একটু পরে রোদ উঠবে – ১

এক

খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। তার থেকেও কম হতে পারে। গুনে গুনে ক’টা কথা। একবার পেটের কাছে চুলকুনি আর একটু চোঁয়া ঢেকুর। তাও পুরো ঢেকুর নয়, আধখানা ঢেকুর। সেই ঢেকুর গলার কাছ পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। এই কর্মকাণ্ডে সব মিলিয়ে কত সময় লাগবার কথা? তারপরেই আবার নরমাল। যে কে সেই। যেমন ছিলেন তেমন।

বিমলকান্তি সেন ভুরু কোঁচকালেন। এটা কী ঘটল! আদৌ কি কিছু ঘটল? নিশ্চয় নয়। একটা ভুল মাত্র। সাধারণ ভুল নয়, হাবিজাবি ভুল। বিমলকান্তি সেনের ভুরু আরও কুঁচকে গেল। তিনি একজন সিরিয়াস মানুষ। জীবনে হাবিজাবি ভুল তিনি বরদাস্ত করেন না। পনেরো সেকেন্ডের জন্য হলেও নয়। তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন।

‘প্রহ্লাদ, টাকা কবে লাগবে?’

প্রহ্লাদ গদগদ গলায় বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্যার।’

‘কত তাড়াতাড়ি?’

প্রহ্লাদ হাত কচলে বলল, ‘ওই তো স্যার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

প্রহ্লাদ ‘সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটস’ কোম্পানির একজন কর্মচারী। গোড়াতে বিমলকান্তিবাবু তার এই মাঝবয়সি কর্মচারীটির মুখ চিনতে পারলেও, নাম মনে করতে পারেননি। আজকাল এটা হচ্ছে। বয়েসের লক্ষণ। বাষট্টি বছর কম বয়স নয়। বিজ্ঞান নানা ধরনের ওষুধবিষুধ আবিষ্কার করায় মানুষের আয়ু বেড়ে গেছে। সকলেই বলে, বাষট্টি বছর এখন কিছু নয়। বাষট্টি কেন? বাহাত্তর, বিরাশিও কিছু নয়। বিমলকান্তিবাবু তা মনে করেন না। তিনি মনে করেন, বেশি বয়স অবশ্যই ‘কিছু’। ওষুধবিষুধ হল চাবুকের মতো। হাঁপিয়ে পড়া ঘোড়াকেও ছোটায়। ঘোড়া যত জোরেই ছুটুক, আসলে সে ক্লান্ত। ছোটায় তার কোনও আনন্দ নেই। একটা সময় নিজের কোম্পানির একশো কুড়িজন কর্মীকেই নামে চিনতেন বিমলকান্তিবাবু। শুধু নামে নয়, কে কোন পোস্টে আছে তাও বলে দিতে পারতেন। এখন পারেন না। কাজে কি আনন্দ কমে যাচ্ছে? চাবুকের শাসনে ছুটতে হয় তাই ছুটছেন? কে জানে!

খানিক আগে প্রহ্লাদ যখন ঘরে ঢোকে, তখনও একই ব্যাপার হয়েছে। মুখটুকু শুধু চিনতে পেরেছিলেন। এই লোককে অফিসে দেখেছেন। কিন্তু কোথায় মনে পড়েনি। প্রহ্লাদ নিজেই নাম, ডিপার্টমেন্ট আর পোস্ট বলল।

‘স্যার, এবার কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

বিমলকান্তিবাবু বিরক্ত হলেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? এই লোক কি তার পরীক্ষা নিচ্ছে? প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কঠিন গলায় বললেন, ‘যা বলবার দ্রুত বলবে। আমার হাতে সময় নেই।’

খানিকটা রাগের কারণেই লোকটার ডিপার্টমেন্ট, পোস্ট পরক্ষণেই ভুলে গেলেন বিমলকান্তি। শুধু মনে রাখলেন আহামরি কিছু নয়, ছোটখাটো কোনও একটা কাজ করে। ক্লার্ক, টাইপিস্ট ধরনের। লোকটার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একধরনের কুঁজো ভাব। বিমলকান্তি দ্রুত মনে করবার চেষ্টা করলেন, তার এই কর্মচারীটি কি সবসময়ই কুঁজো? নাকি অনুগ্রহ নিতে এসেছে বলে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে? দ্বিতীয়টাই হবে। মাঝে মাঝে হাতও কচলাচ্ছে। এক বগলে ছাতা, অন্য বগলে ব্যাগ নিয়ে হাত কচলানো কঠিন কাজ। যারা ছোটখাটো কাজ করে, তাদের এই ধরনের নানা কঠিন কাজ সামলাতে হয়।

‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বলে কোনও দিন হয় না। কত তাড়াতাড়ি দরকার সেটা বলো।’

মালিকের কথায় উৎসাহ ডবল হয়ে যায় প্রহ্লাদের। সে বলে, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে পেলে সবথেকে ভালো হয় স্যার। ইতিমধ্যেই দশদিন দেরি করে ফেলেছি। পরের ইনস্টলমেন্ট দু’মাস পর। তিন নম্বরটা নেবে পুজোর মুখে মুখে। তার মধ্যে স্যার আমি অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। দেশের জমিটা বিক্রিবাটা হয়ে যাবে। জ্ঞাতিদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছি। অনেকটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কেবল ছোটকাকা গোল পাকাচ্ছে। তাও স্যার আপন ছোটকাকা নয়। বাবার খুড়তুতো ভাই। মামলাবাজ লোক।’

বিমলকান্তিবাবু চোখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরালেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এত কথা বলছ কেন? আমি কি এসব জানতে চেয়েছি?’

প্রহ্লাদ আরও জোরে হাত কচলে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর বলব না।’

বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থাকলেন। কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘এত দেরি করে টাকা জোগাড়ে নেমেছ কেন?’

বগলে ছাতা ধরা অবস্থাতেই প্রহ্লাদ ডান হাত দিয়ে পেটের পাশটা খসখস করে একপ্রস্থ চুলকে নিল। বলল, ‘আগেই ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম স্যার। আমার ভায়রাভাই দেবে ঠিক ছিল। পাকা কথা হয়েছিল। দুদিন আগে টাকা আনতে গেলাম, বললে এখন হবে না। ব্যবসায় লস যাচ্ছে। অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে। মিছে কথা। ওর অর্ডারের কাজকারবারই নেই স্যার। দুটো লরি, তিনটে ম্যাটাডর আছে। ভাড়া খাটায়। তার অর্ডার কী হবে? আমিও বলে ফেললাম। তোমার আবার অর্ডার কীসের হে? গাড়ি ভাড়া দাও। মিছে কথা বলছ কেন? ভায়রাভাই বলল, ওই একই হল। ভাড়ার বাজার ডাউন যাচ্ছে। আমার ভায়রাভাই স্যার মানুষ খারাপ নয়। শালিটাই যত গণ্ডগোলের। স্বামীকে আটকেছে। বোন হলেও আমার বউকে হিংসে করে। মেয়েতে মেয়েতে হিংসে বেশি।’

বিমলকান্তিবাবু হাত তুলে বললেন, ‘আ:, আবার বেশি কথা বলছ।’

প্রহ্লাদ আরও খানিকটা কুঁজো হয়ে বাঁ-হাতে কান ছুঁয়ে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না।’

কথাটা বলে একটা ঢেঁকুরের মতো তুলল প্রহ্লাদ। ঢেঁকুর না হেঁচকি? মাঝপথে কেমন থমকে গেল। সে যাক গে। বিমলকান্তিবাবু বিরক্তির সঙ্গে অবাক হচ্ছেন। অফিসে কাজ করে, অথচ এই লোক মালিকের স্বভাবচরিত্রের খবর রাখে না? তিনি অতিরিক্ত কথা পছন্দ করেন না, একজন সিরিয়াস মানুষ সে বিষয়ে কি এই লোকের কিছু জানা নেই! এই লোকের ডিপার্টমেন্টের মাথায় কে?

বিমলকান্তিবাবু বুঝতে পারলেন, তার বিরক্তি বাড়ছে। সকালবেলা বিরক্তি বাড়া ভালো কথা নয়।

সিরিয়াস মানুষ হয় দু’প্রকার। ভক্ত সিরিয়াস এবং বিরক্ত সিরিয়াস। ভক্ত সিরিয়াস মানুষরা সিরিয়াস ভাবের ভক্ত হয়। ভাবে বিভোরও বলা যায়। সিরিয়াস ধর্মে মেতে থাকে। চারপাশে কে কী করল, তা নিয়ে মোটে মাথা ঘামায় না। নিজের মতো করে কাজ করে। জটিল ক্যালকুলাস সলভ করা এবং ঘর ঝাঁট দেওয়া, দুটোতেই সমান মনোযোগ দেয়। এতে কাজ যে সবসময় ঠিক হয়, এমন নয়। অতিরিক্ত ক্যাজুয়াল ভঙ্গি যেমন খারাপ, অতিরিক্ত সিরিয়াস ভঙ্গিও গোলমাল করে। কাজের সূক্ষ্ম গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়। তা হোক। ভক্ত সিরিয়াসরা সে কথা মানে না। কাজ সূক্ষ্ম না মোটা এটা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। সিরিয়াস ভাবের প্রতি ভক্তিটাই আসল। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ধরনের সিরিয়াস মানুষে ঝামেলা বেশি। এরা বিরক্ত সিরিয়াস। নিজে সদা বিরক্ত। আবার অন্যকেও বিরক্ত করে। এদের বিশ্বাস, শুধু নিজে সিরিয়াস হলে চলবে না, চারপাশের সবাইকে সিরিয়াস হতে হবে। সিরিয়াস নয় বলেই মানবজাতির এই দুর্দশা। হাসি-ঠাট্টা, তরল কথা, লঘু আচরণ এই মানুষরা মোটে সহ্য করতে পারে না। তাদের কাছে এসব ‘ছ্যাবলামি’ ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের জন্ম ছ্যাবলামি করবার জন্য হয়নি। মানুষের জন্ম হয়েছে দায়িত্ব পালন করবার জন্য। জীবনে অবাস্তবতা এবং কল্পনার কোনও স্থান নেই। ও সব অলস ও ফাঁকিবাজদের বিষয়। দায়িত্ব এড়ানোর ফন্দি।

লক্ষ করবার মতো বিষয় হল, দু’ধরনের সিরিয়াস মানুষের ভঙ্গিও দু’ধরনের। ভক্ত সিরিয়াসদের ভঙ্গি গদগদ। ‘আমি সব কাজ কত সিরিয়াসভাবে করছি’ তার জন্য গদগদ। আর বিরক্ত সিরিয়াসরা হল গোমড়ামুখো। সবাই কেন তার ইচ্ছেমতো ‘সিরিয়াস’ নয়, সেই কারণে গোমড়ামুখো।

বিমলকান্তিবাবু একজন বিরক্ত সিরিয়াস মানুষ। যত বয়স বাড়ছে, তার এই ভাব বাড়ছে। তিনি গম্ভীর থাকা পছন্দ করেন। ঠান্ডা গলায় ধমক দেন। কারণে দেন, অকারণেও দেন। অকারণ ধমক বেশি কাজের বলে মনে করেন। এতে আগাম সতর্ক করবার সুযোগ থাকে। গৃহকর্তার এই উদ্ভট স্বভাবে বাড়ির সদস্যদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারা বিরক্ত। শুধু তার একানব্বই বছরের পিতা কমলকান্তি সেন এবং বাইশ বছরের ছোট মেয়ে বারিধারা তার স্বভাব এবং মেজাজকে আমল দেয় না।

কর্মক্ষেত্রেও তাই। বিমলকান্তিবাবুর এই সিরিয়াস বাই কর্মচারীদের তটস্থ করে রেখেছে। অফিসে, ওয়ার্কশপে কোনওরকম আলগা ভাব তিনি বরদাস্ত করেন না। তার মত হল, কাজ ভুল না ঠিক সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা, কাজে সিরিয়াস ভাব আছে কিনা। কেউ যদি মন দিয়ে ভুল কাজ করে, তিনি রাগ করেন না। তার বিশ্বাস জন্মায়, এই লোক নিজেকে সংশোধন করতে পারবে। কিন্তু হেলাফেলায় করা ঠিক কাজে কোনও ভরসা নেই। যে-কোনও সময় গোলমাল করবে। একমাস পরে ফাইলে গোলমাল বা তিনমাস পরে প্রাোডাকশনে খুঁত ধরা পড়বে। শুধু কাজে নয়, ছুটিতেও ‘সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর মালিক সিরিয়াস। একবার অ্যাকাউন্টসের ঋত্বিক বিরাট বিপদে পড়েছিল। সে বারোদিনের ছুটি নিয়ে, দশদিনের মাথায় কাজে জয়েন করে। খবর পেয়ে বিমলকান্তিবাবু তাকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বিপদের কথা কেউ আঁচ করতে পারেনি। বরং উলটো ভেবেছিল। ভেবেছিল ঋত্বিক মালিকের পিঠ চাপড়ানি পাবে।

ঋত্বিক ঘরে ঢোকবার পর বিমলকান্তি সহজ গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, ‘বেড়াতে গিয়েছিলে?’

ঋত্বিক গদগদভাবে বলে, ‘হ্যাঁ, স্যার। ফ্যামিলি নিয়ে সিমলা, মানালি গিয়েছিলাম।’

বিমলকান্তিবাবু আরও সহজভাবে বললেন, ‘কেমন বেড়ালে? ওয়েদার ভালো পেয়েছ?’

গম্ভীর বসের হালকা ভঙ্গিতে ঋত্বিক উত্তেজিত বোধ করেছিল।

‘ওয়েদার ভালো পেয়েছি স্যার। একদিন বরফও পেয়েছি। আমার মেয়ে তো বরফ দেখে পাগল।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘এই সময় তো ওদিকটায় বরফ পাওয়ার কথা নয়। তোমার আইস লাক ভালো দেখছি ঋত্বিক।’

ঋত্বিক দাঁত বের করে হাসে। বলে, ‘আপনার আশীর্বাদ স্যার।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘তুমি তো বারোদিন ছুটি নিয়েছিলে।’

ঋত্বিক সাহস পেল। বলল, ‘দশদিনের ট্যুর ছিল স্যার। তারপরেও দুটো দিন এক্সট্রা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে রেস্ট নেব। জার্নির তো একটা ধকল থাকে। তাছাড়া চেনা-পরিচিতদের সঙ্গে বেড়ানোর গল্প করব। ফটো দেখাব। বেড়ানোর এটাও একটা পার্ট। সেই কারণে দুদিন।’

‘ভালো করেছিলে, ঠিক করেছিলে। তাহলে আজ এলে কেন?’

ঋত্বিক বুঝতে পারল, পিঠ চাপড়ানির সময় এসেছে। বলল, ‘স্যার, সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হল, অহেতুক বাড়িতে শুয়ে-বসে ছুটি কাটিয়ে লাভ কী? তার থেকে অফিসে দুদিন আগেই জয়েন করে ফেলি। কাজ অনেকটা জমে গেছে…।’

এরপর বিমলকান্তি সোজা হয়ে বসলেন। একটু চুপ করে, টেবিলে রাখা পেনসিল তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ভালো করেছ। কিন্তু তোমার সামনে এখন দুটো অপশন ঋত্বিক। এক, তুমি এখনই বাড়ি চলে যেতে পারো। জার্নির ধকল সারিয়ে, আত্মীয়-বন্ধুদের বেড়ানোর গল্প করে, বরফের ফটো দেখিয়ে দুদিন ছুটি কাটিয়ে তারপর ফিরে আসবে। প্রমাণ করবে, তুমি যে ছুটি নিয়েছিলে সে ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস। দুটো ছুটির দিন কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। আর দু’নম্বর অপশন হল, তুমি টেবিলে গিয়ে কাজ করো, কিন্তু তোমার বারোদিনের ছুটি আমি আমার বিশেষ ক্ষমতাবলে বাতিল করে দিচ্ছি। এতে তোমার পাওনা ছুটি নষ্ট হবে। মাইনে পর্যন্ত কাটা যেতে পারে।

ঋত্বিকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কি ঠিক শুনল? এই মানুষটা কি পাগল?

বিমলকান্তিবাবু নীচু গলায় বললেন, ‘আমার কাছে কাজটা যেমন সিরিয়াস, ছুটিটাও তেমন। আশা করি, আমার কর্মচারীদের কাছেও তাই হবে। এখন যাও। যে অপশনটা তোমার পছন্দ, সেটা বেছে নাও।’

শুকনো মুখে ঋত্বিক ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

বিমলকান্তিবাবু একতলার ড্রইংরুমে বসে আছেন। হাতে খবরের কাগজ। কাগজটা তুলে মুখ ঢাকলেন। তার বিস্ময় ভাব যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায়। এখন সকাল আটটা বেজে কুড়ি মিনিট। পুবদিকের জানলা দিয়ে ঘরে আলো আসছে। তবে আলোর জোর কম। আকাশে সম্ভবত মেঘ রয়েছে। বাড়িতে অফিস বা ওয়ার্কশপের কারও সঙ্গে দেখা করা বিমলকান্তি পছন্দ করেন না। তারপরেও করতে হয়। বাধ্য হয়ে করতে হয়। কোম্পানির ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে হয়। একসময় ঠাকুরদা করতেন। তার থিওরি ছিল, ‘ব্যবসার বাইরেও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন-অপ্রয়োজন থাকতে পারে। সেসব কাজের জায়গায় না শোনাই ভালো।’ বিমলকান্তি এই থিওরি মানেন না। তার বাবাও মানতেন না। কিন্তু তিনিও দেখা করেছেন। তবে দিন কমেছে। ঠাকুরদা সপ্তাহে তিন করতেন। বাবা সেটা নামিয়ে দুদিনে আনেন। বিমলকান্তিবাবু দেখা করেন মাত্র একদিন। বুধবার। সকালে একঘণ্টা। আজ বুধবার নয়, বৃহস্পতিবার। তবু প্রহ্লাদ এসেছে। ভবানী গেট থেকে এসে খবর দিল।

‘বললাম, দেখা হবে না। পরের বুধবার এসো। তারপরেও যেতে চায় না। বলছে, খুব দরকার। পরের বুধবার পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না।’

বিমলকান্তিবাবু একবার ভাবলেন, তাড়িয়ে দিতে বলবেন। ভবানী ভালো দারোয়ান। লোক কীভাবে তাড়াতে হয় সে জানে। তারপরেও থমকে গেলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।’ সম্ভবত এটা বয়েস বাড়বার লক্ষণ। সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা। ভবানী চলে যাওয়ায় বিমলকান্তি নিজের ওপরই বিরক্ত হলেন। এটা ঠিক নয়। সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা মানে কাজ ভালো লাগছে না। তিনি কি ক্লান্ত?

খাটো ধুতি, কলার দেওয়া হাফহাতা শার্ট পরা প্রহ্লাদ এসে হাজির হল মিনিট দুয়েকের মধ্যে। নিজের পরিচয় দিতে বিমলকান্তিবাবু রাগী গলায় বললেন, ‘যা বলবার দ্রুত বলবে। আমার হাতে সময় নেই।’

এর অল্প কিছু পরেই ঘটনাটা ঘটল। যা হয়তো আদৌ ঘটেনি। হয়তো কেন? অবশ্যই ঘটেনি। এরকম কিছু কখনও ঘটতে পারে না। একটা ভুল। মনের ভুল। বিমলকান্তি সেনের খচখচানি যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, ভুলটা ভয়ঙ্কর! সত্যি তাই। ভয়ঙ্কর।

বিমলকান্তিবাবু মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

গণ্ডারদের মধ্যে সঙ্গীতপ্রেমের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে গানের মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। তানজানিয়ার ওকারু হুনাই গণ্ডার গবেষণাকেন্দ্রে দীর্ঘ বাইশ বছর পরীক্ষার পর পশুবিজ্ঞানীরা এই চমকপ্রদ তথ্যটি জানতে পেরেছেন। পরীক্ষা বলছে, বাদ্যযন্ত্র যদি বাঁশি জাতীয় কিছু হয়, তাহলে সবথেকে ভালো। বাঁশির সুর শুনলে গণ্ডাররা থমকে দাঁড়াচ্ছে। কান খাড়া করছে। অল্প অল্প লেজও নাড়ছে। গণ্ডারের লেজ অতি সংক্ষিপ্ত, তবু নাড়ছে। কোনও কোনও সময় তারিফ করবার ভঙ্গিতে তাদের মাথা দোলাতেও দেখা গেছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মাঝপথে বাঁশি থেমে গেলে গণ্ডাররা বিরক্ত হচ্ছে। রেগে যাচ্ছে। একখানা শিং বাগিয়ে পা দিয়ে মাটি খোঁড়ে। ফোঁস ফোঁস আওয়াজে নি:শ্বাস ফেলে। তখন ফের বাজনা শুনিয়ে শান্ত করতে হয়।

তানজানিয়া সরকার বিরাট খুশি। গবেষণার পিছনে অর্থ বরাদ্দ দ্বিগুণ করে দিয়েছে। প্রজেক্টের নাম হয়েছে, ‘রাইনো মিউজিক’। ‘রাইনো মিউজিক’ প্রজেক্টে এবার বাঁশি ছাড়া অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের প্রতি গণ্ডারদের অনুরাগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে তারের বাজনা। প্রাথমিকভাবে লক্ষ করা গেছে, জগঝম্প সঙ্গীতের থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি গণ্ডারদের ঝোঁক বেশি। প্রজেক্টের মাথায় আছেন পশু বিজ্ঞানী হার্ড কিমোলাই। গণ্ডারেরর সঙ্গীতপ্রেম আবিষ্কারের কারণে তিনি নাকি যে-কোনও সময় নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেছেন, গণ্ডারের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে এখনই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। গণ্ডারকে নিয়ে যাবতীয় গবেষণা ধৈর্যের বিষয়। বিভিন্ন স্তরের চামড়া এবং চর্বি ভেদ করে অনুভূতিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে হয়। সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এই গবেষণার প্রতিবাদে তানজানিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, যে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে দুর্ভিক্ষে মারা যায়, সেই দেশে গণ্ডারের সঙ্গীতপ্রেমের পিছনে সরকারের অর্থ ব্যয় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জিনিস মানা যায় না। আশার কথা, সরকার কড়া হাতে বিক্ষোভ দমন করছে।

প্রহ্লাদ আসবার আগে বিমলকান্তিবাবু গণ্ডার বিষয়ক এই খবর পড়ছিলেন। ইন্টারেস্টিং খবর। যদিও খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে ভিতরের পাতায়, কোণের দিকে। চট করে চোখে পড়ে না। বিমলকান্তিবাবু খেয়াল করে দেখেছেন, খবরের কাগজগুলো আজকাল ইন্টারেস্টিং খবর গুরুত্বহীনভাবে প্রকাশ করে। এটা সিরিয়াস ভাবের অভাব। মানুষ এতদিন দাবি করে এসেছে, প্রাণীজগতে শুধু তারাই সূক্ষ্ম বোধবুদ্ধি, অনুভূতির অধিকারী। গণ্ডারের বাঁশিপ্রেম সেই দাবি নস্যাৎ করবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?

খবরটা দ্বিতীয়বার পড়বার জন্য বিমলকান্তিবাবু তৈরি হচ্ছিলেন। এই ধরনের খবর একবার পড়লে হয় না, দুবার পড়তে হয়।

দু’বার পড়া হল না। তখনই ভবানী গেট থেকে প্রহ্লাদকে নিয়ে এসেছে।

‘স্যার, মাপ করবেন, আজ আপনি দেখা করেন না, কিন্তু আমার বিষয়টা আর্জেন্ট।’

বিমলকান্তিবাবু আবার বিরক্ত হলেন। এই লোক তো সবদিকে গোলমাল করে। এক নম্বর, বুধবারের বদলে আজ এসেছে। দু’নম্বর, তাকে চেনা গেছে কিনা তাই নিয়ে প্রায় কৈফিয়ত তলব করেছে। এখন আবার বলেছে, তার ব্যাপারটা আর্জেন্ট। যেন বাকি যারা তার সঙ্গে দেখা করে তাদের ব্যাপার এখন হলেও হয়, না হলেও হয়। এই লোককে কি জোর ধমক দেওয়া উচিত নয়? নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি। সকালবেলা মেজাজ গরম করে লাভ নেই। মেজাজ গরমের জন্য সারাদিন পড়ে আছে। তিনি খবরের কাগজের পাতা উলটোতে উলটোতে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কেন আর্জেন্ট?’

‘স্যার, আমার কিছু টাকা চাই।’

বিমলকান্তিবাবু চমকালেন না। ব্যক্তিগতভাবে যারা তার কাছে আসে, তারা মূলত দুটো কারণে আসে। চাকরি এবং টাকা। অফিসে-ওয়ার্কশপে ভাগ্নে, শালাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে। অথবা মেয়ের বিয়ে, বাবার চিকিৎসা, ছেলের লেখাপড়ার জন্য টাকা লাগবে। অফিস থেকে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এমনকী এমারজেন্সি ফান্ডও রয়েছে। সেখানে অ্যাপ্লাই করলে হঠাৎ প্রয়োজনে সাহায্য মেলে। তার পরেও লোক আসে। যাদের নিয়মকানুনের বাইরে টাকার প্রয়োজন অথবা যারা নিয়মকানুনের জালে জড়াতে চায় না তারা এসে কাঁদুনি গায়। এখন আবার নতুন ফ্যাচাং শুরু হয়েছে। সেন অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন লোকজনও আসতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম ভবানীকে দিয়ে গেট থেকেই তাড়িয়ে দিতেন বিমলকান্তি।

ভবানী কড়া গলায় বলত, ‘হবে না। স্যার শুধু কোম্পানির লোকেদের সঙ্গে দেখা করেন।’

‘ওদের ফাঁকে একবার ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না?’

ভবানী তেড়েফুঁড়ে উঠত, ‘বলছি তো হয় না। নিয়ম নেই।’

‘তুমি ইচ্ছে করলেই নিয়ম ভাঙতে পারো ভাই। পৃথিবীর সব দারোয়ানই নিয়ম ভেঙে লোক ঢোকাতে পারে। তার জন্য আলাদা সিস্টেম থাকে।’

ভবানী কাজে কড়া হলেও বোকার দিকে মানুষ। তাকে বাড়ির দারোয়ান পদে বহাল করবার আগে বিমলকান্তি কথা বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন যে সে বোকা। পাহারাদার, দারোয়ানের বুদ্ধি বেশি হলে সমস্যা। বোকা এবং গোঁয়াড় প্রকৃতি তাদের প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত। ‘অর্ডার নেই’ বলে বহু ‘উচিত কাজ’ তারা করবে না। চোখের সামনে যদি কেউ জলে ডুবে মারাও যায়, তারা হাত বাড়াবে না। অর্ডার নেই। বিমলকান্তিবাবু এই কারণে বোকা লোক খুঁজে বের করেছেন। ভবানী নিয়ম ভেঙে লোক ঢোকানোর সিস্টেম ধরতে পারেনি। অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘সিস্টেম! কীসের সিস্টেম?’

‘আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? তুমি চা খেয়েছ? নাকি সকাল থেকে টুল পেতে বসে আছ? নাও ভাই, এই দশ টাকাটা রাখো। যাও, চা-কচুরি খেয়ে এসো। ততক্ষণে চট করে তোমার স্যারের সঙ্গে কথা সেরে আসি।’

দশ টাকার লোভ দেখিয়েও ভবানীকে টপকানো যায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত বাইরের লোক আসা পুরোপুরি ঠেকাতেও পারেননি বিমলকান্তি সেন। বড়-মেজো-সেজো নানা ধরনের রেকমেন্ডেশন নিয়ে তারা হাজির হয়। গরিব দেশে রেকমেন্ডেশন হল সবথেকে ঝামেলার বিষয়। সাপের ছুঁচো গেলার মতো। না গেলা যাবে, না উগরানো যাবে। তার ওপর কোনও কোনও ছুঁচো হুমকি-ধমকিও দেয়।

‘দাদা চিঠি দিয়েছে।’

‘কারও নাম বলতে হবে না, স্যারকে গিয়ে শুধু বলো কবিরাজ বাই লেন থেকে এসেছি। ব্যস, তাহলেই হবে। কবিরাজ বাই লেনের কথা শুনলে আজও অনেকের প্যান্টে ইয়ে হয়ে যায়। দেখবে তোমার স্যার আমাকে রিসিভ করতে ছুটে না আসেন।’

ব্যবসা করতে হয়। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে চলে না। পছন্দ হোক না হোক। তাছাড়া শুধু ব্যবসার কারণে নয়, সামাজিকতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। সেটাও মানতে হয়। মণিকুন্তলাও সে কথা বলেছে। স্ত্রীর সঙ্গে তার এই বিষয়ে তর্ক হয়েছে।

‘সিরিয়াস মানুষরা সমাজেই বাস করে। জঙ্গলে করে না। জঙ্গলে যেমন অসুবিধে আছে, সমাজেও কিছু অসুবিধে থাকে। সেই অসুবিধে নিয়েই থাকতে হয়।’

বিমলকান্তিবাবু বলেছেন, ‘এর মধ্যে সমাজ বা জঙ্গলের কী প্রশ্ন ওঠে! বুধবার সকালে তো আমার সবার সঙ্গে দেখা করবার কথা নয়। আমি শুধু আমার অফিসের কারখানার লোকদের সঙ্গে দেখা করি। অন্যদিন আসুক। অফিসে আসুক।’

‘সবাই তোমার এত নিয়ম জানবে কী করে? কেউ এলে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না।’

বিমলকান্তিবাবু রেগে গিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই পারি। আমার অধিকার আছে।’

মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘সমাজে বাস করতে গেলে নিজের অধিকার, ক্ষমতা নিয়ে সবসময় থাকা যায় না।’

বিমলকান্তিবাবু থামকে যান। বলেন, ‘মণিকুন্তলা, তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ?’

‘জ্ঞান নয়, যেটা উচিত সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু ”সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়টস”-এর মালিক নও, তার বাইরেও তোমার একটা পরিচয় আছে।’

বিমলকান্তিবাবু ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘তার বাইরে আবার কী পরিচয়!’

মণিকুন্তলা শান্ত গলায় বলেন, ‘তুমি বিমলকান্তি সেন এটাই তোমার আসলে পরিচয়। সেখানে তোমার ক্ষমতা নয়, ব্যবহার, আচরণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

বিমলকান্তিবাবুর রাগ বাড়ে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে চাপা গলায় বলেন, ‘আমাকে কি একটু বেশি ছেলেমানুষ ভাবছ না মণিকুন্তলা? উপদেশ, শিক্ষা নেওয়ার মতো বয়স কি আমার এখনও আছে বলে তোমার মনে হয়? নাকি মনে হয়, ব্যবহার, আচরণ সম্পর্কে এখনও আমি কিছু শিখিনি?’

মণিকুন্তলাদেবী বললেন, ‘উপদেশ-টুপদেশ নয়, আমি যা মনে করি সেটাই বললাম। বাড়িতে সময়মতো এলে সবার সঙ্গে দেখা করাটাই উচিত।’

বিমলকান্তি রাগ সামলালেন। বললেন, ‘তা বলছি না। সে তোমার কাজ তুমি বুঝবে আমি শুধু সামাজিকতার কথাটুকু বললাম। তোমার মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়।’

বিমলকান্তিবাবু জীবনে যে অল্প কয়েকজনের তর্ক অ্যালাও করেন, নিজের স্ত্রী তাদের একজন। মণিকুন্তলার বুদ্ধি ও যুক্তির ওপর তার ভরসা রয়েছে। যদিও সেই ভরসা-কথা বিবাহিত জীবনের বত্রিশ বছরে কখনও তিনি প্রকাশ করেননি। স্ত্রীর কাছেও নয়। মণিকুন্তলার কলেজ শুরুতেই বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর সংসার। সেই চাপ সামলে আর পড়া হয়নি। তার পরেও এত বোঝেন কী করে! রাগ এবং বিরক্তির প্রকাশ করেও তিনি স্ত্রীর যুক্তি শোনেন এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত বদলও করেন। মুখে কিছু বলেন না। মণিকুন্তলাদেবীও কিছু বলেন না। তার যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে বা মেনে নিয়ে বিমলকান্তি সেন যে সিদ্ধান্ত বদলেছেন, সেটা যেন তিনি বুঝতেও পারেননি। প্রকাশ্যে স্বামীর দাপটের সামনে চুপ করে থাকেন। তার ইচ্ছেমতো নিজে চলতে এবং সংসার চালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আড়ালে তর্ক করতে ছাড়েন না। বিমলকান্তি এবং মণিকুন্তলার ধারণা, তাদের তর্কের কথা বাড়ির কেউ জানে না। ঘটনা ঠিক নয়। সকলেই জানে। একজন মানুষের জীবনে এটাও একটা রহস্য। সে নানারকম ভুল জেনে নিশ্চিন্তে থাকে।

টাকার কথা বলে প্রহ্লাদ হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন টাকা চাওয়াটা কোনও আনন্দের ঘটনা। বিমলকান্তিবাবুর মনে হল, এই লোকের অন্য দোষ আছে, কিন্তু ভণিতা নেই। এটা ভালো।

‘টাকা কেন লাগবে?’

প্রহ্লাদ এবার লজ্জা পেল। বলল, ‘স্যার, একটা ফ্ল্যাট নিচ্ছি। নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অনেকদিনের স্বপ্ন। বুড়ো বয়েসে এসে মেটাতে যাচ্ছি। বারুইপুর স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশায় চল্লিশ মিনিট যেতে হবে স্যার। এখনও মাটি। মাটি থেকে বুকিং করছি বলে সস্তা। ওদিকটায় স্যার হুড়দুড় করে শহর বাড়ছে। শুনছি কয়েক বছর পর মেট্রো রেলও যাবে। তখন তো স্যার জমির দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। আমার মতো মানুষ ঝুপড়িতেও ঘর পাবে না।’

বিমলকান্তি বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এত কথা বলছ কেন! ফ্ল্যাটের টাকার জন্য আমার কাছে এসেছ কেন? অফিসে লোনের ব্যবস্থা নেই? ব্যাঙ্কে যাও।’

প্রহ্লাদ বগলের ছাতা এবং ব্যাগ সামলেই ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাল।

‘স্যার, পুরো টাকা চাই না। শুধু বুকিংয়ের টাকাটুকু পেলেই এখনকার মতো হয়ে যাবে। তারপর ম্যানেজ করব। গত বছর মেয়ের বিয়ের জন্য অফিসের লোন নিয়ে ফেলেছি। মাইনে কাটছে। এখন হাতে যা পাই তাতে সংসার চলা মুশকিল। আবার যদি ব্যাঙ্কে গিয়ে গাদাখানেক টাকা কাটাই, খাব কী? তাই বলছিলাম, আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন…একটা বছর পর খানিকটা সামলে নিয়ে শোধ দিতে শুরু করব।’

এই লোকের আবদার বিরাট! এক বছর টাকা ফেরত দেবে না বলছে! আবদারের বহরে বিমলকান্তিবাবু হালকা মজা পেলেন। বললেন, ‘কত টাকা?’

প্রহ্লাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘লাগবে এক লাখ বিশ হাজার। আপনি স্যার এক লাখ দিলেই হবে। বিশ হাজার স্যার বউয়ের গয়না বেচে হয়ে যাবে। বুকিং মানি নিয়েই ঝামেলায় পড়েছি। পরেরগুলো জোগাড় হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।’

চিন্তা করবেন না! এই লোকের কথাবার্তা তো একেবারে ঠিক নেই। তার টাকা জোগাড় নিয়ে বিমলকান্তি সেন কেন খামোকা চিন্তা করতে যাবেন! না, অনেক হয়েছে। এবার ভবানীকে ডেকে গর্দভকে বের করে দেওয়াই ভালো। নইলে সত্যি সত্যি সকালেই মেজাজ গোলমাল হয়ে যাবে। লোকটার মাথায় হালকা গোলমাল আছে মনে হচ্ছে। ভারী পাগল ভালো। চিনতে সুবিধে হয়। হালকা পাগল নিয়েই সমস্যা। বিমলকান্তিবাবুর ইজি চেয়ারের পাশে ছোট টেবিলে ইন্টারকম রয়েছে। গেটে যোগাযোগ করা যায়। বিমলকান্তিবাবু হাত বাড়ালেন।

আর তখনই সব উলটে গেল। মুহূর্তের জন্য যেন চারপাশ দুলে উঠল। ভূমিকম্প হলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম।

বিমলকান্তি সেনের মনে হল, তিনি বিমলকান্তি সেন নন। তিনি অন্য কেউ। আরেকটা মানুষ। যিনি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিক নন, একজন কর্মচারী মাত্র। অতি সামান্য কর্মচারী। বারুইপুরের কাছে ফ্ল্যাট কিনবেন। বহুদিনের স্বপ্ন স্যার নিজের বাড়ি হবে। জায়গা দেখেছে, কিন্তু ফ্ল্যাট বুকিং করবার টাকা জোগাড় হয়নি। ঘুরছেন টাকার চেষ্টায়। তার এক বগলে ছাতা, এক বগলে সস্তার ব্যাগ। তাতে টিফিন কৌটো। ‘স্যার’-এর সামনে একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পেটের কাছটা চুলকে উঠল। একটা চোঁয়া ঢেঁকুর গলার কাছ পর্যন্ত এসে থমকে গেল। ঠিক যেন প্রহ্লাদ! তিনি কি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহ্লাদ হয়ে যাচ্ছেন! ভয়ঙ্কর! একটা ঠান্ডা স্রোত বিমলকান্তির শিরদাঁড়া দিয়ে সরসর করে নেমে গেল। তার মাথায় কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের কথা নয়, অন্য মানুষের কথা।

বিমলকান্তি কি তাকে টাকা দেবে? সবাই বলেছে, দেবে না। আমার মনে হচ্ছে, দেবে। কড়া মানুষটার ভিতরে একটা নরম মানুষ আছে। সে অন্যের স্বপ্নকে সম্মান করবে। উনি নিশ্চিত বুঝতে পারছেন আমার স্বপ্নটা সিরিয়াস।

বুকের ভিতরটা ধুকপুক করে উঠল বিমলকান্তিবাবুর। কী হচ্ছে এসব! তিনি কি প্রহ্লাদ হয়ে গেলেন? তার মতো করে ভাবছেন!

হতে পারে না। ভুল হচ্ছে। ভয়ঙ্কর একটা ভুল হচ্ছে।

ভাবতে ভাবতেই নিমেষে সব ঠিক হয়ে গেল। খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমন দ্রুতই চলে গেল সব। মনের ভিতর থেকে মুছে গেল। এমনকী পেট চুলকোনো, হাফ ঢেঁকুরও ভ্যানিশ! সব নরমাল। বিমলকান্তি সেন যেমন ছিলেন তেমন হয়ে গেলেন।

এর পরে আরও দু-চারটে কথা চালালেন বিমলকান্তি। ইচ্ছে করছে না। কেমন একটা অস্বস্তি। ভিতরে খচখচ করছে। এটা কেমন ভুল? একটা মানুষ আরেকটা মানুষ হয়ে যাবে কেন! যত কম সময়ের জন্যই হোক, কেন হবে? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলেন না তো? দু:স্বপ্ন?

বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘প্রহ্লাদ, তুমি অফিসে গিয়ে অ্যাপ্লিকেশন জমা দেবে। আমি বলে রাখব। দুদিন পরে টাকা পেয়ে যাবে। এখন যাও।’

প্রহ্লাদ চলে যাওয়ার পর, অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইলেন বিমলকান্তিবাবু।

দুই

‘কেন পারবে না? কেন?’

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে বারি?’

‘হ্যাঁ পাগল হয়ে গিয়েছি। তাতে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি তো পাগলের ডাক্তার নও যে ছুটে এসে আমার ট্রিটমেন্ট করবে। তুমি কিছুই নও। তুমি একজন বেকার।’

‘আমি কিছু নই! আমি বেকার! এটা কী বলছ বারি? আমি একজন আর্টিস্ট। ফটোগ্রাফার এবং কপিরাইটার। অ্যাডভার্টাইজিং অফিসে কাজ করি। আজও বেলা তিনটের সময় অফিসে যাব। তিনটে নয়, আড়াইটে। আমি কেন বেকার হব?’

‘আর্টিস্ট নয় শ্রবণ, ফ্রিলান্স আর্টিস্ট। বিজ্ঞাপন অফিসে ফ্রিলান্স আর্টিস্ট বেকারের থেকেও খারাপ। আমি যা জিগ্যেস করছি, তুমি সে কথার উত্তর দাও। কী কারণে পারবে না সেটা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলো। তুমি তো জানো আমি যুক্তি পছন্দ করি শ্রবণ।’

‘কী উত্তর দেব ধারা? এটা কি উত্তর দেওয়ার মতো কথা হল?’

‘কথা হল না! তাহলে কোনটা কথা হল? তোমার কথাটাই শুধু কথা হল? আমার কথাটা কথা নয়?’

‘আহা, রাগ করছ কেন? বারি আমি তা বলতে চাইনি। ইনফ্যাকট আমি তো কোনও কথাই বলিনি।’

‘তুমি কী বলতে চেয়েছ আমার জানার কোনও ইচ্ছে নেই শ্রবণ। প্রয়োজনও নেই। তুমি বলো পারবে কি পারবে না। ইয়েস অর নো।’

‘ধারা প্লিজ, প্লিজ বারি…আমার কথাটা মন দিয়ে শোনো। লক্ষ্মী মেয়ে। ধারা, কথাটা হল…।’

‘একটা নাম বলো শ্রবণ। হয় বারি বলো, নয় ধারা বলো। একবার বারি, একবার ধারা অসহ্য লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে। আমার পুরো নাম বলতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে? অসুবিধে কেন হবে? বারিধারা উচ্চারণে তো কোনও ঝামেলা নেই। তোমাকে অনেকবার বলেছি, ছেলেদের আদিখ্যেতা আমি পছন্দ করি না। প্রেমিকার নাম ভেঙে ভেঙে বলবার কী হয়েছে? আমি কি তোমাকে শ বা ব বলে ডাকছি? বলো ডাকছি? একটা মেয়ে হয়ে আমি আহ্লাদিপনা করছি না, তুমি কেন করছ? বেশি প্রেম দেখাচ্ছ?’

‘ওহ এত চটছ কেন? আচ্ছা, বাবা ভুল হয়ে গেছে। এবার থেকে পুরো নাম ধরে ডাকব। বারিধারা, বারিধারা, বারিধারা। হয়েছে? তুমি মাথা ঠান্ডা করো।’

‘আমার মাথা ঠান্ডা না হলে তোমার কী সমস্যা? তুমি তো এখন আমাদের বাড়িতে এসে আমার মাথায় বরফ দেবে না। তাহলে? আগে আমার কথার জবাব দাও। বলো কেন পারবে না? সমস্যা কোথায়?’

‘উফ বারি, সরি বারিধারা তুমি একবার ভেবে বলো। এটা কি সম্ভব?’

‘অবশ্যই সম্ভব।’

‘বলা নেই কওয়া নেই, কীভাবে আমি…বারি, তুমি একবার ঘটনাটা চিন্তা করে দেখো ধারা…সরি বারিধারা…।’

‘ঠিক আছে। বুঝেছি আমার জন্য তুমি সামান্য কাজটা পারবে না।’

‘এটা সামান্য কাজ! এটা সামান্য হল?’

‘সামান্য অসামান্য কিছু জানার দরকার নেই। আমার বোঝা হয়ে গেছে।’

‘ধারা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।’

‘তোমাকে ভুল বুঝলেও তোমার মুরোদ আমার বোঝা হয়ে গেছে শ্রবণ। তোমার হল বিড়ালের মুরোদ। বিড়াল যেমন ম্যাও ম্যাও করে তুমিও তেমনি একবার বারি, একবার ধারা, একবার বারি, একবার ধারা করতে পারো। এতদিন জানতাম আমি একজন মানুষ প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম করছি। এখন দেখছি ভুল জানতাম। আমি একজন বিড়াল প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম করি। আমি ফোন রাখছি। তুমি যদি আমাকে আর কখনও, কোনওভাবে বিরক্ত করতে চেষ্টা করো তোমার বিপদ আছে। তুমি জানো আমি কমলকান্তি সেনের নাতনি, বিমলকান্তি সেনের মেয়ে। কেবলা বড় মেয়ে নয়, সাংঘাতিক ছোট মেয়ে। আমি কাউকে মিথ্যে হুমকি দিই না।’

‘বারি শোনো…ধারা, ফোন কেটো না প্লিজ….ধারা…বারি…।’

বারিধারা মোবাইল সুইচ অফ করে খাটের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ল। আজ ইউনিভার্সিটি না গেলে কেমন হয়?

কী কী কাজ আছে? মনে মনে একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল বারিধারা।

১) দুটো ক্লাস আছে। তার মধ্যে একটা মধুজা রায়ের ক্লাস।

২) লাইব্রেরি থেকে বই তোলবার ব্যাপার আছে।

৩) তিথির হয়ে একটা ছেলেকে চড় মারবার আছে।

তিনটে কাজই গোলমেলে। তবে তুলনামূলকভাবে তিন নম্বরটায় ঝামেলা কম। তিথির ওই ছেলেটার কী যেন নাম? মনে পড়ছে না। থাক মনে পড়তে হবে না। চড় মারবার সঙ্গে নামের কোনও সম্পর্ক নেই। এমন নয় যে কারও নাম রামের বদলে শ্যাম হলে চড়ের কোনও হেরফের হয়। সুতরাং নাম জেনে লাভ কী? তিথির কাছ থেকে চড় মারবার এই দায়িত্ব সে নিয়েছে পরশু দিন। একরকম জোর করেই নিয়েছে। তিথি যখন কাঁদো কাঁদো মুখে ঘটনাটা বলে, বারিধারা অবাক হয়।

‘তুই ঠাসিয়ে একটা চড় মারলি না কেন?’

ত্রিধি আরও কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আমি ওসব পারি না।’

বারিধারা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তাহলে কী পারিস ফিচফিচ করে কাঁদতে?’

তিথি বলল, ‘সেটা আমার মতো মেয়ের জন্য সহজ। দরকার হলে কাঁদব, কিন্তু ওসব পারব না। আমি তো আর তোদের মতো স্মার্ট নই। কলকাতায় থাকি না। মফসসল থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় পড়তে আসি।’

বারিধারা তিথির চিবুকে হাত দিয়ে ভেংচি কেটে বলল, ‘কোথায় পড়তে আসি? স্কুলে? ওসব ন্যাকা কথা একদম বলবি না।’

তিথি বারিধারার হাত ধরে বলল, ‘আমি কোনও রকম সিন ক্রিয়েট করতে পারি না। পারি না বলেই চুপ করে চলে এসেছি।’

বারিধারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এর মধ্যে সিনের কী আছে। ঠাসিয়ে একটা চড় মারবি, ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খাবি, তারপর ক্লাসে চলে যাবি। ফিনিশ।’

তিথি মুখ নামিয়ে বলল, ‘আমি জানি, সেটাই উচিত ছিল। কাল সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।’

বারিধারা একটু ভাবল। তারপর তিথির পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘ঠিক আছে তোকে ভাবতে হবে না। তোদের মতো আতুপুতুদের দ্বারা চড়টড় হবে না। চোখের জলই হবে। তুই আমাকে সুপারি দে।’

তিথি অবাক হয়ে বলল, ‘সুপারি দেব মানে! সুপারি আবার কী?’

বারিধারা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সে কী রে! সুপারি কী জানিস না? ইউনিভার্সিটিতে পড়িস সুপারি জানিস না! হিন্দি মুভিতে তো সুপারির ছড়াছড়ি। যাক, আমাকে ভাড়া কর। যেমন সুপারি কিলার হয়, আমি তেমন হব সুপারি চড়ার। তোর থেকে সুপারি নিয়ে ওই ছেলেকে চড় মেরে আসব।’

তিথি চমকে উঠে বলল, ‘থাক, দরকার নেই। একটা হুজ্জুতি হবে।’

‘অবশ্যই দরকার আছে। তোর ওই ছেলেকে চড় না মারলে, ও এরকম ঘটনা আরও ঘটাবে। এরা চড় খেলে চুপ করে যায়। হুজ্জুতির ভয় পাস না।’

তিথি নার্ভাস গলায় বলল, ‘বারিধারা, ইউনিভার্সিটিতে জানাজানি হয়ে যাবে।’

বারিধারা চোখ কটমট করে বলল, ‘বোকার মতো কথা বলিস না। জানাজানি হলে হবে। আচ্ছা, ঠিক আছে আড়ালে ডেকে মারব। আজ তো আর হল না, কালও হবে না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব। শ্রবণের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। পরশু মারব। তুই মাথা ঘামাস না।’

সেই ‘পরশু’ই হল আজ। চড় মারবার দিন। দিনটা কি পিছোনো যায়? তালিকার দু নম্বরেও সমস্যা আছে। বইয়ের ব্যাপারটাও ঝামেলায় ফেলবে। না তোলা হলে অন্য কাউকে ইস্যু করে ফেলবে। তার মধ্যে একটা লেখাপড়ার বই, অন্যটা গল্প-উপন্যাসের। লেখাপড়ার বইটা হল দার্শনিক নিৎসজের ‘দাস স্পেক জারাথ্রুসত্রা’ আর উপন্যাস হল জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির ‘নরউইগিয়ান উডস’। মুরাকামির এই উপন্যাসের বিরাট চাহিদা। লাইব্রেরিতে পড়তে পারছে না। বইটা যখন আনবার জন্য বলা হল, লাইব্রেরিয়ান ‘অসিতদা’ অবাক হয়েছিল।

‘এটা কী!’

‘বই।’

‘বই তো বুঝেছি। লাইব্রেরিতে আনতে বলছ যখন, তখন তো আর মোবাইল ফোন বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ হবে না, বই-ই হবে। কীসের বই সেটা, জানতে পারি? ফিলসফি? হিস্ট্রি?’

‘না, গল্পের বই। নভেল।’

‘অসিতদা’ বলল, ‘এই বইয়ের লেখক কে?’

‘কী বলছ অসিতদা। মুরাকামি কে! পৃথিবীর জীবিত পপুলার লেখকদের মধ্যে অন্যতম। এখন নাম্বার ওয়ানও বলা যায়। অ্যালিস মনরো, মারিও ভার্গাস লোসা, মোদিয়ানা, মো-ইয়াং-রাও-এর মতো লেখকরাও মুরাকামির জনপ্রিয়তার ধারেকাছে আসে না। ‘নরউইগিয়ান উডস’ বইটা জাপানে সবার বাড়িতে আছে। এই বইয়ের নামটা বিটলসের বিখ্যাত গানের লাইন। বাংলায় অনেক লেখক যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন দিয়ে গল্প উপন্যাসের নামকরণ করে, সেরকম। বিটলস কী জানো তো? গানের দল।’

সেই বই লাইব্রেরিতে ঢোকবার পর কাড়াকাড়ি চলছে। বইটার এমন কিছু দাম নয়। ইচ্ছে করলে কিনে নেওয়া যায়। ডাউনলোড করে ই-বুক হিসেবেও পড়া যায়। কিন্তু লাইব্রেরিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে সবার ওদিকেই নজর। তার ওপর বইটা কদিনের জন্য দখলে রাখাও একটা তৃপ্তি। বেশ ব্যাগে ব্যাগে ঘুরবে। ভালো বই ব্যাগে থাকলে মন ভালো থাকে।

আজ লাইব্রেরিতে নিৎসজে, মুরাকামি দুজনেরই থাকবার কথা। না গেলে মিস। আচ্ছা, তাও না হয় হল। ক’দিন পরে আবার বই আসবে। কিন্তু মধুজা রায়ের ক্লাস?

মধুজা ম্যাডাম দুদিন ইউনিভার্সিটিতে আসেন। বাকি দিনগুলো তিনি খুবই ব্যস্ত থাকেন। সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সিলেবাস কমিটির মিটিং, সিলেকশন কমিটির ইন্টারভিউ, গবেষণা কমিটির স্ক্রুটিনি, ট্রান্সফার কমিটির ঝাড়াইবাছাই—সবে থাকতে হয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে আসবেন কখন? সময় কই? এর সঙ্গে আবার নিয়মিত শিক্ষাবিদদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে প্রণাম করা এবং আশীর্বাদ নেওয়ার ব্যাপার আছে। সবার বাড়িতে নয়, ‘ফোন ধরা শিক্ষাবিদ’দের বাড়ি। ‘ফোন ধরা শিক্ষাবিদ’ মানে যাদের ফোন নেতা, মন্ত্রী, আমলা, উপাচার্যরা ধরে। চারটে অনুরোধ করলে তারা দুটো শোনে। তিনটে কমিটির কথা বললে একটায় নাম ঢুকিয়ে দেয়। কমিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। নামের পাশে যত কমিটি, তত ব্যস্ততা, তত দাপট। মধুজা ম্যাডাম এত দাপট এবং ব্যস্ততার মধ্যে যে দুদিন সময় করে ইউনিভার্সিটিতে আসেন, তাই অনেক। দু দিনের মধ্যে একদিন টিচার্স রুমে বসে বিশ্রাম নেন। নিতেই হবে। এত কমিটিতে থাকলে বিশ্রাম লাগে। ক্লাস করবার সময় পান মোটে একদিন। এই ক্লাস মিস করলে মুশকিল। তবু আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।

মণিকুন্তলা ঘরে ঢুকলেন।

মণিকুন্তলা তিনতলায় এলেও ছোট মেয়ের ঘরে ঢুকতে চান না। তার কারণ, এই মেয়ের কাছে বেশিক্ষণ থাকলেই তার প্রেসার বেড়ে যায়। তার পরেও কেন জানি বার বার আসেন।

তার মানে এই নয়, তিনি মেয়েকে ভালোবাসেন না। খুবই ভালোবাসেন। তার পরেও এই অবস্থা। আসলে বারিধারার সঙ্গে একটুক্ষণ কথা বলবার পরই কোনও না-কোনও ইস্যুতে তার ঝগড়া লেগে যায়। মেয়ের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা তিনি সহ্য করতে পারেন না। তার ওপর নানা ধরনের দুষ্টুবুদ্ধি। লেখাপড়ায় বাড়াবাড়ি ধরনের ভালো হলেও এই মেয়ে তার বড় মেয়ের মতো শান্তশিষ্ট নয়, ভদ্র-সভ্যও নয়। এই মেয়ের সবথেকে খারাপ অভ্যেস হল, যা মনে হয় তাই মুখ ফুটে বলে ফেলবে। যা পছন্দ সেটাও বলবে, আবার যা পছন্দ নয় সেটাও বলবে। সভ্য সমাজে এ জিনিস চলে? চলে না। সভ্য সমাজের নিয়মই হল, অপছন্দের কথা সব সময় বলতে নেই। ধারা এই সামান্য সহবতটুকু জানে না। জানে না বললে ভুল হবে, মানে না। জীবনে এই মেয়ে তো পদে পদে হোঁচট খাবে। শ্বশুরবাড়িতে গেলে দু দিন পরেই ঘাড় ধাক্কা। কাজের জায়গাতেও টিকতে পারবে না। অনেক বোঝানো হয়েছে, বকাঝকা হয়েছে। স্থায়ী লাভ হয়নি। ক’দিন সাবধানে থাকে, তারপর আবার যে-কে সেই। উলটে অভিনয় করে আরও গা জ্বালিয়ে দেয়।

‘কী মুশকিল, যা মনে এসেছে তা বলব না! মা তুমি এটা আমাকে কী শিক্ষা দিচ্ছ?’

মণিকুন্তলাদেবী রাগী গলায় বলেন, ‘একটি চড় লাগাব। উনি যেন কত শিক্ষা নিচ্ছেন। ছি ছি, দিদির শাশুড়িকে কেউ ওভাবে বলে? মহিলা নাহয় একটু বেশিই সাজগোজ করে, তা বলে…ছি ছি।’

বারিধারা আকাশ থেকে পড়ল। বলল ‘কী বলেছি! আমি তো গাড়িতে ওঠবার সময় ওকে ভক্তিভরে প্রণাম করতে গেলাম। উনি বললেন, থাক থাক প্রণাম করতে হবে না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব গোল্লায় গেছে। বড়দের মোটে ভক্তিশ্রদ্ধা করে না। এখন প্রণাম করছ, আমি চলে গেলেই বলবে, বুড়িটার জন্য কোমরে হ্যাঁচকা টান লেগে গেল। আমি তখন বললাম, ছি ছি মাসিমা, আপনাকে বুড়ি বলব কেন! আপনি মোটেই বুড়ি নন। আপনাকে দেখতে বুড়ি বুড়ি লাগে। তা বলে কি আপনি সত্যিই বুড়ি? অনেক সময় বাড়াবাড়ি ধরনের সাজগোজ করলে বয়স বেশি লাগে। আপনি কি বাড়াবাড়ি ধরনের সাজগোজ করেছেন? এই কথা শুনে ওর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমি খারাপটা কী বলেছি মা? কেন তুমি আমাকে মিছিমিছি বকছ? আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন করে ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মাসিমা আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি ঠিকই বলেছেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা সব গোল্লায় গেছে। আমিও গোল্লায় গেছি। আমাকে আপনি ক্ষমা করুন।’

মা হয়ে এই মেয়েকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায়? করা উচিত?

মণিকুন্তলা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কীরে ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কেন? দিদি পাচ্ছে না।’

বারিধারা উঠে বসল। দুটো হাত বাড়িয়ে বলল, ‘মা চট করে একটু কাছে এসে তো।’

মণিকুন্তলা থমকে গেলেন। কাছে ডাকছে! নিশ্চয় কোনও দুষ্টু বুদ্ধি আছে। বললেন, ‘কী হয়েছে?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘একটা কথা বলব।’

মণিকুন্তলাদেবী বললেন, ‘বল।’

‘কানে কানে বলব।’

মণিকুন্তলাদেবী সতর্ক হয়ে বললেন, ‘এখান থেকে বল।’

বারিধারা বেচারা মুখ করে বলল, ‘আরে, এ কথা কানে কানে ছাড়া বলা যায় না।’

মণিকুন্তলাদেবী হাসি গোপন করে বললেন, ‘তাহলে বলতে হবে না।’

বারিধারা ঝট করে খাট থেকে নেমে লাফ দিয়ে গিয়ে মাকে জাপটে ধরল। চিৎকার করে বলল, ‘আই লাভ ইউ মামি। আই লাভ ইউ। আমি তোমাকে চুমু খেতে চাই। উমমম…।’

মণিকুন্তলাদেবী বললেন, ‘ছাড়, ছাড় বলছি। এই জন্য তোর ঘরে আসতে চাই না। খালি অসভ্যতা।’

মণিকুন্তলা খুব ভালো করেই জানেন, এই জন্যই তিনি মেয়ের ঘরে বার বার আসতে চান।

তিন

মোস্ট ইনটেলিজেন্ট।

এটা একটা গোপন গবেষণার নাম। সহজ বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় সেরা বুদ্ধিমান এবং সেরা বুদ্ধিমতী। গবেষিকার নাম কুমারী বারিধারা সেন।

সব গবেষণাতেই একজন গাইড থাকে। ‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট’ গবেষণাতেও আছে। গাইডের নাম শ্রীকমলকান্তি সেন। কমলাকান্তি সেন গত চৈত্র মাসের সতেরো বা আঠেরো তারিখ একানব্বই বছরে পা দিয়েছেন। যেহেতু মানুষটার জন্মবিষয়ক কোনও কাগজপত্র নেই এবং সাক্ষী নেই, তারিখ নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তি রয়েছে। সম্প্রতি সেই বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। কিছুদিন আগে এক সকালে কমলকান্তি সেন তাঁর বাঁধানো দাঁতের পাটি যত্ন করে পরে নিয়ে ঘোষণা করলেন।

‘আমার জন্ম চৈত্র মাসে নাও হতে পারে। মাসটা মনে হচ্ছে, ভুল করছি।’

মণিকুন্তলাদেবী কাছাকাছি ছিলেন। শ্বশুরমশাইয়ের ছাতুর সরবতে লেবুর রস মেশাচ্ছিলেন। দুটো গোটা পাতিলেবু। পাতিলেবু হল বার্ধক্য নিরোধক। কমলকান্তি সেন দিন শুরু করেন পাতিলেবু দিয়ে। তার কথায় মণিকুন্তলা আঁতকে উঠলেন।

‘সে কী! এ আপনি কী বলছেন বাবা! এতদিন তো আমরা চৈত্র মাসই জানতাম।’

কমলকান্তি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘এটা কোনও কথা নয় বউমা। মানুষের জানা প্রতি মুহূর্তে বদলায়। এই ধরো, একটা সময় পর্যন্ত আমরা জানতাম, মঙ্গলগ্রহে পৌঁছোনো যায় না। সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন কি আমরা সেই জানাটাই ধরে বসে আছি? না, বসে নেই। অথবা ধরো, আমরা জানতাম, পৃথিবী অনেকটা না হলেও, খানিকটা সভ্য হয়েছে। যতটা সভ্য হয়েছে, তাতে আর যাই ঘটুক, শিশুহত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে না। ক’দিন আগে আমেরিকার স্কুলে যেভাবে ছাত্রদের গুলি করে মারা হল, তার পরেও কি আমাদের সেই জানা বদলায়নি? আজও কি আমরা বলতে পারব, মানুষ বিন্দুমাত্র সভ্য হয়েছে? না, পারব না। এখন জেনেছি, আমরা অতি অসভ্য। পৃথিবীর আদিম মানুষও এত অসভ্য, বর্বর ছিল না। তাই বলছি, কোনও জানা আঁকড়ে পড়ে থেকো না।’

মণিকুন্তলাদেবী শ্বশুরের হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিয়ে আমতা-আমতা করে বললেন, ‘তারিখ এদিকে-ওদিক হতে পারে, তা বলে একেবারে মাসটাই বদলে যাবে বাবা! এটা কি ঠিক হবে?’

কমলকান্তি কৌতুক ভরা গলায় বললেন, ‘ঠিক-বেঠিক কী আছে? ফাল্গুন কি মাস হিসেবে খারাপ?’

মণিকুন্তলাদেবীর সঙ্গে তার শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক সহজ। খুবই সহজ। বাঙালি বাড়িতে এমনটা হয় না। বিয়ের আগেই শাশুড়ির মৃত্যু হয়েছিল। ফলে এ বাড়িতে পা দেওয়ার পর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কমলকান্তি পুত্রবধূর হাতে তুলে দেন। বলেছিলেন, ‘সংসার মানেই ঝামেলা। এ বাড়িতে মনে হয় বেশি ঝামেলা। সবচেয়ে বড় ঝামেলা আমার ছেলে। আমার ধারণা, খুব অল্পদিনের মধ্যে তুমি সুটকেস গুছিয়ে বাপেরবাড়ি ফিরে যাবে। আমি হলে তাই করতাম। তোমার বরের মতো মানুষের সঙ্গে কারও দুটো দিন থাকাও অসম্ভব। যাই হোক, যখন যাবে আমাকে বলে যাবে।’

মণিকুন্তলাদেবী এই কথায় বিরাট ঘাবড়ে যান। নতুন বউকে এ আবার কী কথা! কান্না চেপে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

কমলকান্তি সেন এই কথায় জবাব না দিয়ে বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত তোমাকে বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছে। পরে কী মনে হবে জানি না। আশা করি তুমি ঝামেলা সামলাতে ব্যর্থ হবে।’

বিয়ের এত বছর হয়ে গেল, মণিকুন্তলাদেবী সুইকেস গুছিয়ে যাননি। তিনি এখন মেঘবতী এবং বারিধারা নামে দুই কন্যার মা। একজনের ডাক নাম মেঘ, আরেকজন বৃষ্টি। মেঘবতীর বিয়ে হয়ে গেছে। বারিধারা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে অর্চিন এ বাড়িতে থাকে। সে-ও কলেজে ভর্তি হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মণিকুন্তলাদেবী আজও সঠিকভাবে জানেন না সংসারের ঝামেলা সামলাতে তিনি ব্যর্থ না সফল।

একানব্বই বছরের কমলকান্তি প্রতিদিন সন্ধে সাতটার মধ্যে ডিনার সারেন আর সকাল ছ’টার মধ্যে স্নান করেন। তিনি মনে করেন, রাতের খাবার এবং ভোরের স্নান যত আগে হবে, মানুষের জরা তত পিছিয়ে যাবে। এর মধ্যে ঠান্ডা-গরমের ব্যাপারও আছে। দিনের শেষ খাওয়া হবে গরম, দিনের প্রথম স্নান হবে ঠান্ডা। বাড়ির লোকের দুটোতেই আপত্তি। এই বয়সে গরম খাবার খাদ্যনালি এবং এবং পাকস্থলীর জন্য ঠিক নয়। সকালের স্নান করা উচিত গরম জলে। নইলে যে-কোনও সময় সর্দি-কাশি এবং শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে। একদিন গড়াবেও। কমলকান্তি সেন আপত্তি আমল দেন না। গত তিরিশ বছর ধরেই দেন না। ভোরবেলা স্নান করবার সময় বাথরুম থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

”মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে

জীবন্ত হৃদয়ে স্থান যদি পাই!”

বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর পুত্রের ঠিক উলটো চরিত্রের। বিমলকান্তি বাষট্টি বছরেই নিজেকে বয়স্ক, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ভেবে বসে আছেন। কমলকান্তি একানব্বইতে পৌঁছে মনে করেন, আরও দশ-পনেরো বছর অনায়াসে হেসে-খেলে বাঁচা যায়। তাঁর ছোট নাতনি এই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছে।

‘একটু বয়স হলেই মানুষ ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে, অনেক তো হল, এবার যেতে পারলেই ভালো। অথচ তুমি আরও বাঁচতে চাও। কেন?’

কমলকান্তি সেন বলেন, ‘অনেক কারণ আছে।’

বারিধারা বলে, ‘নিশ্চয় দার্শনিক ধরনের কোনও উত্তর দেবে। আজকাল তোমার মধ্যে ফিলজফি ভাব প্রকট হয়েছে।’

কমলকান্তি বলেন, ‘পুরুষ মানুষ বালক বয়েসে থাকে খেলোয়াড। খালি খেলব খেলব করে। তরুণ বয়সে রোম্যান্টিক। কবি হব, প্রেম করব, বিপ্লব করব। মাঝবয়সে ব্যবসায়ী। কোথা থেকে কতটুকু রোজগার করব সেই সন্ধান। সর্বক্ষণ লাভ-ক্ষতির হিসেব। শেষ বয়েসে হয়ে যায় দার্শনিক। যা দেখেছি তা নয়, যা ভাবছি তা নয়, ভিতরেও আরও কিছু আছে। অন্য কিছু। এমন কিছু, যা দেখাও যায় না, ভাবাও যায় না। এখন আমার সেই পিরিয়ড চলছে রে বৃষ্টি। দার্শনিক পিরিয়ড।

বারিধারা আঁকতে উঠল। বলল, ‘এই রে আবার শুরু হল। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দাও দাদু। এত বয়স হল, তার পরেও তুমি আরও বেঁচে থাকতে চাইছ কেন?’

কমলকান্তি সেনের শরীর-স্বাস্ব্য ভালো। এই বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত ভালো। সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, আর্থরাইটিসের সমস্যা নেই বললেই চলে। আহার, নিদ্রা, বাহার তিনটিই নরমাল। বেশিরভাগ রাতেই ঝরঝরে ঘুম হয়। দিনে পেট পরিষ্কার। কমলকান্তি নিজে বলেন, ‘অল ক্লিয়ার।’ বেলা বাড়লে খিদে খিদে লাগে। এটাও সুলক্ষণ। আর কী চাই? বাঁধানো দাঁত, গোল চশমা আর একটা পাকানো হাতলের পুরোনো শক্ত লাঠি ছাড়া বাইরের কোনও সাহায্যই প্রায় লাগে না। এই বয়সে শরীর ঠিক থাকলেও মনে নানা অসুখ দেখা দেয়। নানা ধরনের বাতিক। বাতিক থেকে সন্দেহ। সন্দেহ থেকে বিষণ্ণতা। কমলকান্তি সেনের মাথা এ সব থেকে মুক্ত। গৃহ চিকিৎসক ডাক্তার মুখার্জি বলেছেন, ‘ব্রেন সেলের অবস্থা এখনও ঠিক আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঘটনা এক্সসেপশনাল তবে ইমপসিবল নয়।’ এই বিষয়ে কমলকান্তি সেনের থিওরি আলাদা।

‘সবাই মনে করে স্মরণশক্তিই মানুষের আসল ক্ষমতা। কথাটা মোটেই ঠিক নয়। স্মরণের সঙ্গে বিস্মরণও চাই। অনেক কিছু মনে যেমন রাখতে হবে, তেমন ভুলেও যেতে হবে বহু কিছু। নইলে ব্রেনে চাপ পড়ে। সুখ, দু:খ, টেনশনে সেল ক্ষইতে থাকে। আমি মনে রাখবার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়ার ক্ষমটাও রপ্ত করে ফেলেছি। মস্তিষ্কে তাই ঝামেলা কম।’

ডাক্তার মুখার্জি মাথা নাড়েন। বলেন, ‘হতে পারে…হতে পারে। শরীর, মনের বহু রহস্য তো আজও সলভ করা যায়নি।’

এই বয়েসে সমস্যা হওয়ার কথা কানেও। ফ্লুইড শুকিয়ে আসে। মানুষ হয় কম শোনে, নাহয় ভুল শোনে। যন্ত্র লাগাতে হয়। কমলকান্তি সেনের সেই ঝামেলাও নেই। তার শ্রবণক্ষমতা তীক্ষ্ণ। দূরের হালকা আওয়াজও শুনতে পান। বলেন, ‘বেঁচে থাকাটা বড় কথা নয়। কীভাবে বেঁচে আছি সেটা বড় কথা। আনন্দে বেঁচে থাকলে চোখ, হার্ট, কান, মাথা সব আনন্দে থাকবে। মনমরা হলে সব মনমরা।’

ডাক্তার মুখার্জি এবারও বলেন, ‘হতে পারে…হতে পারে।’ চশমার ফাঁক দিয়ে নাতনির দিক পিটপিট করে খানিকটা তাকিয়ে কমলকান্তি সেন বললেন, ‘শুনবি, কেন আমি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই?’

‘শুনব বলেই তো জিগ্যেস করেছি।’

কমলকান্তি একটু চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলেমানুষের মতো লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘আসলে আরও কয়েকটা রোববার কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে দুপুরে ভাত খেতে চাই রে বৃষ্টি। দু-এক টুকরো মাংসের পিস, একটা বড় আলু, ঝোলে কাঁচালঙ্কার ঝাল। আহা! তারপর টেনে ঘণ্টা দুয়েক ঘুম। জীবনে আর কী চাই? ওপরে গেলে কি এই সিস্টেম পাব? ওখানে রোববার দুপুরে পাঁঠার মাংস দেয়? মনে হয় না। হয়তো বলবে, এখানে এসব চলে না। নীচে যা অনাচার করবার করে এসেছেন। এখন দুধ-খই সোনামুখ করে খেয়ে নিন। রোববার দুপুরে পাঁঠার মাংসের ঝোল আর ভাতঘুম আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকবার জন্য কি এনাফ রিজন নয়? তুই কি বলিস বৃষ্টি?’

বারিধারা একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। ভুরু কুঁচকে বলে, ‘ক’বছর চাইছ?’

কমলকান্তি একটু ভাবেন। বলেন, ‘বেশি নয়, এখন তো নাইটি ওয়ান চলছে। এই ধর আরও বছর দশ-বারো।’

বারিধারা চোখ বড় করে বলল, ‘তার মানে ইউ আর এক্সপেক্টটিং মোর দ্যান ওয়ান হ্যান্ড্রেড?’

কমলকান্তি সেন মাথা দুলিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি তো আর একটু বেশি বলতে চেয়েছিলাম। ঘাবড়ে যাবি বলে বললাম না।’

বারিধারা তার দাদুর ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘দাদু তুমি কি চাইনিজ ওরিজিন? মানে তোমার পূর্বপুরুষরা কেউ চীন দেশের মানুষ ছিলেন?’

‘হতে পারে। কেন বল তো?’

বারিধারা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘চীনারা অনেকদিন বাঁচে। ক’দিন আগেই নেটে দেখলাম, একজন একশো আটাশ বছর পর্যন্ত বেঁচে রেকর্ড করেছেন। গোয়াং জি প্রদেশে বাড়ি। নাম লিও মেজহিয়ান।’

কমলকান্তি সেন চোখ জ্বল জ্বল করে বললেন, ‘তাহলে তুই বল বৃষ্টি, আমি কী এমন বেশি বলেছি? সত্যি কথা বলতে কী, মনে মনে আমার তেমনই ইচ্ছে। পনেরো-কুড়ির একটা টার্গেট আছে। পাছে তুই ঘাবড়ে যাস তাই বলিনি। কমিয়ে বললাম।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘খুব ভালো। এখন থেকে তোমাকে কমলকান্তি সেনের বদলে কমলকান্তি মেজহিয়ান বলে ডাকব। তুমি চপস্টিক দিয়ে খাওয়াদাওয়া শুরু করো। তবে চীনে কি রোববার দুপুরে মাংসের ঝোল খেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার নিয়ম আছে? দাঁড়াও, নেট দেখতে হবে। আমরা হলাম নেটান। নেটে দেখে বিদ্বান।’

এই কমলকান্তি সেনই নাতনিকে ‘মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট’ গবেষণার আইডিয়া দিয়েছেন। নাম শুনে মনে হবে, সেরা বুদ্ধিমান এবং সেরা বুদ্ধিমতী বিষয়ক গবেষণা। ঘটনা কিন্তু মোটেই তা নয়।

‘এই গবেষণা করে কী লাভ হবে দাদু?’

‘নিজেকে বুঝতে পারবি।’

‘কী বুঝব?’

‘বুঝবি, লেখাপড়ার পরীক্ষায় যতই ফার্স্ট হোস, আসলে তুই একটা বোকা। গবেষণা যত এগোবে, তত নিজের বোকামির মাত্রা ধরতে পারবি। এটা একটা ভালো ব্যাপার নয়?’

বারিধারা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই ভালো ব্যাপার। নিজে কতটা বুদ্ধি রাখি এটা মোটামুটি বোঝা হয়ে গেছে। এবার কতটা বোকা, দেখতে হবে। থার্মোমিটারের মতো আমার এই রির্সাচ হবে বোকামিটার। আচ্ছা, রিসার্চ পেপারের নাম কী রাখব?’

কমলকান্তি আবার চুপ করে রইলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, বোকার উলটো কিছু রাখি যদি? ধর…ধর বুদ্ধি…না না…আচ্ছা ইনটেলিজেন্ট রাখলে কেমন হয়? মোস্ট ইনটেলিজেন্ট।’

বারিধারা হাততালি দিয়ে বলল, ‘দারুণ হয়। গবেষণায় বোকাদের নামের তালিকা তৈরি করব, অথচ নাম হবে মোস্ট ইনটেলিজেন্ট। ইউ আর গ্রেট ডার্লিং। আমি আজই কম্পিউটরে ফাইল খুলে ফেলছি।’

কমলকান্তি সেন উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করে বললেন, ‘খুলে ফেল। লিস্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাক আজ থেকেই। বৃষ্টি দেখবি, গবেষণা কেমন বারে বারে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। একরকম ভাবে এগোচ্ছিস, হয়ে যাবে আরেকরকম। এটাই মজা। যাকে কাল বোকা ভেবেছিলি, আজ দেখবি সে কেমন বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। আজ যাকে বুদ্ধিমান ভেবে লিস্টে নাম তুলবি, কাল দেখবি ব্যাটা বিরাট গাধা। কালকের মার্কসিস্ট আজ হাতে পাথর পরে ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম ঠুকছে। বিজ্ঞানী কুসংস্কারে বিশ্বাস করছে। ল্যাবরেটরিতে ঢোকবার আগে বাঁ পা বাড়াচ্ছে। কোনও বিপ্লবীকে দেখবি চরম রাইটিস্টকে বামপন্থী ভেবে জড়িয়ে ধরছে। আবার উলটোটাও পাবি। কুঁকড়ে-মুঁকড়ে থাকা কোনও বোকাকে দেখবি একদিন হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠান্ডা মাথায় বিপদ থেকে কাউকে রক্ষা করে তোকে চমকে দিয়েছে! পরীক্ষায় গোল্লা পাওয়ায় যাকে এতদিন বোকা ভেবেছিস, সে-ই দেখবি ফুটবল ম্যাচে প্যাঁচ কষে গোল দিয়ে এসেছে। দেখবি ভাবনাচিন্তা সব গোল পাকিয়ে যাবে। যাকে এক নম্বর বোকা ভেবেছিলি, সে দেখবি সাত নম্বরে চলে গেছে। জানতেও পারবি না। প্রতিদিন বুঝতে পারবি, নিজের বিচারবুদ্ধি কত ভুল! কত বোকা! কাকে বুদ্ধি বলে তাই নিয়েই ধন্দে পড়বি।’

বারিধারা মুগ্ধ গলায় বলল, ‘ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল! দাদু কার নাম দিয়ে গবেষণায় কাজ শুরু করব?’

কমলকান্তি সেন হাত বাড়িয়ে নাতনির মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে হেসে বললেন, ‘নিজের নাম দিয়ে। দুনিয়ায় নিজের থেকে বড় বোকা আর কে আছে?’

‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট’ গবেষণার লিস্টে প্রথম নাম রয়েছে বারিধারা সেন। দ্বিতীয় নাম মেঘবতী চৌধুরী। এ বাড়ির বড় মেয়ে। বারিধারার থেকে ছয় বছরের বড়। বিয়ে হয়েছে তিন বছর। সে-ই এখন তার বোনকে ফোন করেছে। অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে। বারিধারার মোবাইল বন্ধ। বাধ্য হয়ে সে তার মাকে ফোন করেছে। মেঘবতী মাকে ফোন করতে চায়নি। মায়ের সঙ্গে তার ঝগড়া চলছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, আর কোনও দিনই সে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে না। প্রতিজ্ঞা শুনে বারিধারা বলেছে, ‘এতদিনে একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলি। আমি তোকে সাপোর্ট করছি। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টে তোর নাম দু’নম্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।’

মেঘবতী অবাক হয়ে বলল, ‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্ট! সেটা কী?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘এক ধরনের তেল। মাথায় মাখলে বুদ্ধি বাড়ে।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের আদর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এখন আহ্লাদ করছে, এক্ষুনি ঝামেলা শুরু করবে। তার থেকে ভালোয় ভালোয় বিদায় নেওয়াই ভালো। বারিধারা আবার ধপাস করে বিছানায় পড়ল। নিজের মোবাইল চালু করে দিদির নম্বর টিপল।

‘দিদি, বল।’

মেঘবতী চুপ করে রইল।

বারিধারা বলল, ‘কী হল! কথা বলবি তো।’

মেঘবতী ফোনের মধ্যেই ‘ভেউ ভেউ’ করে কেঁদে উঠল।

চার

হাসি সহজ বিষয়, কিন্তু কান্না সহজ বিষয় নয়। কান্না জটিল বিষয়। মানুষ কেন হাসে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। মানুষ হাসে মূলত তিনটি কারণে। খুশিতে, উন্মাদ হলে এবং বানিয়ে। কিন্তু মানুষ কেন কাঁদে সে প্রশ্নের উত্তর চট করে বলা যায় না। একটা কান্নার পিছনে অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। জটিল বিষয় হল, কান্নার কারণ অধিকাংশই পরস্পরবিরোধী। মানুষ যেমন দু:খে কাঁদতে পারে, আবার আনন্দেও কাঁদতে পারে। প্রেমে কাঁদে, বিরহে কাঁদে। মারধর খেলে কাঁদে, আদর পেলে কাঁদে। অনেক সময় দেখা যায় দুম করে অনেকটা টাকাপয়সা পেয়ে মানুষ কাঁদছে। হঠাৎ করে নি:সন্তান, অকৃতদার ছোটমামার সম্পত্তি বা লটারি পেলে এমনটা হয়। একে বলে ‘গদগদ কান্না’। আবার ধনদৌলত চলে গেলে কাঁদে। টাকার শোক। মানুষ ঈশ্বরের কাছে কাঁদে। বলে, ‘ঠাকুর, আমাকে দাও, দাও, আরও দাও। যশ, অর্থ, যৌবন, আয়ু তোমার স্টকে যা আছে সব দিয়ে দাও ঠাকুর। আর ক’টা দিনই বা বাঁচব? ভোগ করব আর ক’টা দিন? সুতরাং দেরি না করে দিয়ে দাও।’ একই মানুষ শয়তানের কাছে কাঁদে। কেঁদে বলে, ‘আমার ওপর নজর দিও না প্লিজ। তোমার ঘোড়ার খুরের মতো দুটি পায়ে পড়ি। আর কিছুদিন এই পোড়া পৃথিবীটাকে ভোগ করে যেতে দাও।’ মানুষ ধনীর কাছে ভিক্ষুক সেজে কাঁদে। ভিক্ষুকের কাছে ধনী সেজে কাঁদে। বছরের একদিন গরিবকে লোটাকম্বল বিলির সময় ধনী মানুষকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চোখ খামচে কাঁদতে হয়। সম্ভবত শাস্ত্রে এরকমই নিয়ম। গরিব মানুষকে দানধ্যানের সময় চোখের জল ফেলতে হয়। নইলে পুণ্যি ফুলপ্রুফ হয় না। ফাঁক থেকে যায়। ফাঁক দিয়ে পাপ ঢুকে পড়ে।

এই জন্যই কান্নার কারণ সহজে ধরা মুশকিল।

বারিধারা কিন্তু তার দিদির কান্নার কারণ ধরতে পারে। এই যে মেঘবতী টেলিফোনে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে, বারিধারা তার কারণ বলে দিতে পারে। নো কারণ। কাঁদবার মতো উপযুক্ত কোনও কারণ ছাড়াই তার দিদি সুন্দর কাঁদতে পারে। মেঘবতী যদিও একটা দুর্বল যুক্তি দেখায়। সেটা এত তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর, হাস্যকর যে কেউ মানে না। আগে রেগেও যেত। বকাবকি করত। কখনও বলা হত নেকা, কখনও ছিঁচকাদুনে। এখন সবার অভ্যেস হয়ে গেছে। মেঘবতীর কান্না এখন ইগনোর করা হয়। ছোটবেলা থেকেই বারিধারা এই জিনিসই দেখে আসছে। তবে একটা নিশ্চিন্তির ব্যাপার হল, দিদির কান্না দ্রুত থেমে যায়। এক পশলা বৃষ্টির মতো। মাটি ভেজার আগেই শেষ। মণিকুন্তলাদেবী বড় মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।

‘এরকম করে না সোনা।’

মেঘবতী ছোট মাথা কাত করে বলত, ‘কেন? করলে কী হবে?’

‘রাখল বালকের গল্পের মতো হয়ে যাবে।’

ছোটবেলা থেকে মেঘবতীর চোখ বড়। সেই চোখ আরও বড় করে সে বলত, ‘সেটা কী গল্প মা?’

মণিকুন্তলাদেবী গুছিয়ে গল্প শুরু করতেন। তাঁর আশা হত, গল্প শুনে মেয়ে নিজেকে শুধরোবে।

‘এক গ্রামে একটা রাখাল বালক ছিল। মাঠে ভেড়া চড়াতে যেত আর মিথ্যে মিথ্যে চিৎকার করত…বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে…আমাদের বাঁচাও…বাঘ আমার সব ভেড়া নিয়ে গেল। চিৎকার শুনে গাঁয়ের লোকেরা লাঠিসোটা নিয়ে রে-রে বলে ছুটে আসত। এসে দেখত, কোনও বাঘ নেই! তারা রাখাল বালককে গালি দিতে দিতে ফিরে যেত। পরদিন রাখাল বালক আবার মিথ্যে করে চেঁচাতে লাগল…বাঘ এসেছে…বাঘ এসেছে। একদিন কিন্তু সত্যি সত্যি বাঘ এল…রাখাল বালকও চিৎকার করতে লাগল…বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে…কিন্তু সবাই ভাবল মিথ্যে…কেউ আর এল না…বাঘও ভেড়ার ঘাড় মটকে দিয়ে গেল।’

মেঘবতী বলল, ‘ইস! খুব খারাপ হল।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘হ্যাঁ সোনা, খুব খারাপ হল। তোমারও কিন্তু রাখাল বালকের মতো অবস্থা হবে মেঘ। যেদিন তুমি সত্যি সত্যি কাঁদবে, কেউ তোমার কাছে আসবে না। বলবে, মেঘবতীর কাছে গিয়ে কী হবে? ও তো কারণ ছাড়াই কাঁদে। তুমি কি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

মেঘবতী ঘাড় কাত করে বলে, ‘হ্যাঁ মা, বুঝতে পেরেছি।’

‘তাহলে তুমি আর কখনও এমনি-এমনি কাঁদবে না তো?’

মেঘবতী চুলের ঝুঁটি নাড়িয়ে বলে, ‘না মা। এমনি এমনি কাঁদব না।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের গালে চুমু খান। বলেন, ‘আমার লক্ষ্মী মেয়ে। আমার হিরের টুকরো মেয়ে।’ তারপর নিশ্চিন্ত মনে কাজে চলে যান। ছোট্ট মেঘবতী খেলনা ছড়িয়ে বারান্দায় রান্নাবাটি খেলতে বসে এবং একটু পরেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। মণিকুন্তলাদেবী ছুটে আসেন।

‘কী হল? কী হল মেঘ। কাঁদছ কেন?’

মেঘবতী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, আমার ওই ভেড়াটার জন্য মন কেমন করছে?’

মণিকুন্তলা একটু আগের গল্প ভুলে গেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘ভেড়া! কোন ভেড়া?’

মেঘবতী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘যাকে বাঘ ঘাড় মটকে নিয়ে গেল, সেই ভেড়াটার জন্য।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের গালে চড় বসালেন। মেঘবতীর একটা গুণ ছিল। সে ছোটবেলায় মারধর বা বকাঝকায় কখনও কান্নাকাটি করেনি। থম মেরে গেছে, ঠোঁট ফুলিয়েছে, কিন্তু চোখের জল ফেলেনি। মান-অভিমানেও আর পাঁচজন মেয়ের মতো ‘ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ’ করা তার ধাতে নেই। এই স্বভাব এখনও আছে। বড় কোনও বিপদ বা দু:সংবাদে হাত-পা ছড়িয়ে ‘আগে তো খানিকটা কেঁদে নিই’ গোছের অভ্যেস তার নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এসব ব্যাপারে সে অবশ্যই শক্ত মনের। আসলে জেনুইন কারণে কান্নাকাটি মেঘবতীর পোষায় না।

দিদির কান্না শুনতে শুনতে বারিধারা পাশে রাখা প্যাকেট থেকে পোটাটো চিপস খেতে লাগল। সে রোজ প্রতিজ্ঞা করে, আজই শেষ। কাল থেকে চিপস ছোঁবে না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। বাড়িতে ঢোকবার সময় দোকান থেকে প্যাকেট নিয়ে ঢোকে। মনকে বোঝায়, কাল থেকে আর নয়। পরদিন মন বিশ্বাসঘাতকতা করে। আগের দিনের প্রতিজ্ঞা ভুলিয়ে দেয়। শুধু চিপস নয়, সবরকম জ্যাঙ্ক ফুডের প্রতি বারিধারার দুর্নিবার আকর্ষণ। বন্ধুরা বারণ করে।

‘এভাবে যা খুশি খাস না বারি। মোটা হয়ে যাবি। এই ছিপছিপে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে।’

বারিধারা গম্ভীরভাবে বলে, ‘আমার একটু মোটা হওয়ার দরকার ত্রিধি।’

ত্রিধি অবাক হয়ে বলে, ‘মোটা হওয়ার দরকার। মানে? কী আবোলতাবোল বকছিস? তোর মতো চেহারার জন্য আমরা হেদিয়ে মরছি। ডায়েট, জিম কী না করছি? আর তুই বলছিস মোটা হবি!’

বারিধারা আরও গম্ভীর মুখে বলে, ‘তোর চেনাজানা কোনও জিম আছে ত্রিধি? মাসখানেকের মধ্যে মোটা করে দেবে? আছে চেনা?’

‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল বারি? তুই মোটা হওয়ার জিম খুঁজছিস? তোর সব কিছুই উলটোপালটা।’

বারিধারা ত্রিধির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কিছুই উলটোপালটা নয়। তুই আগে ঘটনাটা শোন, তাহলেই সব বুঝতে পারবি। পরশু মুম্বাই থেকে একটা মেল পেয়েছি। আমিরকাকুর মেল। আমিরকাকু কে বল তো? আমির খান। আমির খানকে চিনিস তো? ওর নেক্সট সিনেমায় আমাকে হিরোইন করতে চাইছেন। ফেসবুকে আমার ফটো দেখে পাগল। বলেছেন, তোমার চোখ মুখ নাক চিবুক এভরিথিং অলরাইট। শুধু খানিকটা ওয়েট গেইন করতে হবে। আমার হিরোইন মোটা।’

ত্রিধি হেসে বলল, ‘গুল থামা। আর নিতে পারছি না।’

বারিধারা ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলে বলল, ‘জানিস তো আমির খানের সিনেমা মানেই সুপার ডুপার হিট। সেখান থেকে নতুন ট্রেন্ড সেট হবে। তখন একটার পর একটা সিনেমা তৈরি হবে মোটা হিরোইন নিয়ে। তারা ট্যুইট করে মোটা হওয়ার টিপস দেবে। যাকে বলে সৌন্দর্যের গোপন রহস্য। কেউ বলবে, আমি দুপুরে পেটপুরে ভাত ঘি খেয়ে ঘুম লাগাই। কেউ বলবে, টিফিনে দুটো আস্ত আলু সিদ্ধ না খেলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কেউ বলবে চিপস চকোলেট আইসক্রিম না থাকলে আমি পার্টিতে যাই না। সব মেয়েরা তখন মোটা হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দেখবি কী কাণ্ড হয়! একটু থেমে কাতর গলায় বারিধারা বলল, ‘প্লিজ ত্রিধি, আমাকে একটা মোটা হওয়ার জিম খুঁজে দে। এক মাসের মধ্যে মোটা না হতে পারলে আমিরকাকু খুব বকাবকি করবে। চল, আগে ফুচকা খেয়ে আসি।’

এ সব ঠাট্টা-ইয়ার্কি করলেও বারিধারা জানে, হাবিজাবি খাবার অভ্যেস তাকে ছাড়তে হবে। আজ তার চেহারা ছিপছপে ঠিকই, কিন্তু সে চেহারা নষ্ট হতে কতদিন? শুধু সুন্দর হওয়ার ব্যাপার নয়, অসুখবিসুখও আছে। তবে চারপাশে এত রোগা হওয়ার ধুম দেখে বিশ্রী লাগে। শুধুমাত্র রোগা হওয়ার জন্য কত আয়োজন! কত হইচই! পেট ভরে খাব না, বেলা করে ঘুমোব না। সুযোগ পেলেই লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে ঘাম ঝরাব। বাপরে! এত স্যাকরিফাইজ আর পরিশ্রম দেখে অবাক হতে হয়। বারিধারার কখনও কখনও মনে হয়, এই পরিশ্রম, স্যাকরিফাইজের দশ ভাগের এক ভাগও যদি দেশের অসুখে আর অপুষ্টিতে থাকা মেয়েদের জন্য দেওয়া হত…। পরক্ষণেই মনে হয়, এ সব ছেলেমানুষি ভাবনা।

বারিধারা এখন যে চিপস খাচ্ছে, তার সঙ্গে মোটা-রোগার কোনও সম্পর্ক নেই। সে দিদির টেলিফোনিক কান্না থামার জন্য অপেক্ষা করছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কান্না থামিয়ে মেঘবতী কথা বলল।

‘বৃষ্টি, শুনতে পাচ্ছিস?’

বারিধারা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। ডান হাঁটুর ওপর বাঁ পা দিয়ে নাড়াচ্ছে। নাড়াতে নাড়াতেই বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।’

মেঘবতী খানিকটা ধমকের গলাতে বলল, ‘তাহলে চুপ করে আছিস কেন?’

বারিধারা মুখে চিপসের কচমচে আওয়াজ করে বলল, ‘চুপ করে থাকব না তো কী করব? তোর কান্নার সঙ্গে পোঁ ধরব? কান্না কোনও নহবতখানার সঙ্গীত নয় যে, সঙ্গে সানাই বাজাতে হবে।’

মেঘবতী একটু চুপ করে রইল। বলল, ‘তুই কী করছিস?’

বারিধারা নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘পোটাটো চিপস খাচ্ছি।’

‘অ্যাঁ, চিপস খাচ্ছিস! আমি কাঁদছি আর তুই চিপস খাচ্ছিস।’

বারিধারা ফের কচরমচর আওয়াজ তুলে বলল, ‘তাতে তোর কী সমস্যা দিদি? তোর কান্নাকাটিতে বিঘ্ন ঘটছে?’

মেঘবতী উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তা বলে আমার কান্নার সময় তুই খাওয়াদাওয়া করবি! একটা কোনও সিমপ্যাথি থাকবে না? একবার বলবি না, আহারে দিদি, তুই কাঁদছিস কেন? আমি তোদের কেউ নই? আমার জন্য তোদের কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। আমি হাসি, কাঁদি, খাবি খাই, তাতে তোদের কিছু এসে যায় না?’

উত্তেজনা কমলে বারিধারা আহ্লাদি ধরনের গলায় বলল, ‘আহারে দিদি, তুই কাঁদছিস কেন?’

টেলিফোনের ওপাশে মেঘবতী খানিকটা চুপ করে রইল। গজগজ করে বলল, ‘কী হবে শুনে?’

বারিধারা নির্বিকার গলায় বলল, ‘কিছু হবে না। তার পরেও যদি বলতে চাস বলতে পারিস। আমার ধারণা, তুই আজ কোনও গুরত্বপূর্ণ কারণে কান্নাকাটি করছিস। মনে হচ্ছে, তুই মাছের ঝোলে আজ বেশি নুন দিয়ে ফেলেছিস। জ্যোতিষ্কদা খেতে বসে রেখে আগুন হয়ে গেছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছে। অফিস যাবার আগে ঘোষণা করেছে, অনেক হয়েছে, আর নয়, এবার তোকে ডিভোর্স করবে। ঠিক বলেছি?’

মেঘবতী গম্ভীর গলায় বলল, ‘ফাজলামি করছিস? ছ’বছরের বড় দিদির সঙ্গে ফাজলামি করছিস?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘সরি দিদি। কান ধরছি। এখন থেকে বাবার মতো সিরিয়াস হয়ে গেলাম। ড্যাম সিরিয়াস। এবার বল কী হয়েছে।’

মেঘবতী একটু চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোর জামাইবাবু একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড করেছে। আজ সকালে রাস্তা থেকে একটা ভিখিরিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।’

বারিধারা ধড়ফড় করে উঠে বসল। বড় হয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, মায়ের রাখাল বালকের গল্পটা ঠিক ছিল না। দিদির সঙ্গে যায় না। গল্পের বালক ‘বাঘ এসেছে’, বলে মিথ্যে কথা বলেছিল। দিদি সহজে মিথ্যে বলে না। সেই কারণেই বোকার তালিকায় তাকে দু’নম্বরে রাখা হয়েছে। যে মানুষ মিথ্যে বলে না, সে একজন উচ্চমানের বোকা ছাড়া আর কী? ছোটবেলা থেকেই মিথ্যে না-বলার বোকামি করে আসছে দিদি। এর জন্য তাকে কম হেনস্থা হতে হয়নি। স্কুলে এবং বাড়িতে অহরহ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। নিজের দুষ্টুমিজনিত অপরাধ কখনোই সে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারত না। চুপ করে থাকত, কিন্তু মিথ্যে বলত না। স্বীকারও করে ফেলত। গুরুজনেরা তখন বকাঝকা, কান মলা, ঝুঁটি নাড়ার জন্য ‘রে-রে’ করে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেই দুর্যোগে বড় নাতনিকে বাঁচাতেন কমলকান্তি সেন।

‘যে মিথ্যে বলছে না তাকে তোমরা বকাবকি করো কোন মুখে?’

মণিকুন্তলাদেবী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘মিথ্যে বলে না বলে সব অপরাধ মাপ করে দিতে হবে। এটা আপনি কী বলছেন বাবা! অত সুন্দর ফুলদানিটা কীভাবে ভেঙে গেছে, সেটা একবার দেখবেন না? এত হুটোপাটি করলে চলে? এরা তো বাড়ির সব ভালো জিনিস নষ্ট করে ফেলবে।’

কমলকান্তি ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘সত্যি বলবার মতো ভালো জিনিস যে বাড়িতে আছে, সে বাড়ির আর দু-চারটে ভালো জিনিস ভেঙে গেলে সমস্যা নেই। বউমা, তুমি মাথা ঘামিও না। মেঘকে আমি শাসন করে দেব।’

কমলকান্তি সেন খুশি হলেও, দিদির সত্যি কথা নিয়ে বারিধারা একেবারেই খুশি ছিল না। বিরক্ত ছিল। রাগও করত। বহু জায়গায় দিদি মিথ্যে বলতে পারেনি বলে তাকেও বিপদে পড়তে হয়েছে। সেই কারণে যেসব গর্হিত কাজে ধরা পড়বার চান্স ছিল, সেগুলো সে দিদিকে বলতে পারত না।

‘এই ভরদুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘পড়তে। মানির বাড়িতে গিয়ে জিওমেট্রি করব।’

‘সে কী রে বৃষ্টি! এই যে কাল বললি মানিরা সাউথে বেড়াতে গেছে। বললি না?’

‘বলেছিলাম বুঝি? ঠিকই বলেছি। বেড়াতে গেছে তো কী হয়েছে? ফিরে এসেছে। বেড়াতে গেলে কেউ ফেরে না?’

‘এই গেল, এই ফিরে এল!’

‘জিওমেট্রি করবে বলে ট্যুর ক্যানসেল করে ফিরে এসেছে। হয়েছে? এবার তোর জেরা বন্ধ করবি দিদি?’

‘অ্যাই বৃষ্টি, বল না কোথায় যাচ্ছিস? প্লিজ বল, সিনেমা? কী সিনেমা?’

‘খেপেছিস, তোকে বলে মরি আর কী? তুই হলি সত্যবাদিনী। মায়ের একটু চাপেই হড়হড় করে সত্য কথার ফুলঝুরি ফোটাবি। দিদি সত্যবাদিনী হলে বোনের যে কী বিপদ হয়, তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। কথা না বাড়িয়ে টাকা দে দেখি। পপকর্ন খাব।’

এই মেয়ের কথা ভুল হতে পারে, কিন্তু মিথ্যে হবে না। ‘ভিখিরি’ না আনলেও জ্যোতিষ্কদা যে বাড়িতে কাউকে ধরে এনেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বারিধারা বলল, ‘সে কী রে, ভিখিরি এনেছে মানে! লোকটা কোথায়?’

মেঘবতী ফিসফিস করে বলল, ‘একতলার গেস্টরুমে।’

বারিধারা চমকে উঠল, ‘অ্যাঁ, গেস্টরুমে। বলিস কী রে দিদি! ভিখিরি গেস্টরুমে!’

মেঘবতী বলল, ‘হ্যাঁ, তোর জামাইবাবু সেরকম ব্যবস্থা করে অফিস চলে গেছে। ভেবে দেখ একবার। এর পরও কাঁদব না? বল, কাঁদব না?’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কী করছে লোকটা?’

মেঘবতী ধরা গলায় বলল, ‘একটু আগে গুপির মাকে নীচে দেখতে পাঠিয়েছিলাম, সে ঘর পর্যন্ত যেতে পারেনি। ভিখিরিটার জামাকাপড় থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে। তবে সিঁড়ির মুখ থেকে শুনে এসেছে বাঁশি বাজাচ্ছে।’

বারিধারা উত্তেজনায় খাট থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল।

‘অ্যাঁ, বাঁশি বাজাচ্ছে। বলিস কী রে দিদি! সত্যি বাঁশি বাজাচ্ছে?’

মেঘতীকে জবাব দিতে হল না। টেলিফোনের ওপাশ থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে এল। বারিধারা থমকে গেল। এই ঘন হয়ে আসা সকালবেলা বালিগঞ্জের বাড়িতে কে বাঁশি বাজাচ্ছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *