একটি সন্ধের যবনিকা – ২০

২০

‘এই! চুপ করো,’ কথার মাঝখানেই রহমান এমনভাবে সিকিউরিটির লোকটাকে ধমকে উঠল সিকিউরিটি তো বটেই আশপাশে তার লোকেরা পর্যন্ত চমকে উঠল। রহমানের পার্টনার জোনায়েদ খুব অবাক হয়ে ফিরে তাকাল রহমানের দিকে। এতদিন ধরে সে রহমানের সঙ্গে কাজ করছে কিংবা বলা যায় কুকাজ করছে কিন্তু রহমানকে এভাবে চট করে রেগে উঠতে খুব কমই দেখেছে। রহমানের মতো ভয়ংকর শান্ত মাথার খুনি সে জীবনে আর একটাও দেখেনি। লোকটা কখনোই রাগে না, বলতে গেলে প্রায় কখনোই উত্তেজিত হয় না, হাসতে হাসতে আবার কখনো কখনো একেবারে ভাবলেশহীনভাবে মানুষ খুন করতে দেখেছে জোনায়েদ। সে প্রায় নিশ্চিত রহমান যদি এহেন বঙ্গদেশে জন্ম না নিত, লোকটা নিশ্চিত সাইকোপ্যাথ খুনি হতো। তবে এখনো সে কোনো অংশে কম না, বরং সাধারণ সাইকোপ্যাথ কিংবা সিরিয়াল কিলারের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এই লোকের কাছে খুন করার লাইসেন্স রয়েছে, রয়েছে অথরিটি প্রভাইডেড অনুমতি, সেই সঙ্গে সবচেয়ে বড়কথা তার পেছনে রয়েছে সব বড়ো বড়ো মহলের সাপোর্ট, যা তাকে অপ্রতিরোধ্য এক কিলিং মেশিনে পরিণত করেছে। যে কিলিং মেশিনকে প্রতিনিয়ত কাজে লাগিয়ে চলেছে একাধিক মহল। জোনায়েদ জানে রহমানের অনেক অনেক খারাপ গুণ আছে কিন্তু সে রেগে ওঠে না, বলতে গেলে কখনোই না। কিন্তু আজ এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো লোকটাকে রেগে উঠতে দেখল সে। এটা কি সে পরিস্থিতির ওপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে ইচ্ছে করে করছে—নাকি আজকের এই বিশেষ রাতের মানসিক চাপ এমনকি রাহমানের মতো ঠান্ডা মাথার লাইসেন্সধারী ক্রিমিনালের জন্যেও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এতদিন ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর যেখানে আজ রাতে উচিত ছিল সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার—সেখানে কি না পরিস্থিতি বারবার তাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে রহমান এবার যেভাবে নিজের ফোর্স নিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে ধরেছে এবার আর রক্ষা নেই ওদের।  

নিজের ভাবনার জগতে ক্ষণিকের জন্যে হারিয়ে গেলেও যেই মুহূর্তে জোনায়েদ দেখতে পেল রহমান তাকে হাতের ইশারায় ডাকছে, প্রায় লাফিয়ে এগিয়ে গেল সে তার দিকে। জোনায়েদ এগোতেই বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার এলাকার গার্ডের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জোনায়েদের দিকে নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিল রহমান। মুহূর্তের জন্যে দিশেহারা বোধ করল জোনায়েদ কিন্তু ওই ক্ষণিকের জন্যেই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে অনুধাবন করল এই সময়ে কী প্রয়োজন হতে পারে রহমানের। পকেটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দুটো খাম একসঙ্গে বের করে এনে নির্দিষ্ট খামটা খানিকটা আন্দাজে বের করে রহমানের দিকে এগিয়ে দিল। কারণ ওটা পরখ করার মতো পরিস্থিতি বা সময় নেই এখন, মনে মনে স্রেফ প্রার্থনা করল সে, যাতে সঠিক খামটাই দিয়েছে। খামটা হাতে নিয়ে রহমান গার্ডের দিকে তাকিয়ে থেকেই ওটা থেকে কাগজটা বের করে ওটায় এক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে ওটা ছুড়ে মারল গার্ড লোকটার প্রায় মুখে। যা, এটা তোর বাপ প্রক্টরকে গিয়ে দেখাস,’ রহমান সরাসরি তুমি থেকে তুই তে নেমে এসেছে। সে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গিয়ে আবারো ফিরে তাকাল গার্ডের দিকে, ‘এখানে আমরা একটা বিশেষ অপারেশনে আছি, যদি আবার তুই বা তোর কোনো চ্যালাচামুন্ডা ভেজাল করতে আসিস, বিশেষ কাজে বাধা দেয়ার দায়ে সোজা গুলি করে দেব,’ বলেই সে নিজের লোকদেরকে কিছু নির্দেশনা দিয়েই আবারো ফিরে তাকাল জোনায়েদের দিকে। তাকে হাতের ইশারায় নিজের পাশাপাশি হাঁটতে বলে গট গট করে হাঁটতে শুরু করল কোয়ার্টার এলাকার ভেতরের দিকে।

‘যা যা বলেছিলাম, সব করেছ?’

‘জি, স্যার,’ বলে জোনায়েদ এক সেকেন্ডের জন্যে দম নিল। ‘পুরো এলাকায় এলার্ট জারি করে দেয়া হয়েছে, প্রতিটা এক্সিট পয়েন্টে আমাদের লোক ছড়িয়ে পড়ছে—’

‘পড়ছে মানে!’ রহমান জোনায়েদের দিকে ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল তার আগেই জোনায়েদ দ্রুত বলে উঠল, ‘এতক্ষণে ওরা চলে গেছে, আমি শিওর।’

‘আর?’ রহমান টকিতে কথা বলতে বলতে জোনায়েদের কথা শুনছে। ‘অ্যাপার্টমেন্টে অপারেশনটা যেভাবে বলেছি—’  

‘জি, স্যার, আপনার কথামতোই বিল্ডিং কভার করে প্রথমে নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়ার কাট করে, এরপর চারজন কমান্ডোর টিম রেডি করে, দুজনকে বাইরে প্রহরায় রেখে দুজনকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে।’

রহমান মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই গুলির শব্দে কেঁপে উঠল কোয়ার্টার এলাকা। গুলিটা এসেছে কোয়ার্টারের ভেতর থেকে।

‘কি ব্যাপার!’ রহমান সঙ্গে সঙ্গে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল কোয়ার্টারের নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টটার দিকে। ‘শ্যুট করতে নিষেধ করোনি তুমি?’

তিনতলার দিকে তাকিয়ে বড়ো করে একবার ঢোক গিলল জোনায়েদ। ‘জি স্যার, আমি কঠিনভাবে মানা করে দিয়েছিলাম গুলি করতে।  

‘তাহলে গুলি চালাল কেন ওরা, রহমানসহ পুরো টিম তাকিয়ে আছে কোয়ার্টারের দিকে।

.

দেয়ালটার দিকে তাকালে মনে হবে কোনো বিখ্যাত শিল্পীর দুর্বোধ্য কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং আঁকা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে, সাদা দেয়ালের ওপরে রং আর তুলির সাহায্যে বুলানো হয়েছে লাল রং, আর তার ওপরে পরম মমতায় ছড়ানো হয়েছে সাদা হাড় আর হলদে মগজের ছিটে। কিন্তু গ্যালারির পেইন্টিংয়ের মতো ছবিটার ঠিক সামনে যেখানে চিত্রশিল্পীর মতো গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল মানুষটার, সেখানে পুরোপুরি উলটোদিকের দেয়াল আর মাটির কাছাকাছি ভাঙাচোরা পুতুলের মতো হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে মানুষটা। তার উন্মাদীয় বিভ্রান্ত দৃষ্টি লেজার পয়েন্টারের মতো স্থির হয়ে আছে মাটিতে পড়ে থাকা খুলি হারানো মৃতদেহটার ওপরে।

হাতের পিস্তল নামাতে নামাতে মাটিতে পড়ে থাকা কমান্ডোর দেহটা টপকে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল রাসনা। দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে থাকা আরিয়ানের দিকে এগিয়ে যেতেই কেমন জানি উন্মাদের মতো হাউ মাউ করতে করতে নড়ে উঠল আরিয়ান। আরো সরে যাওয়ার চেষ্টা করলদেয়াল আর মেঝের কোনার দিকে। ‘আরিয়ান আমি,’ আরিয়ানের দিকে এগোতে এগোতে মেঝেতে বসে পড়ল রাসনা। ‘না না, আমার দিকে আগাবে না,’ বলতে বলতে আরো কোনার দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল আরিয়ান।

রাসনা অনুধাবন করল আরিয়ান পুরোপুরি শকে চলে গেছে। ‘শান্ত হও আরিয়ান আমি রাসনা, তুমি ঠিক আছো, যে তোমাকে গুলি করতে যাচ্ছিল সে মারা গেছে। আরিয়ান,’ এবার আরিয়ানের কোটের কলার ধরে তাকে জোরে ঝাঁকি দিল দুবার। ‘আরিয়ান শান্ত হও।’ আরিয়ান আবারো নড়ে উঠতে গিয়েও ভালোভাবে ফিরে তাকাল রাসনার দিকে। ‘রাসনা রাসনা,’ বলে সে নিজের শরীরে হাত বুলাতে লাগল। ‘কি হয়েছে, ও তো আমাকে গুলি—’

‘ওই কমান্ডো লোকটা মারা গেছে। তুমি ঠিক আছো। আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখতে পাই হাতাহাতির এক পর্যায়ে লোকটা তোমাকে গুলি করতে যাচ্ছে, ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল তোমার দিকে। আমি আস্তে করে নেমে এসে ওর ভেস্ট আর হেলমেটের মাঝামাঝি ঘাড়ের কাছে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে দিই।’

আরিয়ান এখনো তাকিয়ে আছে রাসনার দিকে। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি ঠিক হয়ে আসতে লাগল। ‘রাসনা ধন্যবাদ, তোমাকে,’ বলে সে দুবার ঢোক গিলে হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছে নিল একবার। তুমি না থাকলে আজ গেছিলাম আমি,’ বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়াল। তাকে এখনো খানিক বিভ্রান্ত লাগছে কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে ধোঁয়াটে আধো অন্ধকারের ভেতরে চারপাশে দেখে নিয়ে বলে উঠল, আমাদের এখন পালাতে হবে। ওরা এখানেই থামবে না। আরো পাঠাবে, পাঠাতেই থাকবে। এক মিনিট,’ বলে সে মাটিতে পড়ে থাকা কমান্ডোর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার শরীর থেকে দুয়েকটা জিনিস নিয়ে পকেটে ভরে নিতেই রাসনা বলে উঠল, ‘চলো,’ বলে সে সিঁড়ির নিচের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই আরিয়ান তার হাত ধরে থামিয়ে দিল।

‘ওদিকে না, ওদিক দিয়ে আসবে ওরা,’ বলে সে ওপরের দিকে দেখাল। ‘আমাদের পালাতে হলে ওদিকে যেতে হবে,’ আরিয়ান বাক্যটা শেষ করার আগেই একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল এক সিঁড়ি নিচে, আর ধুপধাপ করে সাইলেন্সর লাগানো অস্ত্র থেকে গুলি এসে লাগল সিঁড়ির রেলিংয়ের এদিকে-সেদিকে।

‘জলদি জলদি,’ রাসনার হাত ধরে টান দিয়ে ওপরের দিকে দৌড়াতে শুরু করল আরিয়ান। কালচে ধোঁয়া আর অন্ধকার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে, তার ওপরে আবার পেছনে যমদূতের মতোই এগিয়ে আসছে অস্ত্রধারীরা। তবে ধোঁয়ার বেগ এখন অনেকটাই কম, একহাতে রসনাকে চেপে ধরে আরেক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে ওপরের দিকে রীতিমতো টেনে নিয়ে চলেছে মেয়েটাকে আরিয়ান। রাসনার বাহুতে ওর নখ প্রায় ঢুকে যাচ্ছে। পেছন থেকে মেয়েটা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, দুবার পড়ে যেতে নিয়েও আরিয়ানের শক্ত হাতের টান খেয়ে আবার সোজা হয়ে গেল মেয়েটা। দুই সিঁড়ি পার হতেই পেছন থেকে আবারো শক্ত হাতের টান খেয়ে খানিক রেগে গেল আরিয়ান, পেছন ফিরে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগে হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটাই কথা বলে উঠল।

‘এক মিনিট,’ এক হাতের কনুই দিয়ে সে নিজের মুখ এতটা আড়াল করে রাখায় কথা শুনতে খুবই অদ্ভুত শোনাচ্ছে। ‘আমরা ওপরে উঠছি কেন, ওপরে—’

এই মেয়ের নাকি পুলিশি ট্রেনিং আছে, আরিয়ান রাগের সঙ্গে মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। ঠং ঠং করে দুবার শব্দ হতেই পাতলা হয়ে আসতে থাকা ধোঁয়ার স্তরের ভেতর দিয়ে দুজনেই পরিষ্কার দেখতে পেল পেপসি বা কোকের ক্যানের মতো দুটো সরু টিনের ক্যানের মতো জিনিস উড়ে এসে একটা সিঁড়ির গোড়ায় আর অন্যটা পড়ল একেবারে ওদের পায়ের কাছে। সাধারণ ক্যানের সঙ্গে এই দুটো পার্থক্য একটাই—দুটো থেকেই গল গল করে ধোয়া বের হচ্ছে। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হয়েছিল ওরা গ্রেনেড চার্জ করেছে কিন্তু স্মোক ক্যান ফায়ার করেছে দেখে সেই ভীতিটা কেটে গেলেও সঙ্গে সঙ্গেই আবারো হাত তুলে নিজের একটা মুখ ঢেকে ফেলল, সেই সঙ্গে রাসনাকে ইশারা করল নিজের মুখ ঢেকে ওপরের দিকে ওঠার জন্যে। কিন্তু তাকে ইশারা না করলেও হতো, কারণ এরই মধ্যে মেয়েটা নিজের মুখ ঢেকে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। আরিয়ান মেয়েটাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে দ্রুত উঠতে বলে নিজে উঠতে উঠতে আপনাতেই একবার পেছনে ফিরে তাকাল। মনেমনে সে দ্রুত হিসেব করছে ওরা কয় সিঁড়ি উঠেছে সেটা সঠিক মনে করতে না পারলেও এটা পরিষ্কার যে, আর বড়জোর এক বা দুই ফ্লোর আছে ছাদে পৌঁছানোর জন্যে। আর নিচ থেকে উড়ে আসা স্মোক বোমগুলো হাতে ছোড়া হয়েছে তারমানে কমান্ডোরাও বড়জোর এক সিঁড়ি নিচে আছে। তবে স্মোক বোম ছোড়ার কারণে ওদের সমস্যা হলেও কমান্ডোরাও একটা সমস্যায় পড়বে, পরিষ্কার দেখতে পাবে না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কমান্ডোদের চোখের ইনফ্রারেড গগলসগুলোর কথা মনে হতেই আবারো হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠতে শুরু করল। রাসনা দ্রুত বেগে ওপরের দিকে উঠছে, মুখ চেপে ধরে আরিয়ান তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতে লাগল। নিচ থেকে ধোঁয়াটে আধো অন্ধকারের ভেতরেও একাধিক পায়ের শব্দ ভেসে আসছে।  

আরিয়ান পায়ের গতি বাড়িয়ে তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ টপকে ওপরে উঠতে শুরু করল। কয়েকটা ধাপ পার হতেই রাসনার পাশে চলে এলো। তাকে পার হয়ে যাওয়ার সময়ে পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল, মেয়েটাও প্রাণপণে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। আরিয়ান কয়েক ধাপ টপকে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এলো দ্রুতবেগে। সিঁড়ির আরেক ধাপে ওঠার জন্যে বামে ঘুরতেই ধাম করে বাড়ি খেল অন্ধকারের ভেতরে। পড়ে যেতে যেতেই নিজেকে সামলে নিয়েই বুঝতে পারল ওরা সিঁড়ির গোড়ায় পৌছে গেছে। সামনেই সিঁড়িঘর এবং ছাদের দরজা। অন্ধকারের ভেতরে হাত দিয়ে ধোঁয়া সরিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই পেছনে দেখতে পেল, রাসনা মেয়েটা ও উঠে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছে। ‘এখন…?’ মেয়েটা কিছু একটা জানতে চাচ্ছিল তার আগেই আরিয়ান বলে উঠল, ‘আমাদেরকে ছাদে যেতে হবে, পালাতে হলে কিন্তু,’ বলে সে দরজাটা ভালোভাবে দেখতে দেখতে যোগ করল, ছাদের দরজায় তালা মারা।  

২১

‘এখন…?’ রাসনা আবারো একই শব্দ একই প্রশ্ন উচ্চারণ করতে করতেই নিজের পিস্তল বের করে আনল। আরিয়ান বুঝতে পারছে মেয়েটা গুলি করে তালা ভাঙার কথা ভাবছে। নিজের একটা হাত তুলে নামিয়ে দিল পিস্তলটা। ‘গুলি করাটা ঠিক হবে না, ভেতরে ভেতরে ভয়াবহ উদ্বেগ আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে সে কিন্তু ভাবার চেষ্টা করছে একেবারে শান্তভাবে। ‘ওরা জানে আমরা ওপরে আছি কিন্তু গুলি করামাত্রই আমাদের অবস্থান একেবারে পিনপয়েন্টেড হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ওরা আমাদের ডিসট্যান্সটাও বুঝে ফেলবে। কাজেই—’ রাসনার পিস্তলটা নামিয়ে দিয়েই দুই পা পিছিয়ে গেল আরিয়ান। রাসনা মুখ খুলেও কথা বলার আগেই, আরিয়ান মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘দায়া দারওয়াজা তোড় দো—’ বলেই সে ঝড়ের বেগে দুই পা লাফিয়ে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল দরজাটায়। পুরনো কোয়ার্টারের ছাদের সিঁড়িঘরের এই দরজা এতটা শক্ত হবে ও ভাবেনি।ও ভেবেছিল এক লাথিতে দরজাটার কবজা ছুটে যাবে, কিন্তু আরো দুবার লাথি মেরেও পা চেপে ধরে বসে পড়ল ও।

‘গাধা পানি খায় ঘোলা করে খায়,’ কথাটা বলে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের নামিয়ে নেয়া পিস্তল তুলে সোজা কবজা বরাবর গুলি করল রাসনা। দুবার গুলি করতেই কবজা ভেঙে ধরাম করে খুলে গেল দরজাটা। সেই সঙ্গে ধুপ-ধাপ শব্দের সঙ্গে স্পার্ক করে উঠল টিনের দরজার এখানে সেখানে। নিচ থেকে গুলি করা হচ্ছে। তার মানে ওরা পৌঁছে গেছে প্রায় কাছাকাছি। বসা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আরিয়ান। আবারো রাসনার হাত চেপে ধরে টান দিল দরজার দিকে। ভাঙা কবজা টপকে এক লাফে বেরিয়ে এলো খোলা ছাদে। ভেতরের গুমোট ধোঁয়া আর অন্ধকার টপকে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এসেই বুক ভরে দম নিতে লাগল দুজনে। চোখের জ্বলা ধরা ভাবটাও কমে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ছাদে প্রবেশ করতেই রসনা ছাদের ভেতরের অংশের দিকে এগোতে শুরু করল। আরিয়ান তাকে এগোনোর জন্যে ইশারা করেই নিজে পানির ট্যাংকের আড়াল নিয়ে বসে গেল ছাদের ফ্লোরে, সেই কমান্ডোর কাছ থেকে নিয়ে আসা পিস্তলটা লোড করে সিঁড়ির দরজার দিকে তাক করল সাবধানে। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে লাগল নিঃশব্দে। আধো অন্ধকার আর ধোঁয়ার ভেতরে প্রথমে একটা অস্ত্রের নল দেখা গেল, তারপর এক জোড়া পা, সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল আরিয়ান। কানের কাছে গুলির শব্দ বোমার মতো ফাটলেও মাস্কের ভেতর থেকে কমান্ডোর চিৎকারটা বেরিয়ে এলো ভোঁতা স্বরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। মাস্কের চোখের দিকে পিস্তল তুলেও থেমে গেল আরিয়ান। এভাবে মারার কোনো মানে হয় না, লোকটা নিশ্চয়ই স্রেফ অর্ডার পালন করছে। তবে ও অবাক হয়েছে এভাবে কমান্ডো লোকটা নিজেকে কভার না করে ছাদে বেরিয়ে আসাতে, এর মানে হয় এরা পরোয়া করছে না, অথবা ওদের গোনায় ধরছে না। সিঁড়ির দরজার ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে, টেনে নিয়ে গেল পড়ে থাকা লোকটাকে। এবার ওরা সবধানে এগোবে, কয়েক সেকেন্ড সময় পাওয়া গেছে। আরিয়ান আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ধুপধাপ শব্দ হলেও পরোয়া করল না। এই কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই পালাতে হবে। মাথা নিচু করে দৌড়ে, ছাদের কিনারায় আসতে আসতে মুখ হা হয়ে গেল ওর। ও ভেবেছিল রাসনা এতক্ষণে ছাদের রেলিং টপকে পাশের বাড়ির ছাদে পৌঁছে গেছে, সেকারণেই মেয়েটাকে আগে সরে পড়তে বলেছিল ও। কিন্তু কাছাকাছি এগিয়ে ছাদের কিনারায় এসে রাসনাকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগ উঠে গেল ওর। মেয়েটাকে ধমকের সঙ্গে কিছু বলতে যাবে তার আগে মেয়েটাই ইশারায় সামনে দেখাল। আর সামনে যা দেখতে পেল তাতে মুখ হা হয়ে গেল আরিয়ানের।

কপাল খারাপ ওদের। ছাদে আসার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল যাতে এখান থেকে অন্য বাড়ির ছাদ হয়ে পালাতে পারে। কিন্তু ওরা এমন এক কোয়ার্টারে আছে যেটার আয়ত্তের ভেতরে আর কোনো কোয়ার্টারই নেই। সব থেকে কাছের কোয়ার্টারটাও অনেক দূরে। লাফিয়ে পার হওয়ার কোনো সম্ভবনাই নেই। অসহায়ভাবে নিজের কপালে হাত দিয়ে রেলিংয়ে বসে পড়েছে রাসনা, সিঁড়ির দরজার দিক থেকে ভেসে আসা পায়ের শব্দে বুঝতে পারছে ধরা পড়ে গেছে ওরা।

২২

মাস্কের ভেতর থেকে মাটিতে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে খুব বিচিত্র এক অনুভূতি হলো জোনায়েদের। লোকটাকে সামনাসামনি না দেখলেও এই মানুষটার ছবি দেখেছে সে অনেকবার, সেই সঙ্গে এটাও জানত যে বৃহদন্ত্রের সঙ্গে ওরা সবদিকে জড়িয়ে আছে তার ভেতরে একজন ছিল এই লোক। ক্ষণিকের জন্যে জোনায়েদের মনে হলো এই লোকের যদি এই পরিণতি হয় তবে ওদেরও কি শেষ  পরিণতি এমনই কিছু? আড়চোখে সে ফিরে তাকাল রহমানের দিকে। সেও ওর মতোই মাস্ক পরে আছে। যদিও এখন ধোঁয়ার বেগ আর নেই বললেই চলে, মাস্কের ভেতরে দম বন্ধ লাগছে। খুলে ফেলবে কি না ভাবতে ভাবতেই সে দেখতে পেল রহমান নিজের মাস্কটা খুলে সেটাকে পাশের এক পুলিশের দিকে ছুড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা প্রফেসরের মৃতদেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মনোযোগ দিয়ে সে মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একবার চারপাশে দেখে নিল।

‘ওরা এই কাজ করেছে?’ মাস্ক খুলতেই বিস্ময়কর প্রশ্নটা আপনাতেই বেরিয়ে গেল জোনায়েদের মুখ দিয়ে। প্রশ্নটা যে বোকার মতো হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে ওর আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ ও প্রশ্নটা করতেই রহমান এমনভাবে ওর দিকে ফিরে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে জোনায়েদের মুখ শুকিয়ে গেল। ‘গাধা,’ প্রায় চিবিয়ে চিবিয়ে সে উচ্চারণ করল, তারপর চারপাশটা দেখিয়ে বলে উঠল, ‘এগুলো দেখে তোর মনে হচ্ছে ওরা খুন করেছে একে?’ জোনায়েদ দেখল, লুপের মতো বানানো প্যাচানো চাদর আর একটা সার্ভিস সিঁড়ি পড়ে আছে রুমের ভেতরে। ‘তার মানে—’

‘হ্যাঁ, এই ব্যাটা সুইসাইড করেছে,’ কথাটা বলতে বলতেই চারপাশে দেখতে দেখতে কথা বলে উঠল রহমান। কিন্তু আমরা এটা ওদের এগেইনস্টে ইউজ করব,’ বলে সে চারপাশে তাকিয়ে জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘খবর প্রচার করতে হবে ওই লেখক ব্যাটা আর মহিলা অফিসার প্রফেসরকে খুন করেছে আর—’

রহমান কথা শেষ করার আগেই রুমের ভেতরে দৌড়ে প্রবেশ করল এক কমান্ডো। ‘খারাপ খবর আছে,’ মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল সে। রহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে থেমে গিয়ে একবার ঢোক গিলল। ‘ইয়ে মানে, ওরা একজন অফিসারকে গুলি করেছে,’ রহমানের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে সে একবার জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে ফিরে তাকাল রহমানের দিকে।

‘আর ওরা?’ রহমান শান্ত স্বরে জানতে চাইল।

‘ওরা ছাদের দিকে গেছে, মানে—’

রহমান চট করে নড়ে উঠল। ‘এটা খারাপ না ভালো খবর, ওরা সম্ভবত ছাদের দিকে গেছিল পালানোর জন্যে। কিন্তু ওখান থেকে পালানো মুশকিল হবে, মুভ বয়েজ এখনই ওদের ধরার বেস্ট অপরচুনিটি, জোনায়েদ দেখল অনেকক্ষণ পর রহমানের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

‘এত বড়ো ভুল করলাম কীভাবে আমরা?’ রাসনা এখনো মাথায় হাত দিয়েই আছে।

‘ভুল না জাস্ট ভুল কনসেপ্ট,’ আরিয়ান শান্ত স্বরে বলে উঠল। সে উঁকি দিয়ে নিচে দেখতে দেখতে কথা বলছে। ‘আমরা দেখেছি এটার পাশে একটা কোয়ার্টার আছে,’ সে ইশারায় পাশের কোয়ার্টারটা দেখাল। ‘খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা ধরে নিয়েছি এটার ছাদ থেকে ওটাতে লাফিয়ে সরে যাওয়া যাবে। অন্তত এখানকার দিকে হলে তা খুব ভালোভাবেই করা যেত, মার খেয়ে গেছি আমরা পুরনো দিনের কোয়ার্টার হওয়াতে, তখন তো আর জায়গার অভাব ছিল না, তাই বাড়িগুলোও অনেক দূরে দূরে। লাফিয়ে সরে পড়ার সম্ভবনা নেই বলতে গেলে,’ আরিয়ান চারপাশ দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে আবারো রেলিংয়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারপাশে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে ও। এই ভবনটা পুরোটা অন্ধকার হলেও অন্য ভবনগুলো আলোকিত, সেই সঙ্গে রাস্তা থেকে আলোর রেশ এসে পড়েছে কোয়ার্টার এলাকার ভেতরে। কিন্তু সেই আলোকে ঘোলাটে করে তুলেছে এই ভবন থেকে বের হতে থাকা ধোঁয়ার রেশ, কিন্তু সেই ঘোলাটে আলোতেও কোয়ার্টার এলাকার সামনের অংশে পুলিশের ফ্লাশ করতে থাকা লাইট আর নড়াচড়ায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে পুরো এলাকা ওরা রীতিমতো নিয়ন্ত্রণ করছে।

‘এখন উপায় কি…আমরা—’ নিচে দেখতে দেখতে ফিরে তাকাতেই আরিয়ান দেখতে পেল ওর ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাসনা, দুঃশ্চিন্তা আর উদ্বেগের চাপে তাকে রীতিমতো উন্মাদ দেখাচ্ছে। হাতের পিস্তলটার নল নামিয়ে মাটিতে বসে পড়ল সে, দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় কান্নায় ভেঙে পড়বে। ‘এখান থেকে—’

‘আমি একটা জিনিস বুঝলাম না,’ আরিয়ানের গলা রাসনার তুলনায় রীতিমতো শান্ত। ‘ওরা আমাদের ধরার জন্যে এই এলাকাতে রীতিমতো কমান্ডো অপারেশন চালাচ্ছে,’ আরিয়ানের কথা শুনে রাসনা বোকার মতো ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘এমন রেসিডেন্সিয়াল এলাকার ভেতরে এরকম একটা অপারেশন চালানোর অনুমতি ওরা পেল কীভাবে,’ রাসনার বোকা-বোকা দৃষ্টি এখন পরিণত হয়েছে অবিশ্বাসে। ‘এর মানে এই ঘটনার পেছনে যারাই থাকুক এরা অবিশ্বাস্য পাওয়ার—

‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে,’ কথার মাঝখানে রাসনার ধমক খেয়ে এই অবস্থাতেও চমকে উঠল আরিয়ান। রাসনার হুঁশ নেই, সে বলেই চলেছে। ‘এই অবস্থায় কোথাও আপনার উচিত পালানো—’

এবারও সে কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই ধুপ ধুপ শব্দের সঙ্গে ধুলো আর ইটের টুকরো ছিটকে পড়তে লাগল ছাদের বাঁধানো রেলিংয়ের চারপাশে। অন্ধকারের ভেতরে ছাদের অপর দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকা ততধিক অন্ধকার ছায়া দুটোকে আরিয়ানই আগে দেখতে পেয়েছে। আসলে ওরা গুলি করার আগেই সে নড়ে উঠেছে। রাসনা একে তো কথা বলছিল, তার ওপরে সে তাকিয়ে ছিল আরিয়ানের দিকে, তাই সে এগিয়ে আসতে থাকা কমান্ডোকে দেখতে তো পায়নি, সে কথাও থামায়নি। আরিয়ান ছায়া দুটোকে অন্ধকারের ভেতরে এগিয়ে আসতে দেখেই লাফ দিয়েছে রাসনার দিকে। যে কারণে ওরা গুলি করার আগেই সে রাসনাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল ছাদের মেঝেতে। রাসনা পড়ে গিয়েই চিৎকার করে উঠেছে। আরিয়ান তাকে জড়িয়ে ধরেই এক গড়ান দিয়ে সরে গেল একটা বোল্ডারের অন্যপাশে, রাসনার মুখ চেপে ধরে তাকে চুপ থাকতে বলে জোর করে বসিয়ে দিল দেয়ালের পাশে হেলান দিয়ে। আর গুলি না হলেও আরিয়ান নিশ্চিত ওরা এগিয়ে আসছে যমদূতের মতো। তারচেয়ে বড়ো কথা আরিয়ান ভয় পাচ্ছে ওরা শুধু এগিয়ে আসবে না, আরো বড়ো কিছু করবে। আর ওদের এখান থেকে নড়ারও উপায় নেই। হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে, গুলি খেয়ে মরতে হবে, আর না হলে নিদেন পক্ষে হাতে-পায়ে গুলি খেয়ে আহত হয়ে ধরা পড়তে হবে।

রাসনা একটু আগেও কটাস কটাস কথা বলছিল কিন্তু এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ের চোটে চোখ দুটো বেরিয়ে আসবে মেয়েটার। শান্ত থাকো, উপায় একটা বের করবই,’ কথাগুলো একেবারে শান্ত স্বরে বলে উঠলেও আরিয়ান জানে এর চেয়ে বড়ো মিথ্যে কথা জীবনে সে আর বলেনি। রাসনাকে পানির ট্যাংকের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসিয়ে আরিয়ান চট করে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কমান্ডোরা কোন দিকে আছে। ঠিকই এগিয়ে আসছে একেবারে ধীর কিন্তু মৃত্যুর মতোই নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে আসছে কমান্ডোরা। না, কমান্ডোরা নয়, একজন কমান্ডো। আরেকজন গেল কই, আরিয়ান এদিক-সেদিক দেখে তাকে খুঁজে না পেলেও আন্দাজ করতে সমস্যা হয় না লোকটা আছে কোথাও, আসলে ওদের অবস্থান নিশ্চিত করে ওরা ওদের দুপাশ থেকে ঘিরে ফেলার জন্যেই দ্বিতীয় কমান্ডো অন্যদিকে গেছে। ছাদের প্যাটার্ন এবং ওদের অবস্থান আন্দাজ করে আরিয়ান অনুধাবন করতে পারল ও যেদিকে ভাবছে লোকটা যদি সেদিক দিয়ে আসে তবে একেবারে ওদের ঘাড়ের ওপরে এসে পড়বে। অসহায়ের মতো এদিক ওদিক- তাকাল ও। কোনো উপায় দেখতে না পেয়ে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে আরিয়ান। এমন সময় বিষয়টা চোখে পড়ল ওর। হয়তো শক্তিশালী কিছু নয় কিন্তু বা পুরোপুরি উদ্ধার পাবার মতো কিছু নয় কিন্তু যদি কপাল খানিকটা ভালো হয় তবে খানিকটা হলেও সময় পাওয়া যেতে পারে।

আপনাতেই এক টানে নিজের পিস্তলটা বের করে আনল আরিয়ান। রাসনার দিকে ফিরে তাকাল। ও যা করতে চাচ্ছে সেটা করতে হলে মেয়েটার হেল্প লাগবে। আর সেটা পেতে হলে আগে মেয়েটাকে ঠিক করতে হবে।

‘রাসনা, রাসনা,’ মেয়েটাকে ধমকে উঠল। একবার মনে হলো এত জোরে কথা বলাটা বোকামি হচ্ছে, এতে করে হয়তো ওরা ওর অবস্থান টের পেয়ে যাবে কিন্তু পরমুহূর্তে মনে পড়ল কমান্ডোরা খুব ভালো করেই জানে ওরা আসলে কোথায় আছে। কাজেই ওই ভয় পেয়ে লাভ নেই। ওর ধমক খেয়ে রাসনা মেয়েটার চোখ জোড়া আরো বড়ো হয়ে গেল। ‘রাসনা শোন, আমাদের শান্ত থাকতে হবে, এখনো আমরা ধরা পড়িনি, মারাও যাইনি, কাজেই—’

‘ওরা ওরা, আমাদেরকে ছাড়বে না—’ মেয়েটা এখনো পুরোপুরি শকে আছে।

‘আরিয়ান মেয়েটার হাত থেকে টান দিয়ে পিস্তলটা নিয়ে নিল, ‘শোন এটাও হাতে নাও, লোড করো, এরপর মন দিয়ে শোন কী করতে হবে, যদি আমার কথা শোন তবে একটা উপায় হতে পারে। আমরা চেষ্টা করলে হয়তো পালাতেও পারব। অন্তত চেষ্টা করতেই পারি। বড়ো বড়ো করে দম নাও, শান্ত থাকো। আই প্রমিজ আমরা পালাতে পারব,’ আরিয়ান পিস্তলসহ মেয়েটার হাত চেপে ধরে আছে শক্ত করে। অন্ধকারের ভেতরেও তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আমি যা বলি মন দিয়ে শোন,’ বলে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে জোরে ঝাঁকি দিল তাকে। ‘বুঝতে পারছ আমি কী বলছি। বুঝতে পারছ?’

মেয়েটা কথা না বললেও মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে বুঝতে পারছে।

‘গুড, এবার মন দিয়ে শোন আমি কী বলি, আরিয়ান আরেকবার দুপাশে দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করল কমান্ডোরা কোথায় আছে। ‘আমার পরিকল্পনা খুব সহজ। কিন্তু কাজ হওয়ার সম্ভবনা আছে।’

২৩

রহমান অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে থাকা কমান্ডোকে একবার দেখে নিয়ে সে ওপরের দিকে ফিরে তাকাল। ,

‘বস, কি মনে হচ্ছে, কীভাবে সম্ভব?’ জোনায়েদও বেশ আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সিঁড়ি আর কোয়ার্টার সংলগ্ন জায়গাটার চার দিকে। এখানে এখন ধোঁয়ার প্রকোপ নেই বললেই চলে। কিন্তু ধোঁয়ার প্রকোপ না থাকলেও সিঁড়ির গোড়ার অবস্থা ভয়াবহ। এর আগে প্রথম ধাপের দুই কমান্ডো ওদের ফেরাতে পারেনি কিন্তু অন্তত আহত হয়েছে, কিন্তু এবার যা দেখতে পেল ওরা সেটা ভয়াবহ। বিশেষ করে সিঁড়ির গোড়ায় মৃত যে কামান্ডো পড়ে আছে, তার খুলি একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে একটা অংশ আধুনিক অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংয়ের মতোই ছড়িয়ে আছে দেয়ালে। রহমানকে এই প্রথমবারের মতো বেশ চিন্তিত দেখতে পেল জোনায়েদ যদিও তার চেহারাতে কোনো বিশেষ ভাব নেই। তবে তাতে সর্বদার মতো সেই তাচ্ছিল্যের খেলাও নেই। রহমান এগিয়ে গিয়ে কমান্ডোর দেহটার সামনে বসে পড়ল।

‘বস কি মনে হয়, এরকমটা কীভাবে হলো?’ প্রায় একই প্রশ্ন আবারো উচ্চারণ করল জোনায়েদ। আপনার কি মনে হয় ওরা বাইরে থেকে কোনো সাহায্য – ‘ জোনায়েদ নিজেই বুঝতে পারছে ওর মন্তব্যটা বোকার মতো হয়ে গেছে তাই অর্ধেক উচ্চারণ করে নিজেই থেমে গেল। ভেবেছিল রহমানের কাছে শক্ত একটা ধমক খাবে বরাবরের মতো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রহমান একেবারে চুপ হয়ে রইল, সে মনোযোগ দিয়ে কমান্ডোর দেহটা পরখ করছে, একবার সিঁড়ির ওপরের দিকে দেখে নিল।

‘বস–’

‘বাইরের তো প্রশ্নই আসে না,’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রহমান গম্ভীর মুখে বলে উঠল। ‘এটা এমনকি ছেলেটাও করেনি,’ সে দেহটার দিকে তাকিয়ে ফিরে তাকাল জোনায়েদের দিকে, তার চেহারা থম থম করছে। খানিক ভেবে ডান হাতের একটা আঙুল তুলল সে। ‘আমি প্রায় নিশ্চিত প্রথম কমান্ডোকে ঘায়েল করার পর দ্বিতীয়জনের সঙ্গে মারামারি করতে করতে ছেলেটা এখানে এসে পড়ে। এরপর মেয়েটা সম্ভবত পেছন থেকে তার ঘাড়ে গুলি করে, প্রশ্ন হলো, রহমান সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো বাকিদের দিকে দেখছে। তার মুড দেখে কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না কিংবা বলছে না। মেয়েটা গুলি করেছে যখন সে তার কমফোর্ট জোনে ছিল, কমান্ডোটা একেবারেই ওদিকে নজর দিতে পারেনি সম্ভবত। ছেলেটা প্রথমে কামরার ভেতরে তারপর সিঁড়ির বাইরে তিন-তিনজন কমান্ডোকে কুপোকাত করে ফেলল,’ সে আবারো ফিরে তাকিয়েছে জোনায়েদের দিকে।

‘এর আগে সেই ভ্যানে…’ জোনায়েদ যোগ করল।

‘ঠিক,’ এক শব্দে জোনায়েদের কথা মেনে নিল রহমান। ‘কারণ কি? আমি কি কিছু মিস করছি এখানে…?’ সে চট করে মুখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে। ‘আচ্ছা, ওপরের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে ঠিক ঠাক?’

‘জি, স্যার,’ স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো বাহিনীর প্রধান বলে উঠল। ‘ওদের যেভাবে বেড় দিয়ে আটকানো হয়েছে তাতে পালাবার কোনো উপায় নেই। ওদের সারেন্ডার করতে হবে না হলে গুলি খাবে,’ লোকটার গলায় কোনো বিশেষ ভাব নেই।

‘গুড,’ রহমান আনমনে মাথা নাড়ল। সিঁড়ির ওপরের দিকে রওনা দিতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল সে, ত্রস্ত পায়ে ফিরে গেল সে সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে থাকা দেহটার দিকে। আঁতিপাতি করে খুঁজল কিছু একটা। ‘শিট,’ চট করে মুখ তুলে তাকাল সে ওদের দিকে। ‘ওপরের ওদের সাবধান করতে হবে।’

জোনায়েদ আর কমান্ডো প্রধান একে-অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল, হঠাৎ কী হলো।

.

কমান্ডোর দেহ থেকে খুলে নিয়ে আসা ছোট্ট কালো জিনিসটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আরিয়ান টান টান লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ট্যাংকের একপাশে, অন্যপাশে এক হাতে পিস্তল চেপে ধরে হেলান দিয়ে বসে আছে রাসনা। বসে থাকলেও সেও একেবারে টান টান হয়ে আছে। ছাদের ওপরটা পুরোপুরি অন্ধকারও না আবার পুরোপুরি আলোকিতও না, ফলে অদ্ভুত এবং ঘোলাটে এক অন্ধকার হয়ে আছে। সেই সঙ্গে নিচ থেকে ভেসে আসা শব্দ, বিচিত্র ফিসফাস আর স্পন্দনের ভেতরেও দুজনেই জান দিয়ে চেষ্টা করছে ওদের পেছন থেকে ভেসে আসা শব্দের ভেতরেও সম্ভাব্য পায়ের আওয়াজ টের পাবার। দুজনেই নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সেটা সম্ভব হবে না, আবার যত অভিজ্ঞতাই থাক না কেন কমান্ডোরা চাইলেও তাদের পায়ের আওয়াজ পুরোপুরি লুকাতে পারবে না। আরিয়ান অনুধাবন করার চেষ্টা করছে ঠিক কোন জায়গাটাতে এবং ঠিক কতটা সময় হিসেব করে ওকে ঝুঁকিটা নিতে হবে। পানির ট্যাংকের নিচ দিয়ে ও ওপর পাশে তাকাল কিন্তু কপাল খারাপ কিছুই দেখতে পেল না। যা আছে কপালে এবার ঝুঁকি নিতেই হবে। রাসনার দিকে একবার তাকিয়ে ইশারা করেই সে সামান্য ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। এক হাতে পিস্তল আর অন্য হাতে ধরা জিনিসটা। আরিয়ান যতটা আশা করেছিল ততটা কাছে না হলেও দুজন কমান্ডোকে ছাদের আইল ধরে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল ও। দুজনেই পুরোপুরি প্রস্তুত এবং দুজনেই সম্ভবত একই দরজা দিয়ে বের হলেও দুজনেই ধীরে ধীরে দুদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল যাতে দুদিক থেকে ওদের কোনঠাসা করতে পারে।

আরিয়ান ঝুঁকে পড়তেই একজন কমান্ডো দেখতে পেল ওকে, প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলি চালাল। আরিয়ানও জানত ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করবে সে, আর তাই প্রস্তুতি নেয়াই ছিল। সে প্রথমে ঝুঁকে পড়ল, কমান্ডো দুজনকে লোকেট করার সঙ্গে সঙ্গেই সে ডাইভ দিল সামনের দিকে। তাই লোকটা যখন গুলি করল আরিয়ান সরে পড়েছে সামনের দিকে। সে ডাইভ দিতে দিতে হাতে ধরা কালো রঙের জিনিসটা ছুড়ে দিল দুই কমান্ডোর মাঝামাঝি। প্রথম গুলিটা ফসকে গেলেও আরিয়ান ডাইভ দিয়ে ছাদের মাঝামাঝি আসতেই দুজনেই নল ঘুরিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলো, সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মাঝে ঠঙ ঠঙ শব্দ করে গড়িয়ে যাওয়া সাউন্ড গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হলো তীব্র শব্দে।

রাসনা এবং আরিয়ান দুজনেই খানিকটা করে কাপড় নিজেদের কানে আগেই গুঁজে দিয়েছিল ট্যাংক থেকে উঁকি দেবার আগেই। আরিয়ান ছাদের মেঝেতে লাফ দিতেই দুজনেই সর্বশক্তি দিয়ে দুই হাতে কান চেপে ধরে বসে পড়েছে মেঝেতে। তারপরও তীব্র শব্দের ধাক্কায় কিছুক্ষণের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো, কানের ভেতরে কেউ স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে গুঁতা দিয়েছে। তবে ব্যথা পেলেও সেটা অসহনীয় না। কান থেকে হাত আর ভেতর থেকে কাপড় ফেলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বসে পিস্তল তুলল আরিয়ান, দুই কমান্ডোর দুজনেই পড়ে গেছে। একজনকে দেখতে পেল অস্ত্র ফেলে কান চেপে ধরে গোঙাচ্ছে, অপরজন কি কারণে কে জানে, পড়ে আছে একেবারে স্থির হয়ে। রাসনাকে দেখতে পেল মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার দিকে ইশারা করে আরিয়ান কমান্ডো দুজনার দিকে এগোতে শুরু করল অস্ত্র হাতে, ঠিক সেই সময়েই একটু আগের মতো ঠঙ ঠঙ শব্দ তুলে কিছু একটা মাটিতে পড়ে গড়িয়ে চলে গেল ট্যাংকের কাছে। ক্ষণিকের জন্যে দেখেই আরিয়ান বুঝতে পারল এটা একটু আগের সেই হালকা সাউন্ড গ্রেনেড নয়, সত্যিকারের গ্রেনেড না হলেও বেশ শক্তিশালী একটা হাত বোমা। বোমাটা গড়িয়ে গিয়ে পড়েছে পানির ট্যাংকের একেবারে কাছে। তার ঠিক অপর পাশেই রাসনা ওখান থেকেই লাফ দিল, আরিয়ান মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে গড়িয়ে পড়তেই ভয়াবহ শক্তি নিয়ে বিস্ফোরিত হলো বোমাটা, পুরো ট্যাংক উড়ে গিয়ে ভিজিয়ে দিল দুজনকে। কিন্তু বোমার মূল ধাক্কাটা ট্যাংকের ওপর দিয়ে যাওয়াতে দুজনের তেমন ক্ষতি করতে পারল না ওটা। দুজনেই ছেঁড়া কাপড় আর হাতে-পায়ে পিঠ থেকে খানিক চামড়া হারিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে দাঁড়াতেই ধুপধাপ গুলি এসে লাগতে লাগল এদিক-সেদিক। আবারো রাসনাকে মাটিতে চেপে ধরে মুখ তুলে আরিয়ান দেখল, এবার ছাদে প্রবেশ করেছে অন্তত আধ ডজনের একটা দল, এবার আর রক্ষে নেই, পালাতে হবে। শেষ শব্দগুলো জোরে উচ্চারণ করে মুখ চেপে বসে থাকা রাসনাকে জোরে ঝাঁকি দিতে লাগল আরিয়ান।

‘আমি পারব না, তুমি পালাও,’ কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল রাসনা। সে হাত থেকে পিস্তলও ফেলে দিয়েছে। আরিয়ান আর কিছু না বলে রাসনার পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে ছেঁড়া কোটের পকেটে রেখে, একহাতে রাসনার হুডির হুডটা চেপে ধরে অন্য হাতে পিস্তলটা নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল, আন্দাজের ওপরে বেশ কয়েকটা গুলি করে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে চলল ছাদের রেলিংয়ের দিকে। রেলিংয়ের কাছে পৌঁছাতেই আরো বেশ কয়েক ধাপ গুলি লাগল এদিকে-সেদিকে। ওরা এখনো যে গুলি খায়নি সেটাই এক আশ্চর্য বিষয়। আরিয়ান রেলিংয়ের কাছে পৌঁছে অসহায়ভাবে নিজের দিকে তাকাল। কঠিন কিন্তু একটাই উপায় আছে। রেলিংয়ের ওপাশের বড়ো আমগাছটা একবার দেখে নিল, ও তারপর চোখ বুলাল অপরপাশের কোয়ার্টারের বারান্দার দিকে। ওরা আছে চারতলার ছাদে, আর বহু পুরনো গাছটা ‘রাসনা রাসনা,’ মেয়েটা এখনো শকের ভেতরে আছে। এখান থেকে পালাতে হলে দুজনারই পরস্পরের সাহায্য লাগবে, তারপরেও সম্ভাবনা খুবই কম। ‘রাসনা রাসনা,’ আবারো ঝাঁকি মারল মেয়েটাকে। ঠিক হও, মনে আছে, কী করতে হবে?’ ধমক খেয়ে মেয়েটা আপনাতেই মাথা নাড়ল। ‘গুড, আরিয়ান পিস্তল পকেটে গুঁজে একবার ছাদের অন্যদিকে দেখে নিল। ও গুলি করাতে ওরা আড়াল নিয়েছিল, সেটা থেকে ধীরে ধীরে আবারো ওরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, যেকোনো সময় গুলি করবে।

আরিয়ান পিস্তল পকেটে রেখে রেলিং টপকে চলে এলো অন্যপাশে। রাসনার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতে সেও টপকাতে শুরু করল রেলিং। রেলিংয়ে বসে পড়ে সাবধানে রেলিংয়ের কিনারা ধরে সামান্য লাফিয়ে ধরে ফেলল একপাশের একটা পাইপ। সেটা বেয়ে নেমে এলো তিনতলার কার্নিশে। রাসনাও একই পন্থায় নেমে তার হাত চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল কার্নিশে। এবার সবচেয়ে কঠিন কাজ।

কোনো কথা না বলে কোনো দিকে না তাকিয়ে আধো অন্ধকারে স্রেফ সামনের দিকে তাকিয়ে রইল আরিয়ান। আমগাছের একটা অংশ বাদে আর কিছুই চোখে পড়ছে না ওর। কোটের হাতা গুটিয়ে কার্নিশের সামান্য জায়গার ভেতরে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে যতটা সম্ভব শরীরটাকে পেছানোর চেষ্টা করল ও, তারপর বড়ো করে একবার দম নিয়ে লাফ মারল সামনের দিকে। লাফ দিয়ে শরীরটা কয়েক ফিট এগিয়ে শূন্য থেকে নিচে পড়তে শুরু করতেই হাত বাড়িয়ে ও ধরার চেষ্টা করল আমগাছের একটা ডাল। ভেবেছিল শক্তি খাটিয়ে ধরে ফেলতে পারবে কিন্তু হাতে ধরা নাগালের ভেতরেই ফর ফর করে একে একে ছুটে যেতে শুরু করল গাছের পাতা আর ডাল। মনে হতে লাগল সরাসরি নিচে পড়ে যাবে। আপনাতেই গলা চিরে বেরিয়ে এলো মরণপণ চিৎকার। নিচে পড়তে পড়তেও বাড়ি খেতে খেতে ধরে ফেলল একটা মোটা ডাল। আবারো প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ডাল ছাড়ল না ও, প্রাণপণে চেপে ধরে রইল। কোনোমতে ডালটা ধরে ওটা বেয়ে উঠে পড়ল ডালের ওপরে। ওটার ওপরে উঠে প্রথমেই ফিরে তাকাল অপর পাশের বারান্দার রেলিংয়ের দিকে। ও ভবনের ওপর থেকে যেখানে নামতে চেয়েছিল সেটা

না পারল—এখানে নামাতে অপর পাশের ভবনের বারান্দা চলে এসেছে অনেক কাছে। ও রাসনার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা যুগপৎ আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে ওরদিকে।  

‘লাফ দাও, জলদি, আরিয়ানের মাথার ভেতরে ঘণ্টা বেজে চলেছে। সময় নেই, সময় নেই। ‘জলদি জলদি।’ মেয়েটা এখনো স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে শরীরটাকে দুহাতে পায়ে ডালটা জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিল নিচের দিকে। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে ধরল ও, আর আড়াল করে লাভ নেই, ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘লাফ দাও।’

আরিয়ান ঝাপসা চেখে দেখল মেয়েটা ছোট বাচ্চারা যেভাবে গোসল করার সময়ে পুকুরে ঝাঁপ দেয় অনেকটা সেভাবে, মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লাফ মারল ওর বরাবর। আরিয়ান দম বন্ধ করে হাতটাকে যতটা সম্ভব প্রসারিত করে আতঙ্ক আর সব হারানোর ভয় নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ওপর থেকে ডালপাতা ভার আর মেয়েটার চিৎকার শুনতে পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ও দেখতে পেল, ভারী কিছু একটা নেমে আসছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে দেহটাকে চেপে ধরার চেষ্টা করেও ভয়ানক আতঙ্কের সঙ্গে অনুধাবন করতে পারল, দেহটাকে ধরে রাখতে পারছে না ও- পিছলে যাচ্ছে। দুজনেই প্রাণপণে চিৎকার করে উঠতেই আরিয়ান একটা হাত চেপে ধরে পতন থামাতে পারল এবং ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হলো ও হাতটা ছিঁড়ে যাবে শরীর থেকে, বা ভেঙে যাবে ডালটা—কিন্তু দুটোর কোনোটা হলো না, বরং দাঁতে দাঁত চেপে বীভৎস ব্যথা সহ্য করতে করতে মেয়েটার দেহটাকে একটা দোল খাওয়ানোর চেষ্টা করল ও। কারণ রাসনার পতন সামলানোটা মীরাকল হলেও সেটা সম্ভব হয়েছে কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। যদি এই মোমেন্টাম কাজে লাগাতে না পারে তবে পুরোটাই ব্যর্থ হবে। মেয়েটার দেহটাকে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে আরেকবার চিৎকার করে ওকে ছুড়ে দিল পাশের কোয়ার্টারের বারান্দার দিকে রাসনার হাতটা সরে যেতেই তাকে ভবিতব্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিজ শরীরটাকেও ছেড়ে দিল ও। ডালে যতটা সম্ভব কিনারায় এসে দেহটাকে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে স্বস্তির সঙ্গে দেখতে পেল মেয়েটা পাশের কোয়ার্টারের পুরনো দিনের রেলিং টপকে ওপাশে চলে গেছে। এবার ওর পালা। ঠিক একইভাবে দুবার দোল খেয়ে ও লাফ দিল রেলিংয়ের দিকে। শরীরটা শূন্যে পাক খেয়ে ল্যান্ড করল রেলিংয়ের ঠিক ওপরে। ব্যথার চোটে বুকের বাতাস বেরিয়ে গেলেও রেলিং চেপে ধরার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে রেলিংয়ের একটা পাশ ভেঙে সোজা মাটির দিকে ছুটে চলল আরিয়ান। মরণ চিৎকার করে মাটিতে পড়ল ও ভীষণ বেগে। ভেবেছিল মরেই গেছে কিন্তু শীতকালের ঝরা পাতার মোটা আবরণ অনেকটাই কমিয়ে দিল পতনের ধাক্কা। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও।

চেতনা ফিরে এলো রাসনার ঝাঁকিতে। ‘আরিয়ান আরিয়ান,’ ওর কোট ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছে মেয়েটা। ‘ওঠ ওঠ পালাতে হবে।

তীব্র ব্যথা আর আতঙ্কের চোটে আরিয়ানের মনে হলো একবার বলে দেয়, আমি আর পারব না কিন্তু ও জানে এই বাক্যটা উচ্চারণ করা মাত্রই সব খেলা সাঙ্গ হবে। ওর পরিবার, ওর ইমেজ, ওর জগৎ, এত কষ্ট সব শেষ হবে। সমস্ত শক্তি এক করে রাসনার গায়ে ভর দিয়ে ঝট করে উঠে বসল আরিয়ান। ‘চলো চলো, দেয়াল টপকাতে হবে।’

চারপাশ থেকে নানা ধরনের শব্দ আলো ভেসে আসছে, কোনোদিকে দেখার সময় নেই। দুজনেই গাছটার অন্যপাশে দেয়ালের কাছে এসে প্রথমে রাসনাকে ঠেলে উঠিয়ে দিল দেয়ালের ওপরে। পুরনো দিনের কোয়ার্টারের দেয়াল অতটা উঁচু না যে পার হওয়া যাবে না। রাসনা উঠে বসে ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। আরিয়ান ওর হাত ধরতে গিয়েও পিছলে গেল, হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। কোমর- পা কাজ করছে না ঠিকঠাক কিন্তু ‘পালাতে হবে…পালাতে হবে’ বেজে চলেছে মাথার ভেতরে। কোনোমতে রাসনার হাত ধরে দেয়ালের ওপরে উঠে এসে একরকম গড়িয়ে পড়ে গেল অন্যপাশে।

দেয়াল থেকে নামতেই শুনতে পেল ওদের বাঁ দিক থেকে পুলিশের সাইরেন বাজিয়ে ছুটে আসছে গাড়ি। খোড়াতে খাড়াতে ডানে দৌড়াতে শুরু করল দুজনে। জলদি আরিয়ান,’ রাসনা এগিয়ে গেছে ওর থেকে আর শখানেক গজ পার হতে পারলে, ওই ডানে মোড় নিতে পারলে হয়তো পালাতেও পারে। জান দিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল আরিয়ান। কিন্তু কোমরের ব্যথাটা কিছুতেই পা চালাতে দিচ্ছে না ওকে।

‘আরিয়ান জলদি জলদি,’ খানিক এগিয়ে থেমে গেছে রাসনা। ওকে এগোনোর জন্যে ইশারা করছে। আরিয়ান ওকে এগোতে বলে যতটা সম্ভব জোরে দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে জড়তা কেটে গতি বাড়ছে ওর। আরেকটু এগোতেই রাসনার পাশে চলে এলো ও। দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে একই সময়ে ডানে মোড় নিল। কিন্তু ডানে মোড় নিতেই গাড়ির তীব্র হেডলাইটের আলোতে অন্ধ হয়ে গেল দুজনে। এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, এত প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ—ধরা পড়ে গেছে ওরা, পালাতে পারেনি এত চেষ্টার পরেও। হতাশার সঙ্গে রাসনার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল আরিয়ান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *