১০
স্থাপত্যটা একটা গ্রিক মন্দির, এটা আমি অবশ্য অনেক পরে জেনেছি। প্রাথমিকভাবে জিনিসটার ছবি সেই লিংকে দেখে স্রেফ পরিচিত এবং অদ্ভুত লাগাতে আমি লিংকে ক্লিক করেছিলাম এবং এরপর যা দেখলাম এবং খুঁজে পেলাম সেটার কোনো তুলনা তো নেইই। বরং খুব বিচিত্র আর যথেষ্ট শিক্ষণীয়ও বটে। আবারো আমি আমার নিজের বন্ধুর প্রশংসা না করে পারলাম না। আগেই বলেছি, সেই বিচিত্র স্থাপত্যটা একটা গ্রিক মন্দির, আর সেটা অবস্থিত টিএসসির ভেতরে। অদ্ভুত বিষয় হলো এই স্থাপত্যের ছবি বা এটা নিয়ে লেখা আর্টিকেল কেন বাংলাদেশে ম্যাকডোনাল্ড নিয়ে দেয়া সার্চে আসবে, ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি প্রথমে। স্রেফ জিনিসটা নিয়ে আগ্রহ থেকে আমি আর্টিকেলটা ওপেন করি। প্রথমবার পড়ে সেভাবে বুঝতে না পারলেও ধীরেধীরে পড়তে শুরু করার পর একটা সময় এক জায়গায় এসে আমার দৃষ্টি থেমে যায় এবং আমি অনুধাবন করতে পারি কেন পাজলের দ্বিতীয় ধাপে ম্যাকডোনাল্ডের লোগো ছিল। সেই সঙ্গে ওখানে থেকেই আমি আরো একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারি, সেটা হলো টোকন আসলে কেন আমাকে ‘ফলো দ্য সিকাডা প্যাটার্ন কথাটা লিখেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য আরো একটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পারি। তবে সেটা আরো পরে বলছি।’
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি’র ভেতরে গ্রিক মন্দিরের ইতিহাসটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আমি যে-আর্টিকেলটা পড়েছি সেটার বর্ণনা ছিল অনেকটা এরকম, এইটুকু বলে জুলহাস মাউসে ক্লিক করে গুগল ড্রাইভ থেকে নির্দিষ্ট ফোল্ডার বের করে সেখান থেকে ফাইলটা বের করে আর্টিকেলটার কিয়দাংশ পড়তে শুরু করল।
‘…ঢাকায় ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে সতেরো শতকের প্রথমভাগে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজদের সঙ্গে গ্রিকরাও ঢাকায় আসেন। ভারতে গ্রিকদের আগমন ঘটে ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে। উপমহাদেশে যে সব গ্রিক এসেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী। অধিকাংশ গ্রিকের ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ঢাকায় দুই শতাধিক গ্রিক বসবাস করতেন। তারা বিশেষত কাপড়, পাট, লবণ ও চুনের ব্যবসা করতেন। এখান থেকে পাট ও কাপড় ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রফতানি করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বংশ পরম্পরায় থেকে যান দীর্ঘ দিন। তাদের অনেকেই এদেশে মৃতুবরণ করেন এবং এখানেই সমাহিত করা হয়। বহু সময় ধরে গ্রিকরা এখানে বসবাস করলেও বর্তমানে দেশে তাদের কোনো স্থাপত্য নেই বললেই চলে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গ্রিক কবরস্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব গ্রিক স্মৃতিচিহ্ন ছিল, তা সব বিলীন হয়ে গেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক টিএসসিতে রয়েছে এদেশে গ্রিকদের সর্বশেষ সমাধিসৌধটি…’
‘….টিএসসির ভেতরে সবুজ মাঠের দক্ষিণ কোনায় অবস্থিত এ সমাধিটি। হলুদ রঙের এ সমাধিসৌধটি দেখতে চতুষ্কোণ আকৃতির কুটিরের মতো। ভেতরে প্রবেশের পথ রয়েছে পূর্বদিকে। চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো এটি। ভেতরে প্রবেশের দরজার ওপর গ্রিক ভাষায় লেখা রয়েছে যার বাংলা অনুবাদ—দাতারাই আশীর্বাদপ্রাপ্ত যারা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছে মৃত্যুর জন্য। ভেতরের দেওয়ালে রয়েছে কালো রঙের ৯টি পাথর বা শিলালিপি। এর পাঁচটি গ্রিক এবং চারটিতে ইংরেজি ভাষায় লেখা। অযত্ন-অবহেলায় অনেকটা বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে এ সৌধটি। দেওয়ালের কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে গ্রিক হাইকমিশনের অর্থায়নে সংস্কার করা হয়েছিল এটি। টিএসসি চত্বরে অবস্থিত এই গ্রিক স্মৃতিসৌধটি সেইন্ট টমাস গির্জার যাজক জে এম ম্যাকডোনাল্ডের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল…’
এইটুকু পড়ে জুলহাস বড়ো করে দম নিল। ‘এই শেষ বাক্যটাই পুরো পাজলের অনেকটা অংশ বদলে দিয়েছিল, পাজলটার সঙ্গে সিকাডার কানেকশন এবং পুরো পাজলটাকে আসলে আর কীভাবে দেখতে হবে, সেটার একটা ভিন্ন আঙ্গিক দিয়েছিল পুরো বিষয়টা। এই লিংক তো বটেই আরো যত সোর্স পেলাম টিএসসির এই স্থাপনার ওপরে সব পড়ে ফেললাম এবং একটা কানেকশন ফিল হলো যে, এবার আমাকে ময়দানে নামতে হবে। এই কানেকশনটা ফিল হওয়ার পেছনে সিকাডার একটা ভূমিকা রয়েছে। সিকাডার পাজলেও একটা সময় পরে যারা ধাঁধাটার সমাধান করার চেষ্টা করছিল তারা বাইরে মুভ করতে বাধ্য হয়েছিল। তারাও নানা জায়গায় ট্রাভেল করে ধাঁধাটার সমাধান করার চেষ্টা করেছিল। আমি তখন ধারণা করছিলাম যে, ‘ফলো দ্য সিকাডা প্যাটার্ন’ বলে টোকন আসলে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিল। এটা পরবর্তীতে সত্যি প্রমাণ হয়েছিল। সেই সঙ্গে আরো কিছু বিষয়। যাই হোক, এটা মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছিলাম যে, আমাকে টিএসসি যেতে হবে। পরের দিন অফিস থেকে ছুটি নিলাম। সরি,’ মৃদু হেসে উঠল জুলহাস। ‘পরের দিন সকালে উঠে অফিসে ই-মেইল করলাম প্লাস বসকে ফোন করে বললাম যে, শরীর খারাপ লাগছে, আজ যাব না। আমি সাধারণত প্রায় কখনোই অফিস কামাই করি না কিংবা বলতে গেলে প্রায় ছুটিও নেই না। কাজেই বসকে বলাতে শুধু ওইদিন না, বরং কয়েকদিন রেস্ট নিতে বলল। আমি বসের সঙ্গে কথা বলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম টিএসসি যাব একটু সকাল দিকে, এই দশটা-এগারোটার দিকে। কারণ এই সময়টাই জানি ভিড় পাতলা থাকে টিএসসির ভেতরে, কারণ নিয়মিত ছাত্ররা ক্লাসে থাকে আর বাউন্ডুলেরা থাকে ঘুমে। বেলা বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে ভিড় বাড়তে শুরু করে। আমি ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে খেয়ে নিয়ে রওনা দিলাম সিএনজিতে করে। টিএসসিতে এসে দেখলাম বাইরে প্রচুর লোক সমাগম হলেও ভেতরে লোকসংখ্যা খুবই কম বলতে গেলে। বুঝলাম এই সময়ে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। আরো একটা কাজ করার ছিল, তবে সেটা আরো পরে করতে হবে যদি সম্ভব হয়।’
‘টিএসসিতে ঢুকে টুকটুক করে খানিক এগিয়েই সবুজ ঘাসের মাঠে নেমে এলাম। সঙ্গেসঙ্গে খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। এর আগে অন্তত কয়েক হাজারবার এখানে আসা-বিকেল সন্ধ্যাতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে বসে আড্ডা দিলেও এর আগে কখনো এই বিচিত্র অনুভূতি এর আগে হয়নি। কারণ এই গ্রিক স্থাপনা নিয়ে পড়তে গিয়ে একটা আর্টিকেলে পড়েছি যে, এই জায়গাটা আসলে একটা সমাধিক্ষেত্র ছিল। মূলত গ্রিক বণিকদের। আর্টিকেলে যা পড়েছি, তার সারমর্ম অনেকটা এমন : সেই উপনিবেশিক আমলের স্বর্ণযুগে অন্য ইউরোপিয়ানদের মতোই গ্রিকরাও এখানে এসেছিল ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে। তাদেরই একটা অংশ বসতি স্থাপন করেছিল ঢাকাতে। মূলত এদেরই একটা অংশের সামধি ছিল এখানে।এটা কয়েকশ বছর আগের কথা। ১৯১৫ সালের দিকে কলকাতার কোনো একটা পত্রিকা, এই মুহূর্তে আমার নাম মনে পড়ছে না। তবে ওখানে এমন একটা রিপোর্ট এসেছিল যে, স্থানীয় এক গ্রিক সমাধির পাথর-টাথর লোকজন খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই রিপোর্ট দেখার পর স্থানীয় এক চার্চের পাদ্রী ফাদার ম্যাকডোনাল্ড পূর্ব বাংলার চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে অনুরোধ এর একটা ব্যবস্থা করার জন্যে। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে লর্ড কারমাইকেল এখানে একটি সমাধি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। এইটা প্রচলিত একটা ভার্সন। এই স্মৃতিস্তম্ভের ভেতরে নাকি দশটা ফলক বসানো আছে। এই দশটা ফলকের কারণ কেউই স্পেসিফাই করতে পারেনি। আরেকটা ভার্সন বলে, টিএসসির ভেতরের এই মাঠটা আসলে পুরোটাই সমাধি ছিল, বিভিন্ন সময়ে এটা পরিবর্তিত হয়ে এখন শুধু স্মৃতিস্তম্ভটাই রয়ে গেছে, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ইতিহাসের কোনটা সঠিক আর কোনটা মিথ, আর কোনটা কী আমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। টোকন এসব বিষয়ে বরাবরই আগ্রহী ছিল, আমি না। আমি শুধু আগ্রহী ওর পাজলটা নিয়ে। আরে সেটার সমাধান করা নিয়ে। এই গ্রিক স্থাপনা পর্যন্ত তো চলে এসেছি, এখন প্রশ্ন হলো, এখান থেকে আমি কী বের করতে পারি।’
‘মাঠ পার হয়ে স্মৃতিস্তম্ভটার কাছে চলে গেলাম। আড়চোখে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। মাঠে তেমন কেউ নেই, ওপাশের করিডরগুলোতে টুকটাক যারাই আছে তারা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আশপাশে কোনো গার্ডও চোখে পড়ল না। স্থাপনাটার কাছাকাছি এসে একবার সামনে আর পাশে চক্কর দিলাম। সুন্দর একটা স্থাপনা। যদিও খুব যে যত্নে আছে এমন নয় কিন্তু বেশ কেমন একটা আকর্ষণ আছে। আর ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায় যে, এটার সঙ্গে আমাদের দেশীয় নিয়মিত স্থাপনাগুলোর বেশ কিছু পার্থক্য আছে। আগেই বলেছি স্থাপত্য নিয়ে আমার কোনোই আগ্রহ নেই, কোনোকালেই ছিল না। আমি ওটার তিনপাশে চক্কর দিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিন্তু চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছু পেলামনা। টোকন এখানে কী ধরনের ব্লু রেখে যেতে পারে সেই ব্যাপারে যথারীতি কোনো ধারণাই নেই। তাই সম্ভাব্য যেকোনো-কিছুর জন্যে চোখ-কান খোলা রেখে চক্কর দিয়ে কিছুই পেলাম না। স্থাপনাটার পেছন দিকে ওটাতে প্রবেশ করার জন্যে একটা দরজা আছে, আর সেটাকে ঘিরে আছে ছোট লোহার একটা গ্রিল দেয়া বেড়ার মতো। নিচু গ্রিলের বেড়াটার ছোট যে গেটটা আছে সেটা আবারো লাগানো। ওটা খোলার ঝামেলায় না গিয়ে সোজা ওটা টপকে ওপারে চলে গেলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখছি, কিন্তু আবারো হতাশা। পেছনেও কিছু নেই। বুঝতে পারলাম এটার ভেতরে ঢুকতে হবে।’
‘যদিও কোনো ধারণা নেই কী ধরনের ব্লু হতে পারে। কিন্তু এটা জানি বা অনুভব করতে পারি, টোকনের যে বুদ্ধিমত্তা আর স্থাপত্যকলার প্রতি ভালোবাসা তাতে দুটো ব্যাপার পরিষ্কার। এক, আমাকে ব্লু দেয়ার জন্যে হলেও সে এই স্থাপত্যের কোনো ক্ষতি বা ড্যামেজ করবে না। দুই, সে এমন কিছুও করবে না, যা অস্থায়ী বা নষ্ট হয়ে যাবে। যেন কাগজের কোনো বার্তা বা এমন কিছু প্রশ্ন হলো তাহলে কীভাবে কী ব্লু দিবে সে, যা এই স্থাপত্যের ক্ষতিও করবে না, আবার স্থায়ীও হবে। গেট টপকে, চারপাশ রেকি করে বুঝলাম এটার ভেতরে দেখতে হবে। ছোট একটা দরজা, নিশ্চিত বন্ধ, প্রয়োজনে কোনো গার্ডকে টাকা দিয়ে হলেও ভেতরে দেখতে হবে আমাকে। দরজাটার দিকে এগিয়ে ওটা ধরে ধাক্কা দেয়ার আগে স্রেফ হাত লেগেই খুলে গেল। হায়রে দুনিয়া। বাইরের খোলা দরজায় তালা, আর এখানে ভেতরের মূল গেট খোলা। ভেতরে প্রবেশ করতে হলো না। কারণ ভেতরে উঁকি দিয়েই মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছে। বাইরে তো কিছু নেইই, ভেতরে আরো কিছু নেই। বারবার এদিক-সেদিকে দেখে, ভেতর বাইরে চষে ফেলে মেজাজ গরম করে বসে পড়লাম গ্রিল দেয়া পাকা মেঝের ওপরে। এখানে সিগারেট খাওয়া মনে হয় বারণ, তাও পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে টানতে লাগলাম। দেখে তো কাজ হলো না, তাই ভেবে বোঝার চেষ্টা করছি, ব্যাটা টোকন আসলে কী বোঝানোর চেষ্টা করে থাকতে পারে। এমন সময় বিষয়টা চোখে পড়ল।’
‘স্থাপনাটার ঠিক পেছন বরাবর টিএসসির দেয়ালে একটা প্রতীক চিহ্ন আঁকা। উত্তেজনার চোটে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম প্রতীক চিহ্নটা। এমনভাবে আঁকা যে, ওটার দিকে সরাসরি না তাকালে এখানে যে কিছু একটা আছে এটা বোঝাই সম্ভব নয়, আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম—এটাই টোকনের প্রতীক চিহ্ন। আমি নিশ্চিত। আনন্দের আতিশয্যে আর উত্তেজনার বশে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে। টোকন আসলে দারুণ একটা বুদ্ধি করেছে, মূল স্থাপত্যের কোনো ক্ষতি না করে দেয়ালে করেছে কাজটা। শার্প কোনো কিছু দিয়ে আঁচড় কেটে আঁকা হয়েছে যাতে রোদ-বৃষ্টিতে মুছে না যায়, আবার তার ওপরে খুব হালকা লুমিনাস পেইন্ট দিয়েছে যাতে দূর থেকে বা আবছা অন্ধকারেও দেখা যায়, তবে খুব ভালোভাবে না দেখলে আবার চোখেও পড়ে না। সবমিলিয়ে টোটাল সেফ। কিন্তু কাছে গিয়ে আমি রীতিমতো বেকুব বনে গেলাম। ফ্রি-ম্যাসনদের চিহ্ন এখানে কেন হবে?’
১১
জুলহাস বলে চলেছে। ‘একটা কাঁটা কম্পাস, সেটাকে সো করা হয়েছে একটা স্কয়ারের ওপরে। বহুল চর্চিত, বহুল জনপ্রিয়, বহুল প্রচলিত প্রতীক চিহ্ন। নিকোলাস কেজের ন্যাশনাল ট্রেজার থেকে শুরু করে ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য লস্ট সিম্বল’, হাজারো ইন্টারনেট মিম থেকে শুরু করে মডার্ন কালচারের ইলুমিনাতির সিরিয়াস এবং ফাজলামো ট্রল সবখানেই পাওয়া যায় ফ্রি-ম্যাসনদের এই প্রতীক চিহ্ন। এই চিহ্ন এতটাই পপুলার যে, আমার মতো হাদাগোদা কিসিমের মানুষও চেনে এটা। প্রশ্ন হলো ফ্রি-ম্যাসনদের এই প্রতীক এখানে কেন, আর টোকনের পাজলের সঙ্গেই বা এর সম্পর্ক কি। এটা বের করতে হলে যে, মস্তিষ্কের প্রায় সব কোষ ব্যবহার করতে হবে সেই ব্যাপারে তো কোনই সন্দেহ নেই, কাজেই দ্রুত প্রতীকটার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে, সাবধানে ওটা মুছে দিয়ে টিএসসির বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেয়ালের কাছে এসে চিনি ছাড়া দুধ চা অর্ডার করে ভাবতে লাগলাম পরবর্তী করণীয়।
এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ না থাকলেও যে যথেষ্ট মাথা খাটাতে হবে এবং সেই সঙ্গে ঘোল খেতে হবে, এটা আমি জানতাম যে, এবার একটা প্যাটার্ন আমি পেয়েছি। আর মনের ভেতরে এমন একটা ভাবনাও কাজ করছিল যে, এবার হয়তো আমি টোকনের প্যাটার্নটা যেটা সে সিকাডা থেকে অ্যাডাপ্ট করেছে সেটার সঙ্গে তার একটা মিল খুঁজে পেতে শুরু করেছি। আমি এই লাইনেই এগোব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে তার আগে চা-বিড়ি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করতে হবে।’
‘চা-বিড়ি খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শাহবাগের কাছেই একটা ক্যাফেতে, আগে যখন আমার অফিসের পোস্টিং এখান থেকে কাছেই ছিল, প্রায় এখানে এসে বসতাম, নীরবে নিভৃতে বসে কাজ করতাম। এখানকার হাতে বানানো একটা ফ্রুট-মিক্স আইসক্রিম আমার বেশ পছন্দের। প্রিয় আইসক্রিমটা অর্ডার করে, ল্যাপটপ খুলে ওয়াই-ফাই কানেক্ট করলাম। এবারের মিশন ফ্রি- ম্যাসনদের নিয়ে। বাংলা ইংরেজি, যা পেলাম খুলে পড়তে শুরু করলাম। এটাই হলো ইন্টারনেটের সৌন্দর্য, যাই খুঁজবে কিছু না কিছু পাওয়াই যাবে। আমার কাছে লাগে ইন্টারনেট হলো আলাদীনের চেরাগের সেই দৈত্য যার কাছে তুমি চাইলে কিছু না কিছু পাবেই। তো গুগল নামক দৈত্য সাহেব, এবারও আমাকে হতাশ করল না। তবে পড়তে শুরু করেই বুঝলাম বেশির ভাগ জিনিস হয় আমি জানি, আর না হয় এগুলো আদতে আমার তেমন কোনো কাজে দেবে না। ফ্রি-ম্যাসনদের বেসিক ইতিহাসের আউটলাইনটা অনেকটা এমন : ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ বলছে, ফ্রি-ম্যাসনরি হলো একটি সংঘ। মধ্যযুগে ক্যাথিড্রাল তৈরি এবং পাথরের কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের দিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। ১৭১৭ সালে যুক্তরাজ্যে এই সংঘ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। ১৭৭৫ সালে লন্ডনে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ব্রিটানিকার তথ্য অনুযায়ী, ফ্রিম্যাসনরির কর্মকাণ্ড প্রচলিত অনেক ধর্ম থেকে ভিন্ন—অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত। ব্রিটানিকা আরো জানাচ্ছে, ফ্রিম্যাসনরি কোনো খ্রিস্টীয় প্রতিষ্ঠান নয়। একটি ধর্মের বিভিন্ন উপাদান ফ্রিম্যাসনরিতে রয়েছে। ফ্রি- ম্যাসনরি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, দাতব্য কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। এটি প্রধানত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সংঘ। সংঘের সদস্যরা ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং তাঁরা মনে করেন আত্মা অমর। সংঘের সভ্যরা যেখানে মিলিত হন, তাকে ‘লজ’ বলা হয়।’
‘ওদের নিয়ে পড়তে পড়তে আমি যা বুঝলাম, তাতে এটা পরিষ্কার যে ফ্রি- ম্যাসনদের নিয়ে একদিকে যেমন অনেক অনেক ভুল আর গুজব প্রচলিত আছে। আবার এটাও ঠিক যে ওদের নিয়ে যা বলা হয় বা মিডিয়াতে বা পপুলার কালাচারে আসে, সেগুলোর চেয়ে তাদের শিকড় অনেক বেশি গভীরে। যেমন অনেকেই একবাক্যে ফ্রি-ম্যাসনদের ইহুদিদের একটা প্রতিষ্ঠান বলে দেয়, অনেকে আবার ক্যাথলিকদের শাখা বলে, এই দুটোই একেবারে ভুল তথ্য। ওদের কিছু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তবে সেটাকে একেবারে সরাসরি কোনো ধর্মের ট্যাগ দেয়া সম্ভব নয়। আবার, সলোমনের অনুসারীদের প্রতিষ্ঠানও বলা হয় ওদের। এটাও আবার পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। তবে ফ্রি-ম্যাসনদের নিয়ে সবচেয়ে ভুল তথ্য বা প্রচলিত গুজবটা সম্ভবত, ফ্রি-ম্যাসনদেরকে একটা গুপ্ত সংগঠন বা গোপন সংঘ বলা হয়। এটা পুরোপুরি ভুল আবার কেউ কেউ এটাকে সঠিকও দাবি করে। আবার এমন দাবিও রয়েছে ওদের নিয়ে যে ওরা আসলে পনেরোশ শতকের ইউরোপে প্রায় ধ্বংপ্রাপ্ত হওয়া টেম্পলারদেরই একটা ভিন্ন নামে ভিন্নভাবে চালু হওয়া একটা শাখা। যত যাই হোক, মোদ্দাকথা আধুনিক উত্তর আমেরিকার গোড়াপত্তন এবং বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী মহলে ওদের শিকড় অনেক গভীরে এবং অনেক বেশি প্রচলিত। প্রশ্ন হলো এগুলোর কিসের সঙ্গে টোকনের এই পাজলের সংযোগ রয়েছে।’
‘শুরু থেকে এখন অবধি খুব বেশি না, আড়ালেও তিনটা কিউব সলভ করার কারণে আমি টোকনের ধরনটা খানিকটা হলেও বুঝতে শুরু করেছি। সেই ভাবনা থেকেই খানিকটা হলেও আমি ধরার চেষ্টা করছি টোকন কীভাবে এবং কেন আসলে ফ্রি-ম্যাসনদের ব্যাপারে ক্লু দেয়ার চেষ্টা করছে, সবচেয়ে বড়ো কথা গ্রিকদের স্থাপত্যের সঙ্গে সে বাংলাদেশ মানে টিএসসির একটা সংযোগ রয়েছে। কিন্তু ফ্রি- ম্যাসনদের মতো দুনিয়ার অপর প্রান্তের এক সংগঠন বা সংঘের আসলে এখানে সংযোগ কি? কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হলো গ্রিকদের মতোই এখানেও ওরকম কোনো সংযোগ নেই তো। যদি এই ঢাকার বুকে মোগলদের গ্রিকদের, পারস্যদের স্থাপনা থাকতে পারে, তবে ফ্রি-ম্যাসনদের কেন নয়। যেই ভাবনা সেই কাজ, আবারো গুগল নামক দৈত্যের আশ্রয়। সোজা সার্চ দিলাম ঢাকায় ফ্রি- ম্যাসনদের স্থাপনা লিখে।’
‘মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হলো, মাত্র দুটো সার্চ রেজাল্ট, তাও এ-দুটোর সঙ্গে আমি যা লিখে সার্চ দিয়েছি সেটার কোনোই সংযোগ নেই। ব্যাপার কি, দেখি ম্যাসন বানান ভুল লিখেছি, আবার ঠিক করে সার্চ দিলাম। এবার একটাও নেই, আবারো আমি বানান ভুল করেছি। এবার ঠিক করে দুয়েকটা শব্দ এদিক-সেদিক করে সার্চ দিতেই ফল পাওয়া গেল। একেবারেই প্রথম সার্চেও দেখা যাচ্ছে ঢাকায় ফ্রি-ম্যাসনদের লজ নিয়ে লেখা একেবারে দেশের প্রথম সারির একটা পত্রিকার আর্টিকেল। খুশিতে আবারো লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। যাক কিছু একটা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে এবার। আর্টিকেলগুলো পড়তে পড়তে যা বুঝতে পারলাম, সেটা অনেকটা এরকম: ঢাকার পুরনো পল্টন এলাকায় মুক্তাঙ্গনের ঠিক পাশেই একটা পুরনো ভবন আছে যেটা সম্ভবত ফ্রি-ম্যাসনদের একটা লজ ছিল। সম্ভবত নয়, আসলে ওটা ফ্রি-ম্যানদেরই লজ ছিল তাতে অনেকেরই কোনো সন্দেহ নেই। যদিও বর্তমানে সরকারি ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত এই অফিসটা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্প এবং মিথ প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলে এটা ইহুদিদের প্রার্থনালয় ছিল, কেউ বলে এটা ক্যাথলিকদের কেন্দ্র ছিল। আবার এমনও প্রচলিত ছিল যে, এটা আসলে ব্রিটিশদের কোনো গোপন আচার অনুষ্ঠান পালনের কেন্দ্র ছিল। তবে যাই হোক না কেন দুটো বিষয় প্রমাণিত, অন্তত সব লেখা পড়ে আমার এমনটাই মনে হলো। দুটো বিষয় হলো : এটা অবশ্যই ফ্রি-ম্যাসনদের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু একটা ছিল। কারণ ফ্রি-ম্যাসনদের লোগো সংবলিত একটা অংশ এখনো রয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো এই জায়গায় আগে যাই থেকে থাকুক না কেন, এখন এটাতে আর আগের কিছুর ছিটেফোঁটাও নেই। এটা এখন একটা সরকারি অফিস ছাড়া আর কিছুই নয়। সময় দেখে নিয়ে আরেক রাউন্ড আইসক্রিমের অর্ডার দিলাম শাহবাগ থেকে পল্টন আসলে খুব দূরে না, কাজেই এখনই যাব সিদ্ধান্ত নিলাম কারণ এটা পরিষ্কার যে, টোকন যাই করে থাকুক না কেন, সেটা যে আর এভাবে ঘরে বসে পাওয়া যাবে না, সেই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই জায়গামতো যেতে হবে। দ্বিতীয় দফা আইসক্রিম শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম রাস্তায় বিকেলের রাশ শুরু হয়ে গেছে। যদিও শাহবাগ থেকে পল্টনের দূরত্ব হিসেবে কয়েক মিনিটের বেশি না। কিন্তু আজিজ মার্কেটের সামনে থেকে সিএনজি নিয়ে এই কয়েক মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো, তখন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। পল্টন এলাকায় এলাম বহুদিন পর। একেবারে জমজমাট ভিড় চারপাশে। কিন্তু এই ভিড়ের ভেতরেও মূল এলাকাটা পার হয়ে মুক্তাঙ্গনের পাশ দিয়ে যে-ভবনটা খুঁজে বের করতে চাচ্ছি, সেটা খুঁজে বের করা খুব বেশি কঠিন হলো না গুগল ম্যাপের কারণে। আবারো প্রযুক্তির জাদুকরী ছোঁয়া। কিন্তু অনলাইনে ছবি দেখে যেভাবে ভেবেছিলাম চট করে ফ্রি-ম্যাসনের লোগোওয়ালা ফলকটা খুঁজে বের করে ফেলতে পারব, সেটা অতটা সহজ হলো না। কারণ ছবিতে যে-রকম দেখেছিলাম সেরকম জৌলুসে ভরা তো নয়ই বরং অন্ধকারের ভেতরে ভবনের সামনের এক কোণে প্রায় মুছে যেতে থাকা ইতিহাসের এই জ্বলন্ত সাক্ষীকে ঠিক যতটা দাপুটে ভেবেছিলাম, ঠিক ততটাই ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। তবে আছে, এটাই বড়ো কথা।’
‘ফলকটা খুঁজে বের করে ভালোভাবে পরখ করতে করতে ছবিতে যা দেখেছি সেটার সত্যতা পাওয়া গেল পুরোপুরি। পাথরের একটা ফলক, সেটার মাঝে ফ্রি- ম্যাসনদের সেই লোগো। ওপার ওপরে ওভালো শেপে লেখা ফ্রি-ম্যাসন হলো, নিচে সময় লেখা ১৯১০। ফলকটার বেশ কিছু ছবি তুলে আশপাশটা ভালোভাবে দেখলাম। এত ব্যস্ত পল্টন এলাকার প্রায় কেন্দ্রে বলতে গেলে এরকম একটা ভবনের আশপাশে ভিড় নেই প্রায়। ঢাকায় এই ব্যাপারটা আগেও খেয়াল করেছে জুলহাস। মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, এক জায়গাতে তীব্র ভিড় তার ঠিক পাশেই খানিকটা ভেতরেই একেবারে ফাঁকা একটা জায়গা কিন্তু কাকপক্ষীও নেই। বিশেষ করে পুরনো ঢাকার অনেক জায়গাতে এই ব্যাপারটা বেশ অনেকবার খেয়াল করেছে জুলহাস। আমি ফলকটাসহ এর আশপাশের বেশ কিছু জায়গার ছবি তুলে নিলাম। মোবাইল পকেটে রেখে এবার শুরু করলাম নিরীক্ষা। আমার ধারণা ছিল, আগেরবারের মতোই আশপাশে কিছু একটা পাব যেটা টোকন রেখে গেছে কিংবা এঁকে গেছে, বা এরকমই অন্য কিছু। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রায় এক ঘণ্টার ওপরে ঘেটেও কিছুই বের করতে পারলাম না। মেজাজ খারাপ করে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ভেবেছিলাম চা খেতে খেতে চায়ের দোকানদারের থেকে কিছু তথ্য নেব কিন্তু দোকানের সাহেব কর্পোরেট অফিসারদের থেকে বেশি ব্যস্ত। কথা বলার উপায় নেই। অগত্যা চারপাশে নজর বোলাতে বোলাতে চা খেতে লাগলাম, এমন সময় দেখতে পেলাম যে-ভবনটাতে এই লোগোটা বসানো সেটার আরেকটা অংশ রয়েছে যেটা সামনের দিক থেকে দেখা যায় না। সামনের দিকটা ফাঁকা থাকলেও ওদিকটা খানিক জমজমাট মনে হলো। চায়ের দাম দেয়ার সময়ে দোকানদারের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওদিকটাতে বেশ কিছু দোকান রয়েছে, ছোট একটা মার্কেটের মতো। যেখানে দেখিবে ছাই, মনোভাব নিয়ে ভিড় ঠেলে সেদিকে রওনা দিলাম।’
‘এবার প্রবেশ করলাম ভবনটার পেছন দিক দিয়ে। এদিকটা সামনের তুলনায় খানিকটা জমজমাট। ভবনের অংশের সঙ্গে কানেকটেড হলেও এদিকে গড়ে উঠেছে ছোট একটা মার্কেটের মতো। বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট তো আছেই সেই সঙ্গে এখানে সেখানে টুকরি আর ছোট ছোট ট্রলির ওপরে অস্থায়ী দোকানও রয়েছে বেশ কিছু। আধা ঘণ্টা ধরে দোকানপাটে ঘুরে বেড়ানোই সার হলো, কিছু না পেয়ে প্রায় হতাশ হয়ে শেষবারের মতো একবার ভেতরে চক্কর দেব সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে এলাম দোকানগুলোর একেবারে শেষ দিকে। একটা ফটোকপি, ফ্লেক্সি আর বিকাশের দোকান, পরে আরেকটা কাচে ঘেরা পুরনো ধাঁচের দোকান, ওদিকে যাব কি না ভেবে পা বাড়িয়েই চট করে থেমে গেলাম, কাচে ঘেরা দোকানটার কাচের ওপরে দৃষ্টি থেমে গেল। দোকানটা কিসের জানা নেই, তবে ওটার কাচের অন্যপাশে নানা ধরনের গানের অ্যালবাম আর পোস্টার লাগানো। সেগুলোর ভেতরে ছোট্ট একটা পোস্টারের মতো চোখে পড়ল, ওটাতে একেবারে পরিষ্কার ফুটে আছে ফ্রি-ম্যাসনদের লোগো। আপনাতেই বুক চিরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। সম্ভবত টোকনের সেট করা কুর কাছাকাছি চলে এসেছি আমি।’
১২
‘প্রথম দৃষ্টিতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলেও ভালোভাবে পরখ করে বুঝলাম এটা সেই লোগোই, যা আমি একটু আগে একটা ফলকে দেখেছি, একই জিনিস। তবে এটা একটা সাধারণ অ্যানিমেশ পেজে অ্যানিমেট করে বানানো। কালচে ধূসর ব্যাক গ্রাউন্ডে সাদাটে লোগোটা ফুটে আছে পরিষ্কার। বেশি ভণিতা না করে আমি দোকানটার পুরনো ধাঁচের কাচের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকলাম এবং সঙ্গেসঙ্গে মনে হলো যেন নব্বইয়ের দশকে চলে এসেছি। বাইরে থেকে ছোট মনে হলেও ভেতরে বেশ বড়ো একটা দোকান। চারপাশে সারি সারি র্যাক, দেয়ালের একটা ইঞ্চিও ফাঁকা নেই, হয় সিনেমার পোস্টার আর না হয় রক মিউজিকের গোল্ডেন যুগের পোস্টারে ভরা। জুলহাস দেখতে পেল, রোলিং স্টোন থেকে শুরু করে ইউ২, ডোরস থেকে শুরু করে পিংক ফ্লয়েড কিছুই বাদ নেই। আর র্যাকগুলোতে রাখা সারি সারি অডিও-ভিডিও ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি। হালকা চোখ বোলাতে গিয়ে আমি দেখলাম জর্জ ম্যালিয়াসের ল্যান্ডিং অন দ্য মুন থেকে শুরু করে সত্যজিত রায়ের আগন্তুকের অরিজিনাল ডিভিডি, সবই আছে। আমি বেশ তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলাম, এমন সময় এই বিরাট কালেকশনের ওপাশের ছোট একটা কাউন্টারে বসে থাকা মানুষটাকে চোখে পড়ল আমার। আমি নিশ্চিত, আমি দোকানে ঢোকার আগে মানুষটা পুরনো দিনের পুথুর মতো দেখতে একটা তুলি দিয়ে একটা ডিভিডি ক্লিন করছিল, আমাকে দেখে সে, তার হাত এবং তার দৃষ্টি সবই স্থির হয়ে গেছে।
—মানুষটাও মোটামুটি দেখার মতো, ষাটের দশকে হবে তার বয়স। চোখে কচ্ছপের শেলের আকৃতির তারের চশমা, তার ওপাশ থেকে ছোট বাচ্চাদের মতো জ্বলজ্বলে বয়সের সঙ্গে একেবারেই বেমানান এক জোড়া চোখ বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।’
‘আপনি—’
‘ইয়ে আমি মানে,’ কীভাবে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’
‘আপনি কি কিছু কিনতে এসেছেন,’ মানুষটা বেশ কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ‘এখানে তো খুব বেশি মানুষ কিছু কিনতে আসে না, বিশেষ করে অপরিচিতরা।’
‘মানুষটার কথায় আমি বুঝতে পারলাম, উনার কালেকশন যেমন ক্লাসিক ঠিক সেভাবেই উনার স্থায়ী এবং অনেকটা এ-ধরনের ক্লাসিক জিনিস কালেক্ট করে এই ধরনের স্টেডি একটা কাস্টমার গ্রুপ আছে। সেটা কম হলেও সম্ভবত তাদের নিয়েই উনার ব্যবস্থা চলে।’
‘আপনার কালেকশন তো অসাধারণ—’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সরাসরি উনাকে টোকনের কথা জিজ্ঞেস না করে একটু এটা-সেটা বলে তারপর শুরু করবআলোচনা। আমার কথা শুনে মানুষটা মৃদু হেসে উঠল। হাতের জিনিসগুলো টেবিলের ওপরে রেখে চোখের তারের চশমাটা খুলে আমাকে সামনের চেয়ারে বসার জন্যে ইশারা করল।’
‘এই ডাউনলোডের যুগে এসব জিনিসের বা কালেকশনের আর কি দাম আছে। আসলে সেই যুবক বয়স থেকে মিউজিকের কাজ করতাম, এলিফ্যান্ট রোডে বিরাট স্টুডিও ছিল আমার। এখন সেসব অতীত, আসলে অনেকটা শখেই দোকানটা ধরে রেখেছি। তবে এখনো কিছু পুরনো মানুষজন আছে, যারা জিনিস নেয়। নিয়মিত দোকানে আসে, আড্ডা হয়। না হলে কবে এসব ছেড়ে চলে যেতাম বিদেশে ছেলেমেয়েদের কাছে। তা আপনি ঠিক করে বলেন তো আপনি এখানে কীভাবে, বা কি কারণে?’ মানুষটার চোখের দৃষ্টিতে কৌতূহল। ‘আমার এখানে পরিচিতের বাইরে খুব বেশি মানুষ আসে না সে-কারণেই মূলত এই জিজ্ঞাসা,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। ‘হয় পরিচিত, আর না, হয় পথ ভুলে,’ এইটুকু বলে সে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল। ‘তা আপনি কোনটা?
‘আমিও উনার কথা শুনে মৃদু হেসে উঠলাম। ‘আসলে আমি কোনোটাই না,’ আবারো অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছি। ‘আমি আসলে আপনার দোকানের বাইরের একটা পোস্টার, ইয়ে মানে বাইরে কাচে একটা পোস্টার দেখলাম, মানে একটা ছবি ওটাতে একটা কম্পাস আর স্কয়ার, মানে ফ্রি-ম্যাসনদের লোগো,’ আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাই তার চেহারার এই রং পরিবর্তনটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। প্রথমে সে খানিক বিস্মিত হয়ে উঠল, এরপর অবাক এবং সবশেষে যেন খানিকটা অবিশ্বাস মিশে রইল তার চেহারাতে, ‘তোমার নাম জুলহাস? তুমি টোকনের ফ্রেন্ড?’ প্রশ্ন দুটো যেন আপনাতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আমিও অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিলাম তার চেহারার দিকে, বিশেষ করে আমার নাম শুনে। ‘আপনি টোকনকে চিনতেন?’
‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মানুষটা আমাকে বসতে ইশারা করে সে উঠে দরজার কাছে চলে গেল। সেখানে গিয়ে ক্লোজড লেখা আইন ঝুলিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে লক করে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে এসে বসল আমার একেবারে মুখোমুখি। ‘আমি টোকনের সঙ্গে যে খুব ক্লোজ ছিলাম তা নয়, ও আমার এক বন্ধু ওর সিনিয়র ফ্রেন্ডের সঙ্গে আসত মাঝেমধ্যে, আড্ডা হতো। এতিম ছেলে অনেক কষ্ট করে বড়ো হয়েছে, পরে ওর প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা কাজ করত। এছাড়া আরো একটা কারণ ছিল, সেটা হলো মিউজিক, সিনেমা আর বই এসবের প্রতি ওর একটা আলাদা ভালোবাসা ছিল।’
‘ও কি কোনো কিছু—’
‘আমার প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়ে চেয়ারে হেলান দিল। ‘আগেই বলেছি, টোকনের সঙ্গে আমি খুব ক্লোজ ছিলাম এমন নয়, কিন্তু নিয়মিত আড্ডা হতো। অনেকদিন ওর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই, এরপর হঠাৎ একদিন প্রায় এরকমই সময় এসে হাজির হলো। আমার মনে আছে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল,’ বলে মানুষটা সামান্য মাথা নাড়ল। ‘আমার কাছে টোকনকে দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব তাড়ার ভেতরে ছিল, যখন। বিশেষ করে আমার কাছে মনে হচ্ছিল কেমন যেন তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো করছিল ও। আমি ওকে চা খেতে বললাম, কী হয়েছে রাতে, খেয়েছে কি না জানতে চাইলাম কোনোটারই জবাব দিল না, অনেক ধরার পর চা খেতে রাজি হলো, আমি নিজেই গিয়ে চা নিয়ে এলাম। চা খেতে খেতে আমাকে বলল ও খুব ঝামেলার ভেতরে আছে। অনেক জোরাজুরি করার পর শুধু এটুকু বলল, আমাকে ও কিছুই জানাবে না, তাতে নাকি আমাকেও বিপদে ফেলা হবে।’
‘আর ওই পোস্টারের বিষয়টা—’
‘শুধু পোস্টার না, আরো একটা জিনিস দিয়েছিল ও আমাকে,’ বলেই সে উঠে দাঁড়াল। উঠে গিয়ে কাউন্টারের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে একটা র্যাকের নিচে থাকা ছোট একটা ভল্ট খুলে একটা খাম বের করে আনল। ‘এটা,’ জিনিসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার চেয়ারে বসে পড়ল। ‘চা খাবে?’ আমি মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে মানা করলাম। ‘ও কি বলেছে এগুলো দিয়ে?’ খামের ভেতরে শক্ত কিছু একটা। আমি খাম না খুলে নাড়াচাড়া করতে করতে প্রশ্ন করলাম। উনার সামনে খোলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। ‘টোকন আমাকে ওই পোস্টারটা দিয়ে বলেছিল, ওটা দরজার কাচের বাইরে লাগিয়ে রাখতে। ও তোমার বর্ণনা এবং নাম বলেছিল আমাকে, সঙ্গে এটাও বলেছিল দুনিয়াতে একমাত্র তুমিই নাকি ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ। তুমি যতই রাগ করে থাকো বা ওকে দূরে সরিয়ে দাও, যদি একদিন ওর কিছু হয় তবে তুমি কোনো না কোনোভাবে এখানে একদিন আসবেই, আর যেদিন আসবে, সেদিন তোমার হাতে এটা তুলে দেবার কথা বলেছিল,’ মানুষটার কথাগুলো শুনতে শুনতে খুব নস্টালজিক হয়ে গেছিলাম। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়তেই নিজেকে কোনোমতে সামলে নিলাম। চোখ তুলে মানুষটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু উনিই আবারো কথা বলে উঠলেন। ‘ও আরো বলেছিল খামটা আমার সামনে খুলতে,’ এই কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠলেও আমি দ্বিধা না করেই খামের সিলটা খুলে ওটাকে উলটো করে ঝাঁকি দিতেই ওটার ভেতর থেকে ছোট আকৃতির একটা ক্যাসেট টুপ করে পড়ে গেল আমার হাতের ওপরে।’
‘একটা ক্যাসেট,’ আমি অবাক হয়েছিলাম। ‘এত কাহিনি করে টোকন আমাকে একটা ক্যাসেট দিতে চেয়েছে। আজিব।’
১৩
‘আহা! একটু ভুল বললে, ক্যাসেট না, একটা মাইক্রো ক্যাসেট,’ বেশ অবাক হয়ে বলে উঠল মানুষটা। ‘এবার বুঝতে পারলাম, কেন সে এটা খুলতে বলেছিল সে আমার সামনে। কারণ এই জিনিস চালানোর মতো প্লেয়ার তুমি সবখানে পাবে না। দাঁড়াও,’ বলে মানুষটা উঠে গেল। আমি একবার বাইরের দিকে দেখলাম, তারপর উলটেপালটে। পুরো ব্যাপারটাতে এতটা ঢাক গুঁড় গুঁড় করার মূল কারণটা আমি এখনো জানি না, তবে এটা অনুধাবন করতে পারছি যে, এইটার অবশ্যই অবশ্যই কোনো না কোনো গুরুত্ব আছে। তা না হলে টোকনের মতো ছেলে বিষয়টাকে এতটা গুরুত্বও দিত না আবার এতটা জটিলও করত না। কারণ, সে বিষয়টাকে এমনভাবেই সাজিয়েছে যাতে একমাত্র আমি বা এমন কেউই এটাকে সাইফার বলতে পারে এবং সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ যারাই হোক না কেন তাদের হাতে পড়লেও যাতে কিছু না হয় বা কেউ কিছু বুঝতেও পারে। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, শুরু থেকে টোকনের পাজলটা যেভাবে বদলেছে এটা সামনে আরো বদলাবে। আর যদি সিকাডার প্যাটার্নই হয় তবে, এতে শুধু আরো মানুষই ইনভলভড হবে না বরং এর বিস্তৃতিও আরো বাড়বে।
‘এই নাও,’ বলে মানুষটা অনেকটা পুরনো দিনের মোবাইলের মতো দেখতে বস্তু আমার হাতে ধরিয়ে দিল। জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখতেই জানতে পারলাম, এটাকে বলে মাইক্রো রেকর্ডার, সনি কোম্পানির। আজকের স্মার্ট ফোনের আগের যুগে লোকজন কথা, গান রেকর্ড করতে, ইন্টারভিউ নিতে, এমনকি গান শুনতেও এটা ব্যবহার করত। এখন সেই যুগ গত হয়েছে, এখন এটা শুধুই একটা অ্যান্টিক পিস ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘এটা কি কাজ করে?
‘শেষবার এটা ব্যবহার হয়েছিল একটা ডিরেক্টর ছেলে এটা নিয়ে গেছিল তার কোনো এক নাটকের শুটিং করার জন্যে। ওই সময়ের পর আর ব্যবহার হয়নি। তবে নষ্ট হওয়ার কথা না, ব্যাটারি বদলে নিও। আর তুমি চইলে এটা নিয়ে যেতে পারো। কাজ হলে পরে একসময় দিয়ে যেও।’
‘আমি মানুষটার কথায় খুশি হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে এলাম, তার আগে বাইরে কাচ থেকে পোস্টারটা সরিয়ে ফেলতে বললাম। আমি বাইরে এসে পল্টন থেকেই ব্যাটারি কিনে সিএনজি একটা নিয়ে সোজা চলে এলাম বাসায়। রাত তখন প্রায় দশটা। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ব্যাটারি বদলে ক্যাসেট ভরলাম মাইক্রো রেকর্ডারে। শুরুটা হলো রূপঙ্কর ব্যানার্জির রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে। সঙ্গেসঙ্গে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোনে, সেই সঙ্গে চোখের কোনে মৃদু অশ্রু। আগেই বলেছি, আমি হলাম টিপিক্যাল জেনারেশনের মানুষ, আর্ট, কালচার, ক্লাসিক মিউজিক নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। টোকন মাঝেমধ্যেই সকালে উঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী রূপঙ্করের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত ওর বিশেষ প্রিয় ছিল, আর আমি মজা করতাম ওকে নিয়ে। এর প্রতিশোধ সে ভালোই নিয়ে গেছে। শুনতে বাধ্য করছে আমাকে নিজের প্রিয় মিউজিকগুলো।’
‘আমি মনোযোগ দিয়ে গান শুনছি। সাধারণ গানই, এর ভেতরে খুব আলাদা বা বিশেষ কোনো ভেরিয়েশন নেই। সাধারণ অডিও সাইট থেকে ডাউনলোড করা মিউজিক, একটাই বিরক্তিকর বিষয়, গানের ভেতরে ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ যে-সাইট থেকে ডাউনলোড করা হয়েছে সেটা বেজে উঠছে। এই ব্যাপারটা আজকাল বেশি একটা দেখা যায় না। কারণ এখন সবার মোবাইল, ল্যাপটপ আর কম্পিউটারেই নেট কানেকশন থাকে, ফলে মিউজিক সেভাবে ডাউনলোড করে শুনতে হয় না। যখন হতো তখন, মাঝেমধ্যেই এরকম সাইটের নাম বলে উঠত। অনেকটা যেই স্যারের নোট, নোটের মাঝখানে বড়ো করে জলছাপের মতো স্যারের নাম লিখে রাখার মতো। যাই হোক, গান শুনছি, এমনিতেই এসব গানে আমার আগ্রহ নেই, তার ওপরে গানের ভেতরে এক মহিলা উৎকটভাবে সাইটের নাম বলে উঠছে রূপঙ্কর থামার পর শুরু হলো আনুস্কা শঙ্কর, এরপর তার বাপ রবিশঙ্কর, মেজাজের চব্বিশটা বেজে যাচ্ছে, এর ভেতরে বারবার কথা বলার অত্যাচার তো আছেই। বিশ মিনিট পর মনে হলো পাগল হয়ে যাব। তবে রবি শঙ্করের মন্টেরি পপ ফেস্টিভাল থামার পর যখন ক্ল্যাপটনের টিয়ারস ইন হ্যাভেন শুরু হলো, এবার খানিক স্বস্তি পেলাম একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে খানিকটা উপভোগ করার চেষ্টা করছি, হঠাৎ মহিলা গলার বদলে একটা পুরুষ গলা কথা বলে উঠল। এতটাই চমকে উঠলাম, হাত থেকে সিগারেটের জ্বলন্ত মোথাটা খসে পড়ল। আরেকটু হলে চেয়ারটাই উলটে ফেলতাম। জলদি রিওয়াইন্ড করে আবারো শুনলাম। কোনো সন্দেহ নেই, এটা টোকনেরই গলা। আবার শুনলাম, আবার আবার। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, টোকন যেন মৃত্যুর ওপার থেকে আমার সঙ্গেকথা বলছে। নিজেকে সামলে নিয়ে খাতা কলম টেনে নিলাম। এবার গলা নয় বরং সে কী বলছে সেটার দিকে বেশি মনোযোগ দিলাম। একটা নম্বর, শুধু ডিজিট নয় কিছু লেটারও রয়েছে, নম্বরটা লিখে নিয়ে। বারবার শুনে মিলিয়ে নিয়ে নিশ্চিত হলাম, এটা বলেছে ও। নম্বরটা লিখে ল্যাপটপ ওপেন করে এবার পরের কিউবটা ওপেন করলাম এবং প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই নিশ্চিত হলাম যে, এই নম্বরটাই এবারের পাসওয়ার্ড হিসেবে কাজ করবে, কারণ এবারের ঘরটা ছয় ডিজিটের চেয়ে বেশি নম্বরটা লিভে এন্ট্রি দিতেই ওটা খুলে গেল। কিন্তু খুলে ভেতরে যা দেখলাম সেটা আরো অবাক করার মতো।’
জুলহাস খানিক দম নিয়ে নিজের মাথার ভেতরে আবারো সব ঝালাই করে নিল। ‘চতুর্থ কিউবটার ভেতরেও সেই একই অক্ষরগুলো লেখা, যেটাকে আমি পাসওয়ার্ড হিসেবে লিখেছি, যেই নম্বরটা টোকন ক্যাসেটে ভয়েস আকারে রেকর্ড করে রেখেছিল। বিচিত্রভাবে সাজানো ডিজিট আর লেটারের কম্বিনেশন এই নম্বরগুলোর নিশ্চয়ই কোনো না কোনো অর্থ আছে, যেটা টোকন আমাকে বলতে চাচ্ছে। নম্বরগুলো লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। ফলাফল নবডঙ্কা। নানাভাবে ট্রাই করলাম। যত ধরনের ডিজিটের বিষয় আমি জানি নেড়েচেড়ে দেখলাম, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। একে তো টানা সারাদিন দৌড়ে বেড়িয়েছি, তার ওপরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা কাজ করে অবস্থা কাহিল। রাত ততক্ষণে মাঝ রাত ছাড়িয়ে গেছে। ভাবলাম ঘুমিয়ে যাব, বাকিটা কাল দেখা যাবে। এবারের পাজলের কিউবটা বন্ধ করতেইপুরো পাজলটা টুকরো টুকরো হয়ে ঘুরে গিয়ে ওটার দ্বিতীয় অংশ সামনে চলে এলো। বুঝতে পারলাম, ফোর ডাইমেনশনাল পাজলের প্রথম অংশ সবে সমাধান করেছি এবার দ্বিতীয় অংশ শুরু হবে। কিন্তু তার জন্যে আগে আমাকে এই নম্বরগুলোর অর্থ বের করতে হবে।’
‘রাতে একদমই ভালো ঘুম হলো না। অতিরিক্ত টায়ার্ড হলে যেমন হয় আরকি। সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল রাতের বেলা টোকনকে স্বপ্ন দেখলাম। ও হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে চেষ্টা করলাম, ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম, কত কথা বলতে চাইলাম কিন্তু আমাকে কোনোটাই করতে দিল না সে। শুধু হাসি মুখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গায়েব হয়ে গেল, যাওয়ার আগে অনেকটা যেন বিড়বিড় করে বলে উঠল, তুই পারবি, একমাত্র তুইই পারবি। সকাল হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল, আর ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে বারান্দায় চলে গেলাম। শুকনো মুখে সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ একটা কথা মনে হলো, সঙ্গেসঙ্গে মনে হলো নম্বরগুলোর একটা অর্থ আমি হয়তো ধরতে পারছি।’
‘সিগারেট শেষ করে আমি ল্যাপটপ ওপেন করে বসলাম। যে-নম্বরটা টোকন দিয়েছে সেটা দেখে আমি ধারণা করতে পারছি এটা কোনো ইউআরএলের শেষ অংশ হতে পারে। ইউআরএল হলো ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর। সোজা কথায় বলতে গেলে আমরা যখন তার ব্রাউজারে কোনো ওয়েব অ্যাড্রেস ওপেন করি ওটার লোকেটর এটা। এর আগে অবশ্য বেশ অনেকটা অংশ থাকে যেমন এইচটিটিপি বা ওয়েবের অন্যান্য অংশ। এটা যে একটা ইউআরএল এটা ধরতে পারার কারণ হলো আমার পেশাগত সংশ্লিষ্টতা, আর অন্যদিকে এটা কিসের অংশ হতে পারে সেটাও খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি আমি। হয় এটা কোনো গুগল ড্রাইভের ইউআরএল আর না হয় ওয়েব ড্রপবক্সের। কারণ এই দুটোই টোকন মারাত্মকভাবে ব্যবহার করত। আর গোপনে কোনো কিছু রেখে ওটাকে কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলে এই দুটোর চেয়ে বেটার অপশন আর কী হতে পারে। কাজেই প্ৰায় কোনো দ্বিধা ছাড়াই এইচটিটিপি দিয়ে শুরু করে গুগল ড্রাইভের জন্যে যা যা লাগে, যেমন ড্রাইভ গুগল ইত্যাদি বসিয়ে টোকনের ডিজিট আর লেটারের কম্বিনেশনটা বসালাম। ভয়াল, ম্যাজিক। আমাকে শতভাগ সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে একটা গুগল ডক ওপেন হয়ে গেল। একা একাই ঘরের ভেতরে খুশিতে রীতিমতো চিৎকার করে উঠলাম।’
‘আনন্দের আতিশয্য সামলে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম এবং প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই একটা ধাক্কা খেলাম। এটা একটা এক পেইজের ডকুমেন্ট। একটা উপন্যাসের নাম লেখা, আর সেটার নিচে লেখকের নাম লেখা—আমাদের সেই এতিমখানার কামালের নাম। তার ঠিক নিচেই উপন্যাসের কাহিনি সংক্ষেপ। আমি কাহিনি সংক্ষেপটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। সোশ্যাল ড্রামা বা সামাজিক ধরনের উপন্যাস। একজন সফল ব্যক্তির গল্প। সে এক জরুরি কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে, এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে একের পর এক জায়গা চোখে পড়ছে, আর সেসব জায়গার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তার স্মৃতিগুলো একে একে বর্ণনা করছে সে। এর মাধ্যমে মাঝের একেবারে নিচের স্তর থেকে কীভাবে কতটা কষ্ট করে, কতকিছু স্যাক্রিফাইস করে, কত মানুষের সঙ্গে সব সম্পর্ক ধ্বংস করে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে একজন মানুষ সমাজের ওপরের স্তরে উঠে আসে সেই গল্প ফুটে উঠেছে। এর এই গল্পের মধ্য দিয়ে সামাজিকতা, রাজনীতি, ধর্মান্ধতা থেকে শুরু করে অর্থনীতি, দুর্নীতি, সমাজের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা পঙ্কিলতা আর ভালোবাসার গল্প ফুটে উঠেছে। গল্পটা খুবই ইন্টারেস্টিং, তারচেয়ে বড়ো কথা খুবই দারুণভাবে লেখা, এতটাই সুন্দর করে লেখা যে, আধা পৃষ্ঠার এই গল্প সংক্ষেপ পড়েই একদিকে পুরো গল্পটার একটা ছায়া পাওয়া যায়, আবার আরেকদিকে পুরো উপন্যাসটাও পড়ার ইচ্ছে জাগে। তবে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই গল্প সংক্ষেপটার ঠিক নিচেই ছোট একটা নোট লেখা: ফাইন্ড দ্য অথার, ফলো দ্য স্টোরি।’
‘গল্পটা তো বুঝলাম কিন্তু এর অর্থ কি? আবারো ব্লু এবং আবারো অনুসন্ধান আবারো ধোঁয়াশা। কিন্তু এবার যেন একটু অন্য লেভেলের, এবার যেন একটু বেশি বিস্তৃত এবং আরেকটু যেন গভীর। এখানে দুটো জিনিস বের করতে হবে: প্রথম অথার মানে লেখককে, এরপর গল্পের প্যাটার্ন বা গল্পটাকে। গল্প কথক না বুঝে যে, গল্পটাকে পাওয়াও যাবে না, আবার বোঝাও যাবে না। পুরো ব্যাপারটাতে আরেকটা লজিক যেমন পরিষ্কার, ঠিক তেমনি এর একটা স্ট্রং কানেকশনও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। কারণ এই কামাল টোকনের সঙ্গে সেই প্রজেক্টে কাজ করেছিল, যেখান থেকে সবকিছুর উৎপত্তি। বুঝলাম এটাকেও এখানে বসে সলভ করা যাবে না। কারণ এর আগেই একবার কামালের খোঁজ করেছি আমি সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে কিন্তু তাকে পাইনি। তাই পরের দিন আমি কাজ শুরু করি এবং আমাদের এতিমখানার মাধ্যমেই কামালের খোঁজ করার চেষ্টা করলাম। শুরুতেই একটা শক্ত ধাক্কা খেলাম। কামাল মারা গেছে। সে সুইসাইড করেছে বেশ কিছুদিন আগেই। পুরোপুরি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। গল্পের লেখকই যদি না থাকে, তবে পুরো গল্পটাই বা পাব কই, আর সেটা না পেলে অনুসরণের তো প্রশ্নই আসে না। তবে কি পুরো ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে।’
এই পর্যন্ত বলে জুলহাস আবারো দম নিল, সেই সঙ্গে সময়ও দেখে নিল একবার। কিন্তু সেটা থেমে থাকেনি। কয়েকদিনের একটা গ্যাপ পড়েছিল। প্রথমত, টানা কয়েকদিন এই পারপাসে ব্যয় করাতে অফিস থেকে শুরু করে পারসোনাল লাইফে বেশ কিছু কাজ জমে গেছিল, যে-কারণে ওদিকে সময় দিতে হয়েছিল। এর পাশাপাশি আসলে কী করব খুব একটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যে-মানুষটা মারাই গেছে যেই গল্পটার পুরোটা আমার কাছে নেই-ই সেই গল্প আমি কীভাবে অনুসরণ করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই চিন্তা-ভাবনা তো বটেই, এর পাশাপাশি আরো খানিকটা সময় চাচ্ছিলাম আসলে পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝে ওঠার জন্যে। এমন সময় অফিসেই একটা ঘটনা ঘটে, যেটা আমাকে দারুণ একটা ক্লু বের করে দিতে সাহায্য করে। আগেই বলেছি আমি তো বই-টই পড়ি না। কিন্তু আমার এক কলিগ আছে প্রচুর বই পড়ে। বিশেষ করে আজাইরা গল্প- উপন্যাস-থ্রিলার এইগুলোর দিকে তার দারুণ ঝোঁক। আমি বুঝিনা মানুষে এইগুলো কেমনে পড়ে। যাকগে, আমি যখন চিন্তা-ভাবনার জন্যে বিরতিতে আছি, সেইসময়ে একদিন অনলাইনে উনার অর্ডার করা বেশ কিছু বই এলো। আমিই রিসিভ করলাম, এরপর সে যখন এলো তখন আমি জানতে চাইলাম সে এসব বই অর্ডার করে কোথা থেকে। সে জানাল সে অনলাইন বুক শপে অর্ডার করে। দেশে নাকি এখন অনলাইন বুকশপগুলো দারুণ জনপ্রিয়। আমি জানতে চাইলাম বই অর্ডার না হয় অনলাইন বুকশপগুলো থেকে করল। কিন্তু এসব বইয়ে ব্যাপারে সে জানতে পারে কীভাবে। এর জবাবে সে যা জানাল সেটা বেশ চমকপ্রদ এবং আমার জন্যে বেশ খানিকটা নতুনও বটে। সে এসব বইয়ের ব্যাপারে বেশির ভাগ সময় নাকি জানতে পারে অনলাইন থেকেই। অনলাইনে নাকি এক লাখ, দেড় লাখ, দুই লাখ মেম্বারের বিভিন্ন বই আলোচনার গ্রুপ আছে সেসবে কার কখন কোন নতুন বই আসছে। কার বই প্রকাশিত হলো, প্রকাশিত বইগুলোর ভেতরে কার লেখা কেমন হলো, সেসব নিয়ে নাকি নিয়মিত বিভিন্ন রিভিউও লেখা হয়। এর পাশাপাশি আবার বিভিন্ন অনলাইন বই বিক্রেতাদের ওয়েবসাইটেও নাকি এসব নিয়ে জানা যায়। তবে অনলাইনে বইয়ের বিষয়ে জানার জন্যে সবচেয়ে সেরা জায়গা নাকি গুডরিডস নামের একটা ওয়েবসাইট। ফেসবুক যেমন একটা সবার জন্যে সোশ্যাল মিডিয়া, ঠিক তেমনি প্রফেশনালদের জন্যে যেমন লিংকডিন, ঠিক তেমনি বই পড়ুয়াদের সোশ্যাল ওয়েবসাইট গুডরিডস। এটা নাকি এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে বই পড়া, বই লিস্ট করা যায়, বই রেটিং এবং রিভিউ করা যায়, যেকোনো বইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া যায়, রিডার কমিউনিটির সঙ্গে কানেকটেড হওয়া যায়, লেখকদের প্রোফাইলের সঙ্গে কানেকটেড হওয়া যায়, এমনকি বই সেলফ পাবলিশের ক্ষেত্রেও হেল্প পাওয়া যায়।’
‘সত্যি কথা হলো এমন কিছু আগে আমি জানতামই না। আমার এই কলিগের কথা শুনতে শুনতে মনে হলো আচ্ছা কামালের এই গল্প বই আকারে প্রকাশিত না হলেও এমনকি কোনোভাবে হতে পারে যে, এটা অনলাইন বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই লাইনে খোঁজ করে দেখলে কেমন হয়। আমার কলিগের কাছে জানতে চাইলাম আমি একটা গল্প পড়েছিলাম, বইটার নাম মনে নেই—কোনোভাবে কি এটা বের করা সম্ভব? সে হেসে বলল, অবশ্যই সম্ভব, আমি যতটুকু জানি সেটা লিখে কোনো একটা বইয়ের গ্রুপে পোস্ট দিলেই কেউ জানলে জানিয়ে দেবে, আমি সঙ্গেসঙ্গে তাকে জানালাম, গল্পটার সিনোপসিস পাঠাচ্ছি আমি তাকে, সে একটা পোস্ট দিতে পারবে কি না। সে জানাল, খুশি হয়েই পারবে। আমি তাকে ই-মেইেল করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু দশ মিনিটও যেতে পারল না, সেই কলিগ আবার আমার ডেস্কে এসে উপস্থিত হলো এবং আমাকে যা জানাল সেটা একদিকে যে চমকপ্রদ, অন্যদিকে আমার জন্যে খুবই অবাক করার মতো এবং খনিকটা বিস্ময়কর এবং ভীতিকরও বটে।’
‘আমার কলিগ জানায়, সে দুটো বইয়ের গ্রুপে পোস্ট দেয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই তার দুটো পোস্টেই একাধিক কমেন্ট পড়তে শুরু করে বইয়ের এবং লেখকের নামের। আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। যেটা খুঁজতে খুঁজতে জীবন বের হয়ে যাবে ভেবেছিলাম, সেটা কি না এত সহজে পেয়ে যাব কে ভাবতে পেরেছিল। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটল যখন আমি লেখকের নাম জানতে চাইলাম। লেখকের নাম আরিয়ান শফিক, আর এত সহজে স্রেফ কাহিনি সংক্ষেপ পড়ে বইয়ের এবং লেখকের নাম জানতে পারার কারণ ছিল এটা নাকি এবছরের সবচেয়ে বড়ো হিট বই। সব ধরনের বেস্ট সেলিং লিস্টে জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি বইটা সমালোচক এবং পাঠকদের বিপুল ভালোবাসা কুড়ানোর পাশাপাশি বছরের সেরা উপন্যাসের পুরস্কারও বাগিয়ে নিতে চলেছে। আমার কলিগ বলে যচ্ছিল কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার কানে স্রেফ লেখকের নামটাই আটকে ছিল। আমি তার কথা শোনা বাদ দিয়ে আমার পিসির সামনে বসে লেখক আরিয়ান শফিক লিখে সার্চ দিলাম। সঙ্গেসঙ্গেই লেখকের বায়ো ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে সবকিছু চলে এলো, সঙ্গে একাধিক ইন্টারভিউ, হঠাৎ খ্যাতি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড়ো কথা সার্চেই এসেছে লেখকের ছবিও, কোনো সন্দেহ নেই, এটা কামাল নয়। আমি আবারো এবং বারবার আরিয়ান শফিকের বেস্ট সেলার এই উপন্যাসটার গল্প সংক্ষেপ পড়লাম এবং টোকনের লিংক দেয়া গল্প সংক্ষেপ পড়লাম। বইটার নাম থেকে শুরু করে গল্পের ধরন এবং চরিত্রায়নে ও অনেককিছু বদলানো হয়েছে, দুটো গল্পসংক্ষেপ পড়েই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, কেউ না কেউ অবশ্যই গল্পটা চুরি করেছে। সেটা কামালও হতে পারে অথবা এটা লেখক আরিয়ান শফিকও হতে পারে। আমার মনের ভেতরে একটা অনুভূতি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করল, এটা কামালেরই গল্প এবং এটা এই লেখক আরিয়ান শফিকই চুরি করেছে কোনোনা কোনোভাবে। আমি—’
মোবাইল বাজতে শুরু করতেই খানিক চমকে উঠল জুলহাস। মোবাইলের স্ত্রিনে কলারের নাম দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর। ভিডিওটা পজ করে দিয়ে কল রিসিভ করল ও। কথা বলতে বলতে ওর কোঁচকানো ভ্রুর গভীরতা স্রেফ বেড়েই চলল। কল কেটে দিয়ে খানিক স্থাণুর মতো বসে রইল। বিগত কয়েকদিন ধরেই ও জানত আজ কিছু একটা ঘটবে। আর সেজন্যে সে প্রস্তুতও হয়েছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে ঘটনা ঘটতে শুরু করল, ক্ষণিকের জন্যে ওর মাথা আর কাজ করছে না। ক্ষণিক ঝিম মেরে বসে থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল জুলহাস। প্রথমেই ভিডিওটা সেভ করে ওগুলোকে প্রসেস করতে দিয়ে প্রথমেই ব্যাগটাকে তুলে নিল চেয়ারের ওপরে। তারপর, আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিল সবকিছু। সময় এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিডিওটা প্রসেস হতে কতটা বাকি আছে দেখে নিয়ে মোবাইলে ও কল করল স্থানীয় ফায়ার স্টেশনে। ওর ঠিকানা বলে একটা আগুন লাগার ঘটনা রিপোর্ট করে ল্যাপটপ থেকে শুরু করে সব গুছিয়ে নিয়ে, আরেকটা সিগারেট ধরাল। যদিও একেবারেই সময় নেই, তারপরও সিগারেটটা ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ টানল ও, তারপর ওটাকে জ্বলন্ত অবস্থাতেই মেঝের ওপরে ছুড়ে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত এবং স্ত্রস্তপায়ে এগোল দরজার দিকে। দরজাটাকে বাহির থেকে বন্ধ করে দিতে দিতে পলকের জন্যে দেখতে পেল, সিগারেটের জ্বলন্ত মোথাটা মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে নির্দিষ্ট জায়গাতে যেতেই মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা জিপো ফুয়েলে ধরে গিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল, এরপরেই সেটা গিয়ে টাচ করল খানিক দূরেই রাখা কাপড়ের স্তূপের ওপরে। কাপড়ের স্তূপের জিপো ফুয়েলের নীলচে আলো জ্বলতে শুরু করেছে দেখেই দরজাটা ধাম করে তালা লাগিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল জুলহাস। মনের ভেতরে একই ডাক ডেকেই চলেছে, সময় নেই, সময় নেই। শালা ওর ইনফরমার অনেক দেরি করে ফেলেছে ওকে খবরটা দিতে গিয়ে।
বাইরে বের হয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রায় দৌড়াতে শুরু করেছে জুলহাস। বাড়ির পেছনে গ্যারেজে রাখা গাড়িটা নিয়ে যখন ও এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে ভিউ মিররে দেখতে পেল ওর এতদিনের অস্থায়ী বাসভবনটা দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। জুলহাসের গাড়িটা টঙ্গী মেইন রোডে উঠতে উঠতে দেখতে পেল ফায়ার ব্রিগেডের একটা গাড়ি ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে যেদিক থেকে আসছে ও সেদিকে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল জুলহাসের। যেভাবে আগুন লাগিয়েছে তাতে ওর টাইমিং ঠিক আছে, যে-বাড়িটাতে ছিল সেটায় ওর থাকার অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে কিন্তু আশপাশে আগুন বেশি ধরার আগেই আশা করছে ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছে যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ও কি সময়মতো পৌঁছাতে পারবে…?
১৪
জুলহাসের মনের ভেতরে যেকু-ডাক ডাকছিল সেটাই প্রমাণিত হলো ও উত্তরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে। এত সচেতনতা আর এত প্রস্তুতি সব ব্যর্থ হলো ওর স্রেফ একটা খবর সামান্য দেরিতে পৌঁছানোর কারণে। যতটা সম্ভব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে জায়গামতো পৌঁছানোর চেষ্টা করল কিন্তু তাতেও খুব বেশি কাজ হবে কি না যথেষ্ট সন্দেহই রয়ে গেল মনের ভেতরে। তবে ভেতরে ভেতরে যতই উদ্বেগ উত্তেজনা আর রাগ কাজ করুক না কেন ও নিজেও জানে আসলে এছাড়া কোনো উপায় ছিল না ইনফরমারের। একে তো পরিস্থিতি এবং বিষয়টাই এমন যে এখানে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। তার ওপরে আবার আদতে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটাও পুরোপুরি জানা নেই। এমন অবস্থাতেও ওর ইনফরমার ওকে যা জানিয়েছে সেটাও একেবারে কম নয়। কাজেই সব মিলিয়ে ইনফরমারের দেরি হলেও আসলে জুলহাস জানে ছেলেটার খুব বেশি দোষ নেই, বরং সে যা করেছে বা করার চেষ্টা করেছে, এরকম একটা অবস্থানে সেটাই অনেক বড়ো বিষয়।
জুলহাস গাড়ি চালিয়ে উত্তরার সেই ক্লাব—যেখানে লেখক আরিয়ান শফিক পুরস্কার গ্রহণ করার কথা, সেখানে পৌঁছাল প্রায় দশটার কাছাকাছি সময়ে। আর জায়গামতো পৌছেই ও বুঝতে পারল,এরই মধ্যে সে দেরি করে ফেলেছে। ভেন্যুর বাইরে এসেই ও বুঝতে পারল এখানে বড়ো ধরনের কোনো একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কারণ এরকম একটা প্রোগ্রামে সবকিছু যেমন হওয়ার কথা তার ধারে- কাছেই সেসব কিছু নেই। বরং বাইরে উত্তেজিত মানুষ মিডিয়াকর্মী এবং সাধারণ মানুষের ভিড়। জুলহাস গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ভেন্যুর পেছন দিকে নিয়ে পার্ক করল। মাথায় একটা ক্যাপ পরে নিয়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে বের করে নিল নীলক্ষেত থেকে প্রিন্ট করা একটা মিডিয়াকর্মীর ভুয়া আইডি কার্ড। সেটাকে গলায় ঝুলিয়ে মুখে একটা মাস্ক লাগিয়ে হাতে নোটপ্যাড আর কলম নিয়ে জুলহাস খুব সাবধানে চলে এলো ভেন্যুর সামনের অংশে। ওকে আগে পরিস্থিতি বুঝতে হবে, এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে আদতে যা ঘটার সম্ভাবনা ছিল আর বাস্তবে কী ঘটছে—দুটোর ভেতরে ফারাক বের করে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সবার আগে ওকে সাবধান থাকতে হবে, যাতে ওর চেহারা চট করে চিনে না ফেলে কিংবা অন্তত দেখে না ফেলে। আর সে জন্যেই এই আয়োজন।
জুলহাস ভেন্যুর পেছন থেকে সামনে চলে এলো। বছরের সেরা সাহিত্য পুরস্কার বলে কথা, খুবই জমকালো এবং সুন্দর আয়োজন করা হয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সেই আয়োজনে বেশ বড়ো ধরনের একটা ধাক্কা লেগেছে। জুলহাস ভিড়ের ভেতরে একজন গার্ডকে পাকড়াও করে বেশ কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে শুনল আসলে কী ঘটেছে এখানে। লেখক আরিয়ান শফিককে কেন এবং কী অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটা শোনার সঙ্গেসঙ্গে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল ও, এমনটা হওয়ারই ছিল। মনের ভেতরে খানিক আফসোসও বোধ হলো যদি ও আরেকটু সতর্ক থাকত তবে হয়তোটা এটা এড়ানোও সম্ভব হতো কিন্তু ওর পক্ষে চাইলেই এটা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি শেষ মুহূর্তেও পরিস্থিতির কারণে। আরো একটা কারণ অবশ্য ছিল। গার্ডের কাছ থেকে আরো জানতে পারল আরিয়ান শফিকের পুরস্কারটাই ছিল অনুষ্ঠানের শেষ এবং ওটার সময়ে গড়বড় হওয়াতে অনুষ্ঠান এলোমেলো হলেও খুব বেশি অনুষ্ঠান বাকিও ছিল না। আর একারণেই তাকে গ্রেপ্তার করার পর অনুষ্ঠান শেষ করা হলেও সেই সৌন্দর্যটা আর ছিল না পুরো অনুষ্ঠানটাতে। কারা তাকে গ্রেপ্তার করেছে কিংবা এখন তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এই প্রশ্নের জবাবে খুব বেশি তথ্য বের করতে পারলনা জুলহাস। এখানে যা জানার জানা হয়ে গেছে, বুঝতে পেরে ও আবারো ভেন্যুর পেছন দিকে রওনা দিয়ে ওর ইনফরমারকে কল দিয়ে এখানে কী ঘটেছে জানিয়ে আরিয়ান শফিককে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটা বের করার অনুরোধ করে গাড়িতে এসে বসল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চেক করতে গিয়েই দেখতে পেল ও যা অনুধাবন করছিল সেটাই ঘটতে শুরু করেছে। লেখক আরিয়ান শফিকের নামে এরই মধ্যে নানা ধরনের খবর আর গুজব ছড়াতে শুরু করেছে। এটাও যে একান্তই ইচ্ছাকৃতভাবে এবং যারা তার পেছনে লেগেছে, তারাই করেছে এটা বুঝতে হলে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় জুলহাস ভালোভাবেই জানে ওরা এভাবেই কাজ করে। কীভাবে ও অনেকটাই বুঝে গেছে, কিন্তু কেন সেটা এখনো ধরতে পারেনি। আর সেটা বোঝার জন্যে ওকে টোকনের ধাঁধার পরের অংশ সমাধান করতে হবে, আর সেটার জন্যে ওকে লেখক আরিয়ান শফিককে প্রয়োজন, কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এই লোককে ধরা এখন আগের চেয়েও কঠিন হতে যাচ্ছে। কিন্তু ওকে প্রাণপণে চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জুলহাস গাড়ির সামনের অংশে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে দুই টান দেয়ার আগেই ওর মোবাইল বেজে উঠল। এতটা দ্রুত রেসপনস আসবে ভাবতে পারেনি ও, সঙ্গেসঙ্গে কলটা রিসিভ করে যা শুনল তাতে আক্ষরিক অর্থেই চোখ কপালে উঠে গেল ওর। কথা বলতে বলতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলল। ও যা ভেবেছিল অন্তত দুটো দিক থেকে তাই হতে যাচ্ছে। প্রথমত, অবশ্যই অবশ্যই এই লোক কিছু না কিছু জানে, তা না হলে সবাই এভাবে তার পেছনে লাগত না, ও নিজেও না। অন্যদিকে, ঠিক একারণেই এই লোককে ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না, জোরদার সম্ভাবনা এই লোক থানায় পৌঁছানোর আগেই একে শ্যুট করে দেবে। কাজেই একেবারে মার্জিনাল হলেও আমার যতটুকু সুযোগ আছে সেটা কাজে লাগাতে হবে, এই লোককে সাহায্য করার জন্যে।
জুলহাস গাড়ি স্টার্ট দিয়েও থেমে গেল। একটা বুদ্ধি এসেছে ওর মাথায়। আরিয়ান শফিককে কোন থানায় নিয়ে যাওয়া হবে, এটা সে জানতে পেরেছে কিন্তু কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এটা বলা মুশকিল। সে সম্ভাব্য থানার ঠিকানা এন্ট্রি দিয়ে গুগল ম্যাপে চেক করতে শুরু করল, প্রথমে সবার আগের সাজেশনটা বাদ দিল। এই এলাকা সে খুব ভালো চেনে, কাজেই সম্ভাব্য কোন কোন দিক দিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে ওরা যথেষ্ট নির্জনতা এবং সুযোগ পাবে লেখককে গায়েব করার, সেটার একটা একটা করে নোট নিতে লাগল। খানিক সময় লাগলেও মিনিট দশেকের ভেতরে সম্ভাব্য তিনটা রুট ফাইনাল করল ও। এবার একটা একটা করে চেক করতে হবে। কপাল ভালো হলে প্রথমটাতেই পেয়ে যাবে ও আর কপাল খারাপ হলে তিন নম্বরটাতে, আর কপাল অতিরিক্ত খারাপ হলে পাবেই না। জুলহাস গাড়ি স্টার্ট করে দিল।
কিন্তু হাউজিং এলাকার মেইন রোড থেকে সাইড রোডে নামতে নামতে ও যা খবর পেল তাতে ও খুশি হবে নাকি বেজার হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। লেখক আরিয়ান শফিক নাকি পুলিশের ভ্যান উলটে একাধিক মানুষকে আহত করে পালিয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই ব্লুটুথ হেডফোনে কথা বলতে বলছে, সেই সঙ্গে ঝড়ের বেগে ভাবার চেষ্টা করছে পুরো পরিস্থিতি। থ্রিলার উপন্যাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে একের পর এক সাসপেন্স আর টুইস্ট ঘটে যাচ্ছে কাহিনিতে। আরিয়ান শফিকের পালাবার ব্যাপারটা প্রথমে অবিশ্বাস্য লাগলেও ইনফরমারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কয়েকটা বিষয় মেলাতেই জুলহাসের মনে হলো ব্যাপারটা আসলে অসম্ভব কিছু না। কারণ একে তো আরিয়ান শফিক আর্মিতে ছিল কাজেই, কমব্যাট থেকে শুরু করে অস্ত্র ইত্যাদি সব বিষয়ে তার ট্রেনিং আছে। তবে ইনফরমারের পরের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠল জুলহাসের। আরিয়ান শফিক নাকি বাইরে থেকে সাহায্য পেয়েছে। মানুষটা কে সেটা শুনে আরো কুঁচকে উঠল ওর ভ্রু। ঘটনা কি, আসলে হচ্ছেটা কি। ইনফরমারের কাছ থেকে লোকেশন জেনে নিয়ে ও সেদিকে রওনা দিল।
গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে ও যেখানে আছে সেখান থেকে ওখানে পৌঁছাতে ওর ত্রিশ মিনিটের মতো লাগবে। মানে খুব দূরে না হলেও একেবারে কাছেও না। ম্যাপ সেট করে ফুল স্পিডে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মৃদু হেসে উঠল আরিয়ান। উত্তরা থেকে ওদের হেডঅফিসে যাওয়ার জন্যে ও সম্ভাব্য যে কয়টা রুট ঠিক করেছিল তার কোনোটাই নয় এটা। আর হাসির কারণ হলো ব্যাটারা একে নিয়ে গেছিল একেবারে নির্জন এক জায়গায়, সম্ভবত শ্যুট করার জন্যে, কিন্তু সেটা তো পারেইনি, উলটো বেশি নির্জনে চলে যাওয়াতে একদিকে আরিয়ান শফিকের পালানোর জন্যে সুবিধা হয়েছে, তার ওপরে আবার ওরাও সময়মতো ব্যাকআপ ডাকতে পারেনি। কিন্তু আরিয়ান শফিক এভাবে পালানোতে ওর জন্যেও ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে গেছে। তবে এটাও ঠিক যে, এরকম কিছুই হতে যাচ্ছিল, এটা ও আগেই খানিক হলেও ধারণা করেছিল।
জুলহাস পূর্ণ বেগে গাড়ি চালিয়ে ত্রিশ মিনিটের আগেই জায়গামতো পৌঁছে গেল। ও একটু চিন্তিত ছিল এই নির্জন জায়গাতে ওর গাড়ি পুলিশ বা অন্যদের চোখে পড়ে যাবে কি না। কিন্তু পৌঁছে দেখল, পুলিশ স্পেশাল ফোর্সসহ মিডিয়ার আরো কিছু গাড়ি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে ওখানে। সাময়িক একটা বন্ধনীও তৈরি করে ফেলা হয়েছে। জায়গামতো পৌঁছে মিডিয়াকর্মী পরিচয় দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেল ও কর্ডনের ভেতরে। পুরো পরিস্থিতি দেখে রীতিমতো হাঁ হয়ে গেল ও। কারণ এতটা এলাহি অবস্থা আশা করেনি ও। প্রথমত, লেখক এরকম এলাহি ধ্বংসযজ্ঞ করে পালিয়েছে এটা মেনে নিতে ওর কষ্ট হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবার এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে যে, যারাই এর পেছনে লেগেছে এরাও আইনের আয়ত্তের ভেতরে থেকেও কতটা বড়ো আকারে একজন মানুষের পেছনে লাগতে পারে—বিষয়টা ভাবার মতো। শেষ কথাটা মাথায় আসতেই জুলহাস হেসে উঠল। সেটা কি সে বিগত কিছুদিনে এরই মধ্যে টের পায়নি।
জুলহাস গাড়িটাকে স্পটের কাছাকাছি নিয়ে রাস্তার পাশে খানিক জায়গা দেখে সেখানে পার্ক করল। ওকে খুব ভালোভাবে পরিস্থিতি অবজার্ভ করতে হবে, কিছু ব্যাপার বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ও একজন কোডার, কাজেই কোডিং যেভাবে করা হয় সেভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে ও। ওর এই মুহূর্তে প্রয়োজন লেখককে, যে পালিয়েছে। কিন্তু তাকে যারা ধাওয়া করছে তারা ওর আয়ত্তের ভেতরে আছে, কাজেই এদের দেখে ওকে এমন কিছু বের করতে হবে, যাতে লেখকের কাছে পৌঁছাতে পারে। যদি এতে কাজ না হয়, তবে ওকে লেখকের পরিবার বা কাছের মানুষদের মাধ্যমে সেটা করতে হবে। জুলহাস মনোযোগ দিয়ে সার্বিক অবস্থা জরিপ করতে লাগল। যদিও খানিক দূরে কিন্তু মোটামুটি সবই দেখা যাচ্ছে চারপাশে।
জুলহাস বেশ কিছুক্ষণ টানা পরিস্থিতি অবজার্ভ করে মোটামুটি বুঝতে পারল, কোন টিমটা আসলে লেখককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে ছোটখাটো স্বাস্থ্যবান করে একজনকে দেখতে পেল বেশ হাত-পা নেড়ে নির্দেশনা দিচ্ছে চারপাশে, তার সঙ্গে বেশ সুদর্শন আরেকজনকেও দেখতে পেল। তারা দুজন তো বটেই তাদের সঙ্গে থাকা বাকিদের দেখে মনে হচ্ছে বেশ অস্থিরতার ভেতরে আছে এবং তাদের এক সঙ্গীকে স্ট্রেচারে করে নিতে দেখে এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারল, লেখককে নিয়ে তাদের যা পরিকল্পনা ছিল, সেটা তো ভেস্তে গেছেই সেই সঙ্গে তারা বেশ বড়ো ধরনের একটা ধাক্কা খেয়েছে। নিজের বিগত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা এবং টোকনের সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে জুলহাস এটুকু জানে বা অ্যাটলিস্ট উপলব্ধি করতে পারে, এই ফোর্সের লোকজন এরা স্রেফ টাট্টু, এদের পেছনে অত্যন্ত শক্তিশালী কেউ আছে, অনেক বড়ো কিছু আছে। আর এসবের পেছনে যারাই থাকুক তারা যদি লেখককে নিকেশ করার জন্যে এই করাপ্টেডদের নিয়োগ দিয়ে থাকে, তবে এই ব্যর্থতা এরা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। কাজেই এই লোকগুলো এবার নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে লেখকের পেছনে লাগবে। তখনই হঠাৎ করে আইডিয়াটা এলো, লেখককে ওর নিজের খুঁজে বের করতে হবে না। এরাই তাকে পথ দেখাবে, ওকে স্রেফ এদের অনুসরণ করতে হবে। আইডিয়াটা ওর মাথায় আসতেই খুশি হয়ে উঠল জুলহাস। তবে এদের পিছু নেয়ার আগে ওকে জানতে হবে, আইনপ্রয়োগকারী লোকজনের খোলস পরা এই লোকগুলো আদতে কারা এবং এদের শক্তি-সামর্থ্য এবং ও কি আসলে এদের সঙ্গে পাল্লা টানার শক্তি এবং সামর্থ্য রাখে কি না।
শিকারির মুখে থেকে ছুটে যাওয়া শিকারকে আবার পাকরাও করার জন্যে শিকারি উন্মাদ হয়ে উঠবে। কিন্তু ওর কাজ হবে আরো ভয়ংকর। উন্মাদ শিকারির মুখ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে তার বাগে আনা শিকারকে। আর সেটার জন্যে যে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে ওকেও।