৫
‘আরিয়ান কোনো সমস্যা?’ দরজার বাইরের ভিড় থেকে আচমকাই ডাকটা শুনে চট করে দরজার দিকে তাকাল। ‘কোনো ঝামেলা হলে বল, আমি দেখছি। তোর চাচাও আছে।’
অফিসার রহমানকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আরিয়ান, কিন্তু চট করে দরজার ওপাশে ভিড়ের ভেতর থেকে সাবেরের ডাক শুনে খানিকটা চমকেই উঠল আরিয়ান। সাবেরের ঠিক পেছনেই ওর চাচাকেও দেখতে পেল ও। যদিও ওর পরিবারের বাকি সদস্যদের কাউকে দেখতে পায়নি কিন্তু আরিয়ান প্রায় নিশ্চিত ওর বাবা-মা-মনিকাও ওখানেই আছে। মুহূর্তের জন্যে নিজের ভাবনার জগৎ থেকে তাল কেটে যেতে খানিকটা বিহ্বল বোধ করল আরিয়ান। একদিকে নিজের সবচেয়ে আনন্দের সন্ধেটা এভাবে বদলে যাওয়া, তার ওপরে দুই অফিসারের ক্রমাগত জেরা এবং সেই সঙ্গে এমন এক দোষারোপ যার কথা ও নিজে ভাবতেও পারেনি। ও ভাবছিল একেবারেই ভিন্ন কিছু। কিন্তু দুই অফিসার যে দোষ ওর ওপরে আরোপ করল, তারা এমন কিছু করতে পারে এটা ও ভাবতেও পারেনি। কিন্তু চট করে তাদেরকে দেয়ার মতো জবাব চলে এসেছিল ওর মাথার ভেতরে, সাবেরের হঠাৎ ডাকে একেবারে তাল কেটে গেল ওর। ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হলো সাবেরকে একজন উকিলের জন্যে বলবে কিন্তু তার পরমুহূর্তেই নিজের ভেতরের সেই অন্ধকার ভয়ের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল আরিয়ান। সাবেরের দিকে তাকিয়ে একবার হাত নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করল। সেই সঙ্গে অনুধাবন করতে পারল মিডিয়া রুমের খোলা দরজাটা অফিসার রহমানের হাতের ইশারা পেয়ে বন্ধ করে দিল এক পুলিশ কনস্টেবল।
দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আরিয়ান ফিরে তাকাল অফিসার রহমানের দিকে। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এটা ওর নিজের লড়াই, আর সেটা লড়বেও ও নিজেই। রহমানের দিকে দেখে নিয়ে একবার সে ফিরে তাকাল দ্বিতীয় অফিসার সুদর্শন জোনায়েদের দিকে। এই প্রথমবারের মতো দুজনকেই ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে ওর দৃষ্টি স্থির হলো রহমানের ওপরে। ‘রহমান সাহেব, আমি জানি না কীসের ভিত্তিতে আপনারা এই এলিগেশন আনছেন, প্রুফ কি আপনাদের হাতে?’
অফিসার রহমান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগে আরিয়ান নিজের একটা আঙুল তুলে থামিয়ে দিল তাকে। ‘এক মিনিট, আমি কথা শেষ করি আপনারা জানেন কি না জানি না, কিংবা কামালের মৃত্যুর বিষয়ে কতটুকু খোঁজ নিয়েছেন আমি জানি না। হ্যাঁ আমি হয়তো ওর মৃত্যুর পর কোনো ধরনের কোনো রি-অ্যাকশন দেখাইনি। কিন্তু আমি সবই জানতাম, সবই আপডেট রেখেছিলাম। প্রথম কথা হলো ওর মৃত্যুর পর থরো ইনভেস্টিগেশন হয়েছিল আমি যতটুকু জানি। কারণ ওর পরিচিত একজনকে চিনতাম আমি তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে একাধিকবার। সেই সঙ্গে আপনাদের নিশ্চয়ই এটা না জানার কথা নয় যে কারো মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করা কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না করা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু নয়,’ কথা বলতে বলতে আরিয়ান উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ভেঙে পড়ছে ওর আগের সেই শান্ত ভাব। কথা বলতে বলতেই আরিয়ান নিজের দুই হাত তুলল শরীরের দুপাশে। ‘আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমি কেন ওকে খুন করতে যাব? হি ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড, হি ওয়াজ মাই বাড়ি।’
আরিয়ান ওর বাক্যটা পুরোপুরি শেষও করতে পারল না তার আগেই রীতিমতো অশ্লীলভাবে হেসে উঠল অফিসার রহমান। ‘বাড়ি!’ বলে সে হাসতেই থাকল। একেবারে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট তার হাসি। আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবারো কথা বলে উঠল সে। ‘বাড়ি, কাকে বলে জানেন আপনি?’ বলে সে জোনায়েদের দিকে ফিরে তাকাল। ‘একে বলে বাড়ি, যারা একসঙ্গে কাজ করে। পার্টনার,’ বলেই সে ঝট করে ফিরে তাকাল আরিয়ানের দিকে। ‘আপনার মতো মানুষ বাড়ি-বন্ধু এসব শব্দের মানে বোঝে? যাকে বন্ধু ভাবতেন সে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভুলে গেলেন? বলেন কারণ কি?’ বলেই সে টেবিলে আচমকাই এত জোরে একটা চাপড় মারল চমকে প্ৰায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল আরিয়ান। স্পেশাল অফিসার রহমান আরিয়ানের দিকে একটা আঙুল তুলল। ‘আমি জানি আপনি কেন এই কাজ করেছেন?’ বলে সে আবারো মৃদু হেসে উঠল। ‘এই যে সম্মান এই যে সাম্রাজ্য আপনার গড়ে উঠেছে, সব এক ধোঁকা, মিথ্যের ওপরে,’ রহমান চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলছে আর তার প্রতিটা কথা আরিয়ানের বুকের ভেতরে চিনচিনে একটা ব্যথা সৃষ্টি করছে। আবারো ওর শরীর আর মনের গহিন অন্ধকার থেকে উঠে এলো কথাগুলো,
ওরা জানে, ওরা…ওরা সবই জানে।
‘দেখুন অফিসার রহমান,’ নিজের ভেতরের অন্ধকার মিস্টার হাইডকে ভেতরে ঠেলে দিয়ে শক্ত মুখে কথা বলে উঠল আরিয়ান। ‘প্রথমত, আমি একজন ল-ইয়ার চাই,’ হঠাৎই কেন জানি খানিক ক্লান্ত লাগছে। দ্বিতীয়ত, আপনারা যদি একদম নির্দিষ্টভাবে না বলেন যে আমার বিরুদ্ধে আপনাদের চার্জগুলো আসলে কি, সেক্ষেত্রে আপনাদের সঙ্গে কথোপকথন এখানেই শেষ। যথেষ্ট সময় এবং ভদ্রতা বরাদ্দ করা হয়েছে আপনাদের জন্য। আমার আর —
‘এই বাড়ি, দেখাও মিস্টার এ’কে, কি প্রমাণ আছে তার বিরুদ্ধে, খোটা মারার জন্যে পাড়ার আন্টিরা একে অপরকে ঠিক যেভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলে ওঠে অনেকটা ঠিক ওরকমভাবেই কথাগুলো বলে উঠল রহমান।
‘অবশ্যই,’ অনেকক্ষণ পর জোনায়েদ কথা বলে উঠল। ‘মিস্টার আরিয়ান আপনাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল যেটার জবাব আপনি দেননি। আপনি ওইদিন কোথায় ছিলেন, যেদিন এবং যেই সময়ে আপনার বন্ধু কামাল সুইসাইড করেছিল, ‘ আরিয়ান উত্তর দিতে যাচ্ছিল তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল জোনায়েদ। ‘আপনাকে বলতে হবে না, আমরাই প্রমাণ দিচ্ছি,’ সে একটা ফাইল বের করে টেবিলের ওপরে রাখতে যাচ্ছিল হঠাৎই আবারো দরজার কাছে চেঁচামেচি শুনে ওরা তিনজনেই ফিরে তাকাল সেদিকে।
একটু আগে বন্ধ করে দেয়া দরজাটা হুট করে খুলে গেছে, সেখানে দুই গার্ডের সঙ্গে উচ্চস্বরে তর্ক করতে দেখা গেল এক মহিলাকে। সে এতটাই জোরে কথা বলছে কামরার অন্য প্রান্ত থেকে পরিষ্কার শুনতে পেল ওরা প্রায় তিনজনেই। মহিলার গলার স্বরই শুধু উঁচু না, তার মুখের ভাষাও খুব বেশি সুবিধার না। কি ব্যাপার, বাসিত, কি হয়েছে?’ অফিসার রহমান অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডের কাছে জানতে চাইল।
‘স্যার, এক মহিলা খুব ঝামেলা করছে, বলছে পুলিশের লোক—’ গার্ড কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই পেছন থেকে সেই মহিলা এক ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ‘কি ব্যাপার, কি হচ্ছে এখানে?’ আরিয়ান দেখল জিন্স, বুট আর হুডি পরা মহিলার ভীষণরকম দাপটের সঙ্গে শুধু ভেতরেই ঢুকল না, বেশ জোরের সঙ্গে ধমকে উঠল। আরিয়ান দেখল হ্যাংলা-পাতলা লম্বা মহিলার সিল্কি চুল একটা কাঁটা দিয়ে পেছনে আটকে রাখা, মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করল, এটা মহিলা নয় বরং মেয়ে, ওর থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোটই হবে। রাগের চোটে মেয়েটার ফরসা চেহারা লালচে হয়ে আছে, সেই সঙ্গে প্রায় একই রকমের লালচে হয়ে আছে তার বড়ো বড়ো চোখ জোড়া। ‘কি ব্যাপার, উত্তর দিচ্ছেন না কেন, হচ্ছেটা কি এখানে?’ আবারো প্রায় একই প্রশ্ন উচ্চারণ করল সে।
পেছন থেকে গার্ড কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে তো থামিয়ে দিলই, সেই সঙ্গে উঠে দাঁড়ানো জোনায়েদকেও হাতের ইশারায় উত্তেজিত হতে মানা করল রহমান। ‘তার আগে আমি জানতে পারি আপনি কে, আর এভাবে পুলিশের কাজে বাঁধা দেবার এখতিয়ারই বা আপনি পেলেন কোথায়?’
‘এখতিয়ার আছে বলেই প্রশ্নগুলো করেছি,’ বলে মেয়েটা আরেক কদম এগিয়ে এলো কামরার ভেতরে। ‘আপনারা এখানে কি করছেন সেটা আমি জানতে চাই, মহিলার গলা আগের চেয়ে আরো এক ধাপ ওপরে উঠে গেছে। আরিয়ান খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে মহিলার দিকে, কেন জানি মহিলাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে ওর কাছে।
‘আর আমি জানতে চাই, আপনি কে?’ মহিলার গলা যতটা উঁচু, রহমানের গলা ততটাই শান্ত। ‘আগামী এক মিনিটের ভেতরে যদি আপনি নিজের পরিচয় না দেন, তবে আপনি যেই হোননা কেন এর ফলাফল খুব খারাপ হবে, কাজেই—’
‘আমি সরি, আগেই আমার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল,’ মেয়েটা আরেকধাপ ভেতরে ঢুকল। আরিয়ানের মনে হলো রহমানের শান্ত গলা শুনে হঠাৎ যেন সে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেছে। ‘আমার নাম রাসনা, জান্নতুল রাসনা—’
‘কি! জান্নাতের রাস্তা?’ জোনায়েদ এমন সুরে বলে উঠল আরেকটু হলে এমন অবস্থাতেও হেসে উঠত আরিয়ান।
‘অফিসার,’ মেয়েটার মুখ সঙ্গে সঙ্গে থমথমে হয়ে গেছে। ‘ইউ বেটার চেক ইয়োর টাঙ, নয়তো—’
‘সরি সরি,’ রহমান বলে উঠল। ‘আমার পার্টনার ভুল করে ফেলেছে। আমি শুনেছি আপনার নাম ঠিকঠাক,’ বলে সে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল। ‘রাসনা, তাই না?’ বলে সে আঙুল দিয়ে ঘোটা দেয়ার ভঙ্গি করল। ‘ওই শরবত রাসনা, ঠিক বলেছি না?’ বলে সে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপল।
‘দেখুন আপনাদের সঙ্গে ফাজলামো করতে আসিনি আমি এখানে, আবারো তার চেহারায় আগের সেই লালচে ভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ‘আমি ডিবিএস অফিসার, আপনারা কামাল আহমদ নামে যার কেসের ব্যাপারে এখানে এসেছেন, সেই কেস আমার অধীনে ছিল,’ বলে সে নিজের দুই হাত শরীরের দুইপাশে নাড়ল বিরক্তির ভঙ্গিতে। ‘অদ্ভুত বিষয়, কোনো ধরনের জানানো নয়, কিছু নয়, কোনো কিছু ছাড়াই আপনারা কেস রিওপেন করলেন, আমি কিছু জানতেও পারলাম না, এটা কেমন কথা। আপনাদের কি মনে হয় না এটা ফেলো একজন অফিসারের প্রতি এক ধরনের ইনসাল্টিং বিহেভিওর?’ শরবতের নামের সঙ্গে নাম মেলানো মেয়েটার আচরণ মোটেই শরবর্তী নয়, বরং অত্যন্ত কাঠখোট্টা।
‘আপনি কে আমি খুব ভালো করেই জানি,’ এই প্রথমবারের মতো ঘুরে বসল অফিসার রহমান। ‘আপনাকে চেহারায় না চিনলেও অন্তত আপনার নাম আমি খুব ভালোভাবেই জানি,’ বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বাউ করল। ‘নাইস টু মিট ইউ অফিসার রাসনা,’ বলে সে আবারো সেই ঘুরান্তি দেয়ার ভঙ্গি করে মৃদু হাসল। আরিয়ান আবারো অনুভব করল শুধু ও না যেকোনো মানুষের প্রতি লোকটার অঙ্গভঙ্গি এত বিরক্তিকর দেখলেই মনে হয় চড় মারতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে একজন মহিলা, তাও নিজের ফেলো অফিসারের সঙ্গে এরকম আচরণ করে যে-লোক, অপরাধীদের সঙ্গে এই লোক কেমন করবে তা বলাই বাহুল্য। ‘আমাকে একটা কথা বলুন তো অফিসার রাসনা, একটা সুইসাইডের কেস একজন ডিবিএস অফিসার কেন হ্যান্ডেল করছিল?’
‘কারণ কেসটাতে ঘাপলা ছিল।’
‘আর সেটা আপনিই সম্ভবত উত্থাপন করেছিলেন এবং সে কারণেই কেসটা পুলিশ থেকে ডিবিএস-এ ট্রান্সফার করা হয়, ঠিক না?’
‘হ্যাঁ কিন্তু আপনারা—’
‘আপনি বা আপনার কলিগরা কি কিছু পেয়েছিলেন?’ রহমান একেবারে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্তভাবে কথা বলছে। এইবার আরিয়ানের মনে পড়ল এই মহিলাকে সেইসময়ে সে দেখেছিল কামালের কেস নিয়ে কাজ করতে। সে নিজে যদিও কখনো স্পটে যায়নি বা কারো সঙ্গে দেখা করেনি একে দেখেছিল সে সেইসময়।
‘না, আমি মানে আমরা,’ মহিলার সেই তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ আর ধারাল আচরণের মধ্যে কোথায় যেন খানিকটা ফারাক দেখা দিয়েছে। রহমানের কথায় এটা পরিষ্কার যে এবং তারা কেসটা নিয়ে খুব ভালোভাবে স্টাডি করেছে এবং তারা বেশ আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে। কিন্তু কেন? শুধুই কি ওই কারণেই? একদিকে আরিয়ানের মাথার ভেতরে শত-সহস্র প্রশ্নের উৎপত্তি হচ্ছে অন্যদিকে রহমান আর রাসনার ভেতরে কথোপকথন রীতিমতো তর্কে রূপ নিচ্ছে।
‘…প্রশ্ন সেটা না—’ রাসনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রহমান তাকে আবারো থামিয়ে দিল। ‘আপনাকে কেন ইনফর্ম করতে হবে, আমি সেটা বুঝলাম না। আপনারা তো কেস ক্লোজ করে এন্ড নোট দিয়ে দিয়েছিলেন এটা ক্লিয়ার কেস অব সুইসাইড। অহহহ সরি,’ বলে সে একবার জোনায়েদ এবং আরেকবার আরিয়ানের দিকে দেখে নিয়ে আবারো মেয়েটার দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আপনাকে তো এই কেস থেকে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাইনা মিস রাসনা?’
মেয়েটাকে দেখে মনে হলো রাগের সঙ্গে সঙ্গে তার গাল দুটো ফুসস করে ফেটে যাবে, কিন্তু তার চেহারা দেখে এটাও পরিষ্কার যে রহমান আসলে সত্যি কথা বলছে। ‘এই কেস নিয়ে আপনার বাড়াবাড়ি এতটাই পাগলামির পর্যায়ে চলে গেছিল যে অথরিটি বাধ্য হয়ে আপনাকে কেস থেকে ডিসচার্জ করে আপনারই আরেক কলিগকে দেয়া হয় এবং আপনার সেই কলিগ কেসটার পুরো ইনভেস্টিগেশন শেষ করে ক্লিয়ার কেস অব সুইসাইড রিপোর্ট দেয়ার পর কেসটাকে বন্ধ করে দেয়া হয়।’
‘তাহলে এই কেস কেন আবার রি-ওপেন করা হলো?’ হঠাৎ করেই যেন মেয়েটা খানিকটা আশার আলো দেখতে পেয়ে জানতে চাইল।
‘যে-কারণেই এই কেস রি-ওপেন করা হোক না কেন আমরা সেটা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই,’ এবার জোনায়েদ যোগ দিল রহমানের সঙ্গে।
‘যেহেতু এই পর্যন্ত এসেই পড়েছেন, কাজেই ফেলো পুলিশম্যান ও সরি পুলিশ ওমেন হিসেবে খানিকটা অনার আপনাকে আমরা করব,’ মুখে সম্মানের কথা বললেও রহমানের গলায় কোনো সম্মানের ছোঁয়ামাত্র নেই। বরং পুরোপুরিই টিটকিরির সুর। ‘আপনারা যেটা পারেননি, যেখানে আপনারা পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলেন সেখানে আমরা যা খুঁজে পেয়েছি সেটা একেবারেই কংক্রিট,’ বলে সে মৃদু হেসে আরিয়ানকে দেখাল। ‘সেই কারণেই মিস্টার আরিয়ানের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত। প্লিজ ডোন্ট ফিল অফেন্ডেড, আপনার সঙ্গে কেন আমরা স্পেশাল কেসে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে কাজ করছি। আপনার সঙ্গে কেন কারো সঙ্গেই আমরা কিছু শেয়ার করব না। আপনি এবার আসতে পারেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মানুষ হিসেবে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি। গুড বাই,’ শেষ শব্দ দুটো রহমান এমন সুরে উচ্চারণ করল যেকোনো সুস্থ মানুষের এই শব্দ শোনার পর সরে যেতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু রাসনা তবুও দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে পারলে রহমানকে খাঁমচে দেয়।
‘ম্যাডাম চলুন,’ পেছন থেকে মৃদুস্বরে পুলিশ কনস্টেবল বলে উঠতেই সে এক ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে রওনা দিল।
সরি ফল দ্য ইন্টারাপশন,’ আরিয়ানের দিকে ঘুরে মুখ বাঁকিয়ে মৃদু হাসি দিল রহমান। ‘জোনায়েদ, উনাকে এভিডেন্স দেখাও, আমাদের দ্রুত কাজ সারতে হবে।’
‘মিস্টার আরিয়ান, যেদিন কামাল আহমেদ আত্মহত্যা করেন, সেদিন শেষবার মোবাইলে আপনার সঙ্গেই তার কথা হয়েছিল, ঠিক?’
আরিয়ান অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে আছে জোনায়েদের দিকে। জোনায়েদ ধপ করে একটা প্লাস্টিকের ফাইলের মতো কিছু একটা রাখল ওর সামনে।
‘কারো সঙ্গে শেষবার কথা হলেই সে খুনি হয়ে যাবে?’ আরিয়ানের গলার স্বরও নিচু হয়ে এসেছে! ও বুঝতে পারছে ওর চারপাশে জাল গুটিয়ে আনা হচ্ছে। ‘আর এটা সত্য নয়—পুলিশ আগেও চেক করেছে, আমি—’
‘আপনি ফোন কল রেকর্ডের কথা বলছেন?’ রহমান হেসে উঠে জোনায়েদের দিকে ইশারা করল।
‘কামাল আহমেদের সঙ্গে শেষবার আপনারই কথা হয়েছে, এটা সমস্যা নয় সমস্যা হলো আপনি আপনার এক টেলিকমিউনিকেশনের বন্ধুকে দিয়ে এই রেকর্ড মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। এই কারণেই আগেরবার পুলিশ সেটা বের করতে পারেনি। এই হলো আপনার সেই বন্ধুর প্রফাইল, যাকে আজ দুপুরে চাকরিচ্যুত করে তার বিরুদ্ধে কোম্পানির পলিসির বাইরে কাজ করার জন্যে মামলা করা হয়েছে,’ জোনায়েদ ধপ ধপ করে আবারো দুটো পাতলা ফাইল রাখল। আরিয়ান দেখল একটাতে ওর সেই বন্ধুর প্রফাইল, অন্যটাকে ফোন কলের রেকর্ড, তাতে একটা নম্বর হাইলাইট করা, আর সেটা ওরই নম্বর।
‘প্রশ্ন হলো আপনি কেন এই কাজ করবেন? শুধু এটাই নয়, আরো আছে,’ বলে সে আরো একটা ফাইল রাখল। ‘ওইদিন সন্ধ্যায়, আপনার সঙ্গে কামালের পার্কে দেখা হয়েছিল ওর বাসার কাছে। আপনারা পার্কে কথা বলার বেশ কিছু সময় পর দুজনে বিদায় নিয়ে দুদিকে যেতে শুরু করেন। কিন্তু আপনি যাননি। আপনি প্রথমে অন্যদিকে যাওয়ার ভান করে তারপর আপনার বন্ধুর পিছু নিতে শুরু করেন। যেদিক দিয়ে আপনি পিছু নিয়েছিলেন, পথের মধ্যে বেশ কিছু দোকান আর এটিএম বুথের সিসিটিভি ফুটেজের স্টিল পিক আছে এখানে।
আরিয়ান পাগলের মতো ফাইলটা ঘাটতে গিয়ে দেখল সত্যি ওর ছবি।
‘শুধু এই নয়,’ এবার আবার রহমান বলতে লাগল। ‘কামাল সম্ভাব্য যে-সময়ে সুইসাইড করে বলে করোনার রিপোর্ট দিয়েছিল, তার কাছাকাছি সময়ে আপনাকে তার বাড়ি থেকে বের হতেও দেখা গেছে।’
‘কোনো প্রমাণ—’
‘আমাদেরকে কি আপনার বোকা মনে হয়?’ রহমানের ঠান্ডা গলায় নেই কোনো টিটকিরির ভাব, নেই কোনো প্রহসন। একেবারেই শান্ত প্রফেশনাল গলায় কথা বলছে সে। আমরা প্রমাণ ছাড়া কথা বলতে আসিনি মিস্টার আরিয়ান।আপনার মতো একজন সেলিব্রেটির গায়ে প্রমাণ ছাড়া হাত দিলে কী হবে আমরা জানি। আপনি সেদিন কামালের বাড়ি থেকে খুব সাবধানে, বের হোন। আপনি এমনকি মোটামুটি এটাও জানতেন ওদের বাড়িতে কোথায় কোথায় সিসিটিভি আছে। কাজেই আপনি সেসব এড়িয়ে প্রবেশ করেন খুব সাবধানে বেরিয়েও আসেন খুব সাবধানে,’ বলে রহমান হেসে উঠল। ‘একটা ভুল করেন আপনি। ওর বাড়ির পেছনে একটা সিকিউরিটি কোম্পানির ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আর ওদের সেই রানিং ভ্যানে আপনার পলায়নের ছবি উঠে পড়ে। সেগুলোও আমাদের হাতে এসেছে।
জোনায়েদ আবারো একটা ফাইল রাখল। আরিয়ান দেখল সেটাতেও ওর ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও ওর চোখে ভেসে উঠল সিলিং থেকে ঝুলে থাকা কামালের লাশটা। কিছুই না বলে চুপ করে রইল আরিয়ান।
‘ইউ আর ক্রুড মিস্টার আরিয়ান, আপনার বন্ধু কামালকে হত্যা সন্দেহে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে,’ কথাটা বলে সে কনস্টেবলের দিকে ইশারা করল ওকে হাত কড়া পরানোর জন্য।
আরিয়ান অনুধাবন করল, সব শেষ।
৬
সেই মিডিয়া রুম থেকে আরিয়ান বেরিয়ে এলো একেবারেই বাংলা সিনেমায় দেখানো আসামিদের মতো করে। হাতে হাত কড়া, কোমরে দড়ি, দুপাশে দুজন পুলিশ কনস্টেবল। ওরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই একদিকে মিডিয়ার লোকজন, অন্যদিকে অনুষ্ঠানের আয়োজক, ওর আত্মীয়স্বজনেরা প্রায় হামলে পড়ল ওদের ওপরে। কিন্তু ব্যবস্থা দেখে আরিয়ান বুঝতে পারল এরা পুরোপুরিই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। স্রোতটা খানিকটা সামনে এগোতেই প্রহরায় থাকা পুলিশেরা স্রোতটাকে থামিয়ে দিল।
আরিয়ানকে নিয়ে ওরা খানিকটা সামনে এগোতেই রহমান নিজের একটা হাত তুলে ভিড় করে থাকা মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে চুটকি বাজিয়ে তাদের কাছে ডাকল। মিডিয়ার লোকজন এগিয়ে আসতেই, ওদের দিকে হাজারো প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিতে লাগল।
‘মিস্টার আরিয়ানকে গেপ্তার করা হয়েছে কেন?’
‘উনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?’
‘মিস্টার আরিয়ান এটা কি আপনার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র?’
‘এভাবে একজন লেখককে হ্যারাস করার অর্থ কি?’
‘এক মিনিট,’ রহমান হাসিমুখে কথা বললেও তার গলায় রীতিমতো ধমকের সুর। ‘আপনাদেরকে সব বলার জন্যেই তো ডাকা হয়েছে। আপনাদের লেখক মিস্টার আরিয়ান শফিক,’ বলে সে আরিয়ানের দিকে দেখাল। যার নাম শফিকুল ইসলাম, আজ থেকে বছর দেড়েক আগে নিজের এক বন্ধুকে খুন করেন,’ রহমান এই পর্যন্ত বলতেই রীতিমতো প্রায় গুঞ্জন বয়ে গেল ভিড়ের ভেতরে।
‘সবাইকে শান্ত থাকতে বললাম না, আবারো প্রায় ধমকে উঠল অফিসার রহমান। শান্ত না থাকলে তো শুনতেই পারবেন না। উনার সেই বন্ধুর নাম ছিল কামাল আহমেদ, দুজনেই একসঙ্গে একটা রাইটিং কোর্স করার সময়ে পরিচিত হন। উনিও লেখক ছিলেন। মিস্টার আরিয়ান উনাকে খুন করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সেটাকে সুইসাইড হিসেবে সাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের কাছে এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রমাণ আছে। মিস্টার কামাল যেদিন সুইসাইড করেন, সেদিনও শেষবার মিস্টার আরিয়ানের সঙ্গেই তার কথা হয়েছিল, এই এভিডেন্স মিস্টার আরিয়ান মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন কাজ হয়নি, তার মৃত্যুর সময়েও সে ওখানেই ছিল, তাকে মৃত্যুর আগে অনুসরণ করা থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর পর তার বাড়ি থেকে মিস্টার আরিয়ানের পালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে ছবিসহ। এর বাইরেও যেখানে মিস্টার কামাল গলায় দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে সাজানো হয়েছিল সেখানেও টেম্পারিংয়ের আলামত পাওয়া গেছে,’ রহমান এটুকু বলতেই আরিয়ান আরেক দফা চমকে উঠল। এটা রহমান তাকে বলেনি।
‘কিন্তু কারণ কি?’ ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করল। উনার খুনের মোটিভ কি? উনি কেন খুন করেছেন উনার বন্ধুকে?’
‘রাইট কোশ্চেন,’ রহমান এমনভাবে হেসে উঠল যেন সে মনে মনে চাচ্ছিল এই প্রশ্নটা কেউ তাকে করুক। ‘আসলে উনি,’ বলতে গিয়েও সে থেমে গেল। আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাল একবার। ‘আমরা এখন উনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। কাল সকালে বিস্তারিত প্রমাণাদিসহ প্রেস কনফারেন্স করে সব জানানো হবে। আপাতত পুলিশকে তার কাজ করতে দিন। রহমান ওদের এগোনোর জন্যে ইশারা করল।
আরিয়ানকে নিয়ে সামনে এগোনো শুরু করতেই মিডিয়ার লোকজন প্রায় হামলে পড়তে শুরু করল ওদের ওপরে।
‘মিস্টার আরিয়ান, পুলিশ যা বলছে তা কি সত্যি?’
‘আপনার কি মনে হয় এটা আপনার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র?’
‘আপনি কি সত্যি খুন করেছেন আপনার বন্ধুকে?’
প্রশ্নে আর ভিড়ের স্রোতের ভেতরে আরিয়ান চেষ্টা করল সাবের কিংবা ওর পরিবারের কাউকে দেখা যায় কি না। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখতে পেল সেই অডিটরিয়ামের বাইরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। সাবেরও ওদের সঙ্গেই যথারীতি সে ক্রমাগত ফোনে কথা বলছে। মিডিয়া এখনো ওদের সন্ধান পায়নি দেখে খানিকটা স্বস্তি বোধ করল আরিয়ান। সেই সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারল ওর কথা বলতে হবে উনাদের সঙ্গে, আর ওরা কথাবলা মাত্রই মিডিয়া হ্যারাস করা শুরু করবে ওনাদের। কিন্তু ওকে কথা বলতেই হবে। সামনে এগোতে এগোতেই ও হাতের ইশারায় ওদের সামনে আসতে বলল। ‘রহমান সাহেব, আমাকে আমার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
‘উঁহু,’ ভিড়ের ভেতরে এগোতে এগোতেই ওর দিকে ফিরে মাথা নেড়ে আপত্তির ভঙ্গিতে বলে উঠল অফিসার রহমান। ‘প্রশ্নই আসে না। ল’ ইয়ার চেয়েছেন, একবার স্পেশাল সেলের অফিসে গেলে সেটা পাবেন কিন্তু তার আগে কারো সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলাবলি নেই।’
‘প্লিজ, আমি অনুরোধ করছি,’ আরিয়ান দেখল ওর পরিবারের সদস্যরা ওর সঙ্গে সঙ্গে এগোতে শুরু করেছে। আরিয়ান অনুভব করতে পারছে এবার না হলে আর কথা বলাই হবে না। একবার থানা কিংবা স্পেশাল সেলে গেলে পরে কী হবে কে জানে। হয়তো ওদের সঙ্গে আর কথাই বলতে পারবে না। প্লিজ মিস্টার রহমান, আমি তো এখন পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কোনো অসহযোগিতা করিনি। আপনাদের কোনো কথার অবাধ্যও হইনি। এটুকু তো আমি অন্তত চাইতেই পারি। প্লিজ, এই পর্যন্ত বলে আরিয়ান থেমে গেল। ‘প্লিজ, আমি আপনাদের সঙ্গে সব বিষয়ে সহায়তা করেছি এবং কথা দিচ্ছি করব। কিন্তু আমাকে এখনি আমার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে। না হলে আমি সিন ক্রিয়েট করব। আমার সম্মান যা যাওয়ার গেছে, সেটা নিয়ে আমি আর চিন্তিত নই। কিন্তু আপনিও জানেন আমি চাইলে মিডিয়ার সামনে এখন অনেক নাটকই করতে পারি। এতে আর কিছু না হোক অন্তত আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে আপনাদের এক গণ্ডা ঝামেলা পোহাতে হবে,’ আরিয়ান সরাসরি তাকিয়ে আছে রহমানের চোখের দিকে। রহমানের চোখে থাকা পরিষ্কার ইগনোরেন্সের জায়গায় এখন বেশ অনেকটাই দ্বিধা।
‘প্লিজ,’ আনমনেই মাথা নেড়ে আবারো অনুরোধ করল আরিয়ান।
ওদের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়া এবং ভিড়ও কাছাকাছি এসে থেমে গেছে। আরিয়ান একবার ওর পরিবারের লোকজনের দিকে দেখে নিয়ে ফিরে তাকাল রহমানের দিকে। রহমানের চোখে এখনো দ্বিধা, সে একবার মিডিয়ার দিকে দেখছে, আরেকবার ফিরে তাকাচ্ছে নিজের লোকদের দিকে। আরিয়ান দেখল জোনায়েদের চোখে নীরব সম্মতি, রহমান সে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একবার প্রায় দেখা যায় না এমনভাবে ইশারা করল। ‘ঠিক আছে, এক মিনিট, স্রেফ এক মিনিট,’ বলে সে নিজের সেন্ট্রিদেরকে ইশারা করল।
‘থ্যাংকস,’ হাত বাঁধা থাকলেও সেন্ট্রিদের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ভেদ করে আরিয়ান এগিয়ে গেল ওর পরিবারের লোকজনের দিকে।
‘আরিয়ান এসব কি? ওরা ব্যাপার কি এমন করছে কেন?’ প্রশ্নটা ওর বাবা করলেও বাকিরাও একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
‘এক মিনিট, এক মিনিট,’ আরিয়ান ওর বাবার দিকে দেখে নিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘সময় নেই, স্রেফ এক মিনিট সময় দিয়েছে ওরা আমাকে। আমি দ্রুত কথা বলব, সবাই মন দিয়ে শোন, ও সাবের আর মনিকার দিকেও দেখে নিল দ্রুত একবার। ‘ওরা বলছে আমি আমার ফ্রেন্ড কামালকে খুন করেছি। ওদের কাছে বেশ কিছু প্রমাণও আছে। কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলছি,’ আরিয়ান সোজা তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে, চট করে একবার ওর মাকেও দেখে নিল। আমি এরকম কিছুই করিনি। ওরা যাই করুক, মিডিয়া যাই বলুক না কেন, তোমরা বিশ্বাস করো না।’
‘আমরা করব না বাবা, তুই চিন্তা করিস না,’ ওর বাবা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। বাবার হাত ধরে থেমে গেল আরিয়ান। ‘সাবের, তুই জলদি একজন ল’ ইয়ার ঠিক করে স্পেশাল সেলের অফিসে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কর।’
‘আমার ফ্রেন্ড আছে একজন অনেক বড়ো ক্রিমিনাল ল’ ইয়ার,’ ওদের পাশ থেকে ওর চাচা বলে উঠল। ‘তুই চিন্তা করিস না শফিক, আমি ওকে নিয়ে সোজা স্পেশাল সেলের অফিসে পৌঁছাচ্ছি।’
‘আমিও আসছি আপনার সঙ্গে,’ ও আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। —তুই একেবারেই চিন্তা করিস না। আজ রাতেই তোকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করছি।’
‘তোমরা বাসায় চলে যাও,’ ওর পরিবারের লোকজনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই আবার নিজেকে শুধরে নিল। ‘এক কাজ করো,’ আরিয়ান ওর চাচির দিকে ফিরে তাকাল। ‘চাচি আপনি ওদের নিয়ে আজ রাতে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান।’
‘না না, আমরা থানা অফিসে—’
‘বাবা কথা শোন, থানাতে যদিও যাও, তাও আজ রাতে তোমরা চাচার বাসায় ক্যান্টনমেন্টে থেকো, তা না হলে মিডিয়া জ্বালাতন করতে পারে, বুঝেছ,’ বলেই ও চট করে মনিকার দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘তুমিও আজ বাসায় থেকো না, অন্য কারো ওখানে—’ আরিয়ান কথা শেষ করার আগেই এক সেন্ট্রি টান মারল ওর হাতে বাঁধা দড়িতে।
‘এই চল চল, অনেক হইছে।’
‘আমি যাচ্ছি,’ আরিয়ানও তার বাবার হাতটা ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে বেশ জোরের সঙ্গেই বাড়ি খেল মানুষটার সঙ্গে। ‘সরি সরি,’ বলতে বলতে অনুভব করলে মানুষটার সঙ্গে প্রায় তালগোল পাকিয়ে গেছে ও। ‘সরি,’ আরিয়ান তাকিয়ে দেখল মানুষটা আর কেউ না, সেই ডিবিএস অফিসার মেয়েটা, রাসনা। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে সে ঘুরে ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল। সেন্ট্রিরা টেনে এগিয়ে নিয়ে চলল ওকে। এক মিনিটের ভেতরে বাইরে এসে দেখল স্পেশাল সেলের জিপ আর ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ওকে ভ্যানের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে ইশারা করল। আড়চোখে একবার পেছন দিকে তাকিয়ে আরিয়ান দেখল সাবের মনিকা থেকে শুরু করে ওর পরিবারের সবাই তাকিয়ে আছে, মিডিয়ার লোকজন ফ্ল্যাশের পর ফ্ল্যাশ ফেলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাস্তার অন্যপাশেও ভিড় জমে গেছে। পলকের জন্যে সবার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরে একটা হার্ট বিট মিস করল আরিয়ান। ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হলো যেন এই ভ্যানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওর জীবন চিরস্থায়ীভাবে বদলে যাবে। আর কখনোই আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবে না।
ভ্যানে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে ভ্যানের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের ওপরে চোখ পড়ল ওর। রাসনা, সেই অফিসার। আরিয়ানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সে। আরিয়ানের মনে হলো মেয়েটা কিছু একটা বলতে চাইছে। সেন্ট্রি ওকে ঠেলে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে ভ্যানে উঠতে গিয়েও থেমে গেল ও, রাসনা মেয়েটা চোখের ইশারায় কিছু একটা বলছে। কিন্তু সেটা বোঝার আগেই ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল সেন্ট্রি।
ভেতরে ঢুকে, বসতেই বিষয়টা বুঝতে পারল রাসনা মেয়েটা আসলে ওকে কী বলতে চেয়েছে। ভিড়ের ভেতরে যখন ওর সঙ্গে ধাক্কা লাগে মেয়েটা কিছু একটা গুঁজে দিয়েছে ওর হাতে। জিনিসটা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছে। হাতের মুঠোটা শক্ত করে চেপে ধরতেই ওকে ঠেলে ভ্যানের ভেতরে বেঞ্চে বসে গেল, আরিয়ান।
‘আরে করো কি, একজন লেখক মানুষ,’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অফিসার রহমান বলে উঠল। ‘হতে পারে খুনি কিন্তু লেখক তো, তাকে সম্মানের সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে হবে,’ বলে সে সেন্ট্রির পাশ দিয়ে একেবারে ভেতরে ঢুকে গেল। আরিয়ান মুঠোর ভেতরে চেপে ধরা জিনিসটা দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সেন্ট্রি ওকে বসিয়ে দিয়ে সেও ভ্যানের ভেতরের দিকে চলে গেল। আরিয়ান আঙুলে ডলে বুঝতে পারল ওটা একটা কাগজের টুকরো। সেন্ট্রি আর রহমান ভ্যানের ভেতরের দিকে ফিরে কথা বলছে আরিয়ান চট করে কাগজটা মেলে ধরল। ওটাতে এলোমেলো হাতের অক্ষরে পেন্সিলে লেখা,
‘ওরা আপনাকে খুন করবে’
আরিয়ান চট করে মুখ তুলতেই ভ্যানের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, অন্যদিকে ফিরে ওঠার চেষ্টা করতেই রহমান আর সেই সেন্ট্রি দুজনেই ফিরে তাকাল আরিয়ানের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আরিয়ানের মনে হলো, ওর যমদূত দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই খুবই বিচিত্র দেখতে এক ধরনের মাস্ক পরে আছে। ‘হোয়াট দ্য…’ আরিয়ান কথা শেষ করার আগেই রহমান একটা স্প্রেয়ার তুলে ওর মুখের ওপরে কিছু একটা স্প্রে করল, শক্তিশালী নার্ভ গ্যাসের প্রভাবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে সিটের ওপরে গড়িয়ে পড়ে গেল আরিয়ান।
৭
বিচিত্র এক ঝাঁকুনি আর মুখে শুষ্ক নোনতা স্বাদ অনুভব করছে আরিয়ান। সঙ্গে হালকা খসখসে ভাবও। জ্ঞান ফিরে আসতেই আরিয়ান অনুভব করল ওর মুখ ভ্যানের মেঝের সঙ্গে লেগে আছে। মুখে লেগে যাওয়া ধুলো থু থু করতে করতে উঠে বসার চেষ্টা করল আরিয়ান। কিন্তু উঠে বসার জন্যে নিজেকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল ওর হাত-পা সবই বাঁধা। উঠে বসতে গিয়েই আবারো পড়ে যেতেই ওর মাথাটা বাড়ি খেল ভ্যানের বেঞ্চের মতো সিটের একপাশে। আনমনেই উফফ করে উঠল আরিয়ান।
‘আরে আরে, করেছো কি!’ রহমানের সেই টিটকিরির গলা শুনতে পেল আরিয়ান। ‘বললাম একজন লেখক মানুষ, হতে পারে খুনি কিন্তু তাকে যথাযথ সম্মান তো দিতে হবে।’ রহমানের কথাগুলো উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ একজন ওকে ঠেলে বসিয়ে দিল। আরিয়ান ভ্যানের মেঝেতে নিজেকে সেট করে বেঞ্চের মতো সিটে হেলান দিয়ে বসল। ‘লেট মি গেস,’ নিজের শুকনো ঠোঁট চাটল আরিয়ান। মাথার ভেতরে দপ দপে একটা অনুভূতি, সেই সঙ্গে তীব্র একটা ভোঁতা ভাব। ভ্যানের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো ও বমি করে দেবে, কিন্তু কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিল ও। ‘লেট মি গেস,’ একই কথা আবারো বলে উঠল ও। ‘সারিন, তাই না?’
জোনায়েদ আর নিজের আরেক সঙ্গীর সঙ্গে মিলে কিছু একটা করছিল রহমান। আরিয়ান কথাগুলো বলতে তিনজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকাল ওর দিকে। ‘বাহ বাহ, লেখক সাহেব দেখি ভালো নলেজ রাখেন। কিন্তু একেবারে নির্দিষ্টভাবে বুঝলেন কীভাবে? লেখকের জ্ঞান দিয়ে তো এটা বোঝা সম্ভব নয়।’
‘আপনারা ভুলে যাচ্ছেন কেন?’ আরিয়ান নিজের পুরনো জীবনের অভিজ্ঞতা আর ট্রেনিং মনে করার চেষ্টা করছে কীভাবে নার্ভ গ্যাসের প্রভাব কমানো যায়। যদিও বসার পরে একটু ভালো লাগছে আগের চেয়ে। আরিয়ান বড়ো করে কয়েকবার দম নিয়ে চোখ তুলে তাকাল ওদের দিকে। ‘আমি একসময় আর্মিতে ছিলাম। সারিন নামের নার্ভ গ্যাসের বিষয়টা আমার জন্যে ধরতে পারাটা তো খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে,’ বলে ইচ্ছে করেই থেমে গেল আরিয়ান।
তিনজনেই এখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে, রহমান বলে উঠল, ‘বলুন বলুন মিস্টার এ, আজকের রাতের নায়ক আপনিই, মনের ভেতরে কোনো কৌতূহল রাখবেন না।’
‘আমি তো জানি সারিন বহু বছর আগে থেকে নিষিদ্ধ, আপনারা এই জিনিস পেলেন কোথায়?’ ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল আরিয়ান। ধীরে ধীরে নার্ভ গ্যাসের প্রভাব কমে আসতে শুরু করেছে। মাথাটা অনেকটাই পরিষ্কার লাগছে ওর এখন।
ওর প্রশ্ন শুনে বেশ জোরে জোরে হেসে উঠল রহমান। ‘দেখলে জোনায়েদ একেই বলে শিক্ষিত অভিজ্ঞ মানুষ। এরকম মানুষের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ, অনেক কিছু শেখা যায়, বলে আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাল সে। ‘আপনি আমাকে খুব অবাক করলেন মিস্টার আরিয়ান। আপনার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যাটা বরবাদ হয়ে গেছে, আপনার রেপুটেশন থেকে শুরু করে পুরো জীবন ঝুঁকি কিংবা বলা যায় মৃত্যুর মুখে। আপনি জানেন না এখন কি অবস্থায়, কোথায় আছেন। আপনার উচিত এখন চূড়ান্ত প্যানিকে থাকা, হাউ মাউ করে কাঁদা, জীবন ভিক্ষা চাওয়া, এক হাজারটা প্রশ্ন করা, বলে সে থেমে গেল। ভ্যানের ভেতরের আধো অন্ধকারে সে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। ‘আর আপনি কি না জানতে চাচ্ছেন নার্ভ গ্যাসের ব্যাপার,’ সে আনমনেই মাথা নাড়তে লাগল। ‘আপনি আমাকে অবাক করলেন মিস্টার এ।’
‘আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি,’ আরিয়ান খানিকটা সুস্থ বোধ করতেই হাত এবং পায়ের দুটো বাঁধনই পরখ করে ফেলেছে। প্লাস্টিকের স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো। একমাত্র কাটা ছাড়া টেনে কিংবা অন্য কোনোভাবে এগুলো খোলা বা ছেঁড়া অসম্ভব। যত টানা হবে তত শক্ত হয়ে বসবে, চামড়া কেটে মাংসে বসে যাবে। আরিয়ান ওর পেছনে বেঞ্চের লোহার পায়া হাতড়াতে লাগল।
‘আপনি ভুল বলেননি,’ রহমান তার হাতে সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো কিছু একটা পাশের বেঞ্চে রেখে জোনায়েদ আর অপর সেন্ট্রির দিকে ইশারা করে সোজা হয়ে হেলান দিয়ে বসল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা ঠোঁটে লাগাল। আরিয়ান দেখল এই শীতের রাতেও লোকটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এটা কি গরমের, ক্লান্তির নাকি, চূড়ান্ত অপরাধের আগে পাপবোধের। ‘যে-নার্ভ গ্যাসটা খুবই স্বল্প পরিসরে আপনার ওপরে প্রয়োগ করা হয়েছে ওটা আসলেই নিষিদ্ধ একটা জিনিস। কিন্তু আমাদের জন্যে কোনোকিছুই নিষিদ্ধ নয়, কোনো কিছুই আরাধ্য নয়।
‘হুমমম,’ বুঝতে পেরেছি। পেছনের বেঞ্চে যত হাতড়াচ্ছে তত হতাশ হয়ে পড়ছে আরিয়ান। কিছুই নেই। ‘আরেকটা প্রশ্ন, আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় যে-আমাদের কথাটা বললেও এটা কি আপনার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়, নাকি অন্য কোনো পরিচয়, মানে যাদের সঙ্গে বা যাদের জন্যে কাজ করছেন আপনি,’ আরিয়ান চোখ তুলে একে একে ওদের সবাইকে দেখে নিল।
আরিয়ান ভেবেছিল রহমান এবারো তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দেবে কিন্তু তা হলো না। বরং সে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল আরিয়ানের দিকে। আমি আপনাকে নিয়ে যা ভেবেছিলাম, আপনি তার চেয়ে অনেক বেশি ঘেড়েল মাল। এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন কামাল আহমেদ সুইসাইড করার পর আপনি তার বাড়িতে হানা দিয়েছিলেন কিন্তু কেউ সেটা ধরতে পারেনি,’ বলে সে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওর দিকে সেটা তাক করে বলে উঠল, ‘আপনার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আসলে হচ্ছেটা কি? আপনার সঙ্গে কেন এমন হলো, আসলে কী হতে যাচ্ছে? কারণ আমি ড্যাম শিওর আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আপনার মনে কোনো কৌতূহল নেই কেন?’ ভ্যানটা ধীরে ধীরে চলতে চলতে সামান্য ঝাঁকি খেল।
‘আমি তো গেছি,’ বলে আনমনেই হেসে উঠল আরিয়ান। সে রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমার নানি মাঝেমধ্যে একটা কথা বলত, রক্তে সয় না। কথাটার মানে কী জানেন, যার যেটা সয় না, তার সেটা করা উচিত না। ঘুষ, যার সহ্য হয় না, তার ঘুষ খাওয়া উচিত না, পাপ যার সহ্য হয় না, তার পাপ থেকে দূরে থাকা উচিত। প্রকৃতি সবার জন্যে সব বরাদ্দ করেনি। আমি তেমনি ছোট একটা পাপ করেছিলাম,’ বলে আনমনে মাথা নাড়ল আরিয়ান। ‘সহ্য হলো না।’
‘কি বক বক করছেন বলেন তো,’ রহমান জোনায়েদের দিকে তাকাতেই জোনায়েদ গড়গড়িয়ে বলে উঠল, ‘ক্যান আমরা এর এত কথা শুনতেছি, এইখানে ঠুসায়া দিলেই তো হয়।’
‘না, স্যার যেইহানে যাব সেইখানে যাইতে আরেকটু সময় লাগব। হুদাই এইহানে মাইরা ভ্যান ময়লা করার কোনো মানে হয় না।’ সেন্ট্রির কথাগুলো শুনে আরিয়ান নিশ্চিত হয়ে গেল ও যা ভাবছিল তাই করতে যাচ্ছে এরা। কিন্তু অবাক করা বিষয় একজন মানুষকে মেরে ফেলার কথা বলছে এরা, কিন্তু এমন অবলীলায় কথাগুলো বলছে, সাধারণ যে-কেউ একটা কুকুরকেও এমন নিস্পৃহার সঙ্গে মেরে ফেলতে পারবে না। এরমানে এই কাজ এরা এতবার করেছে, পুরোপুরি গা সওয়া হয়ে গেছে। একটা আপেল কাটা আর একজন মানুষকে পিঠে গুলি করে মেরে ফেলার ভেতরে কোনো তফাৎ নেই এদের কাছে। কিন্তু এভাবে হেরে গেলে চলবে না, কিছু একটা ভাবতে হবে ওকে। কিছু একটা বের করতেই হবে। এভাবে হারা চলবে না। নিজেকে স্থির করো, ঠান্ডা মাথায় ভাবো। নিজের ভুলে যাওয়া অতীতের ট্রেনিং মনে করার চেষ্টা করো। কাজে লাগাও তোমার টেকনিক্যাল ট্রেনিং।
‘এক কাজ করি, আমি যা জানতে চাইব সব তো আপনারা বলবেন না,’ আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে উঠল। ‘তারচেয়ে আমি বলি, আপনারা মেলান, এর বাইরে কিছু বলার থাকলে বলবেন।
‘ফেয়ার এনাফ, সিগারেটটা শেষ করে সেটাকে ভ্যানের মেঝেতে পিষে দিয়ে জোনায়েদের দিকে ফিরে বলে উঠল রহমান। ‘কি বলো জোনায়েদ?’ জোনায়েদ আর সেন্ট্রি দুজনেই হেসে উঠল।
‘আমাকে নিয়ে আপনারা স্পেশাল সেলের অফিসে পৌঁছানোর জন্যে রওনা দিলেও আমরা সেখানে কখনোই পৌঁছাব না, ঠিক না। বিশেষ করে আমি। পথিমধ্যে আমি পালানোর চেষ্টা করব,’ আরিয়ান মাথা নাড়ল। ‘হয়তো কারো বন্দুক বা পিস্তল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব, তারপর পালাতে গিয়ে পিঠে গুলি খেয়ে মারা যাব। যেহেতু আমার একটা পাবলিক ইমেজ আছে, কাজেই পুরো ব্যাপারটা এতটা সহজে হবে না, এখানে আরেকটু নাটকীয়তা লাগবে। সম্ভবত আপনাদের ভেতরে কেউ একজন গুলি খাবে। এই ভদ্রলোক হতে পারে,’ আরিয়ান এক সেন্ট্রিকে দেখাল। ‘ঠিক বলেছি?’
রহমান তালি দিয়ে উঠল। ‘পারফেক্ট, প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখেছেন আপনি জীবনে।’
‘কিন্তু ঢাকার ভেতরে এমন জায়গা বের করছেন কীভাবে?’
‘আমরা রওনা দিয়েছিলাম উত্তরা থেকে, আর স্পেশাল সেলের যে অফিসে যাওয়ার কথা সেটা মিরপুরে, কাজেই মাঝপথে আশুলিয়ায়—এরপর আপনি যে ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করবেন সেটার জবাবও বলে দিচ্ছি। মিডিয়া বা পাবলিক অপিনিয়ন, সেটাকে আমরা সামলাব কীভাবে। কাল সকালে আপনার লেখালেখি থেকে শুরু করে আপনার পারসোনাল লাইফ নিয়ে এমন কিছু জিনিস বের হবে, যা জেনে পাবলিক আসলে কনফিউজড হয়ে যাবে। তারা আপনার মৃত্যুর জন্যে প্রতিবাদ করবে নাকি, আপনাকে নিয়ে ঘৃণা ছড়াবে। কিন্তু তাদের হেল্প করবে আমাদের বিশেষ সাইবার সেল। দুপুরের ভেতরেই প্রচুর পরিমাণে হেইট পোস্ট ভাইরাল হতে শুরু করবে আপনাকে নিয়ে। বিকেলের ভেতরেই হ্যাশ ট্যাগে ছেয়ে যাবে অর্ন্তজাল,’ নিজের বলা ইন্টারনেটের বাংলা শব্দ শুনে নিজেই হেসে উঠল রহমান। ‘পরশু আপনার বইগুলো সব বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। বড়জোর এক সপ্তাহ এই কন্ট্রোভার্সি চলবে, একমাসের ভেতরে আপনার পরিবার বাদে কেউই কিছু মনে রাখবে না। এক বছরের ভেতরে আরিয়ান শফিক নামে এক লেখক ছিল এটাও কারো মনে থাকবে না। হ্যাঁ কিছু ঝামেলা হবে। আপনার প্রকাশক আর গার্লফ্রেন্ডকে কীভাবে আমরা ম্যানেজ করব, সেটা এরই মধ্যে আমরা বের করে রেখেছি। আপনার পরিবার কিছু ঝামেলা করবে। কিন্তু আপনার বাবা খুবই নিরীহ মানুষ। উনাকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আপনার চাচা বহুত ঝামেলা করতে পারে, উনার বন্ধুবান্ধব আছে সব জায়গায় কিন্তু তাদেরকেও সামলানোর মতো প্রস্তুতি এরই মধ্যে নিয়ে রাখা আছে। ট্রাস্ট মি, আপনি আর আপনার লেখা ভ্যানিশ করে দেয়ার পর বাকি জিনিস আসলে আমার মাথা ব্যথার বিষয়ও না। ওগুলো সামলানোর লোক আছে।’
‘বুঝতে পেরেছি,’ আরিয়ান মাথা নাড়ল। তারমানে ওরা এখন আশুলিয়াতে কোনো জায়গায়। রহমান বক বক করলেও আরিয়ান মনে মনেহিসেব করছে ভ্যানের পেছনে তিনজন, সামনে ড্রাইভারসহ সম্ভবত আরেকজন আছে। ওদের সঙ্গে জিপ থাকতেও পারে নাও পারে। ‘সবই বুঝলাম কিন্তু সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন রয়ে যায়,’ আরিয়ান সরাসরি তাকিয়ে আছে রহমানের মুখের দিকে। ‘কেন?’ বলে ও মৃদু হেসে উঠল। পুরনো ট্রেনিং মনে করতে এবং কাজে লাগাতে পারছে, ব্যাপারটা ভাবতেই বেশ ভালো লাগছে ওর। ‘আমার মতো একজন ছাপোষা লেখককে নিয়ে এত আয়োজন কেন? প্রথমে আমাকে খুনি সাজানো, এরপর এতকিছু, এই নিরীহ হৃদয় জানতে চায় কেন এতকিছু?’ আরিয়ানের মস্তিষ্ক ভিন্ন খাতে চললেও ওর করা প্রশ্নের শেষ উত্তরটুকুর জবাব ও আসলেই জানতে চায়।
রহমান মুখ খুলতে যাবে তার আগেই ভ্যানের অন্যপাশের অংশে থাকা সেন্ট্রি ভ্যানের ড্রাইভিং অংশ আর এপাশের ভেতরে ছোট একটা ফোকরের মতো জায়গা দিয়ে বলে উঠল, ‘আর কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা পৌঁছে যাব।’
‘আমরা আমাদের জার্নির শেষদিকে চলে এসেছি মিস্টার এ রহমান খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল। তার চোখে মুখে সেই আগের দুষ্টুমির ভাবভঙ্গি আর নেই। ‘মিস্টার আরিয়ান, আপনাকে কয়েকটা কথা বলি, যদিও আপনাকে নিয়ে গবেষণা করছি আমরা বেশ কয়েকদিন। কিন্তু কাগজপত্র আর সোশ্যাল মিডিয়ার আপনি আর বাস্তবের আপনার ভেতরে অনেক পার্থক্য। শুনতে অবাক শোনালেও এই স্বল্প সময়েই আপনাকে আমার বেশ ভালোই লেগে গেছিল। আগেই বলেছি আমার স্ত্রী আপনার ফ্যান, যদি আগে কিংবা ভিন্ন পরিবেশে পরিচয় হতো তাহলে হয়তো আমরা বন্ধু হতাম। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আপনি আর আমি বন্ধু নই। আমরা শত্রু,’ রহমান আরিয়ানের চোখের গভীরে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান এই প্রথমবারের মতো অনুভব করল, এই লোক আসলে খুনি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার খোলসের ভেতরে জন্মগতভাবে এক খুনির বসবাস এই লোকের ভেতরে। আরিয়ান যদিও ভেতরে ভেতরে কিছু একটার জন্যে তড়িৎগতিতে হাতড়ে চলেছে, তাও সেই একই ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রহমানের চোখের গভীরে। দুজনেই দুজনার দিকে তাকিয়ে রইল। রহমান বলে চলেছে, ‘আর আমি আপনাকে খুন করব আর কিছুক্ষণের ভেতরেই। তবে মনে রাখবেন, আপনার মৃত্যুতে এত বেশি মানুষের এত বেশি লাভ, মরতে আপনাকে হতোই, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, ছোট একটা পাপ আপনার জন্যে কাল হলো, ছোট একটা পাপ আপনার সাজানো জীবনকে ঝড়ের মতো পালটে দিল। মরতে হচ্ছে আপনাকে, সেই ছোট পাপটা রক্তে সয়নি আপনার,’ রহমান হাত বাড়াল জোনায়েদের দিকে। জোনায়েদ একটা নাইন এম এম ধরিয়ে দিল তার হাতে। সেটাকে লোড করতে করতে রহমান বলে উঠল।
‘আমরা যতই মুখে বলি না কেন, কেউই আসলে সিনেমার প্রভাব থেকে বের হতে পারি না,’ বলে সে লোড করা নাইন এম এমটা আরিয়ানের দিকে তাক করে বলে উঠল, ‘শেষ কোনো ইচ্ছে থাকলে বলতে পারেন।’
আরিয়ান এই প্রথমবারের মতো অনুভব করতে পারল এরা সত্যি সত্যি মেরে ফেলতে যাচ্ছে ওকে। মনের ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এলো ওর,
কেন, স্রেফ একটা লেখার জন্যে কেন মরতে হচ্ছে ওকে?
৮
‘এক মিনিট,’ আরিয়ান মরিয়ার মতো বলে উঠল।
ক্ষণিকের জন্যে থেমে গেল রহমান। ‘বলুন,’ নাইন এম এম নাচিয়ে বলে উঠল সে।
‘একটা সিগারেট খেতে পারব?’ রহমানের পাশের বেঞ্চের দিকে দেখিয়ে বলে উঠল আরিয়ান। ওখানে রহমানের সিগারেটের প্যাকেটটা রাখা। ‘ওহ, ইয়েস, সার্টেইনলি,’ বলে সে ইশারায় তার পাশের সেন্ট্রিকে দেখিয়ে ওটাকে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিতে ইশারা করল।
‘থ্যাংকস,’ রহমানের দিকে আক্ষরিক অর্থেই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামান্য মাথা নাড়ল। আরিয়ান দেখল সেই মেয়েটার ধরিয়ে দেয়া ছোট চিরকুটটা ভ্যানের মেঝেতে পড়ে আছে। ও মনে মনে প্রার্থনা—করল রহমান, জোনায়েদ কিংবা তাদের সেন্ট্রিদের কারো চোখে না পড়ে গিয়ে থাকলেই হয় জিনিসটা। যদিও সার্বিক পরিস্থিতিতে কোনো আশার আলোই নেই, তবুও একবারের জন্যে হলেও চেষ্টা করে দেখতে হবে ওকে, দুনিয়াতে বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো আর কিছু নেই, আর বাঁচার জন্যে করা যায় না এমন কিছু হতেই পারে না। সেন্ট্রি সিগারেটের পুরো প্যাকেটটা নিয়ে ওর দিকে এগোতে যাচ্ছিল রহমান ধমকে উঠল তাকে। ‘আ আ আ,’ বলে এক হাতে সেন্ট্রির ট্রাউজারের পেছনের অংশ চেপে ধরল সে। ‘এই ব্যাটা এতদিন হলো আমার সঙ্গে কাজ করিস, আজো কিছুই শিখতে পারলি না।’
সেন্ট্রি খানিকটা ধমক খেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঠিক বুঝতে পারছে না সে ভুলটা কোন জায়গায় করেছে। রহমান সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে জোনায়েদের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘কীসব পাগল-ছাগল-গর্দভ নিয়ে কাজ করি। এরা একদিন আমারে ডোবাবে,’ বলে প্রায় চড় মারার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। ‘ব্যাটা, সিগারেটের প্যাকেট দিবি ওরে, একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে ওর মুখে লাগিয়ে দে,’ বলে আরেক দফা চড়ের ভঙ্গি করল। সেন্ট্রি বেজার মুখে সিগারেট বের করে ধরিয়ে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিতে আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করল, ‘এভাবে হাত বাঁধা থাকলে কীভাবে—’
রহমান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে মৃদু হেসে উঠল, ‘জোনায়েদ,’ বলতেই জোনায়েদ নিজের পিস্তল বের করে আরিয়ানের দিকে তাক করল। ‘কোনোরকম চালাকির চেষ্টা না মিস্টার এ, এমনিতেও মরবেন, আর যদি উলটাপালটা কিছু করার চেষ্টা করেন, সোজা পেটে গুলি করা হবে, ধীরে ধীরে কষ্ট পেয়ে মরবেন। কাজেই—’
আরিয়ান আনমনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। সেন্ট্রি এগিয়ে এসে, আরিয়ানকে টেনে খানিকটা সামনে এনে সিগারেটটা নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে পকেট থেকে এন্টি কাটারের মতো কিছু একটা বের করল। সেটা দিয়ে হাতের স্ট্র্যাপটা কেটে দিতেই লাল হয়ে ওঠা কবজি ডলতে লাগল। সেন্ট্রি সিগারেটটা নিজের ঠোঁট থেকে নিয়ে আরিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিল। ‘থ্যাংকস’ সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিল। ধোঁয়া আর পুরুষ মানুষের ভেতরের সম্পর্কটা অনেকটা ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে পুরনো হয়ে আসা খেলনার মতো, যতই পুরনো হোক না কেন, সম্পর্কটা পুরোপুরি কখনই বাদ হয়ে যায় না। বারবার ভিন্নভিন্ন রূপে ফিরেফিরে আসে। আরিয়ান নিজেকে নিজে প্রমিজ করেছিল, যদি কখনো সফল নভেলিস্ট হতে পারে ধূমপান ছেড়ে দেবে, দিয়েছিলও, আজ প্রায় এক বছর পর আবার সিগারেটে টান দিতেই ভেতর থেকে উঠে আসা কাশির দমকটাকে ঢোক গিলে ভেতরে চাপিয়ে দিল ও। ‘একটা কথা জানার ছিল রহমান সাহেব, এটা আপনার কততম হত্যাকাণ্ড?’
‘আর ইউ শিওর, আপনি এটাই জানতে চাচ্ছেন মিস্টার এ?’ রহমানও প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে টানতে লাগল। ‘খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার, মিস্টার এ। আমি এখনো আপনাকে ধরতে পারছি না। আমি জানি আপনার মনে হাজারো প্রশ্ন আছে। হাজারো আকুতি আছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই জিজ্ঞেস না করে আপনি কি না আমার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন।’
‘আপনি আমার জায়গায় হলে কী করতেন?’ আরিয়ান ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল। রহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘আমি এটা বুঝতে পারছি জিনিসটা শুরু কোথা থেকে কীভাবে হয়েছে। কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এরকম তুচ্ছ একটা বিষয়ের জন্যে এরকমটা কেন হচ্ছে? কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও অনুধাবন করতে পারি আমি যা-ই জানতে চাই আপনি পুরোপুরি পরিষ্কার উত্তর দেবেন না,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। ‘আপনার চ্যালারাও সম্ভবত সবটা জানে না,’ আরিয়ান দেখল রহমানের মুখে খানিকটা মেঘ জমে উঠল ওর শেষ কথাটা শুনে।
‘আমি কেন জানতে চাচ্ছিলাম বিষয়টা জানেন, ফোর্সের ভেতরে আপনাদের মতো করাপ্টেড লোক যারা আছে, তাদের নিয়ে আমার মাথায় একটা গল্পের প্লট ছিল। এক নরকের কীট,’ বলে সে হাতে ধরা সিগারেটটা নেড়ে ওদের দেখাল। অনেকটা আপনাদের মতোই। নিজের আর্লি ক্যারিয়ারে টাকার জন্যে বসের নির্দেশে এনকাউন্টারের নামে ইচ্ছেমতো কিলিং করে, তারপর একটা সময় গিয়ে সে আর মেন্টাল স্ট্যাবিলিটি ধরে রাখতে পারে না,’ বলে খানিক থেমে সিগারেটে টান দিয়ে বলে উঠল। শালা মাদারচোতটা অতিরিক্ত খাইতে গিয়ে, ক্যারিয়ার, পরিবার, অর্থ সবই হারায়। ওর টাকায় বাকিরা মৌজ করে, আর ওর পরিণতি হয় পাগলাগারদের অন্ধকারে। বাকি জীবন শালা বিচি আর মস্তিষ্কে কারেন্টের শক খেয়ে পার করে,’ আরিয়ান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওদের দিকে দেখছে, তিনজনেরই মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। রহমানের ঘর্মাক্ত মুখটা দেখে মনে হচ্ছে টকটকে লাল চোখের মণিদুটো টপ টপ করে খসে পড়বে। ,
‘বাইনচোত—’ জোনায়েদ আরিয়ানের দিকে এক পা এগিয়ে এসে পিস্তল তুলল, ওদের ভ্যানের পেছন দিকে অন্য একটা গাড়ির আলো দেখা গেল। তিনজনেই সেদিকে ফিরে তাকাল কিন্তু আরিয়ান তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে সেটাকে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝে চেপে ধরল ও। ‘আপনারা আমার আর্মির ব্যাকগ্রাউন্ড তো জানেনই, তবে একটা বিষয় জানেন কি না জানি না,’ আরিয়ান বলে যাচ্ছে, হঠাৎ রাস্তায় অন্য গাড়ির আলোটা দেখে ওরা চমকে উঠেছে। নিজেদের ভেতরে কিছু একটা বলাবলি করছিল, আরিয়ানের শেষ কথা শুনে তিনজনেই ওর দিকে ফিরে তাকাল। ‘আমি ডার্ট থ্রোয়িং চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।’
‘কী?’ জোনায়েদ আরকটু এগিয়ে এলো, আরিয়ান তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝে ধরা অর্ধেক হয়ে আসা সিগারেটটাকে ডার্ট টোকা দেয়ার ভঙ্গিতে কাত করে তার চোখের দিকে ছুড়ে মারল। সিগারেটটা ছুটে যাচ্ছে নিজের শরীরটাকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো একটা ঝাঁকি মারল আরিয়ান। পা দুটো বাঁধা থাকার কারণে খোলা হাতেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না, ও জানত। যে-কারণে সিগারেটের মাথাটা ছুড়ে দিয়েই শরীরটাকে বাঁকিয়ে লাফ মারল যতটা দূরত্ব পার হওয়া সম্ভব। সিগারেটের আগুনের অংশটা গিয়ে সোজা লাগল জোনায়েদের দুই চোখের মাঝখানে, সঙ্গে সঙ্গে তার পিস্তলের মাথাটা ঘুরে গেল অন্যদিকে। আরিয়ানের উদ্দেশ্য ছিল, তার চোখে ওটা লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ে লাথি মারবে যাতে পিস্তলটা ছুটে যায় কিংবা সে পড়ে গেলে কোনোভাবে পিস্তলটা উঠিয়ে নিতে পারে ও। কিন্তু আরিয়ান যে-হিসেব করেছিল সেটা হলো না। ও লাফিয়ে যতটা যেতে পারবে ভেবেছিল গেল তারচেয়ে কম এবং লাথি যখন মারল সেটাও লাগল না জোনায়েদের পায়ে। বরং জোনায়েদ সিগারেটের আগুন লাগতেই খানিকটা পিছিয়ে গেল এক হাতে চোখ দুটো ঢেকে। আর অন্যদিকে রহমান এবং আরেক সেন্ট্রি মুহূর্তের জন্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে রইল ওর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ওই ক্ষণিকের জন্যেই। যে-মুহূর্তে বুঝতে পারল আসলে হচ্ছেটা কি সঙ্গে সঙ্গে রহমান প্রায় গর্জে উঠে বেঞ্চের একপাশে সরে গেল, সেই সঙ্গে নিজের পিস্তল বের করার জন্যে কোমরে হাত দিল। আর সেই সেন্ট্রি কিছু না বুঝেই প্রায় গর্জন করে লাফিয়ে পড়ল আরিয়ানের ওপরে। আরিয়ানও এক গড়ান দিয়ে সরে গেল একপাশে, লাফিয়ে পড়া সেন্ট্রি সোজা গিয়ে বাড়ি খেল জোনায়েদের গায়ের সঙ্গে। জোনায়েদ নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল তার আগেই সেন্ট্রির বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে, তার কনুই ভ্যানের মেঝেতে বাড়ি খেতেই পিস্তল থেকে গুলি ছুটে গেল। বদ্ধ ভ্যানের ভেতরে শব্দ হলো বোকার মতো।
আরিয়ান তখনো মাটিতে, ও দেখল রহমান নিজের পিস্তলটা প্রায় বের করে ফেলেছে, মাটিতে এক গড়ান দিয়ে ও সরে এলো বেঞ্চের কাছাকাছি। লোহার বেঞ্চিটার মাঝের পায়াটা খানিকটা চিকন তিনকোনা লোহার পাতের মতো। আরিয়ান বড়ো করে একবার দম নিল। একবারই সুযোগ পাবে হয় পা ভাঙবে, গুলি খেয়ে মরবে না হয়, সমস্ত শক্তি দিয়ে জোড়া পা ঠেলে দিল ও লোহার পায়াটার দিকে। দুইপায়ের ফাঁক গলে একপাশের পায়ের খানিকটা চামড়া উঠিয়ে নিয়ে পায়ের স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেল কট করে। পায়ে আগুন ধরে গেলেও, উলটো ঘুরে সোজা হয়েই ও দেখতে পেল দুটো পিস্তল উঠে আসছে ওর দিকে, সেই সঙ্গে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে সেন্ট্রিটা। আধ বসা থেকেই ও লাফ দিল সেন্ট্রির দিকে। লোকটাকে জড়িয়ে ধরে এক পাক খাইয়ে ল্যান্ড করল ও ভ্যানের মেঝেতে, সেই সঙ্গে রহমান আর জোনায়েদের দুটো গুলিই লাগল সেন্টির গায়ে। লোকটা প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলে থেমে গেল ভ্যানটা এবং আরিয়ান চলে এলো ভ্যানের দরজার কাছে।
যেকোনো মূল্যে দরজা খুলতে হবে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ও লাথি মারল ভ্যানের দরজায়, কিন্তু হতাশার সঙ্গে অনুধাবন করল এটা খুলবে না, চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল দুটো পিস্তল তাক করা ওর দিকে। ‘খামাখা লোকটাকে মারলেন,’ এরকম অবস্থাতেও রহমান একেবারে শান্ত গলায় কথা বলতে বলতে পিস্তল তুলল ওর দিকে। আরিয়ান দেখল গুলি খাওয়া সেন্ট্রির রক্তে ভেসে যাচ্ছে ভ্যানের মেঝে। আর এক সেকেন্ডের ভেতরে ওরও একই পরিণতি হবে। কিছু না ভেবে চট করে বসে পড়ল ও মেঝেতে সঙ্গে সঙ্গে ঠঙ করে গুলির সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে গেল ভ্যানের দরজা। আরিয়ান দেখল রহমানের গুলিতে খুলে গেছে ভ্যানের দরজা আরিয়ান লাফ দিতে যাবে তার আগেই একটা সিআরভি এসে তীব্র শক্তিতে বাড়ি মারল ওদের ভ্যানটাকে, আরিয়ান লাফ দেবার আগেই বাড়ি খেয়ে উলটো চলে এলো রহমান আর জোনায়েদের কাছাকাছি। নিজেদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও জোনায়েদ খপ করে চেপে ধরল ওর কোটের কলারের কাছটায়, ঝাপটা দিয়ে ছাড়ানোর আগেই আবারো সিআরভিটার বাড়ি খেয়ে একপাশে ঘুরে গেল ভ্যানটা। আরিয়ান অনুভব করল থেমে থাকা ভ্যানটা আবারো চলতে শুরু করেছিল তার আগেই বাড়ি খেয়ে আবারো তিনজনেই গড়িয়ে পড়ে গেল। আরিয়ানই মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই দেখল রহমান শরীরের ব্যালেন্স ফিরে পাবার আগেই পিস্তল তুলছে, অনেকটা ছোট বাচ্চাদের হাত থেকে যেভাবে বড়োরা মারামারির সময়ে লাঠি কেড়ে নেয়, ঠিক সেভাবেই ছোঁ দিয়ে ছিনিয়ে নিল ও পিস্তলটা। কিন্তু আরিয়ান সেটা তোলার আগেই গড়িয়ে পড়ে গেল সে আরিয়ানের ওপরে। ভারসাম্য হারানো ভ্যানের ভেতরে দুজনে লাটুর মতো পাক খেতে খেতে আরিয়ান চলে এলো খোলা দরজার বাইরে, আর দরজার একপাশে থেমে গিয়ে ওর প্যান্টের পায়া চেপে ধরল রহমান।
আরিয়ানের শরীরটা অর্ধেক ভ্যানের বাইরে, তার পা চেপে ধরে আছে রহমান। চিৎকার করে কেউ কিছু একটা বলে উঠল, আরিয়ানের সেদিকে নজর নেই। ও দেখল সেই সিআরভিটা আবারো চলে এসেছে ওদের গাড়ির কাছাকাছি, ভেতরের মানুষটাকে দেখে চমকে উঠল ও। সেই সঙ্গে বুঝল এটাই শেষ সুযোগ। নিজের হাতে ধরা পিস্তলটা তাক করল রহমানের দিকে, দাঁতে দাঁত পিষে রহমান চট করে ছেড়ে দিল ওর পাটা।
ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো ও শুন্যে ঝুলে আছে যেন অনন্তকাল ধরে। পরমুহূর্তে একেবারে পিঠ দিয়ে পড়ল সিআরভিটার ছাদে। আর সিআরভিটা সমস্ত শক্তি দিয়ে বাড়ি মারল ভ্যানটাকে। আরিয়ানের মনে হলো আবারো শূন্যে উঠে পড়বে ও, কিন্তু তার আগেই একপাশে সিআরভিটার লাগেজ ক্যারিয়ারটা চেপে ধরল এক হাতে। তাও ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো, টিকবে না, কিংবা ধাক্কার চোটে হাতটাই ছিঁড়ে যাবে ওর। কিন্তু হাতও ছিঁড়ল না, ও পড়ল না, বরং ভারী সিআরভির ধাক্কার চোটে ভ্যানটা ছুটে গেল রাস্তার একপাশের খাদের দিকে। ভ্যানটা গড়িয়ে পড়ে গেল, আর সিআরভিটা ভারসাম্য হারাতে হারাতে উলটো ঘুরে
থেমে গেল রাস্তার একপাশে। আরিয়ান গড়িয়ে চলে এলো ওটার উইন্ডশিল্ডের ওপরে। মুহূর্তের জন্যে মেয়েটার চোখে চোখ পড়ে রইল ওর। মেয়েটা চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। কিন্তু কানে ঢুকছে না ওর। শরীরটা রাস্তার ওপরে পড়ে যেতেই একহাতে পিস্তলটা ধরে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে এসে বসল কোনোমতে।
সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিল সেই ডিবিএস অফিসার রাসনা মেয়েটা। সিআরভিটা উলটো ঘুরতে ঘুরতে আরিয়ান দেখল ভ্যানটা রাস্তার পাশের খাদের ঢালু অংশে কাত হয়ে আছে। মেয়েটা বন বন করে হুইল ঘুরিয়ে গাড়ি চালু করে দিলে দশ মিনিটের ভেতরে উঠে এলো বেড়িবাঁধের ওপরে।
আরিয়ান গাড়ি দম নিতে নিতে নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে, মেয়েটার দিকে দেখল। সেই জিন্স আর হুডি পরনে মেয়েটা একমনে গাড়ি চালাচ্ছে সে। ‘আমরা…’ নিজের গলা নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হলো ওর। ‘আমরা আছি কোথায় এখন?’ আর কি জিজ্ঞেস করবে বুঝতে না পেরে জানতে চাইল আরিয়ান। মেয়েটা প্রথমে একবার ওকে দেখে নিল, তার চোখে হিমালয় পর্বতের কাঠিন্য এইমাত্র যে-মানুষটা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে তাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে মুখ খুলতেই মেয়েটা গাড়ি থামিয়ে দিল বেড়িবাঁধের অন্ধকার এক অংশের দিকে।
‘থ্যাংকস আপনি—’ আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আচমকাই মেয়েটার শক্ত হাতে কষে চড় খেয়ে রীতিমতো ভড়কে গেল আরিয়ান।
৯
ভ্যানের আটকে পড়া দরজায় এক লাথি মারতেই সেটা একপাশে হেলে পড়ল, আর সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রহমান। বাইরে বেরিয়ে নিজের হাত ডলতে ডলতে দেখতে পেল ভ্যানের ড্রাইভার আর ড্রাইভারের পাশের সিটে থাকা আরেক সেন্ট্রি দুজনেই মাটিতে বসে আছে। ড্রাইভারের কপাল ফেটে গেছে আর হাঁটু ডলছে অন্য সেন্ট্রি।
‘এই, তোমরা ঠিক আছ?’ রহমান নিজের ব্যথা পাওয়া কনুই ডলতে ডলতে চারপাশে তাকাল। নির্জন জায়গায় এনে কাজ সারার সিদ্ধান্তটা ওদের ওপরই উলটো ফল বয়ে আনল। হাত ডলে নিয়ে মাথাটাকে ঘুরিয়ে দুইবার ঘাড় ফোটাল সে। ব্যথা পাওয়া আহত হাতটাকে চোখের সামনে এনে হাতের মুঠোয় ধরা টুকরো কাগজটাতে চোখ বুলাল একবার।
‘স্যার, ওর মাথা ফাইট্টা গেছে, আর আমিও হাঁটুতে ব্যথা পাইছি,’ হাঁটু ডলতে থাকা সেন্ট্রি খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে এলো রহমানের সামনে। তার দিকে না তাকিয়ে মুঠোয় ধরা কাগজটা দেখতে দেখতেই সে সেন্ট্রির সঙ্গে কথা বলে উঠল, ‘এইগুলো কোনো বিষয় না, যে-পরিমাণ টাকা দেয়া হচ্ছে তোমাদের তার সঙ্গে এইগুলো হলো চাটনির মতো,’ বলে সে চোখ তুলে তাকাল সেন্ট্রির দিকে। লোকটা তার কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রহমানকে তাকাতে দেখে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ‘শোন, ভ্যান সোজা করার ব্যবস্থা করো, তবে তার আগে ভেতর থেকে জোনায়েদরে বের করো, ও ব্যথা পেয়েছে তবে বেশি না। আর গহর মারা গেছে গুলি খেয়ে,’ একটু আগে গুলি খেয়ে মারা যাওয়া সেন্ট্রির কথা বলতেই ড্রাইভার আর দ্বিতীয় সেন্ট্রি দুজনেই মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ‘ওর লাশের একটা ব্যবস্থা করতে হবে,’ বলেই রহমান থেমে গেল। খানিকটা সময় ভেবে নিয়ে সে আবারো বলে উঠল, এক কাজ করো, জোনায়েদরে বের করো, গহররে কিছু করার দরকার নেই—’
স্যার, গহর ভাইয়ের লাশটা ভেতরে—’ কপালে হাত দেয়া ড্রাইভার কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল তার আগেই রহমান প্রায় ধমকে উঠল ওদের দুজনকেই।
‘কথা কানে যায় না? বললাম না আমি ব্যবস্থা করতেছি,’ রহমানের ধমক খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল দুজনেই। রহমান দেখল দুজনে পলকের জন্যে চোখাচোখি করল। ‘ঠিক আছে স্যার,’ বলে মাথা নিচু করে সেন্ট্রি এগিয়ে গেল ভ্যানের দিকে। দুজনে মিলে ভ্যানের দিকে এগোচ্ছে, রহমান ফিরে তাকাল রাস্তার দিকে। পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। সে নিজে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ এবং নিজেই নিজের সমালোচনা করতে পারে খুব ভালোভাবে। আজ রাতে তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অপারেশন ছিল, কিন্তু সে সব গুবলেট পাকিয়ে রীতিমতো জট পাকিয়ে সব একাকার করিয়ে ফেলেছে। আর এটা ঘটেছে তার নিজের ভুলের জন্যে। এতদিনের প্রস্তুতি, প্ল্যানিং সব জড়িয়ে ফেলেছে সে স্রেফ নিজেকে বড়ো করে দেখা আর লেখক লোকটাকে আন্ডার এস্টিমেট করার কারণে। সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎই ফস করে হেসে ফেলল সে। এমনিতে খুব বেশি বই পড়া কিংবা সিনেমা দেখার অভ্যাস নেই তার, কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক মানে পুলিশ হিসেবে কপ জনরার সিনেমার প্রতি তার খুব আগ্রহ। সুযোগ পেলেই পুলিশি সিনেমা দেখার চেষ্টা করে। আর তাই এরকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে তার প্রিয় এক একটা কপ জনরার সিনেমা ‘ট্রেনিং ডে’র ডেঞ্জেল ওয়াশিংটনের আলোঞ্জো চরিত্রটার কথা মনে পড়ছে।
কথাটা মনে হতে আনমনেই সে মাথা নাড়ল। এবার তাকে বকা খেতে হবে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল ওটার স্ক্রিন ফেটে গেছে। কয়েকদিন আগে কেনা আইফোন ফোর্টিন প্রো ম্যাক্সের এই করুণ অবস্থা দেখে তার মেজাজ খারাপ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আসন্ন ভয়াবহ কথোপকথনের চিন্তায় ব্যাপারটা তার চোখেই পড়ল না। ‘হ্যালো,’ বিশেষ নম্বরে ডায়াল করে সে খুব ঠান্ডা গলায় বলে গেল কী ঘটেছে, এরপর নীরবে শুনে গেল ওপাশের কথা। কোনো ধমক নয়, রাগ নয়, কোনো কটু কথা নয় কিন্তু কথা শুনতে শুনতে হালকা ঠান্ডার ভেতরেও কপালে ঘাম ছুটে গেল। অন্তত এক হাজারবারের মতো জি জি বলে কল কেটে দিল। কলটা কেটেই যৌনসঙ্গমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যতগুলো গালি সে জানে সেগুলোর তুবড়ি ছোটল কিছুক্ষণ, তারপর বড়ো করে একবার দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করে কাদা সহ্য করতেই হবে, আবারো ডেঞ্জেল ওয়াশিংটনের সিনেমার ডায়লগ। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে নিজেকে অনেকটাই শান্ত করে ফেলল সে, সেই সঙ্গে মনে মনে ঠিক করে ফেলল পরবর্তী করণীয়, সিগারেট শেষ করে আবারো ফোন বের করল। এবার মুখটা বাঁকা হয়ে গেল স্ক্রিনটা দেখে। তাও ভালো, কাজ করছে এটা। আজ রাতে এটার কোনো বিকল্প নেই।
‘হ্যাঁ, মন দিয়ে শোন,’ ওপাশের মানুষটা কল রিসিভ করতেই বলে উঠল সে। ‘পুরো টিমকে এলার্ট করে দাও, অন ফিল্ড, অফ ফিল্ড দুটোই,’ ওপাশে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই প্রায় গর্জে উঠল সে। ‘আমার কথার ভেতরে কথা বলবে না। সবাইকে চাই আমি আজ রাতে। এটা প্রথম কথা। এরপর, সাইবার টিমকে কাজে লাগাও, যে-ব্যাপারগুলো কাল সকালে ফ্ল্যাশ করার কথা ছিল সেগুলো আজই ফ্ল্যাশ করে দাও,’ বলে সে ঘড়ি দেখল। ‘এখন না, আরো আধা ঘণ্টা পর। সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া রিচ করবে বেশি লোকে। লেখক সাহেবের ইমেজের যেন চৌদ্দটা বাজে আজ রাত এগারোটার ভেতরে, না হলে তোমার আঠাশটা বাজাব আমি,’ বলে সে এক সেকেন্ড চিন্তা করল। ‘প্রেমিকা আর প্রকাশকের ফুল প্রোফাইল চাই আমি, আধা ঘণ্টার ভেতরে, তাদের দুর্বলতা আর পরিবারের ডিটেইলসহ, আরেকটা জিনিস,’ সে পকেট থেকে সদ্য বের করে আনা সেই কাগজের টুকরোটা দেখল, সেই সঙ্গে মনে করার চেষ্টা করল সেই অডিটরিয়ামের অভিজ্ঞতা আর একটু আগে সিআরভিটার উইন্ড শিল্ডের ওপাশে দেখা চেহারাটা। ‘আরো একজনের ব্যাপারে আরেকটু বিস্তারিত তথ্য চাই আমি,’ বলে সে আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে কল কেটে দিতেই দেখল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তিনজনেই।
‘আরে জোনায়েদ, তুমি তো দেখি ঠিকই আছো।’
‘স্যার, পিঠে ব্যথা পেয়ে উঠতে পারছিলাম না, এখন সব ঠিক আছে।
‘গুড, ফোর্সে খবর দাও, ব্যাকআপ পাঠাতে বলো, কীভাবে কী বলতে হবে তো জানোই, সেই সঙ্গে সবাইকে অ্যালার্ট করে দাও। একেবারে রেড অ্যালার্ট। এক ফেরারি আসামি একজন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করে আরেকজন অফিসারের অস্ত্র হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। সশস্ত্র এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক,’ একটু থেমে যোগ করল। ‘আরো বলবে তাকে সম্ভাব্য সাহায্য করছে এক ছুটিতে থাকা অফিসার। তার ব্যাপারে ডিটেইল এখনি জানানোর দরকার নেই। গো, গেট টু ওয়ার্ক।’
‘আর স্যার, এই আরিয়ান হারামজাদার ব্যাপারে—’
‘অ্যালার্ট জারি করো, তবে আমি জানি ওরা এভাবে ধরা পড়বে না,’ বলে সে হাতের চিরকুটটা দেখল। কিন্তু আমি জানি ওদের সম্ভাব্য কোথায় পাওয়া যেতে পারে,’ ঠোঁটের কোনাটা বাঁকা হয়ে গেল তার বিশেষ ভঙ্গিতে—যেটাকে সবাই হাসি বলে।