১
রাতের এই সময়ে এখানে সে এর আগে কখনো আসেনি। তাও পায়ে হেঁটে এতটা ভেতরে। দিনভর মানুষকে ভয় দেখিয়ে এসে বেলা শেষে যদি নিজেকে এভাবে ভয় পেতে হয় তবে ব্যাপারটা খানিক বিস্ময়কর লাগে বটে। কথাটা মনে আসতেই আনমনেই হাসির ভঙ্গিতে মুখটা বাঁকা হয়ে গেল সামান্য, আর সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাওয়া ঠোঁটে টান লাগতেই ব্যথা পেয়ে মৃদু ককিয়ে উঠল স্পেশাল ফোর্স অফিসার রহমান। হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল সে। না চাইতেও আনমনে সে পেছনে ফিরে একবার রাস্তার ওপরে থেমে থাকা গাড়িটার দিকে দেখে নিল। এটা ফোর্সের জিপ বা গাড়ি নয়, বেনামে রেজিস্টার করা একটা গাড়ি, যদিও ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থারই মানুষ। রহমান থেমে গিয়ে পায়ে চলা পথটার একপাশে থেমে গেল। এখানে থেমে দাঁড়ানোটা একেবারেই উচিত হয়নি তার, এটা সে ভালোভাবেই জানে। কিন্তু ঠোঁটের কোণে ব্যথা পাওয়াতে এমন রাগ উঠেছে মনে হচ্ছে না থামলে রাগে ফেটে পড়বে সে। রাস্তাটার একপাশে সরে এসে একটা গাছের গায়ে হেলান দিল সে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ধরাল একটা।
এতটাই রেগে গেছে সে, সিগারেট ধরানোর সময়ে দেখল রাগে আঙুলগুলো কাঁপছে তার। কোনোকিছু চিন্তা না করে কয়েক মিনিট স্রেফ ধোঁয়া টানল সে। আশপাশে তাকিয়ে দেখল একটা নার্সারির একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা অন্ধকার এবং খানিকটা বিপজ্জনকও। তার মতো একজন মানুষ, যে কি না দুনিয়ার বাকি সবার জন্য এক জীবন্ত বিপজ্জনক কিংবদন্তি, সে কি না ভাবছে বিপদের কথা। যে-পৃথিবীতে সে বিচরণ করে সেই পৃথিবীর হিসাব একেবারেই আলাদা। সেই পৃথিবীতে ভয় পাওয়ার কোনো স্থান নেই, শুধুই ভয় দেখানোর খেলা সেটা। আর ভয়ের ওপরেই টিকে আছে সেই পৃথিবী। তার বয়স কম হলেও বহু রক্তাক্ত ধাপ পায়ে মাড়িয়ে এই সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে সে। কিন্তু আজকের বিষয়টা ভিন্ন ছিল। নিজের ইগো তো বটেই বিগত কয়েক বছর ধরে যে-ঐশ্বরিক শক্তি আর ক্ষমতা সে উপভোগ করে এসেছে, তাতে এক শক্ত চড় খেয়েছে সে আজ সন্ধ্যায়। আর সেই ক্ষততে লবণ লাগাতে যাচ্ছে সে এখন। ব্যাপারটা সহজ হবে না মোটেও।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মোথাটা পায়ে মাড়িয়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করল সে। মোথাটাকে মাড়িয়ে দিতে দিতে একবার মূল রাস্তার ওপরে রেখে আসা জিপটার দিকে একবার দেখে নিল সে। জিপে যারা আছে তাদের এদিকে আসা তো বাদই, এমনকি দেখারও অনুমতি নেই। জায়গাটা কমলাপুর স্টেশনের পেছন দিকে যেখানে বড়ো বড়ো সব কার্গো কন্টেইনারগুলো রাখা থাকে সেখানে। তবে কার্গো স্টোরেজের মূল এলাকার বাইরে এটা। জায়গাটা রেললাইন পার হয়ে খানিকটা সামনে এগিয়ে মূল রাস্তার অন্যপাশে। এখানে মূলত ভাঙাচোরা কিংবা ড্যামেজ অথবা বাতিল জিনিসপত্র রাখার একটা জাংক ইয়ার্ডের মতো। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বা এরকম অন্যান্য জায়গা থেকে নিয়ে আসা কন্টেইনারগুলোর ভেতরে যেগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বাতিল হয়ে যায় বা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়, সেগুলোকে মেরামতির জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে মূলত এখানে ফেলে রাখা হয়। একভাবে বলতে গেলে এটা বাতিল মালের জায়গা। শেষ কথাটা তার মাথার ভেতরে যেন বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো। যেই বাতিল মালের আড়তে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আজ রাতে কি তাকেও সেই একই পদের বাতিল মাল হিসেবে বিবেচনা করা হবে, অথবা ফেলে দেওয়া হবে সেই আস্তাকুঁড়ে যেখানে এতদিন সে সবাইকে ফেলে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে আপনাতেই তার হাত আবারো মুঠো হয়ে এলো, ঠোঁটে চেপে বসল ঠোঁট। তার অনেককিছু হারানোর আছে, চাইলেই সে এমনটা হতে দিতে পারে না। এতদিন ধরে সে যাদের জন্য কাজ করছে, এতকিছু করে দিয়েছে, তারা কি তার একটা ভুল ক্ষমা করবে না, যেখানে এমনকি সরাসরি নিজে কোনো ভুলও করেনি।
ঠিক তার সামনেই আধো অন্ধকারের ভেতরে একটা সরু রেখার মতো দেখা যাচ্ছে মাটিতে। রেখাটার দিকে তাকিয়েই থেমে গেল সে। ভালোভাবে খেয়াল করতেই সে বুঝতে পারল সরু লেজারের একটা রেখা। খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে এমনকি বোঝাও যায় না। কিন্তু সে থেমে যেতেই ওটা আরেকটু গাঢ় হলো। সঙ্গে সঙ্গে রহমান বুঝতে পারল সে জায়গামতো চলে এসেছে, এই রেখাটা দিয়ে তাকে থামতে বলা হচ্ছে, মূলত এটা সে যে মূল জায়গায় চলে এসেছে তারই ইঙ্গিত। এই রেখাটা যেভাবে হালকা থেকে গাঢ় হলো, এটা পরিষ্কার যে এই লেজার আসলে অনেক শক্তিশালী। যারাই এটা নিয়ন্ত্রণ করছে তারা চাইলে এটা ইনটেনসিটি বাড়িয়ে চাইলেই তাকে দুটুকরো করে ফেলার শক্তি রাখে। রহমান থেমে গিয়ে নিজের দুই হাত তুলল। খুব ইচ্ছে হচ্ছে আলোর রেখাটা কোনদিক থেকে আসে সেটা পরখ করে। কিন্তু মনের ভেতরের ইচ্ছে মনের ভেতরেই চেপে রাখল সে। খানিক পরেই রেখাটা সরল রেখা থেকে ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হলো, তারপর সেই বিন্দুটা এগিয়ে যেতে শুরু করল সামনের দিকে। বিন্দুটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল সে। খানিক এগিয়ে বিন্দুটা একটা আধভাঙা কন্টেইনারের ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু প্রায় কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
ভেতরে আলোর পরিমাণ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যে চাইলেই আপনি কোথাও হোঁচট খাবেন না, আবার যদি সব পরিষ্কারভাবে দেখতে চান, সেটাও পারবেন না। তবে ওরা যা দেখাতে চাইবে সেটা আবার আপনি না দেখতে চাইলেও চোখে একেবারে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। যেমন ভেতরে ঢুকতেই ছোট একটা ট্রের মতো দেখতে পেল সে। কিন্তু ট্রেটা কীসের ওপরে রাখা সেটা আবার দেখা যাচ্ছে না। ট্রেটা ওখানে কেন রাখা আছে খুব ভালোভাবেই জানে রহমান। সে নিজের অস্ত্র, মোবাইল, ঘড়ি থেকে শুরু করে সব সচল ডিভাইস রেখে দিল ওটার ওপরে। জিনিসগুলো রাখা সামনের দিকে দু-পা এগিয়ে খানিক চমকে উঠল সে। ভেতরটা যেমন ভেবেছিল সেরকম কিছু না, পুরনো যেকোনো কন্টেইনারের ভেতরটা যেমন ভাঙাচোরা আর বাতিল হওয়া উচিত তেমনটাই। জায়গায় মরচে পড়া বাতিল লোহালক্কড় পড়ে আছে। এদিকে-সেদিকে ছালা বিছানো আবার ছেঁড়া ছালার মতো কিছু একটা দিয়ে পর্দার মতো করে দুভাগ করা হয়েছে ওটাকে। খানিকটা ধন্দে পড়ে গেলেও সেটা কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না তার। কারণ যা দেখা যাচ্ছে, এটা বাস্তবে তা নয়। কারণ সে খানিকটা সরে এসে ছালার পর্দার দিকে এগোতেই আবারো একটা লেজার লাইট তার পথ রোধ করে দাঁড়াল সরলরেখার মতো। মানে এর চেয়ে বেশি আর সামনে এগোনো যাবে না। খানিক বিরক্তই বোধ করল সে, সেই সঙ্গে কৌতূহলও। একে তো এত ঢাক গুড়গুড় তার ভালো লাগছে না, তার ওপরে এরা ঠিক কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে সেটা সে পুরোপুরি ধরতেও পারছে না, এই কারণে আরো বেশি বিরক্ত লাগছে। সরল রেখার ওপারে দাঁড়িয়ে বড়ো করে একবার দম নিল সে।
সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে মৃদু একটা শব্দ আর ছালার আবরণের অন্যপাশে বাতি জ্বলে উঠল। ওপাশে আবছায়ার মতো একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে, একটা চেয়ারে বসে আছে সে। বড়ো করে একবার ঢোক গিলল রহমান। এটাই কি সেই লোক—এতদিন ধরে যার আদেশ সে এবং তার মতো একদল বা এরকম একাধিক দল বছরের পর বছর ধরে বিনা তর্কে মেনে আসছে। কে এই লোক, আজ কি তাকে দেখতে পাবে? তাকে দেখতে পেলেই বা কি হবে, তাকে কি মেরে ফেলা হবে আজ এখানে। সে কারণেই কি এই লোক ওর সামনে দৃশ্যমান হয়েছে? বড়ো বড়ো ঢোক গেলার সঙ্গে সঙ্গে রহমান অনুভব করল তার ঘাড়ের পেছনটা ভিজে গেছে, সেই সঙ্গে পিঠের ওপর দিয়ে চিকন ঘাম গড়াচ্ছে নিতম্বের দিকে। জীবনে কতবার কতজনকে এভাবে এরকম অবস্থায় সে নিজের মুখোমুখি করেছে, আর আজকে কি না তাকে এরকম অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
‘রিল্যাক্স অফিসার রহমান, তোমাকে মেরে ফেলার জন্য এখানে আনা হয়নি, একটা যান্ত্রিক গলা ভেসে এলো। গলাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে খানিক চমকে উঠলেও সে অনুভব করল স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল তার মনের ভেতরে। আবারো ঢোক গিলল সে, সেই সঙ্গে চমকানো ভাবটাও খানিক কমল। যদিও আসলে খুব বেশি স্বস্তি বোধ করার উপায় নেই, কারণ এরা এমন ধরনের মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন, বিগত কয়েক বছর ধরে এদের সঙ্গে কাজ করে রহমান একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছে, এদের কাছ থেকে সফলতার প্রাপ্তির যেমন কোনো শেষ নেই, তেমনি ব্যর্থতার শাস্তিরও কোনো সীমা নেই। ভেতরে ঢুকেই রহমান চোখ নামিয়ে নিয়েছিল, এবার সামনে দিকে তাকিয়ে সে ঝুলন্ত ছালার ওপাশে একটা চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় আবছা একটা অবয়বের মতো দেখতে পাচ্ছে। অবয়বটা চোখে পড়তেই ভেতরে ভয়াবহ রকমের শিউরে উঠল সে। এতদিন ধরে এই লোকগুলোর জন্য কাজ করছে সে কিন্তু আজ অবধি সে নিজেই ঠিক পরিষ্কার জানে না এরা কারা কিংবা এরা আসলে কী করে, তবে এটা পরিষ্কার জানে কী ভয়ংকর রকমের শক্তিশালী এরা। একবার নয়, অতীতে একাধিকবার সে এদের ভয়াবহ শক্তির বিস্তৃতি এবং নমুনা পরিষ্কার টের পেয়েছে। আর সত্যি যদি ওপাশে কেউ থেকে থাকে তবে এই প্রথমবার সে এদের কারো এতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু আদৌ কি ওপাশে কেউ আছে, নাকি পুরোটাই ধোঁকার খেলা, পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
রহমান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আবারো সেই গলাটা শুনে থেমে গেল সে এবং মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিল কথা না বলার জন্য। ‘তুমি আজ রাতে মরছ না, অন্তত আমাদের হাতে নয়,’ গলাটা থেমে গেল। কথা বলার ধরনটা এমন যে, এটা সরাসরি মানুষ বলছে না মেশিন বলছে বোঝার উপায় নেই, সামনে থেকে আসছে নাকি অনেক দূর থেকে আসছে সেটাও বোঝার উপায় নেই। ‘তবে তাই বলে ভেব না তোমাকে জবাবদিহিতা করতে হবে না,’ রহমান চুপ, অনুধাবন
করতে পারছে কঠিন সময় উপস্থিত। ‘প্রথমেই বলো, আজ রাতে তোমার মূল করণীয় কী ছিল?’
‘লেখক আরিয়ান শফিককে অ্যারেস্ট করা—’
‘ভুল,’ একটা মাত্র শব্দ এমনকি খুব জোরের সঙ্গেও বলা হয়নি, কিন্তু ছোট এই শব্দটারই শক্তি এত বেশি যে ক্ষণিকের জন্য খেই হারিয়ে ফেলল রহমান। বড়ো করে একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল সে। এতদিন এদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় এটা জানে যে, এদের কথার মাঝে কথা বলা যেমন বিপজ্জনক ঠিক তেমনি যখন কথা বলতে বলবে এরা তখন সঠিক কথা বলতে না পারাটা আরো বেশি বিপজ্জনক। ‘লেখক আরিয়ান শফিককে আইনের আওতার ভেতরে থেকে তাকে মেরে-’
‘ভুল,’ এবার শুধু কথার মাঝখানে খেই হারানো নয় পুরোপুরি থমকে গেল রহমান।
‘আজ রাতে তোমার ওপরে দায়িত্ব ছিল লেখক আরিয়ান শফিকের মাধ্যমে আমাদের জন্য যে-বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেটার একটা স্থায়ী সমাধান করা। তাকে অ্যারেস্ট করা, হত্যা করা কিংবা তার ইমেজ নষ্ট করা, তার বই ব্যান করা এগুলো ছিল পুরো ব্যাপারটার ছোট ছোট অংশ মাত্র। তোমাকে তোমার দায়িত্বের জন্য যথেষ্ট রিসোর্স দেওয়া হয়েছিল?’
‘জি।’
‘তোমাকে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল?’
‘জি।’
‘তাহলে কেন পারলে না, কারণ দর্শাও।’
রহমান বড়ো করে একবার দম নিল। সে জানে এটাই তার জন্য একমাত্র সুযোগ নিজেকে রক্ষা করার জন্য, নিজেকে আবারো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য, আর সেজন্য তাকে সত্য বলতে হবে। আমি লেখক আরিয়ান শফিককে আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম,’ সত্য বলা সবসময়ই কঠিন, এমনকি নিজের ধ্বংসের সামনে দাঁড়িয়েও। রহমানের মতো মানুষের জন্য একজন সামান্য লেখক এসে তাকে টেক্কা দিয়ে চলে গেছে, এটা মেনে নেওয়া যতটা কঠিন—সেই সত্য অপর কারো সামনে স্বীকার করা আরো কঠিন। কিন্তু এখন তাকে এটা করতে হবে। ‘আমি ভেবেছিলাম তাকে নিকেশ করা সহজ হবে। সে এভাবে—’ নিজেকে শুধরে নিল সে। ‘তবে সে যতটা কঠিন ছিল, তারচেয়েও বেশি খারাপ হয়েছে—সে বাইরে থেকে সাহায্য পেয়েছে। একবার নয় দুবার।’
‘আর কেন সেটা হলো?’
প্রশ্নটা শুনে সে আবারো খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেল, এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। ভেবেছিল নিজের ভুলের জন্য যুক্তিযুক্ত একটা ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে, বরং ফল হলো উলটো। কী বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। তাকে উত্তর দেওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল অপরদিকের মানুষটাই।
‘আরিয়ান শফিক বাইরে থেকে সাহায্য পেয়েছে কারণ তোমার প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল,’ রহমান কিছু বলার জন্য মুখ তুলল কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিল না কণ্ঠটা। সে বলেই চলেছে। ‘আজ সন্ধ্যার এই অপারেশনের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় এবং রিসোর্স দেওয়া হয়েছিল তোমাকে। রীতিমতো একটা টিম নিয়ে কাজ করেছ তুমি, বস্তাভরা টাকাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই হিসেবে তুমি কিছুই করতে পারোনি। একের পর এক ভুল করেছ। কারণ কি বলো, নিজের উপলব্ধি বলো।’
যদিও রহমান জানে তাকে ধীরে ধীরে কথার ফাঁদে জড়িয়ে থেঁতলানোর আয়োজন করা হচ্ছে—তাও সে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করল। যেহেতু এভাবে কথা বলছে কাজেই আসলেই তাকে মেরে ফেলা হবে না। আজ রাতে শুধু কথার ওপর দিয়েই যাবে। ‘আমি লেখককে আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম।’
‘এর পেছনে দায়ী তোমার অহংকার এবং প্রস্তুতির অভাব। প্রথমত তুমি তাকে আন্ডার এস্টিমেট করেছ, কারণ তুমি ঠিকভাবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করোনি। কারণ তুমি ভেবেছিলে একজন লেখক সে আর কী-ই বা করতে পারবে। বিগত কিছুদিনের সাফল্য তোমার ঘাড়ে চড়ে বসেছে।’
রহমান এবার খানিক রাগের সঙ্গেই মুখ তুলল। কিন্তু কথা বলার আগেই সে থেমে গেল পরের বাক্যটা শুনে। তুমি ভাবছ অযথা তোমাকে দোষারোপ করা হচ্ছে, তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি জানো লেখক আরিয়ান আর্মি থেকে বহিস্কৃত। তুমি কি জানো কেন তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল রহমান। সে আসলেই জানে না। এতটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার জন্য সত্যিই সে গরজ অনুভব করেনি। মাথা নিচু করে রইল সে।
‘আরিয়ান শফিকের বন্ধু যে-ছেলেটা সুইসাইড করেছিল, যার মার্ডার কেস সাজিয়েছ, তার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটাও ইগনোর করেছ তোমরা। সেই সঙ্গে—’ এবার কণ্ঠটাই থেমে গেল। রহমানও চুপ, কণ্ঠটাও চুপ। রহমানের মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু কোনোটাই বলছে না সে, জানে যে প্রয়োজনে তাকে সেগুলো নিজ থেকেই দেওয়া হবে। আর না দিতে চাইলে চাইলেও দেওয়া হবে না।
‘শোন রহমান তুমি কি জানো, আজ রাতে দুবার ব্যর্থ হওয়ার পরও কেন তুমি বেঁচে আছ। কারণ দ্বিতীয় আরেকটা সোর্স যেখান থেকে লেখক সাহায্য পেয়েছে—সেটার বিষয়ে আসলে তোমার কোনো দোষ ছিল না। বরং…যাই হোক অরেকটা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তোমাকে। যা যা জানার দরকার সব বিস্তারিত তোমার বিশেষ ই-মেইলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার অন্তত কাজ দেখাও। আর না হলে কাল তোমার অস্তিত্ব বিলীন করা হবে,’ শেষ কথাটা এমন তরল সুরে বলল লোকটা, রহমানের মনে হলো সাধারণ এই বাক্যটার চাপে স্রেফ মাটিতে বসে পড়বে সে। ক্ষণিকের জন্য তার মনে হলো ব্লাডার আর পায়ুপথ শরীরের ভেতরের বর্জ্যগুলোর ভার বহন করতে না পেরে সে এখানেই ছেড়ে দেবে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল সে। ‘এখন আমার করণীয় কী?’ ঠান্ডার ভেতরেও ঘামতে ঘামতে কোনোমতে প্রশ্নটা উচ্চারণ করল সে। এখনো নিজের ব্লাডার আর পায়ুপথের সঙ্গে যুদ্ধ করছে সে, সব ভেতরে আটকে রাখতে।
‘আজ রাতে তোমাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হবে। যেকোনো জায়গায় এক্সেস করতে পারবে তুমি, যেকোনো ফোর্সে হেল্প চাইতে বা তাদের রিসোর্স ব্যবহার করতে পারবে। সবচেয়ে বড়ো কথা তোমার সব করণীয় একেবারে সাজিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমার কাছে। স্রেফ সঠিকভাবে অনুসরণ করবে। শোন রহমান,’ বলে কণ্ঠটা সম্ভবত গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই থেমে গেল।
‘ছোট, একেবারেই ছোট একটা ঘটনা। কিন্তু এর গুরুত্ব এবং ঝুঁকি ঠিক কতখানি তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। ছোট এই ব্যাপারটা কতটা বড়ো বিপর্যয় বহন করে আনতে পারে, তোমার কোনো ধারণাই নেই। কাজেই যা ভুল করেছ, করেছ, আজ রাতে আর কোনো ভুল করার সুযোগ নেই কারোরই।’
‘আমি ঠিক কোথা থেকে শুরু করব?’ যদিও রহমান ঠিক জানে না তার এটা বলা উচিত হলো কি না, কিন্তু তাকে জানতেই হতো।
‘তুমি পড়ালেখা দিয়ে শুরু করবে, আরিয়ান, রাসনা এবং জুলহাস, এই তিনজন এখন একসঙ্গে আছে। ওদের ট্র্যাক করে তুমি তিনজনকেই স্রেফ গায়েব করে দেবে। তবে তার আগে আরো কিছু বিষয়ে নির্দেশনা আছে। সেগুলো পরে হবে। আগে ওদের ধরো।’
রহমান আবারো ঢোক গিলে প্রশ্ন করল। জুলহাস কে, সে জানতে চাইল না। কারণ সে জানে এটা তাকে জানানো হবে। বরং সে জানতে চাইল, ‘ওরা ঢাকা থেকে বেরিয়ে গেছে। বিগত কয়েক ঘণ্টায় ওরা কোনদিকে সরে গেছে বা আগামী কয়েক ঘণ্টায় ওরা কতদূরে সরে পড়বে, ওদের ট্র্যাক করা—’
অপর পাশে হাসির শব্দ শুনে থেমে গেল সে। তুমি এতদিন ধরে আমাদের সঙ্গে কাজ করছ তাও তুমি আমাদের শক্তিদণ্ড আন্দাজ পাওনি। ওরা কোথায় আছে আমরা জানি। অন্তত অনুমান করতে পারি, তোমাকে স্রেফ নিজের শক্তি খাটিয়ে ওদের ধরতে হবে। এটাও যদি না পার –
রহমান যখন কন্টেইনারটা থেকে বেরিয়ে এলো তখন তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে রয়েছে। সে যা ভেবে ভেতরে গিয়েছিল মিটিংটা তারচেয়ে অনেক ভালোভাবে শেষ হয়েছে। প্রথমত, প্রাণে বেঁচেছে এটাই অনেক বড়ো প্রাপ্তি, সম্ভবত সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। দ্বিতীয়ত, এখন সে জানে তাকে কী করতে হবে। বেশ খানিকটা এগিয়ে পেছনে সামান্য শব্দ শুনে সে ফিরে তাকাল কন্টেইনারটার দিকে। অবাক হয়ে আধো অন্ধকারের ভেতরে দেখতে পেল একটু আগে ঠিক যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সেখানে কিছুই নেই এখন। এতবড়ো জিনিসটা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায় কীভাবে। ওপরের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল বিরাট একটা ক্রেন ট্রলি দিয়ে কন্টেইনারটাকে শূন্যে তুলে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে আরেকদিকে। আর কয়েক মিনিটের ভেতরে অস্থায়ী এই স্টেশনটার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।
আনমনেই একবার নিজের ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল রহমান, এদের অপরিসীম শক্তি এবং ক্ষমতার কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল সে। যেভাবেই হোক তাকে সফল হতেই হবে।
২
‘উফফ উফফ,’ প্রায় চিৎকার উঠতেই আরিয়ানের দিকে সবাই ফিরে তাকাতে খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল সে। কিন্তু তার সামনে উপবিষ্ট মানুষটার এসবের দিকে কোনো নজর নেই, সে মহা মনোযোগের সঙ্গে নিজের কাজ করে চলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এবারের নোবেল পুরস্কারটা নির্ভর করছে তার এই কর্মতৎপরতার ওপরেই। যদিও তার ময়লা হাত আর ঘর্মাক্ত মুখ দেখে মনে হয় না চিকিৎসকসুলভ হাইজিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে সেই বিষয় তো বাদই—সাধারণ সতর্কতাবোধটুকুও নেই। আরিয়ানের, ক্ষতটার পরিচর্যা করে এলোমেলো একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে এমনভাবে একগাল হাসি দিল সে যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। ‘এইবার আর কুনো সমস্যাই নাই। সকালের ভিতরেই ঠিক হয়ে যাব,’ মানুষটার হাসির জবাবে তাকে হতাশ করতে ইচ্ছে করল না আরিয়ানের, আর তাই তার সঙ্গে হাসি মিলিয়ে সামান্য হেসে মাথা নাড়ল সে। যদিও মনে মনে খুব ভালোভাবেই জানে, প্রথম সুযোগেই একজন যথাযথ ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে। তা না হলে এমনিতেই যা হয়েছে তো হয়েছেই, এই ‘ডাক্তার ‘ সাহেবের ব্যান্ডেজের পর কী হবে একমাত্র আল্লাহ মালুম।
‘চা লন, মাস্টার সাহেব,’ আরিয়ান তাকিয়ে দেখল অন্তত একশ বিশ কেজি ওজনের মানুষটার বিপুল আকৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান শিশুর মতো মুখটা উজ্জ্বল করে যেন ভীষণ আনন্দিত—এমন একটা ভাবে সে চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরে রেখেছে আরিয়ানের দিকে। তবে শুধু ভাবে না, ওরা আসাতে লোকটা সত্যিকার অর্থেই আনন্দিত। অন্য যেকোনো মানুষ হলে আনন্দিত হওয়া তো দূরে থাক, ভয়ে শিটিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে এই মানুষটা কি না ওদের পেয়ে ভয় তো দূরে থাক রীতিমতো উৎফুল্ল। এই ব্যাপারটা প্রায় অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে আরিয়ানকে। চায়ের কাপটা নিতে নিতে সে একবার ফিরে তাকাল রাসনার দিকে। তাকেও যে-বেশ একটা অস্বস্তিবোধ ঘিরে ধরেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে একেবারে পরিষ্কার। কিন্তু জুলহাসের ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন, তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না একেবারে মাঝরাতে আরেকজন মানুষের বাড়িতে এসে দুজন গেস্টসহ হানা দিয়েছে সে। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন পর ছেলে বাড়ি ফিরে এলে তার হাবভাব যেমন থাকে অনেকটা তেমন।
‘বুঝছুইন মাস্টর সাব,’ একেবারে খাঁটি ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলে চলেছে ভীষণ মোটা মানুষটা। একেবারে নির্জলা ভাষা, তার ওপরে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো মানুষটা ঠিক যতটা মোটা তার মুখটা ঠিক ততটাই শুকনো। এরকম অদ্ভুত স্বাস্থ্যের কম্বিনেশন আরিয়ান এর আগে কখনোই দেখেনি। মানুষটার শরীরটা দেখলে মনে হয় একটা গাজী ট্যাংকপা লাগিয়ে চলাফেরা করছে। আর তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় কতদিন না খেতে পেয়ে শুকিয়ে গেছে। ফলে মানুষটার আকৃতি খুবই অদ্ভুত এক চাপ সৃষ্টি করে মনের ভেতরে। কিন্তু সব অস্বস্তি দূর হয়ে যায় মানুষটার নির্মল হাসি দেখলে। একেবারেই বিশুদ্ধ বাচ্চাদের হাসি, এরকম হাসি মানুষ একমাত্র তখনই হাসতে পারে যখন তার মনের ভেতরটা বিশুদ্ধ হয়।
‘আহা আইন্নেরা আইলাইন এই মাইঝরাতে, কী খাওয়ামু কইন দেহি, এই এই ছেড়াডাও, ‘ সে কপট রাগের ভঙ্গিতে জুলহাসের দিকে দেখাল। ‘এর কুনো আক্কল নাই। মেমান লইয়া আবো, আগে কবো না, বেদ্দপ পোলা,’ বলে সে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ল। ‘যাকগা, আমি মন্দার বাজারে লুক পাড়াইছি বিরানি আনবার। আপাতত চা খাইন, এই চা-ডা বালা আছে। গঞ্জের বাজারে চা, চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাহে।’
‘দেখুন, আফজাল ভাই,’ আরিয়ান চায়ের কাপ হাতেই অস্বস্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। প্রথমত, এখানে আসাটাই কতটা ঠিক হয়েছে বুঝতে পারছে না, তার ওপরে এই জুলহাস লোকটাকেই বা কতটা ভরসা করা যায় বা লোকটার আলটিমেট উদ্দেশ্য কি—সেটাও পরিষ্কার না। আবার এখানে এসে নিজেদের জন্য আরো বিপদ বাড়াল কি না কিংবা এই লোকটাকেও আরো বড়ো বিপদে ঠেলে দিল কি না, সেটাও বুঝতে পারছে না। এদিকে শরীরও ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে সবমিলিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা ওকে যন্ত্রণায় ফেলে দিচ্ছে। ‘আপনি একদম ঝামেলা করবেন না। আসলে আমরা এমন এক অবস্থায় পড়েছি, আপনার এখানে আসাটাই একটা ব্যাপার, আবার আপনি ঝামেলা—’
‘আরে মিয়া আপনের বাড়ি কই, মমিসিং গেছুইন কুনসময়, গেলে বুঝতাইন, মেমানের লাইগা জান কুরবান। আর বিপদের সময় মাইনসে মাইনসের এইহানে আবো না তো কই আবো। এই জুলা কী কয় মাস্টর সাবে?’ বলে সে যেন ভীষণ রেগে গেছে এমন একটা ভঙ্গি করে মোটা শরীরটা নাড়তে লাগল আফজাল সর্দার, অত্র এলাকায় যাকে সবাই আফজাল মিস্ত্রি নামে চেনে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে জুলহাস, মৃদু হাত নেড়ে কিছু বলতে মানা করল। রাসনার দিকে একবার দেখে নিয়ে অসহায়ভাবে নিজের কাঁধ নাড়ল আরিয়ান। মানুষের আবেগের সামনে সব অসহায়, এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো বিপদও। পড়েছে মোগলের হাতে খানা তো খেতেই হবে একসঙ্গে।
জুলহাস, আরিয়ান ও রাসনা তিনজনে এই মুহূর্তে অবস্থান করছে নারায়ণগঞ্জ এলাকার এক মেকানিক ওয়ার্কশপে। ওয়ার্কশপটা মূল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে। যে-এলাকাটায় ওরা আছে, এটা অনেকটা শহরতলির মতো, তাই আশপাশে জায়গার কোনো অভাব নেই। টিনের বাউন্ডারি দেওয়া পুরনো দিনের একটা বাড়ির একপাশে বিরাট জায়গা নিয়ে ওয়ার্কশপটা। টিনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই বিরাট একটা উঠানের মতো জায়গা, ওটার দুইপাশে সারি সারি পুরনো-নতুন, ভাঙাচোরা গাড়ি থেকে শুরু করে গাড়ির বিভিন্ন অংশ ইত্যাদি পড়ে আছে। জায়গাটার ঠিক পেছনেই উঠানের চেয়ে বড়ো একটা পুকুর। ওটার চারপাশের সব হয় গাড়ি মেরামতির জিনিস আর না হয় নানা ধরনের লোহালক্কড় টাইপের পুরনো জিনিস পড়ে আছে। আর পুকুরটার পেছনে ছোট একটা টিনের ছাউনির মতো, যেটার ভেতরে এই মুহূর্তে অবস্থান করছে ওরা। যদিও জায়গার চারপাশটা এলোমেলো, সেই সঙ্গে লোহালক্কড় থেকে শুরু করে গ্রিজ আর নানা ধরনের বিচিত্র গন্ধে ভরপুর কিন্তু সামনে পুকুর আর চারপাশে গাছপালা থাকাতে খারাপ লাগছে না এখানে। চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিতে মনটা ভালো হয়ে গেল আরিয়ানের। চা এমন এক পানীয়, যা সমস্ত কিছু দূর করে দিয়ে অপরিসীম শান্তি দিতে পারে যেকোনো সময়ে। এমনকি জীবনের সবচেয়ে বাজে আর ভয়াবহ রাতের
স্মৃতিও দূরে সরিয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে পারে ক্ষণিরে জন্য।
আরিয়ান আর রাসনা জুলহাসের সঙ্গে গাড়িতে করে অফিসার রহমান আর তার লোকদের খপ্পর থেকে বের হওয়ার পর আরিয়ান জুলহাসকে পিস্তলের মুখে যখন থামতে বলে, ওরা তখন বেশ অনেকটাই দূরত্ব পার হয়েছে কিন্তু বিপদ থেকে পুরোপুরি দূরে সরেনি। জুলহাসকে সবকিছুর কারণ ব্যাখ্য করতে বললেও সে খুব বেশি রাগ করেনি, বরং সে বলেছে প্রথমেই ওদের আগে নিরাপদ জায়গায় সরে পড়াটা বেশি জরুরি। কিন্তু আরিয়ান কিংবা রাসনা দুজনার কেউই সেটা মানতে রাজি ছিল না, কারণ যদিও জুলহাস ওদের একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে কিন্তু এর মানে এই না যে, সে ওদের বন্ধু, আর যে-পরিস্থিতিতে ওরা আছে, তাতে কাউকেই কোনোভাবেই বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই, বিশেষ করে ওদের দুজনার কেউই আসলে জানে না পুরো পরিস্থিতি কী নিয়ে এবং ওদের আসলে করণীয় কি। রাসনা এই কথাটা বলার সঙ্গে জুলহাস ওদের খুব সংক্ষেপে জানায় সে কীভাবে এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলো এবং সে ওদের এটাও জানায় যে, এই মুহূর্তে যে-নিরাপদ আশ্রয় ওদের প্রয়োজন সেটার ব্যবস্থা সে আগেই করে রেখেছে, সেই সঙ্গে ওদের আসলে করণীয় কি সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেও সে ভূমিকা রাখতে পারে। কথোপকথনের এই পর্যায়ে আরিয়ান জানতে চায়, বিনিময়ে সে কী চায় আসলে। জুলহাস জানায়, সে এই বিষয়ের সমাধান চায় এবং সম্ভব হলে সে ওইসব লোকদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায় যারা তার একমাত্র বন্ধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আরিয়ান পিস্তলটা তখনো পকেটে ঢোকায়নি, কিন্তু ওটার মাথাটা নামিয়ে রেখেছে। রাসনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে, রাসনা অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল, আর উপায় কি। আরিয়ান জুলহাসের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জানায়, ওদের মুভ করা উচিত এবং আপাতত ওরা তার ওপর ভরসা করছে কিন্তু একবার ওরা নিরাপদ দূরত্বে জায়গামতো পৌঁছালে আগে জুলহাসকে ব্যাখ্যা করতে হবে সব বিস্তারিত, এরপর বাকিসব। জুলহাস মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জানায় সে এখান থেকে ভিন্ন রুটে বুড়িগঙ্গা ক্রস করে আগে নারায়ণগঞ্জ যাবে, ওখানে আগে থেকে একটা জায়গা ওর ঠিক করা আছে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। জায়গাটা নিরাপদ এবং ওখানে গিয়েই ওরা সব বিস্তারিত কথা বলতে পারবে সেই সঙ্গে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারবে। জুলহাস গাড়ি নিয়ে চলে আসে পুরনো একটা ফেরিঘাটে। এসব এলাকায় বহু আগে স্রেফ ফেরির মাধ্যমেই পারাপার হতো, যানবাহন থেকে শুরু করে সবকিছু। কিন্তু একের পর এক ব্রিজ হওয়ার কারণে লোকে এখন এগুলো আর ব্যবহার করেই না বলতে গেলে। কিন্তু কিছু কিছু ফেরিঘাট এবং ফেরি সার্ভিস এখনো চালু আছে বেশ কয়েকটা কারণে। এরমধ্যে অন্যতম হলো ইমার্জেন্সি সার্ভিস এবং লোকাল লোকজনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। ব্রিজ দিয়ে নদী পার হওয়াটা ওদের জন্য সাউন্ড আইডিয়া ছিল না বিধায় ওরা ওরকম একটা ফেরির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার ছোট একটা অংশ পার হয়ে অন্য পারে এসে জুলহাস ওদের বিশ্রাম নিতে বলে বিভিন্ন দিকে বারবার ঘুরে প্রায় এক দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটা টিনের বাড়ির সামনে এসে থামায়। কথা ছিল—নিরাপদে জায়গামতো পৌঁছে ওরা আগে সব বিস্তারিত আলাপ করবে, আর জায়গামতো পৌঁছানোর পর ঘটতে শুরু করে ভিন্ন ঘটনা।
জুলহাস নিজের এতিম এবং বিচিত্র জীবনে একেবারে ছোট থেকে শুরু করে জীবনের এই প্রান্তে উঠে আসা পর্যন্ত এক অদ্ভুত আর বিচিত্র জীবন কাটিয়েছে সে। নিজের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জীবনে তাকে পার করতে হয়েছে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, যেতে হয়েছে বিচিত্র কর্মবৈচিত্রের ভেতর দিয়ে এবং মিশতে হয়েছে বহুপদের নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে। নিজের এই বিচিত্র কর্মময় জীবনে বহু শয়তানরূপী মানুষের সঙ্গে যেমন মোলাকাত হয়েছে তার, ঠিক তেমনি আক্ষরিক অর্থেই মানুষরূপী ফেরেশতার সঙ্গেও দেখা হয়েছে। তেমনি একজন মানুষ এই আফজাল মেকানিক। আফজাল মেকানিক, নারায়ণগঞ্জ এলাকার একটা বেশ বড়ো গাড়ির মেকানিক শপের মালিক। তবে আফজাল মিস্ত্রি বা মেকানিক কিংবা সবার মাঝে পরিচিত আফজাল ভাই এমন একজন মানুষ—যাকে অত্র এলাকাতে সবাই এক নামে এক ডাকে চেনে একবারেই ভিন্ন কারণে। আর সেটা হলো তার মানুষকে সাহায্য করার মানসিকতার কারণে। বিষয়টা এমন না যে আফজাল মিস্ত্রি খুব পয়সাওয়ালা মানুষ। বরং তার সমসাময়িক অনেক গ্যারেজের মালিক কিংবা মেকানিকের চেয়ে কম বড়লোকই হবে, কিন্তু তার বড়লোকির জায়গা হলো তার আত্মা। অত্র এলাকায় এমন কথিত আছে যে আফজাল মিস্ত্রির কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছে এমন কেউ কখনো দেখা তো দূরে থাক এমনকি শোনেওনি। টাকা দিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে সে কাউকে সাহায্য করতে না পারলেও একবেলা অন্তত খাবার তার কাছে পাওয়া যাবেই কিংবা খানিকটা আশ্ৰয়। এতিমখানা থেকে বেরিয়ে জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের কোনো এক সময় জুলহাসের আশ্রয় হয়েছিল আফজাল মিস্ত্রির এই গ্যারেজে। খুব বেশি সময় সে এখানে কাজ না করলেও আফজাল মিস্ত্রির সঙ্গে তার আপন বড়ো ভাইয়ের চেয়ে বেশি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই স্বল্প সময়েই। পরবর্তীতে যেখানেই গেছে যাই করেছে আফজাল মিস্ত্রির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওর। আর তাই টোকনের মৃত্যুর পর যখন সে এই কাজে নামতে যাচ্ছিল তখন ব্যাক আপ পরিকল্পনা হিসেবে যে কয়টা জায়গা সে ঠিক করে রেখেছিল এর ভেতরে আফজাল মিস্ত্রির ডেরাও ছিল।
অপারেশনের ময়দানে নামার অনেক আগেই সে আফজাল মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে রেখেছিল এবং পুরো বিষয় না বললেও এই আভাস সে দিয়েছিল যে এর সঙ্গে বিপদ জড়িত আছে, এমনকি সে আফজাল মিস্ত্রিকেও বিপদে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু আফজাল মিস্ত্রি তার কথা এমনকি শোনেওনি। সে সোজা বলে দিয়েছিল যেকোনো অবস্থায় যেকোনো সময় জুলহাস যেন তার ওখানে পা রাখে। গতরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পলায়নের পর ওরা বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার পর, গাড়িতে রাখা ভিন্ন এক মোবাইলের ভিন্ন আরেক সিম থেকে মিস্ত্রিকে কল করে জুলহাস জানায় যে ও দুজন বন্ধুসহ আসছে। সময় তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে। কিন্তু মিস্ত্রির ওখানে ওরা পৌঁছে যা দেখে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। খাওয়া তো বটেই মিস্ত্রি ওই মাঝরাতেই ওদের জন্য রীতিমতো এলাহি আয়োজন করে রেখেছিল। ওদের প্রয়োজন ছিল স্রেফ আশ্রয় আর এই আয়োজন দেখে খানিক অস্বস্তিই বোধ করছিল জুলহাস, আর তার দুই সঙ্গী তো বটেই। কিন্তু মিস্ত্রি এসব শোনার ধারে কাছে দিয়েও যায়নি। সে প্রায় জোরাজুরি করেই ওদের সবার আগে খেতে বসিয়ে দেয়। যদিও প্রাথমিকভাবে ওদের প্রয়োজন ছিল ভিন্ন। আর সেটা হলো ডাক্তার, কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না ওদের। আর এখানে এমনকি ওই মাঝরাতে মিস্ত্রিরও কিছু করার ছিল না। আর তাই তার গ্যারেজের বয়স্ক এক মেকানিক, যে কি না কোনো এককালে তার গ্রামে কবিরাজি করেছিল কিছুদিন তাকে দিয়ে কাজ চালাতে হয়। কিন্তু আফজাল মিস্ত্রির তার ওপরে ভরসা অপরিসীম। এর পেছনে কারণ হলো, আফজাল মিস্ত্রির মতামত হলো, অসুখ-বিসুখ ব্যথা, কাটা-ছেঁড়া এসব কিছুর একটাই সমাধান। আর সেটা হলো খাওয়া। নিজেও সারা জীবন স্রেফ খেয়েছে আর মানুষকেও খাইয়েছে। কাজেই খাওয়া ছাড়া সে কিছু বোঝে না।
‘তুমগোর অইলো নি?’ প্রায় আড়াই মণ ওজনের আফজাল মিস্ত্রি প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে ওদের সামনে বসে পড়ে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে ওরা আবার কী খাবে—জানার উদ্যোগ করতেই জুলহাস তাকে খানিক ইশারা করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ মোটা আফজাল মিস্ত্রির চেহারাটা বদলে গেল। সে হাস্যরসসমৃদ্ধ মানুষ হতে পারে কিন্তু বোকা না। ইশারায় আশপাশে থাকা ছেলে দুজন আর বয়স্ক কবিরাজ ডাক্তারকে সরে পড়তে বলে সে ফিরে তাকাল ওদের দিকে। সবসময় সে কথা বললেও এখন চুপ করে আছে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে জুলহাস কিছু বলবে এবং সেটা সিরিয়াস কিছু।
‘কও জুলা,’ জুলহাসকে সে ছোট ভাই হিসেবে আদর করে জুলা নামে ডাকে।
‘আফজাল ভাই…’ জুলহাস বেশ খানিকটা আবেগি ভঙ্গিতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আফজাল মিস্ত্রি তার সানী দেওল মার্কা আড়াই কিলোর একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল।
‘ধুর ব্যাটা, তুই কি কবি এখন আমি খুব বালা কইরাই জানি,’ বলে সে একবার আরিয়ান আর রাসনার দিকে দেখে নিয়ে শিশুর সারল্য নিয়ে গড়গড়িয়ে হেসে উঠল। ‘তুই কবি ভাই আইন্নেরে অনেক ধন্যবাদ, আমগোরে আশ্রয় দিছেন, বিপদে মাথায় তুইল্লা নিছেন, এইগুলো কইলে একটা চড় খাবি।
তার কথা এবং বলার ভঙ্গিতে জুলহাস হেসে উঠল। ‘আফজাল ভাই আমি এইগুলোর কোনোটাই কবো না। কারণ আমি জানি এইগুলো তোমার লগে যাইব না, আর তোমার লগে আমার সেই সম্পর্কও না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গাতে,’ বলে সে মৃদু থামল। ‘আসলে পরিস্থিতি আমরা যা ভাবছিলাম তার চাইয়াও বেশি খারাপ। আর সবচেয়ে খারাপ অইছে, আসলে আমরা কাগো বিরুদ্ধে লাগছি কী হইতাছে আর ক্যান হইতাছে—এইগুলোর কোনোটাই এহনো আমগোর নিজের কাছেই পরিষ্কার না। তুমি তো আগের বিষয়গুলো কিছু জানো। আমি যহন তুমারে বললাম তুমার সাহাইয্য লাগতে পারে, তহন কিছু বলছিলাম কিন্তু এহন মনে অইতাছে তুমারে অইগুলো বইলা কি তুমারেও বিপদে ফাইলাইলাম কি না।’
‘হুন, কামর কথা ক, আগেরটা বাদ দে এহন—’
‘এইটার জন্যই এইগুলো বলতাছি তুমারে। সমস্যা অইলো, তুমি তো জানো টোকনের মাইরা ফালাইন অইছে। ঠিক যেমন ওরে মারছে ওমনেই উনাগো এক বন্ধুরেও মারছে,’ সে আরিয়ান আর রাসনাকে দেখাল। তার চেয়ে বড়ো কথা, কাইল রাতে প্রথমে উনারে,’ এবার সে শুধু আরিয়ানকে দেখাল, এরপর উনারে সাহায্য করাতে উনাগো দুই জনরেই,’ এবার সে আবারো দুজনকেই দেখাল। ‘দ্বিতীয়বার মাইরা ফালাইতে চাইছে। এরপর আমি উনাগোরে নিয়া কোনোমতে পলাই আসছি।
‘তারমানে তুই কইতাছোস, তোরা এহনো পরিষ্কার জানোস না, কাগো বিরুদ্ধে লাগছোস, কিন্তু হেরা তোগোরে ঠিই চিনে এবং জানে। খালি হেইডাই না, যেই তোগোরে সাহাইয্য করতাছে হেরেও মাইরা ফালাইতাছে,’ আফজাল মিস্ত্রি খুব শিক্ষিত না হতে পারে কিন্তু বোকা না। ‘এইগুলা কি রাজনীতি—’
‘না আফজাল ভাই,’ প্রথমবারের মতো আরিয়ান কথা বলে উঠল। জুলহাস তো বলেছেই আমরা আসলে গতরাত থেকে স্রেফ প্রাণ বাঁচানোর দায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। তাই আমরা এখনো আসলে পুরোপুরি জানিই না কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তবে এটা বুঝতে পেরেছে আমি টোকন কিংবা আমার মৃত বন্ধু কামাল—যার সঙ্গেই আমরা জড়িয়ে থাকি না কেন এটা রাজনীতি কিংবা এসবের চেয়ে আরো বড়ো কিছু। জুলহাস যা বলেছে শুধু তাই না, গতকাল রাতে একজন প্রফেসর স্রেফ আমাদের সাহায্য করার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে। এসবের পেছনে যারাই থাকুন তারা এমনকি ফোর্সের লোকজনকেও ম্যানপুলেট করার ক্ষমতা রাখে। কাজেই বুঝতেই পারছেন।’
‘তাইলে আমারে কী করতে কও?’ আফজাল মিস্ত্রিকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
‘আফজাল ভাই,’ মোবাইল বের করে সময় দেখতে দেখতে জুলহাস বলে উঠল। ‘এহন এই মুহূর্তে আমগোর আসলে প্রথম যেইটা দরকার ঠান্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতি বোঝা এবং সমাধানের চেষ্টা করা। আমার ধারণা আমগোর হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। এই সময়টা আমরা কাজে লাগাব কিছু জিনিস বোঝার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয় খুব বেশি সময় আমরা পাব না, ওরা ঠিকই বাইর কইরা ফালাব আমরা কই আছি। তখন কিন্তু তোমার বিপদ,’ আফজাল মিস্ত্রি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জুলহাস নিজের এক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। ‘আমি জানি তুমি নিজের জীবনের পরোয়া করো না। কিন্তু এইহানে খালি তুমি না, তোমার লগে তোমার সব পোলাপাইন আছে, গ্যারেজে কাম করে বয়স্ক লোকজন আছে। সবার কথা ভাবো। তোমার এইখানে মোট কতজন আছে? তাগোরো সবারে নিয়া কি তুমি—’
আফজাল মিস্ত্রি চট করে মাথা নাড়ল। ‘এইটা কীভাবে সম্ভব দুনিয়ার সব কাম, কাইল বহুত কাস্টোমারের গাড়ি ডেলিভারি দিতে অইবো মাইনষে গাড়ি রাইখা গ্যাছে, আরো অনেকেই আসব।’
জুলহাস আফজাল মিস্ত্রির হাত ধরে ফেলল। ‘আফজাল ভাই, একদিন বড়জোর দুইদিনের জন্য সইরা পড়ো। বাকিটা পরে দেখা যাইব।’
আফজাল মিস্ত্রি ভাবছে। ‘হুন এক কাম কর, সকাল অইতে কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। এই কয়েক ঘণ্টা তোরা বিশ্রাম ল, যা কাম হেইডা সকালে করিস, সকালে সেইরকম কলিজা ভুনা আর নান দিয়া নাশতা কইরা,’ জুলহাস আপন মনে মাথা নাড়ল। মানুষের স্বভাব খুব বিচিত্র জিনিস। আফজাল মিস্ত্রি এরকম ভয়াবহ অবস্থাতেও খাবারের কথা ভুলতে পারছে না। ‘যাক গা, তোগো এইহানে থাহার কাম নাই। গ্যারেজ থেইকা খানিক দূরে আমার বাড়িত যা গা, ওইহানে গিয়া ঘুম বা যা করার কর। সকালের ভেতরে গাড়ি যেইগুলো আছে হেইগুলোর কাম সাইরা আধবেলার ভেতরে আমি সব কিলিয়ার করতাছি, পরেরডা পরে দেহা যাবে। অহন যা,’ বলে সে মুখের ভেতরে আঙুল পুরে দিয়ে জোরে শিস বাজাতেই একটা পিচ্চি দৌড়ে আসতেই মিস্ত্রি তাকে ওদের ভেতর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিল।
ওরা মিনিট দশেকের মতো হেঁটে একটা হাফ বিল্ডিং বাড়ির সামনে এসে থামল। অনেকটা স্কুল-ঘরের মতো বাড়িটার সামনের দিকে সারি সারি কামরা। আরিয়ান অনুমান করল আফজাল মিস্ত্রি এবং তার গ্যারেজের কর্মীরা মনে হয় এখানে থাকে। পিচ্চি ছেলেটা ওদের নিয়ে একটা কামরায় চলে এলো। ওটার ভেতরে পাঁচ-ছয়টা এলোমেলো চৌকি পড়ে আছে। ওগুলোর ভেতরে তিনটা চৌকি আর পাশে কয়েকটা চেয়ার টেবিল গোছানো। চৌকিগুলোর ওপরে তোষক দিয়ে একেবারে পরিষ্কার চাদর বিছানো। ওরা বুঝতে পারল এই আয়োজনটা ওদের জন্যই করা হয়েছে। পিচ্চিটাকে ধন্যবাদ জানাতেই সে চলে গেল। যাওয়ার আগে জানিয়ে গেল সে বাইরেই একটা চৌকিতে ঘুমাবে কিছু লাগলে তাকে ডাক দিতে।
কামরার ভেতরে একটা চৌকি টেনে অন্যটার কিনারায় লাগিয়ে তিনটা চৌকিকে তিনকোনা সাজিয়ে অনেকটা ত্রিভুজের মতো করে ফেলল জুলহাস। টু হেল উইথ রেস্ট, আমার মনে হয় এই সময়টা আমাদের কাজে লাগাতে হবে ধাঁধার সমাধান করার জন্য।’
আরিয়ান এবং রাসনা দুজনেই সম্মতির সঙ্গে মাথা নাড়ল।
৩
গট গট করে দ্রুত পায়ে হেঁটে যখন গাড়ির কাছে পৌঁছাল অফিসার রহমান তখন তার সিগারেটের আগুন একেবারে মোথার কাছে পৌঁছে গেছে। সিগারেটের মোথাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে সে জিপের পেছনে উঠে বসল। ‘গাড়ি ছাড়,’ বলেই সে নিজের ব্যাগটা খুলে ল্যাপটপ বের করে ওটার ডালা তুলতে লাগল।
‘স্যার কই যাব?’ সামনে থেকে ড্রাইভার জানতে চাইল। কিন্তু রহমান কোনো জবাব দিল না, সে তার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। রহমানের মুড দেখে ড্রাইভার আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। সে আড়চোখে একবার পেছনে বসা জোনায়েদের দিকে দেখে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।
রহমান প্রথমেই ল্যাপটপ ওপেন করে বিশেষ একটা ডিভাইসের সঙ্গে কানেক্ট করল, তারপর সেই লাইনের সঙ্গে অ্যালাইন করা একটা স্পেশাল ব্রাউজার ওপেন করল, এটা সাধারণ ব্রাউজার থেকে অনেকটাই আলাদা। অনেকটা টর ব্রাউজারের কাস্টোমাইজড ভার্সনের মতো। ই-মেইলে ঢুকে দেখতে পেল অলরেডি যা যা পাঠানোর কথা সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব সংক্ষেপে সে জুলহাস আর রাসনার প্রফাইলে চোখ বুলিয়ে নিল। পুরো ব্যাপারটাতে ওদের সংযোগের মাধ্যমটাও অবিষ্কার করে মনে মনে মৃত প্রফেসরের পিন্ডি চটকালো একবার। তারপর বাকি ডকুমেন্টগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। এদের সঙ্গে কাজ করার এই একটা মজা, এরা কখনোই সরাসরি বলে দেবে না কোন পথে আগাতে হবে কিন্তু এমন ধরনের সব রিসোর্স শেয়ার করে দেবে এবং এমনভাবে দিকনির্দেশনা দিবে বুদ্ধিমান হলে বুঝতে খুব বেশি সমস্যা হবে না কী করতে হবে। ল্যাপটপ শাট ডাউন না করেই সে ওটার ডালা নামিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজের করণীয় ঠিক করে নিল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে তাকে কী করতে হবে, কিন্তু তাকে স্রেফ সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে কী করতে হবে। চোখ খুলে ল্যাপটপটা ব্যাগে ভরে মোবাইলটা বের করে ওটার নোটপ্যাডে সে একে একে লিখে নিল সেসব, তারপর জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। পরিষ্কার বোঝার চেষ্টা করছে রহমানের পরবর্তী করণীয় এবং কার্যক্রম কী হবে বোঝার চেষ্টা করছে সে।
স্যার, এবার কী করবেন?’ আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল সে।
‘প্রথম কাজ, ঢাকার আশপাশের যেসব এক্সিট পয়েন্টেগুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এখানে আসার আগে সেগুলো থেকে রিপোর্ট নাও, দেখ কোনো আপডেট আছে কি না। আমার ধারণা ওগুলো থেকে কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই। তাও যদি না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে সম্ভবত ওরা ঢাকা ছাড়েনি। আর তাই যদি হয় তবে নতুন পরিকল্পনা করে ঢাকার ভেতরে চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে।’
‘আর যদি কোনোটাতেই কাজ না হয়?’ জোনায়েদ প্রশ্নটা করে একটু ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে গেল। এটা জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হলো।
রহমান সোজা দৃষ্টি স্থির করল জোনায়েদের ওপরে। জোনায়েদ শক্ত একটা ঝাড়ি খাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে, রহমান হেসে উঠল। ঠান্ডা, পিশাচের হাসি। ‘তোমার কি মনে হয় প্রত্যেকের পরিবারের ওপরে নজর রাখার জন্য লোক নিয়োগ দিয়েছি কী করতে,’ রহমানের কথা শুনে জোনায়েদের বুকের ভেতরটাও কেন জানি কেঁপে উঠল, এই লোক সব পারে।
‘স্যার, কই যাব বললেন না তো?’ সামনে থেকে ড্রাইভার জানতে চাইল।
রহমান এবারও তার কথার কোনো জবাব দিল না। সে এটা বুঝতে পারছে এদের পরবর্তী স্টেপ কী হবে, এমনকি জুলহাস আর রাসনার সংযোগ ধরে এটাও সে বুঝতে পেরেছে ওরা এরপর কী করার চেষ্টা করবে কিন্তু ওরা যাতে এমনটা করে সেটা নিশ্চিত করার জন্য তাকে কিছু খেলা খেলতে হবে, যাতে ওদের মনে হয় দেখলে আসলে ওরা, কিন্তু রহমান জানে খেলাটা খেলছে আসলে সে, ওরা শুধুই ঘটনার গোলকধাঁধার আবর্তে পাক খাচ্ছে, যে গোলকধাঁধার আলটিমেট গন্তব্য শুধুই বাঘের গুহায় এসে ঢোকা।
৪
‘এই হলো সেই ধাঁধা,’ নিজের ল্যাপটপটা টেবিলের ওপরে রেখে সেটাকে আরিয়ান আর রাসনার দিকে ঘুরিয়ে দিল জুলহাস। ওরা আফজাল মিস্ত্রির গ্যারেজের লোকজনের সেই থাকার কামরাতে অবস্থান করছে, তিনটে চৌকিতে বসে আছে তিনজন পরস্পরের দিকে মুখ করা, মাঝে ছোট একটা টেবিল, সেটাতে ল্যাপটপটা রাখা। ওদের নিয়ে গাড়িতে করে আফজাল মিস্ত্রির এখানে আসতে আসতে পুরো বিষয়টার খানিকটা বলেছিল জুলহাস। পুরোটা সে বলে শেষ করতে পারেনি। টোকনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, ওদের ছোটবেলা, টোকনের ওদের ছোটবেলার বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া, তার মৃত্যু, টোকনের ওকে ছেড়ে যাওয়া, তারপর ওর এই ঘটনার সঙ্গে সংযোগ ইত্যাদি বললেও টোকনের রেখে যাওয়া ধাঁধা, সেটার সমাধান এবং অবশেষে সেটার মাধ্যমে কীভাবে সে ওদের খুঁজে পেল সেটা সে বিস্তারিত বলতে পারেনি সময়ের অভাবে। সেই সঙ্গে ওটাকে বুঝিয়ে বলতে গেলে ওদের কিছু জিনিস দেখানোরও প্রয়োজন ছিল, গাড়ি চালানো অবস্থায় তো সেটাও সম্ভব ছিল না, যে-কারণে সে পুরোটা বলতে পারেনি। ওরা এখানে আসার পর গাড়িতে যতটুকু বলেছিল সে, ঠিক সেখান থেকে শুরু করে। কীভাবে সে ফোর্সের ভেতরে নিজের পরিচিত একজনকে ঘুষ দিয়ে তথ্য বের করেছে। অবশেষে কীভাবে ওদের খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত বাকিটা বলে শেষ করে সে ল্যাপটপ খুলে সেটাকে পোর্টেবল মডেমের মাধ্যমে কানেক্ট করে টোকনের রেখে যাওয়া সেই ভার্চুয়াল ধাঁধার সব তথ্য বের করে ওদের সামনে তুলে ধরে।
আরিয়ান খানিকটা বিস্মিত ভঙ্গিতে ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে ধাঁধাটার সমাধান করা অংশে একে একে চোখ বুলিয়ে গেল, ওর পাশ থকে রাসনাও একইরকম আগ্রহ নিয়ে দেখছে। দেখতে দেখতে সে প্রথম রাউন্ডের ঠিক যেখানে এসে ওর বইয়ের গল্পটা আসল সেখানে এসে থেমে গেল। ‘অবিশ্বাস্য,’ বলতে না চাইলেও আপনাতেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘আপনি আপনার বন্ধু কামালের গল্পটা চুরি করেছেন, তাই না?’ জুলহাস সরাসরি তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। আরিয়ান চোখ তুলে তাকাতে গিয়েও তার দৃষ্টি নেমে গেল। যে-লোকটার সারা জীবনের অর্জন-পরিবার-ইমেজ ধ্বংস হয়ে গেছে এক সন্ধ্যায়। যে-লোকটা সারারাত অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শক্ত হাতে সেই মানুষটার জন্যও লজ্জা এতটা ভারী হতে পারে, এটা ভাবাটাও কঠিন। আরিয়ান দৃষ্টি না তুলেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
‘আপনি যে-মুহূর্তে দেখলেন মি. কামাল মারা পড়েছে, দেখলেন এটাই সুযোগ তার লেখা মেরে দিয়ে নিজের নামে ছাপিয়ে দিতে, কিছু মনে করবেন না মি. আরিয়ান, এতটা নিচে আপনি নামলেন কীভাবে?’ জুলহাস আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘টোকনের ধাঁধা থেকে ক্রু ধরে ধরে যখন সামনে এগোলাম আপনার নাম আসার পর আমি আপনার পুরো লাইফ হিস্ট্রি ঘেঁটেছি, যে-লোকটা এমনকি আর্মিতে টিকে থাকার জন্যও আপস করেননি, সেই মানুষটা এতটা নিচে নামল কীভাবে, এটা স্রেফ আশ্চর্য এক ব্যাপার।’
আরিয়ান আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আমি এখন যাই বলি না কেন, সেটা ফিকে শোনাবে, আমি যে-ব্যাখ্যাই দিই না কেন, সেটাতে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। আর আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, ব্যাখ্যা বা যুক্তি কখনোই পাপকে হালকা করার ক্ষমতা রাখে না,’ বলে সে একবার রাসনার দিকে দেখে নিল। ‘কিন্তু সত্যি কথা হলো আমি স্ট্রাগল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যে-আমি সারা জীবন মাথা উঁচু করে বেঁচেছি, দিনের পর দিন ফাইট করতে করতে আমি হেরে যাচ্ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল আমি হেরে যাচ্ছি। নিজের স্বপ্ন, নিজের ভালোলাগা, নিজের ক্রিয়েটিভি, নিজের পরিবার-প্রেয়সী সবার সামনে আমি হেরে যাচ্ছি। সত্যি কথা হলো প্রকৃত হেরে যাওয়ার চেয়ে আমি হেরে যাচ্ছি এই অনুভূতি অনেক বেশি কষ্টের, অনেক বেশি অসুস্থ, আপনাতেই আরিয়ানের হাত মুঠো হয়ে হয়ে গেল, না চাইতেও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু। ‘সব হারাবার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ান আমি, একমাত্র নিজের লেখাকে আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় রত, কিন্তু একটাও ভালো আইডিয়া আসছে না, যেগুলো আসছে নিজেরই ভালো লাগছে না, এমন সময় আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, কামাল তার লেখা একটা ছোট উপন্যাস পাঠাল,’ আরিয়ান আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘খুবই বাজে ভাষায় লেখা, খুবই অপরিণত এবং প্লট হোলে ভরা একটা লেখা কিন্তু পড়ে আমি সারারাত ঘুমাতে পারলাম না, বিশ্রীভাবে লেখার মোড়কে মোড়ানো অসাধারণ একটা আইডিয়া। এ-যেন কদাকার ঝিনুকের ভেতরে থাকা অসাধারণ এক মুক্তো, যার দুনিয়ার সেরা অলংকার হয়ে ওঠার জন্য স্রেফ আমার মতো একজন জহুরির হাত দরকার। কিন্তু সে উপায় নেই, কারণ যত খারাপই হোক সেটা আরেকজনের। কাজেই ভালোমন্দের দায়ভারও তার, ঠিক যেমন ওটার অধিকারটাও একমাত্র তার,’ বলে আরিয়ান মৃদু হেসে উঠল। ‘এ-যেন নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধুর বউ কিংবা প্রেয়সীর প্রেমে পড়ে যাওয়া, যার ওপরে তোমার কোনো অধিকার নেই, এমনকি সে তোমার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সুখী হবে এটা জেনেও কোনো লাভ নেই। আমি যখন আশাহত, হৃদয়হত এমন সময় এই ঘটনা, কষ্ট পেয়েছি কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, এটাই সুযোগ, আর তারপর—’ আরিয়ান কথাটা শেষ করতে পারল না।
‘নিজের বন্ধুর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হাতিয়ে নিলেন—
‘বাদ দিন, জুলহাসকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাসনা বলে উঠল। ‘কামাল ছেলেটাই আসলে অভাগা ছিল এতিম ছিল, আপন কেউ ছিল না। আমি কাছের মানুষ ছিলাম, আমি ওকে বিশ্বাস করিনি। মি. আরিয়ান একভাবে বলতে গেলে ধোঁকা দিয়েছে তাকে। কিন্তু মি. আরিয়ানের ব্যাপারটা আমি যে একেবারে বুঝি না তা নয়, ডেসপারেশন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার আসলে কোনো তল নেই,’ বলে রাসনা কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ব্যাপারটা শুনতে অদ্ভুত শোনাতে পারে। আমি কামালের গার্লফ্রেন্ড হয়েও মি. আরিয়ানকে ডিফেন্ড করছি। কিন্তু এর পেছনে কারণ আছে। প্রথমত, যা যাওয়ার গেছে, সামনে কী হবে বা কী করতে পারব আমরা, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, দ্বিতীয় বিষয় হলো আমরা সবাই নিজেদের জায়গা থেকে সমাজের প্রতিষ্ঠিত আদলে সবাইকে বিচার করি, যেটা আসলে সবসময় ঠিক না,’ বলে সে জুলহাসের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। ‘আপনিও তো আপনার ছেলেবেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে বিশ্বাস করেননি, তার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন, এটাকে কীভাবে ডিফেন্ড করবেন আপনি। আমি নিজেও তাই করেছি বলতে পারেন। কামালের কথা তার আচরণ আমি বিশ্বাস করিনি, যখন আমাকে তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। কাজেই আমরা সবাই যার যার জায়গায় কমবেশি অপরাধী, তারপরও বেলাশেষে আমরা মানুষ এবং আমি বলব বিবেকবান মানুষ আর সে-কারণে বিবেকের তাড়না থেকেই যে-ভুল আমরা করেছি সেটার প্রতিকার করার জন্যই এই জটিল অবস্থার সমাধান করার চেষ্টা করছি। বলুন, ভুল বলেছি কিছু?’
জুলহাস কিংবা আরিয়ান দুজনেই চুপ। কথা সত্যি সবাই নিজের পাপের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে অন্যের ভালোমন্দের মাপজোখ করার চেষ্টা করে।
আরিয়ান বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠল, ‘এসব আলোচনা থাক, বরং আমরা কাজে মন দেই।’
‘তার আগে কয়েকটা কথা আছে,’ জুলহাস যেন গা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল। ‘প্রথমত, আপনাদের কাছে কী কী ডিভাইস আছে?’ দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল কিছুই নেই তাদের কাছে। ‘গুড,’ জুলহাস সন্তুষ্টির সঙ্গে বলে উঠল। ‘কাজে নামার আগে আমাদের কয়েকটা বিষয় বুঝতে হবে। প্রথম কথা, আমাদের হাতে কতটুকু সময় আছে এবং এই সময়টাতে আমরা তাদের থেকে গা বাঁচিয়ে কীভাবে কাজে লাগাব। একটা কথা মনে হয় সবার জেনে রাখা উচিত যে, আমরা এখন থেকে আমাদের পুরনো কোনো ই-মেইেল, পুরনো কোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, ওয়েবমেইল ইত্যাদি কোনোটাতেই ঢুকব না, পরিচিত কেউ, বিশেষ করে কাছের আত্মীয় বা এরকম কাউকে কোনো অবস্থাতেই কল করা যাবে না,’ রাসনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জুলহাস থামিয়ে দিল। ‘আমি জানি আপনারা দুজনেই এসব বিষয়ে খুব ভালো জানেন তাও স্রেফ মনে করিয়ে দিলাম। আর এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এতসব করেও যে আমরা খুব বেশি সময় পাব এমন নয়। ওরা ঠিকই বের করে ফেলবে আমাদের। কী মনে হয় কেমন সময় আছে আমাদের হাতে?’
‘আমার ধারণা ওরা ঢাকা থেকে বের হওয়ার সমস্ত চেক পয়েন্ট আগে পরখ করবে, সিসি টিভি হোক বা এরকম কিছু হোক যেভাবেই হোক—’
‘না,’ রাসনাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিল আরিয়ান। ‘সরি, ইন্টরাপ্ট করলাম। অফিসার রহমান যদি এখনো আমাদের পেছনে লেগে থাকে তবে সে কীভাবে কাজ করবে আমি বলি। প্রথমে সে যেখানে আমাদের হারিয়েছে সেখান থেকে ম্যাপ ধরে একটা পসিবল রুট বানাবে আমরা সম্ভাব্য কোনদিকে যেতে পারি। সেখান থেকে ধরে দুটো প্রসেসে আগাবে ওরা। প্রথমত, ধরেই নেবে আমরা ঢাকা থেকে বেরিয়েছি, ওই পয়েন্ট থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব রুট এবং এক্সিট পয়েন্টের সিসি টিভি হোক বা যাই হোক ওরা চেক করে বের করার চেষ্টা করবে আমরা কোনোদিকে গেছি। এখানে ওরা কিছুই পাবে না—’
‘কারণ আমরা জলপথ ব্যবহার করেছি—’
‘একদম ঠিক, জলপথ ব্যবহার করাতে ওরা চট করে বের করতে পারবে না আমরা ঠিক কোনদিকে গেছি। কিন্তু, এটা খুব বেশি সময় দেবে না আমাদের, বড়জোর কয়েক ঘণ্টা। এরপর ওরা ব্যবহার করবে ওদের গ্রাউন্ড ফোর্স, ইনফরমারদের। হয়তো ভেতরে ভেতরে পুরস্কারও ঘোষণা করতে পারে। এর ভেতরে ওরা নজর রাখবে আমাদের পরিবারের ওপরে, বের করার চেষ্টা করবে আমাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রতিটা লিংক খুঁজে বের করবে-
‘আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি, কিছুটা সময় আছে আমাদের হাতে, জুলহাস হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করল। এখন সময় পাজলের পরের অংশ শুরু করার, আপনার কাছে কী মনে হয়, কী থাকতে পারে এই বইতে, যে-কারণে সবাই এর পেছনে লেগেছে।’
‘নিশ্চয়ই কামাল তার বইতে এমন কিছু বলেছে বা ক্লু দিয়ে রেখেছে যেটা কিছু একটা ইঙ্গিত করে, তা না হলে এসবের পেছনে যারাই থাকুক তারা এভাবে মি. আরিয়ানের পেছনে লাগত না, সোজা কথা বলতে গেলে এই বইয়ের পেছনে লাগত না। এখন বলুন, আপনার কাছে কী মনে হয়, কী থাকতে পারে বইতে? কামালের পর আপনিই এই বইয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানেন। প্রতিটা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম জিনিস আপনার মাথায় আছে,’ বলে জুলহাস একবার রাসনার দিকে দেখে নিয়ে আবারো আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘আছে তো?’
আরিয়ান ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আপনাতেই মাথা নাড়ল। ‘তা আছে, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বইটাই একটা সাধারণ সামাজিক উপন্যাস, কামালের গল্পটা আরো সাধারণ ছিল। এর ভেতরে কী এমন সূক্ষ্ম জিনিস থাকতে পারে, যা এরকম একদল ভয়ংকর লোকের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে, এটা আমার মাথায় কিছুতেই ধরছে না
জুলহাস চৌকির ওপরে হেলান দিয়ে বসে ছিল, আরিয়ানের কথা শুনে সে সোজা হয়ে বসল। ‘বলেন কি আপনিই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা,
আপনি না বুঝলে হবে। এত কাঠখড় পুড়িয়ে আপনাদের উদ্ধার করে আনলাম কেন তবে?
‘দেখুন—’
‘এক মিনিট,’ আরিয়ান আর জুলহাস দুজনারই উত্তেজিত গলা শুনে রাসনা দুজনকেই থামিয়ে দিল। ‘কে কার জন্য কী করেছি কী হয়েছে, এসব নিয়ে ঘাঁটলে স্রেফ দুর্গন্ধই ছড়াবে। তারচেয়ে আমরা কাজে মন দিই,’ বলে সে জুলহাসের দিকে ফিরল। ‘মি. আরিয়ান ভুল বলেননি। এভাবে চট করে একটা গল্পের ভেতরে কু খুঁজতে বললে কেউই পারবে না। আপনি ভেবে দেখুন, আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর রেখে যাওয়া ক্লু ধরে ধাঁধার প্রথম অংশটার সমাধান করেছেন কতটা সময় নিয়ে। আর সেখানে এখন যোগ হয়েছে একদিকে টোকন অন্যদিকে কামালের দুজনের রেখে যাওয়া ব্লু জোড়া লাগান, কাজেই পুরো ব্যাপারটা কঠিন হবেই। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আমি সরি,’ জুলহাস দুই হাত তুলল। ‘আমার সময় লেগেছিল এবং আমি সময় লাগিয়েছিলাম কারণ আমার হাতে সময় ছিল। কিন্তু এখন আমাদের হাতে সময় নেই—’
‘তবে একটা সুবিধা আছে,’ আরিয়ানের কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকাল বাকি দুজন। ‘আপনি বিষয়টার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন একা, আর এখন এখানে তিনটা মাথা আছে। কাজেই আমরা তিনজনের বুদ্ধি এক করে সমাধানের চেষ্টা করব। আমি যদিও বুঝতে পারছি না আসলে উপন্যাসের ভেতরে কী ছিল, কিন্তু এটা বুঝতে পারছি এই ভার্চুয়াল ধাঁধা আর উপন্যাস দুটো মিলিয়েই বিষয়টার সমাধান করতে হবে। আমার মনে হয় আমার ভার্চুয়াল ধাঁধার পরের পার্ট ধরে, উপন্যাসটার সংযোগ কী হতে পারে সেই লাইনে এগোতে পারি।’
‘ভেরি গুড, বসা অবস্থাতেই টেবিলে চাপড় মারল জুলহাস। ‘লেটস স্টার্ট।’