একটি ভৌতিক গল্পের পোস্টমর্টেম

একটি ভৌতিক গল্পের পোস্টমর্টেম

সম্প্রতি আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে একটি ভৌতিক গল্পকে কাটাছেঁড়া করার। আমি যে খুব আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছি তা-না। গল্প থাকবে গল্পের মতো। তাকে কাঁটাছেঁড়া করা হবে কেন? একজন মানুষের জীবনে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা ঘটে। অভিজ্ঞতাগুলো তার ব্যক্তিগত গল্প। এইসব গল্পের কিছু থাকে অতিপ্রকৃত বা ভৌতিক। এই গল্পগুলো সে গভীর মমতায় লালন করে। বৃদ্ধবয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বলতে নিজে রোমাঞ্চিত হন। নাতি-নাতনিরা অবাক হয়ে বলে, সত্যি এমন ঘটেছিল। সাধারণত এ ধরনের গল্পে পালক যুক্ত হতে হতে মূল গল্প হারিয়ে যায়।

গল্পে আছে এক মহিলার এক ছেলের জন্ম দিয়েছে, গায়ের রঙ কালো। ধাত্রী তার বাড়ি ফিরে গল্প করল, অমুক মহিলার এক ছেলে হয়েছে। গায়ের রঙ কাকের মতো কালো। লোকমুখে গল্প ছড়াতে লাগল। শেষ অংশ হচ্ছে–এক মহিলা একটা কাকের জন্ম দিয়েছে। কাকটা কা কা করছে তবে ফাঁকে ফাঁকে ‘মা’ ডাকছে। কা কা মা। মা কা কা…

জটিল ভৌতিক অভিজ্ঞতা প্রায় সময়ই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় না। যিনি গল্পটি বলছেন তার আত্মীয়ের অভিজ্ঞতা। সেই আত্মীয় আবার জীবনে কখনো মিথ্যা বলেন টাইপ।

যখন আমার বয়স কম ছিল, তখন বেশ কয়েকবার গল্পের পেছনে দৌড়িয়েছি। বরিশাল বিএম কলেজে কেমিস্ট্রির M.Sc. পরীক্ষার এক্সটারনাল হিসেবে একবার গিয়েছি। সেখানে শুনলাম মাইল তিনেক দূরে একটা ভাঙা রহস্যময় কুয়া আছে। কুয়ার পানির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে পানি হঠাৎ খলবল করে উঠে এবং প্রশ্নের উত্তর দেয়।

পরীক্ষার ভাইবা শেষ করে নৌকা নিয়ে আমি অদ্ভুত কুয়া দেখতে গেলাম। বরিশালের সরু খালবিলে নৌকা নিয়ে যাওয়া এক ধরনের দিগদারি। জোয়ার ভাটা দেখে নৌকা ছাড়তে হয়। তিন মাইল যেতেই আমার সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। ফলাফল শূন্য। কুয়াতে মুখ রেখে অনেকক্ষণ “হ্যালো হ্যালো, তুমি কে? কথা বলো।” এইসব করলাম। কুয়া বা কুয়ার পানি কোনো জবাব দিল না। খলবলানিও নেই। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি বললেন, আজকের ঘটনাটা বুঝলাম না। মনে হয় আপনেরে ভয় খাইছে। কুয়া কেন আমাকে ভয় খাইছে কে বলবে?

পরীক্ষা নিতে একবার গেলাম পটুয়াখালি সরকারি কলেজে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষক হয়েছি। গা থেকে ছাত্রের গন্ধ যায় নি। সিনিয়র শিক্ষকরা এত দূরে পরীক্ষা নিতে আসতে চান না বলেই আমাকে পাঠানো।

কলেজ কম্পাউন্ডের একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা। আমার জন্যে আলাদা বাবুর্চি। এই বাবুর্চি মনে হয় লবণ ছাড়া রান্নার কোর্স নিয়েছে। কোনো খাবারেই লবণ হয় না। তবে সে লবণের অভাব পুষিয়ে দিত ভূতের গল্প করে। তাদের বাড়িতে একটি পোষা ভূত আছে। এই ভূতকে যদি বলা হয় চাপকল টিপে পানি বের করতে, সে বাধ্য ছেলের মতো চাপকল টিপে পানি বের করে। ঘর ঝাঁট দেয়। চাপকল উঠানামা করে। কল চাপতে কাউকে দেখা যায় না। বাবুর্চি বলল, স্যার কষ্ট করে যদি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলা দেন তাহলে আপনাকে ভূতের খেলা দেখায়ে দিতাম। যেতে হবে রাতে।

রাতেই গেলাম। ভূতের চাপকলে পানি তোলা। উঠান ঝাঁট দেওয়া কিছুই দেখলাম না। বাবুর্চি বলল, আপনি অপরিচিত তো আপনারে দেখে শরম পাইছে। সামনে আসতেছে না।

বাবুর্চি তার বাড়িতে খাবার আয়োজন করে রেখেছিল। প্রতিটি আইটেমের লবণ ঠিক ছিল। খেতেও হয়েছিল অসাধারণ। তার বাড়িতে খাওয়া তপসে মাছের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে কেউ কেউ সরাসরি আমাকে ভূত বা জ্বিন দেখাতে আসেন। একজন এসেছিলেন কক্সবাজার কিংবা দোহাজারি থেকে। তিনি নিজে একজন কবি এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি বললেন, স্যার আমি জ্বিন দেখাতে পারব না। চর্মচক্ষে তাদের দেখা যায় না। যারা বলে জ্বিন দেখাবে তারা মিথ্যা কথা বলে। তবে আমি জিনের মাধ্যমে খাবার এনে খাওয়াব। আপনি কী খেতে চান বলুন।

আমি বললাম, মুরগির রোস্ট।

জ্বিন জাতি ঝাল জাতীয় খাবার আনে না। মিষ্টি জাতীয় কোনো নাম বলুন।

আমি বললাম, বগুড়ার মিষ্টি দই।

 শুকনা খাবারের নাম বলতে হবে। ভেজা খাবার এরা আনে না।

 লাড্ডু খেতে পারি। লাড্ডু কি আনতে পারবে?

অবশ্যই পারবে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করতে বলুন। জ্বিনরা আলোতে আসে না।

বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করা হলো। লাড্ডুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আধঘণ্টা পার হলো। লাড্ডু পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক বললেন, জ্বিন আসতে চাচ্ছে না।

গায়ক এস আই টুটুল একবার কুষ্টিয়া থেকে দুজন জ্বিনসাধক নিয়ে এল। এরা নাকি সুপার জেনুইন। মুহূর্তের মধ্যে জ্বিন হাজির করবে। জ্বিন আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। জ্বিন এল না। প্রশ্নের উত্তর অনেক পরের ব্যাপার। দুই জ্বিনসাধক টুটুলকে বলল, স্যারের সঙ্গে এক কঠিন জ্বিন থাকে। এই জ্বিনকে দেখে ভয় পেয়ে তাদের জ্বিন আসে নাই। আমাকে বাদ দিয়ে আসর বসালেই নাকি জ্বিন আসবে। আমি তাতেই রাজি হয়েছি। টুটুল ইউরোপ-আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে বলে আসর বসানোর সময় বের করতে পারছে না।

ছোটবেলায় যেসব ভূতের গল্প শুনতাম এখন আর শুনি না। আমার মার আপন চাচির মুখে শুনেছি, জন্মের পর পর জ্বিন বা ভূত তাকে নিয়ে উঁচু তালগাছের মাথায় রেখে দিয়েছিল। সারা গ্রামের মানুষ মশাল-লণ্ঠন জ্বেলে তালগাছ ঘিরেছে। গাছে মই লাগিয়ে শিশুকে নামিয়ে এনেছে। আমার মা বললেন, ঘটনা সত্য। তিনি ছোটবেলা থেকেই শুনছেন।

মাতৃহারা বানর মানবসন্তান চুরি করে গাছে নিয়ে যায়। এমন কিছু কি ঘটেছে?

গ্রামাঞ্চলে জ্বিন বা ভূত তাড়ানোর ওঝাদের একসময় ভালো প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এই শ্রেণী এখন মনে হয় উঠে গেছে। গতবার গ্রামে গিয়ে ওঝার সন্ধান করলাম। ওঝাদের কাছ থেকে কিছু মন্ত্র লিখে নেব। গল্প-উপন্যাস লেখায় কাজে দেবে। জ্বিন-ভূতের একজন ওঝাকে পাওয়া গেল। সে তার পুরনো পেশা ছেড়ে দিয়ে রুয়াইল বাজারে পানে খাওয়ার ঝিনুকের চুন বিক্রি করে। তাকে খবর দিয়ে আনা হলো। সে দুঃখের সঙ্গে বলল, পল্লী বিদ্যুতের কারণে জ্বিন-ভূত নাই বললেই হয়। সেই কারণেই সে ওঝগিরি ছেড়ে দিয়েছে। জ্বিন -ভূত তাড়াবার কিছু মন্ত্র তার কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করলাম। সে মন্ত্র জানাতে রাজি হলো না। সম্ভবত তার। কাছে কোনো মন্ত্র নেই।  

আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে নানার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সেখানে ভূতের আছর হওয়া এবং ওঝা দিয়ে ভূত তাড়ানো দেখেছি। বেশির ভাগ সময় আছর হতো যুবতী মেয়েদের উপর। ওঝা এসে মন্ত্র-তন্ত্র পাঠ করার পর আছর হওয়া কন্যা যে কাজটি প্রথম করত তা হলো টেনেটুনে শাড়ি খুলে ফেলা। ঘটনা। দেখে বয়স্করা নিশ্চয় মজা পেতেন। আমার কাছে দৃশ্যটা ছিল ভীতিকর। ওঝার সঙ্গে কথোপকথন হতো। মেয়েটিই বিকৃত গলায় কথা বলত।

ওঝা : তুই কে?

মেয়ে : আমি অমুক (একটা নাম বলত। পুরুষের নাম।)

ওঝা : একে ধরেছিস কেন?

মেয়ে : সে সিনান করে আমার গায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে। এইজন্যে ধরেছি।

ওঝা তখন মন্ত্র শুরু করতেন। মন্ত্রের সবটাই অশ্লীলতম বাক্যে ভর্তি।

মন্ত্র পাঠ এবং সরিষার দানা ছুঁড়ে মারার পর ভূত চলে যেত। মেয়েটা তখন পরনের খুলে ফেলা শাড়ি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে কুকুরের মতো চারপায়ে দ্রুত ঘরের দিকে যেত। বেশির ভাগ সময় দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত।

পুরো বিষয়টা অবদমিত যৌন কামনার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। গায়ের কাপড় খুলে ফেলা, আগ্রহ নিয়ে ওঝার অশ্লীল কথাবার্তা শোনার অন্য কারণ নেই। গায়ের কাপড় খুলে ফেলার বিষয়টি এত নিয়মিত ঘটত যে ময়মনসিংহের গ্রাম্য বাগধারায় বিষয়টি উঠে এসেছে। উদাহরণ–”জ্বর হয়ে বৌ নেংটা হইল, সেই থেকে বৌয়ের অভ্যাস হইল।” এই বাগধারার অর্থ একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে নতুন বৌ গায়ের কাপড় খুলে ফেলে দিল। কেউ তাকে কিছু না বলায় সে লাই পেয়ে গেছে। এখন অকারণেই সে গায়ের কাপড় খোলে।

আগেই বলেছি সবার জীবনেই কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতা ঘটে। আমার জীবনেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। আমি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। সবার পেরেছি তা-না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তি পরাস্ত হয়েছে। যুক্তির পরাজয় আমার পক্ষে মানা কঠিন। কারণ আমার মধ্যে মিসির আলি বাস করেন। তিনি মনে করেন যুক্তির বাইরে কিছুই নেই।

নুহাশপল্লীর একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতা বলি-সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি একা নুহাশ পল্লীর দিঘির দিকে যাচ্ছি। ওষুধি বাগানের কাছাকাছি এসে মনে হলো, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। অনুসরণকারীর পায়ে নূপুর। নূপুরের শব্দ করে করে সে আসছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লে নুপূরের শব্দ বন্ধ। হাঁটা শুরু করলেই নূপুরের শব্দ। তিনবার পরীক্ষা করলাম। তিনবারই এই ঘটনা। আতঙ্কে শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করব তাও পারছি না। মস্তিষ্ক উত্তপ্ত। চিৎকার করে কাউকে ডাকব? নাকি দৌড়ে পালাব? দোটানা অবস্থায় নিজে নিজেই রহস্য ভেদ করলাম। আমার প্যান্টের বেল্টটা ঠিকমতো লাগানো হয় নি। বেল্টের ধাতব আংটা ঝুলছে। যখনই হাঁটছি তখনি সেই আংটা শরীরের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঝুন ঝুন শব্দ তুলছে। তাতেই মনে হচ্ছে নূপুর পায়ে কেউ একজন আমাকে অনুসরণ করছে।

তবলার ঠুকঠাক অনেক হয়েছে। এখন মূল গল্পে যাই। একটি ভূতের গল্পের পোস্টমর্টেম করি।

প্রস্তাবনা

মাসুদ আখন্দ তার বাবা-মা’র সঙ্গে সুইডেনে থাকত। এখন সে বাংলাদেশে এসে ফিল্ম মেকিং জাতীয় কাজকর্ম করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার বাবা-মা থাকেন সুইডেনে। আমি ইউরোপে বেড়াতে গেলে মাসুদের বাবা-মা দুজনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল। দুজনই নিতান্তই ভালো মানুষ। তাদের একটাই কষ্ট, নিজ দেশ ফেলে অন্যের দেশে বাস করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি মাসুদের বাবা মারা গেছেন। তার মা এসেছেন বাংলাদেশে। এই মহিলার শৈশব জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। তার ধারণা এই ঘটনাটির কোনো ব্যাখ্যা নেই। একমাত্র মিসির আলিই ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি মিসির আলির বিকল্প হিসেবে তাঁর ছেলেকে পাঠালেন আমার কাছে। আমি যদি ব্যাখ্যা দিতে পারি।

মূল গল্প

মেয়েটির বয়স সাত কিংবা আট (মাসুদের মার কথা বলছি)। তার নানার বাড়িতে কী একটা উৎসব। সে একদিনের জন্যে নানার বাড়ি যাবে। নানার বাড়ি খুব যে দূরে তা-না। হাঁটাপথে দু’ঘণ্টার মতো লাগে। ঠিক হয়েছে মেয়েটাকে তার বাড়ির কামলা ভোরবেলা নিয়ে যাবে। আবার ওইদিনই ফেরত নিয়ে আসবে।

কামলার নাম ঠাকুর। নাম ঠাকুর হলেও সে মুসলমান। মেয়েটির বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ঘর তুলে স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। ঠাকুর এই মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করে।

যেদিন উৎসবে যাওয়ার কথা সেদিন ঠাকুর অন্ধকার থাকতে থাকতে চলে এল। সেই সময় ঘড়ি দেখার চল ছিল না। কারও বাড়িতে ঘড়ি থাকত না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে সময় আঁচ করার চেষ্টা করা হত। ঠাকুর যে গভীর রাতে এসেছে তা কেউ বুঝতে পারল না। মেয়েটা ঠাকুরের সঙ্গে রওনা হলো। ঠাকুর প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যতই বলে চাচা আস্তে হাঁটেন ততই ঠাকুর দ্রুত পা ফেলে।

একসময় ঠাকুর মেয়েটিকে নিয়ে তার নানার বাড়িতে উপস্থিত হলো। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে। তাদের ডেকে তোলা হলো। মেয়ের নানা গভীর রাতে মেয়েটিকে নিয়ে আসার জন্যে ঠাকুরকে অনেক গালাগালি করলেন। ঠাকুর মাথা নিচু করে গালি শুনল তারপর অভিমান করেই একা ফিরে গেল। যাওয়ার সময় কারও কাছ থেকে বিদায়ও নিল না।

গল্পের অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক অংশ হচ্ছে, পরদিন ঠাকুরকে ডেকে পাঠানো হলো। কৈফিয়ত তলবের জন্যে কেন সে কাউকে কিছু না জানিয়ে মেয়েটাকে রেখেই চলে গেছে। গভীর রাতে বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে কেনইবা সে রওনা হলো!

গল্পের ভৌতিক অংশ হলো গত তিন দিন তিন রাত ধরে ঠাকুর জ্বরে অচেতন। বিছানা থেকে নামার অবস্থা তার নেই। তার স্ত্রী জানাল, গত তিন দিন ধরে সে তার স্বামীর পাশে। মানুষটা এখন যায় তখন যায় অবস্থা। ঠাকুর চিচি করে বলল, আম্মারে নিয়া আমি কোনোখানে যাই নাই। আমি ঘাড় ফিরাইতে পারি না এমন অবস্থা।

তাহলে বাচ্চা মেয়েটিকে কে নিয়ে গেছে? ভূত, জ্বিন?

গল্পের পোস্টমর্টেম

জ্বিন-ভূতের কোনো দায়িত্ব পড়ে নি মেয়েটিকে নানার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। কাজেই জ্বিন-ভূত বাদ।

ঠাকুর মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়েছে, এটা সবাই দেখেছে। মেয়েটি বা তার নানার বাড়ি লোকজন ঠাকুরকে দেখেছে। ঠাকুর জ্বরে তিন দিন ধরে অচেতন বা প্রায় অচেতন এটাও সত্যি। এখানে মিথ্যা ভাষণের প্রয়োজন নাই।

তাহলে মেয়েটিকে কে নিয়ে গেছে।

আমার ব্যাখ্যা ঠাকুরই নিয়ে গেছে। সে গভীর রাতে ঘরের মধ্যে বের হয়েছে (স্লিপ ওয়াকিংয়ের মতো) তার মাথায় আছে বাচ্চা মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে হবে। সে ঘোরের মধ্যেই বের হয়েছে। ঘোরের মধ্যে মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়েছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, এই সময় তার স্ত্রী কোথায় ছিল?

স্ত্রী ঘুমাচ্ছিল। রোগীর সেবা করতে গিয়ে সে ক্লান্ত এবং অঘুমা। তার ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক। দীর্ঘসময় তার ঘুম ভাঙে নি, কারণ রোগী পাশে শুয়ে আহ্ উহ্ করছে না। রোগী বাচ্চা মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে গিয়েছে।

পাদটিকা

একটি চমৎকার ভৌতিক গল্প হত্যা করা হলো। কাজটা ভুল এবং অন্যায়। ভৌতিক গল্প থাকবে গল্পের মতো। সে সবাইকে ভয় দেখাবে। এতেই তার সার্থকতা এবং পূর্ণতা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন—

চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব রুদ্ধ ওষ্ঠাধর।
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে পেয়েছে উত্তর।

তাঁর কথাই মনে রাখা আমার উচিত ছিল। গল্প হত্যা করার প্রয়োজন ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *