একটি হাঁসের পালক
প্রথম এল একটা ছোট ঝাঁক৷ পিংকি গুনে দেখল, চুয়ান্নটা হাঁস৷ তালতোড়ের ঝিলে তারা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নামল৷ তারপর জলের ওপর দুলতে লাগল কাগজের নৌকোর মতন৷ পিংকি খুব দুশ্চিন্তায় ছিল, কারণ জঙ্গলের পাশে বড় ঝিলটায় এইসব বিদেশি হাঁস এসে গেছে পাঁচদিন আগেই, এখানে আসছে না কেন? বড় ঝিলটায় হাঁস এলে পিংকির কী লাভ, সে তো আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ওই হাঁসেদের খেলা দেখতে পাবে না!
শান্তিনিকেতন থেকে একটু দূরে, তালতোড় গ্রামের রাস্তায় এই ঝিলটার ধারে বাড়ি বানিয়েছেন পিংকির বাবা৷ দু’বছর আগে৷ প্রায়ই কলকাতা ছেড়ে ওরা এই বাড়িতে থাকতে আসে৷ পিংকিরা কলকাতায় থাকে একটা ভাড়াবাড়িতে৷ ওরা দোতলায়৷ একতলায় আর তিনতলায় অন্য লোক৷ বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ট্রাম-বাস চলে আর ট্যাক্সি-লরি চলে অনেক রাত পর্যন্ত৷ সব সময় শব্দ আর ভিড়৷ এখানে এই বাড়ির চারপাশ কী চমৎকার ফাঁকা, সামনে এতবড় একটা ঝিল, বাগানে কতরকম ফুল৷ এখানে পিংকি ছোটাছুটি করে৷ সাইকেল চালায়, সাঁতারও প্রায় শিখে ফেলেছে৷
মুশকিল হল এবারে, পিংকির হঠাৎ জ্বর হয়ে গেল৷ ওষুধ খেয়েও জ্বরটা কমছেই না৷ তাই সে বাড়ির বাইরে যেতে পারে না, বারান্দায় বসে থাকতে হয়৷ ভোরবেলা উঠে সে দেখে টুকটুকে লাল রঙের সূর্য, সন্ধের পর দেখে একটা বিশাল বাগানের মতন আকাশ, যেখানে ফুলের মতন ফুটে আছে অসংখ্য তারা৷ কলকাতায় তো আর এসব দেখা যায় না!
পরদিন এল আরও দু’ঝাঁক হাঁস, প্রায় তিনশো-চারশো হবে৷ ঝিলের মাঝখানটা ভরে গেছে প্রায়৷ কী সুন্দর খেলা করে ওরা! কত দূর থেকে এসেছে৷ সবাই বলে, এগুলো সাইবেরিয়ার হাঁস, ওই বরফের দেশ থেকে উড়ে আসে এই গরমের দেশে৷ বাবা দূরবিন দিয়ে হাঁসগুলো ভালোভাবে লক্ষ করে দেখে বলেছেন, ঠিক সাইবেরিয়া নয়, ওরা এসেছে ইউক্রাইন নামের একটা দেশ থেকে৷ তিনি কোনও পত্রিকায় পড়েছেন যে ইউক্রাইন থেকে লক্ষ-লক্ষ হাঁস প্রত্যেক বছর ঠিক রাস্তা চিনে-চিনে আসে পশ্চিমবাংলার ঝিলে-পুকুরে৷ আকাশে তো কোনও রাস্তা নেই, তবু প্রত্যেক বছর ওরা ঠিক একই ঝিলে কী করে আসে?
পিংকি দূরবিন দিয়ে প্রত্যেকটা হাঁসকে আলাদা-আলাদা করে দেখবার চেষ্টা করে৷ সব হাঁসকেই একরকম মনে হয়৷ হাঁসেরাও বোধহয় সব মানুষকে একরকম ভাবে!
পিংকি মাকে বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘‘মা, সেই হাঁসটা এবারে আসেনি?’’
মা বলেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসেছে৷ নিশ্চয়ই এসেছে৷ কিন্তু তুই চিনবি কী করে?’’
পিংকি জিজ্ঞেস করে, ‘‘তা হলে তুমি কী করে বুঝলে সে এসেছে?’’
পিংকি নেহাত ছোট্ট মেয়ে নয়৷ তার বয়েস এগারো বছর৷ শরীরে জ্বর আছে বলে চোখ দুটো ছলছল করে৷ মা কাছে এসে পিংকির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘‘বারান্দায় হাওয়া লাগছে, ঘরে চল পিংকি! তোর বাবা তো বললেন, প্রত্যেক বছর একই হাঁসের ঝাঁক ঠিক একই ঝিলে আসে৷ কলকাতার চিড়িয়াখানার দিঘিতে যে হাঁসগুলো আসে, তারা কখনও শান্তিনিকেতনে আসবে না৷ আর এই তালতোড়ের ঝিলের হাঁস অন্য কোনও ঝিলে যাবে না৷ তোর হাঁসটা তা হলে নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে!’’
পিংকির বাবা ডাক্তার৷ কলকাতায় তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন৷ সেইজন্য প্রায়ই চলে আসেন এই বাড়িতে৷ এখানে এসেও তিনি গ্রামের লোকদের চিকিৎসা করেন বিনা পয়সায়৷ বাড়ির সামনে দিয়ে যে লোকজন যায়, হঠাৎ-হঠাৎ তাদের এক-একজনকে ডেকে বলেন, ‘এই, এই, কাছে এসো তো, দেখি, তোমার জিভ দেখি!’ পিংকির বয়েসি একটি সাঁওতাল ছেলেকে ধরে জোর করে তিনি একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিয়েছিলেন একবার, সে ছেলেটার কী কান্না! বাবা বললেন, ছেলেটার পা অনেকখানি কেটে গেছে শামুকে৷ ইঞ্জেকশান না দিলে ওর টিটেনাস হয়ে যেতে পারত!
লোকে আড়ালে তাঁকে বলে, পাগলা ডাক্তার৷ গত বছর এইরকম সময়ে তিনি একটা হাঁসের চিকিৎসা করেছিলেন৷
সেদিন ভোরবেলা কেন যেন ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পিংকির৷ তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি৷ বারান্দায় এসে দেখল, হাঁসের ঝাঁক কিসের যেন ভয় পেয়েছে৷ একসঙ্গে ঝটপটিয়ে উড়ে গিয়ে কঁক-কঁক করে ডাকছে আর গোল হয়ে ঘুরছে ওপরে৷
তারপর পিংকি দেখল, দু’জন মানুষ জাল ফেলেছে সেই ঝিলের জলে, সেই জালে আটকা পড়েছে দু-তিনটে হাঁস, তারা আর্ত চিৎকার করছে৷ লোক দুটো জালটাকে আস্তে-আস্তে টেনে আনছে পাড়ের দিকে৷
পিংকি দৌড়ে শোওয়ার ঘরে এসে ব্যাকুলভাবে বলেছিল, ‘‘বাবা, মা, ওঠো! ওঠো! দ্যাখো কারা যেন হাঁস চুরি করতে এসেছে৷’’
বাবা তড়াক করে খাট থেকে নেমে এলেন৷ তিনি পশুপাখিদের দারুণ ভালোবাসেন৷ কেউ কোনও পশুপাখিকে কষ্ট দিলে দারুণ রেগে যান৷ একবার ছোটকাকা একটা বেড়ালকে লাথি মেরেছিল বলে বাবা তার মাথার অর্ধেকটা চুল কেটে দিয়েছিলেন৷
বারান্দায় এসে তিনি ঘুমচোখে সেই ব্যাপারটা একঝলক দেখলেন৷ তারপর একটা লাঠি নিয়ে ছুটে বেরোলেন বাড়ি থেকে৷ সেবারে তো পিংকির জ্বর হয়নি৷ তাই সেও গেল বাবার সঙ্গে৷ ছোটকাকার ঘুম ভাঙেনি, কিন্তু এ-বাড়ির মালি ভগবানও ছুটল বাবুর সঙ্গে৷
চোর দুটো ততক্ষণে জাল গুটিয়ে, দু’খানা হাঁস হাতে ঝুলিয়ে রওনা হয়েছে ঝিলের দক্ষিণ পাড় দিয়ে৷ বাবা লাঠিখানা উঁচিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘‘চোর, ডাকু, বদমাশ, মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলব!’’
অন্য দু’জন ভদ্রলোক এই সময় মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন৷ তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হয়েছে ডাক্তারবাবু!’’
বাবা বললেন, ‘‘চোর৷ পাখি চুরি করে পালাচ্ছে৷ ধরুন, ধরুন!’’
সবাই মিলে তাড়া করতে চোর দুটো ঘাবড়ে গেল৷ আরও জোরে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল একজন৷ বাবা তার কাছে পৌঁছে গিয়ে লাঠিটা উঁচিয়ে বললেন, ‘‘দিই শেষ করে?’’
চোরটি হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘‘মারবেন না, বাবু, পায়ে ধরছি, ক্ষমা চাইছি৷ আর কোনওদিন এমন করব না!’’
অন্য চোরটা পাঁই-পাঁই করে পালিয়ে গেল, তার হাতে ছিল জাল৷ এই চোরটার হাতে দুটো হাঁস৷ বাবা হাঁস দুটো কেড়ে নিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘যাঃ!’’
একটা হাঁস উড়ে গেল ঝটপট করে৷ অন্য হাঁসটা ঝুপ করে পড়ল বাবার পায়ের কাছে৷ সে উড়তে পারছে না৷ বাবা সেটাকে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘ইশ, এটা যে জখম হয়ে গেছে৷ একটা পায়ের কাছে অনেকখানি কেটে গেছে, এই দ্যাখ রক্ত৷ একে তো ছেড়ে দিলে বাঁচবে না!’’
হাঁসটাকে নিয়ে বাড়ি চলে এসে বাবা পিংকিকে বললেন, ‘‘ডেটল আন৷ তুলো আন৷ আমার ওষুধের ব্যাগটাও নিয়ে আয় পিংকি!’’
মা, কাকা, আরও সবাই নেমে এসেছেন৷ বাবা তুলো দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছেন, পিংকি ধরে আছে হাঁসটা৷ একসময় সে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ডেকে উঠল৷
পিংকি আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘‘বাবা, তুমি ওকে বাঁচাতে পারবে?’’
বাবা বললেন, ‘‘চেষ্টা করে দেখি!’’
পিংকি বলল, ‘‘তুমি তো মানুষের চিকিৎসা করো৷ তুমি কি পাখিদের চিকিৎসা জানো?’’
মা হেসে উঠে বললেন, ‘‘শোনো মেয়ের কথা!’’
বাবা বললেন, ‘‘না, ও ঠিক প্রশ্নই করেছে৷ আমি কখনও পাখির চিকিৎসা করিনি৷ তবে জানিস পিংকি, বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো!’ পাখির ডাক্তার তো এখানে পাওয়া যাচ্ছে না৷’’
হাঁসটার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন বাবা৷ তারপর ছেড়ে দিতেও সে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল না৷ ভীতু-ভীতু চোখে তাকিয়ে রইল৷
বাবা বললেন, ‘‘পিংকিসোনা, তোর ওপর ওর দেখাশোনা করবার দায়িত্ব রইল৷ ওকে চোখে-চোখে রাখবি৷ দেখিস যেন কুকুরে কামড়ে না দেয়৷ দুধ-মুড়ি খায় কিনা চেষ্টা করে দ্যাখ৷ না হলে গেঁড়ি-গুগলি জোগাড় করে আনতে হবে৷’’
তারপর থেকে চার-পাঁচদিন ধরে সেই হাঁসটা হয়ে গেল পিংকির সর্বক্ষণের সঙ্গী৷ বিদেশি বুনো হাঁসের পোষ মানার কথা কেউ কখনও শোনেনি৷ কিন্তু এই হাঁসটা পিংকির পায়ে-পায়ে ঘোরে, পিংকি কোলে নিলে ঝটাপটি করে না৷ অন্য কেউ ধরতে এলে ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাবার চেষ্টা করে, কিন্তু পিংকির কাছে একেবারে চুপ৷
পিংকি ওর নাম দিয়েছিল পিপি৷
চারদিন বাদে পিপি একটু-একটু উড়তে শিখল৷ তবে পিংকি যখন ওকে এনে দোতলার বারান্দায় ছেড়ে দেয়, তখন সে উড়ে পালাবার চেষ্টা করে না৷ বারান্দা থেকে ঝিলের অন্য হাঁসদের দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে পিপি কী ভাবে কে জানে!
পিংকি বলল, ‘‘বাবা, আমি পিপিকে কলকাতায় নিয়ে যাব৷ ওকে পুষব!’’
বাবা বললেন, ‘‘ছিঃ পিংকি, ও-কথা বলতে নেই৷ বিদেশি পাখি আমাদের অতিথি৷ ওদের ধরে রাখতে নেই৷ ওই ঝাঁকের মধ্যে নিশ্চয়ই ওর মা-বাবা ভাই-বোন আছে৷ তাদের কাছ থেকে ওকে সরিয়ে রাখবি কেন?’’
আর দু’দিন পরেই পিংকিদের ফিরে যেতে হবে৷ পিপি অনেকটাই উড়তে পারে৷ এবারে ওকে ঝিলের জলে ছেড়ে দিতে হবে৷ পিংকির চোখ ছলছল করছে৷ পিপি যে ওর বন্ধু, তাকে ছেড়ে ও থাকবে কী করে?
পিংকি বলল, ‘‘বাবা, পিপির অসুখ করেছিল৷ এখান থেকে ইউক্রাইন কত হাজার মাইল দূর, সেখানে ও উড়ে যেতে পারবে?’’
বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘এখনও ওদের ফেরার কিছুদিন দেরি আছে৷ তার মধ্যে পুরোপুরি সেরে উঠবে৷ তা ছাড়া ওর দলের অন্য হাঁসরা ওকে দেখবে৷’’
পিংকি তবু বলল, ‘‘ইউক্রাইনেও কি চোর নেই? সেখানে যদি কেউ ওকে ধরে?’’
মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বাবা একটুক্ষণ চিন্তা করলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘তুই এক কাজ কর, পিংকি৷ তুই দু-লাইনের একটা ছোট্ট চিঠি লেখ৷ সেটা মুড়ে আমি ওর পায়ে আটকে দিচ্ছি৷ কেউ যদি ধরে ওকে, তা হলে বুঝতে পারবে যে পিপির একজন পিংকি নামের বন্ধু আছে৷ ‘চিঠিটা পড়ে নিশ্চয়ই ওকে ছেড়ে দেবে৷’’
পিংকি প্রথমে চিঠি লিখল বাংলায়৷ সেটা বেশ বড় হয়ে গেল৷ তা ছাড়া বিদেশিরা তো বাংলা বুঝবে না৷ সে আবার ইংরেজিতে লিখল, ‘‘প্লিজ ডোন’ট হার্ট দিস বার্ড৷ শি ইজ মাই ফ্রেন্ড৷ আই অ্যাম আ বেঙ্গলি গার্ল, মাই নেম ইজ পিংকি৷ ফর গডস সেক সেভ মাই ফ্রেন্ড৷’’
বাবা চিঠিটাকে মুড়ে সেলোটেপ দিয়ে লাগিয়ে দিলেন পিপির এক পায়ে৷ পিংকি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল৷
বিকেলবেলা ঝিলের জলে যখন সমস্ত হাঁসেরা ফিরে আসে, তখন উড়িয়ে দেওয়া হল পিপিকে৷ সে ঝাঁকে মিশে গেল, আর ফিরে এল না৷
এসব তো গত বছরের কথা৷
এ-বছরে আর পিপি ফিরে এসেছে কি না তা বোঝার উপায় নেই৷ হাঁসেরা আকাশে ওড়ে, জলে সাঁতার কাটে, একটা চিঠি আর ক’দিন আটকে থাকবে তার পায়ে? অন্য হাঁসের থেকে আলাদা করে পিপিকে চেনাও যাবে না৷
একটা হাঁসের জন্য সবসময় কাঁদো-কাঁদো মুখ করে থাকবে, পিংকি মোটেই তত ছেলেমানুষ নয়৷ কিন্তু পিংকির যে জ্বর কমছেই না, সে সাঁতার কাটতে পারছে না, সাইকেল চালাতে পারছে না, খেলতে যেতেও পারছে না৷ বিছানা ছেড়ে সে শুধু বারান্দায় এসে বসে মাঝে-মাঝে৷ আর বারান্দায় বসলেই চোখে পড়ে ঝিলের বুকে হাঁসের ঝাঁক৷ তখন তো পিপির কথা মনে পড়বেই৷ পিপি কি একেবারে ভুলে গেছে পিংকিকে? এতদূরের রাস্তা মনে রাখতে পারে, আর মানুষদের মনে রাখতে পারে না?
পিংকির জ্বর তো কমলই না, হঠাৎ আরও বেড়ে গেল৷ বাবা নিজে ডাক্তার হলেও অসুখ-বিসুখ নিয়ে বেশি চিন্তা করেন না৷ কিন্তু মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ তা হলে তো এক্ষুনি কলকাতায় ফিরে যেতে হয়৷ পিংকির রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে, এক্স-রে তুলতে হতে পারে, সেসব তো এখানে হবে না৷
কালই ফিরে যাওয়া ঠিক হল৷ রাত্তিরের দিকে জ্বরের ঘোরে পিংকি কী যেন বিড়বিড় করে বলে যেতে লাগল৷ সেসব কিন্তু ওই হাঁসটার কথা নয়, তার ইস্কুলের কথা, ইস্কুলের বন্ধুদের কথা, ছোটমাসির লেখা গল্পের বইয়ের কথা৷ পিংকির কপালে জলপট্টি দিয়ে মা বসে রইলেন পাশে৷
একবার শুধু চোখ মেলে পিংকি বলল, ‘‘আচ্ছা, মা, পিপি একবার শুধু উড়ে এসে আমাদের বারান্দায় বসলেই তো পারত! আমরা কি ওকে ধরে রাখতুম!’’
মা বললেন, ‘‘হাঁসেরা তো ঝাঁক বেঁধে ছাড়া একলা-একলা কোথাও যায় না৷ তা ছাড়া এই এক বছরে পিপি আরও বড় হয়ে গেছে৷’’
পিংকি আবার চোখ বুজল৷
অনেক রাতে তার ঘুম ভাঙল, তখন তার মা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ ঘর অন্ধকার৷ পায়ের দিকের একটা জানলা খোলা৷ পিংকির মনে হল, সেখানে একটা পাখি বসে আছে৷ তা হলে কি পিপি এসেছে শেষকালে?
পিংকি বলল, ‘‘কী রে, পিপি, এতদিনে বুঝি তোর মনে পড়ল আমাকে?’’
পাখি তো কথা বলে না, সে ঝটপটাল ডানা৷
পিংকি বলল, ‘‘একবার ভেতরে আয় না, তোকে ভালো করে দেখি!’’
আবার ডানার ঝটপটানি!
এবার পিংকি হাসল৷ জ্বর হলেও তার তো মাথা খারাপ হয়ে যায়নি৷ কোথায় পিপি, কোথায় পাখি? জানলায় কিছুই বসে নেই৷ জানলার কাছে একটা পেয়ারা গাছের ডাল বাতাসে দুলছে৷ রাত্তিরে কোনও পাখি আসে নাকি? দল-ছাড়া একলা হাঁস তো আসবেই না৷ সবই পিংকির চোখের ভুল, মনের ভুল৷ কাল কলকাতায় যাওয়া হবে, ভালোই হবে৷ তার ইস্কুলের বন্ধুরা তার সঙ্গে গল্প করতে আসবে৷
পরদিন সকালে বাঁধাছাঁদা শুরু হয়ে গেছে৷ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া হবে একটু বাদেই৷ বাথরুম থেকে তৈরি হয়ে টলমলে পায়ে বেরিয়ে এল পিংকি৷ তখনই তার চোখে পড়ল খাটের নীচে একটা পালক৷ এটা তো মনের ভুল নয়, সত্যিই পালক৷
পিংকি নিচু হয়ে পালকটা তুলে নিল৷ ধূসর রং, হাঁসের পালক হওয়াই স্বাভাবিক৷ কী করে এল এটা? রোজ ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়, কাল বিকেলেও এটা ছিল না৷
তা হলে চোখের ভুল নয়, রাত্তিরে পিপি সত্যিই এসেছিল? দলছাড়া হয়ে একা আসতে লজ্জা করে বলে পিপি এসেছিল রাত্তিরবেলা৷ চিহ্ন রেখে গেছে!
পালকটা মুখে বোলাতে লাগল পিংকি৷ পিপি বুঝিয়ে দিয়ে গেল, সে ফিরে এসেছে৷ সে বেঁচে আছে৷ এইটা বুঝেই পিংকির চোখে খুশির ধারা এসে গেল৷
এমনভাবে পিংকিকে কাঁদতে দেখলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ পালকটার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷ সবাই হাসবে৷ পিংকি পালকটাকে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রাখল নিজের বইপত্রের ঝোলায়৷
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ঝিলের দিকে তাকাল৷ এবারে অত হাঁসের মধ্যেও সে ঠিক পিপিকে চিনতে পারছে৷
—