১
সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে টুপ করে ছাইটা টেবিলের ওপরে পড়ে যেতেই তীব্র বিরক্তির সঙ্গে সেদিকে তাকাল জুলহাস। তার নিজের ওপরে বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল, উচিত ছিল সিগারেট ধরে রাখা কম্পনরত হাতটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভয় পাবার, অথবা এগুলোর কোনোটার দিকেই নজর না দিয়ে বরং পরিস্থিতির জন্যে শঙ্কিত হয়ে ওঠা। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এগুলোর কোনোটাই সে ভাবছে না।
মানব মস্তিষ্ক বড়ই আজব জিনিস, কখন কীভাবে কী করে—বোঝা খুব মুশকিল। এই যেমন এভাবে টপ করে সিগারেটের ছাই পড়তেই তার শৈশবের শঙ্কর স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। শঙ্কর স্যার ছিল ওদের এতিমখানার হাউস টিউটরদের একজন, যাকে সবাই পণ্ডিত স্যার নামেও ডাকত। খুব নিরীহ সাধারণ মানুষ, কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই একবার পোলাপানরে মারতে শুরু করলে তার ওপরে পিচাশ ভর করত। ওদের এতিমখানায় এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে শঙ্কর স্যারের মার সহ্য করতে না পেরে পোলাপানে প্রস্রাব করে দিয়েছে, একবার জিল্লুর নামে এক ছেলে হেগেও দিয়েছিল। ওরা মাঝেমধ্যেই খুব অবাক হতো যে মানুষটা দুনিয়াতে কখনোই কারো সঙ্গে আগে-পিছে থাকত না, কোনো দিন কারো কোনো ক্ষতি করত না, সেই মানুষটা এতিম ছেলেপেলেগুলোকে সুযোগ পেলেই এমন জানোয়ারের মতো পেটাত কারণ কি?
কারণটা অবশ্য একেবারে অজানা ছিল তাদের কাছে এমন নয়। দুনিয়াতে ভালো জিনিস যতই চাপা থাক না কেন, খারাপ জিনিস জানা হয়ে যায় সবার। শঙ্কর স্যারের একটাই ছেলে ছিল, ছেলেটা খুব অল্প বয়স থাকতে তার স্ত্রী মারা যায়, ছেলেটাকে বহুকষ্টে একাই বড়ো করেছিল মানুষটা। কিন্তু সেই ছেলেটা বড়ো হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার বাপকে দেখেনি শেষ বয়সে, কে জানে হয়তো এই কারণেই সন্তান কিংবা ছেলে প্রজাতির ওপরে তার অক্ষম এক নীরব রাগ ছিল ভেতরে ভেতরে, আর সেটাই সে সুযোগ পেলে অবচেতন মনেই ঝেড়ে বসত এতিম ছেলেদের ওপরে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত যে আজ এই অবেলায় জীবনের অন্যতম এই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্যসব কিছু বাদ দিয়ে শঙ্কর স্যারের কথা মনে পড়ছে জুলহাসের। তাও খুব অদ্ভুত একটা কারণে। শঙ্কর স্যার প্রতিদিন সকালে চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খেত, আর মাঝেমধ্যেই চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট মুখে দেয়ার আগেই বিস্কুটের ভেজা অংশ ভেঙে টুপ করে চায়ের কাপে পড়ে যেত, ঠিক যেভাবে ওর সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ছাইটা টুপ করে টেবিলে পড়ে গেছে। ,
কথাটা মনে হতেই মৃদু হাসি ফুটে উঠল জুলহাসের মুখে। যেই মানুষটা এত অত্যাচার করেছে ওদের এতটা ভয়ংকর নির্যাতনের পরেও লোকটার সেসব কথা ঠিকভাবে মনে নেই, বরং বহু বছর পর তার চায়ের কাপে ভেজা বিস্কুট পড়ে যাওয়ার স্মৃতি ফিরে এসেছে ওর মনের গহিন কোণে, তাও সম্ভবত ওর জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র আর অদ্ভুত সন্ধ্যাতে। বড়ো করে একবার নিঃশ্বাস ছেড়ে জুলহাস হাতের সিগারেটটা প্রায় উপচে ওঠা অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে চেয়ারে হেলান দিল। মন বলছে সিগারেটটা ধরানো দরকার কিন্তু শরীর বলছে এরই মধ্যে অনেক হয়ে গেছে। অতিরিক্ত সিগারেট টানার ফলে ওর মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এতটাই তেতো যে টেম্পার ছেড়ে দেয়া শরবতের মতো মিষ্টি কোক খেয়েও সেই তেতো ভাব ছাড়ছে না। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে জুলহাস কিছুক্ষণ পুরো পরিস্থিতিটা ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেই চেষ্টা ক্ষণিকের ভেতরেই ব্যর্থ হতেই সে চট করে সোজা হয়ে গেল আবার। কিছু সময় আর কিছু কাজ থাকে যেগুলো নিয়ে আসলে খুব বেশি ভাবতে হয় না, কিংবা ভাবা যায় না, স্রেফ করে ফেলতে হয়। এটা সেরকমই একটা ব্যাপার, আর আজকের সন্ধ্যা সেরকমই একটা সময়। ,
জুলহাস চট করে সোজা হয়ে, ল্যাপটপের নামানো ডালাটা আবার সোজা করে ফেলল। আগের কাজ আগে। সে একবার সময়টা দেখে নিল, আসলে এই কাজটা আরো অনেক আগেই করা উচিত ছিল এভাবে শেষ মুহূর্তের জন্যে রেখে না দিয়ে। ল্যাপটপের বিশেষ অপশন ওপেন করে, ওয়েব ক্যামটা সেট করে সে ল্যাপটপটার পজিশন ঠিক করে নিল। সেই সঙ্গে জ্বালিয়ে দিল পাশের টেবিল ল্যাম্পটা। আধো অন্ধকার ঘরটাকে আরেকটু আলোকিত করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেই ঝুঁকিতে যাওয়া ঠিক হবে না। ক্যামেরাটা ওপেন করে সেটাকে ভিডিও রেকর্ড মুডে দিতেই ক্ষণিকের জন্যে জুলহাসের অস্বস্তি হলো। একবার সে ভাবল, বার্তাটা কি আসলে ওর চেহারা লুকিয়ে দিলে বেটার হতো না। অন্তত চেহারাটা আড়ালেই রয়ে যেত, কী দরকার চেহারাটা সবাইকে দেখানোর। কিন্তু পরমুহূর্তে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। যে কারণে সে বার্তাটা রেকর্ড করছে। সেটা যদি সত্যি হয় এবং সত্যি সত্যি যদি এই ভিডিও প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে তবে ততক্ষণে হয় সে মারা পড়েছে অথবা সে এমন মানুষজনের হাতে ধরা পড়েছে, যাদের কাছে তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। কাজেই দুই ক্ষেত্রেই এই ভিডিওতে ওর চেহারা দেখা গেলেও আর কোনো সমস্যা নেই। বরং চেহারা দেখা গেলে এই এভিডেন্স আরো শক্তিশালী হবে, ভাইরাল হওয়ার সম্ভবনাও আরো বেড়ে যাবে। কারণ ও জানে সম্ভাব্য যাদের সঙ্গে ওর লড়াইটা, তাদের সঙ্গে আসলে স্রেফ আইনি লড়াই করে তেমন কোনো লাভ হবে না। তারচেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা সাইবার লড়াই অনেক বেশি স্ট্রং হবে। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এত ভেবে লাভ নেই। আগুনে ঝাঁপ সে অনেক আগেই দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় হলো এই উত্তপ্ত অঙ্গার থেকে সে বেঁচে বেরোতে পারে কি না, অথবা এই অঙ্গারের গোড়ায় পৌঁছাতে পারে কি না। আসলে ওর বেঁচে বের হওয়ার চাইতেই দ্বিতীয়টা বেশি জরুরি।
‘আমি জুলহাস,’ মৃদু কাশি দিয়ে বলতে শুরু করল জুলহাস। অদ্ভুত বিষয় হলো, একটু আগেও সিগারেটটা ধরাতে বিতৃষ্ণা লাগছিল, কিন্তু যেই সে বলতে শুরু করল সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগল নিকোটিনের প্রয়োজনে গলা-বুক সব শুকিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবল ভিডিওটাতে বিরতি দিয়ে সিগারেটটা টেনে আবার শুরু করে। পরমুহূর্তে নিজের ওপরে অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল সে। একটা সিরিয়াস কাজের শুরুতেই সে সিগারেট বিষয়ক চিন্তা করে অকারণে নিজের মনোযোগ নষ্ট করছে। ‘আমি জুলহাস রহমান, একই কথার পুনরাবৃত্তি করল সে আবারো। জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছে সে ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের সামনে। কিন্তু কখনো এভাবে, ভিডিও বা নিজের কথা রেকর্ড করেনি। এই অনভ্যস্ততাই মূলত এই অস্বস্তির কারণ। ‘আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার,’ কথার জড়তা আর অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে সে। ‘একটা আইটি ফার্মে কাজ করি। তবে আজ যে উদ্দেশ্যে এই ভিডিও বার্তা বা জার্নাল তৈরি করছি তার সঙ্গে আসলে আমার পেশাগত প্রতিষ্ঠানের কোনো সংযোগ নেই, এই কথাটা শুরুতেই একেবারে পরিষ্কার করে নিতে চাইছি। আমি চাই না যে প্রতিষ্ঠানে আমি এতদিন কাজ করেছি, আমার কারণে তাদের কোনো সমস্যা হোক। কাজেই আজকের পর বা এই ভিডিও-সংক্রান্ত বিষয়ে যাই হোক না কেন, তার সঙ্গে যেন আমার কর্মস্থানকে জড়ানো না হয়,’ জুলহাস চেয়ার থেকে সোজা হলো। এবার ওকে ধীরে ধীরে মূল বিষয়ের দিকে এগোতে হবে। তবে আশার কথা হলো যত কথা বলছে জড়তা তত পরিষ্কার হয়ে আসছে।
‘আমি আজ এই ভিডিও বার্তা বা জার্নাল যে-উদ্দেশ্যে তৈরি করছি তার সঙ্গে আমার পেশাগত প্রতিষ্ঠানের সংযোগ না থাকলেও এর সঙ্গে অবশ্যই আমার পেশার এবং আমার ব্যক্তিগত জীবনের যোগাযোগ রয়েছে। আর যেই মেসেজটা দেয়া আমার মূল উদ্দেশ্য সেই বিষয়টা আমি যতটুকু ধারণা করতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে অত্যন্ত সেনসিটিভ এবং ভয়ংকর, আমি এইমুহূর্তে আমার জীবনের ঠিক যে- অবস্থায় আছি তাতে তো বটেই। বিশেষ করে আমার যদি ভুল না হয় তবে এখান থেকে যা হতে যাচ্ছে তাতে অবশ্যই আমার কিছু না কিছু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, ‘ এই জায়গাটা পর্যন্ত বলে সে সামান্য মাথা নাড়ল। ‘আসলে কিছু হওয়ার যে সম্ভাবনার কথা আমি বলছি তাতে আমার শরীরিক ক্ষতি, গুম হয়ে যাওয়া কিংবা খুন হয়ে যাওয়া তো বটেই এমনকি আরো খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভবনাও একেবারে বাতিল করে দেয়া যায় না,’ এইটুকু বলে জুলহাস নিজের একটা আঙুল তুলল।
সে কথা বলতে বলতে দারুণ কনফিডেন্ট ফিল করতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে নিজের সহজাত স্বভাবের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ‘আমি চাই আমার এই ভিডিও যেন কারো দেখার প্রয়োজন না হয় কিন্তু যদি কেউ দেখেন সে যেই হোক না কেন, হয়তো ভাবতে পারেন মৃত্যু, গুম হয়ে যাওয়া কিংবা শরীরিকভাবে ক্ষতি হওয়ার চেয়েও বড়ো ক্ষতি আর কী হতে পারে। পারে,’ জুলহাস কথাটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে আবারো মাথা নাড়ল। আপনার কাজের জন্যে যদি আপনার পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের সাফারার হতে হয়, কিংবা আপনার নিজের কাজের জন্যে কিংবা আপনি যা করেননি সেটার জন্যে আপনার সারাজীবনের সম্মান ধুলোয় লুটাতে হয় কিংবা আপনাকে সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে বদনাম করে দেয়া হয়, চেনা- অচেনা মানুষ সবাই আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করে তবে সেটা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। আমার লড়াই যাদের সঙ্গে তারা এমনটা করার ক্ষমতা রাখে, এইটুকু বলে জুলহাস সামান্য অস্বস্তি বোধ করল। ‘আমার জানামতে ঠিক এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে আজ একজনের সঙ্গে। যাক গে সে বিষয়ে পরে বলব কিংবা বলব না। মূল কথায় আসি, অনেক কথা বলেছি এবং আরো অনেক কথা বলব। কাজেই আমাকে ধৈর্য ধরে বলতে হবে। এতসব কথা বলার পেছনে প্রথম কারণটা হলো আপনাদের বোঝানো যে আমি যা করতে যাচ্ছি তার পেছনে কারণ আছে, আমি কোনো পাগলামি করছি না, সেই সঙ্গে আমি বোকার মতোও কিছু করছি না। আর আমার প্রতিপক্ষ কে বা কারা—সেটা পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও এটা পরিষ্কার যে তারা অত্যন্ত ভয়ংকর এবং ক্ষমতাবান। আর আমার এই ভিডিও বার্তা বানানোর পেছনে এটাই মূল কারণ। আমার যাই হোক না কেন, এই ভিডিও এবং রিয়েল টাইমে শ্যুট করা এই ভিডিও প্রমাণ করবে যে আমি পাগল, খারাপ কিংবা ভুল নই। আমি যা করছি এর পেছনে কারণ আছে, সেই সঙ্গে আমি যা জানি সেটাও সবাইকে জানানোর কারণ আছে। আমার কিছু হলেও কিংবা আমি হারিয়ে গেলেও যাতে, মানুষের কাছে বার্তাটা পৌঁছায় এবং কেউ না কেউ আমার জায়গা থেকে এই ঘটনার সুলুক সন্ধান করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি আমি যদি এইরকম কিছুর পেছনে লাগতে পারি তবে অবশ্যই আমার পরেও কেউ এমনটা করতে পারে। যদি করাপশন খারাপ কিংবা যাই থাকনা কেন, কেউ কেউ সত্যটা জানতে চাইবেই, সবসময়ই। আর সে উদ্দেশ্যেই আমার এই ভিডিও বানানো। যাকগে মূল কথায় আসি।’
এই পর্যন্ত বলে জুলহাস ভিডিওটায় বিরতি দিল। কথা বলতে বলতে ঘেমে গেছে। ক্যানের অবশিষ্ট শরবতি কোকটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে সেই সিগারেটটা ধরাল। ওটা টানতে টানতে ল্যাপটপের পাশে রাখা চেকলিস্টটা দেখে নিল শুরুতে কিছু মিস করে গেছে কি-না। নাহ, কিছু মিস করেনি, দু-চারটা বিষয় বেশি বলেছে কিন্তু মিস করেনি কিছু। সিগারেট শেষ করে আবার ল্যাপটপের বাটনের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করেছে রিজিউম করার জন্যে কিন্তু সেটা করার আগেই ধাম ধাম করে শব্দ হলো তার দরজায়।
২
ক্ষণিকের জন্যে জুলহাসের হাত চলে গেছিল টেবিলের ঠিক পাশেই থাকা বিছানাটার বালিশের দিকে। হাতটা বালিশের নিচে গিয়েই খপ করে ধরে ফেলল পিস্তলটা। এই সময়ে কে নক করছে, ঠিক বুঝতে পারছে না ও। তাও এভাবে। পিস্তলটা বালিশের নিচ থেকে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে আলগোছে সেটাকে সে গুঁজে দিল নিজের প্যান্টের পেছন দিকে। আপনাতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিল টেবিলে, টেবিলের ওপরে রাখা ল্যাপটপ আর হার্ড ডিস্কের দিকে। সেই সঙ্গে টেবিলের পাশে রাখা ব্যাগটার দিকেও। চমকে উঠলেও সে ঠান্ডা মাথায় ভাবার এবং বোঝার চেষ্টা করছে কে আসতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে—
আবারো ধাম ধাম করে শব্দ হলো দরজায়।
জুলহাস নিঃশব্দ পায়ে চলে এলো জানালার পাশে। সেখান থেকে দরজার বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে যাকে দেখতে পেল তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সে দরজার সিটকিনি নামিয়ে সেটাকে মেলে ধরল। ‘চাচি, আপনি এই সময়ে, এত জলদি,’ হাতের স্মার্ট ওয়াচে সময় দেখে নিল সে একবার।
‘আরে জুলমিয়া, তুমিই না কইছিলা আইজ জলদি আইতে সাতটার ভেতরে খাওন দিতে, তুমিই এহন ভুইল্লা গেছুইন,’ মোটা মতো দেখতে পুরনো শাড়ি পরা এক বয়স্ক মহিলা হাতে টিফিন বাটির মতো একটা পাত্র হাতে নিয়ে ঢুকে পড়ল কামরার ভেতরে। কি অইল আন্ধারই ক্যান, কুনোহানে যাইতাছো নাকি?’ বাটির খাবার রাখতে রাখতে সে খানিকটা অবাক হয়েই বলে উঠল। জুলহাসের জন্যে খাবার রান্না করে যে-মহিলা সেই চাচি এসেছে।
‘জি চাচি, একটু যাইতে হবে,’ ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠল জুলহাস। চাচিকে সে যে আগে আসতে বলেছিল আজ সেটা ভুলেই গেছিল। এটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। শেষ সময়ে এসে ঠিক যে-সময়ে ওর সবচেয়ে বেশি মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত সেইসময়ে সে কি না সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে ভুলভাল করছে। ভুইল্লা গেছিলাম চাচি, আপনে খাবার রাখেন, আর শোনেন।
মানিব্যাগ হাতে নিয়ে ওটা থেকে টাকা গুনতে গুনতে, সে এসে দাঁড়াল চাচির সামনে। এই টাকাগুলা রাখেন চাচি। আপনাকে কাল থেকে আর খাবার আনতে হবে না।’
‘ক্যান বাপজান খাওন বালা অইতাছে না? তুমি কইলে কাইল ঠিক করছি গরুর গুস্তু রানমু। তুমি—’
চাচি মন দিয়ে শোনেন, জুলহাস টাকাগুলো মহিলার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে উঠল। ‘এইখানে অনেকগুলা টাকা আছে। আপনি চাইলেই এই টাকা দিয়ে কয়েক মাস চলতে তো পারবেনই, আপনে বাড়িত যে জমি কিন্না ফার্ম দিতে চাইতেছিলেন সেইটাও করতে পারবেন।’
‘বাবা আমি এত টাকা ক্যামনে তোমারে ফেরত-’
‘শোনেন আপনাকে টাকা ফেরত দিতে হবে না। এই কয়দিন আপনে যেমন রানছেন, খাওয়াইছেন আপনের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। আমার কোনোদিন মা ছিল না, থাকলে আপনের মতোই হইতো। যাকগা। তবে একটা কাজ করতে হবে,’ জুলহাস মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘ভুলেও এই বাড়িতে আর আইসেন না,’ জুলহাস কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। ‘আমি আবারো বলতাছি, ভুলেও না। পারলে আজকেই এখনই এই এলাকা ছাড়েন। বাড়িত চলে যান, না হলে অন্য কোনোখানে। আর যদি কোনোদিন কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করে পরিষ্কার বলবেন আমারে চিনেন না। বুঝছেন?’ শেষ কথাগুলো ওর প্রায় ধমকের মতো শোনাল।
‘বাবা তোমার কি কোনো বিপদ, তুমি চাইলে আমাগো গেরামের বাড়িত—’
‘চাচি আপনে দোয়া রাখবেন তাইলেই হবে, আর এই এলাকা ছাইড়া দেন যত দ্রুত সম্ভব। আপনার গ্রামের ঠিকানা তো আমি জানি, যদি বেঁচে থাকি একদিন গিয়ে হাজিরও হয়ে যেতে পারি। টাকাগুলা দিয়ে সুন্দর করে বাড়ি সাজায়ে রাইখেন।
মহিলা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই জুলহাস দ্রুত তাকে বিদেয় করে দিল। আবারো এসে বসে গেল ল্যাপটপের সামনে ভিডিও ওপেন করে কথা বলতে শুরু করল। দ্রুত ভিডিও সেরে, খেয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, সম্ভব হলে এই কামরাটা পুরোপুরি ডেস্ট্রয় করতে পারলে ভালো হতো, আচ্ছা সে দেখা যাবে সময়ে। আগের কাজ আগে।
‘আমার এই ভিডিও বানানোর উদ্দেশ্য তো জানালাম, এবার আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে খানিকটা বলে নেই,’ জুলহাস বড়ো করে একবার দম নিল। আবারো অতীতের সেই বিচিত্র স্মৃতি রোমন্থন করতে হবে। ‘আমি একরকম বলতে গেলে জন্ম থেকেই এতিম, এতিমখানাতেই বড়ো হয়েছি। আমার জন্ম কিংবা বাবা- মায়ের পরিচয় আমি জানি না। এতিমখানার দাপ্তরিক কাগজপত্রেও কখনো আমার বাবা-মায়ের পরিচয় লেখা ছিল না। শুধু লেখা আব্দুর রউফ নামে এক শ্রমিক নাকি কন্সট্রাকশন সাইটে আমাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। শ্রমিক রউফ, যাকে আমি পরবর্তীতে রউফ চাচা আবার মাঝেমধ্যে ছোট বাবা বলে ডাকতাম আমি, দরিদ্র মানুষ ছিলেন, চাইলেও একটি শিশুর ভার বহন করার মতো ক্ষমতা তার ছিল না। আর তাই উনি আমাকে এতিমখানায় দিয়ে দেন কুড়িয়ে পাবার পরপরই। তবে রউফ চাচা মানুষ ভালো ছিলেন। দরিদ্র মানুষ কিন্তু তার আত্মা বড়ো ছিল, নিজের পরিস্থিতির কারণে আমাকে এতিমখানায় দিয়ে দিলেও সে কোনোদিনই আমার কথা ভুলে যায়নি, চিরকালই আমার খোঁজ রেখেছে। নিজের সন্তানের মতোই সে এতিমখানায় মাঝেমধ্যে খাবার আর খেলনা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করত। ঈদের সময় জামা-কাপড় দিত। তবে তার সেই ঋণ আমি শোধ করতে পারিনি, আমি সমর্থবান হওয়ার আগেই ক্ষয় রোগে ভুগে মারা যান দরিয়াদিল মানুষটা।’
যাই হোক এটা রউফ চাচা আর আমার গল্প নয়, সেই এতিমখানার গল্প যেখানে আমি বড়ো হয়েছি। আমাকে কুড়িয়ে পাবার গল্প আমি অনেক পরে শুনেছি। জ্ঞান হওয়ার পরই যা মনে পড়ে সেটা হলো—আমি ছিলাম একদল নানা বয়সী শিশুদের মাঝে। সর্বক্ষণই ক্যা ক্যা করত একপাল শিশু, যারা একসঙ্গে খায় একসঙ্গে ঘুমায় একসঙ্গে টয়লেট পর্যন্ত করে। যারা ভাবেন যে এতিমখানা মানেই মাদ্রাসা, তাদের ধারণাটা একেবারেই ভুল। যেসব মাদ্রাসায় এতিমখানা আছে সেটা স্রেফ এক ধরনের এতিমখানা। এর বাইরেও আরো নানা ধরনের এতিমখানা আছে। সরকারি এতিমখানা, বেসরকারি এতিমখানা, এনজিও চালিত এতিমখানা ইত্যাদি নানা ধরনের এতিমখানা রয়েছে। আমাদের সমাজে আমরা নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করি আর ভাবি আমাদের জীবনটা কত কষ্টের। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরে কত বিচিত্র ধরনের জীবনযাত্রা রয়েছে আপনাদের কোনো আইডিয়াই নেই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। যেমন পরবর্তী জীবনে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম গণরুমে থাকা পোলাপানের আহাউহু শুনে আমি ভেতরে ভেতরে হাসতাম। এতিমখানার জীবন খুব বিচিত্র, কষ্টে ভরা আবার অদ্ভুত কিছু প্রাপ্তিতেও ভরপুর ছিল। যেমন সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল দুটো; কঠিন নিয়মের ভেতরে চলতে হতো তাদের, এটা সমস্যা না, কিন্তু ছোট শিশুরাও নিয়মের সামান্য হেরফের করলেই প্রচণ্ড মার পড়ত। এই মারের কোনো আগামাথা ছিল না। মারতে মারতে মাঝেমধ্যে মরেও যেত ছোট ছোট ছেলেরা। দ্বিতীয় বিষয় ছিল খাবার। আমি বড়ো হওয়ার পর অনেক এতিমখানায় দেখেছি বাচ্চাদের এখন খুব ভালো খাওয়ানো হয়, কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে খাবার ছিল ভয়াবহ রকমের খারাপ। সকালে একটা রুটি আর মণ্ডের মতো গোলানো সবজি। এই রুটি আর সবজি কোনোটাই ঘণ্টাখানেকের বেশি পাকস্থলীতে থাকত না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে এই খাবার ওই বয়সের ভয়াবহ ক্ষুধার ভেতরে আরো তীব্র আগুন জ্বালিয়ে দিত। তবে এই ভয়াবহ মার, ক্ষুধার জ্বালা এগুলো সমস্যা হলেও কোনোটাই মূল সমস্যা ছিল না। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল অদ্ভুত এক অসহায়ত্ব, জুলহাস না চাইতেও ওর বুক চিরে এক লম্বা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
‘যারা সাধারণ জীবনযাপন করে তাদের জীবনে অনেক সমস্যা আছে, হাসি- আনন্দ দুঃখ আছে কিন্তু যাদের বাবা-মা নেই, জন্ম থেকেই জন্ম পরিচয় নেই, তাদের জীবনটা কেমন হয় তাদের ভেতরটা যে আসলে ঠিক কতটা হাহাকারে ভরা থাকে এটা কোনোদিনই অন্যকারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমার মাথার ওপরে কোনো ছায়া নেই, আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই, আমার মৃত্যু কাউকে কাঁদাবে না—এই অনুভূতির চেয়ে বাজে অনুভূতি মানব ইতিহাসে আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাবেও না। আর আমার গল্পের শুরুটাও ঠিক এই জায়গা থেকেই।’
‘আগেই বলেছি আমাদের এতিমখানাটা মাদ্রাসার এতিমখানা ছিল না। আদৌ কিসের এতিমখানা ছিল আমি নিজেও জানি না সঠিকভাবে। তবে এটা পরিষ্কার মনে আছে বেশির ভাগ শিক্ষকই ছিল বয়স্ক এবং প্রায় সব ধর্মের শিক্ষকই ছিল ওই এতিমখানায়। আর এতিমখানার বাজেটও একেবারে খারাপ ছিল না। আমাদের জীবনযাত্রার মানও একেবারে খারাপ ছিল তা বলা যাবে না কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে শিশুদের অত্যধিক কড়া শাসনে রাখা হতো। এতিমখানা কম বরং কিশোর শোধনাগার বেশি মনে হতো প্রতিষ্ঠানটাকে। যথেচ্ছা পেটানো হতো, ছেলেপেলেদের, সেই সঙ্গে খাবার ছিল খুবই বাজে। এর ফলে যেটা হতো যারাই ওখানে থাকত প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের ভেতরে গড়ে উঠত অদ্ভুত এক বন্ধন। ছেলেপেলেদের ভেতরে যে শত্রুতা কাড়াকাড়ি ইত্যাদি ছিল না তা নয়, তবে সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। এমনকি শত্রুতা থাকলেও সারভাইবালের প্রয়োজনেই প্রয়োজনের সময় সবাই একজোট হয়ে যেত আর শিক্ষকরাও এটা বুঝত যে কারণে কোনো একটা ঘটনা ঘটলে যখন সবাই মিলে একজোট হয়ে সব অস্বীকার করত তখন আরো বেশি মার পড়ত আমাদের ওপরে। তীব্র মারের চোটে কখনো আমরা জ্ঞান হারাতাম, আবার কখনো কখনো মারতে মারতে শিক্ষকরা ক্লান্ত হয়ে যেত কিন্তু আমরা ভাঙতাম না। তখন আমাদের ভাঙার জন্যে আরো বিচিত্র সব শাস্তি দেয়া হতো। যেমন, অন্ধকার বাথরুমে আটকে রাখা, দিনের পর দিন আলাদা রেখে খেতে না দেয়া, রাতের বেলা ভুতুড়ে কামরায় একা আটকে রাখা, এমনকি কখনো কখনো লোহার রড গরম করে ছ্যাকা তো বটেই এমনকি হাত পায়ের আঙুল আর কানের লতিতে পিন ফোটানোর ঘটনাও ঘটত। আমি জানি না এগুলোর নজরদারির জন্যে কোন মানবাধিকার সংগঠন ছিল কি না, কিন্তু এসব আমাদের সঙ্গে ঘটত এসব। মোদ্দাকথা, যেকোনো উপায়ে সবশেষে আমাদের ভাঙা হতোই। ছোট শিশু আমরা কতক্ষণ টিকব আমরা! কিন্তু কিছু মানুষ কখনোই ভাঙত না। যেমন আমার বন্ধু টোকন। আর আমার এই কাহিনির মূল চরিত্রও এই টোকন। যার জন্যে আজকে এতকিছু।’
মৃদু কাশি দিয়ে বলতে লাগল জুলহাস। ‘এসব এতিমখানাতে একদিকে সারভাইভাল ভয়ংকর রকমের কঠিন একটা বিষয় তার ওপরে খাওয়া-দাওয়া-হাগা- মুতা সবই করতে হয় একসঙ্গে, এর ফলে যেটা হয় যে যত বিভেদই থাকনা কেন, কিছু মানুষের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক হয়ে ওঠে আত্মার মতো। আমি, টোকন আর হরি, আমরা তিনজনই ছিলাম ঠিক এই একই আত্মার বন্ধু। আসলে এসব এতিমখানায় যে-ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এটা ঠিক বন্ধুত্ব বললে এর গভীরতা ঠিক বোঝানো যায় না। এইসব জায়গাতে আমার, টোকন বা হরির মতো ছেলেদের ভেতরে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেটার বহু মাত্রা থাকে। উদাহরণ দিয়ে বলি, হয়তোবা আমি এখানে একটু বেশিই বিশদ বলছি কিন্তু পরবর্তী ঘটনা বোঝার জন্যে আমাদের সম্পর্কের ধরন এবং গভীরতা বোঝার প্রয়োজন আছে। ধরেন আপনি আদর-শাসন পান আপনার বাবা-মা কিংবা বড়ো ভাই বোনের থেকে, খুনসুটি করেন হয়তো ছোট কিংবা বড়ো ভাই-বোনের সঙ্গে কিংবা কাজিনদের সঙ্গে। আবার হয়তো প্রথম সিগারেট টানা বা প্রথম সেক্সুয়াল গল্পের বই পড়া কিংবা পর্ন দেখা এগুলো হয় বন্ধুদের সঙ্গে। ঠিক যেভাবে বন্ধুরা আপনাকে শাসন করবে না, আবার তেমনি আপনি বাবা- মায়ের সঙ্গে বিড়ি টানবেন না। কিন্তু আমাদের মতো ছেলেদের না থাকে বাবা-মা না থাকে ভাই-বোন, না থাকে কাজিন বা আত্মীয়স্বজন। আমাদের যদি কেউ থেকে থাকে তো একমাত্র এসব ন্যাংটাকালের সহযোগী, যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি আবেগের, ভাই-বোনের চেয়ে গভীরতম আর বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু। আর তাই আমরা একসঙ্গে বিড়িও খাই, একে অপরকে শাসনও করি, রাগ করে দূরে যাওয়ার থ্রেটও দিই, আবার একসঙ্গে চটি বইও পড়ি।’
শেষ বাক্যটা বলে বড়ো করে একবার দম নিল জুলহাস। আসলে দম নয় দীর্ঘশ্বাস। মানুষের স্মৃতি যেমনই হোক চাইলেও তাকে পুরোপুরি ভুলিয়ে দেয়া যায় না। ‘তো আমি টোকন আর হরি ছিলাম তেমনই হরিহর আত্মা বন্ধু, আমাদের ভেতরে সম্পর্কের কোনো বাউন্ডারি ছিল না। কেউ কাউকে রক্ষা করার জন্যে পারলে পরস্পরের জান দিয়ে ফেলতাম। আমরা এতিমখানায় যারা ছিলাম, সবার সঙ্গেই সবার তিক্ত-মধুর সম্পর্ক ছিল কিন্তু আমরা তিনজন ছিলাম অন্যরকম। আমাদের ভেতরে আবার হরি ছিল এতিমের এতিম। আমরা যদি হতভাগা হয়ে থাকি তবে সে ছিল মহা হতভাগা। আমার কেউ না থাকলেও রউফ চাচা ছিল, টোকনেরও একইরকমভাবে দূরসম্পর্কের কোনো খালা না কে জানি ছিল, যারা মাঝেমধ্যে হলেও তাকে দেখতে আসত। কিন্তু হরির একেবারেই কেউই ছিল না। সে ছিল এতিমেরও এতিম, তাকে কোনো এক হিন্দু পাড়া থেকে কেউ একজন দিয়ে গিয়েছিল বিধায় তাকে হরি ডাকা হোত। কে তাকে এই নাম দিয়েছে বা আদৌ তাকে এই কারণেই এই নামে ডাকা হোত কি না সেটাও আমরা জানি না। তো যাই হোক যেভাবেই হোক আমাদের দিন পার হচ্ছিল। আমরা যে এতিমখানায় থাকতাম সেখানে ব্যবস্থা আর অন্যসব যতই খারাপ হোক না কেন, একটা বিষয় ভালো ছিল, পড়ালেখার ব্যবস্থা। আমাদের এতিমখানার নিয়ম-কানুন অনেক বেশি কড়া হওয়ার কারণেই কি না কে জানে ছেলেপেলেরা পড়ালেখায় বেশ ভালো করত এবং সত্যি কথা হলো আমরাও পড়ালেখায় ভালো ছিলাম। আরেকটা বিষয় ছিল আমাদের এতিমখানায় মাঝেমধ্যে খুব ভালো ভালো পরিবার ছেলেপেলেদের দত্তক নিয়ে যেত। মানে আমরা তাই জানতাম আরকি।’
‘তো আমাদের দিনকাল নিয়মিতই চলছিল, এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে। ঘটনাটা একদিকে ভালো হলেও আমাদের জন্যে ছিল বিরাট একটা ধাক্কা। প্ৰকৃতি মানুষকে কিছু না দিলেও আবার কখনো কখনো কিছু না কিছু একেবারে দুহাত ভরিয়ে দেয়। আমাদের তিনজনের ভেতরে হরির কেউ না থাকলেও কিছু না থাকলেও ছেলেটা ছিল একেবারে রাজপুত্রের মতো দেখতে। আর তাই আমরা যখন কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে সেইসময়ে বেশ বড়লোক একটা পরিবার আসে আমাদের এতিমখানাতে এবং হরিকে পছন্দ করে তাদের দত্তক ছেলে হিসেবে, তখন আমরা খুশিও হয়েছিলাম আবার বেশ দুঃখও পেয়েছিলাম। যেদিন হরিকে নিয়ে যাওয়া হবে আমার মনে আছে, আগের দিন সারারাত আমরা তিন বন্ধু ঘুমাতে পারিনি। এমনকি ওই সময়েও নিজেদের কিছুই না থাকার পরও যৎসামান্য জোগাড় দিয়ে হরির জন্যে ওর পছন্দের লজেন্স আর বাটার বন এনেছিলাম এতিমখানার এক দারোয়ানকে হাতে- পায়ে ধরে। আহারে জীবন, পরবর্তী জীবনে যখন অনেককিছুই পেয়েছি, বড়ো বড়ো সব জায়গায় খেয়েছি সেদিন সকালের তিন বন্ধু মিলে ভাগ করে খাওয়া সেই বাটার বন আর লজেন্সের মতো স্বাদ আর কোনোদিন কোনোকিছুতেই পাইনি। হরির খুব পছন্দের ছিল ঘড়ি, সেই সময়ের রঙবেরঙের চকচকে ক্যাসিও ঘড়ি। অনেক ইচ্ছা ছিল হরিরে একটা কিনে দেব আমি আর টোকন মিলে, পারিনি। যেদিন হরিকে নিতে আসবে সেদিন শেষ মুহূর্তে হরি বেঁকে বসেছিল, হাজারো অর্থবিত্ত আর সুখী জীবনের হাতছানি তাকে এই পুতিগন্ধময় বিশ্রী এতিমখানা আর বন্ধুদের ছেড়ে যেতে দিচ্ছিল না,’ জুলহাস আনমনে মাথা নাড়ল। চোখ ছলছল হয়ে উঠেছে ওর, পুরনো দিন আর বন্ধুদের কথা মনে করে, কবির কথাটা আর চাইলেও বলতে পারল না সে। ‘হরি চলে গেল। আমরা শুনেছিলাম খুব ভালো পরিবারে স্থান হয়েছে ওর। অনেক সুখে আছে, ভালো আছে। হরি সেই পরিবারের সঙ্গে কেমন আছে, সুন্দর কাপড়-চোপড় পরে স্কুলে যাচ্ছে, ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে সেসবের গল্প শুনতাম এতিমখানার দারোয়ান – আয়া এদের কাছে। আমার আর টোকনের ভালো লাগত এটা ভেবে যে বন্ধু আমাদের অনেক ভালো আছে। কিন্তু আবার ভেতরে ভেতরে হিংসাও যে লাগত না তা নয়, মানব মস্তিষ্ক। আমাদের কোনো আশা ছিল না কারণ সাধারণত যেসব ছেলেপেলেদের ভালো ভালো পরিবার অ্যাডপ্ট করে নিত, এরা সাধারণত আর কখনোই এতিমখানার দিকে ফিরেও তাকাত না, বা কখনো ফিরে আসত না। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমাদের বন্ধু হরি এমনটা করবে না, সে অবশ্যই যেভাবেই হোক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তবতা এক জিনিস নয়। আমরা যা ভেবেছিলাম তেমনটা হয়নি। হরি কোনোদিনই যোগাযোগ করেনি বা করার চেষ্টা করেনি আমাদের সঙ্গে।’
‘হরির চলে যাওয়ার পর আমাদের জীবনটা অনেক বদলে গেছিল। আমাদের জীবনটা দুঃখের কিংবা কষ্টের হলেও আমাদের জীবনে আনন্দেরও কোনো কমতি ছিল না। প্রাপ্তিগুলো হয়তো অনেক ছোট আর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বড়ো ছিল, কিন্তু এর মাঝেও ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নিতে ভুল করতাম না আমরা। কিন্তু হরির সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাদের জীবন থেকে ছোট ছোট আনন্দগুলোও চলে গেছিল। তবে আমাদের বন্ধুত্বের ওপরে ভরসা ছিল আমাদের। বিশ্বাস ছিল হরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। হয়তো, আজ নয় কাল, কিংবা হয়তো সে আরেকটু ঠিক হয়ে নিতে চাইছে, এরপরেই যোগাযোগ করবে কিন্তু হরি সেটা করেনি। আমরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি, বারবার ভেবেছি কালই হয়তো ওর কোনো চিঠি বা কিছু একটা আসবে কিন্তু সেটা আসেনি। আমাদের বন্ধু আসলেই ভুলে গেছিল আমাদের,’ এইটুকু বলতেই মোবাইলটা বাজতে লাগল জুলহাসের, আপনাতেই ওর দৃষ্টি চলে গেল মোবাইলের স্ক্রিনের ওপরে, সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর।
৩
ক্ষণিকের জন্যে জুলহাস একটু দ্বিধায় পড়ে গেল কলটা কি রিসিভ করবে নাকি করবে না। ভিডিওটায় বিরতি দিয়ে, রিসিভ করল কলটা কিন্তু কথা বলল না ও, ওপারের ব্যক্তিটাও ওর কথা শোনার জন্যে খুব আগ্রহ দেখাল না। সে তার যা বলার চুপচাপ বলে গেল চল্লিশ সেকেন্ডের মতো, তারপর কেটে গেল কলটা। মিনিটখানেক পরেই আরেকটা নম্বর থেকে কল করল একই মানুষ। আবারো চল্লিশ সেকেন্ড কথা বলে সে কল কেটে দিতেই, জুলহাস উত্তেজনার সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কামরার পুরনো টিভিটা খুলে একের পর এক চ্যানেল পালটে দেখতে লাগল, কিন্তু যা দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে ছিল সেরকম কিছু পেল না। টিভি বন্ধ করে আরেকবার ঘড়ি দেখল, যেহেতু এখনো কিছু হচ্ছে না, কাজেই খানিক সময় আছে ওর হাতে। খবারের টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে পেটটা ক্ষুধায় সামান্য মোচড় দিয়ে উঠল ওর। একবার ভাবল খেয়ে নেয় কিন্তু সিদ্ধান্ত নিল না আগে ভিডিওটা দ্রুত শেষ করাটা বেশি জরুরি। এরপর বাকিসব হবে, আর সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
আবারো ল্যাপটপের সামনে বসে ভিডিওটা অন করল জুলহাস। হরির এই আচরণে আমাদের এতিমখানাতে কারো কিছু আসে যায়নি। এমনটাই ঘটে সবসময়, সবাই জানত এমনটাই ঘটবে এবারও। আমি আর টোকনই বোকার মতো ভেবেছিলাম এবার ভিন্ন কিছু হবে। আর তাই কারো কিছু না হলেও আমাদের দুজনার ভেতরে একটা বড়ো পরিবর্তন চলে এসেছিল। আমরা গার্ড, কেয়ারটেকার শিক্ষকদের কাছে যত শুনতাম হরির ভালো থাকার আর সুন্দর জীবনের গল্পগুলো আমাদের প্রথমে ভালো লাগত, এরপর ধীরে ধীরে ভেতরটা পুড়তে শুরু করল। আমরা দুজনে প্রতিজ্ঞা করলাম যা প্রকৃতি কিংবা সমাজ আমাদের দেয়নি, আমরা সেটা প্রকৃতি, সমাজ আর পারিপার্শ্বিকতা থেকে ছিনিয়ে নেব। ভালো থাকার অধিকার আমাদেরও আছে, হয়তো জন্মগতভাবে পাইনি সেটা, কিন্তু চাইলে সম্ভব। আর আমরা দুজনেই বুঝতে পারি, এই ভালো কিছু করতে হলে, জীবনে ওপরে উঠতে হলে একটাই উপায় আছে, পড়ালেখা করা। আমরা তখন কৈশোরের সায়াহ্নে, এতিমখানার কাজকর্ম ইত্যাদি সেরে পড়ালেখার জন্যে যথেষ্ট সময় দেয়া হতো আমাদের, আমরা সেই সময় তো বটেই এর বাহিরে রাতে যখন যেভাবে সুযোগ পেতাম পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, এর ফলে একটা সময় যেটা হলো, আমাদের খারাপের ভেতরেও দু-চারজন ভালো লোকের চোখে পড়ে গেলাম আমরা দুজন বিশেষ করে ক্লাস এইটে, অমন জায়গা থেকে দুজনেই যখন ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়ে গেলাম ওটা সেইসময়ে এতিমখানাতে একটা ঘটনাই ছিল। আর সেই জোরে আমরাও অনেকটাই এগিয়ে গেলাম। এতিমখানাতে এর আগে বাইরের কোনো অথরিটির সংযোগ বা নজরদারি ছিল না। কিন্তু বৃত্তি পাওয়াতে তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তার নজরে পড়ে যাই আমরা। আমাদের আগে স্রেফ নিয়মের কারণে এতিমখানা থেকে এক-দুজন পাঠানো হতো বৃত্তিতে— ওরাও তেমন কিছুই করতে পারত না, আর ব্যাপারগুলোই সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকত।’
‘কিন্তু আমরা বদলে দিলাম সেই চিত্র। আমাদের দুজনার পারফরমেন্স দেখে, আমাদের জীবনের ঘটনাগুলো শুনে এতিমখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সেই অফিসার আমাদের জন্যে বিশেষ আয়োজন করে দিল। কাজেই আমাদের পড়ালেখা সুযোগ আরো বেড়ে গেল। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা ভালোভাবেই এসএসসি পাস করে ফেললাম। সাধারণত এতিমখানা থেকে ছেলেপেলেদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হতো বিভিন্ন জায়গাতে, বা কেউ পড়তে চাইলে যতটুকু পারত সেটা করা হতো। কিন্তু আমাদের তেমন কিছুই লাগল না। আমরা এসএসসি পাস করে সরকারি সহায়তায় কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। এরপর আমাদের আর কেউ থামাতে পারেনি। কলেজে উঠে কিছুটা সরকারি সহায়তায় কিছুটা টুকটাক এখানে-সেখানে পড়িয়ে পড়ে পাস করে ফেললাম এইচএসসি। যাত্রাটা যত সহজে বলছি ততটা সহজ আসলে ছিল না। প্রতি পদে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে অগ্নিপরীক্ষা। এইচএসসি পাস করে সেখান থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমি আর টোকন দুজনেরই নিয়ত ছিল যেকোনো উপায়ে দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবো। সেই এতিমখানার ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম ধীরে হলেও একটু একটু করে সেদিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। আর সেই ধাপে আরেকটু এগোনোর প্রক্রিয়া ছিল দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া। দুজনেরই নিয়ত ছিল সিএসইতে পড়ব আমরা। দুজনে চান্স পেয়েছিলাম কিন্তু কপাল খারাপ দুজনে এক জায়গায় চান্স পাইনি। কিন্তু দুজনে দুই জায়গাতে পড়লেও আমাদের দুজনার ভেতরে কখনোই দূরত্ব তৈরি হয়নি। বরং একই ফিল্ডে পড়া এবং কাজ করাতে আমরা সবকিছু নিজেদের ভেতরে শেয়ার করতাম। অনার্স কমপ্লিট করে দুজনে কাজও নিয়েছিলাম একই আইটি ফার্মে।’
‘সবই ঠিকঠাক চলছিল, এমন সময় একটা ঘটনা আবারো বদলে দেয় আমাদের জীবন,’ বলে আবারো দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল জুলহাস। ‘একেক ঘটনা এক এক মানুষের ওপরে একেক ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমন হরির আমাদেরকে ভুলে যাওয়া কিংবা আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ না করা আমার ভেতরে হিংসা এবং চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছিল কিন্তু সেটা কোনো ক্ষোভের সৃষ্টি করেনি। কিন্তু টোকনের ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল—সে সবসময়ই ব্যাপারটা নিয়ে আফসোস করত, সে বলত সে অবশ্যই সুযোগ হলে জীবনে একবারের জন্যে হলেও হরির সামনাসামনি দাঁড়াতে চায় এবং তাকে জিজ্ঞেস করতে চায় নতুন জীবন তাকে কী এমন দিয়েছে যে একবারের জন্যে হলেও সে নিজের বন্ধুদের কথা মনে করল না। ও প্রায়ই আমাকে এই কথাগুলো বলত, আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। আমার বক্তব্য ছিল খুবই সহজ এবং সরল। হরির চলে যাওয়া কষ্ট দিয়েছিল আমাকে আর সেই থেকে যে চ্যালেঞ্জের জন্ম হয়েছিল আমার ভেতরে সেই চ্যালেঞ্জের বশেই আমি আজকে আমার যে জীবন— সেই জীবন অর্জন করতে পেরেছি। কাজেই আগে যা ঘটেছে, সেই ব্যাপারটা নিয়ে অত মাথা ঘামিয়ে এত কষ্ট করে অর্জন করা জীবনকে জটিল বানিয়ে লাভ কি? কিন্তু টোকন এমনটা ভাবত না, ওর হিসেব ছিল ভিন্ন। আসলে কেন জানি ও কখনো বিশ্বাসই করত না পুরোপুরি যে হরি এভাবে আমাদেরকে ভুলে গেছিল।’
যাই হোক, আমরা পেশাগত জীবনে ভালো করছিলাম, ধীরে ধীরে নিজেদের পেশাগত জীবন গুছিয়ে একটু একটু করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, এমন সময় টোকন আবারো আমাকে বলে যে ও হরিকে খুঁজে বের করতে চায়। সেদিন আমার একটু মেজাজই খারাপ হয়েছিল। খানিকটা বাজেভাবেই ওকে আমি ধমকে দিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে সে কী করছে বা এই বিষয়ে কী ভাবছে—আমার সঙ্গে আর শেয়ার করেনি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ও একটু একটু করে ভেতরে ভেতরে হরির খোঁজ করছে। ওই দিনের পর প্রায় বছরখানেক কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন রাতের বেলা টোকন বাসায় ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। আমি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছি না হঠাৎ হলো কি। ও খানিকটা ধাতস্থ হতে আমি ওর কাছ থেকে যা শুনি, তাতে খানিকটা অবাকও হই আবার বিরক্তও হই ওর ওপরে। আমাকে না জানিয়ে ও বিগত এক বছর ধরে হরিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। ও আমাদের পুরনো এতিমখানা, আমাদের পুরনো বন্ধুবান্ধব—এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খোঁজ করেনি কিন্তু কোনোভাবেই সে হরিকে খুঁজে বের করতে পারেনি।’
‘কথাটা শুনে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল আমার। রাগে চিড়বিড় করে উঠেছিল আমার। এত কষ্ট করে যে জীবন গড়েছি আমরা সেই জীবনকে কি না ছেলেটা কলুষিত করার চেষ্টা করছে, আমাদের অতীতের জমা থাকা এক ক্ষোভ দিয়ে। কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও আমি থেমে গেলাম। কারণ টোকনের অবস্থা তখন এমন যে ধমক তো দূরে থাকুক ওকে কীভাবে সামলাব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। একে তো সে একটা গভীর ইমোশনাল যাত্রার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল, যে যাত্রাটা সে শুরু করেছিল বহু আগে সেই শৈশবে। আর সেই যাত্রার শেষ পর্যায়ে ছিল শুধু হতাশা। কাজেই যতই বোকামি আর পাগলামি করুক না কেন এরকম পূর্ণবয়স্ক শক্ত একজন মানুষ যখন শিশুর মতো ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে তাকে আর যাই হোক না কেন বকা দেয়া যায় না বা শাসন করা যায় না, আর যদি সে দুনিয়াতে আপনার একমাত্র আপনজন হয় তাহলে তো আরো সম্ভব নয়। টোকনের এমন নাজুক অবস্থা দেখে তার সঙ্গে খুব সাবধানে কথা বলি আমি। প্রথমে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করি এরপর তাকে সময় নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। অতীতে যা হয়ে গেছে তা তো হয়েই গেছে। সেটাকে নিয়ে ভেবে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা জীবনটাকে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। কাজেই আমাদের উচিত মুভ অন করা। কথা যতই ভালো হোক না কেন, শুনতে ভালোই লাগে কিন্তু মন কি আর মানে। যাই হোক টোকনের সময় লাগে কিন্তু ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে। এর ভেতরে আমি আর ও মিলে পরিকল্পনা করি দুজনে যেহেতু একই বিষয়ে আছি কাজেই দুজনে মিলে পড়ালেখা করে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করব। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে শুরু করি। দুজনে মিলে মহা উৎসাহের সঙ্গে জিআরই আর আইএলটিএসের বই কিনে এনে পড়ালেখা আর কোচিং শুরু করি। পড়ালেখা কতটা হয় কিংবা হচ্ছে—সেটার চেয়ে বড়ো বিষয় ছিল টোকনকে ভিন্ন কিছুতে ইনভলভ করা। আর তাতে কাজও হয়। প্রায় ছয় মাস চলে যায় আর টোকনও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমার পরিষ্কার মনে আছে তখন আমাদের জিআরই পরীক্ষার আর আট-দশ দিন বাকি—এমন সময় এমন এক ঘটনা ঘটে, টোকনের তো বটেই আমারও জীবন বদলে যায় একেবারেই,’ বলে জুলহাস খানিকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে থামল।
‘টোকন হঠাৎই খুঁজে পায় আমাদের বন্ধু হরিকে,’ আনমনেই মাথা নাড়ল জুলহাস। ‘খুবই অদ্ভুত আর বিচিত্র আমাদের এই জীবন। ছোটবেলা থেকেই যে হরির গল্প শুনে শুনে আমরা বড়ো হয়েছি। হরি এটা করছে, ও এত ভালো আছে, ভালো খাচ্ছে, দামি কাপড় পরে দামি গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে হরির বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা হয়ে উঠেছি শক্ত লোহা। প্রতিজ্ঞা করেছি, যেকোনো মূল্যে আমাদের জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হবে। যেকোনো মূল্যে যেকোনো অবস্থায় আমাদেরও ভালো থাকার, ভালো হওয়ার অধিকার রয়েছে। স্রেফ ভাগ্যবল নয় বরং কঠিন পরিশ্রমে সমাজ থেকে জীবন থেকে সেই অধিকার আমরা ছিনিয়ে নেব। আর সেই হরিকে আমার বন্ধু খুঁজে পেল কোনো দামি অফিসের লাউঞ্জে কিংবা দামি গাড়ি থেকে নেমে আসার সময়ে কোনো উঁচু দালানের পার্কিং লটে নয়, বরং মগবাজারের রেলক্রসিংয়ের পাশের বস্তির কাছে ভিক্ষারত অবস্থায়, জুলহাস মৃদু দুঃখের হাসি হাসল। ‘সেইদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে আমার। আমি অফিস থেকে সেদিন একটু জলদি চলে এসেছিলাম, যেহেতু কদিন পর পরীক্ষা যতটা সময় পাচ্ছিলাম, জান দিয়ে পড়ালেখা করছিলাম। টোকনও তাই করে, বরং ও আমার চেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিল পড়ালেখা নিয়ে। কিন্তু ওইদিন ওর খবর নেই। আমি কয়েকবার ফোন করলাম, ও ফোন ধরেনি। এরপর ও নিজেই কল করে কোনো কথা নেই বার্তা নেই। আমাকে প্রথমে মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে যেতে বলল। আমি জানতে চাইলাম ওর কোনো ঝামেলা বা বিপদ হয়েছে কি না। কিছুই বলে না স্রেফ যেতে বলল। ওর কোনো ইমার্জেন্সি হয়নি বুঝতে পেরে আমি গা করিনি। ও ফিরে আসে বেশ রাত করে। কোথায় ছিল জানতে চাইতেই ও উত্তেজিত হয়ে জানায়, ও হরিকে খুঁজে পেয়েছে। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। আমি ভীষণ মেজাজ খারাপ করে ওরে রীতিমতো বকাঝকা করতে লাগলাম। তখন ও জানাল, বিশেষ কাজে মগবাজার গিয়েছিল, সেখানে ওর ফ্রেন্ডের জন্যে অপেক্ষা করতে বলছিল মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে। এমন সময় ওখানে এক ফকিরকে ভিক্ষা করতে দেখে ওর সন্দেহ হয়, সে গিয়ে কথা বলে এবং আবিষ্কার করে ওটাই আমাদের ছোটবেলার সেই বন্ধু হরি।’
‘আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল, ওর এই কথা শুনে আরো খারাপ হয়ে গেল। কী আবল-তাবল বকছে বলাতে ও প্রথমে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, এরপর ক্ষেপে গিয়ে মোবাইল থেকে ছবি বের করে দেখাল আমাকে। শত ছিন্ন একজন মানুষ, এটা বোঝা যায়, লোকটা আমাদের বয়সী কিন্তু দেখতে দেখায় অনেক বেশি। এলোমেলো শত ছিন্ন চেহারাটা একসময় দেখতে ভালো ছিল এবং ফরসা ছিল, সেটার ছাপ শত সংগ্রামে এখনো মুছে যায়নি। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। ছবিগুলোর দূর থেকে তোলা এবং পুরোপুরি স্থির বা পরিষ্কার নয়। এই ছবি দেখে আজ থেকে পনেরো-বিশ বছর আগের একজন মানুষকে চিনে ফেলা সম্ভব নয়।হুম, তবে আমার কাছে এটাও মনে হয়েছে যে লোকটার সঙ্গে হরির মিল আছে। অন্তত নাক-চোখ একেবারেই ওরকম। এরপর টোকন ছবি জুম করে আমাকে প্রমাণ দেখায় যেটা দেখে সে নিশ্চিত হয়েছে এই লোকই আসলে হরি। সেটা হলো একটা জন্মদাগ। হরির কপালের পাশে খুবই বিচিত্র আর অদ্ভুত দেখতে একটা জন্মদাগ ছিল, ঠিক যেখানে বাচ্চাদের নজর ফোঁটা দেয়া হয় সেই জায়গাতে তার নীল রঙের একটা জন্মদাগ ছিল, যেটা একেবারেই ইউনিক। টোকন জুম করে আমাকে দেখায় এই লোকেরও ঠিক একই জায়গায় একই জন্মদাগ রয়েছে। আমি ভালোভাবে দেখে বুঝলাম টোকন ভুল বলেনি। কিন্তু এটাও ঠিক যে এভাবে এরকম একজন মানুষকে র্যান্ডমলি স্রেফ একটা জন্মদাগের জন্যে তাকে পনেরো-বিশ বছর আগের একজন মানুষ ধরে নেয়াটা কোনো বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়। এরপর আমি জানতে চাইলাম, ও কি কথা বলেছে নাকি লোকটার সঙ্গে, সে কি স্বীকার করেছে নাকি যে সে হরি।’
‘জবাবে টোকন যা বলল সেটা শুনে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। লোকটা নাকি পরিষ্কার অস্বীকার করেছে যে সে হরি নামে কাউকে চেনেই না। আমি চোখ তুলে তাকালাম টোকনের দিকে, তাকে শক্ত একটা বকা দেব এমন সময় টোকন আমাকে পরিষ্কার জানাল, সে লোকটার পিছু নিয়ে মগবাজার বস্তির কোথায় থাকে সে দেখে এসেছে এবং সে কাল ওখানে গিয়ে আবার তার সঙ্গে কথা বলবে, এবার সে আমাকেও নিয়ে যেতে চায়। আমি প্রথমে অবাক হলাম, এরপর বিরক্ত হলাম এবং সব শেষে রাগ হয়ে স্রেফ মানা করে দিলাম। আমি টোকনকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম, ও যদি পাগলামি করতে চায় করতে পারে, নিজের জীবন নিয়ে খেলতে চায় সেটা করতে পারে কিন্তু আমার দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। আমার আর দশ দিন পর পরীক্ষা, আমি এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতেও চাই না এবং মাথায় ঘিলু থাকলে টোকনেরও তাই করা উচিত। আমার এহেন জবাবে টোকন অবাক হলেও সে কোনো রকম উত্তেজনা দেখাল না, কিন্তু খুব দৃঢ়ভাবে সে জানিয়ে দিল, আমি ওর বন্ধু হতে পারি কিন্তু সে যেটা করতে চায়, ব্যক্তি হিসেবে সেটা করার অধিকার তার রয়েছে। আমি এত বিরক্ত হলাম, ওকে আর কিছু বলার এমনকি রুচিও হয়নি। পরদিনও টোকন অফিস সেরে বেশ রাত করে ফেরে। টোকনের একটা ভালো দিক ছিল কি—ও আমার মতো হৃদয়ে নিয়ে নিতো না সবকিছু। আমি কিন্তু আগের দিনে টোকনের কথায় গাল ফুলিয়ে বসে ছিলাম, টোকন ওসব ভুলেই গেছে। সে বাসায় ফিরে গল্প করতে লাগল আজ সে আবার ওখানে গিয়েছিল এবং আজ লোকটার সঙ্গে ওর বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছে। তবে এখনো সে স্বীকার করেনি যে সে হরি। আমি কোনো আগ্রহ দেখালাম না। আমি পরীক্ষার জন্যে পড়ে যেতে লাগলাম আর টোকন প্রতিদিন অফিস করে সময় কাটাতে লাগল মগবাজার গিয়ে। পরীক্ষা-টরীক্ষা এসব বিষয়ে ওর আর তেমন কোনো মাথা ব্যথা ছিল বলে আমার মনে হচ্ছিল না, আমিও আর কিছু বলিনি। সবচেয়ে বাজে অবস্থার সৃষ্টি হলো ঠিক আমার পরীক্ষার আগের দিন—’ জুলহাস কথা শেষ করার আগেই মোবাইলে এসএমএস আসার শব্দে চমকে উঠল। তবে মেসেজটা পড়ে চমকে উঠল সে আরো বেশি। ঝট করে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সে। ঘটনা তবে কী ঘটতে শুরু করেছে।
৪
জুলহাস টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই টিভির দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এলো টেবিলের কাছে। চট করে হাতে তুলে নিল মোবাইলটা, অনেকক্ষণ আগেই মেসেজটা এসেছিল সে খেয়াল করেনি। আরো আগেই আসলে খেয়াল করা উচিত ছিল। কথার চোটে ভুলেই গেছিল সে। কিন্তু মোবাইলে যে কলটা এসেছিল তাতে যা যা বলেছে সেগুলোর কোনোটাই সে দেখতে পেল না মোবাইল ঘেঁটে, কিন্তু মোবাইলে যা বলেছে, সেটার কোনো আলামত সে তার সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও পেল না। মোবাইলে চেক করে সে চলে এলো ঘরের পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড এলিডি টিভিটার কাছে। সেটা ছেড়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় চ্যানেলগুলো একে একে ঘঁটে দেখল কিন্তু যে আশায় সে টিভি ঘেঁটেছিল বা মোবাইলের কলে যে সতর্কবার্তা সে পেয়েছিল, তার কোনো কিছুই খুঁজে পেল না। টিভি বন্ধ করে সে ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়েই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল। তবে কি কোনোভাবে তার হিসেবে গড়মিল হয়ে গেল, কোনোভাবে কি সে ভুল হিসেব করেছে। কিন্তু সার্বিক হিসেব তো তা বলছে না। সিগারেট শেষ করে সে একে একে তার প্রস্তুতি পরীক্ষা করে নিল। কাজ সেরে খাবারগুলো সাজিয়ে রেখে আবারো টেবিলের সামনে বসে পড়ল। মোবাইলের কলটা পেয়ে সে খানিকটা চমকে উঠেছিল, এরপরে আবার কিছু না পেয়ে খানিকটা দ্বিধাতেও পড়ে গেছে। তবে সে এতদিন ধরে যা আবিষ্কার করে এসেছে সেই হিসেব অনুযায়ী, সর্বোপরি বলতে গেলে কমন সেন্স খাটালে এত দ্রুত ঘটনা ঘটতে শুরু করার কথা নয়। তবে ও যা আশা করছে সেটা যদি সত্যি সত্যি ঘটে, তাহলে আজ রাতেই ঘটনা ঘটতে শুরু করবে কোনো সন্দেহ নেই। আর সমস্ত প্রস্তুতিও নেয়া আছে সেভাবেই। শুধু এই ভিডিওটা শেষ করে খেয়ে বেরিয়ে যেতে হবে তাকে।
বড়ো করে একবার দম নিয়ে সে ল্যাপটপের পাশে রাখা নোটপ্যাডটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, যেখানে কী কী বলবে সব নোট করা আছে। দেখে নিয়ে সে বলতে শুরু করল। ‘জিআরই পরীক্ষার কারণে আগের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। বিগত কয়েকদিন ধরে টোকনের কাজকর্মের কোনো আগা-মাথা নেই। সে ঠিকমতো অফিস করে না, পড়ালেখা তো পুরোপুরি চাঙ্গে উঠেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ওকে কী বলব বা করব। আমার নিজের অবস্থাই তখন কাহিল পরীক্ষার চিন্তায়। আমি পড়ালেখা করার চেষ্টা করছি এমন সময় রাতের বেলা টোকন বেশ হন্তদন্ত হয়ে আসে বাসায়। বাসাটা আমরা দুজনে মিলে ভাড়া করে থাকতাম। সে বাসায় এসেই জানায় হরিকে নাকি সে খুঁজে পাচ্ছে না আজ সারা সন্ধ্যে ধরে। আমি এমনিতেই ছিলাম ওর ওপরে বিরক্ত, তার ওপরে আবার পরীক্ষার স্ট্রেসে প্রায় অসুস্থ—এমন সময় এই আজগুবি আলাপ শুনে যথেষ্ট মেজাজ খারাপ হলো। আমি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু টোকন তখন আমার কথা বোঝার মতো অবস্থায় নেই। সে বলেই চলছে গত দুই-তিন দিন ধরে হরির সঙ্গে সে সন্ধ্যে বেলার সময়টা কাটাত, তখনো হরি স্বীকার করেনি সে কে, কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলত। এরপর আজ তার সঙ্গে কিছু সিরিয়াস আলাপ হওয়ার কথা ছিল এমন সময় সে মগবাজারে গিয়ে তাকে আর খুঁজে পায়নি। সারা সন্ধ্যে সে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তার কথা কেউ বলতেও পারছে না। হরির খুব খারাপ কিছু হয়েছে ভেবে সে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে।’
‘আমার এত বিরক্ত লাগছিল বলার বাইরে। একদিকে পরীক্ষার চিন্তায় আমি অস্থির আরেকদিকে টোকনের চিন্তায় আরেক দফা বেশি অস্থির। হরির কোনো গুরুত্ব আমার লাইফে নেই বলতে গেলে, আমি চিন্তিত ছিলাম টোকনকে নিয়ে। ছেলেটা এত অবসেসড বিহেভিওর করছিল, বলার বাইরে। আমার মথা গরম ছিল তবুও আমি ওকে মাথা ঠান্ডা করে একপাশে বসিয়ে ওর সব কথা শুনলাম। অস্বীকার করব না ওর কথা পুরোপুরি পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছিল সে সময়। ও সেদিন কী বলেছিল সব মন দিয়ে শুনেছি আমি এমন একটা ভাব ধরেছি, কিন্তু শুনিনি। সব শোনার ভান করে ওকে আমি শান্ত হতে বললাম, এরা ভাসমান মানুষ—একদিন কোথায় ছিল পরের দিন অন্য জায়গায়। টোকনকে আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বললাম। যেহেতু পরের দিন পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করা আছে যদিও পড়েনি তবুও আমি বললাম, পরীক্ষাটায় অন্তত অ্যাটেন্ড করতে। কারণ এগুলো স্কিল বেজড পরীক্ষা আর ও মেধাবী ছেলে—দিলে হয়তো ভালোও করে ফেলতে পারে। কিছু না হলেও অন্তত পরীক্ষা দেয়ার অভিজ্ঞতা তো হবে। যাই হোক, আমি ওকে বললাম, আগামীকাল যদি ও ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনে ভালোভাবে পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষার পর আমি ওকে হেল্প করব হরিকে খুঁজে বের করতে। টোকন বুঝল, ও শান্ত হলো, ওইদিন রাত পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পরীক্ষার প্রবলেম সলভ করে বেশ রাত করে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন পরীক্ষা ছিল তিনটায়, নিয়ত ছিল বেলা করে উঠে খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাব। ওমা পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি টোকন নেই। মোবাইলে কল দিয়ে দেখি মোবাইল বন্ধ। দুপুরের খাওয়া রেডি করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। খবর নেই। খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম একাই। একে তো মেজাজ ভীষণ খারাপ তার ওপরে পরীক্ষাও হলো খারাপ। যা স্কোর করব ভেবেছিলাম তার ধারে-কাছেও যেতে পারলাম না। চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ দিয়ে হল থেকে বের হলাম। হলের বাহিরে বের হয়ে চা খাচ্ছি আর হিসেব করছি—এমন সময় টোকনের কল। সে কই ছিল, পরীক্ষা দিল না কেন, আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে—এসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না, আমি কল রিসিভ করতেই সে হড়বড় করে বলতে লাগল মগবাজার বস্তিতে নাকি আগুন লেগেছে। এর সঙ্গে হরির অন্তর্ধানের সম্পর্ক আছে। মেজাজটা এত খারাপ হলো একটা কথাও না বলে কল কেটে দিলাম। সন্ধ্যায় আর বাসায় ফিরলাম না, বারে গিয়ে হালকা ড্রিংক করে বাহিরে খেয়ে বেশ রাত করে বাসায় ফিরে দেখি, টোকন খুব উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। আমি যেতেই সে আবারো শুরু করল একই গীত, একে তো মেজাজ ছিল খারাপ তার ওপরে ছিলাম মাতাল, আর সহ্য করতে পারলাম না, টোকনের কথা না শুনেই ওকে ইচ্ছেমতো গালাগাল শুরু করলাম, মুখে যা এলো বলে গেলাম। টোকন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না আমি ওর সঙ্গে এমন করছি। এরপর আমি যা ইচ্ছে বলে গেলাম ও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে গেল কিছুক্ষণ—এরপর নিজের কামরায় চলে গেল। আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।’
এই পর্যন্ত বলে জুলহাস থামল। সেই সময়টা মনে করাতে বুকের ভেতর থেকে গভীরতর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। ‘আগেই বলেছি আমি আর টোকন শুধু বন্ধু নই, ভাই-বোন-বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি। আমাদের ভেতরে বন্ধন ছিল অন্যরকম। আমি কিংবা টোকন কখনোই আমরা পরস্পরের থেকে আলাদা ভাবিনি। এমনকি আমরা দুজনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যখন আলাদা আলাদা জায়গায় পড়তে গেলাম, দূরত্ব আমাদের ভেতরে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং দিন দিন আমাদের ভেতরে বন্ধন আরো শক্ত হয়েছে। এর পেছনে অন্যতম একটা কারণ ছিল আমাদের ভেতরকার বিশ্বাস আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। কিন্তু ওইদিন রাতে আমাদের দুজনার ভেতরে কোথায় যেন সেই বিশ্বাস আর একাত্মতার সুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আর এটা ঘটার পেছনে মূল দায়ী ছিলাম আমি। আমিই টোকনকে বিশ্বাস করিনি, ওর প্রতিটা কাজকে পাগলামি ভেবেছি। ওর ইমোশন আর বিশ্বাসের জায়গাটা আমি বুঝতে পারিনি, অনুধাবন করতে পারিনি। আর যে কারণে পরবর্তীতে,’ আবারো জুলহাসের বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
‘হারাতে হয়েছিল আমার বন্ধুকে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। একদিকে পরীক্ষা খারাপ তার ওপরে টোকনের সঙ্গে ঝগড়া এবং দুর্ব্যবহার যা আগে কখনো ঘটেনি, তার ওপরে আবার আগের দিনের হ্যাঙওভার, সব মিলিয়ে পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম দেরি করে এবং খুব বাজে অনুভূতি নিয়ে। উঠে টোকনের খোঁজ নিয়ে গিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে একটা চিঠি পেলাম। টোকন লিখেছে ও আপাতত বাইরে চলে যাচ্ছে, ওর নিজের কিছু কাজ আছে সেগুলো তাকে সারতে হবে এবং সে বিশ্বাস করে সেসব কাজ আমার সঙ্গে থেকে করতে গেলে আমাদের দুজনারই সমস্যা হবে। আপাতত সে বাসা বদলাচ্ছে না, তবে যেহেতু আগামী এক মাসের ভাড়া দেয়া আছে, কাজেই আপাতত সে না থাকলেও সমস্যা হবে না। আর আমি চাইলে অন্য রুমমেট দেখে নিতে পারি। টোকন আমার সঙ্গে আর থাকতে আগ্রহী নয়। সেই সঙ্গে সে জানাল অফিসে ই-মেইেল করে লম্বা ছুটি নেবে, যদি না দেয় তবে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দেবে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম টোকন নিজেকে এমন কিছুর সঙ্গে জড়াতে যাচ্ছে, যা তার জন্যে ভালো হবে না। তখনো আমি ভাবতাম সে মরীচিকার পেছনে ছুটছে, তখনো আমি ভেবেছিলাম সে নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সার্বিক জীবনের ক্ষতি করছে। কিন্তু সে যে আসলে কী করতে যাচ্ছে, সেটা আমি অনুধাবন করতে পুরোপুরি পারিনি।
টোকন ওইদিনের পর অফিসে যায়নি, কোথায় কী করেছে সেটাও জানতে পারিনি। হঠাৎ একদিন বাসায় ফিরে দেখি ওর জিনিসপত্র যা ছিল ও নিয়ে গেছে, ভাড়া বা অন্যান্য টাকা যা ছিল সব সুন্দর হিসেব করে বুঝিয়ে একটা খামে রেখে গেছে। ওকে মোবাইলে কল করে, ফেসবুক মেসেঞ্জার-ই-মেইেল-হোয়াটসঅ্যাপ- ইনস্টাগ্রাম কোনো কিছুতেই নক করে পাইনি। ওর বাস্তব এবং ভার্চুয়াল জীবন দুটোই যেন থেমে গেছিল ওইদিন থেকে। তবে আরেকটা জায়গায়ও ওর অস্তিত্ব আমি টের পেতাম খুব ভালোভাবে। সেই বিষয়ে পরে বলছি। টোকন কী করছে, কী বলছে আমি জানতে পারিনি। তবে এতদিনের বন্ধুত্বে এই বিশ্বাস ছিল যে ও একদিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবে। আমার এই কথা এটাও প্রমাণ করে যে তখনো আমি এটা বিশ্বাস করতাম যে টোকন ভুল ছিল, আমি ঠিক ছিলাম। আর আমি এটা ভাবতাম যে ও ঠিকই একদিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবে আর এ কারণে আমার জন্যে খানিক কঠিন হলেও আমি ফ্ল্যাটে আর অন্য কোনো ভাড়াটিয়া উঠাইনি। আর আমি যে ভুল ছিলাম না সেটা আমি বুঝতে পারি কয়েক মাস পর, টোকন ফিরে আসে। তবে বেশ কয়েক মাস পর।’
‘সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, অফিস থেকে বাসায় ফিরি একেবারে কাকভেজা হয়ে। বাসার লক খুলেই সিগারেটের গন্ধ পাই। আমি সবসময় স্মোক করলেও টোকন আগে করত না। কাজেই বাসার ভেতরে ঢুকে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে বেশ অবাক হয়ে যাই, সঙ্গে খানিকটা ভয়ও পাই। তবে বেশি অবাক হওয়ার বা ভয় পাবার, কোনোটারই সময় ছিল না, কারণ ভেতরে ঢুকেই টোকনকে দেখতে পাই। এই কয়েকমাসে সে বেশ শুকিয়েছে কিন্তু চেহারায় একটা কঠিন ভাব এসেছে সেই সঙ্গে দাড়ি রাখাতে ওকে বেশ অন্যরকম লাগছিল। এই কয়েক মাস যে সে বেশ একটা বিধ্বস্ত সময় কাটিয়েছে সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় ছিল, তার চেহারায় এমন একটা ম্যাচিউর ভাব হয়েছে যে কেউ দেখলে ভাববে, সে হঠাৎ করে যেন ইনোসেন্ট একটা ছেলে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। হাতে ধরা সিগারেটটাও অবাক করার মতো একটা বিষয়ই ছিল। কারণ এর আগে সিগারেট খাওয়া তো দূরে থাক সিগারেটের গন্ধও সে সহ্য করতে পারত না। আর সেই ছেলে কি না এই কয়েক মাসের ব্যবধানে এভাবে সিগারেট খেতে শিখে গেল। আমি ভেজা অবস্থাতেই সব ভুলে ওর সামনে বসে গেলাম।
‘টোকন, তোর কী হয়েছে বলত, তুই আসলে কী করছিস?’ আমি মন থেকেই জানতে চাইলাম ওর কাছে। কিন্তু সে পরিষ্কার কোনো জবাব না দিয়ে উলটো যা জানতে চাইল তাতে খুব অবাক হলাম আমি।
‘কামালের কথা মনে আছে তোর?’ টোকন জানতে চাইল আমার কাছে।
ক্ষণিকের জন্যে অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কোন কামাল?’ কিন্তু প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল আমাদের সঙ্গে এতিমখানাতে একটা ছেলে ছিল কামাল। বয়সে আমাদের থেকে ছোট হলেও আমাদের সঙ্গে একই ক্লাসেই পড়ত, বিশেষ করে এই ছেলেটার কথা মনে থাকার কারণ হলো, এই ছেলেটাও খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। আমি আর টোকন অনেক বেশি জেদি ছিলাম, তাই আমাদের সঙ্গে পাল্লা টানতে না পারলেও যেকোনো ক্লাসে বা পড়াতে আমাদের ঠিক পরের অবস্থানটাই এই ছেলের জন্যে বাঁধা থাকত এবং আমি শুনেছিলাম এই ছেলেটাও আমাদের মতোই পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে।
‘হ্যাঁ কামালের কথা মনে আছে, কেন হঠাৎ ওর কথা কেন, তুই কি ওকেও—’ ‘শোন জুলহাস, আমি কামালের সঙ্গে একটা বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করার জন্যে ছয় মাসের জন্যে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি,’ টোকন সিগারেটের মাথাটা অ্যাশট্রেতে পিষে দিতে দিতে বলে উঠল।
‘প্রজেক্ট, কীসের প্রজেক্ট, তুই আসলে করছিস কি বলত?’ আমি টোকনের সার্বিক অবস্থা দেখে খানিকটা উদ্বিগ্নই বোধ করছিলাম। ছেলেটা কী করছে, কিসের সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি একগাদা প্রশ্ন করাতে টোকন কোনোটারই ঠিকমতো জবাব দিল না শুধু সে বলে উঠল, ‘শোন তোর সব প্রশ্নের জবাব একেবারে প্রমাণসমেত দেব, তুই আরেকটু ধৈর্য ধর। হরির অন্তর্ধানেরও জবাব দেব,’ আমি আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই সে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল আমাকে। ‘শোন এখন আমি কিছুই বলব না, শুধু এটুকু বলি, অনেক বড়ো একটা বিষয়ের একেবারে গোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছি আমি। তোকে কেন কাউকেই কিছু বলব না আমি। আগে সব পুরোপুরি জানি-বুঝি তারপর সব জানাব। আর তোর কাছে আমি এসেছি একটা হেল্প চাইতে, আমি যে-কাজে যাচ্ছি সেখান থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের জন্যে তোর কাছে লোক আসতে পারে বা তোকে কল করতে পারে কিংবা অফিসেও খোঁজখবর করতে পারে। যদি করে একটু হেল্প করিস, বন্ধু হিসেবে তোর কাছে এটুকু তো চাইতেই পারি। আর আশা করি এতে তোর কাজের খুব একটা ক্ষতি হবে না।’
টোকন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমি বুঝতে পারছিলাম শেষ কথাগুলো সে আমার আগের আচরণের জন্যে খানিকটা খোঁচা মেরেই বলেছে। আমি খুব অস্থির হয়ে অনেক কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু টোকন প্রায় কিছুই বলতে না দিয়ে চলে গেল। ছেলেটা এই যে গেল, এরপর স্বাভাবিকভাবে ওর সঙ্গে আমার আর দেখাই হয়নি কখনো, জুলহাস আবারো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে একবার ঘড়ি দেখল। সময় সন্ধের কাটা পার হয়ে রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। যতই জলদি থাক এবার ওকে বিরতি নিতেই হবে। এই বিরতিতে খেয়ে নেয়া যেতে পারে। কারণ ওর ধারণা আজ রাতে কিছু না কিছু ঘটবেই, আর একবার ঘটনা ঘটতে শুরু করলে ও আর কোনো ফুসরত পাবে না। খাবার তো প্রশ্নই আসে না তখন। কাজেই এখনই উত্তম সময়।