একটি মুক্ত ভোরের শুরু – ২০

২০

রহমান শেষবারের মতো ওদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দিল, সেইসঙ্গে তার ইশারা পেতেই আরো এক পশলা গুলি করল এক গার্ড। ওরা দেখতে পেল ল্যাবের বাতি নিভে গেল গুলির সঙ্গে সঙ্গেই। আনমনেই গাল বকে উঠল রহমান, গার্ড গুলি করে সম্ভবত বাতি নিভিয়ে ফেলেছে। রাসনা দেখল আরো দুজন গার্ড এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। ‘আরিয়ান, জোনায়েদ আর এক মিনিটের ভেতরে তোমরা বের হয়ে না এলে একে একে আমি এই লোকগুলোকে গুলি করা শুরু করব,’ বলেই সে খপ করে রাসনাকে এক হাতে টেনে নিল তার দিকে। ‘শুরু করব এই মেয়েটাকে দিয়ে,’ বলে সে গার্ডদেরকে প্রস্তুত হতে বলল।

রাসনা চিৎকার করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু রহমান মনে হয় পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেছে। ‘এক দুই—’ গুনতে শুরু করেছে সে। ল্যাবের ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স নেই। রাসনার মনে হলো লোকটা ওকে গুলিই করে দেবে, কিন্তু তার এক মিনিট গোনা শেষ হওয়ার আগেই নিভে যাওয়া ল্যাবের দরজাতে দুজনকেই দেখা গেল, দুজনেরই হাত বন্দি হওয়ার ভঙ্গিতে মাথার পেছনে। জোনায়েদের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, তাকে এক হাতে ধরে আছে রহমান। তার অন্য হাত মাথার পেছনে ধরা।

‘না না না,’ বলেই সে আরিয়ানের দিকে দুই পা এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল। ‘এই তুমি হাত সামনে খোলা জায়গায় তুলে ধরো।’ রাসনার মনে হলো আরিয়ানের হাতে কিছু একটা ছিল কিন্তু তাকে খালি হাত ওপরে তুলে ধরতে দেখে সে হতাশ হয়ে গেল। ‘সেই তো ধরা পড়তেই হলো হারামির বাচ্চারা,’ বলে সে নিজের হাতের অস্ত্রটা তুলে ধরল আরিয়ানের দিকে,’ এবার তোকে আগে একটা গুলি করে দিই,’ বলে সে নিজের হাতের অস্ত্রটা তুলে ধরেও থেমে গেল। আরিয়ান মুখ খুলেছে কিছু একটা বলার জন্য, সবাই থেমে গেল আরিয়ানের কথা শোনার জন্য।

‘তুমি তো আমার ফাইল পড়েছ,’ বলে সে আড়চোখে একবার রাসনার আর জুলহাসের দিকে দেখে নিয়ে নিজের দৃষ্টি ফেলল রহমানের দিকে। সবাই জানে আমি আর্মি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কথাটা ভুল, আর্মি থেকে আমাকে বের করে দিয়েছিল, কিন্তু এটা কেউ জানে না কেন আমাকে বের করে দিয়েছিল,’ রহমান মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আরিয়ান মৃদু হেসে জোনায়েদকে ছেড়ে দিল, জোনায়েদ পড়তে পড়তে তার হাতে ধরা কাঁচের ছোট একটা বোতল ছুড়ে দিল শূন্যে, আরিয়ান শূন্যে তোলা হাত নামিয়ে এনে নিজের কোমর থেকে অস্ত্র বের করে প্রথমে এক পশলা গুলি করল টিউবটার দিকে, তারপর রহমানের দিকে। কিন্তু রহমান লাফ দিয়েছে ওর দিকে, ফলে দুজনেই ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে আর টিউবটাতে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওটা ভীষণ শব্দে বিস্ফোরিত হলো, প্রথমে ধীরে তারপর আরো জোরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, অস্ত্র হাতে গার্ডদের এক অংশের গায়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ল্যাবের কাচের দেয়াল পুরো খসে পড়েছে, সেইসঙ্গে ফাটল ধরেছে ছাদে এবং পিলারে, আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে, সেইসঙ্গে আবার পানির ধারা পড়ছে ওপর থেকে।

আরিয়ান কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওদের সরে পড়তে বলতেই কেউ একজন ওর পা ধরে টান মারল। আরিয়ান নিজেকে সামলে নিতে নিতে ধুরুম ধারুম করে পড়ে গেল। ও মাটিতে পড়তেই সোজা ওর মুখে লাথি মারল রহমান। মুখে আবারো রক্তের স্বাদ পেল আরিয়ান। ‘শুয়োরের বাচ্চা তোর কারণে সব বরবাদ হতে চলেছে, মর শালার পো,’ রহমান হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে এসেছে ওর ওপরে, শক্তিশালী দুই হাতে চেপে ধরেছে ওর গলা। চারপাশে লোকজনের চেঁচামেচি, চিৎকার, আগুন আর ছোট ছোট বিস্ফোরণের শব্দ। কিন্তু আরিয়ানের কিছু শোনার উপায় নেই, দুই হাতে খামচে ধরে ওর কণ্ঠার হাড় ভেঙে ফেলার উদ্যোগ করেছে রহমান, আরিয়ান দুর্বল হাতে লোকটার হাত সরানোর চেষ্টা করল, মুখে ঘুষি মারল, কিছুই হচ্ছে না, রহমানের লাল চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে প্রায় মুখ টকটকে লাল, সর্বশক্তি দিয়ে সে এমনভাবে চেপে ধরেছে আরিয়ানের যে গলা ওকে শেষ না করে ছাড়বে না। আরিয়ানের দম বন্ধ হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই, এবার চোখে তারা দেখতে শুরু করেছে, আর বড়জোর আধ মিনিট টিকতে পারবে ও। মরিয়া হয়ে চারপাশে হাতড়াতে শুরু করল ও, হাতে শক্ত কিছু একটা লাগতেই সেটাকে ধরেই সোজা চালিয়ে দিল রহমানের মুখ বরাবর, থ্যাচ করে একটা শব্দ হলো, সেই সঙ্গে তীব্র আর্তনাদের সঙ্গে ওর গলার বাঁধন আলগা হয়ে গেল। তীব্র কাশির সঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ঘোরের ভেতরেই উঠে দাঁড়াল ও, সামনে তাকিয়ে দেখল, একপাশে গার্ডদের সঙ্গে রীতিমতো বন্দুক যুদ্ধ চলছে জোনায়েদ রাসনা আর জুলহাসের, যাদের মুক্ত করে এনেছিল তাদের দেখতে পেল না। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, ছোট একটা কাচের টুকেরা ঢুকে আছে রহমানের একচোখে, হরর সিনেমার ভূতদের মতো সেটাকে টেনে বের করে আনল রহমান, তাকে দেখতে আর মানুষ মনে হচ্ছে না, পিশাচের মতো লাগছে। আরিয়ান দৃশ্যটা বোঝার আগেই আবারো ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রহমান। প্রথম ধাক্কাতে সরে গেলেও এবার আগের মতো বোকামি করল না, এক পাশে সরিয়ে নিয়ে নষ্ট চোখটাতে ঘুষি মারলো ও লোকটার।

ভয়াবহভাবে চিৎকার করে উঠল রহমান। আরিয়ান এবার আর কোনো দয়া করল না। এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে প্রথমে লাথি মারল তারপর আবোরা ঘুষি মারল নষ্ট চোখটাতে, এবার রক্ত চামড়া আর হাড়ের টুকরো ছিটকে এসে লাগল ওর মুখে, রহমানকে একপাশে চেপে ধরে, সাঁটিয়ে তবে একটু আগের কাচের টুকরোটা তুলে নিয়ে তার মুখের সামনে মুখ রেখে আরিয়ান বলে উঠল ‘এত পাপ প্রকৃতি সহ্য করে না, বলে সেটাকে প্রথমে রহমানের গলায় বসিয়ে দিল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতেই সেটাকে টেনে নিয়ে আবার বসিয়ে দিল অপর চোখটাতে, প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল রহমান, উলটা-পালটা ঘুরতে শুরু করে তার শরীরটা, সর্বশক্তি দিয়ে রহমানকে একটা লাথি মারতেই ল্যাবের দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে অদৃশ্য হয়ে গেল রহমানের দেহটা। তখনো সে তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে।

আরিয়ান সোজা হওয়ার আগেই কেউ একজন এসে ধরে ফেলল ওকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আগেই কেউ একজন বলে উঠল, ‘আমি আমি জুলহাস।’

‘জুলহাস, কী অবস্থা, গার্ডরা–-’  

‘আরিয়ান ভাই, গার্ডরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওদের ওদিকটাতে ভয়াবহ আগুন লেগে যাওয়াতে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ওরা, আমরা ইচ্ছেমতো গুলি করাতে কিছু মরেছে কিছু পিছু হটেছে, এবার পালাতে হবে আমাদের, বলে সে চারপাশে দেখাল। ‘এই জায়গা আর টিকবে না। আপনাদের কাঁচের বোতলে কী ছিল, এত জোরে বিস্ফোরিত হলো কেন?’

‘নাইট্রোগ্লিসারিন, ল্যাবের ভেতরে থাকা নাইট্রিক এসিড আর গ্লিসারিন মিলিয়ে দ্রুত বানিয়েছিলাম। আর্মিতে থাকতে আমার স্পেশালিটিই ছিল ক্যামিকেল নিয়ে কাজ করা। যাক গে—আমরা যাদের মুক্ত করেছি ওরা—’

‘দুয়েকজন গোলাগুলিতে মরেছে সবার আগে,’ অপর পাশ থেকে রাসনা বলে উঠল।

‘জোনায়েদ?’

‘এখনো বেঁচে আছে, চলো চলো,’ ওরা ধরাধরি করে বাকি যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে দ্রুত এগোতে লাগল সামনে সেই শুকনো লম্বা লোকটা আহত হয়েছে কিন্তু বেঁচে আছে, সে ওদের পথ দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বাইরে নিয়ে এলো। কোনোমতে বাইরে খোলা জায়গাতে সেই পেছনের আঙিনাতে বেরিয়ে এলো ওরা। বুক ভরে দম নিতে লাগল।

আরিয়ান সামনে তাকিয়ে দেখল দাউ দাউ করে জ্বলছে পুরো ফ্যাক্টরি আর ল্যাব। ‘আরিয়ান ভাই, আমি পারলাম না, সব প্রমাণ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল, ওদের পাশ থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে জোনায়েদ বলতে লাগল। সবাই মাটিতে বসে আছে, আরিয়ান দেখল রাসনা জুলহাস নাঈম সবাই আছে, মুক্ত হওয়া বন্দিদের ভেতরে যারা টিকে আছে তারাও দম নিচ্ছে। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ জোরে জোরে হেসে উঠল আরিয়ান। ‘আরে বোকা প্ৰমাণ গেলে কী হবে, জীবিত প্রমাণ আছে আমাদের কাছে, বলে সে মুক্ত হওয়া বন্দিদের দেখাল। ওরা সাক্ষী দেবে কী হচ্ছিল এখানে।’

‘আরো প্রমাণ আছে,’ অনেকক্ষণ পর নাঈম বলে উঠল, ‘আপনারা টোকনের ধাঁধা পুরোটার সমাধান করতে পারেননি আমার বিশ্বাস, বাকিটা কীভাবে করতে হবে আমি জানি, ওখানে ওদের পুরো নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে ওদের এরকম সব সেন্টারের লোকেশনও আছে। আর সেটা করতে একজনের সাহায্য লাগবে। লোকটার নাম নাফিস, নাফিস বিন শরীফ।’

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চট করে নাঈমের দিকে ফিরে তাকাল আরিয়ান। ‘আমার ধারণা আপনি তাকে চেনেন,’ নাঈম বলে চলেছে।

‘আর্মিতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, ওর সঙ্গে এই কেসের সম্পর্ক কি?’ আরিয়ান খুব অবাক হয়ে বলে উঠল।

‘এই লোকও সম্ভবত আপনার সঙ্গেই সাসপেন্ড হয়েছিল। এনার সঙ্গে তো বটেই আপনাদের সাসপেন্ড হওয়ার সঙ্গেও এই ঘটনার—’ বলতে গিয়েও থেমে গেল নাঈম। ‘এই লোককে আমাদের প্রয়োজন হবে। আর-

‘আপনাদের কি মনে হয় না আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির ওপরে বেশি নজর দেওয়া উচিত। এখন আমরা করব কী?’ রাসনা বলে উঠল। ‘এত ক্ষমতাবান এরা—’

‘আমরা মিডিয়ার কাছে সব ফাঁস করব, লোকাল না, ইন্টারন্যাশনাল,’ সামনে আগুনের দিকে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে আরিয়ান বলে উঠল। ‘আমাদের লড়াই স্রেফ শুরু হলো,’ কঠিন প্রতিজ্ঞা ওর গলায়। ‘অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, যে পাপ আমি করেছিলাম নিজের বন্ধুকে ধোঁকা দিয়ে, সেই পাপ মুক্তি আমাকেই করতে হবে। আমি নিজেই সব স্বীকার করব সবার সামনে, এরপর শুরু হবে আমাদের আসল লড়াই, তার গলার সুরে সবাই ফিরে তাকাল তার দিকে, রক্তাক্ত আহত একটা মুখ কিন্তু তাতে প্রতিজ্ঞার কোনো কমতি নেই।

‘রাত্রি সবে শেষ হলো, মুক্ত একটা ভোর নিয়ে আসা আমাদেরই দায়িত্ব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *