১৫
স্পেশাল ফোর্সের জোনাল অফিসের সদর দরজা দিয়ে বলতে গেলে প্রায় যুদ্ধ সাজে বেরিয়ে আসতে থাকা বাহিনীটাকে দেখে খানিক স্বস্তি বোধ হলো জুলহাসের শরীরে। তারমানে যে-উদ্দেশ্যে বিগত প্রায় দেড় দুই ঘণ্টা ধরে বসে ছিল সেটা একবারে বেকার যাচ্ছে না। যা ও শুনেছিল এবং যেভাবে পরিকল্পনা করেছে খোঁজখবর করে সেটা কিছুটা হলেও সত্যি হতে যাচ্ছে। খানিকটা স্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে উঠতেই পুরো টিমের পেছনে বেরিয়ে আসা ছোটখাটো শক্তিশালী চেহারার .মানুষটাকে দেখতে পেল ও। একভাবে বলতে গেলে এই লোকটার ব্যাপারেই বিগত সময়টা ব্যয় করেছে ও। কাজেই দুই ঘণ্টা আগে আশুলিয়াতে দেখা মানুষটা আর এই লোকের ভেতরে অনেক অনেক পাথর্ক্য মনে হচ্ছে ওর কাছে।
স্পেশাল ফোর্স অফিসার, যাকে সবাই অফিসার রহমান নামে চেনে। ফোর্সের অত্যন্ত মেধাবী এবং ক্ষমতাবান অফিসারদের একজন। পুলিশ ফোর্স থেকে ক্যারিয়ার শুরু করা মধ্য ত্রিশের এই মানুষটা পুলিশ থেকে র্যাব, তারপর র্যাব থেকে স্পেশাল ফোর্সে কাজ করছে এখন। প্রতিটি ধাপে নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে খুব দ্রুত ওপরে উঠে আসা অফিসারদের একজন সে। তবে তার মূল বৈশিষ্ট্য অন্য জায়গায়। অসংখ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই অফিসার অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খুনি এবং কানেকশনবাজ হিসেবে পরিচিত ফোর্সে। তার ব্যাপারে তার কলিগরা বলাবলি করে, যে-মেধার কথা বলা হয় এটা আসলে তার নিজের দলের লোকজন ছড়িয়েছে। আদতে এর কোনো সত্যতা নেই। যদি সত্যিকার অর্থেই তার কোনো মেধা থেকে থাকে তবে সেটা হলো, বিভিন্ন ফোর্সের করাপ্টেড উপরওয়ালাদের সন্তুষ্ট রাখা, সেটা যে-উপায়েই হোক। এরপর যদি তার কোনো মেধা থেকে থাকে, তবে সেটা হলো খুন করা। নিজের দশ-বারো বছরের ক্যারিয়ারে যতটা না বেশি অপরাধী গ্রেপ্তার করেছে সে, কিংবা অপারেশন সম্পন্ন করেছে, তার বেশির ভাগই সে মেরে ফেলেছে। সে নাকি মশার মতো মানুষ মারে এবং মেশিনের মতো টাকা খায়। আর ওই দুটো জিনিসই সে একরকম প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়। দুই সন্তানের জনক বিবাহিত এই লোকটা এমনভাবে সব মহলের
সবাইকে সন্তুষ্ট করে রাখে যে, কেউই তাকে নিয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। তার নামে একাধিক কেস তো বটেই মিডিয়া রিপোর্ট হলেও কিছুতেই কিছু হয়নি, এসবের কোনো কিছুই তাকে প্রমোশন পাওয়া কিংবা ফোর্স পরিবর্তন করে আরো ভালো অবস্থানে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি। তার ব্যাপারে এমনও কথিত আছে যে তাকে নাকি তার ওপরওয়ালাও সমঝে চলে, তার আন্তর্জাতিক কানেকশনের কারণে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর চতুর ভয়ংকর এবং কানেকশনবাজ এই লোকটিকেই দেয়া হয়েছে, লেখক আরিয়ান শফিককে গ্রেপ্তার করে তাকে আইনের আওতায় আনার জন্যে।
আশুলিয়াতে যখন দেখতে পেল জুলহাস এই লোকের নাম জানত না। তবে তাকে দেখে এটা বুঝতে পেরেছিল যে, এই লোকই এই জায়গার নেতা। তাই তার আর তার সুদর্শন সঙ্গীর বর্ণনা রেকর্ড করে ভয়েস মেসেজ আকারে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওর ইনফরমারের কাছে, তাদের পরিচয় জানার জন্যে। খুব দ্রুত কয়েকটা লিংকসহ দ্রুত রেসপন্স এসেছে ওর মোবাইলে। কিন্তু ততক্ষণে ওরা মুভ করতে শুরু করাতে জুলহাস সেগুলোকে দেখতে পারেনি। আশুলিয়া থেকে খুব সাবধানে ওদের অনুসরণ করে এদের হেড অফিসের সামনে এসে যখন বসল তখনো জানত এমনকি এরা যদি লেখক অরিয়ান শফিককে লোকেট করতে পারে, তবে এরাই সেই অপারেশন চালিত করবে তাকে ধরার জন্যে। কারণ সার্বিক পরিস্থিতিতে যা বুঝতে পারছিল, ওর তাতে এটা মনে হচ্ছিল যে, এরা এই লেখককে অন্য কারো হাতে পড়তে দেবে না। আর আশুলিয়ার ঘটনার পর রহমানের মতো লোক তো অবশ্যই তাকে ছেড়ে দেবে না। অন্যদিকে এটাও মোটামুটি অনুমেয় ছিল যে, এতে সময় লাগবে, কাজেই ঘটনার ভেতরে কী ঘটছে সেটা জানার জন্যে নিজের লোককে লাগিয়ে দিয়ে ও গাড়িতে বসেই একটার পর একটা সিগারেট উড়িয়ে গেছে, সেই সঙ্গে বিশদভাবে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করেছে তার আপাত প্রতিপক্ষ রহমানকে। আর সত্যি কথা হলো লোকটাকে বোঝার পর ওর ভীতির মাত্রা বেড়েছেই, কমেনি। তবে এটাও ঠিক, ও যেটা ভাবছিল লেখককে ওদের মুখ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কঠিন হবে, এখন সেটা আরো কঠিন মনে হচ্ছে। তবে ওর সতর্কতাও বেড়েছে। সেই সঙ্গে এই করাপ্টেড অফিসারের ব্যাপারে আরেকটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। যে কারণে ও নিজে এই দুরাশার ভেতরেও খানিকটা আশা দেখতে পাচ্ছে। সেটা হলো, এরা যেভাবেই হোক আর যেখান থেকেই হোক, লেখককে পাকড়াও করুক অথবা মেরে ফেলুক সেটা সবার সামনে করবে না, কাজেই হয়তো ওরা খানিক আড়ালেই কাজটা করতে চাইবে, যেই সুযোগটা নেয়ার ইচ্ছে আছে ওর।
রহমানের তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল জুলহাস, এমন সময়ে প্রথমে একবার ওর ইনফরমার খবর দেয় যে, মোহাম্মদপুরে নাকি এক লোককে একবার ট্রেস করা গেছে। কিন্তু সেই তথ্য সে কনফার্ম করতে পারেনি। জুলহাস মনে মনে একবার ভেবেছিল মোহাম্মদপুরের দিকে যাবে কি না। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেয় অপেক্ষা করবে। এরপর বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর ওকে ওর ইনফরমার জানায়, খুব জোরদার সম্ভাবনা ওরা লেখক আর ওই লেডি অফিসারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রেস করেছে। যেকোনো সময়ে ওরা অপারেশন চালাবে। যদিও ওর ইনফরমার ঠিক কনফার্ম করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক কোন জায়গাতে কিন্তু তবুও ও ওই এলাকাতে গিয়ে চেষ্টা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বাই চান্স যদি কোনোভাবে আগেভাগেই লেখককে খুঁজে বের করে ফেলতে পারে তাহলেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করার আগেই দেখতে পায় স্পেশাল ফোর্সের টিমটা বেরিয়ে আসছে। আর ওদের ঠিক পেছনেই রহমান আর তার সুদর্শন সঙ্গী।
ওদের বের হতে দেখে দুই ধরনের অনুভূতি হয় ওর ভেতরে ভেতরে। খানিক স্বস্তির, কারণ এটা প্রমাণ করে জোরদার সম্ভাবনা যে, ওরা লেখক আরিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে। কিন্তু অপর দিকে ওদের আগে তো বের হতে পারেইনি, সেই সঙ্গে এরা যেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বের হচ্ছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, এরা এবার একেবারে আঁটঘাট বেঁধেই নামছে, এদের হাত থেকে লেখকের বাঁচা যেমন মুশকিল, তার চেয়ে বেশি কঠিন এদের মুখ থেকে লেখককে উদ্ধার করে নিয়ে আসা। স্পেশাল ফোর্সের ওরা গাড়িতে উঠতে শুরু করেছে। জুলহাস গাড়ি স্টার্ট করে স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে পলকের জন্যে চোখ বন্ধ করল, মনে মনে একবার টোকনের চেহারাটাকে মনে করার চেষ্টা করল, তারপর চোখ খুলে দেখতে পেল স্পেশাল ফোর্সের শেষ গাড়িটাও ওদের প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে এগোতে শুরু করেছে রাস্তা ধরে।
নিজের গাড়িটাকে পার্কিং জোন থেকে বের করে পিছু নিতে শুরু করল জুলহাস। গাড়িগুলো যেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে, সেই হিসেবে বেশ ধীর গতিতেই এগোতে শুরু করেছে। পুলিশের কিংবা অন্যান্য ফোর্সের গাড়ি যেভাবে সাইরেন বাজিয়ে রাস্তাঘাট সব আতঙ্কিত করে দিয়ে যায়, এরা সেরকম না। জুলহাসের মনে হলো, অনেকটা চিতাবাঘ যেমন নীরবে ভীষণ বেগে নিজের শিকারের দিকে এগিয়ে যায়, সেরকমই ওরা নীরবে নিজেদের শিকার ধরার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছে। অনুসরণ করতে করতে আধা ঘণ্টার ভেতরে গাড়ির বহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করল। গাড়িবহর নীরবে এগিয়ে চলেছে ফুলার রোডের দিকে, বেশ সাবধানে গাড়িগুলোকে অনুসরণ করে ফুলার রোডের মুখের কাছে এসে থেমে গেল জুলহাস। কারণ একে তো এই এলাকা একেবারেই নীরব, তার ওপরে এদিকে নিয়মিত গাড়ির চলাচলও নেই বলতে গেলে। গাড়িটাকে ফুলার রোডের নতুন হওয়া কোয়ার্টারগুলোর ফুটপাতের কাছে এনে পার্ক করে এমনভাবে লাইট অফ করে দিল জুলহাস, যাতে মনে হয় গাড়িটা এখানেই পার্ক করা ছিল। গাড়িটাকে পার্ক করে সামনে তাকাতেই ও দেখতে পেল বহরের গাড়িগুলো পুরনো টিচার্স কোয়ার্টার এলাকার দিকে খানিক এগিয়ে থেমে গেল। কিন্তু এরপর যা ঘটল সেটা বেশ অবাক করার মতো।
যে রকম নীরবে ওরা এগিয়ে এসেছে, তাতে জুলহাসের মনে হয়েছিল, ওরা মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, কাজেই এখানে ওরা বেশি ঝামেলা করবে না; বা নীরবেই লেখক আরিয়ান আর মেয়েটাকে নিজেদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে। কিন্তু গাড়িগুলো থামতেই ওরা ভেতর থেকে দল বেঁধে সারি দিয়ে নেমে এসেই পুলিশের সঙ্গে কর্ডন দিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলতে শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে ক্ষণিকের জন্যে জুলহাস রীতিমতো জমে গেল। কারণ ওর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন কিন্তু এরা যেভাবে রীতিমতো কমান্ডো স্টাইলে অপারেশন চালাতে যাচ্ছে, এতে করে ওদের খুঁজে বের করে সতর্ক করা তো দূরে থাক ওই এলাকাতেই ঢুকতে পারবে না ও। কিছু একটা করতে হবে। জুলহাস কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ওরা পুরো এলাকা ঘিরে তো ফেললই সামনের রাস্তাটাও দেখতে দেখতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
জুলহাস অনুধাবন করল, খুব জলদি কিছু না করলে পরে পস্তাতে হবে। ও উত্তেজনার চোটে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কর্ডনের দিকে প্রায় দৌড়াতে শুরু করল। রাতের বেলা হলেও ওখানে ছোট একটা ভিড় জমেছে। জুলহাস ভেবেছিল ভিড়ের ভেতরে গিয়ে কোনোমতে ঢুকে পড়বে, কিন্তু স্পোশাল ফোর্সের ওরা যারা কর্ডনটা বসাচ্ছে তারা এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডদের যেভাবে রীতিমতো তাড়িয়ে দিচ্ছে কর্ডনের বাইরে সেটা দেখে খানিক দমে গেল ও। একেবারে সরাসরি কর্ডনের কাছাকাছি না গিয়ে ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ শক্ত গলায় ধমক শুনে প্রায় চমকে উঠে ফিরে তাকাল আরেকদিকে। অফিসার রহমানের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি চলছে কারো। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে জুলহাস দেখতে পেল রহমান তীব্র ধমক দিয়ে যার সঙ্গে তর্ক চলছিল তাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল,সঙ্গেসঙ্গে স্পেশাল ফোর্সের ওরা রাস্তার এই ভাগের পুরোটা সিল করে দিল।
১৬
জুলহাস এস্ত পায়ে আবারো ফিরে এলো গাড়ির কাছে। পুরোপুরি বুঝতে পারছে না, আসলে কী করবে। একে তো ও যেভাবে সব ভেবেছিল সেভাবে কিছুই হচ্ছে না। তার ওপরে আবার ওর এখানে থাকাটাও কতটা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে, ভেতরের দিকে যেতে গিয়ে উলটো আরো পরিস্থিতি খারাপ করবে ও। আবার মনে হচ্ছে, এখানে থেকে যদি কিছুই করতে না পারে কিংবা উলটো আবার স্পেশাল ফোর্স বা এমন কারো হাতে ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে আরো বড়ো বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বিধার চোটে জুলহাসের মনে হলো ওর বুক-গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সেটাকে গলা টিপে দিয়ে গাড়িতে উঠে, ওটাকে স্টার্ট দিয়ে ঘোরাতে শুরু করল। গাড়িটাকে উলটো টান দিয়ে হেডলাইড অফ করেই বেরিয়ে এলো ফুলার রোড ধরে। গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নীলক্ষেতের দিকে এগিয়ে বামে টার্ন নিয়ে ইডেনের সামনে দিয়ে এগোত লাগল ধীরে ধীরে।
মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করছে। লেখক আরিয়ান শফিক এবং তার সঙ্গে একজন মহিলা অফিসার আছে। আরিয়ান শফিক সিভিলিয়ান হলেও সে আর্মিতে ছিল এবং তার বেশ ভালোই ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতা আছে, আশুলিয়াতে সে যা ঘটিয়েছে, তাতে এর প্রমাণ বেশ ভালোই পাওয়া যায়। অন্যদিকে তার সঙ্গে একজন লেডি অফিসার আছে, যে-তাকে সাহায্য করছে। এখন প্রশ্ন হলো, তারা দুজনে এই স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডোদের থেকে বাঁচতে পারবে কি না, আর পারলেও, এখান থেকে বেরোতে পারবে কি না, সেই সঙ্গে সে আসলে তাদের নাগাল পাবে কি না। পরিস্থিতির অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ দিক এবং অনেকগুলো সম্ভাবনা, সেই সঙ্গে সুযোগের মাত্রা একেবারেই কম। দেখা যায়। ইডেন পার হয়ে আজিমপুর থেকে বামে মোড় নিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে আবারো উলটোদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করল। এদিকটাতে সেভাবে কর্ডন না দেখে খুশি হয়ে উঠল ও। কিন্তু ফুলার রোডের পেছনের দিকে কর্ডন দেখে সেখানে না থেমে এগিয়ে গিয়ে আবারো শহীদ মিনারের ওখান থেকে ঘুরে চলে এলো জগন্নাথ হলের বাউন্ডারির কাছাকাছি। একেবারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও ওর মনে আছে, এখানে জগন্নাথ হলের কোনো একদিক দিয়ে বাউন্ডারি পার হতে চাইলে সেই কোয়ার্টার এলাকার ভেতরের দিকে যেতে পারবে যেখানে সেই এলাকাটা স্পোশাল ফোর্স ঘিরে রেখেছে,সেই সঙ্গে, ওখানটাতেই লেখক আরিয়ান শফিক আছে বলে ও ধারণা করছে। গাড়িটাকে বাউন্ডারির কাছাকাছি পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে বেরিয়ে এলো ও। একটা গাড়ি চলে যেতেই লাফ দিয়ে ওর নিজের গাড়ির বনেটের ওপরে উঠে গাড়ির ছাদে চলে এলো, সেখান থেকে আরেক লাফ দিয়ে চড়ে বসল দেয়ালের ওপরে। অপরপাশে লাফিয়ে নামল অন্ধকারের ভেতরে। এদিক দিয়ে না গিয়ে মূল রাস্তা ধরে এগোলেই হতো, কিন্তু সময় কম ওর হাতে। হলের এদিকটা গাছপালা আর জঙ্গলে ভরা। মোবাইলে আলো জ্বেলে যতটা সম্ভব দ্রুত এগোতে শুরু করল সম্ভাব্য কোয়ার্টার এলাকার দিকে। আধ মাইলের মতো এগিয়ে একবার চারপাশে দেখে নিয়ে দিক পরিবর্তন করল ও। তারপর দেয়ালের কাছে পৌছে খানিক দ্বিধার সঙ্গে আশপাশে দেখতে দেখতে বহুকষ্টে চড়ে বসল দেয়ালের ওপরে। নিচে নামতে যাবে, তার আগেই গুলির শব্দে চমকে উঠে পড়ে গেল ওপাশে ঘাসের ওপরে। ক্ষণিকের জন্যে ভয়ের একটা স্রোত বয়ে গেলেও আবারো গুলির শব্দে চমকে উঠল। যদিও পড়ে গিয়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে, তাও একদিকে স্বস্তি বোধ করল ও। মনে হচ্ছে সঠিক জায়গাতেই এসেছে। আবার পর পর দুবার গুলির শব্দে রীতিমতো চমকে উঠল ও। হচ্ছেটা কি! উঠে দাঁড়িয়ে খানিক সরে এসে দেখল কোয়ার্টার এলাকা রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র। একদিকে স্পেশাল ফোর্সের লোকজন পুরো ঘিরে রেখেছে একটা পুরনো কোয়ার্টার বিল্ডিংকে, অন্যদিকে ওটার তৃতীয় বা চতুর্থ তলায়, ঠুসঠাস শব্দ হচ্ছে, জুলহাস অনুধাবন করল ওই বিল্ডিংয়েই সম্ভবত লেখক আরিয়ান শফিক রয়েছে। আর পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না, এই লোক এত সহজে হার মানবে। কিন্তু তারা স্রেফ দুজন এই একা জঙ্গলে আছে ও সাহায্য করতে চেয়েও সাহায্য করার মতো অবস্থায় যেতে পারছে না। হঠাৎই জুলহাসের খুব অসহায় লাগতে শুরু করল। সামনের এই গণ্ডগোল আর সবকিছু মিলিয়ে ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হতে লাগল মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। এতদিনের এত চেষ্টা, সময় ও অর্থ ক্ষয়, নিজের ক্যারিয়ার, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত এভাবে বাজি ধরে শেষ পর্যন্ত কি না ওকে এভাবে এইখানে এসে থেমে যেতে হবে।
অন্ধকারের ভেতরেই গাছের পেছনে চট করে বসে পড়ল ও, বড়ো বড়ো করে দম নিতে লাগল। কয়েকবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই ধীরে ধীরে মাথা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল ওর। এখানে সামনের দিকে যে পরিস্থিতি তাতে লেখক আর তার সঙ্গী যদি ভবনের ভেতরে বেঁচেও যায় সেক্ষেত্রেও ওরা কোনোভাবেই সামনের দিক দিয়ে বেরোতে পারবে না। যদি ওরা পালাতেও পারে তবে ওদের পেছন দিয়েই পালাতে হবে। আর ও যদি তাদের পালাতে সাহায্য করতে চায় তবে ওকেও পেছনের দিকে গিয়েই সেটা করতে হবে। কিন্তু এরা যেভাবে ঘিরে রেখেছে পুরো ভবন তাতে মনে হয় না এত সহজে ও পেছনের দিকে যেতে পারবে। তবে চেষ্টা তো করতেই হবে। করণীয় ঠিক হতেই চট করে উঠে দাঁড়াল জুলহাস। যেভাবেই হোক কাজে নামতেই হবে, কোনো অবস্থাতেই এখানে থামা চলবে না। উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার উঁচু করে দিয়ে মাথার ক্যাপটা আরো খানিক নামিয়ে নিল ও, যাতে চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা না যায়। সামনের দিকে এগোতেই দেখতে পেল ওদের ঘেরাও থাকলেও এদিকেও কিছু লোকজন আছে। যদিও জুলহাসের ধারণা, সবাইকে সরে যেতে বলা হয়েছে কিন্তু তারপরও কিছু গার্ড, কোয়ার্টারের অতি কৌতূহলী লোকজন কয়েকজন জমা হয়ে আছে। জুলহাস খুব সন্তর্পণে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ও আবারো চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখার, বোঝার চেষ্টা করছে। এমন সময়ই সুযোগটা দেখতে পেল কর্ডনের ভেতরের দিকেও কিছু সিভিল পোশাকের লোকজন আছে, যারা সিকিউরিটির পাশাপাশি থাকা অ্যাম্বুলেন্স, মেডিকেলসহ এই ধরনের কিছু দায়িত্ব পালন করছে, এদের ভেতরেই সম্ভবত হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে কয়েকজন আছে যারা সাধারণ পোশাকে আছে। এদের সঙ্গে যদি কোনোভাবে ভিড়ে যাওয়া যায়…জুলহাস কথাগুলো ভেবে শেষ করার আগেই ভয়ংকর শব্দে কেঁপে উঠল কোয়ার্টারের সেই ফ্লোর। সবাই চমকে উঠে সেদিকে ‘ফিরে তাকাতেই ও টেম্পরারি ব্যারিকেডের এক ফাঁক গলে ঢুকে গেল ভেতরে। লোকজন স্বাভাবিক হওয়ার আগেই শখানেক গজের দূরত্বটা পার হয়ে এসে একজন মেডিকেল কর্মীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। এবার ওপরের দিকে নজর দেয়ার সময় পেল। আর তাতে খানিকটা ভড়কেও গেল, ভেতরের পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। ভেতর থেকে কয়েকজন দৌড়ে বেরিয়ে এসে মেডিকেলকর্মীদের ভেতরের দিকে যেতে বলল। জুলহাসের জন্যে দারুণ সুযোগ, দুজন মেডিকোর সঙ্গে একটা ট্রলির মতো ঠেলতে ঠেলতে ভেতরের দিকে যেতে শুরু করল ও। কিন্তু হঠাৎই থেমে গেল একজন কমান্ডোর টকিতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে। লেখক আর মেয়েটা নাকি ছাদে অবস্থান করছে।
জুলহাসের জন্যে খুবই সূক্ষ্ম একটা পরিস্থিতি, সেকেন্ডেরও কম সময়ের ভেতরে ওকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ও চাইলে এখন মেডিকেল কর্মীদের সঙ্গে ভেতরে ঢুকতে পারে কারণ ওরা আর কয়েক ফিট দূরত্বে আছে, আর পরিস্থিতির উত্তেজনার কারণে কেউ ওকে সেভাবে খেয়ালও করেনি। কিন্তু ও যা শুনল, তাতে ওর ভেতরে ঢুকে আর লাভ নেই। কারণ ওরা সম্ভবত কোণঠাসা হয়ে ছাদে চলে গেছে এবং ওদের সম্ভবত ঘিরেও ফেলা হয়েছে। এখন ও যদি ভেতরে যায় তাতে খুব বেশি উপকার হবে বলে মনে হয় না বরং ও ভেতরে আটকা পড়তে পারে। অন্যদিকে ওদের জন্যে একমাত্র উপায় হলো কোনোভাবে, যেকোনোভাবে যদি ওরা নেমে আসতে পারে তবেই একমাত্র পালাতে পারবে। নামতে হেল্প করা ওর পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু ওরা যদি নেমে আসতে পারে, তবে ও পালাতে সাহায্য করতে পারবে। এগোতে এগোতে চট করে মেডিকেলকর্মীর ট্রলির একপাশটা ছেড়ে দিয়ে ভবনে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে চট করে সরে এসে ভবনের একপাশে অন্ধকারে সরে এলো ও। তারপর কেউ খেয়াল করে কি না দেখে নিয়ে ঢুকে গেল ভবনের পাশ দিয়ে। সব আলো নিভিয়ে দেয়ার কারণেই কি না কে জানে, সামনের দিকটা আলোকিত হলেও এদিকটা বেশ অন্ধকার, মোবাইলে আলো জ্বালার কথা ভেবে নিয়েও সেটা বাতিল করে দিল চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
কোনোমতে আধো অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে চলে এলো ভবনের পেছন দিকে। এদিকটা তাও খানিকটা আলোকিত, রাস্তার লাইটের কারণে। কিন্তু এদিকটাতে এসে ক্ষণিকের জন্যে ভড়কে গেল জুলহাস। কারণ ভবনের ওপরের ঠিক কোন দিকটাতে থাকতে পারে ওরা—সেটা ঠিক অনুধাবন বরতে পারছে না ও। তার ওপরে একদিকে ছাদের ওপর থেকে আবার অন্যদিকে সামনে থেকে ভেসে আসা হট্টগোল ওকে আরো বিচলিত করে তুলেছে। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক থেকে ছুটে বেরিয়ে দুই ভবনের কোনায় এসে স্থির হওয়ার চেষ্টা করছে জুলহাস। এমন সময় ওপর থেকে চিৎকার ভেসে আসতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল দুজন মানুষ নিচে নেমে আসার চেষ্টা করছে। জুলহাস দেখতে দেখতে অনুমান করল একজন পুরুষ এবং একজন মেয়ে। কোনো সন্দেহ নেই এরাই লেখক আরিয়ান আর তার সঙ্গী। মুহূর্তের ভেতরেই জুলহাস পরিস্থিতি জাজ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ওকে বেরোতে হবে। কারণ লেখক আরিয়ান আর মেয়েটাকে নিচে নেমে আসতে সে খুব বেশি সাহায্য করতে পারবে না। কিন্তু ওরা যদি নিচে নেমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে লেখক কী—করবে খানিক হলেও ধারণা করতে পারছে ও। ওরা দেয়ালের বাইরে দিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আর সেক্ষেত্রে ওদের সাহায্য করার একমাত্র উপায় হবে ও, যদি নিজের গাড়িটাকে নিয়ে আসতে পারে। জুলহাস প্রাণপণে দৌড় দিল যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। বাউন্ডারি ধরে ধরে এগিয়ে আবার কোনার দিকে এসে ঠিক যেখান থেকে ও দেয়াল টপকে ছিল, সেখানে এসে লাফিয়ে উঠে দেয়াল টপকে গাড়ির কাছাকাছি এসে যখন গাড়ি স্টার্ট দিল—ততক্ষণে ওর দম পুরোপুরি ফুরিয়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওটাকে একটানে তুলে ফেলল মূল রাস্তার ওপরে। প্রায় পূর্ণ বেড় তুলে খানিক এগোতেই দেখতে পেল সামনে রাস্তার ওপরে একটা হালকা ব্যারিকেডের সামনে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
সেকেন্ডের জন্যে দ্বিধান্বিত হলেও জুলহাস সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না। সময় নেই ওর হাতে, ঝুঁকি নিতেই হবে। পুলিশ দুজন লাইট নেড়ে থামতে ইশারা করছে, জুলহাস গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিল। গাড়িটাকে তীব্র বেগে এগিয়ে আসতে দেখে দুই পুলিশ শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে সরে গেল। জুলহাস গাড়ি এগোতে এগোতে দেখতে পেল দুই পুলিশের একজন টকিতে কথা বলছে। জুলহাস খানিক এগিয়েই গাড়িটাকে বামে ঘুরিয়েই চমকে উঠল, সামনে একটা পুলিশের জিপ, তার ঠিক অন্যপাশেই আরেকটা ব্যারিকেড। এটা আগেরটার মতো হালকা না। ডানে ঘুরিয়েই আবার বামে কাটল জুলহাস। ব্যারিকেড আর জিপ দুটোকেই এড়াতে পারলেও ঢুকে পড়ল গলির ভেতরে। দুই গজের মতো সরে আসতেই সামনে একটা অংশ দেখে বেরিয়ে এসে গাড়িটাকে ডানে মোড় নিয়ে চলে এলো, রাস্তা আর ছোট একটা মাঠের মতো জায়গার কিনারায়, ক্ষণিকের জন্যে ও আসলে চিনতে পারছে না কোন জায়গাতে এসেছে। আবার মাথার ভেতরে চিৎকার করে কেউ একজন বলছে—সময় নেই সময় নেই, আশপাশটা দেখে নিয়ে ফুলার রোডটা কোন দিকে হতে পারে মোটামুটি আন্দাজ করে খানিক এগিয়ে বামে কাটতেই চূড়ান্ত স্বস্তির সঙ্গে দেখতে পেল, দুজন মানুষ একে অপরকে ধরে কোনোমতে এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। গাড়িটাকে একটানে ওদের সামনে নিয়ে একপাশে ঘুরিয়ে থামিয়ে ফেলল ও।
চট করে একপাশের দরজা খুলে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ঢুকে পড়ুন, ঢুকে পড়ুন।’
আসলে জুলহাস না বললেও চলত, দুজনেই কোনোমতে নিজেদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে উঠে বসছে—এমন সময় পেছন থেকে গুলি হলো। ধুপধাপ শব্দে গুলি এসে লাগছে গাড়িতে। জুলহাস কোনোমতে মাথা চেপে বসে পড়ল সিটের ওপরে। পেছন থেকে কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, ব্যথা পেয়ে নাকি অন্য কারণে বুঝতে পারছে না জুলহাস, কোনোমতে মাথা নিচ করে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। পেছন থেকে পুরুষ গলার চিৎকারটা এবার পরিষ্কার শুনতে পেল ও।
‘গাড়ি ছাড়ো, না হলে সবারই মরতে হবে।’
জুলহাস মাথা নিচু করেই, স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে রিয়াল মুডে দিল। তারপর আরো জোরে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে পিছিয়ে এলো বেশ অনেকটা। একদিকে গুলি তার ওপরে আবার একদল মানুষ দৌড়ে আসছে—ভয়ে জুলহাসের গলা শুকিয়ে এলো, মনে হলো হাত স্থবির হয়ে গেছে। কিন্তু পেছন থেকে গলাটা শুনে সাহস পেল ও। পেছনের গলাটা চিৎকার করে বলে চলেছে, আরো খানিক পেছাও, আরো আরো। জুলহাস মাথা নিচু করেই পিছিয়ে চলল। আরো ত্রিশ গজের মতো পেছাতেই গুলি বন্ধ হয়ে গেল। জুলহাস মাথা তুলে পেছনে দেখে বুঝতে পারল, কেন তাকে পেছাতে বলা হচ্ছিল আর গুলিই বা বন্ধ হলো কেন। এই ভয়ংকর অবস্থাতেও পেছনের সিটের মানুষটার ঠান্ডা মাথা দেখে অবাক হলো ও। গাড়ি পেছাতেই একদিকে ওরা চলে এসেছে গলির বাইরে, আর তাতে একদিকে ওরা ওদের লাইন অব ফায়ার থেকে সরে এসেছে, সেই সঙ্গে আবার ওদের থেকে শখানেক গজ দূরে আরেকটা ব্যারিকেড থাকাতে ওরা সেটার বরাবর চলে আসাতে গুলি করলে নিজেদের লোকের গায়ে লাগার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যে কারণে ওদের সামনে যারা তাদের গুলি করার উপায় নেই।
জুলহাস দেখল এই সুযোগে একটানে গাড়িটাকে ড্রাইভিং মুডে দিয়ে সোজা করে ফেলল। ওদের সামনে থেকে কোনাকুনি এগিয়ে আসছে একদল আবার পেছনে আরেকদল। গাড়িটাকে সোজা করেই দুই দলে সামনে থেকে চট করে সরে এসে প্রাণপণে ডানে স্টিয়ারিং ঘোরাল সে।কিন্তু খানিক এগোতেই গলির শেষ দিকে আরেকটা ব্যারিকেড দেখতে পেল। এটা সেই ব্যারিকেড যেটাকে একবার ভেঙেছিল ও। গাড়ির গতি আপনাতেই কমে এসেছিল, পেছনের সিটের গলাটা আবারো চিৎকার করে উঠল, ‘চালিয়ে যাও, গতি কমিয়ো না।’ জুলহাস আবারো পূর্ণ বেগে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। এবার আর ওকে কিছু করতে হলো না, আগের সেই দুই পুলিশ আগে থেকেই সরে গেল।
‘…যাক আপনারা—’ জুলহাস খানিক স্বস্তির সঙ্গে গাড়িটাকে মূল রাস্তার একপাশে তুলে এনে কথা বলে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই, ওপর পাশ থেকে একটা জিপ এসে বাড়ি মারল ওদের গাড়িটার একপাশে। তীব্র ঝাঁকির চোটে গাড়ির একপাশ রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডে উঠে যচ্ছিল, তার আগেই কোনোমতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ওটাকে রাস্তায় রাখতে পারল জুলহাস। ওদের ঠিক পাশাপাশি ছুটে চলেছে একটা জিপ। ওটার ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা মানুষটা সোজা পিস্তল তুলল ওর দিকে। মুখ হা হয়ে গিয়ে চট করে ব্রেক চেপে ধরল জুলহাস। পাশের গাড়িটা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে অন্য গাড়িটা এসে লাগল ওদের পেছনে। ওদের গাড়িটা আইল্যান্ডের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে থেমে গেল, আর পেছনের গাড়িটা হঠাৎ বাড়ি খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে উঠে গেল আইল্যান্ডের ওপরে, একপাশে কাত হয়ে রইল। জুলহাসদের গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল।
‘গাড়ি স্টার্ট করো,’ শান্ত গলার স্বর শুনে জুলহাস চাবি ঘোরাতে লাগল। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না। ‘জলদি, জলদি, ওদের সামনে থেকে অন্য গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে সরাসরি এগিয়ে আসছে ওটার দিকে। ‘জলদি জলদি,’
সামনের গাড়িটা প্রায় চলে এসেছে, জুলহাসের গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেল। চট করে ব্যাক গিয়ারে দিয়ে গাড়ি পিছিয়ে নিল ও সামনের গাড়িটাও ব্যাক গিয়ারে পেছাছে, দুটো গাড়িই সমান তালে পিছিয়ে চলেছে। পেছন থেকে মেয়েটাও চিৎকার করতে শুরু করেছে, এখন জুলহাস দেখতে পেল ওর ঠিক কানের পাশ থেকে পিস্তল তুলেছে লেখক। লোকটা গুলি করার আগে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে ফেলল জুলহাস, আবারো সামনের গাড়ির পেছনের অংশ এসে বাড়ি মারল ওদের গাড়িতে। ‘এইবার,’ নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়েই আবারো পিস্তল ঘুরাল লেখক সোজা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিল সামনের গাড়িটার একটা টায়ার। জুলহাস গাড়িটার মুখ ঘুরিয়ে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। পেছনের গাড়িটা ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। আরো দশ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে পুরনো ঢাকার অন্ধকার এক গলিতে গাড়ি ঢুকিয়ে হেডলাইট অফ করে দিল জুলহাস। সামনে দিয়ে রাতের ফাঁকা রাস্তা আলোকিত করে ছুটে গেল পুলিশের দুটো গাড়ি।
‘থ্যাংকস,’ পেছন থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটা বলে উঠল তার স্বর শুনে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় জ্ঞান হারাবে।
জুলহাস পেছন ফিরে দেখল, পুরুষ মানুষটা বিধ্বস্ত হলেও সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘কে তুমি?’ সরাসরি তুমিই বলল, সে জুলহাসকে। তার পিস্তলের নলটা ওর দিকে তাক করা না থাকলেও হাতে ধরা এবং ওটা ওর মুখ থেকে খুব বেশি দূরেও না।
‘আমার নাম জুলহাস,’ বলে সে দুজনকেই দেখল, পিস্তলটাও। তারপর লেখক আরিয়ান শফিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘পিস্তল নামান লেখক সাহেব, আমাদের অনেক কথা বলার আছে।’