একটুকরো আকাশ একফালি চাঁদ
আদালত বসছে এ এ এ।
নকিব সুর করে হাঁক ছাড়ল। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি। প্রতিধ্বনি। ধ্বনি। কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। মনে হল জিজ্ঞেস করি, মহাশয়, আপনি কি ‘ওসিবিসা’ গানের দলের ডাকু পোট্যাটো! সাহস হল না। আমার বিচার হবে। বিচারার্থীর দুঃসাহস মানায় না। আমি বাবা কলকাতার মাল। আর কিছু জানি আর না জানি, এইটুকু জানি আদালতে ট্যাঁ ফোঁ করলেই শাস্তির মাত্রা চড়চড় করে বেড়ে যায় যেমন ‘ক্যানসার’। বেশ আছে, বেশ আছে,‘বায়পসি’র জন্যে খোঁচা মারলেই রেগে সারা শরীর ফেটে পড়ে। একবার পাঁচ আইনে কলকাতার পুলিশ আমাকে ধরেছিল। যে অপরাধের জন্যে ধরেছিল সে অপরাধে সাধারণত ধরার রেওয়াজ কলকাতায় নেই। পুলিসটা মনে হয়, সাহেব কলকাতার ভূত পুলিস, তা না হলে ‘কমিট নো ন্যুইসেনস’-এর জন্যে ধরে! বলে সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে সারা দিনে। কার্জন পার্কের সেই গোলাগারটা আর দেখাই যায় না। টাই-পরা সাহেবরা মেট্রোর উলটো দিকে অনায়াসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। ভর দুপুর বেলা। পেছন থেকে জামাটা খামচে ধরতেই প্রথমে আমি খুব হেসেছিলুম। হাসতে হাসতে বলেছিলুম, কেয়া পাগল হো গিয়া তু নে?
তিন ঝাঁকুনি। মনে হল মুন্ডু খসে যাবে। তু নেহি, আপ বোলো, আপ।
আমি অবশ্য বাপ বলেছিলুম! ফ্যাশানেবল বাঙালি। কত পুতুপুতু করে শরীরটাকে রেখেছি। মাপমতো বিয়ার খেয়ে, মাপা ভুঁড়ি। পেটটা একেবারে ঢুকে থাকলে পার্সোন্যালিটি ঝুলে যায়। অ্যান্টাসিড, অ্যান্টিঅ্যামেবিক, মাল্টিভিট, ফ্রীজের ঠাণ্ডা দুধ। কতরকমের ব্যাপার-স্যাপার করে একটা চেহারা খাড়া রেখেছি। সে কি ওই সাঙ্ঘাতিক নাড়া সহ্য করতে পারে!
একান্তে নিয়ে গিয়ে পুলিসবাবাজী বললেন, ‘কাঁহা যায়েগা?’
বললুম, ‘যাঁহা লে চলে।’
আমি তো অবাক। পাঁচ আইনে ধরলি ব্যাটা, আর আমাকেই জিজ্ঞেস করছিস, কোথায় যাব?
পরক্ষণেই মাথা খুলে গেল! আরেব্বাস, এ তো টোপ! সেই স্লোগান, ‘ধরবো ছাড়বো, ছাড়ব ধরব, কামাইকা বাত।’
সঙ্গে সঙ্গে বললুম, ‘মেকোম্বো চলিয়ে।’
কী বুঝলো কে জানে? হেঁড়ে গলায় পাঁচটা টাকা চাইলে। কেন দোবো পাঁচ টাকা! হিউম্যান রাইটসে হস্তক্ষেপ। ‘নেহি দেগা।’ ‘তবে চলো’ বলে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে থানা। আমার জিনিস, আমারই পৃথিবীতে আমি ফেলেছি সেই অপরাধে থানা! সময় সময় মানুষের মাথাখারাপ হয়, পুলিসেরও হয়। পরের দিন কোর্টে হাজিরা। আমার উকিল আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘হাকিম সাহেব যা বলবেন তাইতেই হ্যাঁ বলবেন। প্রতিবাদ করলেই জরিমানা বেড়ে যাবে।’
হাকিম বললেন, ‘তুমি অপরাধী।’
প্রতিবাদের ইচ্ছে হল। ‘তুমি নয় আপনি বলুন।’ সামলে গেলুম। বললুম, ‘হ্যাঁ হুজুর।’
‘দশ টাকা জরিমানা।’
সঙ্গেসঙ্গে আমার মুখ আলগা হয়ে বেরিয়ে গেল, ‘কলকাতায় আবার ওটা অপরাধ!’ সঙ্গে ব্যঙ্গের হাসি।
হাকিম হাঁকলেন, ‘কুড়িটি টাকা।
আমি বললুম, ‘যে ধরেছে সেও করে।’
‘তিরিশ টাকা।’
আমার ভীষণ মজা লেগে গেল। এ যেন কথার নিলাম। আমি যা বলছি, কোনোটাও মূল্যহীন কথা নয়। মুখ থেকে ঝরছে আর ধাপে ধাপে মিটার চড়ছে। দূরপথে ভ্রমণের মতো। আমার উকিল অনবরত ইশারা করছেন। আমার গ্রাহ্যই নেই। নেশায় পেয়েছে।
আমি বললুম, ‘আপনার চেয়ারের পেছনে দেয়াল, সেই দেয়ালের বাইরেও যে পারছে, সেই ছাড়ছে।’
হাকিম সাহেব দুম করে হাঁকলেন, ‘হাজার।’
কেস বহুদূর গড়াত। আমার ইচ্ছে ছিল লাখ তুলে ছাড়ব। সে আর হল না। ‘রিমুভ হিম ফ্রম দি কোর্ট।’
গম্ভীর আদেশ। পেয়াদা এসে ঘাড় ধরে বের করে দিলে।
সাধারণ একটা মানুষ। আমার চেয়েও কুশ্রী দেখতে। তেল মেখে পাতা কেটে আঁচড়ানো চুল। ময়লা কালো কোট। একবার ঢেঁকুর তুলতেও দেখেছি। পুঁইশাক আর কড়াইয়ের ডালের ঢেঁকর। ঈশ্বর টিশ্বর নয়। একেবারে ছাঁচি মানুষ। কী এক আইন, কার এক আইন। বসিয়ে দিলে চেয়ারে। এসে গেল সব মানুষের ওপর ডাণ্ডা ঘোরাবার ক্ষমতা। মানুষের ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভীষণ হাসি পেত। যা বলে তা করে না, যা করে তা বলে না। সব ব্যাটা ভন্ড। সবেতেই ওপর চালাকি। কেন বলছি, ওই ফাইন দেবার দিন থেকেই আমি আবার ওই একই জায়গায় ‘কমিট নো নুইসেনস’ চালু করে দিলুম! কোথায় আইন? কোথায় কি?
সেই আদালত আর এই আদালতে অনেক তফাত। এ হল সর্বোচ্চ আদালত। মৃত্যুর পর সব মানুষকেই আসতে হবে এখানে। রাজা, উজির, প্রজা, ফকির। কারুর নিস্তার নেই। তা না হলে, ঘণ্টাখানেক আগে আমি মরেছি। মরেছি নিজের দোষেই। আর এই একঘণ্টা পরেই আমি মহাআদালতে।
সবই ভালো, তবে বড়ো প্রাচীন। কেমন যেন মহাভারত, মহাভারত চেহারা। সব দুর্যোধন, দুঃশাসনের মতো দেখতে। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, শকুনি। আশ্চর্য, সচিত্র মহাভারতের শিল্পী না মরেই কেমন করে দেবসভার সঠিক ছবি আঁকলেন! যাক, ওসব বাজে কথা ভাবার সময় এ নয়। আমার বিচার হচ্ছে। স্বর্গে যাব, না নরকে যাব, না আবার পত্রপাঠ পৃথিবীতে ফিরে যাব, না ভূত হয়ে আনাচে-কানাচে ঘুরব, এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।
বুড়ো থুরথুরে একজন মানুষ, বুড়ো হলেও অথর্ব নন, উঠে দাঁড়ালেন। সিংহাসনে যমরাজ! সেই চেহারা। থিয়েটারে ঠিক যেমনটি দেখেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেছি স্বর্গের জীবন হল পৃথিবীর থিয়েটার।
সেই বৃদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ পেশ করি?’
সিংহাসনে আসীন মহারাজ, যাঁকে ঠিক সিনেমার সে-যুগের হিরোর মতো, এ যুগের রেডিয়ো-ঘোষকের খাদগলায় বললেন, ‘আজ কটা?’
‘মহারাজ আজ অনেক।’
‘তারা কোথায়? সামনে তো একটাই বসে আছে।’
‘মহারাজ এত মরছে যে সকলকে আর বিচারের জন্যে আনার কোনো মানে হয় না।’
‘তা, কোথায় তাদের পাচার করছ?’
‘ওই ওয়েস্ট বেঙ্গলের কায়দা ধরেছি মহারাজ।’
‘অ্যাঁ, ওই পৃথিবীর কায়দায় দেশ চালাচ্ছ। তাও আবার কোন দেশ, অগামারা পশ্চিমবঙ্গ!’
‘তাতে সুবিধে হচ্ছে মহারাজ। কাজ কত কমছে! পশ্চিমবাংলার মতো নৈষ্কর্মের দেশ তো আর দুটি নেই। সব আছে কাজ নেই।’
‘সে আবার কী? পৃথিবীতে মানুষকে তো খেটে খাবার জন্যে, খুঁটে খাবার জন্যে, ঘাম ঝরিয়ে, লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্যে পাঠানো হয়েছিল। বিনা পরিশ্রমে চালাচ্ছে কী করে?’
চিরকালই আমার বকবক করা স্বভাব। তায় আবার সেলসম্যান ছিলুম, বাংলায় যাকে বলে দালাল। ফট করে বলে বসলুম, ‘ধান্দা করে মহারাজ।’
যমরাজের সেই লাল লাল চোখ আমার দিকে। ভেবেছিলেন ভয় পাব। কাঁচকলা, সারা- জীবন কত লাল চোখ দেখলুম, স্ত্রীর চোখ, মাস্তানের চোখ, সরকারের চোখ, সহযাত্রীর চোখ, প্রভুর চোখ! আমি কী ডরাই প্রভু ভিখারি রাঘবে!
বৃদ্ধ পেশকার, বোধকরি চিত্রগুপ্তই হবেন, সাদা সাদা, বাঁধানো দাঁত বের করে ধমক লাগালেন, ‘তোমাকে কে প্যাটপ্যাট করতে বলেছে?’
সেলসম্যান ছিলুম তো! স্যার বলাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছি। বললুম, ‘স্যার, পশ্চিমবাংলা আমি গুলে খেয়ে এসেছি, তুমি প্রভু আমার চেয়ে বেশি জান! মানুষ যেমন স্বর্গ জানে না, তুমি মহারাজ তেমনি পৃথিবী জান না।’ কথা বলার মওকা মিলে গেলে আমাকে আর পায় কে! বাতেলা বাঙালি। বলো না! কথার তুবড়িতে সব শুইয়ে দেব। কেঁদো বাঘ ন্যাজ গুটিয়ে পালাবে।
খোদ যমরাজকে বললুম, একেবারে থিয়েটারের ডায়ালগে, শ্রুতিনাটকের কায়দায়, ‘সম্রাট, পশ্চিমবাংলার মানুষ স্রেফ স্লোগান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মনের আনন্দে। ফের বলে চলেছে, চলবে না, চলবে না। আর মাঝে মাঝে বলছে, ও লড়াই বাঁচার লড়াই, লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই। তারপর যার যেমন স্ট্যাটাস সেই অনুযায়ী ধেনো, চুল্লু, বিলাইতি মেরে হয় শুয়ে পড়ছে, না হয় ধান্দায় বেরোচ্ছে, না হয় ব্লেড চালাচ্ছে।’
যমরাজ গম্ভীর মুখে বললেন, ‘মূর্খ! রোজগার হচ্ছে কীভাবে? খরচ-খরচা চলছে কী করে?’
‘প্রভু! অতি সহজ পন্থায়! সেই যে তিনি বলেছিলেন, আপনার প্রিয় সন্তান ঋণং কৃত্বা। সেই কায়দা প্রভু, ধারে চলছে। সংসার চলছে ধারে। রাজ্য চলছে ধারে। এভরিথিং অন ক্রেডিট। ধারে ট্যাক্সি, ধারে বাস, ধারে ফ্রিজ, ধারে পাখা, ধারে শাড়ি। সেল আর ইনস্টলমেন্ট। আর সরকারের শেষ কথা, কেন্দ্র দিলে খাবে, না দিলে চেল্লাবে। ভেরি ইজি প্রভু।’
যমরাজ দক্ষিণে বামে বারকতক মাথা দোলালেন তারপর আবার দোলালেন তারপর একান্তে সেই বৃদ্ধ পেশকার, যাঁকে আমরা চিত্রগুপ্ত বলেই জানি, তাঁকে চাপা গলায় বললেন, ‘ঘাড়ের ব্যথাটা তো কিছুতেই যাচ্ছে না চিত্র।’
আমি ঠিক শুনে ফেলেছি। কলকাতার কান বাবা! যে কলকাতায় বউয়ের ফুসফুসি শুনতে পায়, অফিস কোলিগদের চুকলি শুনতে পায়, সে এই নির্জন যমপুরীতে, যেখানে হাল্কা বাতাসে সব শব্দই ফুলের মতো ভাসে, শুনতে পাবে না?
সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার করে বললুম, ‘প্রভু স্পণ্ডিলাইটিস, সিয়োর অ্যান্ড সার্টেন।’
‘বাংলা, অথবা সংস্কৃত বলো ছোকরা। এটা বিলেত নয়।’
‘প্রভু এ হল বড়োলোকের ব্যায়রাম আর ডাক্তারি শাস্ত্রটা ইংরেজের হাতেই সভ্য হয়েছে। ওই নামের বাংলা হয় না প্রভু। তবু চেষ্টা করে দেখি। একে বলে ঘাড়োৎকট।’
‘সে আবার কী হে! ঘটোৎকচের ছেলে নাকি?’
‘আজ্ঞে না। সে তো উৎকোচ গ্রহণ করে যে ঘট করে তাকেই বলে ঘটোৎকচ। আর উৎকট ঘাড় সন্ধি করে ঘাড়োৎকট।’
‘সারে কীভাবে?’
ফিজিওথেরাপি আর গলায় কলার পরা।’
‘অ্যাঁ, সে আবার কী?’
‘আজ্ঞে ঘাড়ের ব্যায়াম আর গলায় বগলস। কুকুরের সরু মতো হয়, মানুষের জন্যে চওড়া চওড়া এতখানি, ভেতরটা নরম মতো, বাইরে চামড়া।’
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘প্রভু, মানুষের কথা বিশ্বাস করবেন না। মিথ্যে ছাড়া সত্যি বলে না। আমাদের কাজ শুরু হোক।’
‘বেশ তাই হোক।’
যমরাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো ছোকরা ধারের কথা বললে, ধার দিচ্ছে কে?’
‘যার আছে।’
‘কার আছে?’
‘কালোয়ার, ব্যবসাদার, চোরাকারবারি, মজুতদার। আছে ব্যাঙ্ক, চিটফাণ্ড। সার্কুলেটারি প্রসেস।’
যমরাজ এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, ‘আঃ আবার ইংরেজি! তোমাকে বলেছি ইংরেজিতে আমি দুর্বল। এ হল হিন্দু রাজত্ব, ম্লেচ্ছরা এখানে আসে না। তাদের জেন্য হোভেন না কি একটা যেন আছে।’
‘মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন হয় যেভাবে, সেইভাবে ধার চলছে, টাকা ঘুরছে। প্রথমে ট্যাকস। বলছি, বলছি বাংলায় বলছি। কর। করভারে জর্জরিত ভারতসন্তান। সব চ্যাঁ চ্যাঁ করছে। আয়কর, বিক্রয়কর, চুঙ্গিকর, ক্রয়কর, বিষয়কর, বিত্তকর, ভোগকর, ভাগকর, ব্যয়কর। সেই প্রথম ভাগের কর খল। করে করে খলখলে। রক্তের মতো নীচের দিক থেকে অর্থাৎ সমাজের উদর থেকে টাকা চলে গেল হৃদয়ে। উদর মানে বুঝেছেন প্রভু। সমাজের সেই উদরসর্বস্ব অংশ, যারা কেবল খাই খাই করছে, কিন্তু খেতে পায় না। খালি খেয়োখেয়ি করে আয় কর দিতে দিতে একেবারে নুয়ে পড়ে। হৃদয় মানে সরকার। সরকার এইবার খরচ করতে থাকে। তার মানে পরিশ্রুত টাকা রক্তের মতো দেহের শিরা-উপশিরায় বইতে শুরু করল। সব জায়গায় সমানভাবে ছড়াবার আগেই ক্যাঁক করে ধমনী চেপে ধরবে ব্যবসাদার কন্ট্র্যাক্টার। সাঁ সাঁ করে শুষে নেবে! সেই টাকার কিছুটা গিয়ে জমবে গলকম্বলে, হয়ে যাবে কালো টাকা। লাও ঠ্যালা। ধমনীর মুঠো মধ্যে মধ্যে আলগা হয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঝরবে নীচের দিকে। খেটে খাওয়া রোজের আয় তিন টাকা, আর চামচাদের তিন-শো টাকা। একটা ভালোমতো ছেনতাই কী ডাকাতি করতে পারলে বেশ কিছুদিন টং হয়ে পড়ে থাকো। ম এ ম এ মমক্কার প্রভু। খাটার চেয়ে বেচা ভালো প্রভু। নেতারা আশা বেচছেন। এই হবে, সেই হবে, হাতি হবে, ঘোড়া হবে! শিক্ষকরা জ্ঞান মানে ডিগ্রি ডিপ্লোমার কারবার করছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ফুস হয়ে গেছে। চোরাই মাল বেচো, দেহ বেচো! আর দেখাও ছুরি, কোথাও বোম দেখাও, রেলা দেখাও। আর দাও, ধাপ্পা দাও, ভাঁওতা দাও, তেল দাও, ভেট দাও। পেলা দাও, চাঁদা দাও, মুজরো দাও। আর নাও, লুটে নাও, পুটে নাও। চেটে নাও চুটে নাও। এইভাবেই চলছে প্রভু আপনার হিন্দু কিংডাম।’
যমরাজ গম্ভীরমুখে বললেন, ‘বাতুল, বড়ো বেশি কথা বলে ছোকরা।’
‘বাঙালিমাত্রেই বেশি কথা বলে প্রভু। মুখেই আমরা বাঘ মারি।’
‘আর নয়, এবার চুপ করো ছোকরা। তোমার বিচার হবে। চিত্রগুপ্ত।’
চিত্রগুপ্ত বসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন। তটস্থ হয়ে বললেন, ‘প্রভু।’
‘এখানের ভিড় তুমি কমালে কী করে?’
‘প্রভু, পশ্চিমবাংলার পুলিশের কায়দায়। ওখানে অপঘাতে যারাই মরছে তাদের বলা হচ্ছে ওয়ান্টেড ক্রিমিন্যাল। কেসটেস আর কিছু হয় না। ভাগাড়ে টান মেরে ফেলে দিয়ে ফুলুরি আর চা খায়। এখন বাকি রইল স্বাভাবিক মৃত্যু। তিন শ্রেণির লোক মরে, গরিব, মধ্যবিত্ত, বড়োলোক। গরিব মরলে সঙ্গেসঙ্গে তাদের জন্মের ব্যবস্থা হয়ে যায়। গরিবদের তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং নেই তাই মরেই জন্মায়। ওরা যখন বেঁচে থাকে তখন থাকার জায়গা মেলে না। ওরা বলে একটু হাউসিং প্রবলেম। বড়ো বড়ো প্রাসাদের তলায় ফুটপাথে, ঝুপড়ি ঝাপড়িতে ছেঁড়া ট্যানা পরে থাকে কিন্তু অসংখ্য যোনি ভ্রূণ ধারণের জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। কেউ বলবে না ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। বড়োলোক মরে কম, বড়োলোকের সংখ্যাও কম তাই মরলেই যমদূতদের বলে দিয়েছি সোজা স্বর্গে নিয়ে যাবি। কেয়ার অফ মেনকা, ঊর্বশী।’
আমি আর থাকতে পারলুম না, বলেই ফেললুম, ‘এখানেও ঘুষ রে ভাই।’
যমরাজ চোখ তুলে তাকালেন, ‘তার মানে?’
‘মানে খুব সিম্পল। পৃথিবীতে যেসব মহাপুরুষ আপনারা ডেসপ্যাচ করেছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, অর্থই অনর্থের মূল। প্রাচুর্যই পাপের উৎস। ব্যবসাদাররা কামাইকা বাত বলছে, চোরাবাজার, কালোবাজার, ফাটকাবাজি করে কোটি কোটি টাকা কালো করে দু-হাতে মজা লুটছে আর মাঝে মাঝে হুমনে ঘি চড়াচ্ছে কি বাবা বিশ্বনাথের মাথায় মণ মণ দুধ ঢালছে, কি শীতে গরিবদের সুতোর কম্বল বিলি করছে, মন্দিরে পলেস্তারা ধরিয়ে দিচ্ছে, ব্যাস, সাতখুন মাপ। মরেই স্বর্গ।’
‘ওরে গবেট অর্থের নরকেই তো তাদের নরকবাস হয়ে যাচ্ছে। শোননি বৎস, ভোগেই মুক্তি। টাকা, টাকা, বিষয়, বিষয়, ভোগ, ভোগ করে সব পোড়া কয়লা ঝামা। বউ নেই, ছেলে নেই, মা নেই বাবা নেই। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন, এমনকী পৃথিবীটাই নেই। প্রেসার, সুগার, লিভার। নিজেরা টাকাই করে। ফুট করে একদিন মরে যায়। সব রইল পড়ে। ভোগ করে পঞ্চভূতে। ওদের স্বর্গে যাবার হক আছে। একজন মানুষের কী প্রয়োজন তা জেনেও যারা টাকা পাগল তারা হল সাধক। ধরছে ছাড়ার জন্যে। তুমি আর কী রেখে এসেছ মানিক! ছোটোখাটো একটা আগরওয়াল যা রেখে আসে তা জান কি? আর বড়ো আগরওয়াল! শুনলে আর একবার মরে যাবে।’
‘তা হলে যত বিচার মধ্যবিত্তের?’
‘কেন? যদ্দিন পৃথিবীতে ছিলে তদ্দিন বিচার চাই, বিচার চাই করে কারা বেশি চেল্লাত। ন্যায়বিচার, সমান অধিকার, আইন, শাসন, রাজতন্ত্রের উৎখাত, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কারা চেল্লায়? রাজপথে ঝাণ্ডা-মিছিল। ভিসি ঘেরাও, পুলিশ ঘেরাও। ধনপতিরা টুঁ শব্দটি করে? তারা নি:শব্দে কাজ করে যায়। প্রভু কৃষ্ণের গীতার উপদেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে? তারা কর্ম করে, কর্মফলের আশা রাখে না। লোক মরুক, বঞ্চিত হোক, খুন হোক, জখম হোক, গ্রাহ্যই নেই, আতঙ্কও নেই, ফল ঈশ্বরে সমর্পিত। তাই তারা মরার পরই সোনার রথে চড়ে সোজা স্বর্গে। পাপের বোধ না থাকলে পাপ স্পর্শ করবে কী করে! শিশুর মতো। শিশুর বোধ নেই তাই শিশুর কৃতকর্মের জন্য আদালতও নেই।’
‘আহা কী যুক্তি মাইরি!’
‘এ কী ভাষা?’
‘মানব ভাষা।’
‘চিত্রগুপ্ত, তাড়াতাড়ি একে বিদায় করো। এর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে আমাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘প্রভু এর প্রথম অপরাধ…।’
‘না না অপরাধের কথা পরে। আগে পরিচয়।’
‘বাঙালি ব্রাহ্মণ। এম. এ. পাশে। চাকরি করত। হাজার দুয়েক ছিল ডানহাতের কামাই। বাঁ- হাতে তার ডবল।’
‘আইনের বইটা দেখো তো। আমাদের শেষ সভায় ঘুষ নেওয়াটাকে কি আমরা এখনো অপরাধের তালিকায় রেখেছি, না বাদ দিয়েছি?’
‘যে আজ্ঞে প্রভু!’
চিত্রগুপ্ত একটা ফাটা কাঁসরে তিনবার লাঠির ঘা মারলেন। এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলুম, শব্দতরঙ্গ বাতাসে কেমন রেকর্ডের খাঁজের মতো গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ছোটো থেকে ক্রমে বড়ো হতে থাকে।
সভায় যিনি হড়বড় করে ঢুকলেন, দেখেই চমকে উঠলুম। আমার খুব চেনা। প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসে বহুবার দেখেছি। আমাদের পাড়ার বৃদ্ধ মাস্টারমশাই একটানা ছ-বছর এই ভদ্রলোকের কাছে হাঁটাহাঁটি করেও কেস বের করতে না পেরে আমাকে বলেছিলেন। আমি মাসছয়েক খুব তেলিয়েছিলুম। আর প্রয়োজন হল না। বুড়ির কোলে মাথা রেখে বুড়ো মারা গেলেন। পাড়ার ছেলেরা এসে বললে, টুলুদা এক-শোটা টাকা ছাড়ো। মাধব স্যারকে পুড়িয়ে আসি। এক-শো দিতে পারতুম, দিলুম পঞ্চাশ। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় লুকিয়ে সিগারেট খাবার অপরাধে স্যার একবার বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। বাবাকেও বলে দিয়েছিলেন। ফলে দ্বিতীয়বার আবার ছাতপেটাই। মেরে কী হয়? সিগারেট কি ছেড়েছি? পিটিয়ে স্বভাব সংশোধন করা যায়? মেরে মানুষকে ব্রহ্মচারী করা যায়। মেরে মদ ছাড়ানো যায়? মেরে মেয়েদের দিকে তাকানো বন্ধ করা যায়?
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘বিষয়-সংশোধনী সভার ফাইল। জলদি।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কি মিশাই! কবে টাঁসলেন?’
প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডবাবু আমার দিকে তাকালেন। চোখে সেই ঘোলাটে ‘এবার আমি তোমায় খাব’ দৃষ্টি নেই। প্রেম ঢুলুঢুলু। লম্বা একটা মই ঘাড়ে করে খুব উঁচু ফাইল র্যাকের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘আর ভাই! পৃথিবীর নিয়ম, এই আছে, এই নেই। তেল ফুরোলো, নিভে গেলুম।’
‘ওখানে বসে এতকাল যাদের নিয়ে ন্যাজে খেলছিলেন তাদের অনেকেই তো এখানে চলে এসেছে, তারা যদি এইবার ঝাড় দেয়!’
‘আপনি সবে এসেছেন, তাই না। কয়েকপল অবস্থান করলেই দেখবেন এখানে হিংসা নেই, দ্বেষ নেই, দেওয়া নেই, নেওয়া নেই। প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা থাকে না। এখানে শুধু অপেক্ষা। পৃথিবীতে নভোচররা যেমন অপেক্ষায় থাকে, কখন শূন্য বলবে! অমনি রকেট চড়ে বসবে আকাশে। এখানেও তাই শূন্য। নেমে যাও নীচে। পপাত ধরণীতলে!’
পি. এফ. বাবু কথা বলতে বলতেই মই বেয়ে ওপরে উঠছেন তো উঠছেন। উঠেই চলেছেন। নেমে এলেন ফাইল হাতে। ফাইল খুলে দেখা শুরু হল। এখানকার ‘কোড অফ কণ্ডাক্ট’ ঘুষ খাওয়া অপরাধ না অপরাধ নয়।
যমরাজ প্রশ্ন করলেন, ‘সেদিনের সভায় সবাই উপস্থিত ছিলেন তো?’
‘হ্যাঁ প্রভু। পরমেশ্বর, আল্লা, গড, জরথুস্ত্র। সব ধর্মের দেবতারাই উপস্থিত ছিলেন।’
‘সই করেছেন?’
‘হাঁ, সইসাবুদ সব আছে।’
‘আচ্ছা, দেখো, দেখো। আজ আবার সড়ক কমিটির মিটিং আছে।’
‘কাল বন্যা কমিটির মিটিং শেষ হল কখন?’
‘ভোর হয়ে গেল। আজকাল এখানেও মানুষের হাওয়া লেগেছে সব গায়ে। কেবল ফাঁকি। কেবল ফাঁকি। আসাম আর বাংলায় আমাদের কত কাজ। এত দিনে তিন চারবার বড়ো বন্যা হয়ে যাবার কথা। বন্যার ওপর কত কী নির্ভর করছে! কেন্দ্রের সাহায্য, ভোট।’
‘কেন প্রভু! বাংলাদেশকে তো আমরা ভালোই মেরেছি!’
‘একটু পক্ষপাতিত্ব হয়ে যায় যে বাবা। সব দেশে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। দুই দুই করলে চলবে না। পশ্চিমবাংলায় অবিলম্বে বড়ো কিছু একটা করা দরকার। নির্বাচন এসে গেল। বেচারারা ভোটের জন্যে লড়বে কী নিয়ে?’
‘বাংলাদেশে মহামারী তো পৌঁছে গেছে!’
‘পৌঁছে কী, কাজ শেষ করে চলে আসছে। তবে কালকের সভায় আমাদের খুব সমালোচনা হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় আন্ত্রিক আর ন্যাবা দিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলুম ঠিকই তবে সুবিধে করা গেল না। আমরা হেরেই গেলুম।’
‘ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গু তো আমরা ধীরে ধীরে ছাড়ছি।’
‘সবই তো ছাড়ছি তবে কোনোটাই তেমন ধরছে না।’
‘এখন পশ্চিমবাংলায় আমাদের একমাত্র ভরসা, ক্ষুর, বোম, রেডপার্টি আর শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ।’ সময় সময় স্বামী। তবে সে তো আর মহামারী হবে না। রোজ গোটাকতক করে বউ পুড়ে মরবে। তাতে আর কী হবে।’
‘লরি, ট্যাক্সি, বাস, মিনি, এরাও তো সাহায্য করছে।’
তেমন কিছু না। আবার কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল, এখন যদি হইহই করে বাবুরা সব রাস্তাঘাট মেরামত করতে শুরু করে তাহলেই খেয়েছে। দুচারটে যাও বা কেঁদেকক্কে মরছে তার দফাও রফা।’
‘প্রভু! হাইওয়ে আছে। ওদের ন্যাশনাল হাইওয়ে। এই স্লোগানটা যদি মনে মনে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, চুল্লু খাও মুখোমুখি লড়ে যাও।’
‘কী হবে! দুটো লরিতে মুখোমুখি হলে বড়ো জোর চারটে খসবে। আজকাল আবার বড়ো কোম্পানির লরি এমন শক্তপোক্ত, তোবড়ায় কিন্তু ছাতু হয় না।’
‘রাজনীতিই দেখছি আমাদের একমাত্র ভরসা। আমেদাবাদ বা পাঞ্জাব ধরনের একটা ঝট পশ্চিমবাংলায় বাধাতে পারলে মড়কের মতোই কাজ হত।’
আমি বললুম, ‘কেন প্রভু! ওই বেআইনি, বিষাক্ত দিশি মদের কারবার আর একটু অবাধ করে দিলেই এক এক রাতে আপনার জালে হাজার হাজার পড়বে।’
‘ছোকরা এইটে তুমি ভালোই বলেছ। ভালো পরামর্শ। মৃত্যুর হার দেখে বড়ো বিমর্ষ হয়ে পড়েছি।’ চিত্রগুপ্ত ফাইল খুললেন, ‘প্রভু গত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘুষ নেওয়া আর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। কারণ আমাদের পর্যবেক্ষক বিশ্ব ঘুরে এসে জানিয়েছেন, প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে পুলিস ঘুষ নিচ্ছে। ঘুষ আর পুশ খুব চলছে ও মুল্লুকে।’
‘পুশ। পুশটা কি?’
‘প্রভু রিপোর্টে যেমন লেখা রয়েছে!’
‘আমি জানি প্রভু। আমেরিকান শব্দ। নেশার ওষুধ যেমন হ্যাস, মারিজুয়ানা, নারকোটিক্স প্রভৃতি যারা চোরাগোপ্তা বিক্রি করে, তারাই হল ড্রাগপুশার।’
‘ছোকরা, অনেক ঘাটের জল খেয়েছ মনে হচ্ছে। ভালো ভালো।’
‘পৃথিবীর বয়েস যত বাড়ছে প্রভু, তত আধুনিক হচ্ছে জীবন। মেয়েরা ছেলেদের মতো চুল কাটছে, ঠোঁটে লম্বা লম্বা সিগারেট অথচ বুক ছোট মাপের হলে বুক বিজ্ঞানীদের পেছনে ছুটছে। আমেরিকায় আবার অঢেল টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচার হচ্ছে। বালির পুঁটলি ঢুকিয়ে চাহিদা মতো বড়ো ছোটো করছে। ছেলেদের মতো চুল চাই, মেয়েদের মতো বুক চাই, নিতম্ব চাই, সংসার চাই সঙ্গেসঙ্গে পুরুষের স্বাধীনতা। এরপর যদি কার্তিকের মতো সরু একটা গোঁফ চায়, কী লিশিং-এর মতো ঝুল ঝুলে চামরের মতো দাড়ি, কিছু বলার নেই। ছেলেরা ওদিকে মেয়েদের মতো লম্বা চুল রেখে শায়ার মতো ফাঁদালো পাজামার ওপর চকরাবকরা পাঞ্জাবি চড়িয়ে, গলায় চেন ঝুলিয়ে, মুখ এনামেল করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সন্ধ্যের দিকে পুশাররা ডোজ পুশ করে দিচ্ছে। চোখ ঢুলু ঢুলু পা টলোটলো। তখন পৃথিবী হল প্রেমের পৃথিবী। গোল গোপিনীসহ পার্কে লীলা করে। আমেরিকায় বলে জয়েন্ট, ইংল্যাণ্ডে বলে ডেন আমরা বলি ঠেক।’
‘ছোকরা তোমার লেকচার থামাও। মানুষের হালচাল আমাদের বিষয় নয়। আমাদের আনন্দ কেবল মৃত্যুতে। আমাদের বিষয় হল মৃত্যু কমছে না বাড়ছে। আর মৃত্যুর পরে বিচার। বিচারের রায় ভগবানের দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া। তারপর তিনি বুঝুন কী করবেন।’
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘ভগবানের কাছে একটা কী দুটো কেস কালেভদ্রে পাঠানো হয়। তোমাদের ইউনিভার্সিটির ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, লেটার মাক্স পাওয়া, স্টার পাওয়া ছেলেদের মতো। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গেল। আর এলই না। যাদের আর জন্মাতে হবে না তারাই ভগবানের কাছে যায়। সপ্তর্ষিমন্ডলের ঋষি হয়ে বসে থাকে। আর বেশিরভাগের ব্যবস্থা এইখান থেকেই হয়ে যায়। ধরো আর মারো।’
যমরাজ বললেন, ‘চিত্র ঘুষ যখন অপরাধ নয় তখন ওটা ছেড়ে দাও। পরের অপরাধ কী? তাড়াতাড়ি করো আমার মিটিং আছে।’
‘প্রভু ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে ওখানে একটা কেস চলছিল।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললুম, ‘হায় ঈশ্বর, ট্যাক্স ফাঁকি অপরাধ! বিগ বিগ পিপল কালো টাকার পাশবালিশ কোলে, মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটের ঠাণ্ডা ঘরে গড়াগাড়ি যাচ্ছে। এক একজন কোটিপতিকে ধরছে, ছাড়ছে, ছাড়ছে ধরছে। কাগজ-টাগজ পড়েন না নাকি?’
যমরাজ হাত তুললেন, ‘চিত্র, ভারতের অর্থনীতি আর অর্থনৈতিক অপরাধের ধরনধারণ বোঝার ক্ষমতা আমাদের বাপেরও নেই। ওটা ছেড়ে দাও। আমি শুনেছি ফিল্ম স্টার, গেমস্টার, গ্যাংস্টার ওদের সমাজের যত ব্লিস্টার সব আইনের ব্যাপারে একটু ঢিলেঢালা। ওদের একটু স্নেহের চোখেই দেখা হয়। যেদ্দাও, যেদ্দাও। আমরা টাকা পয়সা থেকে অনেক দূরে। তুমি ওর জন্য অপরাধে এসো।’
‘প্রভু ও একটা মেয়েকে জোর করে চুমু খেয়েছিল।’
‘মেয়েটা কী ওর বউ?’
‘না প্রভু। কলেজ গার্ল। সুন্দরী, অবিবাহিতা যুবতী।’
‘তাই না কি, তাই না কি, এ তো সাংঘাতিক অপরাধ, নৈতিক অপরাধ, চরিত্রস্খলন। এ পাপের সাজা তো ডোবার ব্যাং হয়ে একটা জন্ম কাটিয়ে আসা।’
আমি বললুম, ‘কী ব্যাং প্রভু? কোলা, না কুনো, না সোনা!’
‘কোলা ব্যাং। গায়ে এই বড়ো বড়ো গোটা। ডোবার জলে গলা ডুবিয়ে পড়ে থাক।’
চিত্রগুপ্ত সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘আর সারারাত কালোয়াতি করো।’
যমরাজ বললেন, ‘ছেলেটা মন্দ নয়, আমার বেশ পছন্দ হচ্ছিল। এমন একটা বাজে কাজ কেন করেছিলি রে ছোঁড়া?’
‘গুরুদেব, কেবলই মনে হত চুমু খাই, চুমু খাই, একদিন সুযোগ এসে গেল চকাম করে খেয়ে বসলুম।’
‘আরে ছি ছি। একটা বুড়ো দামড়া। তুই অমন একটা অশ্লীল কাজ করলি?’
‘কী করব প্রভু! আমার সবই ওইরকম। হঠাৎ করে ফেলি। বেশ সৎ সরকারি কর্মচারী ছিলুম। ঘুষের নামে মারতে তাড়া করতুম। হঠাৎ একদিন সকাল দশটার সময় মনে হল আজ ঘুষ নেবো। মোটা টাকা। মাল খাব আর তারপর যা যা করার সব করব। এগারোটার সময় এমন হল চেয়ারে বসতে পারি না। ঘুষ নেব, মাল খাবো, মাল খাব, ঘুষ নেব। মাথা ভোঁ ভোঁ। কোনো কারণ নেই। শান্ত ছেলে, সকাল বেলা বউয়ের যত্নের রান্না দই-ইলিশ দিয়ে ভাত মেরে দুগগা বলে অফিসে এসেছি। আবার ফিরে গিয়ে চা পাঁপড় খাব। গল্পগাছা হবে। স্ত্রীকে নিয়ে নাইটশোও হতে পারে! কি চাপল মাথায়! ঘুষ খাব মাল খাবো ম করব। সে একেবারে পাগল পাগল অবস্থা। বেলা একটার সময়ে, গাধানি ব্রাদার্সের ডিরেক্টার চোকসি সাহেব এলেন। একেই বলে ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। ফাটাফাটি।’
যমরাজ বললেন, ‘এর মধ্যে ভগবানকে জড়াচ্ছিস কেন বাবা। অসৎ, অসাধু, তামসিক কাজকর্ম তোমার নিজের ইচ্ছায় হয়। ঈশ্বর চোখ বুজে থাকেন। ঈশ্বরকে তোমরা কি ভাবো হে ছোকরা!’
‘প্রভু, ওসব বললে চলবে না। সারা দেশে পোস্টার মেরে রেখেছেন—তোমার কর্ম তুমি করো মা লোকে বলে করি আমি। আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, পঙ্গুরে মা লঙ্ঘাও গিরি। উলটোপালটা কথা বললে এখন তো শুনব না প্রভু। যা যা করে এসেছি, সব করেছি নিজের ইচ্ছেতে নয়, তিনি করিয়েছেন, আমি করেছি। আমরা মহাপুরুষের কথা বিশ্বাস করি। আপনারা তো আর মরেন না। মরলে বুঝতে পারতেন। এই তো দেখুন না, আমি এত সব করতে করতে, নেশার ঘোরে টলতে টলতে, অহংকারে মটমট করতে করতে, পৃথিবীর পথে বছরের পর বছর চলতে চলতে, যেই না ঘণ্টা বেজে গেল, যেই কানে এল স্টাম্প তোলো, খেলা শেষ, টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়ে গেল, বিশ্বাস করুন প্রভু, নিমেষে চোখ খুলে গেল। ধোঁয়াটে পর্দার মতো কী একটা সরে গেল। দেখলুম, মহাশূন্যে মরীচিকার মতো জগৎসংসারের এক একটা দৃশ্য ফুটে উঠেছে আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। মেলাবার মুহূর্তে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে যেন কার হাহা হাসিতে! কার হাসি প্রভু। আমি শুনেছি। শুনতে শুনতে একসময় মনে হল, আমি আর শুনছি না, আমি নিজেই হাসছি।
মহা মহাশূন্যের অখন্ড নিস্তব্ধতায় লীন। আমি নেই। কি ভীষণ সত্য এই নেই। না মারা গেলে বুঝবেন কী করে, নেই কাকে বলে?’
মুখ দেখে মনে হল যমরাজ স্তম্ভিত। হঠাৎ আমার মনে হল এরা কে। পৃথিবীতে থাকার সময় নির্বাচনী সভায় নেতাদের বক্তৃতা দিতে দেখেছি। হিন্দি সিনেমায় আদালত দৃশ্যে উকিলকে আঙুল তুলে বীরের মতো সওয়াল করতে দেখেছি। সেই কায়দায় আঙুল তুলে, হাত বাড়িয়ে, প্রশ্ন করলুম যমরাজকে, ‘তুমি কে? হু আর ইউ? মৃত্যুর পর আমি সার বুঝেছি, যার আকার আছে আকৃতি আছে, তা হল মায়া। আছেটা সত্য নয়, নেইটাই সত্য। নাস্তি নাস্তি। তুমি আর তোমার ওই ঘুটঘুটে চেলা দুটোই বোম্বাই মাল। যাত্রার দলের পোশাক ভাড়া করে মানুষেরই তৈরি স্যাটেলাইটে চেপে, এই মহাজাগতিক স্টেশনে এসে বসে আছ আর বসে বসে ধাপ্পা মারছ। মানুষকে তুমি মারো না, মরে সে নিজে।’
‘কীরকম? কীরকম? শুনি। আরে চিত্র তোমার ওই ফাইলপত্র গুটিয়ে রাখো। এদিকে এসে বোসো। সেই স্বদেশি আমলে, মনে আছে চিত্র, আমরা কিছু অপঘাতে মরা রাগী রাগী ছোকরা পেতুম, মনে আছে! রোজই গোটা দুই আসত। তারা এই রকম তেড়ে তেড়ে কথা বলত; তবে তাদের বাপু ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল বেশ। গীতা হাতে ফাঁসিতে ঝুলত। বন্দেমাতরম বলে গুলি চালাত। তবে কাঁচা হাত তো। বেশিরভাগ গুলিই সায়েবদের গায়ে লাগত না ফলে নিজেরাই পেঁদানি খেয়ে মরতো। আর কবিতা গান লিখত, ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান।’
যমরাজ পেঁ যুক্ত দানি শব্দ ব্যবহার করছেন! দেশের কী হাল হল রে ভাই! তারপর মনে হল, কোথায় বসে আছি! দেশে! না বিদেশে! স্বর্গে না নরকে! আছি কোথায় আমি! পৃথিবীর ম্যাপ আছে। স্বর্গের তো ম্যাপ নেই, ষ্ট্রিট ডাইরেক্টরি নেই। যমলোক ঠিক কোনখানে? কোন গ্যালাক্সিতে? মনে হয় পৃথিবীর খুব কাছে। কারণ মরামাত্রই তো চলে এলুম হুস করে এখানে। নিমেষে। কে জানে কোথায় আছি।
যমরাজ বলছেন, ‘চিত্র বোসো। মজা করে এই ছোকরার যুক্তি তক্কো, গপ্পো শোনা যাক। তারপর না হয় ভালো করে টাইট দেওয়া যাবে।’
আমি বললুম, ‘টাইট! টাইট আর কী দেবেন প্রভু! যে মরেই গেছে তাকে আর কীভাবে!’
যখন দোব তখন বুঝবে ঠ্যালা। পড়োনি ছেলেবেলায়:
অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুন্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরি পাতকীর মুন্ড।।
‘তাতে আমার কাঁচকলা। প্রভু হিসেবে বড়ো ভুল করেন। তা করবেনই তো! বয়েস তো নেহাত কম হল না। পৃথিবীর চেয়েও প্রাচীন। প্রভু আমার তো দেহটাই নেই। এতক্ষণে দাহ হয়ে গেছে। কার মুন্ড কোথায় ধরবেন চেপে!’
‘বোকা পাঁটা। এই হাত ঘোরালেই তো জন্মাবি রে ব্যাটা। প্রতি মুহূর্তে জীবজগতে স্ত্রী পুরুষের মিলন হচ্ছে। এক-শোটা মিলনে অন্তত আশিটি জীবের জন্ম।’
‘আপনি প্রভু একেবারেই ব্যাকডেটেড। কিস্যু জানেন না। কি হারে ফ্যামিলি প্ল্যানিং হচ্ছে জানেন? এরপর আপনাদের সৃষ্টি কী করে রক্ষা হয় দেখি।’
‘পাঁটা। বোকা পাঁটা। কে বলেছে আমরা খবর রাখি না। ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছে বড়োলোকরা। আর নীচের তলায়! বৎস! টাকায় টাকা সুদ। এক এক মিনিটে হাজার হাজার বাচ্চা জন্মাছে। তোমাকে এমন একটি যোনিতে ভরে দিতে পারি, পরের জন্মটায় তুমি হবে বিকলাঙ্ক, দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, ক্ষতবিক্ষত, জর্জরিত।’
‘থামলেন কেন প্রভু! এর সঙ্গে একটু হাসি যোগ করুন, হা: হা: করে। যাত্রার নায়করা তাই করেন। আরে মশাই আর একবার যেই জন্মাব, এই-জন্মের কিছুই মনে থাকবে? কিচ্ছু মনে থাকবে না। কাকে শাস্তি দেবেন? উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। লে হালুয়া। আমার ওই বউবাজার পাড়ার ভাষায় বলি—কিস্যু করতে পারবি না রে।’
আবার বলি, আবার পাঁটা বলি। এই তো মরে ভূত হয়ে এসেছিস, ভুলতে পেরেছিস গাধা। ঠিক সেইরকম, আবার যেই জন্মাবি, তোর কানের কাছে সবাই বলতে থাকবে, আহা পূর্বজন্মের ফল। তখন তুই আর কেঁদে কুল পাবি না। ধর এমন করে দিলুম, পুলিসের হাতে ধরা পড়ে গেলি। সোজা লালবাজার, তারপর সেই থার্ড ডিগ্রি। তিলে, তিলে, তিলে…
আমি গেয়ে উঠলুম—‘পিলে, পিলে, পিলে হরিনামকা পেয়ালা।’
আরে এ ব্যাটা গান গায় যে রে!’
‘এবার নাচব, ক্যালকাটার বিসর্জনের নাচ, ঢ্যাম কুড়কুড়। প্রভু এতবার এত যোনিতে জন্মেছি আর মরেছি আর ভুগেছি আর ভুগিয়েছি ভয় আর পাই না মালিক।’
‘তোমাকে আমি নেড়িকুত্তা করে দোব।’
‘অশিক্ষিত, অবৈজ্ঞানিক কথা বলবেন না। লোকে আর মানবে না। ভাববে কালোয়ার। পয়সা আছে কালচার নেই। ডারউইন সাহেব প্রমাণ করে দিয়েছেন, মানুষ থেকে কুকুর সম্ভব নয়। বিবর্তনের ধাপে একবার ওপরে উঠে গেলে ঈশ্বরের বাপের ক্ষমতা নেই টেনে নামায়। আইন ইজ আইন। বিজ্ঞান ইজ বিজ্ঞান। কী আবোল তাবোল বকছেন। আধুনিক উন্নতির খবর না রাখলে যেমন ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না, সেইরকম আধুনিক খবর না রাখলে যম হওয়া যায় না। কলকাতার পুলিশ কি বলছে জানেন, বলছে অপরাধীরা ক্রমশই আধুনিক শিক্ষিত অপরাধী হয়ে উঠছে, তাদের ঠেকাতে গেলে পুলিশকেও আধুনিক হতে হবে। এ সেই গেঁয়ো সেঁদেল চোর নয়, যে পেটালেই শায়েস্তা। সেই রকম মডার্ন মালেরা মরে মডার্ন আত্মা হয়ে আসছে, তাদের আনসান বলবেন না প্রভু। প্রেস্টিজ ঢিলে হয়ে যাবে। মরে মানুষ আর আগের মতো সুখ পাবে না। ভাববেই না যমে মেরেছে, বলবে কুচো মাস্তানে ব্লেড মেরেছে। মৃত্যুর একটা গ্ল্যামার আছে। ডোন্ট ফরগেট।’
‘তোর ধমক ধামক শুনতে মন্দ লাগছে না রে। আচ্ছা কী আছে কী নেই, কে আছে, কে নেই এই সব মানুষী বিচার ছেড়ে তোর জীবনকাহিনি শোনা। মজা করে শুনি। বুঝলি ম্যাড়া এখানে যারা আসে সকলেই সেই একইভাবে মরে আসে। ভুগে মরে, পড়ে মরে, চাপা পড়ে মরে, গুলি মেরে মরে, গুলি খেয়ে মরে, না খেয়ে মরে, অশান্তি করে মরে, অশান্তি করে মারে। সব, সব এক কেস। তুই তবু যা হয় একটা নতুন কিছু করেছিস। চিত্র কি করেছে ছোকরা?’
‘প্রভু! চুমু খেয়ে মরেছে।’
‘আঃ দারুণ দারুণ। বল রে ছোকরা!’
আমি বিয়ে করলুম। যে-সে বিয়ে নয়। প্রেম করে। আমি যে জেনারেশানের ছেলে সেই জেনারেশানে প্রেম খুব পপুলার।’
‘তুমি কি ভগবৎ প্রেম, জীবের প্রেম, এইসব বোঝাতে চাইছ?’
‘আপনার মাথা। প্রেম মানে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের টুংটাং।’
‘টুংটাং মানে?’
‘আকাশবাণীর বিজ্ঞাপন প্রোগ্রাম। সারাদিন, সারারাত বেজেই চলে টুংটাং। প্রভু, প্রেমে একটা ছেলে চাই, একটা মেয়ে চাই, সাড়ে তিন ঘণ্টার একটা হিন্দি ছবি চাই আর এক ঠোঙা চীনাবাদাম চাই। যেমন আপনার চাষের জন্যে চাই মাটি, জল, সার বীজ।’
‘ছোকরা, এ কী শিখতে হয়?’
‘অবশ্যই। পৃথিবীতে অশিক্ষিতের যুগ শেষ হয়ে গেছে। নরুণ দিয়ে ছানি অপারেশানের যুগ চলে গেছে।’
‘কীভাবে শিখবে?’
‘প্রথম শিক্ষক হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি মেল, ফিমেল আলাদা করে সৃষ্টির আদি থেকেই এক বদমাইশি করে বসে আছেন। এই হাফ আর ওই হাফ মিলে হবে ওয়ান। এক। একমেবাদ্বিতীয়ম। ঈশ্বরই শুধু পূর্ণ, এক আর অখন্ড। জীবজগতের বাকি সব হাফ। আবার কীরকম হাফ। এই হাফ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে ওই হাফের জন্যে ওই হাফ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে এই হাফের জন্যে। ও আর শিখতে হয় না। যেই না জ্ঞান হল অমনি কবির ভাষায়, মন উড়ু উড়ু, প্রাণ উচাটন। আমার যেন কী নেই, কী নেই, কি একটা নেই। খালি খালি, ফাঁকা ফাঁকা। পাগল, ছাগল, রাজা উজির, ফকির কাউকে বলে দিতে হয় না, কি নেই। সবাই জানে আমার হাফটা নেই। সেই হাফটা কোথায় আছে? আছে বারান্দায় এলোচুলে, আছে জানালার পাশে উদাস চোখে, আছে অফিসে গালে হাত দিয়ে, আছে দাদার বিয়ের বাসরঘরে, আছে বন্ধুর বোন হয়ে, আছে ট্রেনের সহযাত্রী হয়, আছে কলেজে সহপাঠী হয়ে। তারপর প্রভু, চোখে চোখে কথা হয়। হাফে হাফ হাত ধরাধরি করে চলে যায় পার্কে, রেস্তরাঁয়, তারপর একদিন সিনেমায়। সেইখানেই লাভ হয় প্রেমের গভীর জ্ঞান। প্রেমের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস! ওদিকে রাজ কাপুর, শক্তি সামন্ত, দেবানন্দ, সিপ্পি, সত্যম শিবম সুন্দরম। লাস্যময়ী, মোহময়ী, ম্যাগনাম মায়াবী ধিনিকেষ্ট হয়ে নিতম্বে টপস্পিন মারছেন, স্তন দুটি যেন আন্দামানের ঝুনো নারকেল, সেই সঙ্গে মিউজিক। নায়কে নায়িকায় জড়াজড়ি, মারামারি। পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনি—পেয়ার আ রাহি হ্যায়। সেনসার বোর্ড পর্দায় চুম্বন ফ্রি করে দিয়েছেন। দক্ষিণী সেক্সবম্বকে মেরিন ড্রাইভের সিবিচে স্বল্প বস্ত্রে পারলে কৌপিন পরিয়ে চেপে ধরো, আর গুড়ুম গুড়ুম গানের তালে তালে কুসুম কুসুম হামি খেয়ে যাও।
আর এদিকে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি টু হাফ। কোণের দিকে দেওয়াল ঘেঁষে ফিমেল হাফ, তার পাশে মেল হাফ। হাতে-নাতে প্রেম। এইরকম জোড়া জোড়া, জোড়া জোড়া। কিশোর কিশোরী জোড় থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বৃদ্ধা জোড়। ছাত্র-ছাত্রী, সামনে প্রিন্সিপ্যাল-ছাত্রী। যতরকম কম্বিনেশান আপনি ভাবতে পারেন সবই তৈরি হচ্ছে এই রাজকাপুর ওয়ার্কশপে—গঙ্গা মাইয়া তোহে পিয়ারী চাইব।
এই সিনেমা হাউসের হাফপে ভায়া ম্যারেজ-রেজিষ্ট্রার ঘরে তুললেই হয়ে গেল বেটার হাফ। মাঝে মাঝে হাফে হাফে প্রেমাবেগে ফুল, কখনও হাফে হাফে ঠোকাঠুকি হয়ে পাউডার। প্রভু একেবারে ব্রহ্ম লীলা। তিনি এক, তিনি বহু। সৃষ্টি তাঁর লীলা। সম্বরণ তার ভাব। প্রেম লীলায় ওই বছর খানেক স্বামী-স্ত্রী দুঁহু দোঁহাঁর। তারপরই ঠুকঠাক হাতুড়ি ঠোকাঠুকি।
আর প্রভু তৃতীয় শিক্ষক হল বিজ্ঞাপন। জাঙ্গিয়া অর বুক খোলা জামা পরে মোটর গাড়ির সামনে কীভাবে দাঁড়ালে সুন্দরী ঢলে এসে টলে পড়বে গায়ে বিজ্ঞাপনই তা শেখায়। বিজ্ঞাপনই শেখায় কোন ব্রা সহজভাবে শরীর থেকে উৎপাটিত করা যায়। গোল হয়ে ঘুরে যায় সামনে থেকে পেছনে। আমাদের দেশে এখন দুটো টেকনোলজি চলছে স্যার, ‘ব্রা-টেকনোলজি’ আর ‘জাঙ্গিয়া-টেকনোলজি’। বিজ্ঞাপন শেখায় প্রেমের সঙ্গে আফটার শেভিং লোশানের কি সাংঘাতিক যোগাযোগ। কি অদ্ভুত সম্পর্ক সিগারেটে আর প্রেমে। একটা সোনালি ঘড়ি, একটা সোনালি কলম, একটা রুপোলী রেকাব ফুলদানি, দেয়ালে বিলিতি ঘোড়ার ছবি। সোফা। সরু আঙুল। ঝলসানো হীরের আংটি। সিগারেট পুড়ছে অ্যাশট্রেতে। ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। একটি মুখ ঝুঁকে আছে আর একটি মুখের ওপরে। প্রভু পৃথিবীর সর্বত্র প্রেম। প্রেমের জন্যে ব্লেড। প্রেমের জন্যে সাবান। প্রেমের জন্যে টুথপেস্ট। প্রেমের জন্যে জুতোর কালি। প্রভু সবই প্রেমের জন্যে। প্রেমের ছুরি চলছে গলায় গলায়। রাইভ্যাল মারছে রাইভ্যালকে। ঈশ্বরকে ভালোবেসে। মেয়েমানুষকে ভালোবেসে। পার্টিকে ভালোবেসেই সব হচ্ছে প্রভু। বউ পুড়ছে। স্বামী ঝুলছে। দেশনেত্রী গুলিবিদ্ধ!
প্রভু প্রথম প্রেমে চুমু ছিল না। অনেকটা গেলাম, দেখলাম, জয় করলাম গোছের ব্যাপার। দোকানে ঢুকলাম, ধূপ, ধূপদানি, হাতের কাজ এইসব কিনলুম। মেয়েটি ক্যাশমেমো লিখছে সামনে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে, ঘাড় হেঁট করে। আমি দেখছি। ঘাড় দেখছি, খোঁপা দেখছি। পিঠের খোলা অংশ দেখছি। ব্রেসিয়ারের ফিতে দেখছি। চোখে ঘোর লাগছে। মনে নেশা। গুন গুন গাইছি বড় নেশাতে পড়েছি, শ্যামের বাঁশিতে।
মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল। এই নিন বলে ক্যাশমেমোটা আমার হাতে দিল। আমি হাসলুম। মেয়েটি হাসল। আঙুলে আঙুলে ঠেকল। আমি আবার হাসলুম। মেয়েটি আবার হাসল। আমি আবার ধূপ কিনলুম। আবার সে ক্যাশমেমো লিখতে শুরু করল। আর আমি…।’
যমরাজ হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, আর বলতে হবে না। তুমি ঘাড় দেখলে, খোঁপা দেখলে, পিঠ দেখলে, ব্রেসিয়ারের ফিতে দেখলে।’
‘হ্যাঁ প্রভু।’
‘তা ওই সব দেখে তোমার কি এমন লাভ হল? ওই-সব দেখলে কী হয়।’
‘আপনি আর কী বুঝবেন প্রভু! মানুষ হলে বুঝতেন। ভেতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় মরে গেছি। মনে হয় বেঁচে আছি। মনে হয় বাতাসে উড়ছি। মনে হয় মহাশূন্য থেকে পড়ে যাচ্ছি চিৎপটাং হয়ে। সে এক, সে এক বিশ্রী ব্যাপার প্রভু। এরই নাম প্রেম। এরই নাম প্রেম।’
‘যাক ও তোমাদের দেহের ব্যাপার।’
‘দেহের ব্যাপার নয় প্রভু। পুরোপুরি মনের ব্যাপার। আগে তো মনেই ধরে। শেষে দেহ ধরে নেমে আসে। প্রেম থেকে কাম, কাম থেকে প্রেম নয় প্রভু।’
‘বেশ বাবা বেশ। তোর সঙ্গে তর্ক আর আমার ভালো লাগে না। তোর গপ্পোটা বল।’
তা প্রভু। দশবারে দশ প্যাকেট ধূপ কেনার পর, মেয়েটি ক্লান্ত করুণ মুখে বললে, ‘আর না। বুঝতে পেরেছি। আপনি হায়েস্ট। তিন থেকে চার প্যাকেটের পর আর কেউ এগোতে পারে না। আপনি দশ। ম্যাকসিমাম। কাল বিকেলে আসুন।’
সেই বিকেল। তারপর, কত বিকেল, কত সকাল, কত সন্ধ্যে কত রাত!
‘তার মানে জিনিসটা জমে গেল।’
‘হ্যাঁ অবাক কান্ড। মেয়েটি আমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করল না। মোগলাই, মাটন দোপিঁয়াজি, ফিশ-ফ্রাই ছাড়া কথাই বলে না। কুট কুট খায়। টুক টুক কথা বলে। ফিক ফিক হাসে। প্রভু প্রায় দেউলে হবার দাখিল। প্রেমে যা খরচ! অসম্ভব খরচ! চড়া দামে সিনেমার টিকিট। ট্যাকসি। শেষে অনেক ভেবে ঠিক করলুম, বিয়ে। প্রেমের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা, মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলা। প্রভু এখনও পশ্চিমবাংলায় রোজ দশ টাকা, বাজার করলে দু-জনের সংসার হেসে খেলে চলে যায়। আর সন্ধ্যেবেলা রেস্তরাঁয় বসলে এক দমকায় কুড়ি। তারপর প্রভু বউকে বাসে চাপানো যায়, ট্রামে চাপানো যায়, ঠেলায় চাপানো যায় প্রেমিকাকে ট্যাক্সি ছাড়া আর নিজের কাঁধে ছাড়া কোথাও চাপানো যায় না।’
‘কেন রে?’
‘আঃ প্রভু! আপনি একেবারে নাদান। বউকে ঘরে পাচ্ছেন আর প্রেমিকাকে ট্যাক্সির পেছনের সিটের অন্ধকারে ছাড়া আর কোথায় পাবেন প্রভু! এমন নিবিড় করে, জম্পেস করে।’
‘বুঝেছি বুঝেছি। এখানকার আবহাওয়া আর কদর্য করিসনি। তুই যেন ব্যাটা আধুনিক বাংলা উপন্যাস লেখক। সোজা কথায় ছোটো করে গল্প বলতে পারিস না। অত সময় নষ্ট করিস কেন?’
‘প্রভু ধরেছেন ঠিক। হিন্দি ছবি আর বাংলা উপন্যাস একটু গায়ে গতরে না হলে পাবলিকের মন ভরে না। তবে আমি নিজে খুব চালাক। যত মোটা উপন্যাসই হোক না কেন আধ ঘণ্টায় ফিনিশ। ঠিক জায়গা মাফিক পড়ে ফেলে দোব। প্রভু মুরগির তো কত পালক, আর রোস্ট, এই এতটুকু। শুধু বাংলা কেন, সব দেশের সব ভাষার উপন্যাসই আজকাল মুরগির মতো। রোস্ট করে পড়তে হয়। আর হিন্দি ছবি। হিন্দি ছবি আমার কাছে জব্দ। হঠাৎ উঠে বাইরে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে এলুম সেলুনে। ফিরে এসে একটু দেখলুম। টুক করে উঠে গেলুম। পাশাপাশি এক পাওনাদার ছিল একটু তেলিয়ে এলুম, চাঁদনি থেকে একটা তালা কিনে আনলুম। ব্যস, তিন ঘণ্টার বই তিরিশ মিনিট দেখলুম ক্ষেপে ক্ষেপে।’
‘দেখেছিস? তুই কীরকম ধান ভানতে শিবের গীত গাস। তোর আসল গল্পটা বল গাধা।’
তা প্রভু মেয়েটি বললে, ‘বিয়ে? বিয়ে করলে আমার সংসার যে অচল হয়ে যাবে।’
‘তুমি তো তাহলে জীবনে বিয়ে করতে পারবে না?’ আমি বললুম।
‘কেন পারব না?’
‘প্রথমে তোমার মা যাবেন, তারপর তোমার বাবা। তারপর তোমার ভায়ের চাকরি। তারপর তার বিয়ে, তারপর তোমার বিয়ে। তখন আর বিয়ে করার কী মানে হয়।
মেয়েরা তো কম চালাক নয়! বললে, ‘আমরা এখন রেজিস্ট্রি করে রাখি। সপ্তাহে একটা দিন, ধরো রোববার সকাল থেকে রাত নটা অবধি আমরা দু-জনে একসঙ্গে থাকব। এইভাবে চলুক। তারপর ভগবান মুখ তুলে চাইলে।’
‘ভগবান কী রে? বল, আমি মুখ তুলে চাইলে।’ যমরাজ বিজ্ঞের মতো হাসলেন।
‘আমাদের দেশে যমে ভগবানে এক করে ফেলেছি। তা আমি বললুম, রোববার সারাদিন আমরা একসঙ্গে কোথায় থাকব?’
‘কেন তোমার বাড়িতে!’
‘মেরে হালুয়া করে দেবে। শোবার ঘরে তোমাকে নিয়ে দরজা দিলে, সেই দিনই বাড়ির লোক মস্তান ভাড়া করে দূর করে দেবে।’
‘তা হলে ধরো পার্কে, গঙ্গার ধারে।’
‘এ কী গোরুর প্রেম! সারাদিন মাঠে-ময়দানে দু-জনে চরব আর ঘ্যাস ঘ্যাস খাব আর মাঝে মাঝে গালে গাল ঘষব আর ফুকরে উঠব হাম্বা! শোনো পার্টটাইম বিয়ে হয় না। বিয়ে হল ফুলটাইম ব্যাপার। দু-দিন তোমাকে ভাববার সময় দিলুম। তুমি না বললে, আবার আমাকে লড়তে হবে। দু’দিন পরে দেখা হতেই বললে, ‘রাজি অন কন্ডিশান।’
‘কী কন্ডিশান?’
‘ওর মাইনের টাকা যাবে ওর মায়ের কাছে। আর আমার মাইনের টাকায় সংসার চলবে।’
একটু দমে গেলুম প্রভু। ভেবেছিলুম দু-জনের রোজগার এক করে বেশ আরামে ইলিশ-মিলিশ খাব। সিনেমা, থিয়েটার। জীবনের ফোয়ারা খুলে দেব। ভেসে যায় ভাসিয়ে নে যায়।
আমি আবার সাতদিন সময় নিলুম। আমার সেই প্রেমিকা বললে, ‘এ কেমন প্রেম? তুমি গুরু আমাকে ভালোবেসেছিলে না আমার রোজগারকে?’ আমি বললুম, ‘টোটাল তোমাকে। ফুলগাছ মানে কী? ফুল আর গাছ। ফুলটা রামের, গাছটা শ্যামের, এমনকী হয় গুরু! আমি আম গাছের গোড়ায় জল ঢালব আর আমের সিজিনে আম খেয়ে যাবে জাম্বুবানে! কেন, তুমি আমাকে ভালোবেসে, খোল নলচে-সমেত চলে আসতে পারছ না! এ কি রে ভাই! এ কেমন প্রেম! খোল আমার কাছে, নলচে তোমার মায়ের কাছে! আমি তামাক সেজে মরি আর তেনারা গুড়ুক গুড়ুক খেয়ে যান।’
সে বললে, ‘অমানুষের মতো কথা বোলো না। বৃদ্ধ পিতা-মাতার কথা চিন্তা করতে হয়। তাঁরাই আমাদের দয়া করে পৃথিবীতে এনেছেন।’
‘তোমার পিতা-মাতা আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন? কি বলছ সুলেখা। শুনেছি গোরু হারালে মানুষ বউকে ভাই বলে। তোমার কি এঁড়ে হারিয়েছে!’
‘আমি যার যার তার তার বাবা-মায়ের কথা বলছি। হিজ হিজ হুজ হুজ।’
‘তাহলে তোমার বাবা-মায়ের কথা আমরা ভাবতে যাব কেন?’
‘তুমি না ভাবো, আমাকে ভাবতে হবে।’
‘বা:, বিয়ের পর আমার বাবা-মাই তো তোমার বাবা মা হবেন!’
‘বিয়ের পর তো আমার বাবা-মা তোমার বাবা মা হবেন, তাহলে তোমার রোজগারে এ-সংসার আর আমার রোজগারে ও-সংসার চলুক। ক্রস হয়ে যাক।’
সাতদিন ধরে ভাবলুম। প্রেম অ্যায়সা জিনিস! ওই জন্যে আমরা সেই গান গাই না! পিরিতি কাঁঠালের আঁঠা। ধরলে পরে আর ছাড়ে না। চোখ বুজেই চোখের সামনে দেখি…’
যমরাজ হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘বুঝেছি বুঝেছি—সেই ঘাড়, সেই খোঁপা, সেই পিঠ, সেই কিসের যেন ফিতে।’
‘হ্যাঁ, মহারাজ, ঠিক ধরেছেন। সেই সব টুকিটাকি সর্বনেশে চিত্তচাঞ্চল্যকারী ব্যাপার স্যাপার একেবারে পাগল পাগল করে দিলে। কাছে পাব না, পাব না কাছে, সারা রাত ঘরে পায়চারি করি। মাথা কাটা মামদো ভূতের মতো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই। চোখ গর্তে ঢুকে গেল। গাল ভেঙে গেল। এলোমেলো চুল। বদহজম, চোঁয়া ঢেকুর। সবাই ধরে ফেলল ব্যাটা প্রেমে পড়েছে। প্রবীণরা বললেন, ‘পাঁচন খাওয়াও। প্রেমের পাঁচন হলো মুড়ো ঝ্যাঁটা।
শেষে এক মহাকান্ড, লন্ডভন্ড কান্ড। বউদির বোন এল শোলাপুর থেকে। পশ্চিমবাংলায় বেড়াতে। আহা সে কি রূপ! আমার গর্তে ঢোকা গুলি গুলি চোখ, ঠেলে বেরিয়ে এল। এইরকম চওড়া চওড়া ডুরে টানা, সিল্কের চিকন শাড়ি। ঘটের মতো টেরিফিক নিতম্ব। সে কী বক্ষদেশ প্রভু। কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে। আপনাদের ওই ঈশ্বরকে বলবেন প্রভু, তাঁর প্রোডাকশান লাইন থেকে মাঝে মাঝে বেশ ভালো ভালো মাস্টারপিস বেরিয়ে আসে।’
‘যাই বেরোক সব আমার এই থাবায়। খেপলা জালে মাছ ধরার মতো এই ফেলব আর তুলব।’ যমরাজ হাত নেড়ে জাল ফেলার ভঙ্গি করলেন।
‘প্রভু সেই মালিনীকে তুলে আনতে পারেন।’
‘কে মালিনী?’
‘ওই যে শোলাপুরী ডুরে শাড়ি। তুলে আনুন না প্রভু। ভীষণ লোনলি ফিল করছি।’
‘সময় না হলে আনি কী করে। যদ্দিন জীবনের স্প্রিঙে দম আছে, তদ্দিন চলবে ঘড়ি টিকটিক। হ্যাঁ তারপর!’
‘তারপর আমার প্রেমের প্রবাহ ঘুরে গেল। আমার ডালে এসে বসেছে ভিনদেশী এক বুলবুল। সে কি শিস তার। সে কী নৃত্য শোলা থা জলভুজা, হাওয়া এ। মেহেদী হাসানের গজলের মতো সুন্দরী ঘুরছে, এ-ঘর, ও-ঘর, বারান্দা, ছাদ। সেই প্রথম আমার অনুভূতি হল প্রভু, মানুষের ভেতর থেকে ভেতরটা বেরিয়ে আসতে পারে তেমন আকর্ষণে। ঈশ্বরের প্রেমে সাধক বেরিয়ে আসে। মানবীর প্রেমে বেরিয়ে আসে মানব। আমার খোল থেকে আমার আমিটা হঠাৎ খট করে বেরিয়ে গেল। চেপেচুপেও ধরে রাখতে পারলাম না। সে দেখি,
সে দেখি কখনো আঁচল হয়ে
দুলছে তার কোমরের কাছে
নিতম্ব ছুঁয়ে।
কখনো অচেতন নেশার ঘোরে
দুই পাহাড়ের সঙ্কীর্ণ সঙ্কটে
সোনার লকেট।
কখনো সে বেড়াল ছানা
ঘুরছে পায়ে পায়ে।
সে যেন কোরামিন, ভিটামিন ফোর্ট
আমার ফোর্টে কামানের গোলা।
আমার এল্ডার ব্রাদার দেখলুম ভুল বকতে শুরু করেছে। চোখ দুটো সব সময় ফ্যালফেলে। সারা মুখে দাড়ি কামাবার সাবান মেখে, দাড়ি না কামিয়ে টুথব্রাস দিয়ে দাঁত মাজছে। ভাতে ডালের বদলে জল ঢালছে। পাজামা ভেবে শায়া পরছে। আর বৌদি কেবল আনাচে-কানাচে গুজ গুজ করে যাচ্ছে, কবে যে আপদ বিদায় হবে। প্রভু সুন্দরী, বেপরোয়া মহিলারা এক ধরনের ভাইরাস। বড়ো ছোঁয়াচে। ওষুধ নেই। মায়ের দয়ার মতো, সুন্দরীর দয়া। একবার আক্রান্ত হলে, নিজে থেকে ছেড়ে না দিলে, ছাড়ান পাবার উপায় নেই।
এদিকে সেই সুন্দরী, শোলাপুরী, মালিনী বেশ খেলা পেয়ে গেল। বেড়াল শিকারকে আধমরা করে থাবা দিয়ে উলটেপালটে খেলতে ভালোবাসে। মালিনী দুটো পুরুষকে কচ্ছপের মতো উলটে চিত করে দিলে। দাদার তো সব লক্ষণই ফুটে উঠল, স্বেদ, কম্প, মূর্ছা, দীর্ঘশ্বাস, বৈরাগ্য। আমি একদিন দশটাকা ধার চাইতে গেলুম। পকেট থেকে একটা এক-শো টাকার নোট বের করে দিল।
এ কি? এ তো এক-শো টাকা!
‘যা যা নিয়ে যা। তোর যা ভালো লাগে, সব, সব নিয়ে যা। বউদি, ফউদি সব নিয়ে যা। আমাকে একটু একা থাকতে দে।’
হাতে কোন এক ছবির শ্রেষ্ঠ কবিতা। বিজ বিজ করে কীসব আওড়ে চলেছে।
বউদি তেড়ে এল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
চোখ উলটে বললে, ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা।’
‘আমি মিথ্যা?’
‘হ্যাঁ তুমি মিথ্যা।’
‘মাঝরাতেও আমি মিথ্যা?’
‘আপাতত তাই মনে হচ্ছে।’
‘ওই যে বাথরুমে মালিনী গান গাইছে। ও মিথ্যা?’
দাদা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, বোকা গাধার মতো।
প্রভু এও বুঝলুম, নারী আর ঈশ্বর এক।’
যমরাজ বললেন ‘সে আবার কী?’
‘খুব সোজা অঙ্ক মহারাজ। ঈশ্বর ছলনাময়। আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে চোখে দেখেননি। তাঁর সৃষ্ট রূপময় জগৎ আমাদের মোহিত করে রেখেছে। হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর করে শেষে একদিন চিতায়। বউদিও সুন্দরী। যেহেতু বউদি দাদার খাটে একবার চড়েছে, বউদি বউ হয়ে নিজের আখের নষ্ট করে বসে আছে। বউদি বেঁচে থাকতে দাদা মালিনীর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। মুড়ো ঝাঁটা খেয়ে টেটভ্যাক নিতে হবে। তাই দাদার কাছে মালিনী আর ঈশ্বর এক। তাই দাদা বলতে পারছে, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। প্রভু! এই না-পাওয়াটাই ঈশ্বর। সুন্দরী যুবতীকে সহজে পাওয়া যায় না। সুন্দরী যুবতী তাই ঈশ্বর।’
যমরাজ হুঁ-হুঁ করে হাসলেন, সমঝদারের হাসি। তারপর বললেন, ‘পাগলা’ কার সঙ্গে কী? কোথায় কাঁচকলা আর কোথায় পেঁয়াজ! গাধা কোথাকার। বেশি জ্ঞানের কথা না বলে, তোর জীবন-কাহিনি বল।’
‘মহারাজ, গল্পে একটু নীতিবাক্য না থাকলে গল্পের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই মাঝে মাঝে একটু ফোড়ন মতো দিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা এর পর কী হল শুনুন। সংসারে যখন এইরকম একটা ভয়ঙ্কর টেনসান চলেছে, বউদি তোলো হাঁড়ির মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি আর আমার দাদা ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা ভাবে প্রায় অচল-অটল হতে চলেছি, সেই সময় একদিন ঘরে ঢুকে দেখি আমারই বিছানায় মালিনী পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সামান্য ফোঁসর ফোঁসর শব্দ। দাঁড়িয়ে থাকা মালিনী, চলে ফিরে বেড়ানো মালিনীকে দেখেই আমার হু-হু ব্রোমা ভেকানসি খুঁজছি, আর চোখের সামনে ও-পাশ ফিরে শুয়ে থাকা মালিনী। হৃদয়টা যেন পুরোনো খাটের মতো মচমচ করে উঠল। সময়টা সন্ধ্যে সন্ধ্যে। বউদি বাথরুমে। দেয়ালে গোটা দুই টিকটিকি ছাড়া আর কোনও প্রহরী নেই। পা টিপে টিপে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম।’
যমরাজ প্রশ্ন করলেন, ‘মনে অসদিচ্ছা!’
‘না মহারাজ, একটা ভয় ভয় অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব। যেন ‘সাউথ কল’ বেয়ে এভারেস্টের মাথায় উঠতে চলেছি। বুক ঢিপ ঢিপ। মালিনী চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। অমন একটা পাকা যুবতীয় মুখ আঁচল চাপা পড়লে, কী ভয়ঙ্কর হয় আপনার ধারণা আছে প্রভু?’
‘না। ওসব ব্যাপারে আমি একেবারে গোলা।’
মালিনীর পিঠে একটা আঙুল ঠেকাতেই তড়াক করে ঘুরে গেল। মুখের আঁচল সরে গেল। ভিজে পদ্মর মতো দুটো চোখ। ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল। আমি চেপে শুইয়ে দিলুম।
কি হয়েছে মালিনী?
মালিনী বললে, ‘কালই আমি চলে যাব। আর কোনো দিনও আসব না এ বাড়িতে।’
কান্না জড়ানো চাপা গলা। প্রভু, নরম তুলতুলে কোনো মেয়েকে জীবনে দু-হাতে চেপে ধরে দেখেছেন, কেমন লাগে? ওসব আপনাদের স্বর্গের কেঠো অপ্সরা ফপ্সরা নয়। পৃথিবীর যুবতী মেয়ে। মাটিতে যাদের অভ্যুত্থান, মাটিতেই যাদের লয়!’
যমরাজ জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, ‘কেমন লাগে রে!’
‘এই ধরুন যেন ক্ষীর-সাগরে ডুবে যাচ্ছেন, না ঠিক হল না, যেন ফুলের বিছানায় হারিয়ে যাচ্ছেন, না হল না, যেন ঈষদুষ্ণ আইসক্রীমে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন, না তাও হল না, যেন আপনার জ্যান্ত কবর হচ্ছে। না: ও আপনাকে ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। ইমপসিবল।’
যমরাজ বেশ উত্তেজিত। হতেই হবে। প্রেমের কাহিনি যাতে একটু দেহটেহ আছে, স্বয়ং ঈশ্বরকে টলিয়ে দেবে। যমরাজ তো কোন ছার। যমরাজ বললেন, ‘তারপর, তারপর?’
‘আমি ঝুপ করে মালিনীর পাশে বসে পড়ে, তারই আঁচল দিয়ে চোখ মোছাতে মোছাতে বললুম, ‘দিদির কথায় রাগ করতে আছে?’
আপনি বলুন, আমার কী দোষ, জামাইবাবু যদি দিদিকে ডাকতে গিয়ে আমায় ডেকে ফেলে, আমি কী করতে পারি?’
‘ঠিকই তো, ঠিকই তো। দিদি ব্রহ্মদর্শনের পর মানুষের কী অবস্থা হল, বুঝবে কী করে! দাদার চোখে তো এখন সব একাকার, দিদিতে তোমাতে কোনো প্রভেদ দেখছে না। মা ত্বং হি তারা। তুমি ঘটে, তুমি পটে, তুমি অর্ঘ্যপুটে গো মা। আমারও তো সেই একই অবস্থা সোনামণি। আমি সর্বত্র মালিনী দেখছি। আমার একপায়ে চটি, আর এক পায়ে নিউকাট। ভেতরে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না টংকার ছাড়ছে।’
মালিনীর লাল ঠোঁটে, কালিদাস যাকে বলেছেন, পঙ্কবিম্বাধরোষ্ঠী, সেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ট্যাপ ট্যাপ করছি। আর মনে মনে যুক্তি খাড়া করেছি, নিয়মও বলতে পারেন, আমার খাটে যে মেয়ে শোবে সে-ই আমার বউ। তা, আঙুল দিয়ে ঠোঁটে যখন ঠোকরাচ্ছি, কিছু যখন বলছে না, তখন প্রভু আমার কী করা উচিত?’
‘তা আমি কী বলব? সে তুই জানিস।’
‘আমার বাঁ-হাত চলে গেল মালিনীর মাথার তলায়, আমার ডান হাত তার বুকের ওপর দিয়ে ঝুলছে ও-পাশে, আমার মুখ ধীরে ধীরে ধীরে, অতি ধীরে।’
‘তারপর, তারপর?’
‘তারপর একটা শক্ত কঠিন হাত পেছন থেকে আমার জামার কলার ধরে টানছে। হিড়হিড় করে টানছে। টানতে টানতে ধপাস করে মেঝেতে। মালিনী ধড়মড়িয়ে উঠেছে, ‘কে জামাইবাবু!’
‘তারপর সেই শয়তানী মালিনী কি বললে জানেন প্রভু! বললে, ‘আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, সেই সুযোগে আমাকে, হুঁ-হুঁ কাঁদতে শুরু করল, সেই আগের কান্নাটাকে জুড়ে দিল এই সঙ্গে। প্রথমে লাথি, তারপর জুতো, তারপর চড়। জিনিসটা বেশ জমে গেল। দেখতে দেখতে আমি একটা কাকতাড়ুয়ার মতো হয়ে গেলুম। ফর্দাফাঁই অবস্থা। আমি কোনো প্রতিবাদ করলুম না। দাদাকে একটা আপার কাট, একটা লোয়ার কাট মারলে ফ্ল্যাট হয়ে যেত, কিন্তু প্রেম এমন জিনিস, মানুষকে একেবারে গাধা বানিয়ে দেয়। সেই অবস্থাতেও আমি মনে মনে গাইছি— ভালোবাসা মোরে ভিখিরি করেছে, তোমারে করেছে রানি।
এরপর দাদা মালিনীকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, মালু আমার মালু বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একেবারে জাপটে সাপটে ধরে যেন আইসক্রিম খাচ্ছে। বউদি বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে, কী হচ্ছে, কী হচ্ছে বলে, আর দাদাকে ওই অবস্থায় দেখে, প্রভু! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আমি একটা আইবুড়ো ছেলে, আমার যা সাজে, তুমি একটা বিবাহিত সংসারী, তোমার তা সাজে? দাদা কিছু ট্যাঁ ফোঁ করার আগেই যেন একটা ঘূর্ণি ঝড় বয়ে গেল। আমার মতোই ফর্দাফাঁই। দুজনে পাশাপাশি, এ বলে আয় ভাই কানাই, ও বলে আয় ভাই কানাই। আর জানলা দিয়ে প্রতিবেশীরা উঁকি মেরে মেরে হাসে। হাসে আর বলে, কেচ্ছা সব সংসারেই আছে, তবে রেখে ঢেকে। এমন হাঘরের মতো, এমন ডাকাতপড়ার মতো হে রে রে রে শব্দ করতে আছে। কে এক ডেঁপো বললে, চুপকে চুপকে।
দাদা আমার দিকে তাকায়, আমি দাদার দিকে তাকাই। শেষে আয় ভাই কানাই টিংচার আইডিন লাগাই।
মাঝরাতে আর এক কান্ড, বউদি ঝুলে পড়ল।
‘অ্যাঁ, ঝুলে পড়লো মানে?’
‘মানে গলায় বিয়ের বেনারসীর ফাঁস লাগিয়ে সড়াক করে ঝুলে পড়ল। শেষ রাতে আমি ঘরের বাইরে এসে দেখি বউদি চাঁদের আলোর মায়া সারা গায়ে মেখে ঝুলছে। আর বসন্তের উতলা দখিনা বাতাসে অল্প অল্প দুলছে। আমি বউদি গো বলে কেঁদে ফেললুম। প্রভু জীবনে সেই একবারই প্রকৃত যাকে কান্না বলে, সেই কান্না কেঁদেছিলুম। চোখের জলে বুক ভেসে গেল। অনেক থানা-পুলিস, টাকা চালাচালি হল। দাদা কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেল। মালিনী ফিরে গেল শোলাপুরে। সেখানে থেকে ছ মাস পরে একটা চিঠি এল আমার নামে, যার মোদ্দা কথা তোমাকে আমি ভালবাসি। কিন্তু প্রভু তখন আমার প্রেম শুকিয়ে গেছে। তারপর থেকে কোনো ছেলে-মেয়েকে আমি আর ভালবাসিনি। প্রভু, আমার বিচার যদি করতে হয়, তাহলে আপনি আমার বিচার করুন খুনী হিসেবে।’
‘অ্যাঁ, খুনও করেছিস?’
‘বা:, কি শুনলেন এতক্ষণ! আমি যদি মালিনীকে চুম্বন না করতুম, দাদা আমাকে ঠেঙাতে আসত না, দাদা তারপর সাপটে ধরার সুযোগ পেত না, বউদি বেরিয়ে এসে ওই অবস্থায় দাদাকে দেখতে পেত না। দেখতে না পেলে ঝুলে পড়ত না। তার মানে বউদির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।’
‘তা সেই মেয়েটার কী করলি? সেই যে ঘাড়, খোঁপা, পিঠ, ফিতে!’
‘ও, তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করিনি। একেশ্বরবাদী হয়ে ঘুরলুম কিছুদিন। হয় মালিনী, না হয় সন্ন্যাসী। মালিনী আমার প্রথম চিঠির কোনো জবাব দিলে না। দু নম্বর না। তিন নম্বর না। এক-শো চিঠি লিখলুম। মোট এক-শোখানা। ওই এক-শো চিঠিতেই যত প্রেম ছিল সব খরচ হয়ে গেল। পরে খবর পেলুম মালিনী অনেকে বড়ো বাগানের মালী হয়েছে। বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা। আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল, আমি নারীর ভজনা ছেড়ে অর্থের ভজনা শুরু করলুম। সে প্রভু আর এক গল্প। দুঃখের কথা কি জানেন, সব ছেড়ে আসতে হল। সব পড়ে রইল ওখানে।’
‘শোন, তোর কথায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি খুব। তোর বিচার তুই নিজেই কর। আবার জন্মাবি, না জন্মচক্রের বাইরে চলে যাবি, না স্বর্গেই যাবি!’
‘প্রভু, পৃথিবীর একটা ভীষণ মায়া আছে। ওই নীল আকাশ, ধূসর পাহাড়, সবুজ বনানী, নদী, ঝরনা, ছোটো ছোটো সংসার, দুঃখ-সুখ, ওই একটি দুঃখী মেয়ে, ছিপছিপে চেহারা, মায়াবী করুণ চোখ সারাদিন ক্যাশমেমো লেখে কাউন্টারে, ওপাশে দাঁড়িয়ে, বিকেলে কোনো ছেলের সঙ্গে সবুজ ঘাসের কার্পেটে বসে একটি একটি করে চীনেবাদাম ভাঙে, আর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে, অথচ অসংখ্য দায়িত্বে শৃঙ্খলিত, পরাধীনতাতেই যে মুক্তির আনন্দ খোঁজে। দিন যায়, আর দিন যায়, যৌবন মেলাতে থাকে দ্রুতগামী ঘোড়সাওয়ারের মতো। ওই সব ছোটোখাটো পাপ, মান-অভিমান, মৃত্যু, বিচ্ছেদ, বুক নেঙড়ানো শূন্যতা, স্মৃতি নিয়ে বসে থাকা জীবননদীর তীরে। কেউ আগে যায়, কেউ পরে। কত স্বপ্ন, কত কিছু ভাঙা, কিছু গড়া। চারটে দেওয়াল, একটা ছাদ, জানলায় দোলে পর্দার মতো একফালি নীল আকাশ। মায়ের বলিরেখা দগ্ধ মুখ। প্রেয়সীর রক্তিম ওষ্ঠ, কপালে কখনো স্নেহের শীর্ণ হাত, কখনো স্ত্রীর অনুরাগের কঙ্কনকিঙ্কিত সুডৌল বাহু, মধ্য রাতের হাপরে দৈহিক প্রেম, কোলজোড়া সন্তান, শ্মশান, চিতা, চাঁদছায়ার মতো দীর্ঘ তারার কাজ করা অন্ধকার আকাশ, যেখানে ভোর হয়, যেখানে রাত আসে প্রেমিকের মতো শান্ত চরণে, যেখানে সব আছে আবার কিছুই নেই, আমাকে সেই মায়াতেই আবার আবদ্ধ করে দিন। প্রভু!’
‘তথাস্তু।’
বাতাসে মিলিয়ে যেতে যেতে শুনলুম বৃদ্ধ চিত্রগুপ্ত হাঁকছেন,
‘আদালত বন্ধ। মামলা খারিজ।’