একটি লক্ষ্য, তিনটি খুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
নামকরা অপরাধ-তত্ত্বজ্ঞের এরকম সাদামাঠা হাব-ভাব আর নিষ্প্রভ বিশ্লেষণ আই. বি. অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার আদৌ আশা করেননি। বুদ্ধির চমক না হোক, অনুসন্ধানী চোখের তেমন ধারাও কিছু দেখলেন না। অথচ ভদ্রলোকটির এ জায়গায় অবস্থানকালে দুর্ঘটনার খবরটা পেয়ে এ সি: বেশ একটু উৎসাহ নিয়ে একেবারে তাঁকে সঙ্গে করে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। কিন্তু বিদেশের নামকরা ক্রিমিনোলজির প্রোফেসরের বৈশিষ্ট্য বা চটক কিছু চোখে পড়ল না। একবার অবশ্য মনে হয়েছিল, অবসরপ্রাপ্ত জীবনে এ-সব নিয়ে আর হয়তো মাথাই ঘামাতে চান না ডক্টর বাবুলাল। কিন্তু জাতের বাঘ রক্তের গন্ধ পেলেও একটু চনমনিয়ে উঠবে না—এই বা কেমন!
এ-ধরণের হত্যা শুধু গোরখপুরে নয়, এই দেশেই নতুন। খবরের কাগজেও তাই লিখেছে। পাখির ঘাড় মটকানো বা ঠাকুমার ঝুলিতে রাক্ষস-খোক্কসদের ঘাড় মটকানোর কথাই শোনা ছিল। কিন্তু শুধু হাতে মানুষও অবলীলাক্রমে মানুষের ঘাড় মটকাতে পারে, সে নজির এই প্রথম। এটা অবশ্য মানুষের ঘাড় মটকানো নয়, মেয়েমানুষের। ঘাড়ের দিক থেকে তাতে কতই বা তফাৎ!
গোরখপুর থানা থেকে মাইল চারেক দূরের এক আবাসিক হোটেলের ঘটনাটা। অনেক মাসকাবারী বাসিন্দা থাকেন সেখানে। দোতলার কোণের দিকের একটা ঘরে মেয়েটি থাকত। কোন এক হাসপাতালের নার্স এক মাসের ছুটিতে ছিল এবং সেই এক মাসের জন্য এখানে ঘর ভাড়া করেছিল। এমনি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও নাকি সে হাসপাতালের নার্স-কোয়ার্টারে থাকত না—কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ত। প্রাথমিক তদন্তে এইটুকুই প্রকাশ।
ডক্টর বাবুলালকে সঙ্গে করে এ. সি. হোটেলের সেই ঘরেই এসেছিলেন। মেয়েটি তখনো দরজার কাছেই মেঝেতে পড়েছিল। তদন্তগত প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর সরকারী ডাক্তার নেড়েচেড়ে দেখেছেন, ঘাড়-মটকানো পাখির মতই মাথাটা ঝুলে পড়েছে। মেয়েটিকে পোস্ট-মর্টেমের জন্য সরিয়ে নেওয়ার পর ডক্টর বাবুলাল বারকতক শুধু ঘরটাকে দেখেছেন, কাউকে একটি প্রশ্নও করেননি। সেদিক থেকে স্থানীয় থানা অফিসার বরং এ-দেশী তদন্তের ঠাট কিছু দেখিয়েছেন। হোটেলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে খানসামা পর্যন্ত সকলকে জেরায় জেরায় জীর্ণ করে ছেড়েছেন।
ফেরার পথে এ. সি. জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কিছু বুঝলেন?’
জবাবে সানন্দে মাথা ঝাঁকিয়েছেন বেঁটেখাট ভদ্রলোকটি, ‘ইয়েস, বড় বেরসিক লোকের হাতে প্রাণ গেছে মেয়েটার। কিলিং সুড বি মোর সোবার—অ্যাট্ লিস্ট ফর এ ফিমেল ভিক্টিম!’
এ. সি. হেসেই ফেলেছিলেন। ভদ্রলোকের কর্মদক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ হয়নি এখনো, কিন্তু তাঁর সরস বাকপটুতা উপভোগ করার মতই। রোজ সন্ধ্যায় কথা শোনার জন্যেই তাঁর বাড়িতে যান তিনি।
এরপর উনি পরামর্শ দিয়েছেন, মেয়েটির মৃত্যুতে সব থেকে বেশি লাভ কার খোঁজ করুন, আর তার সঙ্গে যত লোকের চেনা-পরিচয় আছে, তার একটা লিস্ট করুন।
এবারে এ. সি. মনে মনে হেসেছেন। এই পরামর্শটুকু দেবার জন্য বিদেশের ছাপ-মারা অপরাধ-তত্ত্বজ্ঞের প্রয়োজন ছিল না। এ কাজটুকু এদেশে রুটিন মাফিকই করা হয়। বিদায়ের আগে কথায় কথায় ডক্টর বাবুলাল অনুরোধ করলেন, ‘বিকেলে পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট আর ওই ডাক্তারকেও সঙ্গে করে একবার নিয়ে আসুন না, আলাপ-সালাপ করি।’
এ. সি. তাও এনেছিলেন। মৃত্যু নেক্-বোন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে—মৃত্যুক্ষণ আগের দিন সন্ধ্যারাতের কোন সময়।
‘হোটেলে সেই সময়েই সুবিধে।’ নিস্পৃহ মন্তব্যের পর ডক্টর বাবুলাল জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘ও বাজটা করতে হাতের জোর চাই কতটা?’
ডাক্তার বুঝিয়েছেন, ‘জোর মন্দ লাগে না, তবে তার থেকেও বেশি দরকার ঠিক জায়গাটিতে ঠিকমত ধাক্কা দেওয়া—অ্যাকুরেসি অ্যান্ড অ্যাকশন—ফাঁসিতে যেমন হয়। কিন্তু শুধু হাতে সেটা যে সম্ভব, ভাবা যায় না। আশ্চর্য কাণ্ড বলতে হবে।’
এ. সি. জানালেন, ‘মেয়েটির মৃত্যুতে একমাত্র লাভ দেখা যাচ্ছে পেসেন্টদের—নার্সের গুণাবলি তার কমই ছিল, দশবার ডেকেও দর্শন মিলত না। রোগী আর সহকর্মিণী সকলের সঙ্গেই খিটিমিটির লেগেই থাকত। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও তার ওপর খুব খুশি ছিলেন না।’
এই কেস নিয়ে ডক্টর বাবুলাল হয়তো আর মাথাই ঘামাতেন না। কিন্তু ঠিক সাত দিনের মাথায় গোরখপুরে দ্বিতীয় চমক লাগল। এবারের দুর্ঘটনা শহরের উল্টো মাথায় এক পার্কের মধ্যে। পার্কের বেঞ্চিতে একটি তিরিশ বছরের পুরুষকে মৃত অবস্থায় দেখা গেছে। সেই একই ঘাড়-মটকানো ব্যাপার—কোন রকম ব্যতিক্রম নেই।
শুনে বাবুলাল লাফিয়ে উঠেছিলেন, ‘এ ড্যাম ডার্টি প্লেস, আর বেড়ানোর শখ নেই। আমার মাথার ওপর মায়া আছে, আমি পালাব এবার।’
এ. সি. ঠাট্টাই করলেন, ‘এবারের ভিক্টিম তো ফিমেল নয়, মেল—ততটা নৃশংস লাগছে না বোধ হয়?’
বাবুলাল তৎক্ষণাৎ অনুমোদন করেছেন, ‘রাইট, দিস টাইম ইট লুক্স ম্যানলি, কিন্তু লোকটার চোখে—আই থিঙ্ক্ নো ওম্যান ক্যান ডু দিস—তার চোখে পুরুষ-রমণী ভেদাভেদ নেই। বাট হি হ্যাজ প্র্যাকটিস্ড্ এ গুড ডিল—অনুশীলন করেছে, খুনের মৌলিকতা আছে।’
এ. সি.-র মাথায় দুশ্চিন্তা, মাস্টারি মন্তব্য ভাল লাগল না। সেই জন্যে একটু খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে পারলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওদেশের থেকেও বেশি মৌলিকতা?’
মজার কথা যেন, আধবুড়ো ভদ্রলোকটি জোরেই হেসে উঠলেন, ‘না, তা কি করে হবে, ও দেশগুলো আর্টিস্টিক কিলিং-এ স্পেশালাইজ করছে—দে আর লেস্ লাউড—সো ডিটেকশান ইজ মোর থ্রিলিং দেয়ার। ও-সব কেসে মাথা ঘামিয়েও সুখ।’
এবারে এ সি-র স্পষ্ট টিপ্পনি, ‘এখানকার এই সব স্থূল হত্যায় ওই থ্রিল আর সুখ নেই বলেই হদিস পাচ্ছেন না বোধহয়। এরা বোকার মত খুন করে বলেই যত মুশকিল—’
‘আপনি ঠাট্টা করছেন?’ খোস-মেজাজেই বলেন ডক্টর বাবুলাল, ‘আমি তো মাথা ঘামাইনি, কিন্তু খুব কঠিন হবে বলে আমার মনে হয় না। এরকম হত্যার যদি কোন উদ্দেশ্য বা অর্থ খুঁজে না-ই পান, তাহলে সেটাই ‘ক্লু’ বলে ধরে নিন—দেন্ ওয়েট অ্যান্ড সী।’
পরে টেলিফোনে ডক্টর বাবুলাল এ. সি.-কে কথায় কথায় শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এ-লোকটার মৃত্যুতে সমূহ লাভ কার?’ বিদেশের অপরাধ বিজ্ঞানীর প্রতি এ সি-র আর বোধহয় তেমন আস্থা ছিল না। জবাব দিয়েছেন, ‘ওর নিজেরই। লোকটা বেকার ছিল, দিনরাত চাকরির খোঁজে খোঁজে ঘুরে বেড়াত, শহর ছাড়িয়ে একটা ভাঙা বাড়িতে বুড়ি দিদিমা আর গুটিকয়েক নাবালক পোয্য নিয়ে থাকত। অতএব দেহ-পিঞ্জর থেকে এ-ভাবে খালাস পেয়ে লাভ ওর নিজের থেকে বেশি আর কার?’
বাবুলাল হেসে রসিকতার তারিফ করেছেন আর সেই এক কথাই বলেছেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড সী।’
আলোচনা যত হালকা রকমেরই হোক, পর পর এ ধরণের দু’-দুটো হত্যাকাণ্ডে শহরে চাঞ্চল্য বড় কম দেখা গেল না। এই বিচিত্র হত্যাপদ্ধতি নিয়ে কাগজে অনেক লেখালেখি হল। অনেকে অনেকভাবে মাথা ঘামাতে লাগলেন। কারো কারো ধারণা, কোন ক্ষিপ্ত উন্মাদ নিজস্ব পদ্ধতিতে হত্যার মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে,—আর তাই যদি হয়, সেটা গুরুতর ভয়ের কারণ।
॥ দুই ॥
রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মালপত্র সহ যশোবন্তকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরে চলল কৃষ্ণকুমার। মুখখানা তেমন প্রসন্ন নয়, ক্লান্তও লাগছে। বাড়ির কাছে এসে দেখে, পাশের একতলা বাংলো বাড়ির উৎসব তখনও শেষ হয়নি। বাড়ির দরজায় দশ-বারোখানা ঝকঝকে মোটর দাঁড়িয়ে। আলোয় আলোয় সামনের বড় হলঘরটা দিনের বেলার থেকেও সাদা দেখাচ্ছে। পিছনের দিকের দেয়াল ঘেঁষে দোতলার একটা ঘরে থাকে কৃষ্ণকুমার। দোতলার তিনখানা ঘরই তার দখলে। একতলাটা বছরের মধ্যে এগারো মাসই তালাবন্ধ থাকে। বাড়িওয়ালা কখনো-সখনো সপরিবারে এসে থাকেন। নিচের একটা কোণের ঘরে যশোবন্ত থাকে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বকাবকি করে বছরখানেক হল তার জন্য একটা ঘর আদায় করা গেছে।
কৃষ্ণকুমারের ঘরের জানালায় দাঁড়ালে পাশে জগদীশ ভাটের প্রাসাদের অন্দরমহলের অনেকটাই দেখা যায়। ঘরে ঢুকে কি ভেবে আলো জ্বালল না। জানালা থেকে উৎসব-মুখর হলঘরটা জোরালো আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হলের মাঝখানের একটা মখমল কুশনে গৌরী ভাট বসে—তার চারিদিকে স্তূপীকৃত ফুল আর উপহার। মেয়ে-পুরুষের হাসাহাসি দাপাদাপিতে ঘরটাই যেন হাসছে। কিন্তু ওই মহিলাটির দিক থেকেই সহজে চোখ ফেরাতে পারল না কৃষ্ণকুমার। সর্বাঙ্গের ফুল-সাজে এমন সুন্দরও দেখায় কাউকে জানত না। সুন্দরী বটে, কিন্তু এমন কিছু সুন্দরী নয়—তবু আজ যেন গৌরী ভাট উর্বশীরও ঈর্ষার পাত্রী।
প্রৌঢ় জগদীশ ভাট এক একজনকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন, আর হাসি খুশিতে ডগমগিয়ে উঠছেন। স্ত্রীর জন্মদিনের গোটা আনন্দটা যেন তাঁরই। প্রতিবারই সাতদিন আগে থেকেই বোঝা যায় বাড়িতে বিশেষ উৎসবটি আসছে। মশলার ব্যবসায় ভদ্রলোকের অঢেল টাকা। গৌরী ভাট তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। তার ভাগ্য দেখে অনেক বিত্তবানের ঘরণী গোপনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবেন হয়তো, তৃতীয় না হলে স্ত্রী হয়ে সুখ নেই।
কৃষ্ণকুমার মাঝে মাঝে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে, মাঝে মাঝে বিছানায় এসে বসে। ভিতরে কিরকম অস্বস্তি একটা। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল একসময়। কানদুটো সজাগ। গাড়ি আসছে, যাচ্ছে। শেষে যাচ্ছেই বেশি, আসছেও দুই একটা।·····এটা যাচ্ছে, এটাও যাচ্ছে····এটা, না এটা এল····এটা····
বাইরের কি একটা চাপা কলরবে চোখ মেলে দেখে খরখরে সকাল। কিন্তু জানলা দিয়ে ও-বাড়ির দিকে চোখ পড়তেই চক্ষু স্থির। রাস্তা লোকে লোকারণ্য, বাড়ির ভিতরে পুলিশ গিসগিস করছে। রাস্তার লোক হটাবার তাড়নায় পুলিশ হিমসিম খাচ্ছে। কৃষ্ণকুমার জামাটা টেনে নিয়ে নিচে ছুটল।
॥ তিন ॥
সাত সকালে ঘুম ভাঙানোর বিরক্তি ভুলে ডক্টর বাবুলাল লাফিয়ে উঠলেন, ‘হুর্রে! এবারে কুকুর? হাউ স্ট্রেঞ্জ—চলুন চলুন।’
এ. সি.-র আগেই জিপে উঠে বসলেন তিনি। তারপর সমাচার শুনলেন, সকালে মিল্ক-ম্যান দুধ দিতে এসে দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে যায়, ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না, ভেজানো ছিল শুধু। তারপর ভিতরে ঢুকেই দেখে জগদীশ ভাটের আদরের কুকুরটা মরে পড়ে আছে—ঘাড়টা উল্টো দিকে মটকানো। কারো সাড়া না পেয়ে শেষে ভাটের ঘরে উকি দিয়েই চিৎকার চেঁচামেচি। বাইরের লোক তক্ষুনি টেলিফোনে খবরটা দিয়েছে। হাত-পা বাঁধা মুখে কাপড়গোঁজা অবস্থায় জগদীশ ভাট মেঝেতে অজ্ঞানের মত পড়ে আছে।
ডক্টর বাবুলাল চকিত প্রশ্ন করলেন, ‘বাঁধুন খুলে ফেলা হয়েছে?’
‘না। আমি টেলিফোনে বারণ করেই ছুটছি, ভাবলাম আপনাকেও তুলে নিয়ে যাই।’
‘ওয়ান্ডারফুল!’
এ. সি. ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন আরো জোরে চালাতে, কারণ টেলিফোনে শুনেছেন গৃহস্বামীর অবস্থা শোচনীয়—এর মধ্যে যদি খতম হয়ে যায়, সময়মতো বাঁধন না খোলার দায়টা তাঁদের ঘাড়ে পড়তে পারে।
রাস্তায় তখন দু’জন চারজন করে লোক জমতে শুরু করেছে। দুই এক মুহূর্তের মধ্যে বাঁধন পরীক্ষা করে নিয়ে এ সি: কর্মচারীদের বাঁধন কাটতে নির্দেশ দিলেন। স্থুল দেহের চামড়া আর মাংস যেন হাড় থেকে সরে সরে গেছে। গলার নীল শিরা ফেটে বেরিয়ে আসছে, চোখের দু’কোণ বেয়ে জল পড়ছে টস টস করে। এ. সি. চোখ টেনে দেখলেন, ভিতরে আলগা রক্ত ছড়ানো যেন। জ্ঞান নেই। ধরাধরি করে তাঁকে শয্যায় শুইয়ে ডাক্তার পালস্ ধরে বসে রইলেন। ইঙ্গিতে সহকর্মীকে প্রাথমিক ব্যবস্থার নির্দেশ দিলেন তিনি।
ডক্টর বাবুলাল বেখাপ্পা মন্তব্য করে বসলেন, ‘এমন সুখের শরীরে এতটা দরকার ছিল না, ভদ্রলোককে মিছিমিছি বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে।’
চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে আবার বললেন, ‘এখানে বাড়ির লোক কারা? হোয়ার আর দে? এঁর স্ত্রী কোথায়? ইজ হি এ ব্যাচেলার?’
পুলিশ-কর্মচারী ছাড়া আর যে দু’চার জন ঢুকে পড়েছিলেন, সকলেই বাইরের লোক। প্রশ্নটা শুনে সকলেরই খেয়াল হল, তাইতো, জগদীশ ভাটের স্ত্রী কোথায়? গৌরী ভাট কোথায়? এত গোলযোগেও তাঁর ঘুম ভাঙেনি?
এ সি-র কি যেন মনে পড়ল।····শুনেছিলেন বটে মহিলাটি একটু-আধটু পানাসক্ত, উৎসবের রাতে হয়তো মাত্রাধিক্য ঘটেছে, তাই তেমন হুঁশ নেই। কানে কানে বাবুলালকে জানালেন তিনি। বাবুলাল বাইরে এসে দাঁড়ালেন, কুকুরটা ঘাড় উল্টে মরে পড়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটাকে দেখলেন খানিকক্ষণ, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়েই উঠলেন তিনি, ‘বাট উই মাস্ট সী—মে বি সি ইজ ডেড। শুধু কুকুর মারার উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ নাও আসতে পারে!’
শোনার সঙ্গে সঙ্গে এ. সি-ই সর্বাগ্রে হলঘরের ওপাশের ঘরটাতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন। তারপরেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
নারীর সেই মৃত্যুর দৃশ্য মর্মান্তিক।
ফুলের আভরণ বেশির ভাগই গায়েই আছে তখনো। কিছু মাটিতে ছড়ানো। শিয়রের দিকের জানলার কাছে নারীদেহ কার্পেট-বিছানো মেঝেয় লুটিয়ে আছে।
জগদীশ ভাটকে নার্সিং-হোমে পাঠানো আর গৌরী ভাট ও কুকুরের দেহ ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানোর ফাঁকে কোথা দিয়ে ঘন্টা দুই চলে গেল। খবরটা ততক্ষণে শহরময় ছড়িয়ে পড়েছে। লোজন হটানো এবং খবরের কাগজের রিপোর্টারদের নিরস্ত করার পর এ. সি. বাইরের হলঘরে বসে পড়ে হাঁপ ছাড়লেন। বাড়ির পরিচারকরাও একে একে এসে গেছে। গৌরী ভাটের খাস পরিচারিকাও আছে! আর আছে দু’জন লোক। একজন পাশের বাড়ির কৃষ্ণকুমার, অন্যজন জগদীশ ভাটের ভাগ্নে চন্দ্রমোহন।
পরিচারক বা পরিচারিকাকে জেরা করে একটাই তথ্য জানা গেল। প্রতি বছরই উৎসবের দিন গৃহকর্ত্রী সকলকে এক মাসের মাইনে এবং পরদিন সম্পূর্ণ ছুটি দিয়ে থাকেন। রাতের উৎসব শেষে সেই একটা দিন সকলেই যে যার বাড়ি যায়। পরের দিন কর্তা এবং কর্ত্রী বাইরেই খানাপিনা করেন। কর্ত্রী আগের দিন বিকেলে সকলকে টাকা দিয়েছেন, আর রাত ঠিক দশটা পনেরয় সকলকে ছুটি দিয়েছেন।
তাদের বিদায় দিয়ে এ. সি. ভাগ্নেকে জেরা করতে বসলেন। বছর তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, শক্ত সমর্থ উঁচু লম্বা চেহারা। লোকটা খুব বুদ্ধিমান কি খুব বোকা—বোঝা শক্ত।
‘আপনি কাল রাতে কোথায় ছিলেন?’
‘থিয়েটারে।’
‘বাড়িতে উৎসব, আপনি থিয়েটারে ছিলেন কেন?’
‘বাড়িতে উৎসব বলেই। তাছাড়া আমার পার্ট ছিল····’
‘বাড়িতে এ ধরণের উৎসব আপনি পছন্দ করেন না?’
ভাগ্নে চন্দ্রমোহন সাফ জবাব দিল, ‘মামাকে আর মামার উৎসব পছন্দ করি না।’
‘কেন পছন্দ করেন না?’
‘ভালো লাগে না বলে।’
ডক্টর বাবুলাল সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছিলেন তাকে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মামীকে ভালো লাগে, আই মিন, লাগত?’
চন্দ্রমোহন থমকালো একটু, তারপর বলল, ‘লাগত।’
এ. সি. প্রশ্ন করলেন, ‘থিয়েটার ক’টায় ভেঙেছে?’
‘রাত দশটা নাগাদ।’
‘রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘বন্ধুর বাড়ি। অনেক রাত্রিতেই বন্ধুর বাড়িতে থাকি।’
ডক্টর বাবুলাল এ. সি-র কানে কানে কি বলতে এ. সি. আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার মামা ব্যবসার কাজে বাইরে যান?’
‘মাসের মধ্যে দশ পনের দিন বাইরেই থাকেন।’
‘সেই সময় বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিতে থেকেছেন কোনদিন?’
‘থেকেছি, আরো বেশি থেকেছি।’
এ. সি. এবারে একটু কর্কশ স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ড্রিংক করেন?’
‘করি।’ নির্বিকার জবাব। তারপর নিজেই বলল, ‘মশায়, আমি খুনটুন কাউকে করতে পারিনে, একটা আরশোলাও মারতে পারিনে, একটা—’
এ. সি. রূঢ় কণ্ঠেই কি বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ডক্টর বাবুলাল আলতো করে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘কেন পারেন না, আপনারই তো লাভ বেশি—মামী না থাকলে মামার অবর্তমানে তো আপনিই সব পাবেন?’
জবাবে চোখ বড় বড় করে চন্দ্রমোহন খানিক চেয়ে রইল তাঁর দিকে, তারপর হতাশার সুরেই বলল, ‘মামা থাকলেও পেতাম, মামীর দরাজ হাত—কিন্তু বেছে বেছে তাঁকেই খুন করা হল কেন বুঝলাম না।’
ক্ষোভের স্পষ্ট অর্থ, খুনটা বরং মামা হলে তার আপত্তি ছিল না। ডক্টর বাবুলাল মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। মাঝে দ্বিতীয় লোকটিকে দেখছেন তিনি। কৃষ্ণকুমারকে। হল-এর ওধারে বিষণ্ণমূর্তিতে বসে আছে চুপচাপ। জেরার কাজ চলছিল হলের এ-মাথায় বসে। চন্দ্রমোহনকে ছেড়ে দিয়ে তাকে ডাকা হল।
নাম জেনে নিয়ে এ. সি: জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি পাশের বাড়িতে থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতকাল আছেন?’
‘অনেক কাল, চার পাঁচ বছর।’
‘এঁদের সঙ্গে জানাশোনা ছিল?’
‘ছিল।’
বাবুলাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল এবাড়িতে আপনার নেমন্তন্ন ছিল?’
একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, ‘ছিল।’
‘এসেছিলেন?’
‘না।’
‘কেন?’
জবাবে জানালো, নিমন্ত্রণে সে কোথাও বড় যোগ দেয় না। তাছাড়া সমস্ত দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিল। স্টেশনে যশোবন্তকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত দিনের সমস্ত বিবরণ জ্ঞাপন করল সে। প্রশ্নের জবাবে নিজের পেশারও ফিরিস্তি দিতে হল। ফোটোগ্রাফের ব্যবসা, এখানকার ফোটো স্টুডিওর মালিক সে। খুব ছোট থেকে আরম্ভ করেছিল, দু’তিন বছর হল ব্যবসা ভালোই চলছে।
গোরখপুরের পরের স্টেশনে স্টুডিওর ব্রাঞ্চ আছে, মুভি ক্যামেরা দিয়ে যশোবন্তকে সেখানে পাঠিয়েছে—খুব সকালে সেখানকার একটা লোকাল ফাংশন কভার করার অর্ডার আছে, তাই—!
‘যশোবন্ত আপনার ফোটোগ্রাফার?’
‘না, কর্মচারী। রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে আজ খুব ভোরে দোকানে ক্যামেরা পৌঁছে দেবে—বিকেলের মধ্যে তার ফিরে আসার কথা।’
বাবুলাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মুভি ক্যামেরার দাম তো অনেক, তাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন, বিশ্বাসী লোক খুব?’
‘হ্যাঁ।’
এ. সি. প্রশ্ন করলেন, ‘কতকাল আছে আপনার কাছে?’
‘বছর দেড়েক। বিশ্বস্ত লোক খুঁজছি জেনে মিস্টার ভাট ওকে রেকমেন্ড করেছিলেন। তাঁর বাইরের কোথাকার আড়তে এক সময় কাজ করত, এখানে এসে চাকরির জন্য তাঁকে ধরে পড়েছিল।
বাজে কথায় আর সময় নষ্ট না করে এ. সি. উঠে পড়লেন। এক্ষুণি অনেক জায়গায় ছোটাছুটি করতে হবে তাঁকে। পথে ডক্টর বাবুলালকে চুপচাপ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাগ্নের কথা ভাবছেন?’
তিনি অন্যমনস্কের মত জবাব দিলেন, ‘না, কৃষ্ণকুমারের কথা। রঙ কালো, কিন্তু অদ্ভুত মিষ্টি দেখতে, তাই না? আই এনভি হিম।’
এ. সি. এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও না হেসে পারলেন না। পঞ্চাশ উত্তীর্ণ প্রায় বৃদ্ধের নাদুস-নুদুস খর্বকায় মূর্তিটি কোনদিক থেকেই রমণীয় নয়। তাঁকে হাসতে দেখে হাসলেন বাবুলালও, একটু যেন উচ্ছাসই জ্ঞাপন করলেন, ‘কৃষ্ণকুমার—ওই চেহারায় আর কোন নাম হয় না—হি মাস্ট বি অ্যান আর্টিস্ট, এ রিয়েল আর্টিস্ট—ওর সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে করছে; যশোবন্ত এলে একবার নিয়ে আসুন না?
যশোবন্তকে এ. সি. বিকেলেই নিয়ে এসেছিলেন। এদিকেই দেশ তার। একেবারে নিম্নশ্রেণীর নয়, আবার ভদ্রলোকও ঠিক বলা যায় না। হৃষ্টপুষ্ট জোয়ান চেহারা। স্বল্পভাষী। জবাব দিতে পারলে দুই এক কথায় জবাব দেয়, নয়তো চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে থাকে। প্রশ্ন না বুঝলেও ফিরে জিজ্ঞাসা করে না কি বলা হচ্ছে। এ. সি-র উল্টোপাল্টা জেরার মুখেই বাবুলাল ঈষৎ আগ্রহে প্রশ্নের ধারা বদলে দিলেন একেবারে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কৃষ্ণকুমারবাবু, তোমাকে এখন কত মাইনে দেন যশোবন্ত?’
‘দেড়শ।’
‘বাঃ! আচ্ছা, বছরখানেক আগে কত পেতে?’
‘একশ।’
‘তাহলে বাবু তোমার ওপর খুব খুশি আছেন বল?’
যশোবন্ত নিরুত্তর।
বাবুলাল কোন উত্তর আশাও করেননি যেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা যশোবন্ত, জগদীশ ভাট যখন ব্যবসার কাজে বাইরে থাকেন, তোমার বাবুকে ওই মিসেস ভাটের সঙ্গে রাতেও গল্পসল্প করতে দেখতে তো?’
যশোবন্ত নিরুত্তর।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন এ. সি. পর্যন্ত। বাবুলালের এ কণ্ঠস্বর যেন ছুরির ফলার মত। ‘কত রাত পর্যন্ত তোমার বাবু ও বাড়িতে কাটাতেন?’
যশোবন্ত নিরুত্তর। বাবুলাল নিজেও বিস্মিত একটু, ছুরির ফলাটা যেন একটা নিষ্প্রাণ কিছুতে গিয়ে বিঁধল। যশোবন্ত নির্বাক, নিরাসক্ত।
তখুনি গলার স্বর একেবারে কোমল খাদে নামিয়ে বাবুলাল আবার বললেন, ‘জবাব না দিলে তোমার বাবুর তুমি ক্ষতিই করবে যশোবন্ত । আচ্ছা, ‘ও-কথা থাক, তোমার বাবুকে দেখলে ও বাড়ির কুকুরটা ডাকাডাকি করত কিনা বল তো?’
এবারে যশোবন্ত সামান্য ঘাড় নাড়ল।
‘ডাকত না? রাত্রিতে দেখলে?’
এ. সি. দেখলেন কণ্ঠস্বর নয়, এবারে বাবুলালের চোখদুটি যেন ছুরির ফলা।
যশোবন্ত নীরব।
এ. সি. ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করতে চেষ্টা করলেন, ‘জবাব না দিলে তোমাকে আমি থানায় নিয়ে যেতে বাধ্য হব যশোবন্ত।’
বাবুলাল তক্ষুণি ছদ্মরাগে বলে উঠলেন, ‘ওকে থানায় নিয়ে গেলে আমি আপনার বিরুদ্ধে কেস্ করব। বাবু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছেন যশোবন্ত, তুমি কিছু ভেব না। আচ্ছা তুমি যাও এখন, তোমাকে কষ্ট দিলুম।’
যশোবন্ত চলে গেলে এ. সি ঠাট্টা করলেন, ‘আপনি রোমান্সটাই বড় করে তুলতে চাইছেন দেখি।’
বাবুলাল হাসতে লাগলেন। তারপর মন্তব্য করলেন, ‘মিসেস ভাটের উৎসবের সাজসজ্জা দেখে মনে হল, পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা তিনি খুব অপছন্দ করতেন না—অ্যান্ড কৃষ্ণকুমার ইজ পারফেক্টলি এ লেডিস ম্যান।’
এ. সি. টিপ্পনি কাটলেন, ‘ভাগ্নে চন্দ্রমোহনকেও একটু-আধটু লেডিস ম্যান ভেবেছিলেন।’
জব্দ হয়েই যেন মুখখানা গোবেচারীর মতো করে ফেললেন বাবুলাল।
॥ চার ॥
গত দিনের সমস্ত রিপোের্ট সংগ্রহ করে এ. সি. বাবুলালের বাড়ি এলেন পরদিন সন্ধ্যার পর। রিপোর্টের সংক্ষিপ্ত মর্ম, গৌরী ভাটের মৃত্যুর সময় রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারটার মধ্যে—কুকুরেরও তাই। একই ভাবে মৃত্যু—এর আগে দুজন যেভাবে মরেছে, ঠিক সেইভাবে। তবে এবারে যে বা যারা মেরেছে, শুধু হাতে ফেরেনি—দেরাজের গয়নাপত্র আর টাকাও নিয়েছে। জগদীশ ভাট নার্সিংহোমেই আছেন, এখনো অসুস্থ খুব। দশটা পনের নাগাদ শোবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন—ঘরের আলোও তিনি নেভাননি, খুব সম্ভব স্ত্রী বা চাকর-বাকর কেউ নিভিয়েছে। এ. সি. খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সন্ধ্যা থেকেই ভদ্রলোক একনাগাড়ে ড্রিংক করেছেন, কাজেই আলো নেভাবার ফুরসৎ পাননি।····ক’জন তাঁকে আক্রমণ করেছিল, ভদ্রলোক বলতে পারলেন না, শুধু গলা টিপে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ করা হচ্ছিল এইটুকুই মনে আছে। সমস্ত রাত ভাল করে জ্ঞান হয়নি, কিন্তু তারই মধ্যে একটা মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট, ঠিকমতো সুস্থ হয়ে উঠতে পাঁচ-সাতদিন লাগবে—ব্লাড-প্রেসারও হাই। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শোনার পর আর একটা কথাও বলেননি। বারকতক শুধু বাড়ি যেতে চেয়েছেন, আর কিছু না। ওই অবস্থায় তাঁকে খবরটা দেওয়া হয়েছে বলে ডাক্তাররা অনুযোগ করেছেন।
ডক্টর বাবুলাল ঈষৎ ব্যস্ততায় ঘরের মধ্যে বার দূই চক্কর দিয়ে শেষে বললেন, ‘নো, হি মাস্ট নট কাম, তাঁকে বাড়ি আসতে দেবেন না। ডাক্তারদের বলে রাখুন, তাঁকে যেন অসুখের ভয় দেখিয়েই কিছুদিন আটকে রাখেন। হি মাস্ট নট কাম ব্যাক নাউ। আর একটা কথা—ভাগ্নে, কৃষ্ণকুমার, বন্ধু-বান্ধব, চাকর-বাকর কাউকে নার্সিং-হোমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না—একটা চেনা মাছিও যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না পারে।’
এ. সি. একটু অবাক হলেন, ‘কেন? ভয়ের কারণ আছে?’
‘ইয়েস, ইয়েস।’ হঠাৎ সুর পালটে ফেললেন বাবুলাল, বেশ খুশি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লেডিস ম্যান কি বলে, অ্যান্ড দ্যাট থিয়েটার ভাগ্নে?’
‘খবর নিইনি। কোথাও যেতে বারণ করে দিয়েছি, এই পর্যন্ত।’
‘ও, আই ফিল্ ফর দেম····রিয়েলি আই ডু, আপনাকে আগেই বলেছিলাম, লেডি-কিলিং সুড বি মোর সোবার—অমন একটি মহিলাকে ও-ভাবে যেতে হল বলে এই বয়সেও আমারই বুকটা শুকনো লাগছে—সি ওয়াজ্ নট মেড ফর দ্যাট!’
এ. সি. কূল-কিনারা না পেয়েই এসেছেন, নইলে এই ঝামেলার সময় হয়তো আসতেনও না। রসিকতা বরদাস্ত করতে পারলেন না। বললেন, ‘এবারের কেসটাও আপনার মাথা না-ঘামানোর মতই স্থূল মনে হচ্ছে বোধ হয়?’
‘ও ইয়েস—’ একটুও না ভেবেই জবাব দিলেন, ‘ভেরি লাউড। তবে, মাথা ঘামাতে রাজী আছি—লাইক অস্ট্রেলিয়া প্লেইং ক্রিকেট এগেনস্ট আমেরিকা। কিন্তু তার আগে আপনি আমাকে অফিসিয়ালি ইনভেস্টিগেশনের ভার দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, আই মাস্ট নট বি রিফিউজড এনি-হোয়্যার।’
এ. সি. অবাক, ‘হত্যাকারী কে আপনি অনুমান করেছেন?’
‘অনুমান কেন, আমি তো জানি কে।’
এ সি. লাফিয়ে উঠেছিলেন প্রায়, ‘যাদের দেখেছেন, তাদের মধ্যেই কেউ?’
‘ও ইয়েস। কিন্তু আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
যেন কোন সংশয় নেই। এ সি. শ্লেষের সুরেই বললেন, ‘কিন্তু এর আগেও দুটো খুন হয়েছে যাদের এই পরিবারের কারো সঙ্গে কারো সম্পর্ক নেই—আপনি ভোলেননি তো?’
বাবুলাল হাসতেই লাগলেন, ‘আপনি খুব বিচলিত দেখছি। যা বললাম তাই করুন, আর ভালো কথা মনে করিয়েছেন—যে হাসপাতালে সেই নার্স কাজ করত, থিয়েটার ভাগ্নে, আই মিন, চন্দ্রমোহন সেই হাসপাতালের পেসেন্ট ছিল কি না কখনো, বা ওই নার্সের তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না, খবরটা নিন। আর তারপর যে লোকটা খুন হয়েছে, সে-ও চন্দ্রমোহনের কাছে চাকরির তদ্বির করত কি না জানতে চেষ্টা করুন—টু-ডে দিস ফার।’
মরুভূমিতে ওয়েসিস দেখলেন যেন এ. সি.। পরদিন টেলিফোনে তাঁর উত্তেজিত গলা শোনা গেল। ডক্টর বাবুলালের ধারণা সবই ঠিক, এখুনি গ্রেপ্তার করা হবে কি না চন্দ্রমোহনকে, সেটাই জানতে চান তিনি।
বাবুলাল সহাস্যে বাধা দিলেন, ‘নো, মাই ডিয়ার নো। ইউ উইল হ্যাভ ইয়োর গেম, ডোন্ট ওয়রি।’
কিন্তু ওয়রি না করেও পারেন না এ. সি.। এরপর একনাগাড়ে দু’দিন আর বাবুলালের দেখাই নেই। সকালে এসে শোনেন বেরিয়েছেন, বিকেলে এসে শোনেন বাড়ি নেই। টেলিফোনেরও জবাব পান না—এ. সি. হতভম্ব। এদিকে কুকুর আর গৌরী ভাটের মৃত্যুর পর শহরে একটা ত্রাস পড়ে গেছে। একলা ঘরে শুতেও লোক যেন আর নিরাপদ বোধ করে না। আর সব কিছুর জের এই তদন্ত বিভাগকেই সামলাতে হয়।
তৃতীয় দিনে রাতের দিকে দেখা মিলল। এ. সি. কিছু বলার আগেই ডক্টর বাবুলাল প্রস্তাব করলেন, ‘চলুন, কৃষ্ণকুমারের সঙ্গে একটু গল্প করে আসি।’
অপ্রত্যাশিত আগন্তুকদের ওপরে শোবার ঘরেই বসালো কৃষ্ণকুমার। অন্য উপায়ও ছিল না, কারণ বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ভিতরে এসেই পড়েছেন ভদ্রলোকেরা। কোণের ঘর থেকে যশোবন্ত বেরিয়ে এসেছিল, এঁদের দেখে চুপচাপ আবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাবুলাল সহাস্যে বললেন, এলাম জ্বালাতন করতে—আপনার মন খারাপ নিশ্চয়—বাট আই অ্যাম নট এ ব্যাড টকার। মন খারাপ বলাতেই যেন কৃষ্ণকুমার হাসতে চেষ্টা কবল। বাবুলাল পরম আগ্রহে ফোটোগ্রাফিরই পাঠ নিতে শুরু করলেন তার কাছ থেকে। শেষে তার তোলা ভালো ফোটো কিছু দেখতে চাইলেন। কৃষ্ণকুমার ড্রয়ার খুলে একগোছা ছবি বার করলে। সেই সঙ্গে হাতির দাঁতের পাতের ওপর আঁকা সুন্দর একটা নক্সা বেরিয়ে পড়ল। নিচে নীল জল, ওপরে নীল আকাশ—মাঝে দুটি বলাকা ভারি অন্তরঙ্গভাবে উড়ে চলেছে। প্লেটের নিচে শুধু তারিখ লেখা।
হাতির দাঁতের প্লেটটাই সাগ্রহে তুলে নিলেন ডক্টর বাবুলাল, সপ্রশংস নেত্রে দেখলেন একটু, ‘ওয়ান্ডারফুল! হাতির দাঁতের প্লেটে এ তুললেন কি করে?’
কৃষ্ণকুমার জানালো, ছবি তুলে পরে আর্টিস্ট দিয়ে আঁকিয়ে নেওয়া হয়েছে।
‘হাউ নাইস!’ এ সি-র দিকে তাকালেন বাবুলাল, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম না, হি ইজ এ রিয়েল আর্টিস্ট।’
কিন্তু স্তুতি সত্ত্বেও কৃষ্ণকুমারের মুখখানা শুকনোই দেখাতে লাগল। বাবুলালের এবার হঠাৎই তারিখটার দিকে যেন চোখ গেল। বলে উঠলেন, ‘কবে করিয়েছেন এটা—এতে তো দেখছি মিসেস ভাটের জন্মদিন—মৃত্যুদিনও বলতে পারেন—সেই তারিখ!’
চট করে উঠে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে জগদীশ ভাটের বাড়িটা ভালো করে একবার দেখে নিয়ে আবার এসে বসলেন। প্লেটের দিকে চোখ রেখে হাসছেন মৃদু—মৃদু, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনখানে’—পড়েছেন? রবীন্দ্রনাথ·····আমার নামটা বিদঘুটে হলেও আমি বাঙালী, জানেন তো?’
হাসতে লাগলেন, যেন এটাই একটা খবর। তারপর কোমল গলায় সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা মিসেস ভাটকে উপহার দেবার ইচ্ছে ছিল বোধ হয়?’
পাংশুমুখে কৃষ্ণকুমার মাথা নাড়ল শুধু। তার দিকে চেয়ে বাবুলাল তেমনি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন, ‘ছিল না? হাউ স্ট্রেঞ্জ! একটু ভেবে বলুন, সামটাইমস্ লাইইং প্রুভস ভেরি কস্টলি—ভেরি, ভেরি!’ তাকে অবকাশ না দিয়েই আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার এই ফোটোগ্রাফির ব্যবসা কত দিনের?’
‘চার পাঁচ বছর।’
‘দু’বছর আগে ব্যবসার অবস্থা কেমন ছিল?’
‘খুব ভালো নয়।’
‘কিন্তু এখন তো খুব ভালো চলছে, জায়গায় জায়গায় ব্রাঞ্চ করেছেন—কম করে লাখ টাকার অ্যাসেট তো হবেই, কি বলেন?’
কৃষ্ণকুমারের জবাব দেবার শক্তি নেই যেন, জবাবের প্রতীক্ষাও করলেন না বাবুলাল। আবার প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘হঠাৎ এত মূলধন আপনি কোথায় পেলেন?’
শুকনো মুখে কৃষ্ণকুমার তাকাল তাঁর দিকে, ‘ধার করেছি।’
‘ডকুমেন্ট আছে?’
‘না।’
‘ভেরি লাইকলি। ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানলাম গত দেড় বছরের মধ্যে মিসেস গৌরী ভাট সব মিলিয়ে আপনাকে প্রায় ষাট হাজার টাকার চেক দিয়েছেন—আপনার ধারটা তাঁর কাছেই বোধ হয়?’
এবারে এ সি-ও হতভম্ব। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে গেছে কৃষ্ণকুমারের, কাঁপছেও একটু একটু। এর ওপর ডক্টর বাবুলালের আর একটা নির্মম প্রশ্ন, ‘জগদীশ ভাটের কুকুর রাতে আপনাকে দেখলে ডাকত? প্লিজ—প্লিজ টেল্ মি ইয়েস্ অর নো!’
কৃষ্ণকুমার মাথা নাড়ল, ‘ডাকত না।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ!’ ডক্টর বাবুলাল এ. সি-কে উঠতে ইশারা করে সরাসরি নিচে নেমে এলেন। গাড়িতে উঠে এ. সি. বিস্ময়ে ভেঙে পড়লেন প্রায়, ‘কি ব্যাপার? আপনার ধারণা তো সবই ঠিক দেখছি—’
মৃদু হেসে বাবুলাল বললেন, ‘ওখানেই শেষ নয়।····আমার ধারণা সেই রাতে কৃষ্ণকুমার গৌরী ভাটের ঘরে এসেছিল।’
‘কিন্তু—’
‘হোয়াই কিন্তু? সকলেই জানে কর্ত্রী চাকর-বাকরদের সক্কলকে নিজে বিদায় করেছেন, আর জগদীশ ভাটেরও মদে বেহুঁশ হয়ে থাকার কথা—কৃষ্ণকুমার আসবে না কেন!
এ. সি. অবাক, ‘তাহলে ওকে অ্যারেস্ট করছেন না কেন?’
‘ওয়েট। আমার আরো ধারণা—সেই রাতে চন্দ্রমোহনও মামীর কাছে এসেছিল—মে বি, টাকা নিতে—কিন্তু এসেছিল। রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারটার মধ্যে সে তার বন্ধুর কাছে ছিল না, অ্যাট লিস্ট বন্ধু তার কাছে ছিল না—এগারটার পর বন্ধু বাড়ি এসে দেখে সে তার জন্য অপেক্ষা করছে—চন্দ্রমোহন তাকে বলেছে সে আধঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করছে।’
এ. সি. অথৈ জলে পড়লেন। শেষে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমি কি করব এখন?’
‘সিম্পলি ওয়েট।’ খানিক চুপ করে থেকে হাসলেন হঠাৎ, ‘হোয়াট এ সিলি মার্ডার!’ এ. সি-র দিকে তাকালেন, ‘ওই কুকুর মারা সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?’
এ. সি. জবাব দিলেন, ‘চেনা লোক ভিন্ন ওভাবে কুকুর কেউ মারতে পারে না।’
‘রাইট। কিন্তু মারল কেন?’
একটু ভেবে এ. সি জবাব দিলেন, ‘বোধহয় আমাদের চোখে ধূলো দেবার জন্য, যাতে কুকুরটাকে আমরা বাধা ভেবে হত্যাকারীকে অপরিচিত লোক মনে করি।’
‘ইউ আর এ জেম, পারফেক্টলি রাইট!’
কিন্তু জেম এবং রাইট হয়েও হতভম্বের মতই বসে রইলেন এ. সি.।
॥ পাঁচ ॥
ছুটির দিন। দুপুরে কৃষ্ণকুমারের বাড়ির দোতলায় উঠে যশোবন্তকে দেখে বিরক্ত মুখেই চন্দ্রমোহন জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবু আছেন?’
জবাবে যশোবন্ত কৃষ্ণকুমারের ঘরটা দেখিয়ে দিল শুধু। চন্দ্রমোহন ঘরে ঢুকেই অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আর কাঁহাতক সহ্য হয় বলুন তো? এটা অত্যাচার নয়?’
কৃষ্ণকুমার শুয়ে ছিল, উঠে বসে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাল শুধু। চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে চন্দ্রমোহন বলল, ‘মামা হাসপাতালে, একবার দেখা পর্যন্ত করতে দেবে না। কিন্তু এদিকে বাড়ি চলে কি করে, হাতে তো একপয়সাও নেই!’
কৃষ্ণকুমার নিস্পৃহ জবাব দিল, ‘সেকথা ওঁদের বলেন না কেন?’
‘বলিনি! ওই গোয়েন্দার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলাম আজ। সেখান থেকেই তো আসছি। শুনে বলে—হাওয়া খান। বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে অথচ রসিকতা দেখুন। সিঁড়িতে পা পিছলে আলুর দম, গিয়ে দেখি যন্ত্রণায় ডাক্তারকে হাত ধরে অনুরোধ করছে, রাতে একসঙ্গে তিনটে ঘুমের ওষুধ দেবার জন্যে—অথচ আমায় দেখেই যেন রোগশোক সব ভুলে গেল। আবার আশা দিল, মামীকে যে খুন করেছে, দু’তিন দিনের মধ্যেই ধরা পড়বে—তখন যেন পোলাও-কালিয়া খাই। সহ্য হয়? ইচ্ছে করছিল, একসঙ্গে তিরিশটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জন্মের মত ঘুম পাড়িয়ে দিই।’
কৃষ্ণকুমার চিন্তিতমুখে বলল, ‘আপনার মামী ছাড়া আরও দু’জন বাইরের লোকও তো খুন হয়েছে।’
গোয়েন্দার অভাবে কৃষ্ণকুমারকেই খেঁকিয়ে উঠল চন্দ্রমোহন, ‘কেন আবার! বুদ্ধির ঢেঁকি না ওঁরা? আমি বলেছিলাম— বলে কি জানেন! আসল খুন নাকি মামীর খুনটাই—ও দুটো খুন পুলিশকে আর অন্য সব লোককে ভাঁওতা দেবার জন্য। জাহান্নামে যাক, গোটা পঁচিশ টাকা দেবেন এখন? হাতে এক কানাকড়ি নেই।’
চুপচাপ উঠে কৃষ্ণকুমার টাকা বার করে দিল। প্রাপ্তির ফলে একটু খুশি দেখা গেল চন্দ্রমোহনকে। বলল, ‘যাক বাঁচালেন, মামা না আসা পর্যন্ত কি যে করি—এদিকে তো মামার এমন অসুখ যে, আমাদের তাঁর সঙ্গে দেখা করারও হুকুম নেই, অথচ আমার সামনেই বাবুলাল পুলিশের চাঁইটাকে বলল, মামাকে কাল একবার তার ওখানে নিয়ে আসতে, ঠ্যাং ভালো থাকলে সে নিজেই যেত। মামার সঙ্গে কথাবার্তা বলা হলে কালকের মধ্যেই সে খুনীকে ধরে দিতে পারবে আশা করছে। ওর মাথা আর মুণ্ডু। কালকের মধ্যে মামার সঙ্গে দেখা না করতে দিলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমিই কেস করব, মামাকে জোর করে আটকে রেখেছে ওরা। চেক সই করে টাকা পাঠাতে দিচ্ছে না কেন? না খেয়ে চাকরবাকরগুলো শুন্ধু যখন পালাবে—।’
একটা অসহ্য অবিবেচনার ক্ষোভে গরগর করতে করতে চন্দ্রমোহন প্রস্থান করল। কৃষ্ণকুমার স্থাণুর মত বসে।।
রাত্রি। অন্ধকারে লোক চলাচল থেমে গেছে। দু’দিকে গাছ আর ডালপালায় বাবুলালের বাসাটা আরো নিঝুম মনে হচ্ছে। বাইরের বারান্দার সামান্য শব্দ হল একটু। দড়ির ফাঁস লাগিয়ে সন্তর্পণে কেউ দোতলার বারান্দায় নামল। পা টিপে ঘরের দরজার কাছে কান পাতল। ভেতরে ঘন নিশ্বাসের শব্দ। পকেট থেকে দুটো দস্তানা বার করে হাতে পরে নিল, তারপর আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। দু’হাত বাড়িয়ে শয্যার দিকে এগোতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো ঝকমকিয়ে উঠল। আড়াল থেকে রিভলভার হাতে এগিয়ে এল এ. সি. এবং আরো চার পাঁচ জন। ডক্টর বাবুলাল উঠে বসলেন, নিস্পন্দ মূর্তির দিকে চেয়ে বললেন, ‘এমন বোকা তুমি যশোবন্ত! অ্যাঁ? ওষুধের বড়ির ঘুমটা আর যাতে না ভাঙে সেই ব্যবস্থা করতে এসে গেলে!’
পুলিশ ততক্ষণে কর্তব্য সমাধান করেছে। বাবুলাল বললেন, ‘ওর দস্তানা দুটো দেখুন তো ভালো করে।’
দেখা গেল দু’দিকে দুটো লোহার থাবার মত আটকানো। যশোবন্ত চিত্রার্পিত। বাবুলাল এ সি-কে বললেন, ‘আপনাকে আরো একটা অ্যারেস্ট করতে হচ্ছে, এক্ষুণি যান।’
এ. সি. সানন্দে জবাব দিলেন, ‘সে এতক্ষণে করা হয়ে গেছে, এই মূর্তিটি বাড়ি থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকুমারকে অ্যারেস্ট করার ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে।’
‘মাই গড!’ দু’চোখ কপালে তুলে ফেললেন বাবুলাল, ‘বলেন কি মশাই! সে কি করল? স্বর্ণপ্রসূ হাঁসকে বইয়ের মূর্খই মেরে থাকে, সত্যি সত্যি কি কেউ মারে? গৌরী ভাটের মৃত্যুতে কৃষ্ণকুমারেরই তো ক্ষতি সব থেকে বেশি! নো নো, ইউ আর জোকিং— এক্ষুণি হাসপাতালে গিয়ে যশোবন্তের আসল মনিবটিকে অ্যারেস্ট করুন—গো অ্যান্ড অ্যারেস্ট জগদীশ ভাট!····কৃষ্ণকুমার ওকে সত্যিই রাত আটটায় স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। ও ফিরে এসে সব কাজ সেরে আবার সাড়ে এগারোটার গাড়িতে ক্যামেরা নিয়ে গেছে। কি বলো যশোবন্ত?’
সকলের নির্বাক মূর্তির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হৃষ্টকণ্ঠে বাবুলাল এ. সি-র উদ্দেশেই বললেন আবার, ‘আচ্ছা, গুডনাইট অল্ অভ ইউ—গুডনাইট যশোবন্ত। আই অ্যাম রিয়েলি সরি, তোমার হাত মজবুত, কিন্তু মাথা বড় কাঁচা—মিঃ ভাটেরও! ইউ স্পয়েল্ড এভরিথিং বাই কিলিং দি ডগ। অ্যান্ড মোর ওভার, বাইরের পেশাদার হত্যাকারী ঘরের পুরুষকে বেঁধে স্ত্রী হত্যা করে না, প্রথমেই পুরুষকে হত্যা করে, তারপর দরকার হলে স্ত্রীলোকের কথা ভাবে।’