একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

আমার নাম শ্রীউপেন্দ্রনাথ ঘোষ৷ নিবাস বীরভূম জেলার টগরা নামক গ্রামে৷ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে আমি বি.এ. পাশ করিয়া চাকরির সন্ধানে প্রবৃত্ত হই৷ কয়েকমাস ধরিয়া বহু স্থানে বহু আবেদন করিলাম কিন্তু কোনোরূপ ফল হইল না৷ অবশেষে সিউড়ি জেলা স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষকের পদ শূন্য হইয়াছে সংবাদ পাইয়া স্বয়ং সদরে গিয়া বহু লোকের খোসামোদ করিয়া উক্ত কর্মে নিযুক্ত হইলাম৷ আমার বেতন হইল মাসিক পঞ্চাশ টাকা৷

আমাদের গ্রাম হইতে সিউড়ি বারো ক্রোশ পথ ব্যবধান৷ বরাবর একটি কাঁচা রাস্তা আছে৷ আমি গ্রামে ফিরিয়া গিয়া নিজের জিনিসপত্র লইয়া আসিয়া দুই দিন পরে নূতন কর্মে প্রবৃত্ত হইলাম৷ যেমন অল্প বেতন, সেইরূপ একটি ছোটখাটো সস্তা বাড়ি খুঁজিতে লাগিলাম৷ কিন্তু পাইলাম না৷ হেড মাস্টার মহাশয়ের বাসাতেই শয়ন ও আহারাদি করি, দিবসে বিদ্যালয়ে কর্ম করি, এবং অবসর সময়ে বাসা খুঁজিয়া বেড়াই৷ অবশেষে শহরের প্রান্তে একটি বৃহৎ খালি পাকা বাড়ির সন্ধান পাইলাম৷ বাড়িটি বহুকাল খালি পড়িয়া আছে৷ স্থানে স্থানে ভগ্ন তথাপি বাসোপযোগী কয়েকখানি ঘর তাহাতে ছিল৷ মাসিক পাঁচ সিকা মাত্র ভাড়া দিলেই বাড়িখানি পাওয়া যায়৷ কিন্তু গুজব এই যে বাড়িটিতে ভূত আছে৷ তখন আমি সদ্য কলেজের ছোকরা—ইয়ংবেঙ্গল—ভূতের ভয়ে যদি পশ্চাৎপদ হই তবে আমার বিদ্যা-মর্যাদা একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া যায়৷ সুতরাং বাড়ি লওয়াই স্থির করিলাম৷ কিন্তু অত-দূরে একাকী থাকা নিরাপদ নহে চোর-ডাকাতের ভয়ও তো আছে—তাই একজন সঙ্গী অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম৷ একজন জুটিয়াও গেলেন, তিনি আমাদেরই স্কুলের চতুর্থ শিক্ষক—নাম রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়৷ যদিও তিনি বি.এ. পাশ করেন নাই, তথাপি কলেজে অধ্যয়ন করিয়াছেন এবং নিজেকে ইয়ংবেঙ্গল শ্রেণীভুক্তই মনে করেন৷ তাঁহার পূর্ব বাসায় কিছু অসুবিধা হইতেছিল, তাই তিনি আমার সহিত যোগদান করিয়া সেই বাড়িটি লইতে প্রস্তুত হইলেন৷ একজন পাচক ব্রাহ্মণ স্থির করা গেল কিন্তু তাহারা রাত্রিকালে সে বাড়িতে থাকিতে অস্বীকৃত হইল, বলিল কাজকর্ম সারিয়া, আমাদিগকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া রাত্রি নয়টার মধ্যেই আপন আপন গৃহে ফিরিয়া যাইবে৷ কি করি, তাহাতেই সম্মত হইতে হইল৷ পরবর্তী রবিবার প্রাতে জিনিসপত্র লইয়া সেই বাড়িতে গিয়া বাসা করিলাম৷

বাড়িটি বহুকালের নির্মিত৷ চারিদিকের প্রাচীর স্থানে স্থানে ভগ্ন, গো-মহিষাদি নিবারণ করিবার জন্য বাঁশের বেড়া বাঁধা আছে৷ বাড়িটির চারিদিকে বাগান৷ অনেকগুলি নারিকেল, আম, কাঁঠাল, জাম প্রভৃতি ফলের গাছ আছে৷ সেগুলি ফড়িয়াগণের নিকট জমা দেওয়া৷ বাড়িটি দ্বিতল৷ নিম্নতলে সম্মুখভাগে বেশ বড় বড় দু’খানি ঘর আছে, সেই ঘর দুটি মাত্র আমরা দখল করিলাম, কারণ আমাদের প্রয়োজন অল্প৷ বাড়ির পশ্চাতে একটি পুষ্করিণী—তাহার জল পানযোগ্য নহে, স্নানযোগ্যও নহে, তবে বাসনমাজা প্রভৃতি গৃহকর্ম তাহাতে হইতে পারিত৷ বাড়ির অল্পদূরে একটি উৎকৃষ্ট দীর্ঘিকা ছিল, আমরা সেইখানে গিয়াই স্নান করিতাম, এবং পান-রন্ধনের জন্য সেই জল আনয়ন করিত৷ একখানি ঘর আহারাদি করিবার জন্য নির্দিষ্ট করিলাম৷ অপরখানিতে দুইটি চৌকি পাতিয়া আমরা দুইজনে শয়ন করিতে লাগিলাম৷ সমস্ত রাত্রি ঘরে প্রদীপ জ্বালা থাকিত৷

এইরূপে কিছুদিন যায়৷ ইতিমধ্যে দশহরার দুইদিন ছুটি হইল, সেইসঙ্গে একটা রবিবারও পাওয়া গেল৷ আমি বাড়ি গেলাম৷

বাড়িতে দুইদিন মাত্র থাকিয়া তৃতীয় দিন পদব্রজে সিউড়ি যাত্রা করিলাম৷ আমাদের গ্রামের এক ক্রোশ পরে হাতছালা বলিয়া একটি গ্রাম আছে৷ পূর্বে এখানে স্থানীয় জমিদারের অনেকগুলি হাতি বাঁধা থাকিত, হাতিশালা হইতে হাতছালা নামটি উৎপন্ন হইয়াছে৷ সেই গ্রামের প্রান্তে সড়কের ধারে একটি মন্দির আছে, সেই মন্দিরে রমাপ্রসন্ন মজুমদার নামক একজন ব্রাহ্মণ সর্বদা বাস করেন এবং আপনার তপজপে নিযুক্ত থাকেন৷ তিনি একজন সিদ্ধপুরুষ বলিয়া বিখ্যাত৷ চতুষ্পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা তাঁহাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করে৷ সেইখান দিয়া যাইতে যাইতে দেখিলাম, মজুমদার মহাশয় খড়ম পায়ে দিয়া মন্দিরের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন৷ দেখিয়া রাস্তা হইতে নামিয়া গিয়া আমি তাঁহাকে প্রণাম করিলাম৷ আশীর্বাদ করিয়া তিনি আমাকে বলিলেন—‘‘বাবা, তুমি কোথা যাইতেছ?’’

আমি উত্তর করিলাম—‘‘সিউড়ি স্কুলে আমার মাস্টারি চাকরি হইয়াছে৷ দশহরার ছুটিতে বাড়ি আসিয়াছিলাম৷ কল্য স্কুল খুলিবে, তাই ফিরিয়া যাইতেছি৷’’

মজুমদার মহাশয় একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন—‘‘বাবা, আজ কি তোমার না গেলেই নয়? আজ বাড়ি ফিরিয়া যাও, কল্য তখন যাইও৷’’

আমি বলিলাম—‘‘কল্য স্কুল খুলিবে৷ আমার নূতন চাকরি, কামাই হওয়াটা বড় খারাপ কথা, সুতরাং আমাকে ও-রূপ আজ্ঞা করিবেন না৷’’

মজুমদার মহাশয় বলিলেন—‘‘তুমি কোথায় বাসা লইয়াছ?’’

—‘‘শহরের দক্ষিণাংশে একটি পুরাতন খালি বাড়ি ছিল, সেইটি ভাড়া লইয়া আমি ও আমাদের স্কুলের অন্য একটি মাস্টার রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় একত্র বাসা করিয়াছি৷’’ —বলিয়া মজুমদার মহাশয়কে প্রণাম করিয়া আমি পথ চলিতে লাগিলাম৷

বেলা আন্দাজ দুইটার সময় সিউড়ি পৌঁছিলাম৷ স্নানাহার করিতে পাঁচটা বাজিয়া গেল৷ আহার করিয়া বারান্দায় বসিয়া তামাক খাইতেছি, এমন সময় দেখি আমাদেরই গ্রামের একজন কৈবর্ত বৃহৎ লাঠি ঘাড়ে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল৷ তাহাকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘‘কি রে! তুই হঠাৎ কোথা থেকে এলি?’’

সে বলিল—‘‘আজ্ঞে, মা ঠাকুরানি এই চিঠি দিয়েছেন এবং এই একটি কবচ আপনার হাতে পারবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন৷’’ বলিয়া চিঠি ও কবচ দিল৷

চিঠি পড়িয়া দেখিলাম, মাতা ঠাকুরানি লিখিতেছেন—‘‘তুমি বাড়ি হইতে যাত্রা করিবার পর রমাপ্রসন্ন মজুমদার মহাশয় আসিয়াছিলেন এবং একটি কবচ দিয়া বলিলেন—‘মা তোমার ছেলে আজ প্রাতে সিউড়ি রওনা হইয়াছে পথে তাহার সঙ্গে দেখা হইল, তাহার জন্য আমি এই রামকবচটি আনিয়াছি, তুমি যেমন করিয়া পার আজই এই কবচটি তোমার ছেলেকে পাঠাইয়া দাও এবং বিশেষ করিয়া লেখ যেন আজই সে এই কবচটি ধারণ করে৷ আর লিখিয়া দাও, যদি কোনোরকম ভয় পায় তবে যেন তারকব্রহ্ম নাম জপ করে৷ এই কবচের গুণে এবং নামের বলে সে সকল বিপদ হইতে মুক্ত হইবে৷ সুতরাং আমি দীনু কৈবর্তকে দিয়া এই চিঠি ও কবচ পাঠাইলাম৷ প্রাপ্তিমাত্রে রামনাম স্মরণ করিয়া তুমি কবচটি ভক্তিপূর্বক দক্ষিণ হস্তে ধারণ করিবে, যেন কোনোমতে অন্যথা না হয়৷ ইহা তোমার মাতৃ-আজ্ঞা জানিবে৷’’

পত্র ও কবচ লইয়া আমি দীনুকে বলিলাম, ‘‘তুই আজ এখানেই থাকবি তো? তোর খাবার জোগাড় করি?’’

সে বলিল, ‘‘আজ্ঞে না, মা ঠাকুরানি বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছেন, ‘তুই নিজে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কবচটি পরাইয়া দিবি এবং আজ রাত্রেই আসিয়া আমাকে সংবাদ দিবি যে, আমার ছেলে কবচ পরিয়াছে’৷’’

সুতরাং তাহাকে থাকিবার জন্য আর অনুরোধ করিলাম না৷ তাহার হাতে দুই আনা পয়সা দিয়া বলিলাম—‘‘এই নে, বাজার হইতে কিছু মুড়ি মুড়কি কিনিয়া পথে খাইতে খাইতে যাইবি৷’’ তাহার সম্মুখে কবচটি আমি হস্তে ধারণ করিলাম৷ সে আমায় প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিল৷

সেদিন রাত্রে আহারাদির পর যথাসময়ে দুইজনে শয়ন করিলাম৷ উভয়ের চৌকির শিয়রে দুইটি বড় বড় জানালা খোলা ছিল৷ আকাশে মেঘ, মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছে৷ আবার মাঝে মাঝে প্রবল বায়ু আসিয়া মেঘকে উড়াইয়া একাদশীর চন্দ্রকে দৃশ্যমান করিতেছে৷ আমরা দু’জনে কিয়ৎক্ষণ গল্পগুজব করিয়া নিস্তব্ধ হইলাম৷ পথশ্রমে কাতর ছিলাম, শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িলাম৷

অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া দেখি বাতাসে প্রদীপটা নিবিয়া গিয়াছে৷ ক্ষীণ মেঘপুঞ্জের অন্তরাল হইতে জ্যোৎস্নালোক জানালাপথে প্রবেশ করিয়া বিপরীত দিকের দেওয়ালের একটা অংশ আলোকিত করিয়াছে৷ ঘুমে জড়িত চক্ষু অল্প খুলিয়া দেখিলাম, যেন একটা কঙ্কালসার বৃদ্ধ আমার শয্যার উপর হাঁটু গাড়িয়া থাবা পাতিয়া বসিয়া আছে এবং একদৃষ্টে আমার প্রতি চাহিয়া রহিয়াছে৷ তাহার মুখখানা যেন বহুদিন রোগে শীর্ণ, গালের চামড়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে, দন্তহীন মাড়ীর উপর তাহার ওষ্ঠদ্বয় চুপসিয়া বসিয়া গিয়াছে৷ মাথায় সাদা ছোট চুলগুলো যেন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে৷ তাহার চক্ষু দু’টা হইতে যেন ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্রূপের জ্বালা বহির্গত হইতেছে৷

দেখিয়া আমি আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিলাম৷ ভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিলাম৷ কিন্তু সে অবস্থায় অধিকক্ষণ থাকিতে পারিলাম না৷ আবার চক্ষু খুলিলাম৷ আবার দেখিলাম সেই বীভৎস মূর্তি ঠিক সেই অবস্থায় বসিয়া আছে৷ আবার চক্ষু মুদ্রিত করিলাম৷ তখন হঠাৎ মাতাঠাকুরানির পত্রের কথা স্মরণ হইল৷ মনে মনে বলিলাম, আমার ভয় কি, আমার হস্তে রক্ষাকবচ রহিয়াছে এবং মৃদুস্বরে তারকব্রহ্ম নাম জপ করিতে লাগিলাম৷ কিয়ৎক্ষণ পরে আবার চক্ষু খুলিলাম, তখন সে মূর্তি আর নাই৷ সাহস পাইয়া উঠিয়া বসিলাম এবং জড়িতকণ্ঠে আমার বন্ধুকে ডাকিতে লাগিলাম৷ রাসবিহারীবাবু উঠিয়া বলিলেন—‘‘কি মহাশয়?’’

আমি তখন প্রদীপ জ্বালিয়া সমস্ত ঘটনা তাঁহাকে প্রকাশ করিয়া বলিলাম৷ তিনি অত্যন্ত ভীত হইলেন৷ সমস্ত রাত্রি আমরা গল্প করিয়াই কাটাইয়া দিলাম৷ পরদিন প্রভাতে সে গৃহ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করিলাম৷

আহারাদি করিয়া সাড়ে দশটার সময় স্কুলে গেলাম৷ টিফিনের সময় ডাকওয়ালা পিওন একখানি পত্র দিল৷ দেখিলাম সেখানি রমাপ্রসন্ন মজুমদার মহাশয় লিখিয়াছেন৷ চিঠির তারিখ ও ছাপ গতকল্যকার৷ চিঠিখানিতে লেখা আছে :

শ্রীশ্রীদুর্গাশরণং
পরমশুভাশীর্বাদাঃ সন্তু বিশেষঃ

বাবাজীবন গতকল্য তোমার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমি তোমাদের বাটীতে গিয়াছিলাম এবং তোমার মাতাঠাকুরানিকে তোমার নিমিত্ত একটি রামকবচ দিয়া আসিয়াছি৷ তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছি যে অদ্যই তিনি সেটি যে কোনো উপায়ে যেন তোমাকে পাঠাইয়া দেন যাহাতে অদ্যই নিশাগমের পূর্বে কবচটি তুমি ধারণ করিতে পার৷ বোধ হয় অদ্য রাত্রে তুমি কোনোরূপ ভয় পাইবে কিন্তু সেই রামকবচটির গুণে তোমার কোনো বিপদ হইবে না৷ কবচটি তুমি নিয়ত ধারণ করিয়া থাকিবে এবং আর যদি কখনো ভয়ের কারণ ঘটে তবে তারকব্রহ্ম নাম জপ করিবে৷ সর্বদা শুদ্ধাচারে থাকিবে৷ অত্র কুশল৷ মা ভবানী তোমার মঙ্গল করুন৷

ইতি নিয়ত আশীর্বাদক
শ্রীরমাপ্রসন্ন দেবশর্মা

পত্রখানি পড়িয়া আমার বিস্ময়ের অবধি রহিল না৷ সেখানি রাসবিহারীবাবুকে দেখাইলাম, তিনিও খুব আশ্চর্য হইলেন৷

পূজার ছুটির সময় বাড়ি গিয়া প্রথমেই মজুমদার মহাশয়কে প্রণাম করিতে গেলাম৷ যে বিপদ হইতে আমাকে তিনি উদ্ধার করিয়াছেন, তাহার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—‘‘আচ্ছা আমি যে সেই রাত্রে ভয় পাইব একথা আপনি কি করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন?’’

একটু মৃদু হাস্য করিয়া মজুমদার মহাশয় বলিলেন—‘‘তুমি যখন সেদিন আসিয়া আমাকে প্রণাম করিলে, তখনি আমি দেখিলাম একটি প্রেতাত্মা তোমার পশ্চাতে বেড়াইতেছে৷ কোনো কারণে সে তোমার উপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়াছে এবং তোমার প্রাণহানি করিবার মানসেই তোমার সঙ্গ লইয়াছে৷ কেবল উপযুক্ত ক্ষণ পায় নাই বলিয়া সে পর্যন্ত কৃতকার্য হইতে পারে নাই৷ তুমি চলিয়া গেলে আমি গণনা করিয়া দেখিলাম যে, সেই রাত্রেই ক্ষণ উপস্থিত হইবে তাই তাড়াতাড়ি একটি রামকবচ লিখিয়া তোমার মাতাঠাকুরানিকে দিয়া আসিয়াছিলাম৷ যাহা হউক কবচটি তুমি কখনো পরিত্যাগ করিও না৷’’

আমি বলিলাম—‘‘মজুমদার মহাশয়, আমার সঙ্গে যে লোকটি সেই ঘরে শয়ন করিতেন, তিনি কোনোরূপ ভয় দেখিলেন না কেন? আমরা উভয়েই একত্র সেই বাড়িতে ছিলাম, তবে আমার উপরেই ভূতের এত আক্রোশ কেন?’’

মজুমদার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন—‘‘সে লোকটির নাম কি?’’

—‘‘তাহার নাম রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়৷’’

—‘‘তিনি ব্রাহ্মণ, এই কারণে ভূত সহসা তাঁহার কিছু করিতে পারে নাই৷ তুমি কায়স্থ, তোমার প্রাণহানি করা তাহার পক্ষে সহজ হইত৷’’

এই কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ আমি নীরবে চিন্তা করিতে লাগিলাম৷ পরে বলিলাম—‘‘সে ভূত কি এখনো আমার অনিষ্ট চেষ্টা করিতেছে?’’

—‘‘করিতেছে৷ আর একবার সে তোমায় দেখা দিবে কিন্তু সে ক্ষণ কতদিনে উপস্থিত হইবে তাহা আমি এখন বলিতে পারি না৷ কিন্তু এই রামকবচের বলে তোমার কোনো বিপদ হইবে না৷’’

তাহার পর অষ্টাদশ বৎসর কাটিয়া গেল৷ সে ভূতের কথা আমি প্রায় বিস্মৃত হইলাম৷ কিন্তু রামকবচটি বরাবর সযত্নে ধারণ করিয়া ছিলাম৷ আমি ক্রমে দ্বিতীয় শিক্ষক হইতে প্রধান শিক্ষকের পদে উন্নীত হইলাম৷ পরে আরো কয়েক বৎসর সুখ্যাতির সহিত কর্ম করিয়া প্রেসিডেন্সী বিভাগের ডেপুটি ইনসপেক্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম৷ আমার বেতন দেড়শত টাকা হইল৷ মফঃস্বলে নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া আমাকে বিদ্যালয় পরিদর্শন করিতে হইত৷ এক দিন মেদিনীপুর জেলার একটি গ্রাম্য স্কুল পরিদর্শন করিতে যাইতেছি৷ সন্ধ্যার পর আহারাদি করিয়া, একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া, সেই গ্রামাভিমুখে রওয়ানা হইলাম৷ শরৎকালের পরিষ্কার রাত্রি৷ আকাশে চাঁদ ছিল৷ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা রাস্তা দিয়া গাড়ি মন্থর গমনে চলিয়াছে৷ আমি প্রথম শুইয়া একটু ঘুমাইবার চেষ্টা করিলাম৷ ঘণ্টা দুই এ-পাশ ও-পাশ করিয়া যখন কিছুতেই ঘুম হইল না, তখন চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলাম৷ দেখিলাম গাড়োয়ান তাহার বসিবার সেই সংকীর্ণ স্থানটুকুতে কোনো প্রকারে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে৷ জ্যোৎস্না রাত্রি—পরিষ্কার পথ পাইয়াছে—গরু দুইটি অবাধে আপন মনে চলিয়াছে৷ রাস্তার দুই ধারে বৃক্ষের শ্রেণী, কোথাও দূরে দূরে, কোথাও বা ঘন-সন্নিবদ্ধ৷ ঝুর ঝুর করিয়া বাতাস দিতেছে৷ গাড়োয়ান আরামে নিদ্রা যাইতেছে দেখিয়া গরিবকে জাগাইতে আমার ইচ্ছা হইল না৷ অথচ গরু দুইটা অরক্ষিত অবস্থায় পথ চলে তাহাও নিরাপদ নহে৷ এই বিবেচনা করিয়া আমি আর শুইলাম না বসিয়া রহিলাম৷

এই অবস্থায় প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিল৷ আমার একটু তন্দ্রা আসিতে লাগিল৷ আমি বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে লাগিলাম৷ হঠাৎ গরু দুইয়া থামিয়া গেল, একটা ঝাঁকুনি দিয়া গাড়িখানা দাঁড়াইয়া পড়িল৷ আমার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল৷

চক্ষু খুলিয়া দেখি, সেই ভীষণ মূর্তি৷ গরু দুইটার সম্মুখে পথ অবরোধ করিয়া গাড়ির জোয়ালের উপর দুইটা জীর্ণ হস্ত রাখিয়া, সেই শুষ্ক চর্মাবৃত কঙ্কাল দাঁড়াইয়া আছে এবং সেই জ্বলন্ত চক্ষু দুইটা হইতে আমার প্রতি ক্রোধানল বর্ষণ করিতেছে৷ দেখিয়া আমার শরীরের রক্ত হিম হইয়া গেল৷ আমি কাঁপিতে লাগিলাম৷ বুকের কাছে হাত রাখিয়া তারকব্রহ্ম নাম জপ করিতে লাগিলাম৷ কিছুক্ষণ জপ করিতে করিতে দেখিলাম সে মূর্তি ছায়ার ন্যায় মিলাইয়া যাইতেছে৷ যখন সে একবারে অদৃশ্য হইয়া গেল, গরু দুইটা তখন গাড়ি পশ্চাতে ঘুরাইয়া দিয়া, মহাবেগে ছুটিতে লাগিল৷

ঝাঁকানিতে গাড়োয়ানের ঘুম ভাঙিয়া গেল৷ সে ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বলিল— ‘‘বাবু, এ কি? গরু এমন করিয়া ছুটিতেছে কেন?’’

আমি আসল কথা তাহাকে না বলিয়া কেবলমাত্র বলিলাম—‘‘হয়তো পথে কোনো ভয় দেখিয়াছে তাই ছুটিয়া বাড়ি যাইতেছে?’’

গাড়োয়ান তখন গাড়ি থামাইবার এবং মুখ ঘুরাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল, গরু দুইটির লাঙ্গুল টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল, কিন্তু কিছুতেই তাহারা দাঁড়াইল না৷ দৌড়িতে দৌড়িতে অবশেষে যখন একটি গ্রামের বাজারে উপনীত হইল এবং সেখানে অনেক লোকজন ও অন্যান্য গরুর গাড়ি দেখিতে পাইল, তখন দাঁড়াইল৷ গরু দুইটি ভয়ানক শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল দেখিয়া আমি গাড়োয়ানকে বলিলাম—‘‘থাক, আজ আর কাজ নাই, গরুকে খুলিয়া দাও, উহাদের মুখে ঘাস জল দাও, কল্য প্রভাতে তখন আবার যাওয়া যাইবে৷ অদ্য রাত্রে এইখানেই বিশ্রাম করি৷

তাহার পর আরো সাত বৎসর কাটিয়াছে—কিন্তু আর কখনো কোনোরূপ ভয় পাই নাই৷ সে রামকবচটি এখনো ধারণ করিয়া আছি এবং যতদিন বাঁচিব ধারণ করিয়া থাকিব, আমার মাতৃদেবীর এবং মজুমদার মহাশয়ের লিখিত সেই পত্র দুইখানি অদ্যাপি আমার নিকট আছে, যদি কেহ দেখিতে ইচ্ছা করেন তো দেখাইতে পারি৷

শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের নিকট আমি যেমন শুনিয়াছি, উপরে অবিকল স্বহস্তে তাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছি৷

—শ্রীইন্দুভূষণ সেন৷

উপরের লিখিত ঘটনাগুলি আমি যেমন বলিয়াছি ইন্দুবাবু তাহা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন এবং ঐ ঘটনাগুলি আমার প্রত্যক্ষীভূত ও অবিকল সত্য৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *