একটি শ্লীলতাহানির কাহিনী

একটি শ্লীলতাহানির কাহিনী

বৌয়ের দিকে তাকিয়ে হতবাক হলেন শচীন সেন।

কীব–ব্যাপার!

শুধু এই কথাটিই কোন রকমে তাঁর অথই বিস্ময়ের অতল থেকে উথলে উঠল।

পরীর মত হলেও, উত্তর তিরিশে, প্রায় সাঁইত্রিশে এসে তার বৌকে এখন পরিণত বয়সী বলা যায় হয়তো। প্রার্থনীয় হলেও, এমন উত্তঙ্গ দৃশ্য সেনে প্রত্যাশিত নয়। এই পীনোন্নত পরিস্থিতিতে তিনি যেন একটু হতচকিতই হলেন।

নয়া ব্লাউজের মোড়কে পদ্মকোরকের ন্যায় প্রস্ফুটিত হলেও দৃশ্যটা তার চোখে ঠিক আলপিনের মতই ফুটতে লাগল।

মনে পড়ে, একদা এক কিশোরীকে তিনি যদুবাবুর বাজারের মোড়ে এক জোড়া পদ্মকোরক কিনে উপহার দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, তোমাকে তো ভগবান দুটো দিয়েছেন। আমিও আর দুটো পদ্মকোরক দিলাম তোমায়!

তখন যেন তিনি পাগল হয়েছিলেন। কিন্তু সে তো অনেকদিন আগের কথা।

সেই কথা স্মরণ করে এতদিন পরে আবার তাঁকে পাগল করার মানসেই তার গৃহিণী যে তাঁর এই পঞ্চাশোর্ধ এসে পদ্মিনীরূপে দেখা দেবেন তা তিনি ধারণাই করতে পারেন। না। বানপ্রস্থানের বয়সে এসে আরেক প্রস্থ যৌবনলাভ?–না, না, শচীন সেন হলেও এখনও তিনি such insane হননি।

বৌকে নিয়ে বেরুচ্ছিলেন একট, কিন্তু বৌ শাড়ি ব্লাউজ বদলে সেজে গুজে এসে দাঁড়াতেই কোথায় যে তাঁদের যাবার ছিল সেকথা স্রেফ ভুলে গেছেন বেমালুম।

সেদিন হগসাহেবের বাজার থেকে নতুন যে ব্লাউজটা কিনে আনলে—সেইটে বুঝি? এই কথাই তাঁর মুখ দিয়ে বেরুলো কেবল।

যা, সেইটেই। বৌয়ের চোখে কৌতুক কী রকম লাগছে তোমার বল তো?

না, খারাপনয়তেমন। তবে চোখে লাগছেএলে একটু দম নিয়েবললেন, এ রকমটা হলো কী করে?

কী রকমটা?

কী রকম যে, তা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। শ্লীলতায় না কোথায় যেন বাধল; এই স্তনঢ্যতার সামনে ব্রীড়াবোধ করে বিড়ম্বিতের মতই তিনি বললেন-এমনি ভাবে তোমায় নিয়ে রাস্তায় বার হব কী করে ভাবছি তাই।

কেন, কী হয়েছে?

এই বুড়ো বয়সে এক অষ্টাদশীকে নিয়ে কী করে পথে বেরুব–লোকে কী ভাববে—তাই ভাবছি, বলে তিনি আর একটু প্রাঞ্জল হবার চেষ্টা করলেন—সামান্য একটা ব্লাউজে এমন অসামান্য পরিবর্তন…তোমাকে একেবারে অর্ধেক বয়সে এনে ফেলেছে যে! ভাবতেই পারা যায় না।

ব্লাউজে নয় মশাই, ব্রা-এর জন্যেই। বৌও একটু প্রাঞ্জল হয়, এবার ব্লাউজের সঙ্গে নতুন-সেই কিশোরী-তনু-ব্রা-টা পরেছি কিনা–তাইতেই।

কি-শো-রী-ত-নু?!

হ্যাঁ, এই বিজ্ঞাপনটা দ্যাখো না, তাহলেই টের পাবে।

বৌ পাশের ঘর থেকে একটা সচিত্র পত্রিকা এনে তার হাতে দিল—এ জিনিসটা এখন এখানে নিউ মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে আজকাল।।

দেখলেন বিজ্ঞাপন। বোম্বাইয়ের এক চিত্ৰবহুল ইংরেজি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত মেইডেন ফর্ম -এর বিশদ বিবৃতি : অনুবাদে সংক্ষেপে দাঁড়ায়-বিজ্ঞানের নবীনতম আবিষ্কার যা আপনাকে আবার নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। পরমাশ্চর্য রবার স্পঞ্জে প্রস্তুত আমাদের এই আধুনিকতম ব্রা-ধারণে আপনার বক্ষসৌষ্ঠবের সুষমা সবাইকে বিমোহিত করবে—এর কৃত্রিমতা অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেও কারোর ধরবার সাধ্য নেই, মূল্য মাত্র…ইত্যাদি।

কী? আশ্চর্য নয়?

আশ্চর্য বলে! কিন্তু এই চমকদার বক্ষবেষ্টনী কার জন্যে পরা তা কি জানতে পারি? শচীনবাবু শুধান, পাড়ার ছেলেদের মাথা খারাপ করতে চাও নাকি এই বয়সে?

তোমার জন্যেই পরেচি মশাই! আবার কার জন্যে? কেন, তোমার কি ভালো লাগছে মোটেই?

সত্যি কথা বলতে, একটু আমতা করে তিনি ভাঙলেন, তোমার এই উদ্ধত যৌবন-শ্রীর চাইতে আগেকার শান্তশ্রীই আমার পছন্দ—সেই আমার ভালো লাগত আরো। বুড়ো হয়ে গেছি তো, চোখে চালসে পড়েছে কত কাল, বেশি পাওয়ারের আলোয় এখন চোখ ধাঁধায়। চোখে বড় লাগে—এই আর কি।

সেদিন বেীকে নিয়ে বেরিয়ে পদে পদেই তিনি যেন বিপন্ন বোধ করেন। সারা পথটাই, তাঁর বিপথ বলে মনে হতে থাকে। একবার অপাঙ্গে বৌয়ের দিকে তাকান, আরেকবার অপর পথচারীদের দিকে। আর তাকিয়ে দ্যাখেন তারাই বা কেমন করে তাকাচ্ছে তাঁর বৌয়ের পানে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে নিজের বৌয়ের ভাবগতিক লক্ষ্য করেন। এমন কি উঠতি বয়সের ছেলেদের চাল-চলনও তার নজর এড়ায় না। যাদের দিকে কখনো ভুলেও তিনি তাকাতেন না আজ তারাও তার লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে।

লোকে মেয়েদের দ্যাখে কী? কী দ্যাখে? কানের গোড়ায় এসে ফিসফিস করে বৌ।

প্রথমত, তার মুখটাই দ্যাখে অবশ্যি, বলেন উনি : অন্ততঃ আমি তো তাই লক্ষ্য করি।

তারপর, তৃতীয়ত তার হাত দুখানি দ্যাখে সে…

তারপরে?

তারপর তার পায়ের দিকে নজর দেয় মুখপদ্ম থেকে পদপল্লবে…

কিন্তু দ্বিতীয় কী দ্যাখে তাতে তুমি বললে না, মনে করিয়ে দেয় ওঁর বৌ।

সে আর আমি কী বলব! বলেন শচীনবাবুঃ সে তো তুমিই বলে দিয়েছ।..আর…আর তোমার নিজের কথার জবাব পাচ্ছো চারধার থেকেই। পাচ্ছো না? আমরা যতটা ভাবি মানুষের দৃষ্টি তেমন নিচের দিকে নয়। প্রায় সবারই বেশ উঁচু নজর। বুঝেছ?

পাড়া ছাড়িয়ে ট্রাম রাস্তায় নামতেই তিনি ঘামতে থাকেন। কী ভাবছে আশপাশের সহযাত্রীরা। অচেনারাও কেমন যেন বক্রকটাক্ষে তাকিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। এক পৃর্ণযৌবনার সহিত আরেক প্রায়-প্রৌঢ়ের গতিবিধি তারা তেমন সুনজরে দেখছে বলে মনে হয় না।

ট্রামভর্তি যাচ্ছে কত লোক। তারাই বা কী ভাবছে রাস্তায় তাদের দিকে তাকিয়ে

কে জানে! তাদের ভেতর তাঁর চেনা জানাও যাচ্ছে কত জনা। আপিসের সহকমীরাও রয়েছে হয়তো। তাঁদের দুজনকে দেখে কী ঠাওরাচ্ছে কী জানি! এই বয়সে এক পরীকে নিয়ে ঘুরছেন তিনি? না, দ্বিতীয় পক্ষে এক নব যুবতীকে বিয়ে করেছেন আবার! করেছেন বেশ করেছেন, তাই বলে সেই দ্বিতীয় পক্ষিনীকে সঙ্গিনী করে রাস্তায় বেরুতে লজ্জা করে না লোকটার! এই সবই ভাবছে তারা হয়তো বা। ফলে নিন্দমুখর আপিসে গিয়ে হয়তো কান পাতা যাবে না কালকে।

না, এর পর থেকে বৌকে নিয়ে…না, আর নয়! একলাই তাঁকে বেরুতে হবে এবার থেকে। বৌকে নিয়ে ক্রিকেট মাঠে কি সিনেমায় যাওয়ার দিন তাঁর গেল এবার।।

হপ্তা চারেক বাদে ইডেনে টেস্টম্যাচ দেখতে বৌকে সঙ্গে না নিয়েই তিনি বেরুলেন। এই প্রথম একলা! মনটা খচ খচ করতে লাগল তার। মনে পড়ল, এই ইডেনের মাঠেই তিনি নিজের ঝেটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন; তাঁর পাসে বসে একদা যে অপরিচিতা কিশোরীটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল তাকেই তিনি একদিন বিয়ে করে নিজের ঘরে এনে তুলেছেন। সেদিনের তনু কিশোরীটি আজ কিশোরীতনু পরে কেমন করে যেন তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেল একেবারে!

মাঠের থেকে ফিরতে দেখলেন, বৌ রাজ্যের অন্ধকার মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে।

আপিস থেকে সোজা ইডেনে গেছলাম কিনা টেস্ট ম্যাচ ছিল আজকে। অনেকটা কৈফিয়তের সুরেই তিনি জবাব দেন—আপিস থেকেই চলে গেলাম বলে তোমায় আর নিয়ে যেতে পারিনি। সেই জন্যেই এই মুখভার নাকি গো?

না। সেজন্যে নয়। আমার সেই ব্রা-টা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনে। বৌ জানায়।

পাচ্ছ না বুঝি?

কথা আর না বাড়িয়ে তিনি হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়ে ঢোকেন।

বাথরুমে আজ অনেকদিন পরে তাঁর মন যেন গুঞ্জরণ করে ওঠে। …আমার মল্লিকা বনে…যেদিন প্রথম কলি… তিনি গুণ গুণ করে উঠলেন আপন মনে… তোমার লাগিয়া সেদিনই বন্ধু গেঁথেছিনু অঞ্জলি।

সেদিনের সেই তন্বী কিশোরীটির মুখে শোনা তার প্রথম গান। আর তারই মুখ থেকে কিছুদিন আগেকার শোনা, আমরা দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনায়। ভুল না সে কথা ভুল না! এই গানটাও তার মনে পড়ল সেই সঙ্গে।…

সে গানটির কলিও তাঁর মুখে ফুটল নাইতে নাইতে…সেদিন প্রভাতে কী ছিল তা জানো? তোমার মনের মাধুরী মিশানো, আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা। ভুল না ভুল না।

না, সেকথা ভোলার নয়, ভুলবেন কী করে? অতুলনীয়…অতুলনীয়…যেমন সেই হাসি তেমনি সেই গান আর তেমনিই বুঝি সেই গায়িকা!

চা জলখাবার এনে দিয়ে বৌ জানাল-পেয়েছি আমার ব্রা-টা। কথাচ্ছলেই বলল যেন কথাটা সে।

পেয়েছে বুঝি?

কথাটা তিনি এড়িয়ে যেতে চান।

আচ্ছা, ওটা ওখানে নিয়ে গেলে কী জন্যে গো? গুমরে ওঠে ওঁর বৌ…খেলার মাঠে কী কাজ দিচ্ছিল ওটা?

চিরদিন তুমি আমার সঙ্গে যাও তো…আজ তোমাকে যখন সঙ্গিনীরূপে পেলাম, তখন তোমার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবেই নিজের সাফাই দেন শচীনবাবুঃ খেলার মাঠে কে আর কবে একলাটি যায়? হয় নিজের স্ত্রী নয় পরস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই যায় তো সবাই। এই বয়সে আর আমার সঙ্গে যাবার কে জুটবে তাই…।

তা নিয়ে গেছ বেশ করেছ, কিন্তু ওটার এমন দফা রফা হোল কী করে বল তো? পরবার কোন জো রাখখানি একেবারে।

একদম পরা যাচ্ছে না বুঝি? বলতে গিয়ে শচীনবাবু ফুর্তিতে যেন উহলে ওঠেন।

যাগ্‌গে…নাই পরলাম আর। বলল ওঁর বৌ : তুমিও তো চাও না যে ওটা আমি পরি। আমাকে এই রকমই তো তোমার ভালো লাগে! তাই না?

হ্যাঁ, সত্যি। এই রকমই তোমায় বেশ ভালো দেখায়। সায় দেন শচীনবাবুঃ অ্যাতো সুন্দর দেখায় যে…

বুঝেছি। আর বলতে হবে না। কিন্তু ওটার এরকম দশা হলে কী করে তাই আমি ঠাওর পাচ্ছিনে।

গল্প করার কাউকে পাশে না নিয়ে ইডেনের ঐ কঠিন আসনে ঠায় দু ঘন্টা বসে থাকা যায়?—তুমিই বলো! তাই সঙ্গিনীর অভাব মোচনেই…

তারপর আর বলার দরকার করে না। কার ধর্ষণে তাঁর কিশোরী তনুর কৈশোরধর্ম

যে বিনষ্ট হয়েছে তা বুঝতে আর বিলম্ব হয় না বৌয়ের।

আসনের দুঃখ ভোলাতে কোনো তনু কিশোরীকে সঙ্গিনী না পেয়ে সেটাকে সুখাসন করে তোলার জন্যই ওই কিশোরী তনুর ওপরেই কর্তা চেপে বসেছিলেন এতক্ষণ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *