একটি ভয়ঙ্কর অভিযানের গল্প
চৈত্র মাসের সন্ধ্যা।
সারা দিন অসহ্য গরম গিয়েছে, এখন একটু বাতাস ছেড়েছে। গরম কমেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কে জানে হয়তোবা বৃষ্টিও নামবে। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। এখন হওয়া উচিত।
মশাদের জন্যে এর চেয়ে আনন্দজনক আবহাওয়া আর হতে পারে না। অল্প-স্বল্প বৃষ্টি হবে। খানাখন্দে খানিকটা পানি জমবে। সেই পানিতে ডিম পাড়া হবে। ডিম থেকে তৈরি হবে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা। পিন পিন করে গান গাইতে গাইতে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
এ-রকম এক সন্ধ্যায় এক মা-মশা তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছে ডাকলেন। তাঁর তিন মেয়ে এক ছেলে। মেয়েদের নাম যথাক্রমে–পিঁ, পিঁপিঁ এবং পিঁপিঁপিঁ। ছেলেটার নাম টে।
মা-মশা বললেন, আদরের সোনামণিরা, তোমরা লাইন বেঁধে আমার সামনে দাঁড়াও। তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।
পিঁ বলল, মা এখন তো আমরা খেলছি। এখন কোনো কথা শুনতে পারব না।
মা-মশা বিরক্ত গলায় বললেন, বেয়াদবি করবে না মা। বড়রা যখন কিছু বলেন তখন শুনতে হয়। সবাই আস।
মশার ছেলেমেয়েরা মাকে ঘিরে দাঁড়াল। শুধু পিঁর মন একটু খারাপ। খেলা ছেড়ে উঠে আসতে তার ভালো লাগে না। সে যখন খেলতে বসে তখনই শুধু মার জরুরি কথা মনে হয় কেন কে জানে।
মা-মশা বললেন, আমার সোনামণিরা, আজ তোমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। আজ তোমাদের নিয়ে আমি এক অভিযানে বের হব।
টে বলল, কী অভিযান মা?
রক্ত খাবার অভিযান। আজ আমরা মানুষের রক্ত খেতে যাব। কী করে রক্ত খেতে হয় শেখাব।
টে আনন্দে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, মা, আমি কিন্তু সবার আগে রক্ত খাব।
মা-মশা বিরক্ত মুখে বললেন, বোকার মতো কথা বলবে না টে। তুমি হলে ছেলে-মশা। ছেলে-মশারা কখনো রক্ত খায় না। মেয়ে-মশারা খায়। তোমার বোনরা রক্ত খাবে— তুমি তাদের সাহায্য করবে।
টে মুখ কালো করে বলল, ওরা সবাই খা্বে। আর আমি বুঝি বসে বসে দেখব। আমি রক্ত খেলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। মেয়ে-মশাদের পেটে ডিম আসে। সেই ডিমের পুষ্টির জন্যে মানুষের রক্ত দরকার। ছেলেদের পেটে তো আর ডিম আসে না ওদের সেই জন্যেই রক্ত খেতে হয় না।
টে রাগী গলায় বলল, আমার পেটে ডিম আসুক আর না আসুক, আমি খাবই।
খাবে কীভাবে? রক্ত খাবার জন্যে যে শুঁড় দরকার–সেটাই তো ছেলে মশাদের নেই। .
টে বলল, আমি যদি নাই খেতে পারলাম— তাহলে শুধু শুধু তোমাদের সঙ্গে কেন যাব?
আমাদের সাহায্য করার জন্যে যাবে। মানুষের রক্ত খাওয়া তো কোনো সহজ ব্যাপার না। কঠিন ব্যাপার। ভয়ঙ্কর কঠিন।
মশা-মার সবচেয়ে ছোট মেয়ে পিঁপিঁপিঁ একটু বোকা ধরনের। সে অবাক হয়ে বলল, রক্ত খাওয়া কঠিন কেন হবে মা? আমরা যাব, চুমুক দিয়ে ভরপেট রক্ত খেয়ে চলে আসব।
মা, তুমি সব সময় বোকার মতো কথা বলো। তুমি বড় হচ্ছ কিন্তু তোমার বুদ্ধি বড় হচ্ছে না। এটা খুব দুঃখের কথা! তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয় মানুষরা বাটিতে করে তোমার জন্যে রক্ত সাজিয়ে রেখেছে। ব্যাপার মোটেই তা না। মানুষের রক্ত খাওয়া ভয়ঙ্কর কঠিন ব্যাপার। জীবন হাতে নিয়ে যেতে হয়।
জীবন হাতে নিয়ে যেতে হবে কেন মা?
তোমরা তাদের রক্ত খাবে আর তারা তোমাদের ছেড়ে দেবে? কক্ষনো না। মানুষের বুদ্ধি তো সহজ বুদ্ধি না, জটিল বুদ্ধি।
টে বলল, মা, ওদের বুদ্ধি কি আমাদের চেয়েও বেশি?
না রে বাবা। আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধি কী করে হবে? ওরা যেমন মোটা। ওদের বুদ্ধিও মোটা। আমরা যেমন সরু আমাদের বুদ্ধিও সরু। আমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ওরা যা করে তা দেখে হাসি পায়।
কী করে মা?
দরজা-জানালায় নেট লাগায়। শক্ত তারের নেট। কিন্তু ওরা জানে না যে যখন দরজা খোলা হয় তখন আমরা হুড় হুড় করে ঢুকে পড়ি। তা ছাড়া নেটের ফুটা দিয়েও সহজে ঢোকা যায়। পাখা গুটিয়ে টুপ কক্ষে ঢুকে যেতে হয়। তোদের শিখিয়ে দেব। ওটা কোনো ব্যাপারই না।
মেজ মেয়ে পিঁপিঁ বলল, ওরা আর কি বোকামি করে না?
ওদের কাজকর্মের সবটাই বোকামিতে ভরা। মশারি বলে ওরা একটা জিনিস খাটায় জালের মতো। ছোট ছোট ফুটা। ওদের ধারণা সেই ফুটা দিয়ে আমরা ঢুকতে পারব না। হি হি হি
আমরা কি ঢুকতে পারি?
অবশ্যই পারি। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমরা করি কি, কয়েক জন মিলে ফুটা বড় করে ভেতরে ঢুকি। রক্তটক্ত খেয়ে ঐ ফুটা দিয়ে বের হয়ে চলে আসি। ওরা ভাবে, আমাদের হাত থেকে খুব বাঁচা বেঁচেছে।
আসলে বাঁচতে পারে না, তাই না মা?
হুঁ। এখন তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও আমার সঙ্গে যাবে এবং মানুষদের কামড়ানোর সাধারণ নিয়মকানুন শিখবে।
এটার আবার নিয়মকানুন কী?
কঠিন কঠিন নিয়ম আছে সোনামণিরা। নিয়ম না মানলে অবধারিত মৃত্যু। তোমাদের বাবা তো নিয়ম না মানার জন্যেই মারা গেল। শুনবে সেই গল্প?
পিঁ বলল, না শুনব না। বাবার মৃত্যুর গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। মন খারাপ হবে।
মন খারাপ হলেও তোমাদের শোনা দরকার। এর মধ্যে শেখার ব্যাপারও আছে। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখময় ঘটনা থেকেই শিক্ষা নেয়া যায়।
ঠিক আছে মা বলো আমরা শুনছি।
তোমাদের তখনও জন্ম হয়নি। আমার সবেমাত্র তোমাদের বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তোমাদের বাবা আমাকে বলল–চলো মানুষের রক্ত খাবে। আমার যেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু তার উৎসাহ দেখে গেলাম। তোমাদের বাবা বলল–তুমি নির্ভয়ে রক্ত খাবে, আর আমি লোকটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখব। সে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তোমাকে দেখতেই পাবে না। আমি তোমাদের বাবার কথামতো একটা মানুষের রক্ত খেতে শুরু করেছি। তোমাদের বাবা তাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তার চোখের সামনে খুব নাচানাচি করছে। একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে যায়। মাঝে মাঝে কানের কাছে গিয়ে গান গায়—
তিন তিন তিন
পিন পিন পিন।
বাহ্ বাবার তো খুব সাহস!
হ্যাঁ তার সাহস ছিল। কিন্তু এইসব হলো বোকামি সাহস। বাহাদুরি দেখানোর সাহস। মশাদের যেসব নিয়মকানুন আছে তামধ্যে প্রথম নিয়ম হলো–বাহাদুরি করবে না। বাহাদুরি করেছ কি মরেছ।
দ্বিতীয় নিয়ম— লোভী হয়ো না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। সাধু-সন্ন্যাসীর মতো নির্লোভ হতে হবে।
কীভাবে হব মা?
রক্ত যখন খাওয়া শুরু করবে তখন লোভীর মতো খাবে না। যতটুকু তোমার প্রয়োজন তার চেয়ে এক বিন্দুও বেশি খাবে না। বেশি খেয়েছ কি মরেছ। শরীর ভারি হয়ে যাবে। উড়তে পারবে না। রক্ত খেয়ে ঐ জায়গাতেই বসে থাকতে হবে। তখন যার রক্ত খেয়েছ সে চড় দিয়ে মেরে ফেলবে।
পিঁপিঁ আঁতকে উঠে বলল, কী ভয়ঙ্কর!
মা-মশা বললেন, এই ব্যাপারটা সবাইকে প্রথমেই শেখানো হয়। তারপরেও অনেকের মনে থাকে না। লোভীর মতো রক্ত খেতে শুরু করে। ফল হলো মৃত্যু।
সবচেয়ে ছোট মেয়ে পিঁপিঁপিঁ বলল, আমি কখনো লোভীর মতো রক্ত খাব। অল্প একটু খেয়েই উড়ে চলে আসব। শুধু ঠোট ভেজাব।
সবাই এই কথা বলে কিন্তু কাজের সময় আর কারোর কিছু মনে থাকে না।
রক্ত খেতে কি খুব মজা মা?
অসম্ভব মজা। একবার খাওয়া শুরু করলে ইচ্ছা করে খেতেই থাকি, খেতেই থাকি, খেতেই থাকি।
মা, আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছে।
চল যাওয়া যাক। শুধু একটা কথা তোমরা মনে রাখবে— আমরা কিন্তু বেড়াতে যাচ্ছি না, আমরা যাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর অভিযানে। আমাদের যেতে হবে খুব সাবধানে।
মা-মশা তার চার পুত্র-কন্যা নিয়ে এলিফ্যান্ট পার্ক এপার্টমেন্টের আট তলায় শীলাদের বাসায় এসে উপস্থিত হলো। শীলারা তিন বোন তখন টিভি দেখছে। তাদের ছোট ভাইটা খাটে ঘুমুচ্ছে। শীলার বাবা চেয়ারে বসে কী যেন, লিখছেন। শীলার মা ছোট বাবুর পাশে বসে গল্পের বই পড়ছেন।
পি ফিসফিস করে বলল, মা, আমরা কাকে কামড়াব? বড় মেয়েটাকে কামড়াব মা? ও দেখতে সবচেয়ে সুন্দর।
মা-মশা বললেন, প্রথমেই কামড়াবার কথা ভাববে না। প্রথমে পরিস্থিতি দেখে অবস্থা বিবেচনা করবে।
পরিস্থিতি কীভাবে দেখব? ওদের কাছ থেকে ঘুরে আসব?
অসম্ভব। ওদের কাছে গিয়ে ভনভন করলেই ওরা সজাগ হয়ে যাবে। ওরা বুঝবে যে ঘরে মশা আছে। বলা যায় না মশার ওষুধও দিয়ে বসতে পারে। ওদের কিছুতেই জানতে দেয়া যাবে না যে আমরা আছি।।
পিঁ বলল, আমি কাকে কামড়াব তা তো তুমি এখনো বললে না। তিন বোনের কোন বোনটাকে কামড়াব?
ওদের কাউকেই কামড়ানো যাবে না। দেখছ না–ওরা জেগে আছে, টিভি দেখছে? টিভির প্রোগ্রামও বাজে। কেউ মন দিয়ে দেখছে না। ওদের কামড়ালেই ওরা টের পেয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো ঘুমন্ত কাউকে কামড়ানো।
বড় মেয়ে বলল, মা, ওদের ছোট ভাইটা ঘুমুচ্ছে। ওকে কামড় দিয়ে আসি?
মা-মশা গম্ভীর গলায় বললেন, ভুলেও এই কাজ করবে না। বাচ্চার মা পাশে বসে আছে— বাচ্ছাকে কামড়ালেই মা টের পাবে। মায়েরা কিভাবে কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। একটা কথা খেয়াল রেখো, মা পাশে থাকলে ছোট শিশুর গায়ে কখনো বসবে না।
মাকে কামড়ে আসি মা?
হ্যাঁ, তা পারা যায়। মা বই পড়ছেন–খুব মন দিয়ে পড়ছেন। তাঁর এক হাতে বই, কাজেই এই হাতটা আটকা আছে। অন্য হাতটা খালি। এমন জায়গায় বসতে হবে যেন খালি হাত সেখানে পৌঁছতে না পারে। আমাদের আদরের বড় মেয়ে পিঁ তুমি যাও–ঐ মার রক্ত খেয়ে আস। খুব সাবধান। লোভী হবে না। মনে থাকবে?
মনে থাকবে মা।
কোথায় বসবে বলে ঠিক করেছ?
তার বাঁ হাতে।
ভালো, খুব ভালো চিন্তা। শীলার মার ডান হাতে বই ধরা আছে। এই হাতে সে তোমাকে মারতে পারবে না। বাঁ হাত দিয়ে তো আর বাঁ হাতের মশা মারতে পারবে না। আমার ধারণা, কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই তুমি রক্ত খেয়ে চলে আসতে পারবে। যাও মা…
বড় মেয়ে পিঁ উড়ে গেল এবং রক্ত খেয়ে চলে এলো। শীলার মা কিছু বুঝতেও পারলেন না। একসময় শুধু বিরক্ত হয়ে হাত ঝাঁকালেন।
মা-মশা বললেন, আমার বুদ্ধিমতী বড় মেয়ে কী সুন্দর রক্ত খেয়ে চলে এসেছে! কিছু বুঝতেও পারেনি। এবার মেজ মেয়ের পালা…
মা-মশা কথা শেষ করবার আগেই পিঁপিঁ উড়ে গেল। তার আর তর সইছিল। সে শীলার মাকে দুবার চক্কর দিয়ে বসল তাঁর ঘাড়ে। এবার শীলার মা টের পেলেন। মশা মারার জন্যে বাঁ হাত উঁচু করলেন— মশা এমন জায়গায় বসেছে যে বাঁ হাত সেখানে পৌঁছে না। কাজেই মেজ মেয়ে পিঁপিঁও নির্বিঘ্নে রক্ত খেয়ে চলে এলো।
মা-মশা বললেন, তোমার কাজেও আমি খুশি, তবে তুমি দুটা চক্কর দিলে কেন? এটা উচিত হয়নি। শুধু গায়ে বসলেই যে মানুষ মশা মারে তা না— আশপাশে উড়তে দেখলেও মেরে ফেলে। তুমি বাহাদুরি করতে গিয়েছ। বাহাদুরি করাও নিষেধ। ভবিষ্যতে আরো সাবধান হবে। এবার সবচেয়ে ছোটজনের পালা…
বলতে না বলতেই পিঁপিঁপিঁ উড়তে শুরু করল। মা-মশা চিৎকার করে ডাকলেন, ফিরে এসো, ফিরে এসো।
পিঁপিঁপিঁ ফিরে এলো। মা-মশা বললেন, তুমিও কি ঐ শীলার মাকে কামড়াতে যাচ্ছিলে?
হ্যাঁ।
এত বড় বোকামি কি করতে আছে? এর আগে দুজন তার রক্ত খেয়ে গেছে। এখন সে অনেক সাবধানী। তার কাছে যাওয়াই ঠিক হবে না।
তাহলে কি শীলার বাবার রক্ত খাব মা?
হ্যাঁ, তা খাওয়া যেতে পারে। উনি গভীর মনোযোগে লেখালেখি করছেন। তার গা থেকে এক চুমুক রক্ত খেলে উনি বুঝতেও পারবেন না।
উনি কী লিখছেন মা?
মনে হয় গল্প লিখছেন।
সুন্দর গল্প?
সুন্দর গল্প না পচা গল্প তা তো জানি না–এখন মা, তুমি মন দিয়ে শোনো আমি কী বলছি–তুমি উনার হাতে বসবে। বসেই রোমকূপ খুঁজে বের করবে। যেখানে-সেখানে সুচ ফুটিয়ে দেবে না। সুচ ভেঙে যেতে পারে। সুচ ভাঙলে তীব্র ব্যথা হয়। মনে থাকবে?
হ্যাঁ মা, মনে থাকবে।
মানুষের শরীরে দুধরনের রক্ত আছে— শিরার রক্ত। এই রক্ত কালো, স্বাদ নেই। আর হলো ধমনির পরিষ্কার ঝকঝকে রক্ত। খুব স্বাদ। ধমনির রক্ত খাবে। মনে থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
লোভীর মত রক্ত খাবে না। মনে রাখবে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
মা, আমার মনে থাকবে।
তুমি তো একটু বোকা— এইজন্যেই তোমাকে নিয়ে আমার ভয়।
মা, একটুও ভয় পেও না। দেখ না আমি যাব আর চলে আসব। মা যাই?
মা-মশা চিন্তিত মুখে বললেন, আচ্ছা যাও।
পিঁপিঁপিঁ শীলার বাবার হাতে বসেছে। রোমকূপ খুঁজে বের করে তার শূড় নামিয়ে দিয়েছে। শূড় বেয়ে রক্ত উঠে আসছে। পিঁপিঁপিঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল— কী মিষ্টি রক্ত! কী মিষ্টি! মনে হচ্ছে, আহ, সারাজীবন ধরে যদি এই রক্ত খাওয়া যেত! সে খেয়েই যাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তার পেট বেলুনের মতো ফুলছে… তার কোনোই খেয়াল নেই।
মা-মশা চিৎকার করে কাঁদছেন— বোকা মেয়ে, তুই কী সর্বনাশ করছিস! তুই উঠে আয়। এখনো সময় আছে। এখানে হয়তো কষ্ট করে উড়তে পারবি…
পিঁপিঁপিঁ মার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে রক্ত খেয়েই যাচ্ছে। পিঁপিঁপিঁর দুই বোন এখন কাঁদছে, আর ভাইও কাঁদছে।
মা-মশা ফোঁপাতে বললেন, ও রে বোকা মেয়ে, শীলার বাবা তো এক্ষুনি তোকে দেখবে। পিষে মেরে ফেলবে–তুই উড়ে পালিয়েও যেতে পারবি না। তোকে এত করে শিখিয়ে দিলাম, তারপরেও তুই এত বড় বোকামি কী করে করলি…!
মা-মশার কথা শেষ হবার আগেই শীলার বাবা মশাটাকে দেখলেন–রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। ঝিম মেরে হাতের ওপর বসে আছে। তিনি মশাটাকে তার লেখার কাগজের ওপর ঝেড়ে ফেললেন। মশাটা অনেক কষ্টে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক বার উড়ার চেষ্টা করল। পারল না। শীলার বাবা বললেন, আমার মামণিরা কোথায়? মজা দেখে যাও।
মজা দেখার জন্যে তিন মেয়েই ছুটে এলো। দেখ, এই দেখ। মশাটাকে দেখ, রক্ত খেয়ে কেমন হয়েছে। উড়তে পারছে না।
শীলা বলল, এর মধ্যে মজার কী আছে বাবা? তুমি কী যে পাগলের মতো বলো! মশাটাকে মেরে ফেল।
মেরে ফেলব?
অবশ্যই মেরে ফেলবে। সে তোমার রক্ত খেয়েছে, তুমি তাকে ছেড়ে দেবে কেন? তোমার হয়ে আমি মেরে দেই?
না না, মারিস না। মারিস না— থাক না।
মারব না কেন?
তুচ্ছ একটা প্রাণী শুধু শুধু মেরে কী হবে?
তোমার রক্ত খেয়েছে তো!
বেচারার খাবারই হচ্ছে রক্ত। না খেয়ে করবে কী? আমরা হাঁস-মুরগি এইসব মেরে মেরে খাচ্ছি না? আমাদের যদি কোনো দোষ না হয় ওদেরও দোষ হবে না।
পিঁপিঁপিঁ খানিকটা শক্তি ফিরে পেয়েছে অনেকবারের চেষ্টায় সে একটু উড়তে পারল। খানিকটা উড়ল— ওমনি তাকে সাহায্যের জন্যে তার মা, ভাই ও দুই বোন ছুটে এল। তারা তাকে ধরে ধরে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পিঁপিঁপিঁ বলল, মা, আমারা যে চলে যাচ্ছি ঐ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাম না তো। উনি ইচ্ছা করলে আমাকে মেরেও ফেলতে পারতেন কিন্তু মারেননি।
উনাকে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই মা। উনি আমাদের ধন্যবাদ বুঝবেন না। তা ছাড়া যারা বড় তারা কখনো ধন্যবাদ পাবার আশায় কিছু করে না।
মা, তবু আমি উনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
তুমি তো উড়তেই পারছ না। ধন্যবাদ কী করে দেবে?
আমি এখন উড়তে পারব। আমি পারব।
পিঁপিঁপিঁ শীলার বাবার চারদিকে একটা চক্কর দিয়ে বিনীত গলায় বলল–আমি অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র একটি পতঙ্গ। আপনি আমার প্রতি যে মমতা দেখিয়েছেন তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। আমার কোনোই ক্ষমতা নেই। তারপরও যদি কখনো আপনার জন্যে কিছু করতে পারি আমি করব। পিঁপিঁপিঁর মা, ভাই এবং বোনরা একটু দূরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে উড়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। তার চোখ বারবার পানিতে ভিজে যাচ্ছে। কিছু-কিছু মানুষ এত ভালো হয় কেন এই ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।