একটি মুক্ত ভোরের শুরু – ১৫

১৫

রহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে, আরিয়ানও তাকিয়ে আছে। দুজনেই প্রায় কাছাকাছি বয়সের, কাছাকাছি ব্যাকগ্রাউন্ডের অথচ একেবারেই ভিন্ন পেশার ভিন্ন অবস্থানের পুরুষ, দুজনে দুই অবস্থা থেকে একে অপরকে মাপার চেষ্টা করছে। রহমান তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মৃদু হেসে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ সামনে থেকে ভ্যানের ছোট খোপের ওখান দিয়ে টোকা দিল। সেন্ট্রিকে সাবধান করে দিয়ে জোনায়েদও উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল। কথা শেষ করে সে রহমানের দিকে ইশারা করতেই সে মাথা নেড়ে সায় জানাল, জোনায়েদ কথা শেষ করে বসে গেল, একটু পরেই থেমে গেল গাড়ি, সেই সেন্ট্রি সালাম দিয়ে নেমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল, অন্য একটা গাড়ি স্টার্ট হওয়ার শব্দ শোনা গেল একটু পরেই আবারো গাড়ি চলতে শুরু করল।

‘হুমমম বলো, কী যেন বলছিলে?’ রহমান ভিন্ন কিছু একটা ভাবছিল। সেখান থেকে হঠাৎ অন্য বিষয়ে কথা বলাতে সে তাল হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তার প্রশ্নের জবাবে আরিয়ান কিছু বলার আগেই সে আবারো কথা বলে উঠল। ‘আচ্ছা মূল বিষয়টা নিয়ে,’ বলে সে আবারো ফিরে তাকাল আরিয়ানের দিকে। ‘অদ্ভুত না, আগেও একবার বলেছি তুমি আর আমি, আমরা আসলে মোটেই আলাদা কিছু না। হয়তো বা তুমি আর আমি কলিগ হওয়ার কথা ছিল, কিংবা কে জানে হয়তো তুমি শিকারি হওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটা আমি বোঝাতে পারব না, তোমার দিকে অস্ত্র তাক করে রাখাটা আমার কাছে মানুষ হয়ে মানুষের মাংস খাবার মতো একটা অনুভূতি দিচ্ছে। বিশেষ করে তোমার রেকর্ড পড়ার পর,’ রহমান দৃষ্টি সরু করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘ইট ইজ হোয়াট ইট ইজ,’ আরিয়ানও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘কী হলে কী হতো, সেটা বলে আর লাভ নেই, যা হচ্ছে এটাই বাস্তবতা,’ বলে সে মাথা নাড়ল। ‘তুমি অস্ত্র হাতে আমার দিকে, আর আমি শিকলে বন্দি এটাই এখন বাস্তবতা, সো যত কঠিন ভিন্ন আর ভয়ংকরই হোক না কেন। এসব ফিলোসফি কপচে লাভ নেই, সত্য বলো।’

‘ফেয়ার এনাফ,’ আনমনেই মাথা নাড়ল রহমান। ‘তবে সত্যি কথা হলো পুরো বিষয়টা কী নিয়ে সেটা বলার আগে তোমরা বলো তোমাদের ধারণা কি, টোকনের সেই ভার্চুয়াল ধাঁধার কথা তোমরা যা বলেছ, সেখান থেকে কী বুঝেছ?’  

‘কিছুই না,’ জুলহাস মাথা নেড়ে বলে উঠল। ‘প্রথম ধাপটা পুরোটাই ফাঁপা একটা বিষয় ছিল, জটিল কিন্তু ফাঁপা। কারণ টোকন ওটা এমনভাবে সাজিয়েছিল যাতে একমাত্র আমি, সম্ভবত একমাত্র আমিই দ্বিতীয় ধাপ মানে লেখক আরিয়ানের লেখা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি। আর দ্বিতীয় ধাপ, মানে ওখানে যা পেয়েছি আমরা, বিশেষ করে বইটার থেকে সেটাও খুবই আইসোলেটেড এবং আনকনটেক্সচুয়ালাইজড।’

‘ফরিদপুরের এক গ্রামের একদল মেয়ের ম্যাস হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্যারাসিটামলে একশ শিশুর মৃত্যু, দিল্লিতে নরবানরের মিথ, বাংলাদেশের এক জঙ্গলে অদ্ভুত প্রাণীর দেখা পাওয়া,’ বলে আরিয়ান মাথা নাড়ল। ‘এতগুলো আইসোলেটেড ঘটনা, ইট ডাজন্ট মেইক অ্যানি সেন্স। এ-থেকে কী বুঝব আমরা?’

রহমান হেসে উঠল, ‘বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড়ো অ্যাসেট কী মানব জাতির জন্য?’ হঠাৎই একেবারে অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে ওঠাতে সবাই খানিক চমকে উঠল

‘বলেন জ্ঞানী-গুণী মানুষজন আছেন সবাই এখানে,’ কথাটা শুনে মনে হতে পারে সম্মান দিয়ে বলছে সে, কিন্তু আসলে কথাটাতে দারুণ তাচ্ছিল্য মিশে আছে।

‘অ্যাসেট মানে, সম্পদ?’ জুলহাস ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, সম্পদ।’

‘সম্পদ মানে কি সোনা-দানা, দামি জিনিস—এগুলোকেই তো সম্পদ বলে,’ অনেকক্ষণ পর রাসনা বলে উঠল।

‘হ্যাঁ, তা তো বটেই,’ রহমান সামান্য হেসে উঠল। ‘তবে আমি অন্য ধরনের সম্পদের কথা বলছি। ধরেন এক সময় জমিদারেরা দেশ-দুনিয়া চালাত, কারণ তখন জমি ছিল সবচেয়ে বড়ো সম্পদ, এরপর একটা সময় এলো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা ছিল সবার সেরা কারণ মেশিন-ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি ছিল সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। একভাবে বলতে গেলে দুনিয়া চালাচ্ছে আইটি আর ডিজিটাল জগৎ আর বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো—’

‘ডাটা,’ আনমনেই যেন বলে উঠল জুলহাস।

‘ভেরি গুড,’ রহমান হেসে উঠল। ‘আর আমাদের চারপাশে যা ঘটছে, যা ঘঠাচ্ছে সবই এক অর্থে বলতে গেলে এই ডাটার জন্যই।’

‘মানে কী?’ খুবই অবাক হয়ে বলে উঠল আরিয়ান।

‘আমার যা বলার ছিল কিছুটা আমি বলেছি, তোমাদের আর কিছু জানা আছে বলে মনে হয় না, কিন্তু একজনের বক্তব্য আমাদের এখনো শুনতে বাকি, আমার বিশ্বাস যা বলার এবার সে বলবে। পুরো ঘটনার শুরু শেষ এবং মাঝখান পুরোটাই আমরা তার থেকে শুনব। কারণ এদের মাধ্যমেই এইসব কাহিনির শুরু,’ বলে সে হাতে ধরা একটা সিগারেট ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে তাক করল নাঈমের দিকে। ‘বলো মি. নাঈম, পাগল পাগল খেলা অনেক হয়েছে এবার সত্য ঝাড়ো।’

সবাই ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে। নাঈমের চেহারা বদলে গেছে সঙ্গে সঙ্গে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ‘আমি আমি!’ প্রায় আঁতকে ওঠার মতো বলে উঠল সে। ‘আমি আমি কিছু জানি না। আমি স্রেফ সেই প্রজেক্ট—’ ঘাবড়ে গিয়ে সে বলতে গেলেও আবার নিজেকে রোধ করে ফেলল। ‘আমি আমি কিছু জানি না, আমি সত্যিই জানি না।’

নাঈমের দিকে তাকিয়ে রহমান খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘এই ছেলে তোমার কি মনে হচ্ছে এখানে জোক হচ্ছে?’ তার চেহারা লাল হয়ে উঠছে। ‘এতগুলো লোকের জীবন নির্ভর করছে এই তথ্যগুলোর ওপরে, আরে ব্যাটা তোর জীবনও নির্ভর করছে এর ওপরে। আর তুই বলিস তুই কিছু জানিস না!’ তার গলার স্বর ওপরে উঠছে।

‘আচ্ছা সব বাদ দিলেও তুমি কিছু না জানলে পাগল সেজে পাগলা গারদে বসে ছিলে কেন এতগুলো দিন?’ রহমানকে উত্তেজিত হতে দেখে জোনায়েদ শান্ত স্বরে জানতে চাইল।

আমি কিছু জানি না, আমি কিছু জানি না,’ কেমন যেন বিড়বিড় করার মতো করে বলে উঠল নাঈম। আরিয়ান বুঝতে পারছে ছেলেটা কেন কিছু বলতে চাচ্ছে না। কারণ একবার বলে দিলেই এরা মেরে ফেলবে, কিন্তু ছেলেটা এটা বুঝতে পারছে না, না বললে এরা এখনি মেরে ফেলবে একে।

‘ওকে, শক্ত রাস্তা তাহলে,’ রহমানের গলার স্বরও নেমে গেছে, বাকিরা তাকিয়ে দেখল, তার একহাতে একটা পিস্তল বেরিয়ে এসেছে। সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে অস্ত্রটা ধরে সে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। আরিয়ান দেখল সুদর্শন চেহারার জোনায়েদ একগাল হেসে নিজের পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। ভ্যানের দুলুনি উপেক্ষা করে দুই লাফে সে ওদের ছাড়িয়ে চলে গেল নাঈমের কাছে। ছোট বাচ্চারা চকলেট চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে গার্ডিয়ানদের দিকে যেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কীভাবে ধরা পড়ল, অনেকটা সেরকম দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে জোনায়েদের দিকে, তার দৃষ্টি দেখে আরিয়ানের খানিকটা খারাপই লাগল। ছেলেমানুষ এখনো বুঝতে পারছে না, কতটা খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। জোনায়েদ এক গাল হেসে খপ করে চেইনে আটকানো এক হাতের কবজি ধরে ফেলল, তারপর ওটাকে চেইন আর হাতকড়ায় আটকানো অবস্থায় যতটা ওপরে তোলা সম্ভব টেনে তুলল। নাঈম ছেলেটা এখনো শকে, সে আগের মতোই তাকিয়ে আছে জোনায়েদের দিকে, তার মস্তিষ্ক এখনো প্রসেস করে উঠতে পারছে না আসলে কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে।

‘স্টপ ইট,’ আরিয়ান ঠান্ডা কিন্তু শক্ত স্বরে বলে উঠল। কিন্তু রহমান বা জোনায়েদ কারো ভেতরেই কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না। জোনায়েদ হাতটা তুলে ধরে রহমানের দিকে তাকিয়ে একবার ইশারা করল, রহমান মাথা নেড়ে সায় জানাতেই আরিয়ান আবারো জোরে বলে উঠল, ‘স্টপ ইট,’ কারণ ও বুঝতে পেরেছে জোনায়েদ আসলে কী করতে যাচ্ছে। জোনায়েদ নাঈমের উঁচু করে ধরা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিটা অপরহাতে ধরে সর্বশক্তিতে বিপরীত দিকে ঠেলে দিল। কট করে হওয়া শব্দটা পরিষ্কার শোনা গেল সেই সঙ্গে গলার সব জোর দিয়ে চিৎকার করে উঠল নাঈম। আরিয়ান বুঝতে পেরেছে কী করা হয়েছে, গুরুতর কোনো ক্ষতি না করে সহজে প্রচুর ব্যথা দেওয়া যায় এমন যতগুলো টর্চার আছে এটা তার মধ্যে অন্যতম। নাঈমের আঙুল ঠিকমতো বসিয়ে প্লাস্টার করে দিলে পুরোপুরি আগের মতো হয়ে যাবে কিন্তু এই মুহূর্তে ছেলেটার জান বেরিয়ে যাওয়ার মতো ব্যথা পাচ্ছে সে। নাঈম জান দিয়ে চিৎকার করছে জোনায়েদ সপাটে চড় মারল তাকে একটা, তারপর আরো একটা, ছেলেটার মাথা প্রথমে গিয়ে বাড়ি খেল ভ্যানের দেয়ালে তারপর সেটা আবার টান খেয়ে ফিরে এলো আগের জায়গাতে, একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি হলো আবারো। জোনায়েদ তাকে ধরে সোজা করে দিল, আবারো চড় খাবার ভয়ে অন্যহাতে আঙুল চেপে ধরে গোঙাতে লাগল। রহমান আবারো জোনায়দের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। জোনায়েদ খপ করে আবারো তার হাত ধরতেই নাঈম আবারো চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তার ডিজলোকেট হওয়া আঙুলটা এক ঝটকায় আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল জোনায়েদ, এবার চিৎকার না আহত পশুর মতো গুঙিয়ে উঠল সে। পুরোপুরি ঠিক হতে প্লাস্টার লাগবে তবে আরিয়ান জানে এবার আর আগের মতো ব্যথা পাবে না ছেলেটা, এরা নিজেদের কাজ জানে।

জোনায়েদ আগের জায়গাতে ফিরে গিয়ে আবারো অস্ত্র ধরে বসে পড়ল। রহমান নিজের অস্ত্র রেখে ধীরে-সুস্থে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে উঠল, ‘তুমি কি কথা বলবে নাকি, আবারো একই প্রক্রিয়া রিপিট করা হবে? তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দেওয়া, তুমি কী জানো আমাকে সেটা জানতে হবে, আর সেটার জন্য প্রথমে তোমার আঙুল সব ভাঙা হবে এই প্রক্রিয়াতেই, তারপর কবজি, কনুই—’

‘আমি বলতেছি,’ নাঈম এখনো গোঙাতে থাকলেও কথা বলল মোটামুটি পরিষ্কার স্বরেই। ‘আমার দিক থেকে ঘটনার শুরু হয়েছিল রফিকুজ্জামান স্যারের মাধ্যমেই। আমি ফাইন্যান্স নিয়ে পড়ালেখা করেছি, নিজের কাজ খুব ভালো বুঝতাম তাই পাস করে বের হতেই ভালো চাকরিও হয়ে গেছিল একটা ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু আমি লোভী হয়ে গেছিলাম, চাকরির এক বছরের মাথায় কোম্পানির টাকা এদিক-সেদিক করে ধরা খাই, চাকরি চলে যায়। টাকা- পয়সা যা ছিল সব যায় সব সামলাতে গিয়ে। এমন সময় প্রফেসর রফিকুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হয় এবং তিনি একটা কাজের প্রস্তাব দেন, ওই সময়ে আমি বাড়িভাড়া খাবার নিয়ে পর্যন্ত সমস্যায় ছিলাম। আমি এতিম হলেও ছোটবেলা থেকে আত্মীয়- স্বজনের টাকায় বড়ো হয়েছি, তাই এরকম একটা কলঙ্ক করে তাদের কাছে হাত পাততে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এমন সময় প্রফেসরের প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগে। একটা এনজিওর কিছু ফাইন্যান্সিয়াল কাজ করে দিতে হবে, কাজের ডিউরেশন কয়েক মাস, ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে হবে, প্রচুর টাকা দেয়া হবে। কিছু শর্ত ছিল, এই কয়েক মাস কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না এবং সবচেয়ে বড়ো কথা—এই কাজের বিষয়ে কারো সঙ্গেই কথা বলা যাবে না। অন্য কারো জন্য সমস্যা হলেও আমার জন্য সোনায় সোহাগা’ নাঈম খানিকটা ফোঁপালেও তাকে দেখে মনে হচ্ছে হাতের ব্যথা অনেকটাই কমেছে। কিন্তু এখনো এক হাতে অপর হাত চেপে ধরে আছে। ‘আমি প্রায় তেমন কিছু না শুনেই স্রেফ মোটামুটি সব গুছিয়ে একরকম বলতে গেলে পালালাম। প্রথমেই খানিক অবাক লাগল, কারণ আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো খুব গোপনীয়তার সঙ্গে এবং এমনভাবে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো বলতে গেলে টেরই পেলাম না কিছু। আমি খুব বেশি গা করিনি। কারণ আমার জন্য ওটার মঙ্গল ছিল তখন। যাওয়ার পর দেখলাম এক জায়গায়

আমাদের থাকার আর কাজ করার সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। আমাদের বলতে ওখানে আমরা তিনজন ছিলাম।’

‘তুমি কামাল আর টোকন?’

‘হুমম, আমি ওদের আগে থেকে চিনতাম না, ওখানেই পরিচয়, একেবারেই আমার বয়সী, পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হতে খুব বেশি সময় লাগল না। আর না হয়েও উপায় ছিল না, কারণ একসঙ্গেই কাজ করতে হতো। আমাদের কাজ ছিল ডাটা নিয়ে। টোকনই মূল ছিল, কারণ সে কম্পিউটার এক্সপার্ট ছিল, আমি ফাইন্যান্সিয়াল ডাটা নিয়ে কাজ করতাম আর কামাল কোয়ালিটেভ মানে ডিটেইল ডাটা নিয়ে। প্রফেসর শফিকের মাধ্যমে হলেও তিনি প্রথমদিন কাজ বুঝিয়ে চলে যান, অন্য আরো কয়েকজন ছিল তারা নিয়মিত ব্রিফ করত এবং প্রচুর কাজ ছিল আমাদের। প্রচুর ডাটা প্রসেস করে সেগুলোকে কনভার্ট করতে হতো। এক কথা বলতে গেলে দিনরাত কাজ করতে হতো। আমি প্রথমদিকে কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু ডাটার প্যাটার্ন নিয়ে একটু সন্দেহ লাগত আমার কাছে। সেই সঙ্গে আরো একটা জিনিস নিয়ে সন্দেহ লাগত, সেটা হলো টোকনের আচরণ, আমার কাছে মনে হতো টোকন অনেককিছু জানে কিন্তু সে বলত না এমনকি তার ওখানে যাওয়ার পেছনে কারণও ভিন্ন ছিল। আরো একটা ব্যাপার অবাক লাগত, আমার মতো হতো আমরা যাদের জন্য কাজ করছিলাম ওরা আমাদের ওপরে নজর রাখছে এমনকি আমাদের কথাও শুনছে। আমরা খুব রেয়ার বাইরে যেতাম, তাও সঙ্গে লোক থাকত। এরকমই একদিন বাইরে গিয়ে সুযোগ বুঝে টোকন আমাদের সরিয়ে ফেলে। ওইদিনই ও খুব বেশি না হলেও খানিকটা বলে আমাকে সেই সঙ্গে এই ওয়ার্নিংও দেয় আমাদের কাজ শেষ হলেও ওখান থেকে আমাদের বাইরে যেতে নাও দিতে পারে। খুব অবাক হলেও আমরা আসলে খুব বেশি কথা বলতে পারিনি এবং ওইদিনের পর থেকে আমার মনে হতে থাকে আমাদের নিয়ে ওদের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়, নজরদারিও। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি টোকন আর কামাল মিলে খুব গোপনে এবং সাবধানে ডাটার ওপরে নজর রাখতে শুরু করি এবং খুব মারাত্মক কিছু জিনিস ধরা পড়তে শুরু করে আমাদের চোখে।’

‘কিরকম?’ আরিয়ান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

‘আর কীসের ডাটা ছিল ওগুলো?’ জুলহাস জানতে চাইল।

‘কীসের ডাটা ছিল না সেটাই বলা বাহুল্য, হিউম্যান বডি রিলেটেড বায়োলজিক্যাল ডাটা থেকে শুরু করে স্ট্যাটিসটিক্যাল ডাটা, ইন্টারভিউ ডাটা এমনি কিছু নেই যা ওখানে ছিল না। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো ডাটাগুলো আমাদের এমনভাবে দেওয়া হতো সেগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য যে আমরা বিশেষ কিছু ধরতে পারতাম না। ব্যাপারটা অনেকটা অন্ধকে হাতির কান, পা মাথা আলাদা আলাদা দেখানোর মতো, ফলে অন্ধ যেমন কখনোই বুঝতে পারত না পুরো হাতিটা কেমন, তেমনি আমরাও ধরতে পারতাম না পুরো জিনিসটা কেমন। কিন্তু আমরা হঠাৎ একটা ব্রেক পেয়ে যাই এবং সেটা পাই কামালের মাধ্যমে। এটাও টোকনেরই আইডিয়া

আইডিয়া ছিল, কারণ আমাদের ভেতরে একমাত্র কামালই কোয়ালিটেটিভ মানে ডিটেইল ডাটা নিয়ে কাজ করত। ওর ডাটাতেই মূল জিনিসটার খানিকটা আভাস পাই আমরা, আর টোকন ছিল খুব চালু মাল—মূল জিনিসটার খানিকটা আভাস পাওয়ার পর সে এমন এক সিস্টেম করে কীভাবে যেন। যে-ডাটা নিয়ে আমরা কাজ করতাম সেটার একটা ব্যাকআপ ক্রিয়েট করে রাখতে শুরু করে। ফলে যেটা হয়, আগের আর পরের ডাটা ওরা এলোমেলো করে আমাদের দিলেও আমরা সেগুলোকে প্রসেস করার পর আগের ডাটার সঙ্গে মিলিয়ে একটা ডাটা সেট তৈরি করতে শুরু করি ধীরে ধীরে। বিষয়টা খুব জটিল আর পুরো ব্যাপারটাই টোকন করছিল, ও আসলে এই উদ্দেশ্যেই ওখানে গেছিল, কামালকেও ওই নিয়ে গেছিল। আমি সব টেকনিক্যাল ডিটেইলে যাব না,’ আহত হাতটা ঝাড়া দিল সে একবার।

‘শুধু এটুকু বলি, ওখানে যাওয়ার আড়াই মাসের মাথায় আমরা প্রথমবারের মতো পুরো ডাটা সেটের খানিকটা অংশ লিনিয়ারওয়েতে মিলিয়ে আমরা খানিকটা ধরতে পারি, আমরা অসলে কীসের ভেতরে গিয়ে পড়েছি। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। বুঝতে পারি আমরা নিজেদের মরণ ডেকে এনেছি।’

‘ফর গডস সেক, আপনি কি বলবেন কী নিয়ে পুরো বিষয়টা?’ রাসনা প্রায় ধমকে উঠল। ‘অপেক্ষা করতে করতে মস্তিষ্ক আর লোড নিতে পারছে না।

রহমান হেসে উঠতে তার দিকে খুব ভয়ে ভয়ে ফিরে তাকাল নাঈম। ‘বলো সমস্যা নেই, তোমরা এমনেও গেছ ওমনেও গেছ।’

নাঈম তাও ভয়ে ভয়ে ওদের একবার দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ‘সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আমাদের দেশ এবং আমাদের দেশের মতো এমন সব দেশের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ নিয়ে, যা আমাদের এত বেশি আছে যে এটার যে আলাদা একটা মূল্য আছে এবং এটা যেকোনো দেশের জন্য সবচেয়ে বড়ো সম্পদ হতে পারে, এই ব্যাপারটাই আমরা ভুলে গেছি।’

নাঈমের কথা শুনে খিক খিক করে হেসে উঠল রহমান।

‘মানে?’

‘আমাদের দেশে কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি আছে?’ নাঈম চোখ খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ব্যথা কিংবা কষ্ট অথবা বাজে স্মৃতি যেটার প্রভাবেই হোক না কেন তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে।

‘কৃষি সম্পদ—’ জুলহাস খানিক অবাক হয়ে বলে উঠতে যাচ্ছিল, আরিয়ান তাকে থামিয়ে দিল। ‘মানুষ, ওরা মানুষের কথা বলছে।’

‘মানে?’ জুলহাস খুব অবাক হয়ে বলে উঠল। ‘মানে কী এর?’

‘পুরো ব্যাপারটা এক্সপেরিমেন্ট,’ বলে সে আনমনে মাথা নাড়তে লাগল। ‘ভয়াবহ হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে।’

কোনো কারণ ছাড়াই আরিয়ানের গা শিউরে উঠল কেন জানি।

১৬

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,’ কথাটা যদিও জুলহাস বলে উঠল কিন্তু রাসনা এবং আরিয়ানেরও একই কৌতূহল। কেন জানি জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে আরিয়ানের মনে হলো, এই লোকও আসলে খুব বেশি কিছু জানে না এই ব্যাপারে।

‘হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট মানে কী?’

‘পুরো বিশ্ব যেদিকে যাচ্ছে তাতে একদিকে ফিউচার সায়েন্সের একটা বড়ো রেভ্যুলুশন হতে যাচ্ছে হিউম্যান বডি হ্যাক করা, যেটাকে বলে হ্যাকিং হিউম্যান। গুগলে সার্চ দিলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা আসলে কতটা গুরুতর আর ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। পুরো বিষয়টার এটা একটা দিক, অন্যদিকে সেই সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান এবং মানুষের কাছে সবচেয়ে বড়ো যতগুলো রহস্য আছে তার ভেতরে অন্যতম একটা হলো হিউম্যান বডি, মানুষের শরীর—’

‘এবং মানুষের মস্তিষ্কও, হিউম্যান সাইকোলজি,’ নাঈমের বক্তব্যের মাঝে যোগ করল রহমান।

‘প্রথমে পুরো বিষয়টার ব্যাকগ্রাউন্ড বর্ণনা করছি, এরপর হ্যাকিং হিউম্যানের বিষয়টা বলছি, তারপর আমাদের বর্তমান ঘটনার সঙ্গে এসব কীভাবে সংযুক্ত সেটা বলছি,’ নাঈম নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়ে বলে যেতে লাগল। ‘খুব আধুনিক প্রযুক্তির কথা যদি বাদও দিই সেই সৃষ্টির আদি থেকে মানুষ তার নিজের শরীর এবং মস্তিষ্ককে বোঝার চেষ্টা করেছে। ইবনে সিনা যখন হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে চিকিৎসার বিষয়কে প্রায় বৈজ্ঞানিক রূপ দিয়েছে, ইংল্যান্ডে তখনো চিকিৎসা করাকে ন্যাক্রোমেন্সি মানে খোদার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বিবেচনা করা হতো, কারণ ওরা তখনো মনে করত অসুখ দিয়েছে স্রষ্টা কাজেই সেটার চিকিৎসা করা মানে খোদার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এই সত্য ঘটনা নিয়ে স্যার বেন কিংসলের দ্য ফিজিশিয়ান নামের মুভিটা দেখলে বা একই নামের বইটা পড়লে জানতে পারবেন,’ বলেই নাঈম নিজের হাত নাড়ল। ‘লেকচার দিচ্ছি না, বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। পুরো বিষয়টা বুঝতে হলে এসব জিনিস জানাটা জরুরি। আমি মূল যে পয়েন্টটা মেইক করতে চাচ্ছি সেটা হলো, সেই সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে শামান ওঝা হোক আর আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার  হোক—সবাই হিউম্যান বডিকে বুঝতে চায়, জানতে চায়, বোঝার চেষ্টা করেছে এবং জানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষের ডিএনএর গঠন হোক অথবা তার শরীরে কোনো ওষুধের প্রভাব হোক, অথবা তার সাইকির কোনো জটিল বিষয় হোক— এসব সবাই জানতে চায়। মার্কেটিং এজেন্ট থেকে শুরু করে বিশ্বের বড়ো বড়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাপ ডিজাইনাররা পর্যন্ত সবাই এসব জানতে চায়, বুঝতে চায়। আর তাই এসব তথ্যের মূল্য অপরিসীম। ধরেন যেভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিচালিত হচ্ছে তাতে মানুষের শরীরসংক্রান্ত তথ্য এখন সবচেয়ে দামি। ধরেন কেউ একজন হার্টে একটা পেসমেকার লাগাল, এটার পরিচালনা এবং ফাংশন হচ্ছে কোনো একটা অ্যাপের মাধ্যমে, এই তথ্য যার কাছে থাকবে সে ওই মানুষটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন ভেবে দেখেন, এক লাখ মানুষের হার্টের পেসমেকার কীভাবে ফাংশন করছে—এই তথ্য যার কাছে আছে, সে কতটা প্রভাবশালী হবে, কী করতে পারবে না সে। সেইম কথা প্রযোজ্য অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই, আমি বলতে থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারব। অত কথার কাজ নেই, শুধু এটুকু বলি, হিউম্যান হ্যাকিং হতে যাচ্ছে প্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্ম। আর এটা স্রেফ একটা বিষয়। আর এই কারণেই হিউম্যান বডি আর সাইকি নিয়ে তথ্যের ভাণ্ডার এখন সবচেয়ে দামি। একটা সার্টেন ওষুধে বডি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে, সত্যিই কি সুপার হিউম্যান বডি তৈরি করা সম্ভব? সত্যিই কি জেনেটিক মোডিফিকেশনের মাধ্যমে নিরোগ আর পারফেক্ট হিউম্যান জেনারেশন তৈরি করা সম্ভব? এসব এখন সময়ের প্রশ্ন।’

টানা কথা বলে নাঈম খানিকটা থামল। তারপর আবারো বলতে শুরু করল। ‘আর কিন্তু হিউম্যান বডি হোক বা সাইকি, এ-নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার একটা ভয়াবহ সমস্যা হলো–’

‘এথিক্স, চাইলেই হিউম্যান বডি বা সাইকি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই,’ আরিয়ান অনেকটা আনমনেই বলে উঠল। সে খানিকটা ধরতে পারছে আলোচনাটা কোনদিকে যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন আপনি, নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগ হোক কিংবা কোনো কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন অথবা সাইকিক এক্সপেরিমেন্ট উন্নত যেকোনো দেশ যারা এ-ধরনের কাজ প্রকৃতঅর্থেই করতে সমর্থ, তাদের দেশে এসব করা অনেক ঝামেলা। এন্টরনাল রিভিউ বোর্ড, হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন থেকে শুরু করে সরকারের কড়া নজরদারি থাকে, যেখানে প্রথমত রিস্কি কোর প্রজেক্ট করার পারমিশনই পাওয়া যায় না, আরো হাজারটা নিয়ম-কানুন ইত্যাদি মানতে হয়, যেখানে চুন থেকে পান খসলেই হাজারটা জবাবদিহিতা করতে হয়—তো হয়নি, লাইসেন্স বাতিল হওয়া থেকে শুরু করে ক্যারিয়ার বরবাদ তো হবেই, সঙ্গে সারা জীবনের জন্য নিষিদ্ধ হতে তো হয়ই, জেল এমনকি ফাঁসি পর্যন্ত হওয়া বিচিত্র নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনী যুদ্ধবন্দি থেকে শুরু করে ইহুদিদের ওপরে ইচ্ছেমতো এসব এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে। সেসব ডাটা অনেকে কাজেও লাগিয়েছে। তথ্য দরকার কিন্তু প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। উপায় কি, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে যখন পুরো বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করে কম্পিউটার সব সেক্টর দখল করে নিতে শুরু করে সেইসময়ে বিশ্বব্যপী কিছু অবৈধ এবং গোপন সংস্থার উৎপত্তি হয় যারা নানারকম খুব হারামি এবং অভিনব আইডিয়া নিয়ে আসে।’

‘এরা অনুন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করাপশনের সুযোগ নিয়ে এরা নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট চালাতে শুরু করে এবং সেসব ডাটা এরা বিশ্বের বিভিন্ন বড়ো বড়ো সংস্থাকে বিক্রি করতে শুরু করে। আমরাও এর বাইরে ছিলাম না, শুরুটা হয় বিভিন্ন সংস্থাকে ফ্রি-ওষুধ বিতরণের মাধ্যমে। সবটা জানা নেই তবে এটা নিশ্চিত যে, এসব ওষুধে কিছু এক্সপেরিমেন্টাল পরিবর্তন থাকে, আর সেগুলো কীভাবে হিউম্যান বডিতে রিঅ্যাক্ট করে এর মাধ্যমে শুরু হয়।’

‘নব্বইয়ের দশকের শুরুর প্যারাসিটামল স্ক্যান্ডাল,’ আনমনেই বলে উঠল রাসনা।

‘সময় এগোতে থাকে অথরিটির ভেতরে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনের সুযোগ নিয়ে দিন দিন বাড়তে থাকে, শুধু এই দেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই। আর্লি টু থাউজেন্ডে এরা বিশ্বব্যাপী এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, বলা হয়ে থাকে আফ্রিকার অনেক দেশে এরাই আসলে সরকার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশেও এরাই অপারেট করে, প্রথমে এরা এতটা বড়ো ছিল না ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, কারণ আর যাই থাক না থাক আমাদের দেশে অন্তত মানুষের কোনো অভাব নেই। করাপ্টেড লোকজনেরও,’ শেষ কথাটা বলার সময় সে একবার রহমান এবং জোনায়েদের দিকে দেখে নিল।

‘তারমানে এই প্যারাসিটামল স্ক্যান্ডালের সঙ্গে এদেরই সংযোগ ছিল?’

‘সার্বিক সবকিছু দেখে এটাই সত্যি মনে হবে, পুরোপুরি ধারণাও না, আবার একেবারে কংক্রিট প্রমাণ আছে সেটাও বলা যাবে না। এডুকেটেড গেস বলতে পারেন।’

‘সেটা না হয় বুঝলাম, তবে কি ওই ম্যাস হিস্টিরিয়া, এতিমখানার স্ক্যান্ডাল, নদীর পাড়ের জঙ্গলের সেই অদ্ভুত প্রাণী—সবই এসবের সঙ্গে কানেকটেড?’ রাসনা খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘ম্যাস হিস্টিরিয়ার ব্যাপারটাও ওদেরই হয় কোনো ধরনের কেমিক্যাল লিকেজের কারণে অথবা কোনো ধরনের সাইকিক এক্সপেরিমেন্টোল ফেইলিওরের কারণে হয়েছিল, নদীর পাশের জঙ্গলের ওই অদ্ভুত প্রাণী আর কিছুই না ওদেরই ল্যাব থেকে পালানো কোনো এক মানুষই ছিল আমার বিলিভ, কারণ এই দুটো ঘটনাই কাছাকাছি এলাকাতে ঘটেছে এবং ভুল না হলে আমার ধারণা ওদের ল্যাব থেকে বিকৃত হয়ে যাওয়া কেউ পালিয়েছিল এবং সে-মানুষটাকে ওরা ধাওয়া করেও ধরতে পারছিল না। আর মানুষটাও লোকালয়ে যাচ্ছিল না ওদের হাতে ধরা পড়ার ভয়েই। সেই সময়েই তাকে ঘিরে মিথ ছড়িয়ে পড়ে। মিডিয়া সোচ্চার হয়ে পড়ে কিন্তু পরে সম্ভবত লোকটা ধরা পড়ে যায় সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যায়—

নাঈম এই পর্যন্ত বলতেই রহমান হাসতে লাগল এবং তার হাসিতে পরিষ্কার নির্দেশনা যে ওরা ঠিক পথেই ভাবছে। আরিয়ান রাগের সঙ্গে লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবারো রাসনা প্রশ্ন করে বসল, ‘আর এতিমখানার বিষয়টা তাহলে—’

‘এটা ব্যাখ্যা করতে হলে বাস্তবিক দিকে নজর দিতে হবে,’ নাঈম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল। ‘এটা ভালো কারণ যা বলতে শুরু করেছি, সেই বক্তব্য পুরো করতে হলে এই জায়গাতে আসতেই হতো। এতক্ষণ ধরে আলোচনার পর এটা তো পরিষ্কার যে—পৃথিবীর বহুরাষ্ট্রে যে-ধরনের শারীরিক এবং মানসিক এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব নয়, সে-ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য বেছে নেয়া হয় তৃতীয় বিশ্বের বা এ-ধরনের করাপ্টেড কিছু স্টেটকে, সেখানে করাপ্টেড অথরিটিকে হাত করে এসব করা হয়। এমন কিছু একটা, সেটা যাই হোক আমাদের এখানেও পরজীবীর মতো গড়ে উঠেছে যারা মানুষ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে। প্রশ্ন হলো,এখানে মানুষ সংগ্রহ করা হয় কীভাবে? ব্যাপারটা করা হয় নানাভাবে। কখনো গৃহহীন কর্মহীন মানুষদের কাজের অর্থের বা ফ্রি থাকা খাওয়ার লোভ দেখিয়ে দালালদের একটা শ্রেণি হাত করে, আবার কখনো দেশের নাম না জানা এতিমখানায় যথেষ্ট টাকা দিয়ে নাম-পরিচয়হীন বাচ্চাদের নানাভাবে নিয়ে আসা হয় এসব জায়গাতে। এরকমই এক এতিমখানা ছিল যেখানে টোকন বড়ো হয়েছিল আর ওর বন্ধু হরির সঙ্গে এমনই কিছু একটা হয়েছিল, ছোটবেলায় তাকে বড়ো ঘরে দেওয়া হবে বলে নিয়ে এসে যা ইচ্ছে করা হয় তার সঙ্গে, এরপর পাগল হয়ে গেছে মনে করে ভিক্ষুকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আসলে সে পাগলও হয়নি, স্রেফ শারীরিকভাবে বিকৃত হয়ে গেছিল। এই হরির সঙ্গেই কোনো একসময় টোকনের দেখা হয়েছিল এবং ওখান থেকেই সে নানাভাবে সূত্র সংগ্রহ করে প্রফেসর রফিকুজ্জামান পর্যন্ত এসেছিল। এখানে প্রফেসরের ভূমিকাটা বলি, এই লোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ছিল ঠিকই কিন্তু চূড়ান্ত মাত্রায় করাপ্টেড ছিল। এর মতো লোকেরাই এসব প্রতিষ্ঠানের হয়ে দালালি করে। প্রচুর টাকার বিনিময়ে নানা এনজিওর মুখোশ বানিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে কু-কাজ করার সুযোগ করে দেয়। এসব বুদ্ধিব্যবসায়ীর সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়,’ নাঈম ঘৃণাভরে বলে উঠল

‘আর তাই সে যখন বুঝতে পারে সব ফাঁস হতে চলেছে—প্রথমে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা করতে না পেরে আত্মহত্যা করে দায় এড়ায়, পাপ ছাড়ে না বাপকে,’ আরিয়ান আনমনেই বলে উঠল। ‘প্রশ্ন হলো, যারা এত ক্ষমতাবান, শক্তিশালী, এভাবে দিনের পর দিন ধরে করাপ্টেড লোকজনকে হাত করে কাজ করছে, এদের হঠাৎ টোকন তুমি বা কামালের মতো লোকজনের প্রয়োজন কেন পড়ল, এরকম ঝুঁকি ওরা কেন নেবে? এবং এখান থেকেই সব ঝামেলার শুরু, আর তাছাড়া তোমরাই বা স্রেফ ডাটা থেকে এতকিছু জেনে ফেললে এটাই বা কীভাবে সম্ভব?’

নাঈম হেসে ফেলেও আবার মুখ কুঁচকে ফেলল ভাঙা আঙুলে ব্যথা পেয়ে। ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, এরকম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষেরও যেমন কখনো খুব অসহায়ের সাহায্য লাগে তেমনি এরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন এদেরও আমাদের মতো ক্ষুদ্রের সাহায্যের প্রয়োজন পড়েছিল। শতভাগ সঠিকভাবে না জানলেও আমরা যেটা জেনেছিলাম ওদের এক গ্রুপ লোক দেশের বাইরে থেকে আসতে গিয়ে কোভিডের সময়ে আটকে যায় এয়ারলাইনস এবং ভিসা ইত্যাদি নানা সমস্যার কারণে। ওই সময়টাতে ওদের সার্ভারেও কী জানি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। যার ফলে কোভিডের ঠিক আগ দিয়ে ওদের সংগ্রহ করা ডাটার একটা বড়ো অংশ রিস্কে পড়ে যায়, সেটা দ্রুত ট্রান্সক্রাইবড এবং কোডিং করা না হলে পুরোটাই জলে যেত যে-কারণে ওরা দ্রুত লোকাল হেল্প নেয়, আর প্রফেসর রফিক তখন আমাদের নানাভাবে হায়ার করে। ওদের ইচ্ছা ছিল হয় আমাদের কোনো কোনোভাবে গায়েব করে দেবে। কিন্তু আমাদের ভেতরে টোকন ছিল খুব চালাক—সে কীভাবে যেন কাজ করতে করতে ওদের সিস্টেমে ঢুকে পড়েছিল। প্রথমে আমার ডাটা সেট মিলিয়ে কিছু জিনিস ধরতে পারি এরপরে টোকন ওদের সিস্টেমে ঢুকে পুরো ব্যাপারটা বের করে। ইচ্ছে ছিল ওদের ঘোল খাইয়ে পালাব কিন্তু টোকন সিস্টেমে ঢুকতেই ধরা পড়ে যায় কিন্তু কিছু সময়ের জন্যে ওদের সিস্টেম অচল করতে সমর্থ হয় সে। আমরা ভেবেছিলাম পালাব ওখান থেকে। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে আমরা পালাতে পারিনি। সেই সঙ্গে অবাক হয়ে দেখি আমরা যে কিছু একটা বুঝতে পেরেছি এই ব্যাপারটা ওরা পুরোপুরি ইগনোর করে। আমরা তখন বুঝতে পারিনি কেন ওরা এমনটা করছে। এমনকি প্রজেক্টের কাজ শেষ হওয়ার পর যখন সব ঠিকঠাক পেমেন্ট দিয়ে আমাদের বিদায় করে দিল ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন,’ বলে সে রহমানকে দেখাল। ‘বুঝলাম কেন ওরা এমন করেছিল। ওরা আসলে আমাদের বাইরে সরিয়ে দিয়ে সুবিধামতো নিকেশ করতে চেয়েছিল যাতে প্রজেক্টের ওপরে কোনো সন্দেহ না পড়ে। যাই হোক আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ি। কামাল প্রথমে চলে যায় মফস্বলে, তারপর ফিরে আসে ঢাকায় লেখা শিখতে। টোকন চাকরিতে জয়েন করে প্রথমে এমন ভাব করতে থাকে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে। কিন্তু না কামাল না টোকন দুজনেই তলে তলে নিজেদের কাজ করছিল। কামাল উপন্যাস লিখে তাতে ব্লু দিয়ে রাখে আর টোকন বানাতে থাকে নিজের ভার্চুয়াল ধাঁধা। আর আমি পাগল সেজে থাকতে শুরু করি। আর এরপর যা যা ঘটে সব তো আপনারা জানেনই।’

‘তারমানে বাকি সব তো বাদই, তুমি ওই জায়গাও চেন,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে জানাল সে। নাঈমের মুখ আবারো পাংশু হয়ে গেল। কিন্তু এবার সে বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠল, ‘আমি তো গেছিই, এরা তো আর আমাকে ছাড়বে না, তবে আপনারা কামালের বইটার মূল জিনিসটা বের করতে পারেননি। ওই বইয়ের ভেতরে আরো কু আছে, ওখানে এমনকি ওদের স্টেশনের ঠিকানাও আছে। টোকনের ওই ধাঁধার সঙ্গে আরেকটু এগোলেই সব পাবেন।’

‘বুঝলাম সবই বুঝলাম,’ আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে উঠল। তারপর রহমানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ‘এবার কী বলো, কী করতে চাও আমাদের নিয়ে? সে সরাসরি তাকিয়ে আছে রহমানের চোখের দিকে। ‘তুমি বলেছিলে আমরা যা জানি সব বলার পর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে কী করা হবে আমাদের সঙ্গে। এবার বলো, আমার বিশ্বাস এতকিছুর পর আমরা সবাই প্রস্তুত।’

তুমি বলো আমার জায়গায় তুমি থাকলে কী সিদ্ধান্ত নিতে?’ রহমান খুব স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল। ‘বলো।

‘আগেই বলেছি, সবাইকে মেরে লাশ গায়েব করে দিতাম,’ আরিয়ান খুব নিস্পৃহ গলায় বলার চেষ্টা করল কিন্তু না চাইতেও ওর গলা কেঁপে উঠল। ‘আর তুমিও সম্ভবত সেটাই করতে যাচ্ছে, নাকি ভুল বললাম?’

‘খানিকটা,’ রহমান নিচের ঠোঁটটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল, খুব অবাক বিষয় হলো, তাকে খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘কী হচ্ছে, কারা করাচ্ছে এটা তো বুঝতে পেরেছ, তোমার কি মনে হয়, এরা কোনো বিষয়ে কোনো মার্সি করে, যেখানে পুরো বিশ্বজুড়ে মিলিয়ন কিংবা কে জানে বিলিয়ন ডলারের বিজনেস, সেখানে আমি বা তুমি বা আমরা কেউই এদের কাছেই কিছুই না—স্রেফ একটা মশা-মাছির চেয়েও ছোট কিছু। প্রফেসর রফিকের মতো লোকও এটা জানত। আর তাই যেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে সব গুবলেট পাকিয়ে গেছে, সে প্রথমে সরে পড়তে চেয়েছিল। সেটা না পেরে মৃত্যুকেই বেছে নেয় সে। কারণ সে জানতে বেঁচে থাকলে তার পরিণতি হতো আরো খারাপ। একই কথা আমার জন্যেও সত্য। কাজেই আমার করণীয় কী বলে মনে হয় তোমাদের কাছে। তোমরা একেকজন নিজেই নিজেদের ফাঁদে এসে পড়েছ। আমার কাজ হলো সেই ফাঁদ পরিষ্কার করা। নাথিং এলস,’ সে আবারো নিজের হাতে পিস্তল বের করে এনেছে। কাজেই সবাই প্রস্তুত হও।

১৭

‘আপনার কি মনে হয়ে এভাবে সবাইকে শেষ করে দিয়ে আপনি বেঁচে যাবেন?’ রাসনা ঝাঁজের সঙ্গে বলে উঠল। ‘এত সহজ সবকিছু?’

রহমান সামান্য হেসে উঠল তার কথা শুনে। ‘সবকিছু শোনার পরও আপনার এমন মনে হচ্ছে! হাসালেন দেখছি,’ বলে সে অস্ত্রটা পাশে রেখে সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা জোনায়েদের দিকে ছুড়ে দিয়ে সেটাকে রাসনার দিকে তাক করে বলে উঠল,’প্রথম কথা হলো আমি বেঁচে যাব কি যাব না—সেটা প্রশ্ন নয়, আমি বেঁচে যাবই, কারণ এই পুরো খেলায় আমি স্রেফ একটা টাট্টু। কাজেই আমার পরিণতি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, হয়তো বা একদিন আমারও পরিণতি একই হবে, কিংবা কে জানে,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘যেদিন আমি এই খেলায় ঢুকেছি সেদিনই বুঝে গেছি আমার পরিণতি ভালো হবে না, আমাদের মতো মানুষদের পরিণতি ভালো হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়, কারণ জানেন কি প্রকৃতির মার বলে একটা ব্যাপার আছে, যাকগে আমার পরিণতি গুরুত্বপূর্ণ নয় আগেই বলেছি। তবে প্রশ্ন হলো আপনাদের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে।’

‘এভাবে সবকিছু—’

‘সবকিছু আবার কি, কোনোকিছুই কিছু না, এই প্রথমবারের মতো আরিয়ানের কথার মাঝে রহমান ধমকে উঠল। তাকে খানিকটা উত্তেজিতও দেখাচ্ছে। ‘তোমার কি ধারণা তুমি এই গল্পের হিরো আর আমি ভিলেন, তুমিও হিরো না। বিশেষ করে মানুষের কাছে এরই মধ্যে তোমার ইমেজের চৌদ্দটা বাজানো হয়েছে। তোমার গার্লফ্রেন্ডের বয়ান সেই আগুনে আরো ঘি ঢেলেছে। আর একটা কথা বলি, আমাদের এই সমাজে তোমার মতো দুই পয়সার লেখকের কোনো দাম আছে বলে তোমার মনে হয়,’ বলে সে জিভ দিয়ে চুক চুক করে উঠল। ‘এক কণাও নেই, যদি তুমি মনে করো আছে তবে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ,’ বলে সে নিজের মুখটাকে খানিক সামনে নিয়ে এলো। ‘আমাদের সমাজে যদি কিছু দাম থাকে তবে সেটা হলো টাকার, যদি কিছুর দাম থাকে তবে সেটা  হলো ক্ষমতার। আমাদের সমাজে টাকা আর ক্ষমতা ছাড়া ঈশ্বরও অসহায়। উদাহরণ দিচ্ছি, আমাদের সমাজে একটা সাধারণ মানুষ দেখাও যে রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ করে, একটা মানুষও পাবে না। অন্যদিকে আমাদের সমাজে একটা মানুষ দেখাও যে দরিদ্র আদর্শবান মানুষকে আদর্শ হিসেবে মানে, একটাও পাবে না। যদি কেউ এমনটা বলে তবে সেটা ঢাহা মিথ্যে। আমাদের সমাজের মানুষ যদি মুখে যত বড়ো বড়ো কথাই বলুক তারা দুর্নীতি আর অবৈধ টাকাকেই আদর্শ মানে ভেতরে ভেতরে। যদি তা না হতো তবে এরকম একটা ধর্মভীরু রাষ্ট্রে এতটা দুর্নীতি কোনোদিনই অবস্থান করতে পারত না, সামাজিক স্বীকৃতি আছে বলেই এতটা করাপ্টেড আমরা। করাপশন আমাদের সমাজের ক্ষত নয়, সৎ মানুষেরা আমাদের ক্ষতময় সমাজের ব্যতিক্রম,’ বলে সে দম নিল।

‘বলো আমি ভুল বলেছি কি না। একটা কথাও আমার ভুল নয়। আর এরকম সমাজে একজন লেখকের অবস্থান কোথায়? জিরো, শতভাগ জিরো। আমাদের সমাজ লেখকদের লেখা পড়ে, উপভোগ করে, শিল্পীদের শিল্প উপভোগ করে কিন্তু মন থেকে এদের ঘৃণা করে। আর তাই আমাদের সমাজে যখন একজন লেখক শিল্পীর নামে কুৎসা রটলে মানুষ না জেনেই বিশ্বাস করে, আর একজন সরকারি চাকরিজীবীর নামে কুৎসা রটলে মানুষ বলে আহা লোকটা ষড়যন্ত্রের শিকার, সত্য যাই হোক। আমি সে তর্কে যাচ্ছি না, শিল্পী-সাহিত্যিকরা ধোয়া তুলসী পাতা, সেটাও বলছি না, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটা বলছি। কাল যখন প্রকাশিত হবে একজন লেখক নিজের বন্ধুকে খুন করে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে সাজিয়েছে, তার প্রেমিকাও এর সঙ্গে জড়িত ছিল, মানুষ তাকেই ঘৃণা করবে, সত্য-মিথ্যার ধার দিয়েও যাবে না। কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় লেখকরা খারাপ, মানুষ বিশ্বাস করতে চায় এরা চরিত্রহীন, সেটা আদতে এরা হোক বা না হোক। এই সমাজে টাকা আর ক্ষমতার পর যদি কিছুর দাম থাকে তবে সেটা হলো সরকারি চাকরিজীবীদের। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে মিলিয়ন ডলার কামানো একজনকে আমার মতো একজন সরকারি চাকরিজীবীর পাশে দাঁড় করাও, সমাজ আমাকেই দাম দেবে। আমাদের সমাজে সবাই আদর্শ মানে থ্রি ইডিয়টসের র‍্যাঞ্চোকে, আর বেলা শেষে সবাই ভেতরে ভেতরে হতে চায় সিনেমার ফালতু চরিত্র চতুরের মতো। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব,’ বলে সে চট করে থেমে গেল। উত্তেজনার চোটে সে সিগারেট টানতে ভুলে গেছে, টপ করে ছাই খসে পড়ল সেটা থেকে।

‘তুমি ভুল বলোনি,’ তার জবাবে আরিয়ান খুব শান্ত স্বরে বলে উঠল। ‘মানব সমাজ এমনই, এখন বলে কথা না—সৃষ্টির আদি থেকেই এমন ছিল, আমাদের সমাজ বলে কথা না, দুনিয়ার সবখানেই টাকা, ক্ষমতা আর সাফল্যই মানদণ্ড। কিন্তু সত্যি কথা কী জানো, দুনিয়াতে কিছু মানুষ সবসময়ই ছিল যারা এমনটা ভাবে না, তোমার কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এই ব্যতিক্রম চিন্তা ভাবনার মানুষেরাই চিরকাল ইতিহাস সৃষ্টি করে এসেছে এটাই সত্যি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সময়ের কোনো আমলাকে ইতিহাস মনে রাখেনি, লিওকেই মনে রেখেছে। শেকস্ পিয়রের সময়ের কোনো ক্ষমতাবান থিয়েটারের মালিককে ইতিহাস মনে রাখেনি, শেকস্ পিয়রকেই মনে রেখেছে। একটু আগে তুমি বললে না প্রকৃতির মার বলে একটা কথা আছে, এটাই প্রকৃতির মার,’ ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল আরিয়ান। ‘এখন বলো—’

‘তুমি শেষ আরিয়ান,’ মানুষ যখন যুক্তিতে পারেনা তখন জোর খাটায়। রহমানও তাই করছে এখন। ‘তোমাকে এরই মধ্যে শেষ করে ফেলা হয়েছে, এখন শুধু তোমার এই দেহটা আছে,’ বলে সে আরিয়ানকে আগা-মাথা দেখাল। ‘আর ঝামেলা যেটা ছিল সেটা হলো এই ম্যাডামকে নিয়ে, তোমার সঙ্গে জড়িয়ে তাকেও যথেষ্ট কলঙ্কিত করা হবে এবং,’ বলে সে রাসনার দিকে দেখল। ‘বাকিটা আমাদের হয়ে মিডিয়াই করে দেবে। আর তোমরা। জুলহাস আর নাঈমকে দেখাল, তোমাদের কোনো অস্তিত্বই নেই, আর তাই সেই অস্তিত্বের কোনো দামও নেই। তোমরা স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে। নাঈমের পরিবারের কিছু লোকজন আছে, যারা তাকে শেল্টার দিয়ে রেখেছিল, তারা হয়তো বা খানিক চেষ্টা করবে, কিন্তু যেই মুহূর্তে ওরা কীভাবে তোমাকে পাগল সাজিয়ে শেল্টার দিয়েছে, সেটা ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানো হবে ওরা নিজেদের পাছা বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠবে, তোমার জন্য তখন ওদের আর সময় থাকবে না। আর তুমি, জুলহাসকে দেখাল সে, তোমার সঙ্গে আর একটাই কাজ আছে, সেটা হলো, টোকনের সেই ধাঁধার ব্যাপারগুলো তোমার ল্যাপটপ থেকে বুঝে নেওয়া। সেটা একবার করে ফেললেই বাকিটা—’ বাক্য শেষ না করে সে নিভে যাওয়া সিগারেটের মোথাটা ছুড়ে ফেলে দিল।

‘তারামানে মেরে ফেলা হবে আমাদের সবাইকে?’ আরিয়ান ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল। ‘স্রেফ গুম করে ফেলা হবে, তাই না?’

‘দেয়ার ইজ দ্য টুইস্ট অব দ্য স্টোরি, বলে রহমান খনখনে শুষ্ক গলায় হেসে উঠল। বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো উচ্চস্বরে হা-হা হাসি নয়, কিন্তু উন্মাদ ঠান্ডা পিশাচের হাসি, যে-বাজে সিস্টেমের পঙ্কিল পাকে নিমজ্জিত হয়ে ভেতরটা যখন পচে যায়, সেই পচা মানুষের মনের গহিনের অন্ধকার অতল থেকে উঠে আসে এ-ধরনের শুষ্ক নির্জীব হাসি। ‘তুমি যা বললে আমিও প্রথমে সেরকমটাই ভেবেছিলাম কিন্তু পরে নিজের ভাবনা-চিন্তা পরিবর্তন করেছি, সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তও। তবে আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই সুদর্শন ছেলেটা,’ বলে সে জোনায়েদকে দেখাল। ‘সত্যি কথা হলো আমি বহু বছর ধরে এই অর্গানাইজেশনের জন্য কাজ করছি এবং আমার পারফরমেন্স ছিল খুবই ভালো। দুহাতে কামিয়েছি টাকা আর শরীর ভরে উপভোগ করেছি ক্ষমতা। কিন্তু কয়েকদিনে বিশেষ করে গতকাল থেকে আপনাদের ধাওয়া করতে শুরু করার পর থেকে একটার পর একটা ভুল করেছি এবং আমার রেপুটেশন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই কারণেই যখন ফাইনালি আপনাদের ধরার সুযোগ এলো এই ছেলেটা যে-নিজেও বিগত দু-বছর ধরে খেটেখুটে এই সংস্থার একজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, ও একটা প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটা আমার মনে ধরেছে কারণ এটা আমার ক্যারিয়ার এবং পারফরমেন্সকে আরো এগিয়ে দেবে, অন্যদিকে জোনায়েদকে মূল দলে ঢুকতে সাহায্য করবে, ওকে আমার প্রয়োজন। ওর পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে ও প্রয়োজনে আমার চেয়েও নিষ্ঠুর হতে পারে, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। কাজেই সব মিলিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাদের মারব না,’ বলে সে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

আরিয়ান নিজের ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে এরা আসলে কী করতে যাচ্ছে, কারণ এদের মুখভঙ্গি দেখে একেবারেই ভালো লাগছে না ওর কাছে। হঠাৎই সে বুঝতে পারল কী করতে যাচ্ছে এরা ওদের নিয়ে, জুলহাসের দিকে একবার আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সে চট করে ফিরে তাকাল রহমানের দিকে।

‘তোমরা আমাদের সেই ল্যাবে নিয়ে যাবে এবং আমাদের ওদের কুৎসিত এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করবে,’ যুগপৎ আতঙ্কের সঙ্গে আরিয়ানের শরীরে ভয়াবহ শিহরণ খেলে গেল। সে তাকিয়ে দেখল বাকরুদ্ধ রাসনা এবং নাঈম তো বটেই জুলহাসের অবস্থাও একই। রহমানের দিকে ফিরে তাকাতেই ও দেখতে পেল পিশাচটার মুখে বিকৃত হাসি।

আরিয়ান ফিরে তাকাতেই সে নিজের হাতের অস্ত্রটা নেড়ে বলে উঠল, ‘বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই এক মজা,’ বলে নিজের হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে হেসে বলে উঠল, ‘একেবারে ঠিক ধরেছ তুমি, বিগত এক ঘণ্টা ধরে আমরা ওদিকেই যাচ্ছি।’

১৮

মৃদু দুলুনির সঙ্গে ভ্যানটা থেমে যেতেই ধারণা করল জায়গামতো এসে গেছে ওরা। ওদের মনের ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে মৃদু হেসে হাতের অস্ত্র নেড়ে রহমান বলে উঠল, ‘ওয়েলকাম টু হেল, ডিয়ার ফ্রেন্ডস,’ বলেই সে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে হালকা ইশারা করতেই জোনায়েদ এসে হাতের ছোট্ট একটা চাবি দিয়ে ভ্যানের লোহার বেঞ্চের সঙ্গে আটকানো ওদের পায়ের বেড়িগুলো খুলে দিতেই ওরা সোজা হয়ে বসল, প্রায় ঘণ্টাখানেকের ওপরে একরকম বাঁকা হয়ে বসে থেকে সবার পিঠ ব্যথা হয়ে গেছিল, সোজা হয়ে বসে সবাই শরীরটাকে ঠিকঠাক করতে লাগল। একটু আগে রহমান ওদের পরিণতি ঘোষণা করার পর খুব বেশি সময় পার হয়নি, বড়জোর দশ-পনেরো মিনিট হবে। এই সময়ের ভেতরে ওরা আর কেউ তেমন কিছু বলেনি, রহমান আর জোনায়েদের নিজেদের ভেতরে কথাবার্তা বলেছে, তবে ওরা এমনভাবে কথা বলেছে, ওরা ঠিক বুঝতে পারেনি। নাঈম, নিজের হাত চেপে ধরে কোনায় বসে ঘামছিল, রাসনাকে কেমন যেন নির্জীব লাগছিল, আরিয়ান শুধু একবার তার হাতের ওপরে হাত রেখে সামান্য আশ্বাসের ভঙ্গিতে চাপ দিয়ে বলেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে,’ কথাগুলো ওর নিজের কানেই কেমন জানি বেখাপ্পা ঠেকেছে।

তবে মূল কমিউনিকেশনটা হয়েছে ওর আর জুলহাসের ভেতরে। ওদের ভেতরে একমাত্র জুলহাসের তরফ থেকেই খানিকটা আশার আলো আছে বেশ কয়েকটা কারণে। প্রথমত, জুলহাসের ভিডিওটার ব্যাপারে কেউই কিছু জানে না, আরিয়ান ভেবে রেখেছে কোনো ফাঁকে সুযোগ পেলেই জুলহাসের সঙ্গে কথা বলে ওটাকে সে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত চেষ্টা করে দেখবে কিছু করা যায় কি না, আর ওরা জুলহাসের সঙ্গে আরো একটা বিষয়ে কথা বলবে, অন্তত ওর ল্যাপটপ থেকে কিছু জিনিস বের করার জন্য হলেও ওদের জুলহাসের হেল্প লাগতে পারে। তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনো সম্ভবনা নাও থাকতে পারে, কারণ ওদের হয়তো জুলহাসের থেকে কিছু লাগবেই না, নিজেদের যা প্রয়োজন সেটা নিজেরাই বের করে নিতে পারবে। তবে জুলহাসের সঙ্গে যা-ও খানিক প্রয়োজন, অন্যদের সেটাও নেই। আরিয়ানের মাথায় ভাবনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনোটাই ঠিকমতো সেট হচ্ছে না। কী করা যেতে পারে নিজেদেরকে সেভ করার জন্য, ভাবতে ভাবতেই থেমে থাকা ভ্যানটার দরজা একটানে খুলে ফেলল জোনায়েদ।

‘নামো সবাই,’ আরিয়ান দেখল জোনায়েদ নিচে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে অস্ত্র নেই কিন্তু কোমরে দুপাশে দুই হাত রেখেছে, যাতে প্রয়োজন হলেই অস্ত্র বের করে আনতে পারে। আর ভ্যানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে রহমান, তার হাতে অস্ত্র। ওরা একে একে নেমে এলো। আরিয়ান নিচে নেমে দেখল একটা তারের বেড়া দেওয়া বাউন্ডারির মতো জায়গার ভেতরে ছোট একটা আঙিনার মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওদের ভ্যানটা। সবুজে ছাওয়া জায়গাটা দেশের যেকোনো সাধারণ ছোটখাটো ফ্যাক্টরি কিংবা উপজেলা পরিষদের এনজিও অফিসের মতোই। বাইরের বাউন্ডারিটাও খুবই সাধারণ এবং একেবারেই আলাদাভাবে নোটিশ করার মতো কিছু নয়। ওরা দেখল, আঙিনার একপাশে ছোট একটা পাশ খোলা ছাউনির মতো, সেটার ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে ওদের ভ্যানটা। ওরা একে একে নেমে এসে দাঁড়াল ছাউনির ভেতরেই একপাশে। আরিয়ান চারপাশে তাকিয়ে দেখল ছাউনির অন্যপাশের ভবনটা একেবারেই সাধারণ হলেও বেশ লম্বা আছে, অন্যপাশের শেষ অংশটা দেখা যাচ্ছে না। ভবনটার পেছন দিকে একটা ছোট সাইনবোর্ডের মতো, আরিয়ান দূর থেকেও ওটার গায়ের লেখাগুলো পড়তে পারল।

‘মজা ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড চানাচুর ফ্যাক্টরি,’ সাইনবোর্ডের দুপাশে কয়েকটা রুটি, বিস্কুটের প্যাকেট আর দুটো বাচ্চার ছবি। এরকম খাবার বাংলাদেশের গ্রাম- গঞ্জের উপজেলা শহরগুলোর রাস্তার পাশের সাধারণ কনফেকশনারি কিংবা চায়ের দোকানে অ্যাভেইলবল দেখতে পাওয়া যায়, এসব পণ্যের ফ্যাক্টরিগুলোও এমনই হয়, একেবারে সাধারণ, নাথিং ফ্যান্সি। ‘নাঈম আপনারা কি এখানেই ছিলেন?’ আরিয়ান বিড়বিড় করেই জানতে চাইল।

নাঈম নিজের হাতকড়া পরা হাতেই অপর হাতটা চেপে ধরে রেখেছে। ‘আমি বুঝতে পারছি না, হতে পারে ওরকম লাগছে আবার লাগছেও না। ওরা এমনভাবে আমাদের ওখানে নিয়েছিল এরপর সরিয়েছিল ঠিক বলা সম্ভবও না।’

‘কথা কম, আমরা মূল এলাকায় প্রবেশ করব এখন,’ রহমান মৃদু হেসে বলে উঠল। ‘জোনায়েদ রেডি তো?’ সে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে সাহস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘তোমার লাইফ বদলে যেতে চলেছে আজ থেকে, অপরিসীম ক্ষমতা আর অর্থের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও,’ বলে সে খানিক জোরেই হেসে উঠল ‘আর তোমরা—’ সে খুব হেসে কিছু একটা বলেতে যাচ্ছিল, তার আগেই ওদের পায়ের নিচের মাটি সামান্য নড়ে উঠল।

‘কী ব্যাপার ভূমিকম্প নাকি?’ জোনায়েদ সামান্য কেঁপে উঠেই সোজা হয়ে গেল আবার। ওরাও নড়ে উঠেছিল, নিজেদের সামলে নিল। অস্ত্র হাতে একমাত্র স্থির হয়ে আছে রহমান, ওদের চমকানোটা খুব উপভোগ করছে যেন সে। ব্যাপারটা খানিক পরেই ওরাও ধরতে পারল। ওরা যে ছাউনিতে থেমেছিল ওটা আসলে একটা লিফটের মতো, ওরা ওপরে এসে নামতেই ছাউনির তলার অংশটা নিচে নামতে শুরু করেছে। আরিয়ান নিশ্চিত হয়, রহমান এখানে এসে কোনো একটা বাটন চেপেছে, আর না হয় ভেতর থেকে ওরা কোনো ধরনের সার্ভেলেন্সের মাধ্যমে বাইরে নজর রাখছে। তবে দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লিফটটা ধীর গতিতে নেমেই চলেছে। প্রায় মিনিটখানেক ধরে নেমে হঠাৎ থেমে গেল একটা স্টিলের দরজার সামনে।  

‘অ্যাগেইন ওয়েলকাম টু হেল,’ বলে রহমান জোরে একটা চাপড় মারল জোনায়েদের কাঁধে। ‘ফর ইউ হ্যাভেন,’ বলে সে স্টিলের দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঠিক লিফটের দরজার মতোই ফাঁক হয়ে খুলে গেল ওটা। ওটার ওপাশে তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনেরই মুখে মাস্ক, একজনের পরনে সাধারণ ল্যাব কোটের মতো সাদা পোশাক আর অপর দুজন গার্ড—সেটা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। ‘ওয়েলকাম রহমান সাহেব,’ সাদা পোশাকের মানুষটা বলে উঠল। রহমান কিছু না বলে মাথা নাড়ল, ‘আপনার এটা—’

‘দ্বিতীয়বার,’ রহমান সাদা কোটের মানুষটার জিজ্ঞেস করা বাক্যটা সমাপ্ত করল। ‘ও জোনায়েদ,’ বলে জোনায়েদকে সামনে এগোতে বলল। যার ব্যাপারে ইনফর্ম করা হয়েছিল। আর ওরা—’

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, ওনারাই তো আজকের স্টার, লোকটা এমনভাবে ওদের দিকে তাকাল বহুদিনের ক্ষুধার্ত লোকজন বুফে টেবিলের দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকে ঠিক যেন সেভাবে তাকিয়ে আছে লোকটা ওদের দিকে। ‘জেন্টেলম্যান,’ বলে রহমান আর জোনায়েদের দিকে একটা ট্রের মতো এগিয়ে দিতেই নিজেদের অস্ত্রগুলো সেখানে রেখে দিল রহমান আর জোনায়েদ। আরিয়ান অবাক হয়ে দেখল, প্রথমে রহমান আর জোনায়েদ দুজনকেই সার্চ করা হলো এবং তারপর ওদের একইভাবে সার্চ করা হলো, সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার হলো, রাসনাকেই একইভাবে সার্চ করা হলো প্রথমে ধমকে তারপর চিৎকার করে সে বাধা দিতে চাইল কিন্তু কোনো কাজই হলো না। কোনোরকম অশ্লীল বা কুৎসিত কিছু নয় কিন্তু মেয়ে বলে তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হলো না।

‘এই ফর্মালিটির জন্য দুঃখিত,’ সাদা পোশাক পরা লোকটা খুব যেন দুঃখ পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘আপনারা আমাদের সঙ্গে এগোবেন,’ প্ৰথমে অস্ত্র হাতে একজন গার্ড রইল, তার পেছনে হাতকড়া অবস্থায় সারি দিয়ে এগোল ওরা। ওদের ঠিক পেছনে রহমান, জোনায়েদ আর সেই সাদা কোট পাশাপাশি, আবার সবার শেষে আরেকজন গার্ড।   

ওরা একটা সাদা করিডর ধরে এগোচ্ছে, বাইরে যে মরাধরা ফ্যাক্টরির অবয়ব তার সঙ্গে এখানকার ভেতরের কোনো মিলই নেই। মনে হচ্ছে উন্নত বিশ্বের আধুনিক কোনো ল্যাবের ভেতরে চলে এসেছে ওরা। ‘অবিশ্বাস্য, মনে হচ্ছে সত্তরের দশকের কোনো জেমস বন্ড সিনেমার ভিলেনের লুকানো আস্তানার ভেতরে চলে এসেছি, ডক্টর নো সিনেমার ডক্টর নোর আস্তানা কিংবা অমিতাভ বচ্চনের শান সিনেমার শাকালের আড্ডার মতো লাগছে আমার কাছে, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি বাস্তবে আছি, আর খোদ আমার দেশেই এমন কিছু অস্তিত্ব আছে,’ জুলহাস বিড়বিড় করে বলে উঠল।

আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই, ওদের পাশে এগিয়ে এলো সেই সাদা কোট পরা লোকটা। ‘ফ্যাসিনেটিং ইজন’ট ইট? মাটির নিচে তিনতলা এই ল্যাবটা বানাতে আমাদের প্রায় চার বছর সময় লেগেছে। উইথ ডিউ রেসপেক্ট এরকম উন্নত ল্যাব আপনাদের দেশে খুব কমই আছে,’ লোকটার বাংলায় বেশ একটা উদ্ভট টান। ‘প্রথমে মনে হয়েছিল আমরা টাকা দিয়ে হাতি পালছি কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এই ল্যাবে আমরা যা করেছি, তা অবিশ্বাস্য। আপনাদের দেশের রিসোর্স ব্যবহার করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছি আমরা। আপনাদের গর্বিত হওয়া উচিত,’ লোকটার কথা শুনে আরিয়ানের মনে হতে লাগল, এর গলা চিপে ধরা উচিত।

‘এরকম গর্বিত হওয়ার মতো ল্যাব কী আমাদের দেশে এটাই নাকি আরো আছে?’ আরিয়ান যথাসম্ভব শান্ত সুরে জানতে চাইল।

কিন্তু লোকটা কোনো জবাব দেবার আগেই পেছন থেকে এগিয়ে এসে রহমান বলে উঠল, ‘আমাদের এখন প্ল্যান কী?’ সে একবার পেছন ফিরে জোনায়েদের দিকে দেখে নিল।  

‘ও মি. রহমান, আপনি বৃথাই চিন্তা করছেন,’ সাদা কোট হাত নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘আপনি ভাবছেন আমি ওদেরসেনসিটিভ ইনফরমেশন ফাঁস করে দিতে পারি। নো ওরিজ, দেওয়ার ইজ নাথিং সেনসিটিভ ফর দেম অ্যানি মোর। ওরা এখন একভাবে বলতে গেলে মৃত। এই ল্যাবে আজ পর্যন্ত যারাই এক্সপেরিমেন্টের জন্য ঢুকেছে, আমাদের ইচ্ছে ছাড়া জীবিত বের হতে পারেনি। ওরাও পারবে না, প্রশ্নই আসে না। কাজেই ওদের সবই বলা যায়, ওরা সাদা করিডরটার শেষ প্রান্তে এসে একটা মোড় ঘুরল। মোড় ঘুরতেই ওরা দেখতে পেল দুপাশে সারি সারি কাচের ছোট ছোট কামরা ভেতরে যেকোনো উন্নত ল্যাবের মতোই লোকজন কাজ করছে। প্রচুর ভারী আর দামি উপকরণ, লোকসংখ্যা বেশি না। ওরা অবাক হয়ে দেখল, যারা কাজ করছে এদের ভেতরে সাদা চামড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের লোকই আছে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বিদেশির সংখ্যাই বেশি।

‘আপনারা এতসব জিনিস এখানে আনলেন কীভাবে?’ আরিয়ান খুব অবাক হয়ে এবং সত্যিকার অর্থে কৌতূহল থেকেই জানতে চাইল।

‘ওহহ ইয়েস, আপনি নিশ্চয়ই সেই লোক,’ সাদা পোশাক এই প্রথমবারের মতোই খুব ভালোভাবে ওকে খেয়াল করে এবং যেন খানিকটা সম্মান দিয়ে বলে উঠল। ‘আপনি একেবারে সঠিক প্রশ্ন করেছেন। আমাদের ব্যাপারে কতটা জানেন আমার জানা নেই, আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেকটা করপোরেটের মতো কাজ করে, আমাদের প্রোডাক্ট হলো সেনসিটিভ ডাটা সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রসেস করে সবচেয়ে সেরা প্রাইস বিডারের কাছে বিক্রি করা, সেটা কোনো রাষ্ট্র হোক করপোরেট প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। আমাদের অপারেট করার যতগুলো স্ট্র্যাটেজি আছে তার ভেতরে অন্যতম একটা হলো, যে-দেশে আমরা কাজ করি সেদেশে করাপ্টেড একটা লেভেলকে আমরা কিনে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অনেকটা প্যারাসাইটের মতো একটা আর্মি গড়ে তুলি, তারপর তাদের ফ্রন্টে রেখে আমরা অপারেট করি, মি. রহমান অনেকটা সেই প্যারাসাইট আর্মিরই একজন অন্যতম সদস্য। আজ থেকে মি. জোনায়েদও হতে যাচ্ছেন। তো এভাবে কাজ করতে গেলে অনেক সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে। আর তাই আমাদের আরেকটা বড়ো স্ট্যাটেজি হলো দাতব্য সংস্থা তৈরি করা। খুব বিশদ বলব না, আমরা এ-ধরনের কাজগুলো, যেমন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা ইকুইপমেন্ট আনানো, লোক আনানো—এগুলো আমরা দাতব্য সংস্থার আড়ালে করাই। আর ফিল্ড লেভেলে ডাটার জন্য স্যাম্পল আইটেম কালেক্ট করার বিষয়টা সাজানো হয় ফেইক এনজিওর মাধমে, এ ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল থেকে শুরু করে সেরা মেধাদের কিনে নিয়ে তাদের কাজে লাগাই,’ লোকটার গলার স্বরে কোনো ভাব নেই, এমনভাবে কথা বলছে যেন কোনো করপোরেট প্ল্যানিং নিয়ে কথা বলছে, অথচ এরা পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধটা করছে অবলীলায়।

‘আশা করি বুঝতে পেরেছেন কীভাবে আমরা এই লাব প্রতিষ্ঠা করেছি,’ বলে সে হাঁটতে হাঁটতেই রহমানের দিকে দেখে নিয়ে বলে উঠল। ‘সরি উনার প্রশ্নটার জবাব আগে দিলাম, এবার আপনার প্রশ্নটার জবাব দিই। আমরা প্রথমে পুরো ল্যাবটা দেখব। মূলত দুটো কারণে: আপনি অনুরোধ করেছিলেন দেখার, কারণ এর আগে দুবার এলেও আপনি ল্যাবটা দেখেননি, মি. জোনায়েদও নয়, আর উনারা বন্দি হলেও দেখতেই পারেন। দ্বিতীয়ত, আমরা উনাদের যেখানে নিয়ে যাব সেখানে যেতে হলে ল্যাব পাড়ি দিয়ে যেতে হবে, কাজেই এর ভেতরে দেখা হয়েই যাবে। আমরা ল্যাব দেখে উনাদের নিয়ে যাব ডায়াগনসিস রুমে। ওখানে উনাদের চেক করা হবে, কিছু টেস্ট করা হবে, মূল কাজে লাগানোর আগে, ওখানেই ওনাদের পোশাক থেকে শুরু করে সব সরিয়ে ফেলা হবে, আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলেও করতে পারবেন ওখানেই। কারণ এরপর আর হবে না, এরা স্রেফ এক্সপেরিমেন্টের বস্তুতে পরিণত হবে। ওখানেই ওদের একটা নম্বর দেওয়া হবে এরপর থেকে ওরা ওই নম্বর দিয়ে পরিচিত হবে, এদের আর কোনো নামও থাকবে না। ওদের ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর আপনাদের জিজ্ঞাসা শেষ হলে আপনাকে আর মি. জোনায়েদকে আমরা নিয়ে যাব ল্যাব প্রধানের রুমে, সেখান থেকে ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে আপনারা বড়ো কর্তাদের আপনাদের প্রগ্রেস রিপোর্ট দেবেন, সেই সঙ্গে মি. জোনায়েদেরও কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে, আশা করি আপনি আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ছেন, এবার আমি আপনাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি ল্যাবের নানা অংশ।’  

কথাটা বলে সে ওরা যে-অংশটা পার হয়ে এসেছে সেদিকটা দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওই অংশটাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের টেস্ট রান করিয়ে থাকি, সেই সঙ্গে ওখানে নানা ধরনের কেমিক্যাল নিয়ে টেস্টও করান হয়ে থাকে। ওখান থেকে আমরা এখন যে-অংশের দিকে মুভ করছি এদিকটাতে হিউম্যান অর্গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়,’ বলে সে আরো দু সারি কাচে ঘেরা অনেকটা ল্যাবের মতোই অংশ দেখাল। কিন্তু ওরা আগের কামরাগুলোর মতো ঠিক পরিষ্কার দেখতে পেল না, কারণ এই কামরাগুলোর কাচ একেবারে ঘোলা। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা ইউ টার্ন নেওয়ার মতো বাঁক নিল। ‘এখান থেকে আমরা আরো সফিসটিকেটেড এরিয়ার দিকে মুভ করব,’ বলে সে ওদের দেখাল আরো দু সারি ছোট ছোট কাচের ঘরের মতো, ওগুলোর সামনের কাচের অংশ আগেরগুলোর মতো ঘোলা নয়, এগুলো একেবারে পরিষ্কার এবং ভেতরে যা দেখল তা দেখে গা শিউরে উঠল, নানা ধরনের অপারেটিং টেবিলে আস্ত মানুষ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। অপারেটিং টেবিলের ওপরে ডিসেক্ট করা হিউম্যান বডি দেখে গা গুলিয়ে ওঠে ‘ইয়া খোদা?’ জুলহাসের মুখ থেকে আপনাতেই বেরিয়ে এলো, আরিয়ান চট করে তাকিয়ে দেখল রাসনার মুখ সাদা হয়ে উঠেছে। সরাসরি তাকিয়ো না, সে কথা বলে শেষ করতে পারল না তার আগেই নাঈম গুঙিয়ে উঠে থেমে গেল, কিন্তু সে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই পেছন থেকে এক গার্ড এগিয়ে এসে হাতের অস্ত্রের বাট দিয়ে পিঠে গুঁতো মারল, নাঈম সোজা এসে পড়ল আরিয়ানের গায়ের ওপরে। ‘আস্তে আস্তে, শান্ত থাকো, কিছু হবে না, ছেলেটাকে জাপটে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল আরিয়ান। কারণ এখন থামলে এরা স্রেফ মেরে ফেলবে ছেলেটাকে, কিংবা ওদের যে কাউকে। ও মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেল রাসনাকে শক্ত করে জাপটে ধরে রেখেছে জুলহাস। তবে এইসব ভয়াবহ দৃশ্য বেশি দেখতে হলো না, কারণ ওরা ওই অংশটা পার হয়ে গোলমতো একটা জায়গায় চলে এলো, ওখান থেকে প্যাচানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। ‘ইজন্ট ইট বিউটিফুল?’ লোকটা সিঁড়ির কাছের কাচের রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওদের দিকে ফিরে বলে উঠল। আপনারা যেখানে লিফট থেকে নেমেছিলেন, ওখান থেকে ঠিক এরকমই একটা সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে ওখানে আমাদের মূল কম্পিউটার ল্যাব থেকে শুরু করে পুরো ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সেই সঙ্গে মিটিং থেকে শুরু করে ইত্যাদি সব কাজের জায়গা, অন্যদিকে যে-অংশটা আমরা পার হয়ে এলাম এটা মূল ল্যাবের একটা অংশ, এর সঙ্গে আরো অংশ আছে, সেগুলো সব এখনো দেখানো সম্ভব নয়। আর এখান থেকে আমরা নিচের দিকে যাব, যেখান থেকে আমাদের সাবজেক্টদের প্রসেস করা হয়। সেখানে সাবজেক্টদের রাখা থেকে শুরু করে তাদের প্রাথমিক প্রসেসিংয়ের কাজগুলো ওখানেই করা হয়।’

‘মানে আপনাদের এই ল্যাব মাটির নিচে তিনতলা?’ অনেকক্ষণ পর জোনায়েদ জানতে চাইল। সাদা পোশাক মাথা নেড়ে সায় জানাল। তার জবাব শুনে আরিয়ান মনে মনে হিসেব করল ওর অনুমান ভুল নয় তবে। ‘জেন্টেলম্যান অ্যান্ড লেডিস, শেষ শব্দটা সে রাসনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘আমি জানি ল্যাবের শেষ অংশটা আপনাদের সাইকির ওপরে বাজে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু যেসব সাবজেক্টকে নিয়ে ওখানে কাজ করা হচ্ছে, এরা মূলত গৃহহীন, এদের জীবন উদ্দেশ্যহীন। ওদের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না, কিন্তু ওদের শরীরের মূল্য অপরিসীম, এসব মানুষগুলোর মাধ্যমে আমরা যা জানতে পারছি তাতে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ হচ্ছে। কাজেই সব বিষয়েরই ভিন্ন ভিন্ন দিক থাকে। আমরা যা করছি সেটার মূল্যও অপরিসীম,’ আরিয়ানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, একজন মানুষের জীবনের মূল্য তুই কী বুঝবি, যেখানে মানুষকে মানুষ বলে না ডেকে সাবজেক্ট বলে ডাকে। কিন্তু ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল ও অন্যদিকে, এদের কিছু বলার কোনো অর্থ হয় না। ‘এখন আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তবে অপনাদের বিদায় জানিয়ে আমি সাবজেক্টদের নিয়ে নিচে যাব, সাদা পোশাক মুখের মাস্ক খুলে হাসিমুখে বলে উঠল, এই প্রথমবারের মতো লোকটার চেহারা দেখতে পেল ওরা। মাটির নিচে দীর্ঘদিন থাকার কারণেই কি না কে জানে লোকটার মঙ্গলয়েড ধাঁচের চেহারা একদম ফ্যাকাশে দেখতে, চেহারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার বাংলায় অদ্ভুত টানটা বুঝতে পারল আরিয়ন, লোকটা সম্ভবত আসামের কোনো এলাকার মানুষ।

আপনারা এখন ওর সঙ্গে,’ সে ওদের পেছনে থাকা দ্বিতীয় গার্ডের দিকে দেখিয়ে রহমান আর জোনায়েদকে দেখিয়ে বলে উঠল। ‘ওপরে যাবেন, আপনাদের সঙ্গে কিছু ফর্মালিটি আছে আমার বিলিভ। তবে আমার মনে আছে, সাবজেক্টদের সঙ্গে আপনাদের কিছু কথোপকথন আছে। অপনারা যখন ওপরে মিটিং করবেন ততক্ষণে আমি ওদের প্রসেস করতে শুরু করব, যাতে ওদের থেকে তথ্য বের করতে আপনাদের সুবিধা হয়,’ বলে সে বিদায় জানাল ওদের। রহমান তার স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখা হচ্ছে আবার একটু পরে, সম্ভবত শেষবারের মতো।’

১৯

রহমান এবং জোনায়েদ দ্বিতীয় গার্ডের সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই সাদা পোশাক তার হাতের ঘড়িতে একটা বাটন চাপল, প্রায় নিঃশব্দে বলতে গেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো আরেক গার্ড। ‘জেন্টেলম্যান এবং ম্যাম, আমরা এখন ল্যাবের লেভেল ওয়ানে যাব,’ বলে প্রথমে সে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল, তার ঠিক পেছনে একজন গার্ড, আর ওদের সবার পেছনে আরেকজন। মনে মনে এদের কাজের ধরনের প্রশংসা না করে পারল না আরিয়ান, কাজের ধরনেই পরিষ্কার বোঝা যায় এরা হাইলি ট্রেইনড।   

‘এখন আমরা যে লেভেলে যাচ্ছি এর বেশ কয়েকটা সেকশন আছে,’ ওদের সামনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলতে লাগল সাদা পোশাক। ‘এর ভেতরে মূল সেকশন তিনটা। ‘একটাতে সাবজেক্টদের ওপরে বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং মেডিসিন প্রয়োগের পর রিঅ্যাকশন পরখ করা হয়, অন্যটাতে সাবজেক্টদেরকে রাখা হয়, আর শেষটা হলো যেখানে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে আপনাদের নিউট্রালাইজ করা হবে।’

ওরা নিচে নেমে দেখতে পেল গোল সিঁড়িটাকে কেন্দ্র করে কয়েকটা করিডর একেকদিক চলে গেছে—একটাতে সারি সারি ঘোলা কাচের ঘর ওটার ভেতরে নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছে মানুষ আছে, ঘোলা কাচের সামনে ছোট একটা পরিষ্কার জায়গা এবং ওখানে ড্রয়ারের মতো, ওখান দিয়ে খাবার সরবরাহ এবং কমিউনিকেট করা হয়, অন্যটাতে সারি সারি গ্রিল দেওয়া জেলখানার কয়েদের মতো, আরিয়ান দেখতে পেল ওখানে প্রতিটা সেলে বন্দি রাখা, তিন বছরের ছোট শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ আছে। ‘হায় খোদা,’ না চাইতেই আরিয়ানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘এখানে খোদার কোনো অস্তিত্ব নেই, ‘ সাদা পোশাক ভাবলেশহীন মুখে বলে উঠল। ‘এখানে আমরাই খোদা, আমরাই এখানে খোদার সৃষ্টি এবং মানব সমাজের গতি পরিবর্তন করে চলেছি প্রতিনিয়ত, বলে সে ওদের একটা করিডরের দিকে এগোনোর নির্দেশ দিয়ে হঠাৎ যেন খুব খুশির সুরে বলে উঠল। ‘আপনাদেরকে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি, কেন জানেন,’ হঠাৎ ডেন্টিস্টের চেম্বারের মতো দেখতে কাচঘেরা একটা কামরার সামনে এসে থেমে গেল। ওটার কাচের দরজা খুলতে খুলতে সে বলে উঠল, ‘কেন জানেন আমরা এখানে যেসব সাবজেক্ট পাই, তার বেশিরভাগই হয় শিশু আর না হয় বৃদ্ধ আর না হয় গৃহহীন বা দুর্বল, দীর্ঘসময় ধরে পুষ্টিহীনতায় ভোগা লোকজন। আপনাদের মতো এই ধরনের সাবজেক্ট নিয়ে আমি এর আগে কাজ করার সুযোগ পাইনি। ইয়াং এবং স্ট্রং সাবজেক্টের ওপরে কিছু জিনিস প্রয়োগ করার জন্য আমরা অস্থির হয়ে আছি, বিশেষ করে তিনি,’ বলে সে রাসনাকে দেখাল।

এই প্রথমবারের মতো লোকটার ভাবলেশহীন চোখে কেমন একটা লালসার ভাব দেখতে পেল আরিয়ান। এটা কামনা থেকে বলা, নাকি এক্সপেরিমেন্টের জন্য ঠিক ধরতে পারল না ও। লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মাথার ভেতরে কেমন জানি করে উঠল আরিয়ানের, প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করল সত্যিকার অর্থেই কী হতে যাচ্ছে ওদের সঙ্গে। এতক্ষণ কেমন জানি একটা ঘোরের ভেতরে ছিল সে, এবার যেন সেই ঘোর ভেঙে জেগে উঠল ও, আর সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করতে পারল, এইটাই শেষ সুযোগ এবার কিছু একটা করতে না পারলে আর করার সুযোগ নেই, জুলহাস আর রাসনার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল একই অস্থিরতা ওদের ভেতরেও জেগে উঠেছে। আরিয়ানের মনের ভেতরে একটা ডঙ্কা বেজে উঠল, সময় নেই, সময় নেই, হঠাৎ করেই নিজের একটা কাঁধ নিচু করে ওর সামনে থাকা জুলহাসের পেছন দিয়ে ধাক্কা মারল ও। জুলহাসের ঠিক সামনেই ছিল এক গার্ড, ওর ধাক্কা খেয়ে জুলহাস আর গার্ড দুজনেই প্রায় ছিটকে পড়ল অপর দিকে, সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতকড়া বা হাতটাকে সাদা পোশাকের মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল আরিয়ান। প্রায় সফল হয়েও যাচ্ছিল কিন্তু পারল না লোকটা হঠাৎ নড়ে উঠে সরে যাওয়ার কারণে, সেই সঙ্গে লোকটা সরে যেতেই নিজের শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ও, নিজেকে সামলে নেবার আগেই পেছন থেকে অপর গার্ড সোজা লাথি মারল ওর হাঁটুর একপাশে, ধাম করে মাটিতে তো পড়লই, সেই সঙ্গে নাক আর কপাল সোজা গিয়ে বাড়ি খেল মেঝেতে। গলগল করে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসার পাশাপাশি আরিয়ানের মনে হলো ওর খুলি দুভাগ হয়ে গেছে। চারপাশে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু পরিষ্কার কিছু বুঝতে পারছে না। মনে হলো, কেউ ওকে শূন্যে তুলে আবার মাটিতে নামিয়ে আনল। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, সেই ঝাপসা ভাবটাকে লালচে করে তুলেছে কপাল থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত, জোর করে মাথা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে যখন ও, হতাশার সঙ্গে অনুভব করল সব শেষ হয়েছে, ওকে সেই ডেন্টিস্টের মতো চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হাত-পা আটকে দেওয়া হয়েছে, পাশে তাকিয়ে দেখল বাকি তিনজনকেও একই কায়দায় আটকে ফেলা হয়েছে ততক্ষণে। জানপ্রাণ দিয়ে টানাটানি করল ও কিছুক্ষণ, লাভের লাভ হলো লবডঙ্কা।

‘ছি ছি মি. আরিয়ান, আপনার কাছ থেকে এরকম আচরণ আমি মোটেই আশা করিনি,’ সাদা কোট ওদের সামনে থাকা একটা অপারেটিং টেবিলের মতো দেখতে টেবিলে থাকা সারি সারি ইনস্ট্রুমেন্ট ঘেঁটে কিছু একটা তুলে নিল, আরিয়ান দেখতে পেল একটা ইনজেকশনের ফাইল, তার অন্য হাতে একটা সিরিঞ্জ, আবারো প্রাণপণে টানাটানি শুরু করল ও। যদিও নিজের চিন্তায় বিভোর কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পেল ওদের অন্যপাশ থেকে কেউ একজন চিৎকার করে আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। সেদিকে তাকিয়ে সাদা পোশাক আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘প্রতিবার একই অবস্থা হয়,’ তার মুখ লালচে দেখাচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো আরিয়ান অনুভব করল, লোকটার চেহারায় একটু আগে যে-লালসা দেখেছিল ওটাই এর সত্যিকারের চেহারা, শুরু থেকে যে ভদ্র শান্ত ভাবটা ধরে রেখেছিল ওটা হলো মুখোশ। ‘বুঝেছেন মি. আরিয়ান, প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে, হতভাগাগুলোকে এই কামরায় আনলেই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারামারি-আর্তনাদ, অনেক সময় তো হেগেও দেয়,’ বলে সে খুব অদ্ভুত এক চিকন সুরে হাসতে লাগল। আরিয়ান দেখল লোকটার সিরিঞ্জে লিকুইড ভরা শেষ হয়েছে।

কিছুই কী করার উপায় নেই, কিছুই না!

নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কথ্য ভাষায় গালি দিতে শুরু করল ও। লোকটা ওর দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে, হাতে সিরিঞ্জ, তার পাশেই গার্ড, নিজের অস্ত্র নামিয়ে রেখে সে সাদা পোশাককে সাহায্য করতে আসছে। ‘ছি ছি, আমি আপনার থেকে এরকম কিছু আশা করিনি,’ বলে সে একবার গার্ডের দিকে দেখে হেসে উঠল। ‘আমাদের গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে, যে শক্তিশালী সে করে দেখায়, যে সাহসী সে প্রমাণ করে দেখায়, আর যে দুর্বল সে অভিশাপ দেয়, আর যে তার চেয়েও দুর্বল সে গালি দেয়—এইটুকু বলে সে আবারো হেসে উঠল। গার্ড লোকটা স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো আরিয়ানের একটা হাত চেপে ধরল, সাদা পোশাক উন্মুক্ত করে ফেলল তার কনুই, ‘এই ডোজটা দিয়ে শুরু হবে, এরপর আধা ঘণ্টা পর আরেকটা ডোজ দেওয়া হবে, এরপর মিস্টার রহমান আর জোনায়েদ আপনাদের ইন্টেরোগেশন করবেন, তারপর শুরু হবে আমার আসল খেলা। সিরিঞ্জের সুইটা এগিয়ে আসছে, আরিয়ান আবারো নড়ে ওঠার চেষ্টা করল, চোখে আবার ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে। এবার অনুভব করল চোখ দিয়ে অসহায় আর যাতনার চোটে বের হয়ে আসা পানিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে সব, কিছুই কি করার নেই, এভাবে শেষ হয়ে যেতে হবে, শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকবার নড়ে ওঠার চেষ্টা করল ও, মুখ তুলে তাকাল সাদা পোশাকের দিকে, ক্ষণিকের জন্য মনে হলো ভুল দেখছে, সাদা পোশাকের শরীরের সাদা পোশাক লাল হয়ে উঠেছে, আর মাথার জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে, সেখানে উন্মুক্ত ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো রক্ত, সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ধরে থাকা গার্ড লোকটার বিস্ফোরিত মস্তিষ্ক, মগজ আর হাড়ের টুকরো এসে লাগল ওর চোখে-মুখেও। একে তো চোখে পানি, তার ওপরে ফেনিল ঝাপটায় সামনেটা আরো ঘোলাটে হয়ে গেছে, আরিয়ান অনুভব করল, ওর হাত-পায়ের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে, নড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই আবারো ধাম করে মাটিতে পড়ে গেল, চোখে এখনো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না, কেউ একজন তুলে সোজা করে ধরল ওকে, চোহারাটা পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও তীব্র ঝাঁকির চোটে মনে হলো, সব পরিষ্কার হয়ে এলো, ‘আরিয়ান মি. আরিয়ান, আপনি ঠিক আছেন?’ মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে একহাতে মুখের রক্ত, পানি, লালচে ভাবটা পরিষ্কার করে নিতেই চোখের সামনে ফরসা একটা মুখ দেখতে পেল ও, ক্ষণিকের ব্যবধানে মানুষটাকে চিনতে পেরে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘জোনায়েদ, আপনি!

হ্যাঁ, আমি, আপনি ঠিক আছেন?’ আরিয়ান দেখল জোনায়েদের হাতে গার্ডদের একটা সাবমেশিনগান, মুখে সাইলেন্সার লাগানো। ‘আপনি ঠিক আছেন?’

‘আমি ঠিক আছি,’ আরিয়ান এখন পুরোপুরিই অনুধাবন করতে পারছে সব। আপনি এখানে কীভাবে?’

‘সব বলব, এখন সময় নেই, আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে,’ বলেই সে জুলহাস আর রাসনাকে দেখাল, ‘আমি ওদের খুলে দিচ্ছি আপনি ওই গার্ডের অস্ত্রটা তুলে নিন।’

আরিয়ান দেখল খুলি বিস্ফোরিত গার্ডের অস্ত্রটা মাটিতে পড়ে আছে, কাচে ঘেরা কামরাটার দরজার কাছেই আরেক গার্ড বুকে গুলির ক্ষত নিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ‘আপনি কীভাবে, মানে, গার্ডের অস্ত্রটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ওটাকে পরীক্ষা করতে করতে দুই পা এগিয়ে গেল ও জোনায়েদের দিকে। আনমনেই নিজের হাত পায়ের দিকে দেখে নিল একবার, বিশ্বাসই হচ্ছে না এখনো সুস্থ আছে, অরেকটু হলে গেছিল। ‘আপনি কিন্তু জবাব দিচ্ছেন না, অস্ত্রটা লোড করে ওটার মাথা মাটির দিকে নামিয়ে নিয়ে আরিয়ান আবারো বলে উঠল।

রাসনা, জুলহাস আর নাঈমকে মুক্ত করে জোনায়েদ ওর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আমাদের এখন এখান থেকে পালানোটা বেশি জরুরি,’ আরিয়ান পাশ থেকে তার কনুই চেপে ধরল। আমাকে জানতে হবে,’ বলে সে জুলহাস আর রাসনার দিকে তাকিয়ে দেখল, ওদেরও পূর্ণ সমর্থন আছে ওর জেরার প্রতি, পালানোটা জরুরি কিন্তু জোনায়েদের ভূমিকা বোঝাটা আরো জরুরি।  

‘ঠিক আছে,’ খানিক অসহায়ভাবে কাঁধ নেড়ে জোনায়েদ বলে উঠল। ‘শুনুন একটা ফোর্সে বা সংস্থায় সবাই করাপ্টেড না, তাহলে সিস্টেম চলত না, আমি স্পেশাল ফোর্সে কাজ করলেও আমি আসলে স্পেশাল ফোর্সের লোক না, আমি সিক্রেট সার্ভিসের অফিসার। আমি স্পেশাল ফোর্সে এসেছিলামই একটা ষড়যন্ত্রের তল খুঁজে বের করতে। সিক্রেট সার্ভিসের কাছে রিপোর্ট ছিল, বিগত প্রায় এক দশক ধরেই আমাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ভেতরে বড়ো ধরনের একটা পরজীবী সংগঠন গড়ে উঠেছে, যেটাকে সুডো সংগঠনও বলা যেতে পারে। কে বা কারা এটা চালাচ্ছে, কীভাবে এটা চলছে তার খোঁজ বের করতে গিয়ে এত বিশাল কিছু ব্যাপার জানা যায়, যা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। জানা যায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে সব জায়গায় এদের লোক আছে এবং এরা এতটাই ক্ষমতাবান যে সিক্রেট সার্ভিস এটা নিয়ে তদন্ত শুরু করার পর সিক্রেট সার্ভিসই বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন আমরা বুঝতে পারি ট্র্যাডিশনালওয়েতে কাজ করলে হবে না, বরং ভিন্নভাবে কাজ করতে হবে। তখন আমিসহ আমাদের মতো তরুণ এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া কিছু অফিসারকে সিক্রেট সার্ভিস থেকে খুব গোপনে বিভিন্ন ফোর্সে হয় নিয়োগ দেওয়া হয়, অথবা বদলি করে দেওয়া হয়, যাতে আমরা গোপনে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে খুঁজে বের করতে পারি এই পরজীবী দানবের দল।’

‘তারমানে আপনি যা যা করেছেন, শুরু থেকে সবই অভিনয় ছিল,’ আরিয়ান বুঝতে পারছে দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই লোকটার ভূমিকা পরিষ্কার বোঝাটা ওর জন্য খুবই জরুরি। ‘এতটা সময় নিলেন কেন?’

‘আমি সময় নিয়েছি কিন্তু এখন তো আপনি দেরি করাচ্ছেন,’ বলে সে বাইরের দিকে দেখে নিয়ে আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল, জবাব না পেলে আরিয়ান ছাড়বে না। ‘ঠিক আছে, আমি প্রায় দুই বছরের ওপর ধরে চেষ্টা করার পর বছরখানেক আগে ওদের কিছুটা ভেতরে ঢুকতে পারি, কিন্তু কোনোভাবেই ওরা আমাকে মূল দলে নিচ্ছিল না কিংবা আমি কোনো কংক্রিট অ্যাভিডেন্স পাচ্ছিলাম না। এমন সময় আপনি এবং আপনাদের এই ঘটনা আমাকে  বিরাট একটা সুযোগ এনে দেয়, আর তাই আমি কংক্রিট কোনো অ্যাভিডেন্সের জন্য যা করার সবই করেছি। যতটা নিষ্ঠুর হওয়া প্রয়োজন আমি হয়েছি, খুব শখ করে হয়েছি তা বলা যাবে না, তবে শেষটায় আর পারলাম না,’ বলে সে থেমে গেল। ‘ভেবেছিলাম একেবারে ওপরে গিয়ে ল্যাবের বড়ো কর্তাসহ এখানকার নাটের গুরুসহ ধরব কিন্তু করতে গিয়েও পারলাম না, কারণ আমি ওখানে গিয়ে সব সামলাতে সামলাতে আপনাদের অচল বানিয়ে ফেলত। এখন আমরা যাব?’

‘চলেন,’ আরিয়ান নিজের হাতের অস্ত্রটা নেড়ে সবাইকে বের হওয়ার জন্য ইশারা করল। ওরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই জোনায়েদ ওপরে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে এগোতে উদ্যত হতেই আরিয়ান তাকে থামিয়ে দিল। ‘আমি জানি না আপনাদের মতামত কী, কিন্তু আমি এই মানুষগুলো যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের না নিয়ে বের হবো না।’

‘মি. আরিয়ান বোঝার চেষ্টা করুন, জোনায়েদ মাথা নেড়ে বলে উঠল। ‘আমি গার্ডটাকে মেরে রহমানকে কোনোরকমে বন্দি করে এসেছি, আমাদের এখনি ওপরে যেতে হবে, সম্ভব হলে বাইরে বেরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফোর্সে সিগন্যাল দিতে হবে।

‘আমরাও যাব না,’ আরিয়ানের পাশ থেকে রাসনা বলে উঠল। জুলহাস একহাতে ধরে আছে খানিকটা নেতিয়ে থাকা নাঈমকে। ‘আমিও।’

আরিয়ান সামনে এগিয়ে একটা প্লেক্সিগ্লাসের লকের মতো জায়গাটায় গুলি করল, কিছুই হলো না। ও আবারো গুলি করতে যাবে, রাসনা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এক মিনিট,’ বলেই সে দৌড়ে গিয়ে ঢুকল সেই রুমে যেখানে ওদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে সে দৌড়ে বেরিয়ে এলো ল্যাব থেকে, দেখতে পেল সাদা পোশাকের গলায় ঝোলানো আইডির মতো কিছু একটা, সে ওটা নিয়ে দরজার লকের কাছে ধরতেই সেটা খুলে গেল, ভেতর থেকে দুজন বন্দি বেরিয়ে এল। একে একে সব কামরা থেকে বন্দিদের বের করে নিয়ে আসতে প্রায় মিনিট পনেরোর মতো সময় লেগে গেল।

‘চলুন চলুন,’ জুলহাস চিৎকার করে বলতে লাগল। সবার আগে অস্ত্র হাতে এগোচ্ছে সে, সবার পেছনে আরিয়ান আর মাঝে রাসনা। জুলহাস সবাইকে সামলে সারি দিয়ে ওরা উঠে এলো সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্ষণিকের জন্য আরিয়ান ঘোল খেয়ে গেল, কারণ সবাই দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির ওপরে গোলমতো জায়গাটায়, জোনায়েদ বুঝতে পারছে না কোনদিকে যাবে। আরিয়ানও ক্ষণিকের জন্য বেকুব হয়ে রইল। ‘এদিক দিয়া,’ শুকনো পাতলা মতো দেখতে বয়স্ক একজন বন্দিদের ভেতর থেকে বলে উঠল। ‘আমি চিনি,’ বলে সে সবার সামনে পথ দেখাতে লাগল। ওদের বারো-পনেরো জনের দলটা এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে সেই ল্যাবের মতো জায়গাটা দেখতে পেল ওরা। কয়েকটা কাচের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে লোকজন বোঝার চেষ্টা করছে ওরা কারা, দুয়েকজন চেঁচিয়েই উঠল, ওরা থামল না, আরিয়ান এখন চলে এসেছে জোনায়েদের পাশে, ল্যাবের মতো জায়গাটার কাছাকাছি এসে ওরা থেমে গেল। ‘লিফটটা এই জায়গার কাছাকাছিই হওয়ার কথা,’’ আরিয়ান বলে উঠল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল জোনায়েদ মাটিতে কিছু একটা খুঁজছে। ‘কী ব্যাপার কী হলো?’ আরিয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘আমি এখানেই সেই গার্ডটার সঙ্গে রহমানকে বন্দি করে রেখে গেছিলাম। বলে সে মাটিতে রক্তের চিহ্ন দেখে এগিয়ে গেছে, একটা ল্যাবের খোলা দরজার দিকে। সবাইকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে, ওরা দুজনে নিজেদের অস্ত্র বাগিয়ে ধরে ল্যাবের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ল্যাবের দরজার ভেতরে কেউই নেই, মাটিতে পড়ে আছে এক গার্ড, মৃত।

‘তুমি কি—’  

‘একে মেরেছিলাম আমিই, তারপর রহমানকে অজ্ঞান করে ওর হাতের সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে রেখে গেছিলাম। ‘ওই দেখ,’ আরিয়ান মাটিতে পড়ে থাকা একটা করাতের মতো দেখাল। সেই সঙ্গে গার্ডের বিচ্ছিন্ন কবজি। ‘রহমান লোকটাকে এখানে টেনে এনে ল্যাবের কাজের করাত নিয়ে হাতটা বিচ্ছিন্ন করে—’

সে কথা শেষ করার আগেই গুলির শব্দ শুনতে পেল, ওর সামনে থাকা জোনায়েদ তীব্র বেগে এসে বাড়ি খেল ওর সঙ্গে, দুজনেই ছিটকে পড়ে গেল ল্যাবের মেঝেতে। সমানে গুলি হচ্ছে, কাউকে দেখতে না পেলেও রহমানের চিৎকার শুনতে পেল ও পরিষ্কার। মাথার ওপরে ছিটকে পড়ছে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল দুজনে। গুলি থামতেই আরিয়ান দেখতে পেল জোনায়েদের শরীরের এক অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি ঠিক আছি, গুলি শরীরের একপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’

‘আমরা—’ আরিয়ান কথা শেষ করার আগেই ল্যাবের বাইর থেকে রহমানের গলা শোনা গেল, অস্ত্র নামিয়ে রেখে ওদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। ওপরে হালকা উঁকি দিয়েই ল্যাবের বাইরে থাকা পুরো দলটাকে ক্ষণিকের জন্য দেখতে পেল আরিয়ান। দেখেই মাথা নামিয়ে নিল। শিট, জোনায়েদ ওরা সবাইকে ধরে ফেলেছে,’

‘আমরা বের না হলেই মেরে ফেলবে, এখন কী করব?’

আরিয়ান দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছে, ‘একটা উপায় আছে, মনোযোগ দিয়ে শোন আমি কী বলি,’ আরিয়ান তাকিয়ে আছে ল্যাবের একপাশে রাখা বিভিন্ন কেমিক্যালের দিকে। ‘ব্যাপারটা খুবই রিস্কি কিন্তু একটা উপায় হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *