তি টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র গোছাতে শুরু করলেন। অর্চিনকে পুলিশ খুঁজছে! কেন? পথেঘাটে সে কোনও গোলমাল পাকিয়েছে? অর্চিন তো গোলমাল পাকানোর ছেলে নয়। তাহলে? নিশ্চয় ভুল কিছু হচ্ছে।

ভীম যাকে নিয়ে এল, তাকে দেখে পুলিশ বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে, স্কুল-কলেজের মাস্টার। কমবয়সি মাস্টার। চোখমুখে এক ধরনের উজ্জ্বল ভাব। ‘বই পড়া, বই পড়া’ ব্যাপার আছে। পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। কাঁধে একটা ব্যাগ। চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগটা মোটা। ব্যাগে রিভলভার আছে?

ভীমকে চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে বিমলকান্তি সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন, ‘নমস্কার, বসুন।’

যুবকটি বসল না। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। সেই ব্যাগের ভাঁজ খুলে এগিয়ে ধরল। খাপের ভিতরে আইডেনটিটি কার্ড। সরকারি সিলমোহর দিয়ে তাতে লেখা—’ইনস্পেক্টর’।

যুবক সৌজন্য হেসে বলল, ‘আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আসছি। আমার নাম সুপর্ণ ভট্টাচার্য।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘কার্ড দেখাতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি। আপনি প্লিজ বসুন।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য সহজভাবে চেয়ারে বসল। যেন এই ঘরের চেয়ারে সে আগে বহুবার বসেছে। পুলিশ বোধহয় এরকমই হয়। অভিনয় করতে পারে।

‘মিস্টার সেন, আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে দু:খিত। তবে বেশিক্ষণ সময় নেব না।’

বিমলকান্তি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘ইটস ওকে। কী ব্যাপার বলুন তো? শুনলাম, আপনি অর্চিনকে খুঁজতে এসেছেন?’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য সহজভাবে বলল, ‘হ্যাঁ মিস্টার সেন, আমি অর্চিন রায়ের সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। তবে সেই সূত্রে আপনার সঙ্গেও কথা বলতাম। হয়তো খানিকটা পরে বলতাম। অর্চিনের সঙ্গে কথা বলবার পর। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হল না। অর্চিন তো এখন বাড়িতে নেই। আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাই ভাবলাম, সেই সময়টা যদি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। আপনার কি অসুবিধে হবে?’

অবশ্যই অসুবিধে হবে। আজ তার বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলবার মতো মানসিক অবস্থা নেই। তার ওপর অফিসে বেরোনোর সময় হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশকে তো আর সে কথা বলা যায় না। বিমলকান্তি অস্ফুটে বললেন, ‘না, অসুবিধে হবে না। তবে আমার অফিসের সময়…।’

যুবক অফিসার বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘তাহলে বরং আজ থাক। আপনার সঙ্গে আমি অন্য কোনও সময় দেখা করে নেব। আমি কি অর্চিনের জন্য এখানে বসে একটু অপেক্ষা করতে পারি?’

বিমলকান্তি সেন বললেন, ‘না না, তেমন তাড়া নেই যে কথা বলতে পারব না। আপনি বলুন না কী জানতে চান।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি চিন্তা করবেন না। অফিসের লেট করিয়ে দেব না। অল্প ক’টা কথা বলেই আপনাকে ছেড়ে দেব। অর্চিন রায় আপনার কে হয়?’

বিমলকান্তি সেন একটু ভেবে বললেন, ‘রিলেটিভ। আত্মীয়।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক কী ধরনের আত্মীয়?’

বিমলকান্তি সেন আবার একটু চুপ করে রইলেন। পুলিশকে কতটা বলা ঠিক হবে? আবার না বলেই বা উপায় কী? নিশ্চয় ইতিমধ্যে অনেকটা জেনে এসেছে।

‘সরাসরি আমার রিলেটিভ নয়। আমার স্ত্রীর বোনের ছেলে। দূর সম্পর্কের বোন।’

যুবক অফিসার চোখদুটো বড় করে বিস্ময়ের ভান করল।

‘অর্চিন আপনার এখানে আছে কেন?’

বিমলকান্তি হালকা বিরক্ত হলেন। এই ছোকরা অফিসার অতিরিক্ত চালাক মনে হচ্ছে। নানারকম অভিনয় করছে। কখনও বিনয়ের, কখনও বিস্ময়ের। এবার বিমলকান্তির গলায় বিরক্তির ভাব এসে পড়ল। বললেন, ‘ছেলেটির বাড়ি সিউড়িতে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কলকাতায় খুব নামকরা জায়গায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আপনি নিশ্চয় বুঝবেন, সিউড়ি থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়া করে লেখাপড়া সম্ভব নয়। তাই আমার বাড়িতে থাকে।’

‘অর্চিনের বাবা-মা কি সিউড়িতে থাকে?’

বিমলকান্তি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এত ডিটেইলসে আমি বলতে পারব না। যদি বলেন, স্ত্রীর কাছে জেনে রাখতে পারি।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য হাত তুলে বলল, ‘না না, অত কিছু করতে হবে না মিস্টার সেন। আপনি যতটা জানেন, ততটাই যথেষ্ট। আমার কনসার্ন অর্চিন রায়কে নিয়ে, তার বাবা-মাকে জড়ানোর কোনও বিষয় নেই।’

বিমলকান্তি ভারী গলায় বললেন, ‘আপনি কি চা খাবেন?’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য হেসে বলল, ‘আমি চা খাই না।’

বিমলকান্তি সেন বললেন, ‘তাহলে কি আমার সঙ্গে কথা শেষ?’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য ঘাড় কাত করে বিনয়মাখা গলায় বলল, ‘অবশ্যই শেষ। আপনি যে এই ছেলে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, বোঝা যাচ্ছে। আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য দু:খিত।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘আমি কি এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

যুবক অফিসার হেসে বলল, ‘প্রশ্ন করতে হবে না। আমি জানি আপনি কী জানতে চান। আপনি জানতে চান, আমি কেন অর্চিনের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তাই তো? মিস্টার সেন, আমরা একটা অস্ত্র মামলায় আপনার এই দূর সম্পর্কের, সরি, আপনার স্ত্রীর এই দূর সম্পর্কের ব্রিলিয়ান্ট বোনপোটির কানেকশন পেয়েছি। ঠিক কানেকশন বলব না, বলব নাম পেয়েছি।’

বিমলকান্তি চমকে উঠলেন। অর্চিন অস্ত্র মামলায়! তিনি কি ঠিক শুনছেন? নিশ্চয় নয়।

‘অফিসার আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, একটু স্পষ্ট করে বলবেন?’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘কেন বলব না? অবশ্যই বলব। গত সপ্তাহে পুলিশ একটা বড় অস্ত্র চালান র‌্যাকেট ক্র্যাক করেছে। এরা বিভিন্ন জেলা এবং কলকাতা জুড়ে কাজ করে। এখন পর্যন্ত পুলিশ তিনজনকে অ্যারেস্ট করেছে। ইনভেস্টিগেশন চলছে। আরও অনেকেই ধরা পড়বে। আসামিদের ইন্টারোগেশনের সময় তারা কতগুলো নাম বলেছে। তার মধ্যে অর্চিন রায়ের নামও রয়েছে।’

উত্তেজনায় বিমলকান্তি সেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বসে পড়লেন। বললেন, ‘কী বলছেন আপনি! হতেই পারে না। অর্চিন ভালো ছেলে। সে এইসবের মধ্যে মোটেও যুক্ত থাকতে পারে না।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য মৃদু হেসে বলল, ‘মিস্টার সেন, আমি তো একবারও বলিনি সে যুক্ত আছে। একজন অস্ত্র চালানের আসামি জেরার সময় কত নাম বলে। তার কথা বিশ্বাস করতে হবে? বিশ্বাস করলে তো আপনার রিলেটিভকে আমরা আগে অ্যারেস্ট করতাম। সেসব তো আমরা কিছু করিনি।’

অ্যারেস্ট! বিমলকান্তির মনে হচ্ছে তাঁর শরীর কাঁপছে। বুকের ভিতর ধড়ফড়ও করছে। কপালে ঘাম জমছে। হাত দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘তাহলে এসেছেন কেন?’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘ছেলেটি যে এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেই বিষয়টা কনফার্ম করতে এসেছি। পুলিশের রুটিন খোঁজ। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেই চলে যাব। আপনি বরং অর্চিনের মোবাইল ফোনের নম্বরটা আমাকে দিন। একটা ফোন করে দেখি, সে কখন আসবে। যদি সেরকম দেরি হয়, তাহলে না হয় সে আমার অফিসে আসবে। সেখানে কথা হবে। আপনি যখন বলছেন ছেলেটি এত ভালো, তখন তাড়াহুড়ো তো কিছু নেই।’

বিমলকান্তি অসহায়ভাবে মুখ তুললেন। মোবাইল ফোন নম্বর! অর্চিনের মোবাইল ফোন নম্বর তো তিনি জানেন না। মাথাটা হালকা ঘুরে উঠল যেন। আর তখনই নিমেষের জন্য বদলে গেলেন বিমলকান্তি। মনে হল, তিনি উলটো চেয়ারে বসা ছোকরা পুলিশ অফিসার সুপর্ণ ভট্টাচার্য হয়ে গেছেন। চোখ সরু করে অফিসার বিমলকান্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বুড়ো অনেক কিছু জানে, কিন্তু বলছে না।

বিমলকান্তি নিজের মধ্যে ফিরে আসতে আসতে কেঁপে উঠলেন। নিজেকেই নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না! কী ভয়ংকর! এ কী অসুখ হল তার! চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি।

সুপর্ণ ভট্টাচার্য তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে মিস্টার সেন?’

বিমলকান্তি সেন মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘না, ঠিক আছে।’

মুখে ঠিক আছে বললেও বিমলকান্তি সেন বুঝতে পারলেন, ঠিক নেই। অনেক কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

তেইশ

কর্ণিকা শেষ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে। ঘুম ভাঙার পর থেকে স্বপ্নটা সমস্যা করছে। স্বপ্ন মনে থাকবার কথা নয়। জেগে ওঠবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন থেকে আবছা হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই স্বপ্নের বেলায় ঘটনা ঘটছে অন্যরকম। বার বার মনে পড়ছে। তাতে একই সঙ্গে কর্ণিকার লজ্জা করছে, আবার ভালোও লাগছে।

বাড়িতে খুশির হাওয়া। কাল বাড়ি এসে প্রাোমোশনের কথা বলেছে কর্ণিকা। বাবা-মা-ভাই তিনজনের তিনরকম প্রতিক্রিয়া। মা চিবুকে হাত ঠেকিয়ে আদর করল। ছলছল চোখে বলল, ‘হ্যাঁরে, কাজ পারবি তো? এইটুকু মেয়ে। অত বড় অফিস!’

কর্ণিকা বলল, ‘না, পারব না।’

মা বলল, ‘তোকে এখন কী করতে হবে?’

কর্ণিকা খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না মা। মনে হচ্ছে অফিস ঝাঁট দিতে হবে। ঝাঁট দিয়ে সোনাদানা খুঁজে বের করতে হবে।’

মা বলল, ‘সবসময় ঠাট্টা করিস না।’

কর্ণিকা হাত বাড়িয়ে মায়ের একটা হাত ধরল। অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘ঠাট্টা করছি না। সত্যি আমি জানি না, ঠিক কী করতে হবে। মনে হয়, আমার কাজটা হবে খবরদারি। খবরদারি মানেই তো ঝাঁট দেওয়া। কে সোনাদানা ফেলে গেল, কে সোনাদানা ঠিকমতো চিনতে পারল না, কে সোনাদানার বদলে ছাইভস্ম তুলে নিল। কমপ্লিকেটেড বিষয়। তুমি বুঝবে না। তার কারণ, তুমি অফিসে কাজ করো না বলে নয় মা, তার কারণ, বিষয়টা আমিও বুঝতে পারিনি।’

মা চোখ বড় করে বলল, ‘সে যাই হোক, তোর ভালো হয়েছে এটাই ভালো। সাবধানে থাকবি। কাজে ভুল করবি না।’

কর্ণিকা ফোঁস করে একটা নি:শ্বাস ফেলে বলল, ‘সাবধানে থেকে লাভ হবে না। আমাদের স্যার একজন অদ্ভুত মানুষ। কাজ ভুল করলে রাগ করেন না। কিন্তু…।’

মা বলল, ‘কিন্তু কী…?’

কর্ণিকা উঠে বসে, হেসে বলল, ‘কিন্তু শুনে লাভ নেই। তুমি এখন ঘর থেকে দ্রুত কেটে পড়ো মা। আমি স্নান করতে যাব। কিছু খাবার ব্যবস্থা করো তো। খিদে পেয়েছে। আজ সারাদিন একই সঙ্গে শরীরে টেনশন এবং খুশি—দুটো এফেক্ট কাজ করছে। মিক্সড এফেক্ট। এতে খিদে বাড়ে।’

মা বলল, ‘বাবাকে বলেছিস?’

‘না।’

মা অবাক গলায় বলল, ‘সে কী! চাকরির উন্নতির খবর বাবাকে বলবি না!’

কর্ণিকা খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘরে পরবার জামাকাপড় নিতে লাগল। বলল, ‘তুমি বলো।’

মা এগিয়ে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ছি। এটা কেমন কথা কনি? তুই নিজের মুখে বললে মানুষটা খুশি হবে।’

কর্ণিকা হাতে জামাকাপড় নিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘কে বলল এটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। খবরটা পেলেই তো হল। তুমি তো জানো মা, বাবার সঙ্গে কথা বলাটা একটা ঝামেলা, একটুক্ষণের মধ্যে মুড অফ হয়ে যাবে। এমন সব কথা বলবে, মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না। আজকের দিনে মেজাজ খারাপ করতে ভালো লাগছে না।’

মা মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা ঠিক নয় কনি। সব মানুষ এরকম হয় না। তোর বাবাও নয়। তার পরেও সে তোর বাবা। এখন আর রাগ করে সময় নষ্ট নয়। যাও প্রাোমোশনের খবরটা বলে এসো।’

কর্ণিকা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বলছি। তার আগে তুমি জানিয়ে রাখো, তাহলে আর আমাকে বেশি বকতে হবে না।’

মা ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘আমি কিছু বলব না। যা বলবার তুমি বলবে।’

কর্ণিকা স্নান সেরে বাবার কাছে গেল। দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল। সুখময়বাবু টিভির সামনে বসে আছেন। টিভিতে রোগা-পাতলা একটা লোক বসে। খালি গা। গলায় গাদাখানেক রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে চন্দনের তিলক। মুখটা চোয়াড়ে, নাকটা টিয়াপাখির মতো লম্বা। ভাগ্য গণনা চলছে। লাইভ ভাগ্যগণনা। টেলিফোন আসছে। জ্যোতিষসম্রাট উত্তর দিচ্ছে। তার মুখ অবশ্য নামানো। সামনে রাখা খাতায় পেন্সিল দিয়ে কিছু একটা নোট নিচ্ছে।

‘প্রণাম জানবেন ঠাকুর।’

রোগা-পাতলা নাক টেনে বলল, ‘আপনাকে প্রণাম। আমাকে ঠাকুর বলবেন না। আমি ঠাকুর নই। আমি ঠাকুরের শিষ্য। তার ইচ্ছেতেই মানুষের সেবায় মন দিয়েছি।’

‘স্যার, আমি বড় কঠিন সমস্যায় পড়েছি।’

রোগা-পাতলা নোটখাতায় কীসব লিখতে লিখতে বলল, ‘আগে নাম বলুন, ঠিকানা বলুন।’

‘নাম-ঠিকানা বলা যাবে না গুরুদেব। ফেঁসে যাব।’

‘আচ্ছা, বলতে হবে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘটনাই তার পরিচয়। নাম-ঠিকানায় কার কী আসে যায়? ঘটনা বলুন।’

‘ঘটনা খুব গুরুতর। আমার বউ একটা বিচ্ছিরি কেসে ফেঁসে গেছে।’

রোগা-পাতলা এবার মুখ তুলে ক্যামেরার দিকে তাকাল। ভুরু কোঁচকাল। ভুরু সম্ভবত ফলস। নরমাল ভুরু এত ঘন হতে পারে না। ‘আপনার স্ত্রীর সমস্যা, আপনি বলছেন কেন? তিনি কি কথা বলতে পারেন না?’

‘দাদা, আমার স্ত্রী লজ্জায় বলতে পারছে না।’

রোগা-পাতলা ফের নোটখাতায় মুখ নামাল। বলল, ‘সংসারে আমাদের এই হল জটিলতা। অনেক সময়েই আমরা নিজেরা আমাদের সব সমস্যা নিজের মুখে ব্যক্ত করতে পারি না। তা করলে কী করে হবে? সমস্যা সমাধানের পথ তো আমাকেই সন্ধান করে নিতে হবে। মুক্তির পথ তো আমারই হাতে। শ্লোকে বলেছে, য: স্থাপিত নিজস্ব পথেচ, তদবি চলিতানি দিবসরাত্রি। এর অর্থ কী? এর অর্থ হল…যাক, এর অর্থ শুনে আপনার কাজ নেই। আপনি বলুন। বলুন আপনার স্ত্রীর সমস্যা কী?’

টিভিতে কোনও কথা নেই। রোগা-পাতলা মুখ তুলে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী হল বলুন? নাকি আপনারও সমস্যা?’ তার পরেও প্রশ্নকর্তার কোনও কথা নেই।

‘চুপ করে আছেন কেন? আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? এই যে হ্যালো…হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন না?’

কর্ণিকার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। একটা সুস্থ পুরুষমানুষ টিভির সামনে বসে ভর সন্ধেবেলা এসব কী দেখছে। এই সময়টা কিছু কাজকর্ম তো করতে পারত। কাজকর্ম না করুক বাইরে কোথাও গিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে গল্পটল্প করে আসতে পারত। ক্লাবে গিয়ে তাস খেলতে পারে। তা না করে এসব কী? টিভিতে ভাগ্যবিচার দেখছে! অসুখ থেকে উঠেছে অনেক দিন। তার পরেও একটানা ঘরে বসে আছে। মা বলে, মানুষটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। কর্ণিকার বিশ্বাস, ওসব কিছু নয়। বাবার কাজ করবার অভ্যেস নষ্ট হয়ে গেছে। তার ওপর মেয়ের উপার্জনের পয়সা যখন আসছেই, তখন আর সংসার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? সবই এই লোকটার দোষ। শরীর-টরীর কিছু নয়।

মুখটা তেতো খাওয়া মতো করে কর্ণিকা সুখময়বাবুর থেকে দূরত্ব রেখে বেতের সোফায় বসল।

‘বাবা, টিভিটা বন্ধ করো।’

সুখময়বাবু মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। রিমোট দিয়ে টিভির সাউন্ড কমালেন।

‘বাবা, এসব কী হাবিজাবি জিনিস দেখছ?’

সুখময়বাবু চোখ কপালে তুলে গদগদ গলায় বললেন, ‘হাবিজাবি কী বলছিস কনি! ভদ্রলোক কত বড় অ্যাস্ট্রোলজার জানিস? আট জায়গায় চেম্বার। সপ্তাহে সাতদিন সাত জায়গায়, একদিন ডবল জায়গায়। ওনার সব কথা অব্যর্থ। তুই যদি ওনাকে এখন ফোন করে কিছু জিগ্যেস করিস, ঠিক বলে দেবেন। ধর…ধর…জানতে চাইলি কর্মক্ষেত্রে উন্নতি হবে কিনা। উনি তোর ডেট অফ বার্থ, টাইম অফ বার্থ, কোষ্ঠী বিচার করে ঠিক বলে দেবেন।’

কর্ণিকার বিরক্তি বাড়ল। এই জন্যই সে বাবার কাছে চট করে আসতে চায় না। নিজেকে সামলাল। সামনে টেবিল থেকে একটা পুরোনো ম্যাগাজিন টেনে পাতা উলটোতে লাগল।

‘বাবা, আমার কিছু জানতে হবে না। অফিসে আমার একটা প্রাোমোশন হয়েছে।’

সুখময়বাবু রিমোট টিপে ফট করে টিভিটা বন্ধ করলেন। ঘুরে বসলেন মেয়ের দিকে।

‘সে কী! এতক্ষণ বলিসনি কেন?’

‘এই তো বাড়ি ফিরলাম।’

সুখময়বাবু উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘বেতন কত বাড়ল?’

কর্ণিকার মেজাজটা দুম করে বিগড়ে গেল। প্রথমেই বেতনের কথা? মেয়ের অফিসে উন্নতি মানে, শুধু বেতন বাড়া? কী কাজ, কী দায়িত্ব, সেসব জানবার কোনও উৎসাহ নেই? মায়ের মতো একজন সাধারণ ঘরসংসার করা মহিলা যে-কথা ভাবে, এই মানুষটা সেকথাও ভাবতে পারে না। শুধু টাকা আর টাকা!

কর্ণিকা কোলের ওপর রাখা ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে বলল, ‘জানি না।’

সুখময়বাবু বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, ‘সে কী! প্রাোমোশন হল, মাইনে কত বাড়ল জানলি না! এই হল হাঁদার মতো কাজ। কালই গিয়ে জানবি। ভালো করে খোঁজ নিবি।’

কর্ণিকা সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল। কড়া গলায় বলল, ‘কেন?’

‘কেন! কেন আবার কী? টাকাই তো আসল। বাজারের কী অবস্থা জানিস? জানবি কী করে? শুধু অফিস আর ঘর করিস, দোকান-বাজার তো করতে হয় না। করতে হলে বুঝতিস।’

কর্ণিকার চোখমুখ কুঁচকে গেল। উফ! এই জন্যই আসতে চাইছিল না। ক’টা বাজে কথা শুনতে হবে। বলতেও হবে। নিজেকে কতক্ষণ সামলে রাখা যায়?

‘ভাগ্যিস বুঝতে পারি না। তাহলে সারাদিন তোমার মতো কোনও কাজকর্ম না করে বাড়িতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হত। অপেক্ষা করতাম, জ্যোতিষী কখন আমার উন্নতির কথা বলবে।’

সুখময়বাবু মেয়ের কথায় বোকা বোকা হাসতে লাগলেন। কর্ণিকা সেই ফাঁকে ঘর থেকে চলে গেল। গেল ছাদের ঘরে। ভাইয়ের কাছে।

মানা তার দিদির প্রাোমোশনের ব্যাপারটা নিজের মতো করে নিল।

ছাদের এই ঘরটা মানা বছর খানেক হল দখল করেছে। তার নাকি লেখাপড়া করতে সুবিধে হবে। বাবা বেদম চেঁচামেচি করেছিল। এইটুকু ছেলের আবার আলাদা ঘর কীসের? লেখাপড়া করবে না কচু করবে। যে ছেলে লেখাপড়ার ধারে-কাছে যায় না, তার এসব কী ফুটানি! পরীক্ষায় দুটো থেকে তিনটে সাবজেক্টে ফেল না করলে ভাত হজম হয় না। এই ছেলের জন্য ঘর নয়, চাবুক দরকার। মা-ও মানার ওপর রাগারাগি করল। সেটা অবশ্য অন্য কারণে। ছাদের ঘর ধুলো, ঝুল আর আবর্জনায় ভর্তি। তার ওপর একটা মাত্র জানলা। সেটাও ছোট। ওই ঘরে গেলে ছেলের শরীর খারাপ হয়ে পড়বে। কর্ণিকাই শুধু মানার পাশে ছিল।

‘ঘরটা যখন পড়েই আছে, মানা গিয়ে থাকুক না। সমস্যা কী? সাফসুতরো করে নেবে।’

সুখময়বাবু দাঁত কড়মড় করে বললেন, ‘কেন? তুই কেন ভাইয়ের হয়ে ওকালতি করছিস?’

কর্ণিকা বলল, ‘ওকালতি কিছু করছি না। এই বয়সে একটা স্পেস লাগে।’

সুখময়বাবু ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘স্পেস! কেন আমাদের তো কখনও ওসব লাগেনি। সবাই মিলে থেকেছি। বিড়ি খাবার জন্য লাটসাহেবকে ঘর দিতে হবে?’

কর্ণিকা হেসে ফেলল। বলল, ‘বাবা, বিড়ি-সিগারেট খাবার হলে বাইরে গিয়েও খেতে পারবে। এভাবে আটকানো যাবে না। মানা এমন একটা বয়সের মধ্যে দিয়ে চলেছে, যেখানে সর্বক্ষণ বাবা-মা-দিদির মাঝখানে থাকতে ভালো লাগবার কথা নয়। একটা ঘর যখন পড়ে আছে, ও ব্যবহার করুক।’

সুখময়বাবু বললেন, ‘কই, তোর তো আলাদা ঘর লাগেনি। তুইও তো একসময়ে এই বয়সে ছিলি। নাকি শিশু থেকে লাফ মেরে ধেড়ে হয়ে গিয়েছিস?’

কর্ণিকা বলল, ‘ছেলে আর মেয়ে এক ব্যাপার নয় বাবা। মেয়েরা অনেক কিছু মেনে নেয়। তাছাড়া আমার তো সুযোগ ছিল না। আমি ছাদের ঘরে একলা থাকব শুনলে তোমরা রাগতে না, ভয়ে মরে যেতে। থাক ওসব কথা। মানাকে ”হ্যাঁ” বলে দাও। সবিতামাসিকে দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে দিলেই হবে।’

দিদির সাপোর্ট পেয়েই সিঁড়ির পাশের এই লম্বাপনা ঘরটা পেয়েছে মানা। টেবিল-চেয়ার, টেবিল ফ্যান, বইয়ের তাক। দেওয়ালে ঘুড়ি, মারাদোনা, শচীনের ফটো। ঘরের সবথেকে মজা, দরজাটা আটকালেই বাড়ির থেকে আলাদা। কর্ণিকা কাল রাতে যখন এই ঘরে উঠে এল, মানা খাটে শুয়ে পড়ছিল। কর্ণিকা রাগী গলায় বলল, ‘এ কী পড়াশোনার কায়দা? শুয়ে শুয়ে পড়া হয়? ওঠ এক্ষুনি। উঠে বসে পড়।’

মানা অতি বিরক্তির সঙ্গে উঠে বসল। কর্ণিকা তক্তাপোষের ওপর বসে ভাইয়ের পিঠে হাত রাখল। নরম গলায় বলল, ‘জানিস, মানা, অফিসে আমার প্রাোমোশন হয়েছে। কাজ বেড়েছে।’

মানা বলল, ‘খুব ভালো হয়েছে। কাজ যখন বেড়েছে নিশ্চয় এবার থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরবি। বাঁচা যাবে। আমিও শুয়ে শুয়ে পড়তে পারব। এসে খিটখিট করবি না।’

এখন কর্ণিকা দাঁড়িয়ে আছে বাথরুমে। শাওয়ারের তলায়। একটু পরেই অফিসের গাড়ি চলে আসবে। মানার কথাটা মনে পড়ায় হাসি পেল। যার যাতে সুবিধে। দিদি দেরি করলে পড়ায় ফাঁকি দেওয়া যাবে। একই সঙ্গে রাতের স্বপ্নটাও মনে পড়ে গেল কর্ণিকার। কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ওই স্বপ্নে অর্চিন তাকে আদর করেছে। সেই সময় তার গায়ে জামাকাপড় কিছু ছিল না। ঠিক এখনকার মতো। মাগো!

কর্ণিকা বাথরুমে দরজায় ঝোলানো তোয়ালের দিকে হাত বাড়াল।

চব্বিশ

মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে

ভেবেছিলাম ঘরে রব কোথাও যাব না—

ওই যে বাহিরে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি।।

শুনেছি কোন কুঞ্জবনে যমুনাতীরে

সাঁঝের বেলা বাজে বাঁশি ধীর সমীরে

ওগো তোরা জানিস যদি আমায় পথ বলে দে।।

দেখি গে তার মুখের হাসি,

তারে ফুলের মালা পরিয়ে আসি,

তারে বলে আমি তোমার বাঁশি

আমার প্রাণে বেজেছে।।

বাঁশিতে রবিঠাকুরের এই গান পুরোটা বাজানোর পর বংশীবাদক এখন খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে লুচি-আলুরদম খাচ্ছে। পাশে রসগোল্লার রসভর্তি ছোট একটা বাটি। মেঘবতী প্রথমে বাটিতে দুটো রসগোল্লা দিয়েছিল। বংশীবাদক বলেছে, ‘মা, রসগোল্লা নিয়ে যাও, শুধু রসটা থাক। শেষ পাতে চুমুক দিতে খাব।’

‘সে কী! আপনি শুধু রস খাবেন! একটা মিষ্টি অন্তত নিন।’

বংশীবাদক হেসে বলল, ‘রসের থেকে বেশি মিষ্টি আর কী আছে মা? রসই তো মিষ্টির প্রাণ। তুমি আমাকে শুধু রসই দাও। আমি ভিখিরি মানুষ, রসেই আমি খুশি।’

মেঘবতী কথা বাড়ায়নি, বাটি থেকে রসগোল্লা সরিয়ে নিয়েছে। আসলে মেঘবতী চিন্তিত। এই লোক বাঁশি ভালো বাজালেও ঝামেলা করবে বলে মনে হচ্ছে। কাকভোরে বাঁশি বাজিয়েছে। ঘুম ভেঙে গেছে। একদিন-আধদিন বাঁশির সুরে ঘুম ভাঙলে ভালো লাগে। রোজ হলে মুশকিল। সুন্দর ভাব নষ্ট হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। মেঘবতীর এক বন্ধু গড়িয়ার কাছে থাকে। একটু ভিতর দিকে। ওদিকটায় এখনও কিছু কিছু পুকুর-দীঘি, গাছপালা রয়েছে। পাখিও আছে। পাখিরা সারাদিনই ডাকাডাকি করে। শুনতে ভালোই লাগে। হঠাৎই একটা কোকিল খুব ঝামেলা শুরু করল। রাত একটা-দুটোতে ‘কুহু কুহু’ শুরু করল। এক-আধবার ডাক নয়। একটানা ডাক। নি:শব্দ গভীর রাতে সেই ডাক তীক্ষ্ণ হয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। প্রথম দিন কোনওরকমে মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু পরদিনও যখন এক কাণ্ড, তখন অসহ্য মনে হল। ইচ্ছে করল, গিয়ে কোকিলের গালে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় লাগাই। মাঝরাত কুহু শোনানোর সময়? ইয়ার্কি হচ্ছে। কোকিলের কুহু কুহু ডাক যতই মিষ্টি হোক, রাত একটা-দুটোয় সেই ডাক ভয়াবহ। কাকের কা কা-এর থেকেও কর্কশ। মেঘবতীর বন্ধু জানলা আটকে সেই ডাক ঠেকাতে গেল। পারল না। কানে বালিশ চাপা দিল। তাতেও লাভ হল না। বাধ্য হয়ে জেগে বসে থাকতে হল গোটা রাত। এরকম প্রায় টানা সপ্তাহখানেক চলেছে। শেষের দিকে সারাদিন ধরে টেনশন হত। আজ রাতে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙবে না তো? কোকিল-ফোবিয়া। বন্ধুদের একথা বলতে গিয়ে ঠাট্টা শুনতে হয়েছে। কোকিলের ডাক আবার খারাপ লাগে নাকি! নিশ্চয় মেয়েটা বানিয়ে বলছে। তাছাড়া, কোকিল মাঝরাতে ডাকবে কেন? সে ডাকবে সকালে আর বিকেলে। সঙ্গীকে ডাকবে। মন ভালো করে দেবে। এই কোকিলের নিশ্চয় মাথায় গোলমাল হয়েছে। মেঘবতীর সেই বন্ধুকে কেউ ঠাট্টা করে বলল, ‘তুই বরং ওকে সাইকায়াট্রিস্ট দেখা।’ কেউ বলল, ‘তুইও জানলা খুলে কোকিলকে পালটা গান শোনা। এক হাতে কান চেপে গলা খুলে গান ধরবি। কোয়েলিয়া গান থামা এবার, তোর এই কুহুতান ভালো লাগে না আমার…। দেখবি পাখি ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে গেছে।’

ঠাট্টা হোক, আর যাই হোক, কোকিলের মিষ্টি ডাকও অসময়ে অত্যাচারের মতো লাগে। বাঁশিও তাই হবে। আশপাশের বাড়ি থেকে অবজেকশন দেবে। এই জন্য মেঘবতী চিন্তিত। তবে তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছে জ্যোতিষ্ককে নিয়ে। সে বংশীবাদককে পেয়ে কেমন যেন গলে মতো পড়ছে। তার মুগ্ধভাবে বাড়াবাড়ির লক্ষণ। বলছে, সেরকম বুঝলে নাকি বাঁশিওয়ালার সঙ্গে ঘর ছাড়বে। প্রথমে মনে হয়েছিল, রসিকতা করে বলছে। তার স্বামীর রসবোধ আছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, রসিকতা নয়, কথাটার মধ্যে কোথাও এক ধরনের সত্যি সত্যি ভাব আছে। তবে ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গুপির মা।

‘এইসব মানুষকে ঘরবাড়িতে রাখা ভালো নয় বউদি।’

মেঘবতী ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘ভালো নয়? কেন? কী হয়েছে?’

গুপির মা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। সেই কাজ বন্ধ না করে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘সবের কি কারণ থাকে বউদি? দুনিয়া দুই রকম জিনিসে ঠাসা। তার কিছু জিনিস ভালা, কিছু জিনিস ভালা নয়। বুঝেসুঝে চলতে হয়। এইটা যেমন ভালা নয়।’

মেঘবতী বলল, ‘কী সুন্দর বাঁশি বাজায়, তার পরেও তুমি এসব বলছ গুপির মা?’

‘এমনি এমনি বলছি না বউদি। এই মানুষ ঘরবাড়ির মানুষ নয়, এই মানুষ হল পথের মানুষ। ঘরের মানুষকে যদি পথে রাখেন, সে যাবে নষ্ট হয়ে। তেমন পথের মানুষকে ঘরে রাখলেও এক ঘটনা। সে নষ্ট হবে।’

মেঘবতীর মনে মনে খুঁতখুঁতানি হচ্ছিলই। গুপির মায়ের কাছ থেকে আরও কথা শুনতে চাইল।

‘আমরা কি জোর করে ধরে রেখেছি। তার ইচ্ছে হয়েছে তাই আছে। ইচ্ছে না হলে থাকবে না। অমন একটা ধেড়ে লোককে আমরা নষ্ট করবার কে?’

গুপির মা এই বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থাকে। তবে কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। গোটা ঘরে হয়তো ঝাঁটা বুলিয়ে চলে গেল, ধুলো পড়ে থাকল আগের মতো। টেবিল মুছল ঠিকই, কিন্তু হলুদের দাগ রয়ে গেল এক কোণায়। ভেজানো কাপড়-জামার আদ্দেকটা কাচল, আদ্দেকটা ফেলে রাখল পরের দিনের জন্য। মেঘবতীকে কঠিন নজর রাখতে হয়। এই আলোচনার সময় কঠিন নজর রাখতে পারল না। গুপির মা দার্শনিক প্রসঙ্গ তুলে তাকে অন্যমনস্ক করে ফেলেছে। টেবিল-চেয়ারের তলা পর্যন্ত তার ঝাঁটা পৌঁছল না।

‘অতসব জানি না বউদি। তবে এটুকু জানি, এসব মানুষ ঘরে থাকলে নিজে নষ্ট হয়, সংসারের ক্ষতি করে।’

মেঘবতী চোখ বড় করে বলল, ‘কী ধরনের ক্ষতি করে?’

এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গুপির মা গলা নামিয়ে বলল, ‘দাদাকে বুড়োটার কাছে অত ঘুরঘুর করতে দেবে না বউদি। এরা ভালোমানুষ বশ করতে পারে। ভিখিরি ফকির মানুষ, মন্ত্র-টন্ত্র, ঝাঁড়ফুক জানে।’

মেঘবতী নড়েচড়ে বসল। সে এসব কুসংস্কারে মোটে বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল। বাপেরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও তাবিজ-মাদুলির ব্যাপার নেই। কিন্তু এখন নিজেকে কেমন দুর্বল লাগছে। ঘটনা সত্যি নয়তো? জগতে কত কিছুই তো থাকে। সব কি যুক্তি বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করা যায়?

গুপির মা চিন্তিত মুখে বলল, ‘কে জানে, ওই লোক এতক্ষণে দাদাবাবুকে বশটশ কিছু করে বসেছে কিনা। যেভাবে এ বাড়িতে জাঁকিয়ে বসেছে, তাতে তো মনে হচ্ছে, একটা কিছু ঘটেছে! নইলে পথের ভিখিরি নোংরা জামাকাপড় পরে খাটে বসে লুচি খায়?’

মেঘবতী মন শক্ত করল। বলল, ‘বাজে কথা বোলো না। লোকটার গুণ দেখনি? কেমন সুন্দর বাঁশি বাজায়। এরা হল শিল্পী মানুষ। এদের তোয়াজ করতে হয়। তাছাড়া তোমার দাদাবাবু ছেলেমানুষ নয়। তুমি থামো দেখি। ওই লোক তো পাকাপাকি এখানে থাকতে আসেনি, কাল-পরশুই চলে যাবে। তার নিজের দেশের বাড়ি নেই নাকি?’

গুপির মা ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলে বলল, ‘কিছু না হলেই ভালো। তবে যতক্ষণ না ওই বুড়ো বাড়ি থেকে যায়, সাবধানে থাকবে বউদি।’

মেঘবতী এতে আরও ঘাবড়ে গেল। গুপির মা এসব বলছে কেন? ভয় দেখাচ্ছে? কীসের ভয়? সে তো জানে না, জ্যোতিষ্ক এই লোকের সঙ্গে ঘর ছাড়বে বলে প্ল্যান করছে। তাহলে? বোনকে ফোন করে দুশ্চিন্তার কথা জানাতে গেল মেঘবতী। বারিধারা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছে। বংশীবাদককে খাবার দিয়ে ওপরে চলে এসেছে। তার কান্না পাচ্ছে। খানিকটা কেঁদে নিলে কি টেনশন কমবে? একটাই নিশ্চিন্তি, তার কান্না পাচ্ছে মানে ঘটনা সিরিয়াস নয়। কেস হিস্ট্রি বলছে, সিরিয়াস ঘটনায় তার কখনও কান্না পায় না। যতসব ছোটখাটো গুরত্বহীন বিষয়েই তার চোখে জল আসে।

নীচের গেস্টরুমে তখন অন্য দৃশ্য।

জ্যোতিষ্ক চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসে আছে। এতক্ষণ সে আপ্লুত হয়ে বাঁশি শুনছিল, এখন মুগ্ধ হয়ে বংশীবাদকের খাওয়া দেখছে।

একটু আগে বাঁশিতে যে গান বংশীবাদক বাজিয়ে শোনাল, সেটা যে প্রায়ই শোনা যায় এমন নয়। ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে’ এ গানটা জ্যোতিষ্ক আগে শুনেছে কিনা, মনে করতে পারল না। গানের কথাও তার জানা নেই। বংশীবাদক বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার আগে তার ঝোলা থেকে একটা জীর্ণ খাতা বের করে। গেরুয়া কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া। জ্যোতিষ্কের দিকে এগিয়ে বলল, ‘নিন, ষোলো নম্বর পাতাটা খুলুন।’ খাতা হাতে নিয়ে জ্যোতিষ্ক বলল, ‘কী আছে?’

‘আমি যে গানটা এখন বাজাব, সেটা আছে। আপনার চোখের সামনে কথাগুলো থাকলে শুনতে ভালো লাগবে।’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘থাক, আমার কথা লাগবে না, আপনার বাঁশিই সুন্দর।’

বংশীবাদক বলল, ‘যে সুরে কথা আছে সেখানে কথাও সুন্দর। তাছাড়া এই গানটা রবি ঠাকুরের। তার গানের কথা না শুনলে সুর অসম্পূর্ণ থাকে। এই কারণেই তো আমি ওঁর গান বিশেষ বাজাতে চাই না। শুধু সুর দিয়ে কথার আনন্দ, যন্ত্রণা, গভীরতা আর কতটা ফুটিয়ে তোলা যায় বলুন। কেউ হয়তো পারেন, আমি তাদের মতো গুণী নই। নিন, গানটা বের করুন।’

বংশীবাদক লুচি খাওয়া শেষ করে রসের বাটিতে ছোট একটা চুমুক দিল।

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আপনি বাঁশি কোথা থেকে শিখেছেন?’

‘মাঠেখাটে। ওই যে বললাম, পেটের তাগিদে বাঁশি বানাতাম। তখনই শিখতে হয়েছে। নিজে না জানলে যে ভালো জিনিস বানানোই যাবে না। খানিকটা নিজে শিখেছি, খানিকটা একে ওকে ধরে শিখেছি।’

জ্যোতিষ্ক উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘বাঁশি কীভাবে বানাতে হয়?’

বংশীবাদক সামান্য হেসে বলল, কতরকম বাঁশি আছে, একেকটা একেকরকম ভাবে বানাতে হয়।’

জ্যোতিষ্কর এই বিষয়টাও জানা ছিল না। অনেকরকম বাঁশি আছে! সে জানত, বাঁশি একরকমই। মোটাসোটা, গোলগাল। ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। বড়রা পাশ থেকে ফুঁ দেয়। কমবয়সিরা সামনে থেকে ফুঁ দেয়। হারমোনিয়ামের রিডের মতো ফুটো খুলে বন্ধ করে সুর বের করতে হয়। সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, ‘বাঁশি অনেকরকম হয় বুঝি!’

বংশীবাদক বলল, ‘অবশ্যই অনেকরকম। আড় বাঁশি, কদ বাঁশি, সরল বাঁশি, হরিণা বাঁশি, টিপরা বাঁশি, লয়া বাঁশি, মুখ বাঁশি, ভুয়াং বাঁশি, মোহন বাঁশি। হরিণ বাঁশি নামটা সুন্দর নয়? অতি সুন্দর। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করতে হয়। প্রায় নয় থেকে দশ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। নীচ পর্যন্ত দুভাগে ভাগ করা থাকে। ফুটোর কোনও বলাই নেই। এতে ফুঁ দিলে হরিণ শাবকের ডাকের মতো এক ধরনের আওয়াজ হয়। হরিণ শিকারের কৌশল হিসেবে একসময় এই বাঁশি ব্যবহার হত। এখন তো সে পাট চুকে গেছে। তবে এখনও বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় এই বাঁশি পাওয়া যায়।’

জ্যোতিষ্ক অস্ফুটে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং। আপনি কি এই বাঁশি বানাতে পারেন?’

বংশীবাদক রসের বাটিতে আর একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘না, পারি না। তবে এরকম সুন্দর বাঁশি আরও আছে। যেমন ধরুন পাতা বাঁশি। তালপাতা দিয়ে এই বাঁশি বানাতে হয়। গ্রামের দিকের ছেলেপিলেরা বাজায়। একটা পাতা দু’ভাঁজ করে করে কলম কাঁটার মতো করে আগাটা একটু কেটে নিতে হয়। পরের পাতাকে কেন্দ্র করে পাতা জড়াতে জড়াতে আস্তে আস্তে বন্ধ করতে হয়। ওই ছোট মুখে ফুঁ দিলেই বাঁশি বেজে ওঠে। তবে পাতা বাঁশি দিয়ে নিখুঁত বা মধুর সুর তৈরি করা সম্ভব নয়।’

কথা শেষ করে খাট থেকে নেমে পড়ল বংশীবাদক।

‘যাই, হাতটা ধুয়ে আসি। স্যর, আপনি বরং একটা কাজ করুন। আমার ঝোলাটার মধ্যে একটা বই আছে। বাঁশি বিষয়ক বই। বইটা নিন। পড়ে দেখুন।’

জ্যোতিষ্কও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অবশ্যই পড়ব। কিন্তু আপনি এখনও আমাকে স্যর বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে বলেছি…’

বংশীবাদক হাত তুলে থামিয়ে বলল, ‘আমি জানি, ওইসব প্রথাগত সম্বোধনে আপনি আগ্রহী নন। প্রথম দিনই বুঝেছিলাম। যেদিন আপনার সঙ্গে ভবানীপুরের চায়ের দোকানে আলাপ হয়েছিল, সেদিনই আপনাকে চিনেছি। তবু আপনি কত বড় সরকারি অফিসার! পদের মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে।’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘বাড়িতে আবার পদ কী? না না, দয়া করে আপনি আমাকে আর স্যর ডেকে বিড়ম্বনায় ফেলবেন না। এটাই আমার অনুরোধ।’

বংশীবাদক হাসতে হাসতে বলল, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে’খন। আপনি আগে বইটা উলটে পালটে দেখুন। আপনার বাঁশি সম্পর্কে আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে।’

জ্যোতিষ্ক এবার ঝট করে বলে ফেলল, ‘আচ্ছা, আমি বাঁশি শিখতে পারি না?’

বংশীবাদক দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

‘কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।’

জ্যোতিষ্ক লজ্জা পাওয়া মুখে বলল, ‘আসলে বয়স হয়ে গেছে তো। এই বয়সে নতুন করে কিছু শেখা…।’

‘বাঁশি বাজানো তো ফুটবল খেলা নয় স্যর। বয়স হলে দৌড়তে পারবেন না সেই সমস্যা নেই।’

জ্যোতিষ্ক নিজের ঘরে গিয়ে খবরের কাগজের মলাট দেওয়া বই খুলল। বইটি তাঁতঘর নামে এক পতিতার বাঁশি বিষয়ক সংকলন। খুবই আশ্চর্য লাগছে, ভিখিরি মানুষটা শুধু বাঁশি বাজাতে পারে না, পড়াশোনাও করে। বইয়ের একটা পাতায় চোখ পড়ল। লেখা আছে—বাঁশির সবথেকে বড় পরিচয় হল তার অন্তরটি অন্ত:সারশূন্য। যার অর্থ, সে অহমিকাহীন। কামনা-বাসনায় শূন্যতার বৈভবে সে রসময়। যে একটি বিশুদ্ধ পাত্র বা আধার। বাঁশি শূন্য, তাই সে পূর্ণ হয়ে যায় রসিকজনের প্রসন্ন শব্দময় ধ্বনিতে।

জ্যোতিষ্ক অস্ফুটে বলল, ‘আহা!’

জ্যোতিষ্কর এই ‘আহা!’ উচ্চারণের কিছুক্ষণের মধ্যে এ বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটল।

তখন জ্যোতিষ্ক অফিসে। মেঘবতীও বাইরে। বংশীবাদকের জন্য জামাকাপড় কিনতে বেরিয়েছে। নোংরা পোশাকে তাকে বেশিক্ষণ বাড়িতে অ্যালাও করা যাচ্ছে না। সেই কারণেই খুব বিরক্তির সঙ্গে গড়িয়াহাটে গেছে। পায়জামা, পাঞ্জাবি কিনবে। ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে মেঘবতী দেখে, গোটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড। বেডরুমের আলমারি ভাঙা। কাপড়জামা, টাকা পয়সা, গয়নাগাঁটি কিচ্ছু নেই। এরও মিনিট পনেরো বাদে গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে একতলার রান্নাঘরে গুপির মাকে পাওয়া গেল। তার হাত পা এবং মুখ বাঁধা। বাঁধার কাজ করা হয়েছে তারই শাড়ি খুলে নিয়ে। তার পরনে শুধু ব্লাউজ আর সায়া।

গেস্টরুমে বংশীবাদক নেই। তার ঝোলা নেই। বিছানার ওপর একটা বাঁশি পড়ে আছে শুধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *