একটি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে
মার্চ মাসের সন্ধে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস। উকলে ডিসট্রিক্টের ২৮ অ্যাভিনিউ ফ্রাংকোইস ফোলির একটি লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। সাত তলার একটা ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে উলটে পড়ে আছে ফুলদানি। কতগুলো ডাঁটিসমেত ফুল ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। একটা কালো রঙের গালচের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে এক ভদ্রলোকের লাশ। রক্ত শুকিয়ে চাপ হয়ে বসেছে গালচের ওপর। দাগ বোঝা যাচ্ছে না, কালচে রঙের গালিচায় জমাট বাঁধা রক্তের কালো দাগ, বোঝা যাবেই বা কীভাবে? ঠিক যেমন পুলিশ ধরতে পারছে না হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা আছে।
ব্রাসেলস পুলিশ শেষ অবধি একটা সিন তৈরি করতে সক্ষম হয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ভদ্রলোক নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে চাবি হাতড়াচ্ছিলেন। সন্ধে নেমে আসছিল দ্রুত। তার আগেই গণ্ডাখানেক চাবির মধ্যে থেকে আসল চাবিটা বের করে আনতে চাইছিলেন উনি।
পকেটে অতগুলো চাবি থাকার কারণ কী?
নিজের বাড়ির সুরক্ষা ব্যবস্থাটা একটু বেশিই আঁটোসাঁটো করে রেখেছিলেন ভদ্রলোক। অবশ্য করবেন না ই বা কেন? মাস কয়েক আগে, শীতকালে ওঁর বাসাতে অনুপ্রবেশ করেছিল কেউ বা কারা। না, কিছু চুরি যায়নি। যারা ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিল, তারা কেবল সমস্ত আসবাব ভেঙেচুরে রেখে গিয়েছিল, ওলটপালট করে দিয়ে গিয়েছিল হাতের সামনে পাওয়া সমস্ত জিনিস। কী অদ্ভুত, তাই না?
এ ধরনের অনুপ্রবেশ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ তবে কী ছিল?
সাবধান করা। হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোককে সাবধান করে দেওয়া।
কিন্তু কে এই ভদ্রলোক? কারাই বা সতর্ক করতে চাইছিল ওঁকে?
জেরাল্ড বুল। ডক্টর জেরাল্ড বুলকে সতর্ক করে দিতে চাইছিল কেউ বা কারা। সতর্ক হয়েও উঠেছিলেন উনি। আর তাই হাজার একটা তালা-চাবি ব্যবহার করে সিকিওর করেছিলেন বাসার দরজা। সেই চাবিই হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন নিজের কোটের পকেটে। আর সেই সময়েই পিছন দিক নিঃশব্দে এগিয়ে এল একজন ব্যক্তি। অন্ধকার থেকে তার পিছু পিছু বেরিয়ে এল আরও দুটি ছায়ামূর্তি।
প্রথম জন বলল, ‘হ্যালো ডক্টর! মে উই হেল্প ইউ?’
প্রশ্নটা শুনে অবশ্য ঘাড় ঘোরাবার সময়টুকুও পাননি ডক্টর বুল। তার আগেই সাইলেন্সার লাগানো ৭.৬৫ পিস্তল থেকে পাঁচ পাঁচটা গুলি এসে বিদ্ধ করল ডক্টরের মাথা। মাটিতে আছড়ে পড়লেন ডক্টর জেরাল্ড বুল।
১৯৯০ সালের ২২ মার্চ ডক্টর বুলের নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল একজন একনায়কের স্বপ্ন এবং এখানেই জন্ম নিল সবথেকে বড় প্রশ্ন: কে বা কারা ছিল এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে?
কেউ বলল, এমআই ৬ হত্যা করেছে বুলকে। কেউ কেউ আঙুল তুলল সিআইএ-এর দিকে। ইরান, অ্যাঙ্গোলার মতো রাষ্ট্র চলে এল সন্দেহের তালিকায়। এমন কথাও রটে গেল ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের কোপে পড়েই নিহত হয়েছেন বুল। কিন্তু এই সব কিছুর নেপথ্যে একটা নাম বার বার উঠে এসেছে— মোসাদ। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে মোসাদের উপস্থিতির কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজও মেলেনি।
এই রহস্যময়তাই পুরো ঘটনাটাকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। কারো কাছে এই গাথা জয়ের, কেউ বা শুনেছে শুধুই নিজের পরাজয়ের কাহিনি। এই পুরো ঘটনা পরম্পরাকে প্রথম থেকে না জানলে বোঝাও যাবে না।
১৯৬৫ সাল। জেরাল্ড বুল তখন বছর সাঁইত্রিশের যুবক, কানাডায় মন্ট্রিয়েলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির একজন সম্ভাবনাময় অধ্যাপক। বুলের নাম ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল একজন জিনিয়াস হিসাবে। হবে নাই বা কেন? মাত্র তেইশ বছর বয়সে কানাডার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার মতো প্রতিভাকে একটাই শব্দে সম্মান দেওয়া যেতে পারে— জিনিয়াস।
ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরির দিকে এগোচ্ছিলেন বুল। এমন সময় পিছন থেকে মহিলা কণ্ঠে কেউ ডাকলেন, ‘হ্যালো জেরাল্ড…
ফিরে তাকালেন বুল। সামনে দেখতে পেলেন এক ষাটোর্ধ্ব মহিলাকে। ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বুল বললেন, ‘হ্যালো। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?’
‘আপনি আমাকে চিনবেন না। তবে আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছি। ইউ আর জিনিয়াস জেরাল্ড!’
লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলেন বুল। মুখে বললেন, ‘লোকে ওই বলেই ডাকে। তা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাডাম?’
ভদ্রমহিলার কথার টানে ধরা পড়ছিল যে, উনি একজন জার্মান। নিজেকে পরিচয় দিলেন ফ্রিজ রউসেনবার্জারের আত্মীয়া হিসাবে।
‘রউসেনবার্জার? ফ্রম ক্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজ?’ প্রশ্নের সুরে বললেন বুল।
‘হ্যাঁ….
খানিকক্ষণ অবাক ভাবে জেরাল্ড বুল তাকিয়ে রইলেন ওই ভদ্রমহিলার দিকে। তারপর বললেন, ‘কিন্তু ম্যাডাম, আপনি আমাকে কেন খুঁজছেন?’
এরপর শুরু হল আরেক জিনিয়াসের হারানো পাণ্ডুলিপির কথা বলা। ভদ্রমহিলা নিজের পারিবারিক সূত্রে একটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট খুঁজে পেয়েছিলেন। তাতে ছিল এমন এক বন্দুকের নির্মাণ কৌশল এবং চালনার পদ্ধতি, যার সাহায্যে বহু দূরের লক্ষ্যকে ভেদ করা সম্ভব। এমনকী সম্ভব মহাকাশে রকেট প্রেরণ করাও।
সুপারগান— এক কিংবদন্তী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে মিথ হয়ে যাওয়া এই শব্দবন্ধকে নিয়ে মানুষের ভয়, আগ্রহ, কৌতূহল কোনোটারই সীমা ছিল না। আর এর সূত্রপাত হয়েছিল ১৯১৮ সালের ২৩ মার্চ। প্যারিস শহরের প্লেস ডি লা রিপাবলিকের কাছে বিধ্বংসী একটি গোলা এসে পড়ে। এক ঘণ্টা পরে আরও একটা। আট জন নিহত হলে নিদারুণ আতঙ্কে ভুগতে থাকে প্যারিসের বাসিন্দারা। সীমান্ত থেকে বেশ দূরবর্তী এলাকায় বলে প্যারিসের অধিবাসীদের মনে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কখনোই এত চিন্তা দানা বাঁধেনি। কিন্তু এবারে গল্পটা বদলে যাচ্ছিল। প্যারিস ডিসট্রিক্টের কম্যান্ডার চেলে ফেললেন শহর সংলগ্ন জঙ্গল। ওঁর ধারণা ছিল জার্মান বাহিনী লুকিয়ে থেকে এসব কাণ্ডকারখানা ঘটাচ্ছে। কিন্তু কোনো সূত্র মিলল না। কেউ কেউ বলছিল, হয়তো এয়ারশিপ বা জেপ্পেলিনে চড়ে বোমা ফেলে পালিয়েছে জার্মান সেনারা। কিন্তু কেউ তো তেমন কিছু প্রত্যক্ষ করেনি। তাই সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হল।
বিভীষিকা কিন্তু থামল না। এই ঘটনার পর ২৯ মার্চ গুড ফ্রাইডের দিনে প্যারিসের সেন্ট গারভেইস চার্চে আঘাত হানল অদৃশ্য প্রতিপক্ষ। আক্রমণের ফলাফল ছিল মারাত্মক— ৯১ জন নিহত হয় এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় কয়েকশো।
কিছুতেই কোনো সূত্র মিলল না। কল্পবিজ্ঞানের গল্পের পাতা থেকে উঠে এল এক বিশালাকার বন্দুকের থিওরি। সুপারগান! কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারল না।
যুদ্ধ সম্পাত হল। এবার বেরিয়ে আসতে লাগল নানা খুচরো কথা। জার্মানি নাকি সত্যিই সুপারগান আবিষ্কার করে ফেলেছিল এবং তার মাধ্যমেই চালিয়েছিল ওই আক্রমণ। জার্মানির সম্রাট তখন দ্বিতীয় উইলহেম। তাই লোকমুখে ওই বন্দুকের নাম দাঁড়াল ‘উইলহেম গান’। শোনা গেল, জার্মানির ক্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজই তিন তিনটি সুপারগান বানিয়েছিল। ক্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজের তৎকালীন ডিরেক্টর অব ডিজাইন ছিলেন ফ্রিজ রউসেনবার্জার। স্বাভাবিক ভাবেই সুপারগানের নকশা তাঁর আয়ত্বে ছিল। যুদ্ধ শেষ হলে ক্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে তিনটি বন্দুককে মালগাড়িতে করে গোপন কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। এক একটি বন্দুককে স্থানান্তরিত করতে ৮০ জন সৈন্য লেগেছিল বলেও জানা যায়। একটি বন্দুককে প্রতিপক্ষ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। সেটাকে নষ্ট করার সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ৫ জন সৈন্য ও নিহত হয়। বাকি দুটির হদিশ আর মেলেনি।
এখানেই থমকে যায় ‘সুপারগান পর্ব’। ১৯৬৫ সালে জেরাল্ড বুলের সঙ্গে ওই জার্মান ভদ্রমহিলার সাক্ষাৎকারের পর থেমে দাঁড়ানো সেই অধ্যায়ের চাকা আবার গড়াতে আরম্ভ করে দেয়। নিজের স্বপ্নকে পূরণের পথে এগোতে থাকেন বুল। ভদ্রমহিলার দেওয়া পাণ্ডুলিপিটাকে ভিত্তি করে লিখে ফেললেন একটা আস্ত বই। বিষয়— উইলহেম গান বা সুপারগান।
থিওরি নাহয় মিলল। এবার দরকার ছিল প্র্যাকটিকাল করে দেখার। তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল বিপুল অর্থ। ইউনাইটেড স্টেটস এবং কানাডার সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য করা হল। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ফান্ডিং পেলেন ডক্টর বুল। বার্বাডোজের কোনো একটি দ্বীপে সফল পরীক্ষা করে দেখালেন বুল। কয়েকশো শ্রমিক, এঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদদের সাহায্য নিয়ে উনি বানিয়ে ফেললেন ৩৬ মিটার লম্বা সুপারগান। ২০০ পাউন্ড ওজনের মিসাইলকে ২৫০ কিমি উচ্চতা অবধি ছোড়া বা ৪,০০০ কিমি পরিধির মধ্যে ফায়ার করতে সফল হলেন বুল। সকলে চমৎকৃত হলেন। আমেরিকার সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হল বুলকে। কিন্তু বাধ সাধল মিডিয়ায় এই সুপারগানের বহুল প্রচার। ইন্টারন্যাশনাল নিউজ হয়ে গেল। ইউএস এবং কানাডা সরকার তখন বিপদে পড়ে এই প্রোজেক্টের ফান্ডিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। বুল তখন অস্ত্রের বেআইনি কারবার আরম্ভ করেন। আমেরিকা আর ইসরায়েলের জন্য বানান আর্টিলারি শেল। লং রেঞ্জ শট নেওয়ার মতো বন্দুক বানিয়ে বিক্রি করতে থাকেন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে। বিষয়টা ইউনাইটেড নেশনসের নজরে আসে। আইনত নিষিদ্ধ একটা ব্যবসা চালানো হচ্ছে দেখে ইউএন বাধা দেয়। সিআইএ প্রথম থেকে সব কিছু জানা সত্ত্বেও ইউএন-এর বার্তা দেখা মাত্র পুরো ব্যাপারটা থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা আরম্ভ করে দিল। কিন্তু ধোঁয়া যখন উঠেছেই তখন আগুনও দেখাতে হবে। ইউনাইটেড নেশনসের চাপে পড়ে বলির পাঁঠা করা হল ডক্টর জেরাল্ড বুলকে। বুলকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে মোকদ্দমা চালাল ইউএস গভর্নমেন্ট। ছ’ মাসের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫৫,০০০ ইউএস ডলারের জরিমানা করা হল বিজ্ঞানীকে।
ভয়ানক মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন বুল। উনি চরম নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবে যেতে থাকেন। আমেরিকা ছেড়ে বুল ফিরে আসেন বেলজিয়ামে। নিজের কোম্পানি খুলে বসেন। আর স্বপ্ন দেখতে থাকেন— ‘একদিন সুপারগান বানিয়েই ছাড়ব!’
নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করার জন্য যে কোনো চরম মূল্য দিতেও উনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিকিয়ে দিতেও পিছপা ছিলেন না ডক্টর বুল। দুনিয়ায় কোনোদিনই এ ধরনের কাজের জন্য শয়তানদের অভাব ঘটেনি, এবারেও ঘটল না। বুল হাত বাড়াতেই সঙ্গী পেয়ে গেলেন ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেনকে।
সাদ্দাম হোসেন তখন মধ্যগগনের সূর্য। প্রখর তেজ, প্রবল প্রতাপ নিয়ে শাসন করে চলেছেন ইরাকের ভূমি। আটের দশকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল ইরাকের। অস্ত্রের প্রয়োজন স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। অস্ট্রিয়া থেকে ২০০ জিসি ৪৫ বন্দুক চোরাপথে জর্ডনের আকাবা বন্দরে পৌঁছে দিলেন বুল। সুবিধা পেল ইরাকি বাহিনী। আর এখান থেকেই সাদ্দামের নয়নের মণি হয়ে উঠলেন জেরাল্ড।
কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের লক্ষ্য আরও বড় ছিল। কিছু দিন আগেই ইসরায়েল ইরাকের তামুজ পরমাণু কেন্দ্রটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তাতেও হাল ছাড়েননি সাদ্দাম। ইরাককে পরমাণু শক্তিধর দেশে পরিণত করা হয়ে উঠেছিল ওঁর ধ্যান, জ্ঞান।
বুলের সঙ্গে কথোপকথন চলার পর বুল সাদ্দামকে জানালেন, ‘আমি আপনাকে সুপারগান বানিয়ে দিতে পারি। সেই সুপারগান দিয়ে আপনি যেমন মহাকাশে রকেট পাঠাতে পারবেন, তেমনই পারবেন বহু দূরের শত্রুকে মিসাইল দিয়ে আঘাত করে ধরাশায়ী করে দিতেও।’
‘ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে পারবে আপনার সুপারগান?’ জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাদ্দাম হোসেন।
‘ও তো তখন বাচ্চা ছেলের হাতের মোয়া।’
গুরুত্ব বোঝা মাত্রই বুলকে তাঁর প্রকল্পের জন্য ফান্ডিং বরাদ্দ করে দিলেন সাদ্দাম। আরম্ভ হল প্রোজেক্ট ব্যাবিলন। ঠিক হল, এবারে বন্দুকটি হবে ১৫০ মিটার দীর্ঘ। কিন্তু এত বড় প্রকল্পে নামার আগে একটা প্রোটোটাইপ বানিয়ে নিয়ে মাঠে নামতে চাইলেন বুল। আর সেই প্রোটোটাইপ বানানোর প্রকল্পের নাম দিলেন ‘বেবি ব্যাবিলন’ এবং বানিয়েও ফেললেন একটি পঁয়তাল্লিশ মিটার লম্বা বন্দুক। সাদ্দাম বুঝলেন ইরাকের মরুভূমি থেকে এবার এমন ঝড় উঠবে, যা রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়ে যাবে সমগ্র বিশ্বকে।
সুপারগান তৈরি করার জন্য দরকার ছিল বিভিন্ন ধরনের উপকরণ এবং সাজসরঞ্জামের। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের স্টিল প্লান্টে দরকার মতো স্টিল টিউবের বরাত দিল ইরাক। সেই সময়ে ইরাকের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সুসম্পর্ক ছিল না। লাগু ছিল নানা নিষেধাজ্ঞা। সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, স্পেন, হল্যান্ডের মতো প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত দেশে অর্ডার দিল ইরাক, কিন্তু প্রতিটা বরাতই পড়ল প্রতিবেশী দেশ জর্ডনের নামে। খাতায়-কলমে জর্ডনের পক্ষ থেকে বলা হল, একটি সুবিশাল পাইপলাইনের নেটওয়ার্ক বানানোর জন্যই দরকার এই টিউবগুলো।
ঘাসে মুখ দিয়ে কেউ চলে না। তাই তেল সরবরাহ করার নেটওয়ার্ক বানানোর গল্পটা সকলেই ধরে ফেলল। কিন্তু পাইপ সরবরাহকারী প্রতিটা দেশই কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখল এবং পুরো ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মাল সরবরাহ করে চুপ রয়ে গেল। একের পর এক অ্যাসাইনমেন্টে স্টিল পাইপগুলো এসে পৌঁছাতে লাগল জর্ডনে। তারপর বেশ নিরাপদেই প্রবেশ করলে ইরাকের মাটিতে।
সুপারগান কোন জায়গায় বসানো হবে তা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। পশ্চিমের একটি পাহাড়ের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে বসিয়ে লক্ষ্যবিন্দুতে রাখা হয়েছিল ইসরায়েলকে।
কাজ চলছিল জোর কদমে। আর এর মধ্যে মধ্যেই জেরাল্ড বুল উন্নত করে তুলছিলেন ইরাকের অস্ত্রভাণ্ডার। স্কুড মিসাইলকে উন্নত করার কাজটা সারছিলেন। দুটি স্বয়ংক্রিয় বন্দুক বানিয়েছিলেন। একটার নাম আল-ফাও, আরেকটার নাম আল-মজনুন। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল ইসরায়েল, কারণ খাঁড়িতে যুদ্ধ বাঁধলে উন্নত অস্ত্রের ভাণ্ডার নিয়ে ইরাক যে যথেষ্ট বেগ দিতে পারে তা বুঝতে ইসরায়েলি কর্তাদের আর কিছুই বাকি ছিল না। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল ইরানও। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ে বুলের তৈরি অস্ত্র ইরাককে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। এম আই সিক্স, সিআইএ-এর মতো গুপ্তচর সংস্থাগুলিও বুলের ওপরে নজর রেখেছিল। ইরাকের শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি নিজের শত্রুও বাড়িয়ে চলেছিলন ডক্টর জেরাল্ড বুল।
ওদিকে স্টিলের পাইপের সরবরাহ অব্যাহত ছিল। বরাত মাফিক আসতে থাকা একটি শিপমেন্টকে তুরস্কের কাস্টমস অফিসারেরা আটকাল। সেই অফিসারদের মধ্যে একজন অফিসারকে ইসরায়েলেই মোসাদের এজেন্টরা আগে থেকেই হানি ট্র্যাপে ফাঁসিয়ে রেখেছিল। সুন্দরীর জালে ফেঁসে থাকা সেই অফিসারের মুখ থেকে তথ্য পেয়ে যায় মোসাদ। আরম্ভ হয়ে যায় বুলকে ট্র্যাক করার কাজ।
প্রাথমিক ভাবে বুলকে সাবধানবাণী দেওয়ার কাজ করেছিল মোসাদ। ১৯৯০ সালের শীতকালে একাধিক বার বুলের ব্রাসেলসের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে মোসাদ এজেন্টরা সব তছনছ করে দেয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বুলকে বোঝানো যে, তুমি কোথায় থাকো তা আমরা জানি, আর তোমার বাড়িতে ঢুকে তোমার ক্ষতি করাটা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। তাই তুমি প্রোজেক্ট ব্যাবিলন নিয়ে আর এগিও না।
কিন্তু এসবে আমল দেননি বুল। উনি নিজের প্রোজেক্ট চালিয়ে যেতে থাকেন। সুপারগানের অংশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে জন্ম দিতে থাকেন বিশ্বের এক নতুন ত্রাসকে। ইসরায়েলের কাছে বিষয়টা ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠছিল। অনেক চর্চার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ২০ মার্চ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী য়িৎজাক শামির মোসাদের তৎকালীন চিফ নাহুম আডমোনিকে বলেন, ‘সেন্ড ইয়োর বয়েজ!’ ইঙ্গিত সাফ ছিল— ‘বুলকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দাও!’ ৩ জন হিটম্যানের একটি টিম ব্রাসেলসে পাঠানো হয়। বুল নিহত হন। আজ অবধি কেউ এই হত্যার দায় স্বীকার করেনি।
সরাসরি কাউকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা না গেলেও কাজের পদ্ধতি মোসাদের সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যায়। নিখুঁত কাজ সারার পরে মিডিয়াতে খবর প্লান্ট করে দেওয়ার কাজটা মোসাদের মতো অন্য কেউ করতেই পারে না। এক্ষেত্রেও ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানা নিউজ। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, প্রচারিত হয় সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সুপারগানের প্রোজেক্ট নিয়ে বনিবনা না হওয়ার ফলেই বুলকে হত্যা করিয়েছিলেন সাদ্দাম। বাকি কথা খোদাই জানবেন!