একটু পরে রোদ উঠবে – ১৫

পনেরো

এতদিন আমরা আপনাদের শিখিয়েছি। এবার আপনাদের পালা। আপনারা আমাদের শেখাবেন। —যোশেফ স্টালিন।

অর্চিন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই নিয়ে কতবার যে কথাটা সে পড়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। গত তিন বছর ধরে যখনই সে শেখর গুপ্তর বাড়িতে আসে তখনই একবার করে পড়ে। তার ভালো লাগে।

শুনলে মনে হচ্ছে, এটা কোনও পোস্টার বা দেওয়ালের লেখা। শেখর গুপ্ত নামে কারও বাড়ি যাতায়াতের সময় অর্চিনের চোখে পড়ে। ঘটনা সেরকম নয়। এটা পোস্টার নয়। দেওয়ালেও লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে শেখর গুপ্তর বাড়ির দরজায়। একটা কাগজের টুকরোয় লিখে দরজার গায়ে লাগানো। কম্পিউটারে টাইপ করা কাগজ। চারপাশে যত্ন করে বাদামি রঙের সেলোটেপ। রোদে, জলে লেখা নষ্ট হলে আবার নতুন কাগজ লাগানো হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, জীর্ণ রংচটা, পলকা দরজার গায়ে নেমপ্লেট। নাম, ঠিকানা লেখা আছে। কাছে গেলে ভুল ভাঙবে। প্রথম প্রথম সবাই অবাক হত। বাড়ির দরজায় এসব কী লেখা! হাসাহাসিও করত। শেখর গুপ্তকে জিগ্যেস করত।

‘এর মানে কী!’

শেখর অবাক হয়ে বলত, ‘কেন! সহজ বাংলায় লেখা আছে। মানে না বোঝার তো কোনও কারণ নেই। এতদিন আমরা শিখিয়েছি, এবার তোমরা শেখাবে।’

‘এসব কাকে বলছ শেখর।’

শেখর বলছে, ‘জনগণকে। নিজের বাড়ির দরজা দিয়ে শুরু করেছি।’

‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম?’

রসিকতা। খানিকটা অপমান মেশানো রসিকতা। শেখর গুপ্ত চুপ করে থেকেছে। সে অপ্রয়োজনীয় কারণে রাগে না। ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, অপমান অবজ্ঞা করতে পারে। মুখে বলে, অপমান করবার জন্য যোগ্যতা লাগে। যে যোগ্য নয়, তার অপমান গায়ে মাখবার কারণ নেই।

‘তোমরা ক্ষমতা থেকে সরে গেছ বলে এসব লিখেছ নাকি শেখর?’

শেখর বলে, ‘পুরোটা তাই না হলেও, খানিকটা তো তাই বটে।’

এরপরই প্রশ্নকর্তা ব্যঙ্গের সুরে হেসে বলত, ‘এতে পাপ�ালন হবে? তোমাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরবে?’

শেখরও মৃদু হেসেছে। বলেছে, ‘পাপ�ালনের প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? আমাদের পার্টিতে পাপ-পুণ্যের কোনও জায়গা নেই। একেকটা পরিস্থিতিতে একেকরকম শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আমাদের চলতে হয়। বামপন্থায় সেটাই নিয়ম। তবেই এগিয়ে চলা যায়। নইলে তো থমকে থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে এভাবেই আমাদের চলা উচিত। মানুষের কথা শুনতে হবে। তাদের কাজ থেকে শিখতে হবে। আমাদের ঠিক, ভুল তারা বলবে।’

‘তা বলে নিজের বাড়ির দরজায় নোটিস লাগিয়ে শিখতে হবে?’

শেখর আবার হাসে। বলে, ‘অসুবিধে কী? আমি তোমার কাজ থেকে শিখব এটা প্রকাশ্যে বলায় কোনও লজ্জা আছে নাকি?’

তিন বছর ধরে দরজায় এই কাগজ সাঁটা। পার্টি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই শেখর গুপ্ত এই কাণ্ড করেছে। বাড়িতে যাদের আসা-যাওয়া তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে নতুন কেউ এখনও অবাক হয়। দরজায় স্ট্যালিনের বাণী সাঁটার ব্যাপারে তমসার আপত্তি ছিল। স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সে কখনওই নাক গলায় না। বহু বছরের অভ্যেস। একটা সময়ে সেও পার্টির খুব কাছে ছিল। মহিলা ফ্রন্টে। সমিতির ওপর দিকেই ছিল। পরে দু-একজনের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় সরে আসে। পার্টি অবশ্য তমসাকে ছাড়তে চায়নি। বোঝাতে চেষ্টা করেছিল।

‘আদর্শ, বিশ্বাস, লক্ষ্য অনেক বড়। দু-পাঁচজনের সঙ্গে মতের অমিল অনেক ছোট জিনিস। তার জন্য দল থেকে সরে আসার কোনও কারণ নেই। আপত্তি, প্রশ্ন, প্রতিবাদ নিয়ে দলের ভিতর লড়তে হয়।’

তমসা সেই সময়কার পার্টি লিডারশিপকে বলেছিল, ‘মতের অমিল যদি কোনও ইস্যু নিয়ে হত, তাহলে অন্য কথা ছিল। আমার বিশ্বাসে ধাক্কা লেগেছে। দলের মধ্যে যারা ক্ষমতাবানদের গা ঘেঁষে চলে তারা একরকমভাবে কাজ করবে, আর যারা দূরে দূরে থাকে তারা অরেকরকম কাজ করবে, এই নীতি আমি মানতে পারছি না।’

‘বসে মিটিয়ে নাও তমসা। কথা বলো।’

তমসা বলেছিল, ‘অনেকবার বসেছি। আশ্বাস পেয়েছি, কাজ পাইনি।’

‘এত ছোট কারণে এত বড় একটা স্বপ্ন বাতিল করে দেবে। তুমি তো আর নেতানেত্রীর মুখ দেখে পার্টি করতে আসোনি, মানুষদের মুক্তির স্বপ্ন দেখে এসেছ।’

তমসা এরপরেও রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘আমি স্বপ্নকে বাদ দিচ্ছি না। পার্টিকেও না। আমার আজও বিশ্বাস এই পার্টি পারবে সমাজ বিকাশের মধ্যে দিয়ে মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে। আমি পার্টির সঙ্গে ঝগড়া করছি না। শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদ নিচ্ছি। এখনও মেম্বারশিপ পাইনি। ফলে জটিলতা কিছু নেই। তাছাড়া আমার ছেলেটা খুব ছোট। তাকে বাড়িতে ফেলে প্রাোগ্রামে আসতেও পারি না। এখন তো সমিতিতে লোকের অভাব হবে না। আমার মতো দু-পাঁচজন কে থাকল কি না থাকল তাতে কিছু এসে যায় না। আবার যখন প্রয়োজন মনে করব নিশ্চয় ফিরে আসব।’

এরপর আর তমসাকে নেতৃত্ব কিছু বলেনি।

মহিলা ফ্রন্টে কাজ করতে করতেই শেখরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তমসার। শেখর তখন ব্রাঞ্চের সেক্রেটারি। রাতদিন পার্টি অফিসে পড়ে থাকে। একনিষ্ঠ, সিরিয়াস, সৎ নেতা। পরিশ্রম করে খুব। তার হাবভাব আচার আচরণ দেখলে বোঝা যেত না পার্টি সরকারে আছে। কেউ কখনও তার দিকে আঙুল তুলতে পারেনি। সংগঠনে খুব জোর দিত। মাঝে মাঝেই মহিলা, ছাত্র, যুব শাখার সদস্যদের ডেকে বকাবকি করত।

‘কমরেড আপনারা কী চান? পার্টিটা উঠে যাক? আমরা সবাই মিলে সরকারে চলে যাই? মন্ত্রী হয়ে রাইটার্স বিল্ডিয়ে গিয়ে বসি? সরকারটা কীসের জোরে দাঁড়িয়ে আছে আপনারা জানেন না? দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংগঠনের জোরে। ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন যদি অ্যাক্টিভ না থাকে, পার্টিও চলতে পারে না। সরকারও টিকতে পারে না। আপনাদের দেখে অবাক লাগে। আপনারা যেন বুঝে গেছেন, গণসংগঠন করবার জন্য পরিশ্রম করতে হবে না। পার্টি গভর্নমেন্টে রয়েছে, সেই লোভে সবাই ছুটে আসবে। ছাত্র, যুব, মহিলাদের মিটিং-মিছিলে ভিড় হবে। তাই হচ্ছেও। ভিড় দেখেই আপনারা খুশি। অথচ আপনারা জানেন, এর মধ্যে অনেকটাই ভুষি। বেনোজল। কিছু পাওয়ার জন্য ভিড় করে। সরকারি সুবিধে, চাকরি, কন্ট্রাক্টরি, বদলি, প্রাোমোশন। যদিও আমি তাদের এই ছুটে আসাটাকে অন্যায় বলে মনে করি না। এই দেশে একজন দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের যা প্রাপ্য, তা সে পায় না। সে তার প্রয়োজন মেটাতে অসহায়ের মতো সর্বত্র ছুটে বেড়ায়। আমাদের কাছে রিলিফের জন্য আসে। যেহেতু আমাদের সরকার পার্টির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তাই পার্টির কাছেই মানুষ আসবে। অনেকে সমালোচনা করেন, পার্টির ব্রাঞ্চ অফিস, লোকাল অফিস সরকার চালাচ্ছে। আমরা কেউ কেউ এই সমালোচনা শুনে মুষড়ে পড়ি। লজ্জা পাই। কারণ নিজেদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। আমরা কী, কেন সেটাই আমরা ভালো করে জানি না। আমার তো গর্ব হয়। দরিদ্র পার্টির সরকার তো এরকমই হবে। আমরা নীতি আদর্শ দিয়ে সরকার গড়েছি। মানুষ তো পার্টি অফিসে আসবেই। সাধারণ, গরিব মানুষের কাছে পার্টিই সরকার। আর আপনারা সকলে সরকারের একেকটা পার্ট, অংশ। এইসব সমালোচনায় মুষড়ে পড়বার কিছু নেই। নিজেদের মনকে পরিষ্কার রাখুন। নিজেরা কোনও লোভে জড়িয়ে পড়বেন না। আপনার কাছে যে আসছে তাকে নিয়ম মেনে সাহায্য করতে পারলে করবেন। বুক ফুলিয়ে করবেন। কিন্তু একই সঙ্গে তাকে পার্টির আদর্শে, নীতিতে শিক্ষিত করবার চেষ্টা করতে হবে। গণসংগঠন এই কাজ করতে পারে। যারা ভুষি, বেনোজল তারা সরে যাবে। যাক। আপনারা দশ জনে একজনকে নিজেদের সংগঠনে আনুন। ভিড় বাড়াবার জন্য নয়, নীতি, আদর্শের জন্য। আপনারা এই কাজ সিরিয়াসলি করছেন না।’

তমসা মানুষটার প্রেমে পড়ে যায়। শেখর পার্টির হোলটাইমার। পার্টির দেওয়া লেভিটুকুই আয়। তমসা চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগল। সে লেখাপড়ায় ভালো। পরীক্ষা দিয়ে স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল। অনেকে বেঁকাভাবে বলল, পার্টির কাছের লোক তাই চাকরি জুটে গেল। তমসা এসব কথায় পাত্তা দিল না। সে জানে, পার্টিতে এ ধরনের বেঁকা কথা বলার মতো মানুষ যেমন আছে, তেমন লেখাপড়ায় ভালো, কাউকে ধরাধরি না করে, পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার মতো লোকও প্রচুর আছে। এসব কথা গায়ে মাখবার কিছু নেই।

তমসাই বিয়ের জন্য শেখরকে প্রস্তাব দিয়েছিল।

‘আমার সঙ্গে সংসার করতে পারবে?’

তমসা বলেছিল, ‘জানি না সংসার কাকে বলে, তবে তোমার পাশে থাকাটা যদি সংসার করা হয়, তাহলে পারব।’

‘আমি কিন্তু রাজনীতি নিয়েই থাকব।’

তমসা বলেছিল, ‘সেই কারণেই তো তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

‘অনেক ঝামেলা। অনেক কষ্ট।’

তমসা বলেছিল, ‘এটা আর নতুন কথা কী? ঝামেলার মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট তো পেতেই হবে।’

‘পার্টি এখন পাওয়ারে। কিন্তু আমি কখনও কোনও সুযোগ-সুবিধের মধ্যে দিয়ে যাইনি, যাব না। আমি একা নই, আমার মতো এরকম বহু কমরেড আছে, তারা আমার থেকেও অনেক কষ্টে জীবনযাপন করে। তাদের কথা আমরা জানতে পারি না। গুটিকয়েক শহুরে সুবিধাভোগীকে দেখে পার্টির বিচার করি। আমি কিন্তু এই জীবন থেকে সরতে পারব না তমসা।’

তমসা বলে, ‘জানি। জানি বলেই তোমার পাশে থাকতে চাই। একজন ভালো মানুষের সঙ্গে থাকবার আনন্দ টাকাপয়সার কষ্টের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমি সেই আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাই না।’

বিয়ে হল। তারপর একসময় পার্টি থেকে দূরেও সরে গেল তমসা। এই নিয়ে শেখর তাকে জোর করেনি। তবে কেউ কেউ ফের বিদ্রুপ করেছে। বলেছিল, ‘মেয়েটা চালু। চাকরি, বর জুটিয়ে নিয়ে কেটে পড়ল।’ তবে সেই কথা বেশি দূর এগোতে পারেনি। শেখরের মতো সৎ, স্বচ্ছ মানুষকে জড়িয়ে বেশিদিন খারাপ কথা চালানো মুশকিল। যারা প্রসঙ্গটা তুলেছিল, তারাই দ্রুত চুপ করে গেল। তমসাই দরজায় সাঁটা কাগজ নিয়ে স্বামীর কাছে আপত্তি তুলেছিল।

‘এইসব বাড়ির দরজায় না লাগালেই নয়?’

শেখর বলেছিল, ‘কেন নয়? না লাগালেও চলে।’

তমসা অবাক হয়ে বলল, ‘না লাগালে যদি হত, তাহলে লাগিয়েছ কেন?’

শেখর বলল, ‘দুটো কারণে। না, দুটো নয়, তিনটে কারণে তমসা। এক নম্বর হল, সরকার থেকে সরে গিয়েছি মানেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, আমরা সব গালে হাত দিয়ে বসে থাকব এটা একেবারেই ঠিক নয়। আমাদের নতুন করে কাজ শুরু হল, শেখবার কাজ। এতদিন যে কাজটা আমরা করতে পারিনি। পারা সম্ভবও ছিল না। এত বছরের একটা সরকার গন্ধমাদন পর্বতের মতো আমাদের ঘাড়ের ওপর বসেছিল। তাকে সামলাতেই গোটা পার্টিটার অনেক সময় চলে গেছে। দু-নম্বর কারণ, আমি।’

তমসা অস্ফুটে বলল, ‘আমি।’

শেখর বলল, ‘হ্যাঁ আমি। আমি নিজে যেন ঘরে ঢুকতে-বেরোতে কথাটা মনে রাখি। শুধু কমরেডদের বললাম, আর আমি নিজের মতো চললাম, তা যেন না হয়।’

তমসা বলল, ‘তা হলে দরজার বাইরে? ঘরেও রাখা যেত। এটা কি বাড়াবাড়ি নয়?’

শেখর সামান্য হেসে বলেছিল ‘অবশ্যই বাড়াবাড়ি তমসা। আমাদের এখন বাড়াবাড়িই করা দরকার। যা বলবার জোর গলায় বলতে হবে। আমি ভয় পাইনি, একথাটা পার্টি, সমর্থকদের জানাবার জন্যই নিজের বাড়ির দরজায় লিখে দিয়েছি। আমি জানি, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে এর জন্য বাড়িতে হামলা হতে পারে। আমি সামান্য একটা কাগজ বাড়ির দরজায় সাঁটতে ভয় পাব? এটাই স্বাভাবিক তমসা। এতদিন একটা সিস্টেম চলছিল। সেটা নড়েছে। তার জন্য কিছু ক্ষয়ক্ষতি তো হবেই।’

তমসা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আর তিন নম্বর কারণ?’

শেখর একটু চুপ করে থেকে হাসল। বলল, ‘লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট। আমি কমরেড স্তালিনের প্রসঙ্গ এনে নতুনের একটু নাড়া দিতে চাইছি। এটা পার্টিতে সম্ভব নয়। পার্টি অ্যাপ্রুভ করবে না। তাই নিজেকে দিয়ে খুব ছোটভাবে শুরু করলাম। আমি বিশ্বাস করি, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট নেতারা, বিভিন্নভাবে উন্মোচিত হন। যুগে যুগে হয়েছেন। কমরেড স্তালিনের কিছু কথা এখন খুব সময়োপযোগী। যেমন এই শিক্ষার প্রসঙ্গ।

তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তা বলে স্তালিন!’

শেখর বলেছিল, ‘অবশ্যই। কমরেড স্তালিনের সাফল্যকে ছোট করে দেখবার ক্ষমতা কারও নেই। তাঁর নেতৃত্বেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে শ্রমিকের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা খুব বড় কথা। গণতন্ত্র কার হাতে থাকবে। এখানেই দেখো না। মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া স্ট্রাকচার থেকে উঠে আসা অনেকেই পার্টিতে উচ্চস্থান পেয়েছেন। এটার ভালো দিক যেমন আছে, তেমন মন্দ দিকও আছে। আদর্শকে সরিয়ে ব্যক্তিপুজো বড় হয়ে ওঠে।’

তমসা নীচু গলায় বলে, ‘এখানেও কি তা হয়নি? ব্যক্তি নিয়ে আমরা লাফালাফি করিনি?’

শেখর বলল, ‘অস্বীকার করছি না। কিছু হয়তো হয়েছে। তবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এটা নতুন কিছু নয়। বারবার ঘটেছে। এই চ্যুতি শুদ্ধ মার্কসবাদের ছদ্মবেশে বহুবার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। পেরেওছে। আসলে কী জানো তমসা, মার্কসবাদ চিরকালই আগুনের মধ্যে দিয়ে চলে। যাকে বলে অগ্নিপরীক্ষা। এক সময় যেটা ঠিক, সত্য, অন্য সময়ে সেটাই মিথ্যে ভুল হয়ে যায়। মার্কসবাদের এই দ্বন্দ্ব, দ্বিধা চিরন্তন। তার মধ্যে থেকেই অমৃতকে খুঁজে নিতে হবে। সেই অমৃতই হল মানুষের হাতে ক্ষমতা। আমাদের এখানে এটা সত্য। ব্যক্তির মূর্তি ভাঙা যায়। মানুষটাকে ভাঙা যায় না।

তমসা আর দরজায় সাঁটা কাগজ নিয়ে আপত্তি করেনি। বরং গত দুবছর হল সে আবার পার্টির কাজে খানিকটা করে সময় দিচ্ছে। বারো বছরের ছেলে শান্ত। তাকে সবসময় নজরে রাখতে হয় না। তমসা মনে করে, এখন শুধু ঘর-সংসার নয়, বাইরে বেরিয়ে কাজের সময় এসেছে।

অর্চিন তার ‘শেখরদা’র দরজায় কড়া নাড়ল। সেও মনে করে, এখন শুধু নিজের কেরিয়ার গুছিয়ে ‘গুডবয়’ হওয়ার সময় নয়, মাঠে নেমে কাজ করবার সময় এসেছে। সে সব ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হতে চায়।

ষোলো

কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা-কর্মীর ঘরদোর কেমন হয়? ছন্নছাড়া? অগোছালো?

গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় সেরকমই দেখানো হয়। দেওয়ালে বিপ্লবীদের ঝুললাগা ফটো, টেবিলে উপছে পড়া বই, চেয়ারে না-কাচা জামাকাপড় ডাঁই করে রাখা, খাটের ওপর বই, খাতা, লিফলেট, পোস্টার। ঘরের কোণে পতাকা, মেঝেতে চাটাই, চারপাশে ছড়িয়ে আছে মাটির ভাঁড়, বিড়ির টুকরো। ভাবটা এমন যেন, গোছগাছ পরিচ্ছন্নতায় কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের রুচি নেই অথবা সময় নেই। তারা সর্বদাই ভাবছেন কমিউনে রয়েছি। যে-কোনও সময় লড়াইয়ের জন্য ডাক পড়বে। টেবিলের পাশে দাঁড় করানো বন্দুক, খাটের ওপর রাখা লাল পতাকা, দরজার গায়ে ঝোলানো ওভারকোট আর টুপি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে হবে।

এই ঘটনা যেমন সত্যি, আমার সত্যিও নয়।

কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের জীবনযাপনের যে ছবি বাঙালি মনে জমা রয়েছে, তা মূলত রুশ বিল্পবের সময় থেকে ধার করা। রুশ সাহিত্য, সিনেমায় এই ধরনের ঘরবাড়ি, কমিউন, গোপন আস্তানা আকছাড় দেখা যেত। সেই দৃশ্যই মনে গেঁথে আছে। আবহমানকাল ধরে গল্পে, উপন্যাসে সেসবই বলা হচ্ছে। চিন, ভিয়েতনাম, কিউবা, চিলির বিপ্লবীদের জীবনচর্চার ছবিও এত জনপ্রিয় নয়। ভিয়েতনামের বিপ্লবীরা কোন ধরনের ঘরে থাকতেন, সে বর্ণনা সহজে পাওয়া যায় না। এর কারণ এক সময় রাশিয়ার প্রচার ক্ষমতা ছিল তীব্র। সে কড়া প্রচারের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মনে ‘বিপ্লব থেকে বিপ্লবী’ কর্মকাণ্ডের অনেকটাই দখল করে নিয়েছিল।

শেখর গুপ্ত ড্রইংরুম এই ধারণা ভেঙে দেবে।

তমসাকে বিয়ে করার আগে থেকেই অপরিসর এই ঘরটি পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন। খুবই সাধারণ আসবাব। তক্তাপোশের ওপর পাতলা তোষক পেতে ‘ডিভান’ বানানো হয়েছে। ওপরে বেডকভারটি সাধারণ, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। টেবিল, চেয়ার, মোড়া, বেতের বুকর‌্যাকের সঙ্গে আছে দেওয়ালে ঝোলানো তিনটে ফটো। একজন কার্ল মার্কস, অন্য দুজন শেখরের বাবা এবং মা।

শেখরের ড্রইংরুমের বুকর‌্যাকে লোক দেখানো কোনও বই নেই। সবই রোজ নাড়াঘাঁটা করার বই। পার্টির বই, কাগজপত্র বেশি। নীচের তাকে বেশ কিছু কবিতার বই আছে। শেখর কবিতা পড়তে ভালোবাসে। অর্চিনকে কবিতা পড়ার কথা সে-ই বলেছে।

‘কবিতা পড়তে হবে অর্চিন। যারা সুন্দর, সমঅধিকারের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের কবিতা পড়তে হয়। কবিতা না পড়লে স্বপ্ন দেখা যায় না। আর স্বপ্ন না দেখলে দু:খী মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করবে কী করে? মনে রাখবে, কবিতা পড়ার ব্যাপারে বাছবিচার রাখতে নেই। কবি কোন দলের সমর্থক, কবি বাজারি পত্রিকায় লেখে না লিটল ম্যাগাজিনে লেখে—এসব ভাবতে নেই। সাহিত্য, শিল্প নিয়ে ভাগাভাগি করতে গিয়ে আমাদের পার্টি একসময় ভুল করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশকেও আমরা বর্জন করতে গিয়েছিলাম। সেই ভুল আমরা শুধরে নিয়েছি। আমরাই পারি নিজেদের ভুল সংশোধন করতে। কবিতা পড়বে মন খুলে। পাবলো নেরুদা যেমন পড়তে হবে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও পড়তে হবে। নতুন নতুন কবিদের লেখা খুঁজে পড়তে হবে। কবিতায় শুধু লড়াই সংগ্রামের কথা লেখা থাকবে, এমনটা ভাবলে চলবে না। কবিতা মনের দু:খ, যন্ত্রণা, আনন্দ, চাওয়া-পাওয়া, জীবনের জটিলতার কথা বলে। অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কবিতাকে না ছুঁলে নতুন সমাজ গড়া যায় না অর্চিন।’

শেখরদার ঘরে ঢুকে অর্চিন বসেছে তক্তাপোশ ডিভানের ওপর। আজ ডিভানের ওপর তমসা একটা চওড়া বাদামি স্ট্রাইপের চাদর পেতেছে। অর্চিনের হাতে দুটো বই। একটি প্রবন্ধ সংকলন। নাম বামপন্থার ভবিষ্যৎ। সম্পাদক কল্যাণ দাশগুপ্ত। অন্যটি কবিতার বই। নাম জার্নি। কবির নাম তিলোত্তমা বসু। প্রবন্ধের বই শেখরদার। পড়বার পর ফেরত দিতে এনেছে। কবিতার বইটা তাকে দিয়েছে ঋষা। শেখরদা কবিতা পড়তে বললেও অর্চিন এ ব্যাপারে উৎসাহ পায় না। কবিতা মাথায় ঢোকে না। তাও কিছু কিছু চেষ্টা করে এবং ফেল করে। ঋষা একজন বিরাট কবিতাভক্ত মেয়ে। তাদের লিটল ম্যাগাজিন আছে। সে অর্চিনের মুখে শেখরদার কবিতা সম্পর্কিত কথা শুনে খুবই উৎসাহ পেয়েছে। সেও অর্চিনকে কবিতা পড়ানোর চেষ্টা করে। এই বইটা দিতে অর্চিন নাক সিঁটকেছিল।

‘কবিতার বই আমাকে দিচ্ছিস কেন? আমি কবিতার কী বুঝি?’

এর উত্তরে ঋষা ছোটখাটো একটা লেকচার দিয়ে বসে।

‘আহা, পড়েই দেখো না। বুঝতে হবে না। কবিতাগুলো আমার এক দিদির লেখা। তিলোত্তমা বসু। খুব শক্তিশালী কবি। আড়ালে, নির্জনে থেকে লেখালেখি করে। কবিদের যা মানায় আর কী। আজকাল কিছু কিছু কবির সম্পর্কে কত বাজেবাজে কথা শুনি। খারাপ লাগে। নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি করে। একে অন্যকে হিংসে করে। অন্য কোনও কবির প্রশংসা শুনলে গলা ফোলায়। বলে, নিশ্চয় কোনও স্বার্থ আছে। কয়েকজন আবার নিজের ঢাক পেটাতে চাইলে আর কিছু চায় না। কবিতার মতো পবিত্র একটা বিষয় নিয়ে এমনটা কীভাবে হয় কে জানে? সত্যিকারের কবিরা কখনও আমাকে দেখ, আমাকে দেখ করে না। পাঠকরা তাঁদের খুঁজে দেখে নেয়। হাতে গোনা হিংসুটে, একজিবিশনিস্টদের দল অন্যদের নাম খারাপ করছে। তিলোত্তমাদি আমাদের ম্যাগাজিনে লেখে। আমরাই জোর করে লেখাই। কোনওদিন কাউকে বলে না, আমার লেখা ছাপো। এর মধ্যেই ভালো ভালো সব কবিতা লিখেছে।’

অর্চিন চুপ করে ঋষার লেকচার শোনে। প্রথমে ভেবেছিল, মাঝখানেই থামিয়ে দেবে। তারপর দেখল, ভালোই হয়েছে। কবিদের হালচাল সম্পর্কে খানিকটা জানা গেছে। এই বিষয়টা তার একেবারেই ব্ল্যাঙ্ক ছিল। নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘আমাকে কবিতা পড়তে দিয়ে বিরক্ত করিস না। আমার অনেক কাজ আছে।’

ঋষা হেসে বলল, ‘আচ্ছা, পড়তে হবে না। বাড়ি নিয়ে গিয়ে ফেলে দিস।’

বইটা ঘরে ফেলেই রেখেছিল অর্চিন। একদিন অন্যমনস্ক এবং অবহেলা ভরে পাতা উলটোতে গিয়ে ক’টা কবিতা ভলো লেগে গেল। ঠিক গোটা কবিতা হিসেবে নয়, আলাদা করে শব্দ, বাক্য মনে ধরল। উৎসাহ নিয়ে আরও ক’টা পড়ে ফেলল সে। একসময় বই শেষ করে অর্চিন অবাক হল। সব কথা বুঝতে পারল না, তার পরেও ভালো লাগছে। কবিতা কি তবে এরকমই? সব বোঝা-না-বোঝার জন্যই তাকে ভালো লাগে? কাছের মনে হয়? মনে হয়, এই তো আমার আশ্রয়? এই তো আমার শক্তি? এরপর অর্চিন একটা কাণ্ড করে বসল। তার মতো ছেলের পক্ষে যা অসম্ভব। বইয়ের পাতা খুলে ‘ফেরার ভাড়া’ নামে একটা কবিতা নিজের মনে অস্ফুটে আবৃত্তি করে উঠল—’হতাশার কবিতা থেকে দূরে আমার বাড়ি/ প্রেম ও ঘৃণার কবিতা থেকে ঘুর ঘুরপথ/ একা একা বাড়িতে ফিরছি…।’

বইটা শেখরদাকে পড়াতে এনেছে অর্চিন। তবে শুধু বই দিতে আসেনি ঃ শেখরদাকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাতেও এসেছে। ইতিমধ্যে জানিয়েও ফেলেছে।

শেখর গুপ্ত বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে সহজভাবে বলল, ‘হঠাৎ হোলটাইমার হওয়ার ইচ্ছে হল কেন?’

অর্চিন অবাক হয়ে বলল, ‘হঠাৎ কেন হবে? আমি তো পার্টির স্টুডেন্ট ফ্রন্টে কাজ করছি। এবার পুরোসময় দিতে চাই।’

শেখর বলল, ‘তার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হবে?’

অর্চিন গোঁ ধরা গলায় বলল, ‘অনেক লেখাপড়া হয়েছে। আমি গ্রামে গিয়ে কাজ করব।’

শেখর হেসে ফেলল। মুখ তুলে বলল, ‘অনেক লেখাপড়া হয়েছে মানে! পড়া শেষ করতে হবে না? ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিটা লাগবে না? তুই তো খুব ভালো রেজাল্ট করা ছেলে। তোর সামনে ব্রাইট ফিউচার।’

অর্চিন রাগ রাগ গলায় বলল, ‘ডিগ্রি দিয়ে আমার কী হবে? আমি তো আর চাকরিবাকরি করব না। রাজনীতি করব। আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি শেখরদা। আমি শুধু নিজের ফিউচার নিয়ে ভাবতে শিখিনি। তোমরাই শেখাওনি। অন্যের ফিউচার নিয়েও ভাবতে শিখেছি। মুখে বড় বড় কথা বলব, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অসহায় মানুষের জন্য কাঁদব, আর পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে আসলে নিজের কেরিয়ার গোছাব—এই হিপোক্রেসি আমার ভালো লাগছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তুমি তো জানো, আমি ঘরে বসে বিপ্লব দেখানোকে ঘৃণা করি শেখরদা। মাঠে নেমে কাজ করতে হবে।’

শেখর আবার হাসল। বলল, ‘বাপরে তুই তো খুব উত্তেজিত হয়ে আছিস দেখছি। হল কী তোর? আমিও তোর সঙ্গে একমত। তবে সবটা নয়। এ কথা সত্য, আজকাল খবরের কাগজে, টিভির খবর দেখে রিঅ্যাক্ট করা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নিশ্চিন্ত নিরাপদ দূরত্ব থেকে বিপ্লবীয়ানা দেখাও। এটা বাম আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর। মিডিয়া যেখানে রিঅ্যাক্ট করতে বলছে, কেউ কেউ শুধু সেখানেই রিঅ্যাক্ট করছে। ভাবছে, আহা! বিরাট প্রতিবাদী হলাম। মূল ইস্যুর ধারেকাছে যেতে চাইছে না। দেশের মানুষ কত ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আছে, সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। এসব নিয়ে মাথা ঘামালে যে নিজেকে অনেক স্যাকরিফাইস করতে হবে। একসময় পার্টির মধ্যে কেউ কেউ ভেবেছিল, এই ধরনের টিভি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ প্রচারে কাজ দেবে। কনফারেন্সে সোশাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলাও হয়েছিল। কিন্তু কার্যত সেটা আমাদের পক্ষে গেল না। গভর্নমেন্ট এবং শাসকদলের অনেক দোষ-ত্রুটি আমরা সোশাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলাম, কিন্তু ভোটের সময় ফল পেলাম না। আর সত্যি কথা বলতে কী, যদি বা পেয়ে থাকি, তাদের বিশ্বাস করা যায় না। এদের বড় একটা অংশ এই সোশাল নেট-ওয়ার্কেই একসময়ে আমাদের তুলোধোনা করেছিল। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা, অপপ্রচারে ফেসবুক ভরিয়ে দিয়েছিল। একবারও যাচাই করেনি। আজ উলটো বলছে। কাল আবার উলটো বলবে। এই ধরনের প্রতিবাদীরা নিজেদের মিথ্যে বিচারকের আসনে বসাতে ভালোবাসে। এরা নিজেদের বাড়ি, পথেঘাটে, কর্মক্ষেত্রে অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকে। এদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো অর্থহীন। তুইও ভাবিস না। যেটুকু নিজে থেকে হচ্ছে হোক।’

অর্চিন বলল, ‘তাহলে তো আমার কথাটাই ঠিক শেখরদা। আমাকে সব ছেড়েছুড়ে পুরোপুরি রাজনীতি করার সুযোগ করে দাও।’

শেখর গুপ্ত দৃঢ় গলায় বলল, ‘না, লেখাপড়া ছাড়লে চলবে না। শিক্ষার সঙ্গে পার্টির যোগ গভীর। পৃথিবীর বড় বড় নেতারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন। সাম্যবাদী মতাদর্শে আপ্লুত হয়ে তাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে অর্চিন, আমাদের পার্টিতে লেখাপড়ার বিশেষ প্রয়োজন। ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপ নয়, আমাদের দল দাঁড়িয়ে আছে দলিল, ইস্তেহার, প্যামফ্লেট, মুখপত্র, পত্রপত্রিকার ওপর। লেখাপড়া না শিখলে এসবের দায়িত্ব কারা নেবে? লেখাপড়া করতে হবে না, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ভাঙো ধরনের কাজ যারা অতীতে করেছে, এখন করছে, ভবিষ্যতে করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে। আমরা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলি না। তোমাকেও বলব না। তুমি লেখাপড়া শেষ করো অর্চিন। যা শুরু করেছ তা শেষ করতে হবে। তারপর অবশ্যই হোলটাইমার হয়ে কাজ করবে। কেউ বাধা দেবে না। বিপ্লব কখন হবে, কবে শোষিত মানুষের মুক্তি ঘটবে, সেসব পরের কথা। দরিদ্র মানুষকে রিলিভ দিতে আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলাম, ওই একই কারণে আবার আমাদের ক্ষমতায় ফিরতে হবে। নিজেদের আখের গোছাতে নয়। তখন আমাদের আরও বেশি বেশি করে শিক্ষিত মানুষের দরকার হবে। পার্টি থেকে বেনো জল বেরিয়ে যাচ্ছে, এবার তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।’

অর্চিন মন খারাপ করে বসে রইল। শেখর গুপ্ত উঠে তার কাঁধে হাত রাখল। হেসে বলল, ‘হতাশার কবিতা থেকে দূরে আমার বাড়ি। তোর এই কবিতার বই-ই তো সেই কথা বলছে। তাই তো? আমাদের জার্নি অনেক দীর্ঘ। ম্যারাথন দৌড়ের মতো। মশাল হাতবদল হয়। কিন্তু নেভে না।’

সতেরো

চুমু কত প্রকার ও কী কী?

ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে জোর আলোচনা চলছে। টেবিল ঘিরে পাঁচজন বসে আছে। তিনজন মেয়ে, দুজন ছেলে। এর মধ্যে তিথি এবং স্বয়ংদ্যুতি কথা কম বলছে। তিথিকে লাজুক মেয়ে হিসেবে সকলেই কমবেশি মেনে নিয়েছে, কিন্তু হিস্ট্রির স্বয়ংদ্যুতি কেন এই আলোচনায় অংশ নিতে অস্বস্তি বোধ করছে, এটা বোঝা যাচ্ছে না। সে একজন লম্বা-চওড়া চেহারার ছেলে। দাড়ি-গোঁফ আছে। দাড়ি-গোঁফওয়ালা ছেলে লজ্জা পাবে না, এমন কোনও নিয়ম নেই। তার পরেও বাকিরা তাকে খেপাচ্ছে।

শমজিতা বলল, ‘তোর লজ্জা পাওয়ার কী আছে? তোকে কি চুমু খেতে বলা হয়েছে? নাকি তোর চুমুর এক্সপিরিয়েন্স জানতে চাওয়া হয়েছে? তোর মতো হাঁদা ছেলের যে এই বিষয়ে কোনও এক্সপিরিয়েন্স থাকবে না, তা আমরা জানি। তুই খামোকা লজ্জা পাচ্ছিস। কাম আউট। আলোচনায় অংশ নে।’

স্বয়ংদ্যুতি ভুরু কুচকে বলল, ‘আমি লজ্জা পাচ্ছি কে বলল?’

বারিধারা বলল, ‘আলবাত পাচ্ছিস। আমাদের কথা শুনে তোর চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা কোনও অশ্লীল কথা বলছি না। চুমু কোনও অশ্লীল বা নিষিদ্ধ ব্যাপার নয় যে, তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। চুমু একটা খুবই সুস্থ, সুন্দর বিষয়। অনেক সময় অতি পবিত্র। প্রেমের সবথেকে ভালো এবং সহজ এক্সপ্রেশন হল চুমু। অথচ সেই চুমুর কথা শুনে তোর মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। হোয়াই? সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সামথিং রং উইথ ইউ। চুমু নিয়ে নিশ্চয় তোর কোনও গোলমাল আছে স্বয়ং। আছে নাকি?’

স্বয়ংদ্যুতি এবার ছেলেমানুষের মতো রাগ দেখিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বলিস না। কোথায় আমার চোখ-মুখ লাল হচ্ছে?’

শমজিতা বলল, ‘হচ্ছে, কিন্তু দাড়ি-গোঁফের জন্য বোঝা যাচ্ছে না। দাঁড়ি-গোঁফের অনেক সুবিধে। আমি যদি ছেলে হতাম, দাড়ি-গোঁফ রাখতাম। দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে ফিকফিক করে হাসা যায়, কেউ বুঝতে পারে না। এই তো ডিএনবি-র ক্লাসে আমার খালি হাসি পায়। কিন্তু হাসতে পারি না। উনি যেভাবে লেকচারের মাঝে মাঝে যাত্রাদলের বিবেকের মতো বয়েস অ্যান্ড গার্লস বলে হুঙ্কার মারেন যে, পেটে হাসি খিলখিল করে ওঠে। মুখে হাত ঢেকে বা রুমাল দিয়ে কত হাসব? দাড়ি-গোঁফ থাকলে নিশ্চিন্তে হাসতাম। কেউ দেখতে পেত না। মেয়েদের কত অসুবিধে। মনের এক্সপ্রেশন মুখে গোপন করা যায় না।’

অর্ণব বলল, ‘অসুবিধেও আছে। দাড়ি-গোঁফ থাকলে ঠিকমতো রাগ, ভয়, হাসি দেখানো হয় না। সবসময় একই রকম মনে হয়। তুই হয়তো হাসলি, মনে হবে, গোঁফের ফাঁকে ভেঙাচ্ছিস। অথবা তুই যদি রাগ করে দাঁত কিড়মিড় করিস, তাহলে মনে হবে খুশি হয়ে হাসছিস। আমার এক কাকাকে নিয়ে এই অসুবিধে হত। রাগছে না হাসছে বুঝতে পারতাম না। কাকা যেত খেপে।’ কথা শেষ করে অর্ণর হেসে উঠল।

শমজিতা বলল ‘বাজে কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তো এত বড় দাড়ি ছিল, উনি যখন হাসতেন কী সুন্দর লাগত।’

বারিধারা বলল, ‘ওনার হাসিমুখে ছবি আছে। কিন্তু উনি যে তখন হাসছিলেনই, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কোনও সাক্ষী নেই। হয়তো সকালবেলা বিরক্ত করতে আসা ফ্যানদের দেখে দাঁত কিড়মিড় করছিলেন, তখন কেউ ফটো তুলেছে। পরে সেটাই হাসির ফটো বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

অর্ণব সিগারেটে টান দিয়ে বিজ্ঞভাবে বলল, ‘অত বড় মানুষদের কথা জানি না। তবে দাড়িটাড়ি বেশি থাকলে চুমু খাওয়ার সময় সমস্যা করে।’

শমজিতা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুই জানলি কী করে? তোর তো এখনও ভালো করে গোঁফই বের হয়নি। ফরফর করে সিগারেট টানিস বলে নিজেকে বেশি ভাবছিস নাকি? দে সিগারেটটা দে। অনেক টেনেছিস।’

শমজিতা হাত বাড়িয়ে অর্ণবের হাত থেকে সিগারেট কেড়ে টানতে শুরু করল। অর্ণব বলল, ‘আমার মামাতো দাদা বিয়ের পর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলেছিল।’

বারিধারা বলল, ‘সেটা চুমুর জন্য কে বলল? হয়তো চোর-ডাকাতের মতো দেখাচ্ছিল বলে তোর বউদি জোর করেছে। কাউকে কাউকে দাড়ি-গোঁফে ফিদেল কাস্ত্রো অথবা অপরাজিত সিনেমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো রোমান্টিক লাগে, কাউকে আবার জগাই চোর, মাধাই ডাকাতের মতো দেখায়।’

অর্ণব গম্ভীরভাবে বলল, ‘না, আমাদের কাছে ঠিক খবর আছে। দাড়ি-গোঁফের কারণে মামাতো বউদির সুড়সুড়ি লাগছিল। পরে আমরা দাদাকে চেপে ধরেছিলাম। সে আমতা আমতা করেছে।’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘তোর এখনও গোঁফ গজায়নি বলে হিংসে করছিস। বানিয়ে বানিয়ে যা খুশি বলছিস।’

বারিধারা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা সরিয়ে রাখল। খানিক আগে সে একটা ভয়ঙ্কর কাজ করে এসেছে। কেউ তার মুখ দেখে বুঝতে পারছে না। ঘটনাটা কেউ জানে না। এমনকী তিনিও না। যদিও কাজটা তিথির। কাজ না বলে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ বলা ভালো। তিথির কাছে জোর করে নেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট। কাজটা সে আজ করবে না ভেবেছিল। আজ সে ইউনির্ভাসিটি কামাই করবে ঠিক করেছিল। তারপরে পরিকল্পনা বদলেছে। দিদির বাড়িতে বংশীবাদকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করবার সময় তার মোবাইল ‘হাম্বা হাম্বা’ রবে ডেকে ওঠে। গৃহত্যাগী শ্রবণের মেসেজ। মেসেজ দীর্ঘ। বারিধারা দীর্ঘ মেসেজ মোটেও বরদাস্ত করতে পারে না। তবে আজকে পেরেছে। যতই হোক, ছেলেটা গৃহত্যাগী। শ্রবণের মেসেজটা এরকম—

‘বারি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন ক’টাদিন আত্মগোপন করে থাকব। বাড়ি থেকে যখন পালিয়েছি, তখন ভালো করেই পালানো উচিত। কারও সঙ্গে দেখা করব না। অফিসেও যাব না। সেখানে নিশ্চয় আমার সন্ধানে বাবা বা দাদা এসে বসে আছে। আমাকে ধরবার চেষ্টা করছে। পুলিশেও যেতে পারে। গেলে যাক। আমার আত্মগোপনের ঠিকানা তিন নম্বর কনকবালা লেন, কলকাতা নাইন। শাম্বদের চিলেকোঠা। আমি চাই না, এই ঠিকানা কেউ জানুক। এমনকী তুমিও না। তোমাকে কিছু লুকোতে চাই না। তাই বললাম, ধারা, তুমি পড়েই এই মেসেজ ডিলিট করে ফেলবে। গুড বাই।’

মেসেজ দেখে বারিধারা হেসে ফেলল। সে ঠিক করল, বিকেলের পর শ্রবণের আত্মগোপনের ডেরায় হানা দেবে। সেখান থেকে তাকে বের করে দুজনে মিলে খানিকটা ঘুরবে। কোথাও বসে খাবে। তারপর ট্যাক্সি ধরে শ্রবণকে বাড়ি পৌঁছে তবে নিজে ফিরবে। বাড়ি থেকে পালানো বোকা প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর নিশ্চয় একটা অন্য ধরনের স্বাদ আছে। সেই স্বাদ ঝাল না মিষ্টি দেখতে হবে। বারিধারা একই সঙ্গে ভাবে, সেই যখন বেরোবেই, তখন ইউনিভার্সিটিতে ঢুঁ মারা যেতে পারে। মধুজা রায়ের ক্লাসটা করা যাবে, লাইব্রেরির বইটাও বদলানো যাবে। নন্দকাকার গাড়ি নামিয়ে দিল। ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে ঢোকবার সময় তার তিথির কাজটা মনে পড়ে গেল। নিজে থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ধরনের কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। ফেলে রাখেওনি। বারিধারা ইউনিয়ন রুমের কাছে সুদর্শনকে একা পেয়ে যায়। নামটা সকালে মনে পড়ছিল না। এখন মনে পড়ে গেল। এটাই বোধহয় নিয়ম। এই ধরনের কাজের সময় মন অন্য সবকিছু ঝেড়ে ফেলে, কেবল দরকারি ইনফর্মেশনগুলো শরীরকে সাপ্লাই করতে থাকে। নাম, ঘটনা, রাগ। যদিও সুদর্শনের নাম না জানলে বারিধারার কিছু এসে যেত না। সে এই ছেলেকে চেনে। এর সম্পর্কে আগেও কমপ্লেন শুনেছে। শুধু অশ্লীল কথা নয়, সুযোগ পেলে ছলেবলে মেয়েদের গায়ে হাত দিতেও এই ছেলে পিছপা হয় না। প্রায়ই ইউনিভার্সিটি আর পাড়ার রোয়াক গুলিয়ে ফেলে। এর জন্য সাহস লাগে। মদত আছে বলেই এই ধরনের ছেলে ‘বীরপুরুষ’ হয়েছে।

করিডরের একপাশে দাঁড়িয়ে বারিধারা সুদর্শনকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সুদর্শন সত্যি সুদর্শন। লম্বা, ফর্সা। কায়দা করা জামা-কাপড়। ‘ভাই একটু শুনবে।’

সুদর্শন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমাকে বলছ?’

বারিধারা সুন্দর করে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, তোমাকে বলছি।’

সুদর্শন খানিকটা অবাক এবং খুশি হয়েই এগিয়ে আসে। সুন্দর একটা মেয়ে মিষ্টি করে ডাকলে খুশি হওয়ারই কথা।

‘কী হয়েছে?’

বারিধারা চাপা গলায় বলে, ‘তুমিই তো সুদর্শন?’

সুদর্শন বলে, ‘হ্যাঁ, তুমি বারিধারা না? হিস্ট্রি ফাইনাল?’

বারিধারা গদগদ গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে চেনো দেখে খুব ভালো লাগছে।’

সুদর্শন ঠোঁটের কোণে হেসে বলে, ‘আমি এখানকার সব মেয়েকে চিনি।’

বারিধারা চোখ বড় করে বলে, ‘বা: গুণী ছেলে। আচ্ছা, তুমি তিথিকে চেনো?’

সুদর্শন একটু থমকে, ভুরু কুঁচকে তাকায়। আগ্রহ আর সন্দেহ নিয়ে বলে, ‘চিনি মনে হচ্ছে। কী ব্যাপার বলো তো?’

‘তেমন কিছু ব্যাপার না। ও একটা জিনিস তোমার জন্য পাঠিয়েছে। নিজে হাতে দিতে লজ্জা পাচ্ছে। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। দিয়েছে বলাটা ঠিক হবে না। আমি নিয়েছি।’

সুদর্শন বলে, ‘কী জিনিস?’

বারিধারা অনুরোধের ভঙ্গিতে বলে, ‘একটু ওদিকে সরে যাবে? ওই যে পার্টিশানটার আড়ালে? আসলে তিথিকে আমি কথা দিয়েছি, জিনিসটা আড়ালে দেব।’

সুদর্শন বিরক্তির ভান করে বলে, ‘ইউনিভার্সিটির মধ্যে এসব আবার কী? আড়াল-টাড়াল কী ব্যাপার? যা বলবার এখানে বলো।’

বারিধারা বলে, ইসস জোরে বোলো না। সবাই শুনতে পাবে। প্লিজ একটু এসো। অবশ্য তুমি যদি বলো, আমি এখানেই না হয়…।’

সুদর্শন বলে, ‘আচ্ছা, এসো।’

পার্টিশানের আড়ালে যাওয়ার পর বেশিক্ষণ সময় নেয়নি বারিধারা। নেবেই বা কেন? ঠাসিয়ে একটা চড় মারতে কত সময় লাগে? ভীত, হতবাক সুদর্শন গালে হাত দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। বারিধারা শান্ত গলায় বলে, ‘আজ আড়ালে মারলাম ভাই। দ্বিতীয় দিন যদি এই ধরনের অসভ্যতার কথা শুনি, তাহলে ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে মারব। মনে থাকবে?’

যা কথা ছিল তাই করছে বারিধারা। বলেছিল, ওই বদ ছেলেকে চড় মারবার পর ক্যান্টিনে চা খাবে, তারপর ক্লাস করতে যাওয়া হবে। তাই এসেছে। এখন দুটো পিরিয়ড অফ। তারপর মধুজা ম্যাডামের ক্লাস। চুমু বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত করেছে শমজিতা। কাল রাতে তার মায়ের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে তার ঝগড়া হয়েছে। মা বলেছেন, আজকাল চুমু নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি হয়। সিনেমা-টিনেমায় এমনভাবে দেখানো হচ্ছে, যেন কোনও ব্যাপার নয়। এ আবার কী! ছিছি! ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এসব বিদেশ থেকে আসা ফ্যাশন। নোংরামি, অশ্লীলতা। শমজিতা আপত্তি করেছে। তার মতে, ভালোবাসার এমন সুন্দর প্রকাশকে নোংরা বলা মোটেও ঠিক নয়। জিনিসটাকে কেমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই আসল কথা। আমাদের সমাজ প্রকাশ্যে চুমুকে মেনে নেয় না। সেই পরিস্থিতি এখন হয়নি। তার মানে, কোনও দিন হবে না, এমনটাও নয়। কদিন আগে তো ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে প্রেম করছে, এটাও মেনে নেওয়া হত না। এখন দুটো ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে গেলে কেউ ফিরেও তাকায় না। ঘটনা অন্য কিছু না প্রেম, সেটা বোঝাই যায়। খারাপ কিছু হলে সব কিছুই খারাপ। চুমু খেলেও খারাপ, না খেলেও খারাপ। এসবের মধ্যে যায়নি, এমন অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা চুলোচুলি করে। সেটা কম নোংরা? বউকে চুমু খায় না, কিন্তু পেটায়—এটা কম অশ্লীল? শমজিতার মা এসব মানতে চাননি। তিনি মনে করেছেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা ঠিক করছে না। শমজিতা ক্যান্টিনে, বন্ধুদের কাছে সেই প্রসঙ্গ তুলেছে।

বারিধারা হেসে বলল, ‘চুমু মানে তো শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার চুমু নয়, সন্তানকে বাবা-মায়ের চুমুও আছে। ঠাকুমা, দিদিমাকে নাতি-নাতনির চুমু আছে। ভাই-বোনের চুমু আছে। সবই ভালোবাসা। তাই আগে দেখতে হবে, চুমু কয় প্রকার ও কী কী? ভালোবাসার এই দিকটা নিয়ে অনেক রসাল আলোচনা হয়, কিন্তু অ্যাকাডেমিক চর্চা কখনও হয় না।’

অর্ণব বলে, ‘আপত্তিটা সেক্সের প্রশ্নে। চুমু যখন সেক্স অ্যাক্ট হিসেবে ব্যবহার হয়…।’

বারিধারা অবাক গলায় বলে, ‘আপত্তি কেন? কে তার ব্যক্তিজীবনে কীসে তৃপ্তি পাবে, কীসে খুশি হবে, কেমন ভাবে তার ভালোবাসার মানুষকে স্পর্শ করবে—তাতে অন্যদের আপত্তি হবে কেন! ভালোবাসা শরীর বাদ দিয়ে হয় নাকি? শরীর ভালোবাসা বাদ দিয়ে হতে পারে। তবে সোসাইটি পারমিট না করলে সেটা খোলাখুলি না হওয়াই উচিত।’

এবার তিথি মুখ খোলে। বলে, ‘বিষয়টা নিয়ে এত আলোচনার কী আছে? এত ঢাক পেটানোর তো কিছু নেই।’

বারিধারা বলে, ‘এটা কী বলছিস তিথি! লেখাপড়া শিখে এরকম বোকার মতো কথা বলে নাকি? জীবনের সবকিছু নিয়েই আলোচনা করা উচিত। এরপর তো বলবি, সেক্স এডুকেশনের কোনও প্রয়োজন নেই।’

তিথি বলল, ‘আমাদের পুরোনো আমল কী খারাপ ছিল? তখন তো সেক্স এডুকেশন ছিল না?’

বারিধারা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘খারাপ ছিল না, তবে ন’-দশ বছরে মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দেওয়ার হিড়িক ছিল। তারা এগারো, বারোতেই মা হয়ে যেত। বাধ্য হত। বুড়ো বরের কাছ থেকে একটা চুমুও পেত না। চুমুহীন মা সব। এখনও হয় না এমন নয়, হয়। সেটা ভালোই বলছিস? চুমু ব্যাপারটাকে খারাপভাবে না দেখে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখলে অনেক ভুল ধারণা কেটে যাবে।’

এই আলোচনার ফাঁকেই হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের পিওন লব ক্যান্টিনে এসে উঁকি মারল। তারপর গুটি গুটি পায়ে টেবিলের কাছে এসে বলল, ‘বারিধারাদি, তোমাকে মধুজা ম্যাডাম এখুনি ডাকছে। এখুনি।’

সবাই অবাক হয়ে দেখল, তাদের হাসিখুশি লবদার মুখ থমথম করছে।

আঠেরো

ইউনিভার্সিটির আর পাঁচজন ছেলেমেয়ের মতো বারিধারাও মধুজা ম্যাডামকে পছন্দ করে না। মধুজা রায়কে আড়ালে সবাই ডাকে ‘শ্রীমতী ডিয়ার’। যারা জানে না তারা ‘ডিয়ার’ শুনলে ভাববে, প্রিয়। ঘটনা তা নয়। এই ‘ডিয়ার’ হল ‘ডি’ এবং ‘আর’। শ্রীমতী ধান্দা রায়।

‘শ্রীমতী ধান্দা রায়’-কে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে অনেক গসিপ। শুধু এই ইউনিভার্সিটিতে নয়, তাকে নিয়ে চর্চা অন্য ইউনিভার্সিটি, কলেজেও। কোথাও তিনি গেস্ট লেকচারার, কোথাও গভর্নিং বডির মেম্বার, কোথাও সিলেবাস দেখতে যান, কোথাও ইন্টারভিউ বোর্ডে নাম ঢোকানো আছে। এছাড়া আরও হাজারটা কমিটি তো আছেই । বারাসাতের ওদিকে কোনও কলেজে ‘সাফসুতরো কমিটি’-তেও ঢুকে আছে। মাসে একদিন গাড়ি, আড়াইশো টাকা রেমুনারেশন। গাড়ি নেন, তবে বারাসাত পর্যন্ত যেতে হয় না। ছ’মাস, ন’মাসে একবার গিয়ে একসঙ্গে রেমুনারেশনের টাকা তুলে আনেন। মুখে বড় বড় কথা বলেন।

‘পরিচ্ছন্ন কলেজই দিতে পারে পরিচ্ছন্ন শিক্ষা। সবাই যদি এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাই তা হলে কীভাবে চলবে? বইয়ের সঙ্গে ঝাঁটা বালতিও হাতে তুলতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে। আমি এগিয়ে এসেছি।’

তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়েসেও মধুজা রায় নিজেকে আকর্ষণীয় করে রেখেছেন। নিজেকে ‘ফিটফাট, পরিচ্ছন্ন’ রাখাটা কোনও দোষের নয়; কিন্তু মধুজা রায়ের সাজপোশাক, ভঙ্গি, আচরণ সব কিছুর মধ্যেই চড়া ভাবে ‘আমাকে দেখো’ ব্যাপার আছে। এই ব্যাপার আর পাঁচজন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক-অধ্যাপিকার থেকে আলাদা। তাদের মধ্যেও দেখানো ব্যাপার থাকে। কিন্তু সেটা নিজের শিক্ষা, বিবেচনা, বোধ। তারা নিজের গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ, পত্রপত্রিকায় লেখা বইয়ের সমালোচনা ব্যাগে নিয়ে ঘোরেন। সুযোগ পেলেই বের করে দেখান। সেই দেখানোর মধ্যে এক ধরনের চাপা অহঙ্কার থাকে। লেখাপড়া জগতের মানুষ লেখাপড়া নিয়ে চর্চা, অহঙ্কার করবে না তো কী নিয়ে করবে? মধুজা রায়ের ব্যাপার অন্যরকম। নিজের গবেষণাপত্র নয়, তিনি আজকাল সকলকে দেখাতে চান, তাঁর বয়স কমছে। পেটে ভুঁড়ির ভাব হলে জিমে ছোটেন। তাতে যদি ক্লাস মিস হয় তো হবে। ক্লাস বড় না ভুঁড়ি বড়? ভুঁড়ি বড় হলে ক্লাসে গিয়ে সিলেবাসে মন দেবেন কেমন করে? সারাক্ষণই তো মন থাকবে অশান্ত। ছেলেমেয়েরা কি ভুঁড়ির বিষয়টা ধরতে পাচ্ছে? ধরতে পারলে কেলেঙ্কারি। লজ্জার একশেষ। ভুঁড়ির সঙ্গে মধুজা চুলও সামলান। চুলে নিয়মিত রং লাগান। কমবয়সি ছাত্রছাত্রীদের জন্য লাগান না, বেশি বয়সি ‘ক্ষমতাবান’-দের জন্য লাগান। ‘ক্ষমতাবান’-দের কাছে ‘ম্যাডাম’-এর নিয়মিত যাতায়াত। তিন কারণে যাতায়াত। প্রাোমোশন, অপারেশন, সাপ্রেশন। প্রাোমোশন নিজের জন্য। অপারেশন বিবিধ কমিটি, সেমিনার, ট্যুরে নিজের নাম ঢোকানোর জন্য। আর সাপ্রেশন দরকার হয় যোগ্য লোককে অন্যায়ভাবে ঠেকানোর জন্য। এর জন্যে ‘ক্ষমতাবান’-দের হাতে রাখতে হয়। তাদের সঙ্গে ‘প্রেম প্রেম’ ভাব করতে হয়। চুলে কালার টোন ঠিক থাকলে এই কাজ সহজ হয়। শুধু চুলে রং নয়, মধুজা রায় হাতে, মুখে, গলায় স্কিন ট্রিটমেন্ট করান। চামড়া যেন কুঁচকে না যায়। মাসে একবার বিউটি পার্লার মাস্ট। গায়ে তোয়ালে, মাথায় ক্যাপ, চোখে শসা চাপা দিয়ে বসে থাকেন ঘণ্টা চারেক। সেই সময় কেউ যদি তাকে দেখে কে বলবে, তিনি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। মনে হবে ‘এমনটা তুমি করতে পারলে গো’ মেগাসিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ি। সাজগোজ শেষ হলে ফেসবুকে ফটো পোস্ট করেন মধুজা রায়। ফটোতে দেখা যায় কসবার দোতলা বাড়ির বারান্দায় হাসি হাসি মুখে বসে আছেন। পিছনে গদগদ মুখের স্বামী। তার মুখ দেখে মনে হয়, তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রবর্তিত স্ত্রী-শিক্ষার হাল, চুলের রং এবং বারান্দার চেয়ার নিয়ে গর্বিত। সেই ফটোতে ছেলেমেয়েদের ঝটাপট ‘লাইক’ মারতে হয়। কে রিস্ক নেবে? পরীক্ষায় সাজেশন পাওয়ার আছে। নোটস পাওয়ার আছে। পরের জীবনে গবেষণা আছে। তার জন্য পরীক্ষায় বসতে হবে। এ তো আর অঙ্ক বা কেমিস্ট্রি নয়। ঠিক হলে ঠিক, ভুল হলে ভুল। এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে ঠিক, ভুলের পরে আছে মর্জি। পরীক্ষকের মর্জি। মধুজা রায়ের মতো মানুষ যদি পরীক্ষক হন, সেই মর্জি ঠিক রাখতে হবে? ফেসবুক ইগনোর করলে ভবিষ্যতে বড় ঝামেলা হতে পারে। চাকরি লগ্নে আসতে পারে নানা বিপত্তি। কমিটিতে কে থাকবে এখন বলা যায়? লাইক মেরে কমেন্টস লেখা বুদ্ধির কাজ। শোনা যায়, একটি ছেলে লিখেছে—

‘ম্যাম একটা কথা না বলে পারছি না। আমাকে মার্জনা করবেন। আপনাকে দ্য স্প্রিং ছবির নায়িকা অড্রে হেপবার্নের মতো লাগছে। ওই সিনেমায় অড্রে হেপবার্ন এই ভাবে বসেছিলেন।’

এর উত্তরে মধুজা ম্যাডাম তার ছাত্রকে ফেসবুকেই লিখেছেন—’অরিত্র, তুমি একটা নটি বয়। তুমি কি মনে করো আমি দ্য স্প্রিং সিনেমাটা দেখিনি? অবশ্যই দেখেছি। সেখানে অড্রে হেপবার্নকে অত্যধিক সুন্দরী লেগেছে। আমার সঙ্গে কোনও তুলনা চলে না। তোমার লেখাপড়া কেমন হচ্ছে? স্পেশাল পেপারের জন্য নোটস লাগলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’

অরিত্র এই ফেসবুকের কথা চালাচালি বন্ধুদের বলেছে। হাসতে হাসতে বিষম তুলেছে। দ্য স্প্রিং নামে অড্রে হেপবার্নের কোনও সিনেমাই নেই। তারপরেও ম্যাডাম খুশি হয়েছে।

মধুজা রায় একজন লেখাপড়া জানা মানুষ। স্কুল-কলেজে তেমন ফল করতে না পারলেও, এমএ পরীক্ষার নম্বর খুবই ভালো। ইউনিভার্সিটির দু-একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁকে হাত উপুড় করে নম্বর দিয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় কোনও কোনও সময় এমন হয়। ছোটবেলার অচেনা পরীক্ষকরা ছেলেমেয়েদের প্রতিভা বুঝতে পারেন না। তাঁরা ভুল করেন। পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দিয়ে ফেলেন। মধুজা রায় নিজে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে আর ঝুঁকি নেননি। সম্ভাব্য প্রশ্নকর্তা এবং অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা করে নিয়েছিলেন। গাড়ি নিয়ে সটান বাড়ি চলে যেতেন। দোলের দিন পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম, পুরী থেকে ফিরে ঝিনুকের পেনদানি উপহার, বিজয়ার মিষ্টির প্যাকেট। এমএ পরীক্ষার পর তিনি খুব খাটাখাটনি করে ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন। গবেষণার বিষয়টা বেশ জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে গবেষণাটি নিয়ে পরে কিছু বিতর্ক হয়েছে। তার মধ্যে একটির কথা বলতেই হয়। শোনা যায়, নিজের গবেষণাপত্রের শেষে সাহায্য নেওয়া বইয়ের যে দীর্ঘ তালিকা মধুজা রায় দিয়েছিলেন তাতে ভয়াবহ ধরনের গোলমাল ছিল। সেখানে এমন সব বইয়ের নাম ছিল যার সঙ্গে গবেষণার কোনও সম্পর্ক নেই। আবহাওয়া, সেলাই বোনা, আচার ও চাটনি প্রস্তুতি, মানুষ হইবার দশটি উপায়। বইয়ের নাম ও বিষয় দেখে গবেষক-পরীক্ষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। ভাইবা নেওয়ার সময় ক্যান্ডিডেটকে তাঁরা প্রশ্নও করেছিলেন।

‘এসব কী! তোমার গবেষণার সঙ্গে সেলাই বোনা, আচারের রেফারেন্স বইয়ের নাম কেন?’

মধুজা রায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সাবোটাজ! সাবোটাজ স্যার! আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি।’ শোনা যায়, টেবিলের উলটো দিকে বসা দুই পরীক্ষক ক্ষোভে, দু:খে মাথা নাড়তে থাকেন। দুজনের একজন মধুজা রায়ের পুরোনো শিক্ষক। অন্যজন নাকি সেদিন সকালে ‘ফোন’ পেয়েছিলেন। ‘বর’ পাওয়ার মতো। তবে পরীক্ষক ভদ্রলোক কার ‘ফোন’ পেয়েছিলেন, সেই ফোনে তিনি কী বার্তা পেয়েছিলেন জানা যায়নি। কখনও জানা যাবেও না। গসিপের সবটা জানা যায় না। তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সত্যি ঘটনা হলে একটা কথা ছিল। যাই হোক, ফোন পাওয়া পরীক্ষক বললেন, ‘ছি ছি। একজন মেধাবী ছাত্রীকে এরকমভাবে হেনস্থা! ছি ছি। দেশে শিক্ষা-ব্যবস্থার এ কী বিশ্রি অবস্থা হল! এই ঘটনার ইনভেস্টিগেশন হওয়া উচিত।’

তদন্তের কথা শুনে মধুজা রায় নাকি আরও জোরে কেঁদে উঠেছিলেন।

‘ফোন’ পাওয়া পরীক্ষক মধুজা রায়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কেঁদো না…কেঁদো না…কেঁদো না…আমরা তো আছি…তুমি এসো। তোমার ইন্টারভিউ শেষ।’

যারা এই গসিপ নিয়ে চর্চা করে তারা বলে, মধুজা রায় নাকি শেষ মুহূর্তে রেফারেন্স বইয়ের তালিকা অতিরিক্ত দীর্ঘ করবার জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বানিয়ে বানিয়ে ক’টা নাম লিখে দিলেই চলবে। তারা লেখাপড়া লাইনের লোক নয়। হড়বড় করে মাসি, পিসির, দাদুর কাছ থেকে বইয়ের নাম জোগাড় করে লিখে দিয়েছে। তাতেই কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারি নিয়ে নাড়াঘাঁটা হয়নি। তিনি ছিলেন পুরোনো গভর্নমেন্টের কাছের মানুষ। গভর্নমেন্ট বদলের সঙ্গে তিনি দল বদলেছেন। সবাই জানে আবার যদি গভর্নমেন্ট বদলায় আবার তিনি আগের পার্টি অফিসে ছুটবেন। গাড়ি রাখবেন দূরে। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠবেন দোতলায়। হাতে লাল গোলাপের স্তবক।

‘এতদিন বুকের ভিতরে জ্বালা নিয়ে বসেছিলাম দাদা। আজ সেই জ্বালা জুড়োল। এই ফুলটুকু আমার বুকের রক্ত। আপনার পায়ে নিবেদন করতে নিয়ে এসেছি।’

আর্টস ডিপার্টমেন্টের চারতলায় মধুজা রায় একটা আলাদা ঘরে বসেন। সতেরোটা কমিটির কাজ তাঁকে করতে হয়। সবার সঙ্গে বসে অত কাজ হয়? তা ছাড়া বেশিরভাগ কাজই তো গোপন। এই কারণে ইউনিভার্সিটি তাঁকে ঘর দিয়েছে। সেই ঘরের দরজায় বারিধারা এসে দাঁড়াল।

‘ম্যাডাম আসব?’

মধুজা রায় কাগজপত্র থেকে মুখ তুলে বারিধারাকে দেখলেন। চোখ থেকে চমশা খুললেন।

‘এসো, বারিধারা।’

যতই টিচার হোন না কেন, এই মহিলাকে বাকি ছেলেমেয়েদের মতো বারিধারাও পছন্দ করে না। ‘শ্রীমতী ধান্দা রায়’ তাকে আলাদা কারে ডাকলেন কেন! তার ওপর লবদার মুখও গম্ভীর। কী ঘটল? মধুজা রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে বারিধারা?’

বারিধারার ভুরু কুঁচকে গেল। হঠাৎ দরদ! এভাবে তো কখনও ডেকে জিগ্যেস করেন না। বরং পেয়ারের ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য কেউ কাছে গেলে হাত-টাত নেড়ে, ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ভাগিয়ে দেয়।

‘অল্প অল্প করে হচ্ছে ম্যাম।’

মধুজা রায় মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বললেন, ‘অল্প অল্প করলে তো হবে না বারিধারা। তুমি ভালো ছাত্রী। ভালো রেজাল্ট করতে হবে।’

বারিধারা আরও অবাক হল। পিওন পাঠিয়ে ক্যান্টিন থেকে ডেকে এনে উপদেশ! আসল কথাটা কী?

‘পড়লেও সবসময় তো রেজাল্ট ভালো হয় না ম্যাম। হয়তো ঠিকমতো লিখতে পারি না।’

মধুজা রায় এবার স্মিত হাসলেন। বললেন, ‘রেজাল্ট যাতে ভালো হয় তার জন্য তো আমি আছি। তোমাদের একটা পেপার আমার হাতেই আছে। আর একটার প্রশ্নও তো আমাকে সেট করতে হয়। এসব কথা বাইরে বলার মতো নয়। কনফিডেন্সিয়াল। তোমাকে বললাম, কারণ তুমি ভালো মেয়ে। গুড স্টুডেন্ট। ভালোদের যাতে আরও ভালো হয় সেটা দেখাই তো একজন টিচরের কাজ। তাই না?’

কথা শেষ করে আবার হাসলেন মধুজা রায়। বারিধারা চুপ করে রইল। ওনার এইসব কনফিডেন্সিয়াল কথা সবাই জানে। উনিই বলে বেড়ান। নইলে ছেলেমেয়েরা তাঁকে সমঝে চলবে কেন? বারিধারা চুপ করে রইল।

মধুজা রায় এবার মুখ থেকে হাসি মুছে বললেন, ‘তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারলে বারিধারা?’

বারিধারা হালকাভাবে ঘাড় নাড়ল। মধুজা রায় বললেন, ‘তোমার যদি কোথাও আটকে যায়…এই ধরো সাজেশনস, নোটস, বই… শুধু আমার পেপারের জন্য নয়…অন্য কারওটা আটকালেও আমাকে স্বচ্ছন্দে বলতে পারো…।’

এত লোভ দেখাচ্ছে! ব্যাপারটা কী? বারিধারা অস্ফুটে বলল, ‘বলব ম্যাম।’

মধুজা রায় টেবিলের ওপর খুলে রাখা চশমাটা তুলে চোখে দিলেন। বারিধারার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘সুদর্শনের সঙ্গে তোমার কী হয়েছে বারিধারা? এনি প্রবলেম?’

বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কে সুদর্শন ম্যাম?’

‘যাকে তুমি খানিক আগে চড় মেরেছ।’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার সঙ্গে কোনও প্রবলেম হয়নি ম্যাম।’

মধুজা রায় বললেন, ‘তা হলে তুমি তাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সবার সামনে চড় মারলে কেন?’

বারিধারা চুপ করে রইল। মধুজা রায়ের গলায় এবার রাগ জোরালো হল। হিসহিসিয়ে বললেন, ‘যার সঙ্গে তোমার কোনও সমস্যা হয়নি তাকে তুমি কোন সাহসে এত বড় অপমান করলে বারিধারা?’

এতক্ষণে মধুজা রায়ের ডেকে পাঠানোর কারণ বুঝতে পারল বারিধারা। বারিধারা মনকে শক্ত করল।

‘আমার এক বন্ধুকে ওই ছেলেটি বিশ্রী অপমান করেছে। অনেকের সামনেই করেছে।’

মধুজা দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের ঢঙে বললেন, ‘তোমার বন্ধুকে কী করেছে আমি জানতে চাই না বারিধারা, আমি জানতে চেয়েছি তোমাকে কিছু করেছে কি না। সুদর্শনের একজন রিলেটিভ কলেজে আমার ব্যাচমেট ছিল। আমার খুবই বন্ধু। সুদর্শনের দাদার সঙ্গে আমার সেই বন্ধুর বিয়ে হয়েছে। এ সবের থেকেও বড় কথা, এখন সে একজন খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লেডি। পলিটিক্যাল এবং সোশ্যাল কানেকশন হাইলি স্ট্রং। এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের বহু অফিসার তার হাতের মুঠোয়। সে অনেক গোলমাল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাকে ফোন করেছিল। তুমি চড় মারবার পরই ওই ছেলে তার রিলেটিভকে ফোন করে।’

মধুজা রায় দম নেওয়ার জন্য চুপ করলেন। বারিধারার কাছে এখন সবটা জলের মতো স্পষ্ট হল। মধুজা রায় প্রথমেই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, পরীক্ষার রেজাল্টের ব্যাপারে তিনি কত ক্ষমতাশালী। এখন ধমক দিচ্ছে।

‘চুপ করে আছ কেন বারিধারা? স্পিক আউট। বলো, মানিনীর দেওর তোমাকে কী করেছে? গালাগালি দিয়েছে? ইনসাল্ট করেছে? মলেস্ট করেছে? রেপ করেছে? দেন?’ একটু থমকালেন মধুজা রায়। হাঁপিয়ে নিলেন। বললেন, ‘মানিনী এটা নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে চাইছে। ভিসির কাছে কমপ্লেইন তো বটেই, থানায় ডায়েরিও করতে চায়। যেহেতু সুদর্শন তোমাকে কিছু করেনি, খুব সহজেই তুমি ফাঁসবে। ইউনিভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড তো হবেই, থানা-পুলিশও করতে হবে। পরীক্ষার আগে তোমার কেরিয়ারের পক্ষে একটা বিরাট ধাক্কা হবে। যদি তুমি ভাবো, অন্য ছেলেমেয়েদের তাতিয়ে হট্টগোল পাকাবে, লিডার হবে, সেটাও লাভ হবে না। কতদিন হট্টগোল চালাবে? সবাই কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় দেখবে, পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তোমাকে ধরে নিজেদের ফায়দা করে নিয়েছে। তুমি ছিবড়ে হয়ে পড়ে আছ। চারপাশে দেখছ না? যদিও আমি চাই না এ সব হোক। ঘটনা এখানেই মিটে যাক। আমি যা বলব তাই করো বারিধারা। তোমার ভালোর জন্যই করো।’

বারিধারা মাথা নামিয়ে বলল, ‘কী করতে হবে?’

মধুজা রায় খানিকটা শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি ওই ছেলের কাছে ক্ষমা চাইবে। কালই আমি তাকে ডাকব। মানিনীকেও আসতে বলব। তুমি প্রকাশ্যে অসভ্যতা করেছ। কিন্তু আমি এই ঘরের মধ্যেই বিষয়টা মিটিয়ে দিতে চাই। তোমার কথা ভেবেই চাই। এই ঘরে তুমি ওই ছেলের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।’

বারিধারার শরীর কেঁপে উঠল। বলল, ‘ম্যাডাম, ওই ছেলে তিথিকে খুব নোংরা কথা বলেছে। খুব নোংরা।’

মধুজা রায় শান্ত গলায় বললেন, ‘কী কথা?’

‘মুখে আনা যায় না।’

মধুজা রায় হিসহিসে গলায় বললেন, ‘তা হলে বলছ কেন?’

বারিধারা বলল, ‘আমি তো বলিনি। চড় মেরেছি।’

মধুজা রায় টেবিল চাপড়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘শাট আপ।’ তারপরে নিজেকে সামলে বললেন, ‘বুধবার তিনটের সময় এই ঘরে এসে তুমি ক্ষমা চাইবে। এটাই আমার শেষ কথা। এখন যেতে পারো।’

মধুজা রায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বারিধারার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সে বুঝতে পারছে একটা বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেল।

উনিশ

‘অব ম্যায় কেয়া করু, কেয়া করু, কেয়া করু, কেয়াআআআ করু…’

বারিধারা গুনগুন করে গান গাইছে। গাইছে আর টকটক করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তার চোখমুখ দেখে কে বলবে, খানিকক্ষণ আগে সে এক বিরাট বিপদের মধ্যে পড়েছে? জীবন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে গুন্ডার পায়ে ধরে ক্ষমা, অন্যদিকে কেরিয়ার। তাকে দেখে বরং উলটোটাই লাগছে। মনে হচ্ছে, কোনও কারণে মেয়েটার অতি ফুর্তি হয়েছে। সেই কারণে গান ধরেছে। ফুরফুরে ভঙ্গিতে নিজেকে জিগ্যেস করছে, এখন আমি কী করব?

শাম্বদের চিলেকোঠায় তিন-চারজন বন্ধুর অবাধ গতি। অবাধ গতি বললে কম বলা হবে। তারা নিজের বাড়ির মতো করে চিলেকোঠা ব্যবহার করতে পারে। তাই করে। যখন খুশি আসে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে খাটে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। কখনও একটু ঘুমিয়ে নেয়। কখনও বই পড়ে, গান শোনে, আড্ডা দেয়, ছবি আঁকে। কখনও লেখাপড়াও করে। এই বন্ধুদের মধ্যে একজনের বাড়ি কলকাতার বাইরে। ঝড়বৃষ্টি বা ট্রেনের গোলমালে আটকে গেলে সে চিলেকোঠায় শেল্টার নেয়। মজার কথা হল, চিলেকোঠার চাবি কারও কাছ থেকে নিতে হয় না। চাবি থাকে সিঁড়িতে। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে পাথরের যে পরির মূর্তিটা আছে তার ডানার পিছনে। শাম্বর এই জনা চার বন্ধু ছাড়া কেউ জানে না। যারা জানে না তারা মাথা কুটলেও চাবি পাবে না। বারিধারা এসে চাবি নিয়ে সটান উঠে যায়। উত্তর কলকাতার এই বিশাল তিনতলা বাড়িতে শাম্ব তার মাকে নিয়ে থাকে। সে একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। চকচকে কর্পোরেট অফিস, ভোঁ বাজানো কারখানা থেকে বোকা বোকা বিয়েবাড়ি—সব ধরনের ফোটো তোলে। বেশিরভাগ সময়ই তাকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। চিলেকোঠা কে খুলে দেবে? মা তো আর ওপরে উঠতে পারবে না। সেই কারণেই পরি সিস্টেম। পরির ডানায় চাবি রাখার পিছনে এক ধরনের মজাও আছে। উড়ে যাওয়ার মজা। চিলেকোঠার ঘরে যাওয়া মানে যেন গোলমালের পৃথিবী থেকে নিজের জগতে উড়ে যাওয়া।

গৃহত্যাগী শ্রবণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে বারিধারা। তাকে নিয়ে বেরোবে। এমনটাই ঠিক করা ছিল। মাঝখানে ইউনিভার্সিটির ঘটনা এসে পড়ল। মধুজা রায়ের ঘর থেকে নেমে বারিধারা আর ক্যান্টিনে ফিরে যায়নি। ক্লাসও করল না। তিথিদের সঙ্গে দেখা হওয়া মানেই ওদের সব বলতে হবে। লাভ কী? ওরা টেনশন করবে। কাল পর্যন্ত তো সময় আছে। সে মোবাইলে টেক্সট করে দিল।

‘কেটে পড়ছি। নোটসটা রেখে দিস।’

ওদিক থেকে দ্রুত জবাব এল—’হোয়াই? হঠাৎ কী হল!’

বারিধারা লিখল—’শ্রবণ।’

‘ফাইন। বাট ডিআর? ডেকেছিল কেন?’

বারিধারা লিখল—’পরে বলব। এখন ওনলি প্রেম আর প্রেম।’

‘বেস্ট উইশেস।’

মেসেজের সঙ্গে তিথি স্মাইলি পাঠাল।

বিজ্ঞানের কী অগ্রগতি! এখন কত আয়েসে হাসি কান্না রাগ ভালোবাসা চালাচালি করা যায়। দূর থেকে মন বোঝানোর কী চমৎকার আয়োজন! অথচ কত সময় পাশের মানুষটার খুশি, দু:খ বোঝা যায় না। বারিধারার মনে হয়, এরকম কোনও ব্যবস্থা থাকলে বোঝা যেত। বিজ্ঞান প্রযুক্তি যেভাবে লাফাতে লাফাতে এগোচ্ছে, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এরকম ব্যবস্থা এসে যাবে। মানুষের কপালে মোবাইল ফোনের মতো এলইডি স্ক্রিন থাকবে। তাতে সত্যি মনটা ধরা পড়বে। ধরা যাক, কেউ হয়তো মনে মনে রাগ করেছে, কিন্তু মুখে হাসছে। তখন কপালের এলইডি স্ক্রিনে ‘লাল মুখ’ ফুটে উঠবে। লাল মুখ হল রাগের চিহ্ন। আবার উল্টোটা হতে পারে। মুখ বেজার, কিন্তু ভেতরে গুরগুরিয়ে হাসি। স্ক্রিনে হাসিটাই দেখা যাবে। উল্টোদিকের মানুষটার মনের সত্যি অবস্থা ধরা পড়ে যাবে। মোবাইলের মেসেজে অবশ্য সত্যি মিথ্যে বোঝা যায় না। যাকে খুশি ‘স্মাইলি’ পাঠানো যায়। যাকে খুশি ‘হার্ট’। যার সঙ্গে কোনও পরিচয় নেই, তার জন্যও দাঁত বের করতে হার্টের ছবি পাঠিয়ে ‘ভালোবাসি’ বলতে কোনও সমস্যা নেই। বারিধারা এইসব ব্যবহার থেকে যতটা পারে দূরে থাকে। যত দিন যাচ্ছে, এসব আর কেউ বিশ্বাস করছে না।

শাম্বদের চিলেকোঠার ঘরটা বাইরে থেকে ছবির মতো। মস্ত ছাদের এক কোনায় পাকা ঘর। মাথায় পুরোনো দিনের অ্যালুমিনিয়ামের অ্যান্টেনার খানিকটা এখনও তেরেবেঁকে রয়ে গেছে। শাম্ব ফেলতে দেয়নি। কাক বসলে নাকি ফোটোগ্রাফিক ডিজাইন তৈরি হয়। তখন শাম্ব ক্যামেরা বাগিয়ে ফটো তোলে। ঘরের ভিতরটা ঠান্ডা। বড় বড় দুটো জানলা। অনেকটা দূর পর্যন্ত পুরোনো কলকাতার স্কাইলাইন দেখা যায়। হাওড়া ব্রিজও। অবশ্য আজকাল মাল্টিস্টোরিড, হোর্ডিং, নিওন সাইনও উঁকি মারে। ঘরের একদিকে খাট পাতা। সেখানে শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। বারিধারার অবশ্য ভালোলাগা অন্য কারণে।

‘তোদের এই ঘরটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ইন্টারেস্টের কারণ ঘর নয়।’

শাম্ব অবাক হয়ে বলে, ‘মানে! ঘরের কারণে ঘর ইন্টারেস্টিং নয় কথাটার মানে কী? পাগলের মতো কথা।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘ঠিকই বলছি। সি বিচ কি বিচের জন্য ভালো লাগে? সি বিচ ভালো লাগে সমুদ্রের জন্য। সমুদ্র যদি ভালো না লাগে, সমুদ্রসৈকতও ভালো লাগবে না। তোর এই চিলেকোঠার ঘরটাও তাই। ছাদটার জন্যই এত ইন্টারেস্টিং।’

সত্যি ছাদটা সুন্দর। পুরোনো দিনের উঁচু আর মোটা পাঁচিল। পাশে দাঁড়ালে বুক পর্যন্ত হয়ে যায়। শীতের সময় বা সন্ধের পর ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে থাক। আশেপাশে এর থেকে উঁচু কোনও বাড়ি নেই। কেউ যে ডিঙি মেরে দেখবে তার উপায় নেই। কত শীতের দুপুরে বারিধারা বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়েছে। একবার তো ঘুমিয়ে পড়ে কেলেঙ্কারি হয়েছিল। শাম্বদের নতুন কাজের মাসি বিকেলে ছাদে তালা দিয়ে নেমে পড়েছিল। বারিধারা ঘুম ভেঙে দেখে সন্ধে। বাড়ি ফিরতে হবে। শাম্বদের চিলেকোঠা এত মজার তার অন্যতম কারণ, এই জায়গার হদিশ চার বন্ধুর বাইরে কাউকে জানানোর নিয়ম নেই। এটা একটা গোপন ডেরা। বারিধারা দিদিকেও বলেনি। ঠাকুর্দা কমলকান্তি সেনকেও নয়। অতএব আটকা পড়ে যে বাড়ির কাউকে ফোন করবে সে পথ নেই। চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে শাম্বকে মোবাইলে ধরতে গেল বারিধারা। লাইন আউট অফ রিচ। নিশ্চয় কোথাও ছবি তুলতে গেছে। কলকাতা থেকে দূরে কোথাও। শ্রবণকে ফোন করল বারিধারা। লাভ হল না। সুইচ অফ। অফিসে মিটিং করছে? এখন কী হবে? বাড়িতে ফোন করা মানে ‘নিয়ম ভঙ্গ’। বারিধারা ঠিক করল, যদি সারারাত চিলেকোঠার ঘরে থাকতে হয় তাহলেও চুক্তি ভঙ্গ করবে না। এদিকে শীত করছে। গায়ে একটা হাফ হাতা সোয়েটার। চাদর বলতে বিছানার চাদর। জানলা-দরজা বন্ধ করে সেই চাদর জড়িয়ে বসে রইল বারিধারা। ঝামেলার ব্যাপার হল, দুদিন আগেই ঘরের বাল্বটা গেছে কেটে। এই দুদিনের মধ্যে কেউ আসেনি। বাল্বও বদলানো হয়নি। অন্ধকার ঘরে মশার কামড় খেতে খেতে বারিধারা বুঝতে পারল তার খিদে পেয়েছে। মশা তাড়াবার জন্য মোবাইলের টর্চ জ্বেলে রাখল। একসময় মনে হল, খুব তেষ্টা পেয়েছে। সঙ্গে খিদে। ঘরে খাবার, জল কিছুই নেই। মোবাইল তুলে দেখল বারিধারা চার্জ শেষ। ঘড়িও দেখা যাচ্ছে না। একেই বলে বিপদ যখন আসে আটঘাট বেঁধে আসে। বারিধারা ঠিক করল, ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দরজায় ধাক্কা মারবে। নীচের লোকজন যদি শুনতে পায়। এই ভেবে যেই খাট থেকে নেমেছে, অমনি একটা আওয়াজ হল—ধুপ। কে যেন ছাদে লাফিয়ে পড়ল। সাহসী বারিধারা ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

‘ওরে বাবারে।’

বলেই আবার লাফ দিয়ে উঠে পড়ল খাটে। ঘটনা শেষ হয়েছিল দারুণ মজার মধ্যে দিয়ে। বারিধারা তারপর থেকে এই চিলেকোঠার ঘরটাকে আরও ভালোবেসে ফেলেছে।

বারিধারা ছাদের মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। শ্রবণকে কীভাবে চমকে দেওয়া যায়?

শ্রবণকে এখন যে-কোনওভাবেই চমকে দেওয়া যায়। সে খাটের ওপর বসে আছে। একটা লম্বা ঝুলের হাফ প্যান্ট আর কালো রঙের গেঞ্জি পরেছে। সামনে নোটখাতা খোলা। হাতে পেন্সিল। সে মন দিয়ে বিজ্ঞাপনের খসড়া তৈরি করছে। তার অফিস তাকে ছাতা বিষয়ে অ্যাড তৈরির অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। স্টিল এবং মুভি দুটোই হবে। টাইট কম্পিটিশন। আরও দুটো ছেলেমেয়ে অফিসে ঘুরঘুর করে। তাদেরও রেডি করতে বলা হয়েছে। যারটা ভালো হবে বস তারটা নেবে। ক’দিন পরেই প্রেজেন্টেশন। এখন পর্যন্ত নোটখাতায় শ্রবণ তিন ধরনের প্ল্যান করছে।

১) খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ফুটপাথের ওপর একজন ছাতাসারাইওলা ছাতা মেরামত করছে। তার মাথা প্ল্যাস্টিকে ঢাকা। সামনে একজন মাঝবয়সি লোক ব্যাটারির খোলের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বৃষ্টিতে নির্বিকারচিত্তে ভিজছে। তলায় ক্যাপশন লেখা—এল সি দাসের ছাতা না পেলে ভিজব।

২) একটা দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা এল সি পাল। বাইরে লম্বা লাইন। লাইনে কড়া রোদের মধ্যে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা কেউ ঘামছে, কেউ হাতপাখা নিয়ে খাওয়া খাচ্ছে। তলায় ক্যাপশন—রোদ তাড়াতে চাই এল সি দাসের ছাতা।

৩) এই থিমটা বেশ অ্যাডাল্ট। বড় হোটেলের সুইমিংপুলের পাশে একটা বড় রঙিন ছাতা। ছাতার আড়ালে সুন্দরী। মুখে দুষ্টু হাসি। হাত, পা অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, মেয়েটি জামাকাপড় তেমন পরে নেই। তলায় ক্যাপশন—এল সি দাসের ছাতা, রোদ, বৃষ্টি আর লজ্জা ঢাকে।

তিন থিমের পাশে অল্প অল্প স্কেচ করেছে শ্রবণ। জিনিসটা ভিস্যুয়ালি দেখতে চাইছে। কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। এই ধরনের প্রাোডাক্টের বিজ্ঞাপনে বুদ্ধির থেকে চমক বেশি লাগে! সেটাই মিসিং।

হঠাৎ আওয়াজ—’ধুপ।’

শ্রবণ চমকে মুখ তুলল। বারিধারা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। ছোট লাফ দিয়ে সে-ই আওয়াজ করেছে। এখন দুই কানে হাত রেখে মুখ ভেঙাচ্ছে।

‘আমাকে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে? লেডি হনুমান?’

শ্রবণের মুখ থেকে বিজ্ঞাপনের চিন্তার ভাঁজ চলে গেল। সে গদগদ মুখে বলল, ‘এসো বারি, ভিতরে এসো।’

‘আগে বলো, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে। নইলে ঢুকব না।’

শ্রবণ হেসে বলল, ‘কী ছেলেমানুষি করছ বারি।’

বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘ছেলেমানুষি নয় শ্রবণ, সিরিয়াস মানুষি। আমাকে হনুমানের মতো দেখানোর খুবই প্রয়োজন আছে। কিছুদিনের মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হবে। মেয়েরা হতে চায় রামায়ণের সীতার মতো। অশোকবনে বসে পুঁই পুঁই করে কাঁদতে চায়। আমি হব হনুমান। লেজে আগুন লাগিয়ে লঙ্কা ছারখার করব। সেই জন্য এখন থেকে প্র্যাকটিস করছি। হনুমানের মতো লাফ মারছি, দাঁত খিচোচ্ছি। ঠিক হচ্ছে কিনা বলো?’

শ্রবণ কেবলা মুখ করে বলল, ‘কী সব বলছ ধারা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বারি।’

বারিধারা ঘরে ঢুকে ব্যাগটাকে ছুড়ে দিল খাটের ওপর। তারপর খাটের ওপর ধপাস করে বসে পড়ে বলল, ‘বুঝতে হবে না। যখন আগুন লাগাব তখন বুঝতে পারবে। তুমি কি কোনওদিনও একবার বারি, একবার ধারা বলা ছাড়বে না? যাক, যা খুশি করো। আপাতত খাট থেকে নেমে পড়ো সাহেব। আমি এখন শোবো। খুব টায়ার্ড লাগছে।’

শ্রবণ তাড়াতাড়ি খাতা, পেন, ব্যাগ সব মেঝেতে চালান করল। নিজেকেও। বারিধারা হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। কালো জিনসের ওপর সে একটা কুর্তি পরেছে। কুর্তির রং হলুদ। শ্রবণের মনে হল, ক্লান্ত হওয়ার পরও মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে।

শ্রবণ গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি যে এখানে আছি তুমি জানলে কী করে?’

বারিধারা নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘হাত গুনে। তুমি জানো না, আমি অ্যাসট্রনমি শিখছি? তুমি নিজে যে মোবাইলে জানিয়েছ সেটা ভুলে গেলে?’

শ্রবণ লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ও হো, একদম ভুলে মেরেছি। বারি, আমি জানতাম তুমি আসবে।’

বারিধারা বড় বড় চোখ করে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কী করে জানতে? তুমিও হাত গুনতে শিখেছ!’

শ্রবণ মেঝেতে বসেছে। সে এগিয়ে এল। খাটের ওপর থুতনি রেখে বলল, ‘আমি তোমার কথা শুনেছি ধারা। বাড়ি থেকে পালিয়েছি।’

বারিধারা ডান পায়ের ওপর বাঁ পা তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, ‘আমি খুশি হয়েছি।’

শ্রবণ একটু চুপ করে থেকে গাঢ় স্বরে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি বারি।’

ফস করে কথাটা বলেই শ্রবণ লজ্জা পেল। বোকার মতো হয়ে গেল। অতি বোকার মতো। এমনিতে সে যথেষ্ট স্মার্ট। সে যে ধরনের কাজ করে তাতে স্মার্ট না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু বারিধারার সামনে তার কী যে হয়! অনেকবারই ভেবেছে ভেবেচিন্তে কথা বলবে। শেষ পর্যন্ত হয় না। ধেড়িয়ে ফেলে।

বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভুল করো।’

শ্রবণ বলল, ‘বেশ করি বারি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো ধারা?’

বারিধারা চিৎ অবস্থা থেকে পাশ ফিরল। বিকেলের আলো ছাদ ভেঙে ঘরে এসেছে। বারিধারার চোখেমুখে পড়েছে। এই আলোয় একই সঙ্গে তেজ আর স্নিগ্ধতা। বারিধারা বলল, ‘না, বাসি না।’

এবার হাসতে হাসতে শ্রবণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বারিধারা। প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় ডান হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। বাঁ হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরল জোর করে। তারপর তার নীচের কালো ঠোঁটটা নিজের মুখের ভিতর নিয়ে চোখ বুজল পরম তৃপ্তিতে।

দীর্ঘক্ষণ তারা এভাবেই রইল। তারপর যখন বিছানার ওপর এলো তখন দুজনেই পোশাকহীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *