একটু পরে রোদ উঠবে – ১০

দশ

‘জ্যাতিষ্কদা, লোকটা কে?’

‘ইনি একজন বংশীবাদক বারিধারা। বাঁশি বাজান।’

‘বংশীবাদক তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু আপনি কোথা থেকে একে কালেক্ট করলেন?’

জ্যোতিষ্ক চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘রাস্তা থেকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মূল্যবান জিনিসই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। যদি চাও, আমি উদাহরণ দিয়ে এই সেটমেন্ট প্রমাণ করতে পারি। করব?’

বারিধারা কৌতুকভরা গলায় বলল, ‘কোনও প্রয়োজন নেই। আমি আপনার কথা প্রমাণ ছাড়াই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি এই বংশীবাদককে কোন রাস্তা থেকে এনেছেন? গ্রামের রাস্তা? গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ?’

জ্যোতিষ্ক গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘না, ঠিক রাস্তা নয়, জগুবাবুর বাজার। বাজারের পাশে চায়ের দোকান…সেখানে উনি বসেছিলেন।’

বারিধারা গুছিয়ে বসল। ঘটনা মনে হচ্ছে চমকপ্রদ। জামাইবাবু মানুষটাকে বারিধারার খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে। সরকারি অফিসে বড় পোস্টে চাকরি করে। সেই চাকরিতে যথেষ্ট যুক্তি-বুদ্ধি এবং হিসেব লাগে। কিন্তু মানুষটা মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসে যে, আঁতকে উঠতে হয়। সেই সব ‘কাণ্ড’ যুক্তি-বুদ্ধি বা হিসেবের ধারপাশ দিয়ে যায় না। প্রথমে মনে হয়, লোকটা কি পাগল! নাকি বোকা? গরু-গাধারাও তো আজকাল হিসেব করে চলে। হিসেব করে ঘাস খায়, হিসেব করে ডাকে। হিসেব করে বাঘের চামড়া পরে, তারপর বাঘ সেজে হিসেব করে হালুম-হুলুম করে অন্যকে ভয় দেখায়। চারপাশে গরু-গাধা ভালো, কিন্তু শুধু গরু-গাধা ভালো নয়, বাঁচতে গেলে কিছু মানুষও লাগে। বারিধারার মতে তার জামাইবাবু একজন চমৎকার মানুষ। একটু যা ‘আউট অফ সিলেবাস’। জানার বাইরে। তার দিদি এই মানুষটার জন্য মাঝে মাঝে কঠিন ঝামেলায় পড়ে। ঝামেলা নয়, বলা উচিত যন্ত্রণা। সে তো পড়তে হবেই। আউট অব সিলেবাস মানুষের সঙ্গে ঘর করতে গেলে যন্ত্রণায় পড়তে হবে না? মা-বাবাও জামাইয়ের কীর্তি অনেক সময় নিতে পারে না। বিরক্ত হয়ে যায়। আবার কিছু বলতেও পারে না। কিছু বলতে গেলে বড় মেয়ে রাগারাগি করবে। প্রথমে রাগারাগি, তারপরে কান্নাকাটি। বারিধারার কাছে এটাও মজার। সেরকম কিছু ঘটলে দিদি বাড়িতে চলে আসে। এসে বলে, ‘মা, তুমি আর বাবা নাকি আজ সকালে জামাইকে ফোন করেছিলে?’

মা বলে, ‘অবশ্যই করেছিলাম। চেনে না জানে না একটা লোককে মেয়ের বিয়ের জন্য গাদাখানেক টাকা দিয়ে বসেছে, তার পরেও তাকে ফোন করব না? পরে দেখা গেল, লোকটার কোনও মেয়েই নেই। কত বড় চিটিংবাজ! জ্যোতিষ্কর এই পাগলামি এবার বন্ধ করা দরকার।’

যে মেয়ে গতকাল বরের ওপর রেগে কাঁই হয়েছিল, সে আজ পুরো ডিগবাজি খায়। বরকে ডিফেন্ড করবার চেষ্টা করে। শান্তভাবে বলে, ‘মেয়ে নেই তো কী হয়েছে মা? হয়তো ভাইঝি আছে, ভাগনি আছে। হয়তো তাদের কারও বিয়ের জন্য তোমাদের জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। মেয়ের বিয়েতে টাকা লাগে আর ভাইঝি, ভাগনির বিয়েতে লাগে না, এমন তো কোথাও লেখা নেই মা।’

মা অবাক হয়ে বলল, ‘হয়তো! এতগুলো হয়তো মানে কী? হয়তোর ওপর দাঁড়িয়ে জ্যোতিষ্ক একটা লোককে অতগুলো টাকা দিয়ে দিল! ও কি পাগল?’

দিদি শান্তভাবে বলল, ‘অচেনা মানুষ তাই হয়তো বলছি মা। আমার তো তার গুষ্টির খবর জানা নেই। চেনা হলে মেয়ে না ভাইঝি না ভাগনি সিওর বলতে পারতাম।’

দিদির এই উদ্ভট যুক্তিতে মা খুবই অবাক হয়। বারিধারা হেসে ফেলে। বরকে সমর্থন করতে গিয়ে দিদি যা খুশি বলছে!

মা বলল, ‘এটা কোনও কথা হল মেঘ?’

দিদি বলল, ‘কথা হবে না কেন। অবশ্যই হল। তোমাদের কথা কথা আর তোমাদের জামাইয়ের কথা কথা নয়। সে কি কচ্ছপ? বোবা হয়ে জন্মেছে?’

মা কঠিন গলায় বলল, ‘তাহলে তুই কাল আমাকে বললি কেন? বললি কেন, জ্যোতিষ্ক কাকে না কাকে টাকা দিয়েছে… বল বললি কেন?’

‘বা:, আমার একটা সমস্যার কথা তোমাদের বলতে পারব না? বিয়ে হয়েছে বলে আমি কি তোমাদের কেউ নই?’

বারিধারা বুঝতে পারে, দিদি এবার সম্পূর্ণ অন্য কথায় চলে গেছে। ঠোঁট ফোলানো ধরনের কথা, কান্নার প্রিপারেশন।

মা নরম গলায় বলল, ‘আমি কি সে কথা বলেছি? কাল রাতে তোর বাবাকে ঘটনাটা বললাম। বললাম, জ্যোতিষ্কর এইসব খ্যাপামি এবার বন্ধ করা উচিত। তোর বাবাও গেল রেগে। বলল, ওই ছেলের মধ্যে সিরিয়াস বোধের খুব অভাব। আমি কাল সকালে কথা বলব। তারপর আজ সকালে ফোন করেছে। তখন আমিও জ্যোতিষ্কর সঙ্গে কথা বলেছি।’

দিদি ধরা গলায় বলল, ‘কথা বলেছি বলছ কেন মা? ধমক দিয়েছি বলো। তোমরা ওকে ধমক দিয়েছ।’

মা ভুরু কুঁচকে মেয়েকে বলল, ‘ধমক দিয়েছি কে বলল? জ্যোতিষ্ক নালিশ করেছে?’

বৃষ্টির আগে মেঘ যেমন গুড়গুড় করে ওঠে, দিদিও নাক টানল। কান্নার পূর্বাভাস। বলল, ‘আমার স্বামী যদি আমাকে কিছু বলে, সেটা নালিশ করা হল? বাবা যে তোমাকে কতকিছু বলে, সেটা কি নালিশ? জ্যোতিষ্ক কি নালিশ করবার মতো ছেলে? তাকে তোমরা এতদিনে এই চিনলে মা? সে আমাকে বলল, তোমার বাবা-মা আমাকে ফোন করেছিল। তাতেই আমি ধরে নিয়েছি।’

মা খেপে যায়। বড়মেয়েকে বলে, ‘অ্যাই তুই ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ কর তো। জ্যোতিষ্ক ছোট বাচ্চা নাকি যে তাকে ধমক দেব? যদিও তাই উচিত ছিল। এরপর থেকে তাই করব। তোর পছন্দ না হলে জ্যোতিষ্কের পাগলামি নিয়ে আর কোনওদিন আমাকে বলতে আসবি না। বর তোর, তোর পাগলামি, বোকামিও তোর। তুই সামলাবি।’

‘আমি কি তোমাদের সামলাতে বলেছি?’

মা এবার জোরে ধমক দেয়।

‘চুপ কর। একদম চুপ কর। যেমন বর তেমন তার বউ… একজন দানছত্র খুলে বসেছে, অন্যজন তাতে হাততালি দিচ্ছে… দুটোতে ভালো জুটেছে…। আমার চোখের সামনে থেকে যা এখন।’

এই ঘটনার অবধারিত ফলাফল হল, দিদি ওপরের ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ ফিচফিচ করে কাঁদবে। তারপর চোখের জল মুছে, গালে হালকা পাউডার দিয়ে গুনগুন করে গান করতে করতে নীচে যাবে। মায়ের কাছে আমের আচার খেতে বসবে। আচার খেতে খেতে দুজনে নীচু গলায় হেসে হেসে গল্প শুরু করবে। এই সময় বারিধারাকে তাদের ধারেকাছে ভিড়তে দেওয়া হবে না। গেলে তাড়া খাবে।

‘এখানে তোর কী চাই?’

‘কী চাই মানে! আমার বাড়িতে আমি যেখানে খুশি যাব।’

‘না, এখন যাবি না। এখন আমি আর মা গল্প করব। তুই তো সারাদিনই মাকে পাস। এই একঘণ্টা আমার। যা ভাগ।’

মা বলবে, ‘দিদি ঠিকই তো বলছে। তুই আর দিদি যখন আড্ডা মারিস, আমাকে ঘরে ঢুকতে দিস? এখান থেকে তুমি এখন যাও বৃষ্টি। যাওয়ার আগে খানিকটা আচার নিয়ে যাও।’

বকুনি, চোখের জল অতি দ্রুত গভীর ভাব-ভালোবাসায় ট্রান্সফার হয়েছে। বারিধারা মজা পায়। সে মুখ ভেংচে বলে, ‘বয়ে গেছে তোমাদের আচার খেতে, বয়ে গেছে তোমাদের সঙ্গে গল্প করতে।’

জ্যোতিষ্কদার বেহিসেবি কাণ্ড, দিদির যন্ত্রণা, বাপেরবাড়িতে দিদির অভিযোগ, জামাইকে বাবা-মায়ের ধমক, দিদির কান্না, মায়ের সঙ্গে আচার ভক্ষণ—সবটাই বারিধারা খুব এনজয় করে। নাটকের মতো। একটার পর একটা সিকোয়েন্স।

এখন যেমন নতুন সিকোয়েন্স শুরু হয়েছে।

মেঘবতী সোফায় চুপ করে বসে আছে। তার মুখ থমথমে, চোখ ছলছল। চোখ ছলছল দুটো কারণে হয়। এক, কান্না হবে, দুই, কান্না হয়ে গেছে। মেঘবতীর বেলায় একই সঙ্গে দুটো কারণ কাজ করছে। সে খানিক আগে কেঁদে উঠল এবং সে যে-কোনও মুহূর্তে আবার কেঁদে ফেলতে পারে। স্বামী জগুবাবুর বাজার থেকে একজন ভিখিরিকে যদি বাড়িতে তুলে নিয়ে আসে, তাহলে অতি বড় কঠিন স্ত্রীও চোখ ছলছল করে বসে থাকবে। মেঘবতী একই সঙ্গে চিন্তিত, ত্রু�দ্ধ এবং অপমানিত। স্বামীর মাথাায় যে কিঞ্চিৎ গোলমাল আছে, সেটা বিয়ের পর পরই মেঘবতী বুঝতে পেরেছিল। রাস্তাঘাটে ‘সমস্যায় পড়া’ কাউকে দেখলে এই লোক নিজেকে সামলাতে পারে না। অস্থির হয়ে পড়ে। ‘কিছু একটা’ করতে চায়। এসব ক্ষেত্রে সমস্যা সত্যি কিনা সে বিচারও করে না। গোড়ার দিকে মেঘবতী তার সঙ্গে ঝগড়াও করেছে। একবার রাস্তায় দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সাহায্য করতে গিয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনা ছিল এরকম—

‘তুমি কী করে বুঝতে পারছ যে উনি সমস্যায় পড়েছেন?’

জ্যোতিষ্ক শান্তভাবে স্ত্রীকে বলে ‘বোঝাবুঝির কী আছে মেঘ? সমস্যা দেখতে হয়, বুঝতে হয় না। এটাই তো আমাদের দেশের সিস্টেমে সব থেকে বড় অসুখ। সিস্টেম মানুষের সমস্যা দেখতে পায় না, বুঝতে চেষ্টা করে। বুঝতে বুঝতে সময় চলে যায়। সমস্যা বাড়তে থাকে… বাড়তে থাকে… বাড়তেই থাকে। তখন নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়। একটা সমস্যা আর একটার সঙ্গে গিঁট পাকিয়ে যায়। সেই গিঁট বেশিরভাগ সময়েই খোলা যায় না। মানুষ বাধ্য হয়ে সমস্যার মধ্যে পড়ে থাকে। সরকারি কাজে এটাই কমন প্র্যাকটিস মেঘ। কোনও সমস্যা হলে আগে ফাইল চালু করো। তারপর মিলিয়ে দেখো, খাতায়-কলমে যাকে সমস্যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে ফাইলের সমস্যা মিলছে কিনা। যদি মেলে, তখন সিস্টেম ঢুকবে পরবর্তী পর্যায়ে। বুঝতে হবে, এই সমস্যা সমাধানে টাকা পেতে সমস্যা আছে কি না। সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। গরিব দেশে টাকার সমস্যা থাকবে না, তো কী থাকবে? তাহলে চালু হবে নতুন সমস্যার ফাইল।’

মেঘবতী তার স্বামীকে থামাতে চায়।

‘তুমি ভাষণ বন্ধ করো। এটা তোমার সরকারি দপ্তর নয়, আমি তোমার দপ্তরের কর্মী নই। আমার বিরক্ত লাগছে।’

জ্যোতিষ্ক থামে না। বলে, ‘যখন শুরু করেছি, তখন শেষ করতে দাও প্লিজ। এটা তোমার জানা উচিত। শুধু তোমার কেন, সবার জানা উচিত।’

মেঘবতী হতাশ গলায় বলে, ‘আচ্ছা বল, আমি কান বন্ধ করে রাখছি।’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘সমস্যা ফাইলে যদি ডাউট দেখা যায়, তাহলে গেল। সমস্যা গিয়ে পড়বে বিশবাঁও জলে। ডিপার্টমেন্টে পাঠাও। ক্ল্যারিফিকেশন চাই। সেখান থেকে আরেক ডিপার্টমেন্ট…সেখান থেকে আরেক ডিপার্টমেন্ট…সেখান থেকে আরেক…মানুষের সমস্যা ফাইলের তলায় চাপা পড়তে থাকে। পড়তেই থাকে। যে বেচারি সমস্যায় পড়েছে, সে একবার এই টেবিল একবার ওই টেবিলে মাথা কুটে মরে। তাকে বলা হয়, আরে মশাই, আপনি যে খেতে পাচ্ছেন না সে তো আপনার চেহারাতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেখলে তো হবে না, বুঝতে হবে। আপনার পেটে খেতে না পাওয়া আর আমাদের নিয়মে খেতে না পাওয়া এক কিনা বুঝতে হবে না? তবেই আপনার পাওনা টাকা-পয়সা দিতে পারব। চিন্তা করবেন না, মাস ছয়েক আরও কষ্ট করুন। প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে।’

মেঘবতী কড়া গলায় বলে, ‘তুমিও তো এই সিস্টেমে কাজ করো। তুমিও দায়ী।’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলে, ‘অবশ্যই দায়ী। দায়ী বলেই তো ব্যক্তিগতভাবে প্রায়শ্চিত্ত করে বেড়াই মেঘ। সিস্টেম ভাঙি। ফাইল ছুড়ে ফেলে দিই। মিটিং ডাকি না। বোঝার বদলে মানুষের সমস্যা দেখে রিঅ্যাক্ট করি। চাকরিতে যে কাজ পারি না, বাইরে সেই চেষ্টা করি। আমার আর কতটুকু সাধ্য বলো।’

মেঘবতী স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ও, এই তোমার পালামির কারণ?’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘পাগলামি?’

মেঘবতী কড়া গলায় বলে, ‘অবশ্যই পাগলামি। পাগলামি ছাড়া কী? মানুষের সমস্যা মনে হলেই লাফিয়ে গিয়ে পড়ছ, সেটা পাগলামি নয়? তুমি কি রাজাবাদশা? টাকার কুমির?’

জ্যোতিষ্ক মুচকি হেসে বলে, ‘আমি টাকার কুমির নই মেঘ। সামান্য সরকারি কর্মচারী। সমস্যায় পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে সব সময় টাকা লাগে না। তার পিঠে হাত রাখলেও অনেকটা করা হয়। কতটুকুই বা আমি করতে পারি? কিছুই নয়। মানুষের কত বড় বড় সব সমস্যা… আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যাতায়াতের পথে যতটুকু দেখি… বললাম তো এটা খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারো, শখ বলতে পারো, বদভ্যাস বলতে পারো। সকলেরই তো কত বদভ্যাস থাকে…।’

কথা শেষ করে জ্যোতিষ্ক আওয়াজ করে হেসে ওঠে। মেঘবতীর গা জ্বলে যায়। সে বলে, ‘হাসছ কেন? একদম হাসবে না। তারপর গাড়ির জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওই লোক যে সমস্যায় পড়েছে বুঝতে পারছ কী করে?’

জ্যোতিষ্ক গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। স্ত্রীর সঙ্গে বক বক করলেও, তার চোখ রাস্তার উলটোদিকে।

‘তুমিও বুঝতে পারবে। এত রাতে একজন বৃদ্ধ মানুষ হাতে ঢাউস একটা সুটকেস নিয়ে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাসে উঠছেন না, ট্যাক্সিও ডাকছেন না। তার মানে কী? মানে একটাই। উনি সমস্যায় পড়েছেন। অত বড় সুটকেস নিয়ে বাসে উঠতে পারছেন না। অথবা ট্যাক্সি ভাড়া নেই। আমি ঘটনাটা দেখেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছি।’

মেঘবতী রাগী গলায় বলল, ‘তুমি এখন কী করবে? গিয়ে ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে আসবে? নাকি আমরা সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?’

জ্যোতিষ্ক খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘টাকা-পয়সা দিতে গেলে অপমানিত হতে পারেন। আমি বরং…দাঁড়াও গিয়ে কথা বলি। কাছাকাছি কোথাও যেতে চাইলে একটা লিফট দিতে পারি।’

জ্যোতিষ্ক গাড়ির দরজা খুলে নামল। খানিকটা হেঁটে বৃদ্ধ মানুষটির কাছে গেল এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে জ্যোতিষ্ককে ধরল।

এগারো

অপকারীর বিপদ আসে যেচে, পরোপকারীর বিপদ আসে নেচে।

এই প্রবাদ কোনও সত্যি প্রবাদ নয়, মেঘবতীর বানানো। বরের জন্য বানিয়েছে। এর মানে হল, কারও অপকার করলে বিপদ নিজে থেকেই ডেকে আনা হয়, কিন্তু কারও উপকার করলে উপকারীর কাছে বিপদ আসে নাচতে নাচতে।

বিপদ কেমন নাচতে নাচতে আসে সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল মেঘবতী। বরের পাগলামির জন্য আর একটু হলে পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল। অহেতুক কারণে কাঁদতে ভালোবাসলেও, কঠিন পরিস্থিতিতে মেঘবতী কখনও কান্নাকাটি করে না। নার্ভাস হয় না। অন্য যে-কোনও মেয়ে এই ঝামেলায় পড়লে আগে ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলত। মেঘবতী সেদিন ঠান্ডা মাথায় ঝামেলা সামলেছে।

ঘটনা ছিল এরকম—

রাস্তায় ঢাউস সুটকেস হাতে ‘অসহায়’ বৃদ্ধ মানুষকে দেখে ‘প্রাণ কেঁদে উঠেছিল’ জ্যোতিষ্কর। আহারে, মানুষটা নিশ্চয় সমস্যায় পড়েছে! হয়তো ট্যাক্সির ভাড়া পকেটে নেই। এদিকে অতবড় সুটকেস নিয়ে বাসেও উঠতে পারছেন না। অন্তত খানিকটা পথ গাড়িতে এগিয়ে দিলে উপকার হবে। এই ভেবে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গিয়েছিল জ্যোতিষ্ক। বুঝতে পারেনি, একটু পরে গাড়ি থেকে মেঘবতীও নেমে এসেছে। পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে। সম্ভবত, তার স্বামী ভদ্রলোকটি বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন, সেটা আরও একবার নতুন করে জানবার কৌতূহল হয়েছিল।

‘নমস্কার, আপনাকে আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি।’

বৃদ্ধ থমকে দাঁড়ান। জ্যোতিষ্কর দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘কে আপনি?’

জ্যোতিষ্ক নাটকীয়ভাবে বলে, ‘কেউ নই। একজন পাসারবাই। পথচলতি মানুষ বলতে পারেন।’

বৃদ্ধ সন্দেহ ভরা গলায় বলেন, ‘আমাকে লক্ষ করছেন মানে!’

জ্যোতিষ্ক হেসে হাত তুলে বলল, ‘টেনশনের কিছু নেই মেসোমশাই। আপনাকে আমি আর আমার স্ত্রী গাড়ি থেকে লক্ষ করছিলাম। মনে হল, নিশ্চয় আপনি কোনও সমস্যায় পড়েছেন। তাই গাড়ি থেকে নেমে আপনার কাছে এসেছি। মে আই হেল্প ইউ?’

বৃদ্ধ এবার অবাক হয়ে, চোখ বড় করে বললেন, ‘আমি সমস্যায় পড়েছি! কীসের সমস্যা?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘মেসোমশাই, আপনি লজ্জা পাবেন না। এত বড় একটা সুটকেস নিয়ে ট্যাক্সির জন্য ছোটাছুটি করছেন, এটা একটা সমস্যা নয়?’

বৃদ্ধ চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ট্যাক্সি! ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে যাব কেন!’

এবার জ্যোতিষ্কর অবাক হওয়ার পালা।

‘তবে কি বাস? এই সুটকেস নিয়ে বাসে উঠবেন কী করে? রাতের দিকে বাস কমে যায়। তাই ভিড় থাকে খুব।’

বৃদ্ধ তেড়েফুঁড়ে বললেন, ‘বাসে উঠব, কে বলল আপনাকে?’

জ্যোতিষ্ক থতমত খেয়ে বলল, ‘ট্যাক্সি, বাস কিছুই নয়! রিকশা খুঁজছেন? রিকশায় বাড়ি ফিরবেন? এই বড় রাস্তায় কি রিকশা পাবেন? তাও আবার এত রাতে… গলিটলিতে ঢুকে যদি…।’

বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ট্যাক্সি, বাস, রিকশা আমার কিছুই লাগবে না। আমার ছেলে এখনই গাড়ি নিয়ে আসছে। আমি এগিয়ে গিয়ে সেটাই দেখছি। ছোটাছুটি কিছু করিনি। আপনি ভুল বুঝেছেন।’

জ্যোতিষ্ক থমকে যায়। তাহলে সমস্যা নয়! স্মার্ট হাসবার চেষ্টা করে সে। মাথা চুলকে, আমতা আমতা করে বলল, ‘ও হো, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, আপনি প্রবলেমে পড়েছেন। সরি মেসোমশাই।’

বৃদ্ধ হাত নেড়ে তাড়াবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এবার তো বুঝেছেন, তাহলে যান। নিজের কাজ করুন গিয়ে। আর আমাকে মেসোমশাই ডাকছেন কেন? আমি তো আপনার মেসোমশাই নই।’

জ্যোতিষ্ক দু পা এগিয়ে গিয়ে গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি স্যার… আপনি বরং সুটকেসটা আমাকে দিন। অত ভারী জিনিস…যতক্ষণ না আপনার ছেলের গাড়ি আসে আমি ওটা ক্যারি করছি। নো প্রবলেম। দিন আমাকে।’

কথা শেষে জ্যোতিষ্ক হাত বাড়ায়। বৃদ্ধ চমকে ওঠেন। আঁতকে ওঠেন বলা যায়। লাফ দিয়ে পিছিয়ে যান কয়েক পা। ধড়ফড় করে বলে ওঠেন, ‘না না, আপনি আমার সুটকেসে হাত দেবেন না। মোটে হাত দেবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে বলে, ‘কেন স্যার, এনি প্রবলেম?’

বৃদ্ধ চিৎকার করে বলেন, ‘এ কী কথা। আপনি আমার সুটকেস চাইছেন কেন? আমি পুলিশ ডাকব…।’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘পুলিশ! পুলিশ ডাকবেন কেন? সমস্যা কী?’

কথার ফাঁকেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জানলার কাচ নামিয়ে কেউ একজন ডাকল, ‘বাবা, চলে এসো।’

বৃদ্ধ যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। বাসস্টপ থেকে লাফ মেরে রাস্তায় নামেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘ভলু…ভলু…তাড়াতাড়ি দরজা খোল ভলু…লোকটা আমার সুটকেস কেড়ে নিতে চাইছে…ছিনতাই…।’

‘ভলু’র দামি, বিদেশি গাড়ির দরজা খুলে যায়। আতঙ্কিত বৃদ্ধ নিমেষে সুটকেস সমেত সেঁধিয়ে যান ভিতরে। হতভম্ব জ্যোতিষ্ককে ফেলে গাড়ি চলে যায় ভুস করে। মেঘবতী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার স্বামীর পাশে এসে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হল তো?’

বউয়ের গলা শুনে জ্যোতিষ্ক একটু চমকে যায়। নিজেকে সামলে, পাশ ফিরে বলে, ‘তুমি! কী হল মেঘ?’

মেঘবতী চাপা গলায় বলল, ‘শিক্ষা হল না? আমি তো সেই কারণেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছি। পরোপকরের লেসন তোমার কেমন হয় দেখব বলে।’

জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের শিক্ষা!’

মেঘবতী ক্রোধ ও বিস্ময় মেশানো গলায় বলল, ‘এর পরেও বলছ কীসের শিক্ষা! রাস্তার একজন অপরিচিত কে না কে, একটা বুড়ো, তোমাকে ছিনতাইবাজ বলে চলে গেল। তার পরেও বলছ কীসের শিক্ষা! তোমার লজ্জা করছে না? পরোপকার করতে গেলে কীভাবে অপমানিত হতে হয়, এখনও বুঝতে পারছ না?’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘দুর এসব ছোটখাটো মান-অপমান গায়ে মাখলে চলে? বৃদ্ধ মানুষটি যে আসলে কোনও সমস্যায় পড়েননি, এটাই তো আনন্দের কথা মেঘ। আমরা ভুল ভেবেছিলাম জেনে ভালো লাগছে। আমি আশা করব, এভাবে বার বার আমাদের ভুল ভাঙুক। চলো এবার ফেরা যাক। রাত হতে চলল। খিদে পাচ্ছে। আজ ডিনারে স্পেশাল আইটেম কী?’

মেঘবতী বলল, ‘আচ্ছা মানুষ তো তুমি? এতবড় অপমানের পর নির্বিকারভাবে বলছ ডিনার কী!’

জ্যোতিষ্ক ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে উঠল। মেঘবতী বলল, ‘চুপ করো। একদম চুপ করো। এরপর থেকে তুমি যখন মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কাউকে উপকার করতে যাবে, দয়া করে আমাকে একটু আগে জানাবে।’

জ্যোতিষ্ক মুচকি হেসে বলল, ‘কেন? তুমি কী করবে?’

মেঘবতী বলল, ‘গাড়ি থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যাব। কেউ আমার হাজবেন্ডকে ছিনতাইবাজ বলবে আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে সেটা শুনব, এটা টু মাচ। আমি মেনে নিতে পারছি না। আজ ছিনতাইবাজ বলছে, কাল চোর বলবে, পরশু ডাকাত বলবে।’

জ্যোতিষ্ক হাসতে হাসতে গাড়ির দরজা খুলল। আর তখনই সামনে পথ আটকে একটা পুলিশ জিপ এসে থামে। টহলদার পুলিশের জিপ। টক করে একজন উর্দি পরা অফিসার ধরনের যুবক এগিয়ে এল।

‘এই যে মিস্টার এক মিনিট দাঁড়াবেন।’

জ্যোতিষ্ক ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমাকে বলছেন! কী হয়েছে?’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘হয়নি কিছু। আপনাদের নামে একটা কমপ্লেইন পেলাম, সেটাই ভেরিভাই করতে এসেছি।’

মেঘবতী বিড়বিড় করে বলল, ‘কমপ্লেইন! আমাদের নামে!’

ততক্ষণে অফিসার গাড়ির পাশে চলে এসেছে। হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম। সিরিয়াস কমপ্লেইন। মোড়ে ডিউটি দিচ্ছিলাম, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর তার ছেলে গাড়ি থামিয়ে বলে গেল আপনারা নাকি তাদের সুটকেস কেড়ে নিতে গিয়েছিলেন।’

মেঘবতীর কান, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। তারা ছিনতাই করছে! এ কী কথা! মনে হল, শরীর কাঁপছে। গাড়ির দরজা ধরে কোনও রকমে নিজেকে সামলাল সে। বলল, ‘আপনি এসব কী বলছেন অফিসার! আমরা কেন সুটকেস কেড়ে নিতে যাব।’

অফিসার ছেলেটি বলল, ‘আমরা কিছু বলিনি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেছেন। এবার বলুন, আপনারা কারা এবং এত রাতে এখানে গাড়ি থামিয়ে কী করছেন?’

জ্যোতিষ্ক রাগ সামলে চাপা গলায় বলল, ‘রাতে রাস্তায় বেরোনো বারণ নাকি?’

অফিসার ঠোঁটের কোণায় মিচকে হেসে বলল, ‘না নিষেধ নয়, তবে সময়টা ভালো নয়। কদিন ধরে শহরের এদিকটায় ফ্লাইং ছিনতাই হচ্ছে। একটা গ্যাং গাড়ি নিয়ে ঘুরছে আর সুযোগ বুঝলেই এর-তার ব্যাগ, গয়নাগাঁটি কেড়ে নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। আমরা গ্যাংটাকে ধরবার চেষ্টায় আছি।’

মেঘবতী কঠিন গলায় বলল, ‘আপনারা ভুল করছেন অফিসার। হ্যারাস করছেন।’

 অফিসার ছেলেটি আর একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘সেটা হলেই খুশি হব ম্যাডাম। আপনাদের দেখে এবং কথাবার্তা শুনে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। ছিনতাইয়ের ব্যাপারটা ভুল প্রমাণিত হলে খুশি হব। যাক, সরুন, গাড়ি সার্চ করব।’

ততক্ষণে একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করেছে। জ্যোতিষ্ক তেড়ে যেতে গেল। মেঘবতী দ্রুত হাতে তাকে আটকে পুলিশ অফিসারের কাছে এগিয়ে যায়। নীচু গলায় আসল ঘটনা বোঝাতে চেষ্টা করে। তাতে খুব লাভ হয় না, কিন্তু জ্যোতিষ্ক সরকারের কত বড় পদে কাজ করে সেই পরিচয় পাওয়ার পর তরুণ অফিসার থতমত খেয়ে যায়। এটাই মজা। এ দেশে পদ, অর্থাৎ চেয়ারের মহিমা অতি গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্রও বলা যায়। ঘটনার থেকে চেয়ারের ওজন সবসময় বেশি। কী ঘটল, কেন ঘটল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, ঘটনা যে ঘটিয়েছে সে কোন চেয়ারে বসে? তার স্ট্যটাস কী? নড়বড়ে টুলে বসলে নেংটি ইঁদুর, সিংহাসনে বসলে সিংহ। আরও মজা হল, সিংহাসন ত্যাগ করলে সিংহ হয়ে যায় নেংটি ইঁদুর। বেচারি! যাই হোক, জ্যোতিষ্কর চাকরির কথা শুনে অফিসারের টনক নড়ল। স্যালুট ট্যালুট করে একসা কাণ্ড।

‘সরি স্যার…ভেরি সরি স্যার…আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি…আসলে স্যার কমপ্লেইন পেলাম…আপনার মতো অন্যের সমস্যায় ব্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ তো আজকাল দেখা যায় না…মানুষ ভুল বোঝে…কিছু মনে করবেন না স্যার…আজকের দিনে আপনার মতো মানুষ অতি বিরল…আমি স্যার ওই বুড়োর ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছি…থানায় গিয়েই ধরব…মিথ্যে অভিযোগের ধমক কাকে বলে দেখবে…হারামজাদা…সরি স্যর…।’

বাড়ি ফিরেই মেঘবতী ঘোষণা করেছিল, পরদিনই সে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাবে। খুব বেশি হলে একদিন অপেক্ষা করতে পারে। তারপর আর নয়। জ্যোতিষ্কের এই পাগলামি সে কিছুতেই মেনে নেবে না। তাকে যদি পাগলামি করতেই হয়, তাহলে একা করুক, বউ নিয়ে নয়। অন্যদিকে জ্যোতিষ্কও ঘোষণা করল, মানুষ যতই সমস্যায় পড়ুক, সে আর কখনও এভাবে রাস্তায় গাড়ি থামাবে না। মেঘবতীকে পুলিশের বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য সে ‘সরি’। মেঘবতীর উচিত তার এই ঘোষণাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে বাবা-মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা একবার বিবেচনা করে দেখা। ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা প্রয়োজন। জ্যোতিষ্ক বলল, যা ঘটেছে তার জন্য সে দায়ী নয়। বৃদ্ধ এবং পুলিশের বোঝাবুঝির দায় তার ঘাড়ে ফেলা অনুচিত। মুখে যাই বলুক এবং যতই ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ুক, মেঘবতী আসলে তার স্বামীর পক্ষে। এই যুক্তি সে ফেলতে পারল না। ফলে বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রাখল। কিন্তু দুদিন পরেই আবার এমন ঘটনা ঘটল যে, মেঘবতী সত্যি সত্যি সুটকেস গুছিয়ে চলে যায়।

সেদিন পুলিশ নয়, ঝামেলার কেন্দ্রে ছিল নারকোল। খান বারো নারকোল। তার আবার বেশিরভাগই শুকনো।

দিনটা ছিল রবিবার। টিপটিপ করে সকাল থেকে বৃষ্টি। ছুটির দিনে জ্যোতিষ্ক আস্তে ধীরে বাজারে বেরোয়। আলিস্যি লাগে। অন্যদিনের তুলনায় একটু বেলাই করে ফেলে। তার ওপর সেদিন ছিল স্যাঁতস্যাঁতে একটা দিন। বাজারে ঢোকবার অনেক আগেই দেখল, এক বালিকা প্লাস্টিক পেতে কতগুলো নারকোল নিয়ে বেজার মুখে বসে আছে। বালিকার বয়স কিছুতেই দশ-এগারোর বেশি হবে না। মাথায় একটা গামছা। গামছা দিয়ে বৃষ্টির জল আটকাতে চেষ্টা হয়েছে, লাভ হচ্ছে না। মলিন ফ্রক ভিজছে। প্রতিটা ক্রেতার দিকে বালিকা তাকিয়ে আছে অতি আগ্রহ নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, তার নারকোল বিক্রি নেই। বিক্রি নেই বলে উঠতেও পারছে না। বৃষ্টিতে ভিজছে। কে জানে, হয়তো বেচারিকে তার বাড়ির লোক হুমকি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। জ্যোতিষ্ক সামনে দিয়ে যেতে মেয়েটি নীচু গলায় বলল, ‘নারকোল লাগবে?’

জ্যোতিষ্ক থমকে দাঁড়াল। মায়াভরা গলায় বলল, ‘নারে মা, আজ আর নারকোল লাগবে না। অন্যদিন নেব।’

মেয়েটি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘সবাই যদি অন্যদিন কয় আমার কী হবে? আমি এগুলান নিয়ে কী করব?’

ছাতা হাতে জ্যোতিষ্ক থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়ায়ে দেখেন কী? আমি জলে ভিজি এইডা দেখেন?’

নিমেষের জন্য জ্যোতিষ্কর মনে হল, মেয়েটির চোখে জল। কান্না? নাকি দুনিয়ার প্রতি রাগ? ঘেন্না?

জ্যোতিষ্ক বারোটা নারকোল কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। বারোটাই তাকে কিনতে হয়নি। মলিন ফ্রকের মেয়ে তাকে একটা বিনি পয়সায় দিয়েছে।

‘এইডা আপনারে ফিরি কইর‌্যা দিলাম, টাকা লাগব না।’

মেঘবতী দুপুরের একটু পরেই বাপের বাড়ি চলে গেল। নারকোল-যন্ত্রণা সে মেনে নিতে পারল না।

বারো

বারিধারা উত্তেজিত। সে তার জামাইবাবুর কাছে গল্প শুনছে। এক হতদরিদ্র বংশীবাদককে বাড়ি নিয়ে আসার গল্প। দুর্লভ বস্তু সংগ্রহের গল্প সবসময়েই ইন্টারেস্টিং। পাথরের স্কন্ধকাটা মূর্তি, মাটিতে পুঁতে রাখা ঘড়াভর্তি মোহর, পিকাসোর তুলি, কয়েক হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া টেরোডাকটিল পাখির ডিম সংগ্রহের গল্প যে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন বংশীবাদক সংগ্রহের গল্প যে এতটা ইন্টারেস্টিং হবে, কে ভাবতে পেরেছিল? বারিধারা পারেনি। সে অভিভূত।

মেঘবতী ‘যে-কোনও সময়ে কেঁদে ফেলব’ ধরনের মুখ করে পাশে বসে আছে। থাকুক। বারিধারা সেদিকে তাকাচ্ছে না। দিদি কাঁদুক, কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি দিক, তাতেও কিছু এসে যায় না। খ্যাপা জামাইবাবুর গল্প ছেড়ে এখন অন্যদিকে মন দেওয়া যাবে না। গল্প বলতে পেরে জ্যোতিষ্কও খুশি। শালিকে সে পছন্দ করে। তার বিবিধ পাগলামির প্রতি মেয়েটির বিশেষ আগ্রহ আছে। হাবিজাবি আগ্রহ নয়, এক ধরনের অ্যাকাডেমিক আগ্রহ। জ্যোতিষ্কর মনে হয়, মেয়েটা তার কর্মকাণ্ড নিয়ে হয়তো একদিন গবেষণা শুরু করবে। এই মেয়ে অতি বুদ্ধিমতী। তার কাছে গোপনে খবর এসেছে, বারিধারা তার একানব্বই বছরের ঠাকুরদার সঙ্গে পরামর্শ করে একটা লিস্ট বানাচ্ছে। বোকাদের লিস্ট। লিস্টের নাম উলটো। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট। লিস্টের মাথায় রেখেছে নিজেকে। সেই লিস্ট অবিরত বদল হয়। নাম ওপর-নীচে ওঠানামা করে। একজন অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে ছাড়া এই কাজ করা অসম্ভব। সেই মেয়ে তার পাগলামিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে, এটা কম কথা নয়। জ্যোতিষ্ক স্ত্রীকে একথা বলেছে। মেঘবতী বলে, ‘এটা কোনও ব্যাপার নয়। পাগলার সবসময় অন্য পাগলকে পছন্দ করে। পাগলদের মধ্যে ইউনিটি থাকে।’ জ্যোতিষ্ক স্ত্রীর এই মন্তব্যে গা করে না। বারিধারাও করে না। ‘আউট অব সিলেবাস’ মানুষকে তার সবসময়েই পছন্দ। শ্রবণকেও তার একই কারণে পছন্দ। জামাইবাবুর মতো অতটা না হলেও, শ্রবণও অন্যরকম। এখনকার আর পাঁচটা গাধা ছেলেমেয়েদের মতো জীবনটাকে দাঁড়িপাল্লায় তুলে বেতনের বাটখারা দিয়ে মাপামাপি করে না। সবাই জানে টাকার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তার মানে এই নয়, একজন মানুষের জীবন কতটা জরুরি, সে জীবনের কাছে কতটা যোগ্য—সে বিচার আয়ের পরিমাণ ঠিক করে দেবে। জীবনকে ওজন করবার জন্য বাটখারা শুধু উপার্জনের হয় না। পৃথিবীতে বহু বড় মানুষ খুব কম উপার্জন করেছেন। একবেলা ভালো করে খেতেও পাননি। মজার কথা হল, তাঁদের অনেকেই মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছেন। শ্রবণ এখনও সম্মান না পাক, উপার্জন আর উপার্জনের নিরাপত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সে নিজের পছন্দমতো কাজকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাতে রোজগার কম, নিরাপত্তাও নেই। কিন্তু আনন্দ আছে।

এক রাউন্ড চা শেষ হয়েছে। তার পরেও গুপির মাকে চা করতে বলা হয়েছে। মেঘবতী কাঁদো কাঁদো মুখেই বোনের জন্য মাছের ডিমের বড়া করে এনেছে। সেই বড়ায় জ্যোতিষ্কও ভাগ বসাচ্ছে। সে আজ অফিসে দেরি করে যাবে। বাড়িতে অতিথি এসেছে। তাকে সেটল করবার একটা দায়িত্ব আছে না?

বারিধারা বলল, ‘ঘটনা আপনি ডিটেলসে বলুন জ্যোতিষ্কদা। একটা পয়েন্টও বাদ দেবেন না।’

জ্যোতিষ্ক নীচু গলায় বলতেও শুরু করল।

‘বহুদিন পর জগুবাবুর বাজারে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম তোমার দিদির জন্য। সে কোথা থেকে খবর পেয়েছে, উৎকৃষ্ট মানের মাছের ডিম নাকি ওখানেই পাওয়া যায়। এটা একটা জটিল কথা। মাছ এক বাজারে ভালো, মাছের ডিম আরেক বাজারে ভালো, এটা কী করে সম্ভব? তাও আমি ভাবলাম, একবার ঢুঁ মেরে আসি। যাই হোক, বাজারটাজার করে বেরিয়ে ভাবলাম, ফুটপাথের চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাই। চা খাওয়ার থেকে বড় কথা হল, বহুদিন ফুটপাথে বসা হয় না। ফুটপাথে বসার আলাদা মজা। কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনে তো কম বসিনি। এখন আর পারি না। এখন বিদঘুটে একটা চাকরি করি যে, যেখানে-সেখানে লোকজন চিনে ফেলে আর স্যার স্যার করে। নিজের পাড়ায় তো একেবারেই পারি না। তাও লুকিয়েচুরিয়ে যে দু-একবার বসিনি এমন নয়। তোমার দিদি একবার দেখে ফেলে বিরাট ঝামেলা করল। আমার মতো অফিসারের নাকি…।’

মেঘবতী থমথমে গলায় বলল, ‘আলোচনা কাকে নিয়ে হচ্ছে? বাঁশিওলাকে নিয়ে, না আমাকে নিয়ে? আমি কোন মাছের ডিম পছন্দ করি, ফুটপাথে বসলে কেন রাগারাগি করি—এই সব প্রসঙ্গ এখানে আসছে কেন। আমাকে যদি তোমার এত অপছন্দ, তাহলে বলে দিলেই তো পারো। আমি বৃষ্টির সঙ্গে ও-বাড়ি চলে যাই। ওর সঙ্গে তো গাড়ি আছে। তোমার গাড়িও লাগবে না। তুমি বাঁশিওলাকে নিয়ে থাকো। রোববার রোববার সকালে ওকে নিয়ে ভিক্ষে করতে বেরিয়ো।’

বারিধারা আরও একটা ডিমের বড়া মুখে ফেলল, ‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছিস দিদি। জামাইবাবু যদি সত্যি ভিক্ষেতে বেরোয়, তাহলে আমিও মাঝে মাঝে সঙ্গে যাব। আসলে আমরা তো সারাজীবন ভিক্ষে করেই বেড়াই। একবার এর কাছে গিয়ে হাত পাতি, একবার তার কাছে গিয়ে হাত পাতি। কখনও চাইছি পরীক্ষার নম্বর, কখনও চাকরি, কখনও প্রাোমোশন, কখনও বিজনেসের অর্ডার, কখনও খ্যাতি, কখনও প্রেম, কখনও সংসারের কাছে চাইছি শান্তি, প্রশংসা, কখনও চাইছি সমঝোতা। সবই চেয়ে বেড়াচ্ছি। আর মুখে বড়াই করছি। এই চান্সে নাহয় ডাইরেক্ট ভিখিরি হয়ে দেখব। বড়াটা ভালো করেছিস দিদি। না, জগুবাবুর বাজারে মাছের ডিম সত্যি ওয়ান্ডারফুল। তোর ইনফর্মেশন ঠিক।’

মেঘবতী এবার চোখ পাকিয়ে বোনকে বলল, ‘ই: উনি ভিক্ষে করবেন… একটা চড় মারব। খালি পাকা পাকা কথা। এইটুকু মেয়ে বেশি ফিলজফি শিখেছে। ডায়লগ দিচ্ছে দেখ…আমরা সবাই ভিক্ষে করি…ইস মজা আর কী!’

বারিধারা মুখ ঘুরিয়ে হেসে বলল, ‘এটা ফিলজফি নয় দিদি, ফিলজফির ভান। আমার মতো যাদের পেটে সত্যিকারের বিদ্যে নেই, তারা এইসব ভান করে। গল্প উপন্যাসেও পাবি। লেখকমশাই ফিলজফির ভানভণিতা ক্যারেক্টরের মুখে বসিয়ে দেন। ক্যারেক্টরগুলো ঘ্যান ঘ্যান করে বলতেই থাকে। অসহ্য। প্রপার শিক্ষিত মানুষ ভানভণিতা ধরে ফেলে। তারপর ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে।’

মেঘবতী কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘চুপ করবি? নইলে সত্যি সত্যি কিন্তু এবার মারব বৃষ্টি।’

জ্যোতিষ্ক হাত তুলে বলে, ‘দুই বোনে মারপিট করবে পরে। আগে বংশীবাদকের ঘটনা শোনো।’

বারিধারা বলল, ‘সরি জ্যোতিষ্কদা। আপনি আবার শুরু করুন। অ্যাই দিদি, হয় চুপ করে বসে শোন, নয় আরও খানকতক মাছের ডিম ভেজে আন। বেশি করে লঙ্কা দিবি।’

মেঘবতী উঠল না। আরও গ্যাঁট হয়ে বসল। জ্যোতিষ্ক ফের বলতে শুরু করল। শুনতে শুনতে বারিধারার চোখ আরও বড় হয়ে গেল। যতটা ভাবা গিয়েছিল, ঘটনা তার থেকে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।

ফুটপাথ হলে কী হবে, চায়ের দোকানটা বেশ বড়। ভিড়ও ছিল। জ্যোতিষ্ক নড়বড়ে বেঞ্চে বসে এক ভাঁড় চা নিয়েছে। হঠাৎই ঝগড়া কানে এল। দোকানদার কোনও খদ্দেরের সঙ্গে চাপা গলায় ঝগড়া করছে। জ্যোতিষ্ক প্রথমটায় কথা কানে নেয়নি। চায়ের দোকানে ঝগড়া, তর্কবিতর্ক লেগে থাকেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো। খানিকক্ষণের মধ্যেই এমন সব কথা কানে আসতে লাগল যে, জ্যোতিষ্ক মুখ না ঘুরিয়ে পারল না।

‘তুমি মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করো কেন?’

‘বিরক্ত করবার কী আছে? আপনি চায়ের দোকান দিয়েছেন, আমি চা খেতে আসি। চায়ের দোকান না দিয়ে যদি লোহালক্কড়ের দোকান দিতেন, তাহলে কি আসতাম? বয়ে গেছে।’

‘তুমি বড্ড বাজে বকো।’

‘আপনিও বড্ড বাজে বকেন। তা ছাড়া আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন কেন?’

দোকানওলা এবার তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘তাহলে কী বলব? আপনি-আজ্ঞে করব?’

জ্যোতিষ্ক এবার লোকটাকে পুরোপুরি দেখতে পায়। গায়ে ধুতি-ফতুয়া। ফতুয়ার রং গেরুয়া। বড় বড় চুল। একটা বাউল বাউল ভাব। পোশাকের অবস্থা অতি মলিন। কাঁধে যে ঝোলাটা রয়েছে, সেটায় নানা রঙের কাপড় দিয়ে তাপ্পি। ঝোলা থেকে লাঠির মতো একটা কিছু উঁচু হয়ে আছে। সম্বোধন নিয়ে ঝগড়া শুনে জ্যোতিষ্কর উৎসাহ বাড়ল।

মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘আপনি-আজ্ঞে না করুন, সম্মান দিয়ে কথা বলুন।’

দোকানদার বলল, ‘কেন? তোমাকে সম্মান দেব কেন? রোজ সকালে এসে ভিক্ষে চাও।’

মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘আবার আপনি বাজে কথা বলছেন। রোজ আমি আসি না। আপনার এখানে আসার পালা যেদিন পরে, সেদিনই শুধু আসি। তাছাড়া আমি মোটেও ভিক্ষে করি না। আর যদি করতাম, তাতে খারাপটা কী হত? আপনি চায়ের দোকান দিতে পারেন, আমি ভিক্ষে করতে পারি না?’

দোকানদার হাত জোড় করে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমারই ভুল হয়েছে। এবার চা খেয়ে বিদায় হন।’

মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘চা আমি এমনি খাই না আপনি জানেন।’

দোকানদার হতাশ হয়ে বলল, ‘এ তো মহাঝামেলা করে। ব্যস্ত সময় ভ্যানভ্যানানি। বলছি তো, এখন আমার বাঁশি শোনবার টাইম নেই…দোকান ভর্তি খদ্দের। চা খেতে হলে খান, নইলে বিদায় হন।’

মলিন ধুতি-ফতুয়া এবার বেঞ্চ থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘তাহলে আমারও চা খাওয়া হবে না। আমি চললাম।’

এই পর্যন্ত বলে জ্যোতিষ্ক থামল। মেঘবতী বলল, ‘এসবের মানে কী! চায়ের সঙ্গে বাঁশির কী সম্পর্ক! লোকটা পাগল নাকি?’

জ্যোতিষ্ক সোফাতে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘প্রথমটায় আমিও তাই ভেবেছিলাম। পরে জানলাম ঘটনা অন্য।’

বারিধারা বলল, ‘কী ঘটনা?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আমি তখন মানুষটাকে ডাকি। ডেকে পাশে বসাই। দু-একটা এদিক-সেদিক কথার পর আসল ঘটনা জানতে পারি। মানুষটা বাঁশি বাজান। বর্ধমান না বীরভূমের কোনও গ্রামে গরিব চাষির বাড়িতে জন্মেছে। কাজেকর্মে মন ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বাঁশির নেশা। নিজে নিজেই শিখেছে। বাঁশিতে গান, সুর, রাগ-রাগিণীও বাজাতে পারে। কাজ করে না বলে, বাবা একদিন বাড়ি থেকে দিল তাড়িয়ে। তখন বালক বয়স। ঠিকই করেছে। গরিবের ঘরে কাজকম্ম না করে বাঁশি বাজালে কতদিন সহ্য করবে? তারপর থেকেই ভদ্রলোকের জীবিকা মাধুকরী। মাধুকরী জানো তো?’

বারিধারা বলে, ‘জানি, ভিক্ষে।’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘ঠিক। মানুষটা ভিক্ষেই করেন। তবে টাকাপয়সা নেন না, পেট ভরে খাওয়াতে হয়। যখন খিদে পায়, তখন কোথাও একটা হাজির হয়ে বাঁশি বাজান। কেউ খুশি হয়ে খাওয়ালে ভালো, না খাওয়ালেও ঠিক আছে। সে সকালবেলার চা-ই হোক আর দুপুরের ভাত ডাল বা বিকেলের মুড়ি বাদামই হোক। উনি এমনি এমনি কারও কাছ থেকে খান না। বাঁশি শোনানোর পারিশ্রমিক হিসেবে খান। তবে শুধু তো পেটপুরে খেলেই একটা মানুষের জীবন চলে না। জামাকাপড়, চটি কিনতে পয়সা লাগে। এদিক-ওদিক যেতে ট্রেন, বাসের ভাড়া লাগে। এই কারণে উনি মাঝে মাঝে বাঁশি বানিয়ে হাটে, মেলায় বিক্রি করেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে ভদ্রলোক শুধু বাঁশি বাজান না, বাঁশির মতো মধুরতম একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রচারকও বটে।’

বারিধারা বিড়বিড় করে বলল, ‘উনি খিদে না পেলে কাউকে বাঁশি শোনান না?’

জ্যোতিষ্ক বলল, কেন শোনাবেন না? অবশ্যই শোনাবেন। তবে নিজের মুডের ওপর নির্ভর করেন। আর পাঁচজন শিল্পীর মতো। এবার বলো, এই ভিক্ষুক ভদ্রলোককে বাড়ি নিয়ে এসে কি আমি অন্যায় করেছি? আচ্ছা বৃষ্টি তোমায় বলতে হবে না। মেঘ তুমি বলো, আমার ভুল হয়েছে?’

মেঘবতীর চোখে জল টলটল করছে। সম্ভবত গল্প শুনে তার মন বদলেছে। স্বামীকে এখন পাগলের বদলে মহানুভব বলে মনে হচ্ছে। সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছে। হাতের পিঠে চোখের জল মুছে নীচু গলায় বলল, ‘এসব তো আমাকে আগে বলোনি!’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘বলব কখন? তুমি তো রাগারাগি শুরু করে দিলে।’

বারিধারা বলল, ‘ভদ্রলোকের নাম কী?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘এ-ও এক মজার কথা। আমি নাম জিগ্যেস করায় বললেন, নাম দিয়ে কী হবে? নামে কি একটা মানুষের পরিচয় হয়? না তাকে চেনা যায়? মানুষ হল গানের মতো। সুর দিয়ে চেনা যায়। আপনার যা খুশি নামে ডাকতে পারেন।’

বারিধারা বলল, ‘আমরা বংশীবাদক বলেই ডাকব। আচ্ছা জ্যোতিষ্কদা, বংশীবাদক বাড়িতে আসতে আপত্তি করল না?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘একেবারেই নয়। আমি প্রস্তাব দিতে বললেন, চলেন। আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার কাছে চায়ের দোকানও যা, বাড়িও তাই।’

মেঘবতী বলল, ‘কতদিন থাকবেন?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘কী জানি। এসব লোক কোথাও বেশিদিন থাকতে পারে না। যাযাবর টাইপের হয়।’

বারিধারা ধড়ফড় করে উঠে কাকুতি-মিনতি করবার ভঙ্গিতে বলল, ‘প্লিজ জ্যোতিষ্কদা, আপনি ওনাকে চলে যেতে দেবেন না। আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেব। আচ্ছা, একবার দাদুর কাছে নিয়ে গেলে হত না?’

মেঘবতী বলল, ‘দাঁড়া আগেই এত ছটফট করিস না। কটাদিন যাক।’

জ্যোতিষ্ক অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘না, অনেক কষ্টের মধ্যেও দেশটা বড় সুন্দর! সবথেকে সুন্দর আমার বাংলা। এখানে গানবাজনা করে একজন মানুষ তার খিদে মেটাতে পারে। ভাবা যায়!’

বারিধারা বলল, ‘বিদেশেও আছে জ্যোতিষ্কদা। স্ট্রিট সিঙ্গার পথের ধারে গিটার বাজিয়ে গান করে। লোকে সামনে টাকাপয়সা রেখে যায়।’

জ্যোতিষ্ক জ্বলজ্বলে চোখে বলল, ‘জানি। এ ব্যাপারে পৃথিবীর সেরা হল শান্তিনিকেতন যাওয়ার ট্রেন। রবি ঠাকুরের গান শুনিয়ে দরিদ্র মানুষ উপার্জন করে। আহা! মানুষটা রাজার জন্য যেমন গান লিখেছে, দরিদ্রের জন্যও লিখেছে।’

এই সময় একতলার গেস্টরুম থেকে ভেসে আসা মায়াবী সুরে সবাই থমকে গেল। বাঁশি বাজছে।

তেরো

কর্ণিকা বুঝতে পারছে, আজ তার চাকরি চলে যাবে। গত তিন দিন ধরে তার প্রায়ই এরকম মনে হয়। কিন্তু আজ একেবারে নিশ্চিত। কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজ তার অপরাধ সীমাহীন।

চাকরি চলে গেলে কর্ণিকা খুবই সমস্যার মধ্যে পড়বে। বাড়িতে রোজগেরে মানুষ একমাত্র সে। বাবা অসুস্থ হয়ে গত তিন বছর ঘরে। একটা নড়বড়ে চাকরি ছিল, সেটাও গেছে। এখন যে বেরিয়ে নতুন করে আবার কাজ খুঁজবে, সে মনের জোর নেই। অনেক গোঁতাগুঁতির পর ক’দিন বেরিয়েছিল। ফিরে এসেছে। ভাই স্কুলে পড়ছে। মা কোনওদিন বাইরে কাজকর্ম করেনি। এই অবস্থায় তার চাকরি চলে যাওয়া একটা বড় ধাক্কা। কিন্তু কিছু করবার নেই। ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। কর্ণিকা জানে, লাঞ্চের পর সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার তাকে ঘরে ডেকে পাঠাবেন। তার পর কী কী ঘটবে, তা সিনেমার মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।

‘স্যার আমাকে ডেকেছেন?’

এই ম্যানেজার বয়স্ক এবং ভালোমানুষ। মনের ভাব গোপন রাখতে পারেন না। হাবভাবে দেখিয়ে ফেলেন। রাগ হলে রাগ, খুশি হলে খুশি। ভদ্রলোক থমথমে মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ ডেকেছি।’

কর্ণিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। ম্যানেজার মুখ না তুলে বলবেন, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’

এই ভদ্রলোক অফিসের সবাইকেই ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। শুধু বয়সে ছোট নয়, পদে ছোট হলেও তিনি সম্বোধনে ফারাক করেন না। অফিসারকে যা বলেন, পিওনকেও সেইভাবে কথা বলেন। কর্ণিকার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর দু’মাস। সে চাকরির প্রথম দিকে ‘আপনি’ সম্বোধন না করবার জন্য এঁর কাছে আবেদন জানিয়েছিল। আবেদন গ্রাহ্য হয়নি।

আজ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে কর্ণিকা ভয় পাবে। অফিসের বসেরা যখন ঘরে ডেকে থমথমে মুখে বসতে বলেন, তখন বুঝতে হয় সমস্যা আছে। বিপদ আসছে। সে জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসবে। কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার ভদ্রলোক হাতের ফাইলগুলো নাড়াচাড়া করবেন, কম্পিউটারের কি-বোর্ড টিপবেন, তার পর কর্ণিকার চোখের দিকে তাকাবেন।

‘একটা খারাপ খবর আছে কর্ণিকা।’

কর্ণিকা জানে কী খবর। তার পরেও চমকে উঠবে। কাঁপা গলায় বলবে, ‘কী স্যার? কী খবর?’

ম্যানেজার খবর বলবেন না। তবে এই প্রথম সম্বোধন বদলাবেন। ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’। স্নেহের কারণেই করবেন। নরম গলায় বলবেন, ‘চিন্তা কোরো না কর্ণিকা। তোমার বয়স কম। কেরিয়ার সবে শুরু করেছ। ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় কাজের অফার তোমার কাছে আসবে। রিলিজ অর্ডারে তোমার সম্পর্কে আমরা ভালো কথা লিখে দেব। শি ইজ এক্সেলেন্ট। কাজ পেতে অসুবিধে হবে না।’

কর্ণিকা অস্ফুটে বলবে, ‘স্যার…স্যার…।’

ম্যানেজার ভদ্রলোক গলা খাকারি দিয়ে বলবেন, ‘সরি কর্ণিকা। তোমাকে সেন অ্যাসোসিয়েটস আর কনটিনিউ করতে পারছে না। এটাই তোমার লাস্ট মান্থ। কাল থেকেই তুমি ছুটিতে চলে যাও। এ মাসের ফুল স্যালারি তুমি পাবে।’

কর্ণিকা কাতর গলায় বলবে, ‘স্যার, চাকরি চলে গেলে আমি খুব বিপদে পড়ে যাব। বাড়িতে আমিই একমাত্র উপার্জন করি স্যার।’

ম্যানেজার একটু চুপ করে থেকে বলবেন, ‘সরি কর্ণিকা, আমার কিছু করার নেই। দিজ ইজ হায়েস্ট লেভেল অর্ডার। তুমি বুঝতে পারছ?’

কর্ণিকা মাথা নামিয়ে বলবে, ‘পারছি স্যার।’

চাকরি চলে যাওয়ার এই ভয়ঙ্কর কল্পনা কর্ণিকাকে মাঝে-মাঝেই করতে হয়। এক-একদিন এক-একটা কারণ থাকে। আজ কারণ হল ঘাম। কর্ণিকার মনে হচ্ছে, সে কুলকুল করে ঘামছে। এখনই কপাল থেকে সেই ঘাম টপ করে টেবিলের ওপর রাখা নোটখাতার ওপর পড়বে। এতক্ষণ ধরে ডিকটেশন শুনে যা লিখেছে, সব ঝাপসা হয়ে যাবে। বাইরে গিয়ে কিছুই পড়তে পারবে না। চিঠি ভুল টাইপ করবে এবং সেই অপরাধে তার চাকরি চলে যাবে।

কোম্পানির মালিকের ডিকটেকশন যদি তাঁর সেক্রেটারির ঘাম ঘুছে দেয়, তাহলে তার চাকরি থাকতে পারে?

যদিও ঘটনা একেবারেই ঠিক নয়। ঘরে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চলছে। ফুসফুস করে আওয়াজ হচ্ছে। কড়া ঠান্ডা। ঘাম হাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কর্ণিকা আসলে নার্ভাস। এত নার্ভাস যে, এত ঠান্ডার মধ্যে তার গরমের বিভ্রম হচ্ছে। হ্যালুসিনেশন। আজ যদি ঘর গরম থাকত, তাহলে হয়তো মনে হত, শীতে কাঁপছে। হ্যালুসিনেশনের মাত্রা এতটাই বেশি যে, সে মনে মনে কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজারের ঘরে চলে গিয়েছে। চাকরি নট-এর গল্প শুনে এসেছে। নার্ভাস ভাব থেকে বিভ্রম এতটা হয় কি না তা মনোবিদরা বলতে পারবেন। কর্ণিকার সবটাই কল্পনা। ভয়ঙ্কর কল্পনা।

তিন মাস তেরো দিন হল, অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে বদলি হয়ে সে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পার্সোনাল সেক্রেটারি হয়েছে। এখনও শিক্ষানবিশ। সিনিয়ররা কাজ শিখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা সারাক্ষণ ভয়ও দেখাচ্ছেন।

‘এই যে মেয়ে, খুব সাবধানে থাকবে। বসের কঠিন সমস্যা আছে। সিরিয়াস সমস্যা। কাজে ভুল করলে রেগে যান না, কিন্তু কাজ যদি এলেবেলেভাবে ঠিক করো, রেগে আগুন হয়ে যাবেন। পান থেকে চুন কেন, সুপুরি, খয়ের, এলাচ খসলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সিরিয়াস ভাব খসলে বিরাট ক্ষতি। তখন চাকরি গন হতে এক মিনিট।’

জটিল বিষয়। কাজ ভুল করলে ক্ষতি নেই, কাজ ঠিক করলে ক্ষতি! কর্ণিকা খুব ভয়ে ভয়ে আছে। কেন যে মরতে এই পোস্টে তাকে আনা হল। মনে হয় চাকরি থেকে নট করে দেওয়ার জন্যই হয়েছে। যদিও এখনও সে বড় দায়িত্ব পায়নি, চিঠি লেখালেখির কাজ করছে মাত্র। বস ডিকটেকশন দেন। সে শর্টহ্যান্ডে লিখে নেয়। পরে কম্পিউটারে টাইপ করে, প্রিন্ট বের করে দেখায়। সরাসরি ল্যাপটপেও ডিকটেশন নেওয়া যেত। বস পছন্দ করেন না। তিনি পুরোনো পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। যখনই কর্ণিকা বসের ঘরে ডাক পায়, তার হাঁটু কাঁপতে থাকে। মনে হয়, আজ সে নিশ্চিতভাবে ‘সিরিয়াস ভাব’-এ কোনও গোলমাল করে বসবে এবং চাকরি খোয়াবে।

ঘামে ডিকটেশন মুছে যাওয়াটা কি ‘সিরিয়াস ভাব’-এর বড় গোলমাল নয়?

বিমলকান্তি সেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি ডিকটেশন দিচ্ছেন। কোটি টাকার চিঠি। কোটি টাকার অর্ডার যেখান থেকে পাওয়া গেছে, চিঠি তাদের উদ্দেশে। কোম্পানির সাবান, ডিটারজেন্ট, রুম ফ্রেশনার, টুথপেস্ট, পাউডার, পারফিউম পাঠানোর খুব বড় অর্ডার। প্রাোডাক্ট বাইরে যাবে। সব মিলিয়ে বিজনেস প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এলসি খোলা নিয়ে একটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাোডাক্ট সাপ্লাইয়ের তারিখ পিছোনো ছাড়া উপায় নেই। সমস্যা হল, এসব ক্ষেত্রে অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এলসির সমস্যা সম্পূর্ণ গোপন রেখে তাদের জানানো হচ্ছে, প্রাোডাক্ট কোয়ালিটি নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশয়টি খুবই সামান্য। মনে হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট ব্যাচের সাবানে সেন্টের পরিমাণ যথোপযুক্ত হয়নি। ওয়ার্কশপের চিফ কেমিস্টও সংশয়মুক্ত নন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়েছেন, কোনও কোনও সাবানে গোলমাল থাকলেও থাকতে পারে। অন্য যে-কোনও প্রস্তুতকারক এই ত্রুটি অবজ্ঞা করত। কারণ, এই ত্রুটি ধরা পড়বার নয়। যে ক্রেতা এই সাবান ব্যবহার করবেন, তাঁর পক্ষে গন্ধের সূক্ষ্ম তারতম্য বোঝা অসম্ভব। যাকে অর্ডার সাপ্লাই করা হচ্ছে, সেই সংস্থার পক্ষেও এই খামতি যাচাই করা সম্ভব নয়। গন্ধের মানদণ্ড বিচার করবার মতো কোনও যন্ত্র নেই। সুতরাং, এই ত্রুটিকে গুরুত্ব না দিলেও অনায়াসে চলত। কিন্তু সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস সে কাজ করবে না। তারা নিজেদের প্রাোডাক্ট সম্পর্কে অতিরিক্ত সংবেদনশীল এবং যত্নশীল। তারা মনে করে, প্রাোডাক্টের কোয়ালিটির ওপর নজর দেওয়াটা কোনও প্রস্তুতকারক সংস্থার জন্য সব থেকে জরুরি। লাভ-লোকসান পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু একবার ‘গুড উইল’ নষ্ট হলে সে ক্ষতি মেরামত করা যায় না। তাই কোম্পানির মিটিংয়ে আজ সিদ্ধান্ত হয়েছে, যতই লোকসান হোক, সাবানের এই লট বাতিল করা হবে। নতুন প্রাোডাকশন হবে। তার পর অর্ডার সাপ্লাই হবে। তাই ক’টা দিন সময় চাই। আশাকরি, সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেসের সদিচ্ছা এবং সততার প্রতি আস্থা রেখে অর্ডার সাপ্লাইয়ের জন্য আরও ক’টা দিন সময় পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ…

চিঠি এখনই মেইল করা হবে। যদিও ইতিমধ্যে মুখে কথা হয়ে গেছে। পার্টিকে টেলিফোন করা হয়েছিল। ওরা অভিভূত। সামান্য একটা ত্রুটির জন্য সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এতদূর যেতে পারে, তারা কল্পনাও করতে পারেনি। এত টাকা লোকসান। যে ত্রুটি ধরাই পড়ত না, তাই নিয়ে এত চিন্তা। ওরা টেলিফোনে বলেছে, আপনারা সময় নিন। ফর্মালি চিঠি মেইল করে দিন। আমরা আজই জবাব পাঠাব।

এই চিঠিটাই বিমলকান্তি সেন কর্ণিকাকে ডিকটেশন দিচ্ছেন। কর্ণিকা মেয়েটির কাজ বিমলকান্তি সেনের বিশেষ পছন্দ। মেয়েটি তাঁর কাছে এসেছে বেশিদিন হয়নি। কত দিন হবে? বড় জোর মাস তিনেক। মেয়েটির বয়স কম, অথচ কাজের ক্ষেত্রে খুবই সিরিয়াস। ডিকটেশনের একটা শব্দ বুঝতে না পারলে দশবার জিগ্যেস করে। চিঠির বাক্যে কোথাও জটিলতা থাকলে ঘরে এসে বলে। মাসখানেক আগে একটা চিঠিতে ভুল হয়েছিল। গ্রামারের ভুল। একটা ভুল নয়, দুটো ভুল। একটা ভার্বে, একটা প্রিপোজিশনে। মালিকের ভার্ব আর প্রিপোজিশন ভুল ধরার জন্য সাহস লাগে। সেই সাহস আসে কাজের প্রতি সিরিয়াস ভঙ্গি থেকে। কাজটা কোনও ব্যক্তি নয়, কাজটা শুধুই কাজ। কে রেগে গেল, কে খুশি হল তাই দিয়ে কাজের বিচার হয় না। দুভার্গ্যের বিষয়, বাঙালি কর্মজগৎ এটাই মেনে চলে। ব্যক্তির রাগ, ব্যক্তির খুশি এই জগতের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির কর্মকাণ্ডের সব থেকে বড় সাফল্য হল, উচ্চ আসনে বসা মানুষকে তোষামোদ করা। কাজের প্রতি সিরিয়াস হওয়ার থেকে, হাত কচলানোর প্রতি সিরিয়াস হওয়া তার কাছে অনেক বেশি স্বস্তিজনক। কর্ণিকা যে সাহস দেখিয়েছে, একশো কর্মীর মধ্যে একজনও এর ধারে-কাছে যেতে পারবে না। কাঁচুমাচু মুখ করে এসে ভুল ধরিয়েছে। ভাবটা এমন ছিল, যেন ভুল তার, এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। কর্ণিকার ব্যাপারে বিমলকান্তিবাবু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত যে-কোনও সময় কার্যকর হতে পারে।

ডিকটেশন শেষ হলে বিমলকান্তি বললেন, ‘যাও, ভালো করে টাইপ করে আমাকে দেখাও।’

কর্ণিকা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এখনও তার নোটখাতায় কপালের ঘাম ঝরে পড়েনি। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল, ‘অবশ্যই স্যার।’ তার পর নোটবই হাতে তাড়াহুড়ো করে দরজার দিকে যেতে গিয়ে চেয়ারে ধাক্কা খেল।

চিঠির পরিকল্পনা নিখিলেশ উপাধ্যায়ের। সেন অ্যাসোসিয়েটস কোম্পানির বয়োজ্যেষ্ঠতম কর্মী। অবসর নেওয়ার বয়স দশ বছর পেরিয়ে গেছে। তার পরেও চাকরি রয়েছে। কেন রয়েছে? কারণ খানিকটা জানা যায়, খানিকটা জানা যায় না। অফিসে, ওয়ার্কশপে নানা রকম ঘটনা। শোনা যায়, কোম্পানির গোড়ার দিকে কমলকান্তি সেন তাঁর এই কর্মচারীটির কাছ থেকে এমন কোনও উপকার পেয়েছিলেন, যা তিনি কখনও ভোলেননি। সেই কৃতজ্ঞতার কারণেই অবসরের বয়স হয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে ছাড়া হয় না। আবার শোনা যায়, কমলকান্তি সেন সরে যাওয়ার পর নিখিলেশ উপাধ্যায়ও চলে যেতে চেয়েছিলেন। বিমলকান্তিবাবু কিছুতেই রাজি হননি। তিনি মনে করেন, সন্তান যদি পিতার পরিচয়, সম্মান, সম্পত্তি বহন করতে পারে, তাকে পিতার কৃতজ্ঞতাও বহন করতে হবে।

‘উপাধ্যায়বাবু, আপনাকে অফিসে আসতে হবে না। কিন্তু আপনি আমাদের ছেড়ে যেতেও পারবেন না।’

‘কী মুশকিল। এটা কখনও হয়? সবাই কী বলবে?’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘যা খুশি বলুক। আমরা আপনাকে ছাড়ব না। সেন অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে আপনাকে আজীবন যুক্ত থাকতে হবে।’

‘আপনি তো একজন সিরিয়াস ধরনের মানুষ। আপনার বাবা যা করেছেন, আপনি কেন এসব পাগলামি করবেন? আপনার পিতা তো সরে গেলেন, এবার আমাকে ছুটি দিন।’

বিমলকান্তিবাবু হেসে বলেন, ‘বাবা চলে গেলেন বলেই তো আরও আপনাকে ছাড়া যাবে না। উনি তো কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে যাননি। এখন জিগ্যেস করলে অফিসের বিষয়ে কোনও কথা বলেন না। আপনি যদি ওর ডিসিশন নিয়ে আসতে পারেন, আমি আটকাব না। আপনার ছুটি হয়ে যাবে।’

উপাধ্যায়বাবু বলেন, ‘আমার শরীর ভালো নয়। মাঝে-মাঝে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়।’

বিমলকান্তিবাবু বলেন, ‘আপনাকে তো অফিসে আসতে হবে না।’

উপাধ্যায়বাবু সাদা হয়ে যাওয়া ভুরু তুলে বলেন, ‘সে কী! তা হলে বেতন নেব কেন?’

বিমলকান্তিবাবু ফের হেসে বলেন, ‘বেতন তো নয়, আপনাকে এখানে আটকে রাখবার জন্য কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় এবার কমলকান্তি সেনের সঙ্গে দেখা করতে চান। কমলকান্তি রাজি হননি। অনেক জোরাজুরির পর টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হন। কী কথা হয় কেউ জানে না।

নিখিলেশ উপাধ্যায় অফিসে রয়ে গেছেন। আগে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, এখন ফ্রি। আবাধ গতি। কখনও আসেন, বেশিরভাগ সময়েই আসেন না। তবে দীর্ঘদিন থাকার কারণে এবং স্বভাব মধুর হওয়ায় সব ডিপার্টমেন্টেই চেনাজানা। ম্যানেজার থেকে পিওন—সকলেই পছন্দ করেন। কোম্পানির খবরাখবরও বলে। বেশিরভাগ সময়েই তিনি আগ্রহ দেখান না। হাসিঠাট্টা করে, খানিকটা সময় কাটিয়ে চলে যান। আবার কোনও কোনও খবরে তিনি নিজে থেকেই গভীর আগ্রহ দেখান। সেই খবর ঘুরে ঘুরে যাচাই করেন। খবরের শিকড় পর্যন্ত যান। তার পর কখনও দেখা করেন ম্যানেজারদের সঙ্গে, কখনও বিমলকান্তি সেনের সঙ্গে। এই কোটি টাকার অর্ডারের ব্যাপারেও করেছেন। বিমলকান্তিবাবুকে সময় বাড়াবার পরিকল্পনা বলে দিয়েছেন। পার্টিকে কীভাবে কোয়ালিটির প্রসঙ্গ তুলে চিঠি দিতে হবে, সে কথা বুঝিয়েছেন। বলেছেন, এটা মিথ্যে নয়, এটা ব্যবসার কৌশল। এই সময়ে জট খুলতে হবে। ফুটবল খেলায় যেমন প্রতিপক্ষকে আটকে রাখতে হয়, ব্যবসাতেও তাই।

লাঞ্চের পর সেন অ্যাসোসিয়েটসের অফিসে দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটি ঘটল অফিসের অতি সামান্য এক কর্মচারী কর্ণিকার জন্য। বিকেল তিনটে নাগাদ কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার ইন্টারকমে থমথমে গলায় তাকে ডেকে পাঠালেন। কর্ণিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিশ্চিয় আজ তার চাকরি চলে যাচ্ছে। সে কি কোটি টাকার চিঠি ভুল টাইপ করল? দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল অফিসের সব থেকে বড় পদের লোকটিকে ঘিরে। তিনি বিমলকান্তি সেন।

চোদ্দো

‘তোর মুখ শুকনো কেন কনি?’

‘কোথায় শুকনো মা।’

‘আমাকে লুকোস না, আমি তোর মা, আমি সব বুঝতে পারি। অবশ্যই কিছু হয়েছে। কী হয়েছে বল?’

‘উফ মা, তুমি বড্ড জ্বালাতন করো। বলছি তো আমার কিছু হয়নি।’

‘আমাকে বলবি না, সেটা বল। রাগ দেখাচ্ছিস কেন?’

‘কোথায় রাগ দেখালাম। মা, এক কথা বারবার বলছ কেন? আমার মাথা ধরেছে। অফিস থেকে ফিরেছি, আমাকে রেস্ট নিতে দাও।’

‘আমি জানি, তোর মাথা ধরেনি। তুই আমাকে মিথ্যে বলছিস। যাক, যখন বলবি না ঠিক করেছিস বলতে হবে না। অফিসে গোলমাল হয়েছে?’

‘জানি না। ঘ্যান ঘ্যান কোরো না মা। ভালো লাগছে না।’

‘দেখিস কনি, অফিসে গোলমাল করিস না।’

‘কেন? তোমার কী সমস্যা? তুমি তো আমার হয়ে অফিসে গোলমাল করতে যাবে না। গোলমাল করলে আমি করব।’

‘এখন যদি তোর চাকরিবাকরি নিয়ে সমস্যা হয় আমরা বিপদে পড়ে যাব।’

‘বলতে খারাপ লাগছে না? আর কতদিন আমাকে একা এতবড় সংসারের বোঝা টানতে হবে? বলো আর কতদিন?’

‘ভাইটাকে একটু বড় হতে দে।’

‘কেন? বাবা? বাবা কী করছে? কিছু টাকাপয়সা রোজগার করবার মতো ক্ষমতা কি তার নেই? সে কেন চেষ্টা করে না? তাকে কেন তুমি বলছ না মা? কেন বলছ না মেয়ের ঘাড়ে সবটা ফেলে দেওয়া ঠিক নয়?’

‘তুই তো তোর বাবাকে চিনিস কনি। সে বেরোতে চায় না। অসুখের পর নড়বড়ে হয়ে গেছে…কিছু করতে চায় না।’

‘তুমি আর বাবার হয়ে কথা বোলো না মা। চুপ করো।’

‘চুপই তো করে আছি। সারাটা জীবন চুপ করে থেকেছি বলেই তো আজ এই অবস্থা। কখনও স্বামীর ধমক খাচ্ছি, কখনও মেয়ের ধমক খাচ্ছি।’

‘আবার প্যানপ্যানানি শুরু করলে? আমার ভালো লাগছে না মা। বলছি তো আমার ভালো লাগছে না। কান্নাকাটির অনেক সুযোগ পাবে। এখন আমি তোমাকে এমন খবর দেব যে তোমাকে ডাক ছেড়ে কাঁদতে হবে।’

‘কী খবর?’

‘খুব ভালো খবর। যাকে বলে সুসংবাদ। সুসংবাদ কাকে বলে জানো?’

‘হাসছিস কেন? কী খবর বল। আমার হাত-পা কাপছে।’

‘আমার চাকরিটা চলে গেছে মা। আজ থেকে আমি বেকার। সংবাদ কেমন? যাও তাড়াতাড়ি বাবাকে গিয়ে দাও। বাবা যদি সুসংবাদ শুনে নড়েচড়ে বসে।’

এই কাল্পনিক কথোপকথন চালাতে চালাতে কর্ণিকা অফিসের করিডোর দিয়ে হাঁটছে। সে যাচ্ছে কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজারের ঘরে। কর্ণিকা হাঁটছে এবং ঘামছে। এবার আর বসের ঘরে বসে ঘামের বিভ্রম নয়। সত্যিকারের ঘাম। কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার যে কণ্ঠস্বরে তাকে ইন্টারকমে ডাকলেন তাতে ঘাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কর্ণিকা মনে করার চেষ্টা করছে যে চিঠিতে কী ভুল করেছে। আচ্ছা, এমন নয় তো, একবার বসের ভুল ডিকটেশন ধরার জন্য আজ শাস্তির কোপে পড়ল? প্রতিশোধ? তখন বস চুপ করে ছিলেন। আজ সুযোগ বুঝে আউট করে দিচ্ছেন। হয়তো দেখা যাবে যে বসের যা যা ভুল ধরেছিল, সেগুলো সে নিজেই করে বসে আছে? অসম্ভব কিছু নয়। হতে পারে। এখন বুঝতে পারছে, সেদিনের কাজটা তার ঠিক হয়নি। হঠকারী হয়ে গেছে। মা যদি শোনে তাহলে ভীষণ রেগে যাবে। মা কেন যে-ই শুনবে সে-ই রেগে যাবে। ‘পাকা মেয়ে’ বলবে। বলবে, ‘আমি হলেও তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম। তোমার অফিস কোনও স্কুল নয়। তুমি সেই স্কুলের হেডমিসট্রেস নয়। এবার ঠেলা বোঝো।’

ম্যানেজার স্যার হাতের কাজ সরিয়ে তাকে গম্ভীর মুখে বসতে বললেন। কর্ণিকা তার ভয়ঙ্কর কল্পনার মতোই জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসল।

ম্যানেজার স্যার বললেন, ‘কেমন আছেন কর্ণিকা?’

কর্ণিকা ঢোঁক গিলে অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘ভালো স্যার।’

ম্যানেজার টেবিলের ওপর রাখা একটা খাম তুলে বললেন, ‘আপনার জন্য একটা খবর আছে।’

কর্ণিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে দুহাত দিয়ে চেয়ারের হাতল চেপে ধরল।

ম্যানেজার স্যার বললেন, ‘আপনার একটা প্রাোমোশন হয়েছে। আগামীকাল থেকে আপনি স্যারের মূল অ্যাসিসটেন্টদের একজন হলেন। এখন দুজন আছেন। তারা প্রাোডাকশন এবং ফিনান্স দেখেন। আপনি দেখবেন কো-অর্ডিনেশন। কোথাও কোনও সমস্যা হচ্ছে মনে হলে স্যারকে ইনফর্ম করবেন। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন। স্বাভাবিকভাবেই আপনার স্যালারি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধের অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হল। এখন যা পান তার থেকে দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু রেসপনসিবিলিটি বাড়ল দশগুণ। বসবার জন্য আপনাকে আলাদা চেম্বার দেওয়া হবে। কাল থেকে অফিস যাতায়াতের জন্য আপনি গাড়ি পাবেন।’ এতটা বলে ম্যানেজার স্যার খামটা এগিয়ে ধরলেন। বললেন, ‘নিন ধরুন। আপনার প্রাোমোশনের চিঠি।’ তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘এই বয়সে এত বড় দায়িত্ব এর আগে সেন অ্যাসোসিয়েটসে কেউ পেয়েছে বলে আমার মনে পড়ছে না। এটা একটা খুব ভালো বিষয়। ইয়াং থটস যে-কোনও কাজেই খুব ইমপর্টান্ট। কনগ্রাচুলেশন।’

কর্ণিকার মনে হচ্ছে, তার চেয়ার কাঁপছে। সে এখনই দড়াম করে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে যাবে। সে কি ভুল শুনেছে? এও কি বিভ্রম? কোনও রকমে বললে, ‘থ্যাঙ্কু স্যার। কিন্তু এতবড় দায়িত্ব কি আমি সামলাতে পারব?’

ম্যানেজার ভদ্রলোকের মুখ বলে দিচ্ছে তিনি খুব খুশি।

‘না পারবেন না, ভুল করবেন।’

কর্ণিকা অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী!’

ম্যানেজার হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক তাই। ভুল করতে করতে ঠিক করবেন। আমরাও তাই করি। এবার তাহলে আসুন? আমি কয়েকটা কাজ সেরে ফেলি?’

কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কর্ণিকা নিজের টেবিলে না গিয়ে আগে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এই জায়গাটা ফাঁকা। অফিসের কেউ চট করে এদিকটা আসে না। কর্ণিকা মায়ের মোবাইল নম্বর টিপল। ভাই ফোন ধরল।

কর্ণিকা অবাক হয়ে বলল, ‘মানা তুই! স্কুলে যাসনি? মা কোথায়?’

ওপাশ থেকে চোদ্দো বছরের মানান বিরক্ত গলায় বলল, ‘একসঙ্গে অতগুলো প্রশ্ন করছিস কেন দিদি? দুটো প্রশ্নের তো কোনও মানেই হয় না। গলা শুনেই তো বুঝতে পারছিস আমি। তারপরেও বলছিস মানা তুই! স্কুলে যে যায়নি তাও বুঝতে পারছিস। স্কুলে নিশ্চয় মোবাইল নিয়ে যাব না। লুকিয়ে নিয়ে গেলেও ক্লাসে তোর ফোন ধরব না। তিনটের মধ্যে একটা প্রশ্নই ঠিকঠাক। মা কোথায়? মা দোকান বাজার কোথাও একটা বেরিয়েছে। আমাকে বলে যায়নি। ফোন নিয়ে যায়নি।’

কর্ণিকা কড়া গলায় বলল, ‘পাকা পাকা কথা বলবি না। স্কুলে যাসনি কেন?’

মানা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘সমস্যা আছে।’

চোদ্দো বছর বয়সে কেউ দিদির সঙ্গে এভাবে কথা বলে? ছেলেটা বখে যাচ্ছে। লেখাপড়ায় মন নেই। পাড়ায় টই টই করে বেড়ায়। যখন-তখন স্কুল কামাই করে। এক সময় বাড়ির দায়িত্ব যে তাকেই নিতে হবে সে ব্যাপারে কোনও হুঁশ নেই। কর্ণিকা জোর ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। আজকের দিনটা মন খারাপ করবে না।

‘মা এলে আমাকে মিসড কল দিতে বলবি। স্কুলে যাসনি কেন?’

বাপ্পা নীচু গলায় বলল, ‘বললাম তো সমস্যা আছে। বাড়িতে আয় বলব।’

কর্ণিকা ফোন কেটে দিল। নিশ্চয় বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলবে। কর্ণিকা মুখ তুলে সামনে তাকাল। এখান থেকে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। অনেকদিন আকাশের দিকে তাকানো হয়নি। আজ আকাশটা যেন বেশি নীল। রোদ ঝলমল করছে। কী অদ্ভুত! খানিক আগে একরকম ভেবে ভয় পাচ্ছিল, হল একদম উলটো। চাকরি নট হবার বদলে প্রাোমোশন। জীবনের এটাই মজা। যা ভাবা হয় সবসময় তা ঘটে না। কোন দার্শনিক যেন বলেছিলেন, ‘লাইফ ইজ আনপ্রেডিকটেবল, বিকজ ইট ইজ লাইফ।’ জীবনের এই রহস্য যেমন মজার, তেমনই মনখারাপের। অর্চিনকে নিয়ে সে কত কিছুই না গোপনে ভাবে। ভাবে জীবনের ‘আনপ্রেডিকটেবল’ নিয়মে সব একদিন উলটে যাবে। না, যাবে না। কারণ অর্চিন তাকে নিয়ে ভাবে না। তার ভাবনার মানুষ আলাদা। সেই মেয়ের নাম ঋষা। অর্চিনের মতো ঝকঝকে ছেলের জন্য ঋষাই উপযুক্ত মেয়ে। সে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। তার মতো নার্ভাস নয়। ঋষাকে যে কর্ণিকা খুব বেশি চেনে এমন নয়। তার আলাপ ফেসবুকে। ঋষা ফেসবুকে বেশি থাকে না। এলেও টুকটাক দু-একটা কথা বলে অফলাইন হয়ে যায়। সে ফাঁকা সময়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের থেকে বই টই নিয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে। নিজেই এই কথা ওয়ালে পোস্ট করেছে। কর্ণিকা এই মেয়েকে ঘাটায় না। তার ভয় করে। যদি অর্চিন জানতে পারে তাহলে নিশ্চয় রেগে যাবে। অর্চিন সব সময়েই তার সঙ্গে কেমন যেন রাগ রাগ করে কথা বলে। পাত্তা দিতে চায় না। অ্যাভয়েড করে। করুক। যত খুশি রাগ করুক। তবু সে এই ছেলেকে ভালোবাসে। নরমাল বুদ্ধির ভালোবাসা নয়, বোকার মতো ভালোবাসা। একটা ছেলে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে, তাকে পাত্তা দেয় না, তারপরেও তাকে ভালোবাসার মানে কী? বোকামি ছাড়া আর কী? অর্চিন যখন তাকে হেলাফেলা করে, ফোন ধরে না, মেসেজের জবাব দেয় না, দেখা করে না খুব দু:খ হয়। মনে হয়, ঘরের দরজা আটকে একচোট কাঁদি। মনে হয়, আর কোনওদিন সে হ্যাংলার মতো অর্চিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাবে না। তার নিজের কি কোনও দাম নেই? ঋষার মতো ঝকমকে মেয়ে না হোক, সে কি এতটাই হেলাফেলার? তার কি কোনও আত্মসম্মান বোধ নেই? দুদিন পরেই সব জট পাকিয়ে যায়। মনে হয়, ভালোবাসায় কীসের আত্মসম্মান? কীসের অবহেলা? ধ্যুস। আমার ভালোবাসা আমার কাছে। সব মানুষকে যে সমান হতে হবে, এক ভাবে চলতে হবে তার কি মানে আছে? অর্চিন আলাদা। আলাদা বলেই তো তাকে এত ভালোবাসে। কিছুতেই বেরোনো যায় না। সবথেকে বড় কথা হল, অন্য মানুষটা কেমন ভাবে নিল তার ওপর ভালোবাসা নির্ভর করে না। ভালোবাসা সবসময়ই একা এবং স্বাধীন। তাই এত প্রিয়। এমন তো নয় যে সে অর্চিন আর ঋষার মাঝখানে ঢুকতে চাইছে। মোটেও না। তাছাড়া চাইলেও যে কোনও লাভ হবে না, তাও ভালো করে জানা হয়ে গেছে। উলটে অর্চিন আরও সরে যাবে। এখন যেটুকু যা কথা বলে, যোগাযোগ করে তাও করবে না। ভালোবাসার কোনও পাওয়াই পূর্ণ হয় না, আবার অপূর্ণও হয় না। একটা সময় মনে হয়, আরও পেলে ভালো হত। একটা সময় মনে হয়, উফ এত পাওয়া তো কষ্টকর। দমচাপা। অল্প প্রেমের পরই প্রেমিক প্রেমিকারা ঘনিষ্ঠ হবার জন্য আকুলি বিকুলি করে। আবার দীর্ঘদিন প্রেমে ঘনিষ্ঠ থেকেও স্বামী স্ত্রী আলাদা হয়ে যায়। এর কোনও নিয়ম নেই। নিয়মে ঢোকাও যায় না।

অনেকটা ভেবে ফেলল কর্ণিকা। তারপরেই মোবাইল তুলে অর্চিনের নম্বর টিপল। প্রাোমোশনের খবরটা খুব জানাতে ইচ্ছে করছে।

‘বলো’ অর্চিনের গলা ভারী।

কর্ণিকা নীচু গলায় বলল, ‘একটা খুব ভালো খবর আছে। ভাবলাম তোমাকে জানাই।’

অর্চিন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘বলে ফেলো।’

‘অফিসে আমার একটা প্রাোমোশন হয়েছে। খুব বড় প্রাোমোশন।’

অর্চিন ওপাশে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ভালো খবর।’

অর্চিনের প্রশংসায় কর্ণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আমাদের বস একজন দারুণ মানুষ।’

অর্চিন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কেন? তোমাকে প্রাোমোশন দিয়েছে বলে?’

কর্ণিকা হেসে বলল, ‘না, তা নয়। আমার ধারণা, আমার এই প্রাোমোশন হয়েছে, বসের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।’

ওপাশে অর্চিন যেন একটু ঘাবড়ে গেল। বলল, ‘কী বললে!’

কর্ণিকার উৎসাহ বেড়ে গেল। যে ছেলে তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য মোটে সময় পায় না, সে আজ এত প্রশ্ন করছে!

‘সত্যি! আমি একদিন স্যারের চিঠির ভুল ধরেছিলাম, আমার ধারণা সেই কারণে আমি প্রাইজ পেলাম।’

অর্চিন একটা ছোট শ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমার বসের মনে হয় খানিকটা মাথার সমস্যা আছে।’

কর্ণিকা বলল, ‘মোটেই না। উনি একজন সিরিয়াস মানুষ। বিমলকান্তি সেনের মতো মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।’

অর্চিন একটু চুপ করে বলল, ‘কী নাম বললে?’

কর্ণিকা বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, ‘বিমলকান্তি সেন।’

কর্ণিকা কোথায় কাজ করে, কী কাজ করে সেসব নিয়ে কখনও উৎসাহ দেখায়নি অর্চিন। একটা চাকরি করে, ব্যস এইটুকুই জানে। আজ সে প্রথম জানল, কর্ণিকা কাজ করে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে। বিমলকান্তি সেনের অফিস। যার বাড়িতে সে থাকে। আশ্চর্য!

ঠিক একই সময় আর একটা খুব আশ্চর্যের ঘটনা ঘটল। ঘটছে বিমলকান্তি সেনের চেম্বারে।

বিমলকান্তি নিখিলেশ উপাধ্যায় হয়ে গেছেন! আসল নিখিলেশ উপাধ্যায় বসে আছেন তার উলটোদিকের চেয়ারে। আওয়াজ করে চা খাচ্ছেন। বদলে যাওয়া বিমলকান্তি ভাবছেন—

‘দায়িত্ব কি আমি ঠিকমতো পালন করতে পারছি? কমলকান্তিবাবু আমাকে তাঁর পুত্রকে গার্ড দিতে বলেছেন। অফিসে কোনও সমস্যায় পড়লে পরামর্শ দিতে বলেছেন। আমি কি এতদিন ধরে তা পেরেছি? যদি পেরে থাকি তাহলে নিশ্চয়ই আমার ওপর তার বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এবার বড় কোপ মারতে হবে।’

বিমলকান্তিবাবুর বাঁ হাঁটুর কাছটা কনকন করে উঠল। এই ব্যথা তার নয়। এই ব্যথা নিখিলেশ উপাধ্যায়ের। তিনি চা খাচ্ছেন না, তবু জিভে চায়ের স্বাদ পেলেন।

সব মিলিয়ে একক মুহূর্ত। কয়েক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ। আবার সব নরমাল। বিমলকান্তিবাবু আবার বিমলকান্তি হয়ে গেলেন। তিনি চুপ করে বসে আছেন। তার মানে, উপাধ্যায়বাবুকে বাবাই এখানে রেখেছেন! সমস্যায় পড়লে তাকে রক্ষা করবার জন্য! কী অদ্ভুত! এতদিনে কিছুই বোঝা যায়নি! বড় কোপ মানে কী?

কিন্তু সেসব পরের কথা। আসল কথা হল, আবার একই গোলমাল। প্রহ্লাদ দিয়ে যা শুরু হয়েছিল। তারপর বাবা হয়ে এখন উপাধ্যায়বাবু।

বিমলকান্তি সেন নিশ্চিত হলেন তার কোনও বড় গোলমাল হয়েছে। বড় গোলমাল ছাড়া একজন মানুষ অন্য মানুষ হয়ে যেতে পারে না। এই গোলমাল কি শুধুই বিভ্রম? মনের ভুল? নাকি অন্য কিছু? এমন কিছু যা বোঝা যায় না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *