একটি ভৌতিক গল্প
এসো, তোমার সঙ্গে খানিক গল্প করা যাক, ভূত হয়ে তোমার কেমন লাগছে? বেশ লাগছে। ভীষণ হালকা লাগছে। ইচ্ছে হওয়া মাত্রই যেখানে খুশি হুশ করে চলে যেতে পারছি। বাস, ট্রাম, ট্রেন, ট্যাক্সি কোনও কিছুরই প্রয়োজন হচ্ছে না। এই তো একটু আগে হরিদ্বারে ছিলুম। এখন দ্যাখো মনুমেন্টের মাথায়। তোমার কেমন লাগছে?
আমার একটু ভয়ভয় লাগছে।
ধ্যাস, ভয়ভয় লাগবে কেন? বোকা ছেলে!
বোকা ছেলে বোলো না, বলো বোকা ভূত। ভূত কেন বললুম তা জানো, এক্ষুনি তুমি আমাকে পেতনি বলবে। মরে গেলেও ব্যাকরণ তো ভুলিনি! ভূতের স্ত্রীলিঙ্গ পেতনি। ভয়-ভয় লাগছে কেন? ভূতই তো সকলকে ভয় দেখায়।
ভয়-ভয় লাগছে অন্য কারণে! কী যেন একটা নেই!
শরীরটা নেই। তুমি যখন মরলে তখন তোমার শরীরের অবস্থা কীরকম ছিল?
মোটামুটি ভালোই ছিল, তবে অম্বলে ধরেছিল। অকালে চুলে পাক। টাকের দর্শন।
কলকাতার লোকের অম্বল হবেই। শীতের কম্বল, কলকাতার লোকের অম্বল।
না গো, আমার অম্বল হওয়ার কথা নয়। ছাত্রজীবন থেকেই ব্যায়াম আর আসন করতুম।
আরে বাবা, ব্যায়াম আর আসন তো দেহের, মনের, মনটার কী হবে! মনেই তো টেনশনের বাসা।
ঠিক বলেছ! একটা মাকড়সা দিবারাত্র দুর্ভাবনার জাল বুনে চলেছে। মানুষের কাল হল বিয়ে! বিয়ে যদ্দিন করোনি ফাসক্লাস, বেশ আছো। রাজা। করেছ কী মরেছ! হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন তবুও রানার ছোটে।
ঠিক বলেছ, বিয়ে করেছ কী মরেছ!
তুমি আর কথা বোলো না, তোমাদের জন্যই ছেলেরা হেদিয়ে মরে, অবশেষে ফাঁদে পড়ে,
অত:পর
তুলসীদাসজির সেই দোঁহা:
বেহা বেহা সব কোই কহে
মেরা মন মে ইয়ে ভায়।
চড় খাটোলি, ধো ধো লগড়া।
জেহেল পর লে যায়।
বিয়ে বিয়ে ওরে ব্যাটা, মহামরণ ফাঁদ। ওটা পালকি নয় রে মোবাইল চিতা। জেলে যাচ্ছে যাও।
প্রেম?
হাফ প্রেম।
হাফ প্রেম মানে?
প্যান্টের যেমন ফুলপ্যান্ট, হাফপ্যান্ট, প্রেমেরও সেই রকম ফুল প্রেম, হাপ প্রেম। আমার পিসতুতো দাদার বিয়েতে এসেছিল। পরিবেশন করতে করতে তাকাতাকি। হাতে হাত ঠেকাঠেকি। তারপর বাকি রাত একটা বাগান মতো জায়গায় একটা তক্তপোশের ওপর বসে বলাবলি। বসন্তের বাতাস, থ্রিকোয়ার্টার চাঁদ, রাতজাগা উতলা কোকিলের আকুল ডাক! হৃদয় ফ্র্যাকচার। এইবার কেসটা আমাদের হাতে আর রইল না। বউদির হাতে চলে গেল। পরের লগ্নেই চাদরের তলায় চারি চক্ষুর শুভ দৃষ্টি। তোমাকে বলে রাখি, বসন্তের মেয়েরা সব স্মল পক্সের মতোই ডেনজারাস।
শোনো ভূত হয়েছ হও, অভদ্র হোয়ো না। মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে শেখো। যতদিন বেঁচে ছিলে এটা তো বুঝেছিলে, মেয়েদের অসীম শক্তি। জাঁদরেল, জাঁদরেল পুরুষকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারে।
বড়ো জোর বছরতিনেক।
মানে।
প্রেম পাতলা হয়ে যায়। চায়ের উদাহরণ, নতুন পাতা স্ট্রং লিকার। দুবারে একটু হালকা, তিনবারে ফ্যারফেরে জল। বউ যত পুরোনো হয় প্রেম তত কমতে থাকে। তখন একটা ফার্নিচার। মানুষ যে-খাটে শোয় রোজ সকালে উঠে সেই খাটটাকে কী আদর করে? হাত বোলায়? শুতে শুতে শোওয়াটাই থাকে, খাটটা তখন থেকেও থাকে না।
গাধা।
কে?
তুমি। আরে, বউ না থাকলেও মেয়ে তো থাকে! নতুন নতুন মেয়ে! একটু ঝেড়ে কাশো না।
লজ্জার ব্যাপার।
ভূতের আবার লজ্জা কী?
ওই অপিসের একটা মেয়ে।
তোমার বউযের চেয়ে ভালো?
না, না, আমার বউ ছিল ভীষণ সুন্দরী, প্যারাগনা অফ বিউটি, তেমনি গান, সেবা, রান্না।
তাহলে মরতে ওটার কাছে গেলে কেন?
ওই যে, অবৈধ প্রেম! পাপের আনন্দ, উত্তেজনা।
এত ভান, তবু কাঁদে প্রাণ,
রূপমোহ অতি চমৎকার।
বউ জানত?
আমি মনে করতুম, কী করে জানবে! সবই তো লুকিয়ে চুরিয়ে হচ্ছে। আসলে সে সব জানত। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অতি প্রবল। ছবির মতো সব দেখতে পায়। ছেলেরা মহা গাধা।
যাক, স্বীকার করলে। তা কেসটা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াল।
ওই কেসটা গেঁজে গেল। মেয়েটা ভেবেছিল, আমি অবিবাহিত। আমারও দোষ ছিল, ঝেড়ে কাশিনি। চেপেচুপে রেখেছিলাম। ওই বলে না, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। হঠাৎ অফিসে একটা ফোন এল নদিয়া থেকে। ফোনটা ধরলেন আমাদের বড়বাবু। নিজের চেয়ার থেকেই হেঁকে বললেন, ‘এই শংকর! তোমার ফাদার ইন ল এক্সপায়ার করেছেন’ সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রেমও এক্সপায়ার করল। আমার উলটো দিকে বসে রুমা টাইপ করছিল। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ইংরেজিতে যাকে বলে, কোল্ড স্টেয়ার। আমি বুঝতে পেরে বললুম, এ শ্বশুরমশাই সে শ্বশুরমশাই নয়, রুমা বলল, মাসতুতো পিসতুতো ভাই হয়, বাবা হয় না। পিসতুতো বাবা শুনেছ কোনও দিন। আমি বললুম, কেন, খুড়শ্বশুর! রুমা বলল, আগে একটা শ্বশুর চাই। সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে বললে, সবার আগে একটা বউ চাই, তারপর সেই বউ থেকে আসবে যাবতীয় শ্বশুর। তারপর খুব শীতল গলায় বললে, যাও শ্মশানে যাও, আর আমার সব চিঠি ফেরত দিও।
মানে প্রেমপত্র?
ওই আর কী।
তা, সেই সব প্রেমপত্র রাখতে কোথা?
বাড়িতেই লুকিয়ে চুরিয়ে রাখতুম। বিছানায় ছোবড়ার গদির তলায়।
অত যত্ন। প্রেমপত্র তো টাকা নয়!
তা নয়, তবে চারটে জিনিস একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। এমন জড়ামড়ি সহসা পাবে না। বেশির ভাগই দুটো দুটো যেমন ধরো রস আর রসগোল্লা। পাখি আর ডানা। নদী আর স্রোত। দাঁত আর হাসি। ভালো চায়ে পাবে, লিকার আর ফ্লেভার। চোখ আর চোখের জল। স্বামী আর স্ত্রী। একমাত্র প্রেম। প্রেমে প্রেম আছে, প্রেমিক আছে, প্রেমিকা আছে, আর আছে প্রেমপত্র।
হুঁ। তা, বউয়ের সঙ্গে প্রেম, প্রেমপত্র চালাচালি করা যায় না!
না। প্রেমের কথায় কোনও কাজের কথা থাকে না। কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের সাঁই সাঁই শব্দ। যেমন, কবে তুমি আমার হাত ধরবে? ডাবের জলের মতো ভেতরটা ভরে দেবে। চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি। চলো রিনা ক্যাসুরিনা। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে গিলে হজম করে ফেলি।
আর বউয়ের চিঠি?
ওই মঞ্জুর মায়ের দিকে একটু নজর রাখবে। ভীষণ হাত টান। এক কেজি তেল তিন দিনে সাবাড়। চা আর চিনি খুব সাবধান। এই ক’টা দিন একটু কষ্ট করে চালাও। আমি কাছে নেই, খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? তাই না! আমারও।
কোথা থেকে লিখছে?
বাপের বাড়ি থেকে। আমি মনে মনে বলেছিলুম, ফাঁকা ফাঁকা। বউ থাকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু দুরে থাকাই ভালো। এত কনট্রোল যে মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগে। রাতে কোনপাশে কাত হয়ে শোব, খাওয়ার কতক্ষণ পরে জল খাব, পাশের বাড়ির বউদির সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলব! দেশের স্বাধীনতার জন্য লোকে প্রাণ দেয়, আর নিজের স্বাধীনতা হারাবার জন্য নেচে নেচে বিয়ে করে!
সে তো হল, তা স্ত্রীর মৃত্যুর পর এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে মরে গেলে কেন?
সে যদি বলো তাহলে একটা সত্য কথা বলি। ধরে নাও ভূতের স্বীকারোক্তি হার্ট বা হৃদয় যতদিন ধুকপুক করে মানুষ পাত্তাই দেয় না। যা তা খায়, দুর্ব্যবহার করে। থেমে গেলে ভূত হয়ে বুঝতে পারে জীবনের অপর নাম হৃদয়। স্ত্রী হল সেই হৃদয়ের অধিবাসী, হৃদয়েশ্বরী।
তাহলে কাছে এসো।
কার কাছে?
আমার কাছে। চিনতে পারছ না, আমিই তোমার সেই স্ত্রী। আমিই তো তোমাকে জীবন থেকে তুলে এনেছি। শোনো স্বামীরা যেমনই হোক, মরে যাওয়ার পরেও স্ত্রীদের একটা কর্তব্য থাকে। ছেলেরা মরে হৃদয়হীন ভূত হয়, মেয়েরা মরে হৃদয়বান ভূত হয়। পেতনি বোলো না। বড় বিশ্রী শব্দ।
তোমাকে আমি চিনতে পারলুম না কেন?
কারণ সব ভূতই একরকম দেখতে, যেমন সব কাকই একরকম।
তুমি আমাকে চিনলে কী করে?
তোমার ওই কাহিনি শুনে। তোমার ওই চিঠিগুলো আমি সব ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিয়েছিলুম। সব অক্ষর উঠে গেলে কী থাকে বলো তো?
কী?
একটি মণ্ড। কাগজের উপাদান। কাগজ আর কালি, শুরু জীবনের কাহিনি। জীবন হল কলঙ্ক। বেঁচে থাকার কলঙ্ক। মেয়েরা কাগজের মতো জীবন পেতে রাখে আর তোমরা যন্ত্রণা দিয়ে লেখো। এই হল কথা।
মৃত্যুর পরে কী থাকে?
কেন? সম্পর্ক।